৯০. হুমকির রাজনীতির শিকার আজ প্রগতিশীল মানুষ
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সারা বাংলাদেশে উন্মত্ত মৌলবাদীরা ধর্মের নামে তাণ্ডব শুরু করেছিল। রাস্তাঘাট মাঠ-ময়দান ছিল তাদের দখলে। তারা আমাকে, একজন লেখককে, ফাঁসি দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সরকারের দয়াদাক্ষিণ্যে মৌলবাদীরা দিনে দিনে কত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, তা বাংলাদেশের মানুষ প্রথম লক্ষ্য করেছিল। তাদের ডাকা হরতাল, লং মার্চ সবই তখন সফল হয়েছিল। সরকার ওই গণতন্ত্র-বিরোধী, বাকস্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে তখন নিয়ন্ত্রণ করার বদলে আমাকে শাস্তি দিয়েছিল, আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল, আমাকে গ্রেফতার করার হুলিয়া জারি করেছিল, আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিল। কয়েক মাস জুড়ে উন্মত্ত যে তাণ্ডব চলছিল, তা আপাতত থেমেছিল। সরকার হয়তো ভেবেছিল, আপদকে বিদেয় করা হয়েছে, এখন জনতা শান্ত। পরিস্থিতিকে সামাল দিতে, দেশের ভালোর জন্য সেটিই কি সরকারের করণীয় ছিল? অবশ্যই নয়। আসলে দেশের ভালোর জন্য যা করণীয় ছিল তা হল আমাকে শাস্তি না দিয়ে, উন্মত্ত অপশক্তিকে শাস্তি দেওয়া, যারা দেশের আইনের তোয়াক্কা না করে, গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত মত প্রকাশের অধিকারকে অস্বীকার করে লেখকের মাথার মূল্য ঘোষণা করেছিল, বাড়িঘর, দোকানপাট, বাস, ট্রাক ভেঙেছিল, পুড়িয়েছিল। আমাকে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত একজন ডাক্তারকে, এবং মানবাধিকার, নারীর অধিকার, আর মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে লেখা বইয়ের একজন লেখককে দেশ থেকে বিতাড়ন করা দেশের মৌলবাদী সমস্যার সমাধান ছিল না। যারা দেশের মঙ্গল চায় না, বরং দেশকে ধর্মের নামে রসাতলে নিয়ে যেতে চায়, তারা যা দাবি করেছিল, তা মেনে নিয়ে ভয়ংকর একটি ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করেছিল দেশ। আমাকে হারিয়ে দিয়ে মৌলবাদীদের জিতিয়ে দিয়েছিল সেদিনের সরকার। শতগুণ শক্তি নিয়ে যে মাঠে ফিরে আসবে মৌলবাদীরা, দূরদৃষ্টিহীন রাজনীতিকেরা সেটা বুঝতে পারেনি। অথবা বুঝেও আমল দেয়নি। দেশ নিয়ে সত্যিই কি তাদের কোনও ভাবনা আছে? ফতোয়াবাজদের, লং মার্চের উদ্যোক্তাদের, ধর্মের নামে যারা দেশ থেকে গণতন্ত্র হঠিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাদের বন্ধু ভেবে আলিঙ্গন করেছিল রাজনীতিকরা, তাদের দলে টেনেছিল, তাদের সংসদে বসিয়েছিল।
আজও তার মাশুল দিতে হচ্ছে প্রতিটি সরকারকেই। আজ মৌলবাদীদের উপঢৌকন দিয়ে, তাদের অন্যায় আবদার মিটিয়ে, তাদের কাছে নতজানু হয়ে তাদের খুশি রেখে গদি ঠিক রাখতে হয়। আমাদের সরকাররা জনগণের খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যত না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত নিজের গদি নিয়ে। গদি বাঁচানোর জন্য যা যা করা দরকার বলে মনে করে, তাই করে। নানা কিসিমের অপরাধ করতেও দ্বিধা করে না। কেউ কেউ এই ফাঁকে আখেরও গুছিয়ে নেয়। এই সন্ত্রাসী মৌলবাদীরা যখন মুক্তচিন্তকদের এক একজনকে কুপিয়ে মেরে ফেলে, তখন সরকারকে চুপ হয়ে থাকতে হয়, একটি বাক্য উচ্চারণ করার সাহস হয় না। সেদিন, নব্বইয়ের শুরুতে মৌলবাদের উত্থানকে যদি ঠেকাতো সরকার, তবে আজ তারা এত বড় জল্লাদ হতে পারতো না। দোষ কিন্তু শুধু সরকারের নয়, দোষ বুদ্ধিজীবীদেরও। যে মানুষটি মৌলবাদীদের দ্বারা নির্যাতিত, তার বিরুদ্ধে যখন সরকারি হামলা হল, যখন নব্বইয়ের দশকে একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করতে লাগলো সরকার, ক’জন বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদ করেছিলেন? প্রকাশকরা কী করেছিলেন? আমার বই ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আর পত্রিকার সম্পাদকরা, যে সম্পাদকদের আমরা প্রগতিশীল বলে জানতাম, তাঁরাই মৌলবাদী অপশক্তি আর দূরদৃষ্টিহীন সরকারের মতো আমাকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। আর ফাঁকা মাঠে তখন একশ্রেণীর মৌলবাদী প্রচারযন্ত্র আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছিল। কেউ এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেনি। আমার কণ্ঠরোধ, তার ওপর বিরুদ্ধ-মিডিয়ার অপপ্রচারের অবাধ স্বাধীনতা। সবই, আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে ভয়ে মুখ বুজে থাকার এক ভয়ংকর সংস্কৃতি উপহার দিয়েছিল। মানুষ যেন তসলিমাকে ঘৃণা করে, তসলিমার যে পরিণতি হয়েছে, সেই পরিণতিকে ভয় পেয়ে তার মতো হওয়ার, তার মতো কথা বলার চেষ্টা যেন না করে। তাই তো হয়েছে। যে কথা বলেছে, তাকে হুমকি দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, অথবা দিনেদুপুরে চাপাতি চালিয়ে খুন করেছে।
আজ মানুষকে মুখ বুজে থাকতে হয়। লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক সকলে ভয়ে তটস্থ। মুক্তচিন্তার প্রকাশ দেশটিতে নিষিদ্ধ। শিল্পীরা তটস্থ। চিন্তাশীল, প্রগতিশীল, সকলে সিঁটিয়ে আছে আতঙ্কে। এসব দেখলে নব্বইয়ের শুরুতে মৌলবাদীদের উত্থানের কথা মনে পড়ে। কিছু কাজ ঠিক সময়ে না করলে বড় ক্ষতি হয়ে যায়। সকলে মিলে একজন নারীবাদী লেখকের ক্ষতি করতে গিয়ে আসলে দেশের খুব বড় ক্ষতি করে ফেলেছে। এত কথা এইজন্য বলছি যে বাংলাদেশের ইউটিউবার এবং অনলাইনে শিক্ষাদান কর্মসূচি পরিচালনা বিষয়ক সংস্থা টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আয়মান সাদিককে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে টেন মিনিট স্কুলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সাকিব বিন রশীদকেও। আয়মান সাদিক বলেছেন, ‘ফেসবুক, ইউটিউবসহ অনেক জায়গায় আমাকে মেরে ফেলার জন্য বলা হচ্ছে।’ টেন মিনিট স্কুলের অনেক মানুষকে মেরে ফেলার জন্য বলা হচ্ছে। টেন মিনিট স্কুলকে বয়কট করার জন্য বলা হচ্ছে। ফেসবুকে হুমকিদাতারা লিখেছে, ‘এই মুরতাদকে যেখানেই আপনারা পাবেন, তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিবেন। হাজার হাজার মানুষ সেটা শেয়ার করছে’। সাকিব বন রশীদকে বলা হচ্ছে তিনি নব্য মিশনারি, কাফিরদের এজেন্ট, পশ্চিমা অপসংস্কৃতি প্রচার করার এজেন্ট। এই ভাষা আমার খুব চেনা। সেই নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু, আমাকে মুরতাদ, ইসলাম বিরোধী, কাফির, পশ্চিমা অপসংস্কৃতির এজেন্ট বলা হতো। এই দোষগুলো দিলে তারা মনে করে তারা সাধারণ ধর্মভীরু মানুষের সমর্থন পাবে। তারা কিন্তু ভুল নয়। ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে জগতে হেন অপরাধ নেই যে তারা করছে না, আর সাধারণ মানুষ চোখে ঠুলি এঁটে বসে আছে, আর মন প্রাণ দিয়ে অজ্ঞতা আর মূর্খতার চর্চায় নিজেদের ডুবিয়ে দিয়েছে। সরকার এবং ধর্মান্ধ কেউ চায় না দেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চা চলুক। চললে দু-পক্ষেরই অসুবিধে কিনা।
কী দোষ আয়মান সাদিকের এবং তার স্কুলের? দোষ তাঁরা মেয়েদের ঋতুস্রাব যে অপবিত্র কিছু নয়, তার ব্যাখ্যা করেছেন। যৌন মিলনের জন্য সম্মতির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। এতে নারীবিরোধী ধর্মান্ধ অপশক্তির বড় রাগ। কারণ তারা ধর্ষণে বিশ্বাস করে, তারা বিশ্বাস করে ঋতুস্রাব খুব নোংরা ব্যাপার, ঋতুস্রাব মেয়েদের অপবিত্র করে। তারা ঘোষণা দিয়েছে, এই ভিডিও দুটো ইসলাম-বিরোধী। যারা ভিডিও বানিয়েছেন তাঁরাও ইসলাম-বিরোধী। ইসলাম-বিরোধী—এই তকমা কাউকে দিলে তার সর্বনাশ হয়ে যায়। যেমন আমার হয়েছে। আমি কিন্তু ভয়ে আমার কোনও বই বা লেখা ছিঁড়ে ফেলিনি। কিন্তু আয়মান সাদিক তাঁর ভিডিও দুটো অনলাইন থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। শুধু সরিয়েই দেননি, ক্ষমাও চেয়েছেন। বলেছেন, ঋতুস্রাব ও সম্মতি নিয়ে করা ওই দুটো ভিডিও অনেকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার কারণে তারা দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। এর চেয়ে বড় পরাজয় আর কী হতে পারে? মৌলবাদীদের তিনি জিতিয়ে দিলেন। বার বার প্রগতিশীলদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হচ্ছে মৌলবাদী অপশক্তি।
এতে সরকারের ভূমিকা কী? প্রগতিশীলদের পাশে থাকা? না, বরং মৌলবাদীদের পাশে থাকা। নব্বইয়ের শুরু থেকে তো সব সরকারই মৌলবাদীদেরই পাশে থাকছে। সত্যিকার জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা বাংলাদেশে হতে দেবে না মৌলবাদীরা। গণতন্ত্র-বিরোধী, নারী-বিরোধী, মানবাধিকার-বিরোধী, মানবতা-বিরোধী লোকগুলো ধর্মের নামে সমাজকে অসুস্থ বানানোর ষড়যন্ত্রে বহু বছর থেকেই লিপ্ত। এদের হাতের মুঠোয় আজ বন্দি রাষ্ট্র, সমাজ, এবং জনতা।
এই ধর্মান্ধ বদলোকগুলোকে ধর্ম রক্ষার দায়িত্ব কে দিয়েছে? আজ তারা এত সহজে দেশকে ধ্বংস করে দিতে পারছে কেন? কে তাদের সাহায্য করছে? দেশের সর্বনাশ করার জন্য তারা সবচেয়ে বড় যে হাতিয়ারটি নিয়েছে, সেটি ইসলাম। এই ধর্ষক, ইয়াবা ব্যবসায়ী, নারীবিদ্বেষী বদলোকগুলো যেভাবে ইসলাম পালন করার নির্দেশ দেবে, মানুষ কেন বাধ্য থাকবে সেভাবে ইসলাম পালন করতে? ইসলামকে তারা যেন হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করতে পারে, সেটির ব্যবস্থা সরকার আর কবে করবে? দেরি কি যথেষ্ট হয়নি? তাদের হাত থেকে চাপাতি কেড়ে নেওয়ারও কি সময় আজও আসেনি?
