৮. সাময়িক বিরতি

দিন কাটতে থাকে দিনের মনে। থমকে যাওয়া রাস্তা আবার সময়ের নিয়মে বাঁক নেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলাতে থাকে। কিন্তু যে লড়াইটা কিছু দিন আগেই শুরু হয়েছিল–এখনও সেটা শেষ হয়নি। শুধু সাময়িক বিরতি হয়েছে মাত্র। তবু প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে টিম অধিরাজ। মনে মনে। বলছে–উই মে হ্যাভ লস্ট দ্য ব্যাটল, বাট নট দ্য ওয়ার।

সর্বনাশিনীর তৃতীয় অ্যাটাকের পর প্রায় মাসখানেক হতে চলল। ড. বিজয়। জয়সওয়ালের বডি অহল্যা জয়সওয়াল এবং সুপর্ণা জয়সওয়ালকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। গোটা তদন্তে এই প্রথম গৌতম জয়সওয়ালকে দেখল অর্ণব। বাবার বডি নিতে মা আর বোনের সঙ্গে এসেছিল। ডার্ক-টল-হ্যান্ডসাম চেহারার ব্যক্তিত্ববান পুরুষ। পবিত্র তাকেও জেরা করার তাল করছিল। কিন্তু অধিরাজকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল–দরকার নেই। চুপচাপ থাকো।

ওরা অবশ্য একদম চুপচাপ বসে নেই। সব সন্দিগ্ধের ফোন রেকর্ড আর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ঘেঁটে দেখেছে। যথারীতি কোথাও কোনো সন্দেহজনক কিছু নেই। অ্যাডেলিন বাজাজ জানিয়েছেন যে তাঁর স্বামী কিছুদিনের মধ্যে সত্যিই ভারতবর্ষে ফিরছেন। সঠিক তারিখ বা সময়-কিছুই এখনও বলেননি। তবে খুব তাড়াতাড়িই জানাবেন। অর্ণব বেশি কথা না বাড়িয়ে বলল–উনি ডেট জানিয়ে দিলেই ব্যুরোয় ইনফর্ম করবেন।

অ্যাডেলিনের স্বচ্ছ ঝিলের মতো চোখে একরাশ অবজ্ঞা। তিনি আবার একটা ছোট্ট হাই তুলে বললেন–আচ্ছা।

তারপর গঙ্গা-ভল্লা দিয়ে যে কত জল বয়ে গেল তার ঠিক নেই। ইতোমধ্যেই ট্র্যাফিক ডিপার্টমেন্টকে অ্যালার্ট করে দেওয়া হয়েছে। তারা দুটি বেওয়ারিশ গাড়ি পেয়েছে যেগুলোর সঙ্গে সর্বনাশিনীর ভিকটিমদের গাড়ির লক্ষণ হুবহু মিলে যায়। সব গাড়িগুলোকেই মধ্যরাত্রে পাওয়া গিয়েছে। এবং তাদের চারটে চাকাই যথারীতি পাংচারড! গাড়িগুলো পাওয়ার খবর পেতেই ফরেনসিক টিম তৎক্ষণাৎ ছুটেছিল। অবশ্য পরীক্ষা করে কিছুই পায়নি। অর্ণব আর পবিত্র আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে ভাবছিল–এই বুঝি আরও একখানা আর। আইপি পোস্ট পড়ল! সাইবার টিম সর্বনাশিনীর প্রোফাইলের ওপর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও নজর সরাচ্ছে না। কে জানে কখন আবার পড়বে সেই সর্বনেশে ডেথ ফোরকাস্ট! ঈশ্বরই জানেন, কার ওপরে এবার সর্বনাশ ঘনিয়ে আসছে। টিক টিক করে ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা সরছে। আর সিআইডি অফিসারদের হৃৎপিণ্ডও তার তালে তালে লাফাচ্ছে। এই বুঝি এলো হয়তো এসেই পড়ল সেই অমোঘ পোস্ট। সেই ভয়ানক শব্দগুচ্ছ–আরআইপি…।

তবে শেষপর্যন্ত সেই সর্বনেশে পোস্ট পড়েনি। উলটে দুটি সন্দেহজনক গাড়ির মালিকেরা নিজেরাই গাড়ি ক্লেম করে ফেরত নিয়ে গিয়েছেন। গোয়েন্দা দফতর সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেঁচেছে। যাক, পাংচারড গাড়ির মালিকেরা নিজেরাই পাংচার হননি! যে সাদা বোলেরোতে লাশ ডাম্পড হয়েছিল, আরটিও অফিসের মাধ্যমে জানা গিয়েছে যে সেই গাড়িটি চোরাই।

শিনা জয়সওয়ালকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। একেবারেই রুটিন প্রশ্ন। উত্তরও যথেষ্ট সন্তোষজনক। শ্বশুরের মৃত্যুতে একটুও দুঃখিত নয়। রাধিকা জয়সওয়ালের সঙ্গে তাঁর অবৈধ সম্পর্ক ছিল সে কথা শিনা জানে। ড. বিজয় জয়সওয়াল সম্পর্কে যথেষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করল সে। তার স্বভাব যে মোটেই সুবিধের ছিল না সেটা প্রকাশ করতেও দ্বিধা করল না।

সন্দিগ্ধদের প্রত্যেকেই নিজের স্বহস্তলিখিত জবানবন্দি দিয়েছে। সেগুলো ভালো করে দেখে নিয়ে অর্ণব অধিরাজকে দিয়ে দিয়েছে। জবানবন্দিতে দেখার বিশেষ কিছু নেই। সবাই মুখে যা বলেছেন, তাই লিখেছেন। ব্যতিক্রম শুধু রিয়া বাজাজ, অহল্যা জয়সওয়াল। রিয়া কিছু লেখার অবস্থাতেই নেই। তার জবানবন্দি অহনাই লিখেছেন। সে নিচে সই করেছে। অহল্যা জয়সওয়াল মুখে যা বলেছিলেন, তাঁর উলটোটাই লিখেছেন। তিনি জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন যে তার স্বামী সত্যিই মদ্যপ ও লম্পট ছিলেন। বোকার মতো ভ্রান্তিবশত তিনি ইনভেস্টিগেশনে যে বাধা সৃষ্টি করেছিলেন, তার জন্য আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থী।

ড. জয়সওয়ালের মৃত্যুটাকে আটকানো যায়নি বলে এবার মিডিয়া পুলিশকে ছেড়ে সিআইডির চোদ্দগুষ্টির তুষ্টি করতে শুরু করেছে। ব্যুরোর সামনে ভিড় করে সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্টরা হল্লা করতে শুরু করেছেন। তাদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। অনেকে সিবিআই তদন্তের দাবি করছেন। সর্বনাশিনীকে অনেকেই আবার সমাজসেবিকা তকমা দিয়ে দিয়েছেন। নিউজ চ্যানেলগুলো রীতিমতো সমীক্ষা করে দাবি করছে যে তার প্রকোপে অবৈধ প্রেম, তথা পরকীয়া করতে ভয় পাচ্ছেন পুরুষেরা! চ্যানেলে চ্যানেলে সর্বনাশিনীকে নিয়ে চলছে মনোবিদদের অ্যানালিসিস। এডিজি শিশির সেনকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। তার অবস্থাও খুব ভালো নয়। একদিকে ওপর মহলের চাপ, অন্যদিকে আমজনতার ভোট সর্বনাশিনীর দিকেই। অপরপক্ষে তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী ঘোড়াটি জখম! সব দিক দিয়েই পরিস্থিতি উত্তেজনার চরমবিন্দুতে।

আপাতত অধিরাজকে হসপিটাল থেকে ছেড়ে দিয়েছেন ডাক্তাররা। এখন সে কিছুটা সুস্থ। যদিও পুরোপুরি বিশ্রামে থাকতে হবে। স্মোক করতেও বারণ করেছেন তাঁরা। তারপর থেকেই বোধহয় মুড বিগড়েছে তার। অর্ণব লক্ষ্য। করেছে হসপিটালে থাকাকালীনই কেমন যেন গুম মেরে গিয়েছিল অধিরাজ। বেশি কথা বলছিল না। মাঝেমধ্যেই বিরক্ত হয়ে উঠছে। সবসময়ই কেমন যেন তিরিক্ষি মেজাজ! বেচারি আহেলি একদিন খুব সুন্দর একটা বোকে নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। কথা নেই, বার্তা নেই তাকে দেখেই এমন খেঁকিয়ে উঠল যে স্বয়ং ড. চ্যাটার্জীও অবাক! বিস্মিত স্বরে বললেন–তুমি আহেলিকে বকছ! হলো কী তোমার?

অধিরাজ আরও রেগে গিয়ে বলল–ফুল আনতে কে বলেছে? আমি বলেছি? কোনো দরকার নেই ফুলের।

আরে। তিনি আহেলির মুখের অবস্থা দেখে অধিরাজকে শান্ত করার চেষ্টা করেন–ও তো ভালোর জন্যই এনেছে। গেট ওয়েল সুন কার্ড দেখছ না? আহেলি, ওটা টেবিলের ওপর রাখো।

আহেলি মাথা নিচু করে টেবিলের ওপর বোকো রাখতেই যাচ্ছিল। তার আগেই যেন আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হলো। অধিরাজ প্রায় গর্জন করেই ওঠে–আই সেইড, নো৷।

রাজা, এটা কোনো বম্ব নয়! তুমি এভাবে রি-অ্যাক্ট করছ কেন? জাস্ট আ গেট ওয়েল সুন উইশ…!

কোনো উইশের দরকার নেই। তার মাথায় যেন খুন চড়ে গিয়েছে–আমি ঠিক আছি। কাউকে আমার ভালো ভাবতে হবে না। আই ডোন্ট বদার…আই ডোন্ট কেয়ার! আউট! আউট! ওঃ…ওঃ!

উত্তেজনা ক্রমশই হিংস্র রূপ ধরছে দেখে ড. চ্যাটার্জীই শেষ পর্যন্ত ইশারায় আহেলিকে বেরিয়ে যেতে বললেন। প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে যাওয়ার ফলে আবার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল অধিরাজের। জখম হওয়া ফুসফুস উত্তেজনা নিতে পারছিল না। ড. চ্যাটার্জী ন্যাসাল ক্যানুলাটা লাগিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলেন।

অর্ণব হাঁ করে দেখছিল অধিরাজকে। কীরকম অদ্ভুত ব্যবহার করছে সে! মেয়েদের ব্যাপারে সে চিরকালই অতি ভদ্র, নম্র। ভীষণ কেয়ারিং। আজ পর্যন্ত কোনো মহিলার প্রতি খারাপ ব্যবহার করতে দেখেনি তাকে। অথচ সে যেভাবে থেকে থেকেই খেপে উঠছে, তা এক কথায় অস্বাভাবিক। সম্পূর্ণ তার স্বভাববিরুদ্ধ। এমনকি সিস্টারদেরও ছাড়ছে না! এক বেচারি নার্স ব্লাডপ্রেশার মাপতে এসেছিল। তাকেও হুট আউট করে দিয়েছে। তার বক্তব্য–ব্লাডপ্রেশার মাপার কোনো দরকার নেই। আমার প্রেশার ঠিক আছে।

শেষমেষ আর থাকতে না পেরে ড. চ্যাটার্জী বলেই ফেললেন তোমার হলটা কী! তুমি এরকম পিকিউলিয়ার ব্যবহার করছ কেন? রগচটাশী উপাধি তো আমার পাওয়া উচিত! তুমি আবার অন্যতম দাবিদার হচ্ছ কেন? কী হয়েছে?

