৯. ইহুদি ও মোহাম্মদ
প্রফেট মোহাম্মদের ধর্মীয় প্রচারণার শুরুর দিকে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সাথে তাঁর নিকট সম্পর্ক ছিল। শোনা কথার মাধ্যমে তিনি ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্ম পুস্তক সম্বন্ধে অল্প-বিস্তর জেনেছিলেন, পরে এদের সংস্পর্শে এসে আরো প্রত্যক্ষভাবে মূল মতবাদগুলো জেনে নেন, যা তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। জনশ্রুতি আছে যে, তিনি বেঁচে থাকতে ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্ম গুরুদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন। তিনি বলেছেন বলে কথিত যে, যে ব্যক্তি ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ক্ষতি করবে, শেষ বিচারের দিনে আমি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনব। যখন তিনি আরবদের জন্য একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে মনস্থ করেন তিনি আশা করেছিলেন যে এটা ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের অংশরূপেই প্রকাশ করবে।
অনেক দিন ধরে পশ্চিমাদেশে বিবেচিত হয়েছিল যে ইসলাম জুদো-খ্রিস্টান ট্র্যাডিশনের একটি শাখা এবং এখনো কয়েক মহলে এই ধারণা পোষণ করে। বলা হয় যে, ইসলাম ধর্ম মূলত ইহুদি ও খ্রিস্টান মতবাদের সারগ্রাহী (eclectic) ধর্ম। শুধু আরব দেশের মানুষদের জন্য উপযুক্ত করে একটু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছেন, কিন্তু উদ্দেশ্যটিকে মনে রেখে অগ্রসর হয়েছিলেন। এ বক্তব্যের যথেষ্ট প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়।
আরবে ইসলাম আগমনের অনেক পূর্বে, আরবের বিভিন্ন অংশে ইহুদি লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করত। সত্যি বলতে কি, কয়েকটি আরব গোত্রে ইহুদি ছিল। মদিনাতে এবং এর আশপাশে ইহুদিদের প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের বাসভূমি ছিল এবং মদিনার আনসারদের মধ্যেও অনেক ইহুদি ছিল।
ট্র্যাডিশন বলে যে মদিনার দুইটি প্রধান গোত্র আউস ও খাজরাজ ইহুদি বংশোদ্ভূত। আর একটি ট্র্যাডিশন জোর দিয়ে বলে যে, মদিনার ইহুদিরা খাজরাজ জাতির নাজ্জার গোত্রের একটা অংশ বিশেষ যাদের সাথে প্রফেটের নিজের মাতৃকুলের নিকট সম্পর্ক ছিল।
প্রথমে প্রফেট মোহাম্মদ ইহুদিদের সাথে সদ্ভাব রেখেছিলেন এবং তারাও মূর্তিপূজা উচ্ছেদ ও তার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেনি। প্রফেট মোহাম্মদও বিশেষ রিভিলেশন প্রাপ্ত জাতি বলে তাদের বিবেচনা করতেন। কোরানে তাই ইহুদিদের বিশ্বজগতের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে (৪৫ : ১৫)।
ইবন ইছহাকের কাছে একটি দলিল ছিল (যার প্রামাণ্যতা সম্বন্ধে কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি সন্দেহ করেন) যার শিরোনাম ছিল ‘মুসলিম ও ইহুদিদের মধ্যে চুক্তি’। এই চুক্তি হিজরতের পর পরই ইহুদির সাথে সম্পাদিত হয়েছিল। অন্যান্য শর্তের সাথে শর্ত ছিল— ‘ইহুদিদের আমরা সাহায্য করব এবং সমভাবে দেখব কেননা তারা আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং বন্ধুভাবাপন্ন। তাদের কোনো ক্ষতি করা হবে না কিংবা তাদের শত্রুদেরও সাহায্য করা হবে না।’ তার সেনাপতিদের মধ্যে এক আচরণ বিধিতে প্রফেট জানিয়েছিলেন ইয়েমেনে অভিযান চালানোর প্রাক্কালে সেখানকার ইহুদিদের ধর্ম পালনে যেন কোনো বিঘ্ন না ঘটে।
কোরানে একাধিকবার প্যালেস্টাইনকে ‘আশীর্বাদিত ভূমি’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। প্রথম দিকে প্রফেট মোহাম্মদ জেরুজালেমকে তার ধর্মের কেন্দ্রভূমি মনে করতেন এবং প্যালেস্টাইনের স্থান ছিল মক্কার ওপরে। মক্কা নয়, জেরুজালেমের দিকে মুখ করে প্রফেট প্রার্থনা (নামাজ) শুরু করেছিলেন (Lewis, 1966. P. 42) এবং তাঁর অনুসারীদের সেইভাবে নির্দেশ দেন এবং এই নিয়ম বারো বছর ধরে পালিত হয়েছে, এমনকি মদিনাতে প্রথম মসজিদ তৈরি করার পরও। জানা যায় যে, প্রফেটের মৃত্যুর পর ইরাকে প্রথম দিকে তৈরি মসজিদের কিবলা ছিল জেরুজালেমের দিকে, মক্কার দিকে নয়।
কোরানে বলা হয়েছে যে তোরাহ (তাওরাত)-র মধ্যেই আল্লাহ পথের নির্দেশ ও আলো দান করেন (৫ : ৪৭) এবং মোত্তাকিদের জন্য সম্পূর্ণ কিতাব (৬ : ১৫৫)। প্রফেট মোহাম্মদ কখনো ইহুদিদের কিতাবকে বাতিল বলে মনে করেননি। তিনি কোরানে ওল্ড টেস্টামেন্টের বহু কাহিনী জুড়ে দিয়েছেন, যদিও তিনি সে গ্রন্থ পাঠ করেননি, সম্ভবত ইহুদিদের কাছ থেকে শুনে গ্রন্থিত করেন, যদিও কয়েক স্থানে কিছু ব্যতিক্রম ঘটেছে; হতে পারে, এই ভাবেই তিনি শুনে থাকবেন।
কোরানে বিশ্বসৃষ্টি সম্বন্ধে বলা হয়েছে, স্বর্গে আদম ও ইভের কাহিনী, নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের ফলে (৯৭ : ১৮) পতনের কাহিনী, নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার ফলে জ্ঞানপ্রাপ্ত হওয়া, উলঙ্গ হওয়া, গাছের পাতা দিয়ে আবরণ ইত্যাদি (২০ : ১১৯)। এতে হাবিল ও কাবিলের কাহিনী আছে, নূহ এবং প্লাবনের কাহিনী আছে এবং আল-জুডি পাহাড়ের গায়ে নূহের কিস্তি আটকে যাওয়ার কাহিনী (১১ : ৪৬) (প্রাচীন গ্রিকদের কাছে আর্মেনিয়ার গর্ডাইন পর্বত); ইব্রাহীম ও ইসমাইলের কাহিনী, লুত এবং সডোম ও গোমরাহর ধ্বংসের কাহিনী, ইসহাক ও জ্যাকব, ইউসুফ ও পটিফার স্ত্রী, মুসা ও ফেরাউন, এলিজা ও এলিসা, দাউদ ও সলোমন, শেবার রানী, জব, জোনাহ এবং আরো নাবী ও বাইবেলের রাজা-বাদশার কাহিনী কোরানে বিধৃত।
কোরানে বাইবেল বহির্ভূত কিছু ভার্সান আছে, কারণ প্রফেট মোহাম্মদের ভার্সান মূল (original) থেকে প্রায় পৃথক হয়ে যেত। সেখানে প্রফেট কর্তৃক ব্যবহৃত মেটিরিয়েল বাইবেলের আইন পুস্তকের সাথে অমিল থাকলে তার সূত্র তালমুদ, বাইবেল বহির্ভূত গ্রন্থ (apocrypha) এবং সংশ্লিষ্ট লিখিত বস্তুর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। কতকগুলো কাহিনী আরবের সাথে রচিত হয়েছে যেমন, আব্রাহাম ও ইসমাইল হেজাজে এসেছিলেন কাবাঘর তৈরি করতে।
কোরানের কিছু অংশ প্রফেট মোহাম্মদ অনুপ্রাণিত হয়ে পেয়েছিলেন যাকে ‘সকিনা’ (sakina) বলা হয়। জায়েদ ইবন থাবিত প্রফেটের কাতিব ছিলেন, ওহি লিখতেন। তাঁর মৃত্যুর পর জায়েদকে কোরান সঙ্কলনের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি বলেছেন, ‘আমি তার পাশে ছিলাম। তিনি সজ্ঞানে ফিরলে বলেন- ‘লিখো’ এবং আমি লিখলাম।’ সকিনার ধারণা এসেছে হিব্রু শব্দ শেকিনা (Shekina) থেকে যাকে ইহুদি ট্র্যাডিশনে ঈশ্বরের নারী অংশকে বলা হয় (The femenine aspect of the spirit of God)।
ইবন হিশামের প্যাসেজ থেকে দেখা যায় যে, একবার প্রফেট মোহাম্মদ বেথ হা- মিদরাস-এ গিয়েছিলেন, মিদরাস পাঠ করার জন্য (to study the Midrash)। মিদরাস হচ্ছে বাইবেলের তফসিরি— কমেন্টারি। আল্ বাইদাবি বলেন যে, কোনো কোনো ইহুদি প্রফেট মোহাম্মদের কাছে প্রাচীন ইতিহাসের কাহিনী বার বার পুনরাবৃত্তি করেছেন এবং মোহাম্মদ তাদের সাথেও এ বিষয়ে আলোচনা ও মন্তব্য করতেন। প্রায়ই প্রফেট মোহাম্মদ সিনেগগ, ইহুদিদের উপাসনালয়ে যাতায়াত করতেন। (Hughes, 1977, P. 193)
মক্কাতে আবদিয়াস বেন সালোম নামে একজন বিজ্ঞ রাব্বীর সাথে প্রফেট মোহাম্মদের বন্ধুভাব ছিল। কথিত আছে, এই রাব্বি প্রফেটকে ইহুদি ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। ইহুদিদের ট্রাডিশন ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং অন্যান্য বিষয়ে বলেছিলেন, যেগুলো পরে প্রফেট মোহাম্মদের কোরান প্রণয়নের সময় কাজে লেগেছিল। তফসিরকার আব্বাসী ও জালালায়েনের মতে, এই রাব্বী পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার মুসলিম নাম ছিল আবদুল্লাহ ইবন সালোম এবং বিশ্বাস করা কোরানে তার নাম সাক্ষী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে (৪৬ : ৯) যেখানে ইনি কোরান ও তাওরাতের মধ্যে চুক্তির প্রমাণ দিয়েছেন (Tisdall, 1911, P. 134)।
উল্লেখযোগ্য যে, প্রফেট মোহাম্মদের ওহি লেখকদের মধ্যে একজন ইহুদি ছিলেন এবং ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যভাগ পর্যন্ত তিনি ইহুদি সেক্রেটারিদের দ্বারা হিব্রু বা সিরিয়াক ভাষায় চিঠিপত্র লেখাতেন। তার মুসলিম সেক্রেটারি জায়েদ ইবন থাবিত এইসব ভাষা আয়ত্ত করার পর থেকে প্রফেট আর ইহুদি সেক্রেটারি রাখতেন না।
বলা হয়ে থাকে যে, প্রফেট মোহাম্মদ প্রার্থনা সম্বন্ধে কতকগুলি মৌলিক মতবাদ, প্রথা ও অন্যান্য নিয়ম পদ্ধতি ইহুদিদের কাছ থেকে গ্রহণ করেন; এত বেশি গ্রহণ করেন যে ফরাসি গ্রন্থকার আর্নেস্ট রেনান (মৃ. ১৮৯২) ইসলামকে ‘কট্টর ইহুদিবাদ’ (petrified judaism) বলে অভিহিত করেন।
ঈশ্বরের একত্ব (হিব্রু এহাদ) ইহুদিবাদে জোর দিয়ে বলা হয় এবং ইহুদি ধর্মের বিশ্বাসের স্তম্ভস্বরূপ (Deut 6 : 4)। তেমনি ইসলামেও আল্লাহর একত্বের (আরবি আহাদ) ধর্মেরও ঈমানের অঙ্গস্বরূপ। তাই বলা হয়, মুসলিম ধর্মের ধারণা ইহুদি মডেলে তৈরি।
প্রফেট মোহাম্মদের মিশনের প্রথম দিকে তিনি ‘প্রফেট’ শব্দের বিপরীতে ইহুদি শব্দ ‘নাবী’ ব্যবহার করেছেন। ইহুদিরা যে শ্রেষ্ঠ জাতি এই ধারণা থেকেই তিনি আরবদের শ্রেষ্ঠ জাতিরূপে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেন। ইহুদিদের রীতির ওপর ভিত্তি করে দানকে ধর্মের অঙ্গ হিসাবে (পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি) ‘যাকাত’ প্রবর্তন করেন। ‘যাকাত’ শব্দটি আরামাইক, আরবি নয়।
ইহুদিদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে শূকরের মাংস হারাম করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ওজু এবং পবিত্রকরণ, শনিবারকে ‘সাবাত’ রূপে গ্রহণ এবং সকাল ও সন্ধ্যার প্রার্থনার অতিরিক্ত দুপুরের প্রার্থনা (জোহরের নামাজ) চালু করেন।
ইহুদিদের প্রথানুসারে তিনি খানার প্রবর্তন করেন মুসলিম বালকদের জন্য। যদিও এই প্রথা কোরানে নেই। তবুও প্রাচীন প্রথা রূপে এই প্রথাকে ‘ওয়াজেব’ করা হয়। তার নিজের খানা হয়েছিল কিনা এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু এই প্রথাকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য অনেক পরে এক হাদিসে বলা হয় যে, প্রফেট মোহাম্মদের আদম, নূহ, ইউসুফ, মুসা, সলেমন ও ঈসা নবীদের মতো জন্ম থেকেই খাৎনা করা হয়েছে।
তারপর ইহুদিদের প্রথম মাস তিশরির প্রথম নয় দিন উপবাসের দ্বারা আত্মশুদ্ধির দিন এবং দশ তারিখে আশোর উপলক্ষে কঠোর উপবাস করে তারা প্রায়শ্চিত্ত করে। এই দশ তারিখকে বলে ‘ইয়োম কিপ্পুর’ (লেবীয় ২৩ : ২৭)। ইহুদিদের এই প্রথার সাদৃশ্যরূপে প্রফেট মোহাম্মদ ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে আরবি বছরের প্রথম মাস মহররমের প্রথম দিন উপবাস পালন করে দশ তারিখে আশুরা’-র উপবাস করার প্রথা চালু করেন। এই উপবাস সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত নির্ধারণ করা হতো যখন কালো ও সাদা সুতোর পার্থক্য বোঝা যেত (২ : ১৮৩)। এই পদ্ধতিও গ্রহণ করা হয়েছিল ইহুদি কিতাব তালমুদে বর্ণিত প্রথা থেকে। ইহুদিরা এই প্রথায় তাদের প্রার্থনার সময় নির্ধারণ করত সকাল ও সন্ধ্যার, যখন নীল ও সাদা সুতোর পার্থক্য বোঝা যেত (Rodwell, 1915, P. 357)।
৯.১ ইহুদিদের সাথে বিভেদ
ইহুদি ও প্রফেট মোহাম্মদের সাথে বিরোধ ও বিভেদের সূত্রপাত হয় যখন তার ক্ষমতা বাড়ল এবং দাবিও জোরাল হলো। এই দাবি তার নিজের জন্য এবং আরব জাতির জন্য।
মোহাম্মদ দাবি করলেন ইসলাম আব্রাহামের অরিজিনাল বিশ্বাস (faith) বা ধর্ম, যিনি খাঁটি একেশ্বরবাদ প্রবর্তন করেন। আব্রাহাম হানিফ ও মুসলিম ছিলেন (৩ : ৬০) তার নিজের অগ্রদূত (Precursor)। আব্রাহামের ধর্ম (মিল্লাত ইব্রাহীম) ছিল খাঁটি ধর্ম এবং তিনি, মোহাম্মদ, সেই প্রাচীন ধর্ম পুনরুদ্ধার করেছেন (২ : ১২৯)। আব্রাহাম মুসার পূর্বে এসেছিলেন এবং তার ধর্ম ইহুদি ধর্ম (জুদাইজম) থেকে প্রাচীন। তিনি মনে করেন আরবরা আব্রাহামের প্রথম সন্তান ইসমাইলের বংশধর এবং ইহুদিদের চেয়ে আব্রাহামের ধর্মে তার দাবি আগে।
এই দাবির বিপরীতে ইহুদি রাব্বীদের জবাব হলো- ইসমাইল আব্রাহামের মিশরীয় উপপত্নীর অবৈধ সন্তান, সেমেটিক জাতি উদ্ভূত নয়, সুতরাং ইসমাইল ঈশ্বরের সাথে আব্রাহামের চুক্তির বাইরে (outside God’s covenant), এছাড়া তিনি অসভ্য ও দুর্ধর্ষ ছিলেন; বাইবেলে বলা হয়েছে- ‘বন্য মানব; তার হস্ত প্রত্যেক মানুষের বিরুদ্ধে’ (আদিপুস্তক ১৬ : ১২)।
এটা উল্লেখ করা হয় যে, কোরান অনুযায়ী, প্রফেটিক টাইটেল (নবী পদবি) ইসরাইলের বংশধরদের ওপর আল্লাহ দান করেছেন (৪৫ : ১৫), বিশেষ করে ইসহাক ও ইয়াকুবের (আইজাক ও জেকব) পরিবারের ওপরে (২৯ : ২৯)। সুতরাং ইহুদিরা প্রফেট মোহাম্মদকে প্রফেট বলে স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। নবীদের বিশেষত্ব অলৌকিক কর্ম সম্পাদন করা (মোজেজা দেখানো), মোহাম্মদ কোনো মোজেজা দেখাননি। যাই হোক, ইসরাইলিদের শেষ নবী আগেই এসে গেছেন; যদিও মেসিয়া এখনো আসেননি।
যখন প্রফেট মোহাম্মদের কয়েকজন অনুসারী (প্রফেট মোহাম্মদ নিজে নয়) বলেন যে ইহুদিরা যে মেসিয়ার কথা বলেছেন- এবং আশা করেছেন সেই মেসিয়া হলেন প্রফেট মোহাম্মদ; এতে ইহুদিরা বলে যে, মোহাম্মদ দাউদের (ডেভিড) বংশধর নয়, মেসিয়ার কোনো চিহ্ন বা প্রতীক তিনি ধারণ করেন না, সুতরাং তিনি মেসিয়া হতে পারেন না।
প্রফেট মোহাম্মদ দাবি করেন (৭ : ১৫৭) যে তোরাহ-তে তাঁর আগমন সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। যদিও এই ভবিষ্যদ্বাণীকে কনফার্ম করে কোনো যুৎসই আয়াত উল্লেখ করা হয়নি, মুসলিম পণ্ডিতগণ তারপর থেকে তোরাহ বাদ দিয়ে ওল্ড টেস্টামেন্টের অন্যখানে প্রফেটের আগমন সম্বন্ধে প্রমাণাদি উপস্থাপন করলে ইহুদিরা সেসব প্রমাণ অস্বীকার করে।
মুসলিমদের দাবি যে কোরান আল্লাহর নিকট থেকে আগত পবিত্র পুস্তক; জবাবে ইহুদিরা বলে যে, যদি তা-ই হতো তাহলে, যে কোনো পবিত্র ভাষা, হিব্রু বা সিরিয়ান- এ পাঠানো হতো, (Jeffery, 1938, P. 9) কবি ও মাতালদের ভাষা আরবিতে নয়।
ইহুদিরা, ওল্ড টেস্টামেন্ট সম্বন্ধে প্রফেট মোহাম্মদের ভার্সান অস্বীকার করে বলেছে যে, ওসব ভুল ভ্রান্তিতে ভরা এবং অনেক সময় দুর্বোধ্য। যে ধর্মপুস্তককে তিনি কনফার্ম করার দাবি করেন, সে পুস্তক সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান ক্ষীণ বলে ইহুদিরা উল্লেখ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, তিনি না জেনেই ভুলক্রমে অভিযোগ করেছেন এই বলে যে এজরা (ওজাইর) ঈশ্বর পুত্র (৯ : ৩০)। ইহুদিরা এই অভিযোগ অস্বীকার করে। আরো কয়েকটি ভুল-ভ্রান্তির কথা তারা উল্লেখ করেছে (Geiger, 1970)।
প্রফেট মোহাম্মদ অনবরত ইহুদিদের সাথে তিক্ত তর্ক-বিতর্ক করেন এবং তারা যতই তাঁর, প্রফেটের দাবি মানতে অস্বীকার করে, তত বেশি বিরোধ ও তিক্ততা বাড়ে।
৬২৩ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে ইহুদিদের সাথে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে বদর যুদ্ধের কিছু পূর্বে। বার বার বাধাপ্রাপ্ত হয়ে এবং তাদের বিরূপ সমালোচনায় তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে এই চেতনায়, প্রফেট মোহাম্মদ ইহুদিদের সাথে সমঝোতার আশা ছেড়ে দেন এবং কঠিন পথ অবলম্বন করেন।
তিনি তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের শত্রু বলে অভিযোগ করলেন। কোরানে বলা হয়েছে- তুমি নিশ্চয় দেখবে যে, যেসব মানুষ মুসলিমদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন তারা হচ্ছে ইহুদি (৫ : ৮৫)। তিনি বলেন, ইহুদিরা মুসার কাছ থেকে যে আত্মিক রেভিলেশন পেয়েছিল তাকে বিকৃত করেছে (২ : ৭০)।
প্রফেট মোহাম্মদ এবার পরিবর্তন শুরু করলেন হিব্রু শব্দ ‘নাবী’র স্থলে আরবি শব্দ রসূল (মেসেঞ্জার) ব্যবহার করলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ইহুদি প্রথা অনুসরণ করে যেসব প্রথা তিনি চালু করেন সে সমস্ত বন্ধ করে ইসলাম ও জুদাইজমের মধ্যে যতদূর সম্ভব পরিষ্কারভাবে পার্থক্য তৈরি করবেন।
৬২৪ খ্রিস্টাব্দে ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি ওহি পেলেন (২ : ১৪৪) এবং কিবলা জেরুজালেম থেকে মক্কাতে পরিবর্তন করেন; এতে পূর্ব থেকে পশ্চিমে দিক পরিবর্তন হলো। ইহুদিরা তখন তাঁকে অস্থিরমতি বলে অভিযোগ করল এবং পাল্টা আক্রমণ করে বলল, পশ্চিমে মক্কাতে কাবাঘরে মূর্তিপূজার মন্দির সেখানে একখণ্ড কালো পাথরও আছে। তাই মূর্তি ও পাথর পূজার চার্জ আনল।
এরপর প্রফেট শনিবার সাবাতের দিনের বদলে শুক্রবার সপ্তাহে বিশেষ দিন এবং গণপ্রার্থনার দিন বলে ধার্য হলো। এই দিন পূর্ণ দিবস বিশ্রামের দিন বলে গণ্য হলো না। জুমার নামাজ ও খোবার পর, সাধারণ কাজকর্ম, ব্যবসা, বাণিজ্য- এমনকি প্রয়োজনে যুদ্ধ করতেও বাধা রইল না। এখানেও ইহুদিরা এই অভিযোগ আনল যে প্রফেট মোহাম্মদ প্যাগন আরবদের পুরনো প্রথায় ফিরে গেলেন, কারণ প্যাগন আরবরা শুক্রবারকে বিশেষ দিন রূপে পালন করত।
কিন্তু শূকরের মাংস হারাম থাকল, তবে ইহুদিদের খাদ্য বিষয়ে অন্যান্য কঠোরতা নমনীয় ও সরল করা হলো, কারণ কোরান বলে, খাদ্যবস্তু সম্বন্ধে ইহুদিদের বিধিনিষেধ তাদের ওপর শাস্তিস্বরূপ ছিল (৬ : ১৪৭)।
প্রথমে প্রফেট মোহাম্মদ যখন তাঁর সাহাবীদের সাথে নামাজে ডাকার জন্য কি ব্যবস্থা নেওয়া যায় এ বিষয়ে মতামত চান, তখন কয়েক জন প্রস্তাব করেন ইহুদিদের মতো ‘বুক’ ড্রাম পেটাতে। তখন ড্রাম তৈরি করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয় পরে যখন ইহুদিদের সাথে বিবাদের সূত্রপাত হয় তখন ড্রামের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
৬২৪ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে দশ দিনের আত্মশুদ্ধি যা মহররম মাসে আশুরায় শেষ হতো এ প্রথা বন্ধ করা হয়। এর বদলে আরবি রমজান মাসে সুস্থ মুসলিমদের সারা মাস রোজা রাখার প্রথা প্রবর্তিত হয় যা হানিফরা ঐ সময় মক্কায় পালন করত। সেই সাথে তার সম্প্রদায়কে মধ্যপন্থী’ করার জন্য ইহুদি ও খ্রিস্টানকে অনুসরণ না করে (যেমন ইহুদিদের দশ দিন আর খ্রিস্টান ৪০ দিন লেন্টেন কাল উপবাস করে) মাঝামাঝি ৩০ দিন (এক মাস) রোজা রাখার বা সংযমের মাস ধার্য করা হয়। কারণ, ‘কোরান বলে আল্লাহ তোমার জন্য সব কিছু সরল করে দিতে ইচ্ছা করেন’ (২ : ১৮১)।
৯.২ ইহুদিদের বিনাশ সাধন
এখন প্রফেট মোহাম্মদ ইহুদিদের বিরুদ্ধে সক্রিয় নির্যাতনের পথ বেছে নিলেন এই অজুহাতে যে তাঁর আরব প্রতিপক্ষের সাথে সংঘর্ষে ইহুদিরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কিন্তু আসল কারণ ছিল মদিনাতে ইহুদিদের অর্থনৈতিক আধিপত্য।
৬২৪ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে শহরের বাজারের মধ্যে এক সাম্প্রদায়িক ঘটনার ছুতো ধরে ঐ অঞ্চলের ধনী ইহুদি সম্প্রদায় বানু কাইনুকা গোত্রের বসতি অবরোধ করা হয় মুসলিমদের দ্বারা। বানু কাইনুকা সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ মানুষ লোহালক্কড়ের ব্যবসায়ী, যুদ্ধাস্ত্র কারিগর, স্বর্ণকার এবং কামার জাতীয় ব্যবসার মালিক। একটানা পনের দিন অবরোধের পর ইহুদিদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। পুরুষ মানুষদের বাঁধা হয় তারপর তাদের কতল করার ব্যবস্থা হয়।
এই অবস্থায় খাজরাজ গোত্র প্রধান আবদুল্লাহ ইবন ওবেই এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন। তিনি অনর্থক রক্তপাত পছন্দ করতেন না, তাছাড়া প্রফেট মোহাম্মদের নেতৃত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করতেন এবং তার শনৈ শনৈ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধে মদিনাবাসীদের তিনি সাবধান করে দেন। একবার প্রফেট তাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দিতে গেলে তিনি বলেছিলেন, ‘যারা তোমার ধর্ম প্রচার অপছন্দ করে তাদের অযথা বিরক্ত করার চেষ্টা করো না।’ তিনি ইসলাম ধর্ম থেকে দূরে সরে থাকতেন, কখনোই সত্যিকারের বিশ্বাসী ছিলেন না, তাই তাকে মুসলিমরা ‘মোনাফেক’ বলত। কিন্তু যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন প্রফেট মোহাম্মদ তাকে ঘাঁটতেন না, কারণ মাদানী খাজরাজ গোত্রের তিনি বড় নেতা ছিলেন।
প্রফেট মোহাম্মদ ঘুরে দাঁড়ালে, আবদুল্লাহ ইবন ওবেই তাঁর কুর্তা চেপে ধরেন। এতে ইবন ইসহাক বলেছেন, প্রফেটের মুখ রাগে লাল হয়ে যায়। কিন্তু আবদুল্লাহ কুর্তা ধরে রেখেই বলেন- ‘আল্লাহর শপথ, তুমি যদি এই ইহুদি গোত্রের সাতশো লোক এই সকালবেলায় কেটে ফেল, তাহলে আমি অবস্থার পুরো পরিবর্তন করে দিতে পারি।’ প্রফেট সব সময়েই ঠাণ্ডা মাথায় অবস্থার মোকাবেলা করতেন; তাই তিনি ইহুদিদের প্রাণে মারেননি। পরিবর্তে গোটা কাইনুকা গোত্রের সিরিয়ায় নির্বাসনের আদেশ হয়। তাদের তিন দিন সময় দেয়া হয় মদিনা পরিত্যাগ করতে আর তাদের সাথে ব্যবসার কোনো জিনিসপত্র দিতে বারণ করা হয়। তারা চলে গেলে তাদের জিনিসপত্র ও বাড়িঘর বিশ্বাসীদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যায়।
ইবন ইসহাক বলেছেন, প্রফেট মোহাম্মদ মুসলিমদের অনুমতি দিয়েছিলেন কোনো ইহুদির সম্মুখীন হলে তাকে হত্যা করতে। এই সাধারণ নির্দেশ পালিত হয় ৬২৪ সালে জুলাই মাসে, ফলে ইবন সুনাইমা নামে একজন প্রভাবশালী ইহুদি খুন হয়ে যায়। কিন্তু পাইকারি হারে ইহুদি নিধন পরে সংঘটিত হয়।
৬২৫ খ্রিঃ আগস্ট মাসে মদিনা থেকে তিন মাইল দূরে বানু নাদির ইহুদি গোত্রকে চরমপত্র দেয়া হয় যে তারা যেন বাড়িঘর ছেড়ে অচিরেই সিরিয়াতে চলে যায়, অন্যথায় সকলেই প্রাণে মারা যাবে। ওহোদ যুদ্ধের পূর্বে মক্কার আবু সুফিয়ানের সাথে বানু নাদিরের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল, কিন্তু চরমপত্রের কারণে বলা হয়েছিল যে, তারা প্রফেটের সাথে সম্পাদিত চুক্তিপত্র ভঙ্গ করেছে এবং এর সমর্থনে আল্লাহর কাছ থেকে ওহি পাওয়া গেছে (সূরা ৫৯)। আবদুল্লাহ ইবন ওবেই এই চার্জ অস্বীকার করে বলেছিলেন, ওসব ভিত্তিহীন।
বানু নাদিরের ইহুদিদের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করার জন্য প্রফেট মোহাম্মদ এগিয়ে গেলেন দলবল নিয়ে তাদের খেজুর বাগান কেটে ফেলতে ও জ্বালিয়ে দিতে। ইহুদিরা অভিযোগ করল এই বলে যে, এটা আরব দেশের যুদ্ধ আইন এবং মুসার আইনকে লংঘন করা হচ্ছে (Deut 20 : 19); কিন্তু কে কার কথা শোনে! বানু নাদিরকে নির্বাসনে পাঠানোর পর তাদের তরবারি, শিরোস্ত্রাণ ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম এবং তাদের বাড়িঘর সবই মুসলিমরা দখল করে নেয়।
৬২৭ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে, খন্দকের যুদ্ধের পর প্রফেট মোহাম্মদ বানু কোরাইজা গোত্রের দুর্গ পঁচিশ দিন অবরোধ করার পর দখল করে নেন। ইহুদিরা বানু নাদিরের মতো স্থান পরিত্যাগ করে নির্বাসনে চলে যাবার প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু প্রফেট সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন। তারা বাঁচতে পারে এক শর্তে সেটা হলো তাদের মুসলিম হতে হবে। মাত্র একজন ইহুদি এই শর্ত মেনে নেয়।
এই ইহুদি নিধনে প্রফেট মোহাম্মদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের দায় লাঘব করার জন্য হাদিস তৈরি হলো এই বলে যে, ইহুদিদের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য প্রফেট মদিনার আউস গোত্র প্রধান সাদ ইবন মুয়াদকে সম্পূর্ণ ক্ষমতা অর্পণ করেন। সাদ প্রফেটের উগ্রবাদী চরমপন্থীদের মধ্যে অন্যতম। ইহুদিরা অনেক আগে থেকেই সাদের চক্ষুশূল ছিল, তাছাড়া অবরোধের সময় সাদ মারাত্মকভাবে আহত হয়। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় যে, কোরাইজা গোত্রের পুরুষদের কতল করা হবে, নারী-শিশুদের দাস হিসাবে বিক্রি করা হবে, আর খেজুরের বাগান ও অন্যান্য সম্পত্তি মুসলিমদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হবে।
এই নিষ্ঠুর কর্মের বিরুদ্ধে কিছু আরব আপত্তি ওঠানো সত্ত্বেও প্রফেট মোহাম্মদ সাত তবক আসমান থেকে আল্লাহর প্রেরিত রায় হিসাবে আদেশ দিলেন কার্যকর করার জন্য। কোরানে এ ঘটনার উল্লেখ আছে (৩৩ : ২৬)। আদেশ কার্যকর করার পরেই সাদ ইবন মোয়াদ মারা যায় স্পষ্টত তার জখমের কারণে। বলা হয় যে, এই পবিত্র লোকটির মৃত্যুর জন্য আল্লাহর আরশ আসমানে কেঁপে কেঁপে উঠেছিল (Rodinson 1976, P. 213) ।
শহরের বাজারের কাছে খাল কাটা হয়েছিল এবং মোহাম্মদের সম্মুখেই আটশ’র অধিক বন্দির পেছনে হাত বেঁধে রেখে সেই খালের ধারে পাঁচ জনের গ্রুপ করে একে একে মাথা কাটা হয়, পরে দেহগুলো খালে ধাক্কা দিয়ে ফেলা হয়। এই নিষ্ঠুর ও অমানবিক ম্যাসাকার, ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল লেখকরাও বলেছেন, নাজীদের নিষ্ঠুরতাকেও হার মানায় (Armstrong 1991 P. 207)। এই হত্যাকাণ্ড সারা দিন ধরে চলে এবং রাতে টর্চ-বাতি জ্বালিয়েও এর বাকিটুকুও সারা হয়।
একজন নাম-না-জানা ইহুদি মহিলা যার স্বামী ঐ কতলের অন্তর্ভুক্ত চিৎকার করে দাবি জানায় যে তার স্বামীর সহমরণ হতে চায়; তার দাবি পূরণ হয় এবং সে হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়।
মোহাম্মদের প্রিয় পত্নী আয়েশা, এই ম্যাসাকার দেখেছিলেন, তিনি বলেছিলেন যে, সেই মহিলাটির নির্ভীক মৃত্যুবরণ তাকে সারা জীবন তাড়া করেছে।
জাবির নামে এক বৃদ্ধ ইহুদিকে যিনি পূর্বে কয়েকজন মুসলিমের প্রাণ রক্ষা করেছিলেন, ক্ষমা করা হলে তিনি বলেছিলেন, যখন সকলেই চলে গেল তার আর বেঁচে লাভ কি। সে-ও তাদের সাথী হতে চায়। প্রফেট মোহাম্মদকে এ কথা জানালে তিনি বলেছিলেন, সকলের সাথে তাকে জাহান্নামে যেতে দাও। তার পর তার আদেশে তাকেও হত্যা করা হয়।
বানু কোরাইজার জমি-জমা, জিনিসপত্র, গবাদিপশু, অস্ত্রশস্ত্র – সবকিছু মুসলিমদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। কয়েকজন নারীকে উপপত্নী হিসাবে এবং দাস হিসাবে বন্ধুদের বিতরণের পর তিনি নিজেই একজনকে রেখে দেন। সেই মহিলার নাম রায়হানা; সুন্দরী তরুণী মহিলা। তার স্বামীকে এই ঘটনায় হত্যা করা হয়। রায়হানা প্রফেটের স্ত্রী মর্যাদা পেতেন, কিন্তু তিনি তার ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করতে রাজি না হওয়ায় তাকে বাঁদীর মর্যাদা দেয়া হয়।
প্রফেট মোহাম্মদ, বাকি নারী ও শিশু, প্রায় তেরশ’র মতো, প্রতিবেশী গোত্রের কাছে বিক্রি করে বেশ মোটা টাকা মুসলমানদের কোষাগারে জমা হয়।
৬২৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে, প্রফেট মোহাম্মদ ধনী ও উন্নয়নশীল খাইবার ওয়েসিস দলবল নিয়ে আক্রমণ করেন। খাইবার মদিনা থেকে সত্তর মাইল উত্তরে সিরিয়া যেতে পড়ে। খাইবার ওয়েসিস হিব্রু শব্দ ‘খেবার’ থেকে আগত যার অর্থ সাথী বা সঙ্গী। এখানে ইহুদি সম্প্রদায়ের ঘনবসতি এবং খুবই মজবুত সুসঙ্ঘবদ্ধভাবে তারা বাস করে। ইবনে হিশাম, ইবনে সাদ ওয়াকিদি বলেন, প্রফেট মোহাম্মদ এই ওয়েসিস দখল করেন, গোত্রের প্রধান কিনানাকে বন্দি করে তার বুকের ওপর আগুন দিয়ে নির্যাতন করে কথা আদায় হয়, কারণ গুপ্তধন কোথায় আছে কিনানা বলতে চাননি। পরে গুপ্তধনের সন্ধান মিললে, কিনানার শিরোশ্ছেদ করা হয়।
কিনানার স্ত্রী সাফিয়ার বয়স তখন সতের। তার পিতার নাম হায়ী বেন আখতাব। ইনি বানু কোরাইজাতে মৃত্যুবরণ করেন। মালেগণিমত ভাগের সময় সাফিয়া অন্য লোকের ভাগে পড়ে। কিন্তু প্রফেট মোহাম্মদ সাফিয়াকে দেখে তার ওপর নিজের চাদর ফেলে তাকে নিজের বলে দাবি করেন এবং ঐ রাতেই তরুণী বিধবা সাফিয়াকে বিবাহ করেন।
প্রফেট মোহাম্মদ তার নতুন স্ত্রীর প্রতি এতই মুগ্ধ ছিলেন যে, সাফিয়া মদিনায় ফেরার সময় তার উটে উঠতে গেলে, প্রফেট নিজে জানু পেতে দেন, যাতে তার ওপর ভর করে সাফিয়া উটে উঠতে পারে (Rodinson, 1976, P. 254)। পরে ঈর্ষার বশে প্রফেটের অন্য স্ত্রীরা তাকে ইহুদি বলে উপহাস করলে সে রুষ্ট হয়ে জবাবে বলেছিল যে, মুসা তার চাচা এবং আরন তার পুরোহিত বাবা ছিলেন। এতে প্রফেট মোহাম্মদ খুশি হয়ে কোরানের একটি আয়াত আবৃত্তি করেছিলেন যেখানে উল্লেখ ছিল উপহাসকারী রমণীদের চেয়ে সাফিয়া মহত্ত্বর মহিলা। (৪৯ : ১১)।
বন্দি ইহুদি যুবতী নারীদের মধ্যে একজন ছিল তার নাম জয়নাব, যে প্রফেট মোহাম্মদ ও তার সঙ্গীদের জন্য এক থালা ছাগলের মাংস রান্না করে আনে। সেই মাংসের এক টুকরা খেয়ে একজন তৎক্ষণাৎ মারা যায়। প্রফেটও এক টুকরো খেয়ে যন্ত্রণায় আক্রান্ত হন, কিন্তু সময়মতো চিকিৎসার জন্য প্রফেট সে যাত্রা বেঁচে যান। মাংসে বিষ মিশ্রিত ছিল।
জয়নাবকে জিজ্ঞাসা করা হয় কেন সে প্রফেটকে বিষ দিয়ে মারতে গেল। জবাবে বলেছিল যে, তিনি তার বাবা, চাচা, স্বামী এবং ভাইদের হত্যার জন্য দায়ী এবং তার কওমের জন্য চরম নির্যাতনের কারণ। যদি সত্যিই তিনি প্রফেট হতেন, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই মাংসের টুকরা খাওয়ার আগে বুঝতে পাবেন এতে বিষ আছে এবং গ্রহণ করতে অস্বীকার করতেন। এতে প্রমাণিত হলো যে, তিনি তা বুঝতে পারেননি, তার এই জ্ঞানের অভাবের হেতু তিনি প্রফেট হতে পারেন না। জয়নাবকে তখনিই হত্যা করা হয়।
এই ঘটনার পর থেকে সময়ে সময়ে তার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত (ঘটনার তিন বছর পর) সেই বিষক্রিয়ায় প্রফেট মোহাম্মদ অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। পরে এটা দাবি করা হয় যে প্রফেট মোহাম্মদ সেই বিষাক্ত মাংস খাওয়ার পূর্বে সেই মাংসের টুকরা তাকে সাবধান করেছিল বিষাক্ত বলে, তবু তিনি তা গ্রহণ করেছেন, আর এই জন্য তাকে ‘শহীদ’ আখ্যা দেয়া যেতে পারে, কেননা এই বিষাক্ত মাংস ভক্ষণে কারণে তিনি যথেষ্ট যন্ত্রণা পেয়েছেন এবং এক বিধর্মীর হাতে মারা গেছেন।
খাইবার ওয়েসিস থেকে প্রফেট মোহাম্মদ যত সম্পদ লাভ করেন তা তার আগেকার সব অভিযান থেকে আহরিত সম্পদের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। খেজুর, তেল, মধু, কালি, ভেড়ার পাল ও উটের বহর এবং সোনা অন্যান্য স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ সম্পত্তি, জমি ও গ্রামসহ এত বেশি পেয়েছিলেন যা তিনি কল্পনাই করতে পারেননি। ইবনে হিশাম বলেন, খাইবারের পর থেকে মুসলিম ক্রীতদাসের সংখ্যার মাত্রা অনেক বেড়েছিল।
এর কিছুদিন পরে, অন্যান্য ছোটখাটো ইহুদি সম্প্রদায় যারা ছিল- যেমন, ফাদাক, কামুস, ওয়াতিহ, সোলালিম, ওয়াদি আল-কোরা এবং অন্যরা তাদের জোর করে পরাধীন করা হয়। মদিনার আশপাশে আর গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইহুদি গোত্র রইল না। খলিফা ওমর বাকি যেগুলো ইহুদি হেজাজে বাস করত তাদের আরব পেনিনসুলা থেকে উৎখাত করে দেশকে ইহুদিমুক্ত করেন এবং তা ঘটেছিল প্রফেট মোহাম্মদের মৃত্যুর কয়েক বছর পরে।