অধ্যায় ৯৮
“কেবলই মিস জলির সাথে কথা হলো,” বলল ক্যামিল।
লেসাজ তার দিকে তাকালো। ভদ্রতা এখন ক্রোধে রূপ নিয়েছে।
“সব জায়গাতে নাক গলানো আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, আপনি—”
“নিজের ভাল চাইলে বাকিটুকু আর বলবেন না। আপনাকে বেশিক্ষণ রাখার কোনো ইচ্ছাই নেই আমার। মিস জলির দেয়া বক্তব্যের সত্যতা যাচাই বাছাই করে দেখা হচ্ছে। যদি তার বক্তব্য সঠিক প্রমাণিত হয় তাহলে আপনি ছাড়া পেয়ে যাবেন।”
“যদি না হয়?”
“তাহলে আর কী করার আছে। কয়েকটা খুনের আসামী হিসেবে আপনার নামে মামলা হবে। বাকিটা আপনি তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। বলতে পারবেন।”
“আমার বোনের খাতিরে কিছু বলতে পারবো না আমি।”
“আপনি ওসব নিয়ে ভাববেন না। যদি আপনি সত্য বলেন এবং তা প্রমাণিত হয় তাহলে আপনার সব তথ্যই গোপন থাকবে। এটার নিশ্চয়তা আমি দিচ্ছি। আপনার বোনকে যা খুশি বলতে পারেন।”
লেসাজকে দেখে মায়া হলো ক্যামিলের। তাকে কিছু খাবার দেয়ার কথা বলে বেরিয়ে গেলো সে।
*
অফিস থেকে হসপিটালে ফোন করলো ক্যামিল। স্ত্রীর সাথে কথা বলার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।
“ওর সাথে কি কোনো মোবাইল আছে?” রিসিভারে হাত রেখে এলিজাবেথকে জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
“স্যুটকেসে দিয়েছিলাম আমি। চিন্তার কিছু নেই।”
ঠিক এই জিনিসটারই ভয় করেছিলো সে।
“না,” ফোনের ওপাশ থেকে জবাব এলো। “যেমনটা বলেছিলাম মিসেস ভেরহোভেনকে চারটার দিকে ছেড়ে দেয়া হয়। উনি একটু পরেই
বেরিয়ে যান। কেন, কোন সমস্যা হয়েছে?”
“না, কোন সমস্যা হয়নি। আপনাকে ধন্যবাদ,” এই বলে ফোন রেখে দিলো সে।
“লুইস, গাড়ি বের করো। এখনি বাসায় যেতে হবে,” উত্তেজিত কণ্ঠে বলল ক্যামিল।
অধ্যায় ৯৯
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বাসার সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠছে ক্যামিল, কানে এখনো মোবাইল ফোন ধরে আছে। এখনো আশায় আছে আইরিন তার কল রিসিভ করবে। এরইমাঝে দরজার কাছে পৌঁছে দেখলো তা অর্ধেক খোলা। তখনো ফোন বেজে যাচ্ছে। সাথে সাথে বেডরুমে চলে গেলো স্ত্রীকে খুঁজতে। রান্নাঘরেও পেলো না তাকে। অন্যরুমে যেয়ে আইরিনের স্যটকেস ওলটপালট অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তার বুকের কাঁপুনি বেড়ে গেলো। নাইটড্রেস, মোবাইল ফোন সবকিছু মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
জানালার পাশে থাকা বুকশেলফ কাত হয়ে আছে, বইগুলো একেকটা একেক জায়গায় পড়ে আছে।
হুট করেই চাপা আতঙ্ক ভর করলো তার মাঝে। রক্তের সরু রেখা একদম বাথরুম অবধি চলে গিয়েছে।
বাথটাবের এক কোণায় রক্তের ছোটখাটো পুকুর তৈরি হয়েছে। বাথরুমের আয়না থেকে শুরু করে সব জিনিসপত্র পড়ে আছে নানান জায়গায়।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকটা সম্মোহিত অবস্থায় কাকে যেন ফোন করলো সে।
ওপাশ থেকে রিসিভ করার সাথে সাথে ক্যামিল বলে উঠলো, “লুইস! তাড়াতাড়ি আসো। লুইস, এখনি…” কথা শেষ করতে পারলো না। মুখ দিয়ে শুধু চাপা গোঙানি বেরিয়ে এলো।
কানে এখনো ফোন ধরে আছে।
অধ্যায় ১০০
ছয় মিনিটের মাঝেই ক্রিমিনাল ব্রিগেডের সবাই চলে এলো।
ঘরে ঢুকতেই কারো বোঝার বাকি রইলো না একটু আগে কী ঝড় বয়ে গেছে। সোফায় নির্লিপ্ত ভাবে পড়ে আছে ক্যামিল। লুইস আলতো করে ক্যামিলের হাত থেকে ফোনটা নিলো যেন কোন ঘুমন্ত বাচ্চার কাছ থেকে খেলনা নিচ্ছে।
“আইরিন নেই…” পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে ক্যামিল। বাথরুমের দিকে আঙুল তাক করলো সে।
“ওখানে রক্তের নমুনা আছে।”
“কেউ কোন কিছু ধরবে না,” খালি হাতে একটা ড্রয়ার খুলে দেখছিলো মেদি, তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল লুইস।
“এই নাও। এটা ব্যবহার করো,” এই বলে ম্যালেভাল তার দিকে একজোড়া গ্লাভস ছুঁড়ে দিলো।
“এক্ষুণি ফরেনসিক টিম পাঠানোর ব্যবস্থা করুন,” ফোনে কাউকে নির্দেশ দিলো এলিজাবেথ।
“ফোনটা আমাকে দাও,” এই বলে ফোন নিয়ে নিলো লা গুয়েন। “দশ মিনিটের মাঝে আমি সবাইকে এখানে দেখতে চাই। যত অফিসার আছে সবাইকে পাঠাও। আর মরিনকে বলো যত দ্রুত সম্ভব আমার সাথে যোগাযোগ করতে।”
এবার নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে আরেকটা কল করলো লা গুয়েন।
“লা গুয়েন বলছি, জাজ দেশমের সাথে কথা বলতে চাই। তাকে ফোন রাখতে বলল। এক্ষুণি যেন আমার সাথে কথা বলে।”
লুইসের পাশে এসে দাঁড়ালো ম্যালেভাল।
“এক্ষুণি’ শব্দের মানে জানো না তুমি?” চিৎকার করে বলল লা গুয়েন।
টিমের সব সদস্যকে দেখে কিছুটা মানসিক বল পেলো ক্যামিল।
“হসপিটাল থেকে চারটা পাঁচে বের হয় আইরিন। এরপর এখানেই আসার কথা ছিলো,” কথাগুলো ক্যামিল এতোটা আস্তে বলল সবাই ঠিকমতো শুনতে পেলো না। “এলিজাবেথ তুমি বিল্ডিংয়ের বাকি অ্যাপার্টমেন্ট গুলো দেখে আসো,” হুট করেই বলল সে।
গত গ্রীষ্মের ছুটিতে স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলো। তারই একটা ছবি ম্যালেভালের হাতে দিলো।
“অনেকগুলো কপি লাগবে। আমার অফিসে ফটোকপি মেশিন আছে। সবুজ বাটনে চাপ দিলেই হবে।”
ম্যালেভাল এক মুহূর্ত দেরি করলো না।
“মেদি, তুমি আর ম্যালেভাল নিচে চলে যাও। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করবে। ছবিটা মনে করে নিয়ে যেয়ো। আইরিন গর্ভবতী ছিলো তাই কারো না কারো চোখে পড়বেই। তাছাড়া ওর শরীর দিয়ে রক্তও ঝড়ছিলো। আরম্যান্ড, তুমি ক্লিনিকে চলে যাও। ওখানকার সব জায়গায় খোঁজ নেবে। অন্যান্য টিম চলে এলে আমি পাঠিয়ে দেবো। লুইস, তুমি অফিসে বসে সব টিমের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করবে। কবকে প্রস্তুত থাকতে বললো। ওর সাহায্য খুব দরকার।”
“তুমি ঠিক আছে তো?” জিজ্ঞেস করলো লা গুয়েন।
“আইরিনকে খুঁজে পেলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
লা গুয়েনের ফোন বেজে উঠলো।
“তোমার সাথে এখন কয়জন অফিসার আছে?” মরিনকে জিজ্ঞেস করলো সে। “আমার সবাইকে প্রয়োজন। হ্যাঁ, সবাইকেই। এখনি সবাইকে পাঠিয়ে দাও আর তুমি নিজেও চলে আসো ক্যামিলের বাসায়।”
“ক্যামিল, তোমাকে কিছু কথা বলার ছিলো।”
“কী বলতে চান?”
“দেখো, তুমি জানো আমি কী বলববা…দেশমকে তো ভালোমতোই চেনো তুমি। এই কেসের দায়িত্ব থেকে তোমাকে অব্যাহতি দেয়া হবে। এখন থেকে মরিন এই কেসের তদারকি করবে।”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো ক্যামিল।
“তুমি মরিনকে চেনো। ও বেশ ভাল অফিসার। এই কেসের সাথে তোমার ব্যক্তিগত জীবন জড়িয়ে গেছে, ক্যামিল।”
গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো ক্যামিল।
“আমার জায়গায় অন্য কেউ হলেই তো হবে, তাই না?”
“আমি দুঃখিত, ক্যামিল। এমন কাউকে লাগবে যে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত না।”
“সেক্ষেত্রে আমি আপনাকে চাই।”
“কী বললে…?”
সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উঠে আসার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। দরজা খোলার সাথে সাথেই বার্গেরেটকে দেখতে পেলো ক্যামিল।
“বেশি সময় লাগবে না, ক্যামিল। সব ফরেনসিক অফিসারকে নিয়ে এসেছি।”
ক্যামিল জবাব দেয়ার আগেই বার্গেরেট ঘুরে দাঁড়ালো। উপস্থিত সবাইকে তাদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে।
“এসব তুমি কী বলছে, ক্যামিল?” বলল লা গুয়েন।
“আপনি দায়িত্ব নিলে আইনগত কোন বাঁধা থাকবে না। তাই আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করবেন না।”
“দেখো, ক্যামিল, আমি অনেক আগেই এসব কাজ ছেড়ে দিয়েছি। আগের মত অবস্থা নেই আমার তা তুমি ভালোমতোই জানো। সুতরাং আমাকে বলে কোনো লাভ হবে না।”
“হয় আপনি নিবেন নয়তো কেউই না।”
“সত্যি বলছি, ক্যামিল, আমার মনে হয় না…”
“তাহলে কেউই পাবে না এই কেসের দায়িত্ব। আপনি কি কেসটা নেবেন?”
“আগে আমার পুরো কথাটা শুনো…”
“নেবেন নাকি নেবেন না?”
“হ্যাঁ, কিন্তু …”
“আমার জন্য হলেও দায়িত্ব নিয়ে ফেলুন।”
“ঠিক আছে, আমি রাজি।”
“ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না আপনাকে। কেসের দায়িত্ব তাহলে আপনিই নিচ্ছেন। আপনার পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই।”
“কিছুক্ষণ আগে তো আমি একই কথা বললাম,” বিস্মিত হয়ে বলল লা গুয়েন।
“সেক্ষেত্রে আপনার একজন দক্ষ অফিসার লাগবে। আপনার প্রস্তাব আমি গ্রহণ করলাম।”
লা গুয়েন কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে আছে।
“বার্গেরেট! তোমার কী করতে হবে আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”
পকেট থেকে ফোন করে কাউকে কল করলো লা গুয়েন।
“লা গুয়েন বলছি, এখনি জাজ দেশমকে ফোনটা দাও।”
অধ্যায় ১০১
মরিনের টিমের বাকি সদস্য কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলো। লা শুয়েন, ক্যামিল আর মরিন আলাদা ঘরে ছোটখাটো বৈঠক করলো।
“আমার নেতৃত্বে আইরিন ভেরহোভেনের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে তদন্ত চলবে। পুলিশ আর কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেনের মাঝে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্বও আমি নিয়েছি। এ ব্যাপারে কারো কোনো মতামত আছে?”
লা গুয়েন কথা শেষ করার পর সবাই চুপ করে রইলো।
“তুমি যেমনটা চেয়েছিলে, ক্যামিল,” সবশেষে বলল লা গুয়েন।
এরইমাঝে ফরেনসিক টিমের সব সদস্য ঘটনাস্থলে চলে এলো। দুজন অফিসার ক্যামিলের অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে আর দুজন নিচে থেকে পাড়া প্রতিবেশীর দিকে লক্ষ্য রাখছে।
“কিছুই পেলাম না। চারটা থেকে এখন অবধি কেবল চারটা অ্যাপার্টমেন্টে মানুষ ছিলো। বাকি সবাই এখনো কাজে।”
নিজের বাড়ির আশেপাশের চারদিক কখনো খেয়াল করে দেখেনি ক্যামিল। বাড়ির পাশের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে দেখলো বের হওয়ার সব রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে পুলিশের গাড়ি।
ঠিক তখনি এলিজাবেথ এক বৃদ্ধাকে ধরে নিয়ে আসলো। তাকে দেখে পরিচিত মনে হলেও নামটা মাথায় আসলো না ক্যামিলের।
“মিস অ্যান্টোনাপোলস,” বৃদ্ধাকে পরিচয় করিয়ে দিলো ম্যালেভাল।
“অ্যান্টানোপোলস,” শুধরে দিলো বৃদ্ধা।
“তার ধারণা সে দেখেছে। বাড়ির সামনে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিলো আর আইরিন তাতে চড়ে বসেছিলো।”
ক্যামিলের হৃদপিণ্ডে কে যেন হাতুড়িপেটা করছে। চোখ বন্ধ করে মন থেকে বিভৎস ছবিগুলো সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করলো।
বৃদ্ধা যা যা দেখেছে তা জানতে চাইলো ক্যামিল। পরপর দুইবার একই দৃশ্য বর্ণনা করলো ওই বৃদ্ধা।
“বিকাল চারটা পয়ত্রিশের দিকে কালো রঙের একটা গাড়ি এসে বিল্ডিঙয়ের সামনে দাঁড়ায়। লম্বা মতন একটা লোক বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে যাকে আমি পেছন থেকে দেখছি। পাশেই গাড়িটা পার্ক করে রাখে যাতে করে যানজট বেঁধে না যায়। আবার যখন তাকাই তখন দেখি গাড়ির পেছনের দরজা খোলা। কোনো এক মহিলা উঠছিলো গাড়িতে কিন্তু আমি শুধু পা দেখতে পেয়েছি। এরপর অন্য একটা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পরে তাকিয়ে দেখি গাড়িটা নেই।”
“মিস অ্যান্টানোপোলস, আপনি কি কষ্ট করে আমার সহকর্মীদের সাথে যাবেন? আপনার সাহায্য খুব দরকার।”
যা দেখেছে সব বলে দেওয়ার পরেও পুলিশ তাকে কেন নিয়ে যেতে চাচ্ছে বুঝতে পারলো না সে।
“ম্যালেভাল, তুমি সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করো। রাস্তায় যারা কাজ করে তাদের সাথে কথা বলো। ওদের মাঝে কেউ না কেউ অবশ্যই কিছু দেখেছে।”
অধ্যায় ১০২
সব অফিসারের মাঝে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। আইরিন ভেরহোভেনকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। কৰ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন টিমের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা যাচাই করছে সে।
লুইস তার সাথে তরুণ এক অফিসারকে নিয়ে সব কাগজপত্র ঘেটে দেখছে। ক্যামিলের ডেস্কের উপর সব কেসের ফাইল খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। অফিসে আসার পর বেশিরভাগ সময় ফোনে কথা বলে পার করেছে সে। ড, ক্রেস্টকে ফোন দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব চলে আসতে বলল।
কিছুক্ষণের মাঝে ক্রেস্ট চলে এলো। ক্যামিলকে দেখে ভয় পেলো সে। শরীর কেমন যেন ভেঙে পড়েছে, চোখের নিচে কালো দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
“আমি দুঃখিত…” নিচুস্বরে বলল ক্রেস্ট।
নভেলিস্ট এর পাঠানো সর্বশেষ চিঠি নিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো ক্রেস্ট।
ক্যামিল খেয়াল করলো কানে ইয়ারফোন নিয়ে কাজ করছে কব। ফোন আসলেও যাতে টাইপিং না থামে তাই এই ব্যবস্থা নিয়েছে। সবাইকে এতোটা কঠোর পরিশ্রম করতে দেখে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করলো সে। লুইস কিছু বলার জন্য রুমে ঢুকলেও ক্যামিলের অগ্নিমূর্তি দেখে কিছু বলে বেরিয়ে গেলো।
“নতুন কিছুই পাইনি। এলিজাবেথ ওই বৃদ্ধার সাথে কথা বলছে। আপনাকে যা বলেছে তাছাড়া আর কিছুই মনে নেই তার। তবে এতোটুকু বলতে পেরেছে গাড়ি পার্ক করার পর পনেরো মিনিট ছিলো সেখানে।”
“লেসাজের কী খবর?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
“দেশমের সাথে কথা হয়েছে লা গুয়েনের। তাকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ পাই আমি। বিশ মিনিট আগে চলে গিয়েছে সে।”
ক্যামিল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো আটটা বিশ বাজে।
সব টিমের কাছ থেকে তাদের অগ্রগতি সম্পর্কে রিপোর্ট নিলো কব।
হাসপাতালে গিয়ে আরম্যান্ড জানতে পেরেছে আইরিন স্বেচ্ছায় বের হয়ে গিয়েছিলো। ওই সময়ে দায়িত্বে থাকা দুইজন নার্স আর নিরাপত্তারক্ষীর ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করলো সে। কিন্তু ওদের শিফট আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে বলে ওদের সাথে কথা বলতে পারেনি। তবুও হাল ছাড়েনি সে। চারটা টিম চারজনের বাসার ঠিকানায় চলে গেছে। কিন্তু তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে অস্বাভাবিক কিছুই খেয়াল করেনি। তারা। আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ফলাফলও শূন্য। কেউ কিছু দেখেনি।
রাত নয়টার একটু আগে ঘটনাস্থল থেকে ফিরে এলো বার্গেরেট। অপহরণকারী কোনো গ্লাভস ব্যবহার করেনি। আইরিন এবং ক্যামিল ছাড়াও অজ্ঞাতনামা আরো কয়েকটা আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছে।
“সতর্কতামূলক কিছুই ব্যবহার করেনি। এসব সে পরোয়াই করে না। এটা মোটেও শুভ লক্ষণ নয়।”
সাথে সাথে বুঝতে পারলো কথাটা বলা উচিত হয়নি তার।
“আমি দুঃখিত…সত্যিই দুঃখিত… বিড়বিড় করে বলল সে।
“না। ঠিক আছে,” বার্গেরেটের কাঁধে হাত রেখে বলল ক্যামিল।
“আমাদের তথ্যভাণ্ডারের সাথে মিলিয়ে দেখেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।”
পুরো দৃশ্যটা কল্পনা করা বেশ কঠিন। তবুও চেষ্টা করছি।
“সম্ভবত অপহরণকারী কলিং বেল বাজানোর পর আপনার স্ত্রী দরজা খুলে দেয়। স্যুটকেসটা হয়তো…দেয়ালের পাশে…না…সোফার পাশে ছিলো…তারপর লাথি…”।
“শোনো এভাবে এগুলে কিছুই হবে না। তুমিও কিছু করতে পারবে না, আমিও না। আপনার স্ত্রী, আপনার স্ত্রী বলে গলা না শুকিয়ে সরাসরি আইরিন বলতে পারো। যা বলার সোজাসাপটা বলে ফেলল। লাখির…পর থেকে শুরু করো। “
“আইরিন দরজা খোলার সাথে সাথেই আঘাত করে সে।”
কথাটা শোনার সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ফেললো ক্যামিল।
“আমার মনে হয় বিস্তারিত তথ্য মরিনকে দিলেই ভাল হবে,” বলল ড. ক্রেস্ট।
ক্যামিল কিছুই শুনছিলো না। চোখ খুলে উঠে দাঁড়ালো সে। ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে পরপর দুই গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেয়ে নিলো। কোনো দিকে না তাকিয়ে বার্গারেটের পাশে এসে বসলো।
“সে কলিংবেল বাজানোর পর আইরিন দরজা খুলে দিলো। এরপর আইরিনকে লাথি মারলো সে। এসব কীভাবে হলো? কারো কাছে কোননা ব্যাখ্যা আছে?”
“পিত্ত আর লালার নমুনা পাওয়া গেছে। বমি বমি ভাব হওয়ায় সে বমি করে দেয়।”
“কোথায় লাথি মেরেছিলো তা জানার কোনো উপায় আছে?”
“না, তেমন কিছু পাইনি আমরা।”
“ঠিক আছে। তারপর?”
“সাথে সাথে আইরিন ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে, সম্ভবত জানালার ওদিকে ছুটে যায়। পর্দাটাও হয়তো সে টান দিয়েছিলো। ওই লোক পিছু পিছু দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় তাকে। স্যুটকেসে মাথা ঠুকে যায় আইরিনের আর সাথে সাথে তা খুলে গেলে সব জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। জীবন বাঁচাতে আইরিন বাথরুমের দিকে ছুটে যায় আর সেখানেই অপহরণকারী তাকে আটকে ফেলে।”
“মেঝেতে রক্তের কারণ কী?”
“সম্ভবত মাথায় আঘাত পেয়েছিলো। গুরুতর না হলেও তাকে স্তব্ধ। করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। রক্তক্ষরণ হওয়ার কারণে মেঝেতে পড়ে যায় সে। বাথরুমের সব জিনিসপত্র আইরিনই আত্মরক্ষার সময় ফেলে দিয়েছিলো। এরপর কী হয়েছিলো আমরা জানি না। শুধু এতোটুকু জানি সবশেষে অপহরণকারী আইরিনকে দরজা অবধি টেনে নিয়ে আসে। বের হওয়ার আগে পুরো অ্যাপার্টমেন্ট একবার ঘুরে দেখে সে। আর সেই সময়ে বাকি কাজগুলো করেছে। বেডরুম, রান্নাঘর সহ আরো কয়েকটা রুমে গিয়েছিলো সে।”
“কী কাজ?”
“রান্নাঘরে কয়েকটা ড্রয়ার খুলে দেখেছে সে। জানালা আর ফ্রিজেও তার আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছে।”
“এমনটা করার কারণ কী?”
“বাসাটা ঘুরে দেখছিলো। রান্নাঘরে থাকা একটা গ্লাস আর পানির কলেও তার আঙুলের ছাপ আছে।”
“আইরিনের জন্য নিয়ে গিয়েছিলো?”
“আমারও তাই মনে হয়। সম্ভবত খাওয়ার জন্য আইরিনকে পানি দিয়েছিলো সে।”
“অথবা মুখে মেরেছে?”
“না, আমার তা মনে হচ্ছে না। পানি ছলকে যাওয়ার কোন নমুনা দেখিনি আমরা। তার মানে আইরিন পানি পান করেছিলো। আইরিনের কিছু চুলও পেয়েছি আমরা, তারমানে চুলের মুঠি ধরে ছিলো সে। এছাড়া আর কিছুই জানি না আমরা।”
“আর কিছু?” বার্গেরেটের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
“অপহরণকারীর চুলের নমুনাও পেয়েছি আমরা। হালকা বাদামি রঙের ছোট ছোট চুল। পরীক্ষাগারে তা পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা তার রক্তের গ্রপও জানি।”
“কীভাবে?”
“হয়তো ধস্তাধস্তির সময় আইরিনের নখের আঁচড় লেগে যায় তার। বাথরুমে কয়েকফোঁটা রক্ত পড়ে ছিলো। রক্তের গ্রুপ ও পজেটিভ।”
“বাদামি রঙের ছোট ঘোট চুল। রক্তের গ্রুপ ও পজেটিভ। আর কিছু?”
“আপাতত এতোটুকুই বের করতে পেরেছি। আমরা
“ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ,” কথা শেষ হওয়ার আগেই এই বলে বেরিয়ে গেলো ক্যামিল।
অধ্যায় ১০৩
রাত নয়টার দিকে সবাই ক্রিমিনাল ব্রিগেডের অফিসে চলে এলো। কাজের অগ্রগতি জানার জন্য ছোটখাটো একটা মিটিং হলো। ফলাফল খুবই হতাশাজনক। এখনো সামনে আগানোর মত কোন সূত্রই পাওয়া যায়নি। নভেলিস্ট এর শেষ চিঠি আবারো পড়তে শুরু করলো ক্রেস্ট। লা গুয়েন চেয়ারে বসে কিছু একটা ভাবছে।
“আপনাকে নিয়ে খেলতে পছন্দ করে খুনি। প্রতিটা চিঠির শুরুতেই একটু রহস্য রেখে দেয় যেন কোন খেলা খেলছে আপনার সাথে। শুরুতে যা ভেবেছিলাম এই চিঠি তারই প্রমাণ।”
“কিসের কথা বলছো? ব্যক্তিগত আক্রোশের কথা?” জিজ্ঞেস করলো লা গুয়েন।
“ঠিক তাই। আপনি কী ভাবছেন তা আমি জানি। কিন্তু আপনি ভুল ভাবছেন। বিষয়টা এমন না যে খুনি আগে কখনো কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেনের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলো। ক্যামিলের দেয়া প্রথম বিজ্ঞাপনের পর থেকেই খুনি ব্যাপারটা ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছে। প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে ক্যামিল যেভাবে বিজ্ঞাপন দিয়েছে এমনকি বাসার ঠিকানা এবং নিজের নামও গোপন করেনি, খুনি এটাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে।”
“কী বোকার মত কাজ করেছি আমি,” বিড়বিড় করে বলল ক্যামিল।
“এমন যে হবে তা কে জানতো, ক্যামিল। তাছাড়া আমার আর তোমার মত লোকের বাসার ঠিকানা খুঁজে বের করা খুব একটা কঠিন কাজ
কিছু সময়ের জন্য পেছনে ফিরে গেলো ক্যামিল। কেসটাকে কীভাবে ব্যক্তিগত সংঘাতের দিকে নিয়ে গেছে তা ভেবেই তার গা শিউরে উঠছে। জাজ দেশমের সাথে আলাপচারিতার কথা মনে পড়লো তার। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য এতো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়ার কী দরকার ছিলো?
“সে শুরু থেকেই জানতে কী করতে যাচ্ছে। আমরা কেসটাকে যেভাবেই নেই না কেনো নিজের পরিকল্পনা থেকে একচুলও নড়েনি সে। তার চিঠিতেই বলা আছে আমার তৈরি করা গোলকধাঁধায় আপনি অসহায়ের মত ঘুরপাক খাচ্ছেন। এখানে থেকে তখনি মুক্তি পাবেন যখন আমি চাইবো। “
“আমি সেটা জানি। কিন্তু কখনোই বুঝতে পারিনি টার্গেট আমি না আইরিন।”
“আমিও হয়তো বুঝতে পারতাম না,” সমবেদনা জানালো ক্রেস্ট।
“চিঠির শেষাংশ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেখানে গ্যাবোরির বইয়ের কিছু লাইন তুলে দিয়েছে সে।”
“নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছে, তাই তো? আমি সেটা জানি।”
“এখানেই আপনি ভুলটা করেছেন।”
কথাটা বলার সাথে সাথেই ডাক্তারকে দেখার জন্য একইসাথে ঘুরলো ক্যামিল আর লুইস।
“আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?”
“আমার তাকে পাগল মনে হয়নি। আপনি যেমন চাচ্ছিলেন ভয়াবহ মানসিক বিকৃতগ্রস্থ একজন যে বাস্তব আর কল্পনার জগতের ফারাক জানে না, নিজেকে সেভাবেই উপস্থাপন করেছে সে। কিন্তু আমার মনে হয় এটা তার পরিকল্পনারই একটা অংশ। চিঠিতে যেমনটা বর্ণনা করেছে সেটা তার আসল রূপ নয়। আসলে সে চায় আপনি তার সম্পর্কে এই ধারণা নিয়ে থাকুন যে সে পাগল।”
“এমন করার কারণ কী?” লুইস জিজ্ঞেস করলো।
“আমি জানি না। মানবিকতা, শিল্পকলা এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছে সে। যা ভাবছে তা সে বলছে না। কিন্তু কেন এমন করেছে তা
আমিও বুঝতে পারছি না।”
“তার আসল উদ্দেশ্য থেকে দূরে রাখার জন্য?”
“সম্ভবত। অন্য কারণও থাকতে পারে।”
“যেমন?”
“হতে পারে এটা তার পরিকল্পনারই অংশ।”
*
কেস ফাইলগুলো কয়েকটা টিমের মাঝে ভাগ করে দেয়া হলো। শুরু থেকে শেষ অবধি কেস ফাইলগুলো পড়ে সবগুলো বক্তব্য আর প্রমাণ আবারো মিলিয়ে দেখার জন্য দুজন অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া হলো। কবের ডেস্কে নতুন তিনটা কম্পিউটার বসানো হচ্ছে।
ক্যামিল, লা গুয়েন আর লুইস মিলে তদন্তের মূল বিষয়গুলো আবারো খতিয়ে দেখছে। ক্যামিল বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। পাঁচ ঘণ্টা হয়ে গেছে এখনো আইরিনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ক্যামিলের অনুরোধে হোয়াইটবোর্ডে খুনির সব শিকার, স্থান আর তারিখের একটা লিস্ট করলো লুইস। ড. ক্রেস্ট গভীর মনোযোগে লিস্টের দিকে তাকিয়ে আছে।
“এখান থেকে কিছুই পাবো না আমরা। এসবই তার ‘আগের কাজ’র লিস্ট।”
“না। এখান থেকেই তার পরবর্তি লক্ষ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এরপর কোন বই অনুসরণ করবে সে?”
ব্যালাঞ্জারের দেয়া লিস্ট নিয়ে আসলো লুইস। “এখানে তো অনেকগুলো বইয়ের নাম দেয়া…” ক্রেস্ট বলল।
“অনেক হতে পারে, কিন্তু এই লিস্টেই ওই উপন্যাসের নাম থাকার কথা অথবা…”
কিছুক্ষণের জন্য বিরতি নিলো ক্যামিল।
“…এমন উপন্যাস যেখানে গর্ভবতী নারীর কথা বলা আছে। লুইস?”
“এখানে নেই,” জানালো লুইস।
“একটা না একটা থাকার কথা।”
“আমি তো দেখলাম না।”
“এখানেই থাকা উচিত,” চিৎকার করে উঠলো ক্যামিল, লুইসের হাত থেকে কাগজটা কেড়ে নিলো।
দ্রুতগতিতে পড়ে ফেললো সে।
“এই লিস্টে নেই, লুইস, আরেকটা লিস্ট আছে না?”
“ওহ, তাই তো। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম…” ব্যালাঙ্গারের দেয়া অন্য আরেকটা লিস্ট খুঁজে নিয়ে আসলো লুইস।
“এখানেই আছে,” এই বলে কাগজটা ক্যামিলের হাতে দিলো সে।
কাগজটা পড়ার সাথে সাথে প্রফেসর ব্যালাঞ্জারের সাথে কথোপকথনের কথা মনে পড়লো তার “আমার এক ছাত্রের মনে হয় ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসের ওই কেস যেখানে এক গর্ভবতী নারীর পেট কেটে নাড়িভুড়ি বের করে ফেলা হয় তা একটা বইয়ের সাথে মিলে যায়। বইটার নাম শ্যাডো প্লেয়ার, লিখেছে চাব অথবা হাব নামের কেউ। যদিও আমি কখনো তার নাম শুনিনি।”
*
“আমি বুঝতে পারছি দেরি হয়ে গেছে, প্রফেসর ব্যালাঞ্জার…”
একটু দূরে গিয়ে পুরো বিষয়টা তাকে ব্যাখ্যা করলো লুইস। এরপর ফোনটা ক্যামিলের হাতে দিয়ে দিলো।
“আমার মনে আছে, কিন্তু তখনি তো বলেছিলাম বইটার নামও শুনিনি কখনো। সত্যি বলতে আমার ওই ছাত্রও এ ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী ছিলো না। এছাড়া আর কী-”।
“বইটা আমার লাগবে, প্রফেসর ব্যালাঞ্জার, এখনি লাগবে। আপনার ওই ছাত্র কোথায় থাকে?
“আমি জানি না। আমার অফিসের রেজিস্টার দেখে বলতে হবে।”
“ম্যালেভাল! গাড়ি নিয়ে প্রফেসর ব্যালাঞ্জারের বাসায় যাও। সেখান থেকে তাকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। ওখানে দেখা হবে তোমার সাথে।”
ক্যামিলের আদেশ শুনে এক মুহূর্ত দেরি করলো না ম্যালেভাল।
আরম্যান্ড আর এলিজাবেথ প্যারিসের মানচিত্রে কয়েকটা জায়গা চিহ্নিত করে দিয়েছে। সেখানে অবস্থিত প্রায় ত্রিশটা গুদামঘরের বিস্তারিত তথ্যসমৃদ্ধ একটা লিস্ট তৈরি করে ফেলেছে কব। এদেরকে দুইভাগে ভাগ করা হলো। প্রথম লিস্টে সেই সব গুদামঘরের নাম আছে যা একদম জনবিচ্ছিন্ন এলাকায় এবং অনেকদিন যাবত পরিত্যাক্ত। দ্বিতীয় লিস্টটা করা হয়েছে সতর্কতা অবলম্বন করে যাতে কোনোটা বাদ না পড়ে।
“আরম্যান্ড আর মেদি তোমরা কবের সাথেই থাকো। এলিজাবেথ, উপস্থিত অফিসারদের দুই গ্রুপে ভাগ করে দাও। লিস্টের সবগুলো গুদামঘর যেন চেক করা হয়। চাব অথবা হাব নামের এক লেখকের একটা বই আছে। ‘শ্যাডো সেয়ার’, এই বইটা আমাকে খুঁজে দিতে হবে, কব। অনেক পুরনো বই। আর কিছুই জানা নেই আমার। আমি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছি, কোনো দরকার হলে ফোন করবেন। লুইস, তাড়াতাড়ি চলো।”
অধ্যায় ১০৪
রাতের বেলায় সোডিয়াম লাইটের আলোয় ভিন্ন এক রূপ ধারণ করেছে। ব্যালাণ্ডারের কর্মস্থল। ক্যামিল আর লুইস প্রায় দৌড়ে দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকলো। কিছুক্ষণের মাঝেই প্রফেসর ব্যালাঞ্জারকে নিয়ে হাজির হলো ম্যালেভাল।
ব্যালাঞ্জারের সাথে হাত মেলালো ক্যামিল। ঘটনার আকস্মিকতা আর ম্যালেভালের গাড়ি চালানোয় কিছুটা হতবাক সে।
“এতো রাতে আসার জন্য ধন্যবাদ,” বলল ক্যামিল।
“আপনাকে স্বাগত-” বাক্যটা শেষ হওয়ার আগেই হাঁটা শুরু করলো ক্যামিল। এদিকে ম্যালেভাল নিরাপত্তা রক্ষীকে এতো রাতে আগমনের কারণ ব্যাখ্যা করছে। অফিসে ঢুকেই ‘জি’ আদ্যক্ষরের একটা ফাইল বের করলো ব্যালাঞ্জার।
ক্যামিলের ফোন বেজে উঠলো।
“ভাগ্য খুবই খারাপ। ওই বই সম্পর্কে কিছুই পেলাম না,” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানালো কব।
“এটা অসম্ভব,” রাগান্বিত স্বরে বলল ক্যামিল।
“২১১ টার বেশি সার্চ ইঞ্জিনে খোঁজ নিয়ে দেখেছি। বইটা সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত তো?”
“একটু অপেক্ষা করুন, আমি জানাচ্ছি।”
‘সিলভিয়ান গুইনার্ড নামের একটা ফাইল বের করে আনলো ব্যালাঞ্জার। ফাইলের উপরে ফোন নাম্বার লেখা আছে। সাথে সাথে ফোন করলো ক্যামিল।
“সিলভিয়ান গুইনার্ড?”
“না, আমি ওর বাবা বলছি। আপনি কি জানেন এখন রাত কয়টা বাজে?”
“আমি ক্রিমিনাল ব্রিগেডের কমান্ড্যান্ট ভেরহোভেন। আপনার ছেলের সাথে জরুরি কথা আছে।”
“কী নাম বললেন?”
এবার একটু ধীরে নিজের নাম পরিচয় দিয়ে বলল, “আপনার ছেলেকে এখনি ফোনটা দিন, মঁসিয়ে গুইনার্ড।
পায়ের শব্দ আর ফিসফিসানি শুনতে পেলো ক্যামিল। ওপাশ থেকে তরুণ কারো কণ্ঠ শোনা গেলো।
“সিলভিয়ান বলছো?”
“হ্যাঁ, বলছি।”
“আমি কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন। প্রফেসর ব্যালাঞ্জার আমার সাথেই আছে। আমাদের জন্য বই সম্পর্কিত কিছু কাজ করেছিলে তুমি, মনে আছে?”
“অবশ্যই।”
“তুমি একটা বইয়ের কথা বলেছিলো, মনে আছে?”
“অবশ্যই, থাকবে না কেনো।”
ফাইল মেলে ছেলেটা কোথায় থাকে দেখে নিলো ক্যামিল।
“বইটার কোনো কপি আছে তোমার কাছে?”
“না, এটা অনেক পুরনো বই। আমার শুধু মনে আছে…”
“কী মনে আছে?”
“কেস ফাইল পড়ে আমার এই বইটার কথা মাথায় এসেছিলো।”
“আমার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনো, সিলভিয়ান। বিকেলে প্যারিস থেকে একজন গর্ভবতী নারী অপহৃত হয়। তাকে যত দ্রুত সম্ভব খুঁজে বের করতে হবে। সত্যি বলতে,..ওই নারী আমার…আমার স্ত্রী।
কথাগুলো বলার সাথে সাথে গুমরে কেঁদে উঠলো ক্যামিল।
“বইটা আমার এখনি দরকার।”
“আমার কাছে তো নেই। কমপক্ষে দশ বছর আগে পড়েছি। বইয়ের এবং লেখকের নাম সম্পর্কে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। কিন্তু প্রকাশনীর নাম মনে নেই। শুধু প্রচ্ছদের কথা মনে আছে।”
“কী ছিলো প্রচ্ছদে?”
“পুরো প্রচ্ছদ জুড়ে ভীতসন্ত্রস্ত এক নারী চিৎকার করছে আর পেছন থেকে হ্যাট পড়া এক লোক এগিয়ে আসছে, এরকম কিছু একটা ছিলো।”
“সারাংশ মনে আছে?”
“এক লোক গর্ভবতী নারীকে অপহরণ করে, এটা আমার মনে আছে কেননা এমন বই আমি আগে কখনো পড়িনি। বর্ণনা ছিলো বেশ ভয়াবহ, এছাড়া আর কিছুই মনে নেই আমার।”
“ঘটনাস্থল কেমন ছিলো?”
“সম্ভবত একটা গুদামঘর ছিলো।”
“কী ধরণের গুদামঘর? কোথায়?”
“সত্যি বলছি আমার আর কিছুই মনে নেই।”
“বইটা কী করেছো?”
“গত দশ বছরে তিনবার বাসা বদল করেছি আমরা। এরমাঝে হারিয়ে গিয়েছে কোথাও।”
“আর প্রকাশনী?”
“মনে নেই।”
“তোমার সাথে কথা বলার জন্য একজনকে পাঠাচ্ছি। যা যা মনে পড়ে সব বলবে, বুঝতে পেরেছো?”
“হ্যাঁ।”
“এমন হতে পারে কথা বলতে বলতে নতুন কিছু মনে পড়বে, ছোট একটা তথ্যও খুব প্রয়োজন আমাদের। এরমাঝে তুমি আরেকটু মনে করার চেষ্টা করো। বইটার কথা ভাবো কোথা থেকে কিনেছিলে, কেনার পর কী করেছিলে। স্মৃতি জাগাতে সাহায্য করে এসব বিষয়। যা যা মনে পড়ে লিখে রাখো। আমার ফোন নাম্বার দিচ্ছি। কিছু মনে পড়লে সাথে সাথে জানাবে, ঠিক আছে?”
“ওকে।” ক্রে
স্টকে ফোন করে সিলভিয়ানের বাসায় যেতে বলল ক্যামিল।
“ছেলেটা বেশ বুদ্ধিমান, আমাদের সাহায্য করার জন্যও প্রস্তুত। আমি চাই আপনি গিয়ে কথা বলে দেখুন আর কিছু জানা যায় কিনা।”
“আমি এক্ষুণি বের হচ্ছি।”
“লুইস ফোন করে আপনাকে ঠিকানা জানিয়ে দেবে। একটা গাড়ি আর এক অফিসার কিছুক্ষণের মাঝেই আপনার বাসার নিচে চলে আসবে।”
আরেকটা নাম্বারে ফোন করলো ক্যামিল।
“জেরোমে লেসাজ বলছি,” কণ্ঠে রাগ এবং বিরক্তি প্রকাশ পেলো।
“মঁসিয়ে লেসাজ? আমি কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন। আমি বুঝতে পারছি আপনি সাহায্য করতে ইচ্ছুক নন।”
“বুঝতে পারছেন? যদি সাহায্যের প্রয়োজন থাকে তাহলে অন্য কোথাও যান।”
“দয়া করে, আমার কথাটা শুনুন। আমার স্ত্রী সাড়ে আট মাসের গর্ভবতী নারী। বিকেল বেলা আমার বাসা থেকে অপহরণ করা হয়। আমার স্ত্রীকে খুঁজে বের করতে হবে।”
ওপাশে দীর্ঘ নীরবতা নেমে এলো।
“আমার স্ত্রীকে মেরে ফেলবে সে। মেরে ফেলবে আমার…” দম বন্ধ হয়ে এলো ক্যামিলের।
ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে আছে লুইস। এতোটা অসহায় অবস্থায় নিজের বসকে কখনো দেখেনি।
“মঁসিয়ে লেসাজ…”
“আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?” তাচ্ছিল্যভরা কণ্ঠে জবাব দিলো লেসাজ।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ক্যামিল।
“একটা উপন্যাসের ব্যাপারে জানতে চাই। ফিলিপ চাবের লেখা ‘শ্যাডো শ্লেয়ার।”
ইতিমধ্যে ব্যালাঞ্জারের দিকে ঘুরলো লুইস।
“আপনার কাছে ফ্রেঞ্চ-ইংলিশ ডিকশনারি আছে?” নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করলো সে।
বুকশেলফ থেকে ডিকশনারি এনে লুইসের হাতে দিলো সে।
“বইটার কথা মনে আছে আমার। সত্তর কিংবা আশি দশকের দিকে বিলবান প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিলো। সম্ভবত সত্তর দশকের শেষের দিকে। ১৯৮৫ সালে তারা দেউলিয়া হয়ে যায়। এরপর আর কোন খবর পাওয়া যায়নি।”
লুইস ডিকশনারিতে কিছু একটা খুঁজছে। ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে।
“আপনার কাছে কোনো কপি আছে?”
“দেখে বলছি…না, না, নেই সম্ভবত।”
ক্যামিলকে কিছু বলার চেষ্টা করলো লুইস। কিন্তু ক্যামিল সেদিকে খেয়াল করলো না।
“কোথায় পাওয়া যাবে?”
“এই ধরণের বই খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টকর। খুব কম পরিমাণে ছাপা হয় এসব বই। সংগ্রহে রাখার মত বইও না যে কেউ রেখে দিবে।”
“তুমি কি খুঁজে বের করতে পারবে?” লুইসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
“আমি আগামীকাল খুঁজে দেখবো,” বলার সাথে সাথেই লুইস বুঝতে পারলো কতটা স্বার্থপরের মত শুনিয়েছে কথাটা। “আমি দেখছি কী করা যায়।”
“ধন্যবাদ। লুইস?”
“চাব…” বলল লুইস, “ইংরেজিতে এটা একটা মাছের নাম।”
“আর…?” এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে ক্যামিল।
“ফ্রেঞ্চে এটা শেভেন।”
শোনার সাথে সাথেই ক্যামিলের মুখটা হা হয়ে গেলো আর ফোনটা ফেলে দিলো।
“ফিলিপ বুসন দে শেভেন, লা মাটিনের ওই সাংবাদিক,” বলল লুইস।
ম্যালেভালের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো ক্যামিল।
“ম্যালেভাল, তুমি কী সর্বনাশ করলে?” সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল ম্যালেভাল, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে
“আমি জানতাম না…আমি জানতাম না।”
অধ্যায় ১০৫
বুসনের বাসার উদ্দেশ্যে তৎক্ষণাৎ রওনা দিলো লুইস, ক্যামিল আর ম্যালেভাল।
গভীর রাত হওয়ায় কাউকে পাওয়া গেলো না নিচে। সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে উপরে উঠতে শুরু করলো সবাই।
বুসনের রুমে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। পিস্তল হাতে প্রস্তুতি নিয়ে লাইট জ্বালালো ক্যামিল। তাকে টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে পেছনে সতর্ক অবস্থান নিলো সুইস আর ম্যালেভাল।
টেবিলের কোণায় একটা ফাইলহোল্ডার রাখা। সেখান থেকে একটা কাগজ বাইরে বেরিয়ে আছে। কাগজটা তুলে নিলো ক্যামিল।
প্রিয় ক্যামিল,
আপনি এতোদূর আসতে পারায় আমি বেশ খুশি। এখন যেহেতু কোনো কাজ নেই তাই বিল্ডিংটা খালি পড়ে আছে। আমি জানি কিছু না পেয়ে আপনি কিছুটা হতাশ হয়েছেন। সম্ভবত আপনার স্ত্রীকে খুঁজে পাবার আশা করেছিলেন। কিন্তু সেই মধুর মিলনের জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে আপনার…
কিছুক্ষণের মাঝেই আমার বিশাল কর্মযজ্ঞের পুরোটা বুঝতে পারবেন। সবকিছু একদম পানির মত পরিস্কার হয়ে যাবে। যদি আমি থাকতে পারতাম আপনার মুখভঙ্গি দেখার জন্য।
এতোক্ষণে হয়তো আপনি বুঝতে পেরেছেন আমার ‘মাস্টারওয়ার্ক’ কিংবা আমাদের ‘খেলা’ শুরু থেকেই ধাপে ধাপে সাজানো হচ্ছিলো।
মানুষজন আমাদের গল্প পড়ার জন্য পাগল হয়ে যাবে। সর্বাধিক বিক্রীত বই হবে এব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। সবকিছু লেখা হয়ে গিয়েছে। লাল ফোল্ডারে তা পাবেন। গল্পটা প্রায় শেষ শুধু তুলির শেষ আঁচড় বাকি।
অসীম ধৈর্যশক্তির অধিকারী আপনি। ইতিমধ্যে জানতে পেরেছেন আমি সর্বমোট পাঁচটা বইয়ের কাহিনী অনুসরণ করেছি। আরো করতে পারতাম কিন্তু কোনো লাভ হত না। পাঁচ সংখ্যাটা খুব বেশি বড় নয়, কিন্তু খুনের দিকে বিবেচনা করলে এটা যথেষ্ট। ওহ! খুনের কথা বলেই ফেললাম। তাহলে এটাও জেনে রাখুন শেষ কাজটাই হবে আমার সেরা কাজ। যখন আমি এই চিঠিটা লিখছি, তখনো আপনার স্ত্রী আমার কজায়। সে অসাধারণ
মহিলা। আমার চিত্রনাট্যে একদম মানিয়ে যাবে। কী অসাধারণ এক বিজয়, ক্যামিল। যন্ত্রণাদায়ক, মর্মভেদী এক মেটাফিকশন রচনা হলো আমাদের হাত ধরে। আমাদের রচনার জন্য মানুষজন হুমড়ি খেয়ে পড়বে। তখন আমাকে নিয়ে গর্ব হবে আপনার, আমাদের দিয়ে গর্ব হবে। অবশ্য আপনার অপরূপা স্ত্রীকে নিয়েও গর্ব করতে পারেন যে আমাকে প্রচুর আনন্দ দিয়েছে। ভালো থাকবেন। শুভ কামনা রইলো। এবার নিজের নামটাই লিখবো, এজন্য আমাকে ক্ষমা করে দিবেন আমি জানি।
‘ফিলিপ চাব’
দ্বিতীয় খন্ড
সামনে থাকা চেয়ারটা টেনে বসলো ক্যামিল। তার মাথা কাজ করছে না। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো৷ শেষমেশ ফাইলটা নিজের দিকে টেনে নিলো।
“অ্যালিস…” নাম ধরে ডাকলো সে। যাকে দেখে যে কেউ যুবতি ভাববে।
একটু ব্যঙ্গাত্মকভাবে ডাকলেও অ্যালিসের মনোবলে বিন্দুমাত্র চিড় ধরাতে পারলো না সে। আরম্যাণ্ডের নেয়া প্রথম সাক্ষাৎকারের নোটে চোখ বুলালো : অ্যালিস ভ্যান্ডারবচ, বয়স চব্বিশ।
বাকি পেজগুলো পড়তে শুরু করলো ক্যামিল।
*
“এখানে হত্যালীলা চলেছে। রক্তের বন্যা বয়ে গিয়েছে। কিন্তু সচরাচর আমরা যেমনটা দেখি তেমন না, মানে আমি বলতে চাইছি…”
“আমি তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না, লুইস।”
“মানে আমার জীবনে দেখা কোন হত্যাকাণ্ডের সাথেই এর কোন মিল নেই…”
তার পড়ার গতি আরো বেড়ে গেলো।
*
ভিক্টিম, পঁচিশ বছর বয়সি ককেশিয়ান নারী, প্রচণ্ড মারধোরের চিহ্ন ছিলো শরীরে। চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে আনার ফলে খুলির কিছু অংশ খালি হয়ে গেছে। ফরেনসিক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়েছিলো।
হুট পরে একদম শেষ পাতায় চলে গেলো ক্যামিল।
টেবিলের কোণায় একটা ফাইলহোন্ডার রাখা। সেখান থেকে একটা কাগজ বাইরে বেরিয়ে আছে। কাগজটা তুলে নিলো ক্যামিল।
*
পড়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালো ক্যামিল। তার চোখে মুখে বিস্ময়। ম্যালেভাল রুমের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে লুইস এসে কাগজগুলো পড়তে শুরু করলো।
নৃশংস দৃশ্যগুলো এসে ক্যামিলের মনে জড়ো হলো।
বুসনের ‘মাস্টারওয়্যার্ক’, তার বই।
ক্যামিলের তদন্তের উপর ভিত্তি করেই লেখা হয়েছে তার উপন্যাস।
দেয়ালে নিজের মাথা ঠুকতে ইচ্ছা করছে তার।
এরমাঝে কতটা সত্য? বাস্তবতা আর কল্পকাহিনীর মাঝে ফারাকও জানে না সে? তবে একটা বিষয় নিশ্চিত যে বুসন কমপক্ষে সাতটা খুন করেছে। পাঁচটা খুনের ব্যাপারে সবাই জানে। অবধারিতভাবে এখন ষষ্ঠ খুনের দিকে ঝুঁকছে, যা তার নিজের বই ‘শ্যাডো শ্লেয়ার’ অনুসরণে হবে।
একটা খুন এখনো বাকি।
যেখানে আইরিনের মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
স্ত্রীকে খুঁজে বের করার একটা তাগিদ অনুভব করলো ক্যামিল।
কিন্তু কোথায় সে?
*
রাত পৌনে এগারোটায় ক্রিমিনাল ব্রিগেডের অফিসে জড়ো হলো সবাই।
ফাইলটা ডেস্কে পড়ে আছে। আরম্যান্ড কাগজগুলো ফটোকপি করতে নিয়ে গেছে।
“ফিলিপ বুসন…বুসন এখনো ঘোরাফেরা করছে। আমার স্ত্রী এখনো তার কজায়। আমাদের এখন জানতে হবে তারা কোথায় আছে, তার পরবর্তি পরিকল্পনা কী এবং কখন তা বাস্তবায়ন করবে। অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা, কিন্তু আমাদের হাতে সময় খুব কম।”
ক্যামিলের চোখমুখে ভয়ের কোনো ছাপ দেখতে পেলো না লা গুয়েন। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চিরাচরিত কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন, লক্ষ্য অর্জনে যে অটুট।
“বুসনের বাসা থেকে আমরা যে পাণ্ডুলিপি পেয়েছি, সেটা তার নিজের লেখা উপন্যাস। আমাদের তদন্ত সম্পর্কে তার কী ধারণা তা এখান থেকে জানা যাবে। এটা আমাদের প্রাথমিক সূত্র। এরপর সে কী করবে তা দ্বিতীয় সূত্র, যা আমাদের হাতে নেই তার লেখা উপন্যাস যা চাব নামে প্রকাশ করেছে, যার মাঝে দৃশ্যের পুরো বর্ণনা-”
“এব্যাপারে নিশ্চিত তুমি?” জিজ্ঞেস করলো লা গুয়েন।
“বুঝতেই পারছেন তার উপন্যাসের অন্যান্য অংশ সত্য, তার মানে সত্যিই কোনো গুদামঘরে গর্ভবতী মহিলা খুন হয়েছে।”
এরমাঝে কব এসে হাজির হলো। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ড. ভিগুয়ের। মাথা নেড়ে কব জানালো, “এখনো বইয়ের কোনো খোঁজ পাইনি।”
ফটোকপি নিয়ে হাজির হলো আরম্যান্ড।
“তিনটা টিমে ভাগ হয়ে যাবো আমরা,” বলল ক্যামিল। “জেন, ম্যালেভাল আর আমি মিলে পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসবো ড. ভিগুয়েরের সাথে। আরম্যাণ্ডের নেতৃত্বে একটা টিম বিভিন্ন গুদামঘরে অভিযান চালাবে। লুইস, তুমি বুসনের ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে সম্পর্ক, আত্মীয়স্বজন, যত বেশি জানতে পারো। কব, আপনি বই খোঁজা অব্যাহত রাখুন। কারো কোনো প্রশ্ন আছে?”
কেউ প্রশ্ন করলো না।
*
দুটো টেবিল একসাথে করা হয়েছে, একপাশে লা গুয়েন, ক্যামিল আর অন্যপাশে ম্যালেভাল, ড, ভিগুয়ের বসে আছে। আরম্যান্ড, গুদামঘরের লিস্ট নিয়ে বসে আছে। যেগুলো চেক করা হয়েছে তা পেন্সিল দিয়ে কেটে দিচ্ছে। কাধ আর বাম গালের মাঝে টেলিফোন সেট ধরে অনবরত যোগাযোগ করে যাচ্ছে।
লা গুয়েন কয়েকটা ব্যাকআপ টিম তৈরি করে রেখেছে। আর.এ.আই.ডি কে সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে।
বুসনের ‘উপন্যাস’র প্রথম পাতা খুলে বসলো সবাই। একেকজন একেক গতিতে পড়ছে। ভিগুয়ের, একজন দক্ষ মনোবিদের মত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সবকিছু। খুনির মনস্তাত্বিক অবস্থা বুঝে নেয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে সে।
শুধু মৃত নারী বাদে উপন্যাসের সবকিছুই কাল্পনিক।
ভিগুয়েরের ধারণা বাকি অংশে বুসন নিজেকেই বর্ণনা করেছে পৃথিবীকে সে কী নজরে দেখে, বাস্তবতাকে কীভাবে ঢেলে সাজায়। বুসন কীভাবে সত্যকে প্রভাবিত করে নিজের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে ভুল ধারণা দিয়েছে তাই উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে সে। তিনশ পৃষ্ঠা জুড়েই কত কাহিনী সাজিয়েছে বুসন।
লা গুয়েন একটু নাছোড়বান্দা ধরণের লোক। তার পড়ার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। একদম শেষ থেকে পড়া শুরু করে ক্রমাগত সামনে এগুতে থাকে। গুরুতপূর্ণ বিষয়গুলো নোট করে রাখে সে।
কেউ খেয়াল করলো না ম্যালেভাল এখনো একটা পাতাও উল্টায়নি। প্রথম পৃষ্ঠায় অনন্তকাল ধরে চেয়ে আছে সে। ক্যামিলের কাছে ছুটে গিয়ে নিজের ভুল স্বীকার করতে চাইছে সে, প্রয়োজন হলে ক্ষমা চাওয়ার জন্যও প্রস্তুত। কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না। তাকে যে কোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে।
ক্যামিল ভাবলেশহীন ভাবে পড়ে যাচ্ছে। ঘোট ঘোট নোট নিচ্ছে আর কিছু জিনিস মিলিয়ে দেখছে। আইরিনের সাথে তার প্রথম দেখার দৃশ্য বুসন বর্ণনা করেছে, “প্রথম দেখা হওয়ার ছয়মাস পর ক্যামিলকে বিয়ে করে আইরিন।” ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বুসনের এই ধারণা পুরোপুরি কাল্পনিক।
ডুবন্ত মানুষ মস্তিষ্কে যেমন পুরনো সব স্মৃতি ঘুরপাক খায় ঠিক তেমনি আইরিনের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার কথা মনে পড়লো ক্যামিলের। রবিবারের এক সুন্দর সকালে লুভরের একটা গিফটের দোকানে বই কেনার জন্য এসেছিলো আইরিন। পরপর তিনটা বই দেখে শেষমেশ তিন নাম্বার বইটা বাছাই করে সে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যামিল ভেরহোভেন কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়াই বলে ওঠে, “যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা বলি, ওই বইটা না নেয়াই ভাল হবে।” সাথে সাথে মিষ্টি হাসি দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় আইরিন আর বলে, “তাই নাকি?” আইরিনকে দেখার পর ক্যামিলের পুরো পৃথিবী যেন ঘুরতে শুরু করে। অনেক কিছু বলতে চেয়েও পারে না। কিছুক্ষণ পর লজ্জা ভেঙে একটা বই তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “যদিও এই বইটার দাম একটু বেশি কিন্তু এটাই সবচেয়ে ভাল হবে।” সাথে সাথে আইরিন জবাব দেয়, “তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন যেটার দাম বেশি সেটাই ভাল।” এর প্রত্যুত্তরে আর কিছুই বলতে পারে না সে। শেষে ক্যামিলের দেখানো বই নিয়েই চলে গেলো আইরিন। তাকে চলে যেতে দেখে কিছু বলতে চাইলে ক্যামিল। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হলো। আরেকবার দেখায় আশায় প্রায় প্রতিদিন ওই দোকানে যাওয়া শুরু করলো।
পুরনো স্মৃতি আর ঘাটতে চাইলো না ক্যামিল। পরের পৃষ্ঠায় চলে গেলো।
*
“ক্যামিল, আমার মনে হয় ম্যালেভালের সাথে কথা বলা উচিত,” বলল লা গুয়েন।
পড়া শেষ করলো ক্যামিল।
*
“আমার হাত পা বাঁধা, ম্যালেভাল, তোমাকে পদচ্যুত করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।”
কথাটা শোনার সাথে সাথেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো ম্যালেভলের। আশেপাশে আশ্রয় খুঁজতে শুরু করলো।
“তুমি জানো না এই কাজটা করতে আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে…তোমার সমস্যার কথা আগে কেন বললে না আমাকে?”
ম্যালেভাল লা মাটিনের সাংবাদিককে যতগুলো কল করেছে তারই একটা লিস্ট করা কাগজ ক্যামিলের হাতে তুলে দিয়েছিলো কব। এপ্রিলের ছয় তারিখে বুসনকে ফোন করেছিলো সে আর ওইদিন ক্যুবেভুয়ায় ভিক্টিমের লাশ উদ্ধার করা হয়। সকাল সাড়ে দশটায় প্রথম কল করা হয়েছিলো। এর আগে ওই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কারো জানা সম্ভব ছিলো না।
“এটা কতদিন ধরে চলছে?”
“গত বছরের শেষের দিক থেকে। আমার সাথে সে প্রথমে যোগাযোগ করেছিলো। শুরুর দিকে অল্প কয়েকটা তথ্যেই সন্তুষ্ট ছিলো সে।”
.
চশমাটা টেবিলের উপরে রাখলো ক্যামিল। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে সে।
“ঠিক আছে, ক্যামিল, আমি দেখছি বিষয়টা।” এই বলে ম্যালেভালের দিকে ঘুরলো লা গুয়েন, “ম্যালেভাল, এখানে যা লেখা আছে তা কি সত্যি?”
ম্যলেভাল মাথা ঝাঁকিয়ে না করলো। কী লেখা আছে তা সে জানে না, পড়ে দেখতে হবে তার…
“কী পড়ে দেখবে? তুমি কি বুসনকে তথ্য দিচ্ছিলে নাকি না?”
সম্মতি জানালো ম্যালেভাল।
“ঠিক আছে। আমি তোমাকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হবো।”
কথাটা শুনে ম্যালেভালের মুখ হা হয়ে গেলো।
“সাত খুনের আসামীকে সহযোগিতা করেছো তুমি–তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো নাকি?”
“আমি জানতাম না, বিশ্বাস করুন আমি জানতাম না…” তোতলানো শুরু করলো ম্যালেভাল।
“এইসব বালের কথা তুমি জাজ দেশমের সামনে গিয়ে বলো, কিন্তু এখন আমার প্রশ্নের জবাব দাও,” চিৎকার করে উঠলো ক্যামিল।
“ক্যামিল…” লা গুয়েন থামানোর চেষ্টা করলো।
“তুমি মাসের পর মাস যাকে তথ্য পাচার করেছে সে আমার স্ত্রীকে অপহরণ করেছে। তুমি তো আইরিনকে চেনো, তাই না? তুমি তাকে পছন্দও করতে।”
“আমার স্ত্রী আট মাসের গর্ভবতী। আমার বাচ্চার নামকরণের অনুষ্ঠানে কী উপহার দেবে? নাকি সব ইউরো খরচ করে ফেলেছো?”
চোখ বন্ধ করে ফেললো লা গুয়েন। ক্যামিলের রাগ উঠলে তাকে থামানো যায় না।
“দয়ালু আর ক্ষমাশীল কম্যান্ড্যান্ট তুমি উপন্যাসেই পাবে। আমি চাইলেই তোমার মুখ বরাবর ঘুসি চালাতে পারি। কিন্তু তোমাকে আপাতত কিছুই করছি না। তোমাকে রিমান্ডে নেয়া হবে, আমি হবো রাজসাক্ষী। দোয়া কর আইরিনকে যেন সুস্থ স্বাভাবিকভাবে ফিরে পাই, নইলে এর শোধ আমি নেবো। তোমাকে এই পাপের ফল ভোগ করতে হবে।”
ক্যামিলকে থামানোর জন্য টেবিলে আঘাত করলো লা গুয়েন।
“আমরা সময় নষ্ট করছি, ক্যামিল।”
সাথে সাথে ক্যামিল চুপ হয়ে গেলো।
“ম্যালেভালের বিষয়টা আমি দেখছি। তুমি কাজে ফিরে যাও।”
তবুও নড়লো না ক্যামিল।
“ভালর জন্যেই বলছি, ক্যামিল। বিশ্বাস করো।”
এরপর রুম থেকে বের হয়ে গেলো ক্যামিল।
*
“ম্যালেভাল কোথায়?” জিজ্ঞেস করলো লুইস।
“লা গুয়েনের সাথে। চলে আসবে, বেশি সময় লাগবে না।”
পাণ্ডুলিপিটা আবারো হাতে তুলে নিলো ক্যামিল। সেখানে আইরিনের নাম দেখতে পেলো। আইরিন কতটা একাকীত্ব বোধ করতো, এসব বুসন কীভাবে জানলে? সম্ভবত সব দম্পত্তি এমন টানাপোড়েনের মাঝ দিয়েই যায়।
লুইস অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
“ফিলিপ বুসন দে শেভেন, জন্ম ১৯৬২ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর। নেপোলিয়নের বাহিনীতে এক জেনারেলের নাম ছিলো লোপল্ড বুসন দে শেভেন, জেনায় যুদ্ধ করেছিলো সে। রাজকীয় ফরমান জারি করে খেতাব আর সম্পত্তি দেয়া হয় তাকে।”
এদিকে মনোযোগ নেই ক্যামিলের।
“ম্যালেভাল সম্পর্কে জানতে তুমি?” প্রশ্ন করলো ক্যামিল।
তার দিকে তাকালো লুইস। কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেলো।
“কোন ব্যাপারে?”
“তুমি কি জানতে ম্যালেভাল তথ্য পাচার করতো বুসনের কাছে। তদন্তের যাবতীয় অগ্রগতি সম্পর্কে ম্যালেভলের কাছ থেকেই ধারণা পেতে সে। ওর কারণেই বুসন সবসময় আমাদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে থাকতো।”
হুট করেই লুইসের চেহারা থেকে সব প্রাণচাঞ্চল্য দূর হয়ে গেলো। ক্যামিল বুঝতে পারলো এব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই তার।
“বুসনের উপন্যাস’এ সব লেখা আছে। ল গুয়েন সাথে সাথে বিষয়টা ধরে ফেলেছে। এখন তার সাথেই আছে ম্যালেভাল।”
আর কিছু বোঝার বাকি রইলো না লুইসের।
“তুমি ওকে ইউরো ধার দিয়েছিলো?”
“আপনি কীভাবে–”
“এসবই এখানে বলা আছে, লুইস। ম্যালেভাল হয়তো বুসনের কাছে স্বীকার করেছে। দেখলে, তুমিও নায়ক হিসেবেই আছে। আমরা সবাই আছি, অসাধারণ ব্যাপার, তাই না?”
লা গুয়েনের রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করলো লুইস।
“ম্যালেভালকে জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ নেই। আমি নিশ্চিত যে বুসন তাকে যতটুকু বলেছে সে ততটুকুই জানে। খুনের আগেই সমস্ত কিছু তার পরিকল্পনা করা ছিলো। ম্যালেভালকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে একইসাথে আমাদেরকেও।”
মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো লুইস।
“যাই হোক, কী যেন বলছিলে তুমি?”
পকেট থেকে নোট বের করে পড়তে শুরু করলো লুইস।
“বুসনের বাবা…”।
“আরো জোরে,” চিৎকার করে বলল ক্যামিল যেন নমুনা দেখাতে চাইলো।
“বুসনের বাবা একজন শিল্পপতি। সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে আগত মা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রচুর সম্পদ পেয়েছিলো। বাড়ির পাশেই এক স্কুলে বুসনের শিক্ষাজীবন শুরু কিন্তু ছাত্র হিসেবে খুব একটা ভাল ছিলো না। ১৯৭৮ সালে কিছু সময় একটা ক্লিনিকে কাটায়। ওই ব্যাপারে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। আশির দশকের অর্থনৈতিক মন্দা বুসনের পরিবারকে প্রায় নিঃশেষ করে দেয়। ১৯৮০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়ার জন্য ভর্তি হয়, কিন্তু ওই যাত্রা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এরপর সাংবাদিকতায় ভর্তি হয়ে গ্রাজুয়শেন সম্পন্ন করে ১৯৮৫ সালে। এর এক বছর আগে তার বাবা মারা যায়। ১৯৯১ সালের দিকে লা মাটিনে যোগ দেয় সে। কিন্তু ট্রেলে হত্যাকাণ্ড নিয়ে রিপোর্ট করার আগে তাকে কেউ চিনতো না। ওই রিপোর্ট তাকে রাতারাতি তারকাখ্যাতি এনে দেয়। দুই বছর আগে মা মারা যাওয়ায় একা হয়ে পড়ে। এখনো বিয়ে করেনি। পরিবারের ভাগ্য আরো আগেই বদলে ফেলেছে। ব্যবসা বাণিজ্য ছেড়ে দিয়ে যে সম্পত্তিগুলো ছিলো তা ধরে রাখে। শেয়ার মার্কেট আর বাড়ি ভাড়া বাবদ যে টাকা পেতো তা তার বেতনের তিনগুণ। গত দুই বছরে সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে।”
“কী জানতে পারলে?”
“সামনে আগানোর পরিকল্পনা ছিলো তার। থাকার জায়গা বাদ দিয়ে বাকি সব বিক্রি করে দেয়। সেই টাকা এখন সুইস ব্যাংকে জমা আছে”।
“আর কিছু?”
‘আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশির কাছ থেকে আরো তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন তা সম্ভব না। সংবাদমাধ্যমের লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়বে আমাদের উপর।”
সুইসের সাথে একমত পোষণ করলো ক্যামিল।
*
রাত সাড়ে এগারোটায় লেসাজের ফোন এলো।
“আমার সব সহকর্মীর সাথে কথা বলেছি। যাদেরকে পাইনি মেসেজ দিয়ে রেখেছি। কিন্তু কারো কাছেই ওই বইয়ের কোনো কপি নেই। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”
তাকে ধন্যবাদ জানালো ক্যামিল।
একের পর এক পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
*
লা গুয়েন এখনো ম্যালেভালের সাথে কথা বলছে। সবাই বেশ ক্লান্ত।
‘উপন্যাস’ এর পেছনে সবচেয়ে বেশি সময় দিচ্ছে ভিগুয়ের। অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে ক্যামিল। কিছুদিন পরেই লোকটা অবসরে চলে যাবে অথচ এখনো অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
“বুসনের লেখা আর বাস্তবের মাঝে অনেক অমিল আছে। আমার ধারণী বুসন এটাকে তার স্বভাবজাত প্রতিভা’ বলবে। উপন্যাসে আমাকে ক্রেস্ট নামে ডেকেছে আর বয়স কমিয়েছে বিশ বছর। ফার্নান্ড, মেদি আর এলিজাবেথ নামে তিনজন অফিসার আছে আমাদের কিন্তু উপন্যাসে তাদের স্বভাব চরিত্র পাল্টে দেয়া হয়েছে। বইয়ে সিলভিয়ান গুইনার্ড নামে এক ছাত্রের কথা বলা হয়েছে যে আপনাকে চাবের বই সম্পর্কে তথ্য দেয়। বাস্তবে আপনাকে সেই তথ্য দেয় প্রফেসর দিদিয়ের, যাকে ব্যালাঞ্জার নামে অভিহিত করেছে বুসন।”
ক্যামিল আরেকবার বুসনের উপন্যাস পড়ার তাগিদ অনুভব করলো।
“আপনাকে বেশ আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করেছে। পুরো বইটা জুড়ে আপনাকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবেই দেখিয়েছে সে। সবাই তো নিজেকে এভাবেই দেখতে চায়, তাই না? বুসনের মাঝে খুনিস্বত্ত্বার বীজ বপন হয়েছে অনেক আগেই। পুরো সমাজব্যবস্থার উপর তার তীব্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করেছে খুনের মাধ্যমে। আইরিনের মাধ্যমে আপনাকে আঘাত করতে চায় সে। আপনাকে সম্মান করে সে আর এজন্যই ধ্বংস করতে চায় আপনাকে।”
“কিন্তু আইরিন কেন?”
“কারণ আইরিন ছাড়া আপনি অচল। সে ভালোমতোই জানে আইরিন আপনার অস্তিত্বের অংশ।”
পাণ্ডুলিপির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্যামিল।
“আপনাকে পাঠানো চিঠি আর ‘উপন্যাসে বর্ণিত চিঠি, বানান এবং দাড়িকমা থেকে শুরু করে সবকিছু হুবহু এক।”
“এখানে বর্ণিত সর্বশেষ অপরাধটাও সে বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, তাই না?” বলল ক্যামিল।
ক্যামিলের কথায় মনোযোগ হারালো ভিগুয়ের। পাণ্ডুলিপি রেখে ক্যামিলের দিকে তাকালো সে।
“তার অপরাধের কারণ অনুসন্ধান করছিলাম আমরা। এভোক্ষণে তা পেয়ে গেছি। বহু আগে তার লেখা উপন্যাসের কয়েকটা দৃশ্য বাস্তবায়ন করার জন্যেই এমনটা করেছে। আর এই উপন্যাস রেখে গেছে আমাদের জন্য। যদি তাকে খুঁজে বের করতে না পারি, তাহলে ‘উপন্যাসে যা লিখেছে তাই করবে।”
*
যা যা জানেন আমাকে সত্যি করে বলুন। কিছুই লুকাবেন না। বুসন কী কী জানে আমার তা জানতে হবে।
“বুসনের শেষ বই খুঁজে না পেলে আমরা জানতে পারবো না কোথায় এবং কখন খুনটা হবে। এমনকি খুনটা হয়তো এখনি হচ্ছে কিংবা কয়েক ঘণ্টা পরে হবে। অনুমান করে কিছুই করা যাবে না।”
কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেলো ভিগুয়ের। কী যেন ভাবলো অনেকসময় ধরে।
“এখানে দুইধরনের তথ্য আছে, ক্যামিল। একটা সে অনুমান করেছে আরেকটা আবিষ্কার করেছে।”
“এতো কিছু কীভাবে অনুমান করলো সে?”
“এটা বুসনকে গ্রেফতার করার পরেই জানতে পারবেন। আমার ধারণা, আপনাদের ভেতর থেকে কেউ তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছে তাকে। এমনকি ‘উপন্যাস’র কিছু অংশ সে পুনরায় লিখেছে। নিজের ‘উপন্যাস যতটা সম্ভব বাস্তবের কাছাকাছি করতে চেয়েছে। আপনার কিছু সিদ্ধান্ত তাকে বিস্মিত করেছিলো, কিন্তু সেটাও সে অনুমান করতে পেরেছিলো বলে আমার ধারণা। সে জানতো আপনার প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করবে তার কাহিনী।
“কোন অংশের কথা বলছেন আপনি?”
“যেমন ধরুন, আপনি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তার সাথে যোগাযোগ করেছেন। এটা সে আশা করেনি। আপনার দিক থেকে বেশ সাহসি পদক্ষেপ ছিলো। সম্ভবত বিষয়টা তার কাছেও বেশ আকর্ষণীয় লেগেছে। আমার মনে হয় সে আপনাকে তার সহলেখক হিসেবে কল্পনা করেছে। ‘আমাদের নিয়ে গর্ব করতে পারবেন আপনি চিঠিতে এই কথা সে বলেছে, মনে আছে? তবে একটা জিনিস আমি খেয়াল করেছি তার সব অনুমানই মিলে গেছে। সে জানতো তার খুনের সাথে বইয়ের সম্পর্কের বিষয়টা আপনি আঁচ করতে পারবেন। আপনার হাল না ছাড়ার ক্ষমতা তাকে মুগ্ধ করেছে। আর এটারই সুযোগ সে নিয়েছে। সে এটাও জানতো আজ হোক কাল হোক কেউ না কেউ তার নামের রহস্য বের করতে পারবে।”
রুম থেকে বের হয়ে আসলো লা গুয়েন। ম্যালেভাল এখনো ভেতরে বসা আছে।
“আমাদের আরো দ্রুত গতিতে কাজ করতে হবে, কিন্তু-”
“কিন্তু কী?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
“আমাদের ধারণার চেয়েও কম জানে ম্যালেভাল। বুসন যতটা তথ্য নিতে পেরেছে, ম্যালেভাল তার সিকিভাগও নিতে পারেনি। প্রথমত, ছোটখাটো কেসের তথ্য পাচার করতো ম্যালেভাল। আস্তে আস্তে বুসন তাকে তৈরি করেছে। ক্যুবেভুয়ার হত্যাকাণ্ডের সময় সম্পূর্ণভাবে জড়িত ছিলো সে। তাই এই সুযোগ হাতছাড়া করেনি বুসন।”
“এই ম্যালেভালকে আমি চিনি না,” জানালো ক্যামিল।
“সেটা তুমি যাই বলো।”
*
“১৯৮১ সালে বিলবান প্রকাশনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং ১৯৮৫ সালে দেউলিয়া হয়ে যায়,” বলল কর। “সেই সময়, ইন্টারনেট সুবিধা ছিলো না, তাই অনলাইনে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি। আমি কিছু পুরনো বইয়ের কাটালগ খুঁজে পেয়েছি। দেখবেন?”
উত্তরের অপেক্ষা না করে কাগজটা প্রিন্ট করলো কব।
১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সালের মাঝে প্রায় একশোর বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। লিস্টে থাকা বইগুলোর নাম দেখলো ক্যামিল ‘এজেন্ট টিএক্স ইজ মিসিং’, ‘কিং, কুইন, স্পাই’, ‘ওশান’, ‘ইন এ ডেডম্যানস শু’।
“অনেকদিন ধরে প্রকাশ না পাওয়া বইগুলো খুঁজে বের করে তা নতুন করে ছাপতো বিলবান প্রকাশনী।”
“ওই প্রকাশনীর কোনো মালিকের নাম পাওয়া গিয়েছে?”
“শুধু পরিচালকের নাম জানা গিয়েছে, পল হেনরি ভেইস। আরো কয়েকটা প্রকাশনীতেও তার শেয়ার আছে কিন্তু বিলবান সে নিজেই দিয়েছিলো। ১৯৮৫ থেকে ২০০১ সালের মাঝে তার কোনো খবর পাওয়া যায়নি। অন্য কিছু পাওয়া যায় কিনা আমি দেখছি।”
*
“পেয়ে গেছি…আমি পেয়ে গেছি।”
ক্যামিল দৌড়ে গেলো।
“অন্তত আমার তাই মনে হয়। একটু দাঁড়ান…”
“কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?” উত্তেজিত হয়ে বলল ক্যামিল।
ক্যামিলের চিৎকার শুনে লা গুয়েন আর লুইসও চলে এসেছে। তার মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।
“যার যার কাজে যাও, আমি আর কব মিলে এদিকটা দেখছি।”
“বিলবানের হয়ে যারা কাজ করেছে এখানে তাদের লিস্ট আছে। সবার নাম পাইনি, তবে ছয়জনেরটা যোগাড় করতে পেরেছি।”
“ঠিক আছে,” এই বলে লিস্টটা হাতে নিলো ক্যামিল।
“কীভাবে খুঁজে বের করলেন?”
“এটা ব্যাখ্যা করতে অনেক সময় লাগবে। শুধু এতোটুকুই বলতে পারি দুই নাম্বারি কিছু পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছে।”
“আমি পুরোটা প্রিন্ট করে দিচ্ছি,” বলল কব।
“আর কী বাকি আছে?”
“তাদের পুরো জীবন বৃত্তান্ত।”
ছয়জনের মাঝে একজন মারা গিয়েছে অনেক আগে আর অন্যজন যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
“বাতাসে মিলিয়ে গেছে?” বিস্ময় প্রকাশ করলো লুইস।
“তার সম্পর্কে কিছুই পেলাম না। একদম গায়েব হয়ে গিয়েছে। কী হয়েছে তা জানার কোনো উপায় নেই।”
ইসাবেল রাসেল, জন্ম ১৯৫৮ সালে, বিলবানে যোগ দেয় ১৯৮২ সালে, কিন্তু সেখানে মাত্র পাঁচ মাস কাজ করে। নামটা কেটে দিলো ক্যামিল। জ্যাসিন্থ লেফেব্রে, জন্ম ১৯৩৯ সালে, কোম্পানির শুরু থেকে একদম শেষ অবধি কাজ করে। নিকোলাস ব্রিউক, জন্ম ১৯৫৩ সালে, শুরুতেই যোগ দিলেও ১৯৮৪ সালে চলে যায়। থিয়োডোর সাবিন, জন ১৯২৪ সালে, ১৯৮২ সালে যোগ দিয়ে দেউলিয়া হওয়া অবধি বিলবানের সাথেই ছিলো।
“লেফেব্র আর ব্রিউক, এদের সম্পর্কে আর কী তথ্য আছে?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
“আমি এটা নিয়েই কাজ করছি,” কম্পিউটারের পেছন থেকে জবাব দিলো কব।
“বিলবানে কী পদে কাজ করতো?” জানতে চাইলে লুইস।
“সেটা জানতে পারিনি। তবে এদের ঠিকানা পাওয়া গিয়েছে।”
“তুমি প্রথমজনকে কল করো আর আমি দ্বিতীয়জনকে করছি।”
“এতো রাতে কল করার জন্য শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি…হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি, তবুও ফোন না রাখাটাই আপনার জন্য মঙ্গলজনক হবে, ক্রিমিনাল ব্রিগেড থেকে লুইস ম্যরিয়ানি বলছি।”
এরইমাঝে ব্রিউকের ফোন বেজে চলছে।
“আপনার নাম,..? আপনার মা বাসায় নেই?”
কোনো কিছু না ভেবে কতবার রিং হয় গুণতে শুরু করলো ক্যামিল, সাত, আট, নয়…
“কোন হসপিটালে আছে? হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি …”
এগারো, বারো। ফোনটা রাখতে যাবে তখনি ওপাশ থেকে রিসিভার উঠানোর শব্দ শুনতে পেলো ক্যামিল। কেউ ফোনটা ধরেছে কিন্তু কথা বলছে না।
“হ্যালো? মঁসিয়ে ব্রিউক? হ্যালো? শুনছে পাচ্ছেন?”
লুইস কথা বলা শেষ করেছে। হাসপাতালের ঠিকানা লেখা একটা কাগজ লুইসের দিকে বাড়িয়ে দিলো।
“জিসাস ক্রাইস্ট! কেউ কি আছেন? শুনছে পাচ্ছেন?”
সাথে সাথে ফোনটা রেখে দিলো।
“এক্ষুণি দুজন অফিসার লাগবে আমার,” বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত ক্যামিল।
লা গুয়েনের নির্দেশে ইতিমধ্যে দুজন অফিসার প্রস্তুত হয়ে গেছে। নিজের ডেস্ক থেকে রিভলবার বের করে নিলো ক্যামিল।
*
মোটরসাইকেলে চড়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগলো না। তাদের। বিল্ডিংয়ের নিচে থেকে ক্যামিল বাকিদেরকে ইশারায় তিন তলায় যেতে বলল। কাঙ্ক্ষিত দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে শুরু করলো। কিন্তু পাশের ফ্ল্যাটের এক মহিলা দরজা খুলে পরিস্থিতি দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে যাওয়ার পরেও দরজা না খোলায় সবাইকে সতর্ক অবস্থান নিতে বলল ক্যামিল। পরবর্তি পদক্ষেপ কী হবে এই নিয়ে ভাবার সময় দরজা খুলে দিলো কেউ।
“আপনার নাম কী?” একজন অফিসারকে জিজ্ঞেস করলো সে।
“ফ্যাব্রিস পো-”।
“আর আপনার?” দাঁড়িয়ে থাকা অন্য অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল সে।
“বার্নাড।”
“এসব কী হচ্ছে?” গভীর রাতে এমন কাণ্ডে কিছুটা বিচলিত সে।
পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার জন্য ক্যামিল পেছন থেকে সামনে এলো।
“মঁসিয়ে ব্রিউক? নিকোলাস ব্রিউক?”
লোকটার মুখ থেকে ভুরভুর করে মদের গন্ধ বের হচ্ছে।
“এতোটুকুই জানা দরকার ছিলো, নিচুস্বরে বলল ক্যামিল।
*
বসার ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলো লুইস।
“ফ্যাব্রিস, কফি বানিয়ে নিয়ে আসো। বার্নাড, উনার সাথেই থাকো।”
চোখ বন্ধ করে সোফায় বসে আছে ব্রিউক। গালে তিনদিনের দাড়ি জমে আছে, চেহারায় বিধ্বস্ত একটা ভাব।
ক্যামিলের ফোন বেজে উঠলো।
“বুসনের বাড়ি পুরোপুরি খালি। একটা কুকুর বিড়ালও নেই,” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানালো লা গুয়েন।
“আর কিছু?”
“দুটো মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। সম্ভবত দুই বছর আগে দাফন করা হয়েছিলো। খুব বেশি কষ্ট হয়নি খুঁজে বের করতে। ঘটনাস্থল পরীক্ষা করে দেখছে একটা টিম।”
*
লুইস বাটিতে করে পানি আর তোয়ালে নিয়ে এসেছে। তোয়ালে ভিজিয়ে তা ব্রিউকের মুখে ঠেসে ধরলো ক্যামিল। কোনো ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখালো না সে।
“মঁসিয়ে ব্রিউক, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?”
ব্রিউক রীতিমতো নাক ডাকতে শুরু করলো। ভেঁজা ভোয়ালে আবারো ব্রিউকের মুখে দিলো, কিন্তু ফলাফল শূন্য। পালস চেক করে দেখলো
ক্যামিল, ঠিকই আছে।
“অনেক হয়েছে, বাথটাব আছে না বাথরুমে?”
দুজন অফিসার মিলে ব্রিউককে কোলে করে বাথটাবে নিয়ে রাখলো। পানির কল ছেড়ে দিলো ক্যামিল।
পানির ঝাঁপটা লাগার সাথে সাথেই জেগে উঠলো ব্রিউক।
“মঁসিয়ে ব্রিউক, এখন শুনতে পাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি, দয়া করে এখন বন্ধ করুন…”
“উনাকে এখানে নিয়ে আসো,” বসার ঘরের দিকে ইঙ্গিত করলো ক্যামিল।
লুইস ইতিমধ্যে পুরো বাড়ি চষে ফেলেছে। একটা কোণাও বাদ দেয়নি।
“এখন আমি যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শুনুন, রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে ক্যামিল।
“আমি…আমি কিছু করিনি,” কাঁপতে কাঁপতে বলল ব্রিউক।
“আগে আমার কথা শুনুন! হাতে বেশি সময় নেই।”
“ক্যামিল, “ তাকে থামার অনুরোধ জানালো লইস।
“আমি কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভনে। গর্ভবতী এক নারী অপহৃত হয়েছে। এবং সে মত্যর পথে। আর যদি আপনি সাহায্য না করেন তাহলে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে বলছি আপনাকে খুন করবো।
“আমি চলে যাওয়ার পর আপনি মদ খেতে খেতে মরে গেলেও কোনো সমস্যা মেই? আপাতত যা বলি মনোযোগ দিয়ে শুনবেন এবং কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবেন। বুঝতে পেরেছেন?”
মদের নেশা এখনো পুরোপুর কাটেনি তার।
“বইগুলো কোথায়?”
“আমরা সব বই বিক্রি করে দিয়েছিলাম। ওগুলো দিয়ে আর কী হবে?”
একটা বিয়ালের বোতল আনার জন্য উঠে দাঁড়ালো ব্রিউক। তাকে থামালো ক্যামিল।
“এক মিনিটের মাঝেই আসছি!” কাতরকণ্ঠে বলল সে।
“চুপচাপ এখানেই বসে থাকুন। নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই।”
“কিন্তু আমি তো বলে দিয়েছি–”
“হ্যাঁ, আমি জানি। কিন্তু সব তো বিক্রি হয় না। কোথাও না কোথাও তো থাকবেই। মনে করার চেষ্টা করুন।”
“না, আমরা সবই বিক্রি করে দিয়েছিলাম,” ভয়ে ভয়ে বলল ব্রিউক।
“ঠিক আছে,” ক্যামিলের মুখ হতাশার কালো ছায়ায় ঢেকে গেলো।
ঘড়ির দিকে তাকালো ক্যামিল। একটা বিশ বেজে গেছে। হুট করে তার ঠাণ্ডা অনুভূত হলো।
“চলো যাই, এর কাছ থেকে আর কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না।”
লুইসও তার সাথে একমত পোষণ করলো। বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যান্য অফিসার।
“কিছু একটা মনে পড়ছে আমার। যদিও পুরোপুরি নিশ্চিত নই…”
সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়ালো সবাই।
“আমার যতদূর মনে পড়ে আমার ছেলের জন্য একবাক্স নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আমার ছেলে খুলেও দেখেনি। এখনো সেলারে পড়ে আছে, চাইলে দেখতে পারেন।”
*
খালি রাস্তা পেয়ে প্রচণ্ড বেগে গাড়ি চালাতে শুরু করলো লুইস। ক্যামিলের হাতে বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই বই যা এতোদিন ধরে খুজছিলো। প্রচ্ছদে দেখা যাচ্ছে এক তরুণী বিছানার মত দেখতে কিছু একটায় শুয়ে আছে। ব্লাউজটা এমনভাবে ভোলা যাতে করে স্তনের কিছু অংশ দেখা যায়। চিৎকার দেয়ার জন্য মুখটা হা করে আছে সে, চেহারায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
ক্রিমিনাল ব্রিগেডের অফিসের নিচে থামলো গাড়ি। প্রায় দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো ক্যামিল।
সাথে সাথে বইয়ের চারটা ফটোকপি করে ফেললো লুইস।
“বইয়ের মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৫০। তার মানে যদি গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকে তাহলে শেষাংশেই থাকবে। ১৩০ নাম্বার পৃষ্ঠায় যাও! আরম্যান্ড, তুমি এখান থেকে শুরু করো। আমি, লুইস আর লা গুয়েন বাকিটা দেখছি। ড. ভিগুয়ের, আপনি কষ্ট করে শুরু থেকে পড়ুন। আমরা জানি না আমাদের কী লাগবে? ছোটখাটো কোনো তথ্যও কাজে লাগতে পারে। কব, আপনার সাহায্য দরকার। তোমাদের কাছে যেটাই গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে সাথে সাথে তা কবকে দেখাবে।”
*
সামনে থাকা ফোল্ডারটা খুললো ক্যামিল। বইয়ের একদম শেষের পৃষ্ঠাগুলো পড়তে শুরু করলো।
*
নিচু হওয়াতে কোরের দেহ নিয়ে এগুতে বেশ কষ্ট হচ্ছে ম্যাথিউয়ের। বিষাক্ত ধোঁয়া শ্বাসনালীতে প্রবেশ করায় বিকটভাবে কাশতে শুরু করলো সে। মেঝেতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবারো চলতে লাগলো। হাতে পিস্তল থাকায় হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে পারছে না। পিস্তলটা হোলস্টারে রেখে দিলো।
পরের পৃষ্ঠায় চলে গেলো ক্যামিল।
*
কোরে বেঁচে আছে কিনা তা বলা অসম্ভব। একটুও নড়ছে না সে, কিন্তু ম্যাথিউ তা ঠিকমতো দেখতে পারছে না।
পৃষ্ঠা নাম্বার চেক করে ১৮১ নাম্বার পৃষ্ঠায় চলে গেলো ক্যামিল।
*
“কোরে নামে একটা চরিত্র আছে এখানে,” কবকে উদ্দেশ্য করে বলল লুইস। “কিন্তু পুরো নাম এখনো পাইনি।”
“মেয়েটার নাম নাদিন লেফ্রাঙ্ক,” পাশ থেকে বলল লা গুয়েন।
“এই নামে তো তিন হাজারেরও বেশি মেয়ে আছে,” মিনমিন করে বলল কব।
*
পৃষ্ঠা ৭১:
চারটার দিকে হাসপাতাল থেকে বের হলো নাদিন। সুপারমার্কেটের পাশে গাড়ি রেখে এসেছে, সেদিকে এগিয়ে গেলো সে। আন্ট্রাসাউন্ডের রিপোর্ট দেখার পর থেকেই তার পুরো পৃথিবীটা আনন্দে ভরে উঠেছে।
“ফান্সিস ম্যাথিউ নামে একজন পুলিশকে পেয়েছি,” জানালো আরম্যান্ড।
*
পৃষ্ঠা ২১১:
জানালার পাশে অবস্থান নিলো কোরে। কেউ যাতে দেখে না ফেলে তাই এই সতর্ক অবস্থান, যদিও জায়গাটা অনেকদিন ধরে পরিত্যক্ত। বাইরে স্ট্রিটল্যাম্পের মৃদু আলো, সে দেখতে পাচ্ছে…
পেছনের পৃষ্ঠায় গেলো ক্যামিল।
পৃষ্ঠা ২০৭:
গাড়িতে বসে পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে কোরে। ঘড়িতে সময় দেখে নিলো, দশটা বেজে গেছে। নিজের পরিকল্পনা আরেকবার ঝালাই করে নিলো। বিশ মিনিটের মাঝেই নাদিন এসে পৌঁছাবে। গাড়ির জানালা খুলে একটা সিগারেট ধরালো সে। সবকিছুই প্রস্তুত ছিলো। যতক্ষণ…
*
আরো পেছনে যেতে বাধ্য হলো সে।
*
পৃষ্ঠা ২০৫:
সরু রাস্তায় শেষ মাথায় উছু একটা বিল্ডিং, প্যারেন্সি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে। কোরের মাথায়…
*
“শহরের মান প্যারেন্সি, কিন্তু বর্ণনা দেখে মনে হচ্ছে এটা কোনো গ্রাম,” বলল ক্যামিল।
*
পৃষ্ঠা ২২১:
“যাই হোক আমাকে বললো,” বলল কমিশনার ম্যাথিউ।
ক্রিস্টিয়ান তার কথা শুনতে পেলো না।
“যদি আমি জানতাম তাহলে…”
*
“মেয়েটা পার্নাড নামে এক উকিলের হয়ে কাজ করে। লিলেতে একটা অফিসও আছে,” জানালো আরম্যান্ড।
পড়া থামিয়ে দিলো ক্যামিল। বইয়ে থাকা নামগুলো নিয়ে ভাবলো একবার। কিছুই মাথায় আসছে না তার।
*
পৃষ্ঠা ২২৭:
শেষমেশ, গর্ভবতী নারীর জ্ঞান ফিরলো। মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পেলো কোরে তার পাশে বসে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসছে।
*
ক্যামিলের মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোত নেমে গেলো। তার হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে।
“ওটা তাহলে তুমিই ছিলে?”
*
উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই টের পেলো তার হাত পা শক্ত করে বাঁধা। দড়ি দিয়ে এতোটাই শক্ত করে বাঁধা হয়েছে যে রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কতক্ষণ এভাবে পড়ে আছে তাই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলো সে।
“ঘুম ভাল হয়েছে?” সিগারেট ধরানোর সময় জিজ্ঞেস করলো কোরে।
চিৎকার করা শুরু করলো নাদিন। কিন্তু তার ডাক শোনার মত কেউ নেই। অনেকক্ষণ চিল্লাচিল্লি করার পর ক্লান্ত হয়ে নিজেই থেমে গেলো সে। কোরে এদিকে কোনো ভুক্ষেপই করলো না।
“তুমি আসলেই রূপবতী, নাদিন। তুমি এতোটাই সুন্দর যে…”
এখনো সিগারেট মুখ ধরা, নাদিনের স্ফীত পেটে হাত রাখলো সে। সাথে সাথে কুচকে উঠলো নাদিন।
“আমি এটাও জানি মৃত্যুর সময় তুমি এতোটা রূপসী থাকবে,” কানে কানে বলল সে।
*
নতুন কোনো তথ্য না পায়ে আবারো বইয়ে ডুব দিলো ক্যামিল।
*
পৃষ্ঠা ২৩৭:
“সুন্দর, তাই না?” জিজ্ঞেস করলো কোরে।
মাথা একদমই তুলতে পারছে না নাদিন। মুখ অস্বাভাবিক রকম ফুলে আছে, গায়ের ক্ষতগুলো হলদেটে রঙ ধারণ করেছে। গালের একটা ক্ষত কালচে হয়ে গিয়েছে। মুখ দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার।
জামার হাতা গুটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো কোরে।
“তুমিই বলো নাদিন, পছন্দ হয়নি তোমার পায়ের কাছে পড়ে থাকা কিছু একটার দিকে ইঙ্গিত করলো কোরে।
ক্রমাগত কান্না করার ফলে চোখে কিছুটা ঝাপসা দেখছে নাদিন। পায়ের কাছে পড়ে আছে চার্চ কুসিফিক্স।
“এটা তোমার বাচ্চার জন্য, নাদিন,” কানের কাছে ফিসফিস করে বলল সে।
তার স্তনে খুব জোরে চাপ দিয়ে ধরলো কোরে।
“তোমার সন্তানকে এখানেই আলোর মুখ দেখানো হবে। যদিও তা দেখার জন্য তুমি জীবিত থাকবে না। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি ক্রুসিফাই করার ক্ষেত্রে একটুও গাফিলতি করবো না।”
*
কাঙ্খিত ঠিকানা না পেয়ে পাগলের মত খুঁজতে শুরু করলো ক্যামিল। আরো কয়েক পৃষ্ঠা পরে জায়গাটা সম্পর্কে বর্ণনা পাওয়া গেলো।
*
জায়গাটা নির্ধারণ করার আগে প্রচুর চিন্তাভাবনা করেছে কোরে। জুতার ফ্যাক্টরির পাশে পরিত্যক্ত এক গুদামঘরই হবে উপযুক্ত স্থান। পরবর্তিতে যা চিত্রশিল্পীর স্টুডিও হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে…
*
লুইসকে খুঁজে বেড়ালো ক্যামিল।
“তুমি কী খুঁজছ?” জিজ্ঞেস করলো লা গুয়েন।
“গুদামঘরের কথা বলেছে যা চিত্রশিল্পীর স্টুডিও হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আইরিনকে মনফোর্টে নিয়ে গেছে সে, আমার মায়ের স্টুডিও।”
সাথে সাথে আর,এ.আই.ডি টিমকে ফোন করে জানালো লা গুয়েন। ক্যামিল কোনো কিছুর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে পড়লো।’
সবার এতো দৌঁড়ঝাপের মাঝেও লুইস খেয়াল করলো আরম্যান্ড তার জায়গা থেকে নড়েনি। কারণ জানতে চাইলে সে বলে, “খুনি ঠিক রাত দুইটার দিকে হত্যা করবে আইরিনকে।”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো পৌনে দুইটা বেজে গেছে।
লুইস চড়ে বসার সাথে সাথেই ইঞ্জিন চালু করলো ক্যামিল। দুজনের মাথায় একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে বিছানায় পড়ে আছে আঘাতে জর্জরিত আইরিনের দেহ।
ক্যামিলের মনে এখন কী চলছে তা আঁচ করার চেষ্টা করলো লুইস। হয়তো আইরিনের করুণ আর্তনাদ তার কানে বাজছে, মনে পড়ছে তাদের সুখস্মৃতিগুলো।
গভীর রাতে তীব্র গতিতে ছুটে চলছে তাদের গাড়ি। কারোই যেন নিজের জীবনের কোনো পরোয়া নেই। আইরিনকে বাঁচাতে না পারলে থেমে যাবে পুরো পৃথিবী। লুইসের মনে হচ্ছে গাড়ি যেন আকাশে উড়ছে। বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হতে হতেও বেঁচে গিয়েছে তারা। মনে মনে ইশ্বরের কাছে একটাই প্রার্থনা করছে আইরিনের যেন কিছু না হয়। হুট করেই বিপরীত দিক থেকে আসা একটা গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ক্যামিল। ব্রেক চেপেও দানবটাকে থামাতে পারলো না। ক্যামিলের মাথা গিয়ে ড্যাশবোর্ডে বাড়ি খেলো। কপাল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, সেদিকে
কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই তার। এর পাশেই পড়ে আছে অর্ধচেতন লুইস।
লুইসের অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলো ক্যামিল। তার কাঁধে হাত রাখলো।
“আমি ঠিক আছি,” আশ্বস্ত করলো লুইস।
পকেট থেকে পড়ে যাওয়া ফোন খুঁজতে লাগলো ক্যামিল। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শেষমেশ নিজের রিভলবার খুঁজে পেলো সে। কিছুক্ষণের মাঝেই লোকজন জড়ো হয়ে যাবে। নানা ধরণের কানাঘুষা শুরু করবে তারা। বাইরে বেরিয়ে হাত পা ঝাড়া দিলো ক্যামিল। এখনো রক্ত পড়া থামেনি।
লুইসকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেখে স্বস্তি অনুভব করলো সে। রক্ত মোছর জন্য পাশে পড়ে থাকা ময়লা একটুকরো কাপড় নিয়ে নিলো। গাড়ির বেহাল দশা, চারটা দরজা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সামনের একটা হেডলাইট কাজ করছে না। কিন্তু ইঞ্জিন এখনো চালু আছে। এই দেখে যেন দুর্ঘটনার কথা ভুলে গেলো সে। লুইসকে নিয়ে আবারো চলতে শুরু করলো।
ঘড়িতে এখন রাত সোয়া দুইটা বাজে, গাড়ির গতি একটু কমালো ক্যামিল। কেননা সামনের রাস্তা বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। গাছগাছালির মাঝ দিয়ে যেতে একটু কষ্ট হচ্ছে। মাথাটা দপদপ করছে। তার। স্পিডোমিটারের কাটা ১২০ ছুঁয়েছে এমন সময় ব্রেক কষলো সে। মায়ের স্টুডিওর কাছে চলে এসেছে।
বাইরে কোনো গাড়ি দেখতে পেলো না তারা দুজন। সম্ভবত স্টুডিওর পেছন দিকে রেখেছে বুসন যাতে কেউ দেখতে না পারে। ক্যামিলের মনে সন্দেহ দানা বাঁধলো। কোনো ভুল করেনি তো? আইরিনকে অন্য কোথাও নিয়ে যায়নি তো? সদর দরজা থেকে ত্রিশ মিটার দূরে আছে তারা। পিস্তল হাতে নিয়ে প্রায় নিঃশব্দে এগুতে থাকলো। ক্যামিল একটু সামনে আর লুইস পেছনে। দরজাটা বন্ধ, জনমানুষের কোন চিহ্ন নেই।
হুট করেই মাথায় উপর দিয়ে হেলিকপ্টার উড়ে যেতে দেখলো। কিছুসময়ের জন্য প্রচণ্ড শব্দ আর ধূলিঝড় তৈরি হলো। এরইমাঝে নিজেদেরকে দরজার সামনে আবিষ্কার করলো দুজন।
বাকি টিমগুলোও ঘটনাস্থলে পৌঁছে গিয়েছে। সবার আগে অবস্থানরত ক্যামিল দরজায় ঝোলানো তালা বরাবর গুলি করলো। এরপর দরজা খুলে। ভেতরে ঢুকলো।
দুই পা এগুনোর সাথে সাথেই আছাড় খেলো ক্যামিল। বেকয়দাভাবে পড়ায় পিঠে বেশ ব্যথা পেলো। এসব কিছুতে খেয়াল করার সময় নেই তার। পুরো স্টুডিও জুড়ে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। অন্যান্য টিম প্রয়োজনীয় আলো নিয়ে ঢোকার পর যে দৃশ্য দেখা গেলো তা কেউই আশা করেনি। হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে আইরিন। মুখটা উপরের দিকেই আছে কিন্তু একদম ভাবলেশহীন অবস্থায় পড়ে আছে, ঠোঁটজোড়া বিচ্ছিন্ন। পেটটা আর ফোলা নেই বরং খাঁজকাটা একটা মাংসের স্তূপে পরিণত হয়েছে।
এমন দৃশ্য সহ্য করতে পারলো না ক্যামিল। সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে গেলো।
পরিশেষ
সোমবার, ২৬ শে এপ্রিল, ২০০৪
প্রিয় ক্যামিল,
এক বছর হয়ে গেলো। সময় দ্রুতও যায় না আবার ধীরেও চলে না। সময় আমাদের জীবনে কত পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়।
আপনার লেফটেন্যান্ট আমাকে পেছন থেকে ধাওয়া করেছিল এবং কাপুরুষের মত গুলি চালিয়েছে। এতে করে আমার স্পাইনাল কর্ড মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরপর থেকে আমি হুইলচেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে পারি না, এই চিঠি এখানে বসেই লিখছি।
সত্যি বলতে, আমি এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমার এই অবস্থার জন্য আমি অনেক সুবিধা পাচ্ছি যা অন্যরা পায় না। আমার জন্য আশীর্বাদ হয়েই এসেছে এই হুইলচেয়ার।
আমি আগের চেয়ে অনেক ভাল আছি। তাদের মতে, আমি মানিয়ে নিয়েছি। আমার পা হয়তো অকেজো হয়ে গিয়েছে, কিন্তু বাকি সব ঠিকঠাক আছে। আমি পড়তে পারি, লিখতে পারি, মোট কথা আমি বেঁচে আছি। হাসপাতালে কয়েকমাস কাটানোর পর বুঝতে পারি আমার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে। মানুষজন আমাকে সম্মান করে। আমি এবং আমার কাজ তাদের আলোচনার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হতে এখনো অনেক দেরি, এসব নিয়ে আমি ভাবি না। সত্যি বলতে আমি এর জন্য অপেক্ষা করছি। কেননা আমার ‘উপন্যাস প্রকাশ করার ব্যাপারে আইনজীবীর সাথে কথা বলে রেখেছি। যেমনটা বলেছিলাম সর্বাধিক বিক্রির সকল রেকর্ড ভাঙবে আমার ‘উপন্যাস। বিচারপ্রক্রিয়া যত লম্বা হবে বিক্রি তত বাড়বে, প্রকাশকের এমনটাই মত। ইতিমধ্যে চলচ্চিত্র তৈরির ব্যাপারেও কথা হয়েছে।
সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও কিছু ঘটনা আমার পরিকল্পনা মত হয়নি। এর জন্য আমার আফসোস হয় কেননা লক্ষ্য অর্জনের এতো কাছে চলে গিয়েছিলাম। যদি সময়মতো সবকিছু করতাম, যদি নিজের পরিকল্পনা সম্পর্কে আরেকটু কম আত্মবিশ্বাসী হতাম, আপনার স্ত্রীকে হত্যা করেই পালিয়ে যেতে পারতাম, আমার পরিকল্পিত স্বর্গে বসেই এই চিঠি লিখতাম। শেষমেশ ন্যায়ের সম্মুখীন হতেই হয়েছে। আশা করি আপনি এতে খুশি হবেন।
একটা জিনিস খেয়াল করবেন আমি ‘মাস্টারওয়ার্কের’ কথা না বলে ‘পরিকল্পনার’ কথা বলছি। কারণ ওসবের আর দরকার নেই। সবই ছিলো
আমার পরিকল্পনার অংশ। শুধু আপনাকে একটু গোলকধাঁধায় রাখার জন্য ‘মাস্টারওয়ার্কের’ প্রসঙ্গ তুলে আনি। অবশ্য আমি এতে সফল ছিলাম। আসলে আমি ওই ধরনের কিছুই না। আপনি ওই ধারণা মেনে এগুচ্ছেন দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলাম আমি। আপনার মনস্তত্ত্ববিদ বরাবরের মতই আমার সম্পর্কে ভুল ধারণা দিয়েছে। আমি আগাগোড়া একজন বাস্তববাদী মানুষ। আমার প্রতিভা নিয়ে কখনোই কোনো সন্দেহ ছিলো না। আমি জানতাম একসময় আমার বই নিয়ে মাতামাতি হবে, সবাই বাহবা জানাবে। গোয়েন্দা সাহিত্যের ইতিহাসে আমার বই আলাদা স্থান দখল করে রাখবে। আমার একার পক্ষে এতোসব অর্জন করা সম্ভব ছিলো না।
আপনার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি সন্দিহান, ক্যামিল। ভুল কিছু বলে থাকলে ক্ষমা করবেন। আমার উপন্যাসে আপনার ভূমিকা প্রশংসনীয়। যদিও উপন্যাসে যেমনটা দেখানো হয়েছে আপনি আসলে তেমন না। আপনিও তা ভাল মত জানেন।
নিজেদের ভবিষ্যতের কথা আমরা কেউই জানি না। সম্ভবত আমরা আলাদা কোনো সত্ত্বা না। একদিক থেকে বিবেচনা করলে আমরা দু’জন মিলেই আইরিনকে খুন করেছি।
এই প্রশ্নের জবাব আপনি নিজেই খুঁজে নিবেন।
আপনার একান্ত অনুগত ভক্ত
–ফিলিপ বুসন