৮.১০ “মানুষ! মানুষ!!”
পরিশিষ্ট
সমালোচকদের উত্তরে আমার দুয়েকটি কথা পুনরায় নিবেদন করি।
(১) ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার সাধারণ শিক্ষা এই যে, ব্যক্তির স্বার্থ স্থানকালে তার অবস্থান দ্বারা নির্ধারিত হয়। যেহেতু মানুষ সমাজবদ্ধ জীব এবং সমাজ পরিবর্তনশীল, অতএব স্থানকালে ব্যক্তির অবস্থান বলতে শুধু তার ভৌগোলিক অবস্থান বোঝায় না, বরং বিশেষ সমাজে পারস্পরিক সম্পর্ক দ্বারা নির্ধারিত স্থানটিকেই বোঝায়।
মার্ক্সবাদের বিশেষ শিক্ষা এই যে, ব্যক্তি শুধু সমাজের অংশই নয়, বরং আর্থিক বিচারে সে মূলত শ্রেণীবিশেষের অংশ এবং ব্যক্তিস্বার্থ শ্রেণীস্বার্থের অংশ হিসাবে ইতিহাসে সক্রিয়।
মানুষ ভগবানের ইচ্ছা অথবা শয়তানের অভিসন্ধি দ্বারা চালিত হয় এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে ইতিহাসের কোনো “বৈজ্ঞানিক” ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। বরং মানুষ সামাজিক সম্পর্কসূত্রে নির্ধারিত বাস্তব স্বার্থ দ্বারা চালিত হয়, এই ধারণা ইতিহাসের যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণের পক্ষে সহায়ক। এমনই সহায়ক যে প্রথম দৃষ্টিতে এই ধারণাকে সম্পূর্ণ সত্য মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু স্বার্থবুদ্ধিও একপ্রকার বুদ্ধি, অর্থাৎ যুক্তির প্রকাশ। এক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন যে ব্যক্তিগত অথবা শ্রেণীগত কোনো স্বার্থবুদ্ধি অথবা কোনোপ্রকার যুক্তি প্রবণতা দ্বারাই মানুষের আচরণের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হয় না।
আমাদের সচেতন মন স্বার্থবুদ্ধিটাকেই সহজে চেনে, কাজেই মানুষ স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত এই ব্যাখ্যাটাই আমাদের সচেতন মনের কাছে অবিলম্বে গ্রাহ্য। কিন্তু কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধে যেমন পরিণামে কোনো দলেরই স্বার্থ পূর্ণ হয়নি, স্বার্থবুদ্ধি যেমন সেখানে গভীরতর হিংসা ও প্রেমের দ্যোতকমাত্র ছিল কিন্তু পরিচালক ছিল না, মানুষের দীর্ঘ ইতিহাসে তেমনই স্বার্থের ছলনাকে আশ্রয় করে অন্ধ অবগুণ্ঠিত প্রবৃত্তি নিজেকে। চরিতার্থ করেছে।
আমাদের জীবনকালেও এর নিদর্শনের অভাব নেই। ভারত ও পাকিস্তানের বিদ্বেষের মূলে স্বার্থবুদ্ধি প্রধান নয়। বরং স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হলে আমাদের ভিতর সহযোগিতাই প্রত্যাশিত ছিল।
হিটলারের ইহুদী নিধন ও সীমাহীন বর্বরতার পিছ তীর্থবুদ্ধির ছলনা মাত্র ছিল।
যে-যুদ্ধের পরিণামে জাপান নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল জাতীয় অথবা শ্রেণীগত স্বার্থের গণনাকে তার নিয়ন্তা মনে করা মানব প্রকৃতি সম্বন্ধে অজ্ঞতারই পরিচায়ক।
চীন ও সোভিয়েত দেশের ভিতর বাস্তব স্বার্থের বিরোধ অবশ্য আছে; কিন্তু এটাই কি ঐ দুই দেশের দ্বন্দ্বের একমাত্র, এমন কি প্রধান কারণ? স্বীকার করতে বাধা কি যে মানুষে মানুষে, দেশে দেশে পারস্পরিক হিংসা যুক্তি অথবা প্রয়োজনের মাত্রা মেনে চলে না?
যুদ্ধ ও বিপ্লব আমাদের যেমনভাবে টানে তাতে যুক্তির অতীত অন্ধ প্রকৃতির প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। এ বিষয়ে আত্মসচেতনতা আখেরে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ধীরে ধীরে সহায়ক হতে পারে।
(২) সমাজের স্থায়ী উন্নতির জন্য সর্বোপরি প্রয়োজন শিক্ষা ও বিজ্ঞান। সোভিয়েত দেশ, জমানি ও সুইডেনের ভিতর অন্যান্য নানা পার্থক্য আছে; কিন্তু বিজ্ঞানচর্চা ও শিক্ষার সুব্যবস্থা তিনটি দেশেরই বৈশিষ্ট্য।
বিজ্ঞানের সাহায্যে উৎপাদনপদ্ধতির উন্নতি ঘটাতে হলে সেই সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক এবং প্রতিষ্ঠানেরও পরিবর্তন প্রয়োজন। এজন্য আন্দোলন ও জনমত গঠন আবশ্যক।
পরিবর্তন যদিও আবশ্যক তবু ভিন্ন ভিন্ন দেশে স্থানকালের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নানা বিকল্প পথে উন্নতি সম্ভব। সোভিয়েত দেশ, জার্মানি ও সুইডেনের ভিতর বিজ্ঞানচর্চার স্তরের পার্থক্য বেশী নয়। যদিও শেষোক্ত দেশটিতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান এখনও প্রথমোক্ত দেশটির তুলনায় অনেকটা উঁচু তবু তিনটি দেশকেই শিল্পোন্নত দেশ বলে স্বীকার করা সমীচীন। অথচ তিনটি দেশের সামাজিক, আর্থিক ও রাজনীতিক ব্যবস্থায় পার্থক্য প্রচুর। অর্থাৎ, মোটামুটি সমস্তরে অধিষ্ঠিত বিভিন্ন দেশের ভিতরও বিজ্ঞানের সাহায্যে উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য কোনো একটি সমাজব্যবস্থা অপরিহার্য নয়।
সকল সমাজ ব্যবস্থাতেই শিক্ষার প্রসার ও শ্রমের উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকের জীবনযাত্রার দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন অপ্রতিরোধ্য। অপরপক্ষে উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধি যাতে ব্যাহত হয় শ্রমিকের জীবনযাত্রার স্থায়ী উন্নতি তাতে সম্ভব নয়।
একটি সমাজব্যবস্থা সব দেশের পক্ষে নির্বিশেষে শ্রেষ্ঠ এমন চিন্তা ভ্রান্ত। এ বিষয়ে গোঁড়ামি ত্যাগ করলে উন্নতির শান্তিপূর্ণ পথ খুঁজে পাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ হয়।
(৩) মার্ক্স স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই সাম্যবাদী সমাজের যেখানে শ্রম ও শ্রমিকের ভিতর বিচ্ছিন্নতাবোধ লুপ্ত, মানুষের মানুষে বিরোধ সমাপ্ত। এই আদর্শ সমাজের খুঁটিনাটি অবান্তর, মূল সুরটি ধরিয়ে দেওয়াই প্রধান কথা। তরুণ মার্ক্স এই মূল সুরটি সুন্দর ধরেছিলেন।
পরে তিনি তৎকালীন সমাজের সুদীর্ঘ বিশ্লেষণ করেছিলেন আদর্শ সমাজে পৌঁছবার পথ নির্ণয়ের জন্য। সেই বিশ্লেষণও মূল্যবান।
কিন্তু মার্ক্সবাদী যাকে “শোষণ” বলেন, আর্থিক বিবর্তনের বিশ্লেষণে তার মূল্য যাই হোক না কেন, শেষ বিচারে “বিচ্ছিন্নতাবোধের কারণ সেখান নয়, আরও গভীরে। এ প্রসঙ্গে সামান্য আলোচনা প্রয়োজন।
উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমবিভাগ ক্রমশ সম্প্রসারিত হয়েছে। এতে শ্রমিকের উৎপাদিকা শক্তি বেড়েছে। কিন্তু শ্রমবিভাগের ফলেই আবার স্পষ্ট হয়েছে শ্রম ও শ্রমিকের ভিতর বিচ্ছিন্নতাবোধ। তরুণ মার্ক্স লিখেছিলেন “As soon as labour is distributed, each man has a particular, exclusive sphere of activity, which is forced upon him and from which he cannot escape.” (The German Ideology) শ্রমবিভাগের ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়ার একটি ক্ষুদ্র অংশে শ্রমিক আবদ্ধ হয়ে পড়েন। এই নিষ্প্রাণ খণ্ড কর্মে শ্রমিকের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়, আবার যেহেতু উৎপাদন। প্রক্রিয়ার এই খণ্ডীকরণ ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছা দ্বারা নির্ধারিত হয় না অতএব এ থেকে স্বেচ্ছায় শ্রমিকের মুক্তিও সম্ভব নয়।
উৎপাদন প্রক্রিয়াকে বহু ভাগে বিভক্ত করবার পর এই বিভিন্ন খণ্ডের ভিতর পুত্থানুপঙ্খ যোগাযোগ রক্ষার জন্য নিয়মের প্রয়োজন হয় এবং এই নিয়মও শ্রমিকের উপর একটি বন্ধন হয়ে চেপে বসে। এখানে মনে রাখা আবশ্যক যে, উৎপাদন পদ্ধতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শুধু শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ভিতর শ্রমবিভাগ বেড়েছে তাই নয়, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ভিতর পারস্পরিক নির্ভরতাও বেড়েছে। যেপরিমাণে এই পারস্পরিক নির্ভরতা বেড়েছে সে-পরিমাণে নিয়মের জটিলতা ও ব্যাপকতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ যুগে আমলাতন্ত্রের উদ্ভবের পটভূমিকা এই। যন্ত্র, কর্মবিভাগ ও বৃহৎ প্রতিষ্ঠান যতদিন আছে আমলাতন্ত্রও ততদিন থাকবে। বস্তুর উপর মানুষের শাসন প্রকারান্তরে মানুষের উপর মানুষের শাসনই হবে। এবং আমলাতন্ত্রের উপার্জিত আয়কে যদি ধনতন্ত্রে “শোষণে”র অংশ বলে গণ্য। করা হয় তো সমাজতন্ত্রে তাকে ভিন্ন নাম দিলে চিন্তার বিভ্রমই সৃষ্টি হবে।
নিয়ম যতই যুক্তিসঙ্গত হোক না কেন ব্যক্তিমানুষের কাছে সেটা বন্ধনই বোধ হয়, কারণ মানুষের মনের একটা দিক আছে যেটা কিছুতেই স্থির থাকতে চায় না, সব নিয়ম ভেঙ্গে বেরোতে চায়। যদি একের ইচ্ছা ও বহুর ইচ্ছার ভিতর কোনো সহজ সমন্বয়। থাকতো তা হলে তো নিয়মের প্রয়োজনই হত না। শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগত মালিকানা দূর হলেও ব্যক্তির ইচ্ছা ও অতিকায় প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনের ভিতর অন্তরের মিল স্থাপিত হয় না। অনিয়ম থেকে অবশ্য নিয়মই ভালো, কারণ অনিয়মের তর্জন। নিয়মের শাসন থেকেও ভয়াবহ। কিন্তু ধনতন্ত্রেই হোক আর সমাজতন্ত্রেই হোক, এ যুগে যান্ত্রিকতার বন্ধন থেকে মুক্তির সন্ধান আমরা এখনও জানি না। আদর্শ জীবনের ছবি আঁকতে গিয়ে মার্ক্স যখন একটি মনোরম দিবসের সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যা শিকার, মাছ ধরা ও গোচারণে ভরে তোলেন তখন যন্ত্রের বন্ধন থেকে মুক্তির অবচেতন ইচ্ছাটাই কি তাতে প্রকাশ পায় না। কিন্তু যন্ত্রের দাপট তে বিপ্লব দিয়ে রোধ করা যায় না।
কাজের দিনে আমরা যন্ত্রের দাস আর ছুটির দিনে আমরা পলাতক বালকের মতো মুক্ত, এভাবেও সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান মেলে না। শিল্প ও বিজ্ঞানের একটা ঝোঁক আছে, এই বস্তু জগৎকে সে একান্তভাবে ব্যবহারের সামগ্রী এমন কি ভোগ্যবস্তু হিসাবে ভাবতে শেখায়। শিল্পের প্রাধান্যের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনকেই মানুষ পরম লক্ষ্য বলে গ্রহণ করে। ধীরে ধীরে ব্যক্তিকেও সে বস্তুরই মতো ব্যবহারের সামগ্রী হিসাবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়। কাজ থেকে ছুটি নিলেও মনের এই অভ্যাস থেকে ছুটি পাওয়া কঠিন হয়। শুধু ছুটি বাড়িয়ে কিংবা চাঁদে পলায়ন করে মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতাবোধ দূর করা যাবে না।
আধুনিক সমাজের এই দুটি গভীর সমস্যা একদিকে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য দুর্নিরোধ; অন্যদিকে ব্যক্তিমানুষ আপন অন্তরে নিঃসঙ্গতাবোধে ক্লিষ্ট। সাময়িক উত্তেজনায় এই বিচ্ছিন্নতাবোধকে আবৃত করা যায়, কিন্তু তাতে তার মূল উচ্ছেদ হয় না। হিংসার অস্ত্র তাকে ছেদন করতে পারে না। বিপ্লবের অগ্নি তাকে দগ্ধ করলেও সেই ভস্ম থেকে তার পুনর্জন্ম হয়।
গান্ধী একবার বলেছিলেন “Nehru wants industrialization because he thinks that if it is socialized it would be free from the evils of capitalism. My own view is that the evils are inherent in industrialism and no amount of socialization can eradicate them.” শিল্পোন্নয়ন যদিও আমরা চাই তবু গান্ধীর ঐ উক্তিতে একটি কঠিন অথচ সুগভীর বাস্তববোধ অস্বীকার করা যায় না।
(৪) বিপ্লবের পথে পৃথিবীতে হঠাৎ সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায় না। প্রশ্ন এই নয় যে, হিংসার সাহায্যে কোনো ফললাভ সম্ভব কি না? কোনো সমান্য ফল বিপ্লবীর কাম্য নয়; যে-ফল তাঁর কাম্য তা হিংসার সাহায্যে লভ্য নয়।
সুস্থ সমাজমাত্রই বহু পরিমাণে পারস্পরিক আস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। হিংসার ব্যাপক ব্যবহারে এই আস্থা ভেঙ্গে যায়। তখন স্বৈরাচার ও নগ্ন পশুশক্তিই সমাজকে সংহত রাখবার উপায় হিসাবে অবশিষ্ট থাকে। আধুনিক সমাজের অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এতে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। হিংসা দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্ছেদ সম্ভব নয়; বরং ভয় ও সন্দেহের পরিমণ্ডলে রাষ্ট্রশক্তি তথা আমলাতন্ত্রকে নিয়মের দ্বারা সংযত করা। আরও কঠিন হয়ে ওঠে। উদ্দেশ্য দ্বারা উপায়ের মূল্যায়নের কথা যাঁরা বলেন তাঁদের মনে রাখা উচিত যে, উদ্দেশ্য ও পরিণাম এক বস্তু নয়। পরিণামের দ্বারাই উপায়ের মূল্যায়ন হতে পারে। হিংসাত্মক বিপ্লবের বাস্তব পরিণাম এবং আদি উদ্দেশ্য অথবা কল্পিত ফলের ভিতর বিভেদ বিষম।
ফরাসী বিপ্লব ও রাজহত্যা ইয়োরোপে শাসকগোষ্ঠীর ভিতর যে-ভীতি সৃষ্টি করে, উনিশ শতকে একাধিক দেশে উদারনীতির অভ্যুত্থান তাতে বাধা পায়। পরবর্তী যুগে রুশবিপ্লব ও স্তালিনী স্বৈরাচার জমানিতে নাৎসী আন্দোলনের পথ সুগম করেছে। ফরাসী বিপ্লব ও নেপোলিয়ন, বিসমার্ক, স্তালিন ও হিটলার, সব কিছুর ভিতর একটা ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে সন্দেহ নেই; কিন্তু এই রক্তাক্ত পথই প্রগতির একমাত্র পথ ভবিষ্যতের জন্য যদি আমরা এই শিক্ষাই গ্রহণ করি তবে বিপদ। শতাব্দী জোড়া এই বৈপ্লবিক রক্তক্ষয় থেকে সুইডেন, সুইজারল্যাণ্ড প্রভৃতি যেসব দেশ দূরে ছিল তাদের উন্নতি উল্লেখযোগ্য।
শিক্ষার প্রসার, বিজ্ঞানের সাধনা, গঠনধর্মী কর্ম এবং গণতান্ত্রিক সংগঠন ও আন্দোলনের দ্বারা যা লাভ করা যায় হিংসাত্মক বিপ্লবের পথে তার বেশী কিছু লভ্য নয়। অথবা যদি লভ্য হয় তবে সেই বাড়তি বস্তু লাভের যোগ্য কিনা সন্দেহ। যদি কেউ বলেন যে, আগে বিপ্লবের সাহায্যে অন্যায়ের অবসান হবে তারপর শুরু হবে গঠনধর্মী কাজ, তবে তিনি ভুল বলেন। এটা অবাস্তব চিন্তা। উনিশ শতকের ইংল্যাণ্ড, বিশ শতকের জাপান অথবা স্তালিনী সোভিয়েত দেশে অন্যায় কম ছিল না। এরই ভিতর দেশ গড়বার কাজও এগিয়ে গেছে। গড়বার জন্য পরিশ্রম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন একই সঙ্গে প্রয়োজন। বিপ্লবের দ্বারা অন্যায়ের অন্ত হয় না।
(৫) মার্ক্স মানবতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। অনুন্নত ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমালোচনা ছিল উনিশ শতকে মানবতাবাদের ভিত্তিস্বরূপ। মার্ক্সবাদের বিশেষ রূপরেখা ঐ ভিত্তিতেই নিধারিত। এ যুগে মানুষের অগ্রগতির জন্য উন্নত ধনতন্ত্র এবং সাম্যবাদী সোভিয়েত সমাজব্যবস্থারও সমালোচনা প্রয়োজন। নতুন যুগের অভিজ্ঞতায় মানুষকে ও। অমানুষিকতাকে আমরা নতুন আলোয় চিনেছি। তাই মানবতাবাদের নব রূপরেখা ও ভাষা স্বতন্ত্র।
সমাজ ও ইতিহাস (প্রথম প্রকাশ, ১৯৭০)