2 of 2

৮.০৭ “সাম্যবাদ ও প্রগতির পথ”

৮.৭ “সাম্যবাদ ও প্রগতির পথ

পরিশিষ্ট

প্রবন্ধে আমি লিখেছি; “গত অর্ধ শতাব্দীর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কম্যুনিজম বলতে আজ আমরা কার্যত দুটি স্বতন্ত্র বস্তু বুঝি। একদিকে কম্যুনিজম অনুন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবার একটা বৈপ্লবিক পথ। অন্যদিকে শিল্পোন্নয়নেরও ওটা একটা বিকল্প পদ্ধতি।” কোনো কোনো পাঠক এতে আপত্তি তুলেছেন। কথাটার একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

কম্যুনিজম তত্ত্ব অথবা আদর্শের দিক থেকে কী সেটা এখানে প্রশ্ন নয়, “কার্যত” কী। সেটাই প্রশ্ন। মার্ক্স ভেবেছিলেন যে, ধনতন্ত্রের বিবর্তনের ফলে সমাজের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে উঠবে। শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মজুর শ্রেণীর সংখ্যা ও সংহতি বৃদ্ধি পাবে; অথচ ধনতন্ত্রের অভিশাপে মজুরশ্রেণীর অবস্থার কোনই উন্নতি হবে না। অন্যদিকে আর্থিক ক্ষমতা ক্রমশ কেন্দ্রীভূত হবে মুষ্টিমেয় ধনিকশ্রেণীর হাতে। দ্বন্দ্বটা তীব্রতর হবে অপেক্ষাকৃত উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে। বিশেষ কারণে মার্ক্স ও এঙ্গেলস জামানীতে বিপ্লবের আশু সম্ভাবনা দেখেছিলেন। কম্যুনিস্ট ইস্তাহারে তাঁরা লিখেছিলেন।

“The communists turn their attention chiefly to Germany…because the bourgeois revolution in Germany will be but the prelude to an immediately following proletarian revolution.”

কিন্তু প্রথম কম্যুনিস্ট বিপ্লব ঘটল অনুন্নত রুশ দেশে। লেনিন অবশ্য এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু যাই হোক না কেন ঘটনাটা মেনে নিতে হবে। ঘটনা এই যে গত অর্ধ শতাব্দীতে কোনো উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে কম্যুনিস্ট বিপ্লব সাধিত হয়নি। ১৯১৭ সালের রুশ দেশের মতো ১৯৪৯ সালের চীনও আর্থিকভাবে অপেক্ষাকৃত অনুন্নতদেশ। (চেকোশ্লোভাকিয়ার কথা আমি ধরছি না; রুশ লাল ফৌজের সমর্থন ছাড়া কম্যুনিস্ট দল ওখানে ক্ষমতায় আসতে পারতেন না।) অতএব মার্ক্সীয় আদি তত্ত্ব যে কথাই বলুক না কেন “কার্যত” ক্যুনিজম অনুন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবার একটা। বৈপ্লবিক পথ। অবশ্য অনুন্নত দেশ মাত্রেই যে এই বৈপ্লবিক পদ্ধতিটি সফল হবে এমনও নয়।

দ্বিতীয় কথাটিও একই সূত্রে এসে যায়। মার্ক্সীয় তত্ত্বের দিক থেকে সাম্যবাদী সমাজ ধনতন্ত্রের বিকল্প ব্যবস্থা নয়, বরং ধনতন্ত্রের পরবর্তী উন্নততর সমাজব্যবস্থা। ফরাসী দেশে শ্রমিক বিপ্লব বারবার ব্যর্থ হবার পর মার্ক্সের এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, ধনতান্ত্রিক সমাজের আওতায় উৎপাদিকা শক্তির যথাসম্ভব উন্নতি সম্পূর্ণ হলে তবেই ধনতন্ত্রের অবসান ঘটবে। তার আগে নয়। ধনতান্ত্রিক বিকাশের যেখানে শেষ, সাম্যবাদী ব্যবস্থার সেখানে শুরু। কিন্তু আবারও তত্ত্বের সঙ্গে ঘটনার অসামঞ্জস্য লক্ষণীয়। আজকের জামানীর প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। যুদ্ধোত্তর যুগে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানীতে পাশাপাশি সাম্যবাদী ও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে আর্থিক উন্নতি ঘটছে; উভয় ব্যবস্থাতেই উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ হচ্ছে। এ অবস্থায় কম্যুনিস্ট পথকে ধনতন্ত্রের পরবর্তী উন্নততর আর্থিক ব্যবস্থা আখ্যা না দিয়ে বরং উন্নতির একটা বিকল্প পথ হিসাবে দেখলেই ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে।

