প্ৰথম খণ্ড (অবাক বাংলাদেশ : রহস্যঘেরা প্রহেলিকাচ্ছন্ন হেঁয়ালি )
দ্বিতীয় খণ্ড - রাষ্ট্রের মূলনীতিসমূহ : পথের শেষ কোথায়?
তৃতীয় খণ্ড - রাষ্ট্র পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ : লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে
চতুর্থ খণ্ড - নির্বাচন : আমার ভোট আমি দেব
পঞ্চম খণ্ড - রাজনৈতিক সংস্কৃতি : কান্ডারি হুঁশিয়ার
ষষ্ঠ খণ্ড - উত্তরণের সন্ধান : কোথায় চলেছি?

৯. আমলাতন্ত্র : গ্রেশাম বিধির মতো ব্যামো

৯. আমলাতন্ত্র : গ্রেশাম বিধির মতো ব্যামো

৯.১ আমলাতন্ত্র ও গ্রেশাম বিধির মতো ব্যামো

আমলাতন্ত্র নিয়ে বিতর্কের শুরু কমপক্ষে আড়াই হাজার বছর আগে। এ বিতর্ক শুরু হয়েছিল চীনে। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস আমলাতন্ত্রকে ধ্রুবতারার সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং বলেছেন, এ তারকা স্থির এবং সব তারকাই এর নির্দেশে চলে। আরেক চীনা পয়গম্বর লাওজু কনফুসিয়াসের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতেন। কনফুসিয়াস মনে করতেন যে আমলাদের জ্ঞানের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে জনগণ সমৃদ্ধ হবে। লাওজু বলতেন, যারা জ্ঞানের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চায়, তারা জনগণের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।

আমলাতন্ত্র নিয়ে এ বিতর্ক এখনো চলছে। প্রাচীনকালে আমলাদের যোগ্যতার প্রধান মাপকাঠি ছিল রাজার প্রতি আনুগত্য। আধুনিক আমলাতন্ত্রে আমলাদের শক্তি হলো তাঁদের পেশাগত দক্ষতা। আধুনিক আমলাতন্ত্রের ধারণার প্রধান প্রবক্তা হলেন জার্মান দার্শনিক ম্যাক্স ওয়েবার। তাঁর মতে, আমলাতন্ত্র হচ্ছে অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে স্থায়িত্বে অনুপুঙ্খবোধ সম্পন্ন ও নির্ভরশীলতার দিক থেকে অনেক শ্রেয়। আজকের তাত্ত্বিকদের অনেকেই ম্যাক্স ওয়েবারের সঙ্গে একমত নন। ডেভিড অজবর্ন ও টেড গেবলার লিখেছেন, ম্যাক্স ওয়েবারের আমলাতান্ত্রিক আদল একটি কম পরিবর্তনশীল সমাজের জন্য গড়ে উঠেছিল, যেখানে পরিবর্তন আসত আস্তে আস্তে। এ ধারণা গড়ে উঠেছিল সোপানতান্ত্রিক (Hierarchical) সমাজে, যেখানে পিরামিডের চূড়ায় যিনি থাকতেন, শুধু তাঁর কাছেই সব তথ্য জানা ছিল। অজবর্ন ও গ্যাবলার তাই বলছেন, বর্তমান যুগে আমলাতন্ত্র অচল। আমলাতন্ত্র সেসব মানুষের জন্য উপযুক্ত, যেখানে মানুষ হাত দিয়ে কাজ করে। তাঁদের মতে, যে সমাজের শক্তি উৎপাদনশীলতা, যা মানসিক ক্রীড়াকাণ্ড থেকে উদ্ভূত, সে সমাজের জন্য আমলাতন্ত্র উপযুক্ত নয়।

আজ তাই পৃথিবীতে অনেক ধরনের সরকারকাঠামো গড়ে উঠেছে। অজবন ও গ্যাবলার তাঁদের Reinventing the Government: How the Entrepreneurship Spirit is Transforming the Public Sector ১০ ধরনের সরকারের উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে :

১. অনুঘটক সরকার (Catalytic Government).

২. সম্প্রদায়ের মালিকানাধীন সরকার (Community Owned Government).

৩. প্রতিযোগিতামূলক সরকার (Competitive Government).

৪. সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত সরকার (Mission Driven Government).

৫. ফলাফলকেন্দ্রিক সরকার (Result Oriented Government).

৬. খরিদ্দার পরিচালিত সরকার (Customer Driven Government).

৭. উদ্যোগী সরকার (Enterprising Government).

৮. পরিবর্তনপ্রত্যাশী সরকার (Anticipatory Government).

৯. বিকেন্দ্রীকৃত সরকার (Decentralized Government).

১০. বাজার পরিচালিত সরকার (Market – Oriented Government),

এই তালিকার বাইরে সোপানতান্ত্রিক সরকার, গণতান্ত্রিক সরকার, একনায়কতান্ত্রিক সরকারের মতো বিভিন্ন চিরাচরিত সরকারি ব্যবস্থা রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সব ধরনের সরকারই বিশেষ পরিবেশে ভালোভাবে কাজ করে, কিন্তু কোনো সরকারই সব পরিবেশের জন্য সর্বোত্তম নয়। তাই দেশে এমন পরিবেশ চাই, যেখানে শুধু এক ধরনের সরকার থাকবে না এবং প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন ধরনের সরকার একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে কাজ করবে।

পৃথিবীর সব দেশেই প্রশাসনকে যুগোপযোগী করার জন্য নিয়মিত সংস্কার চলছে এবং নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হচ্ছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হলো বাংলাদেশ। এখানে কোনো উল্লেখযোগ্য সংস্কার হচ্ছে না, বরং অনেক বাতিল হয়ে যাওয়া ধারণার বিকৃত প্রয়োগের ওপর শাসনব্যবস্থা চলছে। পৃথিবীর কোনো দেশেই শাসনব্যবস্থা নিখুঁত নয়। কিন্তু বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ।

বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করা হবে। এই প্রবন্ধটি পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত। বাংলাদেশে আধুনিক অর্থে আমলাতন্ত্র প্রবর্তন করেছিল ব্রিটিশ সরকার। এর আগে আমলাতন্ত্রের ভিত্তি ছিল রাজার প্রতি আনুগত্য। যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগের ধারণা প্রবর্তন করে ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রকে পুরোপুরি আধুনিকায়ন করেনি। যে-কারণে এখানে আধুনিক আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এ ধরনের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যার জন্য বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। প্রবন্ধটির দ্বিতীয় খণ্ডে এই বিশ্লেষণ দেখা যাবে। তৃতীয় খণ্ডে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের মূল সমস্যাসমূহ চিহ্নিত হয়েছে। চতুর্থ খণ্ডে বাংলাদেশের রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পঞ্চম খণ্ডে আমলাতন্ত্রের সংস্কারের লক্ষ্যে একটি দিকনির্দেশনা উপস্থাপন করা হয়েছে।

৯.২ বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক বিকাশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র আদৌ নতুন নয়। ২০০০ বছরের বেশি আগে মৌর্য সাম্রাজ্যে আমলাতন্ত্র ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-এ এর বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। এই আমলাতন্ত্রের দুটি বিশেষত্ব লক্ষণীয়। প্রথমত, এই আমলাতন্ত্র ছিল সোপানতান্ত্রিক। আমলাতান্ত্রিক পিরামিডের চূড়ায় থাকতেন একজন কর্মকর্তা, যাঁকে রাজা বিশ্বাস করতেন। এই কর্মকর্তার বেতন ছিল অনেক বেশি ও ক্ষমতা ও ছিল প্রচুর। নিচের দিকে অনেক কর্মকর্তা ছিলেন, যাঁদের বেতন দেওয়া হতো কম এবং তাঁদের ক্ষমতাও ছিল সীমিত। সব ক্ষমতা ছিল উচ্চ বেতনভুক্ত কর্মচারীদের হাতে। নিচের দিকের কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, তাই সেখানে কম বেতন দিলে

সরকারের অনেক কম খরচ পড়ত। এর ফলে যে বেতন-ব্যবস্থা চালু করা হয়, সেখানে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ পদের আধিকারিকদের মধ্যে তফাত ছিল অনেক বড়। সারণি-৯.১-এ অর্থশাস্ত্র-এ বর্ণিত বেতনসমূহের একটি তালিকা দেখা যাবে।

এই সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রশাসন মূলত অবিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। যাঁরা নিচের দিকের কর্মচারী ছিলেন, তাঁদের বিশ্বাস করা হতো না এবং তাঁদের বেতনও কম দেওয়া হতো। এখানে সর্বোচ্চ বেতন সর্বনিম্ন বেতনের ৮০০ গুণ ছিল। যাঁকে বেশি বেতন দেওয়া হতো, তাঁকেই বিশ্বাস করা হতো। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের বেতন অদক্ষ শ্রমিকের বেতনের চেয়ে ১৩৩ গুণ বেশি ছিল। এই ব্যবস্থাতে ব্যাপক দুর্নীতি দেখা দেয়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-এ প্রশাসনের ব্যাপক দুর্নীতির বর্ণনা রয়েছে। কৌটিল্য সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতিকে দুভাগে বিভক্ত করেছেন : ১. সরকারকে ফাঁকি দেওয়া এবং ২. জনসাধারণের অর্থ তছরুপ করা। কৌটিল্য সরকারি অর্থ আত্মসাতের ৪৮টি পন্থা উল্লেখ করেছেন এবং প্রতিটি অপরাধের জন্য আলাদা শাস্তি নির্ধারণ করেছেন।

মুসলমান শাসনামলেও এই ব্যবস্থাই অটুট থাকে। প্রথমত, এখানে সোপানতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনধারীদের মধ্যে তফাত সারণি-৯.২-এ দেখা যাবে।

সারণি-৯.১
মৌর্য সাম্রাজ্যের বেতনকাঠামো

মৌর্য সাম্রাজ্যের বেতনকাঠামো

নিট বেতনের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন বেতনের ফারাক ছিল ৪৭৫ গুণ। নিচের দিকের কর্মচারীরা যে বেতন পেতেন, তাতে তাঁদের ঘুষ খাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। ঐতিহাসিক এম আতাহার আলী মোগল যুগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি সম্বন্ধে লিখেছেন :

The nobles expected presents in return for doing everything, even for acts done under imperial orders or in accordance with specified duties of their posts.[২]

ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর দলিল থেকে দেখা যাচ্ছে, মোগল যুগে উচ্চ পদের কর্মচারীরাও উৎকোচ গ্রহণ করতেন। আঞ্চলিক সাহিত্যে নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের দুর্নীতির বর্ণনা পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ মুকুন্দরামের লেখায় দুর্নীতির বর্ণনা রয়েছে। তিনি লিখেছেন,

‘সরকার হইলা কাল
খিল জমি লিখে নাল
বিনা উপকারে খায় ধুতি’

সারণি-৯.২
মোগল সাম্রাজ্যে সেনাবাহিনীতে বেতনকাঠামো

মোগল সাম্রাজ্যে সেনাবাহিনীতে বেতনকাঠামো

অর্থাৎ রাজস্ব কর্মকর্তা ঘুষ খেয়েও কাজ করছেন না। ব্রিটিশরা এ দেশে আসার পর প্রশাসনে পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু ব্রিটিশদের মূল লক্ষ্য সুশাসন ছিল না, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল কোম্পানির জন্য মুনাফা সৃষ্টি করা। তাই তারাও প্রশাসনের ব্যয় কমানোতে আগ্রহী ছিল। নিচের দিকের কর্মকর্তাদের অপ্রতুল বেতন দিলে সরকারের ব্যয় অনেক কমে যায়। সুতরাং বেতনের ক্ষেত্রে মৌর্য যুগ বা মোগল যুগের যে প্রথা ছিল, ব্রিটিশরাও সে ধরনের ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। সারণি-৯.৩-এ ইস্ট ইন্ডিয়া শাসনকালে ভারতে বিভিন্ন পদে বেতনের তফাত দেখা যাবে।

সারণি-৯.৩
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে বেতনকাঠামো

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে বেতনকাঠামো

এ সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, একজন ব্রিটিশ জজ একজন দেশি কনস্টেবলের চেয়ে ৬২৫ গুণ বেতন বেশি পেতেন। দারোগাদের বেতন ছিল ইউরোপিয়ান জজদের বেতনের ১০০ ভাগের এক ভাগ। এর ফলে ব্রিটিশ শাসনামলে নিচের পর্যায়ে দুর্নীতি কমেনি। তবে ওপরের পর্যায়ে দুর্নীতি কমে যায়। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ আইসিএস অফিসার হ্যাচ বার্নওয়েল লিখেছেন :

The third grade, for example, comprised Sub-Inspectors of Police and the Office Clerks and the fourth grade police constables, peons and orderlies. Here a sharp distinction was drawn between outright bribery and ‘dasturi’ or customary practices. It was tacitly understood that any person making a complaint at a police station would have to pay two rupees for the benefit of the staff thereof, this being the custom… In the same way, the office clerk expected a small tip to speed the progress of any petition or application, the amins (junior surveyors) a payment of one rupee for each holding surveyed and the orderlies, a tip from any respectable person visiting the DM or SDO. The rates of these tips were prescribed by custom.[৩]

ব্রিটিশ প্রশাসনে নিচের পর্যায়ে ব্যাপক দুর্নীতি থাকলেও ওপরের পর্যায়ে দুর্নীতি ছিল না। এর একটি কারণ হলো, ব্রিটিশ সরকার এ দেশে ওপরের পর্যায়ে আধুনিক আমলাতন্ত্রের প্রবর্তন করে কিন্তু নিচের পর্যায়ে এ দেশের চিরাচরিত আমলাতন্ত্রটি বহাল রাখে। ব্রিটিশ শাসনামলে উচ্চ পর্যায়ে প্রধানত ব্রিটিশদের নিয়োগ দেওয়া হতো। প্রথম দিকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়োগ হতো না, তবু যেসব ব্যক্তিকে মনোনয়নের ভিত্তিতে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে গ্রহণ করা হয়, তাঁদের বেশির ভাগই অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। পরবর্তীকালে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ব্রিটিশ ও পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়দের চাকরি দেওয়া হয়। তাঁরা একদিকে অত্যন্ত যোগ্য ছিলেন, অন্যদিকে তাঁদের বেতনের হার ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। শুধু ভারতের তুলনায় নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায়ও এই বেতনের হার ছিল অত্যন্ত লোভনীয়।[৪]

ব্রিটিশ শাসন এ দেশে সর্বত্র একটি আধুনিক আমলাতন্ত্র সৃষ্টি করেনি। তারা ওপরের দিকে আধুনিক আমলাতন্ত্র প্রবর্তন করেছে আর নিচের দিকে এ দেশের চিরাচরিত আমলাতন্ত্র বজায় রেখেছে। এর ফলে এখানে আধুনিক অর্থে আমলাতন্ত্র গড়ে উঠতে পারেনি। এটা যে শুধু ভারতেই হয়েছে তা নয়, পৃথিবীর বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশে আধুনিক আমলাতন্ত্রের অনুকরণ করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিকারে আধুনিক আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র আর পশ্চিমা দেশগুলোর আমলাতন্ত্রের মধ্যে কোনো তফাত নেই। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর আমলাতন্ত্র পশ্চিমা আমলাতন্ত্রের সমরূপ অনুকরণ (isomorphic mimicry)। আমরা আগেই বলেছি (সপ্তম অধ্যায়ে), এই সমরূপ অনুকরণের ধারণা বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞান থেকে নেওয়া হয়েছে। জীববিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, অনেক সময় কোনো কোনো প্রাণী তাদের আত্মরক্ষার জন্য তাদের চেয়ে দুর্ধর্ষ প্রাণীকে অনুকরণ করে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো কোনো মাছি মৌমাছির মতো আকার ধারণ করে। যদিও মৌমাছির মতো কোনো বিষাক্ত উপাদান এদের দেহে নেই। কোথাও কোথাও বিষ নেই, এ ধরনের সাপ নীল রঙের আকার ধারণ করে, যাতে মনে হয় এদের মধ্যে বিষ রয়েছে এবং আক্রমণকারীরা ভয়ে পিছিয়ে যায়। সমরূপ অনুকরণের এই ধারণাটিকে প্রশাসনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে DeMaggio এবং Powell লিখেছেন :

