2 of 2

৮.০৫ মূল বইগুলির ভূমিকা ও পরিশিষ্ট

৮.৫ পরিশিষ্ট
মূল বইগুলির ভূমিকা ও পরিশিষ্ট
গণযুগ ও গণতন্ত্র (প্রথম প্রকাশ, ১৯৬৭) : ভূমিকা

‘দেশ’ ও ‘আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধ সংকলিত হল। পুস্তকের সর্বশেষ প্রবন্ধটি দশ বছর আগে লেখা। অন্যান্য প্রবন্ধ বাংলা ১৩৭৩-৭৪ (১৯৬৬-৬৭)। সালে রচিত। ঐতিহাসিক সূত্রে বাঙ্গালী বিপ্লবী। চিন্তায় ও সমাজ সংগঠনে আজ নতুন প্রয়াস ও ধ্যানধারণার প্রয়োজন আছে। কিন্তু গৃহযুদ্ধের পথে আমাদের মুক্তি সম্ভব এটা ভ্রান্ত ধারণা। এই ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে শত আত্মত্যাগের মূল্যেও স্বর্গ কেনা যাবে না। গণতন্ত্রের পথেই আমাদের নতুন সমাজ গড়তে হবে। তা নইলে বাঙ্গালীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

প্রগতির পথ (প্রথম প্রকাশ ১৯৬৮) : ভূমিকা

প্রগতির বৃদ্ধি ও বিনাশ দুইই সম্ভব প্রগতিরই নামে। প্রগতির মূল শর্তগুলো নিয়ে তাই সতর্ক আলোচনা প্রয়োজন। সেই আলোচনা আমাদের ভিতর এখনও তেমনভাবে শুরু হয়নি।

এই পুস্তকের অধিকাংশ প্রবন্ধ ১৩৭৪-৭৫ (১৯৬৭-৬৮) সালে লিখিত। তবে ‘মাতৃভাষা ইংরেজী ও হিন্দী’ প্রথম প্রকাশিত হয় আরও দশ বছর আগে। গণতন্ত্র ও সমাজবিবর্তন’ শীর্ষক প্রবন্ধটিও ঐ সময়ে লেখা একটি দীর্ঘতর রচনার অংশবিশেষ।

এই সব প্রবন্ধ থেকে যদি তর্ক ও আলোচনা বিস্তৃতি লাভ করে তবে পুস্তকের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।

সমাজ ও ইতিহাস (প্রথম প্রকাশ, ১৯৭০) : ভূমিকা

‘প্রগতির পথ’ নামে আমার একটি বই কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছিল। তার মূল বক্তব্যের সঙ্গে ‘সমাজ ও ইতিহাস’-এর যোগ আছে। তবে এই বইটির বক্তব্য বোধ করি আরও ব্যাপক। প্রগতির পথ’-এর অন্তর্ভুক্ত একটি প্রবন্ধকে এখানে স্থান দেওয়া হয়েছে, আলোচনা তাতে পূর্ণতর হবে এই আশায়।

মানুষের স্বভাব এই যে, সে খণ্ড খণ্ড অভিজ্ঞতাকে বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করে দেখতে চায়। তা নইলে এদের পারস্পরিক সম্পর্ক, অতএব অর্থ, বোধগম্য হয় না। এই বইটিতে আজকের কয়েকটি জরুরী সমস্যাকে একটি বিস্তৃত _____ সঙ্গে যুক্ত করে দেখবার চেষ্টা হয়েছে।

পল্লী ও নগর (প্রথম প্রকাশ, ১৯৭৩) : ভূমিকা

আমরা সবাই নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ী পৃথিবীকে বুঝতে চেষ্টা করি। মানুষের বিচিত্র কর্মকাণ্ডকে আমিও বুঝতে চেয়েছি। এছাড়া উপায় ছিল না। যেমন নিজেকে বুঝবার চেষ্টা ছাড়া উপায় নেই। আমার যদি কোনও সমাজ দর্শন থাকে, তা যত অসম্পূর্ণই হোক, তার কিছুটা পরিচয় আছে এই বইটিতে।

‘কোন পথ?’ প্রবন্ধটি পঞ্চাশের দশকে লেখা, সামান্য পরিমার্জিত আকারে পুনঃপ্রকাশিত হল। অন্যান্য রচনা গত গত পাঁচ বৎসরের ভিতরে লিখিত। অধিকাংশ প্রবন্ধ ‘দেশ’ সাপ্তাহিকে প্রকাশিত হয়, তবে জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে লেখাটি এদিক থেকে ব্যতিক্রম। বন্ধুবর সাগরময় ঘোষের সহায়তা ও সনির্বন্ধ অনুরোধ ছাড়া এই সব প্রবন্ধ হয়ত সম্পূর্ণ হত না, ধন্যবাদের পরিবর্তে এই বইটি তাঁকেই উৎসর্গ করা হল।

ব্যক্তি যুক্তি সমাজ (প্রথম প্রকাশ জানুয়ারী ১৯৭৮) : ভূমিকা

মানুষের স্বরূপ কি? প্রশ্নটিতেই মানুষের স্বরূপের একটি দিক উদ্ভাসিত। মানুষই সেই অদ্বিতীয় জীব যে এই ধরনের একটা প্রশ্ন নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে পারে আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া”। নিজের স্বরূপ জানতে হলে নিজের বাইরে দাঁড়াতে হয়। অথচ একটি বিপরীত ভাব মানুষের প্রকৃতিকে আচ্ছন্ন করে আছে। এই বিপরীত ভাবটিকে বলা যেতে পারে মমতা অথবা মায়া। সব কিছুকেই আমরা মমত্বের অন্তর্গত করতে চাই। এই মমতা মানুষের সহজাত। মমতা ও মননের বৈপরীত্যে মানুষের বিশিষ্ট পরিচয়। এ দুয়ের মিশ্রণে ও ঘাতপ্রতিঘাতে মানুষের চৈতন্যের বিবর্তন।

এই বিবর্তনের প্রথম পর্যায়ে মায়ার প্রাধান্য। তার একটা জৈব মাধুর্য আছে। বাসনায় আবৃত করে আমরা সংসারকে দেখি। এই সব খণ্ড খণ্ড,সামঞ্জস্যহীন চাওয়ার ভিতর বিপ্লবকে তার নির্লিপ্ত রূপে পাওয়া সম্ভব নয়। বিফল বাসনা বার বার আমাদের ভয়ার্ত, যন্ত্রণাগ্রস্ত ও হিংসাত্মক করে তোলে। এর আধিপত্যে বিপত্তি। আমাদের জৈব অস্তিত্ব পর্যন্ত এতে বিপন্ন হয়ে ওঠে। স্বভাবত মননের উদয় ঘটে জৈব অস্তিত্বের সহায় রূপে। কিন্তু মননের পরিণতি অন্যত্র। সেই পরিণতি বড় সহজ পথে আসে না।

চৈতন্যের বিবর্তনে একটি মধ্য পর্যায় আছে। সেখানে মানুষ সাবধানী এবং স্বার্থান্বেষী, মায়ামমতা সম্বন্ধে সন্দিগ্ধ, যে জৈব রস থেকে স্নেহভালোবাসা সজ্ঞাত তাকে চতুরভাবে স্বার্থের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। এরই সাথে তখন সঙ্গতি রক্ষা করে মনন ও বহির্জগৎ একটি বিশেষ রূপ লাভ করে। মানুষের ক্রমবিকাশে এই মধ্যস্তরের একটা নিজস্ব স্থান আছে। একে অবলম্বন করে জড় জগতের ওপর মানুষের আধিপত্য দ্রুত বৃদ্ধি পায়, প্রাচীন কুসংস্কার দুর্বল হয়ে আসে, রক্তের বন্ধনের অন্ধ সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে স্বার্থের বন্ধনের বিস্তৃত ও বিচিত্র সম্পর্কে মানুষ আবদ্ধ হয়। এই সবই উল্লেখযোগ্য। কিন্তু সেই সঙ্গে মানুষের অন্তরে একটা রিক্ততা অদৃশ্য ব্যাধির মতো প্রসারিত হয়।

বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে একটির পর একটি পরিচ্ছন্ন ক্রমিক ধারায় দেখা দেয় না। বরং পারস্পরিক অনুপ্রবেশই ইতিহাসের নিয়ম, একটিকে ছাপিয়ে আর একটি আসে, অগ্রগতি ও দসরণ কোনো সরল বিন্যাস রক্ষা করে চলে না। মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব কখনও স্বার্থভিত্তিক, কখনও আবার অন্ধ সংঘবদ্ধ মমত্বের সংঘাতই প্রধান। স্বার্থের রূপরেখা পরিবর্তনে সঙ্গে সঙ্গে দ্বন্দ্বেরও চেহারা বদলে চলে। কিন্তু মানুষের চৈতন্যের মতোই দ্বন্দ্বেরও কোনো সরল রূপ নেই। মমতা ও বিদ্বেষ, বিদ্বেষ ও স্বার্থ মিলেমিশে একাকার হয়। আর্থিক স্বার্থের ভিত্তিতে যে সংকটের সৃষ্টি, ক্রমে তাতেই উপজাতীয় অথবা ধর্মবিদ্বেষের সুর স্থাপিত হয়। দ্বন্দ্বের প্রকৃতি যখন অজানা তখন সমম্বয়ের সন্ধানও সফল হয় না।

মানুষকে যুক্তিশীল জীব বলা হয়েছে। চৈতন্যের অন্যান্য উপাদান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুক্তি আবির্ভূত হয় না। বিবর্তনের বিশেষ পর্যায়ে যুক্তিরও একটা বিশেষ ঝোঁক দেখা যায়। এই ঝোঁকের বেগেই সে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পন্ন করে। আবার এরই ফলে তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মানুষ বার বার নিজেকে নিজে অতিক্রম করে যায়। উপজাতীয় সংঘবদ্ধতা থেকে সে একদিন নানা ঘটনাচক্রের ভিতর দিয়ে জাতীয়তায় উত্তীর্ণ হয়। আবার জাতীয়তাবাদও একদিন অসম্পূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। যুক্তি কখনও শ্রেণী ও সংঘবদ্ধ স্বার্থের সহায়ক, আবার কখনও সে এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করবার মন্ত্রণাদাতা। মানবতাবাদের দিকে প্রসারিত এই যে যাত্রা, যুক্তি তাতে পথপ্রদর্শক।

মানুষের স্বাতিক্রমণের যেমন একটা বাইরের ইতিহাস আছে, তেমনি আছে একটা ভিতরের পথ। এদুটি পথ পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। সমাজে ব্যক্তির একটা বিশেষ পরিচয় থাকে, পরিবার পেশা পদাধিকার এই সব নিয়ে সেই পরিচয়। আমাদের অহং এই নিয়ে একটা বিশেষ রূপ ধারণ করে, জীবন ও জগতের কাছ থেকে নানা প্রত্যাশায় নিজেকে পরিবৃত করে। তখন যুক্তির কাজ হয়। এই সব প্রত্যাশাকে পূর্ণ করাবার উপায় উদ্ভাবন। এরই সঙ্গে যুক্ত করে আমরা পরিপার্শ্বের প্রতিটি বস্তুর মূল্য নির্ধারণ করি।