জানি না…জানি না! সে মাথার চুল খামচে ধরে–প্লিজ, লিভ মি অ্যালোন! প্লিজ ড.!

বাড়ি ফেরার পরও সে যে খুব স্বাভাবিক হয়েছে তাও বলা যায় না। অর্ণব আর পবিত্র তার বাড়ি বয়ে সমস্ত ইনফর্মেশন দিয়ে আসে। কিন্তু তার মুখের সেই ছেলেমানুষী ঝলমলে হাসিটাকে কেউ যেন কেড়ে নিয়েছে। কেমন যেন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। অল্পেই বিরক্তি, রাগ, ক্ষোভ! আগে যে লোকটা সবসময়ই কারো না কারো লেগপুলিং করতেই ব্যস্ত থাকত, সে যেন ঠাট্টা, ইয়ার্কি–সব। ভুলে গিয়েছে! শুধু কাজের কথা ছাড়া আর কিছুই বলে না। নিজে থেকে কিছু। জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে সেফ–… হ আর না! বাড়তি একটি কথাও নেই। অর্ণব পরিবেশটা একটু হালকা করার জন্য বলেছিল–আপনি দাড়ি রাখলেও পারেন স্যার। দারুণ লাগছে কিন্তু।

অধিরাজ তার দিকে বিরক্তিমাখা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিছানা থেকে নেমে সটান টয়লেটে ঢুকে গেল। মিনিট দশেক পরে যখন বেরোলো তখন তার গালে আর দাড়ি নেই! ক্লিন শেভড়!

ভাবতেই অর্ণবের বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। হলো কী লোকটার! এত পরিবর্তন! এ যেন অধিরাজ নয়, অন্য কেউ! চেহারাটা একই, কিন্তু মানুষটা আলাদা। কী হয়েছে তা জিজ্ঞেস করার সাহস নেই। তাই সে নিজেও ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে। কী করলে, কী বললে লোকটা খুশি হবে ভেবে পাচ্ছে না। কেন এমন করছে সে…!

অর্ণব।

পবিত্র দুমদাম করে পা ফেলে এসে হাজির হয়েছে। তার উত্তেজিত বুটের খটখটানিতে চিন্তাসূত্র ভেঙে গেল অর্ণবের। সে জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকায় বলুন।

অ্যাডেলিন বাজাজ কয়েক সেকেন্ড আগেই ব্যুরোতে ফোন করেছিলেন। মি. আনন্দ বাজাজ আর আধঘণ্টার মধ্যেই কলকাতায় ল্যান্ড করছেন।

কী?

মুহূর্তের মধ্যেই স্নায়ু, পেশীগুলো টানটান হয়ে ওঠে অর্ণবের। মি. আনন্দ বাজাজই সম্ভবত সর্বনাশিনীর শেষ টার্গেট! সুতরাং আধঘণ্টার মধ্যেই শেষ যুদ্ধটা শুরু হবে। একবার ব্যর্থ হয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। এবার এসপার কী ওস্পার করতেই হবে। এডিজি শিশির সেন টিম অধিরাজের ওপরে ভরসা রাখেন বলে এখনও কেসটা তার কাছ থেকে সরিয়ে নেননি। নয়তো সে যখন ইনজিওর্ড হয়ে পড়ল তখনই ওপর মহলে প্রশ্ন উঠেছিল। এডিজি সেন স্পষ্ট বলেছিলেন–আমি মনে করি কেসটা হোমিসাইডের যোগ্যতম অফিসারের হাতেই আছে। তাদের হাতে যথেষ্ট ডেটা না থাকা সত্ত্বেও সাধ্যের বাইরে গিয়েই আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল তার টিম। কিন্তু বিজয় জয়সওয়ালকে বাঁচানো যায়নি। এটা দুঃখজনক ঘটনা হলেও বাস্তব এটাই যে তাকে সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া গেলেও কিছুতেই বাঁচানো যেত না। ফরেনসিক এক্সপার্ট ড. অসীম চ্যাটার্জীর রিপোর্ট অনুযায়ী আর আইপি পোস্ট পড়ার আগে, কিংবা কিছু পরেই ড. বিজয় জয়সওয়ালকে অ্যামাটক্সিন-এক্স দেওয়া হয়েছিল। এবং অ্যামাটক্সিন এক্সের কোনো অ্যান্টিডোট নেই। তাই বিজয় জয়সওয়ালের কেসে কিছু করার ছিল না ছেলেদের। যতটা পেরেছে, করেছে। আমি ব্যানার্জীর টিমের ওপরই ভরসা রাখতে রাজি আছি।

অথচ সেই ভরসাই এখন প্রশ্নের মুখে! আনন্দ বাজাজ আর আধঘণ্টার মধ্যেই এসে পৌঁছবেন! অথচ এখনও কোনো প্রস্তুতি নেই টিম অধিরাজের। হাতে মাত্র আধঘণ্টা! কে জানে ওদিকে সর্বনাশিনী কী করছে! সে সম্পূর্ণ প্রস্তুতি ছাড়া কোনো কাজ করে না।

অর্ণব প্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো লাফিয়ে উঠল–মানে? তিনি এখন ফোন করছেন! আমি পইপই করে বলে এলাম মহিলাকে যে মি, বাজাজের ফেরার ডেটটা আগেই যেন ব্যুরোতে ফোন করে জানিয়ে রাখেন। আর তিনি কিনা…!

আধঘণ্টা আগে জানালেন! পবিত্রর মুখ রাগে, উত্তেজনায় রক্তিম–লিখে নাও অর্ণব-আইদার এই অ্যাডেলিন বাজাজ আমাদের কথা সিরিয়াসলি নেননি। নয়তো স্বামীকে যমের বাড়ি পাঠানোর জন্য অত্যন্ত আগ্রহী!

কিন্তু এখন কী করব?

রাজাকে ইমিডিয়েটলি ফোন করো…আর…!

পবিত্র আরও কিছু বলতেই যাচ্ছিল। তার আগেই অর্ণবের ফোন সশব্দে বেজে উঠল। অর্ণব উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে দেখল, সাইবার সেলের বিশ্বজিত ফোন করছে।

ইয়েস, বিশ্বজিত!

ওপ্রান্তে বিশ্বজিতের কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় কাঁপছে–পড়েছে স্যার। সর্বনাশিনীর টাইমলাইনটা ইমিডিয়েটলি দেখুন।

অর্ণব আরেকটি কথাও না বাড়িয়ে দ্রুত হাতে কম্পিউটার অন করল। ফেসবুকে ঢুকে সার্চ করতেই সর্বনাশিনীর প্রোফাইলটা খুলে গেল। এতবার এই প্রোফাইল ঘেঁটেছে যে খুঁজতে সেকেন্ডের ভগ্নাংশও লাগল না! আর তার। টাইমলাইনেই লাল ব্যাকগ্রাউন্ডে জ্বলজ্বল করছে কালো অক্ষরগুলো!

আরআইপি মিস্টার এ বাজাজ!

অর্ণব স্তম্ভিতের মতো পবিত্রর দিকে তাকায়।

*

বারবার ফোনে নম্বরটাই ডায়াল করছিল সে।

অবশ্যই একটা ফোন থেকে নয়। বিভিন্ন ফোন থেকে সিম পালটে পালটে একটা নম্বরই ডায়াল করছে সে। ফোনটা রিং হতেই ভয় পেয়ে কেটেও দিচ্ছে। সে আদৌ ভয় পাওয়ার লোক নয়। কিন্তু জীবনে এই প্রথম কারো সঙ্গে কথা বলতে ভয় করছে। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে! একবার তো রিং হতে না হতেই ওপ্রান্তে জাগ্রত হয়েছিল গম্ভীর মোলায়েম কণ্ঠস্বর–হ্যালো?

হৃৎপিণ্ডটা দপদপিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই কেটে দিল সে। অদ্ভুত! এ কীরকম অনুভূতি! এত ভয় তার মধ্যে কোথা থেকে এলো! একটু কথা বললে কী ক্ষতিই বা হতো? কেন এত দ্বিধা! একজন অজ্ঞাত শুভচিন্তকই তো! ফোন করাটা তো ক্রাইম নয়!

সেই ভেবেই ফের ফোন করল সে। এবার ওদিকের কণ্ঠস্বরে বিরক্তি প্রকট–হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট? বারবার ফোন করছেন কেন?

ও চুপ করে ছিল। শুধু তার নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। দু একবার কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। একটা লজ্জা, একটা সংশয় তার মুখ চেপে ধরছিল। তাই শত চেষ্টাতেও মুখ থেকে একটা শব্দও বেরোল না।

ও প্রান্তে কিছুক্ষণ নীরবতা। ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ। তারপর আস্তে আস্তে ভেসে এলো একটাই উষ্ণ বাক্য–আই হেট ইউ!

লাইনটা কেটে গেল। এবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠল নারীটি। এই না হলে। তার টাইগার! ঠিক চিনতে পেরেছে! তার কণ্ঠস্বরও শোনেনি। শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ শুনেই চিনে নিয়েছে নিজের বাঘিনীকে! মাশাল্লাহ!

মেয়েটা আজ কুচকুচে কালো পোশাক পরেছে। তার শ্বেতপাথরের মতো সাদা ত্বকের রঙ বুঝি ঝলসে ঝলসে ওঠে। চুলটা চুড়ো করে বেঁধেছে। গলায় একটা সোনার চেন চিকচিকিয়ে উঠছে। কানের সাবেকি হীরের দুলের ঝলমলে দ্যুতি! এই চেনটা আর হীরের দুল তার মায়ের। সে একটা শ্বাস টানল। এই চেন আর হীরের দুলে তার মায়ের স্পর্শ রয়েছে। পরলেই মনে হয় গ্রীবার ওপরে মায়ের সুগন্ধী নরম স্পর্শ এসে পড়ল। কানের হীরেগুলো যেন মায়ের সস্নেহ হাসির মতোই ঝিকিমিকি প্রভা ছড়াচ্ছে। মা এমন করেই চুড়ো করে চুল বাঁধতেন একসময়! তারপর আর বাঁধেননি। বাঁধার প্রয়োজন ছিল না। আর তার কোনো প্রসাধন, কোনো যত্নের দরকার ছিল না।

মেয়েটার চটুল দৃষ্টিতে আচমকা সন্ধ্যার মতো বিষণ্ণতা নেমে আসে। মনে পড়ে যায় তার মায়ের কুচকুচে কালো মুখ! সাদা ঝকঝকে চোখ, কোঁকড়া কোঁকড়া চুলের গুচ্ছ, মোটা নাক, মোটা ঠোঁট! উঁচু কপালে স্বামীর কল্যাণ কামনায় ডগডগে সিঁদুর। কালো হাতে সাদা শাঁখা ঝকঝক করত…!

