৮.১ পরিশিষ্ট–১
তৃতীয় চরণ
অথবা
মানবমন ও সমাজবিবর্তনের পবানুক্রম
ভূমিকা
এ আমার সৌভাগ্য যে রবীন্দ্রনাথ তথা রাধাকৃষ্ণণ প্রমুখ জ্যোতিষ্মন পূর্বসূরী যে বক্তৃতামালায় গ্রথিত সেই কমলাবক্তৃতা দানের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে সম্মানিত করেছেন। এই ডাক যে আধুনিক ভারতীয় ভাবনাধারণাকে তুলনামূলক প্রেক্ষিতে স্থাপন করার পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী সময়টিতেই আমার কাছে এল সেদিক থেকেও আমি ভাগ্যবান।
ইতিহাস ও ভূগোল দুইয়ে মিলে ভারতকে স্থান দিয়েছে দুই জগতের মাঝখানে, ভারতের উচ্চাশা সে এই দুইয়ের মাঝখানে সেতু বাঁধবে। যদিও আধুনিক ভারতীয় ভাবনার সারভাগের অনেকটাই বেড়ে উঠেছে জাতীয় অভ্যুত্থানের প্রভাবচিহ্নিত আবহে, সর্বাপেক্ষা সৃজনধর্মী ভাবুকদের তবু ক্রমাগতই চেষ্টা করতে দেখা গেছে যাতে তাদের স্বীয় ভাবনাধারণাগুলি বিশ্বের বৃহত্তর ভাবনাধারণার সঙ্গে বিশ্বসমস্যার পটভূমিতে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে। আমি যে ক’টি ভাষণ দেবো তার তৃতীয় অর্থাৎ শেষ ভাষণে আমি দুই মহান ভারতীয় ভাবনাবিদের কিছু অবদানের কথা বিশেষভাবে আলাদা করেই বলবো, কিন্তু যে-সমস্যা নিয়ে প্রধানত আমার কথা সে সমস্যা সারা বিশ্বেই প্রাসঙ্গিক।
আমরা এমন এক যুগে বেঁচে আছি নৈতিক বিভ্রান্তি যার প্রধান লক্ষণ। আমি নৈতিক অবক্ষয়ের কথা বলছি না, বলছি নৈতিক বিভ্রান্তির কথা যে-পৃথিবী প্রধানত মানুষেরই। গড়া সেইখানেই যেন সে নিজের পথ হারিয়েছে।
কোনো সমাজদর্শনকে যদি আমাদের যুগের পক্ষে যথেষ্ট উপযোগী হয়ে উঠতে হয় তাহলে কয়েকটি মূল শর্ত তাকে পূর্ণ করতে হবে। স্বাধীনতা, সাম্য, শান্তি, এইসব শব্দময় ভাবকে ঘিরে আজকের যুগের মর্মর্গত যে-আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত, সেই গভীর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এই সমাজদর্শনের সুর মেলা চাই। উল্লিখিত প্রতিটি শব্দেরই সংজ্ঞাতিরিক্ত দ্যোতনা লক্ষণীয়। যথা, শান্তির প্রাসঙ্গিকতা একদিকে যেমন রয়েছে ব্যক্তির অন্তরে অন্যদিকে তেমনি রয়েছে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলির ভিতরে। মনের গভীরে অচঞ্চল শান্তির জন্য ব্যাকুলতা আগের চেয়ে এখন একটুও কম নয়, কিন্তু কোন পথে মিলবে এই অচঞ্চলতা তার নিশানা আগের তুলনায় যেন আমরা আরো কম জানি। একটি অখণ্ড পৃথিবী যার ভিতরে খণ্ডাংশগুলি নির্বিরোধে পরম্পর লগ্ন তার প্রয়োজন আজকেই সবচেয়ে বেশি জরুরি। অথচ এক্ষেত্রেও কিসের ভিত্তিতে এই অখণ্ড ঐক্যসাধন হবে সে বিষয়ে একমত তো আমরা নই-ই, কোনো পরিচ্ছন্ন ধারণাও আমাদের নেই।
মনুষ্যজাতি তাই আজ স্পষ্টতই এমন এক বিরুদ্ধতার সম্মুখীন যা অতীতের সমস্ত সমস্যার চেয়ে ভয়াবহ এবং দুর্মর। একদিকে দেখা যাচ্ছে বিশ্বশান্তিই মনুষ্যজাতির সমূহ সর্বনাশের বিকল্প। অন্যদিকে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়ে গেছে যে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে রাখার যোগ্যতা যুগের প্রধান তত্ত্ববিশ্বাস এবং মতবাদগুলি তর্জন করে উঠতে পারেনি।
হিন্দুধর্মের মতো কোনো কোনো ধর্মমত কোনদিনই নিখিলবিশ্বধর্ম হয়ে উঠতে চায়নি। অন্যদের এই আকাঙ্ক্ষা ছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ, খৃস্টান ধর্মপ্রচারকগণ শুধু যে ভাবতেন যে, মুক্তির পথ তাঁদের জানা আছে তাই নয়, স্পষ্টতই তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে আজ হোক কাল হোক, পৃথিবীর সর্বত্র সকল মানুষকে তাঁদের বিশ্বাসের প্রতি আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে এবং এভাবেই এক নির্দ্বন্দ্ব অখণ্ড বিশ্বের ভিত্তি তৈরি হবে। আজ নিশ্চয় খুব অল্পসংখ্যক মানুষই যুক্তিসম্মতভাবে এ আশাকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম যে ধর্মান্তকরণের সাহায্যে মনুষ্যজাতি এক হবে।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত মার্ক্সবাদীদের উগ্র বিশ্বাস ছিল সারা বিশ্বে ধনতন্ত্রের অবসান ও সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা সমাসন্ন। ইতিমধ্যে ছবি গেছে পালটে। ধনতন্ত্রের পতন অবশ্যম্ভাবী হতেই পারে কিন্তু যে-মার্ক্সবাদ সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রসমূহের ভিতরই ঐক্য ও শান্তি স্থাপনে। ব্যর্থকাম, সেটি স্পষ্টতই বিশ্বচিন্তাধারার হিসেবে সর্বজনগ্রাহ্য হবে না। বর্তমান দ্বিধা ও বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি নেই ঐ পথে, দ্বিধা ও বিভ্রান্তির আরো একটি দৃষ্টান্ত বরং রয়েছে ওখানে।
চারিদিকেই চোখে পড়ে, ঘোষিত উদ্দেশ্যাদি যার যেমনই হোক না কেন প্রাচীনপন্থীদের পুনরাভ্যুত্থানকামী আন্দোলন এবং সামরিক মতাদর্শ আজকের দিনে বিভেদকারী শক্তি হিসেবেই জোরদার হয়ে উঠছে। যে দুরূহ বিপন্নতাকে এই সব গোষ্ঠী। ডেকে আনতে সক্ষম তাকে পরাস্ত করার ক্ষমতা তাদের নেই। এই সমস্যাটির বিষয়ে ক্রমশই অধিকসংখ্যক মানুষ তীক্ষ্ণভাবে সচেতন হয়ে উঠছেন। কিন্তু এখনো গোলকধাঁধা থেকে উদ্ধারের পন্থা মেলেনি। বর্তমানের অসহনীয় নৈতিক অনিশ্চিত এবং ভবিষ্যৎ বিষয়ে বিভ্রান্তি, এতেই জন্ম নেয় নানা উত্তেজক মতবাদ, আর কঠিন হতাশা থেকে বাঁচবার প্রলোভনে অনেক ক্ষতির মূল্যে ওই সব মতবাদের সাময়িক আশ্রয় নেয় মানুষ। কখনো আবার এর ফলে গড়ে ওঠে এক স্কুল রুচির সংস্কৃতি। ইচ্ছে করেই মানুষ আঁকড়ে ধরে অগভীর সাংস্কৃতিক মেজাজকে। নিজের কালের নীতি ও বুদ্ধির গভীরতর জটিল জাল থেকে উত্তরণ যখন অসাধ্য বোধ হয় তখন আত্মবিশ্বাসে মানুষ ভিতরের গভীরতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে উদ্ধার খোঁজে বাইরের মানে।
তবে এই সংকটের ফল তো সদর্থকও হতে পারে। এ আশা অসম্ভব নয় যে মানুষের মন এবং সমাজের ক্রমবিবর্তন বিষয়ে প্রাচীন সংহত ভাবনাগুলি নবসৃষ্টির উদ্যমে এগিয়ে যাবে এবং সেই প্রচেষ্টায় প্রকাশ্য হবে বহু প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনা, সম্পৃক্ত হয়ে যাবে আবহমানের সঙ্গে সমকালীন মানুষ আর তার অভিজ্ঞতা। এখন প্রয়োজন বিকল্প চিন্তাধারা বা মতাদর্শের নয়। বরং মূল্যবোধ, প্রতিন্যাস ও উপযোগী প্রতিষ্ঠানের সমাহারে এমন এক প্রশস্ত কাঠামোর প্রয়োজন যাতে বহুবিচিত্র ভাবনাধারণা পরস্পর নির্বিরোধী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হতে পারে এবং তারই সাহায্যে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে মনুষ্যসমাজকে পরবর্তী স্তরে উন্নীত করে দেয়।
.
॥ ১ ॥
প্রগতি ভাবনা
আমাদের এই লক্ষ্যভ্রষ্ট প্রজন্মের পক্ষে মানবসংস্কৃতি ও সমাজবিবর্তন বিষয়ে অতীত ভাবনাচিন্তার কতকগুলি আদর্শ ধারা এবং গৃহীত তত্ত্বাবলীর পর্যালোচনায় কিছু লাভ হতে পারে। এগুলিকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের চক্রবৎ গতির তত্ত্ব প্রাচীনযুগে সমধিক প্রচলিত ছিল। সত্য-ক্রেতা-দ্বাপর-কলি এই চার যুগের কথা আমরা সকলেই জানি। এই দূরকল্পনা শুধু প্রাচ্যে সীমাবদ্ধ এমনও নয়। স্বর্ণযুগের পর রৌপ্যযুগ তারপর ব্রোঞ্জ এবং শেষে লৌহযুগের এক চতুষ্কালিক পৌরাণিক কালবিভাজনের কথা প্রতীচ্যেও সবার জানা। এই কথানুসারে চার যুগ পূর্ণ আবর্তিত হয়ে গেলে ঘটে পৃথিবীর লয়, তারপর তার পুনরাবিভাবে পুনশ্চ শুরু হয় যুগের যাত্রা। মহাপ্লাবনের পর ঘটে আবারও চক্রাকারে ইতিহাসের নবপরিক্রম।
ইতিহাসের ঠিক এমনিতর বারংবার অমোঘ পুনরাবৃত্তির তত্ত্বে বিশ্বাসী ব্যক্তি শিক্ষিত মানুষের ভিতরে আজ অল্পসংখ্যকই আছেন। প্রতীচ্যে “নবীন” বিজ্ঞানের আবির্ভাবে। পরিপুষ্ট “প্রগতির”র তত্ত্ব, সম্মুখে প্রসারিত আশাবাদী ইতিহাসদৃষ্টি, অন্তত অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই অধিকতর সমর্থনপুষ্ট।
সমাজের অনন্ত প্রগতির নবীন তত্ত্ব সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাষা পেয়েছিল ফরাসী দেশে। জ্ঞানের প্রসার রয়েছে প্রতিটি অগ্রগতির মূলে। জ্ঞানের অগ্রগতির সীমা নেই। অতএব সভ্যতার অগ্রগতিও অন্তহীন। এখানে বাইবেলে বর্ণিত কাহিনীর সঙ্গে বৈপরীত্য লক্ষণীয়। সেখানে মানুষের প্রতনের কারণ হিসেবে পাওয়া যায় জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে নিষ্পাপ সারল্যচ্যুতির কথাই। মুক্তবুদ্ধিযুগের মেজাজ একেবারেই ভিন্ন। কী তুগো (১৭২৭-৮১) কী কোঁদরসে (১৭৪৩-৯৪) উভয়েই ছিলেন জ্ঞান এবং প্রগতির সদর্থক সম্পর্ক বিষয়ে প্রগাঢ় আস্থাশীল এবং তাঁরা যে কালে বেঁচেছিলেন সেই কাল অন্তত অনেকাংশে তাঁদের সে বাণী গ্রহণে প্রস্তুত ছিল।
“মানুষের স্বর্ণযুগ আমরা পিছনে ফেলে আসিনি, সে রয়েছে আমাদের সামনে ভবিষ্যদ্বাণী শুনিয়েছিলেন স্যা-সিমঁ (১৭৬০-১৮২৫)। স্যা-সিমঁ অবশ্যই কোঁদরসের মতবাদকে শুধু এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন এমন নয়, গুরুতর কতকগুলি বদলও তিনি ঘটিয়েছিলেন এ তত্ত্বের। কিন্তু সেই প্রভেদগুলির কথা আপাতত উহ্য থাক। প্রশ্ন এই, “মুক্তবুদ্ধির সঙ্গে সমাজে নৈতিক ও বাস্তব উন্নতির সম্পর্কটা কী? একে অপরকে সাহায্য করে কী ভাবে? এই সহায়তা আসে অন্তত দুই ভাবে।
নৈতিকতার মাল বায়েছে নান্যায় প্রশ্ন। কেবলমাত্র গায়ের জোরে সামাজিক অবিচারকে অংশত টিকিয়ে রাখা হলেও সম্পূর্ণ তা থাকে না। অজস্র ভ্রান্ত বিশ্বাস, আচার এবং কুসংস্কারের জালে অবিচার যে করে এবং যে সয় উভয়ের মন অনেকাংশে অধিকৃত বলেই অবিচার টিকে থাকতে পারে। দাসের মৌলিক হীনতা বিষয়ে একটি সর্বজনগ্রাহ্য মতই সম্ভব করেছিল দাসত্বকে। রাজা শাসন করেছেন দৈবাধিকার বলে। অজ্ঞতা এবং আত্মছলনার সংযোগে সম্ভবপর হয় উৎপীড়ন, কিন্তু আত্মছলনাও অজ্ঞতার সহায় বিনা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হতে পারে না। জ্ঞানের প্রসার ক্রমেই কমায় অজ্ঞতার ব্যাপ্তি এবং শক্তি। এমনি করে জ্ঞানের সহায় নিয়ে যুক্তি সক্ষম হয় নির্যাতন ও উৎপীড়নের ভিত্তি দুর্বল করে। দিতে। কাজেই ন্যায়বিচার ও স্বাধনীতার প্রধান মিত্র হল যুক্তি।
বিতর্কের এই দিকের বক্তব্য গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে “মুক্তবুদ্ধির ফরাসী প্রবক্তারা ব্যক্ত করেছিলেন। অন্য একটি দিক ইতিমধ্যে ফরাসী দার্শনিকদের আবির্ভাবের এক শতাব্দী। কাল পূর্বে যাঁর অসামান্য পরিচ্ছন্ন এবং জোরালো বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর নাম ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬)। জ্ঞান শুধু কুসংস্কারকে ছেদন করে তাই নয়, প্রকৃতির ওপরে মানসিক প্রভুত্বের বিস্তার ঘটায়। জ্ঞান হচ্ছে ক্ষমতা, প্রকৃতি জয়ের ক্ষমতা। এটিকে ব্যবহার করে মানুষ তার সমাজ সমেত সমগ্র পরিবেশে পরিবর্তন আনতে পারে এবং এভাবেই সে নিজের পার্থিব উন্নতি ঘটাতে সক্ষম।
বিজ্ঞানকে অর্থাৎ বিজ্ঞানের যে শক্তিতে আবিষ্কার সম্ভব হয়, ইতিহাসে নবরূপায়ণ ঘটে, সমাজে যার প্রবল প্রভাব পড়ে, তাকে বেকন খুবই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এভাবে বেকন ইতিহাসের একটি নতুন দৃষ্টিপথ উন্মোচন করলেন যেখানে বিজ্ঞানের স্রষ্টা হিসেবে মানুষ। একই সঙ্গে নিজের ইতিহাস সৃষ্টি করছে।
বেকন কিংবা স্যাঁ সিমঁ কেউই যুক্তিকে ধর্মের বিপরীতে স্থাপন করেননি। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধরনে ধর্মকে এমন এক ভূমিকা দিয়েছিলেন যা বিজ্ঞানের পরিপূরক। বাইবেলের কাহিনী প্রসঙ্গে বেকন বলেছিলেন, “পতনের মধ্য দিয়ে মানুষ হারিয়েছে তার নিষ্পাপ সারল্য এবং সৃষ্ট চরাচরের উপর কর্তৃত্ব। দুটি ক্ষতিরই আংশিক পূরণ সম্ভব হতে পারে এই জীবনে, একটি পূর্ণ হবে ধর্ম ও ঈশ্বর ভরসায়, অন্যটি শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের সহায়তায়।” অর্থাৎ তাঁর পরামর্শমত “নিষ্পাপ সারল্য” বা অন্তঃকরণের পবিত্রতা ও শান্তি ফিরে পাবার জন্য শরণ নিতে হবে ধর্মের, আর বিশ্বপ্রকৃতির ওপরে “কর্তৃত্ব” বা প্রাধান্য স্থাপনার্থে বিজ্ঞান, “শিল্পকলা” অথবা প্রযুক্তিবিদ্যার আন্তরিক চর্চা প্রয়োজন।
ধর্ম বিষয়ে স্যাঁ-সিমঁ যে যুক্তি দিয়েছিলেন তাতে জোর পড়েছিল সাধারণ মঙ্গলার্থে সমাজ সংগঠনের ওপরে। প্রত্যেক যুগেই বিজ্ঞান সামাজিক জীবনে যা আয়ত্তগম্য করে। তোলে তারই সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ধর্মবাক্যগুলির নতুন ব্যাখ্যা করে নিতে হয়। বর্তমান যুগে সমাজের উৎপাদন ক্ষমতা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়ে বিজ্ঞান শিল্পোন্নতির এক অভূতপূর্ব ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। এই নতুন সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোত্তম লক্ষ্য তাহলে কী দাঁড়ায়? আজ দারিদ্র দূরীশ্রণের এক নতুন আশা দেখা যাচ্ছে। স্যা-সিমঁ বললেন, সমাজকে একদেহ-একমন হয়ে দরিদ্রতম শ্রেণীর নৈতিক ও পার্থিব উন্নতিকল্পে চেষ্টা করে যেতে হবে। সমগ্র সমাজের ভিতরে দীনতম যে মানুষ তাকেই টেনে তুলবার জন্য কাজ করা চাই।
এইভাবে স্যা-সিমঁ-প্রবর্তিত নবযুগের দর্শন একই সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ধর্মের সমালোচনা এবং নবীন এক ধর্মের প্রয়োজনের প্রতি তর্জনী নির্দেশ করেছিল। অজ্ঞতা আর কুসংস্কারে যে অমঙ্গল তা দূর হয়ে যাবে মুক্তবুদ্ধির প্রসারে। কিন্তু এই কি সব? সদর্থক কিছু তো প্রয়োজন। কোনো এক মহৎ আবেগ যা প্রতিটি ব্যক্তিকে ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সর্বজনকল্যাণার্থে কাজ করে যেতে অনুপ্রাণিত করে, সে-ও তে চাই। স্যা-সিমঁ প্রকল্পিত নবীন সমাজে সবচেয়ে মূল্যবান সভ্য বলে স্বীকৃত হলেন বিভ্রানী, শিল্পপতি এবং কারিগর বা কর্মী। প্রাচীন পুরোহিত শ্রেণীর সেখানে কোনো স্থানই নেই। তবু ধর্মের স্থান আছে, খুবই প্রধান স্থান। স্যা-সিমঁ প্রস্তাবিত “নবখৃষ্টধর্ম’র কাজ সেই নৈতিক ও দৈববল যুগিয়ে যাওয়া যাতে সমাজ আসঞ্জিত থাকে, সমাজের সম্মিলিত প্রাণশক্তি নিয়োজিত হয় সর্বজনলভ্য এক উদ্দেশ্যসাধনে। স্যা-সিমঁ খেয়াল করেছিলেন যে উত্তরাধিকারের ধরন পাটে গেছে। সম্পত্তির উপরে জন্মগত অধিকারকে তিনি মানতেন না। কিন্তু তাঁর ভাবনার ভিতরে স্পষ্টতই এই কথাটা ছিল যে আদর্শ সমাজ সংরক্ষণের জন্য যতখানি নৈতিক বল প্রয়োজন সেটা শুধু উত্তরাধিকারের রীতিকে বদল করে পাওয়া যাবে না। এই প্রার্থিত লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে বিজ্ঞানের সঙ্গে সংযোগ চাই ধর্মের।
স্যা-সিমঁর এই মতকে একটু ব্যাপক ভাষ্য দিলে ইতিহাসের ক্ষেত্রে বড় মাপে এর প্রয়োগ সম্ভব। প্রতি নবযুগের ধর্মমতের অগ্রগতির সঙ্গে একরকম প্রতিষঙ্গ থাকে সেই যুগের বিজ্ঞানকৃতির স্তরের। যুগের রাজনীতি আবার অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত থাকে ধর্মের। সঙ্গে। সমাজের উপস্থিত পবোর্পযোগী সর্বজনলভ্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবার জন্য সকলকে কাজ করাতে পারে ধর্ম। সমাজের সকল শ্রেণী এবং অংশগুলিকেও একত্র ধরে রাখতে সক্ষম ধর্মই। সমাজের উন্নতিতে ধর্মের এমনই একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এই কথাটা কোঁদরসে ঠিকমত ধরতে পারেননি। ফলে ধর্মের এবং য়ুরোপীয় ইতিহাসে মধ্যযুগের তাৎপর্য বিষয়ে তাঁর মূল্যায়ন একেবারে নঞর্থক। এই মূল্যবিচার স্যা-সিমঁ মেনে নেননি। মধ্যযুগেই মিলেছে সমাজসংগঠন বিষয়ে প্রয়োজনীয় সুত্রের সন্ধান। ইতিহাসে তার নিজস্ব স্থান তো রয়েছেই, ভবিষ্যতে ব্যবহার্য বার্তা আছে এই সংগঠনসূত্রে। ইতিহাসে স্যা-সিমঁ দেখেছিলেন কেমন করে সুসংগঠিত একটি যুগের পিঠেই একটি করে সমালোচনা বা বিপ্লবাহী যুগ নকশা সাজায়। প্রগতি সহজ সরল রেখায় হয় না। চক্রবৎ ঘোরে ইতিহাস এমনও নয়। সংগঠন আর বিরোধপ্রধান যুগের পালাবদলেই তৈরি মানব সমাজের অনবচ্ছিন্ন অগ্রগতির ইতিহাস।