এই পরিচয়কেও অতিক্রম করা যায়। সমাজ ছাড়া মানুষের চলে না। কিন্তু মানুষের পদাধিকার অথবা অন্য কোনো সামাজিক পরিচয়ই তার শেষ পরিচয় নয়। খণ্ড খণ্ড জৈব প্রয়োজন অথবা বাসনায়ও মানুষের স্বরূপের পরিমাপ হয় না। সমস্ত প্রত্যাশা অতিক্রম করে মানুষ যখন বিশ্বের দিকে তাকায়, তখন যে মায়া তার সহজাত তারও একটা আশ্চর্য রূপান্তর সম্ভব। সেই রূপান্তর এমনই যে, অন্যান্য রূপের তুলনায় তাকে “অরূপ” বলায়। অসঙ্গতি নেই। তাকে কখনও বলা হয়েছে মুক্তি। “অরূপ তোমার বাণী। অঙ্গে আমার চিত্তে আমার মুক্তি দিক সে আনি।”

রূপ থেকে অরূপে এই যে প্রবেশ, যুক্তির সঙ্গে এর কোনো বিরোধ নেই, কিন্তু যুক্তির পূর্বনির্ধারিত পথেও এটা ঘটে না। মানুষ এখানে যুক্তিকে খণ্ডন করে না, অতিক্রম করে যায়, যেমন মহৎ প্রেমের অথবা অপার বিস্ময়ে আমরা যুক্তিকে খণ্ডন করি না, তবু অতিক্রম করি। এই অতিক্রমণের পরও প্রত্যাবর্তনের পথ উন্মুক্ত রাখা চাই। প্রত্যাবর্তনহীন বিস্ময়, নিস্পন্দ উৰ্দ্ধবাহুর মতোই চিত্রার্পিত। আনন্দের ধনকে বার বার হারিয়ে নতুন করে পাওয়া–এরই ভিতর দিয়ে প্রাণের জয়। তেমনি করেই রসের সেই ধারাটি অব্যাহত থাকে, যাতে বার বার ধৌত এবং স্নাত হয়ে তবেই জীবন কিঞ্চিৎ পরিমাণে ক্লেদমুক্ত হয়।

মানুষের ভিতর এই যে আশ্চর্য শক্তি, যেটা কখনও অন্ধ আবেগের মতো তাকে পিছন থেকে ঠেলছে আবার কখনও জ্যোর্তিময় আদর্শের মতো সমুখ থেকে আকর্ষণ করছে, মানুষের প্রকৃত সত্তার সঙ্গে যার সম্পর্ক অন্তরঙ্গ অথচ জড়শক্তি বললে যার প্রকৃতি ব্যাখ্যাত হয় না। বিচিত্র চিন্তা প্রতিষ্ঠান ও নানাপরিবর্তনের ভিতর যাকে আমরা যুগে যুগে পাই নানারূপে তারই অভিব্যক্তির বিভিন্ন পর্যায় সম্বন্ধে এই বইটিতে কিছু বলবার চেষ্টা করেছি, সমকালীন ব্যক্তি ও সমাজের সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে।

.

কমলা বক্তৃতা ও অন্যান্য ভাষণ (প্রথম প্রকাশ ১৩৯১, ১৯৮৪) : ভূমিকা

এ আমার সৌভাগ্য যে রবীন্দ্রনাথ তথা রাধাকৃষ্ণণ প্রমুখ জ্যোতিষ্মন পূর্বসুরী যে বক্তৃতামালায় গ্রথিত সেই কমলাবক্তৃতা দানের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে কলকাতা। বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে সম্মানিত করেছেন। এই ডাক যে আধুনিক ভারতীয় ভাবনা ধারণাকে তুলনামূলক পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করার পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী সময়টিতেই আমার কাছে এল সেদিক থেকেও আমি ভাগ্যবান।

ইতিহাস ও ভূগোল দুইয়ে মিলে ভারতকে স্থান দিয়েছে দুই জগতের মাঝখানে, ভারতের উচ্চাশাসে এই দুইয়ের মাঝখানে সেতু বাঁধবে। যদিও আধুনিক ভারতীয় ভাবনার সারভাগের অনেকটাই বেড়ে উঠেছে জাতীয় অভ্যুত্থানের প্রভাবচিহ্নিত আবহে, সর্বাপেক্ষা সৃজনধর্মী ভাবুকদের তবু ক্রমাগতই চেষ্টা করতে দেখা গেছে যাতে তাদের স্বীয় ভাবনাধারণাগুলি বিশ্বের বৃহত্তর ভাবনাধারণার সঙ্গে বিশ্বসমস্যার পটভূমিতে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে। আমি যে কটি ভাষণ দেবো তার তৃতীয় অর্থাৎ শেষ ভাষণে আমি দুই মহান ভারতীয় ভাবনাবিদের কিছু অবদানের কথা বিশেষভাবে আলাদা করেই বলবো, কিন্তু যে। সমস্যা নিয়ে প্রধানত আমার কথা সে সমস্যা সারা বিশ্বের প্রাসঙ্গিক।

আমরা এমন এক যুগে বেঁচে আছি নৈতিক বিভ্রান্তি যার প্রধান লক্ষণ। আমি নৈতিক অবক্ষয়ের কথা বলছি না, বলছি নৈতিক বিভ্রান্তির কথা। যে পৃথিবী প্রধানত মানুষেরই গড়া সেইখানে যেন সে নিজের পথ হারিয়েছে।

কোনো সমাজদর্শনকে যদি আমাদের যুগের পক্ষে যথেষ্ট উপযোগী হয়ে উঠতে হয় তাহলে কয়েকটি মূল শর্ত তাকে পূর্ণ করতে হবে। স্বাধীনতা, সাম্য, শান্তি, এই সব শব্দময়। ভাবকে ঘিরে আজকের যুগের মর্মর্গত যে আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত, সেই গভীর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এই সমাজদর্শনের সুর মেলা চাই। উল্লিখিত প্রতিটি শব্দেরই সংজ্ঞাতিরিক্ত দ্যোতনা লক্ষণীয়। যথা শান্তির প্রাসঙ্গিকতা একদিকে যেমন রয়েছে ব্যক্তির অন্তরে অন্যদিকে তেমনি রয়েছে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলির ভিতরে। মনের গভীরে অচঞ্চল শান্তির জন্য। ব্যাকুলতা আগের চেয়ে এখন একটুও কম নয়, কিন্তু কোন পথে মিলবে এই অচঞ্চলতা তার নিশানা আগের তুলনায় যেন আমরা আরো কম জানি। একটি অখণ্ড পৃথিবী যার ভিতরে খণ্ডাংশগুলি নির্বিরোধে পরম্পর লগ্ন তার প্রয়োজন আজকেই সবচেয়ে বেশী। জরুরি। অথচ এক্ষেত্রেও কিসের ভিত্তিতে এই অখণ্ড ঐক্যসাধন হবে সে বিষয়ে একমত। তো আমরা নই-ই, কোনো পরিচ্ছন্ন ধারণাও আমাদের মেই।

মনুষ্যজাতি তাই আজ স্পষ্টতই এমন এক বিরুদ্ধতার সম্মুখীন যা অতীতের সমস্ত সমস্যার চেয়েও ভয়াবহ এবং দুর্গম। একদিকে দেখা যাচ্ছে বিশ্বশান্তিই মনুষ্যজাতির সমূহ সর্বনাশের বিকল্প। অন্যদিকে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়ে গেছে যে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে রাখার যোগ্যতা যুগের প্রধান তত্ত্ববিশ্বাস এবং মতবাদগুলি অর্জন করে উঠতে পারেনি।

হিন্দুধর্মের মতো কোনো কোনো ধর্মমত কোনদিনই নিখিলবিশ্বধর্ম হয়ে উঠতে চায়নি। অন্যদের এই আকাঙ্ক্ষা ছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ, খৃষ্টান ধর্মচারকগণ শুধু যে ভাবতেন যে, মুক্তির পথ তাঁদের জানা আছে তাই নয়, স্পষ্টতই তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে আজ হোক কাল হোক, পৃথিবীর সর্বত্র সকল মানুষকে তাঁদের বিশ্বাসের প্রতি আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে এবং এভাবেই এক নির্ধ অখণ্ড বিশ্বের ভিত্তি তৈরী হবে। আজ নিশ্চয় খুব অল্প সংখ্যক মানুষই যুক্তিসম্মতভাবে এ আশাকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম যে ধর্মান্তকরণের সাহায্যে মনুষ্যজাতি এক হবে।

কিছুদিন আগে পর্যন্ত মার্ক্সবাদীদের উগ্র বিশ্বাস ছিল সারা বিশ্বে ধনতন্ত্রের অবসান ও সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা সমাসন্ন। ইতিমধ্যে ছবি গেছে পালটে। ধনতন্ত্রের পতন অবশ্যম্ভাবী। হতেই পারে কিন্তু যে-মার্ক্সবাদ সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রসমূহের ভিতরই ঐক্য ও শান্তি স্থাপনে ব্যর্থকাম, সেটি স্পষ্টতই বিশ্বচিন্তাধারার পুরোধা হিসেবে সর্বজনগ্রাহ্য হবে না। বর্তমান দ্বিধা ও বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি নেই ঐ পথে, দ্বিধা ও বিভ্রান্তির আরো একটি দৃষ্টান্ত বরং রয়েছে এখানে।

চারিদিকেই চোখে পড়ে, ঘোষিত উদ্দেশাদি যার যেমনই হোক না কেন প্রাচীনপন্থীদের পুনরভ্যুত্থানকামী আন্দোলন এবং সামরিক মতাদর্শ আজকের দিনের বিভেদকারী শক্তি হিসেবেই জোরদার হয়ে উঠেছে। যে দুরূহ বিপন্নতাকে এই সব গোষ্ঠী ডেকে আনতে সক্ষম তাকে পরাস্ত করার ক্ষমতা তাদের নেই। এই সমস্যাটির বিষয়ে ক্রমশই অধিকসংখ্যক মানুষ তীক্ষ্ণভাবে সচেতন হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এখনো গোলোকধাঁধা থেকে উদ্ধারের পন্থা মেলেনি। বর্তমানের অসহনীয় নৈতিক অনিশ্চিত এবং ভবিষ্যৎ বিষয়ে বিভ্রান্তি, এতেই জন্ম নেয় নানা উত্তেজক মতবাদ, আর কঠিন হতাশা থেকে বাঁচবার প্রলোভন অনেক ক্ষতির মূল্যে ওই সব মতবাদে সাময়িক আশ্রয় নেয় মানুষ। কখনো আবার এর ফলে গড়ে ওঠে এক স্কুল রুচির সংস্কৃতি। ইচ্ছে করেই মানুষ আঁকড়ে ধরে অগভীর সাংস্কৃতিক মেজাজকে। নিজের কালের নীতি ও বুদ্ধির গভীরতর জটিল জাল থেকে উত্তরণ যখন অসাধ্য বোধ হয় তখন আত্মবিশ্বাসে আস্থাহীন মানুষ ভিতরে গভীরতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে উদ্ধার খোঁজে বাইরের মাতনে।

তবে এই সংকটের ফল তো সদর্থকও হতে পারে। এ আশা অসম্ভব নয় যে মানুষের মন এবং সমাজের ক্রমবির্তন বিষয়ে প্রাচীন সংহত ভাবনাগুলি নবসৃষ্টির উদ্যমে এগিয়ে যাবে এবং সেই প্রচেষ্টায় প্রকাশ্য হবে বহু প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনা, সম্পৃক্ত হয়ে যাবে আবহমানের সঙ্গে সমকালীন মানুষ আর তার অভিজ্ঞতা। এখন প্রয়োজন বিকল্প চিন্তাধারা বা মতাদর্শের নয়। বরং মূল্যবোধ, প্রতিন্যাস ও উপযোগী প্রতিষ্ঠানের সমাহারে এমন এক প্রশস্ত কাঠামোর প্রয়োজন যাতে বহু বিচিত্র ভাবনাধারণা পরস্পর নির্বিরোধ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হতে পারে এবং তারই সাহায্যে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে মনুষ্যসমাজকে পরবর্তী অগ্রগতির স্তরে উন্নীত করে দেয়।

সমাজ সংস্কৃতি স্মৃতি (প্রথম প্রকাশ, ১৯৮৭) : ভূমিকা সমাজ ও সংস্কৃতির ভিতর সীমারেখা টানা যায় না। প্রবন্ধগুলি সাজাবার সুবিধার জন্য। একটা রেখা টানা হয়েছে। সেটাকে গুরুত্ব দিলে ভুল হবে। সমাজ বস্তুটি সংস্কৃতি দিয়ে গঠিত’, কথাটা বলা হয়েছে এই বইয়ের কোনো এক পাতায়।

উন্নয়নের তত্ত্ব ও ভবিষ্যৎ (প্রথম প্রকাশ জানুয়ারী, ১৯৮৭) : ভূমিকা

অশোককুমার সরকার ছিলেন সংবাদ জগতের এক দিকপাল। তাঁর মতো বড় সংগঠক বাঙালীর ভিতর কম দেখা যায়। নানা মানবিক গুণে ও ব্যক্তিত্বের মাধুর্যে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। অশোককুমার সরকার স্মৃতি বক্তৃতামালায় আমন্ত্রিত হয়ে আমি সম্মানিত বোধ করছি।

সাংবাদিকের কারবার প্রধানত ‘নিউজ’ এতি খবর নিয়ে। এর দুটি দিক আছে।

এক হল তার নতুনত্ব নিউজ মানেই তো যা নতুন–তার নাটকীয় অথবা চাঞ্চল্যকর দিক। অন্য হল ইতিহাসের উপাদান হিসেবে তার স্থায়ী তাৎপর্য। সাংবাদিক যাকে News বলেন তাতে খবরের চাঞ্চল্যকর দিকটাই প্রাধান্য পায়। তবে ঘটনা স্থায়ী তাৎপর্য বুঝতে হলে তাকে দেখতে হবে আরো একটু বিস্তৃত ঐতিহাসিক পটভূমিকায়, তাকে মুক্ত করতে হবে বর্তমানের সমস্যা আর ভবিষ্যতের আশার সঙ্গে।

অশোককুমার সরকার স্মারক বক্তৃতার জন্য যে বিষয়টি আমি বেছে নিয়েছি সেটি এদিক থেকে উপযোগী বলে মনেকরি। উন্নয়ন নিয়ে রোজই কিছু খবর চোখে পড়ে। বিস্তর আলোচনা চলছে এদেশে ও বিদেশে। অর্থনীতি রাজনীতি ও সমাজনীতি এই সবের সঙ্গে তার যোগ। বিষয়টি তলিয়ে বুঝতে হলে কিছুটা তাত্ত্বিকজ্ঞান এবং একটা বড়। পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজন। অতীতকে সেখানে অবহেলা করা যাবে না, আবার ভবিষ্যৎকেও আনতে হবে চিন্তার পরিধির ভিতর। বিষয়টি এতই বিস্তৃত যে দুটি বক্তৃতায় তার সব দিক নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়। খানিক চিন্তা উসকে দিতে পারলে আমি সন্তুষ্ট। সমকালের দিগভ্রান্ত যাত্রাপথে মননের সামান্য আলো আমার অন্বিষ্ট। মুখবন্ধ হিসেবে এই কটি কথা বলে। নেওয়া গেল। এবার প্রবেশ করা যাবে মূল বিষয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *