৮. সবুজ বিপ্লব ও ভারতীয় কৃষির অবস্থা

অষ্টম অধ্যায়

সবুজ বিপ্লব ও ভারতীয় কৃষির অবস্থা

ষাটের দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় ভারতীয় কৃষি-উৎপাদনের হার ও মাথাপিছু লভ্য কৃষিপণ্যের পরিমাণ ছিল কম। এর ফলে একদিকে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দেয়, খাদ্যমূল্য বাড়ে এবং প্রকারান্তরে তা শিল্পে আর্থিক মজুরির হারকে ঠেলে বাড়ায়। পরিণাম শিল্পে বিনিয়োগের হার নেমে আসা। এই অবস্থায় ভারত সরকার কৃষিতে প্রকৌশলগত উন্নয়ন ঘটাতে উদ্যোগী হয়। ইতিমধ্যেই মেক্সিকোতে উদ্ভাবিত নতুন উন্নত ধরনের গম ও ফিলিপাইনসে সফলভাবে প্রযুক্ত নতুন ধরনের চাল ভারতের কৃষিতে প্রয়োগ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সফল এই নতুন প্রযুক্তিও কাজে লাগানো হল। বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ধারিত অনুপাতে উন্নত ধরনের অধিক ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার ও জলের একটি মিলিত প্যাকেজের ব্যবহারই ছিল এই প্রযুক্তির মূলকথা। এই কর্মসূচি সবুজ বিপ্লব নামে পরিচিত। এই প্রযুক্তি থেকে আশানুরূপ ফল পেতে গেলে নতুন উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার আবশ্যিক, এবং বীজ থেকে চারাগাছ বেরনোর পর ও শস্য জন্মানোর আগে অবধি চাষের বিভিন্ন পর্যায়ে যথোপযুক্ত সময়ে যথোপযুক্ত পরিমাণ জলের প্রয়োগ দরকার। ফলে যে সব শুষ্ক অঞ্চলে সেচের যথেষ্ট সুযোগ নেই, সেখানে এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করেও যথাযথ ফল পাওয়া যায় না। তা ছাড়া এই প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে তিন রাসায়নিক সারের একটি মিশ্রণের ব্যবহার জড়িত। এই সারের বাজার-দর ও প্রতি একক জমিতে এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করে যে-ফসল পাওয়া যায় তার বাজার-দরের অনুপাত চাষির পক্ষে কতটা লাভজনক সেটা নির্ভর করে জোতের আয়তন, চাষের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ জলের জোগান ও চাষের অন্যান্য আনুষঙ্গিক অবস্থার ওপর। ফলে সব অঞ্চলে সব চাষির পক্ষে এই প্রযুক্তির যথাযথ ও লাভজনক প্রয়োগ সম্ভব হয় না। প্রাথমিকভাবে প্রযুক্তিটি গম চাষের ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য অর্জন করলেও তা ভারতের কয়েকটি উন্নত ও সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই প্রযুক্তির ব্যবহারে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও জলের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, কাজেই এতে অধিক শ্রমের নিয়োগ আবশ্যিক। ফলে যথাযথ সময়ে উপযুক্ত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শ্রমিকের জোগান না থাকলে এই প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হয় না। যন্ত্রপাতির ব্যবহার আবশ্যিক হয়ে পড়ে। ফলে ভারতের কৃষিতে এই প্রযুক্তি নতুন আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রয়োগের সূচনা করে। কৃষিতে স্থির পুঁজির ব্যবহারে বড় আকারের মূলধনি বিনিয়োগ আবশ্যিক হয়। ফলে বড় জোতের সম্পন্ন চাষি ছোট জোতের ছোট চাষির তুলনায় এই প্রযুক্তির সাহায্যে অধিক সুবিধা ভোগ করতে পারে। ফলত এই প্রযুক্তি বিভিন্ন মাপের জোতের চাষির মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থার তারতম্য আরও বাড়িয়ে তুলল।

আমরা দেখেছি, ভারতীয় কৃষি তার কাঠামোর অন্তর্গত পিছিয়ে-পড়া বৈশিষ্ট্যগুলি থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আমূল ভূমিসংস্কারের মধ্য দিয়ে তার সনাতন পশ্চাদগামী শক্তিগুলির কার্যকারিতা সম্পূর্ণ নির্মূল করা যায়নি। অ-কৃষি ক্ষেত্রের যথেষ্ট বিস্তার ও যথাযথ উন্নয়নের অভাবে কৃষি থেকে যথেষ্ট বেশি সংখ্যক মানুষ বাইরে বেরতে পারেনি ও বিকল্প উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে নিয়োগের পথ প্রসারিত হয়নি। অন্যদিকে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে ও কৃষির উৎপাদন-ব্যবস্থায় নানা ভাবে বৈচিত্র এনে কৃষিক্ষেত্রকে ক্রম-প্রসারিত করে উৎপাদনশীল কর্মনিযুক্তির ক্ষেত্র হিসেবে তার যথেষ্ট প্রসার ঘটানোও সম্ভব হয়নি। অথচ ইতিমধ্যে কৃষিতে নানাদিক থেকে পরিবর্তন আনার চেষ্টা হয়েছে। ভূমিসংস্কারের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণভাবে সার্থক না হতেই, অথবা কৃষি-শ্রম, কৃষি-ঋণ, কৃষিপণ্য ও কৃষি-উপকরণের বাজারের অপ্রগতিশীল ও পশ্চাদগামী বৈশিষ্ট্যগুলিকে দূর না করেই কৃষিতে সবুজ বিপ্লব তথা প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কর্মসূচি আনা হয়।

১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি দেশে কৃষি-উৎপাদনে বিপর্যয়ের কারণে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। সেই সময় দ্বিতীয়-তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মূল ভারী শিল্প ও শিল্পোন্নয়নের উপযোগী পরিকাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিল্পক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগ করা হয়েছিল। ভারী যন্ত্রপাতি প্রভৃতি আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে ঘাটতি দেখা দেয়, তারই পরিণামে একদিকে খাদ্য আমদানির প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় অন্যদিকে শিল্পক্ষেত্রের কিছুটা প্রসার ঘটায় কৃষিজ পণ্য, বিশেষত খাদ্যের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির হার এই বর্ধিত চাহিদা মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। দেশে একদিকে মুদ্রাস্ফীতি, অন্যদিকে অন্তর্বর্তী চাহিদার স্বল্পতার কারণে ’৬৫ পরবর্তী সময়ে শিল্পক্ষেত্রে মন্দার সৃষ্টি হয়। বেকারত্ব ও খাদ্যাভাব-মুদ্রাস্ফীতি অর্থনীতিতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। আশা করা হয়েছিল, উৎপাদনের হারে বৈপ্লবিক বৃদ্ধি ঘটিয়ে এই নতুন প্রযুক্তি ভারতীয় কৃষিকে তার দীর্ঘকালীন জড়ত্ব থেকে মুক্ত করবে। নতুন প্রযুক্তির চাহিদাগুলো, যার কথা আমরা আগে উল্লেখ করেছি, তার সবক’টি যথাযথ ব্যবহার করতে পারলে একই জমিতে বছরে একাধিকবার চাষ করা সম্ভব। একই জমিতে একাধিক চাষের সুবিধা নেওয়ার জন্য চাষে ট্রাক্টর ও অন্যান্য কৃষি-উপকরণের ব্যবহার বাড়ানো দরকার। নিয়ন্ত্রিত জলের ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে পাম্পসেট ও বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ে। ঝাড়াই-পেষাই ইত্যাদি কাজের জন্য বাড়ে অন্যান্য যন্ত্রপাতির ব্যবহার। একেবারে প্রথমে সেচের সুবিধাযুক্ত কয়েকটি বাছাই করা অঞ্চলে এই নতুন প্রযুক্তি নিয়ে চাষ শুরু হয়। গম চাষে কয়েকটি অঞ্চলে প্রথমে বিপুল উৎপাদন বাড়ে। কিন্তু ব্যাপকভাবে সর্বত্র এই প্রযুক্তির প্রয়োগ সম্ভব ছিল না। এছাড়াও এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সঙ্গে কয়েকটি সমস্যা যুক্ত ছিল। এই প্রযুক্তি জোতের মাপ-নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ করা গেলেও যেহেতু এর সঙ্গে যন্ত্রপাতি, সার, বীজ ইত্যাদি সব কিছুই যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ, তাই বাস্তবে শুধুমাত্র সম্পন্ন চাষির পক্ষেই এর ব্যবহার সম্ভব ছিল। ফলে এই প্রযুক্তি কৃষিতে জমির কেন্দ্রীভবনের পক্ষে অনুকূল ভূমিকা নিয়েছিল। অন্যদিকে কৃষি-উৎপাদনের ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় তা ক্রমশ অলাভজনক হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘদিন অধিক পরিমাণে রাসায়নিক সারের ব্যবহার জমির উৎপাদনশীলতার ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত জল ব্যবহারের জন্য এই প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ভূগর্ভস্থ জলস্তর ক্রমশ নীচে নামে ও জলের খরচ বাড়ে। এছাড়া দেখা গেছে, এই প্রযুক্তিতে তৈরি চারাগাছ বেশি রোগপ্রবণ, এতে সহজেই পোকা লাগতে পারে। তাই এই প্রযুক্তির আর-একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান কীটনাশক। উৎপাদনের সঙ্গে কৃষিতে যন্ত্রপাতির ব্যবহার অঙ্গাঙ্গী জড়িত, তবু চারাগাছ বেড়ে ওঠার বিভিন্ন স্তরে উপযুক্ত পরিমাণে জলের নিয়ন্ত্রিত জোগানের যেমন দরকার, তেমনই দরকার সার ও কীটনাশকের যথাযথ প্রয়োগ। তাই প্রথমদিকে শ্রমের নিয়োগও বাড়ে। কিন্তু অন্যান্য কাজগুলিতে যন্ত্রপাতির প্রয়োগ বাড়ায় শ্রমনিয়োগের ওপর এর নিট প্রভাব হয় ঋণাত্মক, অর্থাৎ মোট মিলিয়ে শ্রমিকের নিয়োগ কমে। এই প্রযুক্তিতে উৎপাদিত চারাগাছ অত্যন্ত রোগপ্রবণ, ফলে উৎপাদনের পরিমাণেও থাকে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি। ফলে প্রত্যাশিত উৎপাদনের পরিমাণ আদর্শ অবস্থার তুলনায় সর্বদাই কম থাকে। তাছাড়া কৃষি-উপকরণগুলি প্রায়ই অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য হওয়ায় উপাদানটি বৈজ্ঞানিক ভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যবহার করলে সব সময় এক-একটি উপাদানের প্রান্তিক উৎপাদন মূল্য উপাদানটির বাজার দামের তুলনায় কম হয়। ফলে অর্থনৈতিকভাবে উপযুক্ত পরিমাণ বৈজ্ঞানিকভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণের তুলনায় কম হওয়ার কারণে সর্বোচ্চ সম্ভাব্য উৎপাদন পাওয়া যায় না। উৎপাদন ক্রমশ অলাভজনক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে।

জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী উচ্চফলনশীল গমের ক্ষেত্রে পঞ্জাব ও হরিয়ানার উদাহরণ বাদ দিলে আর কোনও রাজ্যেই উচ্চ ফলনশীল চাষ উল্লেখযোগ্য অনুপাতে বিস্তার লাভ করেনি, বিশেষ করে উচ্চফলনশীল গমের ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্র মোটেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারেনি। নীচের সারণিতে আমরা কয়েকটি বিশেষ বিশেষ গম উৎপাদক রাজ্যে মোট কর্ষিত জমির মধ্যে উচ্চফলনশীল গমের শতকরা ভাগ দেখিয়েছি।

সারণি ৮.১ মোট কর্ষিত এলাকার মধ্যে উচ্চফলনশীল গম এলাকা (শতকরা ভাগ)

সারণি ৮.১ মোট কর্ষিত এলাকার মধ্যে উচ্চফলনশীল গম এলাকা (শতকরা ভাগ)

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017, GOI

সারণি ৮.২ মোট কর্ষিত জমির মধ্যে উচ্চফলনশীল ধান চাষের অধীন জমি (শতকরা ভাগ)

সারণি ৮.২ মোট কর্ষিত জমির মধ্যে উচ্চফলনশীল ধান চাষের অধীন জমি (শতকরা ভাগ)

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017, GOI

শুধু গমের ক্ষেত্রেই নয়, ধানের ক্ষেত্রে উচ্চফলনশীল প্রযুক্তির প্রয়োগ আরও সীমিত। গম এবং চাল উভয় ক্ষেত্রেই কয়েকটি বিশেষ রাজ্য বাদ দিলে সর্বত্র প্রযুক্তির ব্যবহার যথেষ্ট বিস্তৃতি পায়নি। এই চাষের উৎপাদনশীলতা অনেকটা বাড়ার পর তা তার ঊর্ধ্বসীমায় পৌঁছে গেছে। বহু অঞ্চলে উৎপাদন-ব্যয়ের তুলনায় উৎপাদনশীলতার হার কম হওয়ায় চাষির কাছে এই চাষ অনেক ক্ষেত্রেই অলাভজনক হয়ে পড়েছে। সরকারি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যও উৎপাদন খরচ মিটিয়ে চাষির হাতে আশানুরূপ আয় সৃষ্টি করতে পারছে না। পঞ্জাবে চাষিদের উচ্চফলনশীল চাষের ক্ষেত্রে নানা বিপরীত ক্রিয়ার তথ্য সামনে আসছে।

উচ্চফলনশীল গম ও ধানের উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে অনেক রাজ্যে একটা সময়ে বৃদ্ধির হারে নিম্নগতি দেখা যাচ্ছে। নীচের সারণিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হারের হ্রাস-বৃদ্ধির প্রবণতা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে উৎপাদনশীলতার নিরিখে রাজ্যগুলির বিভাজন করা হয়েছে এভাবে: ২৫০০ কেজি/হেক্টরের চেয়ে বেশি উৎপাদনশীলতা যেসব রাজ্যে, সেগুলি সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল। ২০০০ কেজি/হেক্টরের বেশি কিন্তু ২৫০০ কেজি/হেক্টরের কম উৎপাদনশীলতাকে মাঝারি ধরা হয়েছে। ২০০০ কেজির কম উৎপাদনশীলতার রাজ্যগুলি সর্বনিম্ন উৎপাদনশীল।

সারণি ৮.৩ উচ্চ ফলনশীল ধানের উৎপাদনশীলতার হ্রাস-বৃদ্ধি

সারণি ৮.৩ উচ্চ ফলনশীল ধানের উৎপাদনশীলতার হ্রাস-বৃদ্ধি

Source: Agricltural Statistics at a Glance 2017, GOI

উপরের সারণিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রথমত, পনেরোটি চাল উৎপাদনকারী রাজ্যের মধ্যে ছয়টি রাজ্যে উৎপাদনশীলতা প্রতি হেক্টরে ২৫০০ কেজির বেশি, তিনটি রাজ্যে উৎপাদনশীলতা প্রতি হেক্টরে ২০০০ কেজির বেশি এবং ২৫০০ কেজির কম, ছয়টি রাজ্যে উৎপাদনশীলতা ২০০০ কেজির কম। দ্বিতীয়ত, সব ধরনের উচ্চফলনশীল ধান উৎপাদনের রাজ্যগুলিতে একটা সময়ের পর উৎপাদনশীলতা ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

কোথাও কোথাও উচ্চফলনশীল ধানের উৎপাদনশীলতা ২০০৩–০৪ থেকে ’০৭–’০৮ এই চার বছরের মধ্যে কমে গেছে। পরবর্তী চার বছরে আবার উৎপাদনশীলতা বাড়লেও ২০০৩–০৪ সালের স্তরে পৌঁছাতে পারছে না। কোথাও কোথাও উৎপাদনশীলতা প্রথম চার বছরের ব্যবধানে বাড়লেও পরবর্তী চার বছরে কমে অনেকটা নীচে নেমে আসছে। গমের উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভাল হলেও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার একই স্তরে বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

গমের ক্ষেত্রে চারটি রাজ্যে উৎপাদনশীলতা হেক্টর-প্রতি ২৫০০ কেজির বেশি, দু’টি রাজ্যের উৎপাদনশীলতা ২০০১ কেজি থেকে ২৫০০ কেজির মধ্যে, বাকি চারটি রাজ্যে উৎপাদনশীলতা ২০০০ কেজিরও নীচে। দ্বিতীয়ত, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা সীমার পর কমার প্রবণতা দেখা যায়। কোনও কোনও রাজ্যে উৎপাদনশীলতা চূড়ান্তভাবে হ্রাস পায়। পঞ্জাব ও হরিয়ানা চাল ও গম উভয় ক্ষেত্রেই উৎপাদনশীলতার দিক থেকে সব থেকে এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলির মধ্যে পড়ে। তার মধ্যে পঞ্জাব চাল ও গম উভয়ক্ষেত্রেই সমস্ত রাজ্যের মধ্যে সবথেকে এগিয়ে। কিন্তু আমরা দেখেছি, পঞ্জাবের চাষিরা আজ চূড়ান্তভাবে ঋণগ্রস্ত। পঞ্জাব চাষবাসের ক্ষেত্রে কিছুটা সংকটে পড়েছে। চাল, গম ইত্যাদি খাদ্যশস্যের তুলনায় তুলার মতো বাণিজ্যিক পণ্যের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও তীব্র। আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি।

পঞ্জাবে চাষ অতিরিক্ত ব্যয়বহুল। একই সঙ্গে এখানে জমির উৎপাদনশীলতার উচ্চ হার বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না, ফলে চাষি চাষের খরচ মিটিয়ে সংসারের খরচ মেটাতে পারছে না, তার ঋণগ্রস্ততা বিপুল পরিমাণে বেড়ে চলেছে। এর ফলে চাষিরা সংগঠিত উৎস থেকে বেশি বেশি ঋণ নেওয়ার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ অসংগঠিত ঋণের কবলে পড়ছে, বিশেষ করে, ফসলের উৎপাদন ও তার বাজারজাত-করণ, দু’ক্ষেত্রেই মহাজন ও কমিশন এজেন্টদের কবলে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। উদ্বৃত্ত উৎপাদন হচ্ছে, কিন্তু শস্যের বিক্রি-ব্যবস্থা ও কৃষি-উপকরণের ওপর এজেন্টদের একাধিপত্য, ঋণের বাজারের সঙ্গে উপকরণ ও পণ্যের বাজারের সংযুক্তি এই উদ্বৃত্তকে উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে বাণিজ্যিক ও মহাজনি কারবারে বদ্ধ রাখছে। এর ওপর নয়া আর্থিক নীতির অঙ্গ হিসেবে সরকারের খোলা-বাজার নীতি অনেক ক্ষেত্রেই দেশীয় কৃষি উৎপাদনকারীকে দেশের বাজারে অসম প্রতিযোগিতার সামনে ফেলে দিচ্ছে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত বিপুল ভরতুকি-যুক্ত সস্তার পণ্য দেশি বাজার ভাসিয়ে দেওয়ার ফলে দেশি পণ্যের বাজার সীমিত হয়ে পড়ছে। ঋণ শোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ায় বহু চাষি আত্মহত্যার রাস্তা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে।

সারণি ৮.৪ উচ্চফলনশীল গমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হারে হ্রাস-বৃদ্ধির প্রবণতা

সারণি ৮.৪ উচ্চফলনশীল গমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হারে হ্রাস-বৃদ্ধির প্রবণতা

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017, GOI

শুধু পঞ্জাব নয়, সারা দেশেই এই ব্যবসায়ী-মহাজন শ্রেণি সার, বীজ, যন্ত্রপাতির জোগানের সঙ্গে কৃষিপণ্য ও কৃষি-ঋণের বাজারকে যুক্ত করে সমগ্র সম্ভাব্য কৃষি উদ্বৃত্তের একটি বড় অংশের ওপর কর্তৃত্ব করছে। সরকারি সহায়ক মূল্যে পণ্য সংগ্রহ করার নীতি যথোপযুক্ত কার্যকর না হলে চাষির সমস্যা সমাধানের আর কোনও উপায় থাকে না। চাষির উদ্বৃত্ত উৎপাদকের হাত দিয়ে উৎপাদনশীল ভাবে বিনিয়োজিত হয় না, ফলে কৃষিতে বর্ধিত উৎপাদন প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক বিকাশ বন্ধ হয়। কৃষিতে উৎপাদিকা শক্তির যথেষ্ট উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজার-ব্যবস্থা ও ঋণের বাজারের যৌথ ক্রিয়া চালু থাকায় বিপুল উদ্বৃত্ত কৃষি-উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে যায়, ফলে উৎপাদন-ব্যবস্থা গতিহীন হয়ে পড়ে।

নীচের সারণি ৮.৫-এ ভারতীয় কৃষিতে প্রযুক্তিগত উন্নতির একটি বিবরণ দেওয়া হল।

দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় কৃষি-অর্থনীতিতে যন্ত্র ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে এবং প্রযুক্তির চাহিদামাফিক তিনটি উপাদানের যথাযথ আনুপাতিক মিশ্রণে তৈরি অধিক উৎপাদনশীল সারের প্রয়োগ মোট কর্ষিত এলাকায় ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।

কিন্তু এই নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ কি ভারতীয় কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির হারে আশানুরূপ গতি আনতে পেরেছে? আমরা গম, চাল ও মোট খাদ্যশস্যের দশক অনুযায়ী গড় বাৎসরিক উৎপাদন ও দশক অনুযায়ী বৃদ্ধিহার নিয়ে আলোচনা করেছি। কোনও দশকের প্রথম ও শেষবছরের উৎপাদনের মাপ যেহেতু বৃদ্ধিহারের মাপের হিসাবকে প্রভাবিত করে, সেই কারণে দশকওয়ারি বৃদ্ধি-হার ছাড়াও গোটা দশকের গড় উৎপাদন এবং এই গড় উৎপাদনের বৃদ্ধি-হারও বিবেচনায় রেখেছি। (এ বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে বিভিন্ন দিক থেকে বিস্তারিত আলোচনা করব)। নীচে আমরা প্রতি হেক্টর জমিতে গমের উৎপাদনশীলতার হ্রাস-বৃদ্ধি দেখানোর চেষ্টা করেছি বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে – যথা উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ-প্রক্রিয়া চালু রাখার উদ্দেশ্যে উপযুক্ত প্রকৌশলগত উন্নয়নের কর্মসূচি, যেমন সবুজ বিপ্লব, অথবা পরবর্তী অধ্যায়ে দেশের অভ্যন্তরীণ কাঠামোয় নয়া আর্থিক নীতির মতো পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতির প্রক্রিয়ায় ভারতের ভূমিকার পরিবর্তন।

সারণি ৮.৫ ভারতীয় কৃষিতে নতুন উপকরণের ব্যবহার

সারণি ৮.৫ ভারতীয় কৃষিতে নতুন উপকরণের ব্যবহার

Source: পাওয়ার টিলার ও ট্র্যাক্টরের সংখ্যাগুলি Singh, R. S., S. Singh, S. P. Singh (2015) “Farm Power and Machinery availability on Indian Farms, Agriculture Engineering Today’’ পেপার থেকে নেওয়া হয়েছে।

নিট কর্ষিত এলাকার তথ্যগুলি Agricultural Statistics at a Glance-এর বিভি ন্ন রিপোর্ট থেকে নেওয়া হয়েছে।

নীচের সারণি ৮.৬ এবং অন্যান্য সারণিতে ষাটের দশকের মাঝামাঝি নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ শুরুর আগে ও পরে সারা দেশে চাল, গম ইত্যাদি খাদ্যশস্যের এই বৃদ্ধি-হারের প্রবণতা কেমন ছিল সেটি দেখার জন্য দশক অনুযায়ী বৃদ্ধি-হার নিয়ে বিশ্লেষণ করেছি।

সারণি ৮.৬ চালের ক্ষেত্রে দশকওয়ারি উৎপাদন বৃদ্ধির হার

সারণি ৮.৬ চালের ক্ষেত্রে দশকওয়ারি উৎপাদন বৃদ্ধির হার

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2016, GOI

দেখা যাচ্ছে প্রতি দশকের গড় উৎপাদন হার ’৮০-র দশকে কিছুটা বাড়ে। ’৮০-র দশকে দশকওয়ারি বার্ষিক গড় উৎপাদনের বৃদ্ধি-হার যথেষ্ট বাড়লেও ’৯০-এর দশক এবং এই শতকের প্রথম দশকের মধ্যে গড় বৃদ্ধির হার নেমে আসে। আমরা সবসময় সবক্ষেত্রে ’৬০-এর দশকের ঠিক পরে সবুজ বিপ্লবের কারণে উৎপাদন বৃদ্ধির হারে যথেষ্ট উন্নতি দেখতে পাইনি। কিন্তু প্রায় সবক্ষেত্রেই নয়া আর্থিক নীতি প্রয়োগের সূচনা হওয়ার পর থেকে উৎপাদনের বৃদ্ধি-হার হঠাৎ অনেকটা পড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

সারণি ৮.৭ চালের ক্ষেত্রে গড় বাৎসরিক উৎপাদনশীলতা, গড় উৎপাদনশীলতার শতকরা পরিবর্তন এবং দশকওয়ারি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার

সারণি ৮.৭ চালের ক্ষেত্রে গড় বাৎসরিক উৎপাদনশীলতা, গড় উৎপাদনশীলতার শতকরা পরিবর্তন এবং দশকওয়ারি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017, GOI

চালের ক্ষেত্রে ’৭০-এর দশকে মোট উৎপাদন বা উৎপাদনশীলতার উন্নতিহারে তেমন চোখে পড়ার মতো বৃদ্ধি-প্রবণতা দেখা যায়নি, উৎপাদনের ক্ষেত্রে আশির দশকটি বেশ আশার সঞ্চার করেছিল, কিন্তু নব্বইয়ের দশকের নয়া আর্থিক নীতি ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চাপানো খোলা-বাজার নীতি এবং সরকারি সহযোগিতা হ্রাসের নীতি উৎপাদন বা উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধিতে বিশেষ সাহায্য করেনি। নব্বইয়ের দশকে উৎপাদন বৃদ্ধির হার চোখে পড়ার মতো কমেছে।

গম উৎপাদনের ক্ষেত্রে নব্বইয়ের দশক থেকে গড় উৎপাদন বৃদ্ধির হারে এবং দশকওয়ারি বৃদ্ধি-হারে চোখে পড়ার মতো হ্রাস ’৯০–’৯১ সালের নয়া আর্থিক নীতি প্রয়োগের একটি পরিণতি বলে মনে হয়। গমের ক্ষেত্রে কৃষি-উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বা হ্রাসের ঘটনাকে কতটা সবুজ বিপ্লব বা নয়া আর্থিক নীতি প্রয়োগের ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় সে প্রশ্নটি অবশ্যই এই প্রসঙ্গে আমাদের আলোচনায় উঠেছে। আমরা এই অধ্যায়ে আলাদা ভাবে গমের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তনের মতো ধান ও মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন হারের পরিবর্তন এবং এই পরিবর্তনে সবুজ বিপ্লবের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছি।

সারণি ৮.৮ প্রতি দশকে গমের গড় বাৎসরিক উৎপাদন, আগের দশকের তুলনায় গড় বাৎসরিক উৎপাদনে শতকরা বৃদ্ধি এবং দশকওয়ারি উৎপাদন বৃদ্ধির গড় বাৎসরিক হার

সারণি ৮.৮ প্রতি দশকে গমের গড় বাৎসরিক উৎপাদন, আগের দশকের তুলনায় গড় বাৎসরিক উৎপাদনে শতকরা বৃদ্ধি এবং দশকওয়ারি উৎপাদন বৃদ্ধির গড় বাৎসরিক হার

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017, GOI

সারণি ৮.৯ গমের উৎপাদনশীলতা

সারণি ৮.৯ গমের উৎপাদনশীলতা

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017, GOI

গমের উৎপাদনশীলতায় হ্রাস-বৃদ্ধির একই রকম প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ’৯০-এর দশক থেকেই গমের গড় উৎপাদনশীলতার শতকরা বৃদ্ধি এবং দশকওয়ারি উৎপাদন বৃদ্ধির বাৎসরিক গড় হার ক্রমাগত কমেছে।

চাল, গম এই দু’টি প্রধান খাদ্যশস্যের বাইরে অন্যান্য খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রেও একইরকম কমার প্রবণতা দেখা যায়। আমরা বিষয়টি বোঝার জন্য মোট খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে অবস্থাটি কেমন তা দেখেছি। মোট খাদ্যশস্যের মধ্যে প্রধান খাদ্যশস্য চাল ও গম ছাড়াও রয়েছে জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা ও অন্যান্য মোটা, অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট শস্যদানা। আমরা সমস্ত ধরনের শস্যদানা একত্রে বিচার করে আলোচ্য সময়ে প্রকৌশলগত উন্নয়ন ও নীতিগত পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হারে হ্রাস-বৃদ্ধি বিচার করেছি।

নীচের সারণিতে দেখা যাচ্ছে, মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গম ও চালের মতো ওঠানামার একই নিয়ম মেনে চলেছে। মোট খাদ্যশস্যের প্রতি দশকের গড় উৎপাদন বৃদ্ধির শতকরা অনুপাত সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে কমেছে। দশকের মোট উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির গড় বাৎসরিক হার ৫০-এর দশক থেকে কমে, আবার ৮০-র দশকে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে নব্বইয়ের দশক থেকে কমতে থাকে এবং কখনওই ৮০-র দশক বা ৫০-এর দশকের হার স্পর্শ করতে পারে না।

খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, অর্থাৎ বৃদ্ধির হারে হ্রাস-বৃদ্ধির যে-প্রবণতা আমরা দেখেছি সেটি শুধু চাল বা গমের ক্ষেত্রেই বিচ্ছিন্নভাবে ঘটছে এমন নয়। ’৮০র দশকে উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির যে-হারে পৌঁছানো গিয়েছিল, ’১৫-’১৬ সাল অবধি সমগ্র সময়ে সেই অবস্থায় আর পৌঁছানো যায়নি। উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে এই প্রবণতা আরও স্পষ্ট।

আমরা সবুজ বিপ্লবের প্রভাব আলাদাভাবে ও আরও স্পষ্টভাবে দেখার জন্য সবুজ বিপ্লব-পূর্ববর্তী ও সবুজ বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হারের তুলনা করার জন্য ওই দুই সময়ের (যথাক্রমে ’৫০–’৫১ থেকে ’৬৫–’৬৬ এবং ’৬৬–’৬৭ থেকে ’৮১–’৮২) ধান, গম খাদ্যশস্য, আখ ও তুলার ক্ষেত্রে প্রবণতা সমীকরণের সাহায্য নিয়েছি ও এই কালপর্ব দু’টিতে এই সমস্ত শস্যের বৃদ্ধি-হার আলাদাভাবে মাপার চেষ্টা করেছি। পরিসাংখ্যিক সমীকরণগুলি অষ্টম অধ্যায়ের সংযোজনে দেওয়া হল।

সারণি ৮.১০ মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার প্রতি দশকের গড় বাৎসরিক পরিমাণ, প্রতি দশকের গড়ের শতকরা পরিবর্তন এবং দশকওয়ারি বৃদ্ধির গড় বাৎসরিক হার

সারণি ৮.১০ মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার প্রতি দশকের গড় বাৎসরিক পরিমাণ, প্রতি দশকের গড়ের শতকরা পরিবর্তন এবং দশকওয়ারি বৃদ্ধির গড় বাৎসরিক হার

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017, GOI

সবুজের বিপ্লবের আগে ও পরে বৃদ্ধি

সবুজের বিপ্লবের আগে ও পরে বৃদ্ধি

উৎস: নিজস্ব গবেষণা।

দেখা যাচ্ছে, সবুজ বিপ্লবের আগে ও পরে ধানের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি-হারের পার্থক্য যথেষ্ট। দু’টি ক্ষেত্রেই বৃদ্ধি-হার সবুজ বিপ্লবের পর কমে গেছে। ধানচাষে সবুজ বিপ্লবের নতুন প্রযুক্তিটি কোনও ফল দিতে পারেনি, শুধু তাই নয়, হয়তো এই প্রযুক্তিটি ধান চাষ করে এমন রাজ্যগুলিতে সেভাবে প্রযুক্তই হতে পারেনি। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, এই প্রযুক্তি যথাযথ প্রয়োগের জন্য যেমন একদিকে সুনিয়ন্ত্রিত জলের ব্যবহার প্রয়োজন, তেমনই চাষের বিভিন্ন পর্যায়ে যথাযথ সার ও কীটনাশকের ব্যবহার সুনিশ্চিত করার জন্য চাষের পর্যায় অনুযায়ী অভিজ্ঞ শ্রমিকের জোগান অত্যাবশ্যক। এই প্রয়োজন থেকে উদ্ভূত সম্ভাব্য সমস্যা এড়ানোর জন্য এই নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারকারী চাষি কৃষিতে পাম্পসেট ছাড়াও শ্রম-সাশ্রয়কারী নানা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে থাকে। এর জন্য প্রধানত প্রয়োজন যথেষ্ট কম ব্যয়ে কৃষি-ঋণের জোগান। আমরা আগেই আলোচনা করেছি, বিনিয়োগযোগ্য যথেষ্ট মূলধনের অভাব কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ সীমিত করে রেখেছে, ফলে নতুন প্রযুক্তি থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। আমরা গম, খাদ্যশস্য, আখ ও তুলার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি কতটা সত্যি তার আলোচনা করেছি।

উপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, গমের উৎপাদন বৃদ্ধির হার সবুজ বিপ্লবের পর লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। আমরা আগেই দেখেছি, গমের চাষে নতুন প্রযুক্তির যতটা বিস্তৃত ব্যবহার হয়েছে, চাল বা অন্য কোনও শস্যের চাষে সবুজ বিপ্লবের নতুন প্রযুক্তি ততটা পারেনি। পঞ্জাবের মতো গমচাষের অঞ্চলে এই প্রযুক্তির সূচনা হওয়ার আগেই সেচ-ব্যবস্থার সুবিধা ছিল। ফলে পঞ্জাব আগে থেকেই অধিক উৎপাদনশীল কৃষিপ্রধান অঞ্চল ছিল। পঞ্জাবের মোট অধিক ফলনশীল উন্নত সেচ ব্যবস্থার অঞ্চলগুলিতে গমচাষের ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি বিশেষভাবে কার্যকর হয়। কিন্তু গম ছাড়া অন্য কোনও খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি মোটেই কার্যকর হয়নি। আমরা দেখছি, খাদ্যশস্য উৎপাদনের বৃদ্ধি-হার সবুজ বিপ্লবের পর কমেছে। তেমনই আখ ও তুলা চাষের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি তেমন কোনও উন্নতি ঘটাতে পারেনি। কিন্তু এ সত্ত্বেও যে-প্রশ্নটি ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন তা হল, সবুজ বিপ্লবের পর এইসব শস্যের বৃদ্ধি-হারে হ্রাস ঘটার কারণ কী? আমাদের মনে হয়, নতুন প্রযুক্তির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এর জন্য দায়ী। এই প্রযুক্তির ব্যবহার অধিক বিনিয়োগের ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল, তাই অপেক্ষাকৃত বড় জোতের চাষিরাই এই প্রযুক্তি থেকে লাভ করতে পারত। ছোট চাষিরা মহাজনের কাছে অধিক সূদে টাকা ধার নিয়ে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের বিপুল ব্যয় বহন করলেও এর সাহায্যে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করতে পারে না। ফলে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছোট চাষিরা প্রায়শই বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই কারণে ১৯৬৬ সালের পর এই প্রযুক্তি ব্যবহারকারী ছোট চাষিরা আর উৎপাদনশীলতা ধরে রাখতে পারে না। সামগ্রিকভাবে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার কমতে থাকে। আমরা উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রেও একই রকম চিত্র পাই। আমরা আগেই দেখেছি, ধানের উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রেও সবুজ বিপ্লব বিরাট কোনও আশাব্যঞ্জক ফল দিতে পারেনি। আমরা গম, আখ ও তুলার চাষে উৎপাদনের বৃদ্ধির প্রবণতা দেখেছি।

ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, একমাত্র আখ বাদে অন্য সব শস্যের ক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লবের ফলে উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি-হার বেড়েছে। কিন্তু খাদ্যশস্য ও তুলা, এই দু’টি ক্ষেত্রেই উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি-হার কখনওই উল্লেখযোগ্য স্তরে পৌছয়নি। আমরা আগেই দেখেছি, বিভিন্ন শস্যের উৎপাদনের বৃদ্ধি-হার কমেছে। কিন্তু মোট খাদ্যশস্যের মধ্যে জমির পরিমাণের দিক থেকে গমের প্রাধান্য যথেষ্ট বেশি থাকায় এবং গমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার যথেষ্ট বেশি হওয়ায় মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি-হারে গমের উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি-হারের প্রভাব পড়ে থাকবে। উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি-হার বাড়া সত্ত্বেও উৎপাদনের বৃদ্ধি-হার কমার পিছনে আর একটি কারণ হয়তো এই যে, আলোচ্য কালপর্বে তুলা চাষের ও কোনও কোনও খাদ্যশস্যের চাষে জমির পরিমাণ কমেছে। তবে বিভিন্ন খাদ্যশস্যের উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার গম ও অন্যান্য কোনও কোনও খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতার হার অবশ্যই বাড়িয়েছে।

বিভিন্ন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন হার বাড়া-কমার প্রবণতা থেকে আমরা এই পর্যবেক্ষণে আসতে পারি যে, উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা দীর্ঘদিন ধরে রাখতে হলে একদিকে যেমন দেশের আর্থিক নীতিগুলিকে উৎপাদনশীল বিনিয়োগের উপযুক্ত অবস্থা তৈরির উপযোগী হয়ে উঠতে হবে ও উৎপাদন হার বা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হতে হবে, অন্যদিকে পণ্য, ঋণ ও উপকরণের বাজার-ব্যবস্থাকে মুক্ত করতে হবে একচেটিয়া চড়া সুদে ঋণের জোগানদার, পণ্য ও উপকরণ-ব্যবসায়ীদের মিলিত নিয়ন্ত্রণ থেকে।

তথ্যসূত্র

১. Gill, A. 2004. “Interlinked Agrarian Credit Markets.” Economic and Political Weekly. vol 39 no 33.

২. Singh, G., Anupama, G. Kaur, R. Kaur, S. Kaur. 2017. “Indebtedness among Farmers and Agricultural Labourers in Rural Punjab.” Economic and Political Weekly. vol 52, no 6.

৩. Suri, K. C. 2006. “Political Economy of Agrarian Distress.” Economic and Political Weekly. vol 41, no 16.

সংযোজন

ক। বিভিন্ন শস্যের পরিসাংখ্যিক পরিমাপসিদ্ধ রিগ্রেশন

Source: Directorate of Economics and Statistics, DAC&FW website

t এর সহগ গুলি দশমিকের পর দুটি স্থান অবধি দেখানো হয়েছে। কিন্তু বৃদ্ধির হার নির্ণয় করার সময় সহগ গুলির দশমকের পর সবকটি স্থানের মানই বিবেচনায় রেখে হিসেব করা হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *