৯। দ্বন্দ্ব
কুন্দিনাপুরীর প্রধান ফটক থেকে তিনটি অশ্ব যখন বেরিয়ে এল তখন দিবালোকের বেশিরভাগ সময়টিই বাকি আছে, তবুও দ্রুত বেগে ঘোড়া ছোটাল অগস্ত্যরা। অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। মাঝে একবার থেমেছিল তারা, দণ্ডপুর নামের একটি ছোট জনপদে। সেখানে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে পুনরায় যাত্রা করেছিল। সূর্যের আলো যখন পশ্চিম দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে তখন সোপারার বন্দর শহরে এসে পৌঁছল অগস্ত্যরা। অশ্ব তিনটিকে স্থানীয় আস্তাবলে জমা করে পায়ে হেঁটে তারা তিনজনে এগিয়ে গেল মূল বন্দরের দিকে।
সোপারার হ্রদটি এতই বড় যে প্রথম দর্শনে তাকে সমুদ্র বলে ভ্রম হয়। তার দক্ষিণপ্রান্তে দাঁড়িয়ে উত্তরের তীরকে দেখা যায় না। হ্রদের পশ্চিমে সারি দিয়ে দাঁড় করানো আছে অসংখ্য তরণী। ওইখান থেকে গভীর একটি পরিখার মাধ্যমে হ্রদের জল এসে মিশেছে সমুদ্রে। ওই পরিখার মুখে মূল বন্দরটি শুরু হয়েছে। উপল অগস্ত্যদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলল। সোপারার বন্দর সদাব্যস্ত।
মাঝি মাল্লা, ব্যাপারী বণিকদের ভিড় লেগেই থাকে। কোন নৌকা থেকে হয়তো ভারী ভারী পণ্য নামিয়ে নিয়ে কাঁধের ওপরে ফেলে এগিয়ে চলেছে শ্রমিকের দল। কোথাও কয়েকজন পূর্বদেশীয় মাল্লা একজোট হয়ে নিজেদের মধ্যে খেলায় মত্ত। এরা দুটি ঘনকাকৃতি বস্তু নিয়ে নিজেদের মধ্যে বাজি লড়ছে। ঘনকদুটির গায়ের এক একটি অংশে বিভিন্ন সংখ্যায় ফুটো করা। ঘনকদুটিকে মাটিতে ছুঁড়ে দিয়ে দেখা হয় তার উপরিভাগে মোট কটি বিন্দু আছে। যার ছুঁড়ে ফেলা ঘনকের বিন্দুসংখ্যা বেশি হবে সে জয়ী হবে। সামান্য কিছু দিনার অথবা যাত্রাপথে চুরি করা ধাতুর সামগ্রী অথবা সুরার পাত্র বাজি রাখে এরা। একবার এই খেলা খেলতে শুরু করলে দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকে না এদের। এমনই একদল মাল্লা কোন একটি বাজিকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে বচসা করছে।
মাল্লাদের দল এই তুচ্ছ কারণে এত ব্যস্ত না হলে হয়তো তাদের নজর যেত সেই নারীটির দিকে, সে পরনে খুবই সাধারণ বস্ত্র পরে থাকলেও মুখশ্রীতে রাজকীয় ঝলকানি লুকোবার কোনও উপায় নেই। ঘাম, রক্ত, কদর্য ভাষা এবং অর্থলাভের তাড়না দিয়ে তৈরি এই সোপারার বন্দর। এই জায়গাটিতে নারীর লালিত্যের, তার কমনীয়তার কোন স্থান নেই। ইরতেনসেও হাঁটার সময় খেয়াল করছিল, এত মানুষের ভিড়ে একটিও মানবীকে তার চোখে পড়ছে না।
পেশি শক্তিতে যে নারী পুরুষের সমকক্ষ নয় তা সে জানে এবং বিশ্বাস করে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিতে নারীর বিচক্ষণতা, চাতুর্য, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব বারেবারে পুরুষকে মাত করে দিতে পারে-এও সে জানে স্বীয় অভিজ্ঞতায়। এই বাণিজ্যনগরীতে কি তার কোন স্থান নেই? এমন চিন্তা মনে এলেই ইরতেনসেনু কষ্ট পায়। সে বোঝে তার সামনে অনেক বড় কাজ পড়ে রয়েছে। সে তার সর্বশক্তি দিয়ে এই বিভেদ ঘোচাবার চেষ্টা করবে। এই দেশের মেয়েরা শুধুমাত্র মন্দিরেই নয়, সমাজে, কর্মক্ষেত্রেও সমান ভাবে পূজিত হবে, তাদের অধিকার থাকবে পুরুষদের সমান।
‘এই হল আমার সিন্ধুযান!’
উপলের কথায় ইরতেনসেনুর চমক ভাঙল। উপলের এগিয়ে রাখা তর্জনী বরাবর তাকিয়ে সে নৌযানটিকে দেখতে পেল। নৌকাটি আকারে মাঝারি। এতক্ষণ ধরে সে জলযানগুলির পাশ দিয়ে তারা হেঁটে এসেছে তাদের তুলনায় এটিকে খর্বকায়ই বলা চলে। দৈর্ঘ্যে একশত হাতের সমান, নৌকার হালের সর্বোচ্চ অংশটি মাটি থেকে পাঁচটি মানুষের সমান লম্বা। গাঢ় বাদামি বর্ণের সেগুনকাঠ দিয়ে তৈরি সিন্ধযানের খোল।
একটি কাঠের সরু পাটাতন বেয়ে অগস্ত্য আর ইরতেনসেনু নৌকার উপরে উঠল। অন্যদিকে উপল ব্যস্ত হয়ে পড়ল মাঝিদের জোগাড় করতে। তারপর সে স্থানীয় দোকান থেকে শুকনো খাবার কিনল। শ্রমিকদের পিঠে করে বেশ কয়েক ঘড়া জল বইয়ে এনে রাখল নৌকার ভিতরে। সমুদ্রের নোনা জল পানের অযোগ্য। বারো দিনের এই দীর্ঘ যাত্রাপথে তাই এই ঘড়াগুলি হবে অমৃতকুম্ভের সমান।
সোপারার বন্দর থেকে সন্ধ্যা নাগাদ সিন্ধুযানের যাত্রা শুরু হল। আকাশের রঙ তখনও আলোর অভাবে গাঢ় নীল বর্ণ ধারণ করেনি। সদ্য জ্বলে ওঠা মশালের আলোয় ঝলমল করছিল বন্দরটি। জনা কুড়ি মাল্লা একসঙ্গে প্রায় দুর্বোদ্ধ কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে করতে তরণীটিকে ঠেলে গভীর খালটির মধ্যে এনে ফেলল। এইখানে নৌকাটি গভীরতা পেয়ে সামান্য ভিতরে ডুবে গিয়ে ভারসাম্য খুঁজে পেল নিজের।
নিজেদের সঙ্গে আটজন মাঝিদের নিয়েছে উপল। তারা নৌকার দু’পাশে সারি দিয়ে বসে এক ছন্দে দাঁড় টানতে টানতে নৌকাটিকে সমুদ্রের মধ্যে নিয়ে এল। নৌকার একেবারে অগ্রভাগে থাকা একটি উঁচু অংশে দাঁড়িয়ে ছিল উপল। তার হাতে একটি কপোতের পালক। সে এবারে পালকটিকে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পালকটি যেন কোন অদৃশ্য ক্ষমতার বলে দু’পাশে দুলতে দুলতে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। পিছন ফিরে অগস্ত্যর দিকে তাকিয়ে হাসল উপল। বাতাস তাদের সহায়। সমুদ্রের হাওয়া এখন উত্তরের দিকেই বইছে। উঁচু কণ্ঠে উপল মাঝিদের উদ্দেশে বলল, ‘পাল খুলে দাও!’
চওড়া মাস্তুলের গায়ে মোটা রজ্জু দিয়ে জড়িয়ে রাখা পালটিকে মাঝিরা খুলে দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই পালটি হাওয়ার প্রভাবে সামনের দিকে ফুলে উঠল। সিন্ধযানের গতিও কয়েকগুণ বেড়ে গেল এই সময়। সমুদ্রের ঢেউ কেটে তরতর করে এগিয়ে যেতে থাকল সে। এখন শুধুমাত্র সঠিক দিক নির্ণয় করে এগিয়ে গেলেই হল।
পরবর্তী কয়েকটি দিন মাঝ সমুদ্রে ঘটনাবিহীন ভাবে কেটে গেল। যতক্ষণ সামুদ্রিক হাওয়ার জোর থাকে ততক্ষণ সিন্ধুযান যেন কোন চপল শুশুকের ন্যায় সমুদ্রের বুক চিরে ছুটতে থাকে। উপল তার এতদিনের অভিজ্ঞতায় নির্ভুল ভাবে বলে দিতে পারে ঠিক কতক্ষণ হাওয়ার জোর থাকবে। ততক্ষণই পাল মেলে রেখে যতটা সম্ভব যাত্রাপথ পার করে ফেলা হয়। বাতাস মন্দ হয়ে এলে পাল গুটিয়ে ফেলা হয়, তখন মাঝিদের দাঁড়ের টানে নৌকা এগিয়ে চলে। দিনের দু’বেলায় নিয়ম করে পান আহার সারা হয়, এই সময় দাঁড় টানা থামিয়ে মাঝিরা গোল হয়ে বসে। তাদের সঙ্গেই বসে যায় অগস্ত্য, উপল এবং ইরতেনসেনু।
এই নৌকার বুকে কোন জাতিগত বিভেদ নেই। একই রুটি এবং শুকনো মাংস মাঝিদের সঙ্গে ভাগ করে খায় অগস্ত্যরা। খেতে খেতে মাঝিরা নদী, সমুদ্রের গান শুরু করে। কোন এক মাঝি খাওয়া ফেলেই তার বাদ্যযন্ত্রটিকে বার করে গানের তালে তালে বাজাতে শুরু করে দেয়। তাদের সঙ্গে প্রাণ খুলে গলা মেলায় ইরতেনসেনু। মিশরের দিনগুলিতে বহুবার সে নীলনদের বুকে যাত্রা করেছে। সেই সব নৌকার মাঝিদের আর এই ভারতবর্ষীয় মাঝিদের গানের সুর যেন কোথাও গিয়ে এক রকমের।
তাদের গানের কথাও যেন এক। বছরের বেশিরভাগ সময় জলের মাঝে কাটিয়েও তাদের মন পড়ে থাকে একফালি মাটিতে, সেখানে তাদের ছোট্ট কুটিরে সংসার তৈরি হয়েছে। তাদের ঘরে স্ত্রী পুত্র কন্যা তাদের পথ চেয়ে বসে আছে। মাঝিদের কণ্ঠে যেন তাদেরকে দেখতে না পাওয়ার আকুতি ঝড়ে পরে। তবে সেই গান কিন্তু দুঃখের হয় না। বিরহ থাকলেও তাতে আবার স্বজনকে ফিরে পাওয়ার আশা মিশে থাকে। গানের তালে তালে মাঝিরা কাঁধ ঝুঁকিয়ে নাচতে শুরু করে।
সপ্তমদিনের মধ্যরাত্রের কথা। কয়েকদিন আগের পূর্ণচন্দ্র খয়িষ্ণু হতে হতে হতে প্রায় অর্ধেক আকার ধারণ করেছে। তবে এই রাতে যেন সে পৃথিবীর অনেকটা কাছে চলে এসেছে। উত্তর দিগন্তের সামান্য উপরে দেখা যাচ্ছে তাকে। তার আলোয় সমুদ্রের জল রূপোর মতো ঝিকমিকিয়ে উঠছে। এখন বাতাসের জোর একেবারেই নেই। মাঝিরা ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে আছে নৌকার খোলের ভিতরে তাদের কুটুরিতে।
উপল নিবিষ্ট মনে তাঁর সামনে রাখা শালপত্রটিকে পরীক্ষা করছিল। তার গায়ে যাত্রাপথের নকশা আঁকা আছে। দিনের বেলায় দিকনির্ণয় করা যায় না, কারণ সূর্যের তেজে আকাশের কোনও তারাই দৃশ্যমান হয় না। এখন প্রায় কৃষ্ণবর্ণের আকাশের গায়ে নক্ষত্রগুলি জেগে আছে। নিজের হাতে থাকা ছোট ধাতব যন্ত্রটিকে শালপত্রের একটি নির্দিষ্ট অংশে বসিয়ে বারবার মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দিক পরিদর্শন করছে উপল। তার সামান্য ভুলেও তরণী কয়েক ক্রোশ সরে গিয়ে অন্য পথে যাত্রা করতে পারে।
হাতে সময় বেশি নেই। এতদিন সঠিক পথেই এসেছে তারা, বাকি কয়েকটি দিনেও তার বিচ্যুতি ঘটাতে চায় না উপল। সে ভালো করে পরীক্ষা করে নিয়ে আগামীকালের গন্তব্যের পথ ঠিক করল, তারপর শান্ত শরীরে এগিয়ে গেল নিজের কক্ষের দিকে। এখন তার ঘুমের বড় প্রয়োজন।
রাত্রি তখন কত যাম বোঝা যায় না, অগস্ত্যর ঘুম ভেঙে গেল। গলা শুকিয়ে এসেছে, জল খেতে হবে। পাশ ফিরে সে দেখল ইরতেনসেনু নেই। সামান্য অবাক হল অগস্ত্য। নিজের ছোট্ট কক্ষটি থেকে বেরিয়ে উপরে উঠে এল সে। নৌকার পাটাতনের উপরে শুয়ে আছে ইরতেনসেনু। মৃদু শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে নৌকার উপর দিয়ে, ঢেউয়ের ছন্দে সামান্য দুলছে সিন্ধুযান। চাঁদের নরম আলোয় ইরতেনসেনুকে দেখে মনে হচ্ছে কোনও মৎসকন্যা বুঝি সমুদ্রের জল থেকে উঠে এসে এই নৌকায় সামান্য বিশ্রাম করছে।
নির্নিমেষ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ইরতেনসেনুর সৌন্দর্য উপভোগ করল অগস্ত্য। ইরতেনসেনুর পরনের বস্ত্রটি সমুদ্রনীল বর্ণের। কাঁধ থেকে নেমে এসে শেষ হয়েছে হাঁটুর সামান্য নীচে। ইরতেনসেনু অগস্ত্যর দিকে পিছন ফিরে শুয়ে আছে। সরু গ্রীবা এসে মিশেছে মসৃণ কাঁধে, সেখান থেকে নেমে এসেছে তন্বী বাহু। বাহু মূলে দুটি রং-বেরং-এর পাথর খচিত চুড়ি। ইরতেনসেনুর বাহুটি এলিয়ে আছে তার ঊরুর উপরে। তার হাঁটু দুটি সামান্য সামনের দিকে ভাঁজ হয়ে আছে। গোড়ালিতে রূপোর নিক্কন, পায়ের পাতা দুটি পদ্মের পাপড়ির মতো পেলব। অগস্ত্য ভাবে, নারী শরীর ঈশ্বরের এক আশ্চর্য সৃষ্টি। বিধাতার শিল্পবোধ যেন ফুটে উঠেছে এই শরীরের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি বিভঙ্গে।
আগুনের কাছে যেভাবে কীট উন্মাদের মতো ধেয়ে যায়, সেইভাবে পুরুষ আকর্ষিত হয় এই শরীরের প্রতি। কিন্তু এই শরীর যে স্থায়ী নয়, এ যে কর্পূরের মতো। নারীর যৌবন অমর হয় না, সে কর্পূরের মতোই ক্ষয়িষ্ণু। সেই যৌবন লুপ্ত হলে রয়ে যায় তার স্মৃতিটুকু, গন্ধটুকু। কিন্তু সেই নারীর মন? তার বুদ্ধি, মেধা, প্রজ্ঞা? তার খবর কয়জন রাখে? ওই মায়াময় শরীর পেরিয়ে কজন পুরুষ তাকে ছুঁতে পারে? নারীর শরীরই কি তার শত্রু নয়?
ইরতেনসেনু নিঃসন্দেহে সুন্দরী। কিন্তু তার মেধা যে তার শরীরের তুলনায় শতগুণে উজ্জ্বল তা অগস্ত্য জানে, সে পরিচয় সে বহুবার পেয়েছে। কারণ সে অনেক কাছ থেকে দেখেছে তার স্ত্রীকে। এই অসামান্যা নারী যে তার স্ত্রী তা যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারে না সে, আজ এই মনোরম পরিবেশে যেন মনে হল সে স্বপ্নলোকে আছে। ধীর পায়ে সে ইরতেনসেনুর দিকে এগিয়ে গেল। কাছে আসতে সামান্য উঠে বসল ইরতেনসেনু। অগস্ত্যর দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ হাসিতে ভরা মুখে সে বলল, ‘ঘুম আসছে না, তাই ভাবলাম কিছুক্ষণ এইখানে শুয়ে থাকি।
‘আমাকেও ডেকে নিতে পারতে তো।’
‘শিশুর মতো ঘুমোচ্ছিলে তুমি, তোমার ঘুমন্ত চোখের মণিদুটি নড়ছিল, স্বপ্ন দেখছিলে মনে হয়, এমন ঘুম ভাঙাতে মন চায়?’
অগস্ত্য সামান্য হেসে ইরতেনসেনুর পাশে বসল, তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ঘুম নেই কেন? দুশ্চিন্তা করছ?’
‘হুম, রানির জন্য চিন্তা হচ্ছে। এভাবে ডেকে পাঠালেন, তাও বার্তাবাহক বাজের মাধ্যমে, গোপনে। কেন?’
অগস্ত্যর কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘কেন তা আমিও ভেবে চলছি ইরতেনসেনু। রানি নিশ্চয়ই কোন বিপদে পড়েছেন। তাঁর তো আর শত্রুর অভাব নেই।
‘ফারাওদের কোন কালেই শত্রুর অভাব থাকে না অগস্ত্য। দেশের দক্ষিণ দিকের নুবিয়ার আদিবাসীদের অশান্তি আর দেশের বাইরের অসিরিয়দের আক্রমণের আশঙ্কার মধ্যেই ফারাওদের দিন কাটে। কিন্তু হাতসেপসুতের শত্রু যে তাঁর রাজধানীতে, থীবস শহরেই। এক নারী যে মুখে নকল দাড়ি লাগিয়ে ফারাওয়ের মুকুট পরে দেশ শাসন করবে তা রাজবংশের বাকিরা চায়নি কখনও। ঈশ্বরের আশীর্বাদে তা সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য রাজপরিবারের মধ্যেই সদা চক্রান্ত চলতে থাকা অস্বাভাবিক নয়। রাজমন্ত্রী সেনেনমুতকে আমি ভরসা করি, তিনি পিতা। তিনি রানির পাশে আছেন এটা ভেবে মনে বল আসে। তাঁর প্রবল কূটনৈতিক বুদ্ধি দিয়ে তিনি রানিকে রক্ষা করছেন। তবুও মনে হয় কোথাও একটা গোলযোগ হয়েছে, এমন একটা কিছু যা তাঁর ক্ষমতার বাইরে।’
‘অর্থাৎ বিপদটা এমনই যা থেকে উদ্ধার পেতে তোমাকে প্রয়োজন।’
‘শুধু আমার একার নয়, তোমারও প্রয়োজন। রানি পরিষ্কার ভাবে লিখে দিয়েছেন যে আমরা দুজনেই যেন মিশরে উপস্থিত হই।’
‘ঠিক, সেদিন রাতেই বলেছিলে এ কথা। আমি ভাবছি এমন কী বিপদ যাতে আমাদের দুজনের উপস্থিতিই রানির কাম্য হবে?’
‘জানি না অগস্ত্য, তবে আমার মনে কোন এক অজানা আশঙ্কা বাসা বাঁধছে। মিশরের মাটিতে পা রাখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছি।’
‘আর কয়েকদিনের মধ্যে তা সম্ভব হবে। উপলের নৌচালনার দক্ষতার পরিচয় তো পেয়েইছ। গতকালের অমন প্রবল ঝড়ের মধ্যেও সে সিন্ধুযানের ভারসাম্য তো বজায় রাখলই, উপরন্তু দিগভ্রষ্টও হতে দিল না। তুমি বরং মনটাকে একটু শান্ত করো, অন্য কোন দিকে প্রবাহিত করো তাকে।
ইরতেনসেনু অগস্ত্যর দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল, তারপর বলল, ‘অন্য দিকে? আচ্ছা।’
ইশারায় অগস্ত্যকে পাশে শুতে বলে ইরতেনসেও শুলো। তাদের মাথার উপরে নক্ষত্রখচিত আকাশ। সেই দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ইরতেনসেনু বলল, ‘এক নারী পুরুষের অধিকারের আসনে আসীন হওয়ার কারণে বিপদের মুখে পড়েছেন। অথচ নারীদের তো পুরুষের সমান হওয়ার কথা ছিল অগস্ত্য। সৃষ্টির শুরুতে তো এমন ভেদাভেদ ছিল না।
অগস্ত্য এর উত্তরে কিছু বলল না, চুপ করে রইল। ইরতেনসে বলল, ‘তোমাকে কখনও গেব আর নুতের গল্প বলেছি?’
‘না তো।’
‘শোন তবে, এই ব্রহ্মাণ্ডের আদি দেবতা হলেন আতুম। আতুমের দুই সন্তান, শু আর তেফনুত। শু বাতাসের দেবতা আর তেফনুত আর্দ্রতার দেবী। এদের সন্তানদের নাম হল গেব এবং নুত। গেব হলেন পৃথিবীর দেবতা। গেবের শরীরে জন্ম হল নীলনদের, তাঁর পাঁজর থেকে তৈরি হতে থাকল শস্য। গেব খুব জোরে হেসে উঠলে পৃথিবীতে ভূমিকম্প হয়, গেবের উষ্মায় তৈরি হয় খরা।
‘অপরদিকে নুত হলেন আকাশের দেবী, তাঁর গাত্রে মেঘের জন্ম হয়, বৃষ্টির ধারা হয়ে তা ঝরে পড়ে গেবের উপর। সেই জলে নদী পুষ্ট হয়, জমিতে শস্য ফলে। এই গেব আর নুতের সন্তানরা হল আকাশের এই তারারা। একদিন ভীষণ ক্ষুধার তাড়নায় নুত তাঁর সন্তানদের খেয়ে ফেলেন।
‘স্বাভাবিক কারণেই গেব রুষ্ট হলেন। গেবের রাগ কমানোর জন্য তখন নুত গেবের ওপরে ছাতার মতো উপুড় হয়ে শুয়ে থাকলেন। তাঁর দু’হাত আর দু’পায়ের পাতা স্পর্শ করে থাকল উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব আর পশ্চিম দিক। নারী আর পুরুষ এই দুই নিয়ে তৈরি হল এই জগত। ওই দেখ আমাদের মাথার ওপরে নুত কেমন উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন, তাঁর সন্তানরা তাঁর শরীরে জেগে আছে। আর এই পৃথিবী গেব আমাদের ধারণ করে আছে। এদের একটিকে ব্যতীত অপরটির অস্তিত্ব কল্পনাই করা যাবে না।’
অগস্ত্য এবার বলল, ‘চমৎকার এই পুরাণের কথন ইরতেনসেনু। সত্যিই তো! নারী এবং পুরুষের ভেদাভেদ কেবল মাত্র শরীরের বাহ্যিক প্রকাশেই।’
ইরতেনসেনু এই কথার উত্তরে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তারায় ভরা আকাশের দিকে। তারপর প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা অগস্ত্য, মিথ্যা বচন নাকি সত্য গোপন, কোনটা বেশি ক্ষতিকারক বলে মনে হয় তোমার? এদের মধ্যে কোনটা অপেক্ষাকৃত শ্রেয়?’
ইরতেনসেনুর এমন আকস্মিক প্রশ্নে চমকে উঠল অগস্ত্য। তার হৃদয় কম্পিত হল। এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে চেয়ে রইল ইরতেনসেনুর দিকে।
‘তুমি আমার জন্য রাজা বসুমান আর রানি কঙ্কাবতীকে মিথ্যা বলেছিলে, আমিও তখন চুপ করে ছিলাম অর্থাৎ সেই মিথ্যায় সায় দিয়ে ছিলাম। এখনও সেই কথা ভাবলে লজ্জিত বোধ করি। নিজেকে বোঝাই যে সেইদিনের সেই মিথ্যাটির প্রয়োজন ছিল, তা না হলে তোমাকে আমি পেতাম না। তুমি মন্দিরে না গেলেও ঈশ্বরে বিশ্বাস করো, ভারতবর্ষের মানুষ তোমাকে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করে। মিথ্যাচারের ব্যাপারে তোমার কী মত অগস্ত্য, সেই দিন রাজাকে মিথ্যা বলে পরে তোমার মনে কোন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল?’
অগস্ত্য খানিকক্ষণ নীরব থাকল, তারপর ধীর স্বরে বলল, ‘মিথ্যা বললেই যে ঈশ্বরের অবমাননা হয় তা আমি বিশ্বাস করি না ইরতেনসেনু। মিথ্যা অনেক প্রকারের হতে পারে, মিথ্যা শান্ত হস্তির মতো বিরাট আকার ধারণ করেও ক্ষতিহীন হয়ে থাকতে পারে, আবার বৃশ্চিকের মতো ছোট হয়েও এক দংশনে প্রাণহানির কারণ হতে পারে। যে মিথ্যায় অপরের ক্ষতি হয় না তেমন মিথ্যাচারের আমি পক্ষে। লোপামুদ্রা নামে তোমার পরিচয় দেওয়া ছিল তেমন এক মিথ্যাচার। এই মিথ্যার ফলস্বরূপ আমি তোমাকে পেয়েছি, এতগুলি বছর নিঃসন্তান থাকার পর রাজা-রানি কন্যা পেয়েছেন। এমন মিথ্যা আমি আগেও বলেছি, পরেও বলবার সময় আমার গলার স্বর কাঁপবে না।’
‘তাহলে যে শুনেছিলাম, সত্যই ঈশ্বর, ঈশ্বর সত্য। এ চিন্তা তাহলে ভুল?’
‘ভুল বা ঠিক নয়, এই চিন্তা দার্শনিক। দার্শনিক ভাবনার ঠিক বা ভুল হয় না ইরতেনসেনু। দুটি দর্শন বিপরীতমুখী হয়েও একসঙ্গে অবস্থান করতে পারে। সত্য অগ্নিকুণ্ডের ন্যায়, তা আলো দেয়, উষ্ণতা দেয়। কিন্তু অনেক সময় দাবানলের আকার নিতে পারে। একটি ক্ষুদ্র আপাত তুচ্ছ সত্য সম্পর্কের কুঞ্জকে নিমেষে নিঃশেষ করে দিতে পারে। তেমন সত্যবচনে ঈশ্বরলাভ কীভাবে হবে? সত্যের অনুপস্থিতিও কখনও কাম্য হয় বই কী।
ইরতেনসেনু চুপ করে শুনছিল অগস্ত্যর কথা। সে যেন কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। অগস্ত্যর বাঁ- হাতের উপরের দিকে একটি কাটা দাগ আছে, অন্যমনস্ক ভাবে ইরতেনসেনু তাতে হাত বোলাচ্ছিল। অগস্ত্য বলে এমন দাগ নাকি উপলেরও বাঁ-কাঁধে আছে। ছোটবেলায় একদিন খেলার সময় পড়ে গিয়ে রুক্ষ পাথরে চোট পায় দুজনে। অগস্ত্যর পিতা তখন সেই ক্ষত সেলাই করে দিয়েছিলেন।
অগস্ত্য খুব ছোটবেলায় তার পিতাকে হারায়। অপরদিকে ইরতেনসেনু তার জন্মদাতা পিতাকে কোনদিন চিনলই না। অনাথ সে, বড় হয়েছে পালক পিতা সেনেনমুতের যত্নে, তাতে স্নেহের উষ্ণতা এতটুকু কম ছিল না। তবুও ইরতেনসেনু তার জন্মদাতা পিতার স্পর্শ কেমন তা জানে না, সেই ভাবনা আজও তাকে কষ্ট দেয়। ইরতেনসেনু খেয়াল করেছে অগস্ত্য কখনও কখনও এই ক্ষতচিহ্নে হাত রেখে চোখ বোজে কিছুক্ষণের জন্য, হয়তো সে তার পিতাকেই স্মরণ করতে চায়। ইরতেনসেনু এই নিয়ে অগস্ত্যকে কোনদিন কোন প্রশ্ন করেনি।
এখন সে অগস্ত্যর কাছে আরও একটু সরে এল, তার বুকে মাথা রেখে বলল, ‘তোমার চিন্তার গভীরতা আমাকে অবাক করে। এমন ভাবে আমি ভাবিনি কখনও। আজ যেন এক গুরুভার লাঘব হল আমার বুক থেকে। এখন একটু ঘুমাই।’
এই বলে ইরতেনসেনু চোখ বুজল, ক্ষনিকের মধ্যেই অগস্ত্য বুঝল সে গভীর ঘুমে ডুবে গিয়েছে। ইরতেনসেনুর নিশ্চিন্ত শ্বাসের ধীর উত্থান-পতন অগস্ত্যর বুকে প্রবাহিত হতে লাগল। সে নিজে কিন্তু দু’চোখের পাতা এক করতে পারল না। তার ঈশ্বর সারা রাত তার দিকে চেয়ে রইলেন, জানতে চাইলেন, ‘এমন মিথ্যাচার যা ক্ষতিকারক নয় তাকে তুমি ন্যায়সঙ্গত মনে করলে, কিন্তু সত্য গোপনকে কী বলবে অগস্ত্য? সে কি বৃশ্চিকরূপী মিথ্যার চেয়েও অধিক বিষধর নয়?’
এর উত্তর অগস্ত্যর কাছে ছিল না। সে ইরতেনসেনুকে আরও একটু আঁকড়ে ধরে তারায় ঢাকা আকাশের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণের জন্য। তারপর নিজের বাঁ-হাতের ক্ষতচিহ্নে হাত রেখে চোখ বুজল। কিন্তু সেই রাতে আর ঘুম এল না তার।