৯০. পিএস আশেক মাহমুদ

অধ্যায় ৯০

নুরে ছফা এবং সুস্মিতা দু-জনেই বুঝতে পারছে কিছু একটা ঘটে গেছে।

একটু আগে ফোনকল পাবার পর পুরোপুরি ভড়কে গেছে পিএস আশেক মাহমুদ। তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে। হতভম্ব হয়ে আসলাম দাঁড়িয়ে থাকে ঘরে। এখনও সে বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করছে পিএসের কাছ থেকে কিছু শোনার জন্য।

এরইমধ্যে ছফার সাথে সুস্মিতার চোখাচোখি হয়েছে বার কয়েক। তারও একটাই প্রশ্ন কী হয়েছে?

কাঁধ দুলে ছফা জানিয়ে দিয়েছে, সে-ও কিছু বুঝতে পারছে না। তবে খারাপ কিছুর আশঙ্কাই করছে। ক্ষমতাধর পিএস এতো সহজে ভড়কে যাবার কথা নয়। ছফা যখন তার দিকে পিস্তল তাক করেছিলো তখনও লোকটা ভড়কে যায়নি, বরং রেগে গিয়েছিলো। এখন ঘরের বাইরে সিঁড়ির ল্যাডিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে নীচুস্বরে ফোনে কী কথা বলছে পিএস, সেসব শুনতে পাচ্ছে না এ ঘরের বাকি মানুষজন।

একটু পর ফোনটা হাতে নিয়ে আশেক মাহমুদ ঘরে প্রবেশ করলো। তার চোখেমুখে বিপর্যস্ততার ছাপ সুস্পষ্ট।

“কী হয়েছে, বস?” আসলাম জানতে চাইলো উদ্বিগ্ন হয়ে।

পিএস তার দিকে তাকালেও কিছু বললো না। এরপর ঘৃণাভরে তাকালো সুস্মিতার দিকে। “ওর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দাও…মুখের স্কচটেপটাও।”

আসলাম অবাক হয়ে চেয়ে রইলো ক্ষমতাধর বসের দিকে।

“জলদি করো…আমাদের হাতে সময় নেই।”

বাধ্য হয়েই সুস্মিতার মুখের স্কচটেপসহ হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিলো আসলাম। মেয়েটা মুক্ত হয়েও নিজের চেয়ারে বসে রইলো চুপচাপ। সব কিছু বুঝে উঠতে তারও কিছুটা সময় লাগছে।

পিএস নিজের ফোনটা সুস্মিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো, “ওকে বলো, তোমাকে আমরা ছেড়ে দিচ্ছি। আমার বোনের যেনো কিছু না করে!”

পিএস কার কথা বলছে? নুরে ছফা যারপরনাই অবাক। মুশকানের? সুস্মিতাকে ছেড়ে দিতে বলছে যেহেতু…মাই গড! মুশকান জুবেরি পিএসের বোনকে জিম্মি করেছে! মনে মনে বলে উঠলো সে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। সুস্মিতার দিকে তাকালো।

মেয়েটার চোখেমুখেও অবিশ্বাস। চুপচাপ পিএসের ফোনটা কানে ঠেকিয়ে নীচুস্বরে কথা বলতে শুরু করলো সে।

আসলাম আর ছফাকে ইশারায় বাইরে আসতে বলে নিজেও ঘর থেকে বের হয়ে গেলো পিএস।

“কি হয়েছে?” ঘরের বাইরে এসে জানতে চাইলো ছফা। ইচ্ছে করেই স্যার সম্বোধন করলো না। “ফোনটা কি মুশকান করেছে?”

আসলাম অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো। তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে।

গভীর করে শ্বাস নিয়ে বিমর্ষ মুখে তাকালো আশেক মাহমুদ। “ঐ ডাইনি আমার বোনকে জিম্মি করেছে।”

“ঐ মহিলা কিভাবে আপনার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকলো?!” ছফার কাছে সত্যি বিস্ময়কর ঠেকছে এটা। সুরক্ষিত অ্যাপার্টমেন্টে থাকে আশেক মাহমুদ। নীচের মেইনগেটের দারোয়ানের কাছে গেস্টকে পরিচয় দিতে হয়, তারপর দারোয়ান ইন্টারকমে জানায় অ্যালোটিকে-ওখান থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেলেই কেবল ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়। ছফা যতোটুকু জানে, পিএসের অ্যাপার্টমেন্টে কমপক্ষে দু-তিনজন কাজের লোক আছে। একজন কুক আর অন্য দু-জন বাজার করা, ঘরদোর মোছার কাজ করে।

ঠোঁট ওল্টালো পিএস। “আমার কোনো ধারণাই নেই।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললো, “তবে যেভাবেই হোক সে ঢুকে পড়েছে!”

“আপনি নিশ্চিত হলেন কী করে?”

“হাউজনার্সের ফোন থেকে কল দিয়েছে, প্রমাণ হিসেবে আমার ফোনে একটা এমএমএসও পাঠিয়েছে…আমার বোনের একটা ছবি!”

মুশকান যে ছবিটা পাঠিয়েছে সেটা খুবই ভয়ঙ্কর, গা শিউরে ওঠার মতো : তার বোন আই-মাস্ক লাগিয়ে শুয়ে আছে, আর মেয়েলী একটা হাত ঠিক তার গলার কাছে ধরে রেখেছে কিচেন নাইফ!

পিএস আসলামের দিকে তাকালো। “ঐ মেয়েটা যেখানে নেমে যেতে চাইবে সেখানেই নামিয়ে দিও। উল্টাপাল্টা কিছু কোরো না, ঠিক আছে?”

অবাক হয়ে চেয়ে রইলো গানম্যান।

“স্যার, একটা কথা বলি?” ছফা কিছু বলতে চাইলো।

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো আশেক মাহমুদ।

“আসলামের বদলে আমি যাই? আমি ওই মেয়েটাকে–”

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো পিএস। “না। আসলামই যাক। মুশকান আপনাকে চেনে। তাছাড়া…”

“তাছাড়া কি?”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশেক মাহমুদ। “কিছু না। আসলামই যাবে।” চূড়ান্ত রায় দেবার মতো করে বললো সে।

পিএসের মনোভাব বুঝতে পারলো ছফা। এ কাজে তাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ভাবছে, সে হয়তো কথামতো কাজ করবে না, মুশকানের পিছু নেবে। সত্যি বলতে, ছফার উদ্দেশ্য সেরকমই।

“তাড়াতাড়ি যাও। সময় মাত্র দশ মিনিট,” ম্রিয়মান কণ্ঠে আসলামকে তাড়া দিলো আশেক মাহমুদ, তবে সেই ভঙ্গুর কণ্ঠে চেপে থাকা ক্রোধটা ঠিকই প্রকাশ পেলো।

গানম্যানের চেহারায় তিক্ত অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো, একান্ত অনিচ্ছায় ঘরের ভেতরে চলে গেলো সে।

মুশকান জুবেরি দশ মিনিট সময় বেধে দিয়েছে! নুরে ছফা যারপরনাই অবাক। বুঝতে পারলো, ফোন কলটা এখনও কেটে দেয়া হয়নি! সেই একই চালাকি, একই কৌশল-কলটা ড্রপ করা যাবে না। ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রাখার চমৎকার কৌশল!

এমন সময় সুস্মিতা তার পার্স আর পিএসের ফোনটা কানে চেপেই ঘর থেকে বের হয়ে এলো আসলামের সাথে। মেয়েটা চলে যাবার সময় একবার ছফার দিকে চকিতে তাকালো, তারপর দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো নীচে।

ওরা চলে যেতেই পিএসকে বললো ছফা, “কিছুই বুঝতে পারছি না, এটা কিভাবে সম্ভব হলো!”

কাঁধ তুললো আশেক মাহমুদ। “আমার মাথায়ও কিছু ঢুকছে না। ঐ ডাইনি আমার ফ্ল্যাটে কী করে ঢুকলো!”

“আপনি পুলিশকে ফোন করে জানিয়ে-”

হাত তুলে ছফাকে থামিয়ে দিলো পিএস। “সেই সময় নেই আমার হাতে। এই ঝুঁকিটা আমি নিতে পারবো না।” আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো সে, “মাত্র দশ মিনিট সময় দিয়েছে ঐ ডাইনিটা…কল কেটে দিলেই…”

পিএস কথাটা শেষ না করলেও ছফার বুঝে নিতে অসুবিধা হলো না। পরিহাসের হাসি দিতে গিয়েও দিলো না সে। একটু আগে যখন তার প্রিয়জন কেএস খান আর আইনস্টাইনের মতো মাসুম এক বাচ্চাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলো, তখন তাদের জীবনের কোনো পরোয়া করেনি এই লোক, কিন্তু নিজের মৃত্যুপথযাত্রি বোনের জন্য এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করেনি, সঙ্গে সঙ্গে মুশকানের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছে।

ছফা টের পেলো পিএস তার কাঁধে হাত রেখেছে।

“আমি…সরি,” আস্তে করে বললো আশেক মাহমুদ, প্যান্টের পকেট থেকে ছফার পিস্তলটা বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিলো।

অস্ত্রটা নিজের কোমরে গুঁজে নিলো ছফা, সঙ্গে সঙ্গে ফিরে পেলো। আত্মবিশ্বাস। সেই সাথে খুলে গেলো জট পাকানো চিন্তাভাবনার গিটটাও। “আমার ফোনটা দিয়ে পুলিশকে ইনফর্ম করে বলি আপনার অ্যাপার্টমেন্টে–”

“না।” কথার মাঝখানে থামিয়ে দৃঢ়ভাবে নিষেধ করে দিলো পিএস। “এতো কম সময়ে কিছুই করা যাবে না। আমি আমার বোনকে…” তার গলা ধরে এলো। “আমি এটা করতে পারি না, মাথা দোলালো আশেক মাহমুদ। “বুবু আমার মায়ের মতো!”

হতোদ্যম হয়ে পড়লো ছফা। সঙ্গে সঙ্গে কিছু একটা মাথায় আসতেই বললো সে, “কিন্তু স্যার, মুশকান জুবেরি যে তার কথা রাখবে সেটার কি নিশ্চয়তা আছে?”

পিএস কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো ছফার দিকে। একটু আগে বলা তার নিজের যুক্তিটাই যেনো দিচ্ছে ডিবি অফিসার। কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঢুকে পড়লো ঘরের ভেতর। ছফাও তার সঙ্গে সঙ্গে ঢুকলো।

“আপনি আপনার অ্যাপার্টমেন্টে ফোন করে জেনে নিন সব ঠিক আছে কিনা।”

“আমার ফোনটা ওই মেয়ের কাছে।”

“তাহলে আমার ফোন থেকে কল করুন, নিজের ফোনটা বাড়িয়ে দিলো সে।

“ঐ হাউজনার্সের ফোন নাম্বারটা আমার মুখস্ত নেই, কিন্তু বাসার ল্যান্ডফোনের নাম্বারটা মনে আছে।”

“ওটাতে কল করুন, স্যার।” পিএস ফোনটা হাতে নিয়ে নাম্বার ডায়াল করে কানে চেপে ধরতেই তার চেহারায় আতঙ্ক ফুটে উঠলো। ভয়ার্ত অভিব্যক্তি নিয়ে তাকালো ছফার দিকে।

“ডিসকানেক্ট করে রেখেছে!”

ছফাকে তার ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে ফাঁকা ঘরটায় উদভ্রান্তের মতো পায়চারী করতে শুরু করে দিলো পিএস। এখন সেখানে একটি সোফা আর চেয়ার ছাড়া কিছু নেই। সুস্মিতা যে চেয়ারে বন্দী হয়ে ছিলো সেটার দিকে তাকালো তিক্তমুখে। ফাঁকা চেয়ারটা যেনো তাকে পরিহাস করছে!

তারপরই দৃশ্যটা দেখতে পেলো সে। চেয়ারের সামনে একটা দড়ি সাপের মতো পাক খেয়ে পড়ে আছে। এটা দিয়ে সুস্মিতার পা বেঁধে রাখা হয়েছিলো।

কিন্তু মেয়েটার হাত বেঁধে রাখা হয়েছিলো যে দড়িটা দিয়ে সেটা কোথায়?

ঘরের চারপাশে তাকালো।

“কি খুঁজছেন, স্যার?” কৌতূহলি হয়ে জানতে চাইলো ছফা।

“দড়িটা…নেই!”

“কীসের দড়ি?” বুঝতে পারলো না সে। দেখতে পেলো, একটা দড়ি পড়ে আছে চেয়ারের নীচে। “ঐ যে দড়িটা…?”

“কিন্তু আরেকটা কোথায়?” পিএস বললো। “মেয়েটার হাত-পা দুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিলো!” ছফা কিছু বলার আগেই আবার বললো সে, “আসলাম নেয়নি তো?” দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়লো তার কপালে।

“কিন্তু সে ওটা দিয়ে কী করবে?” ছফা বুঝতে না পেরে বললো।

আশেক মাহমুদের মনে একটা আশঙ্কা দ্রুত দানা বাঁধতে শুরু করেছে : আসলামের কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে? না! এই ছেলে কখনও তার অবাধ্য হয়নি। সে ভালো করেই জানে, ঐ মেয়েটাকে কথামতো নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে না দিলে তার অসুস্থ বোনকে মেরে ফেলবে ঐ ডাইনি মহিলা।

পিএস স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “আসলাম কি মেয়েটাকে নিয়ে অন্য কিছু…”

“স্যার, আসলাম কেন এটা করবে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

আশেক মাহমুদ মাথা দোলালো। “আপনি বুঝতে পারছেন না!”

এবার বুঝে গেলো নুরে ছফা। “কিন্তু আসলাম এটা কিভাবে করবে, ঐ মেয়েটা তো…” নিজে থেকেই থেমে গেলো। আজকে রাতে যেভাবে একের পর এক পাশার দান উল্টে যাচ্ছে, তাতে করে আসলাম যে সুস্মিতাকে কজায় রেখে মুশকানের সাথে কিছু করবে না সে নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। সমস্যাটা হলো গানম্যান আসলাম সম্ভবত দরজার বাইরে থেকে শুনতে পেয়েছে সুস্মিতার কাছ থেকে সিক্রেট অঙ্গটার কথা জানতে চেয়েছিলো পিএস।

রাগেক্ষোভে তাকালো পিএস। “ভুলটা আমারই হয়েছে!”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। সে-ও জানে, যৌবন দীর্ঘস্থায়ী করা কিংবা চিরযৌবন লাভ করার আকাঙ্খর কাছে কোনো আনুগত্যই টেকার কথা নয়। কেএস খান এটা তিন বছর আগেই বুঝতে পেরেছিলো-তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলো, কখনও যদি মুশকানকে কজায় নিতে পারে, ভুলেও যেনো তার কাছ থেকে সিক্রেট অঙ্গটার কথা জানতে না চায়।

“স্যার, আপনার বাসায় চলুন। জলদি!” কিছু একটা মনে পড়তেই তাড়া দিয়ে বললো ছফা।

পিএস হতভম্ব হয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো তার দিকে। “ঐ ডাইনি এততক্ষণে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে, ছফা!”

“এটা আমিও জানি, স্যার।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো পিএস।

“কিন্তু সে কোথায় গেছে, কিভাবে গেছে সেটা বের করা যাবে। দেরি করলে সেই সুযোগটাও হারাববা।”

.

অধ্যায় ৯১

যে গাড়িতে করে সুস্মিতা আর শ্যামলকে অপহরণ করা হয়েছিলো, সেই একই গাড়িতে করে আসলাম এখন সুস্মিতাকে পৌঁছে দিচ্ছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে-বনানীর দশ নম্বর রোডে। এইমাত্র মুশকান তাকে ফোন করে এটা বলে দিয়েছে।

গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে সুস্মিতা। রিয়ার মিরর দিয়ে বার বার তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আসলাম। রাগেক্ষোভে তার চেহারাটা বিকৃত হয়ে আছে। যেনো এক্ষুণি ছিঁড়ে খুবলে খাবে।

কিন্তু সুস্মিতা জানে, তার এই রাগ-ক্ষোভ নিছক আস্ফালন। লোকটা পোষা কুকুর, প্রভুর হুকুম ছাড়া কিছুই করতে পারবে না। আর এখন তার প্রভু নিজেই বেড়াল হয়ে গেছে!

মুশকানের সাথে এখনও কানেক্টেড থাকা ফোনটা সিটের পাশে রেখে নিজের হাতদুটোর দিকে তাকালো সুস্মিতা। দীর্ঘ সময় ধরে শক্ত নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখার কারণে তার নরম চামড়া কিছুটা কেটে গেছে। খুব ব্যথা করছে সেখানটায়। রক্ত চলাচলও বন্ধ ছিলো অনেকক্ষণ। তাই এ হাত দিয়ে ও-হাতে মেসেজ করতে শুরু করলো সে।

রিয়ার মিরর দিয়ে আসলাম দৃশ্যটা পুরোপুরি দেখতে পেলো না, কারণ সুস্মিতা তার কোলের উপর হাতদুটো রেখে মেসেজ করে যাচ্ছে। চোখেমুখে সন্দেহ ফুটে উঠলো পিএসের গানম্যানের। “কী করছিস?” ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো।

রিয়ার মিররে তাকালো সুস্মিতা, আসলামের চোখে চোখ রেখে হাতদুটো মুখের সামনে তুলে ধরলো। “দেখ গা…কী করেছিস আমার হাতদুটোর!” রেগেমেগে অভিযোগের সুরে বললো সে।

অনেক কষ্টে রাগ দমন করলো পিএসের গানম্যান। রিয়ার মিরর থেকে চোখ সরিয়ে গাড়ি চালানোর দিকে মনোযোগ দিলো সে। তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। জীবন নিয়ে ফিরতে পারবি কিনা সেটা আগে ভেবে দেখু! হাত নিয়ে যতো চিন্তা! মনে মনে বললো সে। ডানপাশের খোলা উইন্ডো দিয়ে থুতু ফেললো ঘৃণাভরে।

পিএস যখন তাকে বললো মেয়েটাকে নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে দিতে, আসলাম সেটা মেনে নিতে পারেনি। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় একটা চিন্তার উদ্রেক হয়-এই মেয়েটাকে জায়গামতো পৌঁছে দিলেও তো মুশকান জুবেরি নামের ঐ ডাইনিটা পিএসের বোনকে হত্যা করতে পারে, পারে না? কাজশেষে ওই মহিলা এটা করবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? একটু আগে পিএস নিজেই এমন আশঙ্কার কথা বলেছিলো ছফাকে যখন মুশকান তার সিনিয়রকে জিম্মি করেছিলো।

একজন অসুস্থ মহিলা, যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে, তার জীবন রক্ষার জন্যে নতি স্বীকার করে এই মেয়েকে ছেড়ে দেয়ার কোনো মানেই হয় না। মুশকান যদি পিএসের বোনকে হত্যাও করে, আসলাম তার একটা ব্যাখ্যা দিতে পারবে অনায়াসে-মেয়েটাকে সে ছেড়ে দিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু ঐ ডাইনি তার কথা রাখেনি!

আসলামের কোমরে গোঁজা আছে নাইন মিলিমিটারের একটি পিস্তল। পুরোপুরি লোডেড। এই মেয়েটার সাথে এখন মুশকান নামের ঐ ডাইনিটা কানেক্টেড আছে ফোনে। খেলাটা আবার উল্টে দেয়া যাবে। এই হালকা পলকা মেয়েটাকে নিজের কজায় নিয়ে নিতে পারলে মুশকানকে বাধ্য করতে পারবে ঐ সিক্রেটটা জেনে নিতে। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না সে জানে। কঠিন অত্যাচার করতে হবে একে। আর এটা করতে তার ভালোই লাগবে। ফোনে মুশকান সেই অত্যাচারের আওয়াজ শুনে ভড়কে যাবে। তারপরই আসলাম প্রস্তাব দেবে-মানুষের শরীরে কী এমন জিনিস আছে, যেটা খেলে যৌবন দীর্ঘায়িত করা যায়…আয়ু বাড়ানো যায়? মহিলা তর প্রস্তাবে রাজি হোক আর না হোক, মেয়েটাকে ইচ্ছেমতো ভোগ করতে পারবে সে।

সুনসান গুলশান অ্যাভিনু থেকে বামদিকের একটি রোডে ঢুকে পড়লো আসলাম। রাতের এ সময় ওটা আরো বেশি ফাঁকা আর জনমানবহীন থাকে।

“এদিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?” পেছনের সিট থেকে বলে উঠলো সুস্মিতা।

“শটকাটে যাচ্ছি।” বললো আসলাম। মেয়েটা যে ভয় কাটানোর জন্য তুই-তোকারি করছে বুঝতে পারলো।

“উল্টাপাল্টা কিছু করার কথা চিন্তা করবি না, গাণ্ডু!”

মুচকি হাসি দিলো আসলাম। একটু পর সে কী করবে এই মেয়ের কোনো ধারণাই নেই।

“উল্টাপাল্টা কিছু করেছিস তো, তোর বসের বোনকে শেষ করে দেবে মুশকান।”

রিয়ার মিরর দিয়ে তাকালো, কিছু বলতে গিয়েও বললো না। গভীর করে দম নিয়ে নিলো। একটু সামনেই নির্জন একটি রাস্তা আছে-রাতের এ সময়ে ওটা একদম ভুতুড়ে হয়ে যায়। আবাসিক এলাকা সত্ত্বেও গুলশানের অন্যান্য অংশের মতো এই রাস্তাটার দু-পাশে প্রায় সবগুলো বাড়িই অফিস আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে, রাত নয়টা দশটার পর থেকে জনমানবহীন হয়ে পড়ে।

হঠাৎ করে একটা গান ভেসে আসতেই চমকে উঠলো আসলাম।

“চাই গো আমি তোমারে চাই
তোমায় আমি চাই…”

অবিশ্বাসে রিয়ার মিরর দিয়ে তাকালো সে। অবাক হয়ে দেখলো, মেয়েটা গান গাইছে গুণ গুণ করে!

“এই কথাটি সদাই মনে বলতে যেনো পাই
আর যা-কিছু বাসনাতে…ঘুরে বেড়াই দিনে রাতে…”

মেয়েটাকে এখন দেখে মনে হচ্ছে, মাথা আউলে গেছে। কিংবা ভয় থেকে মুক্তি পাবার জন্যে গান ধরেছে!

বাঁকাহাসি ফুটে উঠলো আসলামের ঠোঁটে।

“মিথ্যা সে-সব মিথ্যা ওগো
তোমায় আমি চাই…”

আমিও তোকে চাই! পিএসের গানম্যান বলে উঠলো মনে মনে। তাকে মানতেই হলো, মেয়েটার কণ্ঠ বেশ ভালো, গায়ও চমৎকার। নির্জন রাস্তাটায় ঢুকেই বামদিকে ফুটপাত ঘেষে গাড়িটা থামিয়ে দিলো সে।

“অ্যাই, গাড়ি থামিয়েছিস কেন!” গান থামিয়ে এবার আঁৎকে উঠলো মেয়েটি।

হ্যান্ডগিয়ারটা টেনে দিলো আসলাম। ডানদিকের ড্রাইভিং ডোরের কাঁচটা তুলে দিলো সুইচ টিপে। রিয়ার মিরর দিয়ে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটাকে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, সুস্মিতা হঠাৎ করেই চুপসে গেছে। তার মধ্যে সুতীব্র ভয় জেঁকে বসেছে সম্ভবত।

“কোনো রকম চালাকি করলে কিন্তু তোর বসের বোন মারা যাবে, তাকে আরো একবার সাবধান করে দিলো।

“ওই মহিলা এমনিতেই মরবে,” বাঁকা হাসি দিয়ে বললো আসলাম। “কয়েকটা দিন আগে মরলেই ভালো…কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে।”

.

অধ্যায় ৯২

জেবুন্নেসা নামে হাউজ নার্স মেয়েটি পাশের ঘরে চুপচাপ বসে আছে। মুশকান তাকে আর তার রোগীর সেবা দান নিয়ে কিছু প্রশ্ন করেছে একটু আগে-একেবারে ইন্সপেক্টরদের মতো। তারপর মেয়েটার মোবাইলফোন দেখতে চাইলে বিনাপ্রতিবাদে নিজের ফোনটা তাকে দিয়ে দেয়। ফোন চালু আছে দেখতে পেয়ে কপট রাগ দেখিয়েছিলো সে।

“তোমাকে কি তোমার ডিপার্টমেন্ট বলে দেয়নি, ডিউটির সময় ফোন বন্ধ রাখার জন্য?”।

“জি…বলেছিলো তো,” কাচুমাচু খেয়ে বলেছিলো মেয়েটি।

“তাহলে তুমি বন্ধ রাখোনি কেন?”

“আ-আমার পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা আছে…ছোটোবোনের কাছে থাকে, ওর খোঁজ নিতে ফোনটা চালু রাখি। কিন্তু মিউট করে রাখি…ভাইব্রেশনও অফ করা থাকে…চেক করে দেখেন।”

মাথা দুলিয়েছিলো মুশকান। “এরকম এক্সকিউজ দেবে না আর। ডিউটিতে থাকার সময় অলওয়েজ ফোন অফ করে রাখবে, ঠিক আছে?”

মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলো মেয়েটি।

এরপর নার্সের ফোন আর ইয়ারফোনটা নিয়ে পাশের ঘরে চলে যায় মুশকান। ফোনের সাথে ইয়ারফোন কানেক্ট করে কানে গুঁজে দিয়ে ডায়াল করে পিএসের নাম্বারে, তাকে জানিয়ে দেয়, সুস্মিতাকে ছেড়ে না দিলে তার বোনকে মেরে ফেলা হবে। ক্ষমতাধর লোকটার নার্ভ গুঁড়িয়ে দেবার জন্য তার অসুস্থ বোনের একটা ছবি তুলেও পাঠায়। রান্নাঘর থেকে একটা কিচেন নাইফ নিয়ে ঘুমন্ত রোগীর গলার কাছে ধরে ছবিটা তোলে সে।

ডাক্তার আসকারই পিএসের নাম্বারটা তাকে দিয়েছিলো হাসপাতালের ফাইল থেকে। ভদ্রলোককে কল করার পর থেকে এখন পর্যন্ত তার ফোনের সাথে কানেক্টেড আছে সে। কিছুক্ষণ আগে পিএস তার কথামতো সুস্মিতার কাছে হস্তান্তর করেছে ঐ ফোনটা। তাকে এখন গাড়িতে করে জায়গামতো পৌঁছে দেবে পিএসের এক লোক। তবে সুস্মিতা পুরোপুরি মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত কলটা কাটবে না।

এখন পাশের ঘর থেকে আর্জুমান্দ বেগমের ঘরে ঢুকতেই টের পেলো মহিলার ঘুম ভেঙে গেছে আবার। একটু নড়াচড়া করছে সে। ঘুম হয় না বলে আই মাস্ক লাগানো আছে তার চোখে, ফলে দেখতে পাচ্ছে না।

“কে?” অস্ফুট স্বরে বললো রোগী।

মুশকান তার পাশে চুপচাপ বসে রইলো। চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। সম্ভবত কিছুক্ষণের মধ্যে পুরোপুরি মুক্তি পেয়ে যাবে সুস্মিতা।

“কথার জবাব দিচ্ছো না কেন?” মৃত্যুপথযাত্রি রোগী একটু জোরেই বলার চেষ্টা করলো, যদিও ভঙ্গুর কণ্ঠে তেমন জোর নেই। “আবারো ফেসবুক ইউজ করছো আমার সামনে?”

মুশকান অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।

“তোমাকে জেবুন্নেসা না ডেকে ফেবুন্নেসা ডাকাই উচিত,” ভঙ্গুর কণ্ঠে বললো আর্জুমান্দ বেগম।

নিঃশেব্দ হেসে ফেললো মুশকান। আগের মতোই টিটকারি মারার স্বভাব রয়ে গেছে। এমন সময় দেখতে পেলো, রোগী তার চোখের উপর থেকে আই মাস্কটা খুলে ফেলতে উদ্যত হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে আর্জুমান্দ বেগমের হাতটা খপ করে ধরে ফেললো সে।

“কে?!” ভড়কে গেলো পিএসের বোন। অন্য হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করলো মুশকানের হাতটা।

“একদম শান্ত থাকো…আরজু!”

অবিশ্বাসের অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো রোগীর চেহারায়। “আরজু!” পুণরুক্তি করলো। “কে?!” ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো এবার।

“অনেক পুরনো বন্ধু। হয়তো তোমার স্মৃতিতে সে আর নেই!”

অস্থির হয়ে উঠলো রোগী। “কে? কে কথা বলছে? নাম বলো…নাম বলো!” হাপাতে হাপাতে বলে গেলো রোগী।

“আহ্,” আস্তে করে বললো মুশকান। “এতো অস্থির হলে তোমার শরীর খারাপ করবে। শান্ত হও। তোমার কোনো ভয় নেই।”

“আমি তোমাকে দেখতে চাই!” দৃঢ়তার সাথে বললো রোগী। “আমার আই মাস্কটা খুলে দাও।”

মুশকান কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিলো। রোগীকে দেখা দেবে কিনা দ্বিধায় পড়ে গেছে সে, কিন্তু তার সমস্ত দ্বিধা উবে গেলো মুহূর্তে। হঠাৎ করেই ইয়ারফোনে শুনতে পেলো সুস্মিতা গান গাইছে!

মেয়েটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এটা না ভেবে পারলো না। এরপর পিএসের যে লোক গাড়িতে করে তাকে নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে দেবে তার সাথে কথাবাতা কেমন অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে সেটাও কানে গেলো।

লোকটা তার মত বদলে ফেলেছে! সে সুস্মিতাকে মুক্তি দিতে চাইছে না!

উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালো মুশকান। “হ্যালো?!” প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো। “সুস্মিতা!” কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলো ফোনটা সুস্মিতার কানে নেই। সুস্মিতা আর সেই লোকটার কথাবার্তা শুনে মুশকানের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। কিছুই বুঝতে পারছে না। এরপরই ধস্তাধস্তির শব্দটা শুনতে পেলো, আর সঙ্গে সঙ্গে কেটে গেলো কলটা!

মাই গড!

দ্রুত নাম্বারটায় আবার ডায়াল করলো মুশকান। ওপাশ থেকে যখন অটোমেটেড অপারেটরের কণ্ঠটা বললো সংযোগ বন্ধ আছে, তখন আর দেরি না করে দ্রুত বের হয়ে গেলো ঘর থেকে।

কিন্তু সে জানতেই পারলো না, এক ঝলকের জন্য আর্জুমান্দ বেগম। হাত দিয়ে চোখের উপরে থাকা আই মাস্কটা খুলে তাকে দেখে ফেলেছে।

মৃত্যুপথযাত্রি রোগী সুতীব্র ভয় আর অবিশ্বাসে কাঁপতে শুরু করলো রীতিমতো। যেনো দুঃস্বপ্ন দেখেছে।

.

অধ্যায় ৯৩

আশেক মাহমুদের গাড়িটা ছুটে চলেছে তার গুলশান দুই নম্বরের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে।

একমাত্র দারোয়ান বদরুলকে ঐ বিরাণ বাড়িতে রেখে ড্রাইভার সেলিমকে নিয়ে রওনা দিয়েছে পিএস। অন্য কোনো সময় হলে এই সরকারী গাড়িটা চালাতে নিয়মিত একজন ড্রাইভার, কিন্তু আজকের রাতের জন্য আশেক মাহমুদ বেছে নিয়েছে তার আরেকজন বিশ্বস্ত লোক সেলিমকেই।

পিএস বসে আছে পেছনের সিটে, ছফা বসেছে ড্রাইভারের পাশে। গাড়িটা পথে নামতেই শুরু হয়ে গেছে বৃষ্টি। প্রথমে বড় বড় ফোঁটায়, তারপর ঝমঝম করে। এরই মধ্যে ছুটে চলেছে তাদের গাড়িটা। বিরূপ প্রকৃতি পিএসকে পরিহাসের সাথে মনে করিয়ে দিচ্ছে, সব কিছুই তার বিপক্ষে চলে গেছে এখন।

একটু আগে ছফা তার জুনিয়র জাওয়াদকে দ্রুত বাইক নিয়ে চলে আসতে বলেছে পিএসের গুলশানের অ্যাপার্টমেন্টে। যে কাজটা করতে হবে তাতে জাওয়াদ ছাড়াও আরো অনেক লোকবল লাগবে। তবে সবার আগে পিএসের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছাতে হবে তাকে, ওখান থেকেই শুরু করতে হবে বিশাল এক কর্মযজ্ঞের।

আশেক মাহমুদের অ্যাপার্টমেন্টের মেইনগেটের সামনে তাদের গাড়িটা থামতেই পিস্তলের সেফটি লক খুলে পেছনে ফিরে তাকালো ছফা।

“আপনি এখানেই থাকুন, স্যার।”

পিএসের চোখেমুখে ভয়ার্ত অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো। “আপনি কি মনে করছেন, ঐ মহিলা এখনও আমার অ্যাপার্টমেন্টে আছে?”

“না,” কথাটা বলেই ছফা গাড়ি থেকে নামতে উদ্যত হলো বৃষ্টির মধ্যেই। “কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে ওখানে ঢাকা ঠিক হবে না।”

অ্যাপার্টমেন্টের গেটের পাশে যে ছোট্ট ওয়াচরুমটা আছে সেখানে ডিউটিতে থাকা দারোয়ান পিএসের গাড়িটা দেখে বের হয়ে এসেছে এতোক্ষণে।

বৃষ্টির ছটা থেকে বাঁচতে ওয়াচরুমের শেডের নীচে এসে দাঁড়ালো ছফা। “একটু আগে কি একজন মহিলা বের হয়ে গেছে এখান থেকে?…কিছুক্ষণ আগে ঢুকেছিলো সম্ভবত?”

দারোয়ান মাথা নেড়ে সায় দিলো। “জি, স্যার। একটু আগেই বাইর হইসে।”

“কতোক্ষণ আগে?”

একটু ভেবে নিলো দারোয়ান। “দশ-বারো মিনিট তো হইবোই?”

ছফা জানতো এমন জবাবই পাবে। “কোন্ দিক দিয়ে গেছে ঐ মহিলা…দেখেছো?”

পিএসের গাড়িটা যেদিকে মুখ করা সে দিকটায় আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলো। “ওই দিকে, স্যার।”

“গাড়িতে করে নাকি পায়ে হেঁটে?”

“হাইট্যাই তো গেলো দেখলাম।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “আশেক মাহমুদের অ্যাপার্টমেন্টে কল দাও।”

অবাক হয়ে ইন্টারকমটা তুলে নিলো দারোয়ান। সে বুঝতে পারছে না, ক্ষমতাধর পিএস তার গাড়ি নিয়ে সরাসরি এই ভবনে না ঢুকে নিজের ফ্ল্যাটে কল দিচ্ছে কেন। যাই হোক, কয়েক বার রিং হবার পর ওপাশ থেকে কেউ ধরলো ইন্টারকমটা। “নেন, কথা বলনে, স্যার…” ছফার দিকে বাড়িয়ে দিলো।

“হ্যালো, আমি ডিবি থেকে বলছি…আপনি কে বলছেন?” জিজ্ঞেস করলো সে।

“আমি জেবুন্নেসা…হাউজনার্স।” মেয়েটা একদমই ভড়কে গেছে।

“একটু আগে একজন মহিলা এসেছিলো?”

“জি, স্যার।”

“তাকে অ্যাপার্টমেন্টে কে ঢুকতে দিয়েছে?”

“ইয়ে মানে,” আমতা আমতা করলো মেয়েটি। “আমিই, স্যার।”

“আপনি তাকে কেন ঢুকতে দিলেন?”

“উনি হসপিস সার্ভিস ইন্সপেকশন করতে এসেছিলেন।”

কথাটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না ছফা। “কী সার্ভিস, বললেন?”

মেয়েটা তাকে সংক্ষেপে জানালো বিষয়টা। সব শুনে থ বনে গেলো সে। মুশকান জুবেরির কৌশলটা এরকম অভিনব হবে ধারণাও করতে পারেনি। কিন্তু এতো দ্রুত কিভাবে এটা করলে বুঝতে পারছে না।

“আশেকসাহেবের বোনের কী অবস্থা এখন?”

“ঐ ম্যাডাম চলে যাওয়ার পর থেকেই পেশেন্ট পাগলের মতো আবোল তাবোল বকছেন, স্যার। বার বার মুশকান নামের একজনের কথা বলছেন…কিছুই বুঝতে পারছি না।”

কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, মনে মনে বলে উঠলো ছফা। “ঠিক আছে।” বলেই ইন্টারকমটা রেখে দিলো। পিএসের অ্যাপার্টমেন্টটা এখন নিরাপদ-মুশকান সেখানে নেই।

উপুড় হয়ে প্যাসেঞ্জার সিটের কাঁচ নামানো দরজা দিয়ে উঁকি মেরে পিএসকে বললো, “স্যার, মুশকান জুবেরি একটু আগে চলে গেছে। আপনার বোনের কিছু হয়নি। আজকে রাতে আপনি আপনার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আর বের হবেন না, কাউকে ঢুকতেও দেবেন না। আমি আপনার সাথে যোগাযোগ রাখবো,” পকেট থেকে নিজের ভিজিটিং কার্ডটা বের করে পিএসকে দিয়ে বললো, “এই নাম্বারে কল দেবেন একটু পর, আপনার সাহায্যের দরকার আছে আমার।”

পিএস খুবই অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। “আপনি কী করবেন? কিছুই তো বুঝতে পারছি না!”

“মুশকানকে ট্র্যাক করবো।”

“কিভাবে?”।

ছফা তাকে আশ্বস্ত করে বললো, “আমার উপরে ভরসা রাখুন,” বলেই দারোয়ানকে গেট খুলে দিতে বলে আশেক মাহমুদের ড্রাইভারকে ইশারা। করলো গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ার জন্য।

পিএসের অ্যাপার্টমেন্টের মেইনগেটটা বন্ধ হয়ে গেলে ছফা গভীর করে দম নিয়ে নিলো। তার সহকারী জাওয়াদ থাকে বাড়ায়, বাইক নিয়ে এখানে চলে আসতে দশ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। যেকোনো সময়ই ছেলেটা চলে আসবে। তবে তার জন্য অপেক্ষা না করে কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে আশেপাশে তাকালো। এক দুজোড়া চোখ ফাঁকি দেয়া সম্ভব কিন্তু অসংখ্য চোখ ফাঁকি দেয়া অসম্ভব।

মুশকান, তুমি কোনো না কোনো চোখে তো ধরা পড়েছেই!

.

অধ্যায় ৯৪

পিএসের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তড়িঘড়ি বের হয়েই মুশকান দেখতে পায় বৃষ্টি পড়ছে। একটু দূরে, কয়েকটি ভবনের পরই অপেক্ষা করছে ঐ গাড়িটা।

পুরনো ঢাকা থেকে উবারে করে গুলশানে আসার পথেই হসপিসের তথ্যটা পাবার পর দ্রুত পরিকল্পনাটা করেছিলো। ডাক্তারকে বলেছিলো, একটা প্রাইভেটকার আর বিশ্বস্ত ড্রাইভার দরকার তার, সেই সাথে ডাক্তারদের একটি অ্যাপ্রোন।

পুরনো ঢাকা থেকে গুলশানে যাবার পথেই ডাক্তার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন সেটা। উবারের গাড়িটা গুলশানের নির্দিষ্ট একটি জায়গায় এসে ছেড়ে দেয় সে, তারপর উঠে পড়ে আসকারের পাঠানো গাড়িতে, ওটা দিয়েই চলে আসে আশেক মাহমুদের অ্যাপার্টমেন্টের কাছে।

এখন পিএসের অ্যাপার্টমেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে অনেকটা পথ সামনে গিয়ে ঐ গাড়িতে উঠে বসেছে। সুস্মিতাকে নির্দিষ্ট একটি রাস্তায় নামিয়ে দেবার কথা, সেখান থেকে এই গাড়িতে করে তাকে তুলে নেবে মুশকান-কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, কিছু একটা গড়বর হয়ে গেছে! সুস্মিতার সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে পিএসের ঐ লোকটা বলেছিলো, সে একটা লেনদেন করতে চায় তার সাথে। এর পরই ধস্তাধস্তির শব্দ শুনেছে। কিছুক্ষণ পর তাকে ভড়কে দিয়ে সুস্মিতার ফোনটাও বন্ধ হয়ে যায়।

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। আরেকটু সতর্কতার সাথে কাজ করা দরকার ছিলো। পিএসের লোকটার বদলে নুরে ছফাকে দিয়ে সুস্মিতাকে নির্দিষ্ট পথে নামিয়ে দেবার চিন্তাটা বাতিল করে দিয়েছিলো এই ভেবে যে, নাছোড়বান্দা ছফা এ কাজের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়। মাঝপথে সে হয়তো বাগড়া দেবে। পিএসের কথার অবাধ্য হয়ে মুশকানকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে সে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার হিসেবে ভুল হয়ে গেছে।

নিজেকে ধাতস্থ করে নেবার চেষ্টা করলো মুশকান। সুস্মিতার নাম্বারে আবারো কল দিলো। নাম্বারটা এখনও বন্ধ আছে। মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু হলে তাকে কল দিতো ঐ লোক-কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটা করেনি। মুশকান আর ভাবতে পারলো না। গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিজের নার্ভকে শান্ত রাখতে চাইলো। আজকে রাতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি সে। বলতে গেলে, সাধ্যের বাইরে গিয়ে সব কিছু করেছে। এরপরও যদি শেষটায় এসে খারাপ কিছু ঘটে যায়, তার কীই বা করার থাকবে।

হঠাৎ চমকে উঠলো সে। তার ফোনটা বাজছে!

পিএস?!

না। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে শুধরে দিলো। প্রচণ্ড মানসিক চাপে পড়ে ভুলেই গেছিলো, এই ফোনটা এখন সুস্মিতার কাছে আছে।

নাকি বেহাত হয়ে গেছে মেয়েটার কাছ থেকে? পিএসের ঐ লোক না তো?

একটা আশঙ্কা জেঁকে বসলেও কলটা রিসিভ করার আগে মনে মনে কেবল একটা প্রার্থনাই করলো সে : ফোনের ওপাশে যেনো সুস্মিতার কণ্ঠটাই শুনতে পায়!

.

অধ্যায় ৯৫

কিছুক্ষণ আগে, পিএসের গানম্যান যখন সুস্মিতাকে মুক্তি না দেবার কথা

জানালো তখন সে ভড়কে গেলেও তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলো, তার এমন কর্মকাণ্ডের ফলাফল কী হতে পারে। আসলাম সেটা এক ফুঙ্কারে উড়িয়ে দিয়ে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়, মৃত্যুপথযাত্রি একজনের জীবন নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই।

তারপরও সাহস করে পিএসের ষাটাকে বলেছিলো সুস্মিতা : “ভালোয় ভালো যেমনটা বলেছি, আমাকে বনানীর পাঁচ নাম্বার রোডে নামিয়ে দে…তুই কোন্ মতলবে যে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিস সেটা কিন্তু বুঝে গেছি!”

রিয়ার মিররে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিলো আসলাম। “কী বুঝে গেছিস?”

বাঁকা হাসি দিয়েছিলো সুস্মিতা। “আমাকে একা পেলে কী করতে চাস, ভেবেছিস আমি জানি না?”

কপট প্রশংসার অভিব্যক্তিতে ভুরু কপালে তোলে গানম্যান। “তাই নাকি!”

“কিন্তু তোর সেই আশা পূরণ হবে না মনে হচ্ছে! মুশকান কিন্তু এখনও ফোনে কানেক্টেড আছে…সব শুনতে পাচ্ছে!” কথাটা বলেই পাশে রাখা ফোনটার দিকে ইঙ্গিত করে সে।

এ কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় আসলাম। “তোর মুশকানকে বল, আমি তোকে ছাড়ছি না! আমার সাথে তাকে একটা লেনদেন করতে হবে।”

সুস্মিতা অবিশ্বাসে তাকায় গানম্যানের দিকে। তারপর হঠাৎ করেই স্মিত হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটে। “তাহলে কথাটা তুই নিজেই ওকে বল্!”

এ কথা শুনে সঙ্গত কারণেই সুস্মিতার পাশে রাখা ফোনটার দিকে তাকায় আসলাম।

মুচকি হেসে মাথা দোলায় মেয়েটি। তারপর আচমকা গাড়ির সামনের দিকে তাকিয়ে বলে, “ফোনে না, মুশকান তোর সাথে সশরীরে কথা বলার জন্য চলে এসেছে!…ঐ দেখ!”

কথাটা শুনে চমকে উঠে মেয়েটার দৃষ্টি অনুসরণ করে গাড়ির সামনের দিকে তাকায় আসলাম, সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারে নিজের ভুলটা।

রাস্তায় কেউ নেই!

ততোক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে! টের পায় তার গলায় কিছু একটা চেপে বসেছে! মুহূর্তে প্রবল জোরে হ্যাঁচকা টান খেয়ে পিছিয়ে যায় তার মাথাটা। হাত দিয়ে গলায় চেপে ধরা নাইলনের চিকন দড়িটা ধরার চেষ্টা করে সে, কিন্তু ততোক্ষণে দড়িটা দেবে গেছে তার গলায়! রিয়ার মিররে তাকিয়ে সুস্মিতাকে দেখতে পায় সে। মেয়েটা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে দু হাতে দড়ির দুই প্রান্ত ধরে টেনে যাচ্ছে, আর এ কাজে তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছে তার পা দুটো!

আসলামের সিটের পেছনে পা দুটো ঠেকিয়ে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ধনুকের মতো বাঁকা শরীরটাকে সোজা করার চেষ্টা করতে থাকে সুস্মিতা। তার শরীর যতো সোজা হচ্ছিলো আসলামের গলার ফাঁস ততোই চেপে বসতে শুরু করেছিলো। দু-হাতে গলা থেকে দড়িটা ধরে টানার চেষ্টা করে যায় সে, কিন্তু সুস্মিতা আরো জোরে হ্যাঁচকা টান দিতেই সেটা বেশি করে দেবে যায় তার গলায়। ড্রাইভিং সিটের হেডরেস্টটার কারণে বেকায়দায় পড়ে যায় আসলামের মাথাটা। আতঙ্কের সাথেই সে টের পায়, তার গলার চামড়া কেটে নাইলনের দড়িটা দেবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিশ্বাস। মেয়েটা দু-হাত আগেপিছে করে প্রবল শক্তি দিয়ে তার গলা কেটে ফেলার চেষ্টা করতে শুরু করছে!

“তোকে আমি অপচয় করবো না…গাণ্ডু?” দাঁতমুখ খিচে বলে সুস্মিতা। “পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করবো!”

কথাগুলো খুব বেশি ভীতিকর শোনায় আসলামের কাছে। মেয়েটা কী বলতে চাইছে-বুঝতে পারে না সে। কিন্তু এর পরের কথাটা শুনে সব কিছু পরিস্কার হয়ে যায়।

“খাওয়ার জন্য তুই একদম উপযুক্ত!”

কথাটা শুনে গানম্যানের দুচোখ যেনো বিস্ফারিত হবার উপক্রম হয়। তীব্র গোঙানি দেয় সে।

একটা পা সিটের পেছন থেকে একটু তুলে হেডরেস্টের পেছনে ঠেকায় সুস্মিতা, তারপর দড়িতে আরো জোরে টান দেয়। বাঁকা হয়ে থাকা শরীরটা পুরোপুরি সোজা করে ফেলে। অস্কুট কিন্তু জান্তব গোঙানি বের হয়ে আসে মেয়েটার ভেতর থেকে। সেই গোঙানির সঙ্গি হয় মাহবুব আসলামের ভোঁতা আর্তনাদটি।

অন্তিম সময়ে তার মনে পড়ে যায় তার কোমরে গোঁজা আছে নাইন মিলিমিটারের একটি পিস্তল! কিন্তু ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, সে-ও তার গলায় ফাঁস হয়ে থাকা দড়িটা দু-হাতে টেনে ধরতে মরিয়া তখন। ভালো করেই জানতো, একটা হাত ছেড়ে দিলেই দড়িটা আরো জোরে চেপে বসবে তার গলায়। তারপরও বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে দড়িটা ছেড়ে বাম হাত দিয়ে কোমর হারাতে শুরু করে উদভ্রান্তের মতো। সঙ্গে সঙ্গে টের পায়, সুস্মিতা আবারো তার দু-হাত আগেপিছে করে গলা কাটতে শুরু করে দিয়েছে! এবার আরো জোরে জোরে!

রিয়ার মিররে তাকায় আসলাম, দেখতে পায় তার গলা কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে!

কোমরের পিস্তলটার নাগাল পেতেই দুচোখে অন্ধকার নেমে আসে। বাতাস না পেয়ে তার ফুসফুস ফেঁটে যেতে চাইছিলো যেনো। কাঁপতে থাকা হাতে তবুও পিস্তলটা কোমর থেকে নিতে পারে সে, কিন্তু দড়িতে আরেকটা হ্যাঁচকা টান পড়তেই হাত থেকে ছুটে যায় অস্ত্রটা! সিটের উপর হারানোর চেষ্টা করলেও নাগাল পায় না আর। অস্ত্রটার আশা বাদ দিয়ে আবারো দড়িটা ধরে ফেলে দু-হাতে। আতঙ্কের সাথেই রিয়ার মিররে দেখতে পায়, রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার গলা আর বুক। শ্বাসনালী কেটে ভোস ভোস শব্দ হচ্ছে।

আসলাম টের পায়, চোখ খোলা রাখলেও অন্ধকার নেমে আসছে চারপাশে! সেই অন্ধকারে ভেসে উঠলো তার ছেলে আরাফের মুখটা! কতোদিন তাকে দেখেনি। স্ত্রী হত্যার ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে তার ছেলেকে ওর নানা-নানী নিজেদের কাছে নিয়ে নেয়।

আরো দুটো মুখও ভেসে উঠলো এরপর!

তার স্ত্রী সোমা! আর মনীষা দেওয়ান!

এদের সবাইকে সে হারিয়েছে। এখন সে-ও হারাবার পথে!

“মুশকানকে পেলে কী করবি…সেটাই শুধু মাথায় রেখেছিলি!” দম ফুরিয়ে গেলেও কিড়মিড় করে কথাটা বলে সুস্মিতা। “কিন্তু তোদেরকে পেলে…” আরেকটু জোরে টান দিয়ে বলে, “আমরা কী করবো…একদমই ভাবিসনি!”

আমরা!

অন্তিম মুহূর্তে আসলামের মনে হয়, একজন নয়, দু দু-জন মুশকান জুবেরির খপ্পরে পড়েছে সে!

এরপরই পরিস্থিতিটাকে আরো বেশি রোমহর্ষক করে দিয়ে একটু আগে গাওয়া গানটার বাকি অংশ গাইতে শুরু করে সুস্মিতা :

“রাত্রি যেমন লুকিয়ে রাখে আলোর প্রার্থনাই
তেমনি গভীর মোহের মাঝে তোমায় আমি চাই…”

আসলাম টের পায় অপার্থিব এক ভয় জেঁকে বসেছে তার মধ্যে। এরপর সুস্মিতা গাইলো কি গাইলো না, বুঝতে পারেনি। আর কোনো শব্দ তার কানে ঢোকেনি। দৃশ্যের পর শব্দও উধাও হয়ে যায়! শুধু ভো ভো আওয়াজ শুনতে পায় সে।

এর কয়েক মুহূর্ত পরই স্থির হয়ে যায় মাহবুব আসলামের পঁয়ত্রিশ বছরের সুঠাম দেহটি।

.

অধ্যায় ৯৬

মুশকান বসে আছে একটি ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্টে।

বৃষ্টি এখন কমে এসেছে। জায়গাটা গুলশান আর বনানী থেকে খুব কাছেই, বারিধারার একটি অ্যাপার্টমেন্ট-অরিয়েন্ট হাসপাতালেরই সম্পত্তি। প্রায়শই বিদেশ থেকে কনসালটেন্ট আর গেস্ট ডাক্তাররা আসে, তাদের থাকার জন্য স্থায়ীভাবে এই অ্যাপার্টমেন্টটি কেনা হয়েছে। আজকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক ভারতীয় কার্ডিয়াক স্পেশালিস্ট ছিলেন, এখন একদম ফাঁকা।

শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা মতোই কাজটা করতে পেরেছে সে। কাজ শেষে ওখান থেকে বের হয়ে গাড়িতে করে সোজা বারিধারার এই অ্যাপার্টমেন্টে চলে আসেনি মুশকান। সুস্মিতাকে পিক করে নিয়ে আসার কথা ছিলো, কিন্তু মেয়েটার ফোন হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেলে খারাপ কিছুর আশঙ্কা করে। কল কেটে যাবার আগে সুস্মিতা আর পিএসের ঐ লোকটার কথা শুনেছে-নির্ঘাত বিপদে পড়েছে মেয়েটি। আবার! তার এই পরিকল্পনাটিও ভণ্ডুল হয়ে গেলো বুঝি! তাই গুলশান দুই নম্বরে পিএসের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে আসকারের পাঠানো গাড়িতে উঠে বসলেও তার জানা ছিলো না কোথায় যাবে। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়, সুস্মিতাকে যেখানে নামিয়ে দেবার কথা বলেছিলো সেখানে গিয়েই অপেক্ষা করা উচিত।

আসকারের পাঠানো লোকটাকে সে কথা বলতেই গাড়িটা ছুটে যায় বনানীর পাঁচ নাম্বার রোডের দিকে। রাতের এ সময়ে পথঘাট ফাঁকা পেয়ে অল্প কিছুক্ষণ পরই চলে যায় সেখানে। রাস্তার এক পাশে গাড়িটা পার্ক করে অপেক্ষা করতে থাকে মুশকান। এছাড়া আর কিছু করারও ছিলো না তার।

কয়েক মিনিট পরই, তার নার্ভের চূড়ান্ত পরীক্ষা নিয়ে ফোনটা বেজে ওঠে। কলার আইডি দেখে সে ভেবেছিলো পিএস, পরক্ষণেই বুঝতে পারে, এই ফোনটা সুস্মিতার কাছে ছিলো বন্দীদশা থেকে মুক্ত হবার সময়।

সুস্মিতার কণ্ঠ শোনামাত্রই মুশকানের সমস্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা উবে যায় এক মুহূর্তে। মেয়েটা জানায়, সে একটা রিক্সা নিয়ে রওনা দিয়েছে বনানীর পাঁচ নাম্বার রোডের উদ্দেশে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওখানে চলে আসে সুস্মিতা। দূর থেকেই দেখতে পায়, বৃষ্টিতে ভিজে জবুথুবু হয়ে রিক্সায় করে আসছে মেয়েটি। প্যাসেঞ্জার ডোরটা খুলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে মুশকান। সুস্মিতা দেখতে পেয়ে রিক্সাটা থামায় গাড়ির পাশে। ভাড়া মিটিয়ে মেয়েটা গাড়িতে ওঠার পরই মুশকান দেখতে পায় তার চোখের নীচে কালশিটে পড়ে গেছে, আর তার জামায় লেগে আছে রক্ত!

“কী হয়েছে তোমার?! তুমি ঠিক আছে তো?” উদ্বিগ্ন হয়ে বলে ওঠে সে।

“আমি ঠিক আছি…ডোন্ট ওরি,” শান্ত কণ্ঠে বলে সুস্মিতা। “পরে সব বলবো।”

যাই হোক, বারিধারার এই অ্যাপার্টমেন্টে আসার পথে গাড়িতে তারা এ নিয়ে আর কোনো কথা বলেনি আসকারের লোকটার উপস্থিতির কারণে। কিন্তু এই ফ্ল্যাটে ঢুকতেই মুশকান প্রথমে জানতে চায়, সে কেন ফোনটা বন্ধ করে দিয়েছিলো হুট করে? তার শরীরে কীসের রক্ত লেগে আছে?

এমন প্রশ্নে রহস্যময় হাসি দিয়েছিলো সুস্মিতা। তাকে জানায়, আগে ভেজা কাপড় ছেড়ে স্নান করবে, তারপর সব খুলে বলবে তাকে–এ কথা বলেই বাথরুমে ঢুকে পড়ে সে।

এখনও বাথরুমে যাওয়ার নিচ্ছে সুস্মিতা।

মেয়েটা সত্যি অদ্ভুত! মনে মনে বললো মুশকান। খুব বেশি দিন হয়নি তার সাথে সাথে পরিচয়, কিন্তু এখন এই পৃথিবীতে ডাক্তার আসকার ছাড়াও আরেকজন ঘনিষ্ঠজন রয়েছে তার। কিন্তু মেয়েটার কিছু কিছু আচরণে সে যেমন দুশ্চিন্তায় থাকে তেমনি অস্বস্তি বোধ করে!

মাথার চুল টাওয়েল দিয়ে মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বের হয়ে এসে মুশকানের বিপরীতে একটি সিঙ্গেল সোফায় বসলো সুস্মিতা।

“ও আসবে না?” জানতে চাইলো সে।

অবাক হয়ে তাকালো মেয়েটার দিকে। তার মধ্যে কোনো বিকারই নেই। অথচ আজকে দুপুর থেকে একটু আগ পর্যন্ত কতোগুলো পিশাচের হাতে বন্দী ছিলো সে। টর্চারেরও শিকার হয়েছে। কে জানে কতোটা ভয়াবহতার ভেতর দিয়ে গেছে!

“ও এখানে আসবে না,” শান্ত কণ্ঠে বললো মুশকান। একটু আগে ডাক্তার আসকারের সাথে কথা হয়েছে তার–বলে দিয়েছে, তারা দুজনেই নিরাপদে আছে।

“কেন?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটার দিকে তাকালো। কারণ ওকে ফলো করে নুরে ছফা আর তার লোকজন এখানে চলে আসতে পারে।”

“ও,” আর কিছু না বলে ভেঁজা চুলগুলো টাওয়েলে মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সুস্মিতা। মুশকানের দিকে চোখ গেলো। স্থিরচোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। “কী হয়েছে? ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”

গভীর করে দম নিলো মুশকান। একটা অস্বস্তি পেয়ে বসেছে তাকে, কিন্তু সেটা নিয়ে কথা বলতে পারছে না।

“ফোনটা কেন বন্ধ হয়ে গেছিলো, তাই তো?”

মুশকান কিছু বললো না।

“ঐ গাঙুটাকে ইয়ে করার সময় সিট থেকে পড়ে গেছিলো ওটা,” নির্বিকার কণ্ঠে বললো সুস্মিতা। “তখনই বন্ধ হয়ে যায়!”

পিএসের লোকটার সাথে সুস্মিতার ধস্তাধস্তির আওয়াজ মুশকানও শুনেছে। “তুমি তাকে কী করেছো?” ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো।

রহস্যময় হাসি দিলো সুস্মিতা সমাদ্দার।

“হেয়ালি না করে স্পষ্ট করে বলো!”

“অমন করে তাকাবে না আমার দিকে, চুল মুছতে মুছতে বললো। “তুমি হলে যা করতে, তা-ই করেছি।”

সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মুশকান।

“সামান্য একটা নাইলনের দড়ি দিয়েই ঘায়েল করেছি। ওটা দিয়েই আমাকে বেঁধে রেখেছিলো। ওখান থেকে বের হবার সময় ওটা নিয়ে নিয়েছিলাম, ওদের কেউ দেখেনি।” মুশকান কিছু বলছে না দেখে আবার বললো, “ঐ লোকটা খুব বাজে ছিলো। আমারও সন্দেহ হচ্ছিলো, সে উল্টাপাল্টা কিছু করতে পারে তাই দড়িটা নিয়ে নিয়েছিলাম।”

“তুমি ওকে মেরে ফেলেছো?!” সরাসরিই জিজ্ঞেস করলো এবার।

“বললাম তো, কিচ্ছু করার ছিলো না। ও আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলো…খুব বাজে ইনটেনশান ছিলো ওর…বিলিভ মি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুশকান। “ঠিক আছে, বুঝলাম কিন্তু…” কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না।

“কি?”

“তুমি আর কিছু কররানি তো?”

সুস্মিতা স্থিরচোখে চেয়ে রইলো মুশকানের দিকে। তারপর কাঁধ খুলে বললো, “আর কী করবো?”

গভীর করে দম নিয়ে নিলো মুশকান। “ওই লোকটার ডেড বডি অটোপসি করলে-”

কথার মাঝে হেসে ফেললো সুস্মিতা। “তুমি আমাকে এতোটা ইম্যাচিউর ভাবো কেন বুঝি না,” চুল মুছতে মুছতে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো। “ওকে গাড়িটাসহ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছি। এতোক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।”

ভুরু কপালে তুললো মুশকান। “কিন্তু বৃষ্টির কথাটা কি মাথায় আছে তোমার?”

“বৃষ্টি নেমেছে তার একটু পর।”

“তোমার কি ধারণা, ততোক্ষনে লাশটা পুরোপুরি পুড়ে গেছে?”

কাঁধ তুললো সুস্মিতা। “আই ডোন্ট হ্যাভ এনি আইডিয়া।” তারপর রহস্য করে বললো, “প্রথমবার পোড়ালাম তো, বুঝতে পারছি না কতোক্ষণ লাগতে পারে!”

আক্ষেপে মাথা দোলালো মুশকান। “তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”

ঠোঁট ওল্টালো মেয়েটা।

অস্বস্তিটা জোর করে মাথা থেকে তাড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলো সে। “আমরা একটু পরই এখান থেকে চলে যাবো।”

“কোথায়?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো।

“এসব তোমার না জানলেও চলবে।”

কাঁধ তুললো আবার। “ওকে। আমরা দুজন একসঙ্গে থাকবো, এটাই বড় কথা।”

হ্যাঁ বা না, কিছুই বললো না মুশকান। এই মেয়েটার সঙ্গে থাকার কোনো ইচ্ছে তার নেই কিন্তু পরিস্থিতি এমনই, সেটা করতে হবে এখন। অন্তত কিছু দিনের জন্য। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে জানালা দিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলো সে। প্রায় সারাটা জীবন যাযাবরের মতো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়ালো। দীর্ঘ যৌবন তার, দীর্ঘ জীবনও পাবে সম্ভবত, কিন্তু থিতু হওয়া তার কপালে নেই!

“আচ্ছা, ঐ নুরে সাফা লোকটা কিভাবে সার্জনের কথা জেনে গেলো?”

সুস্মিতার কথায় ফিরে তাকালো মুশকান। এটা নিয়ে সে-ও অনেক ভেবেছে, কোনো সদুত্তর পায়নি। সুকুমারের ব্যাপারটা না-হয় কলকাতার পুলিশের নজরে চলে এসেছিলো, কিন্তু ডিপি মল্লিকের নিখোঁজের ঘটনায় ওখানকার পুলিশ তাকে সন্দেহ করেনি। আসকার তাকে শুধু বলেছে, কিভাবে যেনো মাস্টারকে লেখা চিরকুটটা ছফা হস্তগত করে ফেলেছে, তারপর সেটার সূত্র ধরেই ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দিনকে পাকড়াও করে সে। ঐ লোকই খোঁজ দিয়ে দেয় আসকারের, কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো কিছুই আদায় করতে পারেনি ডিবি অফিসার। এবার বেশ শক্ত ছিলো ডাক্তার, আগের বার কেএস খানের কথার ফাঁদে পড়ে নার্ভাস ব্রেক ডাউনের শিকার হয়েছিলো সে। তবে আসকারের দেশি পাসপোর্টটা জোর করে নিয়ে নেয় ছফা। ঐ পাসপোর্ট দেখে না-হয় ডিবি অফিসার বুঝে গেলো, ওর কলকাতায় ঘন ঘন যাতায়াতের কথাটা, কিন্তু মুশকান কোথায় থাকে, ডিপি মল্লিকের নিখোঁজ হবার সাথে তার জড়িত থাকার কথা জানলো কিভাবে?

তার চেয়েও বড় কথা, আসকারের বাড়িতে হানা দেবার আগেই ছফা টের পেয়ে গেছিলো সে ঢাকায় গেছে! পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে গেছিলো সে, দু-দিন পর ঢাকা থেকে যশোরের ডামেস্টিক ফ্লাইট ধরার জন্য রওনা দিয়ে ট্রাফিক জ্যামে পড়ে যায়, ফ্লাইটটা মিস্ করে বসে। ফাইন দিয়ে ফ্লাইটটা যখন রিশিডিউল করে লাউঞ্জে অপেক্ষা করছিলো তখনই দেখতে পায় নুরে ছফা বিমানবন্দরে চলে এসেছে। হাতে একটা ছবি নিয়ে ফ্রন্ট ডেস্কে কথা বলছে সে।

ভাগ্য ভালো, পরহেজগার মহিলার বেশে ছিলো, তাই ছফা তাকে দেখতেই পায়নি। তবে ওয়েটিং লাউঞ্জে বসেই দূর থেকে ছবিটা দেখে চিরতে পারে।

অবিশ্বাস্য! ছফা কিভাবে এ ছবি পেলো? কিভাবে জেনে গেলো, সে এখন ঢাকায়? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা ছিলো না তার। তবে এখন সেই প্রশ্নের উত্তর সে জানে-আর্জুমান্দ বেগম। ও-ই ছবিটা দিয়েছে ছফাকে!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুশকান, সুস্মিতার দিকে তাকালো সে। তার চোখে ভেসে উঠলো সেই দিনগুলোর দৃশ্য। সত্যি বলতে, সুন্দরপুর থেকে পালানোর বছরখানেকেরও বেশি পরে, যেদিন এই মেয়েটা হুট করে চলে এলো কলকাতায়, সেদিনই ওর নিয়তি নির্ধারিত হয়ে গেছিলো!

.

অধ্যায় ৯৭

মুশকানের কলকাতা পর্ব

সুন্দরপুর থেকে ঢাকায় চলে আসার পর এমপি আসাদুল্লাহর সাথে লেনদেন চুকিয়ে বর্ডার দিয়ে কলকাতার সল্টলেকে ডাক্তার আসকারের শ্বশুড় বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলো মুশকান। চাইলে সে পাসপোর্ট ব্যবহার করেই যেতে পারতো, ছফা তখনও হাসপাতালে, পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে তদন্ত করলে ছফা জেনে যেতে পারবে, সে কলকাতায় চলে গেছে।

আসকারের স্ত্রী শুভমিতা মারা যাবার পর থেকে তার বড় বোন পারমিতা থাকতো সল্টলেকের বাড়িতে। সে-ও যখন মারা গেলো তখন থেকে বাড়িটা খালিই পড়েছিলো। ফলে, ওই বাড়িটা হয়ে ওঠে মুশকানের নতুন ঠিকানা, উপযুক্ত একটি আশ্রয়!

ওখানে গিয়ে প্রায় এক বছরের মতো সময় একেবারেই চুপচাপ ছিলো মুশকান। তারপরই সিদ্ধান্ত নেয় এভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে আর থাকবে না। চেহারাটা পাল্টে ফেললে আর নতুন একটি নাম পরিচয় থাকলে সব দিক থেকেই সে নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে। নুরে ছফার হাত থেকে তো বাঁচবেই, এমন কি দেশে গিয়েও থিতু হতে পারবে!

কিন্তু এরকম কাজের জন্য দক্ষতার চেয়েও বেশি দরকার ছিলো বিশ্বস্ত একজন ডাক্তারের। কলকাতায় ডিপি মল্লিক নামে এক প্লাস্টিক সার্জনের সাথে আসকারের বেশ ভালো জানাশোনা ছিলো। তার মাধ্যমেই কাজটা করা যাবে।

তো একদিন সেই ডিপি মল্লিকের সাথে ফোনে কথা হয়, মুশকানের কাছ থেকে জেনে নেয়, সে কী চায়। সার্জন জানায়, তার চেহারার অনেকটুকুই পাল্টে ফেলা যাবে, এর জন্যে দরকার হবে একাধিক সার্জারির। মোট কতো খরচ হবে সেটাও জানিয়ে দিয়েছিলো ভদ্রলোক। ব্যস্ত শিডিউল দেখে খুব শিগগিরই জানিয়ে দেবে কবে থেকে কাজ শুরু করবে। কিন্তু ডিপি মল্লিক ক-দিন পর যখন সল্টলেকের বাড়িতে আসে কথাবার্তা চূড়ান্ত করার জন্য তখন মুশকানের পিলে চমকে দেয়।

আমি জানি আপনি কে! রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননির সেই কুক!…সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে এসছেন!…পুলিশ আপনাকে খুঁজছে!

মুশকান স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, কলকাতার এই সার্জন চিনে ফেলবে তাকে। সত্যিটা হলো, বেশ কয়েক বছর আগে, রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে, ডাক্তার আসকারের আমন্ত্রণে অরিয়েন্ট হাসপাতালে প্লাস্টিক সার্জারির উপরে একটি সেমিনারে অংশ নিতে ঢাকায় গিয়েছিলো ডিপি মল্লিক, তখন ডাক্তারই তাকে সুন্দরপুরে নিয়ে গিয়ে রবীন্দ্রনাথে লাঞ্চ করান। কিন্তু ঘটনা এখানে থেমে থাকলে সমস্যা হতো না। এই ডিপি মল্লিক নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টসহ তার পেইজে ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’ নামের অদ্ভুত রেস্টুরেন্টের ছবি আর খাবারের প্রশংসা করে পোস্ট দিয়েছিলো। এই পোস্টে সুন্দরপুরের এক তরুণ কমেন্ট করে, সেই সূত্রে সার্জনের সাথে তার পরিচয়ও হয়, ঠাঁই করে নেয় ভদ্রলোকের ফ্রেন্ডলিস্টে। পরবর্তীতে ঐ তরুণই তাকে জানিয়েছিলো, কী এক কারণে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মালেকিন সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে যাবার পর রেস্টুরেন্টটি বন্ধ হয়ে গেছে। মহিলা এখন ফেরারি আসামি। তবে ঠিক কী কারণে পুলিশ তাকে খুঁজছে সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে।

এরকম খবর শোনার পর ভোজনরসিক মল্লিক একটু কষ্টই পেয়েছিলো, সেই সাথে কৌতূহলিও হয়েছিলো মুশকানের ব্যাপারে। এরকম গুণী মহিলা কী এমন কাণ্ড করলো যে, তাকে ফেরারি হতে হলো!

ডাক্তার আসকার তাকে অনুরোধ করে বলেছিলেন, তমান্না রহমান নামে তার এক আত্মীয়ার সার্জারি করে দিতে হবে, সে এখন কলকাতায়ই আছে। কাজটা করতে হবে সর্বোচ্চ গোপনীয়তার সাথে। কিন্তু সল্টলেকের বাড়িতে মুশকানকে দেখেই ডিপি মল্লিক চিনে ফেলে এ হলো ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’র সেই বিখ্যাত কুক! যার খাবার খেয়ে এবং যাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলো। ডিপি মল্লিকের বুঝতে সমস্যা হয়নি ঘটনা আসলে কী-মুশকান গুরুতর কোনো অপরাধ করে দেশ থেকে পালিয়ে এখানে চলে এসেছে।

মুশকান প্রথমে ভেবেছিলো লোকটা ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করবে, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সার্জন জানায়, তার চাওয়া খুবই সামান্য একটু সান্নিধ্য পেতে চায় তার! আর কিছু না।

এর অর্থ বুঝে নিতে কোনো সমস্যাই হয়নি তার। প্রস্তাবটি পেয়ে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, বরং একটু ভেবে, লোকটাকে অবাক করে দিয়ে জানায়, সে রাজি আছে তবে কিছু শর্ত আছে তার। উদগ্রীব হয়ে মল্লিক জানতে চায় শর্তগুলো কি। মুশকান জানায়, এটা একবারই হবে, এর পর আর কখনও ব্ল্যাকমেইল করবে না, কোনোভাবেই না! এই ব্যাপারটা পুরোপুরি গোপন রাখতে হবে, যেমন গোপন রাখতে হবে তার প্লাস্টিক সার্জারির কথাটাও। যতো দ্রুত সম্ভব করে দিতে হবে সেটা!

ডিপি মল্লিক কোনো রকম কালক্ষেপন না করেই শর্তগুলো মেনে নেয়। তবে সে-ও পাল্টা একটি শর্ত দিয়ে বসে : মুশকানের সান্নিধ্য পাবার সাথে সাথে তার হাতের জাদুকরি রান্নার আস্বাদনও নিতে চায়।

তিন দিন পর এক সন্ধ্যায় সল্টলেকের বাড়িতে হাজির হয় সার্জন। মুশকান প্রথমেই ডিপি মল্লিকের কাছে জানতে চায়, এখানে আসার কথাটা সে গোপন রেখেছে কিনা। মল্লিক তাকে আশ্বস্ত করে, এ কথা কেউই জানে না। আলাপচারিতা শুরুর এক পর্যায়ে ডিপি মল্লিক জানায়, কয়েক বছর আগে মুশকানকে সে স্বল্প সময়ের জন্য দেখেছিলো তার রেস্টুরেন্টে, ডাক্তার আসকার তাকে পরিচয় করে দিয়েছিলেন তখন। সেই থেকেই নাকি তার প্রতি তীব্র কৌতূহল আর আকর্ষণ বোধ করছিলো। মুশকান স্মিত হেসেছিলো কেবল। সত্যি বলতে, ডাক্তারের সাথে তার পরিচয়পর্বের কথা মনে নেই। রবীন্দ্রনাথে প্রায়শই এরকম গেস্ট আসতো, সবার কথা মনে রাখা সম্ভব নয়।

সন্ধ্যা একটু গাঢ় হলে সার্জনকে খাবারের টেবিলে আমন্ত্রণ জানায় সে, তার জাদুকরি রান্নার স্বাদ গ্রহণ করে ডিপি মল্লিক। কিন্তু খাবারের চেয়েও তার কাছে লোভনীয় ছিলো মুশকানের সান্নিধ্য! ডিনার শেষে রেড ওয়াইনের বোতলের ছিপি খোলে মুশকান। লালচে মদের মাদকতায় আচ্ছন্ন ডিপি মল্লিকের লালসা প্রকট হয়। অস্থির হয়ে মুশকানকে জাপটে ধরে ফেলে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে বলে-এভাবে না। রুচিশীল মানুষের মতো যেনো আচরণ করে। ধীরে ধীরে, মার্জিতভাবে!

ডিপি মল্লিক নিজের এমন ছেলেমানুষি আচরণের জন্য লজ্জিত বোধ করে। মুশকান যেভাবে চায় সেভাবেই হবে-ধীরে ধীরে! কিন্তু রাত গাঢ় হবার আগেই সার্জন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এক সময় পুরোপুরি নিথর।

রেড ওয়াইনে কোনো বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশায়নি মুশকান। বাড়ির ছাদে যে ঔষধি বাগানটা আছে, সেখানে একটি টবে প্রাণঘাতী বিষাক্ত অরিয়েন্ডার ছিলো, সেটার ফুল খুবই বিষধর, মল্লিকের গ্লাসে সেই ফুলের রস মিশিয়ে রেখেছিলো। ধীরে ধীরে ওটা সমস্ত শরীর অবশ করে দেয়। মল্লিকের ফোনটা চেক করে দেখে সে। তার ফেসবুকে ঢোকাটা যে এতো সহজ হবে কল্পনাও করতে পারেনি-সার্জন ফেসবুক থেকে লগ অফ করার ধার ধারতো না। মল্লিকের আইডিটা ডিলিট করে দেয়, নষ্ট করে ফেলে ফোন আর সিমটা। পাল্স চেক করে দেখে সার্জন তখনও বেঁচে আছে। নিস্তেজ মল্লিকের ঘাড়টা মটকে দিতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি।

ডিপি মল্লিককে অপচয় করার মতো বোকামি করেনি সে। সার্জনের বয়স, সুস্বাস্থ্য, সব কিছুই তার শিকার হবার জন্য উপযুক্ত ছিলো। তাই প্রয়োজনীয় প্রত্যঙ্গটি রেখে মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে একটি প্লাস্টিকের ড্রামে রেখে দেয়। আগের দিনই এরকম একটি খালি কেমিক্যালের ড্রাম আর কয়েক কেজি চুন কিনে এনেছিলো দারোয়ানকে দিয়ে, বলেছিলো ছাদের বাগানে পানি সংরক্ষণ করবে, চুনগুলো ব্যবহার করবে সার হিসেবে।

চুন আর পানি মিশিয়ে ডিপি মল্লিকের দেহের খণ্ডিত অংশগুলো ড্রামে রেখে দেয়। তিন তলার অ্যাটাচড বাথরুমে সেই ড্রামটি এক মাসের মতো রাখা ছিলো। সে জানতো, মাসখানেক পর ড্রাম খুললে দেখতে পাবে চুনের সাথে গলেটলে সব একাকার হয়ে গেছে-ঘন তরল ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। আর ঠিক সেটাই হয়েছিলো। মুশকান সেই ঘন আর ভারি তরল বাথরুমের কমোডে ঢেলে ফ্ল্যাশ করে দেয়, পৃথিবীর বুক থেকে উধাও হয়ে যায় দয়াল প্রসাদ মল্লিক!

বাড়ির দারোয়ান যাতে কিছু বুঝতে না পারে সেজন্যে সামান্য একটু চালাকি করেছিলো মুশকান। সার্জনকে ঘায়েল করার পর রাতের এক পর্যায়ে দারোয়ানকে দরকারি একটা জিনিস কিনতে পাঠিয়ে দেয় সে। লোকটা ফিরে এলে জানায়, গেস্ট চলে গেছে, সে যেনো মেইনগেটটা তালা মেরে বন্ধ করে দেয় আজকের মতো।

ডিপি মল্লিকের অন্তর্ধানের খবরটি পত্রপত্রিকায় এসেছিলো, তারপর সংবাদপত্র জগতের নিয়ম মেনে ওটা খুব দ্রুতই উধাও হয়ে যায় অন্য কোনো খবরের ভীড়ে।

মল্লিকের অন্তর্ধানের প্রায় পাঁচ-ছয় মাস পর ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ যখন কলকাতায় এলেন মুশকান তাকে সব খুলে বলেছিলো। সব শুনে নিজেকেই দায়ী মনে করেন ডাক্তার-অনেক বছর আগে, মল্লিককে যে রবীন্দ্রনাথে নিয়ে গেছিলেন এটা তার মনেই ছিলো না। মুশকান অবশ্য তাকে প্রবোধ দিয়ে বলেছিলো, এখানে তার কোনো দোষ নেই। অনেক দিন আগের কথা, মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু এরপর দিন বিকেলেই, একেবারে বিনা নোটিশে সুদূর লন্ডন থেকে চলে আসে তার একমাত্র সন্তান সুস্মিতা। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনার পাট না চুকিয়েই লন্ডনে চলে গেছিলো সে। অস্থিরচিত্তের এই মেয়ে বুঝতে পারছিলো না কোথায় সেটেল করবে। এ নিয়ে ডাক্তারও খুব চিন্তায় ছিলেন। মেয়েকে তিনি জানিয়েছিলেন, তার এক বন্ধুর মেয়েকে কিছু দিন সল্টলেকের বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। আমেরিকান প্রবাসী এই মেয়ে রবীন্দ্রনাথের উপরে গবেষণার কাজে কয়েকটা মাস কলকাতায় থাকবে।

সুস্মিতা জানতো না তার বাবাও এখন কলকাতায় আছে। বাড়িতে এসে দারোয়ানের কাছ থেকে এটা জানতে পেরে খুবই অবাক হয়েছিলো সে। কিন্তু তার বিস্ময় দ্রুত বদলে যায় সন্দেহে, যখন বাবাকে ঘরে দেখতে পায় না। অন্য কিছু সন্দেহ করে সে। কৌতূহল থেকে দোতলায় উঠে যায় চুপিসারে। তার বাপাই আর ঐ মহিলা গেস্টের কথা শুনে থমকে যায়। ডাক্তার কিংবা মুশকান কেউই অতোটা সতর্ক ছিলো না, ফলে তাদের বেশির ভাগ কথাই শুনে ফেলে সুস্মিতা। সব শুনে বিস্ময়ে থ বনে যায় সে। বাপাই আর ঐ গেস্ট টের পাবার আগেই নিজের ঘরে ফিরে আসে দ্রুত। বলা বাহুল্য, তাকে দেখে ডাক্তার ভুত দেখার মতোই চমকে উঠেছিলেন। মেয়েকে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, জরুরী একটা কাজে কলকাতায় এসেছেন কয়েক দিনের জন্যে। সুস্মিতাও জানায়, হুট করেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শান্তিনিকেতনের কোর্সটা শেষ করবে এবার। ডাক্তার আর এ নিয়ে কিছু বলেননি। কিন্তু সন্দেহ তৈরি হয়ে গেছিলে সুস্মিতার মধ্যে।

তার বাপাই বলেছিলো, ঐ গেস্টের নাম তামান্না রহমান, কিন্তু আসকার তাকে মুশকান বলে সম্বোধন করছিলেন! একজন প্লাস্টিক সার্জনকে নিয়েও কথা বলছিলো তারা। সবটা শুনতে না পেলেও, যেটুকু বুঝেছে, ঐ লোক মুশকান নামের মহিলাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছিলো।

বাপাই কেন মহিলার নামটা মিথ্যে বলেছে? আর কীসের জন্য তাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে ঐ সার্জন?-সবটা তার কাছে পরিস্কার ছিলো না, সে কারণেই মুশকানের ব্যাপারে প্রচণ্ড কৌতূহলি হয়ে ওঠে সুস্মিতা। আরেকটা ব্যাপার তার মনে খটকার সৃষ্টি করে : তার মায়ের বহু পুরনো ছবির অ্যালবামে মুশকানের মতো একজনকে সে দেখেছে অনেক দিন আগে! মায়ের মৃত্যুর পর স্মৃতি সংরক্ষণের সমস্ত প্রিন্টেড ছবিগুলোর ডিজিটাইজ করে ফেলেছিলো লন্ডনে থাকতেই, সেগুলো ফটো অ্যালবাম বানিয়ে স্টোর করে রেখেছিলো তার ল্যাপটপে।

ঐদিনই ফটো অ্যালবামটি ঘাঁটতে শুরু করে দেয় সে। অনেক ছবি, অনেক স্মৃতি। কিছুক্ষণ পরই সুস্মিতা আবিষ্কার করে, তার বাবা-মায়ের, দু জনেরই কমনফ্রেন্ড হলো এই মুশকান! মুশকান সোহেলি! বেশ কয়েকটি ছবির পেছনে তার মা নিজেদের নামের সাথে ওই নামটাও লিখে রেখেছিলো। কিন্তু সেই ছবিগুলো সুস্মিতার জন্মেরও আগে, প্রায় ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের পুরনো! এতগুলো বছরে মহিলার মধ্যে কোনো পরিবর্তনই হয়নি!

সুস্মিতা জানে না কততক্ষণ সে হতভম্ব হয়ে বসেছিলো। এটা কী করে সম্ভব! কিভাবে ঐ মহিলা এতোগুলো বছরেও একই রকম আছে? আড়াল থেকে শোনা তার বাপাই আর মুশকানের কথাবার্তার অনেক কিছুই বোধগম্য ছিলো না, ছবির অ্যালবাম দেখার পর সেগুলো আরো দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। সুস্মিতার মনে পড়ে যায়, এক পর্যায়ে রহস্যময়ী ঐ মহিলা তার বাবাকে বলেছিলো, পরশু ডিনারের আয়োজন করবে। কথাটা শুনে তার বাপাইর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারচেয়েও বড় কথা, মহিলার বলা ‘ডিনার শব্দটির উল্লেখও কেমন ইঙ্গিতপূর্ণ ছিলো!

এর পরই সুস্মিতা চালাকি করে বাবাকে বলে, আগামীকাল মুকুন্দপুরে এক বন্ধুর বাসায় ডিনারের দাওয়াত আছে, ফিরতে একটু রাত হবে। কথাটা শুনে তার বাপাই খুশিই হয়েছিলো বলেই তার ধারণা। কিন্তু পরদিন সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেও রাত সাড়ে আটটার আগেই ফিরে আসে। বাপাইকে ঘরে দেখতে না পেয়ে চুপিসারে উঠে যায় তিন তলায়।

তাদের বাড়ির তিন তলার কেবলমাত্র একটি অংশে বড় একটা ঘর তুলেছিলো তার পারমিতা মাসি। সিঁড়ির ডান পাশে, ছাদের বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে ঔষুধি গাছের বাগানও করেছিলো। মাসি মারা যাবার পর থেকে সেটার আর যত্ন নেয়া হয়নি। তবে সে দেখতে পায়, মুশকান তাদের বাড়িতে ওঠার পর বেশ যত্ন নিয়েছে বাগানটার।

বাগানের উত্তরে, সিঁড়ি ঘরের পেছন দিকে সরু একটা প্যাসেজ চলে গেছে, ওটা থেমেছে ছাদের পুবদিকে একমাত্র ঘরটির পশ্চিম দিকের দেয়ালে গিয়ে। দেয়ালের একেবারে উপরে ছোট্ট একটি ভেন্ট্রিলেটর আছে, বাগানে থাকা একটা চেয়ার ব্যবহার করেও পাঁচ ফিট চার ইঞ্চির সুস্মিতার পক্ষে সেই ভেন্ট্রিলেটরে চোখ রাখা সম্ভব হয়নি। দ্রুত নীচতলায় চলে যায় সে, চেয়ারের মতো কিছু না পেয়ে আফ্রিকান বাদ্যযন্ত্র কাহনটা চোখে পড়ে তার। গানবাজনার প্রয়োজনে শখ করে কিনেছিলো ওটা। চেয়ারের উপর বাক্স সদৃশ কাহনটা রেখে তার উপরে দাঁড়ানোর পর ভেন্ট্রিলেটর দিয়ে ঘরের ভেতরের দৃশ্যটা দেখতে পায় সুস্মিতা।

তার বাপাই আর মুশকান সোহেলি নামের ঐ মহিলা ডিনার করছে। তাদের মধ্যে খুব কমই কথা হচ্ছিলো তখন। ডিনারের শেষে মুশকান বিশেষ একটি বাটি হাতে নিয়ে রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকায় আসকার ইবনে সায়িদের দিকে। সুস্মিতা দেখতে পায়, তার বাপাইর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বাটির খাবারটা যে মাংসজাতীয় কিছু সেটা বুঝতে পেরেছিলো দূর থেকেও। সেই রান্না করা মাংসের অনেকটুকু অংশ তার বাপাইর পাতে তুলে দেয় মহিলা, তারপর রেড ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে চিয়ার্স করে।

এ সময় সুস্মিতাকে অবাক করে দিয়ে তার বাপাই বলে ওঠে : “সার্জনেরটা?”

মুশকান শুধু মাথা নেড়ে সায় দেয়।

সার্জনেরটা মানে?? এ প্রশ্ন যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তখনই তার বাবার আরো কিছু কথা তাকে আগ্রহী করে তোলে।

“তাহলে তোমার সার্জারির ব্যাপারটা কী করবে?”

“সেটা কি এখানে করা সম্ভব?”

ডাক্তার আসকার একটু ভেবে নেন। “সাউথ কোরিয়াতে খুব সহজেই করা যাবে। ওখানে এসব কাজ প্রচুর হয়…ভালো সার্জনও আছে অনেক।”

“এখান থেকে কিভাবে যাবো? আমার পাসপোর্ট দিয়ে তো এখানে আসিনি। দেশে গিয়ে ওটা ইউজ করাও যাবে না…খুবই রিস্কি।”

“এখানকার পাসপোর্ট করা যাবে, কিন্তু সময় লাগবে একটু। ততোদিন–হয় অপেক্ষা করো?”

“হুম।”

কিছুক্ষণ চুপচাপ দু-জনেই খেয়ে যায় ঐ রহস্যময় খাবারটি।

“সার্জনেরটা দিয়ে কতোদিন চলবে?” খাবারের বাটিটার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন ডাক্তার।

ঠোঁট ওল্টায় মুশকান। “দু-জনের জন্য দুবারের বেশি হবে না।”

কথাটা শুনে ডাক্তারের চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে। “তাহলে এর পর কী করবে?”

মুশকান কোনো জবাব না দিয়ে মুখে খাবার নিয়ে ভেবে যায় কিছুক্ষণ। “চিন্তা কোরো না…একটা ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু এখানে আর কিছু করা ঠিক হবে না। শহর এলাকা…বুঝতেই পারছো।”

“হুম।” খেতে খেতে বলেন ডাক্তার।

“সার্জনেরটা ঘটনাচক্রে পেয়ে গেছি, নইলে এখানে কিছু করার কথা ভাবিনি।”

মাথা নেড়ে সায় দেন আসকার। “তোমার পাসপোর্টটা করা লাগবে দ্রুত। আমি একজনের সঙ্গে কথা বলেছি, ও বলেছে করে দিতে পারবে।”

প্রসঙ্গ পাল্টায় মুশকান। “আচ্ছা, তোমার মেয়ে হুট করে চলে এলো কেন? কিছু হয়েছে নাকি?”

ঠোঁট ওল্টান আসকার। “ও তো কিছু বলেনি।” একটু থেমে আবার বলেন, “ও ওর মায়ের মতোই একটু খেয়ালি স্বভাবের হয়েছে। যখন যা ইচ্ছে তা-ই করে।”

“আমাদেরকে নিয়ে সন্দেহ করছে না তো?”

অবাক হন ডাক্তার। “কীসের সন্দেহ করবে? আমি স্যুয়োর্ধ্ব এক বৃদ্ধ, আর তুমি আমার মেয়ের বয়সী,” বলেই হেসে ফেলেন। “ও জানে তুমি আমার বন্ধুর মেয়ে, সন্দেহ করার প্রশ্নই ওঠে না।”

“তুমি ধরেই নিয়েছো, তুমি যা বলেছে ও সেটা বিশ্বাস করে নেবে?”

“নিতে হবে, কারণ তোমার সাথে আমার ওরকম কোনো সম্পর্ক নেই।”

“কিন্তু ও সেটা না-ও বুঝতে পারে?”

“ওর কথা বাদ দাও। ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না। দেখবে, কিছু দিন পরই লন্ডনে ফিরে গেছে। ও খুব অস্থির…দ্রুত বোরিং হয়ে যায়।”

মুশকান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জানতে চায়, “আচ্ছা, তুমি তো প্রায় পাঁচ বছর ধরে খাচ্ছো, কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করছো কি?”

“না,” কথাটা বলেই মুচকি হাসি দেন ডাক্তার। “কোনো পরিবর্তনই লক্ষ্য করছি না!”

মুশকানও হেসে ফেলে। “তাহলে তো তোমার বেলায়ও কাজ করতে শুরু করেছে!”

রেডওয়াইনের গ্লাসটা তুলে নেন ডাক্তার। “থ্যাঙ্কস ইউ, ফ্রেন্ড।” একটু থেমে তার বাপাই আবার বলে, “আমার নার্ভও আগের চেয়ে স্ট্রং হয়েছে।”

আশ্বস্ত করার হাসি দিয়েছিলো মুশকান।

বাবা আর ঐ রহস্যময়ী নারীর কথাবার্তা শুনে সুস্মিতার পা দুটো টলে গেছিলো, আরেকটুর জন্যে চেয়ারের উপরে রাখা কাহন থেকে পড়েই যেতো সে।

ওদের আরো কিছু কথাবার্তা থেকে যা বুঝতে পারে-ঐ মহিলা একজন সার্জনকে কিছু করেছে, আর সেটা তাকে ব্ল্যাকমেইল করার শাস্তি হিসেবে। কিন্তু লোকটাকে কী করেছে না জানলেও, এটা বুঝতে বাকি নেই, সে আর এই জগতে বিচরণ করছে না! তার চেয়েও বড় কথা, অজ্ঞাত একটি রেসিপি খেয়ে নিজের যৌবন ধরে রেখেছে, মহিলা আসলে তার বাবার বয়সী প্রায়! আর তার বাপাইও পাঁচ বছর ধরে এই রেসিপিটা খাচ্ছে। কিন্তু বয়স ধরে রাখার এই গোপন কৌশলটা কী সেটা আন্দাজ করতে গিয়ে সুস্মিতা ধন্দে পড়ে যায়। ওদের কিছু কথা ঘুরপাক খেতে থাকে তার মাথায় :

সার্জনেরটা? সার্জনেরটা দিয়ে কতদিন চলবে?

গা শিউরে ওঠে তার। দুর্নিবার কৌতূহলে আক্রান্ত হয় সে। সত্ত্বর বছরের এক নারী! অথচ দেখলে মনে হবে প্রায় তার বয়সী কেউ!

কয়েক দিন পর তার বাপাই আবার কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে যান। এর পর সুস্মিতা অন্য একটি কৌশল বেছে নেয় : মুশকানের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে শুরু করে সে। দেখতে তারা প্রায় সমবয়সী, একই বাড়িতে থাকে, সুতরাং ঘনিষ্ঠতা হতে সময় লাগেনি। একসাথে তারা কলকাতা এবং এর আশেপাশে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। তাদের অখণ্ড অবসরে কেনাকাটা, বাজার করা, সিনেমা-থিয়েটার দেখা, এসব হয়ে ওঠে নিয়মিত কাজ। বাড়িতে সুস্মিতার বন্ধুদের আড্ডা বসলে সেখানে মুশকানও যোগ দিতে শুরু করে। সুস্মিতা তাকে তার কাজিন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় বন্ধুদের কাছে।

বেশ ভালো গান করে সুস্মিতা, কিছু বাদ্যযন্ত্রও বাজাতে পারে। তার ঘরে সেতার, হারমোনিয়ামসহ কিছু ইট্রুমেন্ট আছে। সে অবাক হয়ে দেখে, তার মতোই রবীন্দ্রনাথের বিরাট ভক্ত মুশকান, আর গানও গায় চমৎকার। রাতে, ডিনারের পর তারা দুজন একের পর এক গান করে সময় কাটিয়ে দিতে। খুব দ্রুতই মুশকানের মধ্য আরেকটি গুণ আবিষ্কার করে সুস্মিতা-তার হাতের রান্না অসাধারণ!

সুস্মিতা দীর্ঘদিন লন্ডনে থেকেছে, ইউরোপ-আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে গেছে, নানা রকম খাবারের সাথে সে পরিচিত, ভারতীয় খাবারও কম চেখে দেখেনি, কিন্তু মুশকানের হাতে এক একটি পদ যেনো অমৃত। তাদের বাসায় এক মহিলা কুক এসে রান্না করে দিয়ে যেতো, কিন্তু সেসব খাবার খুব একটা ভালো লাগতো না সুস্মিতার। মুশকানের জাদুকরী হাতের রান্নার স্বাদ পাবার পর থেকে তার খাওয়ার রুচি বেড়ে যায়।

একদিন কী একটা কাজে মুশকান বাইরে গেলে সুস্মিতা হানা দেয় তিন তলায়। আগেই মুশকানের ঘরের চাবির ছাপ নিয়ে রেখেছিলো সাবানের টুকরোর উপরে, সেটা থেকে নকল একটা চাবিও বানিয়ে নিয়েছিলো। ঐ চাবি দিয়ে ঘরে ঢুকে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করে সে, কিন্তু রহস্যময় সেই খাবারটি আর পায় না। অবশেষে বইয়ের সেফের দিকে নজর যায় তার। মুশকানের ঘরে প্রচুর বইপুস্তক। বুকসেলফের প্রতিটি বই সরিয়ে সরিয়ে দেখে সুস্মিতা। অবশেষে রবীন্দ্রনাথের কাব্যসমগ্রের পেছনে দেখতে পায় সেই বয়ামটি-তার বাপাইকে যেখান থেকে রহস্যময় খাবার তুলে দিয়েছিলো মুশকান। বয়ামটা খুলে দেখে, অনেকটা আচারের মতো সামান্য। কিছু বস্তু আছে তখনও, তবে সে জানতো, ওগুলো আচার নয়। খাবারটা দেখে তার মধ্যে এক ধরণের ভীতি জেগে ওঠার কথা, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যৌবন দীর্ঘায়িত করার তীব্র আকাঙ্খর কাছে সেই ভীতি পরাভূত হয়। ঐ রহস্যময় বস্তুটার এক টুকরো মুখে দিতেই বুঝতে পারে, মুশকানের জাদুকরী হাতের ছোঁয়া এখানেও বজায় রয়েছে।

এটা কীসের মাংস? সার্জনের! ভাবনাটা আসতেই তার গা শিউরে ওঠে। নাকি অন্য কিছু?! তড়িঘড়ি বয়ামটার মুখ লাগিয়ে জায়গামতো রেখে দেয় সে। যদিও তার লোভ জেগেছিলো আরেকটু চেখে দেখার, কিন্তু নিজেকে বিরত রাখে বহু কষ্টে, নইলে মুশকান টের পেয়ে যাবে।

এক বিকেলে অটো থেকে নেমে বাসায় ঢোকার সময় সুস্মিতাকে তার। নাম ধরে কেউ ডেকে ওঠে। অবাক হয়ে দেখে, তার শান্তিনিকেতনের এক বন্ধুর বন্ধু সুকুমার রঞ্জনকে। বেশ কবছর আগে তাদের বন্ধুদের সার্কেলটি যখন দলবেধে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলো তখন এই ছেলেটার সাথে পরিচয় হয়। সুকুমার জানায়, সে কয়েক দিন আগে কলকাতার এক ডেটা অ্যানালিসিস ফার্মে জয়েন করেছে। কী একটা কাজে এসেছিলো সল্টলেকে। সৌজন্যতার খাতিরে সুস্মিতা তাকে সমাদ্দার ভিলায় নিয়ে এসে কফি দিয়ে আপ্যায়ন করে। এই ঘটনার পর ছুটির দিনে প্রায়ই সুকুমার আসতে শুরু করে তাদের বাড়িতে। সুস্মিতার সাথে তার বন্ধুত্বটাও গাঢ় হতে শুরু করে।

এমনই এক রবিবার সন্ধ্যায় সুকুমার আসে সমাদ্দার ভিলায়। সুস্মিতার যে ভালো হুইস্কির প্রতি আসক্তি ছিলো সুকুমার সেটা জানতো, তাই সঙ্গে করে প্রিয় ব্র্যান্ডের হুইস্কি নিয়ে এসেছিলো সে। ঐ দিন কী একটা কাজে বাড়ির বাইরে গেছিলো মুশকান। বাড়িতে দারোয়ান ছাড়া আর কেউ ছিলো না। দোতলার বিশাল ড্রইংরুমে বসে সুস্মিতা আর সুকুমার হুইস্কি পান করতে শুরু করে। মদ্যপানের এক পর্যায়ে সুকুমার আবেগাক্রান্ত হয়ে জানায়, সুস্মিতার প্রেমে পড়ে গেছে সে।

সুকুমার রঞ্জন দেখতে স্মার্ট আর শিক্ষিত একটি ছেলে, যথেষ্ট ভালো চাকরি করে-সুস্মিতাও বেশ পছন্দ করে তাকে, কিন্তু তারপরও সুকুমারকে ফিরিয়ে দেয় সে। ছোটোবেলা থেকেই টমবয়, ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে সাইকেল-বাইক চালাতো। মাউন্টেনিং করা, মার্শাল আর্ট শেখা, খেলাধূলা, সবই করেছে। তার ছেলেবন্ধুদের কেউ যে তার দিকে অন্যদৃষ্টিতে তাকায়নি তা নয়, তবে সুস্মিতা এ ধরণের ব্যাপারগুলো পাত্তাই দিতো না কখনও।

প্রত্যাখ্যাত হয়ে সুকুমার হতাশ হয়ে জানতে চায়, সে কোনদিক থেকে তার অযোগ্য?-অনেক চাপাচাপির পর সুস্মিতা অবশেষে নিজের সেই গোপন কথাটা জানায়, যা আর কাউকে এর আগে কখনও বলেনি।

আমি সম্ভবত লেসবিয়ান!

কথাটা শুনে হতভম্ব হয়ে পড়ে সুকুমার।

পনেরো-ষোলো বছর বয়স থেকেই সুস্মিতা টের পেয়েছিলো, ছেলেদের প্রতি উঠতি বয়সী মেয়েদের যে স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে সেটা তার মধ্যে নেই। কিন্তু সময় গড়ালে বুঝতে শুরু করে, কিছু কিছু মেয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করছে! তবে নিজের সেক্সয়াল অরিয়েন্টেশন নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিতও ছিলো না।

এ কথা শুনে কিছুক্ষণ ভেবে নেয় সুকুমার। “তুমি তাহলে পুরোপুরি শিওর নও?”

এমন প্রশ্নে দ্বিধায় পড়ে গেলেও মাথা নেড়ে সায় দেয় সুস্মিতা, আর তখনই সুকুমার অদ্ভুত একটি প্রস্তাব দেয় তাকে : তার সাথে কিছুক্ষণ ফোরপ্লে করবে, সুস্মিতা যদি জেগে না ওঠে তাহলে ধরে নেবে সে আসলেই লেসবিয়ান। আর জেগে উঠলে বুঝবে, ওটা আসলে দীর্ঘদিন টমবয়গিরি করার ফলে সৃষ্ট এক ধরণের আচরণগত সমস্যা-সমকামীতা নয় মোটেও।

সুস্মিতা ধন্দে পড়ে যায়, হুইস্কির প্রভাবে তখন কিছুটা বেসামালও, তার এই সিদ্ধান্তহীনতার সুযোগ নিয়ে তাকে আদর করতে শুরু করে। সুকুমার, ধীরে ধীরে খুলে ফেলে শরীর থেকে সব পোশাক। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সুস্মিতা বুঝতে পারে, সুকুমারের এমন স্পর্শেও তার শরীর সাড়া দিচ্ছে না। কেমন গা ঘিনঘিন করা অনুভূতি তৈরি হচ্ছে বরং! সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে বসে সে।

“না, সুকুমার…না! থামো!”

আকুতিভরা কণ্ঠে বলেছিলো সে, কিন্তু মাঝপথে এভাবে বাধা পেয়ে ক্ষেপে যায় সুকুমার, জোরাজুরি করতে শুরু করে দেয়। এক পর্যায়ে সুস্মিতা চিৎকার দিতে চাইলে তার মুখ চেপে ধরে। একটু আগের বন্ধু মুহূর্তে ধর্ষকে পরিণত হয়। কিন্তু সুস্মিতার চিৎকার নীচের গেটের কাছে থাকা দারোয়ানের কানে পৌঁছায় না।

ড্রইংরুমে বন্ধুবান্ধব নিয়ে মাঝেমধ্যেই গানবাজনা করতো সুস্মিতা, আশেপাশের বাড়ির বাসিন্দাদের কাছে এটা উৎপাত মনে হতে পারে বলে ওর এক মিউজিশিয়ান বন্ধু ঘরটা পুরোপুরি সাউন্ডপ্রুফ করে দিয়েছিলো কিছু দিন আগে। সুতরাং, সে বুঝতে পারে, তার চিৎকার কিংবা ধস্তাধস্তির আওয়াজ নীচে যাচ্ছে না, দারোয়ানের কানে সেটা পৌঁছাবেও না, তখন প্রবলভাবে বাধা দেবার চেষ্টা করে, কিন্তু শক্তিতে পেরে ওঠে না। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই মার্শাল আর্টের দক্ষতা প্রয়োগ করে সুকুমারের কুঁচকিতে হাটু দিয়ে আঘাত করে বসে। তীব্র ব্যথায় ঝাঁকিয়ে ওঠে ছেলেটা, রেগেমেগে সুস্মিতার গালে চড়থাপ্পড় মারতে শুরু করে দেয়, সেই সঙ্গে উগলে দেয় জঘন্য সব খিস্তি। পাশবিক শক্তি নিয়ে আবারো ঝাঁপিয়ে পড়ে সে।

অনেক চেষ্টা করেও সুকুমারকে পরাস্ত করতে পারেনি সুস্মিতা, তীব্র ভীতিতে আক্রান্ত হয় সে। শৈশব থেকে যে আতঙ্ক নিয়ে প্রতিটি মেয়ে বেড়ে ওঠে, সেই ধর্ষণ যখন অনিবার্য, তখনই দেখতে পায়, হাতের কাছে হুইস্কির বোতলটা পড়ে আছে। সুকুমার তখন এক হাত দিয়ে তার মুখটা চেপে ধরে রেখেছে, অন্য হাত দিয়ে নিজের উদ্যত অঙ্গটি প্রবেশ করাতে ব্যস্ত। আর কোনো উপায় না পেয়ে, হুইস্কির বোতলটা হাতে তুলে নেয়, সুকুমারের মাথার পেছনে সজোরে আঘাত করে বসে। পর পর বেশ কয়েকটি। কতোগুলো, সে নিজেও জানে না!

কিছুক্ষণ পরই টের পায়, উপগত হওয়া সুকুমার নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। প্রায় অসাড়! হাফ ছেড়ে বাঁচে সে। কিন্তু যখন বুঝতে পারে, ছেলেটা একদমই নড়ছে না তখন ভড়কে যায়। মুশকান যে একজন মেডিকেল ডাক্তার এতো দিনে সেটা জেনে গেছিলো। সম্ভবত এতোক্ষণে বাড়িতে ফিরেও এসেছে। ব্রা আর পেন্টি পরা অবস্থায়ই দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে তিন তলায় চলে যায় সে, দেখতে পায় মুশকান সবেমাত্র ঘরে ফিরে এসে ফ্রিজ খুলে সজি আর ফলমূল রাখছে। সুস্মিতাকে এরকম অবস্থায় দেখে যারপরনাই বিস্মিত হয় সে। সুস্মিতা হরবর করে তাকে জানায় কী হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে দোতলায় নেমে আসে মুশকান, সুকুমারের পাস চেক করে দেখে সে, কিন্তু ততোক্ষণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে ছেলেটি।

মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভাবতে শুরু করে মুশকান। পুলিশকে খবর দিলে, তারা জেনে গেলে কী হতে পারে সেটা তার চেয়ে ভালো আর কেউ জানতো না। সুস্মিতা যদি সব কিছু স্বীকারও করে, আইনের কাছে নিজেকে পুরোপুরি নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে, কারণ আত্মরক্ষার জন্যে কাউকে আঘাত করা যেতে পারে, রাগের মাথায় হুট করে মেরে বসাও স্বাভাবিক, কিন্তু সুকুমারের মাথা যেভাবে থেতলে গেছে, সেটা স্পষ্ট বলে দেবে, সুস্মিতা কেবল আত্মরক্ষার জন্যে আঘাত করেনি! তার উদ্দেশ্য ছিলো হত্যা করা! যদিও ভালো একজন আইনজীবী নিয়োগ দিলে সে হয়তো যুক্তিতর্ক দিয়ে আদালতকে বোঝাতে পারবে, ওরকম মুহূর্তে মারাত্মক ‘প্যানিল্ড’ হয়ে সাময়িক হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো মেয়েটি। আদতে যে সেরকমই কিছু হয়েছিলো, তাতে অবশ্য মুশকানের কোনো সন্দেহ ছিলো না। কিন্তু পুলিশের কাছে সব খুলে বললেও মেয়েটি মামলা মোকদ্দমার হয়রানি থেকে বাঁচতে পারবে না। সামাজিকভাবে খুনি হিসেবে তকমা পাওয়া থেকেও রক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠবে। তার চেয়েও বড় কথা, সুস্মিতার কাছ থেকে যখন জানতে পারে, সুকুমারের বাবা একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, তখন মুশকান বুঝে যায়, আইনের মারপ্যাঁচে ফেলে, অপব্যবহার করে মেয়েটার জীবন বিষিয়ে তুলবে ঐ লোক। নিজের সন্তান যে ধর্ষক না সেটা প্রমাণ করার জন্য যা করার তাই করবে।

এদিকে বাড়িতে তার উপস্থিতিও একটা সমস্যা। পুলিশ তার ব্যাপারেও জানতে চাইবে, খোঁজ নেবে। আর সেরকম কিছু কী হতে পারে, ভালো করেই জানতো মুশকান। সে যে অবৈধভাবে কলকাতায় এসেছে, মিথ্যে পরিচয় নিয়ে বাস করছে, এসব জেনে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। এরকম ঝুঁকি সে-ও নিতে পারে না।

সুস্মিতার বাবা আসকারের সাথে আর যোগাযোগ করেনি মুশকান। ভালো করেই জানতো, দূর থেকে বেচারা না পারবে কোনো বুদ্ধি দিতে, না পারবে কোনো সাহায্য করতে। তাই মুশকান সিদ্ধান্ত নেয়, বন্ধুর মেয়েকে বাঁচাতে হবে। যে বন্ধু তাকে বিপদে আপদে বার বার রক্ষা করেছে, সাহায্য করেছে, তার মেয়েকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতেই হবে।

সুস্মিতাকে আশ্বস্ত করে সে-চিন্তার কিছু নেই। সব কিছু সামলে নেবে সে। এর পর সুকুমারের নিথর দেহটা দু-জনে মিলে ধরাধরি করে তিন তলায় নিয়ে যায়। ডিপি মল্লিককে যেভাবে উধাও করেছিলো ঠিক একই কায়দায় সুকুমারকেও উধাও করে মুশকান।

এই ঘটনার কয়েক দিন পর, এক বিকেলে কী একটা দরকারে বাইরে গেছিলো মুশকান, কিন্তু অনেকটা পথ যাবার পর বুঝতে পারে টাকা রাখার পার্সটা ফেলে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে ফিরে আসে সে। আর তখনই একটি দৃশ্য দেখে ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে ওঠে : তার ঘরে বইয়ের শেফের পেছনে লুকিয়ে রাখা সেই বয়ামটার মুখ খুলছে সুস্মিতা!

হাতেনাতে ধরা পড়ার পর মেয়েটা ঘাবড়ে না গিয়ে বরং মুশকানকেই ভড়কে দেয়।

“আমিও তোমার মতো হতে চাই!”

কয়েক মুহূর্তের জন্য মুশকান কথাটার মানে বুঝতে পারেনি।

“দীর্ঘ যৌবন পেতে চাই!”

ভুরু কুঁচকে যায় তার। বিস্ময়ে, অবিশ্বাসে!

“আমি তোমার সব কথা জানি!”

তারপরই সুস্মিতা তাকে অভয় দিয়ে বলতে শুরু করে-একেবারে আন্দিজের ঘটনা থেকে শুরু করে সার্জনকে গুম করা, তার বাপাইর সাথে রহস্যময় খাবার খাওয়া, তাদের অদ্ভুত সেই কথোপকথন, সর্বোপরি দীর্ঘ দিন ধরে মুশকান যে নিজের যৌবন ধরে রেখেছে-সব। থ বনে যায় মুশকান। সুস্মিতার জায়গায় অন্য কেউ হলে তাকে হয়তো ডিপি মল্লিকের মতোই কিছু করতো, কিন্তু এই মেয়ে তার সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর একমাত্র সন্তান!

পরিহাসের হাসি ফুটে উঠেছিলো হয়তো তার ঠোঁটে। সুস্মিতার মা শুভমিতা ছিলো তার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু এক সময় সতর্কতার কারণেই নিজেকে সেই বন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলো সে, চলে গেছিলো ইউরোপের অন্য একটি দেশে, সেখান থেকে নিজদেশে। কোনো রকম যোগাযোগ রাখেনি সে। আসকার তার স্ত্রীকে বলেছিলো, মুশকান কোনো এক বিদেশিকে বিয়ে করে কোথায় চলে গেছে সে নিজেও জানে না। মুশকান যদি এভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে না নিতো তাহলে শুভমিতাও টের পেয়ে যেতো তার বয়স বাড়ছে না! নিয়তির নির্মম পরিহাস, এখন সেই শুভমিতার মেয়েই কিনা জেনে গেলে সেটা!

কয়েক মুহূর্তের জন্য ভীষণ অসহায় বোধ করে সে। বুঝতে পারে, এখন সুস্মিতাকে না পারবে ভুলভাল ব্যাখ্যা দিতে, না পারবে তার মুখ বন্ধ রাখতে-তার কাছে কেবল একটাই পথ খোলা আছে: মেয়েটাকে নিজেদের দলে নিয়ে নেয়া-এতোদিন যে দলটির সদস্য ছিলো মাত্র দু-জন : সে আর আসকার।

যাই হোক, সব কিছু সামাল দেবার পরই ডাক্তারকে মুশকান জানিয়েছিলো, নির্জন বাড়িতে একা পেয়ে সুস্মিতার এক ছেলেবন্ধু তাকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিলো, মেয়েটা বাধা দেবার চেষ্টা করলে ঘটনাচক্রে ঐ ছেলে মারা যায়। সব শুনে হতভম্ব হয়ে পড়েন ডাক্তার। মুশকান আরো জানায়, সুস্মিতাকে বাঁচানোর জন্য যা করার তা-ই করেছে। এখন দ্রুত এ বাড়ির দারোয়ানকে বদলে ফেলতে হবে আগাম সতর্কতার অংশ হিসেবে, কারণ সুকুমার যে এ বাসায় এসেছিলো সেটা দারোয়ান দেখেছে। মুশকান। জানতো, পুলিশ খুব শিগগিরই জেনে যাবে সুকুমারের বন্ধু ছিলো সুস্মিতা। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বাড়িতে চলে আসবে হয়তো। তখন সুস্মিতা অস্বীকার করে বলবে, ঐদিন সুকুমার এ বাড়িতে আসেনি। কিন্তু এখনকার দারোয়ান থাকলে সমস্যা। পুলিশ তার কাছ থেকে এটা জেনে যাবে। এ ঝুঁকি নেয়া যায় না।

মুশকানের কথাটা বুঝতে পারেন আসকার। শুভমিতার বড়বোন পারমিতা মারা গেলে সমাদ্দার ভিলার দেখাশোনা করতো সুস্মিতার মায়ের দূরসম্পর্কের এক কাজিন, ভদ্রলোক থাকে বারাসাতে। তার মাধ্যমেই নতুন একজন দারোয়ান নিয়োগ দেন ডাক্তার।

মুশকানের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে একদিন সমাদ্দার ভিলায় হাজির হয় পুলিশ। সুকুমার রঞ্জনের নিখোঁজ কেসে সুস্মিতাকে জেরা করে তদন্তকারী অফিসার। সুস্মিতা জোর দিয়ে বলে, সুকুমারের সাথে ওইদিন তার দেখা হয়নি। সে কেন সল্টলেকে এসেছিলো তা-ও জানে না। তারপরও পুলিশ তাকে বলে দেয়, কলকাতার বাইরে গেলে সে যেনো লোকাল থানায় অবশ্যই ইনফর্ম করে।

পুলিশ বাড়ি থেকে বের হবার পর তিন তলায় নিজের ঘরের জানালা দিয়ে মুশকান দেখে, তাদের বাড়ির দারোয়ানের সাথে সাথে কথা বলার পর আশেপাশের বাড়িগুলোর দারোয়ানদের সাথেও কথা বলছে ঐ তদন্তকারী অফিসার। পুলিশ চলে যেতেই মুশকান ঐ দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়, ইন্সপেক্টর কী জানতে চেয়েছিলো তার কাছে।

সমাদ্দার ভিলার আগের দারোয়ানের নাম-ঠিকানা? আর লোকটা সেই তথ্য দিয়েও দিয়েছে!

সতর্ক হয়ে ওঠে মুশকান। সুকুমারের কেসে যে সুস্মিতা ফেঁসে যাবে বুঝতে পারে, আর সেটা হলে প্রকারান্তরে সে নিজেও ফেঁসে যাবে-লাশটা তো সে-ই গুম করেছে!

আসকারকে ফোন করে সব জানায় সে। ডাক্তার তাদের সাময়িক আশ্রয়ের একটি ঠিকানা দিয়ে দিলে তড়িঘড়ি দরকারি সব জিনিসপত্র নিয়ে সুস্মিতা আর সে বাড়ি ছাড়ে ঐ দিনই।

সন্ধ্যার দিকে আবারো বাড়িতে পুলিশ আসে। এবার ঐ অফিসারের হাতে শক্ত প্রমাণ আছে-সুস্মিতা পুলিশকে মিথ্যে বলেছে। সুকুমার রঞ্জন নিখোঁজ হবার আগে শেষ যে জায়গায় গেছিলো সেটা সল্টলেকের সমাদ্দার ভিলা! কিন্তু ততোক্ষণে বাড়ির বাসিন্দারা কোথায় চলে গেছে দারোয়ানও জানাতে পারেনি।

এ ঘটনার পর দিনই আসকার ঢাকা থেকে চলে আসেন কলকাতায়, পরিচিত এক লোকের মাধ্যমে, টাকার বিনিময়ে মুশকান আর সুস্মিতাকে বর্ডার পেরিয়ে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তিনি।

মুশকান যেহেতু ঢাকা শহরে নিরাপদ নয়, ছফার চোখে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে, তাই তাকে অন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিয়ে, সুস্মিতাকে ঢাকার বনানীর বাড়িতে তোলেন তিনি। এই বাড়িটা আর কারোর নয়, রাশেদ জুবেরির পৈতৃক বাড়ি। রাশেদের মৃত্যুর পর মুশকানের সম্পত্তি হয়ে ওঠে বাড়িটা। ওখানে কিছু দিন থাকার পরই হাপিয়ে ওঠে সুস্মিতা। এরকমই এক সময়ে সুন্দরপুরের নতুন স্কুল পরিদর্শন করতে গেলে মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে যান আসকার। তখন ট্রাস্টি রমাকান্তকামার কথায় কথায় জানান, সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্কুলের জন্য একজন গানের টিচার খুঁজছেন। এ কথা শোনার পর ডাক্তারের মাথায় আসে নিজের মেয়ের কথা। প্রস্তাবটা পেয়ে লুফে নেয় সুস্মিতা। প্রকৃতি তার কাছে সব সময়ই ভালো লাগে, আর সুন্দরপুর স্কুলটাও তার কাছে ছিলো এক টুকরো শান্তিনিকেতনের মতোই।

.

অধ্যায় ৯৮

অভিজাত এলাকা বারিধারায় এসে নুরে ছফা আকাশের দিকে তাকালো। বৃষ্টি শেষে সব মেঘ উধাও হয়ে গেছে, এখন বিশাল ফাঁকা শূন্যতা মাথার উপরে। শহরের উপর দিয়ে বইছে ঠাণ্ডা বাতাস। তার শরীরে লেপ্টে আছে ভেজা জামা-কাপড়।

বিগত দেড়-ঘণ্টা ধরে সে আর তার সহকারী জাওয়াদ ভীষণ ব্যস্ত। পিএসের বাড়ির সিসিক্যাম ফুটেজ দেখা থেকে শুরু করে তাদের অনুসন্ধান, সেখানে মুশকান জুবেরির ফুটেজ পেয়েছে। আরো দেখেছে, বাড়ি থেকে বের হবার পর মহিলা কোথায় গেছে সেটাও। তবে পিএস, কেএস খান আর আসলামের ফোন নাম্বারগুলো পুলিশের টেলিকমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টে ট্র্যাক করার জন্য দিলে তারা জানায়, সবগুলো ফোনই বন্ধ আছে এখন।

উদ্বিগ্ন ছফা কেএস খানের ল্যান্ডফোনে কল দিয়ে জেনে নিয়েছে, আইনস্টাইন পুরোপুরি সুস্থ আছে। মি. খান জানতে চেয়েছিলো, এখন কী অবস্থা, ছফা তাকে বলেছে, এ মুহূর্তে সে ব্যস্ত আছে মুশকানকে ধরার কাজে, পরে তাকে সব জানাবে।

যাই হোক, পিএসের অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান যেরকমটি বলেছে, মুশকান কিছুটা পথ হেঁটে সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকারে গিয়ে ওঠে। এটা তারা দেখেছে রাস্তায় বসানো ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের সিসিক্যামগুলো থেকে। পিএসকে দিয়ে ছফা তাদেরকে অনুরোধ করেছে, এই ট্র্যাক ডাউনের কাজে যেনো তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করা হয়।

গুলশানসহ এর আশেপাশের এলাকাগুলোতে অসংখ্য বিদেশি দূতাবাস আর আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অফিসসহ বিদেশি নাগরিকদের বসবাস রয়েছে, সেখানকার রাস্তার সিসিক্যামগুলো অবশ্যই সচল থাকবে-যেমনটি শহরের অন্য অংশে থাকে না। ডিএমপি’র ক্যামেরায় গাড়ির ফুটেজ পেলেও বৃষ্টির কারণে প্লেট-নাম্বারটা স্পষ্ট বোঝা যায়নি। তবে ছফা তাদেরকে বলে দিয়েছে, সময়ের হিসেব করে গাড়িটাকে ট্র্যাক করে যেতে। জাওয়াদের কানে ইয়ারফোন লাগানো আছে, ডিএমপি’র কন্ট্রোল রুমের সাথে কানেক্টেড আছে সে। কিছুক্ষণ পর পর সেখান থেকে আপডেট দেয়া হচ্ছে তাকে। তাদের থেকে তথ্য পেয়েই ছফারা চলে এসেছে গুলশান দুই নম্বর থেকে বারিধারার লেকের পাশ দিয়ে যাওয়া ইউনাইটেড ন্যাশন রোড হিসেবে পরিচিত জায়গাটিতে। সেখান থেকে বারিধারার এগারো নাম্বার রোডে।

কিন্তু ছফার একটাই আশঙ্কা মনে, যেকোনো মুহূর্তে ডিএমপি থেকে জানানো হবে, গাড়িটার কোনো খোঁজ পাচ্ছে না, কারণ অমুক রাস্তার পর তাদের সিসিক্যামগুলো বিকল হয়ে আছে। কিংবা সেখানে আদৌ কোনো সিসিক্যাম নেই!

“স্যার, আরো সামনে গেছে,” জাওয়াদ বললো।

তাদের বাইকটা এগারো নাম্বার রোডের পূর্ব দিকে এগিয়ে গেলো। চার রাস্তার মোড়ের কাছে এসে বাইকটা থামালো সে। আরেকটু সামনে এগোলে প্রগতি সরণী, আর ডান থেকে বাঁয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটার নাম পার্ক রোড।

“ওকে,” ইয়ারফোনে কিছু শুনে বললো জাওয়াদ। “ডানে গেছে।” বলেই বাইকটা নিয়ে ডান দিকে ছুটে গেলো। কিছুটা পথ গিয়েই থামলো সে। “স্যার, অবশেষে গাড়িটার প্লেটনাম্বার স্পষ্টভাবে দেখা গেছে, উত্তেজিত হয়ে বললো সহকারী। ইয়ারফোনে শুনে আবার বললো, “ঢাকা-ট ১১-২৫৭৭।”।

বাইক থেকে নেমে পড়লো ছফা। “ওদেরকে বলে দাও এই নাম্বারটা যেনো এক্ষুণি পুলিশ আর ট্রাফিকের সবগুলো পেট্রল টিমের কাছে সাকুলেট করে দেয়। ট্রাফিক কন্ট্রোলরুমেও জানিয়ে দিতে বলো!” ছফাও উত্তেজিত হয়ে পড়েছে খবরটা শোনার পর। “গাড়িটা যেখানেই পাবে সেখানেই যেনো আটকে দেয়। ভয়ঙ্কর এক খুনি খুন করে এই গাড়িতে করে পালাচ্ছে।”

জাওয়াদ সেটাই করলো।

নির্জন রাস্তায় পায়চারী করছে ছফা। সিনিয়রের উত্তেজনা টের পেয়ে বাইকটা স্ট্যান্ড করে চলে এলো জাওয়াদ।

“স্যার, সিগারেট খাবেন?” সে ভালো করেই জানে, টেনশনের মুহূর্তে সিগারেট না খেলে তার বসের অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়।

“হুম,” সংক্ষেপেই বললো নুরে ছফা। একটা সিগারেটের বড্ড দরকার এখন। তার প্যাকেটটা অনেক আগেই ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।

পকেট থেকে প্যাকেট বের করে ছফার দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিলো। সিগারেটটা ঠোঁটে চেপে ধরতেই জাওয়াদ তার লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলো তাতে। পর পর বেশ কয়েকটি লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো ছফা।

“ডিএমপি এতো দেরিতে আপডেট দিচ্ছে কেন?”

জাওয়াদ এর জবাব না দিয়ে ইয়ারফোনে বললো, “এনি আপডেট?” তার মুখটা কালো হয়ে গেলো। “পুরো রাস্তার সবগুলোই অচল?”

চমকে উঠলো ছফা।

“আচ্ছা, আরো সামনে দেখুন…হুম,” কথাটা বলেই সিনিয়রের দিকে তাকালো।

“কি হয়েছে?”

“এই পার্ক রোডের বাকি সিসিক্যামগুলো নাকি বিকল।”

হতাশ হয়ে পড়লো ছফা। একটু আগেই এরকম আশঙ্কা করেছিলো সে। সিগারেটে জোরে জোরে কয়েকটা টান দিলো।

এমন সময় জাওয়াদ আবার ইয়ারফোনে মনোযোগ দিলো। “হুম…বলেন…” মাথা দোলালো। “পার্কের মোড়েরটা?…তাই নাকি!”

ছফার ভুরু কুঁচকে গেলো।

মাথা নেড়ে সায় দিলো সহকারী, সিনিয়রের দিকে তাকালো সে। “স্যার, সামনে পার্কের যে মোড়টা আছে, তার ডানদিকে আট নাম্বার রোডটা চলে গেছে, ওখানকার সিসিক্যামে গাড়িটার কোনো ফুটেজ পাওয়া যায়নি!”

.

অধ্যায় ৯৯

ডিএমপির সিসিক্যামে গাড়িটার যে কোনো ফুটেজ পাওয়া যায়নি তাতে ছফার হতাশ হবার কথা কিন্তু তার বদলে সে আশার আলো দেখতে পেলো।

জাওয়াদকে নিয়ে আরো সামনে এগিয়ে গেলো সে। যেতে যেতেই দেখলো পার্কের বাঁ দিকের প্রায় সব বাড়ির মেইনগেটেই সিসিক্যাম আছে।

“এখানে বাইকটা থামাও,” পেছন থেকে বললো ছফা, নেমে পড়লো সে। পার্কের বিপরীতে যতোগুলো বাড়ি আছে গুণে দেখলো। “দশ বারোটা।”

রাস্তাটা পূর্ব-পশ্চিমমুখি। ডিএমপির ফুটেজে দেখা গেছে, এই রাস্তায় গাড়িটা ঢুকেছে। কিন্তু পুরো রাস্তায় যেহেতু ডিএমপির কোনো ক্যামেরা কাজ করছে না তাই ছফা একেবারে পুবদিকের বাড়িটার সিসিক্যাম চেক করে দেখার সিদ্ধান্ত নিলো।

ওই বাড়ির সিসিক্যামে গাড়িটার কোনো ফুটেজ না পেয়ে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার মুখ। মানেটা তার কাছে পরিস্কার-এই দশ বারোটা বাড়ির যেকোনো একটাতে ঢুকে পড়েছে ঐ গাড়িটা!

“লোকাল থানায় ফোন করে একটা ব্যাকআপ টিম পাঠাতে বলল, দ্রুত!” জাওয়াদকে তাড়া দিলো সে।

ছেলেটা তাই করলো, তবে সরাসরি লোকাল থানায় ফোন করলো না সে। ডিমএমপি’কে জানিয়ে দিলো অনুরোধটি। পিএস আশেক মাহমুদের ডিএমপিকে আগেই বলে দিয়েছিলো, তাদেরকে সব ধরণের সহযোগীতা করার জন্য।

“কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে, স্যার।” জাওয়াদ বললো।

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। এ জায়গাটা তাকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে-রাস্তার ডান পাশে পার্ক, বাঁ-দিকে এক সারি আবাসিক ভবন। সংখ্যায় দশ বারোটা হবে। রাস্তার দু-পাশে বাড়ি থাকলে এই সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে যেতো।

গভীর রাতে বারিধারার পার্ক রোডে প্রবল উত্তেজনায় সিগারেট খেতে খেতে পায়চারী করতে লাগলো ছফা। পার্কের বিপরীতে থাকা বাড়িগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার। এইসব বাড়িগুলোর যেকোনো একটাতেই আছে। মুশকান জুবেরি। সম্ভবত সুস্মিতাও।

তার থেকে একটু দূরে স্ট্যান্ডের উপর রাখা আছে জাওয়াদের বাইকটা। সে আবারো ডিএমপি’র সাথে কথা বলে যাচ্ছে। এখানকার থানার যে কয়টি পুলিশ পেট্রল টিম আছে তাদের সবচেয়ে কাছেরটা পাঠানোর অনুরোধ জানাচ্ছে এবার। সে-ও বুঝতে পারছে, ঘটনার গুরুত্ব।

ছফা অধৈর্য হয়ে হাতঘড়ির দিকে তাকালো। স্থানীয় থানায় ব্যাকআপ চেয়ে কল করার পর তিন-চার মিনিট সময় অতিক্রান্ত হলেও এরইমধ্যে বেশ কয়েক বার ঘড়ি দেখে ফেলেছে।

ছফার দিকে এগিয়ে এলো জাওয়াদ। “এক্ষুণি এসে পড়বে, স্যার।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “ওর কাছে পিস্তল আছে।”

সহকারী বুঝতে পারলো কার কথা বলছে। আমাদের কাছেও আছে।”

“তারপরও, খুব সাবধানে থাকতে হবে। আমি কোনো রকম ক্যাজুয়ালটি চাই না।”

“জি, স্যার।”

“আমরা যদি লোকেট করতে পারি, এখানে কোন্ বাড়িতে মুশকান আছে তাহলে ধরে নাও, সে কাউকে জিম্মি করতে পারে…খুবই মরিয়া হয়ে উঠবে সে…ধরা দিতে চাইবে না।”

জাওয়াদ কিছু বলতে যাবে, অমনি দেখতে পেলো দূরের রাস্তা দিয়ে ছুটে আসছে স্থানীয় থানার ব্যাকআপ টিম। ছফাও সেদিকে তাকালো। জোরে জোরে সিগারেটে টান দিয়ে কয়েক পা সামনের দিকে এগিয়ে গেলো সে। পুলিশের একটা জিপ আর পিকআপভ্যান এসে থামলো তার সামনে। গাড়ি থেকে পাঁচ-ছয়জন পুলিশ নেমে এলো, স্যালুট দিলো ছফাকে।

দলটির নেতৃত্বে যে এসআই আছে তার বুকে নেমপ্লেটে লেখা আছে। সমীর। সে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিলো।

“এখানকার দশ-বারোটা বাড়ি সার্চ করতে হবে,” সিগারেটে টান দিয়ে বললো ছফা। “আমরা সার্চ টিম হিসেবে কাজ শুরু করবো এখন।”

“জি, স্যার।”

“আসুন আমার সাথে,” বলেই পুলিশের ছোটোখাটো দলটি নিয়ে সামনের একটি বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো ছফা। “এই বাড়ি থেকে এক এক করে সবগুলো বাড়ি সার্চ করবো।”

“সাসপেক্ট কয়জন, স্যার?”

“একজন,” সুস্মিতাকে বিপজ্জনক হিসেবে দেখছে না সে। “তবে মহিলা দেখে আন্ডারএস্টিমেট করবেন না।”

মহিলা সাসপেক্টের কথা শুনে সমীর নামের এসআই বেশ অবাক হলো।

“সাসপেক্টের কাছে পিস্তল আছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো পুলিশ।

“মহিলা দেখতে ত্রিশ-বত্রিশের মতো,” জানিয়ে দিলো ছফা।

নিজের টহল দলের দিকে ফিরলো এসআই। “সাসপেক্ট মহিলা। ত্রিশের মতো বয়স। পিস্তল আছে তার কাছে। সবাই সাবধান!” এরপর ছফার দিকে ফিরলো সে। “চলুন, স্যার।”

নিজের কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে সেফটি লক খুলে রাখলো নুরে ছফা। এটা দেখে এসআই সমীরও তার পিস্তলটা হোলস্টার থেকে বের করে নিলো। একই কাজ করলো জাওয়াদ।

কিন্তু ছফার নেতৃত্বে প্রথম বাড়িটার মেইগেটের সামনে এসে কলিংবেল বাজাতেই ঘরঘর একটা শব্দ শুনতে পেলো তারা। পাশ ফিরে তাকালো সবাই। তাদের থেকে পাঁচ-ছয়টা বাড়ির পরের বাড়িটার মেইনগেট খোলা হচ্ছে ভেতর থেকে। তারপরই সেখান থেকে বের হয়ে এলো সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকার-যে গাড়িটাকে ছফা এতোক্ষণ ধরে খুঁজছে!

গাড়ির হেডলাইট জ্বালানো নেই, ইনসাইড লাইটও বন্ধ। তাই দেখা গেলো না কে চালাচ্ছে-পেছনের যাত্রিই বা কারা। দেরি না করে ছফা পিস্তল হাতেই দৌড়ে গেলো সেদিকে। জাওয়াদ আর বাকি পুলিশের দলটিও একই কাজ করলো।

কিন্তু ছফা চিৎকার করে পিস্তল উঁচিয়ে গাড়িটাকে থামার জন্য বলতেই সেটা আচমকা গতি বাড়িয়ে ছুটে গেলো রাস্তার ডান দিক দিয়ে। পলায়নরত গাড়িটাকে গুলি করবে কিনা দ্বিধায় পড়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত পিস্তল নামিয়ে সহকারীর বাইকের দিকে ছুটে গেলো সে। জাওয়াদও ততোক্ষণে দৌড়ে চলে এসেছে তার বাইকের কাছে।

“আপনারা আপনাদের গাড়িতে উঠুন!” চিৎকার করে পুলিশের টহল দলটিকে বললো ছফা।

বাইকটা স্টার্ট দিতেই পেছনে উঠে বসলো নুরে ছফা। জাওয়াদ সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলো গাড়িটাকে ধরার জন্য।

নির্জন রাতে এরকম জনমানবশূন্য রাস্তায় প্রচণ্ড গতি তুলতে কার্পণ্য করলো না গাড়িটা। জাওয়াদও পাল্লা দিয়ে গতি বাড়িয়ে দিলো তার বাইকের। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গাড়িটার প্রায় পেছনে চলে এলো তারা। ছফা পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করার ভঙ্গি করলো সতর্কতার অংশ হিসেবে, যাতে ড্রাইভার সাইডমিরর দিয়ে দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়।

কিন্তু গাড়িটা যে চালাচ্ছে সে অনেক বেশি মরিয়া। গতি আরো বাড়িয়ে দিলো সে। পেছনে তাকিয়ে ছফা দেখতে পেলো, ব্যাকআপ টিমের জিপ আর ভ্যানটা তাদের পিছু পিছু আসছে।

“তুমি গাড়িটার ডানদিকে থাকো!” চিৎকার করে বললো ছফা।

জাওয়াদ তাই করলো, গতি বাড়িয়ে প্রাইভেটকারটার ডানদিকের ড্রাইভিং ডোরের সমান্তরালে নিয়ে এলো তার বাইকটা। ইনসাইড লাইট বন্ধ থাকার কারনে ঘন কালো কাঁচের ভেতর দিয়ে ছফা দেখতে পেলো না গাড়িতে যাত্রি হিসেবে কে আছে, কে চালাচ্ছে ওটা। তবে সে নিশ্চিত, মুশকান জুবেরি বসে আছে সেখানে। সঙ্গে হয়তো সুস্মিতাও!

ছফা যে বাড়িগুলো তল্লাশি করবে সেটা সম্ভবত দেখে ফেলেছে জানালা দিয়ে, বুঝে গেছে বাড়িতে থাকলে নির্ঘাত ধরা পড়ে যাবে, তাই ঝুঁকি নিয়ে হলেও গাড়িতে করে পালানোর চেষ্টা করেছে।

পিস্তলটা আবারো উঁচিয়ে ধরলো সে-একেবারে ড্রাইভিং ডোরের কাঁচ বরাবর। আর তখনই গাড়িটার গতি আরেকটু বেড়ে গেলো, সেই সঙ্গে দ্রুত চাপতে শুরু করলো ডানদিকে। বাইকের গতি কমিয়ে গাড়িটার পেছনে চলে আসতে বাধ্য হলো জাওয়াদ, নইলে গাড়িটার সাথে ধাক্কা খেতো তার বাইক।

জাওয়াদ তার বাইকের গতি কমিয়ে প্রাইভেটকারের পেছনে চলে আসতেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারলো, কিন্তু ততোক্ষণে বড় দেরি হয়ে গেছে। গাড়িটা আচমকা গতি কমিয়ে, সজোরে ব্রেক কষে ফেললো। জাওয়াদ না পারলে তাল মিলিয়ে গতি কমাতে, না পারলে ঠিক সময়ে ব্রেক কষতে। তার বাইকের সামনের চাকা গাড়ির পেছনের বাম্পারে গিয়ে সজোরে আঘাত হানলো।

জাওয়াদ দেখতে পেলো, বাম্পারের সাথে আঘাত লাগতেই তার বাইকের সামনের চাকা বামদিকে ঘুরে গেলো পুরোপুরি! হাত থেকে ছুটে গেলো বাইকটার নিয়ন্ত্রণ, সজোরে বাড়ি খেলো গাড়ির বুটের সাথে। জাওয়াদ শুধু টের পেলো তার ডান পা-টায় জোরে আঘাত লেগেছে, সেই সঙ্গে শুনতে পেলো নুরে ছফার চিৎকারটা : “জাওয়াদ!”

বাইকসহ রাস্তায় পড়ে গেলো জাওয়াদ আর ছফা। তবে পেছনে বসার কারণে গাড়ির সাথে আঘাত হানার আগেই লাফিয়ে রাস্তায় পড়ে গেছিলো নুরে ছফা। তাদের কারোরই মাথায় হেলমেট নেই, ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে যেতো আরেকটুর জন্যে। ছফা দেখতে পেলো, জাওয়াদ বাইকসহ পড়ে গেলেও তার মাথা রাস্তার পিচে গিয়ে আঘাত হানেনি। তবে ছেলেটার ডান পা আহত হয়েছে নির্ঘাত।

রাস্তায় পড়ে থেকেই ছফা দেখতে পেলো সাদা রঙের গাড়িটা আচমকা ব্রেকমুক্ত হয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে গেলো আবার। রাস্তায় আছড়ে পড়লেও হাত থেকে পিস্তলটা বেহাত হয়নি ছফার। রাস্তায় শুয়ে থাকা অবস্থায়ই সে গাড়ি লক্ষ্য করে পর পর দুটো গুলি চালালো। নিস্তব্ধ এলাকা প্রকম্পিত হলো গুলির শব্দে। তার লক্ষ্য ছিলো গাড়িটার পেছনের চাকাদুটো, কিন্তু একটা গুলিও লক্ষ্যভেদ করতে পারলো না। গতি বাড়িয়ে গাড়িটা ছুটে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ব্যাকআপ টিমের জিপ আর ভ্যানটা দূর থেকে দেখেছে সব কিছু। জিপটা ছফাদের অতিক্রম করে চলে গেলেও ভ্যানটা থামলো তাদের কাছে

এসে। গাড়ি থেকে তিন-চারজন পুলিশ নেমে এলো দ্রুত।

“ওকে দেখো,” জাওয়াদকে দেখিয়ে বললো সে, হাত-পা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দেখতে পেলো বাইকের নীচে চাপা পড়ে আছে জাওয়াদের একটা পা। পুলিশদের দু-জন বাইকটা ধরে তুলে ফেললো, অন্য এক জন তুলে দাঁড় করালো জাওয়াদকে। ডান পা-টা সামান্য শূন্যে তুলে রেখেছে। সে।

“তুমি ঠিক আছো?”

“পা-টা ভেঙে গেছে মনে হয়,” তীব্র যন্ত্রণায় চোখমুখ কুঁচকে বললো ছেলেটা।

“ওকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যাও,” পুলিশদের বললো ছফা।

অমনি একজন পুলিশের ওয়াকিটকি ঘর্ঘর শব্দ করে উঠলো, একটা কণ্ঠ বলে উঠলো : “চার্লি টু। আমরা গাড়িটা আটকে ফেলেছি…এগারো নাম্বার রোডের শেষে…প্রগতি সরণীতে যাবার আগে যে মোড়টা আছে সেখানে!”

“স্যার, ওরা গাড়িটাকে আটকে ফেলেছে!”

ওয়াকিটকিটা পুলিশের কাছ থেকে প্রায় কেড়ে নিলো ছফা। “চার্লি টু…সাবধান! গাড়িতে যে মহিলা আছে সে খুবই ডেঞ্জারাস! আগেই বলেছি, ওর কাছে পিস্তল আছে! সবাই সাবধান! আমি আসছি।” জাওয়াদের দিকে ফিরলো চট করে। “কাছের একটা হাসপাতালে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স আসতে বলো…আমি ভ্যানটা নিয়ে যাচ্ছি।”

“সাবধানে, স্যার!” জাওয়াদ বললো।

কিন্তু নুরে ছফা সেটা শুনলো কি শুনলো না বোঝা গেলো না, সে ততোক্ষণে পুলিশের পিকআপ ভ্যানের ড্রাইভিং সিটের পাশে উঠে বসেছে। ভ্যানটা চলতে শুরু করলো দ্রুত।

এগারো নাম্বার রোডের মোড়ের কাছে আসতেই ছফা দেখতে পেলো, সাদা রঙের প্রাইভেটকারটি রাস্তার বামপাশে থেমে আছে, আর তার সামনে আড়াআড়ি করে রাখা আছে পুলিশের জিপটা। তিনজন পুলিশ সেই জিপকে ঢাল বানিয়ে নিজেদের রাইফেল আর পিস্তল তাক করে রেখেছে প্রাইভেটকারটার দিকে।

পুলিশের পিকআপ ভ্যানটা প্রাইভেটকারের দশ গজ পেছনে এসে থেমে গেলো, দ্রুত পিস্তল হাতে নেমে পড়লো ছফা। টের পেলো হাটু আর বাম কনুইতে ব্যথা করছে। সম্ভবত ছিলে গেছে। এসব তুচ্ছ বিষয়কে পাত্তা না দিয়ে সে অরক্ষিতভাবেই পিস্তল হাতে এগিয়ে গেলো গাড়িটার দিকে।

সাদা রঙের গাড়িটার সব দরজা বন্ধ, ভেতর থেকে কেউ তখনও বের হয়ে আসেনি। পুলিশের একজন ওয়ার্নিং দিচ্ছে চিৎকার করে : “অস্ত্রটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দাও!”

“স্যার, সাবধানে!”

পুলিশদের মধ্যে আরেকজন বলে উঠলো, কিন্তু ছফা গ্রাহ্যই করলো না। প্যাসেঞ্জার ভোরের দিকে পিস্তল তাক করে হুঙ্কার দিলো সে : “দরজা খোলো, মুশকান!”

কোনো সাড়া না পেয়ে ছফা আবারো হুঙ্কার দিতে যাবে, অমনি খট করে ডোরলক খোলার শব্দটা শুনতে পেলো। ডান হাতের পিস্তলটা তাক করে রেখেই বাঁ হাত দিয়ে দরজার হ্যাঁন্ডেলটা টান দিলো সে।

কিন্তু পেছনের সিটে কেউ নেই।

.

অধ্যায় ১০০

কিছুক্ষণ আগে বারিধারার পার্ক রোডে অরিয়েন্ট হাসপাতালের মালিকানাধীন একটি অ্যাপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মুশকান দেখতে পায়, রাতের এ সময়েও নির্জন রাস্তায় একজন লোক সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে পায়চারী করছে আর ভবনগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তার একটু দূরেই বাইক চালক কানে ইয়ারফোন গুঁজে কথা বলে যাচ্ছে। দূর থেকে দেখলেও পায়চারী করতে থাকা নুরে ছফাকে চিনতে পারে সে!

তার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিলো, এই ডিবি অফিসার তাদের এখানকার অবস্থান জেনে গেছে, পিএসের বাড়ি থেকে বের হবার সময় বেশ সতর্ক ছিলো সে, তারপরও ছফা কিভাবে জেনে গেলো?

মুশকানের শক্ত নার্ভ আজ রাতে আরেকবার টলে গেছিলো, কিন্তু বরাবরের মতোই দ্রুত নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। জানালার পর্দার আড়াল থেকে ছফার মধ্যে অস্থিরতাও দেখতে পায় সে। বার বার ঘড়ি দেখছিলো সে। মুশকান ভড়কে না গিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ঘটনা কি-তাদের বাড়িটা এখনও চিহ্নিত করতে পারেনি, তবে যেভাবেই হোক, ডিবি অফিসার জেনে গেছে এখানকার কোনো এক বাড়িতেই আছে তারা!

দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়-এখান থেকে বেরুতে হবে। ছফার হাত থেকে বাঁচতে হবে।

কিন্তু কিভাবে?

নীচে একটা গাড়ি আছে, আসকার তার বিশ্বস্ত একজনকে পাঠিয়েছে। তাদেরকে এখান থেকে নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য। আরেকটু পরই তাদের রওনা দেবার কথা।

মুশকান গভীর করে শ্বাস নিয়ে নেয় বেশ কয়েক বার। স্নায়ুকে স্থির করে মাথা খাটাতে থাকে দ্রুত। তারপরই ঠিক করে, কী করতে হবে। চট করে ঘড়ি দেখে নেয় সে। যে কাজটা করবে, তার জন্যে সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন করে জানিয়ে দেয় ছফার কথা। তাদের পরিকল্পাটা আগের মতো থাকলেও সামান্য পরিবর্তন করতে হবে। তার কাছ থেকে সব শুনে ডাক্তার দ্রুত কাজে নেমে পড়েন।

মুশকানকে সামান্য চিন্তিত দেখে সুস্মিতা জানতে চেয়েছিলো কিছু হয়েছে কিনা, কিন্তু তাকে কিছু বলেনি। শুধু বলেছে, একটু পরই তারা এ বাড়ি থেকে বেরুবে। সুস্মিতা কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ ড্রইংরুমে গিয়ে টিভি ছেড়ে দিয়ে একের পর চ্যানেল ব্রাউজ করতে শুরু করে দেয়।

ডাক্তারের কাছ থেকে ফোন পেয়ে জানালার সামনে আবারো দাঁড়ায় মুশকান। ছফা আর তার সহযোগী কথা বলছে। আসকারকে সে বলে দেয়, কী করতে হবে। আরেকটা ফোনে ডাক্তারের সাথে তার বিশ্বস্ত লোকটা সংযুক্ত থাকায় তিনি সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেন। আর তখনই মুশকান দেখতে পায় ছফা আর তার সহযোগীর কাছে এসে দাঁড়ায় পুলিশের একটা জিপ আর পিকআপভ্যান। গাড়ি থেকে পুলিশের দলটি নেমে ছফার সাথে কথা বলতে থাকে। দৃশ্যটা দেখে ভড়কে যায় মুশকান। দেরি না করে ডাক্তারকে বলে দেয়, নীচে তার যে বিশ্বস্ত লোকটা আছে সে যেনো এখন বাড়ি থেকে বের না হয়! আসকার জানতে চান কী হয়েছে, কিন্তু মুশকান আর তাকে কিছু বলেনি, শুধু একটু অপেক্ষা করতে বলে তাকে।

এর পরই দেখতে পায়, পিস্তল হাতে পুলিশদের দলটি নিয়ে বাঁ-দিকের কয়েকটিবাড়ির পরের একটি বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ডিবি অফিসার। দ্রুত বুঝে যায় মুশকান। আর দেরি করা সম্ভব নয়। ডাক্তারকে সে বলে দেয়, তার ঐ লোক যেনো এক্ষুণি বের হয়ে যায়।

একটু পরই জানালা দিয়ে সে দেখতে পায় নীচের মেইনগেটটা খুলে ফেলছে দারোয়ান। আর গেট খোলার ঘরঘর শব্দ শুনে ছফাসহ পুলিশের দলটি সেদিকে তাকায়। কয়েক মুহূর্তের জন্য মুশকানের মনে হয়েছিলো, তার পরিকল্পনাটা বুঝি ভেস্তে গেলো। এর পরই যে গাড়িটা তাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছিলো সেটা বেরিয়ে পড়ে হেডলাইট না জ্বালিয়ে। গাড়িটা দেখামাত্রই ছফা কালক্ষেপন করেনি, পিস্তল উঁচিয়ে ছুটে যায়, গাড়িটাকে থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আসকারের বিশ্বস্ত লোকটা তখন গতি বাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করে। ছফার সহযোগী নিজের বাইকের দিকে ছুটে গিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে দেয়, ছফাও চড়ে বসে বাইকের পেছনে। পুলিশের দলটিও দৌড়ে তাদের জিপ আর পিকআপ ভ্যানে উঠে পড়ে।

এটাই চেয়েছিলো মুশকান!

সুস্মিতাকে নিয়ে দ্রুত নীচে নেমে আসে সে। বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় তারা দু-জন। আসকারের সাথে তখনও ফোনে যুক্ত ছিলো। এর আগেই তাকে বলে দিয়েছিলো, কী করতে হবে। সে জানতো, ছফাকে খুব বেশিক্ষণ ফাঁকি দিতে পারবে না আসকারের ঐ লোক। সুতরাং তাদের হাতে সময় খুব কম।

যে বাড়িতে তারা ছিলো, সেই বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা বাড়ির পরই সাত নাম্বার রোডটার মোড়। সেখানে এসে আসকারকে বলে দেয়। জায়গাটার অবস্থানের কথা, তারপর অপেক্ষায় থাকে সুস্মিতাকে নিয়ে। অরিয়েন্ট হাসপাতাল থেকে আরো আগেই একটা অ্যাম্বুলেন্স রওনা দিয়ে দিয়েছিলো বারিধারার উদ্দেশ্যে, আসকার সেই গাড়ির ড্রাইভারকে বলে দেন মুশকানদের অবস্থানের কথা।

কিছুক্ষণ পরই অরিয়েন্ট হাসপাতালের লাশ পরিবহনের কাজে নিয়োজিত সেই অ্যাম্বুলেন্সটি এসে হাজির হলে হাফ ছেড়ে বাঁচে মুশকান। সুস্মিতাকে নিয়ে দ্রুত উঠে বসতেই গাড়িটা ছুটতে শুরু করে নিঃশব্দে-ছফা আর পুলিশের দল যেদিকে গেছে, ঠিক তার বিপরীত দিক দিয়ে।

এখন নিশুতি রাতে প্রায় ফাঁকা এই শহরে দ্রুত গতিতে ছুটে যাচ্ছে সেই অ্যাম্বুলেন্সটি। গাড়ির ভেতরে ছোট্ট উইন্ডোটা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে মুশকান। রাস্তায় জ্যাম না থাকায় তাদের জন্য সুবিধাই হয়েছে। তবে সেই অস্বস্তি আবারো তাকে জেঁকে ধরেছে। কিছু একটার গন্ধ পাচ্ছে সে-ভয়ঙ্কর কিছুর।

“তুমি ওই লোকটার সাথে আর কিছু করোনি তো?” সুস্মিতার দিকে ফিরলো সে, কথাটা আর না বলে পারলো না।

“ওকে আবার কী করবো?” অবাক হবার ভান করলো মেয়েটা।

স্থিরচোখে চেয়ে রইলো মুশকান। “তুমি ভালো করেই জানো আমি কী বলতে চাচ্ছি।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো আসকারের মেয়ে। তারপর যেনো হার মানলো এমন অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো তার চোখেমুখে। “ওকে অপচয় করাটা কি ঠিক হতো?!”

মুশকানের কপালে ভাঁজ পড়লো।

“কতো কষ্ট করে ওটা কালেক্ট করেছি, জানো? গাড়ির কাঁচ ভেঙে–“

“চুপ করো!” দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো মুশকান। তারপরই কিছু একটা মনে পড়ে গেলো তার। কিন্তু তুমি কী করে এটা জানলে!?”

রহস্যময় হাসি দিলো সুস্মিতা, কিন্তু কিছুই বললো না। যেভাবে প্রথম বার ভেন্ট্রিলেটর দিয়ে তার বাপাই আর মুশকানকে ডিনার করতে দেখেছিলো, ওদের কথা শুনে ফেলেছিলো, ঠিক একইভাবে সুকুমারের ডেডবডি থেকে সিক্রেট অগ্যানটা নেবার দৃশ্যও দেখেছিলো সে।

প্রশ্নের জবাব না পেয়ে গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে আবারো জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো মুশকান। যেভাবেই হোক, মেয়েটা জেনে গেছে সিক্রেট অগানটার কথা। আর এটার পরিণাম কী হতে পারে ভেবে পেলো না সে।

“যাহ্!” এমন সময় সুস্মিতা অনেকটা আঁৎকে উঠে বললো।

চমকে তাকালো মুশকান। “কি হয়েছে?”

“তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে ওটা তো ফেলে এসেছি ওই বাড়িতে!” আফসোসের সুরে বললো।

সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো মুশকান তারপর আক্ষেপে মাথা দোলালো। তাকে মোটেও চিন্তিত দেখালো না।

“এখন কী হবে?” চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটিয়ে তুললো আসকারের মেয়ে। “তুমি ভাবতেও পারবে না, কতো কষ্ট করে ওটা কালেক্ট করেছিলাম!”

“আমি ওটার গন্ধ পাচ্ছি!” কথাটা বলে অ্যাম্বুলেন্সের ছোট্ট উইন্ডো দিয়ে আবারো বাইরে তাকালো সে। “ওটা তোমার পার্সেই আছে।”

বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো সুস্মিতা। তারপর জিভে কামড় দিয়ে বললো, “সরি!”

তার দিকে ফিরেও তাকালো না মুশকান।

.

অধ্যায় ১০১

নুরে ছফার ইচ্ছে করছে সাদারঙের প্রাইভেটকারটা যে চালাচ্ছে তার বুক গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিতে। রাগে তার শরীর কাঁপছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেলো সে।

প্যাসেঞ্জার সিটে কেউ নেই!

তাকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে। গাড়িটা যে চালাচ্ছে সে বার বার বলছে, রাত-বিরাতে ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েছে ভেবে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলো। এছাড়া তার আর কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না।

লোকটার কথা বিশ্বাস করার কোন কারণই নেই। তাকে জেরা করা হবে, গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাবার আদেশ দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের জিপে করে সে রওনা দেয় ঐ বাড়ির উদ্দেশে, যেখান থেকে এই গাড়িটা

বের হয়েছে। যদিও জানতো, ওখানে গিয়ে কিছুই পাবে না। এতোক্ষণে। তাদের সবাইকে বোকা বানিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে মুশকান জুবেরি।

আবারও!

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ছফার ভেতর থেকে। কিছুক্ষণ পরই চলে এলো পার্ক রোডের ঐ বাড়িটার সামনে। জিপ থেকে নেমে বাড়িটার দিকে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। দারোয়ান আর কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার, কিন্তু হুট করেই তার মাথায় অন্য একটা চিন্তা চলে এলো। জেরাটেরা বাদ দিয়ে নজর দিলো আশেপাশের বাড়িগুলোর দিকে। এখানকার প্রায় সবগুলো বাড়ির মেইনগেটেই সিসিক্যাম দেখতে পেলো সে। মুশকান যে বাড়িতে অবস্থান করছিলো তার পাশের বাড়িতে নক করলো সঙ্গে করে পুলিশ নিয়ে। বাড়ির দারোয়ান সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলো, ঢুলু ঢুলু চোখে অবাক হয়ে তাকালো তাদের দিকে।

“এইখানে ইউএনসিএইচআরের–”

হাত তুলে দারোয়ানের ফাঁপড়বাজি থামিয়ে দিলো ছফা। তাকে বললো, মেইনগেটের সিসিক্যামটা দেখতে চায়, আর কিছু না। বিরক্ত হলেও দারোয়ান তাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দিলো।

পনেরো মিনিট পর ঐ বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো ছফা।

একটা লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স!

এই বাড়ির মেইনগেটের সিসিক্যাম ফুটেজে দেখেছে, তারা সাদা রঙের প্রাইভেটকারটার পেছনে ছুটে যেতেই মুশকান আর সুস্মিতা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। তার কিছুক্ষণ পরই অরিয়েন্ট হাসপাতালের একটি অ্যাম্বুলেন্স চলে যায় সেদিকে। যদিও তাদেরকে সেই অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে দেখেনি, তারপরও ছফার বুঝতে বাকি রইলো না।

দাঁতে দাঁত পিষে আকাশের দিকে তাকালো। ভোরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু রাত। ঢাকা থেকে বের হবার সবগুলো পয়েন্টে গাড়িটার নাম্বার জানিয়ে দেয়া উচিত। মোবাইলফোনটা বের করে কল করতে যাবে এমন সময় রিংটোন বেজে উঠলো। ল্যান্ডফোন থেকে পিএস আশেক মাহমুদ কল দিয়েছেন।

“স্যার?”

“আসলামকে ঐ মেয়েটা…” বিমর্ষ কণ্ঠে বললো আশেক মাহমুদ, তার গলা ধরা এলো। “…মেরে ফেলেছে!”

“কি?!” যারপরনাই বিস্মিত হলো ছফা। যে লোকের সাথে সে অস্ত্র হাতে পেরে ওঠেনি, তাকে কিনা হালকা-পলকা এক মেয়ে খালি হাতে মেরে ফেললো!

পিএস আরো জানালো, পুলিশ গুলশান অ্যাভিনিউর নির্জন রাস্তায় আগুনে ভস্মীভূত একটি গাড়ির কথা জানতে পায়, ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিয়ে সেখানে দ্রুত ছুটে যায় তারা। নাম্বারপ্লেট সার্চ দিয়ে তারা জানতে পারে, ওটা পিএস আশেক মাহমুদের গাড়ি। ড্রাইভিং সিটে একজনের ভস্মীভূত দেহও খুঁজে পেয়েছে পুলিশ।

গাড়িটা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে! ছফার বিস্ময় যেনো কাটেই না।

পিএস আরো জানালো, তার অসুস্থ বোন প্রলাপ বকছে মুশকান জুবেরি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে চলে যাবার পর থেকেই। বোনের শরীর ভীষণ খারাপ। ডাক্তারকে খবর দেয়া হয়েছে। ছফাকে সাবধানে থাকার কথা বলে ফোন রাখে আশেক মাহমুদ।

কলটা শেষ হতেই কয়েক মুহূর্তের জন্য ঝিম মেরে রইলো ছফা, তারপরই কাজে নেমে পড়লো আবার। সারা দেশের সবগুলো সড়কের ট্রাফিক পুলিশকে জানিয়ে দিলো লাশবাহী কোনো অ্যাম্বুলেন্স যেখানে পাবে সেখানেই যেনো আটক করা হয়। সেই সাথে এ কথাটা বলতেও ভুলে গেলো না-ঐ গাড়িতে কোনো লাশ নেই, আছে দু-জন দুর্ধর্ষ মহিলা খুনি!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে পা বাড়ালো পুলিশের জিপটার দিকে। জাওয়াদের কী অবস্থা কে জানে। হাসপাতাল হয়ে বাসায় যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো, আর মনে মনে একটাই আশা করলো, ঢাকা থেকে বের হবার সময় কোনো চেক-পয়েন্টে যেনো ঐ অ্যাম্বুলেন্সটা ধরা পড়ে।

এ মুহূর্তে এরকম আশা করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।

.

কলটা শেষ হতেই কয়েক মুহূর্তের জন্য ঝিম মেরে রইলো ছফা, তারপরই কাজে নেমে পড়লো আবার। সারা দেশের সবগুলো সড়কের ট্রাফিক পুলিশকে জানিয়ে দিলো লাশবাহী কোনো অ্যাম্বুলেন্স যেখানে পাবে সেখানেই যেনো আটক করা হয়। সেই সাথে এ কথাটা বলতেও ভুলে গেলো না-ঐ গাড়িতে কোনো লাশ নেই, আছে দু-জন দুর্ধর্ষ মহিলা খুনি!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে পা বাড়ালো পুলিশের জিপটার দিকে। জাওয়াদের কী অবস্থা কে জানে। হাসপাতাল হয়ে বাসায় যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো, আর মনে মনে একটাই আশা করলো, ঢাকা থেকে বের হবার সময় কোনো চেক-পয়েন্টে যেনো ঐ অ্যাম্বুলেন্সটা ধরা পড়ে।

এ মুহূর্তে এরকম আশা করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।

.

উপসংহার

চারপাশে সবুজ আর সবুজ। একটু দূরে দূরেই আছে ছোটোখাটো কিছু জলাশয়। এরকম অসংখ্য জলাশয়ে পরিপূর্ণ ফুলতলা নামে পরিচিত এই উপজেলাটি। এর উত্তর-পূর্ব দিকে বয়ে গেছে ভৈরব নামের একটি নদী।

কলকাতা ছাড়ার পর এটাই হয়ে উঠেছে মুশকানের ঠিকানা। জায়গাটার প্রতি তার মমত্ববোধ তৈরি হয়ে গেছে। এখানে আবারো ফিরে আসতে পেরে খুব খুশি সে। বুক ভরে নিশ্বাস নিলো তাজা বাতাসে।

গতকাল এখান থেকে ঢাকায় চলে যাবার পর, এক পর্যায়ে তার আশঙ্কা হচ্ছিলো, সুস্মিতাকে সম্ভবত মুক্ত করা সম্ভব হবে না। সেজন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুতও হয়ে গেছিলো সে, কিন্তু যেমনটা বলা হয়-সাহসীদের পক্ষেই থাকে ভাগ্য-সেটাই আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। ডাক্তারের দেয়া মূল্যবান তথ্যটি একেবারে সময়মতো পেয়ে যায় সে। একটু দেরি হলেই সুস্মিতার যে কী হতো কে জানে!

এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো তাকে ধরতে ব্যর্থ হলো ডিবি অফিসার নুরে ছফা। নিশ্চয় রাগেক্ষোভে ফুঁসছে এখন। তবে একটা বিষয়ে তাকে কৃতিত্ব দিতেই হবে-ডিপি মল্লিক আর সুকুমার রঞ্জনের নিখোঁজের কথা জেনে গেছে সে। এমন কি, কলকাতায় আসকারের শ্বশুড়বাড়ির খোঁজও পেয়ে গেছে। আর গত রাতে যেভাবে তাদের সাময়িক আশ্রয়টিও প্রায় চিহ্নিত করে ফেলছিলো, সেটা ছিলো অবিশ্বাস্য। তার ধারণা, লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটাও চিহ্নিত করতে পারবে ছফা। যদিও ঐ গাড়ির ড্রাইভার বড়জোর তাকে জানাতে পারবে, পুরনো ঢাকার জনসন রোডে তাদের দু জনকে নামিয়ে দিয়েছে সে। ছফা হয়তো এটা জানতে পেরে সাময়িক বিভ্রান্তির মধ্যেও পড়ে যাবে, তাদের আসল গন্তব্য কোথায় ছিলো সেটা বের করতে পারবে না সহজে।

জনসন রোডে তাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলো ডাক্তারের আরেক বিশ্বস্ত কর্মচারী, সেখান থেকে তাদেরকে সদরঘাটের রকেট স্টিমারে তুলে দেয়া হয়। স্টিমার ছাড়ার কথা রাত পৌনে তিনটায়, তারা ওখানে পৌঁছায় তারও কয়েক মিনিট পর। কিন্তু রকেট স্টিমারের ঘাঁটে যখন ওরা পৌঁছালো তখনও বৃটিশ আমলের সেই চমৎকার স্টিমারটি নিজের নামের প্রতি চরম অবিচার করে নিশ্চল দাঁড়িয়ে ছিলো।

রাত সাড়ে তিনটার পর খুলনাগামী রকেট স্টিমারটি যাত্রা শুরু করলে হাফ ছেড়ে বাঁচে মুশকান। ছফা যে নদীপথটাকে হিসেবের মধ্যে রাখবে না, এ ব্যাপারে সে প্রায় নিশ্চিত ছিলো। আর সড়কের মতো নদীপথে চেক পয়েন্ট বলে কিছু থাকে না।

কেবিনে বসেই রুম সার্ভিসে অর্ডার দিয়ে কিছু খাবার আনিয়ে খেয়ে নেয় তারা। তারপর ক্লান্তিতে দুচোখে ঘুম নেমে আসে দু-জনেরই। ডাক্তারকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে, নিরাপদ চ্যানেলে জানানোর কথা, তারা ঠিকমতো পৌঁছে গেছে। ফোন করে তাকে জানাতে গেলে বিপদের সম্ভাবনা আছে। ডাক্তারের হাসপাতালের সমস্ত ফোন সম্ভবত টেপ করা হচ্ছে।

ভোরের দিকে ঘুম দিয়ে মুশকান আর সুস্মিতা জেগে ওঠে সকাল দশটার দিকে। এর কিছুক্ষণ পরই স্টিমারটা খুলনায় পৌঁছে যায়।

খুলনা শহর থেকে একটা ইজিবাইকে করে প্রায় উনিশ কিলোমিটার পাড়ি দেবার পর তারা পৌঁছায় ফুলতলা উপজেলায়। সেখান থেকে কয়েক কিলোমিটার কাঁচা-পাকা রাস্তা পাড়ি দিয়ে আসতে হয় দক্ষিণডিহি নামের এই প্রসিদ্ধ গ্রামটিতে। চারপাশে খুব বেশি মানুষের আবাস নেই, তবে জায়গাটা একদম নিরিবিলিও থাকে না, প্রতিদিনই কিছু উৎসাহি পর্যটকের দেখা মেলে।

“ওয়াও!” সুস্মিতাও দারুণ উচ্ছ্বসিত এমন একটি জায়গায় আসতে পেরে। আমরা এখানে থাকবো?”

“না। এখানে কেউ থাকে না,” মুশকান বললো। “আমরা থাকবো এই কমপ্লেক্সের বাইরে…ওই যে, ওখানে…” হলুদ রঙের পাকা দালানটির পশ্চিম দিকে ইঙ্গিত করলো সে। কমপ্লেক্সের সীমানা প্রাচীরের বাইরে কিছু ঘরবাড়ি আছে। “এই কমপ্লেক্সের ভেতর দিয়ে গেলে শর্টকাটে যাওয়া যায়, তাই এখানে এসেছি।”

“তাহলে এখানে থাকে কারা?”

বাড়িটার সামনে, সিঁড়ির দিকে তাকালো মুশকান, তার দৃষ্টি অনুসরণ করলো মেয়েটি। সিঁড়ির দু-পাশে দুটো আবক্ষ মূর্তি দেখতে পেয়ে অবাক হলো সুস্মিতা।

“এটা রবীন্দ্রনাথের বাড়ি!” বিস্ময়ের চেয়ে অবিশ্বাসই বেশি তার অভিব্যক্তিতে। “ওটা আবার কার স্ট্যাচু?” ভুরু কুঁচকে সিঁড়ির ডান দিকে থাকা আবক্ষ মূর্তিটার দিকে ইঙ্গিত করলো সে।

“মৃণালিনী দেবীর,” বললো মুশকান। “রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিনী।

“আমি জানতাম না এখানেও রবীন্দ্রনাথের বাড়ি ছিলো।”

“এটা ওর শ্বশুড়বাড়ি,” শুধরে দিলো মুশকান।

“তুমি এতোদিন এখানে ছিলে?” আশাহত দেখালো সুস্মিতাকে।

মুশকান কিছুই বললো না।

“তাহলে তো ইচ্ছে করলে আমাকেও এখানে এনে রাখতে পারতে,” অন্যদিকে তাকালো অভিমানে। “তুমি আসলে চাওনি…আমি জানি।”

“হ্যাঁ, চাইনি,” সরাসরিই বললো মুশকান। “আর কেন চাইনি সেটা তুমিও ভালো করে জানো।”

ভুরু কুঁচকে তাকালো আসকারের মেয়ে।

“তুমি ভুলে যাও আমি তোমার বাবার বন্ধু।”

ঠোঁট বাঁকালো সুস্মিতা। “বাবার বন্ধু…মা তো নও!”

মুশকান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাম দিকের বিশাল ঝিলের দিকে তাকালো।

“যাই হোক, এখন তো আমরা এখানেই থাকবো, তাই না?”

কিছু বললো না মুশকান।

সুস্মিতা মুগ্ধ হয়ে দেখলো আশপাশটা। “অনেক সুন্দর জায়গা! আই জাস্ট লাভ ইট। এই জায়গাটা কিন্তু ওই সাফা না ছফা…খুঁজে বের করতে পারবে না।”

মেয়েটার দিকে তাকালো মুশকান। ছফা এখন পর্যন্ত যা করেছে সেটা আমলে নিলে, নিশ্চিন্তে থাকার কোনো সুযোগই নেই। তার মনের কোণে একটি আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছে-সে এখানেও চলে আসবে! এ জায়গায় বেশি দিন থাকা সম্ভব হবে না হয়তো।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। সম্ভবত বাকিটা জীবন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়েই বেড়াতে হবে তাকে।

“কিন্তু ছফার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে…আমাদেরকে,” গম্ভীর কণ্ঠে বললো সে।

তার দিকে ফিরে তাকালো সুস্মিতা।

“ভুলে যেও না, ও কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে গেছিলো। আমাদের সব কিছু জেনে গেছে।”

কয়েক মুহূর্ত স্থিরচোখে চেয়ে রহস্যময় হাসি দিলো মেয়েটি। ধীরপায়ে মুশকানের কাছে এসে দাঁড়ালো সে। “ওকে নিয়ে একদম ভাববে না!”

সামান্য চোখ কুঁচকালো মুশকান।

“ও যদি এখানে চলে আসে, সেটা হবে ওর জীবনের শেষ টুর!”

মাথা দোলালো মুশকান। “আমরা ওরকম কিছুই করবো না, ঠিক আছে?”

এ কথার কোনো জবাব দিলো না মেয়েটি। “শোনো, আপাতত ওর চিন্তা বাদ দাও,” বলেই চারপাশে চোখ বুলালো আবার। “এখন শুধু তুমি আর আমি! ঠিক আছে?”

মুশকান কিছু বলার আগেই পা থেকে জুতোটা খুলে সবুজ ঘাসের উপর হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো সুস্মিতা, আকাশের দিকে মুখ করে মুক্তির স্বাদ নিলো বুকভরে, গুণগুণিয়ে গেয়ে উঠলো একটা গান :

“কেন গো সে মোরে যেনো করে না বিশ্বাস।
কেন গো বিষণ্ণ আঁখি আমি যবে কাছে থাকি,
কেন উঠে মাঝে মাঝে আকুল নিশ্বাস।
আদর করিতে মোরে চায় কতবার,
সহসা কী ভেবে যেনো ফেরে সে আবার…”

মুশকানের চোখেমুখে বিব্রত ভঙ্গি ফুটে উঠলো। শক্ত নার্ভের মানুষ হিসেবে এটা তার জন্য বিরলতম অভিজ্ঞতা! কিন্তু গানের মাঝখানে বাধা দিতে মন সায় দিলো না। মেয়েটা দারুণ গায়। তারপরও দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলার চেষ্টা করলো সে।

“প্রাণেশ সমাদ্দারের সাথে রবীন্দ্রনাথের শ্বশুড় বেণীমাধবদের বেশ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা ছিলো…পাশাপাশি বাড়িতে থাকতো ওরা।”

গান থামিয়ে পেছন ফিরে তাকালো সুস্মিতা। “রবীন্দ্রনাথ বোধহয় খুব ঘন ঘন আসতেন এখানে, তাই না? বাঙালি পুরুষগুলো তো আবার শ্বশুড়বাড়ি নিয়ে ভীষণ ফ্যাসিনেটেড। শ্বশুড়বাড়ি মধুর হাড়ি-এরকমটা বলে না?” বাঁকাহাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। “ঐ মেলশোভনিস্ট পিগৃগুলো যে মধুর হাড়ি বলতে কী বোঝায় আমি জানি।”

“শ্বশুড়বাড়ির আদর-আপ্যায়নকে বোঝায়, আর কী বোঝাবে, আজব!”

হা-হা-হা করে হেসে উঠলো সুস্মিতা। “তুমি মেলশভনিস্ট পিগগুলোর সাইকোলজিটাই বুঝতে পারো না।”

কিছু বললো না মুশকান।

“ওরা আসলে অল্পবয়সী শ্যালিকাদেরকেই মধুর হাড়ি বুঝিয়েছে!”

মাথা দোলালো সে। এসব আলাপ করতে ভালো লাগছে না তার। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। যে জায়গাতেই সে কিছু দিন থাকে সে জায়গার উপরে তার মায়া পড়ে যায়, এই জায়গাটার উপরেও মায়া জন্মে গেছে এ কয়দিনে।

“ওঁর অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে, তাই না?”

সুস্মিতার কথা শুনে পরিহাসের হাসি ফুটে উঠলো মুশকানের ঠোঁটে। আদতে রবীন্দ্রনাথ যে শ্বশুড়ালয়ে এসেছিলেন তার কোনো স্মৃতি এখানে নেই। এ নিয়ে বেশ ধোঁয়াশা আছে। কবির শ্বশুড়বাড়িটা খুলনার পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠলেও সত্যিটা বেশ অবাক করার মতো। কপ্লেক্সের প্রবেশপথে এবং ভেতরে রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিনী মৃণালিনী দেবীর বাড়ি সম্পর্কে যে তথ্য দেয়া আছে তার কোথাও উল্লেখ নেই, রবীন্দ্রনাথ কখনও এ বাড়িতে এসেছিলেন কিনা। বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যদিও জানা যায়, বিয়ের আগে, ১৮৮৩ সালের দিকে বেনীমাধব রায় চৌধুরীর যে বাড়িটি এখানে ছিল সেটি ছিলো টিনের তৈরি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার একমাত্র মেয়ে ভবতারিনী দেবী, ওরফে ফেলীর বিয়ের পর নাকি এখনকার অবকাঠামোটি তৈরি করা হয়। তবে কে এটা তৈরি করেছে সেটা নিয়েও আছে অস্পষ্টতা। স্থানীয়দের অনেকেই বলে থাকে, বিয়ের পর রবীন্দ্রনাথ নিজেই এটি বানিয়ে দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিকেরা অবশ্য এর কোনো প্রামাণ্য তথ্য পায়নি। তবে রবীন্দ্রনাথ যে দক্ষিণডিহি গ্রামে বেড়াতে এসেছিলেন সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কন্যাদর্শনের কাজটি সম্ভবত সেরেছিলেন এ গ্রামেই তার এক মামার বাড়িতে। মজার ব্যাপার হলো, ঠাকুরবাড়ির অনেক মেয়েই এসেছিলো এই দক্ষিণডিহি গ্রাম থেকে। রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরমা থেকে শুরু করে নিজের মাসহ কয়েকজন বৌদিও এই গ্রামেরই মেয়ে। এখানে কবির বেড়াতে আসাটা তাই স্বাভাবিকই ছিলো, তবে এখন যে ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে সেই বাঁটে কবির পায়ের চিহ্ন কখনও পড়েছে বলে কোথাও উল্লেখ নেই। ঠাকুরবাড়িতে আবার অদ্ভুত বিয়ের রীতি ছিলো-পাত্র নয়, কন্যাপক্ষ চলে যেতো পাত্রের বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথের বিয়েটাও ওভাবেই হয়েছিলো।

ভবনের নীচতলার দিকে তাকালো মুশকান। সম্প্রতি ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখানে একটি লাইব্রেরি করা হয়েছে-আর এর পুরো কৃতিত্ব তার। যদিও বিষয়টা দুয়েকজন ছাড়া বাইরের মানুষজন জানে না। এই লাইব্রেরি করার কারণে কপ্লেক্সে তার কিছুটা প্রভাবও তৈরি হয়েছে। রবীন্দ্র কমপ্লেক্সের একজন শুভাকাঙ্খি হিসেবে তাকে এখানকার কর্মচারীরা বেশ সমীহ করে। ওরা জানে, এই মহিলা কবির জ্ঞাতিগুষ্টি হয়।

“নমস্কার, সুস্মিতাদি,” এক হ্যাংলা-পাতলা গড়নের মাঝবয়েসী লোক তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় হাসিমুখে বললো।

অবাক হয়ে তাকালো সুস্মিতা। এই লোক তার নাম জানে?! কিন্তু পরক্ষণেই তার ভুলটা ভাঙলো। দু-হাত জড়ো করে নমস্কারের জবাব নিলো মুশকান। লোকটা চলে যেতেই বিস্ময়ে তাকালো সে।

“সুস্মিতা!? তুমি?!”

মুচকি হাসলো মুশকান। “ওরা আমাকে এ নামেই চেনে এখানে।”

কথাটা শুনে মেয়েটার মুখ হা হয়ে গেলো।

মুশকান কিছু বললো না।

সুস্মিতা মুখ টিপে হেসে আবারো প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইলো। আবারো গান ধরলো সে :

“পাগলিনী, তোর লাগি কী আমি করিব বল্।
কোথায় রাখিব তোরে খুঁজে না পাই ভূমণ্ডল…”

এবার আর পারলো না। বড্ড বেশি ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ করছে মেয়েটি। তাই গানের মাঝখানেই বলে উঠলো সে, “জানো, একদিক থেকে সুন্দরপুরের সাথে এ জায়গাটার অদ্ভুত মিল রয়েছে।”

“সেটা কি রকম?” গান থামিয়ে অবাক হয়ে জানতে চাইলো সুস্মিতা।

ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুশকান, কিন্তু সত্যিটাই বললো সে, “রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি!”

***

2 Comments
Collapse Comments

মানে সিরিয়াসলি!! অধরাই থেকে গেল মুসকান

রুবাইয়া January 29, 2024 at 5:25 am

অসাধারণ রহস্যময় এই উপন্যাস।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *