2 of 3

৯৪. হেমন্তের স্নিগ্ধ বিকেল

৯৪

হেমন্তের স্নিগ্ধ বিকেল। রবীন্দ্রসদনের দিক থেকে ডানহাতি ফুটপাথ ধরে দুজনে উত্তর দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। রবীন্দ্রসদনের টিকিট পায়নি তারা। সম্ভবত অ্যাকাডেমিরও পাবে না। টিকিট না পেলে অবশ্য তাদের কিছুই যায় আসে না। টিকিট বা নাটক দেখা একটা ছুতো মাত্র।

অনিন্দিতা বলল, তোমাকে নিয়ে আর পারি না। কোনও ব্যাপারেই তোমার কোনও আগ্রহ নেই কেন বলো তো! নাটক হোক, ফিল্ম হোক, পেইন্টিং হোক, কোনও না কোনও বিষয়ে তো মানুষের কণামাত্র ইন্টারেস্ট থাকবে! তোমার কিছুতেই নেই।

চয়ন মৃদু হেসে বলে, আছে।

কিসে আছে শুনি?

আমি পড়তে ভালবাসি।

ওটা কোনও কথা হল? পড়তে ভালবাসলেই কি হয়? জীবন কত ছড়ানো। কত কী হয়ে যাচ্ছে আর্টে, কালচারে!

তাই নাকি?

তুমি কোনও খবরই রাখো না। বড্ড কুনো স্বভাব বাপু তোমার।

তা ঠিক। ঘরের কোণ আমার খুব পছন্দসই জায়গা। লোকজনের জমায়েত দেখলেই আমার অস্বস্তি হয়।

কী যে করি তোমাকে নিয়ে! এই স্বভাবের জন্যই তোমার কিছু হয় না। যদি একটা ঝাঁকুনি মেরে জড়তার ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারতে, তাহলে কিন্তু তুমি অনেক কিছু করতে পারতে।

তাই কি? সবাই কিন্তু সব কিছু পারে না। আর একটা কথা শোনো, আর্ট কালচারে আমাকে ইন্টারেস্টেড করে তুলে কী হবে বলো তো! কত মানুষ তো ও সব ছাড়াই দিব্যি বেঁচে আছে।

ওকে বেঁচে থাকা বলে না। তোমাকে এ পর্যন্ত আট-দশটা নাটক দেখালাম, তবু তোমার নাটকে আগ্রহ হচ্ছে না দেখে অবাক হচ্ছি। কেন হচ্ছে না বলো তো!

নাটক দেখতে তো আমার ভালই লাগছে।

মোটেই না। তুমি দেখতে হচ্ছে বলে দেখছো। জোর করে ধরে নিয়ে আসি, তাই।

না অনিন্দিতা, ঠিক তা নয়। নাটক বা ফিল্মে একটা কৃত্রিমতার গন্ধ থাকেই। কিছুতেই সেটা আমি ভুলতে পারি না।

আচ্ছা পাগল যা হোক! এইজন্যই বলি তোমাকে আর মানুষ করা গেল না।

অ্যাকাডেমিতেও টিকিট নেই। অনিন্দিতা মুখ ভার করে বলল, আজ যে কী হল! কোথাও টিকিট পেলাম না। নিশ্চয়ই তুমি মনে মনে এ রকমটা চেয়েছিলে। বেরসিক কোথাকার!

আমার ইচ্ছাশক্তির কি এত জোর আছে অনিন্দিতা?

আছে বোধহয়।

চলো হাঁটি। বন্ধ ঘরে বসে ও সব দেখার চেয়ে খোলা হাওয়ায় একটু হাঁটাহাঁটি করা বরং অনেক ভাল।

হাঁটা একটা বিচ্ছিরি একঘেয়ে ব্যাপার। তুমি এত হাঁটতে ভালবাসো কেন?

হাঁটতে ভালবাসি তার একটা কারণ আছে। হাঁটতে হাঁটতে খুব ধীরে ধীরে চারদিকটাকে খুব ভাল করে অবজার্ভ করা যায়। ডিটেলসে।

কি জানি বাবা, চারদিকটা তো রোজই একইরকম আর একঘেয়ে।

ঠিক বোঝাতে পারব না। জানোই তো আমার কথাটথা ভাল আসতে চায় না। অনেক কথা বুঝতে পারি, কিন্তু বোঝাতে পারি না।

অনিন্দিতা মৃদু একটু রহস্যময় হাসি হেসে বলল, আচ্ছা তোমার আর আমার সম্পর্কটা নিয়ে কখনও ভেবেছো?

