নবম সর্গ
ইতিমধ্যে শয়তান কিভাবে সর্পরূপে মর্ত্যলোকে, এসে এক ঘৃণ্য ও ভয়ঙ্কর কাজ করে গেছে, কিভাবে সে ঈভকে কলুষিত ও নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের মত পাপকর্মে প্রবৃত্ত করে এবং পরে ঈভ আবার আদমকে পাপাসক্ত করে তোলে, সে সংবাদ স্বর্গলোকে প্রচারিত হলো। এমন কোন ঘটনা আছে যা সর্বদশী ঈশ্বরের দৃষ্টিকে পরিহার করে যেতে পারে? এমন কে আছে যে সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের অন্তরকে প্রতারিত। করতে পারে? তিনি সত্য এবং ন্যায়পরায়ণ।
এমন কি শয়তান যখন মানুষের মনকে প্রলোভিত করতে যায় এক হীন অপকৌশল অবলম্বন করে তখনও তার স্বাধীন ইচ্ছা ও শক্তিবলে সেকথা জানতে পারলেন ঈশ্বর। শয়তান এ কাজ করার জন্য ছলনা ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করলেও মানুষের এইরকম হীন আচরণের জন্য তার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করার জন্য ঈশ্বর রুষ্ট হলেন তার প্রতি। শয়তান শত্রু বা আপাতমিত্রের রূপ ধরেই আসুক, মানুষ তার কথায় কান দেবে কেন? তার কথামত চলবে কেন?
তারা জানত এবং তাদের এটা মনে রাখা উচিত ছিল। ঈশ্বরের আদেশ, যে-ই তাদের প্রলুব্ধ করুক না কেন, তারা জ্ঞানবৃক্ষের ফল কখনই ভক্ষণ করতে পারে না। কিন্তু ঐশ্বরিক নিষেধাজ্ঞা তারা না মেনে পাপে নিমগ্ন হয়ে পড়েছে। তাদের শাস্তি পেতেই হবে। তাদের পতন অনিবার্য।
যে সব দেবদূত মর্ত্যলোকে প্রহরায় নিযুক্ত ছিল তারা সব কিছু জানতে পেরে বিষণ্ণ মনে স্বর্গে ফিরে গেল। মানবজাতির পতনে তাদের দুঃখ হচ্ছিল। শয়তান কিভাবে তাদের অলক্ষ্যে অগোচরে কৌশলে ইডেন উদ্যানে প্রবেশ করে তা ভাবতে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে যায় তারা।
এই অবাঞ্ছিত সংবাদ স্বর্গদ্বারে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গবাসীরা যেমন একদিকে অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে আদম ও ঈভের প্রতি, তেমনি সেই সঙ্গে তাদের পতনের জন্য দুঃখবোধ করতে থাকে। সকলেরই চোখে-মুখে বিষণ্ণতার ছাপ ফুটে ওঠে। কিন্তু এই ঘটনায় তাদের চিরশান্ত সুখী মন কিছুটা আলোড়িত হলেও তাদের স্বর্গীয় সুখে বিশেষ কোন ব্যাঘাত ঘটল না।
দেবদূত প্রহরীরা মর্ত্য থেকে স্বর্গে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গবাসী দেবদুতেরা দলে দলে ব্যস্ত হয়ে তাদের চারদিকে ভিড় করে আসল ঘটনার কথা জানতে চাইল, তারপর সকলে মিলে ভয়ে ঈশ্বরের সিংহাসনের সামনে সমবেত হলো। তখন পরম পিতা পরমেশ্বর তার মেঘাবরণ থেকে বজ্রগর্জনসম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, হে সমবেত দেবদূতবৃন্দ, ব্যর্থ কর্মভার ত্যাগ করে ফিরে এসেছ যারা তারা ভীত হয়ো না। এই দুর্ঘটনা ও দুঃসংবাদে বিব্রত বোধ করো না তোমরা। কারণ তোমরা আরও অনেক বেশি যত্নবান হয়ে তোমাদের কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করলেও এই দুর্ঘটনাকে নিবারিত করতে পারতে না। সেই প্রবঞ্চক শয়তান যখন নরক থেকে উঠে এসে শূন্যমণ্ডল অতিক্রম করে স্বর্গোদ্যান অভিমুখে যায় তখনি আমি তোমাদের বলেছিলাম, সে তার কু-অভিসন্ধি সিদ্ধ করবেই। মানুষ তার দ্বারা প্রলুব্ধ হবেই, কারণ মানুষ সবচেয়ে তোষামোদপ্রিয়। সে তার স্রষ্টার বিরুদ্ধে যত সব মিথ্যা প্রবঞ্চনায় বিশ্বাস করে তার পতনকে ডেকে আনবে। আমার বিধান সে মানবে না। তার আবেগঘন মুহূর্তে আমার বিধান তার স্বাধীন ইচ্ছায় কোনরূপ হস্তক্ষেপ করবে না।
যাই হোক, তার পতন এখন সম্পূর্ণ। এখন তার বিচ্যুতির জন্য বিচার আর দণ্ডদানের রায় বাকি। সে দণ্ড হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু এখনো সে দণ্ড তার উপর আরোপিত হয়নি বলে সে ভাবছে তার বিচ্যুতির জন্য যে মৃত্যুদণ্ডের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল এবং সে যার ভয় করছিল তা মিথ্যা। আজ দিন শেষ হবার আগেই সে শাস্তির সত্যতা সে বুঝতে পারবে। বুঝতে পারবে কোন মার্জনা তাদের এ শাস্তি থেকে মুক্ত করতে পারবে না। কোন দয়ার দানকে ঘৃণা করে ফিরিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ন্যায়বিচারকে কখনো ফিরিয়ে দেওয়া যায় না।
কিন্তু তাদের বিচারের জন্য কাকে পাঠাব আমি? হে আমার পুত্র, আমার প্রতিনিধি, তোমাকে ছাড়া কাকে পাঠাব? স্বর্গ, মর্ত্য বা নরকে সব ব্যাপারে আমি তোমাকে পূর্ণ বিচারক্ষমতা দান করেছি। তবে তুমি জান, আমি চাই, কোন ন্যায়বিচার যেন করুণাবর্জিত না হয়। তুমি মানবজাতির বন্ধু, মধ্যস্থতাকারী, একই সঙ্গে তাদের শাস্তিদাতা এবং উদ্ধারকর্তা। তাই তোমাকেই পাঠাচ্ছি তাদের বিচারের জন্য। যে হবে একদিন ঈশ্বরের মানবাবতার, সে-ই অধঃপতিত মানবজাতির বিচার করবে।
এই বলে পরম পিতা তার দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে তার পুত্রকে আশীর্বাদ করলে পুত্র পিতার ঐশ্বরিক দ্যুতিতে জ্যোতির্মান হয়ে বললেন, হে পরম পিতা, তোমার বিধান অনুসারে স্বর্গে ও মর্ত্যে তোমার অমোঘ অবিসম্বাদিত ইচ্ছাই আমার মধ্য দিয়ে পূরণ হবে। তোমার এই প্রিয়তম পুত্রের সকল কার্যে সন্তুষ্ট হবে তোমার চিত্ত। আমি মর্ত্যে তোমার বিধান লঙ্ঘনকারীদের বিচার করতে যাচ্ছি।
তবে তুমি জান, আমি যারই বিচার করি না কেন, সে বিচারে শাস্তি যত কঠোরই হোক না কেন, ভবিষ্যতে একদিন আমারই উপর ফিরে আসবে তা। আমি তোমার কাছে এই শপথই করেছিলাম এবং এজন্য কোন আক্ষেপ বা অনুশোচনা নেই আমার মনে। তাদের শাস্তির ও পতনের তীব্রতাকে প্রশমিত করার জন্য আমি নিজের উপর তুলে নেব সে শাস্তির বোঝ। তবু আমি ন্যায়বিচারের সঙ্গে করুণাকে সংমিশ্রিত করে এমনভাবে বিচার করব যাতে সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট হতে পারে এবং তুমিও যাতে সন্তুষ্ট হও। আর কারও উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। যাদের বিচার হবে তারা ছাড়া আর কেউ সে বিচার দেখতে পাবে না। যে তৃতীয় আসামী সেই শয়তান আগেই পালিয়ে গেছে, তার বিচার আগেই হয়ে গেছে। সে আগেই দণ্ড পেয়ে গেছে। সর্পকে দণ্ডদানের কোন অর্থই হয় না।
এই বলে ঈশ্বরপুত্র উঠে পড়লেন তাঁর আসন থেকে। তিনি যাত্রা শুরু করলেন। সমস্ত রাজশক্তি স্বর্গদ্বার পর্যন্ত তাঁর সহগমন করল।
স্বর্গলোকের প্রান্ত থেকে ইডেনের অভিমুখে অবতরণ করতে লাগলেন ঈশ্বরপুত্র। দেবতাদের গতি সংখ্যায় গণনা করা যায় না। তাঁরা অতি অল্প সময়ের মধ্যে অনেক দূর পথ অতিক্রম করতে পারেন।
তখন দ্বিপ্রহরের মধ্য আকাশ ছেড়ে সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়েছে। প্রাকসন্ধ্যার শীতল বাতাস বইছিল মর্ত্যলোকে। ঈশ্বরপুত্রের তপ্ত রোষ কিছুটা শীতল হলো। তিনি মমতাস্নিগ্ধ অন্তরে মানুষের বিচার করতে এলেন। তিনি যখন ইডেন উদ্যানে নেমে হেঁটে যেতে লাগলেন তখন তার কণ্ঠস্বর তাদের কানে বাতাসে ভেসে আসতে থাকায় তারা তার উপস্থিতি এড়াবার জন্য বনের গভীরে গিয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।
ঈশ্বরপুত্র তাদের নিকটে গিয়ে জোরে ডাকতে লাগলেন, কই আদম কোথায় তুমি? আমার আগমন দূর থেকে প্রত্যক্ষ করেও কেন তুমি আনন্দিত হলে না? তোমাকে এখানে দেখতে না পেয়ে এই নির্জনতার মধ্যে অসন্তুষ্ট হয়েছি আমি। আগে তো এখানে তোমাদের কর্তব্যপালনে কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হত না। অযাচিতভাবেই। যথাযোগ্য অভ্যর্থনা ও সম্মান লাভ করতাম। এখন তোমাদের মনের মধ্যে কি এমন পরিবর্তন হলো যাতে তোমরা আমার উপস্থিতিকে এড়িয়ে গেলে? এখন এস আমার কাছে।
প্রথমে আদম এল তার সামনে। তারপর ঈভও এল। কেমন যেন বিকৃত ও বিবর্ণ তাদের চোখ-মুখ। তাদের চোখের দৃষ্টিতে ঈশ্বরের প্রতি বা নিজেদের প্রতি কোন ভালবাসার ভাব ছিল না, ছিল শুধু তার অপরাধচেতনা, লজ্জা, অস্থিরচিত্ততা, হতাশা, ক্রোধ, অবাধ্যতা ও অনমনীয়তা, ঘৃণা এবং চাতুর্য।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আদম উত্তর করল, আমি আপনার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে আমার নগ্নতার জন্য ভীত হয়ে লুকিয়ে পড়েছিলাম।
তখন মহান মহিমাময় বিচারক বললেন, আমার কণ্ঠস্বর আগেও শুনতে, কিন্তু তখন তো কোন ভয় পেতে না বরং তাতে আনন্দ লাভ করতে। এখন ভয়ঙ্কর কি এমন ঘটল? তুমি যে নগ্ন একথা কে বলল? তবে কি যে গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছিলাম তোমরা সেই নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়েছ?
আদম তখন বিব্রত হয়ে বলল, হে ঈশ্বরপুত্র, আজ আমি এক শোচনীয় অবস্থায় আমার বিচারকের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছি। হয় আমাকে সমস্ত অপরাধের দায়িত্ব মাথায় করে নিতে অথবা আমার অর্ধাঙ্গিনী ও জীবনের অংশীদারকে অভিযুক্ত করতে হবে। সে যখন আমার প্রতি এখনো বিশ্বস্ত আছে তখন তার দোষ বা ত্রুটিবিচ্যুতির কথা আমাকে গোপন রাখতেই হবে। আমার অভিযোগের দ্বারা তার দোষকে তুলে ধরতে পারব না। এক অপরিহার্য প্রয়োজনের খাতিরে আমাকে এই নিন্দনীয় গোপনতা অবলম্বন করতে হবেই যাতে সমস্ত পাপ ও শাস্তি আমার মাথার উপরেই পড়ে। যদিও আমি জানি আমি যা গোপন করছি তা গোপন থাকবে না আপনার কাছে, আপনি সহজেই তা ধরে ফেলতে পারবেন তথাপি কোন উপায় নেই। যে নারীকে আপনি একদিন আমার সহায়িকাশক্তি হিসাবে আমাকে দান করেছিলেন সে নারী এত ভাল, এত সৎ, এত গ্রহণযোগ্য এবং এত স্বর্গীয় সুষমাসম্পন্ন যে তার হাতে আমার কোন অমঙ্গল ঘটতে পারে এটা আমি কোন প্রকারে সন্দেহ করতে পারিনি। সে যা কিছু করেছিল আমি তার মধ্যে কোন অন্যায় দেখতে পাইনি। ভেবেছিলাম সে কোন অন্যায় করতে পারে না। সে আমাকে সেই নিষিদ্ধ গাছের ফল দেয় এবং আমি তা ভক্ষণ করি।
তখন সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের পুত্র ও প্রতিনিধি বললেন, সে কি তোমার স্রষ্টা ও ঈশ্বর যে তুমি তার কথা শুনলে? ঈশ্বর কি তাকে তোমার মৃত্যু ও পথপ্রদর্শক হিসাবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন যে তুমি তার কাছে তোমার মনুষ্যত্ব ও পৌরুষকে বিসর্জন দিলে? অথবা ঈশ্বর কি তাকে তোমার সমান বলেই সৃষ্টি করেছেন?
আসলে ঈশ্বর তোমাকে তার ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছেন গুণগত মর্যাদার দিক থেকে। তিনি তাকে তোমার অঙ্গ থেকে তোমারই জন্য সৃষ্টি করেছেন। আসলে তোমার গুণগত পূর্ণতা ও মর্যাদা তার থেকে অনেক বেশি।
সৌন্দর্যের দিক থেকে অবশ্য সে এমনভাবে সজ্জিত যাতে সে তোমার ভালবাসা আকর্ষণ করতে পারে, তোমার অধীনতা নয়। তার যত সব গুণগুলি এক অনুশাসনের সীমার মধ্যে যতক্ষণ থাকে তা ভাল দেখায়, কিন্তু তারা যদি কোন শাসন না মেনে নিজেরাই প্রভুত্ব করতে চায় তখন তাদের খুবই খারাপ দেখায়। আসলে সে তোমারই অংশ। এটা তোমার জানা উচিত ছিল।
আদমকে এই কথা বলার পর তিনি ঈভকে বললেন, বল নারী, তুমি কি করেছ? ঈভ তখন বিপন্ন মুখে লজ্জায় অভিভূত হয়ে তার দোষ স্বীকার করল। কোন ঔদ্ধত্যের পরিচয় না দিয়েই লজ্জাজড়িত কণ্ঠে বলল, ছলনার দ্বারা সর্প আমায় প্ররোচিত করলে আমি নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করি।
ঈশ্বরপুত্র তখন অভিশপ্ত সর্পকুলের বিচার করার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠলেন। তিনি এই বলে তাদের অভিশাপ দিলেন, যেহেতু তুমি এই অন্যায় কাজ করেছ, সমস্ত পশু ও জন্তুদের মধ্যে সবচেয়ে অভিশপ্ত হবে তুমি। তোমাকে সারাজীবন বুক ও পেটের উপর ভর দিয়ে চলতে হবে আর মাটি খেয়ে থাকতে হবে। নারীজাতি ও তোমাদের মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক স্থাপিত হবে এবং তাদের সন্তানসন্ততিরা তোমাদের মাথায় আঘাত করবে আর তোমরা তাদের পায়ে কামড় দেবে।
এরপর অভিশপ্ত শয়তানকেও আবার অভিশাপ দিলেন ঈশ্বরপুত্র, আশ্রয়হারা হয়ে শূন্যে ঘুরে বেড়াতে হবে এখানে সেখানে।
এবার তিনি মানবজাতির আদিমাতা ঈভকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, গর্ভধারণ করে সন্তান প্রসব করে যেতে হবে তোমাকে দীর্ঘকাল ধরে। তোমাকে এজন্য প্রচুর দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হবে। তোমাকে স্বামীর ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করতে হবে। তার শাসনে চলতে হবে তোমায়।
এরপর আদমের উপর দিলেন শেষ বিচারের রায়। যেহেতু তুমি তোমার স্ত্রীর কথা শুনে আমি নিষেধ করা সত্ত্বেও নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেয়েছ, তার জন্য তুমিও অভিশপ্ত হবে। তোমাকে সারাদিনের শ্রমের দ্বারা জীবিকার্জন করে জীবনযাপন করতে হবে। কণ্টকাকীর্ণ হবে তোমার জীবনের পথ। মাঠে কাজ করে ফসল ফলিয়ে তা খেতে হবে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অতিকষ্টে জীবন ধারণ করতে হবে। তারপর জীবনের অবসানে যে মাটি থেকে জন্ম হয়েছিল, তোমায় সেই মাটিতেই ফিরে যেতে হবে। তোমার মাটির দেহ মাটিতে ফিরে যাবে।
এইভাবে বিচার করলেন ঈশ্বরপুত্র। একই সঙ্গে তিনি মানুষের বিচারকর্তা ও পরিত্রাতার কাজ করেন। কারণ যে মৃত্যুদণ্ডের কথা আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল সে দণ্ড থেকে অব্যাহতি দিলেন তাকে। উপরন্তু তাদের নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দয়া হলো তার। তিনি তাদের অভিভাবকের মত শুধু পশুর চামড়া দিয়ে মানুষের দেহের নগ্নতাকে ঢাকার ব্যবস্থা করলেন না, তাদের মনের নগ্নতাটাকেও তার ন্যায়বিচারের আবরণ দিয়ে ঢেকে দিলেন।
এইভাবে বিচারের কাজ সব শেষ করে স্বর্গলোকে ফিরে গেলেন তিনি ঈশ্বরের কাছে। ফিরে গেলেন তাঁর পরম পিতার কাছে। পরম শক্তির গৌরবময় বুকে। তারপর পরম পিতা সর্বজ্ঞ হলেও তাকে বিচারের সব বিবরণ দান করলেন।
এদিকে মর্ত্যলোকে যখন মানুষের বিচার হচ্ছিল তখন নরকের দ্বারে পা ও মৃত্যু বসেছিল। শয়তান নরক থেকে তার কু-উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য বেরিয়ে যাবার পর থেকেই উন্মুক্ত রয়ে গেছে নরকদ্বার। সেই বিস্তৃত দ্বারপথে পাপ বসে আছে। প্রজ্জ্বলিত নরকাগ্নির শিখাগুলো বেরিয়ে আসছিল।
একসময় পাপ মৃত্যুকে বলল, হে আমার পুত্র, কেন আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে অলসভাবে বসে আছি? আমার জনক শয়তান এখন অন্য এক জগতে গেছে উন্নতির আশায়। আমরা তার প্রিয় সন্তান। আমাদের জন্য অনেক ভাল এক বাসস্থান খুঁজে পেয়েছে সে। সে নিশ্চয় সফল হয়েছে তার সন্ধানকার্যে। যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটত, যদি তার শত্রুরা তাকে তাড়িয়ে দিত তাহলে সে প্রচণ্ড ক্রোধের সঙ্গে ফিরে আসত এতক্ষণ কারণ এই নরকপ্রদেশের মত তার শাস্তির উপযুক্ত স্থান আর নেই। তার উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য তাকে এইখানেই নির্বাসিত করেছে।
আমার মনে হয়েছে আমি এক নূতন শক্তি লাভ করেছি। আমার দেহে পাখা গজিয়েছে। এই গভীর নরকপ্রদেশের ঊর্ধ্বে অনেক দূরে এক বিস্তীর্ণ মণ্ডলে উঠে যাবার জন্য যেন আমার সমজাতীয় কোন বৃহত্তর শক্তি আমার প্রতি সহানুভূতিবশতঃ দুর্বারবেগে আকর্ষণ করছে আমাকে। সেই শক্তির সঙ্গে আমার যেন এক নিগূঢ় মিত্রতার সম্পর্ক আছে। তুমি আমার ছায়াসম এক অবিচ্ছিন্ন শক্তি। তুমিও আমার সঙ্গে যাবে। কারণ পাপ থেকে মৃত্যুকে কেউ কখনো বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। তবে আমাদের জনক শয়তান সেই দুর্গম পথ অতিক্রম করে ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। তা নাহলে কষ্ট করে আবার আমাদের ফিরে আসতে হতে পারে সেখান থেকে। এবার আমাদের সেই দুঃসাহসিক যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
তবে তোমার-আমার মিলিত শক্তিতে এই নরক থেকে সেই নৃতন জগতে যাবার উপযুক্ত এক পথ সীমাহীন সাগরমধ্যে স্থাপন করতে পারব আমরা। সে জগতে শয়তান এখন প্রভুত্ব করছে। এই নরকপ্রদেশের সমস্ত অধিবাসীদের মধ্যে তার বুদ্ধি সবচেয়ে । উন্নত ধরনের। সে হয়ত এখান থেকে সকলের যাবার ও পুনর্বাসনের পথ প্রস্তুত করছে। সেখানে যাবার আকর্ষণ ও প্রবৃত্তি আমার এমনই প্রবল ও দুর্বার যে সে পথ ভুল হবে না।
পাপের হীন ছায়ামূর্তি মৃত্যু তখন সঙ্গে সঙ্গে বলল, যেখানে তোমার নিয়তি এবং প্রবৃত্তি তোমাকে আকর্ষণ করে নিয়ে যায় সেখানে যাও তুমি। তোমার পিছু পিছু আমিও যাব। আমার পথও ভুল হবে না। সে জগতের অধিবাসীদের অসংখ্য মৃতদেহের গন্ধ ও আস্বাদ পাচ্ছি আমি। তারা আমার শিকারের বস্তু। যে কাজ তুমি করতে যাচ্ছ সেখানে সে কাজে আমি প্রয়োজনের সমপরিমাণ সাহায্য দান করব তোমায়।
এই বলে মর্ত্যলোকে মানবজাতির যে ভাগ্য পরিবর্তন হলো কিছু আগে তার। গন্ধ পেল সে। সে গন্ধ সে শুঁকতে লাগল। একপাল শকুনি যেমন বহু দূর থেকে কোনও যুদ্ধক্ষেত্রে আহত ও মৃতপ্রায় সৈনিকদের গন্ধ পেয়ে সে গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে সেদিকে পাখা মেলে উড়ে যায় তেমনি মৃত্যুও দূর থেকে বাতাসে তার নাসারন্ধ্র বিস্তৃত করে আসন্ন মৃত্যুকবলিত মর্তমানবদের গন্ধ পেয়ে পুলকিত হলো।
এরপর তারা দুজনে নরকের দ্বারপথ হতে বার হয়ে অনন্তপ্রসারিত অন্ধকার সমুদ্রের বিক্ষুব্ধ বুকের উপর দিয়ে উড়ে চলল। দুই মেরুপ্রদেশ হতে নির্গত দুটি হিমশীতল । বায়ুপ্রবাহ যেমন দুটি বরফের পাহাড়ের মত প্রবাহিত হতে হতে সাইবেরিয়ার নদীগুলিকে হিমে দ্রবীভূত করে দেয়, তেমনি হিমশীতল মৃত্যু তার গদা দিয়ে সেই সমুদ্রের জলরাশিকে প্রহার করতে করতে স্তব্ধ ও দ্রবীভূত করে দিল মুহূর্তে। তখন সেই সমুদ্রের জলরাশির একটি অংশ শুশীতল মাটিতে পরিণত হলো। তখন তারা সেই মাটি দিয়ে নরকের মুখ হতে রাজপথের মতোই প্রশস্ত এক সেতুপথ রচনা করে সমুদ্রের উপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে মর্ত্যলোকের প্রাচীরের সঙ্গে যুক্ত করল। সে সেতুপথের দৈর্ঘ্য হলো বিরাট। সে জগৎ মৃত্যুর কাছে বিকিয়ে গেছে।
এইভাবে নরকের মুখ থেকে সুদূর মর্ত্যলোক পর্যন্ত এক বিস্তৃত সেতুপথ রচিত হলো। গ্রীসের আক্রমণকারী পারসিক জার্সেস যেমন সুসা থেকে তার মেমনিয়ার প্রাসাদকে সমুদ্রের উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল এবং দার্দানালিস প্রণালীতে হেলেসপন্ট উপসাগরের উপর এক সেতুপথ নির্মাণ করে সমুদ্রতরঙ্গমালাকে প্রতিহত করেছিল তেমনি পাপ ও মৃত্যুরূপ শয়তান যে পথে গিয়েছিল সেই বিক্ষুব্ধ সমুদ্রপথের উপর আশ্চর্যভাবে এক সেতুপথ নির্মাণ করে বিশৃংখলাময় বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের উপর দিয়ে সুদূর গোলাকার মর্ত্যলোকের বহির্দেশে যুক্ত করল। শিকল দিয়ে পৃথিবীর তিন জায়গায় বেঁধে দিল শক্ত করে।
এরপর মর্ত্যলোকের পথে যেতে যেতে স্বর্গের দিকে তাকাতেই তারা দেখতে পেল, শয়তান এক উজ্জ্বল দেবদূতের রূপ ধরে আকাশপথে এইদিকেই আসছে। তখন সূর্য মেষরাশিতে আরোহণ করেছে। শয়তান ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকলেও তারা তাদের পিতাকে চিনতে পারল।
এদিকে ঈভকে প্রলুব্ধ ও প্ররোচিত করার পর বনের মধ্যে ছুটে যায় শয়তান। তারপর সে ছদ্মরূপ পরিবর্তন করে ব্যাপারটার প্রতিক্রিয়া কি তা দেখতে চায়। সে দেখল ঈভের কাজ তার স্বামীও সমর্থন করল। সে বুঝল তার চাতুর্য ও ছলনার কাজ সফল হয়েছে। সিদ্ধ হয়েছে তার কু-অভিসন্ধি। মানবজাতির পতন অনিবার্য। সে আরও দেখল আদম ও ঈভ তাদের নগ্নতায় লজ্জা পেয়ে গাছের পাতা দিয়ে তাদের কটিদেশ ঢেকে লজ্জা নিবারণের ব্যর্থ প্রয়াস পেল।
তারপর যখন সে দেখল ঈশ্বরপুত্র আদম ও ঈভের বিচারের জন্য স্বর্গ থেকে নেমে আসছেন তখন সে পালিয়ে গেল। কারণ সে ভাবল ঈশ্বরপুত্র তার উপর রুষ্ট হয়ে তার উপর এক নৃন শাস্তি আরোপ করতে পারেন।
তারপর রাত্রিতে আবার ইডেন উদ্যানে ফিরে এসে সে দেখল সেই অসহায় মানবজাতি বিষণ্ণ মুখে বসে তাদের অবস্থার কথা আলোচনা করছে। সমস্ত গ্রহগুলি সমবেত হয়ে তাদের চূড়ান্ত ধ্বংসের পরিকল্পনা করছে যার ফল পরে তারা পেয়েছিল।
তখন সে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে এক সুসংবাদ বহন করে নরকের দিকে অগ্রসর হলো। তারপর সে মতলোকের বাইরে সেই বনির্মিত পাথরের সেতুর পাদদেশে উপস্থিত হয়ে সে আশ্চর্য হয়ে গেল। সেখানে তার দুই সন্তানকে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখতে পেয়ে প্রচুর আনন্দ পেল সে। সেই সঙ্গে নবনির্মিত বিরাট সেতুপথ দেখে তার আনন্দ বেড়ে গেল।
তখন তার সুন্দরী কন্যা পাপ নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, হে পিতা, এই সেতু তোমারই এক মহতী কার্য। যদিও তুমি এটি তোমার নয় বলেই মনে করছ তবু তুমিই এর নির্মাতা এবং মুখ্য স্থপতি।
যখন আমি আমার অন্তরে বহু দূর থেকে জানতে পারলাম তুমি নরক থেকে অন্য এক জগতে গিয়ে তোমার উদ্দেশ্যকে সফল করতে পেরেছ তখন আমি ভাবলাম– তোমার পুত্রের সঙ্গে আমিও সেই জগতে গিয়ে দেখা করব তোমার সঙ্গে। যাই হোক, আমাদের সেই প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ আমাদের তিনজনের মিলন ঘটল এখন। নরক আর তার সংকীর্ণ সীমার মধ্যে কেউ ধরে রাখতে পারেনি আমাদের। এই অপার অনতিক্রম্য মহা-সমুদ্রও তোমার নির্দেশিত পথে কোন বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। যে আমরা এতদিন নরকদ্বারে কর্তব্যকর্মের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম সেই আমরা আজ তোমারই প্রসাদে মুক্তিলাভ করেছি সমস্ত বন্ধন হতে। এই অন্ধকার মহাসমুদ্রের উপর সেতুবন্ধন করতে তুমিই আমাদের শক্তিমান করেছ।
এখন এ জগৎ তোমার। যে জগৎ তুমি তোমার নিজের হাতে নির্মাণ করনি, সে জগৎ তোমার গুণ ও জ্ঞানের দ্বারা লাভ করেছ। দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধে যা তুমি হারিয়েছিলে, তা অন্যভাবে লাভ করবে। সে যুদ্ধে যে পরাজয়ের গ্লানি তখন মাথা পেতে নিতে বাধ্য হয়েছিলে, সে পরাজয়ের প্রতিশোধস্বরূপ তখন তুমি এই জগতের একমাত্র অধীশ্বররূপে রাজত্ব করবে।
বিগত যুদ্ধের ফল অনুসারে ঈশ্বর বিজেতারূপে স্বর্গলোকে রাজত্ব করুক। তার। বিধান লঙ্ঘন করে স্বর্গ ও মর্ত এই দুটি জগৎ বা রাজ্যকে দুটি ভাগ করে এই মর্ত্যজগতে তুমি সকল বস্তুর উপর প্রভুত্ব করবে। আবার আমরা এখান থেকে তার
সেই স্বর্গের সিংহাসন দখলে এক বিপজ্জনক প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাব।
এই কথা শুনে নরক ও অন্ধকারের রাজ শয়তান উত্তর করল, হে আমার সুন্দরী কন্যা, একাধারে হে আমার পুত্র ও পৌত্র, তোমরা যে শয়তানরাজের সুযোগ্য বংশধর তার যথেষ্ট প্রমাণ দিলে। নরকের রাজারূপে আমাকে যথাযোগ্য গুণগানে ভূষিত করেছ। এখন আমি আমার গৌরবময় কর্মের দ্বারা জয়শীল প্রচেষ্টার দ্বারা নরকপ্রদেশ ও এই মর্ত্যলোক–দুটি রাজ্যকে এক করেছি এমনভাবে যাতে দুটি জগতে সহজেই যাতায়াত করতে পারা যায়। দুটি দেশকে এক অখণ্ড মহাদেশে পরিণত করেছি। আমি এখন তোমাদেরই নির্মিত সেতুপথের উপর দিয়ে এখান থেকে নরকে গিয়ে আমার সহকর্মীদের এইসব সাফল্যের কথা জানাতে পারি।
তোমরা দুজনে এই পথে ঈভের স্বর্গোদ্যানে গিয়ে পরম সুখে বাস করো এবং সেখানে রাজত্ব করো। সেখান থেকে পৃথিবীতে গিয়ে সেখানকার আকাশে, বাতাসে, জলে, স্থলে, বিশেষ করে মানবজাতির উপর প্রভুত্ব বিস্তার করো। সেই মর্তরাজ্যের তোমরাই হবে অধীশ্বর। তোমরাই সে জগতের একমাত্র প্রভু। সেখানে গিয়ে আগে মানুষকে বশীভূত করো, পরে তাদের বধ করবে। আমার বিকল্প শক্তি ও প্রতিনিধিরূপে সেখানে পাঠাচ্ছি আমি তোমাদের। আমার থেকে উদ্ভূত তোমরা সেখানে গিয়ে হবে অতুলনীয় শক্তির অধিকারী।
তোমাদের যৌথ শক্তির উপরেই এই নূতন রাজ্যে আমার সকল কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব নির্ভর করছে। আমারই কর্মের দ্বারা মানুষ পাপ থেকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। তোমাদের সেই যৌথ শক্তি যদি বজায় থাকে তাহলে নরকের কোন প্রতিকূল শক্তির ভয় করতে হবে না। যাও, শক্তিমান হয়ে থাকবে।
এই কথা বলে শয়তান তার সন্তানদের বিদায় দিল। তারা তখন আকাশমণ্ডলে ঘূর্ণ্যমান গ্রহনক্ষত্রদের মধ্য দিয়ে পাখা মেলে উড়ে যেতে লাগল। তাদের পক্ষছায়ায় গ্রহণকালের মতো আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল চারদিক। তারা স্বর্গলোকের দিকে যেতে লাগল।
এদিকে শয়তান গেল নরকদ্বারের দিকে। সমুদ্রের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালা আছাড় খেয়ে পড়ছিল সেই দ্বারপথের উপর। তা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল শয়তান। নরকের দ্বারপথে কোন প্রহরী ছিল না। সে দ্বার খোলা ছিল। উন্মুক্ত বিস্তৃত দ্বারপথ দিয়ে ভিতরে। প্রবেশ করল শয়তানরাজ।
ভিতরে গিয়ে দেখল নরকপ্রদেশের অনেকখানি ফাঁকা। যাদের সেখানে বসে থাকার । কথা ছিল তারা সেখানে ছিল না। অনেক ঊর্ধ্বলোকে উড়ে গেছে। বাকি সবাই ভিতরে সভাসদদের কাছে বসে ছিল। সেই সভামণ্ডপে একদা প্রধান দেবদূত লুসিফার বর্তমানে শয়তানরাজের সিংহাসন ছিল। সেখানে কিছু সৈনিক পাহারা দিচ্ছিল। তাদের সম্রাট কি খবর আনেন তারই প্রতীক্ষায় ছিল তারা।
শয়তান আসার সময় এই কথা বলে গিয়েছিল এবং তারা সে আদেশ পালন করে।
নরকের সৈনিকেরা নরক ছেড়ে নরকপ্রদেশের চারদিকে ঘুরে ঘুরে সদাসতর্ক দৃষ্টি প্রসারিত করে লক্ষ্য রাখছিল। তাদের রাজা যে নূতন জগতের সন্ধান করতে গেছে সে জগতের সংবাদ কখন পাঠাবে অথবা সে সংবাদ নিয়ে কখন আসবে তার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল তারা। কিন্তু শয়তানরাজ দেবদূতের ছদ্মবেশে বাইরে থেকে এসে নরকের মধ্যে প্রবেশ করায় তারা বুঝতে পারেনি। সে যখন তার সভামণ্ডপের উপরদিকে অবস্থিত সুউচ্চ সিংহাসনে বসল তখনো তাকে কেউ। দেখতে পেল না।
তখন মেঘের মত এক কুয়াশাজাল আচ্ছন্ন করে রেখেছিল শয়তানরাজকে। পরে সেই কুয়াশা থেকে নক্ষত্রের থেকে উজ্জ্বলতর এক নতুন উজ্জ্বলতার দ্বারা পরিবৃত তার মাথাটি বেরিয়ে এল যখন, তখন তাদের শক্তিমান রাজা ফিরে এসেছে দেখে আশ্চর্য হলো সকলে। উচ্চকণ্ঠে জয়ধ্বনি দিতে লাগল তারা।
এরপর প্রধান প্রধান মন্ত্রণাদাতারা আপন আপন আসন থেকে উঠে তাকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করে তার কাছে ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে গেল। শয়তানরাজ তখন নীরবে হস্ত প্রসারিত করে তাদের অভিনন্দন গ্রহণ করে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে বলতে লাগল, নূতন জগতের সন্ধান করতে গিয়ে আশাতীত সাফল্যলাভ করেছি আমি। আমি শুধু এক নূতন রাজ্য ও সিংহাসনের সমানাধিকার পাইনি, আমাদের অত্যাচারী শাস্তিদাতার নিষ্ঠুর দণ্ড পরিহার করে তার সমস্ত দণ্ডবিধানকে ব্যর্থ করে দিয়ে এই ঘৃণ্য অভিশপ্ত নরকগহুর হতে, এই যন্ত্রণাময় কারাগার হতে তোমাদের মুক্ত করে তোমাদের বিজয়গর্বে নিয়ে যাব সেখানে। এক বিরাট বিপদের ঝুঁকি নিয়ে যে প্রশস্ত জগৎ আমি লাভ করেছি সে জগৎ তোমরা অধিকার করে তা সকলে মিলে ভোগদখল করো। আমাদের আদি জন্মভূমি স্বর্গলোক থেকে কিঞ্চিৎ নিকৃষ্ট সে জগতের কথা আগেই জানাতাম তোমাদের, কিন্তু যাবার পথে দেরি হয়ে যায় আমার। তোমরা জান না, অনন্ত রাত্রির অন্ধকার আর নিরন্তর নিরবচ্ছিন্ন বিশৃংখলার দ্বারা পরিবৃত সতত বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের উপর সর্বগ্রাসী তরঙ্গমালা কতভাবে বাধা সৃষ্টি করে আমার পথে। পাপ আর মৃত্যু সম্প্রতি সেই বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের উপর এক প্রশস্ত সেতুপথ নির্মাণ করেছে যাতে তোমরা অনায়াসে তার উপর দিয়ে তোমাদের গৌরবময় অভিযানে। যেতে পার।
এইভাবে অতি কষ্টে দুর্গম পথ অতিক্রম করে নবনির্মিত সেই নূতন জগতে গিয়ে উপনীত হই আমি। এক আশ্চর্য পূর্ণতায় সুগঠিত সে জগৎ। আমাদের নির্বাসনের পর ঈশ্বর মানব সৃষ্টি করে সে জগতে স্থাপন করেন তাদের এবং তারা পরম সুখে বাস করতে থাকে সেখানে।
তোমরা শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবে, আমি সেই আদি মানব-মানবীকে প্রতারণার দ্বারা একটি আপেল ফল খেতে প্রলুব্ধ করি এবং তার ফলে তারা ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। তোমরা হয়ত শুনে হাসবে, এই অপরাধে ঈশ্বর তার সৃষ্ট ও তার প্রিয় সেই মানব-মানবীকে পরিত্যাগ করে চিরদিনের জন্য এবং মানবজাতির দ্বারা অধ্যুষিত সেই জগৎকে পাপ ও মৃত্যুর শিকার হিসাবে তাদের হাতে অর্থাৎ আমাদের হাতে তুলে দেন। বিনা কষ্টে ও শ্রমে সে জগতে বাস করে মানবজাতির উপর প্রভুত্ব করতে পারব আমরা। সেই সঙ্গে তাদের অধিকৃত সব বস্তুই আমাদের অধিকারে আসবে।
অবশ্য আমার কাজের জন্য ঈশ্বরপুত্র আমারও বিচার করেছে। হয়ত আমার নয়, যে সর্পের দেহ ধারণ করে এ কাজ করি সেই সর্পের বিচারও করেছে। আমার উপর অভিশাপ দিয়ে আমার ও মানবজাতির মধ্যে এক চিরশত্রুতার সম্পর্ক স্থাপন করে। আমি মানুষের গায়ে আঘাত করব আর মানুষেরা আমার মাথায় আঘাত করবে। আঘাত তো দূরের কথা, একটি নূতন জগৎ লাভ করতে হলে অনেক আঘাত, অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়। আমার কার্যাবলীর পূর্ণ বিবরণ তোমরা পেয়েছ। এখন শুধু সেখানে প্রবেশ করে পরম সুখে বাস করতে থাক।
এই কথা বলার পর এক বিপুল হর্ষধ্বনি ও অভিনন্দনসূচক সমবেত চিৎকার শোনার আশংকায় থামল শয়তানরাজ। কিন্তু তার পরিবর্তে সব দিক হতে এক ঘৃণার গুঞ্জনধ্বনি শুনতে পেল। তা শুনে আর্য হয়ে গেল সে।
কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে থাকতে হলো না তাকে। সহসা তার দেহটা আপনা থেকে শক্ত ও খাড়া হয়ে উঠল। তার হাতদুটো আর পাজরের সঙ্গে জুড়ে গেল। তার পাদুটো জড়াজড়ি হয়ে এক হয়ে গেল। সে মুখ থুবড়ে সটান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে সে এক বিরাট সর্পে পরিণত হলো। সে বুঝল, এক বৃহত্তর শক্তি তার শয়তানসুলভ সকল শক্তিকে ব্যর্থ করে দিয়ে যে সর্পরূপ ধারণ করে পৃথিবীতে গিয়ে পাপ কাজ করে আসে সেই সপে পরিণত করে তুলেছে তাকে।
সে কথা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু তার কাটার মত জিহ্বা থেকে শুধু একটা হিস হিস শব্দ বেরিয়ে এল। কারণ এখন তার দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও ইন্দ্রিয়সমূহ সাপের মত হয়ে গেছে।
শয়তানরাজ দেখল সে শুধু একা নয়, তার সমস্ত সহচর ও অনুগামীর দল তার মত সর্পদেহে হয়েছে রূপান্তরিত। সমস্ত সভাগৃহ জুড়ে নানাজাতীয় অসংখ্য সাপ কিলবিল করে বেড়াচ্ছে আর ফোঁস ফোঁস শব্দ করছে। দুমুখো সাপ, শৃঙ্গধারী সাপ, জলচর সাপ, তরবারি সাপ, যে সাপ কামড়ালে তীব্র পিপাসায় মানুষ মারা যায় সেই সাপ প্রভৃতি কত রকমের সাপ ঘুরে বেড়াতে লাগল সেখানে। যে লিবিয়ার মেদুসার মাথা থেকে ঝরে পড়া এক একটি রক্তবিন্দু সাপ হয়ে ওঠে, সেই লিবিয়া ও অফিউসা দ্বীপেও এত সাপ দেখা যায়নি কখনো।
কিন্তু মাঝখানে ড্রাগনাকৃতি বিরাটকায় যে সাপটি ছিল তার শক্তি সবার থেকে বেশি ছিল বলে অন্যান্য সাপগুলি তারই অনুসরণ করতে লাগল। তারা সেই সভাগৃহ থেকে বার হয়ে একটি ফাঁকা মাঠে এসে পড়ল। সেখানে শয়তানরাজের অন্যান্য অনুগামীরা আগে হতেই তাদের নেতার প্রত্যাবর্তন প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু তাদের নেতা যে ফিরে এসেছে কিছুক্ষণ আগে তা তারা জানতে পারেনি।
এমন সময় সেই সব পর্যবেক্ষণকারী অনুচরেরা দেখল নরকের অভ্যন্তরভাগ হতে অসংখ্য সাপ কিলবিল করতে করতে বেরিয়ে আসছে। দেখার সঙ্গে সঙ্গে বিস্মিত ও হতবুদ্ধি হয়ে গেল তারা। কিন্তু কিছু বুঝতে পারার আগেই তাদের দেহগুলিও সাপে পরিণত হয়ে উঠল একে একে। তাদের নেতা নতুন করে যে পাপ করে এসেছে সেই পাপের শাস্তি নেতার সঙ্গে তার সব অনুগামীদের উপরেও বর্তাল।
সঙ্গে সঙ্গে সেই সব সর্পকুলের সামনে জ্ঞানবৃক্ষের অনুরূপ একটি গাছ গজিয়ে উঠল। তার ফলগুলি জ্ঞানবৃক্ষের ফলের মতোই সুন্দর, সে ফল খেতে ঈভকে প্রলুব্ধ করেছিল শয়তান।
তারা ভাবল সেই ফল খেয়ে তারা তাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটাবে। এই আশায় তারা সাপের মত গাছের গুঁড়ি বেয়ে ডালের উপর উঠে গেল। তারা ফল পেড়ে খেতে লাগল। কিন্তু খাবার সঙ্গে সঙ্গে হতাশায় মুখ ফিরিয়ে নিল তারা। তারা আস্বাদ করে দেখল আসলে ফলগুলি শুধু মাটি আর তিক্ত ছাই দিয়ে ভরা। মুখ বিকৃত করে ফিরে এল তারা।
একদিন আদি মানব-মানবী যেমন প্রলুব্ধ ও মোহগ্রস্ত হয়ে জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করার পর মোহমুক্ত হয় তেমনি মোহমুক্ত হলো এই সর্পকুল।
এইভাবে ঈশ্বরপুত্রের বিচারে পাপের শাস্তিস্বরূপ শয়তানরা সাপে পরিণত হয়ে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ঘুরে বেড়াতে লাগল সমস্ত নরকপ্রদেশের সীমানা জুড়ে। প্রতি বৎসর একবার করে মাত্র কয়েকদিনের জন্য আগের রূপ ফিরে পেত তারা। এই সময় মানবজাতির পতন ঘটাতে পারার জন্য গর্ববোধ করত তারা। নির্দিষ্ট কয়েকদিন পরেই আবার সর্পদেহ ধারণ করতে হত তাদের।
এদিকে তখন মর্ত্যলোকে অবস্থিত ঈশ্বরনির্মিত স্বর্গোদ্যানে পাপ ও মৃত্যু দুই ভাইবোন দেহ ধারণ করে উপস্থিত হলো।
পাপ এই সময় মৃত্যুকে বলল, হে সর্বজয়ী মৃত্যু, শয়তানের দ্বিতীয় সন্তান, আমাদের নবলব্ধ সাম্রাজ্য সম্বন্ধে তুমি কি মনে করো? বহু কষ্টে অর্জিত হয়েছে এই সাম্রাজ্য। আমার মতে এর আগে আমরা যে নরকদ্বারে প্রহারায় নিযুক্ত ছিলাম সেখানে আমরা অগৌরবের সঙ্গে অর্ধবুভুক্ষু অবস্থায় থাকলেও আমরা সেখানে নির্ভয়ে ছিলাম। সে জায়গা থেকে এ জায়গা মোটেই ভাল মনে হচ্ছে না।
পাপ এই কথা বললে পাপসঞ্জাত মৃত্যু তখন উত্তর করল, যে আমি অনন্ত ক্ষুধার জ্বালায় সতত পীড়িত তার কাছে নরক, মর্ত্য ও স্বর্গ সবই সমান। আমার কাছে সেটাই হলো উত্তম স্থান যেখানে আমি আমার সবচেয়ে বেশি খোরাক পাই, যেখানে অনেক অন্ধকার গুহা পাওয়া যায়। এখানকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অনেক সেরকম গুহা থাকলেও আমার উদরপূর্তির উপযুক্ত খাদ্যবস্তু কম। নেই বললেও চলে। এখানকার জনমানবহীন বিস্তীর্ণ সব অঞ্চল প্রাণহীন অবস্থায় পড়ে আছে।
তখন ব্যভিচারিণী মাতা পাপ বলল, তাই তুমি প্রথমে এখানকার গাছপালা, ফুল, ফল খাও, তারপর জীবজন্তু, মাছ, পক্ষীদের ভক্ষণ করবে, হয়ত মানুষ পাবে না। কালের আঘাতে যাদেরই ধ্বংস হবে, যাদেরই কাল পূর্ণ হবে, নির্বিচারে গ্রাস করবে তাদের।
এদিকে আমি চিরকাল মানবজাতির মধ্যে থেকে তাদের সকল কর্ম, চিন্তা, কথা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত ও কলুষিত করে ধীরে ধীরে তোমার শিকারে পরিণত করে তুলব তাদের।
এই বলে কয়েকটি পথ ঘুরে বেড়াল তারা। সবকিছুকে ধ্বংস করে ধ্বংস ও মৃত্যুর শিকারের বস্তুতে পরিণত করতে চাইল তারা। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তার ঊর্ধ্বলোকের আসন থেকে সাধু আত্মাদের সঙ্গে এইসব দেখে বললেন, ঐ দেখ যে জগৎকে আমি কত ভাল ও সুন্দর করে সৃষ্টি করেছি, সে জগৎকে ধ্বংস ও মরুভূমির প্রাণীশূন্য করার জন্য নরকের কুকুরগুলো এক উত্তপ্ত কামনায় অন্ধ হয়ে অগ্রসর হচ্ছে। সে জগৎকে আমি আজও সুন্দরই রাখাতম যদি না মানুষ তার নির্বুদ্ধিতাবশত ঐ সব ভয়ঙ্কর ধ্বংসলোলুপ জীবগুলোকে ডেকে না আনত। ঐ জীবগুলো শয়তানরাজের মত আমাকেও নির্বোধ মনে করত। আমি আমার নির্মিত স্বর্গোদ্যানে ঐ জগতে তাদের প্রবেশ করতে দিয়েছি। আমার ঘৃণ্য শত্রুদের উপর আমার প্রতিশোধবাসনা চরিতার্থ করার জন্য আমি ঐ জগৎ নরকের কুকুরগুলোর অধিকারে ছেড়ে দিয়েছি। আনন্দের আবেগে ও জগতের উপরে তাদের প্রভুত্বকে আমরা মেনে নিয়েছি।
কিন্তু আমার ঐ নরকের কুকুরগুলো জানে না আমিই তাদের ওখানে টেনে এনেছি। মানুষ তার যে পাপের কলুষ ও আবর্জনা দিয়ে মর্ত্যের যা কিছু পবিত্র তা সব কলুষিত করে দিয়েছে সেই পাপের কলুষ ওরা সব চেটে খাবে। হে আমার বিজয়ী পুত্র, নরকের যে মুখগহ্বর থেকে পাপ, মৃত্যু ও যে সব বিশৃঙ্খলা উঠে এসেছে সেই মুখগহুর চিরতরে বন্ধ করে দাও। যাতে স্বর্গ ও মত নরকের কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে নূতন করে আবার পবিত্র হয়ে উঠতে পারে। তার আগে পর্যন্ত ওদের উপর তোমার ঘঘাষিত অভিশাপ কাজ করে যাবে।
এই বলে চুপ করলেন ঈশ্বর এবং উপস্থিত শ্রোতৃবৃন্দ তার জয়গান গাইতে লাগল। হে পরমেশ্বর, তোমার পথ মঙ্গলময়, তোমার সকল কর্মের বিধান ন্যায়সঙ্গত। তোমার প্রভুত্বকে কে অস্বীকার করতে পারে?
তারপর মানবজাতির পরিত্রাতা ঈশ্বরপুত্রের জয়গান গাইল তারা। যাঁর প্রসাদে স্বর্গ ও মর্ত্য উন্নতির উচ্চশিখরে আরোহণ করবে অথবা যাঁর বিধানে মর্ত্যলোক হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে নীচে নামতে থাকবে।
তাদের এই জয়গান গাওয়া হয়ে গেলে ঈশ্বর তার শক্তিমান দেবদূতদের নাম ধরে ডেকে তাদের নূতন নূতন কাজের দায়িত্বভার অর্পণ করলেন। তারপর সূর্যকে ডেকে বললেন তার আবর্তন যেন এমন হয় যাতে পৃথিবী দুঃসহ শীতাতপের তীব্রতার দ্বারা জর্জরিত হয়। উত্তর দিক হতে যেন আসে জড়তাপূর্ণ শীতের হাওয়া আর দক্ষিণ থেকে আসে দুঃসহ গ্রীষ্মের তাপ। এরপর চন্দ্র ও পাঁচটি গ্রহকেও তাদের আপন আপন কাজ বুঝিয়ে দিলেন। গ্রহগুলি যেন তাদের অশুভ প্রভাব বিস্তার করে যায় পৃথিবীর উপরে।
বায়ুপ্রবাহ যেন তীব্রবেগে পৃথিবীর সমুদ্র ও উপকূল ভূমিগুলিতে প্রবাহিত হয়, যেন আকাশ থেকে ভয়াবহ বজ্রপাত হয়।
এরপর ঈশ্বর তার দেবদূতদের পৃথিবীর দুই মেরুতে সূর্যের কক্ষপথ হতে কুড়ি ডিগ্রী করে দূরে সরিয়ে দিতে আদেশ দিলেন। পূর্বে সূর্যের গতিপথ পথিবীর বিষুবরেখার সঙ্গে সমান্তরাল ছিল। ফলে একটিমাত্র ঋতু ছিল। কিন্তু পৃথিবীর কক্ষপথটিকে সরিয়ে দেওয়ার ফলে সূর্যের গতিপথ বিভিন্ন রাশিতে ভাগ হয়ে গেল। তার ফলে একটির জায়গায় বিভিন্ন ঋতুর আবির্ভাব হলো। বিভিন্ন ঋতু পর্যায়ক্রমে পরিবর্তিত হতে লাগল। পূর্বে শুধু একটিমাত্র ঋতু ছিল আর সে ঋতু ছিল বসন্ত। বসন্ত সারা বৎসর পৃথিবীকে ফুলে-ফলে হাস্যোজ্জ্বল করে রাখত, দিনরাত্রি সমান হত। সূর্য তখন এমনভাবে আবর্তিত হত ও তার গতিপথ এমন ছিল যাতে কোন শীতল সমুদ্রস্রোত, শৈত্যপ্রবাহ বা তুষারপাত কোন ক্ষতি করতে পারত না পৃথিবীর। নিষ্পাপ পৃথিবী তখন মানবাধ্যুষিত না হলেও তীব্র শীত-গ্রীষ্মের কোন যন্ত্রণা ছিল না সেখানে।
কিন্তু মানুষ নিষিদ্ধ ফলভক্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গে সূর্য ঈশ্বরের নির্দেশে তার গতিপথ পরিবর্তন করে। আকাশমণ্ডলে সৌরজগতের পরিবর্তনের ফলে ধীরে ধীরে পৃথিবীর সমুদ্রভাগে ও ভূপ্রকৃতিতেও পরিবর্তন দেখা দেয়। উত্তপ্ত বাষ্প, কুয়াশা, তুষারড় প্রভৃতি পৃথিবীকে বিব্রত করে তুলতে লাগল ক্রমাগত। বিভিন্ন দিক হতে উত্তর-পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম প্রভৃতি ভয়ঙ্কর বায়ুপ্রবাহগুলি পৃথিবীর বনভূমিকে বিদীর্ণ করে সমুদ্রের জলরাশিকে উত্তাল ও বিক্ষুব্ধ করে ঝড়ের বেগে প্রবাহিত হতে লাগল। তাদের ভয়ঙ্কর গর্জনে বিকম্পিত হতে লাগল পৃথিবী।
এইভাবে পৃথিবীর জড়বস্তু ও প্রকৃতির উপাদানগুলি বিক্ষোভে ও বিশৃংখলায় ফেটে পড়তে লাগল। তারপর পাপের তৎপরতায় প্রাণীজগতের মধ্যে অনৈক্য ও তীব্র বিরোধিতা শুরু হলো। বিভিন্ন পশু ও মৎসকুলের মধ্যে শুরু হলো অন্তর্দ্বন্দ্ব। তারা নিজেদের স্বজাতিকেই খেতে লাগল। মানুষকে তারা খুব একটা ভয় করত না। মানুষের কাছ থেকে তারা দূরে থাকলেও মানুষকে তাদের পাশ দিয়ে যেতে দেখলে হিংসায় গর্জন করত।
আদম এক অন্ধকার বনপ্রদেশের নিভৃতে লুকিয়ে থাকলেও এইব ক্রমবর্ধমান দুঃখের অভিজ্ঞতা সে লাভ করতে থাকে। বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের মত আলোড়িত হতে থাকে তার অন্তর।
তার ভারী অন্তরটাকে হালকা করার জন্য সে অভিযোগের ভঙ্গিতে বলতে থাকে, হে দুঃখী, তোমার সব দুঃখের শেষ। এই কি সেই গৌরবময় জগতের শেষ পরিণতি? সমস্ত গৌরবের অবসানে আজ আমি কতই না অভিশপ্ত। যে ঈশ্বরের মুখদর্শন করাই ছিল আমার জীবনের পরম সুখ আজ সে মুখদর্শনের ভয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছি আমি। যদি এই দুঃখের এখানেই শেষ হয় তাহলেও ভাল। এই দুঃখ এবং শাস্তির যোগ্য ছিলাম আমি এবং আমি তা সহ্য করেছি। যে দুঃখ পাওয়ার আমি যোগ্য, সে দুঃখের যদি এখানেই অবসান হয় তাহলেই ভাল। কিন্তু অত সহজে সে দুঃখের অবসান হবে না। আমি যা কিছু খাই বা পান করি এবং আমার থেকে যে সব সন্তান উৎপন্ন হবে তাদের দ্বারা শুধু আমার অভিশাপ বিস্তার লাভ করবে।
‘সন্তান উৎপাদনের দ্বারা তোমাদের সংখ্যাবৃদ্ধি করো’–একথা আগে শুনলে আমি আনন্দ পেতাম, কিন্তু এখন একথা মৃত্যুর মতো শোনায়। কারণ আমাদের সংখ্যাবৃদ্ধি মানেই আমার মাথার উপর অভিশাপের বোঝাটা বাড়ানো। সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরো ভারী হয়ে উঠবে সে অভিশাপের বোঝাটা। আমার ভবিষ্যতের বংশধর বা উত্তরসূরীর সবাই এ পৃথিবীতে যারা আসবে আমার দ্বারা আনীত দুঃখ তাদেরও ভোগ করে যেতে হবে এবং তার জন্য আমাকে তারাও অভিশাপ দেবে।
তারা বলবে, ‘আমাদের পূর্বপুরুষ বা আদিপুরুষ অপবিত্র, কলুষিত, আমরা শুধু আদমকে এই ধন্যবাদটুকুই দিতে পারি।’ ফলে আমার নিজস্ব দুঃখের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিদ্রূপ ও কটুক্তিজনিত দুঃখ অনেকগুণ বেড়ে ফিরে আসবে আমার কাছে।
‘হে পলাতক আদম, কত ক্ষণভঙ্গুর তুমি! তুমি যেতে না যেতেই স্থায়ী দুঃখ এসে তোমার স্থান দখল করল।’ আমি কি স্রষ্টার কাছে মাটি থেকে এই দুঃখভোগের জন্যই আমাকে সৃষ্টি করতে অনুরোধ করেছিলাম? অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে এসে এই মনোহর স্বর্গোদ্যানে আমাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কি প্রার্থনা করেছিলাম আমি?
আমার জন্মের ব্যাপারে আমার ইচ্ছার যদি কোন ভূমিকা না থাকে, আমি যদি আমার জন্মের জন্য আমার স্রষ্টাকে কোন অনুরোধ করে না থাকি, স্রষ্টা যদি নিজের ইচ্ছায় আমাকে সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে কেন তিনি আমাকে মানুষ হিসাবে সৃষ্টি না করে এক জড়বস্তু হিসাবে সৃষ্টি করলেন না; যার নিজস্ব ইচ্ছা বা মন বলে কোন জিনিস নেই, যা ঈশ্বরের বিধানের কাছে সতত সমর্পিতপ্রাণ? কিন্তু আমি মানুষ হিসাবে আমার ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের জন্য ঈশ্বরের সব বিধান মেনে নিতে পারিনি। আর তার ফলে অন্তহীন অভিশাপ ও শাস্তিভোগ করে যেতে হচ্ছে। কিন্তু আমি যদি মাটি বা কোন জড়বস্তু হয়ে জন্মাতাম তাহলে আমাকে এই দুঃখ ভোগ করতে হত না।
এই শাস্তিভোগের সঙ্গে হে ঈশ্বর, তুমি আবার এই অনন্ত দুঃখভোগ যুক্ত করেছ। দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে তোমার এই ন্যায়বিচার। কিন্তু এ প্রতিবাদ বড় বিলম্বিত হয়ে গেল। ঈশ্বর যখন সেই বিধান আরোপ করেন আমার উপর তখনি তার প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। ঈশ্বরের কাছ থেকে সব দানগুলি নিয়ে তার বিধানলঙঘনজনিত এই দুরবস্থার জন্য অনুশোচনা করা বৃথা।
তাছাড়া ঈশ্বর আমার অনুমতি না নিয়েই আমাকে সৃষ্টি করেছেন বলে যদি অনুযোগ করি তাহলে আমার সন্তানরাও আমার অবাধ্য হয়ে আমাকে তিরস্কার করে বলতে পারে, আমাদের জন্ম দিয়েছিলে? আমরা এ জন্ম চাইনি।
তাদের সেই ঘৃণামিশ্রিত উদ্ধত অভিযোগ কি তুমি মেনে নিতে পারবে? অথচ তুমি তাদের নির্বাচন করে ইচ্ছা করে জন্ম দেবে না, প্রকৃতির বিধানে স্বাভাবিকভাবেই তাদের জন্ম হবে। ঈশ্বর তোমাকে তাঁর সেবা করার জন্যই নির্বাচন করে জন্মদান করেছেন। এই সেবাদ্বারা তার তুষ্টিবিধান করলে পুরস্কার হিসাবে তার মহিমার কিছুটা লাভ করতে। কিন্তু তা করনি। সুতরাং তার প্রচণ্ড শাস্তি ন্যায়সংগত। তাই হোক, আমি তার ন্যায়সংগত দণ্ড মাথা পেতে ভোগ করে যাব। মাটি থেকে উদ্ভূত হয়ে আমি মাটিতেই ফিরে যাব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
কিন্তু আজ তিনি যে দণ্ডের বিধান দিয়েছেন তা কার্যকরী হতে এত বিলম্ব হচ্ছে কেন? কেন আমি এখনো বেঁচে আছি? কেন মৃত্যু আমার সঙ্গে ছলনা করে মৃত্যুযন্ত্রণা এত দীর্ঘায়িত করছে? কত আনন্দের সঙ্গে আমি মৃত্যুদণ্ড লাভ করে অচেতন জড়বস্তু হয়ে মাতৃক্রোড়ে শিশুর মত মাটির বুকে ঘুমিয়ে পড়ব। সেখানে আমি অনন্ত নিদ্রায় অভিভূত হয়ে চিরবিশ্রাম লাভ করব। তার ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর বজ্রগর্জনের মত আমার কানে আর ধ্বনিত হবে না। আমার বা আমার সন্তানদের উপর আরোপিত কোন ভয়ঙ্কর শাস্তির ভয়াবহ প্রতীক্ষায় দিনযাপন করতে হবে না।
তবু একটা সংশয় আমার মন থেকে যাচ্ছে না। হয়ত সম্পূর্ণ মৃত্যু হবে না আমার। আমার দেহাবসানের সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরপ্রদত্ত আত্মার মৃত্যু হবে না। হয়ত সমাধিগহ্বরের ভিতরে অথবা অন্য কোন ভয়াবহ স্থানে আমাকে এক জীবন্ত মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে যেতে হবে।
একথা ভাবতেও ভয় লাগে। কিন্তু কেন? পাপ যা করেছে তা তো আমার জীবনচৈতন্য, আমার দেহ তো কিছু করেনি। তবু আমার দেহ এবং জীবনচৈতন্য কেন একই সঙ্গে বিনষ্ট হবে? তবু আর সংশয় নয়, মানুষের জ্ঞান এর থেকে বেশি কিছু জানতে পারে না।
ঈশ্বর অনন্ত, অমর। কিন্তু তাঁর রোষও কি অনন্ত, অমর? কিন্তু মানুষ মরণশীল। মৃত্যুই তার শেষ পরিণতি। মানুষের জীবন যদি অনন্ত না হয়, তাহলে সেই মরণশীল মানুষের উপর ঈশ্বর কি করে তাঁর অনন্ত রোষ আরোপ করে যাবেন? তবে কি তিনি মৃত্যুহীন মৃত্যু ঘটাতে পারেন? এই আশ্চর্যজনক বৈপরীত্য এই অসম্ভব ব্যাপারের সংঘটন একমাত্র সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের দ্বারাই সম্ভব। আমাদের মত দুর্বল মানুষের পক্ষে তা বোঝা বা সে রহস্য ভেদ করার শক্তি নেই।
তবে কি তিনি ক্রোধের খাতিরে শান্ত মানুষকে অনন্ত করে তুলবেন? তাঁর অতৃপ্ত রোষাবেগকে তৃপ্ত করার জন্য মানুষের উপর আরোপিত শাস্তির কঠোরতাকে অনন্তপ্রসারিত করে তুলবেন? সে রোষাবেগ কি কখনো তৃপ্ত হবে না? যে প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে প্রকৃতিজগতের সকল বস্তু কার্যকারণতত্ত্বের অধীন হয়ে কাজ করে, তিনি কি তার দণ্ডাদেশকে সেই নিয়মের উর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে চান?
কিন্তু আমি যা ভেবেছিলাম, মৃত্যুর আঘাত কি আমার উপর অকস্মাৎ নেমে এসে একমুহূর্তের মধ্যে সবকিছুর শেষ করে দেবে না? তা না হয়ে সে মৃত্যুর চিরস্থায়ী যন্ত্রণা আজ থেকে অনন্তকাল ধরে প্রসারিত হবে? হায়, এই ভয় এক ভয়াবহ আবর্তনে এক জ্বলন্ত বজ্রাগ্নির মত বারবার আনাগোনা করছে আমার অসহায় মস্তিষ্কের মধ্যে। মনে হচ্ছে মৃত্যু এবং আমি দুজনেই অনন্ত এবং আমরা দুজনে অঙ্গাঙ্গী ও অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। আমি একা নই, আমার মধ্য দিয়ে আমার সমস্ত ভবিষ্যৎ বংশধরেরাও অভিশপ্ত হবে।
হে আমার বংশধরগণ, যদি পারতাম, আমি নিজে সব শাস্তি সব অভিশাপের বোঝা বয়ে বয়ে নিজেকে ক্ষয় করে তোমাদের এক বিশুদ্ধ সুন্দর পিতৃত্ব দান করে যেতাম। কারণ তোমরা অভিশাপগ্রস্ত হয়ে আর আমাকে কোন আশীর্বাদ করতে পারবে না, কোন শ্রদ্ধা জানাতে পারবে না।
কিন্তু মাত্র একটি মানুষের জন্য কেন সমগ্র মানবজাতি কোন দোষ না করেই অভিশপ্ত হবে? আমার থেকে দুর্নীতি, পাপ আর কামনার কলুষ ছাড়া আর কি উৎপন্ন হতে পারে? সেই কলুষ নিয়ে কেমন করে তারা ঈশ্বরের রোষ হতে মুক্ত হয়ে দাঁড়াবে তার সামনে?
আমার সকল প্রতিবাদ ও ক্ষুব্ধ গুঞ্জন সত্ত্বেও আমি ঈশ্বরের উপর আর কোন দোষারোপ করি না। আমার সকল যুক্তি সকল অনুসন্ধান বিভিন্ন পথ ঘুরে শেষে আমার দোষকেই সাব্যস্ত করছে। আমাকে সকল দোষ ও দুর্নীতির উৎস হিসাবে সপ্রমাণিত করছে। সুতরাং ঈশ্বরের রোষ ও তার শাস্তিবিধান ন্যায়সংগত।
হে আমার কামনা, তুমি কি ঐ পৃথিবীর থেকে ভারী এই শাস্তির বোঝা দুষ্টা নারীর সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে বহন করে যেতে পারবে? তুমি যাই ইচ্ছা করো বা ভয় করো, পরিত্রাণের সকল আশাই তাতে বিনষ্ট হবে। তোমার দুঃখভোগ অতীত ও ভবিষ্যতের সকল দৃষ্টান্তকে ছাড়িয়ে যাবে। অপরাধ ও শাস্তির দিক থেকে তা একমাত্র শুধু শয়তানের দুঃখের সঙ্গে তুলনীয়।
হে আমার বিবেক, কোন বিভীষিকাময় গহ্বরের অতল অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছ আমাকে যেখান থেকে আমি মুক্তির কোন পথ খুঁজে পাচ্ছি না? শুধু গভীর থেকে গভীরতর স্তরে নিমজ্জিত হচ্ছি আমি।
এইভাবে আদম সেই নির্জন নিস্তব্ধ রাত্রিতে আপন মনে উচ্চকণ্ঠে আত্মবিলাপ করল। তার পতনের আগে পর্যন্ত রাত্রি শান্ত ছিল। বাতাস ছিল মৃদুমন্দ। কিন্তু আজ হিমশীতল এলোমেলো বাতাস বইতে লাগল। তার বিবেক কলুষিত হয়ে পড়ায় এক সংশয়ান্বিত আশঙ্কা রাত্রির অন্ধকার ও প্রকৃতির সব বস্তুকে দ্বিগুণ ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল তার কাছে। হিমশীতল মাটির উপর সে তার দেহটাকে প্রসারিত করে শুয়ে পড়ল। সে তার জন্মকে অভিশাপ দিতে লাগল। তার পাপকর্মের শাস্তিস্বরূপ যে মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয় সে মৃত্যুদণ্ড এখনো পর্যন্ত কার্যকরি না হওয়ায় মনে মনে অনুযোগ করে আসছিল সে।
সে বলল, একটিমাত্র আঘাতে তার জীবনের অবসান ঘটানোর জন্য মৃত্যু কেন আসছে না? সত্য কি তার কথা রাখতে ব্যর্থ হবে? ঐশ্বরিক ন্যায়বিচার কেন তার সার্থকতাকে প্রতিপন্ন করছে না?
কিন্তু মৃত্যু আসছে না কেন? শত প্রার্থনা ও ক্রন্দন সত্ত্বেও ঐশ্বরিক ন্যায়বিচার তার মন্দগতিকে দ্রুত করছে না। হে বনভূমি, ঝর্ণা, পাহাড়, উপত্যকা ও কুঞ্জবন, তোমরা আগে অন্য এক সঙ্গীতের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত করতে।
আদমকে এইভাবে দুঃখে আর্ত দেখে ঈভ অন্য এক নির্জন জায়গায় বসে থাকতে থাকতে তার কাছে উঠে এসে শান্তমেদুর কণ্ঠে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল।
কিন্তু আদম কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করল তার আবেদন। সে তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল, আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাও নাগিনী, তুমি সাপের সঙ্গে একদিন বন্ধুত্ব করেছিলে, সুতরাং এই নামই তোমার যোগ্য। সাপের মতোই তুমি মিথ্যাচারী ও ঘৃণ্য। সাপের মত তোমার আকৃতি এবং গায়ের রং। তোমার অন্তর্নিহিত প্রতারণামূলক কুটিল প্রকৃতিকে প্রকটিত করে অন্যান্য প্রাণীদের কাছ থেকে দূরে সরে যাবার জন্য সতর্ক করে দেয়।
অহঙ্কার আর আত্মম্ভরিতার বশবর্তী হয়ে যদি তুমি আমার সতর্কবাণী প্রত্যাখ্যান না করতে তাহলে আমি সুখেই জীবনযাপন করতাম। আমার উপর থেকে সব আস্থা ঘৃণাভরে প্রত্যাহার করে শয়তানের হাতে সহজে ধরা দেবার জন্য চলে যাও তুমি। তারপর সেই সর্পরূপী শয়তানের সঙ্গে দেখা হওয়ায় নির্বোধের মত তার ছলনায় ধরা দাও তুমি এবং তোমার ছলনায় আমি ভুলে যাই। তোমাকে বিজ্ঞ ভেবে তোমার কথায় বিশ্বাস করি আমি। ভাবি তুমি এমন সব পরিণত ও নির্ভরযোগ্য গুণরাজির দ্বারা ভূষিত যার দ্বারা বাইরের যে কোন প্রলোভনাত্মক আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারবে।
কিন্তু তখন ভাবতে পারিনি তোমার ঐ সব গুণ এক ভ্রান্ত বহিরাবরণ মাত্র যার মধ্যে নির্ভরযোগ্য কোন দৃঢ়তা নেই। এখন বুঝতে পারছি আমার বক্ষদেশ হতে নিষ্কাশিত এক বক্রকুটিল পাঁজরা ছাড়া তুমি আর কিছুই নও।
যিনি পরম প্রভাসম্পন্ন পরম স্রষ্টা, যিনি যত সব পুরুষ দেবদূতদের সবচেয়ে ঊর্ধ্বে, স্বর্গলোকে বিরাজ করেন, তিনি কেন প্রকৃতির এক সুন্দর অথচ বিকৃত রূপ হিসাবে পৃথিবীতে এই নারীকে সৃষ্টি করলেন? কেন তিনি পৃথিবীকে সম্পূর্ণরূপে নারীবর্জিত করে শুধু পুরুষ দেবদূতদের দ্বারা তা পূর্ণ করলেন না? কেন তিনি মানবজাতির জন্মের অন্য কোন উপায় উদ্ভাবন করলেন না?
তাহলে এই ক্ষতিকারক অঘটন সংঘটিত হত না! শুধু তাই নয়। ভবিষ্যতে পৃথিবীর ছলনাময়ী নারীর পাতা ফাঁদে ধরা পড়ে কত পুরুষের জীবন বিষময় হয়ে উঠবে, কত বিপত্তি সংঘটিত হবে। হয় পুরুষ তার যোগ্য নারীকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে খুঁজে . পাবে না অথবা ভুল করে যাকে নির্বাচন করবে, সে তার জীবনে নিয়ে আসবে দুঃখ অথবা দুর্ভাগ্যের পশরা। অথবা যে নারীর দ্বারা অনেক কিছু পেতে চাইবে সে যে নারীর অসততা ও অবিশ্বস্ততার জন্য কোন লাভই হবে না, বরং সমূহ ক্ষতি হবে তার। আবার যদি কোন নারী তাকে ভালবাসে অথচ তাদের পিতামাতা সে ভালবাসাকে অনুমোদন না করে অথবা যদি কোন হীন নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার পর অনেক দেরিতে সে তার পছন্দমত প্রেয়সীকে খুঁজে পায় তাহলে অন্তহীন ঘৃণা আর লজ্জা তার জীবনকে বিষময় করে তুলবে, তার পারিবারিক শান্তি বিনষ্ট হবে সমূলে।
আর কিছু না বলে মুখ ফিরিয়ে নিল আদম। ঈভ তবু চলে গেল না। তার চোখ দিয়ে তখনো ঝরে পড়ছিল অবিরল অশ্রুর ধারা, চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল আলুলায়িত কেশপাশ। এই অবস্থায় সে আদমের পায়ের উপর পড়ে তার পা দুটোকে জড়িয়ে ধরে তাকে শান্ত হবার জন্য অনুনয়-বিনয় করতে লাগল।
ঈভ বলল, আমাকে এইভাবে পরিত্যাগ করো না আদম। ঈশ্বর জানেন কত ভালবাসা, কত শ্রদ্ধা-নিষ্ঠার সঙ্গে আমার অন্তরে পোষণ করে আসছি আমি তোমার প্রতি। আমি না জেনেই এই পাপকর্ম করে ফেলেছি। আমি অন্যের দ্বারা সম্পূর্ণ প্রতারিত হয়েছি। আমি পা ধরে ক্ষমা চাইছি তোমার। আমার এই বাসস্থান থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করো না। এই দুঃখ ও দুরবস্থার মধ্যে তোমার চোখের দৃষ্টি, তোমার সাহায্য, তোমার পরামর্শই আমার একমাত্র সান্ত্বনা এবং আশ্রয়। তুমি না থাকলে তোমাকে ছাড়া কোথায় আমি যাব, কোথায় গিয়ে বেঁচে থাকব? আর যতক্ষণ আমরা বেঁচে থাকি, দুজনে একসঙ্গে শান্তিতে থাকাই ভাল। আমাদের পাপের শাস্তিস্বরূপ দুজনে যে একই দণ্ড লাভ করেছি, সেই দণ্ডজনিত এই দুরবস্থায় আমরা মিলিতভাবে থাকলে অনেক দুঃখের লাঘব হবে।
সেই নিষ্ঠুর সর্প এখন তো আর তোমার ঘৃণার গরল ঢেলে দিচ্ছে না আমার ওই দুঃখের উপরে। আমি তোমার থেকে অনেক দুঃখী। আমরা দুজনেই পাপ করেছি ঠিক, কিন্তু তুমি শুধু ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ করেছ কিন্তু আমি ঈশ্বর এবং তোমার এই উভয়ের বিরুদ্ধে পাপ করেছি।
এরপর যখন শেষ বিচারের দিন ঈশ্বরের কাছে যাব তখন হয়ত দেখা যাবে তার বিচারে সব দোষ আমার উপর পড়বে এবং তোমার উপর থেকে এই শাস্তির বোঝা নেমে এসে আমার উপর চাপবে। কারণ এই দুঃখ ও অভিশাপের মূল কারণ আমি। সুতরাং একমাত্র আমিই তার রোষের বস্তু।
ঈভ কাঁদতে কাঁদতে তার সব কথা শেষ করল। সেই পাপকর্মের অনুষ্ঠানের পর তার এই শোচনীয় অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। তার প্রতি আদমের কঠোর ব্যবহার আরও বাড়িয়ে দিয়েছে তার দুঃখকে।
এখন ঈভের অবস্থা দেখে তার দুঃখে কাতর হলো আদম। তার অন্তর কিছুটা নরম হলো। সে দেখল, যে ছিল একদিন তার জীবনের আনন্দ, তার প্রাণপ্রতিমা, সে আজ চরম দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় তার পায়ে পড়ে বারবার ক্ষমা চাইছে। পুনর্মিলন চাইছে তার কাছে। আজ সে তার সাহায্য চায়, তার স্পর্শ চায়। কিছু আগে সে ঈভের ব্যবহারে দারুণ অসন্তুষ্ট হলেও এখন তার সব রাগ দূরীভূত হয়ে গেল।
তাই আদম এবার শান্তকণ্ঠে বলতে লাগল, তুমি আমারই রোষ ও অসন্তোষ যখন বহন করতে পারছ না তখন ঈশ্বরের সমস্ত রোষ তুমি একা তোমার মাথায় তো বহন করতে পারবে না। যদি প্রার্থনার কোন দাম থাকে তাহলে আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব তিনি যেন তোমার মত এক দুর্বল নারীকে সম্পূর্ণরূপে মুক্তি দিয়ে আমার উপর চাপিয়ে দেন সব শাস্তির বোঝা।
যাই হোক, এখন ওঠ, আর ঝগড়া-বিবাদ করে লাভ নেই পরস্পরে। পরস্পরকে দোষ দিয়েও কোন লাভ নেই। এখন আমরা কিভাবে পরস্পরের দুঃখ ভাগ করে নিয়ে সেই দুঃখের বোঝাভার লঘু করে তুলতে পারি তার চেষ্টা করতে হবে। হায়, যেদিন মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয় সেদিন যদি জানতাম এ মৃত্যু শীঘ্র আসবে না, সে মৃত্যুযন্ত্রণা তিলে তিলে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের ও আমাদের হতভাগ্য বংশধরদের সহ্য করে যেতে হবে।
ঈভ তখন তাকে সাহস করে বলল, আদম, এক জ্বলন্ত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমি দুঃখের সঙ্গে জানতে পারলাম, আমি যে সব কথা তোমাকে বলেছিলাম, যে আশ্বাস তোমাকে দিয়েছিলাম তা কত গুরুত্বহীন, ঘটনার আঘাতে তা কত ভ্রান্ত ও দুঃখজনক প্রতিপন্ন হলো! এইসব সত্ত্বেও অর্থাৎ আমি পাপিষ্ঠ, একথা প্রকাশিত হলেও তোমার দ্বারা আমি তোমার প্রেমের আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলাম। আমি কত আশান্বিত হলাম। তোমার এই ভালবাসাই আমার জীবনে-মরণে একমাত্র সান্ত্বনা ও শান্তির উৎস।
যাতে আমি আমার চরম দুঃখের দিনে কিছুটা শান্তি পাই সেই আশায় আমার অশান্ত বুকে যে সব চিন্তার উদয় হচ্ছে তার কোন কিছুই আমি গোপন করব না তোমার কাছে।
আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য আমাদের দুশ্চিন্তা যদি আমাদের এতখানি বিব্রত ও বিপন্ন করে তোলে এবং সে চিন্তা যদি মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সমানে আমাদের দুঃখ দিতে থাকে, যদি মনে কর একটি জাতিকে এই অভিশপ্ত জগতে এনে বা জন্ম দিয়ে তাদের দুঃখের কারণ হব আমরা, তাহলে এই অবাঞ্ছিত ঘটনা পরিহার করার শক্তি তো তোমার মধ্যেই আছে। তাহলে যারা এখনো জন্ম নেয়নি সেই হতভাগ্য জাতির জন্মকে তো তুমি আগেই নিবৃত্ত করতে পার।
তুমি এখনো পর্যন্ত নিঃসন্তান আছ এবং নিঃসন্তান অবস্থাতেই থাক। তাহলে মৃত্যু প্রতারিত হবে। তাহলে যে মৃত্যু তার করাল দংষ্ট্রাদ্বারা শুধু আমাদের ধ্বংসসাধন করেই ক্ষান্ত ও তৃপ্ত হবে।
আর যদি মনে করো দাম্পত্য প্রেমের আনুষ্ঠানিক বা আনুষঙ্গিক ক্রিয়াকর্ম ও আলিঙ্গনাদি শৃঙ্কারকার্য হতে বিরত থাকা কঠিন হয়ে পড়বে তোমার পক্ষে আর তার ফলে দীর্ঘায়িত হবে যত সব দুঃখ ও বেদনা, তাহলে এস, আমরা দুজনে নিজেদের জীবন সংক্ষিপ্ত করে নিজেরাই মৃত্যু ঘটিয়ে যত দুঃখ ও ভয়ের অবসান করি। আমাদের সন্তান জন্মের পথ বন্ধ করে দিই চিরতরে। মৃত্যু যদি নিজে থেকে না আসে তাহলে তার ভয়ে সারাজীবন না কেঁদে নিজেদের হাতেই মৃত্যু ঘটাই নিজেদের। ধ্বংসের দ্বারা ধ্বংসকে ধ্বংস করি।
এইখানেই তার কথা শেষ করল ঈভ। গম্ভীর হতাশায় রুদ্ধ হলো তার কণ্ঠস্বর। এতক্ষণ ধরে মৃত্যুর যে চিন্তা পোষণ করে আসছিল তার মনে সে চিন্তাপ্রভাবে মলিন ও বিবর্ণ হয়ে গেছে তার গণ্ডদ্বয়।
আদম কিন্তু ঈভের এই পরামর্শে বিচলিত হলো না কিছুমাত্র। অনেক কষ্ট করে অনেক চিন্তা করে আরও বড় ও ভাল আশার সন্ধান পেয়েছিল সে। সে তাই বলল, ঈভ, তুমি জীবনের প্রতি যে ঘৃণা প্রদর্শন করলে তাতে বোঝা যাচ্ছে জীবনে এক মহত্তর ও অধিকতর ভাল একটা কিছু আছে। তুমি তা কল্পনাও করতে পারনি। কিন্তু আত্মহনন জীবনের সেই বৃহত্তর দিকটাকে লাভ করতে দেবে না। ঘৃণা নয়, অন্তর্বেদনা ও অনুশোচনাই জীবন ও তার আনন্দকে উপেক্ষা বা অগ্রাহ্য করতে বাধ্য করেছিল।
আবার দেখ, যদি তুমি এই দীর্ঘায়িত দুঃখ ও যন্ত্রণার হাত হতে মুক্তি পাবার জন্য মৃত্যু কামনা করো এবং এইভাবে তোমার উপর আরোপিত দণ্ডকে পরিহার করতে চাও তাহলে মনে রেখো, তোমার আমার থেকে অনেক বেশি বিজ্ঞ ঈশ্বর অত সহজে আমাদের ছাড়বেন না। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য হয়ত নূতন অস্ত্র প্রয়োগ করবেন। আমার মনে হয় মৃত্যুকে যদি আমরা এইভাবে ছিনিয়েও নিই তাহলে কিন্তু মৃত্যুযন্ত্রণার অবসান হবে না। কারণ এই যন্ত্রণাভোগ আমাদের করে যেতেই হবে, এটাই হলো ঐশ্বরিক শাস্তি। বরং আমরা একাজ করলে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর রেগে গিয়ে মৃত্যুর পরও বাঁচিয়ে রাখবেন আমাদের।
তার থেকে অন্য এক নিরাপদ সমাধানের খোঁজ করা উচিত। সে সমাধান মনে হয় পেয়ে গেছি। বিচারের রায় দেবার সময় ঈশ্বরপুত্র বলেন, তোমার বংশধরেরা সর্পকুলের মাথায় আঘাত করবে। আমাদের প্রধান শত্রু শয়তান সাপের রূপ ধরে আমাদের সঙ্গে যে, প্রতারণা করেছে তার জন্য আমাদের প্রতিশোধবাসনা কিছুটা চরিতার্থ হবে এইভাবে।
কিন্তু আমরা যদি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যাই অথবা তোমার কথামতো আমরা সন্তান সৃষ্টি না করি তাহলে আমাদের সন্তানরা সাপদের মাথা ভাঙতে পারবে না এবং আমাদের প্রতিশোধবাসনা কোনভাবেই চরিতার্থ হবে না। তাহলে আমাদের শত্রু সব শাস্তি এড়িয়ে যাবে এবং সমস্ত শাস্তির বোঝা কেবল আমাদেরই বহন করে যেতে হবে।
সুতরাং আত্মহনন বা স্বেচ্ছাকৃত বন্ধ্যাত্বের কথা আর বলবে না। তাহলে আমাদের কোন আশাই থাকবে না। তাহলে শুধু আত্মবিশ্বাস আর অধৈর্যের সঙ্গে ঈশ্বরের ন্যায়সঙ্গত বিধানের বিরুদ্ধে ঘৃণা আর বিতৃষ্ণা পোষণ করে যাব মনে মনে।
একবার মনে করে দেখ, কত শান্ত ও ধীরভাবে ঈশ্বরপুত্র আমাদের সব কথা শুনে কোনরূপ রাগরোষ না করে বিচার করে গেছেন। সেদিন আমরা ভেবেছিলাম বিচারের সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু ঘটবে আমাদের।
কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি রায় দেন, তোমাকে শুধু সন্তানপ্রসবের কষ্টভোগ করতে হবে। কিন্তু প্রসবের পর তোমার গর্ভের ফলস্বরূপ সন্তানের মুখ দেখে আনন্দ পাবে আর সেই আনন্দের দ্বারা সব প্রসববেদনার কথা ভুলে যাবে।
আমার সম্বন্ধে রায় দেন, আমাকে প্রতিদিন শ্রমের দ্বারা জীবিকা অর্জন করতে হবে। কিন্তু ক্ষতি কি তাতে? আলস্য এর থেকে অনেক খারাপ। আমার শ্রমই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। পাছে শীততাপে আমাদের কষ্ট পেতে হয় তার জন্য তিনি যথাসময়ে যত্ন নিয়ে বস্ত্রাবরণে আচ্ছাদিত করেন। এইভাবে আমাদের মত পাপিষ্ঠ ও অযোগ্যদের বিচার করার সময়েও দয়া প্রদর্শন করেন তিনি।
যদি আমরা তাঁর প্রার্থনা করি তাহলে তিনি তাঁর কুর্ণকুহর উন্মুক্ত করে নিশ্চয়ই তা শুনবেন। করুণা জাগবে তার অন্তরে।
বর্তমানে এই পাহাড়ে প্রকৃতির নির্দয়তাহেতু ঋতুবৈষম্যে বৃষ্টি, তুষার, ঝড় ও আরপাতে কষ্ট পাচ্ছি। তীক্ষ্ণ হিমেল বাতাস যখন ঝড়ের বেগে এই সব সুন্দর গাছগুলিকে বিদীর্ণ করে প্রবাহিত হচ্ছে, আমরা যেন আরও আমাদের অসাড় শীতার্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিকে আচ্ছাদিত করতে চাইছি।
মেঘে মেঘে ঘর্ষণে বিদ্যুতাগ্নিতে পাইন ফার প্রভৃতি গাছগুলি যেমন প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে তেমনি দুটি কঠিন বস্তুর ঘর্ষণে যেমন অগ্নি উৎপন্ন করে, আমরা হয়ত এই তীব্র শৈত্য ও আমাদের পাপজনিত অশুভ শক্তিগুলি হতে মুক্ত করতে পারব নিজেদের।
কিভাবে প্রার্থনার দ্বারা তাঁর করুণা আকর্ষণ করতে হয় তা তিনিই শিখিয়ে দেবেন। মৃত্যুতে শেষ পরিণতি লাভের আগে পর্যন্ত কিভাবে আরাম-স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে জীবন যাপন করতে হয় তা তিনিই বলে দেবেন।
যেখানে ঈশ্বরপুত্র আমাদের বিচার করেছিলেন স্বর্গ হতে অবতীর্ণ হয়ে সেইখানে গিয়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত হয়ে আমরা যদি পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে অনুতপ্ত চিত্তে আমাদের সব দোষ সব পাপ অকপটে স্বীকার করে তার কাছে মার্জনা ভিক্ষা করি, যদি আমরা আমাদের অনুতাপের অশ্রু দিয়ে সিক্ত করে দীর্ঘশ্বাসের দ্বারা বাতাসকে ভারী করে সব অহঙ্কার ও অভিমান ত্যাগ করে বিনয়াবনত চিত্তে তার নিকট অকুণ্ঠভাবে আত্মসমর্পণ করে আমাদের দুঃখের কথা নিবেদন করি তাহলে অবশ্যই তাঁর সব অসন্তোষ ও রোষাবেগ পরিহার করে তিনি সদয় হবেন আমাদের প্রতি। তাহলে তাঁর শান্তমিগ্ধ যে দৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর রোষাগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছিল সে দৃষ্টিতে আমাদের প্রতি অনুগ্রহ ও করুণার দ্যুতি ফুটে উঠবে।
এইভাবে আমাদের আদিপিতা তার অনুতাপ প্রকাশ করল। আদিমাতা ঈভও কম অনুতপ্ত হলো না। তারপর তারা সেই বিচারস্থানে গিয়ে শ্রদ্ধাপূর্ণ ও অনুতপ্ত চিত্তে প্রণিপাত হলো দুজনে। তাদের অশ্রুজলের দ্বারা ভূমিতল সিক্ত করে দীর্ঘশ্বাসের দ্বারা বাতাসকে ভারী করে বিনীতভাবে তাদের সব দোষ স্বীকার করে ক্ষমাভিক্ষা করল। নিবিড় অনুতাপের সঙ্গে তাদের দুঃখের কথা নিবেদন করল।