কেন? কার জন্য? যে লোকটা চিরদিনই তাকে পথের বেওয়ারিশ কুকুর ছাড়া আর কিছুই ভাবল না, তার জন্য? যে মানুষটা বেঁচে থাকতেই তার অস্তিত্ব মুছে দিল তার কল্যাণ কামনা করে কীহবে? কী পেলেন মা? শুধু অপমান! এক নারীর নয়, এক মানুষের অপমান! যেমন মানুষ খাবার খেয়ে উচ্ছিষ্ট শালপাতা বা থার্মোকলের থালা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তেমনই তাকেও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল লোকটা। যে নারী তার প্রিয়তম পুরুষকে ভালোবেসে সব কিছু দিয়েছিল– অর্থ, কায়িক শ্রম, নিজস্ব সত্ত্বা, দেহ-মন, সংসার, সন্তান-সব কিছু দিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলেছিল, সেই মানবীকেই ঘরের এককোণায় অপ্রয়োজনীয় আবর্জনার মতো ফেলে রেখেছিল সেই দানব! যে বিছানা, যে স্বামীর সহবাসের ওপর একমাত্র তাঁরই একান্ত অধিকার ছিল, সেই অধিকারকেই দুমড়ে মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। সেই নারী নীরবে ব্যথিত দৃষ্টিতে প্রত্যেক রাতে দেখে গিয়েছেন তাঁর মাতাল স্বামীর বক্ষলগ্ন হয়ে আছে কোনো এক অপরূপ সুন্দরী! যে শয্যা কোনোদিন তাঁর জন্য মধুর স্মৃতি বয়ে এনেছিল, সেই শয্যায় দাপাচ্ছে দানবীয় রিরংসা! কী যন্ত্রণা…! কী অপমান…! কী অভিশপ্ত দৃশ্য…!

বুকের ভেতরে চরম একটা যন্ত্রণা ঘোঁট পাকিয়ে উঠল। মেয়েটি অতিকষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। তার দু চোখের কোণ রক্তাভ! যেন রক্ত

ফেটে পড়বে।

রক্ত! রক্তই তো ছিল না মানুষটার গায়ে। এখনও চোখ বুজলে সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে! মা পড়ে আছে মেঝের ওপর। চতুর্দিকে যেন রক্তের বন্যা বইছে। সাদা মেঝের ওপরে তাজা টকটকে লাল রক্তের ধারা! দশ বছরের শিশু ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়েছিল সেই লোকটার কাছে। বলেছিল–মা পড়ে গেছে! রক্ত…কত রক্ত! এখনই ডাক্তার ডাকো…!

লোকটা তখন ঐ মেয়েটার সঙ্গে দাবা খেলছিল। টেবিলের পাশে রাখা মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল–গেট আউট!

দশ বছরের মেয়েটা কী করবে বুঝে পায়নি। অসহায়ভাবে একবার মায়ের কাছে দৌড়চ্ছিল। আরেকবার লোকটার কাছে। লোকটা শেষমেষ তার মুখের ওপরই দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। সে আপ্রাণ দরজায় করাঘাত করেছিল। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল–প্লিজ, সেভ হার! মা চোখ খুলছে না! প্লিজ, ওপেন দ্য ডোর!

কিন্তু দরজা আর খোলেনি। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! ছোট ছোট হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। ডাকছিল–মা…মা! মা সাড়া দেননি। এক ভীষণ অনিশ্চয়তায়, প্রচণ্ড ভয়ে, নিরাপত্তাহীনতায় ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছিল সে। শেষপর্যন্ত বাইরে দৌড়ে গিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল–প্লিজ হেল্প! সেভ মাই মাদার! প্লিজ…হেল্প! হে…!

প্রতিবেশীরা তার আর্ত চিৎকার আর কান্না শুনে তাড়াতাড়ি ছুটে এসেছিল। আর তারপর…!

তার চোখের সামনে আবার আরেকটা দৃশ্য ভেসে ওঠে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন মা। ফ্যাকাসে ঠোঁট! মুহূর্তটায় মনে হয়েছিল মাকে আগের থেকে অনেক কম কালো দেখাচ্ছে। ডাক্তারদের গম্ভীর মুখ। মাউকে বলছিলেন। সাদা অ্যাপ্রন পরা ডাক্তার–ব্লিডিং থামানো যাচ্ছে না। এমনিতেই অ্যানিমিয়ার পেশেন্ট! প্রেগন্যান্সির সময় আপনারা লক্ষ্য করেননি সেটা? ঠিকমতো যত্ন নেওয়াই হয়নি! আধখানা আগেই মরে গিয়েছিলেন! এখন আর কিছু করার নেই।

মাউ কী বলবে বুঝতে পারেনি। মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কাঁদছিল! ডাক্তারবাবু বললেন–

বেবিকে বাঁচাতে পেরেছি। কিন্তু মাকে পারব না। ইন্টারনাল ব্লিডিংয়ের ফলে আস্তে আস্তে শরীরের সব রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। শেষবারের মতো যদি কিছু বলার থাকে…।

কথাটা শেষ না করেই তিনি চলে গেলেন। সে অবাক হয়ে দেখল, মা তাকে ইশারায় কাছে ডাকছেন। মেয়েটা গিয়ে তার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল–মা! মা!

মা হাসলেন। সে হাসি বর্ণনা করা যায় না! সে হাসির মধ্যে স্নেহ ছিল, যন্ত্রণা ছিল, কান্না ছিল–প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয়ও ছিল! তিনি খুব শান্তস্বরে বললেন–মাউকে একদম বিরক্ত করবে না। ড্যাডকেও নয়। তোমার একটা বোন হয়েছে। দেখেছ তুমি?

সে কোনো কথা না বলে মাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে বলে চলেছে–মা…মা! আর কিছু এ পৃথিবীতে সত্য নয়। আর কাউকে এ জীবনে তার দরকার নেই। অবুঝ শৈশব শুধু নিজের মাকে বেঁধে রাখতে চায়। সে হাতের বন্ধন এতটাই দৃঢ় যে সহজে ছাড়ানো যায় না! সে বন্ধনের সামনে হয়তো মৃত্যুও অসহায়! মেয়ের সে আলিঙ্গন ছাড়িয়ে মাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা মরণেরও নেই।

মা তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন–ভালো থাকিস মা। বোনের খেয়াল রাখিস।

বলতে বলতেই ক্লান্তিতে চোখ বুজলেন। সেই চোখ আর খোলেনি! মৃত্যু আসতে সময় লেগেছিল। রক্তের সঙ্গে তিলে তিলে খসে পড়েছিল আয়ু। মা সাদা হয়ে গিয়েছিলেন! একদম সাদা!

এখন মনে হয় মা কী সত্যিই অহল্যা ছিলেন! পাথরের অভিশপ্ত নারী!

আমি তোমার মতো হব না মা! আর কাউকে হতেও দেব না!

মেয়েটা চোখের জল মুছে আয়নার দিকে তাকায়! সেখানে তার পিছনেই ঠিক সেই লোকটার প্রতিবিম্ব! সে মধুর হাসল!

এই লোকটাই শুধু বাকি আছে! শুধু ওকেই শেষ করতে হবে। তারপর…!

*

অধিরাজের ঘরে পা রাখতেই ড. চ্যাটার্জী অস্বস্তি বোধ করলেন।

ঘরের ভেতরটা পুরো অন্ধকার। এখন সকাল সাতটা বেজে পাঁচ মিনিট। বাইরে চতুর্দিকে সূর্যালোক ঝলমল করছে। অথচ এ ঘরে যেন অনন্ত রাত্রি। যেন এখানে কখনই সূর্যোদয় হয়নি, হবে না! প্রথমে কিছুই দেখা যায় না! তিনি একটু ভুরু কুঁচকে অন্ধকারটাকে চোখে সইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। একটু মন দিয়ে দেখতেই একটা মানুষের দীর্ঘ সিলয়েট ধরা পড়ল। বিছানায় চুপ করে শুয়ে আছে সে।

ড. চ্যাটার্জী কোনো কথা না বলেই হাত বাড়িয়ে সুইচবোর্ডের আলোর সুইচটা টিপে দিলেন। দপ করে আলোটা জ্বলে উঠতেই একটা বিরক্তিমিশ্রিত মৃদু স্বর ভেসে এল–কে?

আমি। তিনি বক্তার কোনোরকম অনুমতি না নিয়েই ধপাস করে বিছানার ওপরই বসে পড়লেন–মহম্মদ পর্বতের কাছে না এলে পর্বতকেই মহম্মদের কাছে আসতে হয়। এই যে তোমার অহল্যা জয়সওয়ালের চেসবোর্ডের ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিপোর্ট! তোমার ল্যাজেরা ব্যস্ত বলে আমাকেই আসতে হলো।

এত দেরিতে?

অধিরাজ এবার উঠে বসেছে। সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে দিল–দেখি।

এই ফাঁকে ড. চ্যাটার্জী তার হুলিয়াটা দেখে নিলেন। এমনিতে ওপর থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। হসপিটালে থাকাকালীন চেহারাটা একটু ভেঙেছিল। এখন আবার শুধরে গিয়েছে। সাদা গাউনে যথারীতি চিরপরিচিত লেডিকিলার! কিন্তু তারচোখ মুখের চিন্তিত ভাবটা নজর এড়াল না। কোনো একটা চিন্তা তাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে তা দেখলেই বোঝা যায়।

কালো খুঁটিতে ড. বিজয় জয়সওয়াল, গৌতম, অহল্যা, শিনা, রাধিকা এবং সুপর্ণার আঙুলের ছাপ। সাদা খুঁটিতে গৌতম, রাধিকা, বিজয়, সুপর্ণা! সে ফরেনসিক রিপোর্টটা দেখতে দেখতেই বলল–গোটা ফ্যামিলিটাই দেখছি দাবা খেলে!

হুম।

ড. চ্যাটার্জী সবিস্ময়ে দেখলেন অধিরাজের বেডরুমের চতুর্দিকে বিভিন্ন রঙের গোলাপের বোকের ছড়াছড়ি! কোনোটা শুকিয়ে গিয়েছে, কোনোটা সামান্য ঝরে পড়েছে, কোনোটা আবার একদম তাজা! প্রত্যেকটাতেই গেট ওয়েল সুন স্টিকার সঁটা!

এ কী রাজা! তুমি ফ্লাওয়ার শপ খুলছ নাকি? সবিস্ময়ে বলেন তিনি–তোমার ঘরটাকে এরকম গুলবাগ বানাল কে?

কে জানে! অধিরাজের মুখে স্পষ্ট বিরক্তি–কোনো এক মুন্নাভাই আমাকে লাকি সিং ভেবে গেট ওয়েল সুন উইশ করছেন হয়তো!

সে কী! কে সে!

জানি না। সে ঠোঁট উল্টায়–রোজ ঘুম থেকে উঠেই দেখি একটি করে গোলাপের বোকে আমার ঠিক মাথার কাছে বসে রয়েছে। কে রাখে, কখন রাখে। ঈশ্বরই জানে! মাকে জিজ্ঞেস করলেই মুচকি হেসে বলেন–গোয়েন্দাটা কে? আমি না তুই? তুই না জানলে আমি জানব কী করে? পিকিউলিয়ার ব্যাপার স্যাপার!

অর্ণব বা পবিত্র নয় তো?

ওরা কেউ হলে আমার হাতেই দিত। তাছাড়া কার্ডের নিচে নামও লেখা থাকত। সে আবার অধৈর্য হয়ে উঠেছে–যত রাজ্যের ইরেসপন্সিবল পাবলিক। কার্ডের নিচে নাম লেখে না কেন? এভাবে পুরো বাগানটাকেই। ইনস্টলমেন্টে আমার ঘরে ঢোকানোর মানেটা কী? প্রথম প্রথম ফেলে দিতাম! এখন হালই ছেড়ে দিয়েছি! আই অ্যাম সিক্ অব ইট!

ড. চ্যাটার্জী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন তার দিকে। যেভাবে সামান্য ফুলের বোকে নিয়ে সে উত্তেজিত হয়ে উঠছে, সেটা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়! উত্তেজনার কারণ আর যাই হোক, ফুলের তোড়া হতে পারে না। তিনি কিছুক্ষণ সময় দিলেন তাকে। কিছুক্ষণ আপনমনেই বক্ করে আবার শান্ত হলো ঠিকই, কিন্তু মুখের সেই প্রশান্ত ভাবটা ফিরে এলো না। অদ্ভুত তিরিক্ষি মেজাজ। চোখে মুখে বিক্ষিপ্তভাব। অর্ণব আর পবিত্র আগেই তাকে বলেছিল। আহেলির সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে তিনি স্বচক্ষেই দেখেছেন। এ অধিরাজ আর যেই হোক, তার চিরপরিচিত পা-জি, বদমাশ ছোঁড়া নয়।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি সপাটে বললেন–নিজের ডান কাঁধটা দেখেছিলে?

অধিরাজের চোখ মুখ ইস্পাত কঠিন হয়ে ওঠে। উত্তেজনার পারদও হুট করে বেড়ে গেল। সে চাপা অথচ উত্তেজিত স্বরে বলল–দেখেছি। দ্যাট উইচ ইজ প্লেয়িং উইথ মি! আমায় ম করছে ও! হাউ ডেয়ার ইজ শি…!

ড. চ্যাটার্জী বুঝলেন ঢিলটা সঠিক জায়গাতেই লেগেছে। তিনি আস্তে আস্তে বললেন–রাজা, ইটস জাস্ট আ কিস!

এইবার বিস্ফোরণটা হলো! যে জ্বালা এতদিন সে বুকের মধ্যে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল, এবার সেই অপমানের জ্বালা প্রচণ্ড উত্তেজনার হস্কা নিয়ে প্রকাশ্যে এল–নো! ইটস্ অ্যান ইনসাল্ট টু মাই এবিলিটি! ঐ ডাইনিটা প্রকাশ্যে আমায় জোকার বানিয়ে দিল! ও দেখিয়ে দিল–আমি একটা লুজার! ওকে ধরবার ন্যনতম যোগ্যতাও আমার নেই। আমি ওকেই চেজ করছিলাম! ও আমাকে বুঝিয়ে দিল–অফিসার ব্যানার্জী, তুমি একটি গাভু! তোমার নাকের সামনে দিয়ে এই দ্যাখো আমি বেড়িয়ে গেলাম। এমনকি তোমায় নিয়ে সবকিছু করার ক্ষমতা আমার ছিল! স্রেফ একটা লাভ বাইট দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি এই তোমার চোদ্দপুরুষের ভাগ্যি! নয়তো যদি আরও পাঁচটা গুলি করতাম তাহলেই বা তুমি কী করতে বীরপুঙ্গব! আমার কোন কেশকর্তনটি করতে! ড., এটাই ও বোঝাতে চেয়েছিল এবং বোঝাতে পেরেছে! ও সবার সামনে আমাকে ইনসাল্টই করতে চেয়েছিল। বলতে বলতেই সে দুহাতে মুখ ঢেকেছে–ডিপার্টমেন্টের সবাই দেখেছে, আপনি দেখেছেন, এডিজি শিশির সেন- অর্ণব-পবিত্র আহেলি…কারোর জানতে বাকি নেই! সবাই নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে গসিপ করছে। সবাই করুণা করছে, আমার বাবা-মা…ওঃ! আই হেট হার! আই হে–ট হার! ড্যাম ই-ট!

প্রচণ্ড রাগে হাতের কাছের গোলাপের বোকেটাকে একটা আছাড় মারল অধিরাজ! ড. চ্যাটার্জী স্তম্ভিত! এত রাগতে তাকে আগে কখনো দেখেননি। তিনি সুযোগ বুঝে আবার একটু ফোড়ন কাটলেন–হোয়াট অ্যাবাউট মানসী জয়সওয়াল! ওঁকে ঘৃণা হয়নি? তিনি তোমাকে ছেড়েছেন?

মানসী জয়সওয়ালের সঙ্গে আমার কিছু হয়ইনি! উত্তেজনার চরম মুহূর্তে বলেই ফেলল সে–উনি যা চেয়েছিলেন, শুধু সেটুকুই পেয়েছেন। জাস্ট ওয়ান কি! সেখানেই গল্প শেষ! আমার সন্দেহ হয়েছিল যে যিনি ওরকম ধুরন্ধর বিজনেস-ওম্যান, তিনি এত গর্দভের মতো কথা বলেন কী করে! মহিলা সুন্দরী। ন্যাকামি করে ছলে, বলে, কৌশলে যেকোনো পুরুষকে ক্যাপচার করতে পারেন। আপনার অ্যারোমা থেরাপির লিড ছিল। মানসী স্কলার বটানিস্টও। দাবাও খেলতে জানেন। তার ওপর ওঁর হাতে কাকড়াবিছের ট্যাটু! স্করপিয়ন সেক্স, স্ট্রেঙ্গথ, আরডমিনেটিং নেচারের প্রতীক। সর্বনাশিনীর প্রোফাইলের সঙ্গে যথেষ্টই মিল আছে। ইন দ্যাট কে, সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল যে ওপরের বোকা বোকা ভাবটা নেহাতই ওঁর ক্যামোফ্লেজ! সেজন্যই আমি রিস্কটা নিয়েছিলাম!

আর তিনিও সুযোগ নিলেন!

ধুত্তোর! অসম্ভব বিরক্তিতে সে মাথা ঝাঁকায়–কিছুই সুযোগ নেননি তিনি। ভদ্রমহিলা একটাই কি চেয়েছিলেন। ওনলি ওয়ান! সেটা তিনি পেয়েছেন। অবশ্য তারপর ওঁকে থামাতে আমার ঘাম ছুটেগিয়েছিল। কিন্তু বুঝিয়ে সুঝিয়ে থামিয়েছি। ওঁকে বোঝাতে পেরেছি যে আমার ওঁর প্রতি করুণা ছাড়া আর কোনো অনুভূতি নেই। আমি জাস্ট ওঁকে সহ্য করছি মাত্র। এভাবে কিছু হয় না। তাছাড়া উর্দিতে না থাকলেও আমি নিজের ডিউটিই করছি। আই মাস্ট অ্যাডমিট, শি ইজ ভেরি প্রোফেশনাল! একটু হার্ট হলেও বাকি ম্যাসাজটা ঠিকঠাকই করেছেন।

এটাও তো একটা কিসই! ড. চ্যাটার্জী তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন–ভুলে যাও না! সুন্দরীরা চুমু খেলে তোমার খুশি হওয়া উচিত। মেয়েরা তোমার মতো একটা সোমত্ত ছেলেকে চুমু খাবে না তো কী আমার টাকে খাবে?

আমার ইচ্ছের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে? টোট্যাল এ্যারাসিং! জাস্ট…জাস্ট…!

সে উত্তেজনার চোটে কথাই হারিয়ে ফেলেছে। যেন শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না!

ইন দ্যাট কেস…। ড. চ্যাটার্জী দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচুস্বরে বললেন–তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আরেকটি কাজ সে করেছে।

অধিরাজ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। ড. চ্যাটার্জী অত্যন্ত সংক্ষেপে সিপি আর এবং স্ট্রবেরি লিপ বামের ঘটনাটি বিবৃত করলেন। সে প্রথমে বিহ্বল হয়ে যায়। মুখে কোনো কথা নেই। যেন বাক্রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এই মেয়েটা এ কী জাতীয় শত্রুতা শুরু করেছে। খেলা তো এতদিন বাইরেই চলছিল। হঠাৎ এরকম বিলো দ্য বেল্ট অ্যাটাকের কারণ!

সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে ফের বিড়বিড় করে গোঁয়ারের মতো বলল–আই হেট হার! আই জাস্ট হে-ট হার!

ড. চ্যাটার্জী তার মুখের অবস্থা দেখে মনে মনে হাসলেন। ছেলেটা অত্যন্ত বুদ্ধিমান! কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে একেবারে রামছাগল! দোষও নেই। সর্বক্ষণ অপরাধীদের ঠ্যাঙাতে ঠ্যাঙাতে কিছু সূক্ষ্ম অনুভূতি বোঝার সুযোগ পায়নি। নয়তো বুঝতে পারত–ঘৃণাটাও একরকমের অবসেশন! কাউকে ঘৃণা করা মানে। অবচেতনে তাকে গুরুত্ব দিয়ে ফেলা। তার প্রতি অন্যভাবে আকৃষ্ট হওয়াও বটে! অনেক সময়ে ভালোবাসার চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে দাঁড়ায় ঘৃণী! এটাই বাস্তব! নেগেটিভ সবসময়ই পজিটিভকে টানবে! এটাই বিজ্ঞানের নিয়ম।

কিস্ কিস্ নে কি কি কো কি জগাহ্ পে কিস্ কিয়া/ ম্যায় উয়ো বদনসিব হুঁ যোহ কি কো মিস্ কিয়া তিনি হেসে উঠে বললেন–তুমি একটি গাধা! এইজন্যই সবার ওপরে মেজাজ দেখিয়ে বেড়াচ্ছ! কেউ কিছু জানে না। সবাই তোমার অবস্থা দেখে এতই ব্যস্ত ছিল যে ওদিকে তাকায়নি। শুধু আমি আর অর্ণব জানি। তাছাড়া বেচারি আহেলি কী দোষ করেছে? তাকে ওরকমভাবে। সবার সামনে হ্যারাস করার মানে কী? সর্বনাশিনী তোমায় হ্যারাস করেছে বলে তুমিও সবাইকে হ্যারাস করে বেড়াবে? কাম অন, গ্রো আপ বয়!

অধিরাজের উত্তেজনা অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে। হয়তো এই বিস্ফোরণটা তার জন্যও অত্যন্ত জরুরি ছিল। সে ফের বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসেছে। একটু দম নিয়ে এবার অনেকটাই স্বাভাবিক এবং তরল কন্ঠে বলল–আপনি উর্দু শিখলেন কবে? মিস্ অপোগন্ড শেখাচ্ছেন নাকি?

ফরেনসিক এক্সপার্ট কৃত্রিম রাগ ফলালেন–ওঁর নাম মোটেই অপোগন্ড নয়…!

জানি! অধিরাজ সদ্য আগত ফুলের বোকেটা এগিয়ে দিয়ে বলল–কার্ডটা একবার কে দেখুন। নিজেই বুঝে যাবেন এই অজ্ঞাত মুন্নাভাইটি কে!

কার্ডটা খুঁকেই ড. চ্যাটার্জীর চক্ষু চড়কগাছ! গেট ওয়েল সুন কার্ডের গা। থেকে একটি বিশেষ অ্যান্টিব্যাক্টিরিয়াল হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কড়া গন্ধ বেরোচ্ছে! এই গন্ধ তার অতি পরিচিত! কারণ তার ল্যাবেই রাখা আছে এই বিশেষ ধরনের হ্যান্ড স্যানিটাইজার! তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন–মাই গড! এ তো মুন্নিবেন! তাই ভাবছি মহারানি রোজ সকালে আধঘণ্টা লেট করে ল্যাবে ঢুকছেন কেন? দাঁড়াও, আজই কড়কে দিচ্ছি।

দরকার নেই। অনেকদিন পর স্মিত হাসল সে–বরং আমারই ওকে একটা ট্রিট দেওয়া উচিত! ওর সঙ্গে একটু অভদ্রতা করে ফেলেছি। উলটে ও এবার অনেক সার্ভিস দিয়েছে।

ড. চ্যাটার্জী মৃদু হাসলেন। তাও ভালো ছেলের সুবুদ্ধি হয়েছে। এখন ভালোয় ভালোয় মাথা ঠান্ডা হলেই বাঁচা যায়।

ইতোমধ্যেই অধিরাজের মোবাইলে দেশ রাগ বেজে উঠল। সে মোবাইলের দিকে তাকিয়েই উত্তেজিত হয়ে উঠে বসেছে–অর্ণব ফোন করছে! এক মিনিট ড.। মনে হচ্ছে কোনো খবর আছে।

সে ফোন রিসিভ করতে না করতেই ওপ্রান্ত থেকে অর্ণবের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো–স্যার! আবার আরআইপি পোেস্ট পড়েছে। এ বাজাজ! ওদিকে ঠিক আধঘণ্টা পরেই আনন্দ বাজাজ কলকাতায় ল্যান্ড করছেন। কী করব?

ফাইন। অধিরাজ বলল–মিস্টার আনন্দ বাজাজকে তার ইচ্ছেমতোই ফিরতে দাও। কারণ এই আরআইপি পোেস্টটা ওঁর জন্য নয়। এটাও বিজয় জয়সওয়ালের মতোই আমাদের মিস্ লিড করার একটা চেষ্টা মাত্র। এ ফ আনন্দ নয়, অ্যান্ড্রু বাজাজ! এবং নিশ্চিন্ত থাকো তিনি অ্যাডেলিন বাজাজের স্বামী কোনোমতেই নন্।

অ্যান্ড্রু বাজাজ! অর্ণব প্রায় হাহাকার করে ওঠে–এই আধঘণ্টার মধ্যে তাঁকে খুঁজব কী করে?

খুঁজতে হবে না। সে আত্মবিশ্বাসী-আমি জানি তিনি এখন কোথায় আছেন!

ওদিকে অর্ণবের কী অবস্থা হলো তা জানা নেই। কিন্তু ড. চ্যাটার্জীর চোয়াল এতটাই ঝুলে পড়ল যে তার মধ্যে আস্ত একটা প্রমাণ সাইজের কচ্ছপ ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।

তুমি ইমিডিয়েটলি ড. বিজয় জয়সওয়ালদের বাড়িতে ফোন করে খোঁজ নাও এই মুহূর্তে বাড়িতে কে কে উপস্থিত আছে। আমি লাইনে আছি।

অধিরাজের ফোনটা মিনিটখানেকের জন্য হোল্ডে চলে গেল। এক মহিলা কণ্ঠস্বর কিছুক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে গেলেন। তারপরই আবার শোনা গেল অর্ণবের কণ্ঠস্বর-স্যার, ড. বিজয় জয়সওয়ালের বাড়িতে শুধু অহল্যা জয়সওয়ালই আছেন। আর কেউ নেই।

চমৎকার! এবার তুমি তাড়াতাড়ি মিস ঘোষকে নিয়ে মেরিলিন প্ল্যাটিনামে পৌঁছে যাও। একদম সোজা রিয়া বাজাজদের ফ্ল্যাটে গিয়ে উপস্থিত হবে। কাউকে কিছু বলবে না। আশা করি এখনও ওদের কারোর ব্রেকফাস্ট হয়নি। অহনা ভট্টাচার্য আর মানসী জয়সওয়ালকে ফোনে চেতিয়ে দাও, যাতে ওরা ব্রেকফাস্ট না করেন। আর মানসী এবং জুয়েলার বিজয় জয়সওয়ালকে উপস্থিত থাকতে বলবে। নিজে কিছু খাবে না, ওদেরও কিছু খেতে দেবে না। আই রিপিট, কিছু খেতে দেবে না। একগ্লাস জলও না! আমিও ডকে নিয়ে আসছি। হাতে বিশেষ সময় নেই। এই খুনটাকে আটকাতেই হবে অর্ণব। আর এবার সে আমাদের একটুও সময় দেবে না! ধারে কাছে পবিত্র আছে?

হ্যাঁ স্যার! তিনি পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন।

ফ্যান্টাস্টিক। ফোনটা ওকে দাও তো।

কয়েক সেকেন্ডের বিরতি। ফোন হস্তান্তরিত হলো।

হ্যাঁ রাজা।

পবিত্রর কণ্ঠস্বর ভেসে আসতেই অধিরাজ বলল–তোমার কাছে উমঙ্গ অ্যান্ড্রু বাজাজের বাড়ির ঠিকানা আছে না?

হ্যাঁ। পবিত্র একটু কনফিউজড–কিন্তু সেখানে তো এখন কেউ থাকে না কতগুলো মাকড়সা আর টিকটিকি ছাড়া! ওঁর দ্বিতীয় স্ত্রী সিঙ্গাপুরে থাকেন। আর রিয়া বাজাজ…।

উঁহু…উঁহু! কারোর থাকার দরকার নেই। সে মাথা ঝাঁকায় কাউকে না পেলেও অন্তত কিছু তুমি ওখানে পাবে। ল্যাপটপ, ট্যাব বা এমন কিছু যা থেকে সর্বনাশিনী অনলাইন হচ্ছেন! সদ্য সদ্য আর আইপি পোস্টটা পড়েছে। তিনি ভাবতেও পারবেন না যে এত তাড়াতাড়ি তুমি একেবারে দলবল নিয়ে অন দ্য। স্পট হানা দেবে। সুতরাং লুকিয়ে ফেলার প্রয়োজনীয় সময় পাবেন না। ধরা পড়তেও পারেন। তোমার হাতে দশ মিনিটের বেশি নেই। জলদি টিম নিয়ে পৌঁছে যাও।

ওকে বস।

ফোন কেটে যেতেই দ্রুতহাতে আলমারি খুলে নিজের জামা-কাপড় বের করতে শুরু করল অধিরাজ। উ, চ্যাটার্জীকে বলল–আপনি একটু নিচে গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসুন ড.। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রেডি হয়ে আসছি।

কিন্তু…! তিনি বিমূঢ়ের মতো বললেন–তুমি ড্রাইভ করবে? সেটা উচিত হবে?

আমি যদি আজ মরেও যাই, এই খুনটাকে আটকেই মরব ড.।

কিন্তু এর মধ্যে অ্যান্ড বাজাজ এলেন কী করে? তার মাথায় সব যেন গুলিয়ে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

তিনি গিয়েছিলেন কখন যে আসবেন? সর্বনাশিনীর পুরো গল্পটাই তো উমঙ্গ অ্যান্ড্রু বাজাজের থেকেই শুরু হয়েছে। শেষও সেখানেই হবে। অধিরাজের মুখে সেই দুষ্টুমিভরা হাসিটাই ঝিলিক দিয়ে ওঠে–ভিকটিমের নাম শুনেই আপনার যদি এই অবস্থা হয়, তবে খুনির নাম শুনলে কী করবেন?

ড. চ্যাটার্জী সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চান–খুনি কে?

অধিরাজ একগাল হেসে বলল–প্রিয়া এস্থার বাজাজ।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ শুধু একটাই বাক্য উচ্চারণ করতে পারলেন–গ-ডু, এটা কী হচ্ছে!

*

সারা রাস্তা আর একটিও কথা বলেনি অধিরাজ। তার চোখে মুখে অদ্ভুত একটা কাঠিন্য খেলা করছে। চোয়াল অদ্ভুত প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় সংবদ্ধ। শুধু বাড়ি থেকে বেরোবার আগে ড. চ্যাটার্জীকে জিজ্ঞেস করেছিল– ফরেনসিক কিটস আছে আপনার সঙ্গে? খাবারের মধ্যে বিষ থাকলে ট্রেস করতে পারবেন?

ফরেনসিক কিটস তো আছেই, ইমিউনো ফ্লোও আছে। অন দ্য স্পট বিষ ধরার জন্য গ্যাজেটটা ইউজড হয়। জেনারেলি পনেরো থেকে তিরিশ মিনিট লাগে। তবে আমারটা আরও অ্যাডভান্সড বলে আরও তাড়াতাড়ি হয়।

ফাইন।

তারপর থেকেই মুখে কুলুপ এঁটেছে সে। ড. চ্যাটার্জী একটু মিনমিনিয়ে কিছু জানতে চাইছিলেন। কিন্তু সে এমন রাগী রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়েছে যে ভয়ের চোটে ল্যাম্পপোস্ট হয়ে রয়েছেন। একদম সাইলেন্ট মোড়ে!

বালিগঞ্জ ফাঁড়ি ক্রস করতে না করতেই পবিত্রর ফোন এলো। সে বলল রেড মেরেছি বস্। তুমি ঠিকই ধরেছিলে। এবার আর প্রমাণ লোপাট করার সুযোগই পায়নি। ছোট্ট একটা ল্যাপটপ, ট্যাব, ব্যাকপ্যাক, বেশ কয়েকটা মোবাইলও পেয়েছি। আর অনেকগুলো সিরিঞ্জ, বোটক্স ইঞ্জেকশন, ল্যাভেন্ডার ম্যাসাজ অয়েল! আশ্চর্যের বিষয় একখানা বোরখাও পাওয়া গিয়েছে! ইনি মুসলিম নাকি?

না। ক্রিশ্চান। অধিরাজ বলল–দেবীকে নিশ্চয়ই পাওনি?

না। পবিত্র জানায়–পাখি উড়ে গিয়েছে। তিনি রেডি ছিলেন না ঠিকই। কিন্তু অপ্রত্যাশিত আক্রমণটাও সামলে নিয়েছেন! বাড়ির পেছনের দরজা খোলা দেখছি। তবে শ্রীমুখ মিস্ করলেও তেনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গিয়েছে।

ঠিক আছে, কোনো ব্যাপার নয়। আমি জানি তাকে কোথায় পাওয়া যাবে। সে বলে–তোমাদের কাছে বেলচা, কোদাল জাতীয় যন্ত্রপাতি আছে?

সে কী! তুমি তো বলেনি যে এবার আমাদের চাষবাসও করতে হবে! পবিত্র ফিচেল হাসি হাসে–কী দুর্দিন এলো সিআইডির। এখন সব কিছু ছেড়ে গাইতে হবে চলো কোদাল চালাই, ফেলে মানের বালাই! তা ট্র্যাক্টরটাও কি লাগবে? না আমাকে আর অর্ণবকে যুতে দেওয়ার তাল করছ।

ফাজলামি নয়। টেক ইট ভেরি সিরিয়াসলি। অধিরাজ নিজেও সিরিয়াস-শাবল, কোদাল, বেলচা, ট্র্যাক্টর-যা খুশি আনাও, আই ডোন্ট কেয়ার। কিন্তু মি. বাজাজের বাড়ির চতুর্দিকটা খোড়ো। ওখানে কেউ বেশ কয়েক বছর হলো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাকে আর অপেক্ষায় রাখা উচিত হবে না।

মানে? এবার পবিত্র বিস্ময়ের ধাক্কায় কথা বলতেই ভুলে যায়–ইউ মিন… স্কেলিটন!

এগজ্যাক্টলি। সঙ্গে যন্ত্রপাতি আছে?

না থাকলেও জোগাড় করে নেব। হয়ে যাবে।

গ্রেট!

সে লাইন কেটে দিয়ে ড্রাইভিংয়ে মন দেয়। ড. চ্যাটার্জী শুধু বিড়বিড় করলেন–এখন মরতে চলেছেন অ্যান্ড্রু বাজাজ। মারতে চলেছেন প্রিয়া এস্থার বাজাজ। অহল্যা বাজাজ আগেই টপকে গিয়েছেন। রিয়া বাজাজকে জলজ্যান্ত চোখের সামনেই দেখেছি। তবে মাটির তলায় কে?

ধৈর্য আছে?

আছে।

তাহলে চুপ করে থাকুন।

অগত্যা! ড. চ্যাটার্জী মুখের জিপার টেনে দিলেন। এ ছেলের এখন মতিগতির কিছুই ঠিক নেই! কখন আবার খ্যাক করে ওঠে কে জানে!

অন্যদিকে অর্ণব মিস্ ঘোষ সমেত মেরিলিন প্ল্যাটিনামে পৌঁছতেই মহা হাঙ্গামা শুরু হয়ে গিয়েছে। সে যখন পৌঁছেছিল তখন মানসী জয়সওয়াল বাড়িতে ছিলেন না। ফিরে এসে সিআইডি অফিসারদের দেখেই খেপে গেলেন–আপনাদের ব্যাপারটা কী? যখন তখন এসে জ্বালাতন করছেন! আপনাদের উৎপাতে ঠিকমতোন খেতেও পারছি না। পেয়েছেনটা কী?

শা-ট আ-প! মিস ঘোষ ধমকে উঠল–একদম চুপ! বেশি খাওয়ার ইচ্ছে থাকলে যা খুশি খান। কিন্তু সেটা যে আপনার শেষ খাওয়া হবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই।

যেখানে প্রাণের দায় সেখানে সবাইকে চুপ মেরে যেতে হয়। মানসীও চুপ করলেন। বিজয় জয়সওয়াল অবশ্য নীরবেই ব্যাপারটা মেনে নিলেন। অহনা ভট্টাচার্য একটু বিস্মিত হলেও কিছু বললেন না। অ্যালিস মার্কেট থেকে ফিরে এসে সবে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করছিল। কিন্তু অর্ণব হাঁ হাঁ করে ওঠায় থেমে গেল। রিয়া শুধু জ্বরু কুঁচকে বলল–আমার খিদে পেয়েছে।

কিন্তু ঐ একবারই। আর কিছু বলেনি সে। অর্ণব সবার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে নেয়। প্রত্যেকের মুখেই চিন্তার ছাপ। একমাত্র রিয়া সামান্থা বাজাজ শূন্য দৃষ্টিতে ছাতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। টিকটিকি দেখছে না মাকড়সাইশ্বরই জানেন।

বেশিক্ষণ অবশ্য অপেক্ষা করতে হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই অধিরাজ এবং ড. চ্যাটার্জী এসে উপস্থিত। ড. চ্যাটার্জী এতই কনফিউজড যে তার মুখটাই কেমন বোকাটে হয়ে আছে। মানসী জয়সওয়াল যথারীতি টেরোডাক্টেল। মার্কা একটা লুক দিয়ে দিলেন অধিরাজের দিকে। সে অবশ্য তাঁকে বিন্দুমাত্রও পাত্তা না দিয়ে বলল–আপনাদের অভুক্ত রাখার জন্য দুঃখিত। টেবিলে তিনটে ব্রেকফাস্ট প্লেট দেখছি। কোনটা কার?

অ্যালিস একটু অবাক হয়েই জানায়–ডানদিকেরটা ম্যামের, বাঁ দিকেরটা আমার, আর উলটো দিকেরটা রিয়া বেবির।

ব্রেকফাস্ট যখন বানানো হচ্ছিল তখন আপনি বাড়িতে ছিলেন?

অ্যালিস না। আমি রোজ সকালে বাজারে যাই। রিয়া বেবি আটটার আগে ওঠে না। আমি সেই ফাঁকেই বাজার করে ফেলি। ম্যামই ব্রেকফাস্ট রেডি করেন। আমি শুধু সার্ভ করি।

আজও ম্যাডামই ব্রেকফাস্ট রেডি করেছেন?

হ্যাঁ।

সেই সময় আপনি মার্কেটে ছিলেন?

হ্যাঁ।

অধিরাজ এবার ড. চ্যাটার্জীর দিকে ফিরেছে–ড., অ্যালিস আর রিয়ার খাবারগুলো একবার টেস্ট করে দেখুন। আমার ধারণা এই দুজনের খাবারেই বিষ পাবেন আপনি।

ড. অসীম চ্যাটার্জী আবার একটা জোরদার ধাক্কা খেলেন! মরার কথা তো অ্যান্ড্রু বাজাজের! আর এরা দুজনেই তো মহিলা! কে মারছে, কাকে মারছে–সব আবার গুলিয়ে গেল তার! কিন্তু শকটা সামলে নিয়ে ফরেনসিক কিট নিয়ে কাজে লেগে গেলেন।

ওদিকে অর্ণবের হালও খারাপ। কোথা দিয়ে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। তবু নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখেই সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। দেখা যাক, শেষপর্যন্ত কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! বিজয় জয়সওয়াল ভুরু কুঁচকে আছেন। মানসী এখনও তার ইঙ্গিত বস্তুকেই দেখছেন।

অধিরাজ এবার আস্তে আস্তে অহনা ভট্টাচার্যের দিকে এগিয়ে। গেল–অ্যালিস খুব ভালো রান্না করে তাই না?

এ কী জাতীয় প্রশ্ন! বিস্ময়ে অহনার চক্ষু ছানাবড়া-হা! কিন্তু…। .

তবে ব্রেকফাস্টটা সে বানায় না কেন? আপনাকেই কষ্ট করতে হচ্ছে কেন?

অহনা একটু রেগে গিয়েই বললেন–কারণ অ্যালিস বাজারও করে। ও যথেষ্ট সুইফট নয়। একসঙ্গে সব কাজ ফটাফট করতে পারে না। মাল্টিটাস্কিংয়ের ক্ষেত্রে হিমশিম খায়। তাই আমাকেই বানাতে হয়।

হুঁ। অধিরাজ দড়াম করে প্রায় অসভ্যের মতোই প্রশ্ন করে–আচ্ছা আপনার বয়েস কত?

এটা কী প্রশ্ন! তিনি এবার চটে লাল-মেয়েদের বয়েস কেউ এভাবে জিজ্ঞেস করে?

সরি। আই অ্যাপলোজাইজ। কিন্তু…। অধিরাজ মৃদু হেসে সেই প্রশ্নটাই আবার করে–আপনার বয়েস কত?

ফর্টি ফাইভ! তিতিবিরক্ত মুখে উত্তর দিলেন অহনা।

সে কী! আপনাকে দেখে তো বত্রিশ-পঁয়ত্রিশের বেশি মনে হয় না! কপালে বা চোখের তলায় কোনো রিকল নেই–যেটা থাকা সবচেয়ে স্বাভাবিক। সে খুব শান্ত গলায় বলল–আপনার এই চিরযৌবনের রহস্যটা একটু জানাবেন? ড. চ্যাটার্জী সদ্য এক যুবতীর প্রেমে পড়েছেন। আপনার টি ওঁর কাজে লাগবে!

ড. চ্যাটার্জী অ্যালিস আর রিয়ার ফুডস্যাম্প টেস্ট করছিলেন। অধিরাজের কথা শুনে এক রামবিষম খেলেন। অর্ণব আর মিস ঘোষ মুখে উল্কট গাম্ভীর্য মেখে দাঁড়িয়ে আছে। অহনা ভট্টাচার্য রাগে, অপমানে লাল হয়ে গেছেন–হাউ ডেয়ার ইউ! আপনি সিআইডি অফিসার বলে যা খুশি তাই প্রশ্ন করতে পারেন না!

রহস্যটা ফাঁস করবেন না তাহলে? অধিরাজ মুচকি হাসল–আপনি বোটক্স ইউজ করেন? বোটক্স ইঞ্জেকশন? দমক্তি হুই জওয়ানি কা রাজ! বোটক্স মুখে বলিরেখা পড়তে দেয় না। জানেন নিশ্চয়ই?

জানি না। অত্যন্ত বিরক্তিসহকারে উত্তরটা এলো।

অ্যামাটক্সিন-এক্স কাকে বলে নিশ্চয়ই জানেন! সে বিনয়ে গলিতং-একেই বটানিস্ট! তার ওপর মাশরুমের চাষ আপনার। প্লিজ, আমায় আশাহত করবেন না! অ্যামাটক্সিন-এক্স কাকে বলে ম্যাডাম?

অহনা নির্বাক। কোনো উত্তর নেই তাঁর কাছে। অথবা উত্তরটা দেবেন না। অধিরাজ তাঁর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই জিজ্ঞেস করল–ড., কতদূর?

ড. চ্যাটার্জী একটু চিন্তিত ভাবেই বললেন–তোমার সন্দেহই ঠিক। দুজনের খাবারেই প্রচুর পরিমাণে বিষ রয়েছে। বিষটা কী সেটা অবশ্য বলতে পারছি না।

এনাফ।

অধিরাজ অহনা ভট্টাচার্যের দিকে ফিরল। এখন তার চোখে যেন বিদ্বেষের আগুন জ্বলছে। প্রত্যেকটা শব্দ কেটে কেটে বলল সে–এনাফ ইজ এনাফ! আপনি এতদিন ধরে গোটা পুলিশ প্রশাসন বিভাগকে যথেষ্ট নাকাল করেছেন। টোটাল ছটা খুন করেছেন! অর্ণব ঠিক সময়ে এসে না পৌঁছলে আরও দুটো খুন হতো! আমাকেও বাগে পেয়ে যথেষ্টই ইনসাল্ট করেছেন! এবার আমার পালা! আমাকে যেমন সবার সামনে হ্যারাস করেছিলেন–আমিও সেটাই করব! টিট ফর ট্যাটু!

অহনা ভট্টাচার্য ঘাবড়ে গিয়েছেন–মি!

নট ইউ! শি!

বিদ্যুৎবেগে অ্যালিসের দিকে ঘুরল অধিরাজ। তারপর যা ঘটল তা কল্পনারও অতীত! কেউ কিছু বোঝার আগেই সে একটানে অ্যালিসের কাঁচাপাকা। চুলের গুচ্ছ খুলে আনল–

 চে-কে্‌ম-ট্‌!

সবাই স্তম্ভিত! অ্যালিসের কঁচাপাকা চুলের উইগ খসে পড়তেই তার মেঘের মতো কালো রেশমী একটাল চুল বেরিয়ে পড়ল। তাতেও যেন অধিরাজের শান্তি নেই। সে রাগে প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়ে অ্যালিসকে একেবারে দেওয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরেছে। এবং আক্ষরিক অর্থেই তার প্রায় ছাল-চামড়া তুলে আনল। অর্থাৎ গাল ও গলার দুপাশ থেকে খানিকটা থলথলে চামড়া টান মারতেই হাতে খুলে চলে এলো। দর্শকেরা বিস্ময়ের আঘাতে বোধহয় নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছে। এ কী! এ তো প্রস্থেটিক মেক-আপ!

তখনও অধিরাজের শান্তি হয়নি। সে ওয়েট টিস্যু পেপার রোল বের করে অ্যালিসকে চেপে ধরে তার মুখে পাগলের মতো জোরে জোরে ঘষছে! এত জোরে ঘষছে যে অর্ণবের ভয়ই হচ্ছিল যে গোটা চামড়াটাই না ঘষার চোটে উঠে আসে! কিন্তু অধিরাজের মাথায় যেন দানব ভর করেছে। সে একটার পর একটা ভিজে ন্যাপকিন নিয়ে সজোরে অ্যালিসের মুখ পরিষ্কার করছে। চিরকালীন ভদ্র নম্র মানুষটার এই মুহূর্তে এইটুকু জ্ঞানও নেই যে এই কাজটা আইনত কোনো পুরুষ অফিসার করতে পারে না! এটা লেডি অফিসারদের কাজ। অ্যালিস তার বিরুদ্ধে মলেস্টেশন, কিংবা হ্যারাসমেন্টের কেস ঠুকতেই পারে। আর অ্যালিসও আশ্চর্য! সেও লক্ষ্মী মেয়ের চুপ করে অধিরাজের অত্যাচার সহ্য করছে। বরং তাকে দেখে মনে হয় সে ব্যাপারটা বেশ উপভোগই করছে।

টিস্যু পেপারের মর্দনের ফলে আস্তে আস্তে কালো মেক-আপওয়ালা মুখের পেছনের ফরসা মুখটা প্রকাশ্যে এলো। অ্যালিস একটু মৃদু হেসে বলল হয়েছে? শান্তি?

অধিরাজ এবার থেমে গেল। অত্যন্ত উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছিল সে। হাতের কালো হয়ে যাওয়া টিস্যুপেপারটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একটা শ্বাস টেনে বলে-চেকমেট! সর্বনাশিনী, ওরফে অ্যালিস ওরফে শিনা জয়সওয়াল ওরফে প্রিয়া এস্থার বাজাজ! ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট! এবার বাকিটা নিজেই খুলবেন? না আমিই লজ্জার মাথা খেয়ে টেনে খুলব। ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের আজ নিকুচি করেছে!

শিনা জয়সওয়াল! অর্ণব আর মিস ঘোষ প্রায় একসঙ্গেই বলে ওঠে। বিজয় জয়সওয়াল আর মানসী প্রস্তরীভূত! ড. চ্যাটার্জীর প্রায় ভিরমি খাওয়ার মতো দশা! কোনোমতে বললেন–শি-না!

কোনো সন্দেহই নেই! শিনা জয়সওয়াল বলেই ওঁকে চেনো তোমরা। সে বলল–চোখ আর ঠোঁটে বোটক্স ইঞ্জেকশন দিয়ে ফুলিয়েছেন! বোটক্স শুধু রিঙকলই ম্যানেজ করে না, একটু বেশি পরিমাণে স্কিনটাকে ফুলিয়েও দিতে পারে। ফোলা ভাবটা কমে গেলেই চিনতে পারবে। আর যে ভয়ংকর বহরটা দেখছ–সেই বহরটা চিলড্রেন্স পার্কে দেখা শেরু, বা টমি টেডির কলেবরের মতোই ফাপা! একটা মোটকা খোলস মাত্র। ওর ভেতরে ওঁর চাবুকের মতো ফিগারটা রয়েছে। অধিরাজ আবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে শিনার দিকে তাকায়–নিজের মূর্তিতে দয়া করে এবারে আসবেন কী? আপনার ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল, ব্যাকপ্যাক–সব বাজেয়াপ্ত হয়েছে। যে বোরখাটা পাওয়া গিয়েছে, সেটা আমাদের ফরেনসিক এক্সপার্ট পরীক্ষা করলেই আপনার তিন ভিকটিমের মধ্যে কারোর না কারোর ডিএনএ পেয়ে যাবেন। সঙ্গে আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্টও। রিয়ার সঙ্গে, এবং যে কঙ্কালটা পাওয়া যাবে সেটার সঙ্গে ডিএনএ টেস্ট করলে বুঝতে বাকি থাকবে না যে আপনিই প্রিয়া এস্থার বাজাজ। শুধু তাই নয়-যেদিন জুয়েলার বিজয় জয়সওয়াল অ্যাবডাক্টেড হন, সেদিন ওর ফোন থেকে যে লাস্ট মেসেজটি গিয়েছিল সেখানে ওঁর নাম বিজয় নয় ভিজয় জয়সওয়াল লেখা হয়েছিল। আরআইপি পোস্টেও তাই ছিল। কিন্তু সমস্ত সাসপেক্টরা যখন নিজের হাতে বয়ান লিখে দিলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই বিজয় জয়সওয়াল নামটা কোনো না কোনোভাবে এসেছিল। বাকি সবাই নামের স্পেলিং বিজয়ই লিখেছিল। আপনি এবং অ্যালিসই সেই দুজন ব্যক্তি যারা ভিজয় লিখেছিলেন। যতই বেঁকিয়ে চুরিয়ে লেখেন, হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্টদের বোকা বানাতে পারবেন না। বাকি প্রমাণও পেয়ে যাব। যথেষ্ট দৌড় করিয়েছেন আমায়। এবার অন্তত দয়া করুন।

আপনিও আমার ধড়াচুড়ো খুলতে পারেন। ভয় নেই। মি-টু করব না। অ্যালিস, ওরফে শিনা, ওরফে প্রিয়া বাজাজ মোহিনী হাসি হাসল–বিউটিফুল! জাস্ট ব্রিলিয়ান্ট! এবার আপনি আমাকে এভিডেন্স লোপাট করার সময়টাই দেননি। আমি সত্যিই ভাবতে পারিনি আপনি সর্বনাশিনীর সঙ্গে প্রিয়া বাজাজের লিঙ্কটা এত পার্ফেক্টলি বুঝতে পারবেন! আমি আরও ভাবছিলাম, পুলিশ চুপচাপ বসে আছে কেন! ওখানেই ভুলটা করেছি। আপনি স্রেফ আর আরআইপি পোস্টের অপেক্ষায় ওঁত পেতে বসেছিলেন! এমনকি ভিজয় স্পেলিঙটাও : আপনার চোখে পড়েছে। আমি তো ওটা ধর্তব্যের মধ্যেই আনিনি! সত্যি, আপনার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না! হোয়াট আ ব্রেন! দাবা খেলেন নাকি?

লজ্জা করে না? ড. চ্যাটার্জী খেঁকিয়ে ওঠেন-পাঁচখানা খুন করে আবার হাসা হচ্ছে। তাছাড়া অ্যান্ড্রু বাজাজই বা কোথায়? নাকি তাকেও মেরে ফেলেছেন?

পাঁচটা নয়-ছটা খুন। আসলে অ্যান্ড্রু বাজাজ অনেকদিন আগেই মারা গিয়েছেন ড.। অধিরাজই উত্তরটা দিয়ে দেয়–এতক্ষণে পবিত্ররা হয়তো তাঁর কঙ্কালটা খুঁজেও পেয়েছে। বলাই বাহুল্য, মি. বাজাজের সুপুত্রীই কাজটা সেরেছেন।

ব্বে-শ করেছি! শিনা বা প্রিয়ার চোখে দাবানল লাগল–আপনারা কী করে বুঝবেন! আমি চোখের সামনে নিজের মাকে একটু একটু করে রোজ মরতে দেখেছি। কিছু করতে পারিনি। আমার মা অত্যন্ত সুশিক্ষিত মহিলা ছিলেন। সাহিত্য পড়তেন, চমৎকার গান গাইতেন, তাঁর হাতের রান্না যে খেয়েছে, সে কোনোদিন ভুলবে না। তাঁর মতো গভীরমনস্ক মানুষ খুব কম ছিল। তার মতো ধৈর্য, সহ্য খুব কম লোকেরই আছে। তাঁর মতো নিপুণ গৃহিণী, স্নেহময়ী মা পাওয়া দুষ্কর। তিনি তাঁর গোটা জীবন, যৌবন একটা অপদার্থ পুরুষকে দিয়েছিলেন। সেই লোকটার সংসারে খাটতে খাটতে মুখে রক্ত তুললেন! একজন সম্পূর্ণ নারীর যা গুণ থাকা দরকার, সব ছিল তাঁর। বিনিময়ে কী পেলেন? শুধু যন্ত্রণা! দু বেলা খেতে পেতেন না। নিজের স্বামীর বিছানায় বসার অধিকার তার ছিল না! একটা কুকুর-বিড়াল পুষলেও তার প্রতি মায়া পড়ে। আমার মা তাও পাননি! রোজ স্বামীর সঙ্গে অন্য নারীকে শয্যাসঙ্গিনী হিসাবে দেখাটা কী প্রচণ্ড অপমানের, কী ভীষণ যন্ত্রণার তা বোঝেন আপনারা? লোকটা তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল–তুমি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় জিনিস! কেন? শুধু তার গায়ের রঙ কালো বলে! এটা কী জাতীয় ন্যায়! গায়ের রঙ কালো হলেই সে অসুন্দর? কেন? কোন্ শাস্ত্রে লেখা আছে? শুধু গায়ের রং কালো বলে তাঁর আর কোনো গুণই গ্রহণযোগ্য নয়। আমার মা দগ্ধে দগ্ধে মরেছেন! রিয়ার কী অবস্থা হয়েছে আপনারা নিজের চোখেই দেখছেন! সারাজীবন ধরে সে মরেছে। আজও মরছে! আমিও সবকটাকে তেমনই যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে মেরেছি। প্রিয়া এবার হিংস্রভাবে বলে–বেশ করেছি। ওরা যত কষ্ট পেয়েছে–আমি ততই আনন্দ পেয়েছি! সুযোগ পেলে আরও মারতাম! শুধু একটাই দুঃখ! অ্যান্ড্রু বাজাজকে মারার সময়ে রিয়া দেখে ফেলেছিল। আমায় চিনতে পারেনি। আমিও বুঝতে পারিনি যে ও দেখেছে। কিন্তু তারপর থেকেই ওর অবস্থা খারাপ হয়ে গেল! খুনটা রাতে হয়েছিল বলেই রাত হলেই প্রচণ্ড ভয় পেত! আর যা দেখেছে সেই অ্যাকশনটাই বারবার আজও রিপিট করছে! ওটাই একমাত্র আফসোস। আর কোনো আফসোস নেই।

অর্ণব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসাই করে ফেলে–কিন্তু প্রিয়া বাজাজ থেকে শিনা মৈত্র বা জয়সওয়াল হলেন কী করে?

প্রিয়া ফুঁসে ওঠে–কারণ লোকটা আমায় প্রায় খুন করেই ফেলেছিল। মাউ ঠিক বলেছে। ঐ শুয়োরের বাচ্চাটা রিয়াকে বেল্ট দিয়ে পেটাচ্ছিল। আমি আর সহ্য করতে পারিনি। লোকটার গলা টিপে ধরেছিলাম। হারামিটা নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে আমার মাথায় ফ্লাওয়ারভাস দিয়ে মেরেছিল। তারপর আমি মরে গিয়েছি ভেবে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল। কপালগুণে যেখানে ও আমাকে ডাম্প করেছিল–সেখান দিয়েই এক কাপল যাচ্ছিলেন। তাঁরা আমায় হসপিটালাইজড় করেন। মাথায় এত জোরে মেরেছিল যে আমি একবছর কোমায় ছিলাম। ঐ কাপল বাবা-মায়ের মতোই আমায় সামলেছেন। তাঁদের এক মেয়ে ছিল। শিনা মৈত্র। সে আমারই বয়েসী। কিছুদিন আগেই অরিজিনাল শিনা ক্যান্সারে মারা যায়। তারা আমার নাম-ধাম জানতেন না বলে হসপিটালের রেজিস্টারে আমায় ডটারের পরিচয় দেন। জ্ঞান আসার পরেও আমি বেশ কিছুদিন কিছুই মনে করতে পারিনি। মি. আর মিসেস মৈত্র আমায় শিনা মৈত্র হিসাবেই বড় করে তুলেছেন। নিজের মেয়ের জায়গা দিয়েছেন। আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। বিয়ের পর জয়সওয়াল হলাম। তবে যখন সব মনে পড়ল তখন মি. বাজাজকে ছাড়িনি। ও কারোর সঙ্গে পালায়নি। ওর সমস্ত টাকা পয়সা-গয়না আমিই লোপাট করেছিলাম। মেইলগুলো সব আমারই পাঠানো। এমনকি ওর সমস্ত টাকাও আমি খুব সহজেই অন্য অ্যাকাউন্টে ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে। ট্রান্সফার করেছিলাম। রিয়া একাই শুধু হ্যাকার নয়, ওর থেকেও ভালো হ্যাকার আমি। ও শুধু আইপি স্পুফিং অবধি ভাবতে পেরেছিল। কিন্তু ধরা পড়ে যায়। সেটা দেখেই আমি শিক্ষা নিয়েছি। আরও এক স্টেপ এগিয়ে খেলেছি।

থ্যাঙ্কস ফর দ্য কনফেশন। আমি অবশ্য সেটা আগেই বুঝেছি। অধিরাজ বলল–তারপর?

আমি মাউয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। মাউ বলল রিয়া মি. বাজাজকে হ্যারাস করার জন্য গ্রেফতার হয়েছিল। ওর মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। মি. বাজাজ ওকে সামলাতে না পেরে মাউয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ও কোথাও গায়েব হয়নি বা গা ঢাকা দেয়নি। শুধু মাউয়ের কাছে ছিল। আর মি. বাজাজের ভয়ে বাইরে বেরোত না। শুধু মাসে একদিন কী দুদিন ও বাজাজের কাছে থাকত। কারণ বাজাজেরও টর্চারের জন্য কাউকে দরকার ছিল। তাছাড়া রিয়ার নামে একটা টাকা প্রতি মাসে আসত। মায়ের প্রপার্টির ও একজন দাবিদার। আর বাজাজ জানত আমি সিনেই নেই। সেই টাকাটার ওপরও বাজাজের লোভ ছিল। তাই তোক দেখানো ভড়ং। গভীর আফসোসে মাথা নাড়ল সে–এমনই কপাল, যেদিন বাজাজকে মারলাম সে রাত্রেই রিয়াকে ওখানে থাকতে হলো!

অ্যালিস তো অনেক আগেই মারা গিয়েছিল। অধিরাজ বলল–তাহলে আবার তার অবতারে আপনাকে নামতে হলো কেন? রিয়ার জন্য?

প্রিয়ার চোখে বাষ্প–আমারই দোষ। অ্যালিস রিয়াকে ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছিল। ওর সমস্ত অভ্যাস, সমস্ত আতঙ্ক, সবরকমের অসহায়তা একমাত্র দুজনই জানত। পৃথিবীতে ওকে সামলানোর মতো শুধু দুজনই ছিল। অ্যালিস আর আমি! মাউও রিয়াকে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারত না। বাজাজকে খুন হতে দেখে ও এত শর্ল্ড হলো যে অতীতের সব কথা ভুলে গেল! চূড়ান্ত ভয়ে সে বারবার সেই লোকটাকেই খুঁজতে শুরু করল যে ওকে ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছে। যার সঙ্গে ও সবচেয়ে বেশি কমফর্টেব্ল…। মাউ আর আমি–দুজনেই বুঝতে পারলাম, ও অ্যালিসকে ছাড়া বাঁচবে না। সেইজন্যই আমি ওর ঘুম থেকে ওঠার আগেই অ্যালিস হয়ে চলে আসতাম। আবার রাতে ও ঘুমিয়ে পড়লে চলে যেতাম। ওর অত বোঝার ক্ষমতা ছিল না, তাই আমাকে অ্যালিস ভেবেই আঁকড়ে ধরেছিল। নয়তো ও মরে যেত। আপনি ঠিকই ধরেছেন। বোটক্স ইঞ্জেকশন এমন মাত্রায় নিতাম যাতে একটা সময় পর্যন্ত ওটার এফেক্ট থাকত। বাকিটা প্রস্থেটিক মেক-আপ যেটার খানিকটা অংশ আপনি এই মাত্রই টেনে খুললেন। আর গায়ের রঙ বলাই বাহুল্য…।

যখন মি. বাজাজকে মেরেই ফেলেছিলে বাপু, তখন আবার এতগুলো খুন করতে হলো কেন? আবার ড. চ্যাটার্জী নাক গলালেন–অ্যান্ড্রু বাজাজকে মেরে শান্তি হয়নি? এতদিন পরে আবার? হোয়াই?

অধিরাজ উত্তরটা দিয়ে দেয়–ওটা পরে বুঝিয়ে বলব। এক কথায় বলতে গেলে অহল্যা জয়সওয়ালের নাম যদি অহল্যা না হতো–তবে এতগুলো খুন হতোই না ড.!

আপনি সেটাও বুঝেছেন! ব্রিলিয়ান্ট! বিউটি! প্রিয়া অধিরাজের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসল–আপনার মতো সমঝদার পেলে ক্রাইম করার মজাই আলাদা! একটা ছোট্ট গিফ্ট দিয়েছিলাম আপনাকে। পেয়েছেন?

অধিরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। অর্ণব প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য বলে উঠল–তা বলে আইনকে নিজের হাতে তুলে নেবেন?

প্রিয়া এবার ফুঁসে ওঠে–আমার মাকে বাঁচাতে পেরেছে আপনার আইন? তিনি মারা যাওয়ার পরে আমি চিৎকার করে বারবার বলেছিলাম–ইটস্ আ মার্ডার! তখন আপনার আইন কী ছিঁড়েছে? রিয়াও আইনি পথে বাজাজকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল। আইন ওকেই উলটে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিল! কী প্রচণ্ড যন্ত্রণা ওর ভেতরে ছিল তার খোঁজ কোন্ আইন রেখেছে? যে বাস্টার্ডগুলোকে আমি মেরেছি, সে শালারা আমার প্রেমে পড়ে নিজেদের বৌকেই মারার তালে ছিল! আমি বাধা দিয়েছিলাম, পালিয়ে যাওয়ার লোভ দেখিয়েছিলাম বলে সেই মহিলারা এখনও বেঁচে আছে! কেন? তারা কালো বলে? সান অফ আ বিচ! সবার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে। তাদের কী অবস্থা হতো? আমি আর রিয়া যেমনভাবে মরেছি, মরছি তারাও মরত! বেশ করেছি শালাদের মেরেছি। ওদের এভাবেই মরা উচিত! আইন দেখাচ্ছেন! কীসের আইন মশাই! আপনাদের আইন একদিকে ডিভোর্স করতে গেলে বলে-সন্তানদের কথা ভাবুন। অন্যদিকে সেই আইনই এট্রাম্যারিটাল অ্যাফেয়ারকে লিগ্যাল বলে! ন্যাকামি! তখন সন্তানদের কথা মনে পড়ে না? বাপ যদি মাকে ফেলে দিনের পর দিন অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘোরে তাহলে সন্তানদের কেমন লাগে জানে আপনাদের আইন? আমি জানি! উত্তেজিত হয়ে বলল সে-আইন স্রেফ দাঁড়িপাল্লা ধরানো গান্ধারী! আইন মানে আ ব্লাডি ব্লাইন্ড ফুল!

তাহলে শেষমেষ নিজেই সুইসাইড করার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? মিস্ ঘোষ এতক্ষণে মুখ খুললেন।

নিজেকে নয়–ঐ শুয়োরের বাচ্চাটাকে মারতে চেয়েছিলাম! অ্যান্ড্রু বাজাজ! প্রিয়া হিসহিসিয়ে বলল–ঐ কুত্তাটার মতো দেখতে হয়েছি যে! মহাপাপ করেছি! কসমেটিক সার্জারি করে মুখটাকে পালটাতে পেরেছি। কিন্তু স্কিন! এই সাদা চামড়া যাবে কোথায়! মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি নেওয়ার পেছনেও এই একটাই কারণ। রোদে পুড়ে পুড়ে যদি চামড়াটা তামাটে হতো তবে শান্তি পেতাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না! বলতে বলতেই কেঁদে ফেলল প্রিয়া–যতবার আয়নায় নিজেকে দেখি, ততবার নিজের ওপরেই ঘেন্না হয়! ততবার নিজের পেছনে অ্যান্ড্রু বাজাজকে দেখতে পাই! সেই সাদা চামড়া, যার জন্য আমার মা শেষ হয়ে গিয়েছিলেন! দেখতে পাই লোকটা ব্যঙ্গের হাসি হাসছে। একমাত্র আমি মরলেই ঐ লোকটা হারত। পুরো চেকমেট! রিয়াকে ফেলে রাখলে ও এমনিতেই মরত! তাই ওকেও…!

প্রচণ্ড কান্না এসে গিলে নিল বাকি কথাগুলোকে। দু হাতে মুখ ঢাকল প্রিয়া এস্থার বাজাজ।

অ্যামাটক্সিন এক্স? সেটা কে দিয়েছিল? অহনা ভট্টাচার্য?

অধিরাজের কথা শুনে সে জলভরা চোখ তুলে তাকিয়ে ক্লান্তভাবে বলল–অনেক বলেছি, আর একটা কথাও বলব না।

বেশ। মিস্ ঘোষ–অ্যারেস্ট হার!

মিস্ ঘোষ এগিয়ে যেতেই ফোঁস করে উঠল প্রিয়া–এই মহিলা আমাকে হ্যান্ডকাফ পরাবেন কেন? তিনি কি আমায় ধরেছেন? যে আমায় ধরেছে সেই আমার হাতে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাবে।

কো অপারেট করুন ম্যাডাম…। মিস ঘোষ শান্তভাবেই বলে।

ফুঃ। প্রিয়া অবজ্ঞাসূচক মুখভঙ্গী করে–এখানে বাঘ আর বাঘিনীর মধ্যে লড়াই চলছে। তুমি কে ছুঁচোসম্রাজ্ঞী যে মাঝখানে নাক গলাচ্ছা

মিস ঘোষ তার কথায় পাত্তা না দিয়ে তাকে ধরতেই যাচ্ছিল। প্রিয়া তাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দেয়। উন্মত্ত রাগে বলল–খবরদার! শেষ বিষটা অ্যামাটক্সিন নয়, সায়ানাইড ছিল। আর তার অ্যাম্পুল এখনও একটা আছে আমার কাছে। অন্য কেউ আমাকে হাতকড়া পরালেই অ্যাম্পুলটা খেয়ে নেব আমি।

সর্বনাশ! অর্ণব শুনল ড. চ্যাটার্জী আপনমনেই বলছেন–লাও ঠ্যালা! এক্কে রে! এ তো পুরো সাইকো!

অধিরাজ কোমরে হাত দিয়ে ঘটনাটা দেখছিল। এবার অত্যন্ত তিক্তবিরক্ত হয়ে বলল–সরুন মিস ঘোষ। আমি দেখছি।

প্রিয়া বাজাজ মুখ টিপে হাসল। অধিরাজ হ্যান্ড কাফ নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতেই পরম আগ্রহে দুই হাত এগিয়ে দিয়েছে। যেন হ্যান্ডকাফ নয়, তাকে শাঁখা বা বালা পরানো হচ্ছে! অধিরাজ একটু ঝুঁকে পড়তেই ফিক করে হেসে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল-ফর ইওর কাইন্ড ইনফর্মেশন টাইগার, আমার কাছে কোনো পটাশিয়াম সায়ানাইডের অ্যাম্পুল নেই।

জানি। কড়াৎ শব্দে তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বলল অধিরাজ–আই হেট

পরাজিত বন্দিনী অর্ধনিমীলিত নেত্রে ভীষণ মোহ নিয়ে বিজয়ী সম্রাটের দিকে তাকাল। তার বিভাজিত ওষ্ঠাধরের ফাঁক দিয়ে বরফসাদা দাঁত ঝলসে ওঠে। ফের ফিসফিসিয়ে বলল সে–

অ্যান্ড আই লাভ ইওর হেট্রেড!

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *