৯০
ডিসেম্বরে ফয়সালাবাদের লায়ালপুর এলাকায় আবহাওয়া বেশ ঠান্ডাই থাকে। সে রাতে ১২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় নিজের নির্জন সেলে একটা ময়লা কম্বল পায়ের ওপরে দিয়ে শেখ মুজিব চুপচাপ নিজের নোংরা বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন। তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়ে গেছে, এখন মৃত্যুর জন্য দিন গোনা। বাইরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে, তিনি জানেন না! শুধু তিনি জানেন, বাঙালিদের হত্যার জন্য এবং জনগণের রায় অমান্য করার জন্য যার বিচার হওয়া উচিত এবং বিচারে যার মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিত, সেই ইয়াহিয়া তার বিচার করছেন।
পাকিস্তান ব্যাপারটাই একটা আগাগোড়া ভুল। শেখ মুজিব ভাবতে থাকেন।
এটা একটা মিলিটারিতন্ত্র। এর আসল প্রতীক হলো, বুট, হেলমেট, বন্দুক, বেয়নেট।
গণতন্ত্র জিনিসটা এর মধ্যে নেই। পুরোটাই একটা সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। যেখানে আছে কয়েকজন সামন্ত মহাপ্রভু, এখন যারা হয়েছে মার্শাল লর্ড। আর তারা পাহারা দিচ্ছে কতগুলো পুঁজিপতিকে, যাদের আছে সামন্ত উত্তরাধিকার। মদ, নারী, শিকার, প্রমোদ যাদের জীবনাচারের নিত্য উপাদান। সামন্ততন্ত্রের আরেক উপাদান, ধর্মের অপব্যবহার, নিজেদের শোষণ, দুঃশাসন, অনাচারের বর্ম হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করা–সেটাও আছে পুরোপুরিই। ভয়াবহ ব্যাপার হলো, তারা আবার পাহারা দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে। সবটা মিলেমিশে পাকিস্তান একটা কিম্ভুতকিমাকার দানবে পরিণত হয়েছে, যেখানে জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেতার বিচার করে অবৈধভাবে বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখলকারীরা। সেই পাকিস্তান ভেঙে বাঙালিরা বেরিয়ে আসবে, একটা সুন্দর সমাজ তারা গড়ে তুলবে তাদের নদীবোয়া সবুজ সুন্দর পলিমাটির দেশটাতে, যেখানে মানুষের ঘুম ভাঙবে বন্দুকের গুলিতে নয়, পাখির ডাকে, যেখানে নদীতে সামরিক যুদ্ধযান নয়, শোনা যাবে ভাটিয়ালি গান আর জলের কল্লোল, যেখানে রেডিওতে আধা উর্দু আধা ইংরেজিতে সামরিক ফরমান নয়, শোনা যাবে লালন, নজরুল, রবীন্দ্রসংগীত। যেখানে শিশুরা স্বপ্ন দেখবে বড় হয়ে একজন হাবিলদার হওয়ার নয়, একজন শিক্ষক হওয়ার।
আমাকে মেরে ফেলবে, তাতে কিছুই যায় আসে না, শুধু আমার এই আত্মদান যেন বাংলার মানুষকে শান্তি দেয়, সুখ দেয়, সমৃদ্ধি দেয়।
এইভাবে ভাবা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। একজন ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত আসামি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষার দিনগুলোকে সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে সুখের করতে পারে শুধু এই ভাবনাই যে সবাইকে একদিন মরতেই হয়, কিন্তু আমি মারা যাচ্ছি বৃহত্তর স্বার্থে, আমাদের সন্তানদের, আমাদের শিশুদের একটা স্বাধীন দেশ দিয়ে যাব বলে। আহ! মৃত্যুও কত না সুন্দর হতে পারে!
হঠাই বাইরে হেলিকপ্টার নামার শব্দ পাওয়া গেল। তাঁর মনে হলো, লায়ালপুর জেলে তাঁকে আনা হয়েছিল একটা হেলিকপ্টারে। আবার কি তাঁকে লায়ালপুর থেকে অন্য জেলে নেওয়া হবে? এরই মধ্যে তিনটা জেল দেখে ফেলেছেন। তাকে এক জেলে তারা রাখতে চায় না। তিনি একজন চিকিৎসকের কাছে শুনেছেন, তাকে কোথায় রাখা হয়েছে, এটা বাইরের কেউ জানে না, তারপরও ভয় আছে যে বাঙালি বন্দীরা জেল ভেঙে তাঁকে নিয়ে যেতে পারে, কিংবা ভারতীয়রা কমান্ডো বাহিনী পাঠিয়ে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারে।
একটু পরে সেলের দরজা খুলে গেল। জেলার নিজে এসেছেন। সঙ্গে দুজন সান্ত্রি।
জেলার বললেন, আপনাকে এক্ষুনি বেরোতে হবে।
তার চোখ পিটপিট করে একবার খুলছে, একবার বন্ধ হচ্ছে।
শেখ মুজিব বললেন, ঘটনা কি আজকে রাতেই ঘটতে যাচ্ছে? আমি তাহলে একটুখানি কোরআন শরিফ থেকে পাঠ করে নেব। আর দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নেব। সে জন্য আমি সময় চাইব যে আমাকে শাওয়ার নিতে দেওয়া হোক।
জেলার বললেন, আপনাকে আরেকটা কারাগারে নেওয়া হচ্ছে। লায়ালপুরে আপনার পাট চুকল। আপনার জন্য বাঙালি বাবুর্চিকেও আমরা ওই জেলে পাঠিয়ে দেব।
শেখ মুজিব বললেন, আমাকে কোন জেলে নেওয়া হচ্ছে?
আমি সেটা জানি না। আপনার জন্য বাইরে হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছে।
এই রাতের অন্ধকারে হেলিকপ্টার যেতে পারবে?
হ্যাঁ। এগুলো সামরিক হেলিকপ্টার। রাতেও উড়তে পারে।
শেখ মুজিবের রেডি হতে পাঁচ মিনিটের বেশি লাগল না। নিজের জিনিস বলতে তাঁর কাছে কিছু নেই। লুঙ্গি, গেঞ্জি, পায়জামা যা ছিল, জেলখানার কর্মীরাই তা গুছিয়ে ব্যাগে ভরল।
শেখ মুজিব সেলের বাইরে এলেন। বারান্দা দিয়ে অনেকটা হেঁটে তিনি এলেন মিয়ানওয়ালি জেলের উঠানে। একটা হেলিকপ্টার সেখানে অপেক্ষা করছে।
তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশ পরিষ্কার আর আকাশে জ্বলজ্বল করছে একটা চাঁদ। চাঁদের আলো দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। পাতলা মশারির মতো কুয়াশা ঝুলছে। তার গায়ে চাঁদের আলো সোনার রেণুর মতো ভাসছে। ঠিক একই চাঁদ উঠেছে বাংলাদেশের আকাশে। বাংলাদেশে এখন অগ্রহায়ণ মাস। সামনে পৌষ মাস আসছে। কৃষকেরা কি ধান কাটা শুরু করে দিয়েছে? কিষানিরা কি সারা রাত কেঁকিতে ধান ভানছে আর গীত গাইছে? শেখ মুজিব তার বক্তৃতায় একটা কবিতা বলতেন : বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এবার আসিলে তব বধিব পরান। বাংলাদেশের মানুষ কি প্রাণ দিয়ে ধান রক্ষা করছে? রক্তবোনা ধান? শাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলেপুড়ে মরে ছারখার তবুও মাথা নোয়াবার নয়!
তিনি হেলিকপ্টারে উঠে বসলেন। একটা সিটবেল্ট বেঁধে নিতে হলো। তাঁর ব্যক্তিগত জিনিসের ব্যাগটা রাখা হলো তাদের সিটের পেছনে। একজন পাইলট, তার পাশে একজন কো-পাইলট। তার দুই পাশে দুই জন সশস্ত্র সৈনিক। তিনি দেখলেন হেলিকপ্টারে আরও কজন উর্দি পরা সশস্ত্র সৈনিক বসা। স্টার্ট নিল হেলিকপ্টার। পাখা ঘুরছে। বিকট শব্দ হচ্ছে। বাতাসে চারপাশে ঝড়ের মতো সৃষ্টি হয়েছে। হেলিকপ্টার আকাশে উড়তে লাগল। তিনি হেলিকপ্টারের জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখতে লাগলেন। নিচে শহরে আলো কমই।
হেলিকপ্টার বাতাসে ভাসতে ভাসতে নামল আরও একটা দেয়ালঘেরা উঠানে। স্টার্ট বন্ধ হওয়ার পর হেলিকপ্টারের দরজা খুলে দেওয়া হলো। মুজিব নামলেন।
দেখতে পেলেন, তাঁর সামনে হাবিব আলী, মিয়ানওয়ালি জেলের গভর্নর। ছোটখাটো চেহারার মানুষটি যখন তার সামনে দাঁড়ান, তখন মনে হয়, তিনিই অপরাধী। হাবিব আলী তাঁকে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলেন।
মুজিবকে রাখা হলো ১০ নম্বর ব্যারাকের পেছনে জেনানা ফাটকে। নারী বন্দিদের তাড়াহুড়া করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১০ নম্বর ব্যারাকে ছিল ভারতীয় বন্দীরা। তার পেছনে নারী বন্দিদের একটা অংশে রাখা হয়। বাঙালি বন্দীরা ছিল আরেক অংশে।
হাবিব আলী খানকে দেখে মুজিব বুঝলেন তিনি মিয়ানওয়ালি কারাগারে আবারও এসেছেন।
তখন অনেক রাত। ৭৩ নম্বর সেলে আটকানো হলো তাকে। মুজিব ঘুমানোর চেষ্টা করলেন।
পরদিন বিকেলবেলা সেলের দরজা খুলে অপরিসর প্রাঙ্গণে তাঁকে হাঁটার। সুযোগ দেওয়া হলো। তিনি দেখলেন যে সেখানে একটা বড় গর্ত করা হয়েছে। তিনি প্রহরীকে জিজ্ঞেস করলেন, এই গর্ত কেন?
প্রহরী বলল, এই গর্ত কেন সে জানে না।
এই গর্ত কেন, তা জানত ভারতীয় বন্দীরা। তাদের দিয়ে সারা দিন ধরে এই গর্ত খোঁড়া হয়েছিল। মুজিবকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এখানে কবর দেওয়া হবে। এই হলো ইয়াহিয়া খানের নির্দেশ।
হাবিব আলী খান তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন।
মুজিব বললেন, আমাকে ফাঁসি দেবে তাতে তো কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু আমার কবর এই দেশের মাটিতে হতেই পারে না। আমার কবর হবে বাংলাদেশের মাটিতে।
হাবিব আলী হাত কচলাতে লাগলেন। তিনি বললেন, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ বেধে গেছে। এই জন্য এটা হলো ট্রেঞ্চ। যদি বিমান আক্রমণ হয়, তাহলে এখানে আশ্রয় নিতে হবে।
মুজিব বললেন, বিমান আক্রমণের ভয়ে তোমরা গর্তে লুকাতে পারো, আমি লুকাব না।
.
মিয়ানওয়ালি জেলে বন্দীরা জেনে গেলেন শেখ মুজিব আছেন এখানে। ভারতীয়রা উচ্ছ্বসিত। কী করে একনজর শেখ মুজিবকে দেখা যায়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক সৈনিক এই জেলে ছিলেন। তাঁরা গোপনে তাদের ফটক থেকে সলিটারি সেলের মধ্যে সুড়ঙ্গ খুঁড়তে আরম্ভ করলেন। মুজিবকে বের করে নিয়ে তাঁরা পালাবেন। কিছুদিনের মধ্যেই জেলের কর্মীদের কাছ থেকে তারা জানলেন যে মুজিব ফাঁসির জন্য বরাদ্দ নিঃসঙ্গ সেলে নেই। তাঁকে জেনানা ফাটকে রাখা হয়েছে। তারা খুবই হতোদ্যম হয়ে পড়লেন।
প্রায়ই সাইরেন বাজতে লাগল। বাতি সব নিভিয়ে দেওয়া শুরু হলো। আকাশে বিমানের ওড়াউড়ি শুরু হলো। ভারতীয় বন্দীরা হাততালি দিত। বাঙালি বন্দীরা কল্পনা করত যে তাদের জেলখানার দেয়াল বোমায় উড়ে যাবে আর তারা তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হচ্ছিল না।
শুধু শেখ মুজিবের জন্য বরাদ্দ খাওয়াদাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হলো।
সামরিক কর্তৃপক্ষ জেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছে, শেখ মুজিবের মৃত্যুদণ্ডাদেশে ইয়াহিয়া খান সাইন করে রেখেছেন। শুধু তারিখটা বসিয়ে নিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করাটা বাকি। তা করা হতে পারে যেকোনো সময়। ফাঁসির মঞ্চ যেন প্রস্তুত করে রাখা হয়।
.
