প্রায় ভোরবেলা, তখনও আকাশে আলো পরিষ্কার হয়ে জেগে ওঠেনি, শহরের আলো নিভে যায়নি, ওরা এসে শিলিগুড়ি শহরে পৌঁছুল।
নারায়ণ বলল, এখন আর অফিসের দিকে না গিয়ে বাড়ির দিকেই যাওয়া যাক।
উদিত নারায়ণদের বাড়ি চেনে। সুতপা বলল, হ্যাঁ, বাড়িতে ওঠাই ভাল, আমার একটু কোথাও থামা দরকার।
নারায়ণদের বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াল। দারোয়ান জেগে ছিল। সে দরজা খুলে দিল। সুতপা জানতে চাইল বাথরুম কোথায়। নারায়ণ বউদিকে ডেকে তুলে, তার হাতে সুতপাকে দিয়ে এল। নীচে এসে উদিতকে বলল, মেয়েটা তোর প্রেমে পড়ে গেছে একেবারে।
তার কথা শেষ হবার আগেই, বাড়ির সামনে একটা জিপ এসে দাঁড়াল। শিলিগুড়ি পুলিশের জিপ। উদিত দেখল একজন অফিসার নেমে, নারায়ণের ট্রাকটা দেখল। ঘরের দিকে এগিয়ে এল। চেনা অফিসার। জিজ্ঞেস করল, এ ট্রাকটা কখন এল?
নারায়ণ বলল, এই তো আসছে।
ড্রাইভার কোথায়?
তাড়াতাড়ি উদিত বলল, মিহির ট্রাক রেখেই বাড়ির দিকে গেল, সেই চালিয়েছে।
কোথা থেকে ট্রাকটা এল এখন?
মানিকচক, মালদহ।
এ গাড়িতে কোনও মেয়ে ছিল?
উদিত বলল, না তো, কী ব্যাপার?
অফিসার উদিতকে চেনে না, বলল, থাকার কথা। খবর আমরা আগেই পেয়েছি। কিন্তু ট্রাকটা শিলিগুড়ি ঢোকবার আগে ধরতে পারিনি। আর কে কে ছিল ট্রাকে।
নারায়ণ এক বার উদিতকে দেখে বলল, এ আর আমি।
কিন্তু নারায়ণবাবু এ ট্রাকে নিশ্চয়ই একজন মেয়ে ছিল। যদি জানেন তা হলে বলুন, তা না হলে, ব্যাপার অনেক দূর গড়াবে। যে মেয়ের কথা আমি বলছি, তার নাম নয়ন সিনহা। আজ তিন দিন ধরে, তার জন্য কলকাতা থেকে তরাই পর্যন্ত, ওদিকে বাগডোগরা এয়ারপোর্ট, সবখানে জাল ফেলে রাখা হয়েছে, যাতে তাকে ধরা যায়। আমাদের কাছে খবর হচ্ছে, এই নম্বরের, এই মিলিটারি মাঝারি ট্রাকে তাকে দেখা গেছে।
উদিত বলল, আমাদের কী লাভ বলুন মিথ্যে কথা বলে। আমরা নিশ্চয়ই তাকে ইলোপ করতে চাইনি বা, এরকম কোনও মেয়েকে আমরা চিনিই না।
অফিসার বলল, ইলোপ করবেন কেন। তাকে হাতে রাখতে পারলে, অনেক টাকাও রোজগার করতে চাইবে। কোটিপতির মেয়ে। যে তাকে ধরে রাখবে, সেই কিছু টাকা চেয়ে বসবে। কিন্তু আইনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কেউ ধরিয়ে দিতে পারলে, নিশ্চয়ই টাকা পাবে, অনেক টাকাই পাবে। আর চালাকি করলে, তখন সেটা দুষ্কৃত বলে ধরা হবে।
নারায়ণ উদিত কিছুই বলল না। অফিসার বলল, তা হলে আপনারা কিছুই জানেন না?