স্যাঁ-সির্ম থেকে মার্ক্স (১৮১৮-৮৩)-এ এসে আমরা কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ মিল আর কিছু তফাৎ দেখতে পাই। স্যা-সিমঁর মতে মার্ক্সের কাছেও ইতিহাসে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যার সদর্থক ভূমিকা স্পষ্ট। মার্ক্সের মতে উৎপাদনের কাজে মানুষ যে-সব সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করে সেইগুলির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। সমাজের সকল দিকেরই মূল বিধায়ক হিসেবে থাকে এই সব সম্পর্ক। ক্যাপিটাল (ভম ১) বইটিতে মার্ক্স লিখছেন, “মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে কী ভাবে সমঝোতা করছে, জীবনধারণার্থে কেমন তার উৎপাদন পদ্ধতি এ সবই প্রযুক্তিতে প্রকাশ্য। তার সমাজ সম্পর্ক গড়বার ধরন, এবং তা থেকে উদ্ভাবিত মানসিক ভাবনাধারাকেও খোলাখুলি দেখা যায় এ ভাবেই।” ইতিহাসের। প্রধান প্রধান পর্বের সঙ্গে প্রতিষঙ্গ থাকে উৎপাদনী রীতিপদ্ধতির অগ্রগতির। এই প্রতিষঙ্গের ভিতরে উৎপাদনী শক্তি এবং উৎপাদনবিধায়ক সম্পর্ক দুই-ই বর্তমান। অর্থাৎ প্রযুক্তিবিদ্যার তৎকালীন অবস্থা তথা সম্পত্তির মালিকানার পরিবর্তিত রীতিপদ্ধতিসমেত সেই সময়ের সমাজিক প্রতিষ্ঠান মিলেমিশে ঐতিহাসিক পবান্তরকে বিশিষ্টতা দেয়। এর ভিতরে উৎপাদনী শক্তি গতিশীল এবং উন্নয়নমুখী। উৎপাদনব্যবস্থাসম্বন্ধী সমাজবন্ধন কিন্তু সমাজজীবনের যে-কোনো পর্বেই অপেক্ষাকৃত পরিবর্তনবিমুখ। ফলে এই দুইয়ের ভিতরে থেকে থেকে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। এই অসমন্বয় কাটিয়ে ইতিহাসের উন্নততর পর্বে উত্তীর্ণ হওয়ার পথ কী? শ্রেণীসংগ্রামের মুখ্য ভূমিকা হচ্ছে এইখানে। ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার পরবর্তী কাল থেকেই সমাজ বিভক্ত হয়ে গেছে দুটি শ্রেণীতে। এদের স্বার্থ পরস্পরবিরোধী। বর্তমান উৎপাদনব্যবস্থার সুফলভোগী সমাজের শক্তিমান শ্রেণীটি বড়ো কোনো পরিবর্তনের বিপক্ষে থাকে। উৎপাদনের হাতিয়ার তাদের হাতে। সেইখানে তাদের জোর। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থা আর উৎপাদনের উন্নয়নমুখী সম্ভাবনার ভিতরকার অসঙ্গতি ক্রমেই যত তীব্র হয়, শক্তিমান শ্রেণীর প্রগতিবিরোধিতা ততই ধরা পড়ে যায়। বিত্তবান আর বিত্তহীনদের ভিতরে অনিবার্য সংঘর্ষে তখন বিত্তহীনই শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করে কেননা তারাই হচ্ছে প্রগতির পক্ষে। যে সামাজিক বিরোধিতা ঘনিয়েছিল উৎপাদনী শক্তির সঙ্গে অসমঞ্জস সমাজসম্বন্ধের জটিলতায় মালিকশ্রেণী ও সর্বহারার পরস্পরবিরুদ্ধ স্বার্থের দ্বন্দ্ব মিশে, সেই বিরোধিতা দূর হয়ে যায় বিপ্লবে। বিপ্লবের এই উত্তরণের পরে উন্নত উৎপাদনী শক্তির সঙ্গে সুসমঞ্জস সমাজসম্বন্ধগুলি উচ্চতর স্তরে আবার সংগঠিত হয়। ইতিহাসের পরিবর্তনের এবং অগ্রগতির এই ভাষ্য ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা নামে পরিচিত।
মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে এখানে কয়েকটি কথা বিশেষভাবে লক্ষ্য করে রাখা যাক। প্রথমত মার্ক্স বিশ্বাস করতেন যে শুধু সমাজ সম্পর্ক দিয়েই মানুষকে বোঝা যায়। বিখ্যাত ফয়েরবাখৃ স্বীসিসে তিনি লেখেন “এক বিমূর্ত মানবসত্তা প্রতিটি পৃথক-পৃথক ব্যক্তিতে অন্তর্নিহিত এমন নয়। মানবসত্তা প্রকৃত প্রস্তাবে সমাজসম্বন্ধাবলীর সমাহার।” দ্বিতীয়ত, তাঁর বিশ্বাস ছিল যে আদিম সাম্যবাদের কাল শেষ হয়ে যাবার পরে সমাজে স্বার্থের সামঞ্জস্য আর নেই। পরবর্তী কোনো মনুষ্যসমাজের ক্ষেত্রেই আর “সর্বজনকল্যাণ” ধারণাটি ঠিক প্রযোজ্য নয়। এই সব সমাজের প্রতিটিই পরস্পরবিরুদ্ধ স্বার্থান্বেষী শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে রয়েছে। এই বিরুদ্ধতা বা শত্রুভাবের মূল বাস্তব অবস্থাতে নিহিত। উপস্থিত উৎপাদনী হাতিয়ারের মালিকানার ধরন থেকে এই অবস্থা বুঝে নেওয়া সম্ভব। এছাড়া শুধু উৎপাদকদের পরস্পর সম্বন্ধই নয়, সবরকম সামাজিক সম্বন্ধেরই একটি ব্যবহারিক দিক থাকে। মার্ক্স লিখেছিলেন, “সমাজজীবন প্রধানত ব্যবহারিক জীবন।” কার্যকারিতা বা প্রয়োগের ক্ষেত্র থেকে পৃথক করে কোনো কিছুর অর্থ বা মূল্য খুঁজতে যাওয়া ভুল। সব সামাজিক কাজ, সে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিল্পকলাগত বা ধর্মীয় যে রকমই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হয় বাস্তব কার্যকারণের বিধানে। এ কথার অর্থ অবশ্য এই নয় যে ওই বাস্তব সূত্রগুলির সঙ্গে বস্তুতন্ত্রের অতিরিক্ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার জগৎ সম্পৃক্ত হতে পারে না। সেটা সম্ভব। কিন্তু সংস্কৃতিকে মূল বাস্তব নিয়ন্ত্রকগুলি থেকে সরিয়ে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করলে এক ধরনের মোহাবিষ্টতার অনুকূল রহস্যবাদী অভিমত সৃষ্টি হতে থাকে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির কাজ মোহাবেশ ভেদ করা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ধর্মকে ঠিকমত বুঝতে হলে বুঝতে হবে উৎপাদনব্যবস্থা ও তজ্জনিত পরস্পরবিরোধী। স্বার্থের নিরিখে। নইলে ধর্মকে যথার্থ বোঝা যাবে না।
যদিও মানবসমাজ একরেখ ভঙ্গিতে চলে না, চলে পাকদণ্ডী পথে, তবু প্রগতি যে একটি ঐতিহাসিক তথ্য এতে মার্ক্সবাদীদের কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু এ কথাটা এমন নিঃসন্দেহ জানা গেল কী করে? কেমন করে জানা যায় যে আমাদের আজকের সভ্যতা প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা বা গুপ্তসাম্রাজ্যের ভারতের তুলনায় বেশি উন্নত? এদিকে ওদিকে নানারকম কথাই এখানে বলে দেওয়া যায়। তবে একটা কথা খুবই নিশ্চিত যে আগেকার যে কোনও যুগের তুলনায় আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা পৃথিবীর অনেকখানি জায়গা জুড়ে অনেক বেশি উন্নত হয়ে উঠেছে। বেকন এবং স্যাঁ-সিমঁর আশা ন্যস্ত হয়েছিল এই সম্ভাবনার ওপরেই। ইতিহাসের প্রগতির গতিকে চালু রাখার কাজে মার্ক্সও উৎপাদনী সচলতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। যে ক’জন চিন্তাবিদের গভীর প্রভাব সপ্তদশ শতাব্দী থেকে দীর্ঘকাল বিদ্যমান রয়েছে তাঁদের ভিতর এইখানে আমরা ভাবনাধারণার একরকম ধারাবাহিকতা পাচ্ছি।
কিন্তু একটা প্রশ্ন এখানেই ওঠে। ঐতিহাসিক প্রগতির এই যে ব্যাখ্যা একে বস্তুবাদী” বলা যায় কী ভাবে? উৎপাদন শক্তির উন্নতি তো বরাবরই পরীক্ষণী ও তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিল। এটাই স্বীকার্য যে জ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে উৎপাদন শক্তির উন্নতিসাধন। তর্কের খাতিরে হয়ত কেউ বলবেন বস্তুগত প্রয়োজনেই জ্ঞান বেড়ে ওঠে। খানিকটা তাই। কিন্তু সত্যিই কি দেখা যায় যে মানুষের প্রয়োজনের সংকট মুহূর্ত এলেই বিজ্ঞানের প্রগতির বেগ দ্রুত হয়েছে? তাঁর ফ্রীডম অ্যাণ্ড অরগানাইজেশন গ্রন্থে বাট্রাণ্ড রাসেল প্রশ্ন তুলেছিলেন, “আর্কিমিদিসের সময় থেকে লিওনার্দোর কাল পর্যন্ত প্রায় কোনোরকম পরীক্ষণী বিজ্ঞান হল না কেন?” এবং তিনি এই সঙ্গে জানিয়েও দিয়েছিলেন, “আর্কিমিদিসের পরে ছয় শতাব্দীকাল জুড়ে আর্থিক অবস্থা এমনই ছিল যাতে বিজ্ঞানকৃত্য সহজ হতে পারে।” খৃষ্টান যুগের প্রথম কয়েক শ বৎসর রোম সাম্রাজ্যে দূর পাল্লার বাণিজ্যের ঘাটতি ছিল না, যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য বাহ্য উদ্দীপনার অভাব ঘটার কথা নয় সেখানে। গুরুতর অর্থনৈতিক সমস্যার তো শেষই ছিল না। তথাপি কোনো এক কারণে রোমান চিত্ত বিজ্ঞান এবং ব্যবহারিক আবিষ্কারের তুলনায়। অধিকতর আকৃষ্ট হল ইতিহাস, আইনের তত্ত্ব এবং অলংকারশাস্ত্রের প্রতি। এ থেকে এ রকম সিদ্ধান্ত করা ঠিক হবে না যে সাংস্কৃতিক সূত্রই প্রধান বা মৌলিক সূত্র। ঐতিহাসিকের সীমাবদ্ধ কাজ হচ্ছে বিভিন্ন সূত্রের পরস্পর প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করা। মৌলিক সূত্ৰ সন্ধান করতে গিয়ে কেবলি পিছোতে থাকলে এমন অন্তহীন অনুক্রমে জড়িয়ে যাওয়া সম্ভব যা একেবারে নিষ্ফল। মানবিক কর্মকাণ্ডে কোনো একটি সূত্রের মৌলতাই বড়ো প্রশ্ন নয়। কী ভাবে বস্তুজগৎ এবং মনোজগতের বিভিন্ন সূত্র পরস্পর গ্রথিত হয়ে শুধু সংস্কৃতিতে রূপ নেয় তাই নয়, বেঁচে থাকার প্রতি পর্বে সব কাজে জাল বুনে যায়, আকর্ষণীয় ব্যাপার সেটাই।
অনুরূপ কিছু মন্তব্য স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিষয়েও করা সম্ভব। মার্ক্সবাদীদের মতে সমাজে প্রধান দ্বন্দ্ব শ্রেণীতে-শ্রেণীতে। ঐ দ্বন্দ্বের মূল আছে বস্তু জগতের বিন্যাসে, বিশেষত উৎপাদনী হাতিয়ারের মালিকানায়। এই সব কথাই আংশিক সত্য। সমাজে দ্বন্দ্ব কিন্তু রয়েছে অসংখ্য আকারে। এদের ভিতরে কোনটি কখন প্রবল হয়ে উঠবে তা অবস্থাবৈগুণ্যের উপর নির্ভর করে। এ ছাড়াও মনে রাখা দরকার যে দ্বন্দ্ব ঘটাবার। উপযোগী বাস্তব কারণ উপস্থিত থাকলেই অতঃপর সেই কারণ থেকেই জোরদার বিরোধ বাধবে এমন নয়। ওই কারণগুলির দিকে ব্যক্তিগত ভাবে নজর দেবার একটা ব্যাপার। রয়েছে। এই ব্যক্তিগত এবং অবস্থাগত দুটি দিকের কোনো একটিকে বেশি গুরুত্ব দিলে একদেশদর্শিতা দেখা দেয়। প্রকৃত প্রস্তাবে যেটা দেখবার মতো বিষয় সেটা হল এই যে দুটি দিক কী ভাবে একত্র সংযুক্ত হয়ে যায়, কেমন করে কোনো বিশেষ প্রশ্নে ব্যক্তিগত দেখার ধরন কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির প্রবলতায় “বাস্তব অবস্থা তৈরি হয়ে ওঠে।
বিগত অর্ধ শতাব্দীতে ভারত তথা সারা পৃথিবী জুড়ে প্রধান যে সব সামাজিক দ্বন্দ্ব চলছিল সেগুলিকে অনুধাবন করবার জন্য একটুখানি পিছন ফিরে তাকানো যাক। এ ভাবে তাকানো শক্তও তো নয়। এই সমস্ত বছরগুলিতে সারা ভারতভূমি জুড়ে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গাই ছিল প্রধানতম সামাজিক সংঘর্ষ। জাতিপাঁতির বিভেদের হিংস্রতা। সামান্য প্রকাশ পেয়েছিল সেদিন, এখন তা-ই কিন্তু মস্তো বড়ো হয়ে উঠেছে। আমাদের নিজেদের সমাজে সমকালীন সামাজিক দ্বন্দ্বের এগুলি অন্যতম দৃষ্টান্ত। গোটা পৃথিবীকে ধরলে অন্য এক ধরনের হিংস্রতার ধারাবাহিকতা চোখে পড়বেই। এই যে গাত্রবর্ণের ভিন্নতা নিয়ে উত্তেজনা জমে ওঠার মতো দুঃখকর পরিস্থিতি, বিরোধের এই এক সূত্র। আর যুদ্ধ তো রয়েছেই। গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের হানাহানির ঘটা দেশে-দেশে যুদ্ধ বেধে গেলেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। মতবাদভিত্তিক কোনো প্রাখিচার মনে না রেখে যদি আমরা ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ধরনের এ সমস্ত সামাজিক সংঘর্ষগুলিকে সাজাই, গুরুত্ব বিচারে এগুলিকে শ্ৰেণীযুদ্ধের অন্তত সমতুল্য না ভেবে উপায় থাকে না।
মার্ক্সবাদীরা হয়ত তর্ক করতে চাইবেন যে এ সমস্ত বিরোধেই আসলে ছদ্মবেশী শ্ৰেণীযুদ্ধ। কিন্তু এ যুক্তি শেষ পর্যন্ত টেকে না। সন্দেহ কি যে বিভিন্ন সংঘাত পরস্পর সম্পৃক্ত। তা হলেও এরকম ধরে নেওয়া ঠিক নয় যে এগুলি সবই মূলতঃ এক এবং এদের একটিকে অন্য কোনটিতে রূপান্তরিত করে দেখলেও ব্যাপারটা অর্থবহ হবে। দরিদ্র শ্বেতকায় আর ধনী শ্বেতকায়দের যে বিরোধ তা কৃষ্ণকায় এবং শ্বেতকায় বর্ণসংঘাতের সঙ্গে এক হতে পারে না। মুসলমান বনাম ইহুদী যুদ্ধের সঙ্গে আরব অঞ্চলের শ্ৰেণীযুদ্ধ সমতুল্য নয়। এটাও লক্ষণীয় যে কোনো পূর্বনির্ধারিত অর্থনৈতিক বা বস্তুস্বার্থের। বিচ্ছেদের রেখা ধরে কিছু মানুষ খৃষ্টান অন্যেরা মুসলিম হয়েছে এমন নয়; পরস্তু। ধর্মবিশ্বাসের পূর্বনির্ধারিত বিভাগই তাদের মনে এই বোধ জাগিয়েছে যে তাদের স্বার্থ পরস্পরবিরোধী। অবশ্য অন্যান্য পারিপার্শ্বিক অবস্থাও অবধারিতভাবে এই শত্রুতা জাগিয়ে। তুলতে সাহায্য করেছে।
ভারতীয় রাজনীতিতে বর্ণভেদ প্রথার প্রভাব সুবিদিত। নিম্নবর্ণের কিছু মানুষ এখন অর্থনৈতিক সোপান বেয়ে বেশ কিছুটা ওপরে দাঁড়াতে সক্ষম হওয়ার ফলে উচ্চবর্ণের। মানুষদের কাছাকাছি প্রতিষ্ঠিত। এখন এই অবস্থায় নিম্নবর্ণের দরিদ্র মানুষগুলি যখন নির্বাচনের দিনে দুটি প্রার্থীকে পান যাদের ভিতরে একজন তাঁদেরই নিজ বর্ণের তখন তুলনামূলক ধনসম্পদের হিসেব না নিয়েই তাঁরা প্রায়শ নির্বাচিত করে নেন স্বর্ণের প্রার্থীকে। অর্থনৈতিক মর্যাদাগত মিলের চেয়ে স্বর্ণের অভিন্নতাবোধ এখানে জোরালো হয়ে ওঠে।
তার মানে কি সামাজিক বিরোধের প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিবর্তনশীল বাস্তব অবস্থার কোনোরকম ভূমিকাই নেই? ঠিক তা নয়। এই অবস্থার দ্বারা নিঃসন্দেহে স্পষ্ট হতে থাকে উপস্থিত “আত্মীয় গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়গুলি আর সেই স্পর্শে প্রভাবিত হয়ে এই সব। গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের রীতিনীতি, গড়ন, পরস্পর বন্ধুত্ব এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছাঁদ প্রভৃতিও বদলে যেতে থাকে। এই যে মূল কাঠামো এরই সঙ্গে সহযোগে থেকেই শ্রেণীসংগ্রামের উপাদানগুলি ক্রিয়াশীল হয়। এই দিক থেকে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াকে অনুধাবন করলে অনেক সমস্যার এবং তাদের নানা সমাধানের একটি বিশেষ চরিত্রলক্ষণ ধরা পড়বে। ইতিহাসের মস্তো মস্তো যুদ্ধ বিগ্রহ হয়েছে স্বজনবর্গীয় যুথে, গোষ্ঠীতে বা জাতিতে, এই মনুষ্যযুথ বৃহৎ অথবা ক্ষুদ্রায়তন যা-ই হোক। যে বিরোধ অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বলে মনে হচ্ছে তারও সমাধান অর্থনীতির স্তরেই খুঁজে নিতে গেলে দেখা গেছে যে নিষ্পত্তি হচ্ছে সাময়িক এবং আংশিক। স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। বারবারই প্রমাণ হয়েছে যে সমাজ উন্নত স্তরের এক সামগ্রিক সামঞ্জস্য বিধানের ভিতর দিয়েই এই সব বিরোধের মৌলিক সমাধানে উত্তীর্ণ হয়েছে। এই উত্তরণ একান্ত অর্থনৈতিক যুক্তির সাহায্যে লভ্য নয়। একদিকে ক্ষুদ্র সংকীর্ণ আনুগত্যে যখন মানুষ নিজেকে আঁকড়ে ধরে রাখে সেই মূঢ় সংস্কারবন্ধতা ও আত্মবিনাশ, অন্যদিকে কোনো নবীন স্বপ্নাদর্শে যখন তাকে টানে তখন সেই স্বপ্নের বিশিষ্টতা এবং বৃহত্তর ও মহত্তর আনুগত্যে উত্তীর্ণ হওয়ার উদ্যম, এ সবই মানুষ পায় সচেতন, হিসেবী বিবেচনাবুদ্ধির চেয়ে ঢের বেশি গভীর কোনো উৎস থেকে।
বলা হয়েছে সামাজিক অস্তিত্ব মানুষের চেতনার নির্ধারক। খানিকদূর পর্যন্ত এই যুক্তি খুবই মনকে টানে; মনে হয়, পরিষ্কার হয়ে গেল কথাটা। তার পরে কথাটাকে আর সঠিক ব্যাখ্যা বলে মনে হয় না। ওই যে “সামাজিক সম্বন্ধের সমাহার” যার ভিতরে ব্যক্তি বিধৃত, ওই সমাহার তো বর্তমান উৎপাদনী সম্বন্ধের উপরে এবং সম্পত্তির মালিকানার প্রচলিত ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে গড়া। অথচ মানুষের চেতনা শুধুমাত্র কি বর্তমানের দ্বারা নির্ধারিত? তা নয়। অনাদিকালের প্রবাহ বেয়ে মানুষের অতীত আজকের মানব চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। অতীত গ্রথিত হয়ে থাকে বর্তমানের অন্তস্তলে। মানবচেতনার। সমগ্রতার ভিতরে যদি অবচেতনাকেও হিসেবে রাখি তাহলে এই সমগ্রতার ওপরে সমকালীন সমাজসম্বন্ধের যেটুকু ছাপ থাকে তার তুলনায় আরো গভীর এবং পরিব্যাপ্ত প্রভাব পড়ে অতীতের।
মানুষের মনের কিংবা সমাজের যেটারই অংশ হয়ে থাকুক অতীতও কিছু অনড়, চিরস্থির নয়। অতীত হচ্ছে কতকগুলি ধারার সমষ্টি, বর্তমানের ভিতরে যে-ভাবে তা প্রবিষ্ট হয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যায় তার নিরিখেই অতীতের ভাষ্য করা সম্ভব। এর অর্থবহ ব্যাখ্যা প্রকাশ পায় ওই ক্ৰমান্বিত আত্মউত্তরণের ভঙ্গিতে। এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়েই মনুষ্যত্বও নতুন নতুন ব্যাখ্যা, ভিন্ন সংজ্ঞার্থ পেতে থাকে। বর্তমান যুগে বস্তুজাগতিক কীর্তি মস্ত হয়ে উঠে মানুষের আত্মপ্রতিকৃতিতে বিকৃতি এনেছে। সংশোধন চাই এই প্রতিকৃতির। আজকের দিনে প্রগতির তত্ত্বকে আবার শুরু করতে হবে একেবারে মূল থেকে। মনুষ্যস্বভাব, তার সঙ্গে সমাজ এবং ভবিষ্যতের যোগ এই সব মিলিয়ে এক প্রাণবান এবং যথার্থ কালোপযোগী ধারণা যে প্রগতি তত্ত্বে মিলবে ভাবীকালের নির্ভরযোগ্য পথ দেখাবে সে-ই।
.