Isometric mimicry is an organizational strategy in which organizations attempt to gain legitimacy by appearing to be like other organizations with legitimacy in the organization domain.[৫]

ভারতে আধুনিক আমলাতন্ত্র প্রবর্তনের জন্য দুটি পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। প্রথম পরিবর্তন হলো, সব ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যথোপযুক্ত বেতন প্রদান। কিন্তু নিচের দিকের বেতন বাড়ালে সরকারের ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। এ দেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে একটি বাণিজ্যিক কোম্পানি। এদের মূল লক্ষ্য ছিল কোম্পানির জন্য সর্বোচ্চ হারে মুনাফা অর্জন। তাই তারা নিম্ন পর্যায়ে বেতন বাড়ানো থেকে বিরত থাকে। দ্বিতীয়ত, দেশের প্রশাসন তখন নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের অবিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা শুধু স্বল্পসংখ্যক বিশ্বাসভাজন কর্মকর্তাদের দেওয়া হতো। দেশে আধুনিক অর্থে আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রশাসনকে অবিশ্বাসের বদলে বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হতো। এর অর্থ হলো, সর্বনিম্ন পর্যায়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করা। ব্রিটিশদের পক্ষে মূল কাঠামো পরিবর্তন ছাড়া এ সংস্কার সম্ভব ছিল না। ব্রিটিশরা আধুনিক আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য শুধু উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের এবং তাদের উচ্চ হারে বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করে। কাজেই ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশে যে আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তা আধুনিক আমলাতন্ত্র নয়, তা ছিল আধুনিক ও ভারতের চিরাচরিত আমলাতন্ত্রের এক সংমিশ্রণ। ব্রিটিশ শাসনের অবসানে পাকিস্তানে আমলাতন্ত্রের দুটি সমস্যা দেখা দেয়। প্রথম সমস্যা হলো ভারত বিভক্তির ফলে প্রশাসনে যে শূন্যতা দেখা দেয়, তা পূরণ করা। আর দ্বিতীয় সমস্যা হলো আধুনিক আমলাতন্ত্র প্রবর্তন করে দেশে ঔপনিবেশিক শাসনকে ঢেলে সাজানো। পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়কেরা প্রথম সমস্যাটিতেই নজর দেন এবং দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাটিকে এড়িয়ে যান।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে ব্রিটিশ শাসনের আদলে প্রশাসন গড়ে তোলা হয়। কোনো পরিবর্তন ছাড়াই আইসিএস ব্যবস্থাকে সিএসপি ব্যবস্থা হিসেবে প্রবর্তন করা হয়। অথচ বিশ্বে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অভ্যুদয়ের ফলে পাকিস্তানেও অনেক নতুন বিশেষজ্ঞ আমলার প্রয়োজন পড়ে। আইসিএস ব্যবস্থায় ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা ছিল সংকুচিত। অথচ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে প্রশাসনের মৌল কাঠামো পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পাকিস্তানে প্রশাসনিক সংস্কারের নামে যা ঘটেছে, সেটা হলো দেশে সর্বোচ্চ পদের জন্য বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে লড়াই। এই লড়াইয়ে একদিকে ছিলেন আইসিএসের উত্তরসূরি সিএসপিরা, যাঁরা ছিলেন শুধুই প্রশাসনে অভিজ্ঞ। আরেক দিকে ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা, যাঁদের মধ্যে অনেক বিশেষজ্ঞও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তবে তাঁদের সবাই বিশেষজ্ঞ ছিলেন না, তাঁদের মধ্যে অনেক ক্যাডারভুক্ত সাধারণ প্রশাসকও ছিলেন। পাকিস্তানে এই দ্বন্দ্বের নিরসন করা সম্ভব হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস টিকে ছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান তুলে দেওয়া হয় এবং একীভূত সিভিল সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর ফলে পুরোনো অনেক সার্ভিস বিলুপ্ত হয় এবং নতুন অনেক সার্ভিস প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮০ সালে ২৮টি ক্যাডার প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ১৯৮৯ সালে সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ পদসমূহ পরিচালনার জন্য ২৮টি ক্যাডার থেকে সংগৃহীত যোগ্যতম কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সিনিয়র সার্ভিসেস পুল গঠিত হয়। আমলাতন্ত্রের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত সিনিয়র সার্ভিসেস পুল ভেঙে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিস পুনর্গঠনের পক্ষে প্রধান যুক্তি ছিল, দেশে সব ক্যাডারের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা। এই ব্যবস্থায় তাই সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ পদগুলোতে নির্বাচনের একমাত্র মাপকাঠি হওয়া উচিত ছিল পদের জন্য যোগ্যতা। কোন ক্যাডারের সদস্য, সেটা বিবেচনার বিষয় হওয়া উচিত ছিল না। কিন্তু পাকিস্তান আমলে সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠতম পদগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ সিএসপিদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এ ব্যাপারে অন্যান্য ক্যাডারের বক্তব্য ছিল, এই সংরক্ষণের ফলে তাদের যোগ্যতম কর্মকর্তাদেরও পদোন্নতি সম্ভব হচ্ছে না, আর তাই এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে দেওয়া উচিত। বাংলাদেশে বর্তমানে যে পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, তাতে উপসচিবের ৭৫ শতাংশ পদ এবং যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিবের ৭০ শতাংশ পদ সিএসপিদের উত্তরসূরি বিসিএস অ্যাডমিন ক্যাডারের সদস্যদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। শুধু সচিব পদে কোনো কোটা নেই। পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে উপসচিব পদে বিসিএস ক্যাডারে ৭৫ শতাংশ সংরক্ষণকে বিধিসম্মত ঘোষণা করা হয়েছে। তবে যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে সংরক্ষণ তুলে দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে, উপসচিব পদের কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতা অনুসারে এসব পদে পদোন্নতি দিতে হবে। এর ফলে বর্তমানে আইনত বিসিএস অ্যাডমিন ক্যাডারের সদস্যরা পাকিস্তানের সিএসপিদের চেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। বাস্তবে এ পরিস্থিতি আরও করুণ। ২০১৩ সালের এক সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, ৮৭ শতাংশ সচিব, ৮২ শতাংশ অতিরিক্ত ও যুগ্ম সচিব এবং ৮৩ শতাংশ উপসচিব বিসিএস অ্যাডমিন ক্যাডারের সদস্য।[৬] সংস্কার করে বাংলাদেশে অন্যান্য ক্যাডারের জন্য সমান সুযোগ দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেছে।