নারায়ণ বলল, না আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
নারায়ণদের বিরাট প্রতিপত্তি। অফিসার বিশেষ কিছু না বলে, খালি বলল, ট্রাকটা যেন আর কোথাও পাঠাবেন না, আপনারা দুজনে বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না।
অফিসার চলে গেল। নারায়ণ আর উদিত অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল। এ সময়ে সুতপা নেমে এল। উদিত আচমকা বলল, আপনার নাম নয়ন সিনহা।
সুতপা চমকে উঠল। নারায়ণ পুলিশের কথা বলল। সুতপা ভয়ার্ত মুখে বলল, তা হলে আর আমি এক মুহূর্ত এখানে থাকতে চাই না। আমার পালানো দরকার।
উদিত বলল, ব্যাপার কী?
সুতপা বলল, পরে সব বলব, আপনি আমাকে মেটেলিতে পৌঁছে দিন।
কিন্তু কী করে যাব! চারদিকে আপনার জন্য জাল ফেলা হয়েছে।
এখনও একটু অন্ধকার আছে। অন্য একটা গাড়ি নিয়ে, আমরা মেটেলিতে যেতে পারি।
উদিত নারায়ণের দিকে তাকাল। নারায়ণ বলল, একটা জিপ ব্যবস্থা হতে পারে, কিন্তু কোন পথে যাবি?
উদিত বলল, আমার মনে হয়, সেবক ব্রিজ দিয়ে গেলে, ওদিকে ধরে ফেলবে। কারণ ভাববে ওদিক ছাড়া রাস্তা নেই। আমরা যদি জলপাইগুড়ি হয়ে বার্নেস দিয়ে আবার উজোন যাই মেটেলিতে, ধরতে পারবে না।
ঠিক বলেছিস।
উদিত বলল, কিন্তু আমার জানা দরকার, আমি এমন কোনও অপরাধ করছি কি না। যেটা আমাকে অপমানিত করবে।
সুতপা ওর হাত ধরে বলল, আপনি কোনও অপরাধই করছেন না। শেষে সব জানতে পারবেন, হয়তো আপনি ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাবেন। পরে সবই আপনাকে আমি বলব।
আর দেরি না করে, নারায়ণের গ্যারেজ থেকে জিপ বের করল উদিত। সব দেখেশুনে সুতপাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল, জলপাইগুড়ির পথে।
.
সকাল নটার মধ্যেই বার্নেস পেরিয়ে, মালবাজারের রাস্তায় পড়ল। মেটেলির চা বাগান অঞ্চলে, ওরা যখন পৌঁছল তখন প্রায় বারোটা। সুতপার কথানুযায়ী মেটেলির পাহাড়ে টিলার ওপরে, যে বিশাল বাংলো প্রাসাদে এসে ওরা উঠল, উদিত সেটাকে প্রচুর চা বাগানের মালিক, টি-কিং দীপেন্দ্র সিংহের বাংলো বলেই জানে। দীপেন্দ্র সিংহ মারা গিয়েছেন কয়েক মাস। তাঁর স্ত্রী এখন এখানে আছেন।
সুতপা দৌড়ে বাংলোয় ঢুকল। চাকর দারোয়ান আয়া লোকজন সব হইহই করে উঠল। আর পিছনে পিছনে এল আরও কয়েকটা গাড়ি। সবই পুলিশের এবং অন্যান্য আরও কিছু।
প্রথমেই একজন অফিসার এসে, উদিতের হাত চেপে ধরল। আর সেই মুহূর্তেই বাংলোর বারান্দায়, সুতপাকে দেখা গেল এক মহিলার সঙ্গে। তিনি সুতপাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তিনি পুলিশ অফিসারকে বললেন, ওকে ছেড়ে দিন, আমার কাছে আসতে দিন। এই আমার মেয়ে আমার কাছে।
পুলিশ অফিসার অবাক হয়ে উদিতকে ছেড়ে দিল। উদিত বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল।
সমস্ত ঘটনার আকস্মিকতায়, উদিত বিস্মিত এবং চমকিত। যদিও, সমস্ত ঘটনা ওর এখনও জানা হয়নি। ইতিমধ্যেই যা ঘটেছে, তাতেই ও অবাক। সুতপা এখন আর সুতপা নয়, নয়ন সিন্হা বলাই উচিত। উদিতের পক্ষে যেন বিশ্বাস করাই কঠিন, তরাইয়ের বিখ্যাত চা ম্যানুফ্যাকচারার, যাকে টি-কিং বলা হত, সেই ডি সিনহা–অর্থাৎ দীপেন্দ্র সিংহের বিলাসবহুল বাংলোয় ও বসে আছে। আর নয়ন সেই দীপেন্দ্র সিংহেরই একমাত্র মেয়ে। যাকে বলা যায় কোটিপতির মেয়ে। এখন নারায়ণের কথা ওর বিশেষভাবে মনে পড়ছে। নারায়ণ যে বার বার বলেছিল, নয়নের মুখ তার চেনা চেনা লাগছে, সেটা মিথ্যা না। নারায়ণ নিশ্চয়ই এর আগে নয়নকে দেখেছে। নানা কারণেই, নারায়ণ মেটেলিতে এসেছে। নয়নও নিশ্চয়ই অনেক বার শিলিগুড়িতে গিয়েছে এবং সবাই এক ডাকেই, ডি সিনহার মেয়েকে চিনতে পেরেছে। শুধু শিলিগুড়িতে কেন, আরও অনেক জায়গাতেই হয়তো নয়নকে দেখা গিয়েছে।
সমস্ত ঘটনা জানবার জন্য, উদিতের মনে তীব্র কৌতূহল জেগে উঠল। নয়নের কাছ থেকেই সমস্ত ঘটনা জানতে হবে। কিন্তু আপাতত তার সুযোগ নেই। বসবার ঘরে, প্রায় একটা সভা বসে গিয়েছে। জেলা পুলিশের বড় কর্তা পর্যন্ত হাজির। তা ছাড়া অন্যান্য অফিসাররাও আছেন। টি-এস্টেটের বড় বড় কর্মচারীরাও রয়েছেন।
উদিত দেখল, নয়নের মা, মিসেস হেমলতা সিনহা এক ব্যক্তিত্বশালিনী মহিলা। সকলের ওপরেই যে তাঁর বিশেষ প্রতিপত্তি, তা তাঁর ব্যবহারেই বোঝা গেল। যদিও, এই মুহূর্তে তিনি খুশি ও আবেগে ভরপুর। সবাইকে চা-খাবারে আপ্যায়ন করে, সকলের কাছেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন, ধন্যবাদ জানালেন। জেলা পুলিশের বড় কর্তাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানালেন। বললেন, আমার মেয়েকে ফিরে পাবার ব্যাপারে, আপনারা যথেষ্ট সাহায্য করেছেন।
জেলার কর্ণধার গাম্ভীর্যের মধ্যেই একটু হেসে বললেন, আমরা মিস সিনহাকে নিরাপদে এখানে নিয়ে আসার যথেষ্ট চেষ্টা করেছি, তবে ব্যাপারটা আমাদের হাতে ছিল না।
বলে তিনি উদিতের দিকে কুটি করে তাকালেন। বললেন, আমি এই উদিতবাবুর কোনও পরিচয় জানি না। মালদহ থেকে শিলিগুড়িতে খবর আসে যে, একটি মেয়েকে নিয়ে, দুজন যুবককে একটি ট্রাকে রওনা হতে দেখা গেছে। কিন্তু কোথায় তারা রওনা হয়েছে, সে খবর সঠিক জানা যায়নি। পরে অবিশ্যি আমরা জানতে পেরেছি, ট্রাকটি শিলিগুড়িতেই এসেছে। ট্রাকটিকে অনুসরণ করে আমরা ঠিক জায়গাতেই গেছলাম। কিন্তু পুলিশের কাছে উদিতবাবুরা মিথ্যে কথা বলেছিলেন। মিস সিনহার কথা উদিতবাবু অস্বীকার করেছিলেন। এক্ষেত্রে তার উচিত ছিল, পুলিশের কাছে সারেন্ডার করা।
উদিত অপ্রস্তুত হয়ে, সকলের দিকে একবার তাকাল। নয়ন বলে উঠল, সেটা উদিতবাবুর দোষ নয়, আমিই বারণ করেছিলাম।
জেলা কর্ণধার একটু নরম সুরে, সম্ভ্রমের সঙ্গে বললেন, সেটা আপনি ঠিক করেননি মিস সিনহা।
প্রথমত আপনার মায়ের অনুরোধে, সমস্ত ব্যাপারটাই গোপন ছিল। তিনি চাননি, কলকাতার আত্মীয়ের বাড়ি থেকে আপনি যে পালিয়েছেন, সেটা এ অঞ্চলে জানাজানি হোক। কিন্তু ধরে নেওয়া হয়েছিল আপনি যে ভাবেই হোক, এদিকেই আসবেন। সেইজন্য আজ চার দিন ধরে, আমরা সবখানে আপনার জন্য জাল পেতেছিলাম। বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে সমস্ত ঘাঁটিতে। আপনার নিরাপত্তার জন্যই।
নয়ন লজ্জিতভাবে বলল, আমি সত্যি দুঃখিত।
জেলা কর্ণধার হাসলেন। তাঁকে একটু বিব্রতও দেখাল। বললেন, অবিশ্যি এক হিসাবে ভালই হয়েছে। আমরা ব্যাপারটা গোপন রাখতে চাইলেও, একেবারে গোপন থাকেনি। কিছু বাজে এলিমেন্ট খবরটা পেয়ে যায়। কী ভাবে পায় তা জানি না। তাদের সোর্স কলকাতাও হতে পারে। তারাও আপনার পিছু নিয়েছিল। ওদের দুটো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এক, আপনাকে এখানে পৌঁছে দিয়ে, আপনার মায়ের কাছ থেকে মোটা টাকা পুরস্কার পাওয়া। অথবা, কলকাতায় নিয়ে যাওয়া।
উদিতের সঙ্গে নয়নের এক বার চোখাচোখি হল। নয়ন ঠোঁট টিপে হাসল। বলল, তাদের বোধ হয় ইংলিশবাজারেই আমরা দেখেছি।
হ্যাঁ, সেখান থেকেই, তারা আপনাদের পিছু নিয়েছিল। তারা তোক খুব মারাত্মক, মার্ডারাস ওয়েপনস তাদের সঙ্গে ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, দরকার হলে রক্তারক্তি করেও আপনাকে ছিনিয়ে নেবে।
নয়নের চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠল। মিসেস সিনহা শঙ্কিত গলায় বলে উঠলেন, ভগবান বাঁচিয়েছেন।
জেলার কর্ণধার উদিতের দিকে তাকালেন। বললেন, সেটা অবিশ্যি উদিতবাবুরই কৃতিত্ব। উনি নির্ভয়ে খুব জোরে গাড়ি চালিয়েছিলেন। ওদের চিৎকারে বা ধমকে থামেননি, বা ওদের সাইড দেননি। কিন্তু, সামনে পুলিশের জিপ দেখেও নামেনি। আর একটু হলে পুলিশের জিপ খানায় পড়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেত।
উদিতের চোখের সামনে সেই দৃশ্য ভেসে উঠল। ও নয়নের দিকে এক বার দেখল, মাথা নিচু করল। জেলা কর্ণধার বললেন, কিন্তু যারা পিছু নিয়েছিল, তারা সেই প্রথম জানল, ঘটনার পিছনে পুলিশ ঢুকে পড়েছে। তখন তারা সরে পড়ে। এনি হাউ, এখন আমরা ধরে নিচ্ছি, যা হয়েছে, তা মঙ্গলই হয়েছে। মিস সিনহা নিরাপদে পৌঁছেছেন।
বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর সঙ্গে প্রায় সকলেই। মিসেস সিনহা বললেন, সেজন্য আমি আপনাদের সকলের কাছেই কৃতজ্ঞ।
একে একে সকলেই বিদায় নিলেন। উদিতের মনে হল, ওর-ও এবার বিদায় নেওয়া উচিত। ও বাইরের বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। মিসেস সিনহা বলে উঠলেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
উদিত বলল, আমি এখন শিলিগুড়ি ফিরে যাব।
মিসেস সিনহা ঘাড় নাড়িয়ে বললেন, অসম্ভব। তুমি আমার নয়নকে ফিরিয়ে এনেছ। তোমাকে আমি এখন ছাড়তে পারব না। তুমি ঘরে গিয়ে বসো।
নয়ন তখন সকলের সঙ্গে নমস্কার বিনিময়ে ব্যস্ত। উদিত সেদিকে একবার দেখল।
মিসেস সিনহা আবার বললেন, তুমি বসো, আমি নয়নকে ডেকে দিচ্ছি।
উদিত একটু লজ্জা পেল মিসেস সিনহার কথা শুনে। মুখ ফিরিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল। অবিশ্যি সমস্ত ঘটনাটা আনুপূর্বিক জানবার কৌতূহল ওর রয়েছে। তা ছাড়া, এভাবে যে ছাড়া পাবে না, সেটা ও বুঝতে পারছে। কিন্তু নারায়ণের গাড়ি নিয়ে এসেছে। বেশি সময় ওর পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়। আজকের মধ্যেই ফিরে যেতে হবে।
উদিত এসে বসতে না বসতেই নয়ন এসে ঘরে ঢুকল। জিজ্ঞেস করল, আপনি নাকি এখনই শিলিগুড়ি ফিরে যাবেন বলছেন?
উদিত বলল, আমার কর্তব্য তো শেষ হয়েছে।
নয়ন বলল, আপনার হয়তো হয়েছে, আমার তো হয়নি। ধরেছি যখন, এত সহজে ছাড়ছি না।
কথাটা বলেই, নয়নের মুখে রং ধরে গেল। লজ্জা পেয়ে চোখের পাতা এক বার নামাল। কিন্তু তেমন কোনও আড়ষ্টভাব নেই।
উদিত বলল, কিন্তু নারায়ণদের গাড়িটা নিয়ে এসেছি।
নয়ন বলল, তা হোক। নারায়ণবাবুদের একটা গাড়ি নয়, অনেক গাড়ি আছে। বলেন তো, আপনার বন্ধুকে ডেকে পাঠাই।
উদিতের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, নারায়ণ এলে খুব ভাল হত। একসঙ্গে ফিরে যেতাম।
নয়ন বলল, নারায়ণবাবুরও তা হলে সন্দেহ ঘুচত। উনি তো আপনাকে অনেক বারই বলেছেন, আমার মুখটা ওঁর চেনা চেনা লেগেছে।
উদিত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, সে কথা আপনি শুনতে পেয়েছেন?
নয়ন মুখে কিছু না বলে, ঠোঁট টিপে হাসল। বোঝা গেল, শুধু এই কথাই নয়, নারায়ণের অনেক কথাই নয়ন শুনেছে। উদিত লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে ধরল। নয়নের চোখের দিকে তাকাল। নয়নের চোখে হাসির ঝিলিক। বলল, আমি নারায়ণবাবুকে ট্রাঙ্ককল করছি। আমাদেরই একটা গাড়ি এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি ওঁকে নিয়ে আসবার জন্য। আমাদের জন্য না থাকেন, বন্ধুর টানে থেকে যান।
নয়নের হাসির মধ্যে একটু অভিমানের রেশও রয়েছে। উদিত বলল, তা কেন। আপনাদের জন্যই থেকে যাব। তবে নারায়ণ এলে ভাল হয়।
নয়ন বলল, আমারও ভাল লাগবে।
তারপরেই সে ব্যস্ত হয়ে উঠে বলল, এখন চলুন তো। তাড়াতাড়ি চান করে জামাকাপড় বদলে খেয়ে নিয়ে শুতে যাবেন। কাল সন্ধে থেকে একটানা গাড়ি চালিয়েছেন।
উদিত একটু অবাক হয়ে বলল, সবই করব, কিন্তু জামাকাপড়ও বদলাব কী করে। আমি তো কিছুই নিয়ে আসিনি।
নয়ন বলল, আপনার গায়ে মানিয়ে যাবার মতো পায়জামা-পাঞ্জাবি দিতে পারব। আসুন।
কেমন করে তা সম্ভব উদিত জানে না। ও নয়নকে অনুসরণ করল।
.
উদিত বাথরুমে ঢুকল। মোজাইকের মেঝে আর চীনামাটির টালির দেওয়াল, পুরোপুরি আধুনিক স্নানের ঘর। সেখানে পাট করা নিভাঁজ ধোয়া পায়জামা-পাঞ্জাবি তোয়ালে সবই ছিল। তেল সাবান শাম্পু থেকে কিছুই বাদ নেই। এ রকম বিলাসে অভ্যস্ত থাকলেও, মনটা বেশ খুশি হয়ে উঠল।
চান করে বেরিয়েই নয়নের সঙ্গে ওর দেখা। ঝি-চাকরেরা আশেপাশে থাকলেও, উদিতকে দেখাশোনার সব দায়িত্ব নয়নের নয়ন ওকে একটি ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে খাটে মোটা গদির বিছানা এবং ড্রেসিংটেবিল।
নয়ন বলল, মাথা আঁচড়ে খেতে চলুন।
উদিত বলল, একলা খেতে যাব? আপনি আপনারা?
আমি পরে।
আপনিও তো সেই কাল সন্ধে থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
তা হোক। মেয়েদের তাতে কষ্ট হয় না। আপনি খেয়ে শুতে আসবেন, তারপরে আমার ব্যবস্থা।
উদিত জানে, মেয়েরা এ ব্যাপারে একটু বেশি কষ্টসহিষ্ণু। কিন্তু এ ধরনের পরিবারের মেয়েদের ক্ষেত্রে, সেটা ওর জানা নেই।
নয়ন আবার বলল, আপনার বন্ধুকে ট্রাঙ্ককল করা হয়ে গেছে। গাড়িও বেরিয়ে গেছে। রাত্রের খাবার সময়ের আগেই পৌঁছে যাবেন।
উদিত বলে উঠল, আপনি দেখছি সবই খুব তাড়াতাড়ি করতে পারেন।
নয়ন ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, যথা?
উদিত থমকে গেল। সহসা একটু অপ্রস্তুতও। তারপরে বলল, এই কাজকর্মের কথা বলছি।
নয়ন ঘাড় নেড়ে, চোখে ঝিলিক হেনে বলল, আর কিছু নয় তো?
বলেই পিছন ফিরল। দু পা গিয়ে, আবার উদিতের দিকে ফিরে ডাকল, আসুন।
উদিত তাকে অনুসরণ করল। মনে মনে বলল, হ্যাঁ, আরও কিছু। তাড়াতাড়ি মন চুরি করতেও পারে এই মেয়ে।
খাবার ঘরে মিসেস সিনহা আগেই বসে ছিলেন। উদিতকে ডেকে বসালেন, এসো বাবা, বসো।
খেতে বসে প্রধানত, মানিকচক থেকে মেটেলি পর্যন্ত আসার বিষয়েই কথা হল। উদিতের থেকে নয়ন বেশি বলল, মিসেস সিনহা বারবারই উদিতকে বললেন, ভগবানই নয়নকে তোমায় জুটিয়ে দিয়েছিলেন। তা না হলে, আমার নয়নকে ফিরে পেতাম কি না কে জানে।
উদিত বিব্রত লজ্জায় প্রতিবাদ করল। মিসেস সিনহা সে কথা বোধ হয় শুনতেই পেলেন না। উদিতকে বারে বারে আশীর্বাদ করলেন।