॥ ২ ॥
প্রকৃতির রাজত্ব
সাধারণভাবে একটা অনেক দিনের বিশ্বাস রয়েছে যে মনুষ্যচরিত্রে যথার্থ অন্তর্দৃষ্টি লাভ করতে হলে স্বাভাবিক” অথবা আদিম দশায় মানুষকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করে নেওয়া দরকার। শুধু রোমান্টিকরাই এই বিশ্বাস চালু করেছেন তা নয়। কেবল এ ভাবে পর্যবেক্ষণই অবশ্য পর্যাপ্ত নয়, মানুষের চরিত্রের স্বাভাবী বৃদ্ধি এবং বিকাশ দেখাটাও জরুরি। কিন্তু মানবজাতির শৈশবকে অনুধাবন করতে পারলে কয়েকটা জিনিস বোঝার ব্যাপারে অনেকটা সাহায্য হয়।
প্রকৃতির প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কী সেটির মধ্য দিয়ে ধরা পড়ে মানুষের নিজের প্রকৃতি। দ্য এসেন্স অফ ক্রিশ্চিয়ানিটি বইতে ফয়েরবাথ অনুরূপ একটি ভাব বোঝাতে গিয়ে চিত্তাকর্ষী এক উপমা ব্যবহার করেছিলেন। সূর্যকে বিভিন্ন গ্রহ থেকে ভিন্ন রকম দেখায় অথচ সূর্য সেই একই। “অতঃপর নিজস্ব সূর্যই প্রতিটি গ্রহকে দিচ্ছে তার নিজ স্বরূপের মুকুর।” প্রকৃতিও নিশ্চয়ই তেমনই ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর চোখে বিভিন্ন রূপে বিভাসিত। মানুষ তার শৈশবে প্রকৃতির যে রূপ দেখে তা মানুষেরই আদিম স্বভাবের প্রতিচ্ছবি।
“এই বিশ্বচরাচর বিষয়ে আধুনিক আর প্রাচীন মানুষের প্রতিন্যাসের মূল প্রভেদ হলো এই যে আধুনিক, বৈজ্ঞানিক মানুষের কাছে বাহ্যজগৎ প্রধানত “ওটা”, যেবাহ্যজগৎ প্রাচীনদের কাছে, বন্যদের কাছে, ছিল “উনি”।”–এই কথা বলেছেন এইচ. এবং এইচ. এ, ফ্রাঙ্কফট তাঁদের দ্য ইনটেলেকচুয়াল অ্যাডভেঞ্চার অফ এনশেন্ট ম্যান নামে ১৯৪৬-এ য়ুনিভার্সিটি অফ শিকাগো প্রেস থেকে প্রকাশিত গ্রন্থে। জানি না কথাটিকে এ ভাবে বললে পুরো বলা হয় কি না। শৈশবে প্রকৃতির সান্নিধ্য মানুষের মনে যে সম্ভ্রম এবং বিস্ময়ের উদ্রেক করে এই বক্তব্যে সেই ভাব স্পষ্ট হয়নি। এর ভিতরে সম্ভবত একটা চেষ্টার জুলুম আছে, যেন আধুনিক ছকবাঁধা ধর্মভাবনার ছাঁচে ফেলেই আদিম এবং প্রাচীন মানুষকে সবটাই বোঝা গেল। তবুও এই বক্তব্য এক অর্থে মূল্যবান। আদিম এবং আধুনিককে একত্রে এনে ফেলার একটা সারবত্তা আছে।
আদিম মানুষ চতুর্দিকে প্রাণ নিষ্প্রাণ সকল পদার্থের ভিতরে এক প্রাণশক্তির অশরীরী উপস্থিতি অনুভব করত এবং কোনো একভাবে তার মনে হয়েছিল সেই একই শক্তি তার ভিতরেও নিত্য উপস্থিত রয়েছে। আমাদের তাৎক্ষণিক প্রত্যক্ষের বাইরে মনস্তত্ত্ব এবং শারীরতত্ত্বের সূত্রগুলি যে এক হয়ে আছে এই কথাটি এই প্রসঙ্গে নজরে পড়ে। মনুষ্যাকৃতি পাবার পূর্বে গর্ভের ভিতর মানুষের ভূঃ কী ভাবে বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে মাছ, সরীসৃপ এবং মনুষ্যেতর প্রাণীর রূপ ধরে আর ছাড়ে আমরা জানি। অল্প একটুখানি স্থানকালের ভিতরে বিচিত্রভাবে ঘটে এই বিজ্ঞানচিহ্নিত লক্ষাধিক বর্ষকালের ক্রমবিবর্তন। এইভাবে যেন আমরা মনুষ্য আবির্ভাবের বহু পূর্ব যুগের জৈব বিবর্তনের শারীরস্মৃতি ভরে রেখে দিতে পারি আমাদের এই দেহের অন্তস্থ কোষে। আরো পিছিয়ে গিয়ে জীবের এই বিচিত্র রূপের উৎসসন্ধানও সম্ভব, মাটি, সমুদ্র, আগুন থেকে এবং আরো দূরের আকাশ থেকে।
আমাদের এই দেহাবয়বে জন্মসূত্রাগত স্মৃতি প্রকৃতই আছে কি নেই তা নিয়ে দূরকল্পনায় প্রবৃত্ত হওয়া নিরর্থক। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে আদিম মানুষের নিজেকে এক প্রকার আর অবশিষ্ট বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা রয়েছে তাকে অন্যপ্রকার পদার্থ বলে বোধ হয়নি। বরং সর্বব্যাপী অশরীরী এক শক্তিকে সে অনুভব করেছিল যা মানুষকে বিশ্বের সঙ্গে কোন এক রহস্যময় যোগে যুক্ত করে রাখে। এই শক্তিকে সে নিজের চেয়ে বহুগুণে বড়ো বলেই জেনেছিল। তাই শুধু প্রকৃতির অনুরূপ শক্তিস্পৃষ্ট বস্তুপুঞ্জের সঙ্গে সহাবস্থানের চেয়ে ঢের বড়ো কথা ছিল ওই দৈবশক্তির প্রতীক কোনো বস্তুর সান্নিধ্য। সেই সান্নিধ্য তথা সাযুজ্য তার আত্মশক্তিকে যেন বাড়িয়ে দিয়ে যেত। এই বোধকে সমাজজীবনে ব্যবহার করা যায়। ডুরখাইমের মতো কোনো কোনো খ্যাতিমান সমাজতাত্ত্বিক সেই সামাজিক উপযোগিতার নিরিখেই এই অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন তদুত্তরে মালিনোসকি তাঁর ম্যাজিক, সায়েন্স এ্যান্ড রিলিজন (১৯৪৮) বইতে একটি সঙ্গত কথা তুলেছেন। তাঁর বক্তব্য এমন-কি আদিম মনুষ্যসমাজেও নিবিড়তম ধর্মানুভবের মুহূর্তগুলি প্রায়ই সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ এটা লক্ষণীয়। এটা খুবই সম্ভব যে মানুষের অন্তর্নিহিত প্রবণতাকে সমাজ জীইয়ে তুলে উৎসাহ নিয়ে নিজের কাজে লাগাবে।
প্রকৃতির রহস্যময় শক্তির যে দুই রূপ প্রাচীন কালের মানুষের সামনে উদঘাটিত হয়েছিল তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়ে গেছে মানুষের ধর্মের ওপরে। এক রূপে মূর্ত হয়েছে প্রাণশক্তি তথা এই জীবনের গুহ্য সূত্র। প্রকৃতিই মানুষকে দিয়েছে প্রতিদিনের আহার, তার জীবিকা। এটা খুবই স্বাভাবিক যে মায়ের প্রতি শিশুর আকর্ষণতুল্য অনুভব মানুষ বোধ করবে এই পৃথিবীর প্রতি। প্রকৃতির উর্বরতার প্রতীক দেবীমাতৃকার পূজা অসংখ্য প্রাচীন ধর্মে প্রচলিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই দেবীর সঙ্গে থাকেন এক দেব যিনি তাঁর সহচরমাত্র যেমন উর্বরতাদায়ী সূর্য পৃথিবীর নিত্যসহচর। তেমনই উদাহরণ স্বরূপ মিশরের দেবী মাতৃকা আইসিস-এর সহচর ওসাইরিসের উল্লেখ করা যায়। এই যুগ্মতায় দেবী এবং তাঁর নিত্যসহচর উভয়ে মূলত একই সূত্রের বিধায়ক, ভিন্ন দুই সূত্রের সম্মেলক নন।
কিন্তু ধর্মের ভিতরে সম্পূর্ণ পৃথক ও বিশিষ্ট একটি উপাদান সংযোজন করেছে প্রকৃতির দ্বিতীয় একটি রূপ! এই পৃথিবী যেমন নবনবরূপে মনোহারী, বর্ণবৈভবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রেখায় রেখায় মাতাল করে, উদ্দীপ্তও করে, তেমনি উর্ধ্বে মেঘের স্তর পেরিয়ে রয়েছে অপরিবর্তনীয় আকাশ, পবিত্র নিষ্কলঙ্ক যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আদর্শের প্রতীক। এই দৃষ্টিতে সূর্য তখন আর পৃথিবীর উর্বরতা বিধানের সহচরমাত্র থাকে না, সূর্য হয়ে যায় সর্বপাবক অগ্নির মূলাধার, বিশুদ্ধ জ্ঞানপ্রিয় আলোকের ভাণ্ডারী, প্রত্যহের যত ভয়াবহ প্রলোভন থেকে উর্বে নিয়ে যাবে উজ্জ্বল, সক্ষম সারথি। এই ভাবে দেখলে স্বর্গ ও পৃথিবীর বিবাহে দুটি বিপরীত অথচ পরিপূরক সূত্রের মিলন ঘটে। এই দুই সূত্র মানুষের ধর্মচেতনার দুটি মেরু প্রকৃতির আর পুরুষ-এর মতো নানা নামে ও ভাবে প্রাচীন কাল থেকেই চিত্রিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন সময়ে নানা উদ্দেশ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু আদিযুগ থেকে সারা পৃথিবী জুড়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বিশ্ব ব্যাপারে মানুষের প্রতিক্রিয়ার যেটুকু দলিল যা মেলে তা থেকে আদিম মানবমনে অধ্যাত্ম প্রয়োজনের একটি ছবি দেখা যায়। এই ছবি হাল্কাভাবে উড়িয়ে দেবার যোগ্য নয়। মানুষের দৈব-চেতনার দুটি উপাদানই প্রধান মনে হয়। একটি হলো প্রকৃতিপ্রেমে আসক্তি, মত্ততা, অন্যদিকে অন্তরের শাস্তি সুষমা জন্য ও নিরাসক্তির জন্য ব্যাকুলতা যাতে সব মত্ততার নিবৃত্তি।
প্রকৃতি থেকে মানুষ যেমন পুষ্টি পেয়েছে তেমনি প্রকৃতির অসংখ্য কালো, অর্থহীন খেয়ালের ভয়াবহ নিষ্ঠুর কীর্তি, তার বিনাশী রূপও কম তাড়া করেনি মানুষকে। সাপে। তাড়া করেছে তাকে, আক্রমণ করেছে মাংসাশী প্রাণী। ঝড় ঝঞ্জা বন্যায় তাকে গ্রাস করে নিয়েছে কিংবা কখনো আছড়ে ফেলে রেখে গিয়েছে, পীড়িত হয়েছে শুধু দেহের নয় মনেরও কঠিন ব্যাধিতে, বিনা অপরাধে কতবারই না মানুষকে সইতে হয়েছে আগুনে, ভূকম্পনে, কিংবা আগ্নেয়গিরির মুখে বিপর্যয়ের শাস্তি। আদিম মানুষের মনে প্রকৃতির প্রতি প্রচণ্ড মিশ্র অনুভূতি দেখা দিয়েছিল। প্রকৃতিপ্রণয়ে মিশেছিল অবোধ ভয়, ভৌত উপাদানকে ভোগ করবার আকাঙ্ক্ষায় মিশে গিয়েছিল তার সহজাত সাবধানতা আর অবিশ্বাস।
দুর্লক্ষণের উদ্বেগে বন্দী হয়েও অন্য সব প্রাণীর তুলনায় আদিম মানুষের ছিল সচল এক ব্যবহারিক বুদ্ধি এবং অতুলনীয় বিস্ময়বোধ।
এই সব বৈশিষ্ট্যগুলির শরীর এবং জৈব ভিত্তি এখন সুবিদিত। মানুষের মস্তিষ্কের গড়ন তো এক গল্প কথা। এই গঠনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশার্ধ এক গবেষক এর নামকরণ করেছিলেন ত্রিমুখ। বিবর্তনের ভাষায় মস্তিষ্কের ক্রমাম্বিত যে গঠন তার তিনটি স্তরের পার্থক্য ধরা সম্ভব। ম্যাকলীন যাকে সরীসৃপ-জট [সংক্ষেপে রকমপ্লেক্স]* বলে চিহ্নিত করেছেন আদিতম স্তর সেটি, মানুষ আর সরীসৃপ উভয়ের ভিতরেই বর্তমান। দ্বিতীয় স্তরে আছে সাঙ্গিক বিন্যাস। এই বিন্যাস সমস্ত স্তন্যপায়ী জীবের মতো মানব-মস্তিষ্কেও উপস্থিত। সর্বশেষ স্তরে, অবশিষ্ট সারা মস্তিষ্কের ওপরে বিরাজিত যে-নবমগজ মানুষকে তার বৈশিষ্ট্য দিয়েছে, বিবর্তনের ধারায় মস্তিস্কের সাম্প্রতিকতম সংযোজন এই গুরুমগজ।
এত জটিল বৃহৎ মস্তিষ্কাধারে মানুষের কী প্রয়োজন ছিল? মানুষের বিবর্তনের দিকে চেয়ে বলতে হয় এর প্রয়োজন তার টিকে থাকার জন্যই। মানুষের পূর্বপুরুষ প্রথম যুগের। বানর জাতির বাস ছিল অরণ্যে। ক্রমে এমন দিন এল যখন অরণ্য বিরল হয়ে আসছে। সেই কালের বানর জাতির ভিতরে যারা অরণ্যেই রয়ে যায় তাদের সংখ্যা আজ ক্ষীয়মাণ। যে প্রজাতি থেকে মানুষ এসেছিল তারা জঙ্গল ত্যাগ করে সমতলে এসে বাঁচার লড়াই শুরু করে। এই লড়াইয়ে অন্য যেসব জীবজন্তুর সঙ্গে মানুষকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হয়েছে। তারা নানা অর্থে এই বাঁচার লড়াইয়ে মানুষের চেয়ে বহুগুণে দক্ষতর ছিল। এই সব জীবজন্তুর সঙ্গে দ্রুত দৌড়ে এঁটে ওঠা মানুষের সাধ্যাতীত, এদের দাঁত এবং থাবাও ঢের বেশি জোরালো। কিন্তু মানুষের একটা যে দুর্বলতা, সে দাঁড়ায় দুটো মাত্র পায়ে, ওতেই তাকে একটা বিশেষ বল আর সুযোগ এনে দিল, দুই পায়ে দাঁড়িয়ে মানুষ মুক্ত করে নিতে পারল তার দুই হাত। এর অর্থ দাঁড়াল এই যে মানুষ সামনে দেখে নিতে সক্ষম হয়ে। উঠল, অন্য জন্তুর মতো কে, নাক ঘষে তাকে বুঝতে হয় না। ঋজু দণ্ডায়মান মানুষের দৃষ্টির সম্মুখে খুলে যায় বহু দূর দিগন্ত, অনেকখানি দেখে বুঝে সে অনেকটা কার্যকর পরিকল্পনা করতে পারে। সত্যি বলতে, গোড়াতে এই সুবিধেটুকু সামান্যই মনে হয় কিন্তু অল্প একটুখানি এই সুবিধের ভিতরে সম্ভাবনা ছিল প্রভূত। কালক্রমে সেই সম্ভাবনা সম্যক। মহিমা পেয়েছে। মানুষ যে হাত দুটো ব্যবহার করে কিছু একটা, লাঠি বা পাথর, যাহোক ধরে তুলতে পারে প্রাথমিক সহায় হিসেবে এইটের গুরুত্ব ছিল খুব বেশি। এতেই মানুষ শিকারী প্রাণী হয়ে উঠতে পারে। কুকুর, বনবিড়াল, নেকড়ে কিংবা বাঘ সকলের চেয়ে মানুষ দৌড়ের ক্ষমতায় খাটো, দুই পায়ের ওপর কোনমতে নিজেকে খাড়া করে রাখা মানুষ এক আশ্চর্য জোর পেয়েছিল তার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে। ওই আঙুলটির বিন্যাসগুণে শুধু যে মানুষ শক্ত মুঠিতে জিনিস ধরতে পারলো তাই নয়, এরই সাহায্যে ক্রমে নানা হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি নির্মাণে দক্ষতা এসে গেল মানুষের যাতে সমস্ত শারীরিক দুর্বলতার ঘাটতি পুষিয়ে। যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার বাশক্তি। বাক্যের বলে সম্ভব হয়েছে অনেকখানি জটিল সমাজ সংগঠন গড়ে তোলা, তাকে উত্তরাধিকার সূত্রে স্থায়ী রূপ দেওয়া। ভাষার সাহায্য ব্যতিরেক জটিল সাংগঠনিক ঐতিহ্যকে পুরুষানুক্রমে বহন করা সম্ভব হত না। এ সবের জন্যই প্রয়োজন ছিল ক্রমবিবর্তনের দায়িত্ব পালনের উপযোগী সুসংগঠিত মস্তিষ্ক। এইটা লক্ষ্য করবার বিষয় যে গোটা মস্তিষ্কের পরিমাপের অনুপাতে বাকশক্তি এবং আঙুল বিশেষত বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ব্যবহারনিয়ন্ত্রক কেন্দ্র দুটি অনেকটাই বড়ো।
মানুষের অররা এক বৈশিষ্ট্য এখানে উল্লেখযোগ্য। মানুষ নামক জীবটির শৈশব বড়ো দীর্ঘ এবং এর বোধভাষ্যকে শিক্ষিত করে তুলতে অনেকখানি সময় দিতে হয়। একটা শারীরতাত্ত্বিক ভিত্তি রয়েছে এর। ডেসমন্ড মরিস তাঁর দ্য নেকেড় এপ (ম্যাকগ্রহিল, ১৯৬৭) নামক গবেষণা গ্রন্থে লিখেছেন যে বাঁদরের বাচ্চার জন্মকালেই “তার মগজে পূর্ণবয়স্ক জীবের মগজের সত্তর ভাগ মাপ এসে গেছে। অবশিষ্ট ত্রিশ ভাগ দ্রুত ভরে যায় জীবনের প্রথম ছয় মাসে।…আমাদের প্রজাতিতে বরং উল্টোটা হয়। পূর্ণবয়স্ক মানবমস্তিষ্কের মাত্রই তেইশ শতাংশ পরিমাণ নিয়ে জন্ম নেয় মানবশিশু। প্রথম ছয় বৎসর কাল জুড়ে দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে তারও। কিন্তু তেইশ বৎসর বয়সে না পৌঁছনো পর্যন্ত এই বৃদ্ধির প্রক্রিয়া সম্যক সম্পূর্ণ হয় না। মানুষের কল্পনাশক্তির ক্ষেত্রে এর প্রাসঙ্গিকতা এবং মূল্য কী অপরিসীম বলে বোঝানো শক্ত। বাল্য ও কৈশোরের প্রথম দিকেই মানুষের কৌতূহল সজীব থাকে সবচেয়ে বেশি কেননা ভাবনাচিন্তা ও ব্যবহারকে তখনো অভ্যাসের জড়তায় আড়ষ্ট করেনি, পৃথিবী তখনো নমনীয় লাগে যেখানে আমাদের কল্পনার অবাধ বিহার সম্ভব। নতুন ভাবনা যাতে শিকড় নামিয়ে অঙ্কুরিত হয়ে উঠতে পারে এমনি করে তখন মানবচেতনার জমি তৈরি।
আদিমমানুষের পরিবারবদ্ধ হয়ে ওঠার মূলে ছিল মানুষের এই বিধিনির্দিষ্ট দীঘায়িত বাল্য এবং সংশ্লিষ্ট নানা প্রয়োজন। ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে কী অবস্থায় মানুষশিকারী প্রাণীতে পর্যবসিত হলো। স্বভাবতই এই শিকারীরা অন্যান্য জীবজন্তুর মতো দলেবলে বেরোত। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে মানুষদের প্রভেদ ছিল এই যে মেয়েদের এই শিকারীদলের বাইরে রাখা হতো। মানবশিশু জন্মকালে শরীর অনুপাতে অনেকটা বড়ো মাথা নিয়ে জন্মায়। এতে গর্ভ থেকে নিষ্ক্রমণের প্রক্রিয়া অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় কঠিন ও বেদনাদায়ক হয়ে থাকে। জন্মের পরে শিশুর যত্নের জন্য সময়ও লাগে দীর্ঘ। এ জন্যে পুরুষেরা যখন শিকারে যায় তখন মা ও শিশুর সুরক্ষার আবশ্যকতা থাকে। সেই প্রয়োজন মেটাবার জন্য সৃষ্ট আবাসেই গড়েছিল পরিবারের কেন্দ্র। মানব সমাজে অপরিসীম গুরুত্বশীল প্রতিষ্ঠান পরিবারের পত্তন এই ভাবে হয়।
অনেকের ধারণা সমাজের আদিযুগে একপ্রকার সাম্য বলবৎ ছিল। এটা সম্ভবত সম্পূর্ণ ঠিক নয়। প্রথমত, বয়স-ভিত্তিক এক স্বাভাবিক অসাম্য তো ছিলই। এই-যে মনুষ্য-প্রজাতিতে শিশুর বড়ো হতে এতখানি সময় লাগে এটা লক্ষণীয়। হয়ত এখন যত দীর্ঘকাল লাগে প্রাচীন কালে ঠিক ততখানি লাগত না তবু সন্তানকে শিক্ষা দিয়ে মানুষ করে তুলতে যে-সময়টা লাগে তাতে পিতামাতার ওপরে সন্তানদের কতখানি নির্ভরশীল করে তোলে সেটা অনুধাবনযোগ্য। অসমান পদমর্যাদার প্রাথমিক ছাঁচটি ঢালাই হয়েছে পিতাপুত্র সম্বন্ধে। স্ত্রী-পুরুষ সম্বন্ধকে ঠিক লক্ষণ মিলিয়ে বর্ণনা করা সহজ নয়। একটু আগেই বলা হয়েছে শিকারী মানুষদের সমাজে পারিবারিক ব্যবস্থায় পুরুষ বাইরে যেত খাদ্য সংগ্রহে, শিশুপালিকা জননীরা থাকত ভিতরে। আক্ষরিক অর্থে সাম্যের ধারণার পূর্বশর্ত এই যে দুজন সমতাসম্পন্ন ব্যক্তি সকল প্রকার প্রাসঙ্গিক অর্থেই একে অন্যের বিকল্প হতে সক্ষম। স্ত্রীলোক এবং পুরুষ সেই ভাবে একে অপরের বিকল্প নয়, হতে পারে না। প্রত্যেক স্ত্রীলোক এবং পুরুষই তা জানে। তাই আদিকাল থেকেই স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্ক এক ‘অঙ্গাঙ্গি’তায় সংহত হয়েছিল। সাম্য-অসাম্য দিয়ে এই সম্পর্কের সামগ্রিক রূপকে বিবৃত করা অসম্ভব। তবু যে-পরিমাণে স্ত্রীলোককে আর্থিক অধীনতায় পুরুষের কাছে আবদ্ধ হতে হয়েছে সেই পরিমাণেই তাকে পুরুষের সমকক্ষ জ্ঞান করা যাবে না, এ কথা ঠিক।
আদি পরিবারকে মানব সমাজের একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ বলে গুণা সম্ভব। রুসো একে সমাজের “প্রাচীনতম” এবং “একমাত্র স্বাভাবিক রূপ” বলে বর্ণনা করেছিলেন। যখন তিনি বলেছিলেন যে “সর্বস্রষ্টার হাতে থামলো সবই তখন ভালো, নামলো এসে মানুষের হাতে সবই মান হারালো”, তখন ফরাসী দার্শনিকের মনে ছিলো ওই ‘স্বাভাবিক সমাজ আর প্রতিতুলনায় মানুষের পরবর্তী ইতিহাসের কথা। রুসোর এই ইঙ্গিতটিকে নিয়ে আর একটু খতিয়ে দেখা দরকার।
হবস্ আদিম সমাজের জীবনকে জঘন্য, জান্তব এবং ক্ষণস্থায়ী বলে বর্ণনা করেছিলেন। এটা সম্ভব যে জীবন তখন ঐ রকমই ছিলো। কিন্তু আদিম পরিবারে বিশেষভাবে আকর্ষক যা ছিলো তা ওই পরিবারকে ধরে রাখার মতো অপর্যাপ্ত স্বাভাবিক মমতা। সন্তানদের প্রতি জননীর যে যত্ন, নরনারীর পরস্পর আকর্ষণ, শিশুদের একের অন্যের প্রতি এবং জনকজননীর প্রতি স্নেহপ্রীতির বোধের যে বন্ধন এ সবই এসেছে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে, কোনো বাধ্যবাধকতা থেকে নয়। ব্যতিক্রম হয়ত কোথাও-কোথাও ছিলো। কিন্তু প্রধানত যদি ঘটনা এমন না হতো তবে সাধারণ অর্থে প্রতিকূল এবং “জান্তব পরিবেশে আদিম মানব পরিবার টিকে থাকতে পারত না।
রুসোর মতে “বিবেক” এক স্বর্গীয় প্রেরণা, সমাজের আদি স্তরে এর খোঁজ মেলে। আদিম পরিবারগুলি শুধু যে শিশুপালন কেন্দ্র ছিল তাই নয়, মানুষের নীতিবোধ একটা রূপ পরিগ্রহ করে বেড়ে উঠেছিল ঐ পরিবারের ছাঁচ পাওয়া গিয়েছিল বলে। আজও দেখা যায় উঁচুদরের নীতিকথা বোঝাবার প্রকৃষ্ট পথ হচ্ছে সহজ পারিবারিক পরিপ্রেক্ষিতে এনে কথাগুলিকে বোঝানো। “স্বাভাবিক” সহানুভূতির সাহায্যে খুব বড়ো মানবগোষ্ঠীকে একত্র রাখা যায় না। এই জন্যই বেশ কয়েকটি পরিবার মিলে যেই উপজাতি হলো, উপজাতিসমূহ মিলে হলে বৃহত্তর মানব সম্প্রদায়, তখন সমস্যাটা জটিল হয়ে উঠল। একটি পরিবারের ভিতরকার “সার্বিক কল্যাণ প্রত্যক্ষ করা সম্ভব এবং সাধারণত সকলেই সেই কল্যাণবোধকে স্বীকার করে নেয়। কিন্তু বৃহত্তর সমাজে ব্যাপারটি তেমন পরিচ্ছন্ন থাকে না। আমাদের বিচার বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়, মুখে বলি হরি কাজে অন্য করি, ভণ্ডামি দেখা দেয়। রুসোর ধ্যানের যে প্রাচীন সমাজ, সেখানে বিবেক সহজাত প্রত্যক্ষে পায়। সার্বিক কল্যাণবোধ, স্বাভাবিক ভাবেই তাই স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় বিবেক। আজকের সমাজ যে ভাবে তৈরী তাতে এ স্ব কিছুই আর তেমন নেই। আদি সমাজের এই বিবরণ অবশ্য এক অর্থে আদর্শের মাপে-মাপে সাজিয়ে তোলা ছবি এবং খুঁজলে মানসিক দ্বন্দ্ববিরোধের মূল প্রকৃতির রাজতেও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আসল প্রশ্ন তো সত্যিই এটা নয় যে রুসোর আদিম সমাজ বিষয়ে এই স্বপ্নকল্পনার ঐতিহাসিক যাথার্থ্য আছে কি না। আদত কথা হচ্ছে এক আদর্শ সমাজের মূল শর্তগুলিকে তিনি এমন। অবিস্মরণীয় ভঙ্গিতে বিবৃত করেছিলেন যাতে তার সাহায্যেই আধুনিক সমাজের মৌলিক সমস্যার চেহারাটা ফুটে ওঠে।
কোঁদরসে থেকে স্যা-সিমঁ হয়ে মার্ক্স পর্যন্ত যত সারি সারি দর্শনবেত্তা প্রগতির ভাবনা-ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, বেকন যাঁদের বিখ্যাত পূর্বসুরী, এঁরা সকলেই মূলত। নাগরিক যুক্তিবাদী সংস্কৃতির বুদ্ধিজীবী আবহের মানুষ। ঐতিহ্যবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াতে গড়ে-ওঠা এই যুক্তিবাদী মেজাজের ভিতরে ঐতিহ্যবিরোধী সমালোচনা নিহিত ছিল। কী অর্থনীতিতে, কী সংস্কৃতিতে, শিল্পোদ্যোগ যে প্রগতিই নিয়ে আসছে এ বিষয়ে স্যাঁ-সির্ম এবং মার্ক্স উভয়েরই পরিচ্ছন্ন প্রত্যয় ছিল। এরই পাশাপাশি ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গি নানা ভাবনাবিদদের ধ্যানধারণায় গড়ে উঠেছিল। এর দৃষ্টান্ত মেলে রুসো বা রাস্কিনের মতো সম্পূর্ণ ভিন্ভাবনার চিন্তাবিদের বক্তব্যে। রুসো আদর্শ সমাজের রূপ দেখতে পেয়েছিলেন প্রকৃতির রাজত্বে। এইরকম ভাবা যায় যে মার্ক্সও তা-ই দেখেছিলেন শুধু রূপায়ণে “প্রকৃতির রাজত্বের বিকল্প হয়ে যায় “আদিম সাম্যবাদ” কিন্তু একটা গুরুতর প্রভেদ লক্ষণীয়। “আদিম সাম্যবাদে” মার্ক্স সেই আদর্শ সমাজের কাঠামোটি পেয়েছিলেন যা ব্যক্তিগত মালিকানা, শ্রেণী বিভাজন এবং শোষণ থেকে মুক্ত। অপরদিকে আদিম সমাজ রুসোর কাছে এনেছিল অন্য এক মূল্যবান বাতা। মানুষের প্রকৃতির আর মানুষের সমাজবদ্ধ জীবনপ্রণালীর ভিতরে এক মৌল সামঞ্জস্যের প্রতীক রূপে তিনি আদিম সমাজকে দেখেছিলেন।
এই প্রভেদ অনেকের কাছে নিরর্থক মনে হবে। কেননা তাঁদের মতে চিরন্তন। মানবস্বভাব বলে কিছু নেই। কিন্তু ব্যাপারটা ওভাবে দেখা স্পষ্টতই ভুল। মানসিক অসুস্থতা বলে একটা জিনিস আছে যা দেখা দেয় মন এবং পরিবেশের গরমিলে। মানবস্বভাবের শিকড় ছড়িয়েছে হাজার হাজার বৎসর জুড়ে। কতকগুলি মনের ঝোঁক এবং “মৌলিক প্রয়োজন রয়েছে সমাজ এবং মানুষের সুখের দুরপনেয় ক্ষতি না ঘটিয়ে যাদের উপেক্ষা করা যায় না। মনের গভীরে স্পন্দিত প্রতিটি স্থায়ী ক্লেশের ভিতর দিয়ে একটুখানি সহনীয়, যেন বা খানিকটা উন্নত স্তরের সামঞ্জস্যের জন্য আত্মিক আর্তিই প্রকাশ পায়। এমনি ভাবে বিবর্তনের নিরন্তর সংগ্রামের পথেই মানব মনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যাঁরা শিল্পোদ্যোগী এবং যুক্তিবাদী সংস্কৃতির মুখপাত্র আর যাঁরা শুদ্ধ প্রকৃতির জয়গান গাইছেন এই উভয় তরফের কাছেই খানিক খানিক সত্য আছে, এখন প্রয়োজন মানব মন ও সমাজের ঊর্ধ্বতন স্তরে এই দুইয়ের মিলন ঘটানো।
.
॥ ৩ ॥
যুক্তির বিকাশ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান
কোনো কোনো ইতিহাসদার্শনিক মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতির বিবর্তনের ভিতরে যুক্তির ক্রমবিকাশের লক্ষণ দেখতে পান। এ বিষয়ে অবশ্য সন্দেহ নেই যে ইতিহাসে অনেক কিছুতেই যুক্তির উপস্থিতি সৃচিত, নিজের সৃষ্টির সঙ্গে নিজেই যুদ্ধরত আংশিক যুক্তি কখনো-কখনো সাময়িক হার মেনেও বাধা ঠেলে এগিয়েছে। মনুষ্যসমাজ নিয়ে চর্চা যে। বিদ্যার্থীর সে অবশ্য জানে যে যুক্তি বলে যে গণ রয়েছে তার প্রজাতি অনেকগুলি। প্রতিটি প্রজাতিই নিজস্ব সমস্যা সৃষ্টি করতে পটু। সে সমস্যার উত্তরণ কেবল উচ্চতর যুক্তির সাহায্যেই সম্ভব। আধুনিক যুগের মেজাজ যুক্তিবাদী বলে খ্যাত। এই যুক্তিধর্মিতা এক বিশেষ ধরনের। এ দিয়ে কী গড়া গেছে বা গড়তে সাহায্য হয়েছে তা বিচার করে দেখলে এর ধরনটি ঠিক বোঝা যাবে।
ইতিহাসের দিকে ফিরে চাইলে এই বিষয়ে আমরা সঠিক পরিপ্রেক্ষিত পেতে পারি। আমাদের মুখ্য আগ্রহ এইটা দেখার যে বৃহৎ সামাজিক সংগঠনের এবং সাংগঠনিকতার। ভিতর দিয়ে যুক্তি কী ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সাংগঠনিক প্রকাশের ক্ষেত্র পেরিয়েও যাতে আধুনিক যুগের যুক্তির আন্তরবৈশিষ্ট্যগুলি কী সেটা ধরতে পারি তার জন্য আমাদের সচেষ্ট থাকা চাই।
প্রথমেই, মূল ধরনের ভিত্তিতে সামাজিক সংগঠনকে একাধিক ভাগে বিভক্ত করে নেওয়া যায়। এর ভিতরে কয়েকটির সাংগঠনিক ধরন বা ছাঁচ এসেছে পরিবারের আদর্শ থেকে। এগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বৈপরীত্য লক্ষণীয়। এই দুই ছাঁদের মূল বৈসাদৃশ্য এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। যখন দুই বা ততোধিক ব্যক্তির ভিতরে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তখন প্রতিটি ব্যক্তিই স্বার্থ এবং আগ্রহ নিয়ে স্বতন্ত্র, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে আছে। পরিবারধর্মী সংগঠনে কিন্তু তা হয় না। গোটা পরিবার বা আত্মীয় গোষ্ঠীর গভীরতর স্বার্থ একই। তাই পরিবারের একজন সম্মানিত বলে সবাই যেন সম্মানিত হয়, একজনের ক্ষতিতে গোটা পরিবার ক্ষতি অনুভব করে। বাণিজ্যিক সংগঠনে ব্যাপারটা অনেকটা অন্যরকম। একজনের লাভ সেখানে সকলের লাভ বলে পরিগণিত নয়, একজনের ক্ষতিতে সকলের ক্ষতিবোধ নেই। বরং কতকটা উল্টো; একজনের লাভে অন্যদের যেন খানিক ক্ষতি হলো মনে করা হয়। কেননা বাকিরা যদি একেবারে পূর্বের অবস্থাতেই রয়ে যায় তবু যেলাভবান হলো তার তুলনায় এরা দীন বোধ করে। এই দুই ভিন্ন ধারার সংগঠনের সঙ্গে এখনকার দিনের প্রধান যে প্রতিষ্ঠানিকতার রূপ, আমলাতন্ত্র, এইটের কথাও খেয়াল রাখা দরকার। একটু পরে তার আলোচনায় আসছি। সর্বশেষে চতুর্থ এক ধরনের সংগঠনের কথা বলা যায়। যথার্থ উপযোগী নামের অভাবে একে বান্ধবসমাজ বা সমবায়সমিতি নামে অভিহিত করতে পারি। যাই হোক, আপাতত আমরা। প্রথম তিনটি ধরনকে নিয়েই আলোচনা করবো। এখানে এই কথাটা বলে নেওয়া ভালো যে এই ধরনগুলি প্রায়ই বিশুদ্ধ রূপে থাকে না, মিশ্র ধাঁচে দাঁড়িয়ে যায়। তা ছাড়াও, একটা ধরনে শুরু হয়ে পরে অন্য ধরন এসে গেল এমন ঘটনাও দুর্লভ নয়।
পরিবার বা আত্মীয় গোষ্ঠী গড়ে ওঠে যথার্থ অথবা কাল্পনিক রক্তের সম্বন্ধের ভিত্তিতে। আমরা যাকে “পরিবারধর্মী সংগঠন” বলছি তার ভিত্তিতে কিন্তু এরকম বন্ধন অনাবশ্যক। জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ জাতিকে তাই পরিবারধর্মী গোষ্ঠী বলা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন, পরিবারের কোনো সদস্যের সম্মানে সমগ্র পরিবার যেমন সম্মানিত হয় গোটা জাতি তেমনি ভাবেই সম্মানিত বোধ করেছিল। এই সব ক্ষেত্রে সার্থকতা বা ব্যর্থতা, জয়-পরাজয়, সম্মিলিত উল্লাস বা শোকের দ্বারা চিহ্নিত হয়। এই যে মনের মিলের ফলে সংহতি, এটি নানা উপাদানে তৈরি হতে পারে। একটি উপাদান হলো এক ভাষা; এক ধর্ম তেমনি আরেক উপাদান। সাধারণভাবে দেখা যায় এক সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের ওয়ারিশ হলেই এই বোধ আসা সম্ভব।
প্রথম রাজ্যবিস্তার এবং প্রতিষ্ঠিত রাজ্যগুলি সংগঠিত করে তোলবার সময়ে পরিবারধর্মী এই ধাঁচটির সাহসিক বিস্তারের প্রয়াস চলে। এই সব রাজ্য ও সাম্রাজ্য অগণিত ছোট ছোট গোষ্ঠীকে একত্র করছিল। বৃহত্তর এই সমাজের তলে খণ্ড খণ্ড অংশগুলিকে একত্র করে বিরাজিত ছিল সামরিক শক্তির লৌহকাঠামো। কিন্তু সাম্রাজ্যের ভিত্তিতে যে-সংহতি আবশ্যক, শুধু গায়ের জোরে বিজয়ের সম্যক ফল সেভাবে সংহত করা যায় না। কতকটা ভিন্ন ধরনের বল-ও লাগে। সম্রাটকে তাই অবতীর্ণ হতে হতো বৃহৎ পরিবারের কর্তার ভূমিকায়।
ইতিহাসের গতিতে এই যে নতুন দায়িত্ব এলো একে বইবার জন্য ধর্মকে বিশেষভাবে সংগঠিত করা হলো। প্রয়োজন যে-রকম ছিল তা কেবল বহু দেবতার পূজাপ্রার্থনা থেকে একেশ্বরবাদে উত্তীর্ণ হয়ে যাবার আন্দোলনে মিটিয়ে দেবার মতো নয়। পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন স্থানে তাই এর রকমফের হলো। প্রধানত প্রয়োজন যা ছিল তা কতকটা এই যে, কেন্দ্রে বিরাজমান অখণ্ড ঐক্যবোধের সঙ্গেই নীচের তলার ধারে কাছে বহু বৈচিত্র্যের নির্বিরোধ সহাবস্থান স্বীকৃতি পাক। কী ঈশ্বর, কী সামাজিক রীতিনীতিবোধ সব ক্ষেত্রেই প্রকৃত শর্ত ছিল এই-ই এবং এই প্রয়োজন নানা রূপে স্বীকৃত হয়েছিল। একটা স্তরে সাম্রাজ্যের পক্ষে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক ঐক্যের প্রতীক খুবই আবশ্যক। কিন্তু অন্যান্য স্তরের বৈচিত্র্য ও ঐতিহাসিক ভিন্নতার সঙ্গে এই অখণ্ডতা বোধের একটা সমঝোতাও কম আবশ্যক নয়। পরিবেশের নানা আনুকূল্য ও প্রতিকূলতার ফলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এই দুইয়ের পরস্পর সঙ্গতির আকার ও মাত্রায় প্রভেদ ঘটেছে।
মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্যে যে ব্যবস্থার প্রবর্তন হয় সাধারণ ভাবে সকলে সামন্ততন্ত্র বলে একে অভিহিত করে থাকেন। এর ভিতরে কিন্তু ঠিক কী প্রকরণে সম্রাটের প্রতি আনুগত্য স্বীকারান্তে অনুগত শাসকেরা স্বাধিকার এবং দাপটের সঙ্গে স্বায়ত্তশাসন চালাবার অনুমতি পাবেন তার নানারকম স্থানীয় রূপ ছিল। এই ভিন্নতার মূলে যথেষ্ট যুক্তি আছে। স্থানীয় গোষ্ঠীগুলির ছিল নিজস্ব রীতিনীতি ও সংস্কৃতি, ছিল স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণশক্তি ও অভঙ্গুর। আত্মস্বাতন্ত্র্য বোধ। এদের তুলনায়, যতই কেন না অঙ্গরাজ্যগুলিকে মিলিয়ে পরিবারতন্ত্রী সামগ্রিকতায় তাদের গ্রথিত করার চেষ্টা চলুক, সাম্রাজ্য এক কৃত্রিম রাজনৈতিক নির্মিতি মাত্র। সামগ্রিক অবয়ব হিসেবে যে সীমারেখা দ্বারা সাম্রাজ্য চিহ্নিত সেটি তো ক্ষণভঙ্গুর; ভবিষ্যদ্বাণীর পরোয়াবিহীন কোনো পরিবর্তন সাম্রাজ্যের শীর্ষস্থানে এসে ক্ষমতার রদবদল ঘটালেই এই সীমানা রেখার পরিবর্তন ঘটে যায়। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় শাসকরা অকারণে সাম্রাজ্যের ছোট ছোট স্থানীয় সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর ভিতরে শত্রুতা তৈরি করবেন কেন? প্রকৃত প্রস্তাবে সম্রাট এবং তাঁর শাসকবর্গের প্রধান কাজ ছিল স্থানীয় অঙ্গরাজ্য থেকে করসংগ্রহ। সেই কাজ যতক্ষণ নির্বিাদে চলছে ততক্ষণ সকলের কাছেই সদাশয় অপ্রতিবন্ধকতার নীতি বাঞ্ছনীয় হওয়ার কথা।
অতঃপর আলোচ্য রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যদি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ঝোঁককে সামান্য লক্ষণ হিসেবে দেখা যায় তার ব্যাখ্যা সহজবোধ্য। কিন্তু আত্যন্তিক কেন্দ্রীকরণের দিকে বিপরীত একরকম ঝোঁকও এই ব্যবস্থায় দেখা গিয়েছিল, বিশেষ ব্যাখ্যার প্রয়োজন সেই প্রসঙ্গে। সাধারণত উল্লিখিত সামন্ততন্ত্র বা “অধিরাজ”তন্ত্র ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণাধীন। শাসকদের শুধু যে আইন সংরক্ষণ শাসন ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কৃত্যে প্রভূত ক্ষমতার অধিকার দেওয়া হয়েছিল তাই নয়, এই ক্ষমতাগুলি বংশানুক্রমে শাসকেরা ভোগ করতে পারতেন। এর ফলে নিজের ক্ষমতাকে এই সব শাসক এতদূর অপ্রতিহত করে তুলতে পারতেন যে এমনকি, বিশেষ করে সম্রাট যখন বিপন্ন তখন সম্রাটের বিরুদ্ধাচরণ করারও। শক্তি পেয়ে যেতেন। এতে একটা উভয় সংকট দেখা দেয়। একদিকে স্থানীয় শাসকদের। ভিতরে ক্ষমতার বিস্তার আবশ্যক। অন্যদিকে স্থানীয় শাসকেরা যার যার এলাকায় প্রভাব বিস্তার করুন এই অনুমোদন দিলে সম্রাট নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনেন। সমস্যাটি কঠিন। কেন্দ্রীয় শক্তিবৃদ্ধির ঝোঁক অংশত এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়েই বেড়ে যায়। সমস্যার একটা চরম সমাধান খুঁজে নিয়ে তার ফলাফল কী দাঁড়াতে পারে সেটা এইখানে একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক।
সম্রাটের দিক থেকে তাঁর অধীনস্থ শাসক (রাজা কিংবা সামন্ত প্রভু নামে যাঁর পরিচয়) হচ্ছেন মুখ্যত একজন করসংগ্রাহক। বিচার ব্যবস্থা এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ভারও তাঁকেই দিয়ে দেওয়া গেছে। সমস্যাটা যদি এই হয়ে থাকে যে, কী করে তাঁকে এ সমস্ত কাজই করতে দেওয়া যায় অথচ নির্দিষ্ট কর্মস্থলে গভীর শিকড় চালিয়ে যাতে তিনি বিপজ্জনকভাবে শক্তিশালী না হয়ে ওঠেন সে বিষয়েও রাশ টেনে রাখা যায়, তাহলে এর সবচেয়ে সোজা সমাধান হচ্ছে এই শাসককে এক গণ্যমান্য কিন্তু যাঁকে বদলি করা চলে এইরকম পদাধিকারিকে পরিণত করা। এর সরল অর্থ দাঁড়ায় কোনো এক নামে এবং পদ্ধতিতে উচ্চপদস্থ কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক পদের সৃষ্টি যাঁদের নিয়োগ এবং নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের হাতেই থাকবে। অর্থাৎ, এই হলো আমলাতন্ত্রের অভ্যুত্থানের প্রারম্ভিক পর্ব। একবার এই পন্থা নিলেই আনুষঙ্গিক বহু ব্যবস্থা নৈয়ায়িক অনিবার্যতায় চলে আসে। যেমন, কেন্দ্রীয় প্রশাসনে নিয়োগ কী ভাবে হবে? চীনাদের প্রাচীন ব্যবস্থামতে যে পরীক্ষাবিধির প্রবর্তন হয়েছিল সেটাই নিয়োগবিধির সবচেয়ে যুক্তিসম্মত বন্দোবস্ত বলে মনে হয়। এই ব্যবস্থায় শুধু যে দেশের আইন এবং ঐতিহ্য বিষয়ে খানিকটা জ্ঞান বা প্রশাসনের ভারপ্রাপ্ত পদস্থ ব্যক্তিদের রীতিতরিবৎ বিষয়ে চেতনা এবং তদনুযায়ী আচরণ ইত্যাদি বাঞ্ছনীয় যোগ্যতাকে ঠিকমত পরখ করে পুরস্কৃত করার বা এগুলিতে উৎসাহ দান করার সুযোগ ছিল তাই নয়। এই বিধির বলে বহু পরিমাণে জাতি বা সম্প্রদায় জনিত ভেদাভেদ নিরপেক্ষ হতো এই বাছাই। এটা বড়ো কম সুবিধা নয়। অগণিত উপজাতির সমাহারে সাম্রাজ্যের সৃষ্টি। সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থেই দেখা দরকার যে এইসব “উপজাতি” বা জাতি কোনোভাবে উচ্চতম প্রশাসনের সঙ্গে সমার্থক না হয়ে ওঠে। ওরকম এক বিশেষ গোষ্ঠীর একান্ত প্রাধান্যই সাম্রাজ্যের অবশিষ্টাংশে বিরূপতা জাগিয়ে শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যের ভাঙন ডেকে আনে। যে-সব জায়গায় সাম্রাজ্যের ভিতরে পূর্বোল্লিখিত কেন্দ্রীয় পরীক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন সম্ভব হয়নি সেখানে প্রাজ্ঞ সম্রাট মাত্রেই সংযুক্ত প্রভুগোষ্ঠী গড়ে তুলতে এবং ব্যাপ্ত রাখতে চেষ্টা করেছেন যাতে জনসাধারণের কাছে, বৃহত্তর সমাজের কাছে, সেই প্রভূগোষ্ঠী গ্রহণীয় হয়ে ওঠে।
এর কতকগুলি ফল দেখা দিয়েছিল। বহু বৈচিত্র্য ছিল স্থানীয় সংস্কৃতিগুলির স্বভাবী বৈশিষ্ট্য। উদাহরণত বহু ভাষা এবং অসংখ্য বারীতির উল্লেখ করা যায়। দেশের বিভিন্ন অংশে বর্ণ থেকে বর্ণে এবং প্রদেশ থেকে প্রদেশে আচরণীয় রীতিতরিবতের প্রভেদও ছিল বিস্তর। কেন্দ্রীয় প্রশাসকেরা কিন্তু মোটামুটি একভাষা ও সংস্কৃতির প্রসারের বাহক হয়ে ওঠেন। নিপুণ কর্মনিবাহের স্বার্থে অপেক্ষাকৃত সমভাবের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রয়োজনও ছিল। এখন এই ভাষা এবং সংস্কৃতিই যেহেতু প্রশাসনের উচ্চতম মর্যাদাবান মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি, সাম্রাজ্যের সমস্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও উদ্যমী মানুষ সামাজিক সম্মানের প্রত্যাশায় এইগুলি আয়ত্ত করতে ব্যগ্র হয়ে উঠল। প্রশাসন ও সংস্কৃতিতে কেন্দ্রীয়করণের ঝোঁক এলো এইভাবে। আজ পর্যন্ত সমাজে অন্যতম মূল সমস্যা হচ্ছে লোকসংস্কৃতির সঙ্গে রাজসভা ও মহানগরীর পরিশীলিত সংস্কৃতির সম্যক সম্বন্ধবিধান।
উপরে বিবৃত হয়েছে আমলাতন্ত্রের সূত্রপাত এবং প্রাথমিক পরিবেশের সংক্ষিপ্ত কাহিনী। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে ঐতিহ্যসম্মত স্বৈরতন্ত্রের তুলনায় আমলাতন্ত্র যুক্তিবাদের সূত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত করার ব্যাপারে অগ্রবর্তী। ঐতিহ্যবাদী সমাজে মানুষের মর্যাদার বনিয়াদ বহুলাংশে নির্ধারিত ছিল দৈববং জন্মসূত্রে পাওয়া গোষ্ঠী পরিচয়ের ভিত্তিতে। বর্ণভেদ প্রথায় এই ভিত্তি বিন্যাস প্রশ্নাতীতভাবে স্পষ্ট। ভারতীয় সমাজের সঙ্গে বিশেষভাবে এই প্রথা সংযুক্ত থাকলেও পৃথিবীর সর্বত্রই প্রকৃতপক্ষে এটি কোনো না কোনোভাবে উপস্থিত। আমলাতন্ত্রে ব্যক্তির অধিকার নিদিষ্ট হলো শাসন ব্যবস্থায় তার পদাধিকার এবং সেখানে তাকে কী কাজ করতে হয় তার দ্বারা। অর্থাৎ প্রকৃত অধিকারগুলি গিয়ে বতাল ব্যক্তিতে নয় পদে। যে কেউ, ‘লর্ড’ কিংবা ‘কমনার’, ব্রাহ্মণ বা শূদ্র যেই হোক, কোনো সংগঠনে সচিব পদ পেলে সেই কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ক’টি অধিকারেই তার দাবি জন্মাবে। তা ছাড়া, আমলাতন্ত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা নিয়ম অনুসারে, খামখেয়ালে নয়। কার্যক্ষেত্রে এই নিয়ম থেকে অবশ্য ব্যতিক্রম দেখা যেতে পারে কিন্তু তত্ত্বগত চেহারাটা অদ্ভুত এই। এ জন্য ব্যতিক্রম ঘটলে যে বিশেষ নিয়ম ভঙ্গ করে ঘটনাটি হয়েছে তার ভিত্তিতে ওই ব্যতিক্রমের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলাও সম্ভব। সর্বশেষে, এই সব পদ-সংশ্লিষ্ট অধিকার এবং সংস্থাপিত রীতি-নিয়ন্ত্রক আইনকানুনের বৈধতা দৈবশক্তি-নির্ভর নয়, যুক্তিবিচারের উপরই এদের বনিয়াদ এবং প্রায়োগিক উপযোগিতার খাতিরে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনাদি সম্ভব বলে মনে করা হয়। আমলাতন্ত্রের কেঠো এবং বেঢপ চালচলন আমাদের সকলেরই সুপরিচিত। কিন্তু ওইরকম চালচলনেই প্রতিষ্ঠা করা গেছে সর্বশক্তিমান সম্রাটের খেয়ালখুশির বদলে আইনের রাজত্ব। ঠিকমত ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে সংগঠিত যৌক্তিকতা এবং আমলাতন্ত্রের যোগ লক্ষে না-পড়েই যায় না।
আজকের দিনে বৃহৎ সমাজে গণতন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি তা আমলাতন্ত্র ছাড়া কার্যকর হতো না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত এবং তার সাময়িক রদবদলকে প্রতিফলিত করে রাজনৈতিক দলগুলি, এইরকমই করার কথা। সাধারণ নীতি প্রণীত হবে পরিবর্তনশীল জনমতের সঙ্গে তাল রেখে, নীতি প্রণয়নের কাঠামো অনড় কিংবা খামখেয়ালী হলে চলবে না। পরিবর্তনের সঙ্গে প্রবহমানতার যোগ-সম্পাদক-যন্ত্রের কাজটুকু করে দেয় আমলাযন্ত্র। দৃশ্যত তুল্যমূল্য আনুগত্য সহকারে আমলারা পুরোনো। কানুন বলবৎ থাকাকালীন সেগুলিকে মান্য করেন আবার আইনত সমুপযুক্ত আধিকারিক নতুন নিয়মরীতি প্রণয় করা মাত্র সেগুলিকে চালু করে দেন। আদর্শ আমলাতন্ত্র হচ্ছে নিরপেক্ষ এবং নৈর্ব্যক্তিক, দক্ষ অথচ নিয়মকানুন বিষয়ে সতর্ক। এতে প্রতিফলিত হয়েছে মানুষের সৃষ্ট যন্ত্রের চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্য, সৃজনধর্মী মানুষ স্বয়ং এখানে নেই। যন্ত্রের মতই এখানে মূর্ত যৌক্তিকতা। কার্যক্ষেত্রে যে এই যন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু একেবারে ব্যাপক পুনর্গঠন না হলে আজকের সংগঠিত সমাজে আমলাতন্ত্র ব্যতিরেকে কাজ চালানোর বিপদ আছে। চালাতে গেলে হয় বিশৃঙ্খলা এসে ভাঙচুর ঘটিয়ে দেবে আর নয়তো এক স্বেচ্ছাচারী শাসক সর্বেসর্বা হয়ে বসবে এর মাথায়। এই সর্বেসর্বা শাসক কিন্তু আবারও আমলাতন্ত্র তৈরি করতে বাধ্য হবে তবে সেটা হবে আদর্শ ধরনের চেয়ে ভিন্ন ছাঁচে।
আধুনিক যুগের এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে ধর্ম থেকে রাজনীতির মুক্তিতে। প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় রাজারা নির্ভর করতেন পুরাণ কথার উপরে যাতে জনমানসে ঐশীবলে তাঁদের শাসন এবং বৈধতাকে কায়েম করে তোলা যায়। এর দৃষ্টান্ত পাই ভারত এবং অন্যত্র পৌরাণিক বংশতালিকার ব্যাপক ব্যবহারে। এ কথা বলা হচ্ছে না যে এই বংশতালিকা সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক। বরং উল্টোই, কিন্তু ইতিহাসে যেটুকু ঘাটতি তা পূরণ করার ভার ছিলো ঐতিহ্যের দোহাইটানা কল্পনা দিয়ে। ঐহিকতা বোধের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো প্রথায় এইভাবে আর কাজ চলছিল না কেননা লোকে বিশ্বাস করতে চায় না। প্লেটোর পরামর্শ ছিল, অনৃত জেনেও কিছু পৌরাণিক কল্পকাহিনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করো। কিন্তু সে ছিল একদিন যখন লোকের বিশ্বাস ছিল এ সব পুরাণ কথায়।
রাজনীতির ঐহিকতাবিধানের কিছু কিছু পূর্বাভাস প্রাচীন কালেও মেলে। যথা কৌটিল্যে অনেকখানি ঐহিকবোধ রয়েছে। কিন্তু আমানের কথা হচ্ছে যুগের মেজাজ নিয়ে। য়ুরোপে মেকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭) পরিচিত সকল তাত্ত্বিকদের ভিতরে এই নতুন মেজাজের প্রারম্ভ প্রতীক হিসেবে বিশেষভাবে গণ্য। নবযুগের প্রবক্তা ফ্রান্সিস বেকন স্বয়ং তাঁর দি অ্যাডভানসমেন্ট অব লার্নিং বইতে লিখেছিলেন : “মেকিয়াভেলি এবং অন্যান্য যাঁরা মানুষের কী করা উচিত তা নিয়ে মানুষ কী করে তাই লিখেছেন তাঁদের কাছে আমরা ঋণী।” মেকিয়াভেলি নিজে কিন্তু ওঁর মতো করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলেন। যুবরাজ অথবা সাধারণ রাজপুরুষদের কী করা উচিত। দ্য প্রিন্স গ্রন্থে মেকিয়াভেলি বললেন, “বিশ্বাস রক্ষা করা যদি নিজ স্বার্থের পরিপন্থী হয় তবে বিচক্ষণ শাসকের তেমন বিশ্বাস রক্ষা করা উচিত নয়।… সকল মানুষ যদি সৎ হতো এই অনুশাসন সদানুশাসন হতো না। কিন্তু মানুষ মন্দ, তারা তোমার বিশ্বাস রাখবে না কাজেই তাদের কাছে বিশ্বস্ত থাকতে তুমি বাধ্য নও।” এই শিক্ষা নিজের প্রতিবেশীর প্রতি উচিত ব্যবহার বিষয়ে খ্রীষ্টীয় নির্দেশের পরিপন্থী। কিন্তু নবযুগে একেই যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছিল। বিস্তারিত প্রমাণপত্র না দিয়েও নির্ভয়েই বলা যায় যে কূটনীওি দলীয় রাজনীতি, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে প্রতিযোগিতার যুগে, মেকিয়াভেলির বদনের সঙ্গে মিল রেখেই চলেছে।
এইবারে রাজনৈতিক বিবর্তনের প্রশ্ন ছেড়ে সমাজের আর্থনীতিক এবং বিশেষত বাণিজ্যিক সংগঠন এবং এ-সবের পরিণাম বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে দেখা যাক।
এটি তুচ্ছ ব্যাপার নয় যে ‘ওইকনমিক’ গ্রীক মূল থেকে ইকনমিকস্ কথাটি এসেছে। আর ওই গ্রীক মূলের অর্থ গার্হস্থ্য ব্যবস্থাপনা। প্রাচীনকালে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের স্বাভাবিক ভিত্তিভূমি ছিল ঘরগৃহস্থালী। পরিবারের ব্যবহারের জন্য এবং পরিবারের চৌহদ্দির ভিতরেই প্রধানত উৎপাদন হতো। প্রান্তিক, অবশিষ্ট প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা ছিল অন্যান্য পরিবারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিনিময় প্রথার মাধ্যমে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকার ব্যবহার ছিল নিষ্প্রয়োজন। শহর গড়ে ওঠার এবং বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন জগতের এই বিন্যাস বদলে যায় বটে, পুরোনো প্রতিন্যাস কিন্তু অপরিবর্তিত রয়ে গেল। জিনিস কিনে নিয়ে লাভের উদ্দেশ্যে আবার সেই দ্রব্যসামগ্রী ফিরে বেচে দেওয়ার কাজে টাকার ব্যবহার কিংবা টাকা বাড়ানোর জন্য টাকার ব্যবহার অ্যারিস্টট্র-তুল্য মহৎ গ্রীক দার্শনিকদের কাছে “অস্বাভাবিক এবং নিন্দনীয় কর্ম বলে বিবেচিত হয়েছিল।
কালক্রমে এই “অস্বাভাবিক” কর্মই প্রাধান্য পেয়ে যায় সবচেয়ে বেশী। পুরোনো কালের গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ভোগের জন্য উৎপাদন এখন বাজারমুখী হয়েছে কেননা বাণিজ্য এখন সম্প্রসারিত। বাণিজ্যিক বিস্তারের বহু সুদূরপ্রসারী ফল দেখা গেছে যার অল্প কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে। বাজারের জন্য উৎপন্ন কথাটির অর্থ এই যে পণ্যের উৎপাদন হচ্ছে সেই সব ভোক্তাদের জন্য যাদের সঙ্গে প্রায় ক্ষেত্রেই। উৎপাদকের কোনো যোগ প্রত্যক্ষ ভাবে নেই। তোক্তা তথা ক্রেতা এবং উৎপাদকের ভিতরে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে বলে কোন পণ্যের কদর বা চাহিদা কেমন সে কথা বণিকেরা যতখানি জানে, উৎপাদক নিজে ততখানি জানে না। এতে দ্রব্যসামগ্রী যোগান যারা দেয় সেই কারিগরেরা নিজ রুচি এবং প্রবণতা অনুসারে শিল্পীর মতো দ্রব্যসামগ্রী প্রস্তুত না করে বণিকদের ফরমায়েসী মালের যোগান দিতে উত্তরোত্তর মনোযোগী হলো। বণিকদের ওপর তাদের নির্ভরতা ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগল।
–
–
–
প্রথম সংযোগ ও সংগ্রহের আকারে “যোগানদারী ব্যবস্থা”য় এই যে নির্ভরতা ছিল, পরে কারখানার আবিভাবে তা জোরালো হয়ে ওঠে। বাজারমুখী উৎপাদনের একটা বড়ো সুবিধা আছে। পরিবার ছোট এবং তার ভোগ্যসামগ্রীর চাহিদা সীমাবদ্ধ। বাজার বেড়ে উঠবার সম্ভাবনা অপরিসীম। বৃহদায়তন শিল্পের বনিয়াদ গড়ে দিলো বাজারেই। কারখানা আসায় দুটো ব্যাপারে নিশ্চয়তা আসে উৎপন্ন ভোগ্যসামগ্রীর একই সমমান নির্ধারণ হবে আরো বেশী; উৎপাদনের কাজে শ্রমবিভাজনও আরো বেশী হবে। “যোগানদারী ব্যবস্থা”র সময় থেকেই কারিগরেরা বণিকদের উপরে নির্ভরশীল, তবু এতদিন তারা একটা গোটা জিনিস গড়ে তুলছিল। কারখানার ক্রমবর্ধিত শ্রমবিভাজনে কারিগর এখন দ্রব্যসামগ্রীর খণ্ডাংশমাত্র উৎপাদনে রত রইল। কথাটাকে এভাবে বলা যায় যে যত ছোট ছোট কাজের সমাহারে উৎপন্ন হয় একটি সামগ্রী, তার একটিমাত্র কাজ হলো। এখন একজন শ্রমিকের কৃত্য। এই খুচরো কাজটুকু যান্ত্রিক। কাজেই কালক্রমে যন্ত্র এসে শ্রমিকের স্থান নেবে এ সম্ভাবনাও দেখা দিলো। উৎপাদনকে যান্ত্রিক করে তুলতে সাহায্য করেছে শ্রমবিভাজন এই কথা অ্যাডাম স্মিথ জানতেন। উৎপাদনী শক্তি বৃদ্ধির নিরিখে একে এক বিরাট অগ্রগতি বলতে হয়। আবার অন্য দিক থেকে মানুষের শ্রমের অ-মানবিকীকরণ ঘটে গেল এভাবেই।
দূরের বাজারের সঙ্গে উৎপাদন যুক্ত হয়ে যাওয়ার পরবর্তী প্রক্রিয়া এক আভ্যন্তরীণ কার্যকারণ শৃঙ্খলায় নিজ পথে এগোতে থাকে। এখানে একটিমাত্র সামগ্রী তথা পণ্য কিংবা একটিমাত্র বাজারের উপর নির্ভরতা কিছু দূর যাওয়ার পরে কতকগুলি অসুবিধার সম্মুখীন হয়। যে-কোনো একটিমাত্র সামগ্রীর জন্য একটি বাজারের চাহিদা সীমাবদ্ধ হবেই। সেই নির্ধারিত সীমার পরে একই সামগ্ৰী অধিক পরিমাণে বিপণনের জন্য গেলে বাজারে দর পড়ে যায়। প্রস্তুতকারককে তখন লাভে ওই সামগ্রী বিক্রয় করবার জন্য। নতুন বাজার খুঁজতে হয়। অন্যদিকে বৃহদায়তন শিল্পে আয়তন-আনুপাতিক-ব্যয় বিষয়ে নির্দিষ্ট সীমার কথাও সকলেই জানেন। উৎপাদন ব্যয়কে একটা সীমা পর্যন্ত “সর্বোত্তম সীমা হিসেবে ধরা যায় যখন প্রতি খেপে একই হারে কিংবা ক্রমাম্বিত স্বল্পতর হারে ব্যয়কে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে, যার পরে আর সেটি সম্ভব হয় না। সাদা কথায় এর নির্গলিতাৰ্থ এই যে কোনো একটি শিল্পের মাত্রাহীন বিস্তার লাভজনক নয়। শিল্পোদ্যোগে বৈচিত্র্য থাকায় আরো নানা সুবিধা রয়েছে। এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখলে ঝুঁকি বাড়ে। তাছাড়া বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ অর্থনীতিতে প্রতিটি উৎপাদনের ধারা অন্যগুলিকে পুষ্টি মোগায়। এই আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কিছু “বাহ্য” আয়তনানুপাতিক ব্যয়সংকোচ সম্ভব হয়। কেননা কতকগুলি কৃত্যক আছে নানা শিল্পের যৌথ সেবায় লাগতে যারা সক্ষম। এই সব কৃত্যক কিছু চোখে দেখা যায়, কিছু থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু এদেরই কাজে লাগাতে পারে বলে দূর বাজারে নিবদ্ধদৃষ্টি আর্থনীতক ব্যবস্থা ক্রমাগত শিল্পপণ্যের বৈচিত্র্যসাধনে এবং বিদেশী বিপণির ব্যাপ্তি ও সংখ্যা বিস্তারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে যে পথের শুরু সেটি এইভাবে বাজারের অর্থনীতির পথ বেয়ে গিয়ে পৌঁছয় আন্তর্জাতিক |||||||||
এই বেগবান অগ্রগতির প্রক্রিয়ার এক বিশেষ পরিণামের কথা এই আলোচনারয় ছেদ টানবার পূর্বে বলে নেওয়া দরকার। কোনো অঞ্চলে যখন অগ্রগতি শুরু হয় তখন এরই ফলে সঞ্জাত ‘বাহ্য’ আয়তনানুপাতিক ব্যয়সংকোচ সমেত অজস্র উপাদান এই অগ্রগমনে। সহায়ক হয় যাতে ওই অঞ্চল কোনো-না-কোনো কারণে পিছিয়ে পড়া সমস্ত অঞ্চলের তুলনায় ক্রমাগতই এগিয়ে যেতে সমর্থ হয়। বলা বাহুল্য এই বৃদ্ধিরও কোথাও একটা সীমা রয়েছে। অন্যথায় পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলির কোনো কোনোটি যে কখনো কখনো অগ্রণী অঞ্চলের সঙ্গে পাল্লা দেয়, এমনকি উন্নয়নে টেক্কা দিয়ে যায় এই ব্যাপারটার ব্যাখ্যাই মিলত না। শিল্পোন্নয়নের স্বাভাবিক নিয়ম কিন্তু এই-ই যে সাফল্য আরো সাফল্য আনে এবং অগ্রণীদের অগ্রবর্তিতার মাত্রা প্রায়ই আরো বৃদ্ধি পায়। গত দুই শতাব্দী কাল খুব চমকপ্রদভাবে এই ব্যাপার পৃথিবীর বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ঘটতে দেখা গেছে। গত শতকে মার্কিনী গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিলো উত্তর দক্ষিণে আৰ্ধনীতিক উন্নয়নে অসঙ্গতি। আজ ‘উত্তর’ আর ‘দক্ষিণের সম্মুখসমর এক পৃথিবীরব্যাপী ঘটনা। উনবিংশ শতকী ঔপনিবেশিকতা এবং সাম্রাজ্যবাদ এখন অপসৃয়মান কিন্তু নতুন “আন্তজাতিক অর্থনৈতিক বিন্যাস” কোনো ছাঁদই পায়নি এখনও। স্পষ্টতই আগামীকালের ইতিহাসের কার্যসূচীতে এইটা একটা বড়ো জায়গা নেবে।
ধরনে যদিও প্রভেদ ছিলো তবু বাণিজ্য ও তৎসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলি আমলাতন্ত্রের সঙ্গে যুক্তভাবে যুক্তিবাদী মেজাজের প্রধান বাহন হয়ে ওঠে। গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে উৎপাদন এবং ভোগ দুই-ই বহুল পরিমাণে নিয়ন্ত্রিত ছিলো রীতির দ্বারা। ঐতিহ্যসম্মতভাবে সমগ্র পরিবার ওই সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিত। কণাশ্রম ব্যবস্থায় এ কথাটা পরিষ্কার বোঝা যায়। বর্ণ বা জাত নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে পারিবারিক জীবিকা, সেখানে মানমর্যাদা লঘুগুরু সম্পর্কের ভিতরে বশ্যতা এবং জীবনশৈলী দৃঢ় উচ্চবাচ সোপানবিন্যাসে নির্ধারিত। এই কথা অবশ্য সত্যি হতে পারে যে এই ব্যবস্থার দার্ট নিয়ে একটু বাড়িয়ে বলা হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থায় একটা বদল আনা যে বেশ শক্ত ছিলো এতে সন্দেহ নেই।
এই প্রথাসম্মত ব্যবস্থায় বণিকদেরও একটি স্থান ছিলো। কিন্তু এটা লক্ষণীয় যে তাদের জীবিকাকে হেয়জ্ঞান করা হতো এবং সমাজ সোপানের যে পৈঠাটিতে তাদের স্থান ছিলো। সেটি রীতিমত নীচে। তাদের বিষয়সম্পদের আপেক্ষিক প্রাচুর্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই সামাজিক অসম্মানের ভিতরে একটা অসঙ্গতি দেখতে পাওয়া যায়। শুধু ভারতেই যদি এরকম হতো, পৃথক আলোচনা করতে হতো এটা নিয়ে। কিন্তু অন্যান্য সমাজেও খুবই চোখে পড়ে এর বাপক উপস্থিতি। মধ্যযুগীয় জাপানে শি-নো-কো-শো প্রথায় শো নামে যাদের পাই সেই বণিকদের স্থান যথাক্রমে ‘নো’ এবং ‘কো’ অর্থাৎ চাষী এবং কারিগরদের চেয়েও নীচে। এ-ও লক্ষ্য করতে হবে যে অ্যারিস্টটল বাণিজ্যিক কাজকর্ম এবং টাকা কামানোকে খেলো কাজের ভিতরে গণ্য করেছিলেন। বণিকশ্রেণীর প্রতি এই রকম প্রতিন্যাস এতখানি পরিব্যাপ্ত হলো কী কারণে? কেবলমাত্র ইচ্ছের জৈারে তাদের অস্তিত্ব উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কাজেই সমাজ-সোপানে একটা স্থান বণিকদের জন্যও রাখা। হয়েছিল। কিন্তু প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় নৈতিকতা বোধের সঙ্গে এই শ্রেণীটির স্বধর্মে এমন গভীর গরমিল ছিলো যে তাদের নিঃসন্দেহ সমৃদ্ধি সত্ত্বেও কিছুতেই তাদের প্রভুগোষ্ঠীর অন্যতম হিসেবে নেওয়া বা সমাজের উচ্চমার্গে স্থান নির্দেশ করা সম্ভব হয়নি।
এই গরমিল কোনখানে? গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে উৎপাদন ছিলো প্রত্যক্ষ ভোগ ব্যবহারের জন্য, বণিক সম্প্রদায়ের লক্ষ্য মুনাফা। অথং সমাজের অন্য সবার তুলনায় তারা যেন স্পষ্টতই আত্মসচেতন হিসেবী বুদ্ধির প্রতীক হয়ে উঠেছিল, তাদের সাফল্যও এসেছিল এই হিসেবিয়ানার জোরেই। যদিও বর্ণগত নিয়মরীতির কিছু-কিছু এদেরও মেনে চলতে হতো তবু এই সম্প্রদায়ের গোনাগাঁথা কেজো বাস্তববোধের ভিত যুক্তির যে-চেহারা পরিদৃশ্যমান এবং ক্রমশ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে সেই যুক্তিধর্মিতার মুখে প্রাচীন ব্যবস্থার ভিতর দুর্বল হয়ে যেতে বাধ্য। ঐতিহ্যবাহী সমাজের তার আভ্যন্তরীণ কোনো অংশ, যে-অংশ অপরিহার্যভাবে এই সমাজে সংলগ্ন, ধনতান্ত্রিকতায় যেমন অঙ্গাঙ্গী সর্বহারা শ্রেণী, সেই রকম কোনো অংশের ক্রিয়ায় ভাঙতে শুরু করেনি। বরং বলা যায় মূলতই বহিরাগত একটি উপাদানের বৃদ্ধি রোধে অক্ষম হওয়াতে এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার ভিতরে এই বাড়বাড়ন্ত উপাদানটিকে সমন্বিত করে নিতে না পারার দরুন ঐতিহ্যবাহী সমাজব্যবস্থায় ভাঙন ধরে গেল।
বাণিজ্যের প্রসার এক রকম নতুন নগরজীবনের সূত্রপাত করল। নবযুগকে স্বাগত জানিয়ে নগরে দেখা দিল নতুন ব্যক্তি স্বাধীনতার মেজাজ। জামান প্রবচনে বলে, ‘শহুরে হাওয়ায় স্বাধীনতার নিঃশ্বাস। ভূমিদাসেরা পালিয়ে গিয়ে শহরে ঢুকে পড়তে পারলে ভিড়ে হারিয়ে থাকত এবং কিছুকাল পরে মুক্ত হয়ে যেত। এইভাবে পুরোনো সমাজ যা দেয়নি, নতুন সমাজ মানুষকে একটা নতুন চলাফেরার স্বাধীনতা দিল। দিল নিজের বৃত্তি নিবার্চনের স্বাধীনতা। সেই সময়ে কাজের কিছু সুযোগও বেড়ে যাওয়ায় এই স্বাধীনতা খুবই অর্থবহ হলো। শিল্প ও বাণিজ্য ক্রমবর্ধমান। কিছুটা ভাগ্যের আনুকূল্য পেলে যে কোনো উদ্যমশীল মানুষ সমাজের সঙ্কীর্ণ সীমায় ইতিপূর্বে যেটুকু সুযোগ পেতে পারত তার তুলনায় বহু বিচিত্র বৃত্তি থেকে নিজস্ব কাজটি বেছে নেবার অবকাশ পেয়েছে। এই ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের নতুন ধ্যানরূপ গড়ে দেওয়ার বাস্তব ভিত্তি দিয়েছে। এলো সেই ব্যক্তি মানুষ, সমাজে যার পূর্বনির্ধারিত স্থান নেই, নিজেকে নিয়ে অন্তহীন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিজের অপরিসীম সম্ভাবনাকে বিকশিত করবার জন্য যার জন্ম।
ব্যক্তিদের সঙ্গে সঙ্গে একভাবে বিশ্ববোধেরও জন্মদাতা বাণিজ্য। কোনো অনড় এবং আত্মস্থিত গোষ্ঠী নিজেদের বিশিষ্ট নিজস্ব রীতিনীতি নিয়ে কাল কাটিয়ে যেতে পারে। কিন্তু নানা দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে আদানে প্রদানে লিপ্ত বণিকদের স্বভাবতই বারোয়ারী আইনের বন্দোবস্ত খুঁজতে হয় একটু বেশি যাতে আঞ্চলিক রীতিনীতির প্রভূত ভিন্নতা সত্ত্বেও চুক্তিবদ্ধ হওয়া কিংবা বাদ বিসংবাদ মেটানোর একটা ভিত্তি থাকে। আইনকে নৈর্ব্যক্তিক যুক্তির প্রকাশ হিসেবে ভাবার প্রথম সূত্র এইখানে রয়েছে। এর সঙ্গে এক নতুন সাম্যভাবও যুক্ত হয়েছে। পসারীর কাছে সব ক্রেতাই তো সমান। জাতিধর্মনির্বিশেষে কী কিনছে, কতটা কিনছে খদ্দেরের পরিচয় এইটা দিয়ে। জাত পাত বিচার করে যদি পসারী খদ্দের বাছতে যায় তাহলে বলতে হবে সে স্বধর্মত, মূল করণীয় কাজটি সে করছে না।
একটু থেমে খতিয়ে দেখলে কী পাই? শিল্প আর বাণিজ্য যৌথভাবে গড়ে তুললো। অদ্ভুত, মর্মান্তিক স্ববিরোধে দীর্ণ এক পৃথিবী। একদিকে এই যৌথ ক্রিয়া প্রবলবেগে ক্রমবিবর্তিত যুক্তির এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে সমাজকে। ব্যক্তিত্ব সম্ভাবনার বহুরূপী বৈশিষ্ট্য বিষয়ে বোধ জেগেছে এই আবহে, জানা গেছে মানুষের ব্যক্তিসত্তার বিকাশে স্বাধীনতার মূল্য কী। আর, ব্যক্তিত্বের মূল্যবোধের সঙ্গে ঐহিক পরিপ্রেক্ষিতে ন্যস্ত বিশ্ববোধকেও মেলানো গেছে এই সময়েই। তবু অন্যদিকে একই সময়ে এসে গেল। শিল্পের যে-সংগঠন আর শ্রম বিভাজন তাতে অধিকাংশ মানুষ কর্মসূত্রে এমন কাজে নিরত থাকতে বাধ্য যাতে যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তির চাপে সে জন্তু হয়ে ওঠে। উৎপাদন ব্যবস্থা এমনভাবেই বিবর্তিত হলো যাতে এক স্ববিরোধিতায় সমাজের পক্ষে অনুকূল শ্রমিক এই ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সৃজন সম্ভাবনা বাদে প্রায় অন্তঃসারশূন্য হয়ে যায়। এই স্ববিরোধকে অ্যাডাম স্মিথের চেয়ে স্পষ্ট করে আর কেউ দেখতে বা বর্ণনা করতে পারেননি। শ্রম বিভাজনের ফলে আর্থনীতক সুযোগ-সুবিধার বিখ্যাত বিবরণ লিখে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন অ্যাডাম স্মিথ। নতুন ব্যবস্থায় শ্রমিক তার যথানির্দিষ্ট কৃত্যে যে অসামান্য পরিমাণ নিপুণতা আনতে পেরেছে তা যে সম্ভব হয়েছে কেবল পুরো মানুষ হিসেবে তার গুণ এবং মূল্যকে খেসারত দিয়ে এই কথাটা বলতে বলতে অ্যাডাম স্মিথ তাঁর দ্য ওয়েলথ অ নেশন বইয়ের পঞ্চম খণ্ডে এই মর্মভেদী মন্তব্য যোগ করেছেন “এমন (ভাগ্যহত) ছিল না সেই সমাজ, যদিও অসভ্য বলেই বর্ণনা করা হয় বিদেশী বাণিজ্য পণ্যসামগ্রী প্রস্তুতির উন্নতিবিধানের পূর্বকালীন কৃষিকাজের অদক্ষ দশাকে। সেই সব সমাজে..নিম্নশ্রেণীর সকল মানুষের বোধভাষ্য যে-আচ্ছন্নতায় সুসভ্য সমাজে জড়ত্বপ্রাপ্ত। হয় তেমন মূঢ়তার আবেশে মনকে ঠেলে দেওয়া হয়নি।” অ্যাডাম স্মিথের এই সব ভাবনা ধারণার সঙ্গে মার্ক পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর প্রথম দিকের কিছু লেখায় এসব ভাবনার প্রতিধ্বনি মেলে।
আভ্যন্তরীণ এই স্ববিরোধ সত্ত্বেও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গী কিংবা তথাকথিত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির চমকপ্রদ অগ্রগতির প্রতীক এবং দৃষ্টান্ত হলো আধুনিক শিল্প। সত্যি বলতে কি এই শিল্প এবং উন্নত প্রয়োগবিদ্যাকে উক্ত দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব সার্থকতার নিদর্শন ধরে নিয়েই এই দৃষ্টিভঙ্গির উৎকর্ষ বিষয়ে জনমানসে সমীহ ভাবটি যেমন জেগেছে তেমন আর কোনোভাবে জাগত না। যুক্তিবাদী মন জানে বিশ্বজগৎ নিয়মের রাজত্ব। প্রাচীনকালে এই বিশ্বাস কঠিন সাহসের সঙ্গে জীবনকে মেনে নেবার বল যুগিয়েছে। আধুনিক যুগে। সম্পদ ও শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রত জাতি ও গোষ্ঠীপ্রভাবিত পৃথিবীতে নতুন করে এই আস্থা জেগে ওঠার মূলে রয়েছে এর প্রয়োগিক সুফল।
আধুনিক সমাজে নামহীন এক আইন চলছে, একে নাম দেওয়া যাক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ বিধি। ব্যক্তিগত-মালিকানা-ভিত্তিক পুঁজিবাদী সমাজের প্রেক্ষিতে এই আইনের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণান্তে মার্ক-এর নাম দিয়েছিলেন পুঁজির আঁটুনি ও। কেন্দ্রীকরণ বিধি। তিনি ভেবেছিলেন উৎপাদনের হাতিয়ার কয়েকজনের মুঠোর ভিতরে মালিকীস্বত্বে এঁটে গেলেই সমাজ দুই শক্রশিবিরে সম্পূর্ণ বিভক্ত হয়ে যাবে। অথচ আধুনিক সমাজে আমলা এবং নানা বৃত্তিধারী মানুষের জোট মিলে মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি হয়েছে, এঁরা অর্থনীতির “রাষ্ট্রকৃত অংশে যেমন ব্যক্তিগত উদ্যোগ”-এর ভাগটিতেও তেমন বেশ সুখে স্বচ্ছন্দেই থাকছেন। মনে হয় মাসের বিধিতে যা বিবৃত হয়েছে তা মূলত আরো সামান্য একটি প্রবণতার বিশিষ্ট এক দৃষ্টান্ত মাত্র। আমাদের যুগে নানারকম। সামাজিক বিন্যাসের ভিতরেও আমলাতন্ত্র যেভাবে বেড়ে উঠেছে তাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ বিধি বিষয়ে বেশ শিক্ষাপ্রদ উদাহরণ পাওয়া সম্ভব। লক্ষণীয় যে উন্নত প্রয়োগবিদ্যার যুগে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এই কেন্দ্রীকরণকে বেশ জোরালো যৌক্তিক এবং নৈতিক সমর্থন যুগিয়েছে।
পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উৎপাদন এবং বিপণনের সিদ্ধান্ত নেয় পৃথক পৃথক ব্যবসায় সংস্থা। শিল্প যেখানে এমন বেশ কটি ব্যবসায় সংস্থার সমাহারে রচিত যার কোনোটিই মাপে ছোট নয় অথচ তেমন বৃহদায়তন বা জোরালো নয় যে সমগ্র শিল্পকে একেবারে কজার ভিতরে রাখবে, সংক্ষেপে বলতে গেলে মেজকতাদের রাজত্ব যেখানে, সেখানে অন্যান্য অনুরূপ সংস্থার সিদ্ধান্ত বিষয়ে অনতিপর্যাপ্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রত্যেক ব্যবসায় সংস্থাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় অথচ অন্যান্য সব ক’টি সংস্থার নিজ নিজ মুখ্য সিদ্ধান্তগুলি বাজারকে প্রভাবিত করে দারুণভাবে। এ অবস্থাকে সন্তোষজনক বলা যায় না, অনেক অসুবিধা হয় এতে। প্রায় একই কথা বিভিন্ন শিল্পের পরস্পর সম্পর্ক বিষয়ে বলা সম্ভব। সেখানেও একটি শিল্প অন্যগুলির খবরাখবরের ভগ্নাংশমাত্র পায়, নীতি নিধারণ ব্যাপারে পরস্পর পরস্পরের কাছে সমান্যই জানতে পারে। কাজেই সমবেত সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযোগী কোনো ব্যবস্থা করে নিতে পারলে সেটা ব্যবসায় সংস্থাগুলির স্বার্থের অনুকূলই হতো। বিশেষত যেখানে অনেকগুলি শিল্প একই ধরনের পরিসেবাগ্রহণে কিংবা একই অথবা সমজাতীয় দ্রব্যসামগ্রীর ক্রয়বিক্রয়ে কোনোভাবে যুক্ত হয়েই রয়েছে, সেই সব ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থাকে কোনো না কোনো আকারে চালু করবার উপযোগিতা অনস্বীকার্য। শিল্পের সম্মিলিত সংগঠন বা শিল্পজোটের নানারকম আন্দোলনের ভিতরে। যুক্তির দিকটা হলো এই। অবশ্য অ্যাডাম স্মিথ যেমন বলে গিয়েছিলেন এই ধরনের চেষ্টাকে একদিক থেকে জনসাধারণ তথা ভোগ্যপণ্য ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে শিল্পপতিদের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখা সম্ভব। কিন্তু অন্যদিক থেকে ব্যবসায়সংস্থার ভিতরে এবং শিল্পে-শিল্পে এই জোটবদ্ধ উৎপাদনকে যুক্তিসহ করবার অনুকূল পরিবেশ গড়ে। যাকে “ব্যক্তিগত উৎপাদনের বিশৃঙ্খলা” বলা হয়েছে সেই অরাজকতা থেকে মুক্তি পাবার এই একটা উপায়।
এক ধরনের যুক্তিবাদিতার কাছে অখণ্ড পরিকল্পনার স্পষ্ট আবেদন রয়েছে। লক্ষ্যের সঙ্গে উপায়কে মিলিয়ে দেবার নাম হচ্ছে যুক্তি। আয়তগম্য উপায় সম্বল কোথায় কী কতটুকু আছে তার সম্পূর্ণ খতিয়ান নিয়ে কাজে হাত দিলে এই মিলিয়ে দেওয়া সার্থক হতে পারে। এইভাবে দেখলে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা আংশিক পরিকল্পনার চেয়ে উঁচুদরের হতে বাধ্য। এই ধরনের প্রাপ্য সহায়সম্পদ গুণে গেঁথে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার সপক্ষে রায়। সবচেয়ে জোরালো হয় যখন পরিকল্পনার লক্ষ্য একেবারে খুবই পরিচ্ছন্ন এবং বিকল্পহীন। দৃষ্টান্ত যুদ্ধকালীন পরিকল্পনা।
কেন্দ্রীয় পরিকল্পনানুগ জাতীয় অর্থনীতির যে জোরদার আদর্শটি প্রথম মেলে তার উদ্ভব প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন জামানীতে। উল্লেখযোগ্য এপ্রিল ১৯১৫তে পেট্রোগ্রাডের এক পত্রিকায় লারিন লিখছেন : “সমকালীন জামনিী পৃথিবীকে এই যে কেন্দ্রাভিগ জাতীয় অর্থনীতির রূপরেখাঁটি দিল, এটি যেন পরিকল্পনানুসারে সক্রিয় একটি যন্ত্র।” দ্য। বলশেভিক রেভলুশন বইতে এভোয়ার্ড হ্যালেট কার দেখিয়েছেন যে গৃহযুদ্ধের যুগে সাম্যবাদের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকে অনুপ্রাণিত করেছিল ওই জার্মান রূপরেখা। কেন্দ্রীয় শক্তি গুটিকয়েক ছকে বাঁধা লক্ষ্য সমাজের উপরে চাপিয়ে দিলে মুক্ত সমাজের আদর্শের সঙ্গে তার গরমিল ঘটে যায় কিন্তু সে হচ্ছে ভিন্ন কথা। বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক অর্থে আঞ্চলিক অথবা আংশিক পরিকল্পনার সমাহারের চেয়ে একটা কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার ভিতরে যুক্তি মূর্ত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ঢের বেশী। কার্যক্ষেত্রে আমরা জানি এই পরিকল্পনাকে কার্যকরী করবার উপযুক্ত জোরালো এবং মাপসই আমলাতন্ত্র যেই গড়ে তোলা হয় অমনি পরিকল্পনা মূর্ত হওয়ার সঙ্গে অনিবার্য নানা বিকৃতিও মূর্ত হতে থাকে। আমলাতন্ত্র এবং কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা পরম্পরনির্ভর। উভয়ের যৌথকমের ভিতর দিয়েই আমাদের যুগের বিশেষ ধরনের যুক্তির বিস্তারের ঐতিহাসিক হাতিয়ার হিসেবে এরা চিহ্নিত হয়ে রইল।
পূর্বেই বলেছি যুক্তি একটি গণ যার অগণ্য প্রজাতি। এ-ও বলা যায় যুক্তি একটি ভাব যা বহু রূপ ধরে। একটা যুগের মুখ্য যুক্তি হচ্ছে সেটাই যা সেই যুগের মুখ্য প্রতিষ্ঠানগুলিতে, জীবনযাপনের ভঙ্গিতে এবং কর্মে আকার পায়। মধ্যযুগের যুক্তির চারিত্র ছিলো বিভাজন। কী তার ব্যাকরণ কিংবা আইনতত্ত্ব, কী-ই বা তার বর্ণাশ্রম প্রথা সব কিছুর ভিতরেই বিভাজনের ধারা আকৃত। আধুনিক যুগের বিশিষ্ট যুক্তির চরিত্র আমাদের জীবন ও সমাজে প্রভাববিস্তারী বাণিজ্যিক এবং আমলাতান্ত্রিক ধাঁচের ভিতরে কাজ করে যাচ্ছে। এই যুক্তি আসলে প্রয়োগবাদী এবং যান্ত্রিক যুক্তি। ভৌত জগৎ কিংবা সমাজ থেকে শুরু করে মনুষ্যদেহ এমনকি মন পর্যন্ত যেটাকেই এই যুক্তি বুঝবার চেষ্টা করে সেটাকে যন্ত্রবৎ দেখে। অনেক কাজের কাজ এর দ্বারা হয়েছে। কিন্তু গুরুতর সমস্যাও তেমনি এর রয়েছে অনেক। সে সমস্যা যেন ইতিহাসের সূত্রে গড়ে ওঠা এর বা আঙ্গিকে আছে তেমনি আছে সেই আঙ্গিক সম্পৃক্ত মেজাজেও।
বিমূর্তভাবে বিবেচনা করলে বিশুদ্ধ যুক্তি সর্বতঃ সত্যের বাহক। কিন্তু প্রয়োগের দাস্যে নিযুক্ত যুক্তির সীমাবদ্ধতা এবং গর্হিত বহুচারিতা সর্বজনবিদিত। কে না জানে, কার পক্ষ নিচ্ছেন তার উপরে নির্ভর করে আইনজ্ঞরা যুক্তিকে কেমন সম্পূর্ণ বিপরীত সিদ্ধান্তের অভিমুখে টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম। এর উদাহরণ আন্তজাতিক আইনের বেলায় যেমন দেখা যায় তেমনটি আর কোথাও নয়। এও দেখা যায়, ধনী ও দরিদ্র, যতই-না আপাতদৃষ্টিতে যুক্তির চোখ মেলে থাকুক, নিজ নিজ জীবনের পরিস্থিতি দ্বারা কেমন প্রভাবিত হয়েই সমাজকে দেখে। আধুনিক যুগে যুক্তির অন্যতম প্রধান রূপ, প্রয়োগবাদ, সামাজিক বিরোধে ও যুদ্ধে ক্ষমতার অস্ত্র হিসেবে কাজ করে, শান্তির প্রতিশ্রুতি আনতে। ব্যর্থ হয়। ক্ষমতা এবং ভোগকে আনন্দের চেয়ে ঢের সহজে গুছিয়ে তোলা সম্ভব, যান্ত্রিক যুক্তির লক্ষ্যও হয়ে উঠেছে সেটাই। এই যুক্তি নিজের সীমাবদ্ধতা দেখতে সক্ষম কিন্তু উন্নততর কোনো কিছুর সহায় ব্যতিরেকে সে সীমা পার হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা এর ভিতরে নেই। যারা ন্যায়নীতির জন্য লড়াই করে এমনকি তাদেরও চাই উচ্চতর বোধির আলোক যাতে পথ দেখা যায়। অন্যথায় তাদের লড়াই এক অন্যায়কে সরাতে অন্য এক অন্যায়কে ডেকে আনবে।
মানুষের ভিতরে রয়েছে এক সৃজনী শক্তি ইতিহাসের মধ্য দিয়ে যার বিকাশ আর বিবর্তন ঘটছে। এর অন্তর্নিহিত প্রবণতা এবং উপস্থিত কালের প্রতিকূলতা ও আনুকূল্যের যোগসাজসে যৌথভাবে এই সৃষ্টিশীল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। যুক্তি যখন প্রতিষ্ঠানিকতা, প্রয়োগিক নিয়মকানুন, অভ্যাস ইত্যাদির ভিতরে বিধৃত তখন ওই সব বহিরঙ্গের দুর্গে যুক্তি বন্দী হয়ে যায়। কিন্তু চঞ্চল যুক্তির চিরস্থায়ী বাস তো সেখানে নয় কেননা যুক্তি রয়েছে প্রধানত ভাবরূপে, বহিরঙ্গে নয়, বিবর্তমান মানুষরে সৃজনী উদ্যমের অন্যতম প্রকাশই যুক্তি।
আমাদের যুগের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানবিক ক্রিয়াকর্মে জাগতিক স্বার্থের জোরটাকে বাড়িয়ে দেখাই। অনেক সময়েই আসলে এইসব স্বার্থের ফাঁদে সাময়িকভাবে জড়িয়ে পড়ার বিরুদ্ধে মনের খেদ প্রকাশের জন্যই এরকম করা হয়। তেমনি আরেক যুগবৈশিষ্ট্য হলো যে শ্রমকে মানবেতিহাসে অগ্রগতির শক্তি বলে আমরা গণ্য করি। গণতন্ত্রের যুগে মানুষের সৃজনী শক্তিতে আমাদের আস্থা জানানোর ধরন হলো এইটা। বৃহদায়তন শিল্প ও আমলাতন্ত্রের ক্রমবিকাশ, একদিকে ক্রমাম্বিত শ্রমবিভাজন আর অন্যদিকে ক্ষমতার কেন্দ্রায়ন, তার ভিতরে এই জটিল পরিস্থিতি উদ্ভবের যুক্তি হিসেবে “দক্ষতা”র এক যান্ত্রিক ধারণা, এই সব মিলেমিশে জীবন এবং উৎপাদন ব্যবস্থার যে প্রধান ধরনটি তৈরি হয়েছে তারই আবহে আধুনিক শ্রমিক কাজ করতে বাধ্য। ইতিহাসের একটা পর্বে এ সবেরই হয়ত প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু এখন এর বাইরে দৃষ্টি মেলবার সময় এসেছে।
তবু বর্তমানকে পেরিয়ে চোখ মেলার সময়েও আমাদের মনে রাখা দরকার আজ যে যুগের অন্তকাল উপস্থিত সেখানে ইতিবাচক আমরা কী কী পেয়েছি। সম্প্রতি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পুনরভূদয়ী আন্দোলনের ঢেউ এসেছে। ইরাণে খোমেইনি এবং তাঁর অনুচরবর্গের ইসলামের পুনরভদয়িক প্রচেষ্টা বহুর ভিতরে একটি মাত্র দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ্য। মানব সংস্কৃতির বর্তমান পর্যায়ে সাফল্যের ঘরে কোথায় কী জমা পড়লো, সীমাবদ্ধতা রয়ে গেল কোনখানে কতখানি, এর যুক্তিসহ সদ্বিচারী মূল্যায়ন ব্যতিরেকে এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আত্মঘাতী, উদ্ভট ও পশ্চাদগামী হতে বাধ্য। ওই সব বিদ্রোহী-আন্দোলন উন্নততর যুক্তি বা মনুষ্যস্বভাব বিষয়ে সেই গভীরতর বোধে উদ্বুদ্ধ নয় যার বলে ভবিষ্যৎ সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলিকে সমর্থন যোগানো যায়, সত্যই যাতে আজকের সংকট পার হওয়া সম্ভব হয়।
.
॥ ৪ ॥
তৃতীয় চরণ
ভবিষ্যৎ সমাজের বহিরঙ্গ রূপ এবং অন্তরঙ্গ ভাবমূর্তি কী হবে? এই প্রশ্নে আধুনিক ভারতের মনস্বিতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথের উত্তর খুবই তুলনীয়। এর অর্থ এই নয় যে তাঁদের মতামত এক ছিলো। দুজন সৃষ্টিশীল ভাবুকের ভিতরে খানিকটা প্রভেদ এমনকি তীব্র মতভেদ অনিবার্য। লক্ষণীয় যে জীবনের বাহ্য পরিস্থিতির এবং নিজস্ব মেজাজের পার্থক্য সত্ত্বেও কতখানি মিল তাঁদের মতের ভিতরে ছিলো।
১৯০৯-এ গান্ধীজি লেখেন হিন্দ স্বরাজ। এর কয়েক বৎসর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচিত স্বদেশী সমাজ (১৯০৪) নামক প্রবন্ধে গভীর ভবিষ্যসম্ভাবী কিছু ভাবনাধারণা প্রকাশ করেন। গান্ধীজির মতই রবীন্দ্রনাথেও ভারতীয় সমাজের বনিয়াদ হিসেবে গ্রামের প্রতিষ্ঠা। দেখতে পাওয়া যায়। স্পষ্টতই গান্ধী কিংবা রবীন্দ্রনাথ শুধু এই তথ্য বিবৃত করতে চাননি যে অধিকাংশ ভারতীয়ের বাস গ্রামে। সোজাসুজি তাঁরা একটি আদর্শের উপস্থাপনায়। সচেষ্ট হয়েছিলেন।
গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথের গ্রামীণ সমাজ সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা ছিলো, উভয়েই তত্ত্বালীন গ্রামজীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতি বিষয়ে সচেতনও ছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাঁদের রচনা। থেকে সহজেই উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ যাকে “গ্রাম্যতা” বলেছেন তার খোলাখুলি বিরুদ্ধাচরণই ছিলো তাঁর অভিপ্রেত, তাঁর বিশ্ববোধ কিংবা প্রতিনিয়ত নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডী উত্তীর্ণ হয়ে যাবার মানবিক প্রচেষ্টার একান্ত পরিপন্থী এই গ্রাম্যতা তাঁর কাছে ছিলো। অগ্রহণীয়। অনুরূপভাবে গান্ধীজিও বলেছিলেন, তিনি তাঁর স্বপ্নের গ্রামকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চান, গ্রাম বলতে যা দেখা যায় তা থেকে সেটি অনেকখানি ভিন্ন। তাহলে কোন সূত্র বা কী আদর্শের প্রতীক স্বরূপ গ্রাম এসে রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীর চিন্তায় স্থান নিল? এই আদর্শ আমাদের নিয়ে যাবে কত দূরে? এই সব প্রশ্ন এখন আমাদের বিবেচ্য।
গ্রামকে যদি আদর্শ-নির্মিতি হিসেবে নিই তাহলে মুখোমুখি-যোগযুক্ত-মানব-গোষ্ঠীর আরেক নাম হলো গ্রাম। এর বিপরীতে আছে নগরের নামহীন জনতা। মুখোমুখি-যোগযুক্ত-মানবসম্প্রদায়ে প্রতিবেশীকে মনে হয় নিজের সত্তার সম্প্রসারণ যাকে বাদ দিলে নিজে অসম্পূর্ণ। সাধনা (১৯১৩) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “কোনো কিছুকে বোঝবার অর্থ তার ভিতরে আমাদের নিজস্ব যেটুকু আছে সেটুকুকে আবিষ্কার করা এবং আপনার সীমার বাইরে আপনাকে আবিষ্কারের এই অভিজ্ঞতা আমাদের আনন্দিত করে। বোঝার এই সম্বন্ধ আংশিক, ভালবাসার সম্বন্ধটিতে আছে সম্পূর্ণতা। ভালবাসায় ভেদবোধ ঘুচে যায় এবং এক সবাঙ্গীণ সম্পূর্ণতায় মানবাত্মার উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়।” মানবগোষ্ঠীর আদর্শ প্রতীকরূপে গ্রামের বৈশিষ্ট্য এই যে পল্লীকে একটি সম্প্রসারিত মনুষ্যপরিবার বলে বোধ হয়, সদস্যরা যেখানে কেবলমাত্র স্বার্থকেন্দ্রী প্রয়োজনে পরস্পরসম্পৃক্ত নয়, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে আত্মীয়সম্বন্ধ বরং ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক স্নেহ ও প্রীতির বন্ধনে। অর্থাৎ রুসো যাকে মানবসমাজের আদিমতম, স্বাভাবিক রূপ বলে বর্ণনা করেছিলেন সেই আদি পরিবারের ভাবনির্যাসটুকু যেন ভিন্ন নামে হয়ত বা একটু পরিবর্ধিত আকারে এখানে ‘পল্লী” হয়ে উঠল। জাতিকেও পরিবারধর্মী ভাষায় ধ্যানধারণায় আনা চলে কিন্তু বিমূর্ত “জাতি” ভাবটি যে বিশাল মানবগোষ্ঠীর প্রতীক, বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেই গোষ্ঠীর ভিতরে এই ভাব যৌথ উত্তেজনা এবং আবেগের জন্ম দিলেও মানুষের পরস্পর সান্নিধ্যজাত প্রতিবেশীসুলভ উষ্ণতা ও তাৎক্ষণিক নৈকট্যানুভব এই ভাবনার দ্বারা সহজে জাগানো যায় না। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছিলেন। কী ভাবে সংগঠিত ক্ষমতার দুরাগ্রহে সামরিক সংহতির জন্ম দিয়েছে জাতীয়তাবাদ এবং একে তিনি অপদেবতা বলে পরিত্যাজ্য জ্ঞান করেছিলেন। মানুষের ভালবাসা ও সেবার ব্যাকুলতা স্বাভাবিক নির্গমনে ব্যর্থ হলে ভ্রান্ত পথে চলে যেতে চায় আর তখন তাদের মূর্তি হয়ে ওঠে সংহারক। রবীন্দ্রনাথ সমাজকে সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন এমনভাবে যাতে ব্যক্তি হয়ে ওঠে সমাজের মৌল সংস্থার অঙ্গাঙ্গী অংশ, ব্যক্তিগত সেবার ব্যাকুলতার সার্থক প্রকাশ ঘটে নিকটতম প্রতিবেশীর জন্য গঠনমূলক কর্মে। গান্ধীও “আমাদের প্রত্যক্ষ নিকটতম প্রতিবেশের সেবায় ও ব্যবহারে লাগবার প্রেরণা” অর্থেই “স্বদেশী” শব্দটিকে গ্রহণ করেছিলেন। সকল মানুষ বিষয়ে আমাদের ব্যর্থতার সমানুপাতে নিকট প্রতিবেশী “পল্লী”র প্রতি সকর্মক প্রীতির সামঞ্জস্যবিধান একান্ত আবশ্যক।
এই আলোচনাকে বিস্তারিত করবার পূর্বে এখানে কিছু সম্ভাব্য আপত্তির প্রসঙ্গ সেরে নেওয়া যাক। আদর্শল্প পল্লী অথবা নবরূপায়িত পুনরুজ্জীবিত গ্রামের স্বপ্নের বিপরীতে রয়েছে প্রকৃত রূঢ় বাস্তব, সেখানে প্রতিবেশীরা পরস্পরের প্রতি অসূয়াপরায়ণ, কুসংস্কার সর্বত্র পরিব্যাপ্ত এবং মোড়লেরা অজ্ঞ স্বজাতীয়দের উৎপীড়ন করেই চলেছে। আম্বেডকর ভারতীয় গ্রাম বিষয়ে লিখেছিলেন, “কুপমণ্ডুকতার একটি ডোবা, সাম্প্রদায়িকতা, সঙ্কীর্ণতা আর মুখতার খোঁয়াড়, একেই তো বলে গ্রাম?” রবীন্দ্রনাথ বা গান্ধী এই বর্ণনাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবেন না। কিন্তু এর জবাবে তাঁদের দুটি কথা বলবার থাকবে।
প্রথমত গান্ধী অহিংসা এবং ভালবাসার নিয়মের কথাটা বলবেন। অসূয়া এবং ঘৃণা। সংবাদ হয়ে ওঠে, তাদের দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এই সব বিচলন এবং নিষ্ঠুরতার অন্তরালে নিঃশব্দে কাজ করে চলেছে অহিংসার শক্তি। অন্যথায় সমাজ বহু পূর্বে ধ্বংস হয়ে যেত। গান্ধী লিখেছিলেন, “পরিবারের সুনিয়ন্ত্রণের প্রধান ভার নেয় ভালবাসার এই নিঃশব্দ কিন্তু অমোঘ নিয়ম।” অসুয়াই নয়, প্রতিবেশীর প্রতি প্রীতিও গ্রামের সমাজকে বেঁধে রেখেছে।
আদর্শবাদীর পক্ষে দ্বিতীয় বক্তব্যটি আরো জোরালো। আমাদের গ্রামগুলিতে খুঁত রয়েছে বহু। কিন্তু সেই যুক্তিতে আমরা গ্রাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারি না কেননা গ্রামনির্ভরতা ব্যতিরেকে গত্যন্তর নেই আমাদের। আমাদের গ্রামগুলি অস্বাস্থ্যকর হয়ে থাকলে বরং আমাদের পক্ষে যুক্তিসহ কাজ হবে তাদের সাহায্য করে রোগমুক্ত সুস্থ করে তোলা। গভীরতর প্রশ্ন হচ্ছে, কোন সৎ সমাজ কি ছোট-ছোট মুখোমুখি-যোগযুক্ত-সম্প্রদায়-বিনির্ভরভাবে গড়ে তোলা সম্ভব? অন্তত অধিকাংশ সাধারণ মানুষের পক্ষে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুখের পূর্বশর্ত হিসেবে ওইরকম মুখোমুখি গোষ্ঠীসদস্যতা আবশ্যিক মনে হয়। সে অবস্থায় সৎ সমাজের আদর্শ ত্যাগ না করলে পৃবোল্লিখিত অর্থে “পল্লী”র বিকল্প নেই বলেই পল্লীর ভাবনা আমরা পরিত্যাগ করতে পারব না।
এখানেও কিন্তু দুটো ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার। এমনকি আদর্শ হিসেবেও আমরা রুসোর বর্ণনাধন্য আদিপরিবারিক ছাঁদের সতেজ এবং স্বভাবী প্রবণতার বনিয়াদে গড়ে ওঠা পল্লীতে আজ ফিরে যেতে পারি না। মনুষ্য মনও সমাজবিবর্তনের দ্বিতীয় পর্ব আমরা ইতিমধ্যে পার হয়ে এসেছি। এই পর্বের মূল্যবান যে সব সংগ্রহ এবং অন্তর্দৃষ্টি তার রক্ষা এবং সমন্বয়সাধনের প্রয়াস করতে হবে ভবিষ্যতের গ্রহণযোগ্য আদর্শকে। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির যেটুকু সারভাগ সেটুকুকে রক্ষা করা চাই। রবীন্দ্রনাথ জোর দিয়েছিলেন এই বিষয়ে। লিওনার্ড এলমহাস্টকে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লেখেন, “আমাদের দেশের মানুষের যেটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো যথার্থ বৈজ্ঞানিক শিক্ষা:শ্রীনিকেতন [যেখানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পল্লী পুনর্গঠনের পরীক্ষা নিরীক্ষার কেন্দ্র গড়তে চেয়েছিলেন) যেন ছাত্রদের যুক্তিসঙ্গত ভাবনার আবহ তৈরী করে তোলে নইলে মূঢ় অন্ধ বিশ্বাস আর নৈতিক ভীরুতা কিছুতে ঘুচবে না।” তেমনি জরুরী ব্যক্তিসত্তার সেই ইতিবাচক দিকগুলির মূল্য বিষয়ে ধারণা যে সব ইতিবাচক দিককে রবীন্দ্রনাথ বলবেন ব্যক্তিত্ব। সচেতন চেষ্টায় ভবিষ্যৎ সমাজে এটিকে গ্রহ্ন করবার মনস্কতা গড়ে নিতে না পারলে ব্যক্তিসত্তা অনাদৃত ব্যাহত হওয়ার ভয় রয়ে যায়।
এই শেষ কথাটা একটু পরিচ্ছন্ন করে নেওয়া দরকার। “ভালবাসায় প্রভেদ মুছে যায়।” ওতেই কিন্তু বিপদ আছে। কেননা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কিছু প্রভেদ থাকারই কথা। কাজেই যা প্রার্থনীয় তা হলো এমন ভালবাসা যা ভিন্নতা সইতে পারে। অপরকে নিজের সত্তার সম্প্রসারণ ভাবাই যথেষ্ট নয়। আত্মীয় ছাঁদে সৃষ্ট আদর্শে আমরা ভিন্নতা। মেনে নেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট মন দিতে পারি না। সেই দিক থেকে এবং আরো কিছু কিছু বিষয়ে ভেবে দেখলে মনে হয় যে-সম্পর্ক আমরা চাইছি তাকে আত্মীয়তা বলার চাইতে সৎপ্রতিবেশী সম্বন্ধ নাম দেওয়াই অধিকতর সঙ্গত। সে-ই আমাদের প্রতিবেশী যে আমাদের কাছে বাইরের লোক অথচ ঠিক যেন পুরো বাইরের লোক নয়। আমরা তার কুশল চাই আবার সেই সঙ্গে তার স্বাতন্ত্র এবং ব্যক্তিসত্তাকে স্বীকার করি। তার সঙ্গে আমরা যুক্ত হই শুভইচ্ছার মাধ্যমে, ভালবাসার টানে নয়, যদি না ভালবাসা কথাটাকে খুব ব্যাপ্ত সামান্যার্থে ব্যবহার করা হয়। সমাজের মৌল সংস্থাগুলির ভিতরে প্রভেদসহিষ্ণু শুভেচ্ছার বন্ধন আবশ্যক।
.
পল্লীর সঙ্গে সঙ্গে নগরকেও চাই। গান্ধীজি বলেছিলেন, “আমার গ্রামীণ অর্থনীতিচিত্রে নগরসমূহ স্বাভাবিক স্থানই পাবে।” কী সেই স্বাভাবিক স্থান যা নগর পাবে?
নগরের বিরুদ্ধে গান্ধীর নালিশ ছিলো এই যে পল্লীকে শুষে নগর বাঁচে। সম্পদ সামর্থ্য এবং প্রতিভা সবই গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে পুঞ্জীভূত হয়। মহানগরে কেন্দ্রীভূত হয়ে ওঠে ক্ষমতা, বিজ্ঞানের সাধনা সব কিছু। আধুনিক প্রয়োগবিদ্যা এই প্রবণতাকে বাড়িয়ে তুলেছে। এটি নগরের পক্ষে তো বটেই সমগ্র দেশের পক্ষেই অস্বাস্থ্যকর। গান্ধী লিখেছিলেন, “আমি চাই যে-রক্ত এখন নগরের ধমনীকে অতিস্ফীত করে দিচ্ছে তা আবার প্রবাহিত হোক পল্লীর রক্তবাহী শিরায়-শিরায়।”
এই আলোচনাসূত্র থেকে আমরা শহর ও গ্রামদেশের সম্বন্ধ বিনির্ণয়ে এগোতে পারি। নগরের পক্ষে পল্লী এবং বিশ্বজগতের মাঝখানে সেতুস্বরূপ হয়ে ওঠা সম্ভব। নানা অঞ্চল থেকে জ্ঞান আহরণ করে নগরগুলি পল্লীতে পল্লীতে তা সম্প্রচার করে দিতে পারে। নিঃসন্দেহে এরকম একটি সম্প্রচারণ বেষ্টনীর প্রয়োজন রয়েছে। গ্রামকে গ্রামের মনে থাকতে দিলেই সেগুলি সহজেই “গ্রাম্যতা” নামে রবীন্দ্রনাথ যাকে অভিহিত করেছেন সেই প্রকার কুসংস্কার এবং ক্ষুদ্র স্বার্থে দলাদলির গর্তে পড়ে যায়। কিন্তু কেবলমাত্র জ্ঞান ও সংস্কৃতির সম্প্রচারেই শহরগুলির কাজ সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। পল্লীসংস্কৃতি থেকে রস এবং পুষ্টি সংগ্রহ করে নেওয়ার কাজও শহরের পক্ষে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যা অবশ্য প্রয়োজন তা হলো লোকসংস্কৃতি এবং নাগরিক সংস্কৃতির নিত্য সঞ্জীবনী, সজীব পরস্পর নির্ভরতা। গণজীবন ও লোকসংস্কৃতির জমিন থেকে নিরন্তর রস সংগ্রহে বিরত হলে নগরের শিল্পসৃষ্টি হবে ফুলদানিতে সাজিয়ে তোলা ফুলের মতো, কিছুক্ষণ দেখতে ভালো কিন্তু প্রকৃত প্রাণশক্তি না থাকায় কিছু পরেই শুকিয়ে যায়।
জাগতিক কাজকর্মের ক্ষেত্রেও পল্লীর পরস্পর সহায়ক ব্যতিহারী সম্বন্ধ প্রয়োজন। কিছু কিছু আর্থনীতিক কর্মকৃত্য গ্রামে বসে, গ্রামের জন্য, গ্রামগুলিকে দিয়েই সংগঠিত করে তোলা সহজ ও সম্ভব। এ কথা শুধু ভোজ্যপণ্য উৎপাদনের বেলাতে খাটে তাই নয়। উপযুক্ত গবেষণা এবং সাংগঠনিকতার সাহায্যে সম্প্রসারণযোগ্য কয়েকটি শিল্প এবং পরিসেবা বিষয়েও এই কথা খাটে। কোনো কোনো উৎপাদনী এবং প্রয়োজনীয় কাজকর্মের ব্যাপারে বর্তমানে গ্রামকে যে অনুপযুক্ত বলে মনে হয় তার সোজা কারণ হচ্ছে এই যে আমাদের গবেষণা, শিক্ষা, কিংবা ধরা যাক ব্যাঙ্কের ঋণদানের ব্যবস্থায় অন্তর্নিহিত পক্ষপাত এ সমস্তই শহরমুখী। এই ধরনের রীতিবদ্ধ পক্ষপাতকে শুধরে নেবার সমস্ত বন্দোবস্ত করে নিলেও কিছু কিছু দ্রব্যসামগ্রী এবং পরিসেবা থাকবে যা প্রধান কেন্দ্র থেকেই যোগান দেওয়া প্রয়োজন। বাড়ির উঠোনে ইস্পাত উৎপাদন প্রচেষ্টা খুব ফলপ্রসূ হয়নি এবং প্রত্যেক পল্লীতে অথবা উপজিলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার ভাবনাকে সদবুদ্ধির নিদর্শন বলা যায় না।
আমাদের চাই নানা মাপের এবং ধাপের কয়েকটি সদরশহর এবং নগর যারা পরস্পরকে এবং গ্রামকে সাহায্য করতে সক্ষম। গুটিকয়েক পরস্পরসম্পৃক্ত পল্লীর কেন্দ্রে একটি বাজার থাকলেই সেখানে ওই সব গ্রামের পণ্যসামগ্রী বিক্রি হতে পারে আবার সেখান থেকে গ্রামের মানুষ নিজেদের অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রী এবং পরিসেবাও সংগ্রহ করে নিতে পারে। এ ছাড়াও অবশ্য এমন অনেক জিনিস থাকবে যার জন্য লোককে সদর বাজারের উপর নির্ভর করতে হবে। সেই সদর বাজারের আওতায় পড়বে আরো অনেক পল্লীবৃন্দের বেষ্টনী। অর্থাৎ কিনা সদর শহর ও নগরের এক ধরনের সোপানবিন্যাস অথবা কর্মকৃত্যের যুক্তিসঙ্গত বিভাজনের ভিত্তিতে সংগঠিত বেষ্টনীকেন্দ্র চাই। প্রকৃত প্রস্তাবে এই সব কেন্দ্র ঠিকই গড়ে ওঠে কিন্তু সেই গড়ার কাজ একটু এলোমেলো ফলে ত্রুটিযুক্ত হয়। ভারতে কয়েকটি বৃহৎ নগর আর অযুত-অযুত গ্রাম রয়েছে। সংখ্যায় আরো অনেক বেশি এবং তেজী ছোট আর মাঝারি দরের শহর আমাদের একান্ত প্রয়োজন। তৃতীয় তথা উন্নতিশীল বিশ্বের অন্যান্য বহু দেশ সম্পর্কেও নিশ্চয় এই কথাই খাটে।
এখানে পল্লী ও বেষ্টনী কেন্দ্রগুলি নিয়ে কী ধরনের সাংগঠনিক পরিকল্পনার ছক দেওয়া হলো সেটা ঔষধ তথা স্বাস্থ্য পরিসেবার দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝানো যাক। এই দৃষ্টান্তে বর্তমান অবস্থার দুর্বলতাও কতকটা ধরা পড়বে। ভারতে আধুনিক চিকিৎসা বিদ্যা এবং শিক্ষণ ব্যবস্থার সরকারী প্রথামাফিক বনিয়াদ হচ্ছে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র এবং সংশ্লিষ্ট প্রয়োগবিদ্যা। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের চিকিৎসকদের চাহিদা আছে এবং শিল্পোন্নত সমাজে নিজ নিজ বৃত্তিতে কাজ করবার উপযুক্ত মোগ্যতা তাঁরা রাখেন। কিন্তু যেখানে আমাদের অধিকাংশ দেশবাসীর বাস এবং যেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রায় কোথাও নেই বললেই হয় ভারতের সেই সব গ্রামে গিয়ে কাজ করবার যোগ্য মেজাজ কিংবা শিক্ষা। কোনোটাই এঁদের তৈরি হয় না। সাবেকী ঐতিহ্যসম্মত ভেষজাদির ভিত্তিতে নেই সংগঠিত এবং তত্ত্বমূলক বিজ্ঞান। আধুনিক দৃষ্টিতে ওসব তাই একরকম স্থূল অভিজ্ঞতায় পাওয়া টোটকা। কিন্তু ওই অভিজ্ঞতার মূলে আঞ্চলিক নিত্যনৈমিত্তিক আধিব্যাধি নিবারণে স্থানীয় শিকড়-বাকড় গাছ-গাছড়ার ব্যবহারে জ্ঞান সঞ্চিত আছে, সেই জ্ঞান মূল্যবান। তবে সাবেকী ঐতিহ্যের এইসব ঔষধবিধির সীমাবদ্ধতা কিছুটা রয়েছে।
এক্ষেত্রে দুটো কাজ স্পষ্টত করণীয়। ঐতিহ্যসম্মত জ্ঞান থাকলে ঔষধপত্রের ব্যাপারে এইটুকু লাভ হয় যে দেশজ সহায় সম্বল অর্থাৎ ধারে কাছে যা মিলছে তাই দিয়েই কাজ চালিয়ে দেওয়ার উপায়টুকু আয়ত্তে থাকে। কিন্তু এই জ্ঞানের দৃঢ় বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। নীতি হিসেবেই অতঃপর এই সব ঐতিহ্যসম্মত জ্ঞানকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক বনিয়াদে ন্যস্ত করার উপযোগী সূক্ষ্মতাদানের উদ্দেশ্যে গবেষণার প্রকল্প নেওয়া আবশ্যক। আজ সরকারী ব্যবস্থাপনা যদি খুব ভালো ভাবে চলে তবু তার ফলে চিকিৎসাবিদ্যায় সুশিক্ষিত চিকিৎসক আধুনিক যন্ত্রপাতি ও নিয়মরীতি সাপেক্ষেই স্বাস্থ্য ও নিরাময়ের জন্য কাজ দিতে পারেন। সমাজের “উঁচু” তলাতেই তাঁদের কাজ প্রধানত। আমাদের কিন্তু ধাপে ধাপে নানা স্তরের মানুষের সাহায্যার্থে চিকিৎসাবিদ্যার সযত্ন সম্প্রসারণের ব্যবস্থা চাই। এমন কাঠামো গড়ে তুলতে পারা উচিত যাতে স্বল্পকালীন শিক্ষাপ্রাপ্ত কিছু জনস্বাস্থ্যকর্মী নিত্য যে সব রোগজ্বালায় গ্রামাঞ্চলে মানুষ ভোগে সেইগুলির বিষয়ে আঞ্চলিক প্রয়োজন বিষয়ে ওয়াকিবহাল হয়ে গ্রামে গ্রামে চিকিৎসা ও সেবার কাজে লেগে যান। যাঁরা এই কাঠামোর ভিতরে কর্মরত তাঁরা নিজ নিজ অর্জিত জ্ঞানের সীমা মেনে নিতে শিখবেন যাতে যে-রোগের উপশমের উপায় তাঁরা জানেন না সেই সব জটিল পীড়াগ্রস্তদের জেলা হাসপাতাল জাতীয় একটুখানি বড়ো মাপের কোনও জায়গায় পাঠিয়ে দিতে পারেন। তেমনি আবার কোনো-কোনো রোগীকে হয়ত আবো উঁচুস্তরের কোথাও, ধরা যাক রাজধানী শহরেই পাঠাতে হবে রোগনির্ণয় এবং নিরাময়ের জন্য। এতে করে নগরীর অতিভারাক্রান্ত চিকিৎসাগারগুলিতে সর্বপ্রকার রোগীর অপ্রয়োজনীয় ভিড় করে আসার প্রবণতা রোধ করা যাবে এবং লোকবল বা ঔষধপথ্যাদির যোগান বাবদে আমাদের যতটুকু সীমিত সাধ্যসামর্থ্য তার সার্থকতর ব্যবহার সম্ভবপর।
এই স্বাস্থ্যপরিসেবার দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে আমরা একটি অধিকতর ব্যাপ্ত সাধারণ সত্যকে বুঝতে চেষ্টা করছি। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যপরিসেবার ক্ষেত্রে সাবেক রীতি এবং আধুনিক প্রয়োগবিদ্যার এই যে-ব্যবধান, সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সহ শিক্ষাব্যবস্থার অভ্যন্তরে নগরমুখী পক্ষপাত, দেশগ্রামের প্রয়োজন ও অভাব মেটাবার জন্য উপযুক্ত সোপানবিন্যস্ত পরিসেবার অভাব, এ সব কিছুই চিকিৎসা তথা শল্যশাস্ত্রের সীমা পেরিয়ে সমগ্র শিল্পপণ্যোৎপাদী সমাজে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্বন্ধ বিষয়ে, বৃহত্তর প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। কাজে কাজেই ওই তথ্যাদি থেকে দূরপ্রসারী শিক্ষাগ্রহণ সম্ভব যাতে শিক্ষা, গবেষণা এবং প্রশাসনিক পুনর্গঠনে এবং এক নতুন সমাজ বিন্যাসের জন্য যথাযথ প্রয়োগবিদ্যার বিকাশে সাহায্য মেলে।
সমকালীন ভারতের সর্বাধিক সৃজনশীল চিন্তাবিদদের ভাবধারায় আরো একটি যে অসামান্য মিল নজরে পড়ে সে হলো উৎপাদনী হাতিয়ারের মালিকানা এবং উৎপাদনকর্মে সংগঠন প্রশ্নে। “যতদূর সম্ভব” গান্ধী লিখছেন, “সমস্ত কাজই করা হবে সমবায় ভিত্তিতে।” রবীন্দ্রনাথ সমবায়ের সপক্ষে অতি পরিচ্ছন্ন ভাষায় অক্লান্ত বক্তব্য সাজিয়ে রেখে গেছেন তাঁর পল্লী পুনর্গঠন সংক্রান্ত প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলীতে। বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায় জীবনের শেষ পর্বে মানবতাবাদআশ্রয়ী সমবায়িক আন্দোলনের এক মুখপাত্র হিসেবে প্রসিদ্ধিলাভ করেন। এই সব মতের মিলের কারণ খুঁজতে বেগ পেতে হয় না। আমাদের সমাজে জমি এবং অন্যান্য সম্পদের বন্টনে আছে প্রভূত অসাম্য। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র বিসর্জন দিয়েও সাম্য আনার পন্থা নিয়েই ওঠে প্রশ্ন। সমবায় হচ্ছে যথার্থ স্বাধীনতা এবং সাংগঠনিকতাকে আপোসে মিলিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধনবণ্টনে অসাম্য এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমেত আধুনিক সকল সমাজ ব্যবস্থায় আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, এই দুইয়ের মধ্যপথ দিয়ে পথ কেটে চলবার উপায় সমবায়।
সমবায়ের আকারে-প্রকারে বৈচিত্র্য সম্ভব। এই রকমের হওয়াই স্বাভাবিক কেননা যে-বিশেষ কাজকে সমবায় নিজ আয়ত্তে রাখতে চায় তার উপর নির্ভর করে সমবায়িক। সংগঠনের ধরন। যেমন উৎপাদনের ক্ষেত্রে ছোট খামারের পরিবার-ভিত্তিক কাজের সঙ্গে। বিপুল শ্রমশক্তিনির্ভর বৃহৎ শিল্পোদ্যোগের অনেকটাই প্রভেদ থাকতে বাধ্য। উনিশ শতকের মধ্যভাগে লেখনী ধারণ করে জন স্টুয়ার্ট মিল বৃহদায়তন শিল্পোদ্যোগের জন্য। পরামর্শ দেন এমন এক “সাম্যভিত্তিক শ্রমিক সমিতি স্থাপনের যার সাহায্যে শ্রমিকেরা কমেদ্যোগে আবশ্যক পুঁজির মালিকানা নিজেদের যৌথ নিয়ন্ত্রণে রেখে, যৌথকর্তৃত্বে নির্বাচিত এবং অপসারণযোগ্য অধিনায়কের কর্তৃত্বাধীনে কাজ চালাবেন।” সমবায়কে স্বাধীনতা ও সাম্যের সমাহারী প্রতীক মেনে নিয়েও তিনি কিন্তু ভেবেছিলেন যে সমাজে। সাংস্কৃতিক এবং নৈতিক মানের যথোচিত উন্নতিবিধানকল্পে পর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রকল্প না নিলে এই সহযোগিতা সার্থকভাবে কাজ করতে পারবে না। এই সাবধানতার কিছুটা ভিত্তি ছিলো। সমাজোন্নতির স্তরসাপেক্ষে শিল্প পরিচালনার ব্যাপারে কতকগুলি বাধ্যবাধকতা থাকে। সেই বাধ্যবাধকতা পেরিয়ে শিল্প পরিচালনার ধরনকে ভয়ানক বেশি উন্নত মানে পৌঁছে দেওয়া যায় না। বৃহদায়তন শিল্পে দক্ষ কর্মিষ্ঠতার অনুকূল যে সব অভ্যাস সেগুলি দেশে যথেষ্ট সুগঠিত হয়নি এবং নতুন অভ্যাস গড়ার প্রথম পর্বে অনেক সময়ে খানিকটা জোরজবরদস্তির দরকার পড়ে। যৌথ আত্মসংযম কার্যকর করার ব্যাপারে সমবায়ের উপর নির্ভর করা যাবে কি? তাছাড়াও এ রকম প্রশ্ন ওঠে যে প্রয়োজন হলে বেতনবৃদ্ধি স্থগিত রেখে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় গড়ে তোলা বনাম তাৎক্ষণিক ভোগ এ দুটি বিকল্পের ভিতরে কোনটি গ্রহণীয়? এ জাতীয় বহু প্রশ্নে যদি না সমাজ সজাগ থাকে এবং সুষ্ঠু পরিচালনাকে পর্যাপ্ত উৎসাহ দেওয়া যায় তাহলে পরিচালকদের মধ্যে নিয়মনীতির ধার না ধেরে কাজ করা বা সবচেয়ে কম বাদ-প্রতিবাদে যেতে হয় যাতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝোঁক এসে। যাওয়াই সম্ভব। সমবায়ের দ্বারা এই সব শর্ত পূর্ণ হওয়া সহজ নয়। যে-দেশ যত কম অগ্রসর সে দেশে এসব বাধা ততই পর্বতপ্রমাণ হয়ে ওঠে।
তবু সহযোগিতার নীতি হিসেবে সমবায় এক মহৎ আদর্শ। আমাদের ভবিষ্যতের গতিপথ নির্দেশিত রয়েছে এর ভিতরেই। শেষ পর্যন্ত সমাজকে এই পথেই যেতে হবে। আজ না হোক কাল বাণিজ্যিক এবং আমলাতান্ত্রিক সমস্ত সাংগঠনিক গড়ন পালটাবেই। খুব সীমাবদ্ধ স্তরের কথা বাদ দিলে আমরা গার্হস্থ্য অর্থনীতিতেও ফিরতে পারি না। প্রতিবেশিকতার ভাবরূপকে সবল করবার যোগ্য আর্থনীতিক কৃত্যকের সুপরিকল্পিত নব-জোট, নানাবিধ সমবায় এবং বান্ধব-সমিতির সঙ্গে সংযুক্ত করে নিম্নতর স্তরে ক্ষমতার বিকেন্দ্রণ-অসম্নোদ্ভাব নতুন সমাজের সাংগঠনিক রূপরেখাঁটি হচ্ছে এই ছাঁদের। পূর্ব য়ুরোপের সাম্প্রতিক ইতিহাসকে যদি পূর্বাভাষ হিসেবে গণ্য করি তবে এই সব স্বশাসিত সমবায়ে সংগঠিত মৌলিক উৎপাদনী উদ্যোগগুলিকে অতীত সোভিয়েট কাঠামোর তুলনায় বহুগুণে খোলামেলাভাবে ভবিষ্যতে বাজার অর্থনীতির পরিবেশে কাজ করতে দিতে হবে। কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্রের অমিতাচারের হাত থেকে বাঁচবার জন্য এটা দরকার।
এতক্ষণ সমাজ আর অর্থনীতির যে ছবি সাজানো হলো এর সঙ্গে রাজনৈতিক সংগঠনের কোন চেহারাটি ঠিক খাপ খায়? সংসদীয় গণতন্ত্র রাজনৈতিক দলনির্ভর। একদিকে একটি ক্ষমতাসীন দল আর উল্টোদিকে সাবেকী প্রথা এবং দেশের সংবিধানের সাহায্যে সুরক্ষিত বিবিধ অধিকারের ভাগীদার বিরোধীপক্ষ হচ্ছে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার তথাকথিত রক্ষাকবচ। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে এই ব্যবস্থার দ্বারা বহু দেশেই প্রতিষ্ঠিত প্রভুগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মত প্রকাশের অনেকখানি স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু দলনির্ভর এই ব্যবস্থার নিজস্ব কতকগুলি সীমাবদ্ধতা এবং সমস্যা রয়েছে। আধুনিক রাজনীতি মেকিয়াভেলি পন্থায় বিশ্বাসী। ক্ষমতা নিয়ে লড়াইয়ের উত্তেজনায় মত্ত হয়ে প্রতিটি দল নিজ নিজ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হিতাহিতবিবেচনাহীন পন্থা নিতে চায়। যে-সব দেশে বিবদমান অথবা পরমতসহিষ্ণু বহুজাতিক গোষ্ঠী অথবা নানা ধর্মসম্প্রদায় বর্তমান সেই সব দেশে রাজনৈতিক দলগুলিরও অনুরূপ গোষ্ঠীবিভক্ত হয়ে যাওয়ার বিপদ থেকে যায়। তখন দলাদলি প্রায়ই প্রচ্ছন্ন গৃহযুদ্ধের আকার নেয়। সে অবস্থায় মুখ্য সমস্যাগুলির সুস্থ সমাধানকল্পে দলগুলিকে দলস্বার্থের উর্ধ্বে উঠতেই হয় নইলে কোনো শোভন সমাধান আদৌ মেলে না। এই অবস্থার উদাহরণ দেওয়া খুবই সহজ, দেশ বিভাগের পূর্বে ভারত কিংবা আজকের আয়াল্যান্ড এর উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এতটা চরমে না পৌঁছলেও রাজনীতিতে নীতি ব্যাপারটি ক্ষয়ে যাওয়ার ফলে দলীয় রাজনীতিব্যবস্থা যে কী গুরুতর সমস্যাগ্রস্ত হয়ে উঠেছে তা আজকের ভারতীয় নাগরিক খুব ভালোই জানেন।
উপস্থিত রাজনৈতিক বন্দোবস্ত যেটা না-পবিত্র না-অপরিবর্তনীয় আর গভীরতর অতুচ্ছ মূল্য এই দুইয়ের ভিতরে একটা পার্থক্য করে নেওয়া ভালো। যেমন, মূল্যের কাছাকাছি যদি রাজনীতির জগতে কিছু থাকে তা হলো বাক্য ও বিবেকের স্বাধীনতা। অন্যদিকে দলীয় ব্যবস্থা যতই কাজের হোক সে হচ্ছে একটা পরিবর্তনসহ ক্রমবিবর্তনী বন্দোবস্ত। ভালো একটা পরিবারের ভিতরে কিংবা বন্ধু সমাজে সমালোচনার স্বাধীনতা থাকে কিন্তু দ্বন্দ্বের রেখা তো সেখানে নির্দিষ্ট দলের সীমায় সীমায় মিলিয়ে অনড়ভাবে টানা হয় না। দলীয় ব্যবস্থাকেও যদি সেই ধরনের সমাজে চালানো হয় যে সমাজে ঐতিহ্যের দরুনই। হোক কিংবা দশজনের কাণ্ডজ্ঞান সুশিক্ষিত বলেই হোক স্বাধীন সমালোচনার মনোবৃত্তিকে। শ্রদ্ধেয় জ্ঞান করা হয়েছে, তাহলে দলীয় ব্যবস্থাও হয়ত কতকটা ভালোই চলবে। দলীয় ব্যবস্থার ত্রুটি আছে এর অর্থ কি এই যে একদলীয় ব্যবস্থায় উন্নততর রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি হবে? তা নয় কেননা এতে প্রতিবাদের অধিকারই প্রায় অস্বীকৃত যার ফলে এ ব্যবস্থা মানবিক স্বাধীনতার অন্যতম মৌল শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন হয়ে যায়। মার্কসের আশ্বাস ছিলো রাষ্ট্র ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। আজ কোনো-কোনো দেশে দলই হয়ে উঠেছে রাষ্ট্র। আশা রাখতে পারলে বলা যায় দল ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গেলে তারপরে দেখা দেবে দলহীন। গণতন্ত্র। এই নির্দলীয় গণতন্ত্রের কোনোপ্রকার অভাদয়িক প্রচেষ্টা করতে চাইলে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের ছোট-ছোট কেন্দ্রগুলি তার উপযুক্ত পরীক্ষাগার হতে পারে। গান্ধীজির শেষজীবনের সিদ্ধান্ত স্মরণীয় জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে দিলেই সেটা জাতির পক্ষে ভালো হবে। ওই সিদ্ধান্তে প্রোথিত ছিলো ভবিষ্যতের নতুন রাজনৈতিক আদর্শের বীজ। নতুন আদর্শের কাঠামোকে সহসা স্থাপিত করা যায় না কিন্তু মৌলিক পুনভাবনা যদি কিছু করতে চাই তার এই সময়। কোনো একরেখ দল কিংবা রাষ্ট্র নিজের মুঠোয় সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ে মেকিয়াভেলি-নির্দিষ্ট পথে চলে মানব স্বাধীনতার পরম বাহক হয়ে উঠবে এমন হয় না।
আদর্শ মানব ধারক ও সমাজের মূল সংস্থা যদি হয় ব্যক্তি অথবা পল্লীতুল্য মুখোমুখি-যোগযুক্ত-মানবগোষ্ঠী, মানুষের অন্তিম আনুগত্যকে অবশ্য ন্যস্ত রাখতে হবে সমগ্র মানবতায়। আরো যা প্রয়োজন তা কেবলমাত্র সাংগঠনিক বহিরঙ্গের পুনর্বিন্যাসে সীমাবদ্ধ নয় অনুরূপ অন্তরঙ্গ পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত। উপস্থিত যে অবস্থাগতিকে এই অন্তরের দিকের কথাটা ধরা যাচ্ছে সে বিষয়ে অল্প একটুখানি উল্লেখ করি।
গত ত্রিশ বৎসরে শিল্পোন্নত দেশে সমৃদ্ধির এক অতি উচ্চস্তরে একটি প্রজন্ম বড়ো হয়ে উঠেছে, এমন উচ্চমানের সমৃদ্ধির ভিতরে তুলনীয় সংখ্যক মানুষ ইতিহাসের পূর্ববর্তী অধ্যায়ে অন্য কোনো প্রজন্মে এ-ভাবে বেড়ে উঠতে পারেনি। এই প্রথম আমরা পেলাম যথেষ্ট শিক্ষাপ্রাপ্ত, প্রাণবন্ত বহু লক্ষ যুবক-যুবতী পৃথিবীব্যাপী উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে যারা পূর্বে যা ছিলো সে তুলনায় ঢের বেশি পরস্পরের নিকট সান্নিধ্যে এসেও অস্থির এবং অসুখী অথচ দারিদ্র্য তাদের দুঃখের প্রধান কারণ নয়।
এরই পাশাপাশি জনসংখ্যা অসম্ভব বৃদ্ধি পেয়েছে দারিদ্রপীড়িত দেশগুলিতে। পূর্বাপেক্ষা বৈষম্য-চেতনা যে-পৃথিবীতে শতগুণে তীব্র হয়ে উঠেছে সেখানেই জাতিতে জাতিতে অর্থনীতিক বৈষম্য উঠেছে বেড়ে। অনুচ্চারিত এমন আশা কখনও থাকলেও থাকতে পারতো যে শিল্পের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এই বৈষম্য আনুপাতিকভাবে। কমে আসবে। এখন তেমন আশা পোষণ করা কঠিন হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর সমগ্র লোকসংখ্যার মোটামুটি কুড়িভাগের একভাগের বসতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে দেশের জীবনযাত্রার মান ধরে রাখতে পৃথিবীর মৌল সম্পদের প্রায় অর্ধেক নিজেদের প্রয়োজনে টেনে নিচ্ছে। দৃষ্টিগোচর সময়সীমার ভিতরে ওইরকম মানের কাছাকাছিও পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে পৌঁছে দেবার ভাবনাকে সম্ভাবনার বাইরে রাখাই বিধেয়। সাম্প্রতিক তৈল সংকটের ফলে সবাই খেয়াল করে আয়ত্তগম্য শক্তির উৎসের খতিয়ান নিতে বাধ্য হয়েছেন। এটা খুবই স্পষ্ট যে কয়লা বা পেট্রলিয়ামের মতো যে-সব শক্তির পুনর্নবীকরণের পথ নেই সেগুলি শীঘ্রই ফুরিয়ে যাবে। পারমাণবিক শক্তি যেমন নতুন আশা জাগিয়েছে নতুন সমস্যাও তেমনি এনেছে অনেক। ই. এফ. শুমাখর তাঁর স্মল ইজ বিউটিফুল গ্রন্থে “তথাকথিত শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে আণবিক শক্তির ব্যবহারে মানবিক বিপর্যয়। সম্ভাবনা সৃষ্টির কথা বলেছেন। তিনি বিবৃত করেছেন কী ভাবে পারমাণবিক চুল্লী থেকে তেজস্ক্রিয়-আবর্জনা বিপুল পরিমাণে ছড়িয়ে যায়। তেজস্ক্রিয়তায় বাতাস জল এবং মাটিকে যে-রকম বিপজ্জনকভাবে দূষিত করে সেই বিপদকে বহু গুণে বাড়িয়ে না তুলে আমরা পারমাণবিক শক্তির উপরে নির্ভরতা তেমন কিছু বাড়াতে পারব না। মস্তো বড়ো এক উভয় সংকটে পড়েছি আমরা। এই অবস্থায় শুমাখর আশা দেখতে পান শুধু “যে..প্রকৃতির আমরা অচ্ছেদ্য অংশ সেই প্রকৃতির সঙ্গে সহযোগের অপেক্ষাকৃত অহিংস, সুসমঞ্জস, অঙ্গাঙ্গিক পন্থা যতগুলি মেলে সবগুলির অনুসন্ধান ও অনুশীলনে”। এতে ধরা পড়ে প্রয়োগবিদ্যা এবং তৎসংশ্লিষ্ট জীবনযাপনের যে ভঙ্গি পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তাকে ঢেলে সাজানো দরকার। সমর পরিকল্পনায় চাই অত্যন্ত কৃতসংকল্প কেন্দ্রীয় অর্থনীতি, জাতীয় সীমানার ভিতর অতি কঠিনভাবে আবদ্ধ সেটা অহিংস পরিকল্পনার বেলায় কাজের আরম্ভ হলো গ্রামে কিন্তু সারা পৃথিবীকে না-ছুঁয়ে এর ক্ষান্তি নেই।
হিরোশিমা স্মৃতির তাড়না যেন অন্য সব সমসার নিত্য পটভূমি। অস্ত্রধারণে সক্ষম দুখানি হাত নিয়ে শিকারী লাঙ্গুলবিহীন বানর রূপে যখন মঞ্চে মানুষ অবতীর্ণ তারপর দীর্ঘ পথ পার হয়ে এলাম। একদিন এটাই তাকে দিয়েছল অন্য সব প্রতিদ্বন্দ্বীর তুলনায় অপরিমিত সুযোগ এবং শক্তি। আজ মানুষই একমাত্র সেই ভয়ংকর বৈশিষ্ট্যচিহ্নিত জীব যে উপযুক্ত সংহারশক্তি ক্ষেপণ করে স্বীয় প্রজাতিকে কয়েক ঘণ্টার ভিতরে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। মানবপ্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষার এক নতুন পূর্বশর্তের পরিপ্রেক্ষিতে অহিংসার বাতা আজ সবিশেষ অর্থবহ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু আণবিক বোমার ফলে মানবদশায় এতখানি নাট্যসম্ভাবনা না হলেও নবীন ভাবের উদয় সম্ভবত মানবেতিহাসের এই পর্যায়ে অবশ্যম্ভাবী ছিলো। কেননা নবীন এই-যে ভাবটি মাঝে মাঝে অভিনব চরমপন্থার আকার নিয়েছে এর জন্ম হয়েছিল প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও চেতনার সীমাবদ্ধতার তিক্ত বোধ থেকে। এটা লক্ষণীয় যে পৃথিবীর সর্বত্র এর প্রতিধ্বনি জাগলেও যে-সব সমাজে প্রতিষ্ঠিত সাবেকী প্রথার একদা সর্বৈব জিত ধরে নেওয়া হয়েছিল সেই সব জায়গাতেই এই ভাব আত্মপ্রচার করেছে সবচেয়ে বেশী।
দার্শনিকেরা পৃথিবীকে শুধু ব্যাখ্যা করেছেন, মার্কস্ বলেছিলেন, আসলে যা করতে হবে তা হলো এর পরিবর্তন। এবং তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে সমাজের পরবর্তী উন্নতির স্তরে। যাবার বেলায় সর্বহারারাই হবে পরিবর্তনের বাহন, বিশ্ববিপ্লবের পথপ্রদর্শক। কিন্তু যুগের মেজাজে বদল এসে গেছে এর ভিতরেই। ১৯৬৮-তে বিপ্লবী আন্দোলনের পুরোভাগে এলো ছাত্র এবং যুবসমাজ। সারা পৃথিবীতেই ঘটল এটা। কী ফ্রান্স, কী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কী পোলাণ্ড, কী-ই বা চীন সর্বত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিলো ছাত্র এবং যুব সম্প্রদায়ের হাতে। একে অতঃপর পুরোনো অর্থে শ্রেণীসংগ্রাম বলা যায় না কেননা মার্কস্ শ্রেণীকে সংজ্ঞার্থ দিয়েছেন উপস্থিত উৎপাদনী সম্পর্কের নিরিখে। ছাত্রদের ছাত্র হিসেবে বৈশিষ্ট্য দেয় এই তথ্য যে তারা এখনো উৎপাদনী সম্বন্ধের বাঁধাবাঁধিতে প্রবেশ করেনি এবং সে সম্বন্ধ জালে জড়িয়ে যায়নি। বাকি সমাজ থেকে তারা ভিন্ন, উৎপাদনী সম্পর্কজাল থেকে অপেক্ষাকৃত মুক্ত। এতেই তাদের আদর্শবাদ এক অর্থে যেমন পবিত্রতর, অন্যদিকে অনেকটাই অরাজকতাপন্থী। ফরাসী দেশ থেকে চীন পর্যন্ত এক অসামান্য অথচ অপরিকল্পিত ঐক্যতানিক আন্দোলনে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল যুবশক্তি। এরকমটি প্রায় হয়ে থাকে যে পুরোনো বুলি কপচাতে কপচাতেই মানুষ নতুন উদ্দেশ্যে নতুন লড়াইয়ে নামে। ভাবের নিঃশব্দ অগ্রগতির সঙ্গে তাল রাখতে না পেরে ভাষা পিছিয়ে থাকে। যে সব তরুণ পৃথিবীকে পালটে দিতে চাইছিল তারা পুরোনো ভাবাদর্শের ছাঁচ দূরে ফেলে দিয়ে এসেছিল অথচ অনেকের মুখেই ধরতাই বুলি ছিলো সাবেকী। নিজস্ব ভাবরূপের অনুরূপ ভাষা তাদের এখনো আবিষ্কার করে নিতে বাকি আছে।
১৯৪২-এ প্রদত্ত কমলা বক্তৃতামালার ভিত্তিতে গ্রথিত রিলিজন এ্যান্ড সোসাইটি বইতে রাধাকৃষ্ণণ বলেছেন “পূর্বকালে সভ্যতাকে যে বাধার সম্মুখীন হতে হতো তা ছিল বস্তুজগতের এবং বাইরের বিরোধ, পরবর্তীকালে যা আসবে তা ভিতরের এবং আত্মিক।” তিনি এ-ও বলেছিলেন, “বাস্তবিকের কাছে মানবিকের পরাজয় আমাদের সমাজের প্রধান দুর্বলতা এই।” বাস্তব এবং আত্মিক ভাবের এই নিঃশর্ত বিচ্ছেদ ইতিহাসের পরখে টেকে কি না সন্দেহ আছে। মানবসভ্যতায় ভাব এবং বস্তু ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ানিরত, একটিকে ধরতে গেলেই দেখা যায় অন্যটি এসে পড়েছে। তা সত্ত্বেও রাধাকৃষ্ণণ যা বলেছেন তার ভিতরে কিছু সত্য রয়েছে। “জীবনের বস্তুময় যন্ত্রটির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এই যন্ত্রের বাহ্য উন্নতি সাধনেই মানুষের সর্বৈব সুখ চিরকালের মতো পাওয়া যাবে এরকম ভাবাও ভুল। দারিদ্র্য দূর করা জরুরি। তেমনি আবার দরিদ্রই শুধু এই মোহের স্বাদটুকু পায় যে দারিদ্র গেলেই পথের শেষে ওইখানে সর্বসুখ সেজে রয়েছে। নতুন যে প্রজন্ম বিশেষ করে প্রতীচ্যে বড়ো হয়েছে তাদের কাছে বাস্তব অভাব তো কোনো মুখ্য সমস্যা নয়। তবু তাদের কতজন কী অসম্ভব দুঃখী। ব্যক্তিকে মুখোমুখি-মানবসম্প্রদায়ের সদস্যয় ঠিকমত ফিরিয়ে দিতে পারলে হয়ত এ সমস্যার কতকটা নিরসন হবে। কিন্তু সমাজ স্থাপত্যের কোন নিয়ম কানুন মেনে কেমন করে সেটা করা যাবে তার সরল নিদান কারুর হাতেই নেই। জন স্টুয়ার্ট মিলের আত্মজীবনীতে একটি চমকপ্রদ উক্তি পাওয়া যায়। মিল লিখছেন, “নিজেকে একবার সোজাসুজি এই প্রশ্নটা করে দেখেছিলাম ধরো জীবনের সব উদ্দেশ্য সার্থক হলো, প্রতিষ্ঠানে এবং জনমতে যত পরিবর্তন আশা করেছিলে সে সব বাঞ্ছাই পূর্ণ হলো এই মুহূর্তে। তবে এই মুহূর্তে বিপুল আনন্দ এবং সুখের ভরা পূর্ণ হয়ে যাবে তো? এক অদম্য আত্মসচেতনতা তক্ষুণি বলে উঠল, “না।” মিলের এই সংজ্ঞা যথার্থ খাঁটি। শুধু আইন বা প্রাতিষ্ঠানিক আকারে-প্রকারে পরিবর্তন এনে মানুষকে সুখী কিংবা সমাজকে ত্রুটিহীন করা যাবে এই ধারণার গোড়াতেই গলদ রয়েছে।
মানুষের নিজের সঙ্গে নিজের একটা লড়াই লড়ে যেতে হয়। চারিপাশে বানানো হাসির নানা মুখোশে ঢাকা কত মুখ আমরা দেখি। নিঃশব্দে কী অপরিসীম দুঃখ মানুষ সহ্য করে না-দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমার এক বন্ধুর ভাষায় যাবজ্জীবন কারাবাসের মেয়াদ কাটে এই বিশ্বদুনিয়ার গারদঘরে। এই কারাগারের আগল ভাঙা যায় কেমন করে?
এই পৃথিবীকে কী করে পালটে দেওয়া যায়–প্রশ্ন কেবল এইটা নয় যদিও সেটা খুব জরুরি প্রশ্ন। কিন্তু ওরই সঙ্গে ফিরে শিখতে হবে চোখ মেলে চেয়ে থাকা যেমন করে শিশু অবাক চোখে তাকায় আর ‘উদ্দেশ্যহীন খেলাচ্ছলে মন পরিপুষ্ট হয়, সঞ্জীবিত করে। তোলে বস্তুকে, নতুন নতুন আকারে রূপায়িত হয় বস্তু, সেই রূপায়ণে আছে বিশুদ্ধ শিল্পের সার। আমাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কতকগুলি কেজো উদ্দেশ্যের ভিতরে বাঁধা পড়ি এবং সেই সব উদ্দেশ্যের কথা মনে রেখে এই পৃথিবীকে দেখি, জিনিসপত্রের মাপজোখ দামদর কষি। বয়স্করা এই ভাবেই কাজের লোক প্রতিপন্ন হয়। উদ্দেশ্য সাধনে তৎপরতা এতে নিঃসন্দেহে বেড়ে যায় কিন্তু বিশ্বসংসার থেকে একটা আলোর আভা অদৃশ্য হয়ে যায়। আমরা বিস্ময় ____ করতে ভুলে যাই। পৃথিবী আর আমাদের চিত্তকে পরিপুষ্টি যোগাতে পারে না।
দ্য স্কুল মাস্টার নামক নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “বয়ঃপ্রাপ্তির পরে আমরা জীবনকে কতকগুলি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের বোঝাবিশেষে পরিণত করি এবং ওই বাঁধাছাঁদা বোঝাটির বাইরে যা কিছু তথ্য রয়েছে সবই বাদ দিই। এই ভাবে আমাদের লক্ষ্যসচেতন চিত্তে একটি সঙ্কীর্ণ এলাকা প্রস্তুত হয় যার ভিতর দিয়ে উদ্দেশ্য সরু একটি পথ ধরে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে পারে। বেঁচে থাকার চেয়ে বড়ো আর কোনো সচেতন উদ্দেশ্য যেহেতু তাদের জীবনে তৈরি হয়নি ছোটরা আশেপাশে সব কিছুই দেখতে পায় সমস্ত কিছু শুনতে পায়, তাদের মনোযোগের স্বাধীনতা অখণ্ড।” নিজের বিষয়ে কবি লিখেছিলেন তিনি যে জগতে জন্মেছিলেন সেটি জীর্ণ ছিল না, বৈচিত্র্যপরিপূর্ণ সেই জগতে বিস্ময়বোধ তাঁকে কখনো পরিত্যাগ করেনি। সকল প্রাণীর ভিতরে মানুষই জৈব অর্থে দীর্ঘতম বাল্যের অধিকারী। মহৎ জীবনশিল্পের বড়ো কথাটা হচ্ছে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাল্যের এই মনের একটুখানি রক্ষা করতে পারা। সহজ নয় এ কাজ। পৃথিবী বড়ো শীঘ্র আমাদের। হাঁপ ধরিয়ে দেয়। যত আঘাত বাজে তার হাত থেকে বাঁচার জন্য আমাদের চেতনার চতুর্দিকে শুক্তির মতো কঠিন আবরণ গড়ে ওঠে। কেবল জাগতিক স্বার্থের নিরিখে চিনি। বলে পৃথিবীর সব কিছুই বড় অতিচেনা হয়ে যায়। এই অতিপরিচয়ে পৃথিবীর প্রতি যে তাচ্ছিল্য আসে গভীরতর অর্থে সেই অশ্রদ্ধা আমাদের নিজেদের প্রতিই উদ্দিষ্ট। জগতে আমরা যা পাই তার ভিতরে আমাদের অভ্যন্তর প্রতিবিম্বিত হয়ে ওঠে। সব বিরুদ্ধতার। মাঝখানে তাজা ভাবটি ধরে রাখা বাল্যের বিস্ময়বোধকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই আসলে এক আধ্যাত্মিক দ্বন্দ্ব। বাইরের কোনো বস্তু বিন্যাসের দ্বারা এই দ্বন্দ্বের জয় পরাজয় নিশ্চিত নির্ধারিত হওয়ার নয়। এই লড়াইয়ে অল্প সংখ্যক মানুষই জয়ী হয় কিন্তু হেরে যেতে যেতেও যে বঞ্চনার বোধ পাওয়া যায় তার মূল্য কম নয়। অন্তত “প্রাপ্তবয়স্ক” স্পর্শরোমাঞ্চরহিত জড়তাগ্রস্ততার চেয়ে এই বোধ পাওয়া ভালো।
একটা কথা বুঝতে যেন ভুল না হয়। মানুষের স্বভাবী বাল্যকে দীর্ঘতর করবার প্রশ্ন নিয়ে আমরা ভাবিত নই। ছোটরা, জৈব প্রাণবস্তুতায় ভরপুর, এই মুহূর্তে যেমন আনন্দে অস্থির পরমুহূর্তে আবার তেমনি অবিশ্বাস্যরকম নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারে। কোন্টা মূল্যবান আর কোস্টা নয় তা তো তাদের জানা নেই। স্বাভাবিক বাল্যকাল স্বাভাবিক ভাবেই এসে পৌঁছয় বয়ঃপ্রাপ্তির সমে। এই পরিণত সমের পরে তৃতীয় চরণের ব্যাপ্তিতে। আমরা আত্মিক উপহারের মতো পুনরায় ফিরে পেতে পারি বাল্যকে। পরিণতির পূর্ণতা ব্যতিরেকে অভিজ্ঞতার ফলের পক্কতাকে প্রথম ফুলের সৌগন্ধের সঙ্গে যুক্ত করবে কিসে? সেই পরিণতি চাই কিন্তু পরিণতি লাভের নির্দিষ্ট কোনো পথ নেই। তা সত্ত্বেও এর সম্ভাবনা আছে। অন্তত এই ভাবটুকুকে মনের ভিতরে রাখা চাই। সেটুকুও যদি মরে যায় তার চেয়ে বড়ো ক্ষতি আর কিছুতে হতে পারে না।
সভ্যতার বাল্যদশায় প্রায়োগিক বুদ্ধির প্রাথমিক উন্মেষের সঙ্গে মানবচেতনায় মিশে গিয়েছিল আবছায়া মরমী অভিজ্ঞতা। আমাদের আদিম পূর্বপুরুষেরা বিশ্বের দিকে চেয়ে সর্বত্র অশরীরী উপস্থিতি দেখেছিল। যুক্তিবুদ্ধিতে তারা ছিলেন খাটো কিন্তু সেই খর্বতার জন্য কিছুটা এরকম হলেও সবটাই শুধুমাত্রই সেই কারণে হয়েছিল এমন নয়। এই। জগতের সঙ্গে নিজেদের তারা জড়িয়েছিল আদিম প্রেমের কৃষ্ণকালো শক্তিতে। সাম্প্রতিক কালে আমরা অনেকটা কার্যকর পন্থা ধরেছি। পৃথিবীকে আমরা দেখতে শিখে গেছি একটা যন্ত্রের মতো। জানি এর ভিতরকার নানা অংশ কী ভাবে পরস্পর সম্পৃক্ত থাকে, কেমন করে এর কাজ চলে। এভাবে দেখতে গিয়ে পৃথিবীটাকে আমরা একেবারে আমাদের বাইরের জিনিস করে ফেলেছি। কিন্তু সত্যি কি সবটা তাই? বস্তুবাদী প্রশ্ন এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। আমার বাড়ি ইটচুনসুরকিতে তৈরি। বাস্তুকারের কাছে ওইটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু আমার সমগ্র দেখাকে ওই বর্ণনায় পুরোপুরি ধরা যায় না তো। আমার বাড়ি যদি সত্যি-সত্যিই ওইটুকুর বেশি আর কিছুই না হয় তাহলে সে তো একটা গারদ তাকে আমি আর আমার আপন ঘর ভাবছি না।
এই বিশ্ব আমাদের আপন ঘর। একে আমরা পুরোপুরি যথার্থ বর্ণনা দিই কেমন করে? আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের যা শিখিয়েছে সব শিক্ষাই খুব কাজের, অনেকের কাছেই এই জ্ঞানের উপযোগিতা আছে, থাকবে। এই শিক্ষা আমাদের মনকে বহু অযৌক্তিক ভয়। থেকে মুক্ত করেছে যে ভয় শুধু বাস্তব জীবনের সমস্যা বাড়াত তাই নয় আমাদের ভালবাসার স্বাদ নষ্ট করে করে দিত। এতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে বিশ্বের প্রতি যে আমাদের প্রেম সম্যক স্ফূর্তি এবং দীপ্তি পায়নি তার অন্যতম কারণ রাসেল যাকে “আধিদৈবিক” নামে অভিহিত করেছিলেন সেই অনতিস্পষ্ট ভয়। এই সঙ্গে অবশ্য মনে রাখতে হবে যে অতি আত্মপ্রত্যয়ী অধিযবাদ যে ধরনের বীক্ষা এবং বিশ্বদৃষ্টির প্রসার ঘটায় তারও সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট। এই দেখার খণ্ডতাকে উত্তীর্ণ হয়ে যেতে পারলে তবেই আমরা যেভাবে দেখায় যেটুকু সত্য রয়েছে তার শ্রেষ্ঠ ফল পাবো। বুদ্ধিতে বিবিক্ত করে, বোধে পুনরায় যুক্ত করে; বিভাজন ও পুনযোজনার এই অন্তহীন দ্বন্দ্বে আমরা এই বিশ্বকে বারংবার সৃষ্টি করি, গড়ে তুলি আপনার ঘর।
পৃথিবীর যে-মুখখানি উন্মোচন করে দেবার ক্ষমতা মানুষের সৃজনীশক্তির ভিতরে রয়েছে আমাদের দৈনন্দিন সংসারকর্মে প্রায়োগিক বুদ্ধির কাছে প্রকাশ্য বিশ্বের মুখ থেকে। সেটি এতই ভিন্ন যে একে রহস্য বলাই সঙ্গত। রহস্যের এই উপাদানকে পরিত্যাজ্য জ্ঞান করে রহস্যকে অস্বীকার করার জন্য জিদ ধরে থাকাকেই যদি সম্যক জ্ঞানের একেবারে আবশ্যিক পূর্বশর্তের সঙ্গে সমার্থক করা হয় তাহলে আগাম ধরে নেওয়া হবে যে সত্যের একটা দিক নেই বা আয়ত্তের বাইরে থাকবেই। শেষ পর্যন্ত হিসেব খতিয়ে দেখলে এই রকম আত্মনিগ্রহী একটা ফরমান জারি করার ফলে মানুষের জ্ঞান থেকে এমন কিছু বাদ পড়ে যেতে পারে যার মূল্য অনেক। যুক্তির সীমাকে কিন্তু স্বেচ্ছাচারী ভাবে বেঁধে দিতে যাওয়ার প্রশ্ন এখানে ওঠাই উচিত নয়। প্রত্যেক যুক্তিকেই মুক্ত থাকতে দিতে হবে যাতে সে তার নিজের সীমা খুঁজে পায়। মানুষ যখন নিজের গণ্ডী পেরিয়ে গিয়ে অন্যের সঙ্গে মমতার ব্যাপ্তিতে যুক্ত বোধ করে তখন এমন কোনো বোধের প্রেরণায় সে কাজ করে যাকে তর্কনীয় বলা যায় না, কিন্তু এই বোধই যুক্তিকেও উন্নীত করে নিয়ে যায় এবং সেই পরিবর্তিত যুক্তিযুক্ততার সঙ্গে এ বোধের কোনো অসামঞ্জস্য থাকে না।
পূর্বানুক্রমিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নানা ভাবাদর্শের বিরোধ আজ মানব মন ও সমাজের অগ্রগমনের পথে অকারণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন এসেছে গঠনমূলক পন্থা গ্রহণের কাল। তর্কবিতর্ক নিঃসন্দেহে চলবে, কিন্তু শান্তির প্রয়োজন যে আজ কী মর্মান্তিক এই বোধ যেন তর্কের সুরকে নরম করে আনে। আশার কথা এই যে দিগন্তে এক নতুন পরিপ্রেক্ষিত ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। পূর্বকালের দিগন্ত যেখানে সীমারেখা টেনে দিয়ে গিয়েছিল তার থেকে ভিন্ন নতুন এই দিগ্বলয়।*
—–
* মূল ইংরেজি থেকে অনুদিত সম্পূর্ণ কমলা বক্তৃতামালা। অনুবাদিকা মানসী দাশগুপ্তা।
কমলা বক্তৃতা ও অন্যান্য ভাষণ (প্রথম প্রকাশ ১৩৯১, ১৯৮৪)