বাংলাদেশে সংস্কারের পক্ষে আরেকটি বড় যুক্তি ছিল, প্রশাসনে বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের সীমিত ভূমিকা। সুতরাং দেশে এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেখানে বিশেষজ্ঞরা তাঁদের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারবেন। অথচ বাংলাদেশে বর্তমানে যে প্রশাসনব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, সেখানে বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা আগের তুলনায় অনেক হ্রাস পেয়েছে। সরকারি পদে প্ৰধানত দুভাবে নিয়োগ দেওয়া হয় : (১) ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগ এবং (২) যোগ্যতাভিত্তিক পদে নিয়োগ। ক্যাডার সার্ভিসে যোগ্যতার ওপর জোর দেওয়া হয় না। জোর দেওয়া হয় ব্যক্তিত্বের ওপরে। একজন ব্যক্তি যদি যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও নেতৃত্বের গুণাবলির অধিকারী হন, তাহলে তাঁর পক্ষে যেকোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা সম্ভব। পক্ষান্তরে পদভিত্তিক নিয়োগে জোর দেওয়া হয় ব্যক্তির অর্জিত বিশেষ জ্ঞানের ওপর, যাতে ওই ব্যক্তি নিয়োগের পরই তাঁর দায়িত্ব পালন করতে পারেন। প্রশাসনে বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা প্রসারিত করতে হলে নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতার ওপর জোর দেওয়া উচিত। বাংলাদেশে ক্যাডারভিত্তিক নিয়োগের ফলে যোগ্যতার ওপর গুরুত্ব কমে যায়। এর ফলে নিম্নতম যোগ্যতাধারীরা সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞ পদের দাবিদার হয়ে দাঁড়ান। তাতে অনেক ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। দু-একটি উদাহরণ বিবেচনা করলে এই বক্তব্য স্পষ্ট হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে অর্থনৈতিক উপদেষ্টার একটি অনুবিভাগ রয়েছে। এই দপ্তরটি সারা বছর অর্থনীতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে এবং বাজেট পেশ করার সময় জাতীয় সংসদে জাতীয় অর্থনীতি সম্পর্কে একটি বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করে। দীর্ঘদিন ধরে এই প্রতিষ্ঠানটিতে অর্থনীতিবিদেরা নিযুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশে বিসিএস (পরিকল্পনা) নামে একটি ক্যাডার গঠন করা হয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা দপ্তরের সব পদ ওই ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কাজ ব্যাপক। যদিও বেশির ভাগ পদেই অর্থনীতির জ্ঞানের প্রয়োজন, তবু সেখানে প্রকৌশল, সমাজবিজ্ঞান, স্থাপত্য ইত্যাদি অনেক বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তির প্রয়োজন। বিসিএস পরিকল্পনা ক্যাডারে তাই শিক্ষাগত যোগ্যতা শুধু অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়, অনেক বিষয় এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই ক্যাডার প্রতিষ্ঠা করার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদ এই ক্যাডারের একটি জ্যেষ্ঠ পদে পরিণত হয়। যেহেতু ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিচের পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে কর্মকর্তার পদোন্নতি দিতে হয়, সেহেতু এই পদে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৌশলী, সমাজতত্ত্ববিদ বা এ ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদেরও পদোন্নতি দিতে হয়। অনুরূপ পরিস্থিতি পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগেও দেখা যায়। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগে বিভাগীয় প্রধান হওয়া উচিত একজন অর্থনীতিবিদের, অথচ দেখা যাচ্ছে যে অর্থনীতিতে আদৌ কোনো আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই, এমন ব্যক্তিরাই এমন পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন। এ ধরনের পরিস্থিতি সব বিশেষজ্ঞ ক্যাডারেই দেখা যাচ্ছে। ব্রিটিশ আমলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ পদসমূহ শূন্য হলে এই পদে যোগদানে ইচ্ছুক প্রার্থীদের কাছ থেকে দরখাস্ত চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে যোগ্যতম প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হতো। এখন এ সমস্ত নিয়োগ ক্যাডার সদস্যদের মধ্য থেকে দেওয়া হয়। যার ফলে যোগ্যতম প্রার্থী নন, জ্যেষ্ঠতম প্রার্থী পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। এ ধরনের পদে ক্যাডারভিত্তিক নিয়োগ কখনো কাঙ্ক্ষিত সুফল দিতে পারে না।

বাংলাদেশে বর্তমানে যে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু আছে, সে ব্যবস্থা ব্রিটিশ আমলে যে ব্যবস্থা ছিল, তার চেয়েও দুর্বল। এ ব্যবস্থায় বিশেষজ্ঞদের জ্যেষ্ঠ পদগুলো বিশেষ জ্ঞানের ভিত্তিতে নয়, ক্যাডারের জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পূরণ করা হয়ে থাকে।

৯.৩ বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের মূল সমস্যাসমূহ

বাংলাদেশের প্রশাসনের আদলই শুধু ত্রুটিপূর্ণ নয়, এখানে প্রশাসনে যে সমস্ত নিয়ম অনুসরণ করা হয়, তা প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভেঙে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয় :

ক. নিয়োগ

সরকারি চাকরিতে যথোপযুক্ত ব্যক্তির নিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একবার কাউকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হলে তাঁকে বাদ দেওয়া অত্যন্ত কঠিন। এখানে যেসব সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তার মধ্যে নিচের অভিযোগগুলো বিশেষ বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। ১. নিয়োগে দুর্নীতি : ২০০৬ সালে The State of Governance in Bangladesh 2006 বইয়ে সরকারে নিয়োগ সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘A review of the literature and the media highlights the presence of corruption and the inclusion of political considerations in the recruitment system.’[৭] বিশেষ করে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। এ প্রসঙ্গে টিআইবি বাংলাদেশ সংগৃহীত উপাত্তসমূহ সারণি-৯.৪-এ দেখা যাবে।

সারণি-৯.৪
সারণি-৯.৫

এ ধরনের ব্যাপক দুর্নীতি সম্ভব হয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের দুর্বলতার ফলে। অভিযোগ করা হচ্ছে, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য এবং চেয়ারম্যানকে দলীয় বিবেচনায় মনোনয়ন দেওয়া হয়। এর ফলে নিয়োগ- প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নষ্ট হয়ে গেছে।

খ. অনুপযুক্ত পরীক্ষাব্যবস্থা

বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা-ব্যবস্থা একটি ভ্রান্ত ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ ধারণাটি হলো যে বিসিএসে সব ক্যাডার সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং সবাইকে একই পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ করতে হবে। এ ধারণা ভুল এবং এ ধারণার ফলে যে গণপরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তাতে ২ লাখের বেশি প্রার্থী উপস্থিত হয়। এত প্রার্থীর একই সঙ্গে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। কিন্তু তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এক পরীক্ষার মাধ্যমে যে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাতে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের পরীক্ষা সম্ভব হয় না। সারণি-৯.৫-এ বিসিএস পরীক্ষায় বিশেষজ্ঞ ক্যাডার ও অবিশেষজ্ঞ ক্যাডারের পরীক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমের তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেখা যাবে।

পৃথিবীর আর কোনো দেশে বিশেষজ্ঞ নিয়োগে এ ধরনের পরীক্ষা নেওয়া হয় কি না, সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। চিকিৎসক, কৃষিবিদ ও বিজ্ঞানীর মতো বিশেষজ্ঞদের নির্বাচনে তাঁদের বিশেষ বিষয়ের ওপর জ্ঞানের জন্য রাখা হয়েছে ২০০ নম্বর। আর বাংলা, ইংরেজি, বাংলাদেশ বিষয়াবলি ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদির মতো বিষয়সমূহে নম্বর রাখা হয়েছে ৬০০। অর্থাৎ যেসব বিশেষজ্ঞ বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞানে ভালো, তাঁরা তাঁদের বিশেষ বিষয় সম্পর্কে কম জানলেও নির্বাচিত হতে পারবেন। সাধারণ পদের জন্য যে পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটাও অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। এ ধরনের পাঠ্যক্রমের ভিত্তিতে একবিংশ শতাব্দীতে কোনো উন্নত দেশেই নিয়োগ দেওয়া হয় না। অঙ্ক, প্রাত্যহিক বিজ্ঞান এবং অনেক ক্ষেত্রে বাংলা ও ইংরেজিতে এসএসসি পর্যায়ের প্রশ্ন করা হয়।

গ. কোটা পদ্ধতি

বাংলাদেশে শুধু পরীক্ষার ফল ভালো করলেই চাকরি পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে অধিকাংশ পদে কোটার ভিত্তিতে চাকরি দেওয়া হয়। সারণি-৯.৬-এ বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত কোটার বিতরণ দেখা যাবে।

বাংলাদেশে বর্তমানে একটি অত্যন্ত জটিল কোটা পদ্ধতি চালু রয়েছে। প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মোট কোটা হলো ২৫৭টি (প্রতিবন্ধীদের কোটাসহ ২৫৮)। এত কোটার মধ্যে পদ বিতরণ একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। কোটা ব্যবস্থার ফলে বাংলাদেশের নিয়োগপদ্ধতি অস্বচ্ছ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ জেলা কোটা সব অঞ্চলের নিয়োগে বৈষম্য দূর করতে পারেনি। বর্তমানে যে পদ্ধতি চালু আছে, তাতে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করা কোনো দিনই সম্ভব হবে না। মুক্তিযোদ্ধা কোটা রয়েছে, অথচ বর্তমানে যথেষ্ট মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী নেই। তাই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তবে সংবিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে এই সুবিধা সবাইকে দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে না, শুধু যাঁরা দুস্থ মুক্তিযোদ্ধার পরিবার,

তাঁদের ক্ষেত্রে কোটা দেওয়া যেতে পারে। সুতরাং আস্তে আস্তে এই কোটা হ্রাস করে বিলুপ্ত করতে হবে।

সারণি-৯.৬
বাংলাদেশে কোটা পদ্ধতি

বাংলাদেশে কোটা পদ্ধতি

ঘ. কর্মসম্পাদন মূল্যায়নে ব্যর্থতা

বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তাদের বার্ষিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা চালু আছে। তবে যে ব্যবস্থা বর্তমানে প্রচলিত, এর ভিত্তিতে সঠিক মূল্যায়ন আদৌ সম্ভব নয়। মূল্যায়নের জন্য যে ফর্ম ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে কাজে সাফল্য ও ব্যর্থতার চেয়ে ব্যক্তিগত গুণাবলির ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। ঔপনিবেশিক আমলে সরকারি কর্মচারীদের আনুগত্যের ওপর সবচেয়ে জোর দেওয়া হতো। সুতরাং সেই মূল্যায়নে আনুগত্য-সংক্রান্ত গুণাবলির জন্য বেশি নম্বর দেওয়া হতো। স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের মূল্যায়ন হওয়া উচিত তাঁদের কাজের ভিত্তিতে। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে মূল্যায়নের জন্য যে ফর্ম ব্যবহার করা হয়, তার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করলে একজন অনুগত ও বশংবদ কর্মকর্তা ১০০ মধ্যে ৯৪ নম্বর পেতে পারেন। এর কারণ হলো, কর্মের পরিমাণের ওপর মোট নম্বর হলো ৪ আর কাজের মানের ওপর নম্বর হলো ৪। প্রচলিত নিয়মে কাউকে ১-এর কম নম্বর দেওয়া যায় না। সুতরাং কাজের পরিমাণ ও কাজের মানে ২ নম্বর পেলেও একজন কর্মকর্তার পক্ষে ৯৪ নম্বর পাওয়া সম্ভব। সারণি-৯.৬ থেকে দেখা যাবে, বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা সবাই কর্মসম্পাদন মূল্যায়নে অনেক বেশি নম্বর পেয়ে থাকেন।[৯] ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে ১১৬ জন উপসচিবের প্রাপ্ত নম্বরের বিশ্লেষণ সারণি-৯.৭-এ দেখা যাবে।

সারণি-৯.৭
১১৬ জন কর্মকর্তার মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বর, ১৯৯৬-২০০১

১১৬ জন কর্মকর্তার মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বর, ১৯৯৬-২০০১

সারণি- -৯.৭-এ দেখা যাচ্ছে, মাত্র ২.৬ শতাংশ কর্মকর্তা তাঁদের মূল্যায়নে ৮০ নম্বরের কম পেয়ে থাকেন। ৫৫.৩ শতাংশ কর্মকর্তা ৯০ শতাংশের বেশি নম্বর পান। এ ধরনের মূল্যায়নে ভালো এবং খারাপ কর্মকর্তাদের মধ্যে তফাত নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। এর ফলে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কাজের মান ও পরিমাণের কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে না।

ঙ. অপরিকল্পিত নিয়োগ

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে অপরিকল্পিতভাবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। কখনো কখনো কোনো ক্যাডারে অতিরিক্ত-সংখ্যক কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, আবার কখনো কখনো কোনো নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে নিয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ-ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সারণি-৯.৮-এ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের প্রবণতা দেখা যাবে।

সারণি-৯.৮
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ, ১৯৭২-২০১৩

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ, ১৯৭২-২০১৩
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ, ১৯৭২-২০১৩

ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, কোনো একটি বছরে সব ক্যাডারে ৫২২৪ জন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আবার অন্য একটি বছরে নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যা ১৬৮০ জনে নেমে এসেছে। আকস্মিকভাবে নিয়োগের সংখ্যা বাড়লে শুধু প্রশিক্ষণেরই সমস্যা দেখা যায় না, পরবর্তীকালে পদোন্নতিতেও সমস্যা দেখা দিয়েছে।

চ. ক্যাডার সার্ভিসের উপযোগিতা

বাংলাদেশের ক্যাডার সার্ভিসের সংখ্যা অনেক বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে বিশেষজ্ঞদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। অন্যদিকে অনেক ক্যাডার সৃষ্টি করা হয়েছে, যেগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই এবং সব ক্যাডারকে সমানভাবে গণ্য করার কোনো সুযোগও এখানে নেই। অনেক ক্ষেত্রে সরকারের কার্যপদ্ধতি পরিবর্তিত হচ্ছে এবং তার ফলে কোনো কোনো ক্যাডার একেবারে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। যেমন ধরা যাক, বিসিএস টেলিফোন ক্যাডার। যখন এই ক্যাডার করা হয়, তখন টেলিফোন একটি সরকারি বিভাগ ছিল। এখন টেলিফোন একটি স্বশাসিত বাণিজ্যিক সংস্থা, এখানে সরকারি ক্যাডারের কোনো যৌক্তিকতা নেই। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানির ওপর নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়াতে বিসিএস ট্রেডকে একটি আলাদা ক্যাডার হিসেবে সৃষ্টি করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। অর্থাৎ, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে ক্যাডার ব্যবস্থা পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

৯.৪ রাজনীতি ও প্রশাসন

তত্ত্ব অনুসারে আধুনিক আমলাতন্ত্রের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা। আমলাতন্ত্রের কাজ হলো, যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করা। ম্যাক্স ওয়েবার তাই লিখেছেন :

The honour of the civil servant is vested in his ability to execute conscientiously the order of superior authorities, without this moral discipline and self-denial, in the highest sense, and otherwise the whole apparatus would fall to pieces.

বাস্তবে রাজনীতি এবং প্রশাসনের মধ্যে এই প্রভেদ টিকিয়ে রাখা অত্যন্ত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিবিদেরা অনুগত কর্মকর্তা-কর্মচারী চান। এর কারণ, তাঁরা প্রশাসনযন্ত্রকে তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চান। অন্যদিকে অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পদোন্নতি ও অন্যান্য সুবিধার মোহে রাজনৈতিক দলের সমর্থক হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় দলীয় রাজনীতি প্রশাসনকে সংক্রমিত করে। অবশ্য অনেকে বলে থাকেন, প্রশাসনে রাজনৈতিকীকরণ গণতন্ত্রের জন্য বড় সমস্যা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সব উচ্চপদে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক বিবেচনায় মনোনয়ন দিয়ে থাকেন কিন্তু এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এই যুক্তির বেশ কয়েকটি দুর্বলতা রয়েছে।

• মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সব পদে রাজনৈতিক নিয়োগ দেওয়া হয় না। বৃহৎ আমলাতন্ত্রে অতি ক্ষুদ্রসংখ্যক পদে রাজনৈতিক নিয়োগ দেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল সরকারের আমলাতন্ত্রে ২০ লাখ লোক নিয়োজিত আছেন। এর মধ্যে মাত্র ৩ থেকে ৪ হাজার পদে রাজনৈতিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এই পদগুলোর অর্ধেক পদ, অর্থাৎ ১৫০০ থেকে ২০০০ পদ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার এবং বাকি ১৫০০ থেকে ২০০০ পদ নিম্ন পর্যায়ের সমর্থনদানকারী কর্মকর্তার (পিএস, কম্পিউটার অপারেটর ইত্যাদি)। [১১]

• এ কথা সত্য নয় যে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় সব উচ্চপদে নিয়োগ দেওয়া হয়। যে ১৫০০ থেকে ২০০০ পদ উচ্চ পর্যায়ের, তার অর্ধেক থেকে দুই-তৃতীয়াংশ পদে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর সিনেটের অনুমোদন লাগে। সিনেট ওই প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে রাষ্ট্রপতির সুপারিশ গ্রহণ করতে পারে, অথবা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। এমন অনেক উদাহরণ প্রতিটি প্রশাসনেই রয়েছে যে রাষ্ট্রপতির মনোনীত প্রার্থী সিনেটের অনুমোদন পান না। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে নতুন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিতে হয়। পক্ষান্তরে দেখা যায়, এই ধরনের পদে প্রেসিডেন্ট যাঁদের নিয়োগ দেন, সে ধরনের যোগ্য কর্মকর্তা প্রশাসনে খুব বেশি নেই। প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এবং বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত উচ্চপদের কর্মকর্তারা দায়িত্বশীল সরকারি চাকরিতে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চান। তাঁরা দুই-তিন বছরের জন্য এই সব পদে যোগ দেন। এ ধরনের যোগ্য কর্মকর্তারা আমলাতন্ত্রের নিচু পদে যোগ দিয়ে পদোন্নতির জন্য বছরের পর বছর প্রতীক্ষা করতে রাজি নন। কাজেই এই ধরনের রাজনৈতিক মনোনয়ন-পদ্ধতির ফলে অনেক যোগ্য কর্মকর্তা প্রশাসনে আকৃষ্ট হন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক মনোনয়ন-পদ্ধতি মার্কিন প্রশাসনের দুর্বলতা নয়, বরং সবলতা।

• ফেডারেল সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নির্বাচনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নন। সুতরাং তাঁদের পক্ষে নির্বাচন প্রভাবিত করা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে প্রশাসনে যে রাজনৈতিকীকরণ চলছে, তার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নিয়োগের তুলনাও ঠিক নয়। মার্কিন সংবিধান অনুসারে বিভিন্ন উচ্চপদে নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে। বাংলাদেশে এই ক্ষমতা অত্যন্ত সংকুচিত। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে পেশাদার আমলাদের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত। অথচ বাংলাদেশে এই পেশাদার আমলাতন্ত্রকে কার্যত রাজনৈতিকীকরণ করা হচ্ছে, যা মোটেও বিধিসম্মত নয়। বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের রাজনৈতিকীকরণের জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা হয় :

• রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ

• রাজনৈতিক বিবেচনায় দায়িত্বশীল পদে পদায়ন

• রাজনৈতিক বিবেচনায় দ্রুত পদোন্নতি প্রদান

• রাজনৈতিক বিবেচনায় বিরোধীদলীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ এবং কারও কারও চাকরিচ্যুতি।

এই চারটি ব্যবস্থার মধ্যে শুধু একটি ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের আইনগত অধিকার রয়েছে। সে ক্ষেত্রটি হলো পদায়ন। নির্বাচিত সরকার যেকোনো কর্মকর্তাকে তাঁর সম-মর্যাদাসম্পন্ন পদে নিয়োগ দিতে পারে, এ ব্যাপারে অভিযোগের কোনো সুযোগ নেই। বাকি তিনটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিকীকরণ বেআইনিভাবে করা হচ্ছে। সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে হওয়ার কথা। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারি দল পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে কুক্ষিগত করে তাদের প্রার্থীদের নিয়োগ দান করে। এই ব্যবস্থা আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকারের ভূমিকা রয়েছে। প্রচলিত বিধি অনুসারে কেউ যদি পদোন্নতির যোগ্য না হন, তাহলে সরকার তাঁকে পদোন্নতি দিতে বাধ্য নয়। প্রচলিত বিধিতে সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে তাঁদের রাজনৈতিক অতীত বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই। তবে কেউ যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য আচরণবিধির আওতায় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। কিন্তু যদি আচরণবিধি অনুসারে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না করা যায়, তাহলে তাঁকে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা যায় না। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে এই নিয়ম তিন দশক ধরে মানা হচ্ছে না। রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে এবং অনেককে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। উপরন্ত পদোন্নতির ক্ষেত্রে যে পদের সংখ্যা, তাও রাজনৈতিক বিবেচনায় বাড়ানো বা কমানো হচ্ছে। পদোন্নতি দেওয়ার জন্য কাজ ছাড়া উদ্ধৃত্ত পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সচিবালয়ে ১৭৬৮ জন কর্মকর্তাকে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া হয়। (সারণি-৯.৯ দ্রষ্টব্য)।

সারণি-৯.৯
মঞ্জুরিকৃত পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি

মঞ্জুরিকৃত পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি

এ ধরনের পদোন্নতির ফলে নিম্নরূপ ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দিচ্ছে।

১. সরকারি অর্থের অপচয় : উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত মোট মঞ্জুরিকৃত পদ ছিল ১৪২০টি। মোট পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা ৩১৮৮। অর্থাৎ ১৭৬৫ জনকে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ওই সময়ে প্রচলিত বেতন-ভাতার ভিত্তিতে মোট অপচয় ছিল ৬৩.৭ কোটি টাকা। আর বর্তমান বেতন-ভাতার হিসাবে এই অপচয় বছরে ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এর অর্থ হলো এই পদোন্নতির জন্য আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশ সরকারের কমপক্ষে ১ হাজার কোটি টাকা লোকসান হবে।

২. নতুন ধাপ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রশাসনিক অদক্ষতা সৃষ্টি : মঞ্জুরিকৃত অতিরিক্ত সচিবের পদ মাত্র ১০৭টি। অথচ এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ৩৫০ জনকে। আগে সব মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব ছিল না। যেখানে সচিবের দায়িত্ব খুব বেশি, সেখানে সচিবের সহায়তার জন্য অতিরিক্ত সচিবের পদ সৃষ্টি করা হতো। কিন্তু যেসব নথি অতিরিক্ত সচিবের কাছে পেশ করা হতো, তার বেশির ভাগই অতিরিক্ত সচিবকে নিষ্পন্ন করার ক্ষমতা দেওয়া ছিল। আসলে চার ধাপের বেশি একটি বিষয় পরীক্ষা করার দরকার নেই। অথচ বর্তমানে সব মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিবের পদ সৃষ্টি করে পাঁচ ধাপবিশিষ্ট সচিবালয়-ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এতে নিশ্চিতভাবে প্রশাসনিক অদক্ষতা বেড়ে গেছে।

৩. রাজনৈতিক কারণে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত : এত বেশি পদোন্নতি দেওয়ার ফলে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কালের কণ্ঠ-এর (৭.৪.২০১৫) একটি প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ১৩৭ জন কর্মকর্তাকে অতিক্রম করা হয়েছে। যুগ্ম সচিব পদের পদোন্নতির জন্য ৩৬০ জন কর্মকর্তাকে অতিক্রম করা হয়েছে এবং ২৭০ জন কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব কর্মকর্তাকে অতিক্রম করা হয়েছে। সুতরাং এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর মনোবল ভেঙে পড়েছে এবং তাঁদের উৎপাদনশীলতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।

৪. পদায়নের জন্য তদবির : ১৭৬৮ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে কিন্তু তাঁদের পদায়নের জন্য উপযুক্ত পদ নেই। এখন সবাই পদায়নের জন্য তদবির করছেন। যেহেতু রাজনৈতিক বিবেচনায় পদায়ন হয়, সেহেতু উদ্বৃত্ত কর্মকর্তারা, যাঁরা পদায়ন পেয়েছেন, তাঁদের রাজনৈতিক আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। এ ধরনের পদোন্নতি আমলাতন্ত্রের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রকট করে তোলে।

৫. উল্টো পিরামিড ও নিম্নস্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রকট সংকট : উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে উদ্বৃত্ত কর্মচারীর সংখ্যা ১৭৬৮। অথচ সহকারী সচিব পদে ১৫০০ কর্মকর্তা নেই। এর কারণ হলো, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু নিচের স্তরে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এর ফলে প্রশাসনিক অদক্ষতার সৃষ্টি হয়েছে। তত্ত্ব অনুসারে সচিবালয়ের প্রশাসন পিরামিড আকৃতির হওয়ার কথা, যেখানে ওপরের দিকে পদের সংখ্যা হবে কম আর নিচের দিকের পদের সংখ্যা হবে বেশি। বাংলাদেশে এর উল্টো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নিচের দিকে পদে কর্মকর্তা নেই আর ওপরের দিকে অজস্র কর্মকর্তা বিনা কাজে বসে আছেন। নিচের দিকে কর্মকর্তা না থাকার ফলে প্রয়োজনীয় কাজ করা যাচ্ছে না। এ ধরনের প্রশাসন পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।

বাংলাদেশের সংবিধানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, কোনো সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বরখাস্তকরণ, অপসারণ অথবা অবনমনের আদেশ দেওয়া যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁকে কারণ দর্শানোর যুক্তিসংগত সুযোগ দেওয়া হয়। সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিস্তৃত নির্দেশাবলি সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা এবং আপিল) বিধিতে রয়েছে। এসব বিধি অনুসারে স্বেচ্ছাচারী ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ সীমিত। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে তাঁকে দুবার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয় : একবার তদন্ত শুরু হওয়ার আগে এবং দ্বিতীয়বার তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর। এসব বিস্তৃত ব্যবস্থা সত্ত্বেও ১৯৭৪ সালে পাবলিক সার্ভেন্ট রিটায়ারমেন্ট অ্যাক্টে সরকারি কর্মচারীদের অপসারণের একটি অভিনব পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। এ পদ্ধতি অনুসারে কারও ২৫ বছরের চাকরি পূর্ণ হলে সরকার তাঁকে অবসরে পাঠাতে পারে। অনুরূপভাবে ২৫ বছরের চাকরি পূর্তিতে সরকারি কর্মকর্তা নিজেও অবসরে যেতে পারেন। আইনের এ বিধান প্রয়োগ করে সরকার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য তাঁদের অবসরে পাঠাতে শুরু করে। এর ফলে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হয় এবং তাঁরা সরকারের বশংবদ হয়ে পড়েন। মোট কর্মচারীর সংখ্যার তুলনায় এ ধরনের অবসর প্রদানের ঘটনা খুব বেশি নয়। একটি হিসাবে দেখা গেছে, ১৯৯১-৯৬ সময়কালে ১৯৭ জন কর্মকর্তাকে সরকার অবসর দিয়েছে। এরপর এ সংখ্যা কমে আসে কিন্তু এখনো প্রতিবছরই কিছু কিছু কর্মকর্তাকে ২৫ বছর পূর্তিতে অবসর দেওয়া হচ্ছে। আসলে কতজনকে অবসর দেওয়া হয়েছে, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো যে সরকার কোনো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার আচরণে ক্ষুব্ধ হলে তাঁকে কোনো কারণ দর্শানো ব্যতিরেকেই অবসর দিতে পারে। এ বিশেষ বিধান বিলোপ না করা হলে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সরকারের স্বেচ্ছাচারের সুযোগ থেকে যাবে।

৯.৫ সংস্কারের রূপরেখা

ওপরের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রশাসনিক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশে প্রশাসনে নতুন কাঠামো গড়ে তুলতে হবে ও নতুন কাঠামো পরিচালনার জন্য দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ করতে হবে। এ কাজ সহজ নয়; কারণ, ইতিমধ্যে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রশাসনিক কাঠামো রয়েছে এবং ১০ লাখের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী এ কাঠামো পরিচালনা করছেন। এ পুরো ব্যবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। তবু বাংলাদেশে প্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণের যে সমস্যা হয়েছে, সে সমস্যার সমাধান না হলে প্রশাসন থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাবে না। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের প্রশাসনে বর্তমানে গ্রেশাম বিধির ব্যামো চলছে। গ্রেশাম বিধির বক্তব্য হলো, একই সঙ্গে বাজারে ভালো মুদ্রা এবং খারাপ মুদ্রা থাকলে ভালো মুদ্রা লোকে ঘরে তুলে রাখে আর শুধু খারাপ মুদ্রা বাজারে চালু থাকে। অন্য কথায় খারাপ মুদ্রা ভালো মুদ্রাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও অনেক সময় এই সংকট দেখা দেয়। দেখা যায়, প্রশাসনে খারাপ লোকেরা ভালো লোকদের কোনো আসন দেন না। এই অবস্থার নিরসন করতে হলে বাংলাদেশে প্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের বুঝতে হবে, প্রশাসনিক রাজনৈতিকীকরণ স্বল্প মেয়াদে তাঁদের জন্য লাভজনক হলেও দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে সমস্যা শুধু রাজনৈতিকীকরণেরই নয়, দুর্নীতি ও অদক্ষতাও অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে গ্রাস করেছে। এই ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সংস্কারে নিম্নলিখিত নীতিসমূহ অনুসরণ করা যেতে পারে :

১. সব খারাপ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নতুন ভালো কর্মকর্তা নিয়োগ। এ ধরনের ব্যবস্থা সংস্কার নয়, এ ধরনের ব্যবস্থা বৈপ্লবিক। তবু বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে অধিকাংশ কর্মকর্তা দুর্নীতিপরায়ণ ও স্বেচ্ছাচারী। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের মাধ্যমে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। নতুন লোক নিয়ে প্রতিষ্ঠান গড়তে হবে। পৃথিবীর কোনো কোনো স্থানে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যেমন এল সালভাদরে একটি নতুন পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করা হয়। বাংলাদেশের দাতারা দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষেত্রে এই নীতি প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছিল, তবে বাংলাদেশ সরকার শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করেনি।

২. দুর্নীতিপরায়ণ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অপসারণ ও অন্য কর্মকর্তা- কর্মচারীদের নতুনভাবে প্রশিক্ষণ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটলে প্রশাসনে পরিবর্তন সম্ভব। এই ক্ষেত্রে পুরোনো কর্মকর্তাদের ব্যাপারে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

৩. কার্যসম্পাদনে ব্যর্থ বা দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠানের বদলে নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা। এখানে গ্রামীণ ব্যাংকের উদাহরণ স্মরণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনায় ব্যর্থ হওয়ায় সরকার গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দেয়। যদিও কৃষি ব্যাংক ও গ্রামীণ ব্যাংকের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা সমান, তবু অর্জনের দিক থেকে কৃষি ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অনেক পেছনে পড়ে আছে। কাজেই অনেক ক্ষেত্রে নতুন লোক নিয়ে নতুন সংস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রশাসনিক গতি সঞ্চার করা সম্ভব।

৪. গুরুত্বপূর্ণ কাজে আগে সংস্কার। অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে যেসব ইউনিট রয়েছে, তার সব কটি একসঙ্গে সংস্কার করা সম্ভব না-ও হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে যেসব ইউনিটের কাজ গুরুত্বপূর্ণ, সেসব ইউনিটে নতুন লোকদের নিয়োগ দিয়ে সংস্কারের কাজ শুরু করা যেতে পারে। বর্তমান কর্মচারীদের পুরোনো ইউনিটে সীমাবদ্ধ রেখে তাঁদের ক্রমশ অবসরে পাঠিয়ে সংস্থাটি নতুন করে গড়ে তোলা যেতে পারে।

৫. বেসরকারীকরণ এবং সরকারের ভূমিকা হ্রাস। বেসরকারীকরণ করে এবং সরকারের দায়িত্ব কমালে দুর্নীতির সুযোগ কমে যাবে।

ওপরের পাঁচটি নীতি থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে গ্রেশাম বিধির ব্যামো সারানোর একটিমাত্র পথ নেই, এখানে অনেক ধরনের পথের অনুসন্ধান করতে হবে। তবে এ ধরনের সংস্কার তখনই সম্ভব হবে, যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

বাংলাদেশে প্রশাসনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত সংস্কারের জন্য একটি নকশা তৈরি করে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে :

১. প্রশাসনিক পুনর্গঠন : বাংলাদেশ সচিবালয়ে যত কর্মকর্তা এবং কর্মচারীর পদ আছে, তত কাজ নেই। বিশ্লেষণে দেখা যায়, সচিবালয়ের প্রায় ৫০ শতাংশ ঊর্ধ্বতন পদের কোনো প্রয়োজন নেই। যে আদলে সচিবালয়ের প্রশাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, সে আদলকে পরিবর্তন করতে হবে। ডিজিটালাইজেশনের পর বাংলাদেশে বেশির ভাগ অফিসে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদের প্রয়োজন অনেক কমে গেছে। এ ধরনের পদ তুলে দিতে হবে এবং নিচের কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হবে।

২. উদ্বৃত্ত কর্মচারীদের ব্যবস্থাপনা : যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী উদ্বৃত্ত হবেন তাঁদের চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে এ ধরনের ক্রান্তিকালে দুই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, সচিবালয়ের সব নথি কম্পিউটারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ কাজে অতিরিক্ত জনবলের প্রয়োজন হবে। মূল প্রশাসনে যাঁরা উদ্বৃত্ত হবেন, তাঁদের এ কাজে নিয়োগ করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে সর্বত্র উদ্বৃত্ত কর্মচারী নেই, কোথাও কোথাও কর্মচারীর অভাবও রয়েছে। যেমন স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়। উদ্বৃত্ত কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যেখানে প্রয়োজন, সেখানে নিয়োগ করা যেতে পারে।

৩. সিনিয়র সার্ভিস পুল পুনর্গঠন : বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যতগুলো প্রশাসনিক পুনর্গঠন কমিশন গঠন করা হয়েছে, তার প্রতিটিই সিনিয়র সার্ভিস পুল গঠনের পরামর্শ দিয়েছে। সরকার এ সুপারিশ গ্রহণ করেছিল, কিন্তু পরে সরকারি কর্মচারীদের চাপের মুখে এ ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা পুনরায় চালু করার প্রয়োজন রয়েছে।

৪. সচিবালয়ের বাইরের প্রশাসনে সংস্কার : শুধু সচিবালয়ের সংস্কারই যথেষ্ট নয়, সচিবালয়ের বাইরে যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলো সংস্কার করতে হবে। এই সংস্কারের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত নীতিমালা অনুসরণ করা যেতে পারে।

১. যেসব কাজ বেসরকারি খাতের পক্ষে করা সম্ভব, সেসব কাজ সরকারে না রেখে বেসরকারি খাতে স্থানান্তর করা যেতে পারে।

২. পুরো প্রতিষ্ঠানটির একসঙ্গে সংস্কার না করে প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর ক্ষেত্রে সংস্কার শুরু করা যেতে পারে।

৩. যেখানে বর্তমান প্রতিষ্ঠান একেবারেই অক্ষম, সেখানে বিকল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যেতে পারে এবং পুরোনো প্রতিষ্ঠানটি আস্তে আস্তে গুটিয়ে ফেলা যেতে পারে।

প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য যোগ্য আমলাতন্ত্রের প্রয়োজন। এই যোগ্য আমলাতন্ত্র গড়ে তোলার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে :

১. ক্যাডার সার্ভিস পুনর্গঠন : খুব বেশি ক্যাডার সৃষ্টি করা হয়েছে, যেখানে ক্যাডার ব্যবস্থা উপযুক্ত নয়, সেখানেও ক্যাডার সৃষ্টি করা হয়েছে। এর ফলে প্রশাসনে বিশেষজ্ঞদের কদর কমে গেছে। ক্যাডার ব্যবস্থাকে পুনরায় পরীক্ষা করতে হবে, তবে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে এই পরিবর্তনের ফলে যেন কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর সুযোগ-সুবিধার হ্রাস-বৃদ্ধি না ঘটে।

২. পাবলিক সার্ভিস কমিশন পুনর্গঠন : স্বাধীন এবং কার্যকর পাবলিক সার্ভিস কমিশন গড়ে তুলতে হবে। এর পরীক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে, ২৯টি ক্যাডারের জন্য এক পরীক্ষার বদলে ক্যাডারের প্রয়োজনভিত্তিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। পরীক্ষার পাঠ্যক্রম অতি দ্রুত পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে।

৩. সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মসম্পাদন মূল্যায়নের ব্যবস্থা : বর্তমান পদ্ধতি একেবারেই অচল, ব্যক্তিগত গুণাবলির মূল্যায়ন না করে কর্মকর্তাদের কাজের পরিমাণ ও মানের মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।

৪ . বেতন-ভাতা : বর্তমানে যে বেতন-ভাতা প্রচলিত, তা যোগ্য প্রার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট নয়। যোগ্য প্রার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য নতুন কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

এখানে ঘুণে ধরা আমলাতন্ত্রকে কার্যক্ষম করার জন্য একটি রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। তবে এসব সংস্কার যথেষ্ট নয়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমলাতন্ত্রে পরিবর্তন আনতে হবে এবং নিয়মিতভাবে আমলাতান্ত্রিক সংস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে।

পাদটীকা

১. David Osborne and Ted Gaebler. 1993. Reinventing Government: How the Entrepreneurhip Spirit is Tranforming Public Sector. New York, Penguin Books.

২. M. Atahar Ali 1991. The Mughal Nobility under Aurangzeb. Delhi, Oxford, 15

৩. Hatch Barnwell 2011. The Last Guardian. Memoirs of Hatch Barnwell. ICS of Bengal. Dhaka: The University Press Ltd.

৪. David C. Potter. 1996. Indian ‘s Political Administrators from ICS to IAS. Delhi. Oxford University Press. 32-34

৫. Paul D. Maggio and Walter C. Powell. 1983. ‘The Iron Cage Revisted : Institutional Isomorphism and Collective Rationality in Organizational fields.’ American Sociological Review. Vol. 48 (April), 147-166

৬. Akbar Ali Khan 2015. Gresham’s Law Syndrome and Beyond. Dhaka: University Press Ltd.

৭. Center for Governance Studies, BRAC University. 2008 The State Governance in Bangladesh 2008 Dhaka. BRAC University, 57

৮. Akbar Ali Khan 2015. প্রাগুক্ত

৯. Akbar Ali Khan 2015. প্রাগুক্ত

১০. Max Weber. 1947. The Theory of Social and Economic Organization. New York: The Free Press ১১. James P. Pfiffner. 1987. ‘Political Appointees and Career Executives: The Democracy-Bureancraey Nexus in the Third Century, Public Administration Review. Vol. 47. No 1 (February), 57-65

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *