আই সি এস ই পরীক্ষায় অনীশ পেয়েছিল শতকরা একাশি নম্বর। আর আপা পেয়েছিল তিরাশি। সেই থেকে খুব গোপনে এবং গভীরে অনীশের একটা হীনম্মন্যতা দেখা দিয়েছে। হায়ার সেকেন্ডারিতে সে ওকে টপকে যেতে পারে, আবার নাও পারে। আপা ভাল মেয়ে এবং তার খুব ভাল বন্ধু। আপা তাকে সব বিষয়ে সাহায্য করতে চায়, যদিও অনীশের সাহায্য লাগে না। কিন্তু আপা এতই ভাল যে, অনীশের হীনম্মন্যতার কথা জানতে পারলে নিজের বাড়তি শতকরা দু নম্বর এখনই তাকে দিয়ে দিতে চাইবে। সেটা অসম্ভব জেনেও চাইবে। আপা একটু ও ধরনেরই। তামিলরা বেশ বাস্তববাদী হয় বলে শুনেছে অনীশ। কিন্তু ব্যতিক্রম তো থাকেই। আপা সেই ব্যতিক্রম। এই কালো, বোগা, নিরহঙ্কারী, এবং সবসময়ে একটু ঘোরের মধ্যে থাকা মেয়েটি মোটেই বাস্তববাদী নয়। আঠারো বছর বয়সেও এই ছোটখাটো মেয়েটিকে মোটেই যুবতী বলে মনে হয় না, বরং বালিকা বলে ভ্রম হয়। আপা পুরোপুরি বালিকাও নয়, মনের মধ্যে এখনও অনেকটাই শিশু।
আপাতত আপা কলকাতার ভিখিরিদের জীবনী লিখছে। সেটা একটা কাণ্ডই। লাল কাপড়ে বাঁধাই খেরোর খাতা সবসময়ে তার সঙ্গে থাকে। ফুটপাথে হাঁটু গেড়ে বসে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিখিরিদের সাক্ষাৎকার নেয় এবং তা যত্ন করে টুকে রাখে। মাঝে মাঝে টেপ রেকডারও ব্যবহার করে বটে, কিন্তু মাইক মুখের সামনে ধরলে অধিকাংশ ভিখিরিই ঘাবড়ে যায় বলে সেটা ব্যবহার করে খুব কম। বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে একটা বুড়ো ভিখিরিকে আপা বাবা বলে ডাকে। জীবনী-সংক্রান্ত নোট তার অনেক জমেছে। আপার ইচ্ছে ছবিসহ বইটা আমেরিকা বা ইংলন্ড থেকে বেরোবে। খুব বিক্রি হবে। তার রয়্যালটি থেকে সে ভিখিরিদের জন্য একটা প্রাসাদ বানাবে ইস্টার্ন বাইপাসের কাছে কোথাও।
নাসা এবং রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা প্রকল্পে একটা প্রস্তাব উঠেছিল, বন্ধু দেশের কতিপয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষকে মহাকাশে ঘুরিয়ে আনবে। সেই প্রকল্পে নিজের নাম নথিভুক্ত করার জন্য আপা বিস্তর লেখালেখি করেছে। কোনও আশাব্যঞ্জক জবাব পায়নি। সে শিখতে চায় এয়াররা ডায়নামিক্স। নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে—অথাৎ কেরিয়ার নিয়ে আপা চিন্তিত নয়। সে শুধু চায় পৃথিবীর সামনে ভারতবর্ষকে তুলে ধরতে। ভারতবর্ষের দারিদ্র্য, আধ্যাত্মিকতা, ভারতের বিচিত্র মানুষ ও ইতিহাসকে। আপা সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। এ নিয়ে সে কাগজে কাগজে চিঠি লেখে। কয়েকটা চিঠি ছাপাও হয়েছে।
আপার সঙ্গ খুবই পছন্দ করে অনীশ। ওর কোনও সেক্স অ্যাপিল নেই এবং ওকে মেয়ে বলে না ভাবলেও চলে। ভাবেও না অনীশ। শুধু আজকাল, আই সি এস ই পরীক্ষার ফল বেরোনোর পর থেকে তার একটু আফসোস হয়, আপার কাছে দু নম্বরের জন্য হেরে যাওয়াটা তার পৌরুষের পক্ষে অপমানজনক।
চার দিন ক্লাশে যায়নি অনীশ। সবাই জানে, তার বাবার অসুখ। আজ পাঁচ দিনের দিন দুপুরে আপা নার্সিং হোমে এসে হাজির। সঙ্গে ক্লাসের আরও পাঁচটি ছেলেমেয়ে। সুমিত সিং, অর্চনা হায়দার, রোশন, পিটার, রচনা। অনীশ সকালে আসছে না। সকালে উঠতে তার দেরি হয়। আসে দুপুরে, বিকেলে আর মাঝে মাঝে রাতেও।
মণীশকে রাখা হয়েছে ইনটেনসিভ কেয়ারে। সেখানে ঢোকা বারণ। তবে কাচের পার্টিশন দিয়ে শায়িত বাবাকে দেখতে পায় অনীশ। হু-হু করা বুক নিয়ে সে দেখে। চব্বিশ ঘণ্টা মনিটারিং-এ রয়েছে তার বাবা। কথা বন্ধ, নড়াচড়া বন্ধ। শুধু ওষুধ দিয়ে নিরন্তর ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়।
বেশীর ভাগ সময়ে বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে অনীশ। আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর নেয়। বাবাহীন পৃথিবী কি সে সহ্য করতে পারবে? বাবা ছাড়া বেঁচে থাকাটার কি মানে থাকবে কোনও? আজকাল এই একটি চিন্তাতেই তার মাথা ভার হয়ে থাকে। মাইনাস বাবা এই পৃথিবীর, এই জীবনের কোনও বর্ণ, কোনও স্বাদ থাকবে না। বড় নিঃসঙ্গ লাগবে তার। ভীষণ একা। ভয় করবে।
পাশ করার পর ইদানীং তার বাবা তাকে মাঝে মাঝে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করছিল, ইউ আর কোয়াইট এ ইয়ংম্যান নাউ। এনি গার্ল? ইজ দেয়ার এনি গার্ল?
না বাবা, নো গার্ল।
মণীশ ভ্রূ কুঁচকে চিন্তিতভাবে বলে, সাম ডে এ গার্ল মে টেক এ প্লেস ইন ইওর লাইফ। এ ভেরি ইস্পট্যান্ট প্লেস। চুজ হার ইওরসেল্ফ্। বাট বি চুজি। ভেরি ভেরি চুজি।
কিন্তু অনীশের জীবনে এখনও সেই অর্থে কোনও মেয়ে বা মহিলা নেই। তার দিগন্ত কেউ আড়াল করে দাঁড়ায়নি। তার অনেক অনেক মেয়ে-বন্ধু আছে। সম্পর্ক খুবই সহজ, জটিলতাশূন্য।
এ সব প্রসঙ্গ উঠলে তার মা একটু রাগ করে, কেন এখনই ওসব ওর মাথায় ঢোকাচ্ছো বলো তো? ও তো বলতে গেলে এখনও দুধের শিশু।
মণীশ গম্ভীর হয়ে বলে, প্রাপ্তে তু যোড়শবর্ষে পুত্রমিত্রবদাচরেৎ। আমি চাই আমার ছেলে আমার কাছে জলের মতো সহজ হোক, তাতে কমপ্লিকেশনসের ভয় থাকবে না। অধিকাংশ বাবাই এটা করে না বলে জেনারেশন গ্যাপ তৈরি হয়।
মায়েরা কখনও বোঝে না এসব। তার মা এখনও ছেলের শৈশব আঁকড়ে পড়ে আছে। তাই তর্ক করে বাবার সঙ্গে।
বাবাকে আকণ্ঠ ভালবাসে অনীশ। এত ভালবাসে যে, তার মনে হয় বাবা মরে গেলে তাকেও হয়তো আত্মহত্যা করতে হবে।
বন্ধু ও বান্ধবীরা যখন দুপুরবেলা আচমকা এসে হাজির হল, তখন নিঃসঙ্গ অনীশের মনে হল, এদের সঙ্গে তার দেখা হল দু হাজার বছর পর। কতকাল দেখেনি ওদের! এত একা, এত মৃত্যুহিম, এত অসহায় লাগছে নিজেকে যে, অনীশ নিজেকে দেখে নিজেই অবাক!
নার্সিং হোমের লবিটা বিরাট বড়। দুপুরবেলা একটু ফাঁকা। তারা বসে গেল। বন্ধুদের মুখ সময়োচিত গভীর। অনীশ শুকনো মুখে বলে, প্লীজ স্মাইল এ বিট। আমি একটু হাসিমুখ দেখতে চাই।
বাস্তবিক ওদের মুখের গাম্ভীর্য— যতই কৃত্রিম হোক— সহ্য হয় না অনীশের। চারদিকটা শোকার্ত হয়ে পড়লে সে যে জোর পায় না।
বন্ধুরা একটু হাসল। তবে জোর করে। একটু সাহস-টাহস দিল। সুমিতের বাবা মস্ত হার্ট স্পেশালিস্ট। তবে এখন আমেরিকায় গেছেন একটা কনফারেন্সে। সুমিত মুখে আফসোসের শব্দ করে বলল, ড্যাডি আমেরিকায় না গেলে আমি ড্যাডিকে নিয়ে আসতাম। এনিওয়ে অল বিগ ফিজিসিয়নস্ আর হিয়ার। নো ওরি।
একটু পড়াশুনোর কথা হল, একটু খেলাধূলার কথা হল, একটু পপ মিউজিকের কথা হল। তারপর আপা ছাড়া সবাই চলে গেল।
আপা বলে, তুমি কিছু খাওনি অনীশ? লানচ্?
লানচ্-ফানচ্ এখন মাথায় উঠেছে। খিদে পেলে— অর্থাৎ খুব খিদে পেলে দুটো কলা বা বিস্কুট খেয়ে নিই।
তুমি অনেক উইক হয়ে গেছ। চোখের কোল বসে গেছে। চলো তোমাকে কিছু খাইয়ে আনি।
আরে না ভাই, খেতে ইচ্ছে করে না আমার। টেনশনের মধ্যে কি খাওয়া যায়!
তোমাকে গুচ্ছের খেতে বলছি না। ট্রাই ফাস্ট ফুড। কিংবা ফ্রুট জুস। এগুলো খেতে কোনও বোরডম নেই। খেয়ে যাচ্ছি তো খেয়েই যাচ্ছি— আমারও ওরকম ভাল লাগে না। চলো, স্ট্রং না থাকলে তোমার বাবার কোন উপকার করতে পারবে তুমি?
অনীশ রাজী হয়ে গেল। ফলের রস খেতে তার আপত্তি নেই। আর শরীরটা তার বেশ দুর্বল লাগছে আজকাল।
নার্সিং হোমের কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুজনে দু’গ্লাস মুসুম্বির রস নিয়ে বসে গেল। অনীশ তার সব সহপাঠী বন্ধু এবং বাবার সঙ্গে ইংরিজিতেই কথা বলে। ব্যতিক্রম শুধু আপা। এ মেয়েটা ঝরঝরে বাংলা বলে এবং বাংলা ছাড়া ইংরিজিতে কখনও কথা বলে না অনীশের সঙ্গে। আপা বলে, তোমাদের প্যাট্রিওটিজম নেই জানি। এখন যা আছে সেটা হল প্রভিনসিয়াল প্যাট্রিওটিজম। তামিলরা তামিলনাড়ু, কন্নড়রা কর্নাটক, পঞ্জাবীরা পঞ্জাব নিয়ে পড়ে আছে। কিন্তু তোমরা বাঙালী আপার মিডলক্লাস— তোমাদের সেটাও নেই। আর কিছু না পারো মাতৃভাষায় কথাটা বোলো বাপু।
আপা বাংলা জানে বললে ভুল হবে, সে বাংলার গোটা ইতিহাস জানে। বাংলা সাহিত্য জানে। বাংলা লোকসাহিত্য অবধি জানে।
এক চুমুকে গ্লাস শেষ করে অনীশ আরও এক গ্লাস নিল। তারপর আপাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আঠারো বছর বয়স ভয়ংকর— এ লাইন তুমি শুনেছো?
আপা অবাক হয়ে বলে, কেন বলো তো!
অনীশ একটু লজ্জা পেয়ে বলে, আমার সতেরো বছর কমপ্লিট হওয়ার পর থেকেই আমার বাবা মাঝে মাঝে এ লাইনটা বলে। আমি তো বুঝতেই পারি না, আঠারো বছর বয়সটাই কেন ভয়ংকর? বাবার ধারণা আঠারো বছর বয়স হলেই ছেলেরা রান আফটার গার্লস অ্যান্ড ডু আনডুয়েবল থিংস। কিন্তু দেখ আপা, আমাদের আঠারো বছর বয়সটা কি সত্যিই ওরকম? পড়াশুনো, কেরিয়ার বিল্ডিং, হাজারো টেনশনের মধ্যে আমরা কি বয়সটা টের পাই? ইজ ইট এ রিয়েলি ডেনজারাস এজ? লাইনটা কার জানো?
তোমাকে নিয়ে আর পারাই যায় না। এটা কবি সুকান্তর লাইন।
সুকান্ত! মিন, সুকান্ত ভট্টাচার্য?
হ্যাঁ বুদ্ধু। পড়োনি?
না। জাস্ট নামটা শোনা। পড়বার সময়টা কোথায় বলো তো? আমাদের সময় বলে কিছু আছে?
আমি তাহলে কি করে সময় পাই?
তুমি! তোমার কথা আলাদা, তুমি একসেপশনাল।
মোটেই নয় বাবা। তবে আমি তোমার মতো কেরিয়র-কনশাস নই। অমি যা পড়ি তা ভালবেসে পড়ি।।
ওই আঠারো বছর নিয়ে কবিতা একদিন আমাকে শোনাবে?
মুখস্থ নেই। তবে বই দিতে পারি।
ঠিক আছে। আমার বাবা কেন লাইনটা কোট করে তা আমার জানা দরকার! আপা, তোমার কি মনে হয় বাবা সারভাইভ করবে?
কেন করবে না? ওঁর বয়স কত?
পঞ্চাশের ঘরে। আরলি ফিফটিজ। কিন্তু বয়সটা বড় কথা নয়।
নৈরাশ্যের মধ্যেও আশার কথা ভাবতে পারাটাই সবচেয়ে বড় ফিলজফি—তা জানো?
ভাবতে হলে বুকের জোর চাই। আমি যে একদম জোর পাচ্ছি না আপা। বাবার কিছু হলে আমি বাঁচব না।
আপার চোখ হঠাৎ ছলছল করে উঠল। টেবিলের ওপর রাখা অনীশের হাতটা ধরে থেকে সে বলল, তুমি এই কারণেই ভীষণ ভাল।
কি কারণে?
পিতা স্বর্গঃ, পিতা ধর্মঃ, পিতাহি পরমং তপঃ, তুমি কথাটা মানো?
শুনেছি, অতটা নয়, তবে আমি বাবা ছাড়া অন্ধকার দেখি। মা বলে, বাবাই নাকি আদর আর আশকারা দিয়ে আমাকে নাবালক করে রেখেছে।
মা বাবা ওরকমই হয়। ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে তারা ভীষণ প্যাশনেট। কিন্তু কি জাননা, স্নেহ সবসময়ে নিম্নগামী। মা বাবা আমাদের যতটা ভালবাসে আমরা কিছুতেই তাদের ততটা ভালবাসতে পারি না।
বাজে কথা আপা। আমি কিন্তু—
তুমি তো প্রকৃতির নিয়ম উল্টে দিতে পারো না। তবে আমি মানছি তুমি তোমার বাবাকে খুব ভালবাসো, যতটা আমাদের বন্ধুদের কারও মধ্যেই দেখি না। আর সেইজন্যই তুমি ভীষণ ভাল।
থ্যাংক ইউ। কিন্তু তুমি জানো না, আমার বাবাও ভীষণ ভাল। আইডিয়াল ম্যান।
কেন জানবো না! তোমার বাবার সঙ্গে তো আমি কত কথা বলেছি। অনেক খবর রাখেন। প্রচুর পড়াশুনো করেছেন। স্মার্ট।
অ্যান্ড অনেস্ট। অ্যান্ড লাভিং। অ্যান্ড কেয়ারিং।
আপা অনীশের হাতে মৃদু চাপড় দিয়ে বলে, শোনো, এখন বাবার কথা অত ভেবো না। মনটাকে অন্যদিকে সরিয়ে নাও।
কি করে?
জোর করে। সবসময়ে বাবার কথা ভাবছো, অথচ তার জন্য প্র্যাকটিক্যালি তোমার কিছু করার নেই, এটা তোমাকে ভীষণ দুর্বল করে ফেলছে। জোর করে মনটাকে অন্য চিন্তা-ভাবনায় নিয়ে যাও। পৃথিবীটা তো অনেক বড়, কত কি আছে, ভাবতে পারো না!
না।
তাহলে একটা কাজ করবে? আমার সঙ্গে দাবা খেলবে?
দাবা? যাঃ!
দাবা খুব ভাল খেলা। মনটাকে একদম গ্রেফতার করে নেয়। কিছুক্ষণ খুব রিলিফ পাবে। আর যদি থ্রিলার পড়তে চাও আমি তোমাকে একটা দারুণ বই দিতে পারি। রোড টু গনডলফো। পোপকে চুরি করার একটা মজাদার উপন্যাস। পড়বে?
অনীশ হেসে ফেলে। বলে, বাবার কথা ভাবতে তো আমার খারাপ লাগছে না। মনটাকে অত সহজে সরানো যাবে না আপা!
আমি মনে করি কাল থেকে তোমার ক্লাস করাও উচিত। তোমার বাবা নার্সিং হোম-এ, ডাক্তাররা যা করার করবে। তুমি কেন ক্লাসে যাচ্ছো না?
পড়াশুনোর চিন্তা মাথায় উঠেছে। আমাদের ফিউচারও খুব আনসার্টেন। বাবাই আমাদের সোর্স অফ ইনকাম। চাকরিটা ভাল। কিন্তু আমাদের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স বা প্রপার্টি নেই।
তাহলে সুকান্তর কবিতাটা তোমাকে শুনিয়ে লাভ নেই, ও কবিতা তুমি বুঝবে না।
তার মানে?
সুকান্তর আমলে আঠারো বছরের ছেলেরা এত হিসেবী ছিল না। পকেটে টাকা নেই, ভবিষ্যতের আশা নেই, অথচ দুনিয়াটা তার নিজের বলে মনে হয়। তুমি সেরকম যুবক বোধ হয় কখনও হবে না।
না না, কবিতাটা আমি তবু শুনতে চাই আপা। কি কারণে আঠারো বছর বয়স ভয়ংকর, আমাকে জানতে হবে।
‘ভয়ংকর’ শব্দটা এবং আপা দুপুর থেকে বিকেল অবধি তার সঙ্গে রইল। তারপর আপা চলে গেল, কিন্তু ‘ভয়ংকর’ শব্দটা গেল না।
ভিজিটিং আওয়ারে অপর্ণা এসে ছেলের দিকে চেয়ে বলল, তুই ভেবেছিস কি বল তো! এভাবে কি নিজেকে শেষ করতে চাস? দুপুরে কিছু খাসনি। বাবার অসুখ কি আর কারও করে না?
কাতর গলায় অনীশ বলে, অ্যাপেটাইট নেই মা। গা বমি—বমি করছিল।
খালি পেট বলেই ওরকম করেছে। সকালে শুধু দুখানা বিস্কুট আর চা ছাড়া তোর পেটে কিছুই যায়নি।
গেছে মা। আপা এসেছিল। আমরা ফ্রুট জুস খেয়েছি।
অত ভাবছিস কেন বল তো! আজ সকাল থেকে তোর বাবার অবস্থা স্টেবল। আমরা তো ফোনে খবর নিচ্ছিই। এখন বাড়ি যা। আমি খাবার সাজিয়ে রেখে এসেছি টেবিলে, খেয়ে নিস। তারপর একটু রেস্ট নে।
আঠারো বছর বয়স ভয়ংকর…আঠারো বছর বয়স ভয়ংকর বিড়বিড় করতে করতে তার বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। কোন এক ঘোরের মধ্যে কোন বাসে চড়ে যেন— বসে বা দাঁড়িয়ে— ঠিক মনে নেই, সে বাড়ি ফিরে এল। তার বাবা ইদানীং তাকে একটা স্কুটার কিনে দেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছিল। বাসে ভিড়। কিন্তু অপর্ণা এই প্রস্তাব ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করেছে, পাগল নাকি! স্কুটার ভীষণ বিপজ্জনক জিনিস। আমি যতদিন বেঁচে আছি ওসব হবে না।
একটা স্কুটার বা মোটরবাইক থাকলে তার অনেক সুবিধে হত। তার অনেক বন্ধুর আছে। অ্যাকসিডেন্ট জিনিসটাই তো অ্যাকসিডেন্ট। রাস্তায় হাঁটছিল একটা লোক, পাঁচতলার ছাদে কাপড় রোদে শুকোতে দিয়ে ইঁট-চাপা দিয়েছিল কেউ, বাতাসের তোড়ে কাপড় উড়ে ইঁট খসে পড়ল সোজা মাথার চাঁদিতে, লোকে তো এ ভাবেও মরে! খবরের কাগজে এ খবর পড়েছে অনীশ। মৃত্যু-ভয় আছে জেনেও মানুষ উঁচু পাহাড়ে চড়ে, রেসিং কার চালায়, প্লেন ওড়ায়, আরও কত কী করে!
ভেবে লাভ নেই। মা ওসব যুক্তির ধার ধারে না। কিন্তু তার বিবেচক বাবা কথাটা যে ভেবেছিল, তাতেই সে আজ যথেষ্ট কৃতজ্ঞ বোধ করে। বাবার অন্তত আপত্তি ছিল না।
রাত সাড়ে আটটার সময় দাবার এক চাল খেলা শেষ করল ঝুমকি আর অনীশ। জমল না। তারা কেউ মন দিয়ে চাল দেয়নি, কেউ জিততে চায়নি, ভুল চাল ফেরত নেয়নি। মাত্র পনেরো মিনিটে খেলাটা শেষ হয়েছে। ঘুঁটিগুলো নাড়াঘাটা করতে করতে অনীশ বলে, বাবা তোকেই সবচেয়ে বেশী ভালবাসে রে দিদি!
তোকে।
না, তোকে।
আগে আমাকেই বাসততা। এখন তোকে।
মোটেই নয়।
তোর চেয়ে বেশী কিন্তু আমি ভালবাসি বাবাকে।
চ্যালেঞ্জ।
জানিস তো, ছেলেরা বিয়ে করলেই কাত! কিন্তু মেয়েরা মোটেই সেরকম নয়।
বিয়েই করব না।
ওরকম সবাই বলে, আবার করেও। তারপর বউ-পাগলা, স্ত্রৈণ হয়ে সবাইকে ভুলে যায়। মা বাবা ভাই বোন কাউকে আর পাত্তা দেয় না। ছেলেগুলো ভীষণ ট্রেচারাস।
তুই মেয়েদের খুব সাপোর্টার, না?
তা কেন, যা সত্যি তাই বলছি।
শোন দিদি, আজ আমার ঝগড়া করতে ইচ্ছে নেই। মনটা বিগড়ে আছে। তুই একটা কবিতা পড়েছিস, যাতে এই লাইনটা আছে, আঠারো বছর বয়স ভয়ংকর?
ঝুমকি একটু ভ্রূ কুঁচকে বলে, পড়েছি। সুকান্ত। কেন বল তো?
আমার একটুও বাংলা নলেজ নেই। এমন কি আপাও কত কী জানে। আমি কবিতাটা জানিই না!
কবিতাটা হঠাৎ তোর মনে পড়ল কেন?
আজকাল বাবা আমাকে প্রায়ই লাইনটা বলে। কেন বলে তা বুঝতে পারছি না। বাংলা আমি কিছু জানি না।
জানবি কি করে! ইংলিশ মিডিয়মে পড়ে পড়ে ট্যাঁশ গরু তৈরি হয়েছিস যে। আমি তো তোর মতো ইংলিশ মিডিয়মে পড়িনি। বাবা পড়ায়নি। তুই হচ্ছিস ড্যাডিজ ব্লু আইড বয়।
ইংলিশ মিডিয়মে পড়লে ট্যাঁশ গরু হয়? ট্যাঁশ গরু মানে কি বল তো! সামথিং মিক্সড আপ? ক্রস ব্রিড?
তোকে নিয়ে আর পারা যায় না। অনু আর তুই দুটোই ট্যাঁশ-গরু।
বল না!
কবিতাটা পড়েছিস?
বললাম তো বাংলা নলেজ নেই।
ট্যাঁশ গরু একটা মজার কথা। এ ফানি মিক্সড আপ। তবে আসলে ননসেন্স ভার্স।
আর ও কবিতাটা! আঠারো বছর বয়স ভয়ংকর!
ওটা ননসেন্স ভার্স নয়। পোয়েট্রি।
বাবা ওটা আমাকে কেন বলে?
বাবার ভয় আঠারো বয়স হওয়ার পর তুই একটু ওয়াইল্ড হয়ে যেতে পারিস।
ওয়াইল্ড! আমি! আমি তো বরাবর শান্ত ছেলে।
ঝুমকি ভ্রূ কুঁচকে বলল, তাই বুঝি? আজকাল নিজের ক্যারেকটর সার্টিফিকেট নিজেই দিচ্ছিস? তোর কিল ঘুষি, চুলটানার ব্যথা আজও আমার যায়নি, তা জানিস?
ওঃ, তোর কথা তো আলাদা। দিদিদের সঙ্গে ভাইরা সকলেই ওরকম এক-আধটু করে।
ইস, মায়ের কথাগুলো কেমন মনে করে রেখেছে দেখ!
আচ্ছা, আমি সত্যিই ওয়াইল্ড হয়ে যেতে পারি বলে বাবা মনে করে?
বাবা তোকে নিয়ে ভীষণ ভাবে। তাই বলে। আঠারো বছর বয়সটা একটু খারাপ।
এই সময়ে রান্নাঘরে একা অপর্ণা। গ্যাসের উনুনে মাছের ঝোল আর ডাল ফুটছে। রুটি বেলছে কাজের মেয়েটা। রোজ একইরকম একঘেয়ে দৃশ্য। সে এই রান্না করা, খাওয়া, শোওয়া, ওঠা, রান্না করা… ইত্যাদি একটা ছক থেকে বেরোনোর কোনও পথ খুঁজে পায় না। মাকড়সার জাল যেমন এও ঠিক তেমনি। নিজের জালের পরিধিতে দিনের পর দিন আটকে থাকে মাকড়সা। অপর্ণাও কি তাই?
আজ বিকেলেও মণীশকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখতে পেল না অপর্ণা। ডাক্তার বলছে, অবস্থা স্টেবল। কিন্তু তেমন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছে না। আজ মণীশের বস এসেছিল বিশাল একখানা কনটেসা গাড়িতে চেপে, বয়স চল্লিশের নিচে। দারুণ স্মার্ট, পাৰ্শি লোকটা ডাক্তারের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে কথা বলছিল। ইংরিজিতে। অপর্ণা পাশেই ছিল, কিন্তু এক বর্ণও বুঝতে পারেনি। অনীশ বা অনু হলে বুঝত। অপর্ণা ওরকম খই-ফোটা ইংরিজি বুঝতে পারে না। মণীশের বস বনাতওয়ালার আবার বিদেশেই জন্ম, সেখানেই লেখাপড়া।
পুরো না বুঝলেও ভাবসাব এবং গলার স্বর থেকে অনুমান করতে পারে, মণীশের বেঁচে যাওয়ার একটা আউটসাইড চান্স আছে। আউটসাইড চান্স কাকে বলে তা অবশ্য অপর্ণা জানে।
ছেলেমেয়েদের মতো অপর্ণা ভেঙে পড়েনি বটে, কিন্তু তাকে অনেক চাপ নিতে হচ্ছে মনের মধ্যে। অপর্ণা আর কতটা পারবে, তা জানে না। তবে সে পৃথিবীর এবং জীবনের নেতিবাচক দিকটাকে সবসময়ে বড় করে দেখে, সঠিক গুরুত্ব দেয়। তার আশা, ভরসা, স্বপ্ন কখনোই মাত্রা-ছাড়া নয়। মণীশ যেমন আদ্যন্ত স্বপ্নের ঘোরে বাস করে, অপর্ণার তেমনই সবসময়ে কঠিন মাটিতে পা।
মাছের ঝোল বেশী রাখতে নেই, তাহলে রুটির সঙ্গে ওরা ভাল খাবে না। আসলে রুটির সঙ্গে ডিম বা মাংসই ভাল। কিন্তু অপর্ণার সময় হয়নি বাজার করার। ফ্রিজে মাছ ছিল, তাই রাঁধছে। মণীশের অসুখ বলে ওরা হয়তো খাবার নিয়ে কথা তুলবে না। খুশী না হলেও না। ওরা খাবারের স্বাদ পায় না এখন। বাবা ওদের ভুবনময়। বাস্তববাদী অপর্ণা, হিসেবী অপর্ণা, একটু কৃপণ অপর্ণার চেয়ে ওরা অনেক বেশী পছন্দ করে বেহিসেবী, ক্ষ্যাপাটে, স্বপ্নশীল মণীশকে।
সেই একই কারণে কি অপণাও পছন্দ করেনি মণীশকে?
ঘুমচোখে অনুশীলা এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াল, মা, এ সময়ে কি ড্যাডিকে নিয়ে ডিসকাস করা ভাল?
কে ডিসকাস করছে?
ওই তো ওরা করছে। দাদা আর দিদি।
ডিসকাস করলে কী হয়?
এ সময়ে তো ড্যাডি সিক। এখন কি ডিসকাস করা ভাল? সুপারস্টিশন আছে না?
কিসের সুপারস্টিশন?
ডিসকাস করাটা আমার ভাল লাগছে না। আমাদের চুপ করে থাকা উচিত।
তা কেন? ডিসকাস করলে খারাপ কিছু হয় না। তুই আজ সারাদিন বেরোসনি, যা একটু ছাদে ঘুরে আয়।
ছাদটা ভীষণ অন্ধকার। আমি ভয় পাই।।
উঃ, তোর ভয় নিয়ে আর পারি না বাপু। ভয়ে ভয়েই তুই শেষ হয়ে গেলি। বড় হচ্ছিস, এখনও অত ভয় কিসের!
অনু ছলো ছলো চোখে চেয়ে থাকে। জবাব দেয় না।
অপর্ণা বলে, তাহলে যা না, স্টিরিওটা চালিয়ে গান শোন। পিয়াসার ক্যাসেটটা চালা, আমিও শুনতে পাবো।
তার চেয়ে আমি বরং মোহিনীদের বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসি মা? ও রোজ আসে, আমি তো যাই না।
ক’টা বাজে?
পৌনে আটটা মাত্র। কাছেই তো!
একটু দোনোমোনো করে অপর্ণা। পাড়ার একটি কেষ্ট ঠাকুর সম্প্রতি অনুর পিছনে লেগেছে। ঘন ঘন বাড়ির সামনে দিয়ে যাত্ময়াত করে। লেটার বক্সে চিঠিও ফেলে গেছে দু দিন। গুরুতর কিছু নয়। তবু সাবধান হওয়া ভাল।
এত রাতে যাওয়া ভাল দেখবে না।
কেন, কি হয়েছে মা? এক মিনিটের তো রাস্তা!
সেই ছেলেটা যদি পিছু—টিছু নেয়?
নিক না। কী করবে? ওরা তো কাওয়ার্ড টাইপেরই হয়। সামনে আসতে সাহস পায় না। আমি পাত্তাই দিই না।
সে আমি জানি।
ও ছেলেটা একদম হ্যাংলা। মোহিনীর পিছনেও লেগেছিল। ওরকমই চিঠি দিত।
তারপর কী হল?
কী আবার হবে! মোহিনী পাত্তা দেয়নি, তাই আর পিছনেও লাগে না। তুমি ভয় পেও না।
যা তাহলে। মনটা একটু ভাল লাগবে। ছাতা নিয়ে যাস। বৃষ্টি আসতে পারে। আধঘণ্টার মধ্যে ফিরবি।
ঠিক আছে।
মোহিনী তোর কেমন বন্ধু?
জাস্ট বন্ধু।
ওরা ভাল লোক তো?
খুব ভাল। ওর বাবা ফার্মার ছিল।
কী ছিল?
ফার্মার। চাষ-টাস যারা করে।
চাষা নাকি?
ঠিক তা নয়। তবে ওরকমই। ওদের গ্রামটা ভীষণ নাকি অজ পাড়া গাঁ। শেয়াল ডাকে।
কে থাকে সেখানে?
সবাই। মোহিনী বলেছে ওর দাদু-টাদু সব সেকেলে আর আনএডুকেটেড।
কিন্তু ওর বাবা তো বিরাট চাকরি করে! বিদেশে যায় শুনেছি।
ওর বাবা একজন প্রাইম এনভিরনমেন্টালিস্ট।
সেটা আবার কী?
ও তুমি বুঝবে না। নাইস ম্যান। খুব শান্ত, ঠাণ্ডা, ভেরি আন্ডারস্ট্যান্ডিং। ঠিক আমার বাবার মতোই।
চাষা ছিল বলছিস?
খুব গরিব। ওদের সঙ্গে একদম মেলে না। সম্পর্কও নেই।
তাই বল!
যাবো মা?
যা।