৮.২ বর্তমান সংকটে কর্তব্য
যে চীনের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ সে-চীন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে অভ্যস্ত। গত ৩৫ বছর যাবৎ এরা ক্রমাগত যুদ্ধের ভেতর দিয়েই চলেছে। ১৯২৭-এ গৃহযুদ্ধের শুরু। তারপর চীন জাপানের লড়াই চললো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এলো। গৃহযুদ্ধের যদি অবসান হলো ১৯৪৯-এ, ১৯৫০-এ আবার কোরিয়ায় যুদ্ধ। তারপর তিব্বতে। তারপর ভারতের সীমান্তে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে যারা আমাদের সীমান্তে আজ যুদ্ধ করছে, সারাজীবন ধরে যুদ্ধ করা এদের অভ্যেস। আরো ৩৫ বৎসর যদি এদের যুদ্ধ করতে হয়, তাহলে সেটা তাদের কাছে অন্তত অভ্যাসের ব্যতিক্রম হবে না। এই কথা জেনেই আমাদের তৈরি হওয়া দরকার। চীনের আশা এত ছোট নয় যা ছ মাসের যুদ্ধে পরিপূর্ণ হতে পারে। যুদ্ধের কায়দা, যে কায়দা ওদের নেতা মাও সে তুং বহু বৎসরের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে রপ্ত করেছেন, সেটাও আমাদের মনে রাখা দরকার। লেনিন বলেছিলেন, দুপা এগিয়ে এক পা পিছোবে। মাও সে তুং এই কথাটাকে আরো অনেকখানি চালাকি দিয়ে ভরেছেন। শান্তিকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে। যুদ্ধে দুপা এগোবে। শান্তির কথা বলে একপা পেছুবে। শান্তির কথা বলে প্রতিপক্ষকে ঘুম পাড়াবে। তারপর আবার এগোবে। এই নীতি নিয়ে চীন চলবে। যদি তাই-ই হয় আমাদের তা মনে রাখা দরকার। এই আমার প্রথম বলবার কথা।
দ্বিতীয় কথা এই, আমাদের মনে রাখতে হবে যুদ্ধ যদি করতেই হয়, আমরা নানা দেশের কাছ থেকে সাহায্য নেব। কিন্তু এমন মোহ যেন মনে আমরা স্থান না দিই যে, আমাদের যুদ্ধ অন্য কেউ এসে করে দিয়ে যাবে। একথা যেন আমরা মনে না করি যে, মার্কিন দেশের সৈন্য, ইংরেজ সৈন্য বা অন্য কোন দেশের সৈন্য এসে চীনের বিরুদ্ধে। আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা করে যাবে। অস্তু অন্যদেশ থেকে আমরা হয়ত পাব, এবং পেলে। নিশ্চয়ই নেব। জনবল আমাদের আছে এবং সেই জনবলের যাতে ব্যবহার হয়, এদেশের। সৈন্যবাহিনী যাতে যথেষ্ট বড় আকারের হয়, সে চেষ্টা এদেশে দাঁড়িয়েই করতে হবে। কোনো দেশ নিজের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে পারে না অন্যদেশের সাহায্যের ওপর নির্ভর। করে। যে স্বাধীনতা চায় সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখে। আমাদের তাই একথাই মনে রাখতে হবে যে আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই যুদ্ধ। আমাদের যা শক্তি আছে, সেই শক্তি নিয়েই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে হবে। তাছাড়া শুধু সৈন্য জোগাড়ের প্রশ্নও নয়। সারা দেশকে এই সৈন্যদের রসদ জোগাতে হবে। ক্ষেতে খামারে কলে কারখানায় যাঁরা কাজ করছেন তারাও দেশকে যুদ্ধের উপযুক্ত অবস্থায় রাখবার সহায়তা করছেন। একথা সকলেরই জানা। তবু বারবার মনে রাখতে হয়। আমরা সবাই যুদ্ধ করতে যাব। এমন নয়। কিন্তু যে যেখানেই আমরা আছি সেখানে দুজনের কাজ যদি একজন করতে পারি তাহলে একটি লোক ছাড়া পায় যে অন্য কাজ এগিয়ে দিতে পারে। আমরা যে যেখানে আছি সেখানে আমাদের যথাসাধ্য শক্তি অনুযায়ী যদি চেষ্টা করি, তাহলে সে চেষ্টার ফলে দেশের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। আমার দ্বিতীয় কথা তাই, এই, আবারও বলছি এ বিশ্বাস আমাদের মনে যেন স্থান না পায় যে, অন্য কোনো দেশ এসে আমাদের যুদ্ধে জয়ী করিয়ে দিয়ে যাবে। আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই চালাতে হবে। অন্যের সাহায্য পেতে পারি, কিন্তু আমাদের প্রধান নির্ভর নিজেরই শক্তিতে। যেমন সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে যখন জামানীর যুদ্ধ হচ্ছিল তখন সোভিয়েট ইউনিয়ন লেন্ড লীজ ব্যবস্থা অনুযায়ী মার্কিন দেশের কাছ থেকে প্রচুর সাহায্য পেয়েছিল; কিন্তু সোভিয়েট ইউনিয়নের যুদ্ধ সোভিয়েট ইউনিয়নই চালিয়েছে। আমরাও যা পাব নেব; কিন্তু সব নেবার পরেও যদি আমাদের। স্বাধীনতা রাখতে হয়, আমাদের দাঁড়াতে হবে আমাদের শক্তি নিয়ে একথাটা যেন আমরা মনে রাখি।
আমার তৃতীয় কথা এই, আজকে আমাদের সীমান্তে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, সে যুদ্ধ শুধু দুই দেশের ভিতর যুদ্ধ নয়, সে যুদ্ধ দুই আদর্শের ভিতর যুদ্ধ। এই কথাটা বিশেষভাবে বলবার প্রয়োজন এই সভায়। কারণ আজকের সভায় যাঁরা উপস্থিত সাহিত্যিক শিল্পী মননশীল মানুষ, এদের অনেকেই আদর্শ নিয়েই চিন্তা করবেন, আদর্শ নিয়েই লিখবেন, কাজ করবেন। আমাদের ভিতর কেউ হয়ত সৈন্য হয়েও রণাঙ্গনে যেতে পারেন, কিন্তু সবাই যাবেন না। কেউ হয়ত ক্ষেতে খামারে কলকারখানায় কাজ করবেন, কিন্তু অনেকেই করবেন না। এখানে যাঁরা সমবেত হয়েছেন তাঁদের অনেকেই হয়ত কাজ করবেন চিন্তার ক্ষেত্রে, শিল্পের ক্ষেত্রে। সেই জন্যই এ যুদ্ধ যে দুই আদর্শের লড়াই, সেই কথাটা আজকে এখানে বিশেষভাবে মনে রাখবার প্রয়োজন। কথাটা আর একটু বিস্তারিত করে বলা যাক।
ভারতবর্ষ এবং চীন এই দুই দেশই আজ অর্থনৈতিক গঠনের কাজে, শিল্প উন্নয়নের কাজে ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় রচনা করতে লেগেছে। একথাটা মনে রাখাই ভাল যে, এমন কোন ব্যবস্থা নেই যে-ব্যবস্থার ফলে কোনোরকম কষ্ট ছাড়াই অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব হয়। এমন কোন পথ আমেরিকা বা সোভিয়েট ইউনিয়ন, ইংরেজ বা জাপান বের করতে পারেনি যে-পথে দুঃখ কষ্ট ছাড়াই শিল্পোন্নতি সম্ভব হয়। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি যে, অর্থনৈতিক গঠনের এই যুগে যত কষ্টের ভিতর দিয়েই আমাদের যেতে হোক না কেন তবু মানুষের কয়েকটা বড় আদর্শকে আমরা বাঁচিয়েই পথ চলতে পারব। আমরা বিশ্বাস করি যে, মানুষের স্বাধীনতার যে-আদর্শ নিজের চিন্তা এবং বিবেক অনুযায়ী মানুষের পথ। বেছে নেওয়ার যে আদর্শ, সে আদর্শকে রক্ষা করেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে চলা। সম্ভব। এই আমাদের বিশ্বাস। এ বিশ্বাস নয় আজকের চীনের। এই দুই বিপরীত বিশ্বাসের মধ্যে আজ সংগ্রাম।
মনে রাখা দরকার যে এই দুই আদর্শের ভিতর যে সংগ্রাম সে শুধু ভারত নামক একটা ভূখণ্ডেরই স্বার্থের সঙ্গে জড়িত নয়। কম্যুনিস্টরা বিশ্বাস করেন যে, যদি পৃথিবী জোড়া গণতন্ত্রকে আজ শেষ করতে হয়, তাহলে প্রথম ধ্বংসের কাজ শুরু করতে হবে এশিয়ায়, বিশেষত ভারতবর্ষে। সোভিয়েট ইউনিয়নের লালফৌজ পশ্চিম দিকে যতখানি এগোতে পেরেছে এগিয়েছে, চেকোশ্লোভেকিয়া পর্যন্ত। এবার যদি লালফৌজকে এগোতে হয় তবে তার গতি হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এবং প্রধানত ভারতবর্ষে। শ্রদ্ধেয় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় মেবারের সেই চারণ কবির কথা বলেছেন, যিনি রাণা প্রতাপকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি মেবারের শেষ স্বাধীনতার শৃঙ্গ। আজকে এশিয়ায় ভারতবর্ষ। শেষ স্বাধীনতার শৃঙ্গ। ভারতবর্ষকে তাই দাঁড়াতে হবে। যদি ভারতবর্ষ তার স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে না পারে তাহলে এশিয়ায় এবং পৃথিবীর একটা বড় অংশে স্বাধীনতা বিপন্ন এমন কি ধ্বংস হতে পারে। আমাদের সংগ্রাম শুধু আমাদেরই সংগ্রাম নয়, আমাদের সংগ্রাম আজ বিশ্বজোড়া স্বাধীনতার সংগ্রামের এক বিশেষ অংশ। একথা আজ আমাদের। বারবার স্মরণ করতে হবে।
আমাদের দেশের ভিতর এমন অনেক লোক আছেন যাঁরা আমাদের এই আদর্শে বিশ্বাস করেন না। আমার পূর্ববর্তী বক্তারা নানাভাবে তাঁদের কথা উল্লেখ করেছেন। আমিও অল্প কয়েকটি কথা বলছি। কম্যুনিস্টরা চীনের আক্রমণে সবাই অখুশি হয়েছেন এ মনে করবার কোন কারণ নেই। নিজেকে কম্যুনিস্টদের জায়গায় বসিয়ে কথাটা একবার বিচার করে দেখুন। ওঁদের সামনে এদেশে ক্ষমতায় আসবার আর কোন পথ খোলা আছে। ওঁরা ১৯৪৮-৪৯এ চেষ্টা করেছিলেন। সশস্ত্র অভূত্থানের ভিতর দিয়ে ক্ষমতায় আসতে; সেদিন তেলেঙ্গানার পথ ব্যর্থ হয়েছিল। তারপর চেষ্টা করেছেন যাকে পালামেন্টারী পথ বলা হয়, সেই পথে ক্ষমতায় আসতে। আবারও ব্যর্থ হয়েছেন। যদি দেশের ভিতর সশস্ত্র অভূত্থানের পথ এবং পালামেন্টারী পথ দুইই ওঁদের সামনে বন্ধ হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে ওঁরা, অন্তত ওঁদের অনেকে, কেন মনে করবেন না যে, একমাত্র যা খোলা আছে আজকেও তা হল পূর্ব ইউরোপের পথের এক নতুন চীনা সংস্করণ? পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েটের লালফৌজ এসে কম্যুনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। এখানেও তাই হতে পারে। চীনের লালফৌজ আসামে এসে, আসাম থেকে ভারতীয় ফৌজকে তাড়িয়ে সেখানে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির এক সরকার গঠন করিয়ে দিতে পারেন। এবং তারই ফলে আজকেও ভারতবর্ষে কম্যুনিস্টদের এক নতুন ইয়েনা তৈরী হতে পারে। সেখান থেকে কম্যুনিস্ট আন্দোলন কেন নয়? আরও ২৫ বছর ধরে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে এবং ক্রমশ এগুবে। চীনের আক্রমণে কম্যুনিস্ট দল অখুশী হবেন একথা মনে করার কী কারণ আছে? বহু কষ্টে উচ্চারিত ওঁদের মুখের কথা? ওরা চীনের আক্রমণে যদি অখুশী না হন, মনে মনে যদি এ আশাটুকুই জেগে থাকে যে লক্ষ্যে পৌঁছবার এই একটা তৃতীয় দরজা খুলে গেল, তাহলেই কী ওরা আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে সে কথা বলবেন? আমাদের কি ধরেই নিতে হবে যে, কম্যুনিস্টদের বিন্দুমাত্র বুদ্ধি নেই? যদি বিন্দুমাত্র বুদ্ধি থাকে তাহলে কি ওঁরা চীনের আজকের এই প্রসারে আনন্দিত হয়েও রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা করবার জন্যই বাইরে থেকে যাঁরা ক্ষমতা নিয়ে আসছেন তাঁদের হাত থেকে ক্ষমতা পাবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মনের আসল কথাটা গোপন করবেন না?
ওঁরা কি এতবড় সত্যবাদী! ওঁরা কি এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে বেরিয়েছিলেন যে, বিপ্লবে জয়ী। হবার জন্যে ওঁরা কখনো মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না? ওঁরা কি অহিংস? আমরা যদি ওঁদের মন বুঝবার সামান্য চেষ্টা করি তাহলে আমাদের বোঝা কঠিন হওয়া উচিত নয় যে, কম্যুনিস্ট দলের অন্তত একটা বড় অংশ একথাই ভাবছেন যে, যেহেতু ভারতবর্ষে ক্ষমতায় আসবার অন্য পথ বন্ধ, অতএব লালফৌজের হাত থেকে ক্ষমতালাভের পথেই ওঁদের আজ প্রধান ভরসা। আমি কম্যুনিস্টদের একথা বলে দোষ দিচ্ছি না যে ওরা নিজেদের আদর্শে বিশ্বাস করেন না; বরং একথাই বলছি যে, ওঁরা নিজেদের আদর্শে বিশ্বাস করেন বলেই আজকে মিথ্যাচরণ ওঁদের ধর্ম।
আজকে শিল্পী, সাহিত্যিক এবং চিন্তাশীল লোক যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তাঁদের সামনে আরও একটি কথা আমি বিশেষভাবে জানাতে চাই। কম্যুনিস্টরা দেশের শত্রুতা করবেন এটাই আজ স্বাভাবিক। তাঁদের বাধা দেওয়া কিছুটা পুলিশের কাজ। কিন্তু পুলিশের কাজ ছাড়াও যাঁরা চিন্তাশীল লোক এবং গণতন্ত্রে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁদের নিজেদের আর একটি কাজ আছে। পুলিশ তার নিজের ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকবেন। কিন্তু চিন্তাশীল লোকদের চিন্তনের যে ধর্ম সে ধর্মে তাঁরাও যেন প্রতিষ্ঠিত থাকেন। মনে রাখতে হবে যে, আদর্শের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আর একটি আদর্শকে তুলে ধরতে হয়। এমন এক একটা সময় আসে যখন কোন মিথ্যা আদর্শের পিছে শত সহস্র আদর্শবাদী যুবক ছুটে যায়। বারবার তাই হয়েছে। ইতিহাস শেখায়, জীবন শেখায়, কিন্তু অনেক মূল্যে শেখায়। অনেক ব্যর্থ সন্ধানের পর, অনেক মূল্য দিয়ে তবে সমাজ শেখে, এটা ভুল পথ। মিথ্যা ছলনার জালে। ইতিহাসের সৃষ্টির পথ বিকীর্ণ। আমাদের দেশে কম্যুনিস্টদের আমরা যেন আদর্শবাদী বলেই স্বীকার করি; ভুল আদর্শ এই যা বিপদের কথা। আরো কত মূল্য দিতে হবে, আরো কত রক্ত বইবে, তারপর ওঁরা ওঁদের আদর্শের ভ্রান্তি বুঝতে পারবেন, জানি না।
ইতিমধ্যে আমাদের যুগে অনেক অভিজ্ঞতা তৃপীকৃত হয়েছে। কম্যুনিস্টরা কৃষক মজুরদের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। সোভিয়েট ইউনিয়নে, চীন দেশে, জোর জবরদস্তি করে যৌথ খামার প্রতিষ্ঠার নামে লক্ষ লক্ষ চাষীকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে সাইবেরিয়ায় সিংকিয়াং-এ পাথর ভাঙতে বসিয়ে স্বল্পাহারে রেখে পলে পলে তিলে তিলে মারা হয়েছে। আদর্শের অপলাপের আরো কত প্রমাণ চাই? চীনের সেই শতপুষ্প সমাচার আপনারা জানেন, বু আর একবার বলি। ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে কথা বলা যাক। আজকের চীন তার নাম পেয়েছিল বহু বছর আছে চীন বংশের নাম থেকে। সেই বংশ যখন রাজতে এলেন তার আগে চীনের একটা গৌরবময় অধ্যায় কেটে গেছে। কনফুসিয়াস লাওৎসে আরো অনেক বড় বড় দার্শনিক তাঁদের বাণী প্রচার করে গেছেন। চিন্তা এবং সংস্কৃতির নেতারা চারদিকে ফুল ফোঁটালেন নতুন দর্শনের এবং নতুন শিল্পের সেই যুগকে চীনে শতপুষ্পের যুগ বলা হয়েছে। তারপর এলেন ঐ প্রতাপশালী চীন বংশ। সেটা খ্রীস্টের জন্মের প্রায় আড়াই শ’ বছর আগে। ঐক্যের নামে চীনকে একাকার করা হল। চীনে এত দার্শনিক এত ভাষায় এত কথা বলেছেন! হুকুম এলো সব বই এক সঙ্গে পুড়িয়ে দাও। তারপর বহু যুগ কেটেছে। আজ এসেছেন মাও সে তুং। তিনি সেই চীন বংশের সম্রাটের চেয়ে আরও চতুর। ভিন্ন মতাবলম্বীদের বহুভাবে উৎপীড়ন করবার পর চীনের এই নতুন যুগের নেতাটি ভাবলেন, এবার কিছু প্রতিবাদ শোনা যাক! ১৯৫৭ সালে বললেন, আবার শতপুষ্প ফুটুক! আবার শতপুষ্প ফুটুক আশ্বাস পেয়ে কিছু বুদ্ধিজীবি কম্যুনিস্ট-দর্শনের এবং কম্যুনিস্ট শাসনের প্রতিবাদে সাহস করে নিজেদের বক্তব্য বললেন। ফলে হাতে হাতে এরা ধরা পড়ে গেলেন! তারপর এদের দিয়ে দোষ স্বীকার করাবার পালা। এঁরা কবুল করলেন, আমরা ক্যাপিটালিস্টদের অনুচর, আমরা দোষ করেছি! নানারকম অকথ্য শাস্তিবিধান হল এঁদের জন্য। স্বাধীনতার ক্ষেত্রে, চিন্তার ক্ষেত্রে, এই হলো নতুন চীনের মত ও পথ। ওঁরা। বিশ্বাস করেন না যে, মানুষকে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে দেওয়ার ভিতরে কোন গৌরব আছে। আমরা বিশ্বাস করি।
আমাদের বিশ্বাস নিয়ে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। এদেশে নতুন যুগের তরুণ তরুণীরা আবারও যাতে একটা মিথ্যা আদর্শের পিছনে গিয়ে জীবন নষ্ট না করেন সেজন্য। নতুন আদর্শের কথা বলে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের। ইতিহাসে এমন মুহূর্ত সব সময় আসে না–মাঝে মাঝে শুধু আসে–যখন একটা জাতি, একটা দেশ, নিজের সামনে এমন কোন মহৎ উদ্দেশ্য খুঁজে পায়, যে উদ্দেশ্যে সারা জীবন সমর্পণ করে ধন্য হওয়া যায়। যদি আজ ইতিহাস আমাদের সম্মুখে সেই সুযোগ এনে দিয়ে থাকে আমরা যেন সেই মহৎ উদ্দেশ্যে নিজেকে উৎসর্গ করে ধন্য হতে পারি।
———
গত ৯ ডিসেম্বর ১৯৬২ মহাজাতি সদনে বাঙালী সাহিত্যিক শিল্পী ও বুদ্ধিজীবিক্ষের এক মহতী জনসভায় প্রদত্ত ভাষণের অনুলিপি।