মুজিব দেখলেন, কবর খোঁড়া হচ্ছে। পরের দিন দেখলেন, আবার ভরে ফেলা হলো খোঁড়া গর্ত। পরে আবার খোঁড়া হচ্ছে।
মুজিব আবার বিড়বিড় করলেন, কাওয়ার্ডস ডাই মেনি টাইমস বিফোর দেয়ার ডেথস, দ্য ভ্যালিয়েন্ট নেভার টেস্টস ডেথ বাট ওয়ান্স।
৯১
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বসে যুদ্ধ পরিস্থিতি আলোচনা করছে :
ভারতীয় বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর একযোগে আক্রমণ–ভারতের যুদ্ধ ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশে মিত্রবাহিনী জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করতে লাগল। পশ্চিম সীমান্তে লড়াই হতে লাগল ভয়াবহ, প্রাণঘাতী, কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান।
৪ ডিসেম্বরের আগেই পাকিস্তানি সৈন্যরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এটা ঘটেছে ২ ডিসেম্বরেই। অর্ধেক সরে গেছে কুষ্টিয়ার দিকে, অর্ধেক গেছে খুলনার দিকে।
.
ব্যাঙ্গমা বলল, খুলনার দিকে যাওয়ার কারণ নাকি আছিল যদি আমেরিকা সপ্তম নৌবহর পাঠায়, তাইলে জাহাজে কইরা হেরা পালায়া যাইব।
ব্যাঙ্গমি বলল, ৩ ডিসেম্বরের আগেই যশোরে পাকিস্তানি বিমান বিধ্বস্ত হয়, আর পাইলট প্যারাস্যুটে নাইমা ইন্ডিয়ান গো যুদ্ধবন্দী হয়।
ব্যাঙ্গমা বলল, ৪ ডিসেম্বরের আগেই পাকিস্তানের গর্ব নৌবাহিনীর সাবমেরিন গাজি বিশাখাপত্তম সমুদ্রবন্দরের কাছে বিধ্বস্ত হয়। সেখানকার জাইলা আর মাঝিরা দেখতে পায় কতগুলা লাইফবোট ভাইসা উঠতাছে।
ব্যাঙ্গমি বলল, ভারতে এইটা নিয়া দুই মত আছে। জেনারেল জ্যাকব বলেন, গাজি নিজেরা মাইন পাততে গিয়া সেই মাইনের বিস্ফোরণে ধ্বংস। হইছে। আইএনএস রাজপুতের ডেপথ চার্জে গাজি ধ্বংস হইছে, এই দাবিও ভারতীয় নৌবাহিনী কইরা থাকে। তবে ঠিক কোন গভীর বাণে কীভাবে গাজি বিধ্বস্ত হইছে, আইএনএস রাজপুত সেটা টের পায় নাই। মাঝিরাই ধ্বংসাবশেষ ভাইসা উঠতে দেইখা খবর দিছে। পরে ইন্ডিয়ান নেভি ভালো কইরা খোঁজ নিয়া তো অবাক, ঘটনা সত্য, গাজিরে খোদা তুইলা নিছে। যে দুইজন মাঝি গাজির দুইটা লাইফ ভেলা উদ্ধার কইরা আইনা জমা দিছিল, তাগো ৫০০ রুপি কইরা ১০০০ রুপি পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম পালার্মেন্টে ঘোষণা দেন, গাজিরে ধ্বংস কইরা দেওয়া হইছে। টেবিল চাপড়ানোর শব্দে গাজির বাকি ধ্বংসাবশেষও ধ্বংস হইয়া যায়।
.
আইএনএস বীরাক্রান্ত জাহাজ থেকে যুদ্ধবিমান উড়ে গিয়ে বোমা ফেলে কক্সবাজারের বিমানবন্দর অচল করে দেয়।
ভারতের বিমানবাহিনী পূর্ব ফ্রন্টে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর কার্যক্ষমতা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খতম করে ফেলে। মূলত তারা বিমানঘাঁটির রানওয়েগুলোতে বোমা ফেলে যুদ্ধবিমানের ওড়ার ক্ষমতা নষ্ট করতে সক্ষম হয়। এরপর মুক্ত আকাশ পেয়ে বিমানবাহিনী শত্রুর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে বোমা ফেলতে থাকে নির্বিঘ্নে। এমনকি তারা হেলিকপ্টার দিয়ে মেঘনা নদী পার করে দেয় সৈন্যদের। ছত্রীসেনা নামিয়ে টাঙ্গাইল অঞ্চলে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করে। দুই জায়গাতেই তাদের সহায়তা করে বাঙালিরা। টাঙ্গাইলে যেমন জনতা তাদের পাহারা দিয়ে রাখে, তেমনি কাঁদেরিয়া বাহিনীর হাজার হাজার সদস্যও ছত্রীসেনাদের নিরাপদ অবতরণ নিশ্চিত করতে পালন করে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা। মেঘনা নদীতে মাঝিরা শত শত নৌকা এনে সৈন্যদের রসদপত্র পারাপার করে দেয়। যেমন কামালপুর যুদ্ধে তিনজন। কিশোর তিনবার তিনটি চিঠি নিয়ে যায় ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের কাছ থেকে, একবার পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের কাছে, আরেকবার পাকিস্তানি লে. কর্নেল সুলতান আহমদের কাছে।
.
ব্যাঙ্গমা বলল, কামালপুরের চিঠি নিয়া যাওনের ঘটনাটা কও না গো শুনি!
ব্যাঙ্গমি বলল, শুনবা? আচ্ছা কই!
.
কামালপুর বাংলাদেশ যুদ্ধের একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এটাকে বলা হয় ঢাকার প্রবেশদ্বার। জায়গাটা জামালপুরের বকশীগঞ্জ থানার সীমান্তঘেঁষা এলাকা। এই জায়গাটা পার হলে ঢাকার দিকে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর জন্য ঢাকার দিকে আসা সহজ হয়ে যাবে। পাকিস্তানিরা জানে জায়গাটার গুরুত্ব। তাই তারা একেবারে কঠিন নিচ্ছিদ্র প্রতিরোধ ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল কামালপুরে। কংক্রিটের বাংকার। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ। এপ্রিল থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বারবার এটাতে হামলা করেছে, উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু পাকিস্তানিরা ঘাটি ছাড়েনি।
১১ নম্বর সেক্টরের এই এলাকায় নিজের গ্রামের বাড়ির কাছে যুদ্ধ পরিচালনা করতে আসেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। আবু তাহের ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে, সেখান থেকে পালিয়ে কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে বহু কষ্টে তিনি, মেজর মঞ্জুর প্রমুখ চলে আসেন কলকাতায়, থিয়েটার রোডের বাড়ির আঙিনায় তাঁবু গেড়ে পড়ে থাকেন, যাতে তাদের যুদ্ধে পাঠানো হয়, তখন মেজর তাহেরকে দেওয়া হয় ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব, আর মেজর মঞ্জুরকে দেওয়া হয় ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব। ১৪ নভেম্বর আবার আক্রমণ করল মুক্তিবাহিনী, তাহের নিজে উপস্থিত, যুদ্ধ চলছে, মুহূর্মুহূ বিস্ফোরণ, শত শত রাউন্ড গুলি মাথার ওপর দিয়ে বাতাসে শাঁই শাঁই শব্দ করে ছুটে যাচ্ছে, গোলা এসে পড়ছে পাশে, ফুটছে, ফাটছে। শব্দে মনে হচ্ছে যেন আতশবাজি হচ্ছে এই এলাকাজুড়ে। হঠাৎ একটা বিস্ফোরণ, আর মেজর তাহের দেখতে পেলেন তার একটা পা ক্ষতবিক্ষত, রক্তে ভেসে যাচ্ছে প্যান্ট, ভেসে যাচ্ছে ঘাস-মাটি। সেই যুদ্ধে ক্ষতি স্বীকার করতে বাধ্য হলো পাকিস্তানি মিলিটারি, কিন্তু তারা পোস্ট ছাড়ল না।
মেজর তাহের হাসপাতালে, তার পা কেটে ফেলতে হবে। ২৪ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি পোস্টটাকে ঘিরে রাখল। পাকিস্তানি মিলিটারি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, কোনো অস্ত্র, গোলাবারুদ এমনকি খাদ্য-পানীয় আসার কোনো রাস্তা তাদের খোলা নেই।
৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষিত হলে গড়ে উঠল ভারত বাংলাদেশ যৌথ কমান্ড। ৯৫ মাউন্ট ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ার নিজে উপস্থিত হলেন কামালপুরে।
এবার ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী একযোগে হামলা করবে কামালপুর পাকিস্তানি মিলিটারিদের অবস্থানের ওপর। ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ছিলেন সজ্জন। তিনি দেখলেন, এই যুদ্ধে পাকিস্তানিদের জেতার কোনোই কারণ নেই। এমনিতেই ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী সংখ্যায় শক্তিতে বেশি, তার ওপর মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘদিন তাদের অবরুদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে বলে তাদের অস্ত্রশস্ত্র, খাওয়ার পানির সংকটে আধমরা হয়ে থাকার কথা। তিনি চিঠি লিখলেন ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের কাছে : অকারণ রক্তক্ষয় আমার পছন্দ নয়। আত্মসমর্পণ করো। জেনেভা কনভেনশন অনুসারে তোমাদের নিরাপত্তা ও সম্মান দেওয়া হবে।
কিন্তু চিঠি নিয়ে যাবে কে?
আমি। আমি যাব।
অগ্রহায়ণের সেই সকালে কেবল কুয়াশা কাটতে শুরু করেছে। সূর্য উঠে গাছের পাতায় ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দুগুলোকে রোদে শুষে নিতে শুরু করেছে পরম আদরে। মাসের পর মাস গোলাগুলির শব্দে এলাকায় কোনো পাখি নেই, তবে গরু-ছাগল যেসব আছে, সেগুলো যুদ্ধের দামামা শুনতে অভ্যস্ত।
তুমি কে? জিজ্ঞেস করলেন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার।
আমি বশির আহমেদ।
তুমি ইংরেজি জানো?
ইয়েস স্যার।
কোন ক্লাসে পড়ো।
আই রিড ইন ক্লাস টেন স্যার।
হোয়াটস দ্য নেইম অব ইয়োর স্কুল।
কামালপুর কো-অপারেটিভ স্কুল স্যার।
ক্লেয়ার তাকালেন ছেলেটির মুখের দিকে। গোলাকার মুখ। বড় বড় ভাসা ভাসা চোখ। চোখের বড় বড় পাতা এক অপরূপ মায়া সৃষ্টি করেছে। অবয়বজুড়ে। কাঁধে একটা লাইট মেশিনগান। এই ছেলে যুদ্ধে এসেছে কেন?
ওকে, গো।
একটা সাইকেল জোগাড় করে একটা সাদা শার্টকে পতাকা বানিয়ে সাইকেলের সামনে ঝুলিয়ে বশির চলে গেল পাকিস্তানি ক্যাম্পের উদ্দেশে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হচ্ছে। বশির ফেরে না। ক্লেয়ারের চোখেমুখে উদ্বেগ। একটা নাবালককে তিনি পাঠিয়েছেন।
সে আসছে না। এ তো বড় দুশ্চিন্তার কথা। পাকিস্তানি মিলিটারি কি যুদ্ধের নিয়মকানুন জানে না? মিলিটারি ভব্যতা জানে না? আত্মসমর্পণের আহ্বানসংবলিত চিঠি নিয়ে সাদা পতাকা উড়িয়ে যাওয়া বালককে কি আটকে ফেলল তারা? মিত্রবাহিনীর সবাই উদ্বিগ্ন।
.
বশির পৌঁছাল পাকিস্তানি অবস্থানে। কংক্রিটের বাংকারের আড়ালে সব পজিশন নিয়ে বসে আছে। সামনে সেন্ট্রি আছে। তাকে দেখেই তারা চিৎকার করে উঠল : হল্ট।
বশির সাদা শার্ট নাড়তে নাড়তে চিৎকার করে বলল, লেটার। লেটার। পত্র হ্যায়। পত্র হ্যায়। চিঠি হ্যায়।
সেন্ট্রিরা দৌড়ে এল। হ্যান্ডস আপ। বশির তাঁর হাত মাথার ওপরে তুলল। প্রহরীরা এসে তার কোমর, প্যান্ট সব তল্লাশি করল। বশির বলল, লেটার হ্যায়।
সাইকেলটা একটা গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে রাখল বশির। দুপুরের রোদে গাছের পাতা, কাণ্ডের ছায়ার পাশে সাইকেলের ছায়াও পড়ল। সাইকেলের বেলে রোদ পড়ে ঠিকরে উঠছে।
তারা তাকে নিয়ে গেল ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের কাছে।
স্যার, এ বাচ্চালোগ লেটার এনেছে।
লেটার? কার লেটার। কংক্রিটের একটা দেয়ালে ভর দিয়ে ঘাসে বসে। থাকা ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন বশিরের দিকে।
ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার সাবের চিঠি।
আহসান পড়লেন। বললেন, তুমি একটা বাচ্চা। না জানি কোন মায়ের কোল খালি করে যুদ্ধের ময়দানে এসে পড়েছ। এখন লাঞ্চের সময়। আমরা খাব। তুমিও খাও। আমি ভেবে দেখি কী করব।
বশিরের জন্য টিনের থালায় রুটি আর ডাল এল। বশির ঘাসে বসে রুটি ডাল দিয়ে চিবাতে লাগল।
ক্যাপ্টেন আহসানও রুটি চিবুচ্ছেন আর ভাবছেন, আত্মসমর্পণ করা ঠিক হবে কি না।
এই সময় আকাশে দেখা গেল ভারতীয় বিমান। ভীষণ শব্দ করে এসে তারা আকাশ থেকে বোমা ফেলতে লাগল। ভীষণ শব্দ, ধোয়া আর আগুন। একঝটকায় বশিরকে নিয়ে আহসান বাংকারের ভেতরে ট্রেঞ্চের মধ্যে ঢুকে পড়লেন।
যুদ্ধবিমান ব্যাপক ক্ষতি করেছে। অনেকে হতাহত হয়েছে।
আহসান সেসব সামলাচ্ছেন। নির্দেশ দিচ্ছেন। তারপর নিজে একটা চিঠি লিখলেন।
আমরা আত্মসমর্পণ করব কি না, এটা ভারতীয় অফিসারের সঙ্গে আলাপ করে ঠিক করতে চাই। একজন অফিসারকে পাঠান।
বাঙালি একটা বাচ্চা ছেলের আনা চিঠিকে অবিশ্বাস করছেন না তিনি, কিন্তু তারও তো মান-অপমান বোধ আছে। পাঞ্জাবি তিনি। আরেকজন পাঞ্জাবির কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারেন।
সেই চিঠি নিয়ে বশির উঠল সাইকেলে। সাদা শার্ট উড়িয়ে বাতাসের বিরুদ্ধে উত্তরের দিকে ছুটছে তার সাইকেল।
.
বশির না আসায় ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার অস্থির হয়ে উঠলেন। চিঠি লেখা তাঁর প্রিয় হবি। তিনি আরেকটা চিঠি লিখলেন। তারপর হাঁক ছাড়লেন, আরেকটা চিঠি লিখেছি। কে যাবে?
এবার এগিয়ে এল আরেক কিশোর। হুবহু বশিরের মতোই যেন দেখতে। যেন যমজ ভাই।
আমি যাব স্যার।
তোমার নাম কী?
আনিসুর রহমান স্যার।
তুমি কোন ক্লাসে পড়ো।
আমি টেনে পড়ি স্যার।
কোন স্কুলে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্যার। ক্লেয়ার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। সেখানে ছিলেন যুদ্ধ-সাংবাদিক হারুন হাবিব। তিনি বললেন, এটা স্যার ত্রিপুরার কাছে। আগরতলা বর্ডারে।
ক্লেয়ারের বিস্মিত হওয়ার পালা। কত দূর থেকে কোনখানে যুদ্ধ করতে এসেছে আরেকটা বালক।
আনিসুর রহমান আরেকটা সাইকেল জোগাড় করে একটা সাদা কাপড়কে পতাকা বানিয়ে লাঠির ডগায় ভালোভাবে বেঁধে নিয়ে ছুটল পাকিস্তানি পজিশনের দিকে।
বশির ফিরছে। আনিস যাচ্ছে। কিন্তু দুজন দুই পথে যাওয়া আসা করায় কারও সঙ্গে কারও দেখা হলো না।
বশির ফিরে এল।
তাকে দেখে অধীর ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের মুখে হাসি ফুটে উঠল। ঘর্মাক্ত বশির সাইকেল থেকে নামতেই ক্লেয়ার তাকে জড়িয়ে ধরলেন।
বশির চিঠি দিল। ব্রিগেডিয়ার চিঠি পড়লেন। পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছে। তবে আলাপ-আলোচনা করতে হবে।
ততক্ষণে আনিসুর রহমান পৌঁছে গেছে পাকিস্তানের ক্যাম্পে। তাকে বলা হলো, তুমিও বসো। খাওয়াদাওয়া করো। খাবারের অবস্থা খুব খারাপ। যে রুটি তোমাকে দেওয়া হবে, সেটা যদি তুমি দাঁত না লাগিয়ে ছিঁড়তে পারো তোমার জন্য আছে পুরস্কার।
আনিসুর রহমান সত্যি সত্যি সেই রুটি ছিঁড়তে পারছে না। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! এই রুটি কি সাইকেলের টায়ার দিয়ে তৈরি।
আহসান মালিক দ্বিতীয় চিঠিটাও পড়লেন।
ওয়্যারলেসে খবর আসছে। স্যার, দুরে দুজনকে দেখা যাচ্ছে স্যার। সাইকেলে আসছে। একজন ইন্ডিয়ান আর্মির ইউনিফর্ম পরা স্যার। ওভার।
ওকে আসতে দাও। ওভার।
ততক্ষণে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পোশাক পরা একজন আর একজন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধা দুইটা সাইকেল চালিয়ে এসে হাজির হলেন। আলাপ-আলোচনা শুরু হলো।
শেষে সন্ধ্যার আগে আগে ১৫০ জন পাকিস্তানি সৈন্য, ৩০ জন রেঞ্জার আর ২৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করল।
তাদেরকে অস্ত্র হাতে ঘিরে রইল লুঙ্গি পরা, গেঞ্জি পরা, শার্ট পরা কয়েক শ মুক্তিবাহিনীর ছেলে। আর সঙ্গে রইল ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের ভারতীয় সৈনিকেরা। পাকিস্তানি সৈন্যরা অস্ত্র মাটিতে রাখল। বাংলাদেশের ছেলেরা চিৎকার করে উঠল : জয় বাংলা।
সূর্য তখন দিগন্তে ডুবে যাবে বলে একটা ডিম পোচে ভাসা কুসুমের আকার নিয়েছে। অস্তগামী সূর্যের হলুদ আলোয় দেখা গেল ক্যাপ্টেন। আহসানের চোখের কোণে অশ্রুফোঁটা হলুদ হয়ে আছে।
পাকিস্তানিদের অনেক দিন ধরে তৈরি করা ডিফেন্স লাইন, শক্ত ডিফেন্স পোস্ট অধিকার করল মিত্রবাহিনী। পেল অনেক অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ।
ক্যাপ্টেন আহসান মালিক বললেন, আমাদের জওয়ানরা অনেক দিন। ভালো খাবার পায় না।
ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার অর্ডার করলেন, এদের প্রত্যেককে ভালো ডিনার বক্স দাও। মাত্র এক দিন আগে এসেছে ভারতীয় এই ব্রিগেড। তাদের রেডিমেড খাবার এখনো মুখে দেওয়া যায়।
.
ডিসেম্বরের ৮। ক্লেয়ারের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী এগিয়ে চলেছে। তারা জামালপুরের দক্ষিণে পৌঁছে গেছে। ব্রহ্মপুত্র নদ পেরোতে হবে। নদে পানি নেই, কিন্তু পাহাড় থেকে আনা গরুগুলো পানি দেখেই ভয় পেয়ে গেল, গরুর গাড়িতে কামান, গোলাবারুদ রসদ পার করা যাবে না। নৌকায় সবাই নদী পার হলো। অনেক জিনিস পেছনে রাখা হলো শক্ত নিরাপত্তায়।
মোল্লাপাড়া গ্রামে ঘাঁটি গড়ল মিত্রবাহিনী।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার আরেকটা চিঠি লেখেন। তবে নিজে লেখেন নাই, কর্নেল ব্রারকে দিয়া লিখা নিয়া তিনি নিচে সাইন করেন। ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে একটা ৪ পৃষ্ঠার বড় চিঠি লেখেন। চিঠিটা এবং এর উত্তর দুইটাই পরে সংগ্রহ করা হয়। কাজেই এইটা গল্প না, ইতিহাস। ইংরেজি চিঠির বাংলা করলে দাঁড়ায় :
বরাবর কমান্ডার,
জামালপুর গ্যারিসন,
আদিষ্ট হয়ে জানাচ্ছি যে তোমার গ্যারিসন চারদিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। তুমি যে পালিয়ে যাবে সে রকম কোনো পথই আর নেই। পুরো গোলন্দাজ দলসহ একটা ব্যারিকেড এখানে তৈরি আছে। কাল সকাল সকাল আরেকটা ব্রিগেড এসে যাবে। তার ওপরে আমাদের বিমানবাহিনীর ক্ষমতার কিছু পরিচয় তোমরা পেয়েছ, আসলটা সামনে আসছে। তোমাদের দিক থেকে পরিস্থিতি একেবারে আশাবিহীন। তোমাদের বড় কমান্ডাররা এরই মধ্যে তোমাদের পরিত্যাগ করেছে।
একজন সৈনিক হিসেবে আরেকজন সৈনিককে বলছি, আমি তোমাদের নিরাপত্তা আর সম্মানের পুরো নিশ্চয়তা দিচ্ছি, তোমরা আত্মসমর্পন করো, কারণ এটাই একমাত্র পথ। আমি নিশ্চিত তুমি তোমার নিজের জেদের কারণে তোমার অধীন এতগুলো লোকের প্রাণহানির কারণ হয়ে উঠবে না। তুমি নিশ্চয়ই আমাদের সেনাবাহিনী প্রধানের আবেদন শুনেছ, তোমরা যদি তোমাদের পরিবারের সঙ্গে আবার মিলিত হতে চাও, তোমাদের একমাত্র কাজ হবে সারেন্ডার করা। তুমি রাজি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি কাগজপত্র তৈরি করে ফেলব।
এটা বোধ হয় বলে রাখা দরকার যে তোমরা যদি মুক্তিবাহিনী কিংবা তাদের সমর্থকদের হাতে পড়ো, তোমাদের জীবনের আর কোনো নিশ্চয়তা থাকবে না। তোমার সহযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আহসান। মালিক ৪ ডিসেম্বর কামালপুরে আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। বুদ্ধিমানের মতো। তাদের জেনেভা কনভেনশন অনুসারে যত্নসহকারে রাখা হয়েছে।
আমি তোমার কাছে ৬.৩০ মিনিটের আগে উত্তর আশা করছি। অন্যথায় আমি বাধ্য হব তোমাদের জন্য বরাদ্দ ৪০ সোরটি এমআইজি নিয়ে চূড়ান্ত আঘাত করতে। আজকে সকালে যে যুদ্ধ হয়েছে তাতে তোমাদের যারা বন্দী হয়েছে, তারা আমাদের শক্তি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেয়েছে। তবে তাদেরও যত্নসহকারেই রাখা হয়েছে।
এই বেসামরিক বার্তাবাহকের সঙ্গে সভ্য আচরণ করা হবে, তার কোনো ক্ষতি করা হবে না বলে আমি আশা করি।
তাৎক্ষণিক উত্তর প্রত্যাশা করছি।
ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার
৯ ডিসেম্বর ১৯৭১।
এই বার্তা নিয়ে কে যাবে জামালপুর গ্যারিসনে? মুক্তিবাহিনীর গাইড জহিরুল হক মুন্সি এগিয়ে এলেন, আমি যাব।
সাইকেলে সাদা পতাকা উড়িয়ে জহিরুল হক মুন্সি চললেন। কিন্তু পাকিস্তানি মিলিটারি তাকে দেখামাত্র ধরে মারতে শুরু করে দিল। মারতে মারতে আধা মরা করে তার পকেট সার্চ করে তারা পেল চার পৃষ্ঠার চিঠি। সেটা নিয়ে তারা গেল গ্যারিসন কমান্ডার লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদের কাছে।
সুলতান আহমদ চিঠি পড়ে খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। তাঁর কাছে যুদ্ধ করার মতো গোলাবারুদ নেই। ছেলেরা কয়েক দিন আধা বেলা আধপেটা খেয়ে আছে। যুদ্ধ করবে কী করে? কিন্তু বিনা যুদ্ধে তিনি আত্মসমর্পণ করবেন না।
তিনিও চিঠি খারাপ লেখেন না। ছাত্রজীবনে ইংরেজি ক্লাসে চিঠি লিখে তিনি শিক্ষকের কাছ থেকে এক্সিলেন্ট কমেন্ট পেয়েছিলেন।
তিনি লিখতে আরম্ভ করলেন :
জামালপুর
০৯ ১৭৩৫ ডিসেম্বর প্রিয় ব্রিগেডিয়ার,
আশা করি তোমার মনোবল এখনো অনেক উঁচু আছে। তোমার চিঠির জন্য ধন্যবাদ। আমরা এখানে জামালপুরে বসে আছি যুদ্ধ করব বলে। যুদ্ধ এখনো শুরু হয়নি। কাজেই কথা না বলে বরং এসো আমরা যুদ্ধ করি।
৪০ সোরটি! আমার মনে হয় এটা খুবই কম। দয়া করে তোমার সরকারকে বলো আরও অনেক পাঠাতে।
তোমার বার্তাবাহককে উপযুক্ত অভ্যর্থনা করার যে অনুরোধ তুমি করেছ, তার কোনো দরকার ছিল না। এর দ্বারা বোঝা যায় পাকিস্তানি সৈন্যদের সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কত খারাপ। আশা করি সে আমাদের এক কাপ চা পছন্দ করেছে। আশা করি, তোমার হাতে স্টেনগান দেখব। কলম দেখছি, যা ব্যবহারে তুমি তো একেবারে মাস্টার।
তোমার একান্ত
লে. কর্নেল সুলতান আহমদ
জামালপুর ফোর্সেস
.
ব্যাঙ্গমা বলল, সুলতান আহমদের জবাবটা কিন্তু ভালোই হইছে। শুধু তা-ই না, মুন্সির হাতে একটা খামে ভইরা তিনি দিছিলেন একটা তাজা বুলেট।
ব্যাঙ্গমি বলল, কলমে জবাব যত সুন্দর দিছেন, অস্ত্রে জবাব তত ভালো তিনি দিতে পারেন নাই।
ব্যাঙ্গমি বলল, ১০ ডিসেম্বর রাতে মিত্রবাহিনী চারদিক থাইকা তাগো ঘিরা ধইরা চুপচাপ বইসা থাকে। বিকেল ৪টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাইর হইয়া একনাগাড়ে গুলি চালাইলেও ভারতীয়রা চুপটি কইরা বইসা আছিল।
.
রাত ১০টায় পাকিস্তানিরা আবার গ্যারিসনের চারদিকে গুলি ছুঁড়তে থাকলেও মিত্রবাহিনী নীরব হয়ে থাকে।
ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ধারণা করেন, এরা আসলে পালিয়ে যাবে ঢাকার দিকে। তাই বোঝার চেষ্টা করছে কোন পথ খোলা আছে। মিত্রবাহিনী তাদের পালানোর পথের দুধারে অ্যাম্বুশ পেতে বসে রইল। রাত ১টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা পালানোর জন্য লাইন ধরে অগ্রসর হতে লাগল। পুরো বাহিনী বেরিয়ে পাতা ফাঁদের মধ্যখানে আসার পর ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার প্রথম এমএমজি গানার থেকে গুলি করতে শুরু করলেন। এবার একযোগে মিত্রবাহিনীর অস্ত্র গর্জে উঠল।
ভোর হলো। কুয়াশা কাটে না। ছয়টার দিকে একটু একটু করে চারপাশ পরিষ্কার হলো। ২০০ জন পাকিস্তানি মারা গেছে। সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর ফজলে আকবর রেডিওতে যোগাযোগ করে জানালেন, তাঁরা সারেন্ডার করবেন।
ক্লেয়ার ছুটে গেলেন। ৪০০ সৈন্য আত্মসমর্পণ করল। বিপুল অস্ত্র দখল করা গেল। কিন্তু সুলতান আহমদ দুই শ সৈন্য নিয়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন।
চারদিক থেকে বাঙালিরা জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে জামালপুর শহর সয়লাব করে দিল।
ক্যাপ্টেন জয়নুল আবেদিন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। তিনি এই যোদ্ধাদের জন্য একটা গণসংবর্ধনার আয়োজন করলেন। তারা বাংলাদেশের পতাকা তুললেন। তাঁর সামনে গাইতে লাগল আমার সোনার বাংলা। গান গাইতে গাইতে তাঁরা কাঁদছেন।
আর সেই গান শুনে কাঁদছে ক্যাম্পের ভেতরে একটা বাড়িতে আটকে থাকা সালোয়ার-কামিজ পরা একদল নারী।
তাদের আটকে রেখেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে গেল। তাদের বলা হলো, তোমরা মুক্ত। তোমরা চলে যাও।
শাড়ি এনে দেওয়া হলো তাদের। সালোয়ার-কামিজ ছেড়ে শাড়ি পরে মেয়েরা চলে গেল।
জেনারেল নাগরা সকাল ৭টায় হেলিকপ্টারে করে এসে নামলেন জামালপুরে।
৯২
আপা, আপা শোনো। রেডিওটা নিয়ে দৌড়ে হাসিনার কাছে গেলেন রেহানা। হাসিনা জয়কে কোলে নিয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন।
হাসিনা বললেন, কী?
জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানি মিলিটারিকে সারেন্ডার করতে বলছে।
হাসিনা কান পাততে পাততেই ঘোষণাটা শেষ হয়ে গেল আকাশবাণী কলকাতার।
রেহানা বললেন, একটু পর আবার হবে। এটা বাজতে থাকুক। দাঁড়াও। অল ইন্ডিয়া রেডিওর অন্য সেন্টার কী বলে শুনি।
রেহানা রেডিওর নব ঘোরাচ্ছেন। নানা ধরনের শব্দ হচ্ছে। গান, কথা। অর্থহীন টু টু। শেষে পাওয়া গেল সেই ইংরেজি বার্তাটা :
পাকিস্তানি বাহিনীর অফিসার ও সৈন্যদের বলছি, আমি জানি তোমরা খুলনা, চট্টগ্রাম দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছ। তোমরা পালাতে পারবে না। নৌবাহিনী সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। মিলিটারিদের জীবন। আমি রক্ষা করতে চাই। আমার কাছে সারেন্ডার করো। তোমাদের জীবন বাঁচবে। জেনেভা কনভেনশন অনুসারে তোমাদের মর্যাদা দেওয়া হবে।
হাসিনা বললেন, এ ছাড়া তো পাকিস্তানিদের আর কোনো উপায় নাই। এখন সারেন্ডার করতে হবে ওদের।
হঠাই আকাশে বিমানের শব্দ। আর সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়ি থেকেই কান ফাটানো গুলির শব্দ।
সবাই মেঝেতে বসে পড়লেন। রেনু, হাসিনা, হাসিনার কোলে জয়, রেহানা, রাসেল–সবাই।
গৃহপরিচারক আবদুল একটু পরে দৌড়ে এল। কয়েকদিন নিজ বাড়িতে থাকার পর আবার সে এ বাড়িতে ফিরে এসেছে। আবদুল বলল, ইন্ডিয়ান প্লেন আইছে। আর মিলিটারিরা আমগো বাড়ির ছাদে উইঠা গুলি করতেছে। একটা গুলির গরম খোসা আমার গায়ে লাগছে। সে একটা গুলির খোসা হাতে নিয়ে দেখাল।
রেহানা বললেন, ইন্ডিয়ান প্লেন দেখলেই সব বাড়ির ছাদের লোকেরা হাততালি দিচ্ছে।
আবদুল বলল, পাকিস্তানি প্লেন তো আর নেই। সব ফেলায়া দিছে। নাইলে ডগফাইট দেখতে খুব মজা।
রাসেল বলল, জয়বাবু, ভয় পেয়েছ? গুলির শব্দে ভয় পেয়েছ? ভয় পেয়ে না। জয় জয় জয় হয় হয় হয়…
গোলাগুলির শব্দ থেমে গেছে। বিমানের শব্দও আর নেই।
হাসিনা বললেন, মা শুনেছ, নুরুল আমিনকে ইয়াহিয়া খান প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন। আর ভুট্টো সহকারী প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
রেনু বললেন, পাকিস্তানে কে প্রধানমন্ত্রী হলো, কে প্রেসিডেন্ট, আমার কিছু যায় আসে না। আমার চিন্তা বাংলাদেশ নিয়া। খালি তোর আব্বা য্যান ভালো থাকে, আল্লাহর কাছে দিনরাত এই দোয়া করি।
আবদুল জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, এই বাড়ির পাহারাদার মিলিটারিরা গর্তের ভেতরে লুকিয়ে আছে।
সে হাসতে হাসতে বলল, প্লেন চল গিয়া। আপলোগ ডর মাত করো।
৯৩
ব্রিগেডিয়ার কাদের খান পাঠানমুলুক থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছেন হিন্দু, কাফের, হিন্দুস্তানের দালালদের দমন করতে। আটটা মাস তাঁর কাজ ছিল বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করতে নির্দেশ দেওয়া। তিনি ছিলেন ইন্টার সার্ভিসেস স্ক্রিনিং কমিটির প্রেসিডেন্ট। তাঁর সামনে আওয়ামী লীগার, মুক্তিযোদ্ধা, কমিউনিস্ট, হিন্দু, ভারতের দালালদের আনা হতো। তিনি কোনো তদন্ত ছাড়া, কোনো কারণ ছাড়াই বলতেন, বাংলাদেশে পাঠিয়ে দাও। এর মানে হলো, একে হত্যা করো। সৈন্যরা সেই লোককে বা সেই লোকসকলকে গুলি করে হত্যা করত।
কামালপুরের যুদ্ধে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাদের খান ছিলেন। তিনি শুনলেন মেজর আবু তাহের পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে এখানে যুদ্ধ করছে। তিনি বললেন, আমার ছাত্র সে। আমি তাকে ট্রেনিং দিয়েছি। আমার ছাত্র আজকে আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে!
তাহের যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হলেন।
তার পিতামাতাকে রাজাকাররা ধরে আনল। তিনি যখন শুনলেন, এরা তাহেরের আব্বা, আম্মা, তিনি বললেন, এদের সসম্মানে বাড়িতে পাঠিয়ে দাও। তিনি তাহেরের আব্বা মহিউদ্দিন তালুকদারকে বললেন, আপনার ছেলেকে বলবেন, নিজেকে বাঁচিয়ে যুদ্ধ করতে। প্রাণ দিয়ে ফেললে দেশ দিয়ে সে কী করবে!
তাহেরের বড় ভাই আবু ইউসুফ ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। পোস্টিং ছিল সৌদি আরবে। তিনি সৌদি আরব থেকে পালিয়ে ভারতে চলে আসেন। তাহেরের সঙ্গেই যুদ্ধ করেন। কামালপুর যুদ্ধে জামালপুর যুদ্ধে আবু ইউসুফ জান বাজি রেখে লড়াই করেন।
যৌথ বাহিনী চারদিক থেকে এগিয়ে আসছে। জামালপুর বেদখল। টাঙ্গাইলের অদূরে উড়োজাহাজ থেকে শত শত ছত্রীবাহিনী নামল। টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখে কাদির খান হাতের মেশিনগান থেকে রাশি রাশি গুলি ঝরিয়ে ম্যাগাজিন খালি করে ফেললেন। তারপর তার মনে হলো, বড় ভুল করে ফেললাম। এই গুলি আট-দশ মাইল দূরের ছত্রীসেনাদের গায়ে কোনো দিনও লাগবে না। শুধু তার নিজের ম্যাগাজিন খালি হলো। এখন পাকিস্তানি সৈন্যদের বড় সমস্যা হলো গোলাগুলির অভাব।
তিনি তাঁর অধীন মেজর সারোয়ারকে হুকুম করলেন, যাও, এই ছত্রীসেনাদের নিউট্রালাইজ করো। সারোয়ার কয়েক ডজন সৈন্য নিয়ে চললেন ছত্রীসেনাদের অবস্থান লক্ষ্য করে। তারা কয়েক দিন ঘুমান না। ঠিকভাবে খান না। শরীর চলছে না।
পথে কয়েকজন রাজাকারের সঙ্গে দেখা হলো। তারা তাদের পা ঠুকে সালাম করল।
সারোয়ার বললেন, ছত্রীসেনা মারতে হবে। আমরা রাস্তা চিনি না। চলো আমাদের সঙ্গে। আগে আগে পথ দেখিয়ে নাও।
রাজাকাররা বলল, স্যার। ওরা তো স্যার চীনা সৈন্য।
সারোয়ার খুশি হলেন। তিনি তার দলবলসহ ফিরে এলেন।
কী হলো? চলে এলে কেন? বিরক্ত ব্রিগেডিয়ার বললেন।
মেজর সারোয়ার বললেন, ওরা তো স্যার আমাদের ফ্রেন্ডলি বাহিনী। চাইনিজ প্যারাট্রুপার।
ব্রিগেডিয়ার কাদির বললেন, তোমার মতো আহাম্মক আমি জীবনে দুইটা দেখিনি। চীনারা এখানে এসে নামবে, আর আমাদের কোনো খবর দেবে না। বলা নাই কওয়া নাই আকাশ থেকে চীনারা নামবে।
ইয়েস স্যার। কারণ তিব্বত সীমান্ত তুষারে ঢাকা। ৬ ফুট থেকে ১১ ফুট তুষার জমেছে স্যার। পায়ে হেঁটে ওদের পক্ষে আসা অসম্ভব। তাই তারা প্লেনে চড়ে এসেছে।
ব্রিগেডিয়ার কাদির বুঝতে পারলেন, তাদের সৈন্যদের সবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। রাওয়ালপিন্ডি থেকে সারা বছর এবং গত এক মাস শুধু এই আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, ভারত অ্যাটাক করলে চীনও অ্যাটাক করবে। নো চিন্তা। ডু ফুর্তি। মদ খাও। আর বাঙালি মেয়েদের প্রেগন্যান্ট করো। ওদের রেস পাল্টে দিতে হবে।
ওয়্যারলেসে কথা হচ্ছে ঢাকার সঙ্গে। হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ, টাঙ্গাইল ছেড়ে দাও। ঢাকা আসো। ঢাকা সুরক্ষিত রাখতে হবে। তা নাহলে যেকোনো সময় যৌথ বাহিনী ঢাকায় ঢুকে পড়বে।
কাদির খান টাঙ্গাইল ছাড়লেন। তখন বাজে পৌনে ছয়টা। সূর্য ডুবে গেছে। আকাশে সূর্যের আভা এখনো ছড়িয়ে আছে। পাকিস্তানের পতাকাটা এখনো উড়ছে সার্কিট হাউসের ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে। তাঁর সঙ্গে আছে এক কোম্পানি সৈন্য আর রেঞ্জার, ৬০০ জন ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের জওয়ান, পুলিশ, আর ছয়জন অফিসার।
এর আগে ঢাকার উদ্দেশে সুলতান আহমদ রওনা হয়েছেন। গাড়িতে যাচ্ছিলেন। কাঁদেরিয়া বাহিনীর পাতা মাইনে তাঁদের গাড়ি উড়ে গিয়ে একটা গাছের ওপরে লটকে আছে। ড্রাইভার রক্তাক্ত। সুলতান রাস্তার ধারে পড়ে আছেন।
তাঁর পাশ দিয়ে বালুচ সৈন্য যাচ্ছে। তাঁকে স্যালুট জানাল। সুলতান বললেন, আমার ব্যাটালিয়ন কোথায়?
আমার জানা নাই স্যার। বলে সে আরেকটা স্যালটু ঠুকে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করল।
কাদির খান গোলাগুলির আওয়াজ পাচ্ছেন। তিনি ঠিক করলেন বড় রাস্তা দিয়ে নয়, তিনি যাবেন মাঠের ভেতর দিয়ে। সৈন্যদের বললেন, তোমরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হও। একেকজন একেকভাবে ঢাকার দিকে যাও। মনে রাখবা, তোমরা হলো আল্লাহর সৈনিক। একজন মুসলমান ১০ জন হিন্দুর সমান। যাও। ফেরেশতারা তোমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।
২৬ জনের দল নিয়ে কাদির হাঁটছেন। পথ ছেড়ে দিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। রাস্তাঘাট তারা চেনেন না। পথের মধ্যে নালা পড়ছে। খাল পড়ছে। পানি দেখলে তাদের ভয় লাগে। শীতের রাত। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। রাতের বেলা হাঁটা সহজ। দিনে হাঁটা কঠিন। বাঙালিরা যদি দেখে পশ্চিমা সৈন্য যাচ্ছে, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঘিরে ধরবে। পিটিয়ে মারবে, কুপিয়ে মারবে।
তাঁদের সঙ্গে খাবার নেই। তাঁদের সঙ্গে পানি নেই। তাদের সৈন্যদের পায়ে জুতা নেই। পোশাক ছিঁড়ে গেছে। তারা রাতের বেলা কৃষিজমিতে কৃষকদের ফসল চুরি করেন। একটা জমিতে অনেক শসা পেলেন মাচায়। ঝুলছে। শসা তাঁদের জীবন বাঁচাল। খাদ্য আর পানি দুটোর প্রয়োজন মিটল। তারা দুই রাত হাঁটলেন।
এরপর আর কী খাওয়া যায়। সকালে গাছের পাতায় শিশির জমে আছে। বাঁধাকপির পাতায় পাতায়। ২৬ জন সৈন্য ফুলকপির বাগানে বসে পাতা থেকে তুলে তুলে পানি শুষে খেতে লাগলেন। ফুলকপিতেও তাদের খিদে মিটল ভালোই।
দুপুরের রোদে তাদের চলা অসহ্য হয়ে পড়ল। তাঁরা আর পারছেন না। একটা জঙ্গলের মধ্যে বসে পড়লেন।
পেটের খিদেয় ব্রিগেডিয়ার কাদিরের পেট জ্বলে যাচ্ছে।
এই সময় একজন অফিসার মাটি থেকে গোল গোল পাতার একধরনের ঘাস তুলে এনে বললেন, স্যার চিবুতে থাকেন।
এগুলো কী পাতা? বিষাক্ত নয়তো?
না স্যার। আমি খেয়েছি। পিপাসা চলে যায়।
ব্রিগেডিয়ার কাদির বললেন, আমি আর পারছি না। তুমি কয়েকজন সোলজার নিয়ে হাইওয়েতে ওঠো। দেখো আমাদের কাউকে পাও কি না। একটা গাড়ি পেলে আমরা হয়তো বেঁচে যাব।
অফিসার চলে গেলেন। গাছের নিচে রিক্ত নিঃস্ব ব্রিগেডিয়ার শুয়ে পড়লেন। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নীল আকাশে ঝকঝকে রোদ দেখা যাচ্ছে। তার নিজের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের কথা মনে পড়ল।
এই সময় পায়ের আওয়াজ এল। তার পাঠানো অফিসার ফেরত আসছে। তার পেছনে স্টেনগানধারী গোটা ত্রিশেক লুঙ্গি পরা লোক। মুক্তি।
তারা বলল, হ্যান্ডস আপ।
ব্রিগেডিয়ার হাত তুলবেন, সেই শক্তিও তার নেই।
.
তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। রাখা হলো একটা ঘরে আটকে। এই সময় এলেন এক মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বললেন, স্যার, আমার নাম আবু ইউসুফ। মেজর তাহের আমার ছোট ভাই।
ব্রিগেডিয়ার আবু ইউসুফকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।
তারিখটা ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১।
৯৪
মেজর জেনারেল জ্যাকব ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ অব স্টাফ। তাঁর সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রধান মানেকশর কয়েকটা বিষয়ে মতের মিল হচ্ছে না। জ্যাকব মনে করেন, বাংলাদেশ যুদ্ধে আসল হলো ঢাকা। বড় শহরগুলো দখলে নেওয়ার দরকার নেই। যেখানে শত্রুসৈন্যরা দুর্ভেদ্য ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে, তাদের সেখানে থাকতে দাও। তাদেরকে পাশ কাটিয়ে ঢাকা চলে আসো। আর ঢাকার বাইরের শত্রুসৈন্যদের ঢাকা আসার পথ রুদ্ধ করে রাখো। ঢাকা দখল করলেই পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে।
মানেকশ মনে করেন, চট্টগ্রাম, খুলনার মতো বন্দরগুলো দখল করে বসে থাকলে ঢাকার পতন ঘটবে আপনা-আপনি।
জ্যাকব মনে করেন, জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব নেওয়ার আগে, চীন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের আগেই দ্রুততম সময়ে ঢাকার পতন ঘটাতে হবে।
জ্যাকব একটা কাজ করলেন। তাঁর কলকাতার বাসভবনে দাওয়াত করলেন আমেরিকার কলকাতা কনসুলেট অফিসের নয়া পলিটিক্যাল অফিসার জর্জ গ্রিফিনকে। নিজের বেডরুমে তিনি একটা বড় বাংলাদেশের ম্যাপ ঝুলিয়ে রাখলেন। সেখানে দেখালেন ব্রহ্মপুত্রের পূর্বপারে ঢাকার ধারে ট্যাংকবাহিনী এসে গেছে। এগুলো সোভিয়েত ট্যাংক। পানিতে সাঁতার কাটতে পারে। আর ঢাকার চারপাশে ভারতীয় সৈন্যদের অবস্থান বেশি করে চিহ্নিত করে রাখলেন।
নৈশভোজ ভালো হলো। জ্যাকব বললেন, জর্জ, তুমি কি হাত ধোবে? ওয়াশরুমে যাবে? এই বেডরুমের ভেতর দিয়ে যাও।
গ্রিফিন উঠলেন। বেডরুমের দেয়ালে চোখ পড়ল তাঁর। ইস্ট পাকিস্তানের ম্যাপ। আজকের যুদ্ধচিত্র। তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখলেন।
পলিটিক্যাল অফিসাররা সিআইএর ট্রেনিংপ্রাপ্ত হন। এই-জাতীয় গোপন তথ্য সংগ্রহ করাই তাদের কাজ।
গ্রিফিন তাড়াতাড়ি ফিরে গেলেন কনসুলেট অফিসে। ফিরেই বার্তা পাঠালেন তাঁর ওয়াশিংটন অফিসে। আমরা তো কিছুই জানি না। সর্বনাশ হয়ে গেছে। সোভিয়েত উভচর ট্যাংক ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে ঢাকার কাছাকাছি চলে গেছে। পুরো ঢাকা ঘেরাও হয়ে গেছে ভারতীয়দের দ্বারা। ঢাকার পতন এখন অনিবার্য।
এই খবর চলে গেল ফারল্যান্ডের কাছে। রাওয়ালপিন্ডিতে। ফারল্যান্ড সারাক্ষণ বসে থাকেন ইয়াহিয়ার সঙ্গে। ইয়াহিয়ার গ্লাসমেট তিনি।
তিনি ইয়াহিয়া খানকে জানিয়ে দিলেন ঢাকা এখন ভারতীয় ট্যাংকের নলের নিচে।
নিয়াজিও ঢাকার আমেরিকান কনসুলেট অফিসের মাধ্যমে সেই খবর জেনে গেলেন। আর কোনো আশা নেই। ঢাকা যৌথ বাহিনীর দ্বারা ঘেরাও হয়ে গেছে।
৯৫
ঢাকার গভর্নর হাউসটা সত্যিই সুন্দর। ব্রিটিশ আমলে খাজা আবদুল গণি দিলকুশা গার্ডেনে এই প্রাসাদোপম গম্বুজশোভিত প্রাসাদটা নির্মাণ করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হলে ঢাকা আসাম ও পূর্ব বাংলার রাজধানী হয়, তখন ব্রিটিশ সরকার এটা কিনে নেয় এবং ১৯১১ সাল পর্যন্ত এটা ছিল ব্রিটিশ ভাইসরয়ের সাময়িক বাসভবন। ১৯০৬ সালে স্যার জোসেফ বামফিল্ড ফুলার এই ভবনের দরবার হলে গভর্নরের কার্যালয়ের কাজ শুরু করেন। ১৯১১ সাল থেকে এটাকে গভর্নর হাউস হিসেবে ডাকা হচ্ছে। ব্রিটিশরা চলে গেছে। পাকিস্তানিরা এসেছে। এটা এখনো গভর্নর হাউস। চারদিকে সবুজ প্রান্তর। সেইখানে পুষ্পে-বৃক্ষে শোভিত একটা দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ।
এখন গভর্নর হলেন ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক। ৬৬ বছর বয়স। ১৯০৫ সালে জন্মেছিলেন চুয়াডাঙ্গায়, চোখের ডাক্তার ছিলেন, মুসলিম লীগ করতেন, ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত পাকিস্তানে লিয়াকত আলী খানের মন্ত্রী ছিলেন। ইয়াহিয়া খানের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছিলেন। জুলাই মাসে। ইয়াহিয়া তাঁকে স্বাধীনতাসংগ্রামে উত্তাল পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী করে পাঠিয়েছিলেন। ৩১ আগস্ট তাঁকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৩ সেপ্টেম্বর তিনি শপথ নেন। পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের ১০৪ দিন আগে গার্ডেন তথা গুলিস্তানের এই পাখিডাকা, ছায়াঢাকা জ্যোৎস্নাঘোয়া গভর্নর হাউসে তাঁর অভিষেকে পূর্ব পাকিস্তানের দালাল রাজাকাররা উপস্থিত থেকে নিজেকে ধন্য করেছিলেন–আবদুল মোনেম খান, সৈয়দ আজিজুল হক, ফজলুল কাদের চৌধুরী, গোলাম আজম, খান এ সবুর খান, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া), আবদুল জব্বার খান, পীর মোহসিন উদ্দীন দুদু মিয়া।
গভর্নর মালিকের অফিসেই নিজের অফিস বানিয়ে নিয়েছেন জেনারেল রাও ফরমান আলী খান। তিনি গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে কী হবে না-হবে তিনিই ঠিক করেন। কাকে হত্যা করতে হবে আর কাকে মন্ত্রী বানাতে হবে, এসব কাজ তিনি করে যাচ্ছেন। দক্ষতার সঙ্গে। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ এসব দলকে দিয়ে কীভাবে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের ঘায়েল করা যায়, সেসব বুদ্ধি বের করা ও প্রয়োগ করাও তার কাজ। এখন তিনি ব্যস্ত ২০ ডিসেম্বরের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে দালাল বাঙালি এমএনএদের পাঠানো নিয়ে। আওয়ামী লীগের ৭৯ জন এমএনএর সদস্যপদ বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন দলের লোকজনকে বসিয়ে এরই মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেককে জিতিয়ে আনা হয়েছে। ইয়াহিয়া ভুট্টোর পিপিপিকে দিতে বলেছিলেন ২৪টি এমএনএ পদ। রাও ফরমান আলী ১২টি দেওয়ার জন্য দর-কষাকষি করেন। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগের তিন অংশ, পিডিপি, নেজামী ইসলামী আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া আসন ভাগাভাগি করে নেবে। রাও ফরমান আলী বসে বসে ঠিক করছেন, কাকে কোন আসনে জেতানো হবে। ভুট্টো রেগে যান, ইয়াহিয়াকে ধমক দেন, তাঁকে ২৪টি আসনই দান করতে হবে, যাতে পাকিস্তানে তিনি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান। তিনি বলেন, তাঁকে মাত্র ১২টি আসন দান করা পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। কাতর ইয়াহিয়া বলেন, আচ্ছা আমি বলছি রাওকে। রাও ফরমান আলী পাকিস্তানে গেলে প্রেসিডেন্ট তাঁকে ভুট্টোর দাবির কথা বলেন। রাও বলেন, কেবলটা ৭৯টি আসন। এর বাইরে আরও ৮৮টা আসন তো আছে। পরে দেওয়া যাবে।
না, ভুট্টো এখনই চায়।
কী মুশকিল। এই লোককে তাহলে আওয়ামী লীগে ১৬৭ আসনের সব দিয়ে দিলেই তো হয়।
নির্বাচন হবে ১২ ডিসেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বর। রাও ফরমান আলী এসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। রাও ফরমান আলী। বুঝতে পারছেন, যৌথ বাহিনী যে গতিতে এগোচ্ছে, কয়েক দিনের মধ্যেই তারা ঢাকা দখল করে ফেলবে। কী করা যায়, উপায় খুঁজছেন। তিনি ভাবছেন পাকিস্তান চলে যাবেন। কিন্তু তার আগে একটা কাজ তাঁকে করতে হবে। জামায়াতে ইসলামীর গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামীদের নিয়ে তিনি একটা পরিকল্পনা করছেন। সারা দেশের বুদ্ধিজীবী যারা ইন্ডিয়ার দালাল, কমিউনিস্ট, হিন্দু, তাঁদের একটা তালিকা করছেন। এই কাজটা শেষ না করে তিনি পালাতে পারেন না।
পিন্ডিতে বিচারপতি কর্নেলিয়াসের নেতৃত্বে সংবিধান কমিশন কাজ করছে। তারা একটা নতুন সংবিধান বানাচ্ছে। ২০ ডিসেম্বরে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে এটা পাস করানো হবে। রাও ফরমান আলী তাঁর টেবিলে বসে একটা আধুলি বের করেন। ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান থাকবে। তো! হেড না টেল। হেড হলো পাকিস্তান। টেল হলো না-পাকিস্তান। টেল। উঠল। তিনি আবার টস করবেন। এটা মেনে নেওয়া যায় না।
গভর্নর ডেকে পাঠিয়েছেন।
গভর্নরের অফিস রুমে ঢুকলেন রাও। এর মধ্যে সেখানে এসে গেছেন জেনারেল নিয়াজি। চিফ সেক্রেটারি মোজাফফর হোসেন। ৯ ডিসেম্বর বিকেলটায় আবহাওয়া চমৎকার। বাইরে শীত পড়েছে। ঢাকার শীত এমন না যে ঠকঠক করে কাঁপতে হয়। গভর্নরের রুমে এসি চলছে। এসিতে একটা একটানা আওয়াজ হচ্ছে।
গভর্নর বললেন, রেডিওতে তো শুনছি আমাদের বাহিনী খুব ভালো করছে। তবে এই দেশের মানুষ তো আমাদের রেডিও বিশ্বাস করে না। তারা ইন্ডিয়ার কথা শোনে। বিবিসির কথা বিশ্বাস করে। আর মনে হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনে বেইমানি করার তেজ পায়। আমি গভর্নর। নিয়াজি সাহেব, আপনি বলেন আসলে পরিস্থিতি কী? আমরা কি কাশ্মীর পাঞ্জাব সব দখল করে ফেলছি!
জেনারেল নিয়াজিকে বলা হয় টাইগার নিয়াজি। তিনি বললেন, অবশ্যই। যুদ্ধের তো কেবল শুরু। আর কয়েক দিনের মধ্যে আমরা দেখিয়ে দেব কত গমে কত আটা।
তাহলে আমরাই যুদ্ধে জিততে যাচ্ছি? ফরমান সাহেব, তাহলে ইলেকশন হচ্ছে?
নিশ্চয়ই হচ্ছে। আজকেও আমি চিফ ইলেকশন কমিশনার বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সঙ্গে কথা বলেছি। যদিও নির্বাচন কমিশন অফিসে বোমা মারা হয়েছে, তাতে ইলেকশন তো পণ্ড হবে না। কারণ, আমাদের তো ভোটার দরকার নেই। রেজাল্ট আমার হাতে।
তাহলে আর কোনো চিন্তা নেই? সেক্রেটারি সাহেব কী বলেন?
সেক্রেটারি মোজাফফরের চোখে বালু পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। তিনি চোখ রগড়াতে লাগলেন।
সবাই চুপ করে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। কেউ না।
মোজাফফর তাকালেন নিয়াজির দিকে।
নীরবতা পাথরের চেয়েও ভারী। নীরবতা দোজখের মতো তপ্ত। ডিসেম্বরের ৭ তারিখের বিকেলের শীতে এসি চালিয়েও সবাই ঘামতে লাগলেন।
মুখ খুললেন মালিক। বললেন, দেখুন জেনারেল সাহেব, মানুষের জীবনে উত্থান-পতন থাকবে। সৈনিক হিসেবে আপনি জানেন, কখনো যুদ্ধে জয়লাভ করবেন, কখনো হারবেন। আজকে আপনার সামনে গভীর সংকট। আজকে আপনাকে আত্মসমর্পণ করতে হতে পারে…কিন্তু ভেঙে পড়বেন না। আল্লাহ মহান।
জেনারেল নিয়াজি কাঁদতে শুরু করলেন। কান্নায় তাঁর মুখ বিকৃত হয়ে উঠল। তিনি কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। মুখ চেপে ধরছেন। কিন্তু রোদনের ধাক্কায় মুখ খুলে যাচ্ছে। বিলাপ গোঙানি হয়ে উঠছে। চোখের পানিতে তার ব্যাজ ভিজে জবজবে।
সাদা উর্দি পরা পরিচারক মাথায় সাদা টুপি ট্রে হাতে প্রবেশ করল। চা স্যান্ডউইচ দেওয়া হবে। সঙ্গে আঙুর, কাজুবাদাম।
মোজাফফর ধমকে উঠলেন। তুমি কেন এই সময় এসেছ? তোমার কাছে কেউ চা চেয়েছে?
বেয়ারা বাইরে গেল। তাকে গভর্নরের পিএস জিজ্ঞেস করলেন, ভেতরে কী হচ্ছে?
বেয়ারা বলল, সাহেবরা কান্নাকাটি করতাছে।
মালিক বললেন, জেনারেল সাব, প্রেসিডেন্টকে জানান, যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করতে। আর দুদিন যুদ্ধ চললে আপনি-আমি কেউ বাঁচব না।
মোজাফফর বললেন, সবচেয়ে বড় কথা, ঢাকার বেসামরিক নারী-পুরুষ মারা পড়বে। পুরো ঢাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।
নিয়াজি বললেন, স্যার। আপনি প্রেসিডেন্টকে টেলিগ্রাম করুন। যুদ্ধবিরতি আয়োজন করতে। আমি আপনার অর্ডার মেনে নেব।
মালিক বিস্মিত। টাইগার নিয়াজি তাকে স্যার বলে ডাকছেন।
চোখের পানি মুছে নিয়াজি বাইরে এলেন। বাইরে কর্মচারীরা উঁকিঝুঁকি দিয়ে ইস্টার্ন কমান্ডের সেনাপ্রধানের কান্নামোছা চোখ দেখার চেষ্টা করতে লাগল।
তিনি গাড়িতে উঠে সোজা চলে গেলেন ক্যান্টনমেন্টে। সেনা সদর দপ্তরে। দরজা বন্ধ করে দিলেন। যে নিয়াজি তার আদিরসাত্মক কৌতুক বলার জন্য বিখ্যাত, তিনি আর কোনো কথা বলেন না। চুপ করে থাকেন। একা একা চুল ঘেঁড়েন। কান্নাকাটি করেন।
একটু পরপর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে খবর আসে। সব খারাপ খবর। যশোর। হাতছাড়া। কুমিল্লা আর ফেনীর মধ্যখানের জায়গাটা যৌথ বাহিনীর দখলে। বিমানবাহিনী বলতে কিছু নেই। সব কটি বিমানবন্দর গর্তে গর্তে চাঁদের পিঠ হয়ে গেছে। নৌবাহিনী বলতে কিছু নেই। জাতিসংঘ বলছে বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নেবে। ৮ ডিসেম্বর ইন্ডিয়া যেন বিমান আক্রমণ বন্ধ রাখে। সরিয়ে যে নেবে, এয়ারপোর্ট তো সারাতে হবে। অসম্ভব আবদার।
তিনি ঘুমান না। মদ ছাড়া আর কিছু খান না। একটু পরপর বাথরুমে যান। বাথরুমে গিয়ে বসে বসে কাঁদেন।
৯৬
ইয়াহিয়া খানের প্রেসিডেন্ট ভবনকে পুলিশের লোকেরা নাম দিয়েছিল কাঞ্জারখানা। এর মানে হলো পতিতালয়। সামরিক সদর দপ্তরকে তারা অভিধা দিয়েছিল দঙ্গরখানা–পশুর আখড়া। আর নিজেদের পুলিশ লাইনকে। তারা ডাকত লঙ্গরখানা বলে। যুদ্ধের পর ভুট্টো সরকার গঠিত হামুদুর রহমান তদন্ত কমিশনও ইয়াহিয়ার প্রেসিডেন্ট ভবনে যাতায়াতকারী নারীদের এক বড় তালিকার কথা রিপোর্টে লিখেছিল।
যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ইয়াহিয়া খানকে সন্ধ্যা ছয়টার পর পাওয়া যায় না। বেলা ১১টার আগে তিনি ঘুম থেকে ওঠেন না। সাধারণত তিনি তার রাত্রিপোশাক পরিহিত অবস্থায় নিজের শয়নকক্ষে থাকেন। মদ্যপান করেন। রাতের পর পার্টিতে থাকেন।
গভর্নর মালিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। জরুরি তারবার্তা এসেছে। কিন্তু এটা কে প্রেসিডেন্টের কাছে নিয়ে যাবে?
ইয়াহিয়া খান পার্টিতে। নর্তকীরা নাচছে। তাদের উদর ওঠানামা করছে। বেলি ডান্সে তারা রীতিমতো দক্ষ হয়ে উঠেছে। তারপরও একজন রানার তারবার্তার প্রিন্ট নিয়ে প্রেসিডেন্টের পার্টি হলরুমে যায়।
তিনি বার্তাবাহককে দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
কী হয়েছে?
ভীষণ জরুরি টেলিগ্রাম স্যার।
দুনিয়া কি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে? তুমি কেন আমার পার্টিটা মাটি করতে এসেছ?
স্যার আপনাকে ঢাকায় ফোন করার কথা বলে দিয়েছে…।
কে বলে দিয়েছে? আমি প্রেসিডেন্ট। আমাকে হুকুম করে কে?
পীরজাদা সাহেব।
পীরজাদা। কোথায় পীরজাদা। ইয়াহিয়া টলমল পায়ে এগোতে থাকেন। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে তাঁর কণ্ঠ জড়িয়ে আসছে। তিনি রিভলবার বের করে পীরজাদাকে খুঁজতে থাকেন।
রানার ভয়ে পালিয়ে যায়। ভেতরে চলতে থাকে চূড়ান্ত অশ্লীলতা।
ইয়াহিয়া একজন জেনারেলের স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে বললেন, আমাকে বলছে পূর্ব পাকিস্তানকে ইন্ডিয়া দখল করে নিচ্ছে। এটা কী করে সম্ভব? ব্ল্যাক বিউটি ভবিষ্যৎ দেখতে জানে। সে আমাকে বলেছে, তিন বছর পর আমি সাফল্যের চূড়ায় উঠব। তার আরও দুই বছর বাকি। ১৯৭৩ সালে আমি থাকব পৃথিবীর সেরা শাসক…
জোরে জোরে বাদ্য বাজছে। আলো জ্বলছে আর নিভছে। নর্তকীরা পোশাক ছুঁড়ে ফেলছে। প্রেসিডেন্ট নাচতে নাচতে বমি করতে শুরু করে দিলেন।
করাচির হারবার তখন জ্বলছে দাউ দাউ করে। চাকলালা বিমানবন্দরে তিন দফা বিমান হামলা হয়।
প্রেসিডেন্ট বললেন, আমি ঠিক আছি। ঠিক আছি কি না?
তার পাশে দুই অফিসার বললেন, অবশ্যই ঠিক আছেন স্যার।
আমি পৃথিবীর সেরা যোদ্ধা।
অবশ্যই স্যার। আপনি স্পেন বিজয়ী তারেকের মতো। আপনি সারা পৃথিবীকে চাঁদতারা পতাকার নিচে আনবেন।
৯৭
জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি ঘটিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং ইয়াহিয়া খানের পরাজয় ঠেকাতে আমেরিকা পাগলের মতো চেষ্টা করতে থাকে। চীন। ছিল তাদের পাশে। নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকার প্রস্তাবে রাশিয়া ভেটো দেয়। রাশিয়ার প্রস্তাবে চীন ভেটো দেয়। নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে সমাধান করা যাবে না, কাজেই সাধারণ পরিষদে আলোচনা নিয়ে যাওয়া হয়। সাধারণ পরিষদ ভারত-পাকিস্তানকে অবিলম্বের যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মানতে কোনো দেশ বাধ্য নয়।
ইন্দিরা গান্ধী এসবকে পাত্তা না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তিনি বরং চীনা হামলার বিপরীতে সোভিয়েত সামরিক সমর্থন পাওয়ার দিকে মনোযোগ দেন।
.
১০ ডিসেম্বরে নিউইয়র্কের রাস্তায় ছিল তুষার। সকালে আলো ফুটেছে, রাস্তার দুধারে আর বাগানে মাঠে জমা তুষারের ওপরে আলো পড়ে চকচক করছে। চারপাশ।
বিকেলের দিকে রোদ মরে এসেছে।
ওয়াশিংটন ডিসি থেকে উড়ে এসে নিউইয়র্ক নামলেন কিসিঞ্জার। কেউ যেন জানতে না পারে, তিনি নিউইয়র্কে, এই রকম চুপি চুপি চোরের মতো তিনি এসেছেন। কালো কাঁচে ঢাকা গাড়িতে তিনি উঠেছেন কানঢাকা, মাথাটকা ওভারকোট পরে। রোদ মরে এলেও তার চোখে কালো চশমা। যাতে কিছুতেই কেউ জানতে না পারে কিসিঞ্জার এসেছেন নিউইয়র্কে।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘে আছেন স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ। তাঁকে বলা হয়েছে, চুপি চুপি কাউকে না জানিয়ে চলে আসতে আপার ইস্ট সাইডে। এখানে একটা পুরোনো ঝরঝরে ভবনে সিআইএর একটা গোপন বাড়ি আছে। বুশ এসে পৌঁছালেন সবার আগে। তিনি একটা পুরোনো এলিভেটরে উঠলেন। তাঁর মনে হলো, এই এলিভেটরটা না আবার আটকে যায়।
এরপর এসে গাড়ি থেকে নামলেন কিসিঞ্জার, তাঁর দুই সহযোগী, হেইগ আর উনস্টন লর্ড। লর্ড চীন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। এরপর এলেন জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া। জাতিসংঘে ভারতের আগ্রাসন আর একে রাশিয়ার নগ্ন মদদদানের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে দিতে তাঁর চোয়ালে ব্যথা হয়ে গেছে।
কিসিঞ্জার ভবনের দেয়ালের দিকে তাকালেন। দেয়ালে চকচকে টাইলস, তাতে নিজেদের মুখ দেখা যাচ্ছে। ছবিগুলোও বেশ আজব। তবে ভবনের গেটে কোনো দারোয়ান নেই। বিল্ডিংয়ে লোকও থাকে কম। কেউ, তিনি আশা করেন, তাকে দেখে ফেলেনি এবং চিনে ফেলেনি। মাও স্যুট পরা একটা চীনা লোক আর কিসিঞ্জার এই বাড়িতে গোপন বৈঠক করছেন, নিউইয়র্কের মানুষেরা এটা জানলে সমূহ ক্ষতি। নিউইয়র্ক টাইমস-এ খবর প্রকাশিত হবে। ডেমোক্র্যাটরা জীবন খেয়ে ফেলবে।
কিসিঞ্জার হুয়াং হুয়াকে বললেন, আমরা পাকিস্তানের পক্ষে। কতটা পক্ষে জানতে চান?
হুয়াং হুয়া চুপ করে রইলেন। কিসিঞ্জার নিজেই বলুক।
কিসিঞ্জার বলে চললেন, আমরা পাকিস্তানে অস্ত্র দিতে পারি না। আইনে বাধা আছে। আমাদের অস্ত্র কোনো তৃতীয় দেশও পাকিস্তানে পাঠাতে পারে না। এটা একেবারেই আমাদের আইনে নিষিদ্ধ। তবু আমরা ইরান, জর্ডান, সৌদি আরবকে বলেছি পাকিস্তানকে অস্ত্র দিতে। জর্ডান থেকে বিমান উড়ে যাচ্ছে পাকিস্তানে।
বুশ প্রমাদ গুনলেন। কিসিঞ্জার সম্ভবত নিজের মনের চাপ নিজে সামলাতে পারছেন না। তা না হলে এসব গোপন কথা চীনকে বলার দরকার কী। এসব না বলেও তো তিনি কাজের কথা বলতে পারেন।
কিসিঞ্জার বললেন, আমরা আমাদের যুদ্ধজাহাজ ওই এলাকায় পাঠাচ্ছি। আমাদের নীতি আপনাদের নীতি এক। আমরা ভারতে সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছি। ভারতের উত্তরে আমাদের রাডার পাঠানোর কথা ছিল। চীনের সুবিধার জন্য আমরা তা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা ভারত সাগরে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের বহর পাঠাচ্ছি। কতগুলো বিধ্বংসী জাহাজ পাঠানোর অর্ডার হয়ে গেছে। সোভিয়েত জাহাজবহর আমাদের সঙ্গে একেবারেই তুলনীয় নয়। তারা কিছুই করতে পারবে না।
এইবার কিসিঞ্জার পাড়লেন আসল কথা। আমাদের প্রেসিডেন্ট চায়, চীন যদি মনে করে তাদের নিরাপত্তার জন্য বাইরে থেকে হুমকি আসছে, তাহলে তারা যে পদক্ষেপ নেবে, তার বিরুদ্ধে তৃতীয় কোনো দেশ কোনো রকমের অ্যাকশন নিলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাবে।
হুয়াং হুয়া বলে, আমাদের ওপরে আঘাত আসতে পারে উত্তর থেকে, দক্ষিণ থেকে, পশ্চিম থেকে। দরকার হলে আমরা আবার গেরিলাযুদ্ধে যাব…। তিনি গেরিলাযুদ্ধের উপকারিতা নিয়ে লেকচার দিতে শুরু করলে কিসিঞ্জার বলেন, আমরা চাই চীন ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক অ্যাকশন নিক।
হুয়াং হুয়া বুশের উদ্দেশে বললেন, আপনি কি জাতিসংঘে বাংলাদেশের কারও সঙ্গে কথা বলেছেন? বাংলাদেশ শব্দটাকে অবশ্য আমি ভীষণ অপছন্দ করি।
বুশ হাত কচলালেন। হ্যাঁ। আবু সাঈদ চৌধুরী নামের একজন এসেছিলেন। আমি বুঝতে পারিনি। দেখা করার পর বুঝলাম যে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধি। আমি আর বেশি কথা বলিনি।
হুয়াং হুয়া যেন সন্তুষ্ট হলেন, আমি বুঝতে পারছি। কিসিঞ্জার বললেন, আমরা বাংলাদেশের কারও সঙ্গে কথা বলি না। বলব। এই দেশকে আমরা স্বীকৃতি দিইনি। স্বীকৃতি দেবও না।
হুয়াং হুয়া বললেন, আমি আপনাদের বার্তা চৌ এন লাইয়ের কাছে এখনই পৌঁছে দিচ্ছি।
কিসিঞ্জার বললেন, বুঝতে পারছেন তো কী চাই (আমরা চাই, চীন ভারতকে আক্রমণ করুক)?
.
ওয়াশিংটন ডিসির ওভাল অফিস। ঝড়ের বেগে ঢুকলেন আলেক্সান্ডার হেইগ। তিনি বললেন, চীনারা খুব জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে চায়।
কিসিঞ্জার মাথার চুল টানতে লাগলেন। এটা তো হওয়ার কথা না। তাদের এখন ভারতকে আক্রমণ করার কথা।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন এক গেলাস পানি খেয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, হেনরি, চীনারা সত্যি সত্যি সৈন্য পাঠাচ্ছে তো?
এই নিয়ে কোনো প্রশ্নই থাকতে পারে না। তাদের সৈন্য পাঠাতেই
হবে।
নিক্সন হিসাব কষছেন। চীনারা ভারতে আক্রমণ করলে অবশ্যই সোভিয়েত ইউনিয়ন চীন আক্রমণ করবে। তিনি বললেন, চীনারা সৈন্য পাঠাচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি পাল্টা আক্রমণ করে, আমরা কী করব? তারপর নিজেই আবার বললেন, আমরা অ্যাটম বোমা প্রস্তুত রাখব, তাই তো তুমি বোঝাতে চাইছ?
নিক্সন বলে চললেন, যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে আসে, আর আমরা চুপ করে থাকি। আমরা চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে যাব। যদি তারা এগিয়ে আসে, তাহলে আমাদের অ্যাটম বোমা ব্যবহার করতে হবে। তা না হলে আমরা শেষ হয়ে যাব।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, পৃথিবী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি। চীন আক্রমণ করবে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করবে চীন, আর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আমেরিকা পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করবে। এই হইল কথা।
.
এর সমস্তটা কিছু ঘটেছে শুধু একটা কারণে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের পছন্দমতো দলকে ভোট দিয়েছিল, তাদের পছন্দমতো একজনকে নেতা নির্বাচিত করেছিল–শেখ মুজিবুর রহমান। শুধু তাঁর সঙ্গে ইয়াহিয়া খান কথা বলবেন না বলে আজ পৃথিবী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি।
১২ ডিসেম্বর আমেরিকার নৌবাহিনীর প্রধান পদ থেকে প্রমোশন পাওয়া জয়েন্ট চিফ অব স্টাফদের চেয়ারম্যান টমাস মুরার কিসিঞ্জারকে বললেন, প্রেসিডেন্ট তাকে আদেশ করেছেন আর সে অনুসারে রণতরি রওনা হয়ে গেছে। ভিয়েতনাম থেকে ৭ম নৌবহর মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মধ্যবর্তী মালাক্কা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিতে পারবে। এরপর তারা ভারত সাগরে পড়বে। যেখানে যেতে বলেন সেখানেই যেতে পারবে। এটা হলো একটা ক্যারিয়ার। চারটা ডেস্ট্রয়ার আছে। একটা ওয়েলার। পানিতে চলার ফোর্স–তিনটা ডেস্ট্রয়ারসহ।
কিসিঞ্জার গেলেন ওভাল অফিসে। প্রেসিডেন্টকে জানালেন, সপ্তম নৌবহর রওনা হয়ে গেছে। আমরা চীনকে বলব এটা যাচ্ছে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। সংবাদমাধ্যম আর আমেরিকার জনগণকে কী বলব?
আমরা বলব আমরা যাচ্ছি আমেরিকানদের উদ্ধার করে আনার জন্য।
তাহলে বিধ্বংসী অস্ত্রসমেত কেন? হেলিকপ্টারসমেত জাহাজ পাঠালেই হয়। লোকে কি বিশ্বাস করবে?
সেটা পরে দেখা যাবে–নিক্সন বললেন।
কিসিঞ্জার বললেন, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরেকটা ফর্মুলা বের করেছে। ইন্ডিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে হামলা করবে না। যুদ্ধবিরতি হবে। বিনিময়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেব।
না না। এটা হয় না। চীনকে আমরা তখন কী বলব? নিক্সন বললেন, আসলে বাংলাদেশ একটা বাস্তবতা। এটা ঠেকানোর কোনো উপায় আর আমাদের হাতে নেই। ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকছে, পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা তাদের ভালোবাসা দেখাচ্ছে, ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে। আমরা তাহলে কেন এত কষ্ট করছি?
কিসিঞ্জার বললেন, আমরা এত কষ্ট করছি, ১. পশ্চিম পাকিস্তান মিলিটারিকে একেবারে ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে। ২. আমাদের চীনা বন্ধুদের বন্ধু হিসেবে ধরে রাখতে। ৩. পৃথিবীর ভারসাম্য ভেঙে যাওয়াটাকে ঠেকাতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আর তার সাহায্যপ্রাপ্ত একটা দেশ আরেকটা দেশ ভেঙে ফেলবে, আর আমরা কিছুই করব না?
আমরা কী করব?
আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নকে বলব, যুদ্ধবিরতি করতে। কঠোরভাবে বলব।
৯৮
গভর্নর মালিকের হয়ে রাও ফরমান আলী ঢাকার জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মার্কের কাছে তারবার্তা পাঠালেন।
সেটা পল মার্ক পাঠিয়ে দেন জাতিসংঘ সদর দপ্তরে। জাতিসংঘের মহাসচিব সেটা পাঠালেন নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যের কাছে :
আমি গভর্নর মালিক বলছি। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা রাজনৈতিক। এর সমাধানও হতে হবে রাজনৈতিক। আমি মালিক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের অনুমোদন সাপেক্ষে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছা অনুসারে সব ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হোক। জাতিসংঘকে অনুরোধ করছি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে সহায়তা করতে।
করণীয় :
১. অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি।
২. পাকিস্তানি সৈন্যদের সসম্মানে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত।
৩. পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে আগ্রহী কর্মচারীদের যাওয়ার ব্যবস্থা।
৪. ১৯৪৭ সালের পর পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী সব নাগরিকের নিরাপত্তার ব্যবস্থা।
৫. পূর্ব পাকিস্তানে কারও বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার নিশ্চয়তা।
এই খবর পাকিস্তান মিশন জানতে পারে। ভুট্টো নিউইয়র্কে। তিনি এখন পাকিস্তানের সহকারী প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে ইয়াহিয়া নিয়োগ দিয়েছেন নুরুল আমিনকে। ভুট্টো নিউইয়র্কে এসে হোটেলে ঘুমিয়ে নিলেন খানিকক্ষণ। চোখ মেলে যখন জানলেন, মালিক এই বার্তা পাঠিয়েছে জাতিসংঘের কাছে, তিনি চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করলেন।
ভুট্টো যোগাযোগ করলেন ইয়াহিয়ার সঙ্গে। নতুন প্রস্তাব দাঁড় করালেন। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি। পাকিস্তানি সৈন্যদের ফিরিয়ে আনা। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমঝোতা বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথাটা এখানে রইল না।
.
ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত। তিনি বললেন, আমার কাছে খবর আছে, চীনা সেনাবাহিনী নড়াচড়া করতে শুরু করেছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী বললেন, তা হলে তো চিন্তারই কথা। আমাদের উত্তর সীমানায় দুই ডিভিশন সৈন্য বাড়াতে হবে।
ইন্দিরা গান্ধী হাসলেন। বললেন, জগ বাবু, বিস্কুটটা খেয়ে দেখুন। বেশ পনিরযুক্ত। আমি সব সময় এই ধরনের নোনা বিস্কুট পছন্দ করি। চা কোনটা দিয়েছ?
তুলসী ফ্লেভার ম্যাম। পরিচারক বললেন।
গুড। আমি তুলসী চা-ই পছন্দ করি। তুমি এখন এই ঘর থেকে যাও।
ইন্দিরা হেসে বললেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। চীনা হস্তক্ষেপ হওয়ামাত্রই তারা সিয়াংকি এলাকায় ঢুকে পড়বে।
আরেক মন্ত্রী বললেন, সপ্তম নৌবহর আসছে। আমরা পিন্ডি থেকে ঢাকায় পাঠানো একটা বার্তা ইন্টারসেপ্ট করেছি। নিয়াজিকে বলা হয়েছে, উত্তর থেকে হলুদ আর দক্ষিণ থেকে সাদারা আসছে।
ইন্দিরা বললেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন সপ্তম নৌবহরের গতিবিধির ওপরে নজর রাখছে। তারা কসমস নামের নতুন উপগ্রহ থেকে এটাকে ফলো করছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারাও পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত সাবমেরিন রেডি রেখেছে। সপ্তম নৌবহরের পথ আগলে দেবে।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, সোভিয়েত ইউনিয়নের ১০ নম্বর যুদ্ধ গ্রুপের কমান্ডার ভ্লাদিমির ক্রুগলিয়াকফকে নির্দেশ দেয় নৌযুদ্ধ ইউনিট নিয়ে কাজে নাইমা পড়তে। হুকুম আসে, আমেরিকান নৌবহর য্যান ভারতীয় সামরিক বাহিনীর আশপাশে আসতে না পারে। ক্রুগলিয়াকফ পরে কইবেন, আমগো ক্রুজার আর জাহাজবিধ্বংসী মিসাইলসজ্জিত আণবিক সাবমেরিন মার্কিন নৌবহরের পথে আটকায়া দাঁড়ায়। আমরা মার্কিনদের ঘিরা ফালাই এবং আমগো মিসাইল তাক করি। আমগো লক্ষ্য যেন মিস না হয়, সে জন্য যতটা পারা যায় আমরা তাগো রণতরিবহরের কাছাকাছি চইলা যাই।
ব্যাঙ্গমি বলে, তার মানে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকা পারমাণবিক অস্ত্র নিয়া মুখোমুখি হইয়া গেল।
.
ইন্দিরা গান্ধীকে এক মন্ত্রী বললেন, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আসছে একটার পর একটা। সোভিয়েত ইউনিয়নও একই প্রস্তাব দিচ্ছে। আমাদের অবস্থান কী?
ইন্দিরা বললেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা নেবে। তারপর আমরা যুদ্ধবিরতিতে যাব।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন বললেন, কাশ্মীরের খানিকটা দখল নিলে কী হয়?
ইন্দিরা বললেন, না, আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নকে আশ্বস্ত করেছি, অন্য সব দেশকেও আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমরা আগ্রাসনবাদী নই। আমরা শুধু একটা জাতির ন্যায়সংগত সংগ্রামে তাদের পাশে আছি।
.
ভারতের মন্ত্রিপরিষদের এই বক্তব্য কিছুক্ষণের মধ্যেই সিআইএ পাঠিয়ে দিল আমেরিকায়। মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে উপস্থিত থাকেন, এমন ভারতীয়দের মধ্যেই সিআইএর লোক আছে।
৯৯
রিমি আর রিপির দুজন বন্ধু আছে। তাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। মিঠু আর সোমা।
তাদের বাবা প্রশান্তকুমার পাল। তিনি রিমি-রিপিদের সঙ্গে গল্প করেন। রিপি ছোটদের মহাভারত পড়ে শেষ করেছে। প্রশান্ত কাকু বলেন, বলো তো, ঘটোৎকচের মায়ের নাম কী?
রিমি বলে, হিড়িম্বা।
মিঠু আর সোমার মা রাধা পাল। তাদের বাড়ি বিক্রমপুর। তিনি বিক্রমপুরের ভাষাতেই কথা বলেন। শুনছ, যশোর তো মুক্ত অইয়া গেল, আমগো মিষ্টি খাওয়াইবা না?
এই ফ্ল্যাটে এসেছেন হাসান ভাই। যশোরে বাড়ি। রিমির আব্দুকে মামা ডাকেন। রিপিদের জন্মের আগে থেকে রিমির আব্দু-আম্মুর পরিচিত। আত্মার সম্পর্ক যে অন্য যেকোনো সম্পর্কের উর্ধ্বে তা রিমিরা তাঁর হাসান ভাইকে দিয়ে জেনেছে। তিনি বাংলাদেশ থেকে এনেছেন টাটকা খবর। মিলিটারির দোজখখানা থেকে মুক্তি পেয়েছেন আজিজ বাগমার চাচু, আর যারা যারা ধরে পড়েছিলেন ২৫ মার্চ রাতে, তাদের সবাই। তবে অত্যাচার নিপীড়নে সবারই মাংস থেঁতলে পচে গেছে। জানা গেল, মুজিব কাকুর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল যে হাজি মোরশেদ চাচুকে, তাকেও মিলিটারিরা একই বন্দিশালায় রেখেছিল এবং তাকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ২৫ নভেম্বর। তিনি ছাড়া পেয়েছেন।
প্রশান্ত কাকু বললেন, যশোর মুক্ত হয়েছে, আমি যশোর যাব। হাসান আমাদের নিয়ে চলুন।
মিঠু সোমা বলল, আমরাও যশোর দেখতে যাব।
আম্মু আমিও যাব, রিপি বলল।
আম্মু আমিও যাব, রিমি বলল।
১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভোরবেলা। তখনো অন্ধকার।
আম্মু ডাকছেন, রিমি-রিপি ওঠো। যশোর যাবে না?
রিমি ঘুম থেকে একলাফে উঠে গেল। রিপি উঠতে পারল না।
অন্ধকার থাকতে থাকতেই প্রশান্ত কাকু গাড়ি স্টার্ট দিলেন। পাশে বসলেন হাসান ভাই। পেছনে মিঠু, সোমা, রিমি।
যশোর রোডে দ্রুত যাওয়া কঠিন। দুই ধারে শরণার্থীদের বস্তি। ছইয়ের নিচে, চালার নিচে, পলিথিনের নিচে মানুষ জড়াজড়ি, গাদাগাদি করে পোকামাকড়ের মতো বেঁচে আছে। বেঁচে আছে, কিংবা মারা যাচ্ছে। রিমি চোখ পিটপিট করে মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখছে।
তারা এগিয়ে গেল। একসময় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি, পোড়া বাড়িঘর দেখে তারা বুঝতে পারল এ হলো যুদ্ধের ধ্বংসচিহ্ন।
কোথাও দেখা গেল পাকিস্তানিদের বাংকার। প্রশান্ত কাকু গাড়ি থামালেন। হাসান ভাই এগিয়ে গেলেন ব্যাপার কী দেখতে। এসে বললেন, তোমরা নেমো না। বাংকারের ভেতরে মানুষের লাশ।
একসময় তারা ঢুকে পড়ল যশোর শহরে। রাস্তায় মানুষ আর মানুষ। সবাই স্লোগান দিচ্ছে জয় বাংলা। দোকানে দোকানে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
হাসান ভাইয়ের বোনের বাড়িতে দুপুরে খেল তারা। তারপর আবার বেরিয়ে পড়ল।
হাসান ভাই বলল, রিমি দেখ দেখ মামা যাচ্ছেন।
রিমি দেখল, মানুষের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন আব্দু। পাশে নজরুল কাকু।
যশোর ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে ট্রাকে করে আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি মিলিটারিদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এক মহিলা চিৎকার করে কাঁদছেন, আমার ছেলেকে ওরা মেরেছে। ওদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আমাকে দাও। আমি শাস্তি দেব।
.
ব্যাঙ্গমা বলবে, ওই দিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যশোরে আসে। যশোরে তারা জনসভা করে। সভায় তারা ভাষণ দেয়। সভাপতিত্ব করেন যশোর আওয়ামী লীগের নেতা সোহরাব হোসেন। হাজার হাজার মানুষ যোগ দেয়। জয় বাংলা স্লোগানে আকাশ বাতাস কাইপা ওঠে। ভাষণ দিতে গিয়া সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন আবেগে চোখের পানি ধইরা রাখতে পারতেছিলেন না।
ব্যাঙ্গমি বলবে, সিডনি শনবার্গ নিউইয়র্ক টাইমস-এ লেখেন, জনতা আছিল সংযত। তারা আসলে শেখ মুজিবের ভাষণের সময়কার জনতার অনুজ্জ্বল সংস্করণ। কারণ, তারা সবাই জানে, তাগো নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী।
.
সাংবাদিক, কবি, লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী কয়েকজন সাংবাদিকসহ মেজর জলিলের সঙ্গে গেলেন যশোরে।
আবদুল গাফফার চৌধুরী জয় বাংলা পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করছিলেন।
মেজর জলিল বললেন, পাকিস্তানিদের বাংকার দেখবেন?
গাড়ি থামল। একটা বাংকারের কাছে গেলেন সাংবাদিকেরা।
তখন ওই বাংকার থেকে একে একে নগ্ন বাঙালি নারীরা চোখেমুখে বনপোড়া হরিণীর আতঙ্ক নিয়ে বের হচ্ছিলেন। তাঁদের মুখে, বুকে, হাতে, পায়ে আঘাতের চিহ্ন। তাঁদের চোখ শুকনো, কাঁদতে কাঁদতে তারা চোখের পানি এরই মধ্যে শেষ করে ফেলেছেন। তাদের মুখে ভাষা নেই, তারা কথা বলতেও যেন ভুলে গেছেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী তার ৩৭ বছরের জীবনে এর চেয়ে শকিং দৃশ্য আর দেখেননি।
শিখ সৈন্যরা তাদের মাথার পাগড়ির কাপড় খুলে মেয়েদের দিচ্ছিল। মেয়েরা সেই কাপড় শরীরে পেঁচিয়ে নিয়ে এগোচ্ছিলেন।
গাফফার চৌধুরী এগিয়ে গেলেন একজন নারীর কাছে। বললেন, নাম
কী?
তিনি খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বললেন, ওরা তো আমাকে কোনো নাম দেয়। নাই। শুধু রোজ কলেমা পড়াত আর অত্যাচার করত।
আরেকজন নারী বললেন, আমার নাম সাহানা বেগম।
আপনি কী করতেন?
আমি টিচার। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। ভাই, আমি দেড় মাসের প্রেগন্যান্ট। আমাকে একটা হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করতে পারেন। বুঝতেই পারছেন, আই নিড টু ডু অ্যাবরশন।
মেজর জলিলের চোখে পানি। মেজর উদম সিং হাউমাউ করে কাঁদছেন।
চোখের জল মুছতে মুছতে গাফফার চৌধুরী বললেন, মেজর সাহেব, এদের কোথায় নিয়ে যাবেন?
আপাতত আমাদের ফিল্ড হাসপাতালে নিই। তারপর সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এরা তো একজন-দুইজন নয়। হাজার হাজার।