কী ভাববো?

এই সম্পর্কটা আসলে কি? প্রেম ভালবাসা, না বন্ধুত্ব?

চয়ন একটু অস্বস্তি বোধ করে বলে, এটাও আমি ঠিক বুঝতে পারি না, অনিন্দিতা। আমি জীবনে কারও সঙ্গে প্রেমট্রেম করিনি। আমার ভিতরে আবেগ এত কম!

দূর বোকা, প্রেম একটা বায়োলজিক্যাল ব্যাপার। ওর জন্য এক্সপেরিয়েন্স দরকার হয় না। তবে ভয় পেও না। তোমার আর আমার মধ্যে বন্ধুত্বটাই আছে। অন্য কিছু নয়। কি, শুনে স্বস্তির শ্বাস ফেললে তো!

চয়ন একটু হেসে বলল, তা হবে! তবে তোমাকে আমি কখনও অপছন্দ করিনি তো। তোমার সঙ্গ আমার বেশ ভাল লাগে।

সেটা আমারও লাগে। প্রেম জিনিসটা তার চেয়ে কিছুটা বাড়তি জিনিস।

তুমি কখনও কারও প্রেমে পড়েছে অনিন্দিতা?

অনিন্দিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একবার।

ও।

শুনবে সে কথা?

চয়ন একটু মিটিমিটি হেসে বলল, সেটা কি ব্যর্থ প্রেম?

তা তো বটেই! আমার মত মেয়েকে তার পাত্তা দেওয়ার কথাই নয়। দেয়নি কোনোদিন। কিন্তু তার কথা ভাবলেই আমার চোখে জল আসে।

ও।

তুমি কৌতূহল দেখাচ্ছো না তো!

না।এ সব ব্যাপারেও আমার আগ্রহ নেই।

কেন নেই?

প্রেমটাও একটা আবেগসর্বস্ব ব্যাপার। বিয়ে-টিয়ে করলে সেই আবেগটা অনেকটাই কেটে যায়।

উল্টোটাও আছে।

থাকতে পারে!

তুমি ভীষণ নেগেটিভ টাইপের লোক।

তা হবে।

মোড় অবধি এসে অনিন্দিতা থমকে দাঁড়িয়ে বলল, এবার কি করব বলো তো! কোনদিকে যাবো?

চলো চৌরঙ্গি ধরে হাঁটি। এসপ্লানেড অবধি গিয়ে বাস ধরব।

উঃ, হাঁটতেও পারো বটে তুমি! আমার কিন্তু হাঁটু ব্যথা করছে। আচ্ছা, ফুচকা খেলে কেমন হয়?

তোমার না খুব অম্বল হয়?

সে তো আছেই! চলো ভিক্টোরিয়ার সামনে খুব ভাল ফুচকা পাওয়া যায়।

আমি যে ও সব খাই না। সহ্য হয় না।

সহ্য হয় কি না আজ পরীক্ষা হয়ে যাক। আমার ব্যাগে অ্যান্টাসিড আছে, ভয় নেই।

চয়ন মৃদু স্বরে বলে, আমি বোধহয় ও সব খেলে অজ্ঞান হয়ে যাবো।

মোটেই না। ওসব ভাবলেই তোমার হয়।

অনিন্দিতার ফুচকা খাওয়ার দৃশ্যটা মোটেই ভাল লাগছিল না চয়নের। বড্ড লোভীর মতো খাচ্ছে। একটু বাদে ওর আইঢাই অম্বল হবে, কড়ার নিচে ব্যথা হবে। তবু কেন খাচ্ছে? চয়ন মাঝে মাঝে খুব ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে ঠিকই, কিন্তু সে কখনও যা-তা খেতে পারে না।

তুমি শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে রইলে, একটু ঝালমুড়ি অন্তত খাও।

না অনিন্দিতা। আমার সহ্য হয় না।

বড্ড সাবধানী, বড্ড গুডি গুডি তুমি।

চয়ন একটা শ্বাস মোচন করে বলে, আমি ঠিক আমারই মতো। অপদার্থ, অচল।

তোমার ওসব অটো সাজেশনই তোমাকে খেয়ে ফেলছে।

তাও জানি। তুমি আর খেও না। অনেক হয়েছে।

আচ্ছা আচ্ছা। একজন শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকলে খেতে ভালও লাগে না।

ফুচকার দাম মিটিয়ে ফের দুজনে হাঁটতে লাগল। আজ রবিবার। ঈষৎ শীতল সন্ধেবেলায় ময়দানে মানুষের ঢল নেমে এসেছে। ভিড়ের জায়গা চয়নের ভাল লাগে না।

এবার বাসে উঠবে চয়ন?

চলো।

বাসায় নিজের চিলতে ঘরখানার নির্জনতায় ফিরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল চয়ন। ছুটির দিনে আজকাল অনিন্দিতা তাকে টেনে হিঁচড়ে নানা জায়গায় নিয়ে যায় বা যেতে চেষ্টা করে। এই আউটিংটা তার একদম পছন্দ নয়। বড় নিরর্থক আর ক্লান্তিকর মনে হয়। নাটক দেখে বেড়ানোতেও সে তেমন কোনও আকর্ষণ বোধ করে না। এ বার সে অনিন্দিতাকে বলবে, আমি আর এসব পারছি না। ছেড়ে দাও আমাকে। বলাটা খুব শক্ত। সে কিছুতেই দৃঢ়ভাবে নিজের মত প্রকাশ করতে পারেনি কখনও।

অনিন্দিতার ফুচকা খাওয়ার দৃশ্যটা কেন বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে তার? ঊর্ধ্বমুখ, মস্ত হাঁ, ফুচকাটা টপ করে হাঁয়ের মধ্যে ফেলে দেওয়া, তারপর চিবোনো এবং মুখে আহ্লাদ ও উত্তেজনা ফুটে ওঠা—সবটাই তার কাছে এত খারাপ লাগছে।

একটু রাতের দিকে অনিন্দিতা ফের ছাদে উঠে এল। চয়ন তখন স্টোভ জ্বেলে রাঁধতে বসেছে।

এই, শুনেছো, তোমার দাদা আর বউদি আজ বাড়ি নেই। কোন্নগর না কোথায় বেড়াতে গেছে, আজ ফিরবে না। তাই আড্ডা মারতে চলে এলাম।

চয়ন একটু হাসল। দাদা বউদি থাকলেও আজকাল অনিন্দিতা প্রায়ই আসে। তবে সন্ধের পর বেশিক্ষণ থাকে না। সে বলল, ভালই তো! কিন্তু খোলা ছাদে ঠাণ্ডা লাগতে পারে।

কিছু হবে না। রান্না তাড়াতাড়ি শেষ করো। একটু গল্প করি।

তাদের গল্প করাটা কিন্তু অদ্ভুত। চয়নের কথা বিশেষ থাকে না। অনিন্দিতার অনেক থাকে। ও বক্তা, সে শ্রোতা। সম্পর্কটা যে কোনদিকে গড়াবে তা ভেবে পায় না চয়ন।

তার পাশে উবু হয়ে বসে অনিন্দিতা বলে, কী রাঁধছো?

ভাত আর সেদ্ধ। আজ আর বেশী কিছু নয়।

আহা, কবেই বা তুমি পঞ্চব্যঞ্জন রাঁধো! মা আজ মাংস বেঁধেছে, একটু নিয়ে আসব?

না না, মাংস আমার সহ্যই হয় না।

ওঃ, কী নিরামিষ লোক।

চয়ন মৃদু একটু হাসে।

আচ্ছা, তুমি ডিম খাও না কেন?

এ কথার জবাব দিলে তুমি আমার ওপর বিরক্ত হবে।

ও মা, কেন?

একই কথা বারবার বলতে হয় যে! আমার সহ্য হয় না।

মাছ তো খেতে পারো।

তা পারি। কিন্তু ঝামেলা। খাওয়াটা আমার কাছে উপভোগ্য ব্যাপার নয়। খেতে হয়, তাই খাই। খাওয়া না থাকলে আমার খুব ভাল হত।

কিম্ভূত আছে। আমি কিন্তু খেতে ভালবাসি।

সেটাই স্বাভাবিক। আমি তো স্বাভাবিক নই!

স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে শুরু করলেই দেখবে তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো সব কিছুই ভালবাসবে।

হয়তো ঠিকই বলেছো।

আমার কী ইচ্ছে করে জানো? তোমাকে জোর করে স্বাভাবিক জীবনে টেনে আনি।

আমাকে নিয়ে কেন ভাবো অনিন্দিতা? দুঃখ পাবে।

অনিন্দিতা তার সুন্দর দাঁত ঝলসে হাসল, তবু ইচ্ছে করে।

চয়ন মৃদু একটু হেসে বলল, ইচ্ছেটাকে আর প্রশ্রয় দিও না। তাহলে তোমাকে আমার ভয় করবে।

ও মা! কী কথা দেখ! আমাকে আবার ভয়ের কি?

ওই যে, জোর করতে চাও!

যাকে ভালবাসা যায় তার ওপরেই তো জোর করা যায়। তাই না?

চয়ন মৃদুস্বরে আত্মবিশ্বাসহীন গলায় বলে, তা বটে।

তা হলে?

আমার ওপর জোর খাটাতেও হয় না। আমি সবসময়ে অন্যকে খুশি রাখতে চেষ্টা করি। অনেক সময়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে। করি না, বলো?

হ্যাঁ, তা করো। যেমন ইচ্ছে না হলেও আমার সঙ্গে নাটক দেখতে যাও, বেড়াতে যাও। শুধু ফুচকাটা খাওনি।

আরও একটু জোর করলে তাও হয়তো খেতাম। তারপর সারা রাত জেগে থাকতাম অস্বস্তিতে। তাই বলি, আমার ওপর জোর করার দরকার নেই।

তাই বুঝি?

বলে আচমকা যে কাণ্ডটা করে বসল অনিন্দিতা তার কোনও যুক্তিসিদ্ধ অর্থ হয় না, না হয় তার কোনও ব্যাখ্যা। খুবই অকস্মাৎ সে দুই হাতে চয়নের দুটো কাঁধ ধরে নিজের শরীরের দিকে টেনে নিল তাকে। খোলা, বিপজ্জনক ছাদে তার দুখানা ঠোঁট চেপে বসে গেল চয়নের ঠোঁটে। কয়েকটা অদ্ভূত মুহূর্ত। তারপরই তাকে ছেড়ে দিল অনিন্দিতা।

বেসামাল চয়ন পড়েই যাচ্ছিল ছেড়ে দেওয়ার পর। সামলে নিল। কি হল কাণ্ডটা তা সে বুঝতেই পারল না প্রথমে। কি করল এটা অনিন্দিতা? কেন করল?

অনিন্দিতা উঠে দাঁড়াল। তারপর অস্ফুট কণ্ঠে বলল, যাচ্ছি।

সিঁড়িতে তার পায়ের শব্দ যখন নেমে যাচ্ছিল তখন কাঁধে আর ঘাড়ে একটা ব্যথা টের পায় চয়ন। বড্ড হঠাৎ তাকে জাপটে ধরেছিল। বেকায়দায় লেগেছে।

হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁটদুটো মুছে ফেলে চয়ন। কিন্তু ঘটনাটা তো ও ভাবে মুছবে না: এর যে গভীর দাগ থেকে যাবে তার স্মৃতিতে। এটা কী করল মেয়েটা।

চারদিকে কাছাকাছি ছাদগুলোর দিকে চেয়ে দেখল চয়ন। না, কেউ কোথাও নেই। হয়তো কেউ দেখেনি। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, এই ঘটনাটা ঘটিয়ে অনিন্দিতা কী বলতে চাইল তাকে?

স্টোভটা নিবিয়ে দিল চয়ন। তার ভিতরটা গুলিয়ে উঠছে। অদ্ভুত লাগছে। তার জীবনে এরকম অভিজ্ঞতা এই প্রথম। কিন্তু অভিজ্ঞতাটা ভাল না মন্দ তা সে বুঝতে পারছে না। তার ভাল লাগছে না। তার শরীর খারাপ লাগছে।

আধাসেদ্ধ ভাত স্টোভের ওপরেই পড়ে রইল। ঘরে ঢুকে বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়ল চয়ন। তার শরীর কাঁপছে থরথর করে। মনটা অস্থির। মাথাটা পাগল-পাগল লাগছে। শুয়ে থেকে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল চয়ন। কিন্তু কেবলই মনে হচ্ছে, একটা অঘটন তার অস্তিত্বের ভিত বড্ড নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ভীষণ।

অথচ একটি চুম্বন তো এমন কিছু দোষের ব্যাপার নয়। তার জীবনে হয়তো প্রথম। কিন্তু এ রকম তো হয়! অনিন্দিতার কাছ থেকে ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত ছিল বলেই কি তার একটুও ভাল লাগছে না?

অনিন্দিতা এ ভাবে কিছু কি বলতে চাইল তাকে?

কি বলতে চাইল, তা চয়ন জানে না। কিন্তু তার শরীর জেগে উঠল না এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়। বরং তার চোখে জল এল। প্রেমহীন চুম্বন কত কষ্টকর হতে পারে। এমন কি যেখানে কামনাটুকু অবধি নেই!

প্রায় সারা রাত জেগে রইল চয়ন। যখন ঘুম এল না তখন চাদর মুড়ি দিয়ে ছাদে ঘোরাফেরা করল। রেলিং ধরে উদাস চোখে চেয়ে রইল দূরের দিকে। মানে হয় না, কোনও মানেই হয় না।

ধীরে ধীরে ভোর হয়ে গেল। আর কি কখনও অনিন্দিতার সঙ্গে সহজে মিশতে পারবে সে? পারবে ওর চোখের দিকে তাকাতে?

সারাদিন একটা ঘোরের মধ্যে রইল চয়ন। যন্ত্রের মতো সকালের টিউশনিগুলো সেরে এল। ভাত রাঁধল, খেল। তারপর বিকেলে গেল চারুশীলার বাড়ি। সবই ঘটছিল যেন স্বপ্নের মধ্যে। তাকে এই কঠিন বাস্তব যেন স্পর্শই করছে না।

চারুশীলা তাকে দেখেই বলে উঠল, এই চয়ন, তোমার কী হয়েছে বলো তো!

চয়ন এই সামান্য প্রশ্নেই ভীষণ থতমত খেয়ে বলে উঠল, না না, কিছু হয়নি তো!

না মানে? তোমার মুখ যে ভীষণ শুকনো। চোখ অমন লাল কেন?

চয়ন যেন ধরা-পড়ে গেছে এমন আতঙ্কের সঙ্গে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, না, কিছু হয়নি আমার। কিছু হয়নি।

টেম্পারেচার নেই তো! সিজন চেঞ্জের সময়, খুব জ্বর হচ্ছে চারদিকে।

না, জ্বর নয়। রাতে ঘুম হয়নি।

কেন হয়নি?

এমনিই।

আমার ভীষণ ঘুম, তা জানো? লোকে বলে ব্রেনলেসদের নাকি ভাল ঘুম হয়।

চয়ন এবার একটু হাসল। কিছু বলল না।

শরীর খারাপ লাগলে আজ পড়াতে হবে না। আজ ছুটি। বসো, তোমাকে একটা নতুন জিনিস খাওয়াবো।

আজ আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।

শোনো, আমি কিছু অফার করলে কখনও না বলবে না। নেগেটিভ জবাব আমার একদম পছন্দ নয়। একটু হলেও খাবে। এসো তো, ডাইনিং টেবিলে এসে বোসো।

অগত্যা একটা অচেনা ঝাল-নোনতা হালুয়া গোছের জিনিস অনিচ্ছের সঙ্গে খেতে হল চয়নকে।

চারুশীলা জিজ্ঞেস করল, এক রাতেই তোমার চেহারাটা অন্যরকম হয়ে গেল কেন বলো তো!

চয়ন লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিল।

তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, ইউ আর ইন এ শক।

না তো! কিছু হয়নি।

বলতে না চাইলে বোলো না। কিন্তু খুব শকিং কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। আচ্ছা, তুমি কি ওজন নাও?

না তো!

কেন নাও না? রেগুলার ওজন নিলে বুঝতে পারবে তোমার স্বাস্থ্য ভাল হচ্ছে কি না।

চয়ন বলল, আমার আর ভাল কিছু হবে না।

আমার তো মনে হচ্ছে উল্টোটাই। ইদানীং তোমার ওজন একটু বেড়েছে বোধহয়। চলো তো, তোমার ওজনটা একটু দেখি।

চয়নকে তাও করতে হল। ডাইনিং হল-এর কোণে দামী একটা ওজন নেওয়ার যন্ত্রে তাকে তুলে চারুশীলা স্কেলটা দেখে বলল, এখনও তুমি বেশ আন্ডারওয়েট। আরও দশ কেজির মতো বাড়লে তবে হয়।

চয়ন খুব লজ্জিত মুখে চুপ করে থাকে।

রাতে নিজের ঘরে যখন চয়ন ফের একা হল তখন একটা হতাশা আর বিভ্রান্তিতে সে কয়েক টুকরো হয়ে আছে। কিছু করতে ইচ্ছে করছে না।

শুয়ে থেকে থেকে সে অনেক ভাবল। অনেক, অনেক ভাবল।

অনিন্দিতার সঙ্গে দেখা হল আরও তিনদিন বাদে।

সন্ধের পর অনিন্দিতা উঠে এল ছাদে।

ক্ষমা করো চয়ন।

চয়ন চুপ করে রইল।

তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি, ভুল করেছি।

কেন করলে?

তোমাকে শক দেওয়ার জন্য। ভেবেছিলাম ধাক্কাটা তোমার উপকার করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *