পায়রাটি
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তাঁবুতে অসুস্থ পড়ে আছেন। তার থেকে সামান্য দূরে আক্রার বাইরে তার জানবাজরা আক্রা অবরোধকারী খৃস্টান বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তীনের ইতিহাসে সবচে বেশি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে। কিন্তু অবরোধ ভাঙার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
নগরীর ভেতরে সুলতান আইউবীর সৈন্যসংখ্যা দশ হাজার। আর বাইরে নগরী অবরোধকারী খৃস্টানরা ৫ লক্ষাধিক। সুলতান আইউবী নগরীর বাইরে খৃস্টানদের পেছনে। তাঁর কাছে আছে দশ হাজার মামলুক, যাদের উপর তার অনেক ভরসা ছিলো। তারা পেছন থেকে খৃস্টানদের উপর অত্যন্ত দুঃসাহসী আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো সাফল্য আসছে না। শত্রুর সংখ্যা বেশি হওয়ার পাশাপাশি অবরোধ না ভাঙার আরেকটি কারণ হচ্ছে, খৃস্টানরা আক্রার চতুর্দিকে স্থানে স্থানে গর্ত খনন করে রেখেছে। এই গর্তগুলো সুলতান আইউবীর বাহিনীর জন্য বিপজ্জনক রূপে দেখা দিয়েছে। অশ্বারোহী সৈন্যরা আক্রমণ করতে এলে ঘোড়া গর্তে পড়ে যাচ্ছে।
আক্রার বাইরে বিস্তৃত অঞ্চল রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। লাশের কোনো সংখ্যা নেই। আক্রার প্রাচীরের বাইরে নগরীর প্রাচীরসম দীর্ঘ ও চওড়া পরিখা ছিলো, যেটি পার হওয়া দুষ্কর ছিলো। খৃস্টানরা তাদের মৃত সৈন্য ও ঘোড়া দ্বারা সেই পরিখা ভরাট করে চলেছে। যুদ্ধের ডামাডোল এতো বেশি যে, আকাশে শকুন ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী উড়ছে না। শুকনরা নীচে নামছে এবং পেট পুরে লাশ খেয়ে খেয়ে উড়ে যাচ্ছে।
শকুন ছাড়া আছে আর একটি পাখি- একটি কবুতর। কবুতরটি প্রায় প্রতিদিন আক্রা থেকে উড়ে এসে সুলতান আইউবীর ক্যাম্পে অবতরণ করছে এবং বহুক্ষণ পর ক্যাম্প থেকে উড়ে আবার আক্রা ফিরে যাচ্ছে। অবরোধ ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাঝে এই কবুতর একদিন আক্রা থেকে উড়াল দেয়। ইংল্যান্ডের সম্রাট রিচার্ড তাঁবুর বাইরে দণ্ডায়মান। সঙ্গে তার বোন জুয়ানাও আছে।
এই পায়রাটার উপর দৃষ্টি রাখবে- রিচার্ড আদেশ করেন- দেখামাত্র তার উপর বাজ ছেড়ে দেবে। এই একটি পায়রাই আমাদের পরাজয়ের কারণ হতে পারে।
বোন জুয়ানা এবং তার হবু স্বামী বেরঙ্গারিয়া রিচার্ডের নিকট দণ্ডায়মান। এই অল্প কদিন আগেও জুয়ানা সিসিলির সম্রাটের স্ত্রী ছিলো। সম্রাট মারা গেলে জুয়ানা ভর যৌবনেই বিধবা হয়ে যায়। ফিলিস্তীন জয় করে সঙ্গের ছেলেটির সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্য রিচার্ড তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। জুয়ানা এতো রূপসী যে, কেউ বলবে না মেয়েটির বিয়ে হয়েছে। ইংল্যান্ড থেকে আসার সময় পথে সিসিলি থেকে রিচার্ড তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন।
রিচার্ড জুয়ানার হাসি শুনতে পান। বোনের দিকে ফিরে তাকালে সে জিজ্ঞেস করে- ভাইজান! এই পায়রাটি মরে গেলে কি সালাহুদ্দীন আইউবীও মরে যাবেন?
এই পায়রাটি পিয়ন জুয়ানা!- রিচার্ড বললেন- পায়ের সঙ্গে বার্তা বেঁধে ও সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট আক্রাবাসীদের চিঠি নিয়ে যায়। আইউবী এরই মাধ্যমে সেই চিঠির উত্তর আক্রায় পৌঁছিয়ে দেন। আইউবী বাইরে থেকে আমাদের উপর যে আক্রমণ চালাচ্ছেন, আক্রাবাসীদের বার্তা মোতাবেকই করে থাকেন। আক্রাবাসীদের জোশ-চেতনা এবং অস্ত্র ত্যাগ না করার প্রত্যয় এই পায়রাটির কারণেই অটুট রয়েছে জুয়ানা। অন্যথায় কোনো অবরুদ্ধ বাহিনী এতো দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এমন তীব্র আক্রমণ সহ্য করতে পারে না। তুমি তো দেখেছো, আমরা মিনজানিকের সাহায্যে পাথর ছুঁড়ে কয়েক স্থান থেকে প্রাচীরের উপরের অংশ ফেলে দিয়েছি এবং আমাদের নিক্ষিপ্ত গোলা নগরীতে ব্যাপক ধ্বংস সাধন করেছে। তারপরও তারা অস্ত্র ত্যাগ করছে না।
আপনার আসল উদ্দেশ্য এবং গন্তব্য তো জেরুজালেম, যার থেকে আপনি এখনো অনেক দূরে- জুয়ানা বললো- আক্ৰা জয় করতে যদি কয়েক বছর অতিবাহিত হয়ে যায়, তাহলে জীবনেও জেরুজালেম পৌঁছতে পারবেন কি? আমাদের গোয়েন্দা ও মুসলিম যুদ্ধবন্দিরা বলছে, নগরীর ভেতরে মাত্র দশ হাজার সৈন্য আছে। আমাদের সংখ্যা প্রথমে ৬ লাখ ছিলো। এখন ৫ লাখ। অবরোধ ১৯৮৯ সালের আগস্টে শুরু হয়েছিলো। এখন ১১৯১ সালের আগস্ট চলছে। দুই বছর ভাইজান! এখনো আপনি দশ হাজার অবরুদ্ধ সৈন্যকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে পারেননি। আমি জানি, আপনি এই অবরোধ অভিযানে এসে যোগ দিয়েছেন মাস কয়েক হলো। কয়েক মাস সময়ও কম নয় ভাইজান। কিন্তু এই কয়েক মাসে আক্রা নগরীর সামান্য প্রাচীর ভাঙা আর মিনজানিকের সাহায্যে নগরীর কিছু অংশে আগুন লাগানো ব্যতিরেকে আপনি কোনো সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন কি? আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, নগরীর ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আপনি কিছুই অর্জন করতে পারবেন না।
রিচার্ড তার হবু ভগ্নিপতিকে সেখান থেকে চলে যেতে বললেন। সে চলে যায়। রিচার্ড বোনকে উদ্দেশ করে বলতে শুরু করেন—
বড় ক্রুশ এবং জেরুজালেমের মর্যাদা ও পবিত্রতার দাবি হচ্ছে, তুমি ভুলে যাও, তুমি আমার বোন। তুমি সেই ক্রুশের কন্যা, যেটি মুসলমানদের দখলে চলে গেছে এবং যে জেরুজালেম আমাদের নবীর উপাসনালয় ছিলো, সেটিও এখন মুসলমানদের দখলে। তুমি জানো, আমাদেরকে ইসলামের বিনাশ সাধন করতে হবে। আর তুমি নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছো, মুসলমানরা আত্মহত্যার ন্যায় যুদ্ধ করছে। এরা মৃত্যুর পরোয়া করে না। এরা বিজয় অর্জন করার লক্ষ্যে লড়াই করে। আমি এই প্রথমবার তাদের যুদ্ধ দেখলাম। এখানে আমি এই প্রথম এসেছি। মুসলমানদের উন্মাদনার যে কাহিনী কানে শুনেছিলাম, এখন তা চোখে দেখলাম। আমাকে ধারণা দেয়া হয়েছিলো, মুসলমানদেরকে ঘায়েল করার উত্তম পন্থা নারী। একজন নারী নাকি একজন ক্ষমতাধর ও যুদ্ধবাজ মুসলমানকে কুপোকাত করে ফেলতে পারে। তাদের মাঝে যে গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো, সেটি আমাদের সম্রাটগণ তাদেরকে ক্ষমতার মোহ, সোনা-মাণিক্য এবং মদ ও নারীর নেশায় আচ্ছন্ন করে সংঘটিত করিয়েছিলেন। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবী লোকটা এমন পাথর যে, তাকে কোনো কিছুতেই গুলানো সম্ভব হয়নি। তার যে ভাইয়েরা আমাদের সঙ্গে এসে পড়েছিলো, তরবারীর জোরে তিনি তাদেরকে নিজের অনুগত বানিয়ে নিয়েছেন কিংবা তাদের অন্তরে ইসলামী চেতনা জাগিয়ে তুলেছেন।
হ্যাঁ, এসব আমিও শুনেছি- জুয়ানা বললো- মুসলিম আমীর ও শাসকদের নিকট গুপ্তচরবৃত্তি ও নাশকতার জন্য আমাদের যে মেয়েদের প্রেরণ করা হতো, তাদের আত্মত্যাগের কাহিনীও শুনেছি। আমার মনে হচ্ছে, এ পদ্ধতিটা সফল হয়নি।
ব্যর্থও যায়নি- রিচার্ড বললেন- মুসলমানদের জাতীয় চেতনা বিনষ্ট করার জন্য যদি এই মেয়েগুলোকে ব্যবহার না করা হতো, তাহলে তারা বহু আগে শুধু জেরুজালেমই নয়- অর্ধেক ইউরোপ দখল করে নিতো। আমরা নারীর দেহের রূপ-যাদু প্রয়োগ করে এবং তাদের কতিপয় উজির-সালারকে সুলতান বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে দেখিয়ে তাদের ঐক্য ভেঙে দিয়েছিলাম। তাদেরকে আপসে যুদ্ধ করিয়ে করিয়ে তাদের সামরিক শক্তি খর্ব করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেছে।
আপনি এসব কথা আমাকে কেননা শোনাচ্ছেন? জুয়ানা বললো- আপনার বর্ণনা ভঙ্গিতে হতাশা কেনো? আমি আপনার কী সাহায্য করতে পারি?
আমি তোমাকে বলেছি, তুমি ভুলে যাও তুমি আমার বোন- রিচার্ড বললেন- তুমি ক্রুশের কন্যা। ক্রুশের বিজয়ের জন্য তুমি বহু কিছু করতে পারো। তুমি দেখতে পাচ্ছো, আমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করছি আবার পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎও হচ্ছে। আমরা এক পক্ষ অপর পক্ষের নিকট দূত প্রেরণ করছি। সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাই আল-আদিলের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিলো। আমি তাকে আমার কতিপয় শর্ত মান্য করতে বাধ্য করার চেষ্টা করছি; কিন্তু সে মানছে না। তাকে বলেছি, তোমরা জেরুজালেম: ও বড় কুশটা আমাদের দিয়ে দাও আর তোমরা এই অঞ্চল ছেড়ে চলে যাও। সালাহুদ্দীন আইউবীও আমার দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করেছেন।
আপনি নিজে সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন না কেন?
তিনি আমাকে সাক্ষাৎ দিতে রাজি হচ্ছেন না- রিচার্ড উত্তর দেন- তাছাড়া তিনি অসুস্থ। মনে হচ্ছে তার ভাই আল-আদিল তারই ন্যায় পরিপক্ব মুসলমান ও দৃঢ়প্রত্যয়ী। সে সালাহুদ্দীন আইউবীর স্থান দখল করছে। আমি তার মাঝে একটি দুর্বলতা প্রত্যক্ষ করেছি। লোকটি যুবক এবং প্রাণোচ্ছল মনে হচ্ছে। আমি লোকটার হৃদয় জয় করার চিন্তা করছি। আমি তাকে বন্ধু বানাতে সক্ষম হবো। কিন্তু তোমার কাজ আমি কীভাবে করবো বলো। তোমার কি লোকটাকে পছন্দ হয়?
তার মানে আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েরা দীর্ঘদিন যাবত যে কাজটা করে আসছে, আপনি আমার দ্বারা সেই কাজ নিতে চাচ্ছেন, তাই না?
হ্যাঁ- রিচার্ভ বললেন- তার হৃদয়টা জয় করে নাও। পাগলকরা ভালোবাসা প্রকাশ করো। তুমি তাকে বিয়ে করার আগ্রহ ব্যক্ত করো। আমি মধ্যখানে এসে সালাহুদ্দীন আইউবীকে বলবো, যদি উপকূলীয় অঞ্চলটা আপনার ভাই আর আমার বোনকে দিয়ে দেন, তাহলে আমি আল-আদিলের সঙ্গে আমার বোনের বিয়েতে প্রস্তুত আছি। তুমি আল-আদিলকে স্বধর্ম পরিত্যাগ করে খৃস্টধর্ম গ্রহণে প্রস্তুত করবে। তাকে প্রলোভন দাও, এই সুবিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের তুমি সুলতান হয়ে যাবে। আমি আশাবাদী, তুমি তাকে সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রতিপক্ষ বানাতে সক্ষম হবে।
জুয়ানা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। রিচার্ড উত্তরের অপেক্ষায় তার প্রতি তাকিয়ে আছে। অবশেষে জুয়ানা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো- আমি চেষ্টা করবো।
মুসলমানদেরকে এই প্রক্রিয়ায় পরাজিত করা যেতে পারে- রিচার্ড বললেন- আমি যুদ্ধের ময়দানে তাদেরকে পরাস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাবো। কিন্তু তার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। সে সময় পর্যন্ত সম্ভবত আমি বেঁচে থাকবো না। তাছাড়া আমাকে ইংল্যান্ডও ফিরে যেতে হবে। ওখানকার পরিস্থিতি ভালো নয়। বিরোধীরা আমার অনুপস্থিতিতে সুযোগ নিচ্ছে।
***
রিচার্ডের মাথার উপর দিয়ে উড়ে আসা পায়রাটা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর তাবুর সম্মুখে পাতা মাচানটার উপর এসে বসে। দারোয়ান ছুটে এসে তার পা থেকে বাঁধা বার্তাটি খুলে তাঁবুতে নিয়ে যায়। সুলতান আইউবী শরীরে বেশ দুর্বলতা অনুভব করছেন। তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন। তথাপি তিনি উঠে বসে বার্তাটি পড়তে শুরু করেন। বার্তাটি আক্রার শাসনকর্তা মীর কারাকুশ এবং সেনাপতি আল-মাশতুব প্রেরণ করেছেন। পত্রে তারা নতুন কোনো সংবাদ দেননি। অবস্থা শোচনীয়, নগরী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা অস্ত্র সমর্পণ করতে প্রস্তুত নই ইত্যাদি। তারা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন, আপনি এই আশঙ্কা রাখবেন না, জীবন থাকতে আমরা অস্ত্র সমর্পণ করবো। কিন্তু খৃস্টানদের উপর বাইরে থেকে আরো জোরদার আক্রণ করে আমাদের সাহায্য করা আপনার পক্ষে অধিক জরুরি হয়ে পড়েছে। সৈনিকদেরকে বলুন, নগরবাসীরা যেরূপ জযবার সঙ্গে যুদ্ধ করছে, তোমরাও তেমনি জযবার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাও। অর্ধেক নগরীর পুড়ে গেছে। সৈন্যও অর্ধেক কমে গেছে। কিন্তু জনসাধারণের জোশ-জযবা এতো প্রবল যে, তারা পানাহার ছেড়ে সৈন্যদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছে। মহিলারও আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে। তারা নিজেরা কম খেয়ে সৈন্যদের খাওয়াচ্ছে।
তারা প্রাচীরের বিবরণ এভাবে প্রদান করে যে, খৃস্টানদের মিনজানিকের অনবরত পাথর নিক্ষেপের ফলে কয়েক স্থান থেকে প্রাচীর ভেঙে গেছে। উপরের অংশ শেষ হয়ে গেছে। শত্রুরা তাদের নিহত সৈনিক ও মৃত ঘোড়ার লাশ দ্বারা বাইরের পরিখা ভরাট করে দেয়ালের নিকটে আসার চেষ্টা করছে। আপনি যখন দফের শব্দ শুনতে পাবেন, তখন পেছন থেকে খৃষ্টানদের উপর অত্যন্ত তীব্র আক্রমণ চালাবেন। খৃস্টানরা যখন প্রাচীরের উপর আক্রমণ চালাবে, আমরা তখন দফ বাজাবো। আপনি এমন জানবাজ প্রস্তুত করুন, যারা সমুদ্র পথে আমাদের কাছে অস্ত্র পৌঁছিয়ে দেবে।
সুলতান আইউবী জ্বর ও শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ান। তিনি পত্রের উত্তর লেখান। তাতে তিনি আক্রাবাসীদের প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানান এবং সাহস প্রদান করেন। লিখেছেন, জানবাজরা আগেই নগরীতে অস্ত্র পৌঁছানোর জন্য চলে গেছে। আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছেন। ইসলামের বড়ই দুর্দিন যাচ্ছে। খৃস্টানরা বাইতুল মুকাদ্দাস যাওয়ার পরিবর্তে আক্ৰা আসুক এটা আমারই প্রচেষ্টা ছিলো, যাতে আমি এখানেই আটকে রেখে তাদের সামরিক শক্তি দুর্বল করে দিতে পারি। তোমরা আক্তার প্রতিরক্ষার জন্য নয়- মসজিদে আকসার সুরক্ষার জন্য লড়াই করছে।
পত্রখানা পায়ে বেঁধে কবুতরটিকে রওনা করিয়ে সুলতান আইউবী তাঁর সালারদের তলব করেন। বললেন, প্রতিজন কমান্ডার ও প্রত্যেক সৈনিকের নিকট গিয়ে কথা বলার সময় ও সুযোগ আমার নেই। শরীরে যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে, তাকে আমি এই জিহাদে ব্যয় করতে চাই। আমার কমান্ডার ও সৈনিকদের বলল, তোমরা আল্লাহ, রাসূল ও ইসলামের জন্য যুদ্ধ করো। এখন আর চিন্তা করো না, তোমরা তোমাদের সুলতানের নির্দেশে যুদ্ধ করছে। এ ও ভেবো না, তোমাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে। আল্লাহ তোমাদেরকে বিনিময় দান করবেন।
কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন, সুলতান আইউবী অতীতে কখনো এমন আবেগপ্রবণ হননি। মা কোলের শিশুটিকে হারিয়ে ফেললে যেমন আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে, সুলতান আইউবীও সেদিন তেমনি আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেছিলেন। তিনি ঘুমাতেন না। বিশ্রাম করতেন না। আমি তাকে বহুবার বলেছি, সুলতান! স্বাস্থ্যটার প্রতি একটু লক্ষ্য রাখুন। এভাবে শরীরটা একেবারে শেষ করে ফেলছেন। আল্লাহকে স্মরণ করুন। জয়-পরাজয় তারই হাতে। সুলতানের চোখ থেকে অশ্রু বেরিয়ে এসেছিলো। তিনি কম্পিত কণ্ঠে বললেন- বাহাউদ্দীন! আমি খৃস্টানদেরকে বাইতুল মুকাদ্দাস দেবো না। সেই পবিত্র ভূ-খণ্ডটির অবমাননা আমি হতে দেবো না, যেখান থেকে আমার প্রিয় রাসূল আল্লাহর দরবারে মিরাজে গমন করেছিলেন। যেখানে আমার রাসূল সিজদা করেছিলেন। হঠাৎ তিনি গর্জে ওঠে বললেন, না বাহাউদ্দীন না। আমি মৃত্যুবরণ করেও ক্রুসেডারদের বাইতুল মুকাদ্দাস দেবো না।
কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন, এক রাতে সুলতান আইউবী এতো অস্থির ছিলেন যে, আমি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে থাকি। তার ঘুম আসছিলো না। আমি তাঁকে কুরআনের দুটি আয়াত স্মরণ করিয়ে বললাম, আয়াতগুলো পড়তে থাকুন। তিনি চক্ষু বন্ধ করে নেন এবং তার ঠোঁট দুটো নড়তে থাকে। আয়াতগুলো পাঠ করতে করতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে বিড় বিড় করে ওঠেন- ইয়াকুবের কোনো খবর আসেনি? সে নগরীতে ডুবে যাবে। বলে আবারো ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু আমি লক্ষ্য করি, সুলতান ঘুমের মধ্যেও অস্থিরতা প্রকাশ করছেন।
সুলতান আইউবীর তাবু থেকে আক্রার প্রাচীরটাকে এমন দেখা যেতো, যেনো পিঁপড়েরা কোনো বস্তুর উপর দলা বেঁধে আছে। রাতে আক্রার প্রাচীরের উপর প্রদীপ হাঁটা-চলা করতো। অন্ধকারে প্রাচীরের উপর দিয়ে আগুনের গোলা-ভেতরে গিয়ে নিক্ষিপ্ত হতো। প্রাচীর টপকে ভেতর থেকে বাইরেও তেমনি, গোলা আসত। সুলতান আইউবীর কমান্ডো সেনারা প্রতি রাতে দুশমনের উপর গেরিলা হামলা চালাতো।
***
ঘুমের ঘোরে সুলতান আইউবী যে ইয়াকুবের নাম উচ্চারণ করেছিলেন, তিনি হলেন তার নৌ-বাহিনীর একজন অতিশয় দুঃসাহসী কাপ্তান। আক্রা নগরীতে রসদ ও অস্ত্র পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো। নগরীর যেদিকটায় নদী, সেদিকে খৃস্টানদের নৌ-বহর ছড়িয়ে ছিলো। অথচ নগরবাসীদের জন্য সরঞ্জাম পৌঁছানো খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিলো। সুলতান আইউবী ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য নৌ-বাহিনী থেকে স্বেচ্ছাসেবক তলব করেন। দুঃসাহসী কাপ্তান ইয়াকুব সুলতানের ডাকে সাড়া দেন। তত্ত্বালের কাহিনীকার কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ এবং আরো দুজন ঐতিহাসিক ইয়াকুবের কাহিনী বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। তিনি হালবের অধিবাসী ছিলেন। ইয়াকুব নৌ ও স্থল বাহিনী থেকে ৬৫০ জন সৈন্য বেছে নেন। তাদেরকে তিনি নিজ জাহাজে তুলে বৈরুত চলে যান। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ রসদ ও অস্ত্র বোঝাই করে আক্রার উদ্দেশ্যে রওনা হন। সেই অস্ত্র ও রসদের পরিমাণ এতো বেশি ছিলো যে, হাতে পেলে আক্রাবাসীরা দীর্ঘদিন যাবত যুদ্ধ করতে সক্ষম হতো।
ইয়াকুব তার সৈনিকদেরকে বলে রাখেন, প্রয়োজনে জীবন কুরবান করে দিতে হবে। যে কোনো মূল্যে হোক জাহাজ আক্রা পৌঁছাতে হবে। কিন্তু জাহাজটি আক্রার সামান্য দূরে থাকতেই খৃস্টানদের চল্লিশটি জাহাজ তাকে ঘিরে ফেলে। ইয়াকুবের জানবাজরা প্রাণপণ মোকাবেলা করে। জাহাজ চলতে থাকে এবং ইয়াকুব জাহাজটিকে আক্রার কুলের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। জানবাজরা দুশমনের জাহাজগুলোর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। এক ফরাসী ঐতিহাসিক দ্য উইনসোফ লিখেছেন, তারা জিন ও প্রেতাত্মার ন্যায় লড়াই করে। তবু দুশমনের ঘেরাও থেকে বেরুতে সক্ষম হয়নি। অর্ধেকেরও বেশি মুসলিম সৈন্য খৃস্টানদের তীর খেয়ে মারা যায়।
ইয়াকুব যখন দেখলেন, পাল ছিঁড়ে গিয়ে জাহাজ আপন গতিতে মাঝের দিকে এবং দুমশনের কজায় চলে যাচ্ছে, তখন তিনি তার জানবাজদের চীৎকার করে বললেন- আল্লাহর কসম! আমরা মর্যাদা নিয়ে মৃত্যুবরণ করবো। দুশমনকে না জাহাজ দখল করতে দেবো, না তার থেকে কোনো বস্তু ছিনিয়ে নিতে দেবো। জাহাজে ছিদ্র করে দাও। সমুদ্রকে জাহাজের ভেতর ঢুকে যেতে দাও।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, ইয়াকুবের যে কজন জানবাজ তখনো জীবিত ছিলো, তারা ডেকে গিয়ে জাহাজের তলদেশ ফুটো করতে শুরু করে। ছিদ্র হয়ে গেলে সাগরটা জাহাজে ঢুকতে শুরু করে। একজন জানবাজও জাহাজ থেকে লাফিয়ে জীবন রক্ষা করার চেষ্টা করেনি। সকলে জাহাজসহ সমুদ্রের তলদেশে হারিয়ে যায়। এটি ১৯৯১ সালের ৮ জুনের ঘটনা।
এই দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে সুলতান আইউবী তাবু থেকে বেরিয়ে আসেন। তার ঘোড় সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকতো। তিনি উচ্চশব্দে আদেশ করেন- দফ বাজাও। দফ বেজে ওঠে। এটা আক্রমণের সংকেত। অল্পক্ষণের মধ্যে তার বাহিনী আক্রমণের জন্য সমবেত হয়ে যায়। সুলতান আইউবী বললেন- আজ দুশমনকে ভেদ করে প্রাচীরের নিকট পৌঁছে যেতে হবে। তিনি ঘোড়া হাঁকান। তার সবকটি ইউনিট, আরোহী ও পদাতিক বাহিনী তার পেছনে পেছনে রওনা দেয়। বাহ্যত এটি ছিলো এলোপাতাড়ি আক্রমণ। কিন্তু সুলতান আইউবী বাহিনীকে আগেই বিন্যস্ত করে রেখেছেন। খৃষ্টানরা মুসলমানদের এরূপ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে আসতে দেখে তাদের পদাতিক বাহিনী তীর-ধনুক নিয়ে প্রাচীরের ন্যায় দাঁড়িয়ে যায়। তারা তীর বর্ষণ করতে শুরু করে দেয়।
আক্রমণের নেতৃত্ব সুলতান আইউবী স্বয়ং দিচ্ছিলেন। তাঁর মামলুকরা বিদ্যুতের ন্যায় ক্রুসেডারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু ক্রুসেডারদের সৈন্য ছিলো অনেক বেশি। মুসলমানরা এমনভাবে যুদ্ধ করে, যেনো তাদের জীবিত পেছনে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। অশ্বারোহীরা ঘোড়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসছে আর আক্রমণ করছে। এই যুদ্ধ যখন সমাপ্ত হয়, ততোক্ষণে সাঁঝের আধার নেমে এসেছে। ক্রুসেডারদের ক্ষয়ক্ষতি ছিলো বিপুল সংখ্যাতীত। কিন্তু সুলতান আইউবী যে উদ্দেশ্যে আক্রমণটা করেছিলেন, তা সাধিত হয়নি।
এরূপ হামলা এটিই প্রথম ও শেষ আক্রমণ ছিলো না। আক্ৰা দুটি বছর অবরুদ্ধ থাকে। এই সময় সুলতান আইউবী পেছন থেকে এরূপ কয়েকটি আক্ৰমণ করিয়েছেন। প্রতিটি আক্রমণেই তার জানবাজরা বীরত্বের এমন সব দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে, যেমনটি অতীতে তারাও দেখাতে পারেনি। এই সময়ে সুলতান আইউবী মিসর থেকেও সাহায্য পেয়ে যান এবং কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্র তাকে সৈন্য ও সরঞ্জাম প্রেরণ করে। পুরো কাহিনী লিখতে গেলে শেষ হবে না। শুধু জিহাদের স্পৃহা নয়- সে ছিলো উন্মাদনা। সেসব আক্রমণে আক্রার অবরোধ ভাঙা যায়নি বটে; কিন্তু ক্রুসেডারদের হৃদয়ে ভয় ধরে যায় যে, মুসলমানরা এখান থেকে তাদেরকে জীবিত বেরিয়ে যেতে দেবে না। খৃস্টানদের সৈন্য বেশি ছিলো বিধায় তাদের প্রাণহানিও ঘটেছে বিপুল। এই সুবিপুল লাশ আর আহতদের দেখে খৃস্টানদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছিলো। মুসলমানদের অভাবিতপূর্ব এই বীরত্বে স্বয়ং রিচার্ডও প্রভাতি হতে শুরু করেছেন।
এ সময়ে রিচার্ড সুলতান আইউবীর নিকট সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে দূত প্রেরণ করতে থাকেন। দূত আল-আদিলের নিকট যেতো আর আল-আদিল প্রস্তাবটা সুলতানের নিকট পৌঁছিয়ে দিতেন। তার দাবি ছিলো, আমাদের জেরুজালেম আমাদেরকে দিয়ে দাও, আমাদের কুশটা ফিরিয়ে দাও এবং হিত্তীন যুদ্ধের আগে যেসব অঞ্চল আমাদের দখলে ছিলো, সেগুলো আমাদেরকে দিয়ে দাও। সুলতান আইউবী জেরুজালেম নাম শুনে আঁৎকে ওঠতেন। তথাপি তিনি আল-আদিলকে রিচার্ডের সঙ্গে সন্ধি বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখার অনুমতি দিয়ে রেখেছিলেন। প্রায় সকল ঐতিহাসিক লিখেছেন, রিচার্ড ও আল আদিল যখন রিচার্ডের নিকট যেতেন কিংবা রিচার্ড আল-আদিলের নিকট আসতেন, তখন রিচার্ডের বোন জুয়ানাও সঙ্গে থাকতো। এই বন্ধুত্ব সত্ত্বেও আল-আদিল রিচার্ডের শর্ত মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না।
এই সাক্ষাৎ-যোগাযোগের এবং আলাপ-আলোচনার মধ্যেও যুদ্ধ অব্যাহত ছিলো। রক্তক্ষয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিলো এবং আক্রাবাসীদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে ওঠেছিলো। অবরোধকারীদের মধ্যে অন্যান্য খৃস্টান সম্রাটও ছিলেন। তন্মধ্যে ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন উল্লেখযোগ্য। ইংল্যান্ডের ম্রাট রিচার্ড সকলের নেতৃত্ব প্রদান করছিলেন।
***
আমি এতোটুকু সফলতা অর্জন করেছি যে, তিনি আমার ভালোবাসা বরণ করে নিয়েছেন- জুয়ানা ভাই রিচার্ডকে বললেন- কিন্তু সকল মুসলমান আমীর-শাসকদের মাঝে যে দুর্বলতাটি পাওনা যায় বলে আপনি জানিয়েছেন, সেটি তার মধ্যে পাইনি। তিনি আমাকে বিবাহ করতে সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন বটে; কিন্তু তার জন্য নিজের ধর্ম ত্যাগ করার পরিবর্তে আমাকে ইসলাম গ্রহণ করতে বলছেন।
মনে হচ্ছে, এ বিদ্যায় পারদর্শী মেয়েরা যেভাবে যাদু প্রয়োগ করে, তুমি তেমনটি প্রয়োগ করতে সক্ষম হওনি- ভাই রিচার্ড বললেন- আল-আদিল চরিত্রে পরিপন্তু সে আমিও দেখেছি। ইতিমধ্যে আমি তাকে বলে ফেলেছি; সে (তুমি) যদি আপনাকে বিয়ে করতে সম্মত হয়, তাহলে আপনি খৃস্টধর্ম গ্রহণ করে নিন, আর ভাইকে বলুন যেনো তিনি উপকূলীয় অঞ্চলটা আপনাকে দিয়ে দেন, যেখানে আপনার স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে রাজত্ব করবেন। তিনি উত্তর দিয়েছেন, ধর্মই যদি পরিবর্তন করলাম, তাহলে এতো খুন-খারাবির আবশ্যক কী ছিলো? আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি কি আমার বোনকে পছন্দ করেন? তিনি উত্তর দেন, সে আপনার বোনকে জিজ্ঞেস করুন। তাকে আমি ততোটুকু কামনা করি, যতোটুকু সে আমাকে কামনা করে। আমি তাকে বললাম, আপনাদের এই প্রেম-ভালোবাসায় আমার কোনো আপত্তি নেই।… শিকার জালে এসে পড়েছে। এখন ধরে বোতলে ভরার দায়িত্ব তোমার।
আচ্ছা!- জুয়ানার হঠাৎ মনে পড়ে যায় আমার সেবিকা দুটিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। রাতে এখানেই ছিলো। সকাল থেকে উধাও!
আমার মনে হচ্ছে, ওরা উধাও-ই থাকবে- রিচার্ড বললেন- ওরা মুসলমান ছিলো।
ওরা সিসিলির মুসলমান ছিলো- জুয়ানা বললো- আমার বিয়ের সময় থেকে ওরা আমার সঙ্গে ছিলো।
মুসলমান যেখানকারই বাসিন্দা হোক, সকলের চেতনা একরকমই হয়ে থাকে।- রিচার্ড বললেন- সে কারণেই আমরা এ জাতিটাকে বিপজ্জনক মনে করি এবং ঐক্য বিনষ্ট করে তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ওরা এখানে এসে দেখলো, আমরা তাদের জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি, অমনি তাদের কাছে চলে গেলো।
রিচার্ড ঠিকই বলেছিলেন। ততোক্ষণে তারা সুলতান আইউবীর নিকট পৌঁছে গেছে। তারা সুলতান আইউবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে বললো, এমন কিছু কথা আছে, যা সুলতানকেই বলতে হবে। তারা সুলতান আইউবীকে জানায়, আমরা সিসিলিতে জন্মগ্রহণ করেছি এবং সেখানেই লালিত-পালিত হয়েছি। শৈশব থেকেই চাকরানি হয়ে রাজমহলে সময় অতিবাহিত করেছি। সম্রাট রিচার্ডের বোন জুয়ানা রাজার স্ত্রী হওয়ার পর বয়স, রূপ-সৌন্দর্য ও দৈহিক আকার-গঠনের সুবাদে আমাদেরকে তার খাস চাকরানি নিযুক্ত করা হয়। সিসিলিতে মুসলমান ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ। সে জন্য সেখানে ইসলাম জিন্দা ছিলো। আমরাও ধর্মের কথা ভুলিনি। জুয়ানা বিধবা হয়ে যাওয়ার পর সম্রাট রিচার্ড ক্ষমতার মসনদে আসীন হন। এখানে আসবার সময় তিনি বোনকেও সঙ্গে নিয়ে আসেন। এখানে এসে আমরা খৃস্টানদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখে চাকরি থেকে আমাদের মন ওঠে গেছে।
মেয়ে দুটো দৈহিকভাবে মানানসই হওয়ার পাশাপাশি যেমন চালাক, তেমনি সতর্ক। তারা সুলতান আইউবীকে জানালো, জুয়ানা রিচার্ডকে বলছিলো, আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাই আল-আদিলকে ফাঁসিয়ে ফেলেছি। আল-আদিল যদি ধর্ম ত্যাগ করে খৃস্টান হয়ে যান, তাহলে তাদের বিয়ে হয়ে যাবে। তারপর সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করা ও জেরুজালেম দখল করা সহজ হয়ে যাবে। মেয়ে দুটো এই সন্দেহও ব্যক্ত করে যে, জুয়ানা ও আল-আদিল গোপনে কোথাও মিলিত হয়ে থাকেন। তথ্যটা সুলতান আইউবীকে জানানোর জন্যই তারা ওখান থেকে পালিয়ে এসেছে। কাজী বাহউদ্দীন শাদ্দাদ তার রোজনামচায় এই মেয়ে দুটোর নাম উল্লেখ করেননি। শুধু লিখেছেন, সুলতান আইউবী তাদেরকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে দামেশক পাঠিয়ে দেন।
***
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী মেয়ে দুটোর রিপোর্টে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন বটে; কিন্তু তাঁরই সহোদর তাকে ধোকা দিচ্ছে, এ তথ্য তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। প্রতিজন সালারের উপর তার পূর্ণ আস্থা ছিলো। কিন্তু ভাই আল-আদিল ও দুপুত্র আল-আফজাল ও আয-যাহিরের উপস্থিতিতে তিনি বহু পেরেশানী থেকে মুক্ত থাকতেন। খৃস্টানদের উপর যখন পেছন থেকে আক্রমণ হতো, তার নেতৃত্ব হয় তিনি নিজে দিতেন কিংবা এই তিনজন। তাছাড়া খৃস্টান সম্রাট বিশেষত রিচার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলাপ-আলোচনার দায়িত্ব আদিলের উপর ন্যস্ত ছিলো। সুলতান এ বিষয়ে আল-আদিলের সঙ্গে কথা বলা আবশ্যক মনে করলেন। কিন্তু আক্রার যুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছিলো। মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন দিক থেকে সাহায্য আসছিলো। আল আদিলকে কোথাও দেখা যাচ্ছিলো না। তার সম্পর্কে সুলতান আইউবী শুধু এটুকু সংবাদ পাচ্ছিলেন যে, আজ তিনি অমুক স্থানে আক্রমণ করেছেন, আজ অমুক স্থানে। সুলতান তার পুত্রদেরও দেখা পাচ্ছেন না। তিনি এখন স্বাস্থ্য খারাপ হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছেন।
অনবরত পাথর নিক্ষেপের ফলে আক্রান্ত প্রাচীর একস্থান থেকে ভেঙে যায়। খৃস্টানরা সে পথে ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে মুসলমানরা জীবন বাজি রেখে তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিলো, জায়গাটা উভয় পক্ষের লাশে ভরে যাচ্ছে। অবশেষে কবুতর ভেতর থেকে পয়গাম নিয়ে আসে- কাল নাগাদ যদি আমাদের কাছে সাহায্য এসে না পৌঁছায় কিংবা আপনি যদি বাইরে থেকে অবরোধ ভাঙার চেষ্টা না করেন। তাহলে আমরা অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হবো। কারণ, নগরীর শিশুরা ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করছে। মগরী জ্বলছে। অল্প কজন সৈন্য বেঁচে আছে। যারা বেঁচে আছে, তারাও দুবছর যাবত অবিরাম যুদ্ধ করে করে জীবন্ত লাশ হয়ে গেছে।
সুলতান আইউবীর চোখ থেকে অশ্রু বেরিয়ে আসে। তৎক্ষণাৎ সকল বাহিনীকে একত্রিত করে একযোগে তীব্র আক্রমণ চালান। এমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয় যে, ইতিহাসের পাতা কেঁপে উঠতে শুরু করে। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, মানব-মস্তিষ্ক এরূপ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কল্পনাও করতে অক্ষম। মুসলমানরা রাতেও খৃস্টানদেরকে স্থির থাকতে দেয়নি। মধ্যরাতের পর সুলতান আইউবী তাঁবুতে ফিরে এসে এমনভাবে পালংকের উপর পড়ে যান, যেনো তার দেহটা জখমে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। তিনি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আদেশ দেন, সকালেও এরূপ আক্রমণ হবে। কিন্তু ভোরের আলো তাকে যে দৃশ্য দেখালো, তাতে তার মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। আক্রার প্রাচীরের উপর ক্রুসেডারদের পতাকা উড়ছে। খৃস্টান সৈন্যরা স্রোতের ন্যায় নগরীর ভেতরে অনুপ্রবেশ করছে। দিনটি ছিলো জুমাবার। ৫৮৭ হিজরীর ১৭ জমাদিউস সানি মোতাবেক ১২ জুলাই ১১৯২ খৃস্টাব্দ।
আল-মাশতুব ও কারাকুশ শর্তের ভিত্তিতে চুক্তিতে সই করেছিলেন। তথাপি সুলতান আইউবীকে দেখতে হলো, ফিরিঙ্গিরা প্রায় তিন হাজার মুসলমানকে কয়েদি বানিয়ে রশিতে বেঁধে আক্রার বাইরে নিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে সামরিক লোকও আছে, বেসামরিক লোকও আছে। তাদেরকে এক স্থানে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। চারদিক থেকে খৃস্টান বাহিনীর আরোহী ও পদাতিক সৈন্যরা সেই হাত-পা বাঁধা নিরস্ত্র মানুষগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। খৃস্টানরা এতো পৈশাচিকতা ও অমানবিকতা প্রদর্শন করবে, মুসলিম বাহিনীর সে ধারণা ছিলো না। যখন খৃস্টানরা মুসলিম বন্দিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, মুসলিম সৈন্যরা কারো নির্দেশের অপেক্ষা না করে ছুটে গিয়ে খৃস্টানদের উপর পূর্ণ শক্তিতে আক্রমণ করে বসলো। কিন্তু ততোক্ষণে হাত-পাৰ্বধা বন্দিরা শহীদ হয়ে গেছে। উভয় বাহিনীর মধ্যে আবারো তীব্র রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হলো।
***
ইতিমধ্যে রিচার্ডও সুলতান আইউবীর ন্যায় গুরুতর ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তার উপর খৃস্টজগতের অনেক নির্ভরতা ছিলো। লোকটি সিংহ-হৃদয় ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আক্রার অবরোধে যেখানে তিনি সফল হয়েছিলেন, সেখানে তার মনোবলও ভেঙে গিয়েছিলো। মুসলমানরা এতো প্রাণপণ লড়াই করে থাকে তার ধারণা ছিলো না। তার গন্তব্য ছিলো বায়তুল মুকাদ্দাস। আক্রী জয় করার পর রোম উপসাগরের কূল ঘেঁষে রওনা হয়েছিলেন। সম্মুখে আসকালান ও হীফা ইত্যাদি বৃহৎ নগরী ও দুর্গের অবস্থান। সুলতান আইউবী তার মতলব বুঝে ফেলেন। এই নগরী ও দুর্গগুলোকে দখল করে এখানে ক্যাম্প স্থাপন করে বাইতুল মুকাদ্দাসের উপর আক্রমণ করার মতলব এটেছেন।
সুলতান আইউবী বাইতুল মুকাদ্দাসের খাতিরে যতো বড় ও যতো বেশি প্রয়োজন কুরবানী দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। তিনি আদেশ প্রদান করেন আসকালানকে ধ্বংস করে দাও। দুর্গ ও নগরীটা ধ্বংস্তূপে পরিণত করে দাও। শুনে সালার ও উপদেষ্টাদের মাথায় যেনো বাজ পড়ে। তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এতো বিশাল নগরী! এতো শক্ত দুর্গ! সুলতান আইউবী গর্জে ওঠে বললেন নগরী আবার গড়ে ওঠবে। মানুষ জন্ম নিতে থাকবে। কিন্তু বাইতুল মুকাদ্দাসকে রক্ষা করার জন্য বোধ হয় সালাহুদ্দীন আইউবী আর জন্মাবে না। নিজেদের সকল নগরী এবং শিশুদেরসহ সব মানুষ মসজিদে আকসার জন্য, কুরবান করে দাও।
সুলতান আইউবী বাস্তবিকই আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেছিলেন। তিনি বাস্তবতাকে লুকাবার চেষ্টা করেননি। গেরিলা ইউনিটগুলোকে খৃস্টান বাহিনীর পেছনে লেলিয়ে দেন। তারা লুকিয়ে লুকিয়ে অগ্রসরমান রিচার্ড বাহিনীর পেছন অংশের উপর আক্রমণ চালাতে থাকে। ফলে রিচার্ডের অগ্রযাত্রা মন্থর হয়ে যায়। তাদের রসদ অনিরাপদ হয়ে পড়ে। রিচার্ড আসকালান যাচ্ছিলেন। তিনি যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছেন, ততোক্ষণে নগরী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে গেছে। সেখানে যে মুসলিম ফৌজ ছিলো, তাদেরকে বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রতিরক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। রিচার্ডের পথে যে কটি দুর্গ জয় করার কথা ছিলো, সবগুলো আগেই ধুলিসাৎ করে দেয়া হয়েছে। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, মুসলমানরা এমন ত্যাগও স্বীকার করতে পারে ভেবে রিচার্ডের মাথা খারাপ হয়ে যেতে শুরু করেছে। তিনি বুঝে ফেলেছেন, বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করা সহজ হবে না।
ফ্রান্সের সম্রাট রিচার্ডকে ত্যাগ করে চলে গেছেন। এ রিচার্ডের জন্য বিরাট এক ধাক্কা। তিনি আক্ৰা জয় করেছেন ঠিক; কিন্তু এই সফলতার মধ্যেও মুসলমানরা তার কোমর ভেঙে দিয়েছে। আক্রা হাত থেকে ছুটে যাওয়া সুলতান আইউবীর জন্য আক্ষেপের বিষয় ছিলো। কিন্তু তাঁর কৌশল সফল হয়েছে যে, তিনি ক্রুসেডারদের সামরিক শক্তির ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছেন। এবার তিনি পুনরায় নিজের বিশেষ পদ্ধতির যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন। সে হচ্ছে, গেরিলা ও কমান্ডো আক্রমণের ধারা। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, মুসলমান গেরিলারা রাতের অন্ধকারে ঝড়ের ন্যায় আসতো এবং খৃস্টান বাহিনীর পেছন অংশের উপর কমান্ডো আক্রমণ চালিয়ে বিপুল ক্ষতিসাধন করে অদৃশ্য হয়ে যেতো। ফলে খৃস্টানদের এক মাসের পথ অতিক্রম করতে তিন মাস সময় লেগে যেতো। ইতিমধ্যে সুলতান আইউবী ক্রুসেডারদের অগ্রযাত্রার গতি মন্থর করে দিয়ে নিজে বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রতিরক্ষা শক্ত করে ফেলেন।
***
কিছু করো জুয়ানা! ক্রুশের খাতিরে কিছু একটা করো- রিচার্ড তার বোনকে বললেন- আল-আদিলকে হাত করে নাও। যুদ্ধ করে আমরা বাইতুল মুকাদ্দাস নিতে পারবো না।
তিনি আমাকে চাচ্ছেন- জুয়ানা উত্তর দেয়- রওনার সময়ও তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিলো। আমি বলতে পারি, তিনি আমাকে মনে-প্রাণে কামনা করছেন। কিন্তু বলছেন, আমি মুসলমান হয়ে যাই। আমার কোন শর্তই মানতে রাজি হচ্ছেন না।
ওদিকে সুলতান আইউবী ভাই আল-আদিল, পুত্রদ্বয় এবং সালারদের সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁর মুখে এখন দুটি মাত্র বুলি- ইসলাম, বাইতুল মুকাদ্দাস। তিনি সকলকে বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রতিরক্ষার দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। সভা শেষে আল-আদিল সুলতান আইউবীর সঙ্গে একাকীত্বে মিলিত হন এবং বললেন- রিচার্ড আমাকে তার বোনকে বিয়ে করতে বলছেন। শর্ত দিচ্ছেন, ইসলাম ত্যাগ করে আমাকে খৃস্টান হতে হবে।
তোমার ইসলামের সঙ্গে বেশি ভালোবাসা, নাকি রিচার্ডের বোনের সঙ্গে?
উভয়ের সঙ্গে।
তাহলে তাকে তোমার ধর্মে দিক্ষিত করো এবং বিয়ে করে নাও- সুলতান আইউবী বললেন- আমি অনুমতি দিচ্ছি।
আমি আপনার নিকট বিয়ের অনুমতি নিতে আসিনি- আল-আদিল বললেন- আমি আপনাকে বলতে এসেছি, রিচার্ডের ন্যায় একজন সাহসী এবং যুদ্ধবাজ সম্রাটও এতো নীচে নামতে পারলেন! আমি স্বীকার করছি, তার বোনটাকে আমার ভালো লাগছে। কিন্তু আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমি আপন ধর্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবো না।
আর সেও নিজ ধর্মের সঙ্গে গাদ্দারী করবে না।
জাহান্নামে যাক- আল-আদিল বললেন- এই অস্ত্র দ্বারা রিচার্ড বাইতুল মুকাদ্দাস নিতে পারবে না।
সুলতান আইউবীর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ রিচার্ডের এই হীন আচরণটাকে লুকাবার চেষ্টা করেছেন। তারা লিখেছেন, রিচার্ড খৃস্টধর্ম গ্রহণের শর্তে আল-আদিলকে তার বোনকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু রিচার্ডের বোন আল-আদিলকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো।
রিচার্ড বাইতুল মুকাদ্দাসের সন্নিকটে গিয়ে ছাউনি স্থাপন করেন। এখানে আক্রা অপেক্ষা বেশি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হওয়ার আশংকা ছিলো। তিনি পূর্বে যেসব শর্ত আরোপ করে সন্ধির প্রস্তাব করেছিলেন, এখানে এসেও সুলতান আইউবীকে সেসব শর্ত আরোপ করতে শুরু করেন। বারংবার এক কথা কারুরই ভালো লাগে না। একবার সুলতান আইউবী বিরক্ত হয়ে রিচার্ডের দূতকে অপমান করে তাঁবু থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
এ সময়ে সুলতান আইউবী সংবাদ পান, রিচার্ডের অসুখ হয়েছে। এমন, গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন যে, বাঁচবার আশা নেই। সুলতান রাতে তাঁবু থেকে বের হয়ে রিচার্ডের তাবু অভিমুখে রওনা হন। কোথায় যাচ্ছেন আল আদিল ছাড়া কাউকে বলেননি। আল-আদিল বললেন, অমুক স্থানে রিচার্ডের বোন আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকার কথা। আপনি তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন।
জুয়ানা যথাস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। ঘোড়র পায়ের শব্দ শুনে দৌড়ে এসে বলে ওঠে- তুমি এসে পড়েছে আল-আদিল? সুলতান আইউবী ঘোড়া থেকে নেমে জুয়ানাকে ঘোড়ায় বসিয়ে চুপি চুপি রিচার্ডের তাবুর দিকে রওনা দেন। জুয়ানা সুলতানকে কিছু বলছিলো। সুলতান আইউবী বললেন- তোমার ভাষা আমার ভাই বোঝে- আমি বুঝি না। জুয়ানা কী বললো সুলতান বুঝতে পারেননি।
সুলতান আইউবী রিচার্ডের তাবুতে প্রবেশ করেন। রিচার্ড সত্যিই গুরুতর অসুস্থ। সুলতান আইউবীর সঙ্গে কথা বলার জন্য তিনি দোভাষী ডাকেন। সুলতান আইউবী প্রথম কথাটা বললেন- বোনকে সামলাও। আমার ভাই আপন ধর্ম ত্যাগ করবে না। বলো তোমার কষ্টটা কী? আমি তোমাকে দেখতে এসেছি। এমন ভেবো না, তোমাকে মুমূর্ষ দেখে গিয়ে আমি আক্রমণ করবো। সুস্থ হও, যুদ্ধ পরে করবো।
রিচার্ড বিস্ময়াভিভূত হয়ে ওঠে বসেন এবং সম্ভবত অলক্ষ্যেই বলে ওঠেন তুমি মহান সালাহুদ্দীন আইউবী! তুমিই সত্যিকার যোদ্ধা!
রিচার্ড সুলতান আইউবীকে কষ্টের কথা জানান। সুলতান বললেন আমাদের অঞ্চলে রোগাক্রান্ত মানুষকে আমাদের ডাক্তারই সুস্থ করে তুলতে পারে। ইংল্যান্ডের বাহিনী যেমন এখানে এসে অথর্ব হয়ে যায়, তেমনি তোমাদের ডাক্তারও এখানে এসে আনাড়ি হয়ে যায়। আমি ডাক্তার পাঠাবো।
সালাহুদ্দীন। আমরা আর কতোকাল একে অপরের রক্ত ঝরাতে থাকবো? রিচার্ড বললেন- আসো, সন্ধি ও বন্ধুত্ব স্থাপন করে ফেলি।
কিন্তু তুমি বন্ধুত্বের যে মূল্য দাবি করছে, আমি তা পরিশোধ করতে পারবো না- সুলতান আইউবী বললেন- তোমরা খুন-খারাবিকে ভয় করছে। আমার জাতি বাইতুল মুকাদ্দাসের খাতিরে নিজেদের প্রতি ফোঁটা রক্ত কুরবান করে দেবে।
ফিরে এসে সুলতান আইউবী তার প্রাইভেট ডাক্তারকে রিচার্ডের চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করেন। তাঁর সেরে ওঠতে বহুদিন কেটে গেছে। সুলতান আইউবী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু আক্রমণের পরিবর্তে রিচার্ডের পক্ষ থেকে সন্ধির নতুন নতুন শর্ত আসে। রিচার্ড বাইতুল মুকাদ্দাস থেক হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। শুধু এতোটুকু সুবিধা প্রার্থনা করেন যে, খৃস্টান পর্যটকদের বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হক এবং উপকূলীয় কিছু অঞ্চল খৃস্টানদের দিয়ে দেয়া হোক। সুলতান আইউবী রিচার্ডের এই দুটি দাবি মেনে নেন। তার বাহিনীও যুদ্ধে অক্ষম হয়ে পড়েছিলো। নিজেও একদিকে যেমন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অপরদিকে অসুস্থ। তাই এ মুহূর্তে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করলেন।
রিচার্ড মুসলমানদের চেতনা ও নির্ভীকতায় ভয় পেয়ে গেছেন। তার স্বাস্থ্যও হাল ছেড়ে দিয়েছে। তাছাড়া নিজ দেশে বিরুদ্ধবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠছিলো। তাই তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে যাওয়া তার আবশ্যক হয়ে পড়েছিলো।
৫৮৮ হিজরীর ২২ শাবন মোতাবেক ১১৯১ খৃস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ১১৯২ সালের ৯ অক্টোবর রিচার্ড বাহিনীসহ ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। চুক্তির মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছিলো ৩ বছর। রিচার্ড রওনার আগে সুলতান আইউবীকে বার্তা পাঠান, চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণের পর আমি জেরুজালেম জয় করতে আসবে। কিন্তু তারপর কোন খৃস্টান আর বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করতে পারেনি। অবশেষে ১৯৬৭ সালে আরবদের অনৈক্য এবং তাদের সেসব দুর্বলতা, যেগুলো সুলতান আইউবীর আমলে খৃস্টানরা মুসলিম আমীরদের মাঝে জন্ম দিয়েছিলো বাইতুল মুকাদ্দাসকে ইহুদীদের হাতে তুলে দেয়।
রিচার্ডের রওনার পর সুলতান আইউবী ঘোষণা দেন, বাহিনীর যেসব সৈন্য হজ্বে যেতে চাও নাম লেখাও। তাদেরকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় হজে পাঠানো হবে। তালিকা প্রস্তুত হয়ে যায়। আগ্রহী সকলকে হজ্বের উদ্দেশ্যে রওনা করা হয়। স্বয়ং সুলতান আইউবীর নিজের দীর্ঘদিনের আকাঙ্খ ছিলো হজ্ব করবেন। কিন্তু জিহাদ তাকে সুযোগ দেয়নি। আর যখন অবসর পেলেন, তখন তার নিকট হজ্বে যাওয়ার অর্থ ছিলো না। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ নিতে বলা হলো। তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন, এই অর্থ আমার নয়। সুলতান আইউবী নিজেকে হজ্ব থেকে বঞ্চিত করলেন। রাজকোষ থেকে কোন অর্থ নিলেন না। মিসরী কাহিনীকার মুহাম্মদ ফরিদ আৰু হাদীদ লিখেছেন, মৃত্যুর সময় সুলতান আইউবীর সর্বমোট সম্পদ ৪৭ দেরহাম রুপা এবং এক টুকরো সোনা ছিলো। নিজস্ব কোনো বাসগৃহ ছিলো না।
***:
সুলতান আইউবী ১১৯২ সালের ৪ নবেম্বর বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে দামেশক গিয়ে পৌঁছেন। তার চার মাস পর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ এই বীর মুজাহিদ মহাকালের মহানায়ক ইহলোক ত্যাগ করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। দামেশক পৌঁছার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর স্বচক্ষে দেখা পরিস্থিতি কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ এভাবে বর্ণনা করেছেন–
… তার শিশু সন্তানরা দামেশকে ছিলো। একটানা পরিশ্রম ও সর্বশেষ অসুস্থতার পর বিশ্রামের জন্য তিনি এ নগরীকেই পছন্দ করেন। সন্তানরা তাকে দেখে বেশ আনন্দিত হয়েছিলো। দামেক ও আশপাশের মানুষ তাদের বিজয়ী সুলতানকে দেখার জন্য দলে দলে আসতে শুরু করে। স্বজাতির এই ভক্তি ও আন্তরিকতা দেখে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী পরদিনই জনসভার আয়োজন করেন, যেখানে সুলতানের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করার এবং কারো কোনো অভিযোগ কিংবা দাবি-দাওয়া থাকলে পেশ করার অনুমতি প্রদান করেন। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু, ধনী-গরীব, শাসক-জনতা সকলে সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য এসে ভিড় জমায়। কবিরা সুলতানের শানে কবিতা আবৃত্তি করেন।
বিরামহীন যুদ্ধ এবং রাষ্ট্রের নানাবিধ ব্যস্ততা সুলতান আইউবীকে না দিনে কখনো বিশ্রাম নিতে দিয়েছে, না রাতে একটু শান্তির ঘুম ঘুমাতে দিয়েছে। তিনি শারীরিকভাবেও ভেঙে পড়েছিলেন এবং মানসিকভাবেও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই ক্লান্ত শরীর-মনকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য তিনি দামেশকে হরিণ শিকার করাকে ব্যস্ততা বানিয়ে নেন। তিনি ভাই ও সন্তানদের সঙ্গে শিকার খেলায় মেতে ওঠেন। তার ইচ্ছা ছিলো, দিন কয়েক বিশ্রাম করে মিসর চলে যাবেন। কিন্তু দামেশকের রাষ্ট্রীয় কাজ তাকে আটকে রাখে।…
আমি সেসময় উজিরের দায়িত্ব নিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাসে অবস্থান করছিলাম। একদিন দামেশক থেকে সুলতান আইউবীর একখানা পত্র এসে পৌঁছে। তিনি আমাকে দামেশক যেতে বলেছেন। আমি তৎক্ষণাৎ চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। কিন্তু লাগাতার মুষলধারী বৃষ্টির কারণে পথঘাট চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছিলো। ঊনিশ দিন পর্যন্ত আমি বেরই হতে পারলাম না। অবশেষে ২৩ মহররম শুক্রবার রওনা হয়ে ১২ সফর মঙ্গলবার দামেশক গিয়ে পৌঁছি। সে সময় বৈঠকখানায় আমীর ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ সুলতানের অপেক্ষা করছিলেন। সুলতানকে আমার আগমনের সংবাদ জানালো হলো। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে তার খাস কামরায় যেতে বললেন। আমি তার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে দুবাহু প্রসারিত করে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। তাঁর চেহারায় এমন প্রশান্তি ও স্থিরতা আমি অতীতে কখনো দেখিনি। তার দুচোখ অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আসে।
পরদিন তিনি আমাকে ডেকে পাঠান। আমি তাঁর খাস কামরায় গিয়ে প্রবেশ করলে জিজ্ঞেস করেন, বৈঠকখানায় কারা আছে? আমি বললাম, আপনার পুত্র আল-মালিকুল আফজাল, কয়েকজন আমীর এবং আরো অনেক লোক। তারা আপনার সাক্ষাতের অপেক্ষায় বসে আছেন। তিনি জামালুদ্দীন ইকবালকে বললেন, তাদেরকে আমার পক্ষ থেকে ওজরখাহি করে বলে দাও, আজ আমি কাউকে সাক্ষাৎ দিতে পারবো না। তিনি আমার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা বলেন। আমি চলে যাই।…।
পরদিন তিনি অতি প্রত্যূষে আমাকে ডেকে পাঠান। আমি যখন গেলাম, তখন তিনি বাগানে সন্তানদের নিয়ে খেলা করছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, বৈঠকখানায় কোনো সাক্ষাৎ প্রার্থী আছে কি? তাকে জানানো হলো, ফিরিঙ্গিদের দূত এসে বসে আছে। সুলতান বললেন, তাদেরকে এখানেই পাঠিয়ে দাও। সন্তানরা সেখান থেকে চলে যায়। সর্বকনিষ্ঠ সন্তান আমীর আবু বকর সুলতান যাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন- সেখানে থেকে যায়। ফিরিঙ্গিরা এলে শিশুটি লোকগুলোর দাড়িবিহীন চেহারা এবং তাদের পোশাক দেখে ভয়ে কাঁদতে শুরু করে। শিশুটি এর আগে কখনো দাড়িবিহীন পুরুষ দেখেনি। সুলতান আইউবী বললেন, আমার পুত্র আপনাদের দাড়িবিহীন চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেছে। কিন্তু এই সমস্যার মোকাবেলায় সুলতান শিশুটিকে ঘরে পাঠিয়ে দেয়ার পরিবর্তে দূতদের বললেন, আজ আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারবো না। তিনি তাদেরকে আলাপ-আলোচনা ব্যতিরেকেই বিদায় করে দেন।…
তাদের চলে যাওয়ার পর তিনি বললেন, খাবার যা আছে নিয়ে আসো। তাঁর সম্মুখে হাল্কা কিছু খাবার এনে হাজির করা হলো। তাতে ক্ষিরও ছিলো। তিনি সামান্যই খেলেন। আমি অনুভব করলাম, যেনো তার ক্ষুধা মরে গেছে। তার সঙ্গে আমিও খেলাম। তিনি বললেন, মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ-কথাবার্তা কম করছি। ক্ষুধামান্দ্য এবং দুর্বলতা অনুভব করছি।…
আহারের পর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন- হাজীরা ফিরে এসেছে কি? আমি বললাম, রাস্তায় অনেক কাদা। চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। আশা করি, কাল নাগাদ এসে পৌঁছবে। সুলতান বললেন, আমরা তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে যাবো। বলেই তিনি একজন কর্মকর্তাকে ডেকে বললেন, হাজ্বীরা আসছে। রাস্তায় কাদা ও পানি আছে। এখনই লোক পাঠাও, পথের কাদা-পানি পরিষ্কার করাও। আমি তার থেকে অনুমতি নিয়ে চলে আসি। আমি দেখলাম, সুলতানের উৎসাহ-উদ্দীপনা ও কর্মতৎপরতায় বেশ ভাটা পড়ে গেছে।…
পরদিন ঘোড়ায় আরোহণ করে তিনি হাজ্বীদের অভ্যর্থনা জানাতে বেরিয়ে পড়েন। আমিও ঘোড়ায় চড়ে তার পিছু নেই। পুত্র আল-মালিকুল আফজাল সঙ্গ নেয়। মানুষের মাঝে দাবানলের ন্যায় সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে, সুলতান বাইরে এসেছেন। জনতা কাজ-কর্ম ত্যাগ করে ছুটে আসে। তারা তাদের বিজয়ী সুলতানকে কাছে থেকে দেখার এবং তাঁর সঙ্গে হাত মেলাবার জন্য উগ্রীব হয়ে ওঠে। সুলতান তার এই পাগলপারা ভক্তদের মাঝে হারিয়ে যান। পুত্র আল-মালিকুল আফজাল সন্ত্রস্ত কণ্ঠে আমাকে বললো, সুলতান তো বর্ম পরিধান করে বের হননি! আমার ভয় লাগছে। দুর্ঘটনা ঘটে যেতে কততক্ষণ! সে সময় সুলতানের সঙ্গে দেহরক্ষী ছিলো না। আমি ভিড় ঠেলে সুলতানের নিকট গিয়ে বললাম, হযরত! আপনি বিশেষ পোশাক পরে বের হননি। শুনে তিনি এমনভাবে চমকে ওঠেন, যেনো তাঁকে হঠাৎ ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। তিনি বললেন, পোশাকটা এখানেই নিয়ে আসো। কিন্তু পোশাক এনে দেয়ার মতো সেখানে কেউ ছিলো না। আমার বেশ ভয় লাগছিলো।…
আমার মনে হতে লাগলো, যেনো কোনো অঘটন ঘটে যাবে। আমি তাকে বললাম, আমি এখানকার পথঘাট চিনি না। অন্য কোনো রাস্তা আছে কি, যেখানে লোকজন কম হবে এবং আপনি ফিরে যেতে পারবেন? তিনি বললেন, একটি রাস্তা আছে। তিনি ঘোড়ার মুখ সেদিকে ঘুরিয়ে দেন। জনতার ভিড় ছিলো গণনাতীত। সুলতান আইউবী ঘোড়াটা বাগ-বাগিচার মধ্যকার এক রাস্তায় তুলে দেন। আমি ও আল-মালিকুল আফজাল তাঁর সঙ্গে ছিলাম। আমি তাঁর জীবনেরও আশংকা অনুভব করছিলাম এবং স্বাস্থ্যেরও। আমরা আল মাইবানার কূপ হয়ে দুর্গে এসে প্রবেশ করি।…
শুক্রবার সন্ধ্যায় সুলতান আইউবী অস্বাভাবিক দুর্বলতা অনুভব করেন। মধ্যরাতের সামান্য আগে তাঁর গায়ে জ্বর আসে- চোরা জ্বর। শরীরের ভেতরে বেশি ছিলো, বাইরে কম অনুভব হচ্ছিলো। সকাল নাগাদ তিনি বেশ কাহিল হয়ে পড়েন। কিন্তু গায়ে হাত দিলে তেমন গরম অনুভব হচ্ছিলো না। আমি তাকে দেখতে গেলাম। পুত্র আল-মালিকুল আফজাল শিয়রে বসা ছিলো। সুলতান বললেন, রাত অনেক কষ্টে কাটিয়েছি। তিনি এদিক-ওদিকের কথা শুরু করে দেন। আমরা গল্প-গুজবে তাকে সঙ্গ দেই। তাতে তার মন-মেজাজে প্রফুল্লতা ফিরে আসে। দুপুর নাগাদ বেশ সুস্থ হয়ে ওঠেন। আমরা বিদায় নিতে উদ্যত হলে তিনি বললেন, বসুন, খানা খেয়ে যাবেন। আমার সঙ্গে কাজী আল-ফজলও ছিলেন। তিনি নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া অন্য কারো কাছে আহারে অভ্যস্ত ছিলেন না। তাই ওজরখাহি করে চলে যান। আমি খাওয়ার রুমে চলে যাই। সুলতানের সঙ্গ ছেড়ে উঠতে মন সরছিলো না। অন্তরটা তার নিকট রেখেই খাওয়ার রুমে চলে যাই। দস্তরখান বিছানো হয়েছে। অনেক লোক বসে আছে। আল-মালিকুল আফজাল পিতার জায়গায় বসা। আফজাল সুলতান আইউবীর পুত্র বটে, কিন্তু সুলতানের স্থানে তাকে উপবিষ্ট দেখে বেশ কষ্ট লাগলো। অন্য যারা বসা ছিলেন, তাদেরও প্রতিক্রিয়া আমারই ন্যায় ছিলো। অনেকের চোখ বেয়ে অশ্রু বেরিয়ে আসে।…
সেদিনের পর থেকে সুলতান আইউবীর স্বাস্থ্য খারাপই হতে থাকে। আমি ও কাজী আল-ফজল প্রত্যহ কয়েকবার তাকে দেখতে যেতাম। একটু সুস্থতাবোধ করলেই আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। অন্য সময় চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকতেন। আমরা তাঁর প্রতি তাকিয়ে থাকতাম। তাঁর জীবনের জন্য সবচে বড় আশংকাটা ছিলো, তার ব্যক্তিগত ডাক্তার অনুপস্থিত ছিলেন। চারজন ডাক্তার মিলে তার চিকিৎসা করছিলেন। কিন্তু রোগ দিন দিন বেড়েই চলছিলো।…
অসুখের চতুর্থ দিন সুলতানের অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যায়। কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ জোড়া বেকার হয়ে যায়। দেহের ভেতরে রস শুকিয়ে যেতে শুরু করে। সুলতান আইউবী দুর্বলতার শেষ পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হন। ষষ্ঠ দিন আমরা তাকে ধরে তুলে বসাই। তাঁকে একটি ওষুধ সেবন করানো হলো, যার পর গরম পানি পান করার প্রয়োজন ছিলো। পানি আনা হলো। পানিটা হাল্কা গরম হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু গ্লাসটা মুখের সঙ্গে লাগিয়ে সুলতান বললেন, পানি অনেক গরম। তিনি পানি পান করলেন না। পানি ঠাণ্ডা করে আনা হলো। সুলতান বললেন, এবার একেবারে ঠাণ্ডা। সুলতান সামান্যতম বিরক্তি প্রকাশ করলেন না। শুধু হতাশা প্রকাশার্থে বললেন- ইয়া আল্লাহ! কেউ কি নেই, যে আমাকে হাল্কা গরম পানি এনে দিতে পারবে?…
আমার ও আল-ফজলের চোখে অশ্রু নেমে আসে। আমরা অন্য এক কক্ষে চলে আসি। কাজী আল-ফজল বললেন, জাতি কতো মহান এক ব্যক্তিত্ব থেকে বঞ্চিত হতে চলেছে। তার স্থলে অন্য কেউ হলে পানির গ্লাসটা মাথায় ছুঁড়ে মারতেন।…
সপ্তম ও অষ্টম দিন সুলতান আইউবীর অবস্থা এতো খারাপ হয়ে যায় যে, তাঁর জ্ঞান হারিয়ে যেতে শুরু করে। নবম দিন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পানিও পান করতে পারলেন না। নগরীতে খবর ছড়িয়ে পড়ে, সুলতান আইউবীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়েছে। সমগ্র নগরীতে মৃত্যুর বেদনা ছেয়ে যায়। সব জায়গায় এবং সকলের মুখে তার সুস্থতার জন্য দুআ চলছে। ব্যবসায়ী ও সওদাগররা এমন ভয় পেয়ে যায় যে, তারা বাজার থেকে পণ্য তুলে নিতে শুরু করে। প্রতিজন মানুষ কিরূপ হতাশ ও অস্থির হয়ে ওঠেছিলো, তা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো ছিলো না।…
আমি ও আল-ফজল রাতের প্রথম প্রহর তার কাছে থাকতাম এবং দেখাশোনা করতাম। তিনি কথা বলতে পারতেন না। অবশিষ্ট রাত আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ভেতর থেকে কেউ আসলে জিজ্ঞেস করতাম, সুলতানের অবস্থা কেমন। প্রত্যূষে যখন সেখান থেকে বেরিয়ে আসতাম, তখন বাইরে জনতার ভিড়। দণ্ডায়মান দেখতে পেতাম। তারা আমাদের নিকট সুলতানের অবস্থা জিজ্ঞেস করার সাহস পেতো না। আমাদের চেহারা দেখেই বুঝে নিতো, সুলতানের অবস্থা ভালো নয়। জনতা চুপচাপ আমাদের প্রতি তাকাতো আর আমরাও তাদের প্রতি এক নজর তাকিয়ে মাথানত করে বেরিয়ে যেতাম।….
দশম দিন ডাক্তারগণ তাকে নাড়ি পরিষ্কার করার ঔষধ সেবন করান। তাতে কিছুটা চৈতন্য ফিরে আসে। তারপর যখন জানতে পারলাম, সুলতান যবের পানি পান করেছেন, তখন আমরা সকলে আনন্দ অনুভব করলাম। সে রাতে তাঁর নিকট যাওয়ার জন্য কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে থাকি। জামালুদ্দীন ইকবালের নিকট সুলতানের অবস্থা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি ভেতরে গিয়ে তুরান শাহকে জিজ্ঞেস করে এসে আমাদেরকে জানালেন, সুলতানের উভয় ফুসফুসে বাতাস চলাচল করতে শুরু করেছে। আমরা মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। জামালুদ্দীনকে বললাম, আপনি নিজে গিয়ে দেখে আসুন অবশিষ্ট শরীরে ঘামের লক্ষণ আছে কিনা। তিনি ভেতরে গিয়ে দেখে ফিরে এসে জানালেন, অনেক ঘাম আসছে। এটি শুভ সংবাদ ছিলো। আমরা নিশ্চিন্ত মনে চলে আসি।…।
পরদিন মঙ্গলবার। সফরের ২৬ তারিখ। সুলতান আইউবীর অসুস্থতার একাদশ দিবস। আমরা তাঁকে দেখতে গেলাম। ভেতরে ঢুকতে পারলাম না। আমাদেরকে জানানো হলো, ঘাম এতো বেশি ঝরছে যে, বিছানা বেয়ে মেঝেতে গিয়ে পড়ছে। সংবাদটা ভালো ছিলো না। শরীরের রস-আদ্রতা দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলো। ডাক্তারগণ বিস্ময়ের সঙ্গে জানালেন, শরীর ভেতর থেকে শুকিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সুলতানের দেহে শক্তি বহাল রয়েছে।…
সুলতান আইউবী পুত্র আল-মালিকুল আফজাল দেখলেন, সুলতানের সেরে ওঠার কোনো আশা করা যাচ্ছে না। তিনি তৎক্ষণাৎ আমীর-উজিরদের থেকে আনুগত্যের শপথ নেয়ার ব্যবস্থা করলেন। তিনি সকল বিচারপতিকে রেজওয়ান মহলে সমবেত করে বললেন, আপনারা কাগজ প্রস্তুত করে দিন, যাতে সুলতান আইউবী যতোদিন বেঁচে থাকবেন তাঁর আনুগত্যের হলফনামা থাকবে এবং তাঁর ওফাতের পর আল-মালিকুল আফজাল। আল-আফজাল ওজরখাহি করে বললেন, এ হলফনামা কখনো প্রস্তুত করাতাম না। কিন্তু সুলতানের অবস্থা বিপজ্জনক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে বিধায় কাজটা না করে পারলাম না।..
হলফনামা প্রস্তুত হয়ে গেছে। পরদিন হলফ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট আমীর উজিরদের তলব করা হলো। সর্বপ্রথম দামেশকের গবর্নর সাদুদ্দীন মাসউদ শপথ করেন। তারপর সাহয়ুনের গবর্নর নাসরুদ্দীন আসলেন। তিনি এই শর্তে হলফ করেন যে, তিনি যে দুর্গের গবর্নর, সুলতান আইউবীর মৃত্যুর পর সেটি তার ব্যক্তি মালিকানা, বলে গণ্য হবে। সকল আমীর-উজির ও গবর্নর আনুগত্যের শপথ করলেন। দু-তিনজন হলফ করার আগে শর্ত আদায় করে নেন। হলফনামার ভাষ্য ছিলো নিম্নরূপ–
এই মুহূর্ত থেকে বৃহত্তর ঐক্যের খাতিরে আমি আল-মালিকুন নার (সালাহুদ্দীন আইউবী)-এর অনুগত থাকবো, যতোদিন তিনি জীবিত থাকেন। তাঁর শাসন ক্ষমতাকে অটুট রাখার লক্ষ্যে অক্লান্ত ও অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাবো। তার খাতিরে নিজের জীবন, সম্পদ, তরবারী, সৈন্য এবং প্রজাদের ওয়াফ করে দেবো। আমি তাঁর প্রত্যেকটি আদেশ-নিষেধ মান্য করবো এবং তাঁর প্রতিটি আকাঙ্খা পূর্ণ করবো। আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে ঘোষণা করছি, সুলতান আইউবীর পর এই আনুগত্য তাঁর পুত্র আল-মালিকুল আফজালের জন্য ওয়াফ করে দেবো এবং তারপরে আল-মালিকুল আফজালের পুত্রদের জন্য। আমি আল্লাহকে হাজির-নাজির জ্ঞান করে প্রতিটি আদেশ-নিষেধ পালন করবে। তার জন্য নিজের জান-মাল, তরবারী ও সৈন্যদের ওয়াকফ করে রাখবো। এই আনুগত্যের শপথে আমি আল্লাহকে সাক্ষী করছি।…
হরফনামার অপর অংশ ছিলো–
আমি যদি আমার এই হলফের বিরুদ্ধাচরণ করি, তাহলে এই শপথ ভঙ্গের দায়ে আমার স্ত্রী-স্ত্রীগণ তালাক হয়ে যাবে, আমি সকল ব্যক্তিগত ও সরকারি চাকরদের থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে এবং আমি খালি পায়ে পব্রজে হজ্ব করতে বাধ্য থাকবো।….
৫৮৯ হিজরীর ২৬ সফর মোতাবেক ১১৯৩ খৃস্টাব্দের ৩ মার্চ মঙ্গলবার সন্ধ্যাবেলা এবং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর অসুখের একাদশ দিবস। তাঁর শরীরের শক্তি-সামর্থ সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে গেছে। আর বেঁচে থাকার আশা নেই। রাতে এমন এক সময়ে আমার ও কাজী আল-ফজল ইবনে যকির ডাক পড়ে, যে সময়ে পূর্বে কখনো ডাকা হয়নি। ইবনে যকির পুরো নাম আবুল মাআলী মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন। হযরত ওসমান (রা.)-এর বংশের লোক। আইন ও বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তাকে বেশ শ্রদ্ধা করতেন। বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করার পর সুলতান আইউবী মসজিদ আকসায় প্রথম জুমার খুতবা দেয়ার জন্য তাকেই মনোনীত করেছিলেন। পরে তাঁকে দামেশকের বিচারপতি নিযুক্ত করা হয়েছিলো।…
আমরা গেলে আল-মালিকুল আফজাল বললেন, আপনারা তিনজন বাকি রাত সুলতানের সঙ্গে থাকুন। তিনি শোকাহত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কাজী আল-ফজল আপত্তি তুলে বললেন, রাতভর মানুষ বাইরে দাঁড়িয়ে সুলতানের স্বাস্থ্যের সংবাদ শোনার অপেক্ষা করে। আমরা যদি সারারাত ভেতরে থাকি, তাহলে তারা অন্য কিছু ভেবে বসবে এবং নগরীতে ভুল সংবাদ ছড়িয়ে পড়বে। আল-আফজাল যুক্তিটা মেনে নেন। তিনি বললেন, ঠিক আছে। আপনারা চলে যান। তিনি আমাদের পরিবর্তে ইমাম আবু জাফরকে ডেকে পাঠান। ইমাম আসলে আল-ফজল বললেন, আপনি সুলতানের কাছে থাকুন। আল্লাহ না করুন যদি রাতে মৃত্যু যন্ত্রণা শুরু হয়, তাহলে তার শিয়রে বসে কুরআন তিলাওয়াত করুন। আমরা সেখান থেকে ফিরে আসি।…
পরে ইমাম আবু জাফর সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর জীবনের শেষ রাতের যে বৃত্তান্ত শুনিয়েছেন, আমি তা লিপিবদ্ধ করছি। তিনি বলেছেন, আমি সুলতান আইউবীর শিয়রে কুরআন তিলাওয়াত করছিলাম। সে সময় সুলতান কখনো অচেতন হয়ে পড়ছিলেন, কখনো জ্ঞান ফিরে পাচ্ছিলেন। আমি বাইশতম পারার সূরা আল-হজ্ব তিলাওয়াত করছিলাম। যখন পড়লাম আল্লাহই সবসময় ক্ষমতার অধিকারী ও সত্য। তিনিই মৃতকে জীবিত করেন এবং প্রতিটি বস্তুর উপর ক্ষমতা রাখেন। তখন আমি সুলতানের কণ্ঠ থেকে ক্ষীণ শব্দ শুনতে পেলাম। তিনি বলছিলেন- এটা সত্য কথা। এটা সত্য কথা। এই ছিলো সুলতান আইউবীর জীবনের শেষ উচ্চারণ। তার অল্পক্ষণ পরেই কানে ফজরের আযান ভেসে আসে। আমি কুরআন তিলাওয়াত বন্ধ করে দিলাম। আযান শেষ হওয়ামাত্র সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী অতি নীরবে ও শান্তিতে ইহজগত ত্যাগ করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে যান। ইমাম আবু জাফর আমাকে আরো বলেছেন, যখন আযান শুরু হয়, তখন সুলতান একটি আয়াত পড়ছিলেন- আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই। আমরা তাঁরই নিকট সাহয্য প্রার্থনা করি। সে সময়ে তার ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে ওঠেছিলো। চেহারাটা তার জ্বলজ্বল করছিলো। সেই অবস্থাতেই তিনি আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যান।…।
আমি যখন গিয়ে পৌঁছি, ততোক্ষণে সুলতান আইউবী ইহজগত ত্যাগ করে পরজগতে চলে গেছেন। খোলাফায়ে রাশেদীনের পর জাতির গায়ে কোনো কারণে সত্যিকার অর্থে যদি কোনো আঘাত লেগে থাকে, সে ছিলো সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর মৃত্যু। দুর্গ, নগরী, জনতা ও তাবৎ পৃথিবীর মুসলমানদের উপর এমন এক কালো মেঘ ছেয়ে যায় যে, একমাত্র আল্লাহই জানতেন, তা কতো গভীর ও গাঢ় ছিলো। সাধারণত মানুষ প্রিয়জনের জন্য জীবন দেয়ার কথা বলে থাকে। কিন্তু কাউকে জীবন দিতে দেখা যায়নি। কিন্তু আমি কসম খেয়ে বলতে পারবো, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর জীবনের শেষ রাতে কেউ যদি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করতো, সুলতানের পরিবর্তে কে মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত আছে, তাহলে আমাদের মধ্যে বহু মানুষ নিজেদের জীবন কুরবান করে সুলতানকে বাঁচিয়ে রাখতো।…
সেদিন নগরীতে প্রতিজন মানুষকে অশ্রুসিক্ত দেখা গেছে। জনতা ক্রন্দন ছাড়া সব ভুলে গিয়েছিলো। কোনো কবিকে শোকগাঁথা শোনাবার অনুমতি দেয়া হয়নি। কোনো ইমাম, বিচারপতি কিংবা কোনো আলিম জনতাকে ধৈর্যধারণের উপদেশ দেননি। তাঁরা নিজেরাই ডুকরে কাঁদছিলেন। সুলতান আইউবীর সন্তানরা কাঁদতে ও চীৎকার করতে করতে রাস্তায় নেমে পড়েছিলো। তাদের দেখে মানুষের কান্নার রোল পড়ে গিয়েছিলো।…
যোহর নামাযের সময় হয়ে গেছে। ততোক্ষণে সুলতানকে গোসল দিয়ে কাফন পরানো হয়ে গেছে। আদালতের এক কর্মকর্তা আদ-দালায়ী সুলতানকে জীবনের শেষ গোসল করান। আমাকে বলা হয়েছিলো। কিন্তু আমার মন অতটা শক্ত ছিলো না। আমি অস্বীকার করি। মাইয়েতকে বাইরে রাখা হয়েছে। যে কাপড়খানা দ্বারা লাশ ঢেকে রাখা হয়েছিলো, সেটি কাজী আল ফজল দিয়েছিলেন। যখন জানাযা জনতার সম্মুখে রাখা হলো, তখন পুরুষদের ক্রন্দনরোল আর মহিলাদের চীৎকারে আকাশের কলিজাও বুঝি ফেঁটে যেতে শুরু করেছিলো।…।
কাজী মুহিউদ্দীন ইবনে যাকী নামাযে জানাযার ইমামতি করেন। সুলতান আইউবীর নামাযে জানাযায় কতো মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলো, আমি তার সংখ্যা বলতে পারবো না। শুধু এটুকু বলতে পারবো, কান্না আর ফোঁপানির কারণে কেউ দুআ-কালাম পাঠ করতে পারছিলো না। অনেকে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চীৎকার করে করে কাঁদছিলো। জামাতের চারদিকে মহিলারা জড়ো হয়ে মাতম করছিলো। নামাযে জানাযার পর লাশের খাঁটিয়া বাগিচার সেই ঘরটিতে রাখা হলো, যে ঘরে সুলতান আইউবী অসুস্থতার দিনগুলো অতিবাহিত করেছিলেন। আসরের সামান্য আগে মহাকালের মহানায়ক সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর দাফন সম্পন্ন করা হয়। জনতা যখন নিজ নিজ ঠিকানায় ফিরে যাচ্ছিলো, তখন মনে হয়েছিলো যেনো কতগুলো লাশ হেঁটে যাচ্ছে। আমি সঙ্গীদের নিয়ে কবরে কুরআন পাঠ করতে থাকি।…
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর জীবনে দুটি বাসনা ছিলো। ফিলিস্তীনকে খৃস্টানদের থেকে মুক্ত করা এবং হজ্ব করা। তাঁর প্রথম বাসনাটি পূর্ণ হয়েছে। দ্বিতীয়টি অর্থের অভাবে পূরণ হয়নি। তাঁর কাছে হজ্ব করার মতো অর্থ ছিলো না। ব্যক্তিগত পকেট শূন্য ছিলো। নবচন্দ্রের কাঁচি দ্বারা ক্রুসেডীয় ফসল কর্তনকারী মর্দে-মুজাহিদ, মিসর, সিরিয়া ও ফিলিস্তীনের সম্রাট এমন গরীব ছিলেন যে, অর্থাভাবে হজ্ব করতে পারেননি! তাকে যে কাফন পরানো হয়েছিলো সে আমি, কাজী আল-ফজল ও ইবনে যাকী চাদা করে ক্রয় করেছিলাম।…
আজো ফিলিস্তীন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর জন্য তেমনি মাতম করছে, যেমন করেছিলো ১১৯৩ সালের ৪ মার্চ দামেশকের নারীরা।
[সমাপ্ত]
আজকের পৃথিবীতে মহাকালের মহানায়ক একজন সুলতান সালাউদ্দিন আইউবির বড়ই প্রয়োজন।