৯ ১. করোনা ভাইরাসের সঙ্গে জীবনযাপন কি সম্ভব?
দিন দিন খারাপ খবর আসছে। ঘরে বসেও রক্ষে নেই, বাতাসের সঙ্গে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়তে পারে করোনা। করোনা আক্রান্ত লোকেরা হাঁচি কাশি দিলে তো বটেই, এমনকি কথা বললেও, নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেললেও নাক মুখ থেকে বেরোবে ড্রপলেটস বা জলফোঁটা, ভাইরাস কিলবিল করছে যে সব জলফোঁটায়। বড় জলফোঁটাগুলো মাটিতে পড়ে যায়, আর ছোটগুলো বাতাসে ভাসে। কত দূর যেতে পারে বাতাসে, ছ’ফুট, বারো ফুট, দু’মিটার, ছ’মিটার এরকম শুনেছি আগে। থাকে কতক্ষণ? থাকে দু’তিন ঘণ্টা। এখন আরও গবেষণার পর কী বলছেন বিজ্ঞানীরা? বলছেন ছোট জলফোঁটাগুলো বাতাসে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ঘুরে বেড়ায়। অনেকটা দূরেই এই ভাইরাস যেতে পারে। এক ঘরে কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে, পাশের ঘরে বসে আর এক লোক বাতাসে ভাসা ভাইরাস তার ফুসফুসে শ্বাসের সঙ্গে নিতে পারে। আমাদের চারপাশে প্রচুর লোক নিঃশ্বাস ফেলছে। সুতরাং বাতাসে সারাক্ষণই ভাইরাস ভাসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাসের এই ধ্বংসাত্মক চরিত্রটি নিয়ে তেমন কিছু বলেনি আগে। বলেছে বড় জলফোঁটাগুলো যেসব জায়গায় পড়তে পারে, সেসব জায়গায় হাত না দিতে, সেসব জায়গা সাবান দিয়ে ধুয়ে দিতে, হাতও সাবান দিয়ে বারবার ধুতে। মানুষ বড় জলফোঁটার কথাই বেশি জানে। আর ছোট জলফোঁটাগুলোকে তো কোনো সাবান বা স্যানিটাইজার বা ডিসিনফেক্টেন্ট দিয়ে ধোয়া যায় না! এই ফোঁটাগুলোই তো শ্বাসের সঙ্গে ঢুকে পড়ছে আমাদের ফুসফুসে! এই তথ্যটি জানিয়ে কেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জনগণকে সতর্ক করেনি, এ নিয়ে বেশ অনেক বিজ্ঞানীই ক্ষুব্ধ। সে কারণেই ৩২টি দেশের ২৩৯ জন বিজ্ঞানী জনগণকে শুনিয়েই বলে দিয়েছেন যেন তথ্য না লুকিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জগতকে জানিয়ে দেয় যে করোনা ভাইরাস—যে ভাইরাসটি কোভিড১৯ নামের রোগ ঘটাচ্ছে—সেটি বায়ু বাহিত। বলে কী লাভ। এই যে শুনছি করোনা ভাইরাস বায়ুবাহিত, এ আমাদের কী দিচ্ছে হতাশা ছাড়া! কী করে অবিশ্বাস্য রকম সংক্রামক বায়ুবাহিত ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে সেটা আমরা কতটা আর জানি! তারপরও হতাশা থেকে গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে একসময় ভাঙ্গা মনোবল জোড়া দিয়ে নিজেরাই বলি, এমন মাস্ক পরলে কিন্তু চলবে না, যে মাস্ক পরলেও ফাঁক থেকে যায—যে ফাঁক দিয়ে বাতাসে ভাসা ভাইরাস ঢুকে পড়তে পারে মুখে। হায়! এত যে ভয়ংকর এইডসের ভাইরাস, সেটিও তো বায়ুবাহিত নয়, হামের ভাইরাস খুবই সংক্রামক, সেটিও বাতাসে দু’ঘণ্টার বেশি থাকে না। যক্ষার জীবাণু থাকে বড়জোর ছ’ঘণ্টা। আর আমাদের এই ভাইরাস যেটি পুরো পৃথিবীকে পঙ্গু করে ফেলেছে, সেটিই থাকে সবচেয়ে বেশি। ১৬ ঘণ্টা।
ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকাও নাকি এখন আর নিরাপদ নয়। বন্ধ বাতাসে করোনা নাকি চমৎকার পেয়ে বসে। দরজা-জানালা খুলে রাখার উপদেশ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। রেস্তোরাঁ, ক্লাসঘর, অফিস, উপাসনালয়—যেসব বন্ধ জায়গায় মানুষ দীর্ঘক্ষণ থাকে, সেসব জায়গা নিরাপদ নয়। ঘরেও আসলে মাস্ক পরে থাকা উচিত। আর কাহাতক এসব যন্ত্রণা সহ্য হয়। মানুষের স্বাধীনতা কমতে কমতে শূন্যতে এসে দাঁড়িয়েছে। এদিকে আরও একটি খারাপ খবর এসেছে, খবরটি হল, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে রক্তে যে এন্টিবডি তৈরি হয় করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য, যুদ্ধে জেতার পর সেই এন্টিবডি দু’ তিন মাসের মধ্যেই হাওয়া হয়ে যায়। এর মানে, করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় থাকে মাত্র ২/৩ মাস, আবার যে কে সেই! আবারও করোনায় আক্রান্ত হতে পারে করোনা থেকে সবে সুস্থ হওয়া মানুষ। বিজ্ঞানীরা একসময় যে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ দিয়ে করোনাকে ঘায়েল করার কথা ভেবেছিলেন, সেটি কোনওদিনই সম্ভব নয়। হার্ড ইমিউনিটির ব্যাপারটা এমন, প্রচুর মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে উঠবে, তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকবে, এত প্রতিরোধ পেয়ে ভাইরাস টিকে থাকতে পারবে না, এই প্রতিরোধই, এই দেওয়ালই, যারা এখনও আক্রান্ত হয়নি, তাদের রক্ষা করবে। করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলা সম্ভব নয়, কারণ মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতার সময়সীমা অত্যন্ত কম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, মহামারী আরও খারাপ আকার ধারণ করবে। এই তো আমাদের গোটা জীবনে দেখা সবচেয়ে খারাপ সময়, এর চেয়েও যদি খারাপ সময় আসে, তবে সেই খারাপটি ঠিক কীরকম কল্পনা করতেও ভয় হয়। কল্পবিজ্ঞানের সেইসব চিত্র মনে পড়ে, সব মানুষ মরে গেছে পৃথিবী খালি হয়ে গেছে, হাতে গোনা কিছু মানুষ শুধু ভয়ে ভয়ে পথে প্রান্তরে হাঁটছে আর খাবার খুঁজছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের এও জানিয়ে দিয়েছে, পুরোনা দিনের মতো নিশ্চিন্তের দিন আমরা হয়তো আর ফেরত পাবো না।
কেউ কেউ বলে কেউই রেহাই পাবে না, সবাইকেই ধরবে এই করোনা। যাদের বয়স কম, যাদের শরীরে রোগ বালাই নেই, তারা বেঁচে যাবে, আর বাকিরা মরে যাবে। হ্যাঁ পৃথিবীটা হবে শিশুদের, কিশোর-কিশোরীদের, আর সুস্থ সবল তরুণ-তরুণীদের। পৃথিবীতে সরকারি হিসেবে গত ছ’মাসে পাঁচ লাখ বাহাত্তর হাজার মানুষ মানুষ মারা গেছে করোনায়। যারা চুপচাপ বাড়িতে মারা গেছে, তাদের সংখ্যাটা গুনলে হিসাবটা ৮ বা ৯ লাখও হতে পারে। করোনা আমাদের ধ্বংস না করে ছাড়বে না, মন্দটা আগে ভেবে নেওয়াই ভালো। মন্দটা ভেবে রাখলে যখন দুর্যোগ আসে, তখন বিস্ময়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। মন্দই কি শুধু চারদিকে। কত মানুষ বেঁচে উঠছে, বাঁচার সংখ্যাটাই তো বেশি। ডাক্তার জাফরুল্লাহর কথা ভাবলে কিন্তু আশা জাগে। ডাক্তার জাফরুল্লাহর মতো ডায়ালাইসিসে বাঁচা বয়স্ক মানুষ করোনার সঙ্গে যদি যুদ্ধ করে বেঁচে উঠতে পারেন, তাহলে আমাদেরও চান্স আছে যুদ্ধ করে বাঁচার। কঠোর কঠিন নিষ্ঠুর নির্মম বাস্তবতাকে যেমন মেনে নিতে হবে, তেমন চান্সের আশাও মনে মনে রাখতে হবে। আমাদের বিবর্তনটাও ছিল এক চান্সের খেলা।
খুব বেশি সুস্থ হওয়া মানুষ প্লাজমা দান করছে না। প্লাজমায় যে এন্টিবডি থাকে, তা তো অন্তত কিছু লোককে বাঁচাতে পারতো। এইসময় টিকাই যদি অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন করতে পারে। দু’দিন পর পর টিকা বানানোর আশ্বাস পাই এ-দেশ ও-দেশ থেকে, তারপর আবার সব চুপ হয়ে আসে। কেউ বলে এ বছরের শেষ দিকে, কেউ বলে আগামী বছরের মাঝামাঝি, কেউ বলে ২০২২ সাল ছাড়া হচ্ছে না। টিকা নেওয়ার পর কি পুরোনো দিন ফেরত পাবো, বড় জানতে ইচ্ছে করে। আবার কি মাস্ক ছাড়া ঘুরে বেড়াতে পারবো, ভিড়ের রাস্তায় হাঁটতে পারবো, রেস্তোরাঁয় বসে নিশ্চিন্তে খেতে পারবো, শপিং সেন্টারে চলতে পারবো, সিনেমা-থিয়েটারে বসতে পারবো, স্টেডিয়ামে হাজার মানুষের সঙ্গে বসে খেলা দেখতে পারবো, ট্রেনে-বাসে-উড়োজাহাজে ভ্রমণ করতে পারবো আগের মতো? পারারই তো কথা। তা হলে কেন বিজ্ঞানীরা বলেন, পুরোনো জীবন সুদূর ভবিষ্যতে আর ফিরে পাবো না! বিজ্ঞানীদের বার্তা মাঝে মাঝে যেমন আশা জাগায়, তেমন আবার ভয়ও জাগায়।
কিছু দেশে করোনার ভয়াবহতা বেড়ে চলেছে, কিছু দেশে কমেছে। কমে যাওয়া দেশেও আবার যে কোনও সময় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে করোনা। নিউজিল্যান্ডে কমে গেছে, তাইওয়ানে আবার বাড়ছে। একে বিশ্বাস নেই। মানুষ হয়তো ইচ্ছে করলেই একে বিদেয় করতে পারতো। কিন্তু করেনি। কারণ সবাই করোনার ব্যাপারে এক মত হতে পারেনি। করোনার সংক্রমণের ক্ষমতাকে আমলে আনেনি। ব্যাবসাবাণিজ্য চালু করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। মিছিলও তো কম হল না। এলন মাস্কের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীও করোনার ভয়াবহতা অনুধাবণ করতে পারেননি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট করোনার তাণ্ডবের চার মাস পর তীব্র সমালোচনার চাপে মাস্ক পরেছেন। কত লোককে এঁরা মাস্ক না পরার জন্য ইন্ধন জুগিয়েছেন তার শেষ নেই। এসবের মাশুল তো দিতেই হবে এখন।
অদ্ভুত লাগে ভাবতে, একা একা বাস করার জন্য মানুষ হতাশায় ভুগতো বলে একা মানুষকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারি কতরকম আয়োজন চলতো। অসুস্থদের মন ভালো করার জন্য টাচ থেরাপিও জনপ্রিয় ছিল। মানুষকে আরও সামাজিক হওয়ার জন্য, মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হত। মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে থাকতে মানসিক সমস্যায় ভুগতে ভুগতে এক আমেরিকাতেই বছরে দেড় লাখ মানুষ মারা যেত। আর এখন, মানুষের সংস্পর্শে আসার কারণে, মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে দেড় লাখের চেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে।
করোনার সঙ্গে বাস করা মানে মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রুর সঙ্গে বাস করা। এ বসবাস বড় কঠিন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো বলবো না, ‘কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’। করোনার সঙ্গে এই দুঃসহবাসকে ভালোবাসার কিছু নেই। শুধু দাঁতে দাঁত চেপে প্রচণ্ড মনোবল নিয়ে এর বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হবে।
৯২. সমাজ আর কত পেছনে হাঁটবে
একটা সময় ছিল যখন মেয়েদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আর চাকরি করা পুরুষলোকেরা পছন্দ করতো না। বিয়ের সময় পাত্রী দেখতে গিয়ে মধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষিত পুরুষেরাও বলে আসতো, বিয়ের পর লেখাপড়া করা বা চাকরি করা চলবে না। এভাবেই চলছিল সমাজ। এভাবেই চিরকাল চলতো, যদি না কিছু দৃঢ়চিত্তের মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইতো। সমাজে ধীরে হলেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন ভালোও যেমন, মন্দও তেমন। এক পা এগোলে আর এক পা পেছোয়—এমন পরিবর্তন। লেখাপড়া করছে, চাকরি করছে, এমন মেয়ের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, পুরুষতন্ত্রে মগজ ধোলাই হওয়া মেয়ের সংখ্যাও তেমন বেড়েছে।
সমাজের অজস্র প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে কিছু মেয়ে ঠিকই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করেছে, চাকরি বাকরি করেছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। এই মেয়েরাই কোনও কোনও সংসারে সবচেয়ে বড় সহায়। সংসারে খরচ দিচ্ছে, ভাই-বোনকে পড়াচ্ছে, মা-বাবার চিকিৎসা করাচ্ছে। পুত্র’র ওপর যে ভরসাটি করতো মানুষ, কন্যার ওপর দেখেছে একই ভরসা করা যায়। টাকাপয়সা আসলে সমস্ত তন্ত্রমন্ত্র ডিঙিয়ে যেতে পারে। পুরুষতন্ত্র মেয়েদের শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর হওয়ার কথা বলে না। বরং ঘরে বসে স্বামী সন্তানের সেবা করতে বলে। কিন্তু এবার পুরুষতন্ত্র দেখলো, মেয়েরা টাকাপয়সা রোজগার করে সংসারে খাটালে সংসারের অভাব যায়, সংসারে চেকনাই বাড়ে। তাই বিয়ের বাজারে আগের মতো ফর্সা, সুন্দরী, ঘরোয়া মেয়ের যেমন চাহিদা ছিল, সেই চাহিদা তো রইলোই, যোগ হল রোজগেরে মেয়ের চাহিদা। মেয়েদের দিয়ে স্বামী সন্তানের সেবা হল, শ্বশুরবাড়ির সকলের সেবা হলো, টাকা রোজগারটাও হল। এ বাড়তি সুবিধে। টাকার গন্ধ পেলে সমাজ-সংসারের জিভ বেরোবে না, এ কোনও কথা। এমন সময় যদি শুনি, সুমাইয়া বেগম নামের একটি মেয়ে পড়াশোনা বন্ধ করেনি বলে, বা চাকরি করতে চায় বলে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে প্রাণে মেরে ফেলেছে, তাহলে অবাক হতেই হয়। এমন আজকাল শোনা যায় না। বরং শোনা যায়, বাপের বাড়ি থেকে যৌতুকের টাকা না আনাতে বাড়ির বউকে পিটিয়ে, পুড়িয়ে, মেরে ফেলা হয়েছে।
ওই যে বলেছিলাম কয়েক যুগে যে পরিবর্তন ঘটেছে সমাজে, তার মধ্যে মন্দের সঙ্গে ভালোও আছে। ভালোটা হল এই, প্রচারমাধ্যমে নারী-নির্যাতনের খবরগুলো, যদিও সব আসে না, সামান্য কিছুই আসে, তবু তো আসে। আগেও মেয়েদের খুন করা হত, আগেও ধর্ষণ হত, নারী-নির্যাতন হত, মানুষ জানতে পারতো না। এখন জানার সুযোগ হওয়ার ফলে সমাজ কতটা পুরুষতান্ত্রিকতার কাদায় ডুবে আছে; কতটা মূর্খ, অসভ্য, বর্বরদের বাস সমাজে—তা অনেকটাই অনুমান করা যায়। আগে নারী-নির্যাতনকে স্বাভাবিক বলে মনে করা হত। এখনও হয়। তবে কিছু মানুষ সচেতন হয়েছে। তারা প্রশ্ন করতে শিখেছে। এখন বর্বরতা আর খুন, ধর্ষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। এই প্রতিবাদ, যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, হতে পারছে কারণ মানুষ বর্বরতা আর খুন, ধর্ষণ, নির্যাতনের ঘটনাগুলো জানতে পারছে। সমাজের সব লোক কিন্তু প্রতিবাদে অংশ নেয় না। কারণ সমাজের সব লোক বিশ্বাস করে না নারী-নির্যাতন আদপেই অন্যায় কিছু। এখনও সমাজের অধিকাংশ লোক বিশ্বাস করে, স্বামীর আদেশ অমান্য করা কোনও মেয়েরই উচিত নয়। এই হত্যাকাণ্ডে, সত্য তথ্য এই, অনেক লোকের সমর্থন আছে, কিছু লোক হত্যাকাণ্ডকে বাড়াবাড়ি মনে করলেও সুমাইয়া যে স্বামীর আদেশ না মেনে অন্যায় করেছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত।
সুমাইয়ার পিতা একজন ধর্মগুরু। সম্ভবত ওয়াজ মাহফিল করে বেড়াতেন। এমন লোক সাধারণত মেয়েদের শিক্ষার বিরুদ্ধে বলেন। সেখানে সুমাইয়ার পিতা সিদ্দিকুর রহমান কন্যাকে বাধা দেননি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার ব্যাপারে, বরং নিজেই অর্থকড়ি দিয়ে সাহায্য করেছেন। অবশ্য বিষয় বেছে দিয়েছেন, ইসলাম। উচ্চশিক্ষার জন্য কোনও বিষয়ই মন্দ নয়। সুমাইয়া পদার্থ-বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, গণিত বিজ্ঞান, বা নারীর সমানাধিকার, পুরুষতন্ত্রের অপকারিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেনি, সে নারীবাদীও হবে না, বিজ্ঞানীও হবে না। সে পড়াশোনা করেছে ইসলাম নিয়ে, আরও বেশি ইসলাম সম্পর্কে জানবে, আরও বেশি ধর্মপ্রাণ হবে—এতেও স্বামী-শ্বশুরের আপত্তি। আপত্তি আসলে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যাপারে। স্বাবলম্বি মেয়েরা সাধারণত ক্রীতদাসী হতে চায় না। ক্রীতদাসী না হলে বাড়ির বউকে মানাবে কেন! স্বামীর অবাধ্য হওয়া কোনও মেয়েকে আজও এই একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষ পছন্দ করে না। মেয়েরা যদি নিজের স্বপ্নপূরণ করতে চায়, এই নারীবিরোধী সমাজে কারও না কারও তো অবাধ্য হতেই হয়, এ ছাড়া তো স্বপ্নপূরণ সম্ভব নয়।
বধূহত্যা কোনও নতুন ঘটনা নয়, বধূ স্বাবলম্বি হতে চেয়েছে, ঘরের বার হতে চেয়েছে, যদিও হিজাব পরেই ঘরের বার সুমাইয়া হত, তাতেও মানতে পারেনি স্বামী-শ্বশুর, অতএব নির্যাতনই ভরসা। ঘৃণা থেকে যে নির্যাতনগুলো করা হয়, সেগুলোতে নির্যাতনকারীদের হুঁশ থাকে না। কণ্ঠদেশ কতটা চেপে ধরলে মানুষ শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা পড়ে, সেটা বেমালুম ভুলে যায়।
সুমাইয়া হত্যার খবরটা আমরা পেয়েছি যেহেতু সুমাইয়ার মা মামলা করেছেন এবং প্রচারমাধ্যমকে জানিয়েছেন। এরকম কত সুমাইয়াকে প্রতিদিন নির্যাতন করা হচ্ছে, কত সুমাইয়াকে মেরে ফেলা হচ্ছে, কত সুমাইয়া বর্বরতার শিকার হয়ে আত্মহত্যা করছে—সে খবর কে রাখে! মেয়েরা নিহত হলে সাধারণত নিঃশব্দে সৎকার করা ফেলা হয়, নিজেদের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে ভাগ্যে ছিল তাই মরেছে অথবা থানা-পুলিশ করে কী লাভ, যে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না জাতীয় কথাবার্তা কয়েকদিন বলে টলে ব্যাপারটির নিস্পত্তি করার হয়।
স্বনির্ভর মেয়েদের অহংকার বেশি থাকে, তারা উঠতে বললে ওঠে না, বসতে বললে বসে না, এরকম একটি বিশ্বাস সুমাইয়ার স্বামী-শ্বশুরদের ছিল। কিন্তু তাদের জানা ছিল না, আজকালকার পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী মেয়েরা রোজগার করে স্বামীর হাতে টাকা তুলে দেয়, এবং পরনির্ভর মেয়ের মতোই মুখ বুজে স্বামী-শ্বশুরদের সেবা করে। সুমাইয়ার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা খুব বড় ভুল করেছে, তারা অনায়াসে লাভবান হতে পারতো সুমাইয়া দ্বারা। সুমাইয়ার অর্থ এবং শ্রম থেকে এখন তারা বরং বঞ্চিত। সুমাইয়া স্বামী-সংসার ত্যাগ করতে চায়নি। সে ধর্ম মেনে চলে, তাই হিজাব পরে। ধর্ম বলেছে স্বামীকে সদা সুখী রাখতে, স্বামী যখন যা চায় তাই দিতে, নিজের জীবনকে অপূর্ণ করেও স্বামীর জীবনকে পূর্ণ করতে। সুমাইয়াও নিশ্চয়ই তাই করতো। সুমাইয়া ঘরে টাকা আনলে বেকার স্বামী স্বস্তি পাবে, সুখ পাবে, এই ভেবেই হয়তো ভালো চাকরি পাওয়ার উদ্দেশে সে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
মেয়েদের জীবন সম্পূর্ণ নির্ভর করে স্বামী কী চায় বা না চায় তার ওপর। স্বামী যদি না চায় স্ত্রী বেঁচে থাকুক, তাহলে স্ত্রীর বেঁচে থাকার খুব বেশি উপায় থাকে না। স্বামী যদি স্ত্রীকে নির্যাতন করতে চায়, তবে নির্যাতন থেকেও স্ত্রীর বাঁচার খুব উপায় থাকে না। অসুখী দম্পতির মধ্যে যত ডিভোর্স হওয়া উচিত, তত হচ্ছে না। সমাজের ভয়েই হচ্ছে না। সমাজের ভয় মেয়েদেরই। যত মন্দ কিছু ঘটে, দোষ মেয়েদের। পুরুষকে ক’জন লোক ঘেন্না দিয়ে বলে, ‘আপনি তো সংসার করতেই পারছেন না, নিশ্চয়ই আপনার চরিত্র খারাপ।’
পুরুষের চরিত্র খারাপ এবং মেয়েদের চরিত্র খারাপ—এই দুই খারাপের মধ্যে সমাজ কিন্তু পার্থক্য করে। পুরুষের চরিত্র খারাপ হওয়া সমাজের চোখে ততটা কুৎসিত নয়, যতটা কুৎসিত মেয়েদের চরিত্র খারাপ হওয়া।
মেয়েরা স্বামী দ্বারা নির্যাতিত হলে সমাজ বরং মেয়েদেরই দোষ দিয়ে বলে নিশ্চয়ই ওর কোনও দোষ ছিল, তা না হলে স্বামী পেটাবে কেন। স্বামী মন্দ লোক বলে স্বামী পেটায়, এই সত্যটা বেশি লোক ভাবতে জানে না।
সুমাইয়ার বাপের বাড়ি প্রভাবশালী হলে সুমাইয়ার হত্যাকারীরা শাস্তি পাবে, তা না হলে পাবে না। কত হত্যাকারী নিশ্চিন্তে নিরাপদে হাটে-ঘাটে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা নিশ্চয়ই সবাই জানে।
সারা পৃথিবীর জরিপে দেখা যায়, মেয়েদের নির্যাতন করে, অত্যাচার করে, হত্যা করে তার পরিবারের লোকেরাই বেশি, বিশেষ করে স্বামীরা। তারপরও এই নারীবিরোধী সমাজে বিবাহের হিড়িক পড়ে। কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, মেয়েরা তাদের সম্ভাব্য হত্যাকারীকেই বিয়ে করে। এরপর যদি সংসার সুখের হয়, সে পুরুষের গুণে।
৯৩. আমাদের বর্ণবৈষম্য
ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় অর্থাৎ সাদাদের দেশগুলোয় যখনই কোনও বর্ণবৈষম্যের খবর পাই, তখন ভীষণ ক্ষিপ্ত হই আমরা, বিশেষ করে আমাদের লোকেরা যদি আক্রান্ত হয়। কালোরা আক্রান্ত হলে আমাদের খুব একটা অবশ্য যায় আসে না। কালোদের কি আমরা ঘৃণা করি না? আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ, আমরা দু’শ বছর ঔপনিবেশিক শক্তির অপশাসন আর শোষণের শিকার হয়েছি। সাদা ব্রিটিশ শাসকেরা কালো আফ্রিকানদের যেমন ঘৃণা করতো, ভারতীয়দেরও তেমনই ঘৃণা করতো। কিন্তু ভারতীয়রা চিরকালই কালো আফ্রিকানদের চেয়ে নিজেদের উন্নত জাতের মানুষ বলে ভেবে এসেছে। আফ্রিকার কোনও কোনও জাত মানুষখেকো, ব্রিটিশরা বলেছিল। শিক্ষাটা এত গভীরে ঢুকেছে যে আজ ঔপনিবেশিক শাসন নেই ৭০ বছরের চেয়েও বেশি, তারপরও আফ্রিকার যে কোনও লোককে দেখলেই মানুষখেকো বলে আমাদের অনেকেরই সংশয় হয় । আফ্রিকা থেকে ভারতে অনেকেই লেখাপড়া করতে আসে। তাদের যে কী হেনস্থা হতে হয় গায়ের রঙ কালো বলে! সুদান, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, ইরেত্রিয়া যেখান থেকেই আসুক, সব ছাত্রছাত্রীকে ভারতীয়রা ‘নাইজেরিয়ান’ বলেই ডাকে। এবং সব নাইজেরিয়ানকেই তারা মনে করে মাদক ব্যবসায়ী, এবং পতিতার দালাল। মনে আছে দিল্লির ফরেনার রেজিস্ট্রেশান অফিসে একবার ভিসা বাড়ানোর জন্য গিয়েছিলাম। একজন আফ্রিকার লোকও ভারতীয় এক মহিলার সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হওয়ায় ভারতে বাস করার ভিসার জন্য ওখানে গিয়েছিলেন। যে অফিসার আমাকে বসিয়ে চা খাওয়াচ্ছিলেন, তিনিই আফ্রিকার লোকটির সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার করলেন, জঘন্য গালি দিলেন। আমাকে বললেন আফ্রিকার লোকেরা খুব খারাপ, এরা মানুষখেকো, এবং মাদক ব্যবসায়ী। রেগে ফেটে পড়লেন সেই সব ভারতীয় মহিলার বিরুদ্ধে, যারা আফ্রিকার লোকদের বিয়ে করে। একই অফিসার চমৎকার ব্যবহার করেছিলেন ভিসার জন্য আসা সাদা ইউরোপিও লোকদের সঙ্গে। আমেরিকায় কালোদের একসময় নিগ্রো বলে ডাকা হত, নিগ্রো শব্দটি এখন গালি হিসেবে প্রচলিত। ভারতেও নিগ্রোর মতো নাইজেরিয়ান শব্দটি একটি গালি। এত উপেক্ষা, এত অপমান জোটে, আফ্রিকানরা তারপরও ভারতকে ভালোবেসেই ভারতে আসে।
আফ্রিকার লোকদের ওপর ভারতীয়রা প্রায়ই হামলা চালায়। ২০১৭ সালে ৫ জন নাইজেরিয়ার ছাত্রকে ভারতীয়রা লোহার রড, ছুরি ইত্যাদি দিয়ে হামলা করেছিল। একটি অল্পবয়সী ছেলের মাদক সেবন করে মৃত্যু হয়েছিল, ছেলেটির বাবা জানিয়েছিল যে ছেলেটি মাদক পেয়েছিল এক নাইজেরিয়ানের কাছ থেকে। এর প্রতিশোধ নেওয়া হয় নাইজেরিয়ার ছাত্রদের অমানুষের মতো পিটিয়ে। মানুষ দেখেছে এই পেটানো, কেউ ওদের থামায়নি, পুলিশকেও খবর দেয়নি। দেবে কেন, কালো লোকদের তো তারাও ঘৃণা করে। ভারতে আফ্রিকার নাগরিকের ওপর হামলা নতুন কিছু নয়। দিল্লিতে ২০১৬ সালে কংগোর এক লোককে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল ভারতীয়রা। এর আগে তানজানিয়ার এক ছাত্রীকে ব্যাঙ্গালরে টেনে কাপড় খুলে দিয়েছিল। ২০১৩ সালে গোয়ায় এক নাইজেরিয়ান লোককে ছুরি দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলা হয়েছিল। আফ্রিকার ছাত্রদের রাস্তাঘাটে গালি শুনতে হয়, বাড়িওলা তাদের ঘর ভাড়া দিতে চান না, প্রচুর ডকুমেন্টস দেখাতে হয় ভাড়া পেতে গেলে। বিদেশ থেকে যে সাদা লোকেরা আসে পড়তে, গবেষণা করতে, চাকরি বা ব্যবসা করতে, তাদের কিন্তু এই অসুবিধে হয় না।
শুধু যে আফ্রিকার লোকদের গায়ের রঙকে আমরা অপছন্দ করি তা নয়। নিজেদের মধ্যে যাদের গায়ের রঙ কালো, তাদেরও তো আমরা গ্রহণ করি না। তারা সুন্দরী হলেও তাদের আমরা সুন্দরী বলে ডাকি না। গায়ের রঙ ফর্সা করার ক্ষতিকর কেমিক্যালে ছেয়ে গেছে আমাদের গোটা অঞ্চল। উপজাতিদের মধ্যে যারা কালো, দলিতদের মধ্যে যারা কালো তাদের মানুষ বলেই মেনে নিই না। নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশের মানুষ কালো নয়, কিন্তু ওরা দেখতে অধিকাংশ ভারতীয়দের মতো দেখতে নয়, আমাদের মতো দেখতে নয়। তাই ওদেরও কিন্তু একই হাল করা হয়, যথেষ্ট ঘৃণা উথলে উঠলে ওদেরও পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। আমরাই মেরে ফেলি।
চলচ্চিত্র নির্মাতা মাইকেল মুর একবার নিউইয়র্কের রাস্তায় দুজন লোককে ট্যাক্সি ডাকার জন্য দাঁড় করিয়েছিলেন, একজন কালো, তিনি হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আর এক জন সাদা, তিনি একজন বড় সড় ক্রিমিনাল। ট্যাক্সি সাদার কাছে থেমেছে। কালোর কাছে একটি ট্যাক্সিও থামেনি। নিউইয়র্কে বাংলাদেশের বাঙালিরা ট্যাক্সি চালায়, আফ্রিকান আমেরিকানদের আগে ‘কাইল্যা’ বলে গালি দিয়ে তারপর ওদের সম্পর্কে কথা বলে। আমাদের রঙ যতই কালো হোক, নিজেদের আমরা কালোদের থেকে পৃথক বলে ভাবি। অনেক সময় আমরা তো নিজেদের সাদা বলে ভাবতে থাকি, বিশেষ করে যখন কালোদের কীর্তিকলাপের দিকে তাকাই।
দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়রা কিন্তু কালোদের মতো জাতিগত বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তারপরও ভারতীয়রা সবাই মিলেমিশে থাকে না। ওদের মধ্যে জাতপ্রথা বা কাস্ট সিস্টেম নেই। ভারত থেকে সমুদ্রপথে আসার সময় জলে ডুবিয়ে দিয়েছিল ওই প্রথা। তা ঠিক, কিন্তু যারা চুক্তিভুক্ত শ্রমিক ছিল, আর যারা গিয়েছিল বাণিজ্য করতে, এই দুই ধরনের ভারতীয়দের মধ্যে ফারাক ছিল। এই শ্রেণির ফারাকের বাইরে আরও একটি ফারাক ছিল এবং এখনও আছে সেটি হল, ভারতীয়দের মধ্যে কারও গায়ের রঙ কালো, কারও গায়ের রঙ বাদামি। কালো ভারতীয়দের খানিকটা নিম্নমানের মানুষ হিসেবেই মনে করে বাদামি ভারতীয়রা। দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়রা সদ্য বিলেত-ফেরত ব্যারিস্টার মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে উকিল হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওখানে গান্ধী নিজেও তো দেখতে অনেকটাই কালো, কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার কালো লোকদের নিম্নমানের মানুষ বলে মনে করতেন। ওদের গালি দিতেন ‘কাফির’ বলে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘কাফির’ খুব অপমানজনক গালি। বছর দুই আগে ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে ছাত্রছাত্রীরা এ কারণেই গান্ধীর মূর্তি সরিয়ে ফেলেছে। এত বড় মহাত্মাই যদি বর্ণবাদী, আমরা কোন ছার!
বর্ণবাদী নয়, এমন লোক ভারতীয় উপমহাদেশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এখানে মানুষ নিজের ধর্ম, বর্ণ, জাতের চেয়ে অন্যের ধর্ম, বর্ণ, জাতকে নিম্নমানের বলে মনে করে। ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাই ধর্মবাদী, বর্ণবাদী, গোষ্ঠীবাদী, জাতবাদী, জাতীয়তাবাদী, শ্রেণিবাদী। যারা এসবের ঊর্ধ্বে উঠেছে, তাদের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য।
আমেরিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এই করোনা ভাইরাসের মহামারীর সময় যে প্রতিবাদ হল তার তুলনা হয় না। এ নিয়ে যতবারই আমি টুইটারে লিখেছি, ততবারই অজস্র মানুষের কটাক্ষ শুনেছি। তারা ভারতীয় উপমহাদেশেরই লোক। তারা লুটপাট করার জন্য কালোদের দোষ দিচ্ছে, সে দিক। দোকানপাট যারা লুঠ করেছে, তারা অন্যায় করেছে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু হাঁটু দিয়ে চেপে জর্জ ফ্লয়েড নামের কালো লোককে মেরে ফেলা? ওটিকে টুইটারের ভারতীয়রা বলছে জর্জ ক্রিমিনাল ছিল, মেরেছে বেশ করেছে অথবা বলছে নিজের অসুখ বিসুখের কারণে জর্জ মারা গেছে, শ্বাসরোধ হয়ে মরেনি।
এই হচ্ছি আমরা। আমরা কালোদের যত ঘৃণা করি, তত ঘৃণা সাদারাও করে না। নিজেদের গায়ের রঙ কালো হলে আমরা নিজেদেরই ঘৃণা করি। আমার এক অন্ধ্রপ্রদেশের বন্ধুর ত্বক খুব কালো। দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ মানুষের গায়ের রঙ কালো। কিন্তু সেই বন্ধুটি কিছুতেই তার গায়ের কালো রঙকে মেনে নিতে পারে না। নিজেই নিজের রংকে কুৎসিত ভাষায় গালি দেয়। বারবারই বলে সে আসলে বাদামি, কিন্তু ক’দিন রোদে ঘোরা হয়েছে বলে কালো দেখাচ্ছে। নিজে সবসময় এক স্পেশাল সাবান রাখে সঙ্গে, ওটা দিয়ে মুখটা পনেরো কুড়ি মিনিট ধরে ঘসে একটু যেন উজ্জ্বল দেখায়। এই তো আমরা। আমরা এমনই। আমাদের বর্ণবৈষম্য পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ংকর বর্ণবৈষম্য। মেয়ে কালো হলে তাকে আমরা জন্মের পরই মাটিতে জ্যান্ত পুঁতে ফেলি। অথবা তাদের সংগে আমরা প্রেম করি না, তাদের আমরা বিয়ে করি না, বিয়ে যদি করিই টাকার জন্য করি, বিরাট অংকের যৌতুক নিই, অথবা ঘরের নোংরা সাফ করার জন্য রেখে দিই।
আমাদের বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ করি না। কারণ আমরা ততটা সভ্য এখনও হইনি, যতটা সভ্য হলে বৈষম্যহীন সমাজের জন্য আপোসহীন সংগ্রাম করা যায়।
৯৪. মানুষ মরছে
মানুষ মরছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন আমেরিকায় দেড় থেকে আড়াই লাখ লোক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবে। ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা মে মাসের মাঝামাঝি হবে ১৩ লাখ। চীন বলেছিল বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য বন্ধ করবে। কোথায়? ফের তারা তাদের ‘ভেজা বাজার’ খুলে বসেছে, যেখানে মানুষের খাদ্য হিসেবে বিক্রি করছে বাদুড়, প্যাংগলিন, কুকুর ইত্যাদি।
লকডাউনে কেউ বেশিদিন থাকতে চাইছে না। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে সুতরাং কাজকম্ম শুরু করতে হবে।
না, আশা নেই। মানুষ বোধহয় আর বয়স্ক মানুষের কথা ভাবতে চাইছে না। ইয়ং দিয়েই দুনিয়া চলবে। সুতরাং ইয়ং বেঁচে থাকলেই হল।
মানবপ্রজাতি বিশাল হুমকির মুখে। দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। কিন্তু, অবাক হয়ে দেখি মানুষের কোনও হেলদোল নেই। এখনও কিছু লোক হিন্দু- মুসলমান করছে। জীবনে ঘৃণাই যাদের সম্বল, তারা বোধহয় শিয়রে মৃত্যু এসে বসলেও ঘৃণা করতে থাকবে, কারণ এটি ছাড়া অন্য কিছু তারা সারাজীবনে শেখেনি।
৯৫. মৃত্যু
ইতালিতে ১০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। আজই তো ন’শ মানুষ মরলো। স্পেনে আজ মারা গেছে প্রায় সাতশ’। ইউরোপ তো মরে সাফ হয়ে যাবে মনে হয়। ওদিকে আমেরিকাও বসে নেই। ১ লাখ ১৬ হাজার মানুষ আক্রান্ত, দিন দিন বাড়ছে সংখ্যা। ভারতে, বাংলাদেশে, পাকিস্তানে, ভয় পাচ্ছি, কখন না দিনে লাখের ওপর মরতে শুরু করে। সভ্য দেশ, উন্নত আধুনিক দেশ! তারাই জ্ঞানী বিজ্ঞানী! তারাই চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ, তারাই পিঁপড়ের মতো মরছে। আমরা তো ইমিউনিটি নেই ম্যালনিউট্রেশনে ভোগা ডেন্সলি পপুলেটেড দেশে গাদাগাদি করে বস্তিতে বাস করা মূর্খ অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ। আমরা যখন মরতে থাকবো, মহামারী কাকে বলে দুনিয়া দেখবে। ভালো যে আফ্রিকার গরিব দেশগুলোতে খুব একটা কামড় বসায়নি করোনা। বসালে শ্মশান হয়ে যেত দেশগুলো।
আপাতত ভ্যাক্সিন ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই। ভ্যাক্সিন বের হতে নাকি ১৮ মাস। ১৮ মাস কী করবো, ঘরে বসে থাকবো? আমার মতো রিস্ক ক্যাটাগরির লোক ভ্যাক্সিন অবধি টিকে থাকতে পারে কি না সন্দেহ। ভাইরাস তো শুনেছি থেকেই যাবে পৃথিবীতে। জানিনা কী হবে, কেউ কি সত্যিই জানে? যাঁরা গবেষক, তাঁরাও হয়তো সঠিক জানেন না, শুধু অনুমান করছেন।
এই পৃথিবীতে মানুষ তো আর শুধু আমরাই ছিলাম না, আরও নানান জাতের মানুষ ছিল। সব কটাকে মেরে ফেলেছি আমরা। কী ভয় কী ভয়! আমরা ছাড়া অন্য কেউ রাজত্ব করতে পারবে না। নিজেদের একসময় নাম দিলাম ‘সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব’। শিম্পাঞ্জির বংশধরেরা নাকি শ্রেষ্ঠ জীব! খুনোখুনি আর বর্বরতা করে শ্রেষ্ঠ সেজেছি। জীবজন্তু, পশুপাখিকে মেরেধরে সর্বনাশ করেছি। এর লোম দিয়ে ওভার কোট বানাবো, ওর চামড়া দিয়ে হ্যান্ডব্যাগ বানাবো, এর থাবা দিয়ে ছাইদানি বানাবো, ওর দাঁত দিয়ে গয়না বানাবো, আমাদের শখের শেষ নেই। এই পৃথিবী যে শুধু আমাদের নয়, ওদেরও— যেন ভুলেই গিয়েছিলাম।
এখন ওই ‘ইতর’ পশুপাখিগুলোই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবগুলোকে একঘরে করে রেখেছে, এতটাই ওদের শক্তি। আর আমরা জানিইনা ভবিষ্যত বলতে আমাদের কিছু আছে কি না।
৯৬. করোনাকথা
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী, অস্ট্রেলিয়ার স্ব্ররাষ্ট্রমন্ত্রী, ইরানের উপস্বাস্থ্যমন্ত্রী, ওদিকে প্রিন্স চার্লস, সবাইকেই ধরেছে করোনা ভাইরাস। জানি না কে বাঁচবে, কে মরবে। চীন স্বাভাবিক করতে চাইছে জীবনযাত্রা, যেহেতু আক্রান্ত মানুষের এবং মৃত্যুর সংখ্যা কমে গেছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনে দ্বিতীয়বার নতুন সংক্রমণের জোয়ার শুরু হতে পারে। ঘরবন্দির সময়সীমা আরও বাড়ালে দেরি করে আসবে সেটি। চীনকে যদি মাসের পর মাস ঘরবন্দি থাকতে হয় বাঁচার জন্য, আমাদেরও তাই থাকতে হবে। ইউরোপ, আমেরিকার কী হবে বুঝতে পারছি না। আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা এখন চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে। টেস্ট কিট পর্যাপ্ত থাকলে আরও টেস্ট হত, আরও রোগী বাড়তো।
কিছুতে মন বসছে না। না পড়তে পারছি, না লিখতে পারছি। রোবটের মতো ঘরের এটা সেটা করছি। যদি মরতেই হয়, ঘুমের মধ্যে মরে গেলেই ভালো। অথবা মরছি এটা না জেনে যন্ত্রণাহীন মরে গেলে বেশ। দরজার বাইরে মৃত্যু দাঁড়িয়ে আছে, ঘরের খিল এঁটে বসে আছি সবাই। কত দিন, মাস, বছরের জন্য, জানি না।
একজন মজা করে বললো চীনের সেই বাঁদুড়টাকে নাকি সব পশুপাখি হাইফাইভ করছে। সেই বাঁদুড়, যে তার ভাইরাসটা প্যাংগলিনকে দিল, আর প্যাংগলিন দিল আমাদের। চীন কি এখন বনের পশুপাখি খাওয়া বন্ধ করবে? মানুষ তো ভুলে যায়। এ যাত্রা বেঁচে উঠলে ফের হয়তো কয়েক বছর পর খেতে শুরু করবে, কে জানে।
চীনের লাল পতাকায় তারকার জায়গায় করোনা ভাইরাসের ছবি দিয়ে কার্টুন বানানো হয়েছে। চীনের ওপর রাগ মানুষের। বাইশ হাজার মৃত্যু, আর কত মৃত্যু যে আসছে! বাঁদুড়, প্যাংগলিন এগুলো না খেলে ওদের চলতো না? অবশ্য এমন যে হবে ওরা তো জানতো না। জানলে নিশ্চয়ই খেতো না। করোনা ভাইরাসকে কেন চাইনিজ ভাইরাস বলা যাবে না? জায়গার নামে তো কত ভাইরাসের নামকরণ হয়েছে, জিকা ভাইরাস, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস। এবোলা ভাইরাস তো আফ্রিকার এক নদীর নামে নাম। চীন এমন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে চীনকে ক্ষেপাতে কেউ সাহস পায় না। মনে আছে এক সুপার বাগকে নাম দেওয়া হয়েছিল নিউ দিল্লি বাগ? তো? কোভিড১৯ রোগটি যে চীন থেকে এসেছিল তা আমরা কেউ কি কোনওদিন ভুলে যাবো? কোনওদিন?
করোনা ভাইরাসের প্যান্ডেমিক হওয়ার পেছনে অনেকে ষড়যন্ত্র খোঁজে। আমার মনে হয় না কোনও ষড়যন্ত্র আছে এতে। নিতান্তই দুর্ঘটনা। কত প্রাণঘাতী ভাইরাসকে মানুষ ধরাশায়ী করেছে, শুধু এটির কাছেই ধরাশায়ী হল।
সামনে কী আছে?
৯৭. করোনা কালে ১
না আমি প্যানিক শপিং করিনি। করি না কখনও। কবে চাল-ডাল-নুন তেল কিনেছিলাম মনেও নেই। কয়েক মাস আগে হয়তো। কিছুদিন আগে শুধু হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনতে চাইলাম, দোকানেও নেই, আমাজনেও নেই। অগত্যা আইপিপি এলকোহল কিনতে বেরিয়েছিলাম, ওটা দিয়ে নিজে স্যানিটাইজার বানাবো বলে। ওটা কোথায় পাওয়া যায় ধারণাই নেই। মদের দোকানে গিয়ে চাইলাম, ওরা বুঝতেই পারেনি কী চাইছি। অগত্যা ওটি পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছি।
ভারতের ইউপি, বিহার, রাজস্থানের অনেককে দেখেছি, পেঁয়াজ বা টমেটো ছাড়া রান্না কী করে হবে বুঝতে পারে না। অন্ধ্রপ্রদেশের লোকেরা বিশ্বাস করে না লাল মরিচ ছাড়া রান্না হতে পারে। প্রচুর লোকের প্রতিদিন কিছু না কিছু সবজি চাই; চাইই চাই, অথবা দুধ চাই, চাইই চাই। আমার এরকম কোনও বাতিক নেই। ঘরে চাল না থাকলে আটা থাকলেও আমার চলে। ভাত না হলে রুটি। তাও না থাকলে মুড়ির সঙ্গে ডাল নিয়ে নিই। চাল, ডাল, আটা, চিড়ে, মুড়ি কিছুই না থাকলে নুডলস পাস্তা বানাই। তাও না থাকলে সবজি সেদ্ধ আর মাছ করে নিই। যদি মাছ না থাকে মাংস না থাকে, মশলাপাতিও না থাকে, তাহলে দুধ দিয়ে ওট বানিয়ে নিই। যদি দুধ না থাকে, জলে ওট সেদ্ধ করে নিই। যদি ওটও না থাকে, তাহলে ডালিয়া সেদ্ধ করে নিই, অথবা কুসকুস। এ কৌটো সে কৌটো খুঁজে দেখি কী পাওয়া যায়। তেল না থাকলে ডিম সেদ্ধ করে, শশা গাজর দিয়ে দিব্যি চমৎকার লাঞ্চ না হলেও ব্রাঞ্চ হয়ে যায়। এক্সট্রা ভারজিন অলিভ অয়েল ছিটিয়ে দিলেই তো ইয়ামি। খাওয়া দাওয়া নিয়ে মূলত আমি যা করি, তা হলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা। নানারকম খাবার খেতে জানলে ক্রাইসিসের সময় খুব একটা অসুবিধে হয় না। ভাত, ডাল, নিরামিষ, মাছ ভাজা, মাছের ঝোল থাকতেই হয় না প্রতিদিন। প্রতিদিন একইরকম একই স্বাদের একই গন্ধের একই উপাদানের খাবার খাওয়াটা বোরিং। কিচেনের সবগুলো কৌটো বয়াম খালি হয়ে গেলে অগত্যা আমি অনলাইনে বাজার সদাইয়ের অর্ডার করবো, ঘরের দরজায় ওরা রেখে যাবে ওসব, ব্যস।
খাবারদাবারের জন্য আমি প্যানিক হই না, আমি প্যানিক হই ইতালির হাসপাতালে জায়গা নেই, রোগীকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে। স্পেনে মানুষ ভাইরাসের কামড়ে প্রতিদিন চারশ পাঁচশ করে মারা যাচ্ছে দেখে। ভারতের বস্তিতে একবার যদি ভাইরাস ঢুকে পড়ে, কত কোটি মানুষকে মরতে হবে, তা ভেবে। আমি প্যানিক হই এখনও কেন টিকা আবিষ্কার হচ্ছে না এই নিয়ে ভেবে। ইমিউনিটি বাড়াতে হলে এক্সারসাইজ করতে হবে, ভিটামিন সি টি খেতে হবে। নাহ উৎসাহই পাচ্ছি না। মনে হয় না ইমিউনিটি বাড়ালেও করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হতে পারবো। তার চেয়ে কিছু লেখাপড়া করি এই সময়টায়। বাড়িতে তো কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না, না কাজের লোক, না পড়শি, না বন্ধু, না প্রেমিক। শুধু নিজের জন্য এমন সময় আর কবে পাবো কে জানে।
৯৮. করোনা কালে ২
লকডাউনে আমার খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না। ইউরোপ, আমেরিকায় দীর্ঘকাল বাস করার কারণে রান্নাবান্না করা, বাসন ধোয়া, ঘরদোর গোছানো, ডাস্টিং, ঝারু মোছা, কাপড় কাচা, টয়লেট পরিষ্কার ইত্যাদি হাজার রকমের কাজ নির্বিঘ্নে করে ফেলতে পারি। একা থাকতেও কোনও অসুবিধে কখন হয়নি কারণ জীবনের অর্ধেকটা বয়স একাই থেকেছি আমি।
লকডাউনটা টিকা আবিষ্কার হওয়া পর্যন্ত চালু থাকলে ভালো হয়। এই সময় গরিবদের ঘরে ঘরে চাল, ডাল আর টাকাকড়ি পৌঁছে দেওয়া দরকার। কিছু দেশ তো তাই করছে।
এই সার্স কোভ ২ ভাইরাস খুব বেশি বিবর্তিত না হলে টিকা আবিষ্কারে খুব বেশি দেরি হবে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন ফ্লুর টিকার মতো প্রতি বছর নতুন নতুন টিকা নয়, এই টিকা একবারই নিতে হবে, হাম আর গুটি বসন্তের টিকার মতো।
ইতালি আর স্পেনের দিকে তাকানো যায় না। পিঁপড়ের মতো মানুষ মরছে। ইরান, আমেরিকায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের শরীরে ভাইরাস ধরা পড়ছে। মানুষের জীবন যে কতটা কচু পাতায় জল, তা হাড়ে মজ্জায় যেন বোঝা হল আবারও। মানব প্রজাতির সবচেয়ে বড় দুর্যোগের দিনে যারা ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, স্বার্থপরতা নিয়ে থাকছে, অন্যের ক্ষতি হলে যাদের কিছু যায় আসে না—তাদের কিন্তু চীনে রাখা বড় জরুরি।
দেখা যায় না এমন ছোট ভাইরাস আজ আমাদের প্রজাতির সবচেয়ে বড় শত্রু। গোটা পৃথিবী লকডাউন, যেন নীল ডাউন হয়ে ভাইরাসের কাছে প্রাণভিক্ষে চাইছে। মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার এবং বাস করার সব আয়োজন আমরা করে ফেলেছি, কত শক্তিশালী আমরা, অথচ কত শক্তিহীন!
এই সময় আমরা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখলেও মানসিক দূরত্ব যেন ঘুচিয়ে ফেলি। ভাইরাস আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, আমরা মানুষ—এই আমাদের আসল পরিচয়। নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি, নাস্তিক, ছোট-বড়, ধনী-গরিব, সাদা-কালো, বাদামি, হলুদ, ফরাসি, চৈনিক, সিরীয় ভারতীয় আরব, ওলন্দাজ আমরা সব এক। দেশে দেশে যে বেড়া দিয়েছি, তা নিতান্তই অর্থহীন।
৯৯. আজকালের রোজনামচা
১। যুক্তরাজ্য থেকে দুটো খবর এসেছে, একটি খারাপ, একটি ভালো। খারাপটি হল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে করোনার টিকাটা বানানো চলছিল, সেটির ট্রায়ালে ভুল ডোজ দেওয়া হয়েছে। যদিও গবেষকরা বলছেন, এই ভুলটাকে ভিন্নভাবে সংশোধন করে ট্রায়ালের কাজ চালিয়ে যাওয়া হবে, তারপরও সংশয় জাগে। শেষপর্যন্ত এই ভুল ডোজের কারণে পুরো টিকাটাই বাতিল হয়ে যাবে না তো! বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কিন্তু আছে। কত লক্ষ কোটি টাকা আর কত দিন রাতের পরিশ্রম পণ্ড হবে, ভাবা যায়!
দ্বিতীয় খবরটি ভালো, ভেন্টিলেটরে যে করোনা রোগীদের রাখা হয়, তাদের অধিকাংশই মারা যায়, কিন্তু ডেক্সামেথাসন নামের একটি স্টেরয়েড দিয়ে দেখা গেছে তাদের অনেকে বেঁচে যাচ্ছে। সুতরাং এই স্টেরয়েড ওষুধটিকে ভীষণভাবে করোনায় আক্রান্ত হওয়া মৃত্যুপথযাত্রীকে বাঁচানোর ওষুধ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এটিই করোনা ভাইরাসের সংগে যুদ্ধ জেতার হাতিয়ার। যে ওষুধই বিপদের সহায় হোক না কেন, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলে করোনার টিকা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। কিন্তু অতল সমুদ্রে যখন ডুবছি, হাতের কাছে বড় জাহাজ না হোক, ছোট একটি ডিঙি নৌকো তো পাওয়া গেছে।
২। ভারতের এক বলিউড তারকার আত্মহত্যা, দেশটিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে কিছুক্ষণের জন্য। সুশান্ত সিং রাজপুত বেশ কিছু ছবিতে চমৎকার অভিনয় করেছেন। নাম-যশ-খ্যাতি-প্রতিপত্তি যখন দ্রুত বাড়ছিল, তখনই কিনা মানুষটি মাত্র ৩৪ বছর বয়সে নিজের জীবনের ইতি ঘটিয়ে দিলেন। চরম বিস্ময়কর ঘটনা তো বটেই। সুশান্ত অন্যান্য তারকার মতো ছিলেন না, বলিউডের তারকারা সাধারণত অল্প শিক্ষিত, প্রচণ্ড ধর্মান্ধ এবং প্রচণ্ড কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সুশান্ত নিজে অত্যন্ত ভালো ছাত্র ছিলেন, পদার্থবিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়ই শুধু নয়, তাঁর অবসেশান। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর তৃতীয় বর্ষে পড়াকালীন সব ছেড়েছুঁড়ে নাচ আর অভিনয় শিখতে ঢুকে গেছেন। যা হতে চেয়েছেন হয়েছেন, অভিনেতা। তাঁর ৫০টি স্বপ্নের কথা লিখে গেছেন, এমন স্বপ্ন বলিউডের কোনও অভিনেতা দেখেন না, এ আমি হলফ করে বলতে পারি। নাসায় তিনি ওয়ার্কশপ করেছেন, আবার আর এক ওয়ার্কশপের স্বপ্ন তাঁর। নভচারী হওয়ার স্বপ্ন তাঁর। বিমান চালানোর স্বপ্ন তাঁর। নাসায় ১০০০ কিশোর কিশোরী পাঠাতে চেয়েছেন মহাশূন্য সম্পর্কে যেন জ্ঞান লাভ করতে পারে। সুইজারল্যান্ডে বেড়াতে গেলে অন্যান্য অভিনেতারা আর যেখানেই যাক, সার্নে যাবেন বলে মনে হয় না, সুশান্ত সার্নে গেছেন, যে বিজ্ঞানগবেষণা কেন্দ্রে গবেষণা হচ্ছে আলোর গতির চেয়ে দ্রুত আমাদের গতি হবে কি না কখনও। সুশান্ত খুব দামি টেলিস্কোপ কিনেছেন, ও দিয়ে রাতের আকাশ দেখেন, কোটি কোটি নক্ষত্র, গ্রহ, গ্যালাক্সি দেখেন। সুশান্তর স্বপ্নের মধ্যে আছে পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে আরও পড়া, আরো জানা। এমন জ্ঞানপিপাসু, কৌতূহলী, প্রতিভাবান তরুণ ছিলেন বলিউডের গোবরে পদ্মফুল।
সুশান্তর মানসিক রোগ ছিল, এ কথা তাঁর প্রেসক্রিপশানই বলে। তাঁকে ডিপ্রেশানের ওষুধ দিয়েছিলেন তাঁর মানসিক রোগের চিকিৎসক। তাঁর কাছের লোকেরা বলছেন, সুশান্ত নাকি অনেকদিন ওষুধ খাননি। ঠিক কী কারণে হাতের নাগালে তারকাখ্যাতি থাকার পরেও, ৫০টি স্বপ্নের বেশিরভাগই এখনও পূরণ না হওয়ার পরও তিনি নিজের জীবনের ইতি ঘটাতে চাইলেন, তা আমরা জানি না। তাঁর মস্তিষ্ক তাঁকে কী বলছিল সেই সকালে, যে কারণে তিনি দড়ি নিয়েছিলেন হাতে, সেটা আমরা কোনওদিন জানতে পারবো না। মস্তিষ্কই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে জটিলতম জিনিস।
সব মানুষই কমবেশি ডিপ্রেশানে ভোগে। তবে সুস্থ মানুষের ডিপ্রেশান আর মানসিক ব্যাধির ডিপ্রেশান এক নয়। একটি ডিপ্রেশান, আর একটি ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার। ডিপ্রেশান থেকে উঠে আসা সহজ, কিন্তু ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার থেকে উঠে আসা সহজ নয়। একে সামাল দিতে নিয়মিত থেরাপি এবং ওষুধের দরকার হয়। অনেকে বলে, ভালোবাসা না পেলে, বা একাকীত্বে ভুগলে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে ভোগা মানুষ আত্মহত্যা করে। তা ঠিক নয়। এই ডিসঅর্ডার যাদের আছে, তারা অগুনতি মানুষের, পরিবারের সবার এবং বন্ধুবান্ধবদের নিখাদ এবং অফুরন্ত শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-স্নেহ পেলেও আত্মহত্যা করে। প্রচুর ভালো বন্ধু তাদের ঘিরে থাকলেও তারা আত্মহত্যা করে, কারণ তাদের মস্তিষ্ক তাদের অন্য বার্তা দেয়, যেটার সঙ্গে তাদের বাস্তব জীবনের কোনও সম্পর্ক নেই।
৩। বাংলাদেশের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকাকে গ্রেফতার করা হয়েছে কারণ তিনি ফেসবুকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সামান্য কিছু লিখেছিলেন। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের এক টেলিভিশান এক তথ্য-তদন্ত-চিত্রে দেখিয়েছিল পাবনার এক সরকারি হাসপাতালে ঢাকার এক প্রাইভেট কোম্পানি হাসপাতালের জন্য কী কী সরঞ্জামাদি কিনতে হবে তা লিস্ট করে পাঠিয়ে দিয়েছে এবং অর্ডারে সই করতে অনুরোধ করেছে। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ-ডাক্তার বলেছেন, তাঁর হাসপাতালে ওই সরঞ্জামাদির প্রয়োজন নেই তাই তিনি অর্ডারের কাগজে সই করবেন না। এর কিছুদিন পর পাবনার ওই হাসপাতাল থেকে কর্তৃপক্ষ-ডাক্তার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আসা বদলির কাগজ পান। রোমহর্ষক ঘটনা। তদন্ত করলে আরও জানা যায় যে ওই প্রাইভেট কোম্পানিটি দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে অর্ডার পাঠিয়ে দেন। একটি হাসপাতালে কী কী দরকার, তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুঝবেন, কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানিকে কে দায়িত্ব দিয়েছে বোঝার, এবং কোনও হাসপাতাল যদি কোম্পানি থেকে সরঞ্জামাদি না কেনে, তাহলে শাস্তি পাওয়ার ব্যবস্থাটা ওই কোম্পানি কী করে করে! কোম্পানির সংগে খুব প্রভাবশালী লোকেরা জড়িত, তা সহজেই অনুমেয়।
এসব দেখে যদি কেউ দুর্নীতির সমালোচনা করেন, তাহলে তাঁকে কি গ্রেফতার করাটা উচিত? যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে বলতে হয়, নিশ্চয়ই উচিত নয়। দুর্নীতি বাড়তে থাকলে, অরাজকতা বাড়তে থাকলে, বাকস্বাধীনতা কমতে থাকে, গণতন্ত্র হতে থাকে অর্থহীন একটি শব্দ। সেইজন্যই ভয় হয়। মাঝে মাঝে ভাবি, দেশটায় গণতন্ত্রের কতটুকু অবশিষ্ট আছে। গণতন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে বাকস্বাধীনতা। গণতন্ত্রকে সম্মান করলে বাকস্বাধীনতাকে সম্মান করতেই হয়।
এইসব ছোটখাটো অগণতান্ত্রিক আচরণ মানুষকে খুব স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন করে। এখন পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে, তা পৃথিবীর সবাই আধুনিক প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়ে মুহূর্তেই জেনে যেতে পারছে। সুতরাং আমি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, কিন্তু আমার মতের সঙ্গে মেলে না, এমন কোনও মতকে আমি সহ্য করি না, এই সহ্য না করার ব্যাপারটা শুধু দেশের মধ্যেই গোপন থাকবে—এটি শত চাইলেও আজকাল আর সম্ভব নয়।
বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন সাহসী মানবতাবাদী, নারীবাদী। তিনি বাকস্বাধীনতায় ভীষণ বিশ্বাস করতেন বলেই যে যুগে মেয়েদের অন্দরমহলে মুখ বুজে বাস করাই ছিল নিয়ম, তিনি সেই নিয়ম ভেঙে কথা বলেছেন, মেয়েদের পড়ালেখা করার, অর্থ উপার্জন করার, ঘরে-বাইরে সর্ব ক্ষেত্রে সমানাধিকার পাওয়ার কথা খুব জোর দিয়ে বলেছেন। তিনি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারে, মত প্রকাশের অধিকারে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন। তাঁর নাম দিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ হয়েছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি তাঁর আদর্শকেই মূল্য দেওয়া না হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকে তাঁর অর্থাৎ বেগম রোকেয়ার নাম সরিয়ে দিয়ে অন্য কারও নাম বসানো হোক, যে নামের মানুষ বাকস্বাধীনতার জন্য জীবন ভর সংগ্রাম করেননি। তা হলে অন্তত আমাদের শ্বাসগুলি এত দীর্ঘ হবে না যত দীর্ঘ হচ্ছে এখন।
সেদিন আমি আমার এক পরিচিত বাংলাদেশি লোককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেউ কেউ বলছে দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা, হাসপাতাল ইত্যাদির নাকি বারোটা বেজেছে? স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ অনেক টাকাই নাকি নানান লোকে নিজেদের পকেটে ভরেছে? এটা কি সত্যি যে নিজের অসুখ হলে দেশে চিকিৎসা না ক’রে চিকিৎসার জন্য খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিদেশে যেতে চেয়েছিলেন?’ লোকটি আমার প্রশ্ন শুনে মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন। গলা কাঁপছিল যখন বলছিলেন যে কাকপক্ষী যেন না জানে আমার এই প্রশ্নগুলো তিনি শুনেছেন। আরে প্রশ্ন তো আপনি করেননি, করেছি আমি! না এতেও তাঁর ভয় কাটেনি। বুঝতে পারলাম সরকার সম্পর্কে সমালোচনা করা তো অপরাধই, সমালোচনা শোনাও অপরাধ, এমনকি সরকারকে নিয়ে কারও কোনও প্রশ্ন শোনাও অপরাধ।
লোকটির প্রতিক্রিয়া দেখে আমার মনে পড়েছে চীনের অভিজ্ঞতার কথা। আমার এক প্রশ্ন শুনে আমার দোভাষী চৈনিক ভদ্রমহিলার যে প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম, তাতেই আমি চীনের বর্তমান অবস্থা বুঝেছিলাম। তিয়ানানমান স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আচ্ছা, এখানে সেদিন, ১৯৮৯ সালে, মোট কতজন মানুষকে মারা হয়েছিল?’ সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলা ছিটকে সরে গেলেন, থরথর করে কাঁপতে লাগলেন, কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘কিছু জানি না, কিছু জানি না, আমরা কিছু জানি না সেদিন কী ঘটেছিল, আমরা কিছু দেখিনি, কিছু পড়িনি, কিছু শুনিনি, কিছু জানি না।’