১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব যদি ব্যর্থ হত তবুও রুশ দেশের আর্থিক উন্নতি বন্ধ হয়ে যেত না। কম্যুনিস্ট বিপ্লব ছাড়াই যেমন জাপান ও জার্মানীতে শিল্পোন্নয়ন ঘটেছে, রুশ দেশেও আশা করা যায় তেমন উন্নতি সম্ভব হত। এই অর্থেই আমি বলেছি যে কম্যুনিজম কার্যত শিল্পোন্নয়নের একটি বিকল্প পদ্ধতি।

শিল্পোন্নয়নের বিভিন্ন পথের তুলনামূলক আলোচনায় আমি ধনতন্ত্রের দোষগুলি অপেক্ষাকৃত সংক্ষেপে উল্লেখ করেছি, আর সাম্যবাদী সমাজের সমস্যাগুলি কিছুটা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছি। এর কারণ সহজ। ধনতন্ত্রের দোষত্রুটি আমরা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে জানি। এ বিষয়ে আমাদের মিথ্যা মোহ নেই, কাজেই উল্লেখ মাত্রই ব্যাপারটা সাধারণত বোধগম্য হয়। কিন্তু সাম্যবাদী সমাজ আমাদের দূরের জিনিস; এ বিষয়ে অনেকের ধারণা অতিরঞ্জিত। তাই ভ্রম সংশোধনে খানিকটা ব্যাখ্যা আবশ্যক।

মুশকিল এই যে মার্ক্সীয় দর্শন এ ব্যাপারে ভ্রমটাকে দীর্ঘায়ু করতে ব্যস্ত। তা নইলে এ কথাটা আজ দিবালোকের মতোই স্পষ্ট যে, ধনতন্ত্র ধ্বংস না হলে শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয় এই আদি মার্ক্সীয় সিদ্ধান্ত ভুল। এর বিপক্ষে সাক্ষ্য পশ্চিম থেকে দূর প্রাচ্যে জাপান পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। প্রাগ্রসর ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে শ্রমিকদের অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। উনিশ শ তিরিশের যুগের তুলনায় তার পরবর্তী যুগে। আর্থিক সংকটের তীব্রতা হ্রাস পেয়েছে; বেকারের সংখ্যা ঐ তুলনায় আজ কম; সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রসারও লক্ষণীয়। উপনিবেশ হাতছাড়া হওয়া সত্ত্বেও ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, হল্যাণ্ড, জার্মানী, জাপান ইত্যাদি দেশে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান। আজ পঞ্চাশ বৎসর পূর্বের তুলনায় অনেকখানি উন্নত। আজকের পৃথিবীকে বুঝতে হলে। এসব কথা ভুললে চলবে না। এরই পাশে পাশে অবশ্য এমন বহু ঘটনা ঘটছে যাতে আমরা স্বভাবতই ব্যথিত অথবা ক্রুদ্ধ। মার্কিন দেশে নিগ্রোরা আজও লাঞ্ছিত। জাতিতে জাতিতে যুদ্ধের আজও অবসান ঘটেনি; বরং হত্যা ও ধ্বংসের নব নব কৌশল উদ্ভাবিত হচ্ছে। কিন্তু এখানেও নতুন চিন্তা প্রয়োজন। যুদ্ধের কারণ সম্বন্ধে পুরনো মার্ক্সীয় ধারণাকে পিষ্ট করেই ইতিহাসের রথ চলেছে। চীনের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধটা কি বাজার নিয়ে?

ধনতান্ত্রিক দেশগুলি সম্বন্ধে যেমন মার্ক্সের অতি ঘোর ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়নি, বিপ্লবোর সাম্যবাদী সমাজ সম্বন্ধেও তেমনই মার্ক্সীয় আকাশচুম্বী প্রত্যাশা বহু পরিমাণে ব্যর্থ হয়েছে। স্তালিনী অত্যাচারের বিভীষিকা পঞ্চাশ বছর আগের মার্ক্সবাদীর দুঃস্বপ্নেরও অতীত ছিল। বিশ্বের শ্রমিক আন্দোলনের ঐক্যের ধ্বনির পাশে আজ চীন ও সোভিয়েত দেশের উগ্র কলহ কেমন ব্যঙ্গের মতো শোনায়। তবু মোহ সহজে ভাঙ্গে না। পৃথিবীকে শত্রু ও মিত্র, অতি মন্দ ও অতি ভালো, এ দুই ভাগে ভাগ করে দেখলে আমাদের এক জাতীয় প্রবৃত্তি পরিতৃপ্ত হয় বটে; কিন্তু এতে সমাজে হিংসা ও দ্বন্দ্ব একটা মিথ্যা বিশ্বাসে উৎসাহিত হয়ে ওঠে। এটাই বিপদের কথা।

সোভিয়েত দেশের কৃতিত্ব অস্বীকার করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বিজ্ঞানের চর্চায়, সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থায় সোভিয়েত দেশের কাছে আমাদের বহু শিক্ষণীয় বস্তু আছে। কিন্তু একদেশদর্শিতার প্রয়োজন কি? শিক্ষার প্রসারে ও বিজ্ঞানের চচায় জাপানের কৃতিত্বও কিছু কম নয়। সাধারণের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থায় পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশের উদাহরণও উল্লেখযোগ্য। তবু সোভিয়েত দেশকে তার বিশেষ কৃতিত্বের জন্য প্রশংসা করি। উনিশ শতকের রুশ দেশেও প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিকের অভাব ছিল না; কিন্তু বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত দেশে বিজ্ঞানের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগসাধনের ব্যাপক চেষ্টার প্রশংসা করব উচ্চকণ্ঠে। স্তালিনী অত্যাচারের দুর্দিনেও সোভিয়েত সরকার শিক্ষার ব্যাপারে অর্থব্যয়ে কার্পণ্য করেনি। শিল্পী, সাহিত্যিক ও বৈজ্ঞানিকদের ভিতর যাঁরা রাষ্ট্রের আস্থাভাজন তাঁদের সাধারণ শ্রমিকের তুলনায় অনেকটা উচ্চ আয়ের অধিকার দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে সোভিয়েত দেশে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার অধিকারও উন্মুক্ত হচ্ছে, এটাই আশার কথা এ

আজ থেকে শতবর্ষ পরে সমাজের চিত্র কি হবে তা এই মুহূর্তে কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু একটা বিরাট আর্থিক সংকটের ভিতর উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলির সহসা অপমৃত্যু ঘটবে এই নাটকীয় প্রত্যাশা সত্য হবার সম্ভাবনা কম। বরং ক্রমপরিবর্তনের লক্ষণই আজ সুস্পষ্ট। সোভিয়েত ও উন্নত পাশ্চাত্য দেশগুলির বিভিন্ন গুণের সমম্বয় সম্ভবত দেখা যাবে এই শতাব্দীর শেষের বহু সমাজে, যদি-না পরমাণুবোমার আঘাতে সভ্যতা ততদিনে বিকলাঙ্গ হয়। চীন ও ভারতের মতো কৃষিপ্রধান ও জনবহুল অঞ্চলে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশে, বর্তমান শতাব্দীর শেষেও সম্ভবত জনসংখ্যার অন্যূন অধাংশ গ্রামেই বাস করবেন। এই সব সমাজের সেদিক থেকে কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা স্বাভাবিক, যেমন মার্ক্স-এঙ্গেলসের নাগরিক মানসিকতার তুলনায় গান্ধী ও মাওয়ের চিন্তায় গ্রামের স্পর্শ আমাদের একটা স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে সচেতন করে তোলে। পৃথিবীর গ্রামীণ সমাজের পুনগঠনে আমরা পথের নির্দেশ পেতে পারি একদিকে বিজ্ঞান ও অন্যদিকে গান্ধীজীর অহিংস জীবনদর্শনের সমন্বয়ে।

তত্ত্বের চেয়ে আদর্শ বড়। সাম্যবাদী তত্ত্বের চেয়েও স্বাধীনতা ও প্রগতির আদর্শ বড়। ভারতের বর্তমান অবস্থায় গৃহযুদ্ধের পথে সাম্যবাদী আদর্শ অথবা অন্য কোনো আদর্শেই পৌঁছান যাবে না।

গণযুগ ও গণতন্ত্র (প্রথম প্রকাশ, ১৯৬৭)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *