৮. শেরউডের ভোজ
শেরিফটাকে ভাল মত একটু শায়েস্তা করা দরকার, মনে মনে ভাবলো রবিন। ‘একের পর এক আমার বিরুদ্ধে যা খুশি তাই করে চলেছে লোকটা, চুপচাপ হজম করে গেলে করতেই থাকবে, থামবে না। কোনও ছুতোয় ওকে ধরে এনে শেরউডের ভোজ খাওয়ালে কেমন হয়?’
কথাটা মনে আসতেই হো হো করে হেসে উঠলো রবিন হুড। কোন ব্যারন বা জমিদার, অথবা মোটাসোটা মোহান্ত বা বিশপকে ধরতে পারলে সরাসরি টাকাকড়ি কেড়ে নেয় না রবিন কখনো; খুবই সমাদর করে ডেকে নিয়ে আসে তাদেরকে নিজেদের ডেরায়, পেট পুরে ভোজ খাইয়ে তারপর তাদের থলি হালকা করে। সত্যিই, শেরিফকে একদিন ডেকে আনতে পারলে মন্দ হতো না।
উইল স্টিউটলিকে উদ্ধার করে আনার পর বেশ কিছুদিন চুপচাপ কাটালো রবিন ও তার দলবল। চুপচাপ থাকা মানে নিষ্ক্রিয় থাকা নয়, হাসি-ঠাট্টা, গল্প-গুজব, গান-বাজনা তো আছেই, প্রত্যেকদিন সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হয় কুস্তি, তলোয়ার ও লাঠিখেলা আর তীর-ধনুকের লক্ষ্যভেদ প্রতিযোগিতায়। এইভাবে দিন দিন আরো দক্ষতা অর্জন করে নিচ্ছে ওরা, নতুন নতুন কৌশল শিখে নিচ্ছে একে অপরের কাছ থেকে।
কিন্তু অল্পদিনেই বিরক্ত হয়ে উঠলো দুঃসাহসী রবিন। রোমাঞ্চ বিবর্জিত সাদামাঠা জীবন ভাল লাগে না তার। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সেদিন- নাহ, একটু ঘুরে ফিরে আসতে হয়। কাউকে কিছু না বলে লিংকন গ্রীন ছেড়ে সাধারণ পোশাক পরে নিল সে, তারপর হাঁটতে হাঁটতে শেরউডের ধার ঘেঁষে যাওয়া একটা রাস্তার কাছে এসে থামলো। এদিক-ওদিক চেয়ে সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলো সে নটিংহামের দিকে। কিছুদূর গিয়ে গাড়ির শব্দে পিছন ফিরে তাকালো রবিন, দেখলো অল্প-বয়েসী এক মাংস- বিক্রেতা গাড়ি-ভর্তি মাংস নিয়ে খুশি মনে চলেছে নটিংহাম শহরের দিকে।
‘সুপ্রভাত,’ বললো তাকে রবিন। ‘খুব খুশি মনে হচ্ছে যে আজ তোমাকে?’
‘নিশ্চয়ই!’ জবাব দিল তরুণ। ‘কেন খুশি হবো না বলো। দিনটা চমৎকার, শরীরটা ভাল আছে, টাকা-পয়সার অভাব নেই, যাকে ভালবাসি তাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি আগামী বৃহস্পতিবার-দুঃখ করার কোন কারণ আছে আমার? গোটা লকলি শহরে আমার মত সুখী কে আছে আর?’
‘লকলি শহরে বাড়ি বুঝি তোমার?’ বললো রবিন। ‘আমারও জন্ম ওই শহরেই। ওখানকার প্রতিটা ঝোপঝাড়, জঙ্গল, পাখির বাসা, ঝর্ণা, এমন কি ঝর্ণার ছোট ছোট মাছগুলো পর্যন্ত আমার চেনা। তা মাংস নিয়ে কোথায় চলেছো তুমি?’
‘চলেছি নটিংহামের বাজারে। সত্যিই লকলি শহরে জন্ম তোমার? নাম কি?’
‘আমার নাম রবিন হুড।’
‘ওরে সব্বোনাশ!’ ভয় পেয়ে গেল তরুণ। ‘তোমার কথা অনেক শুনেছি আমি। আমাদের ওখানে লোকের মুখে মুখে তোমার নাম। কিন্তু আমাকে ধরেছো কেন, আমি তো কারো ওপর কখনও কোন অন্যায় করিনি। শুনেছি নিরপরাধ কাউকে রবিন কিচ্ছু বলে না।’
‘ঠিকই শুনেছো,’ হাসলো রবিন। ‘তোমার কাছ থেকে কিছুই কেড়ে নেব না আমি। তোমাকে ভাল লাগলো তাই দু’টো কথা শুধাচ্ছি। স্যাক্সন তরুণের উজ্জ্বল হাসি-মাখা মুখ আমি ভালবাসি, আরো ভালবাসি যদি সে লকগুলি শহরের ছেলে হয়, তার চেয়েও বেশি ভালবাসি যদি জানতে পারি আগামী বৃহস্পতিবার সে বিয়ে করতে যাচ্ছে তার ভাল-লাগা মেয়েটিকে। কিন্তু সেটা আসল কথা নয়, আসল কথা হচ্ছে তোমাকে দেখে একটা মতলব ঢুকেছে আমার মাথায়। বলো দেখি, কত পেলে গাড়ি, ঘোড়া, মাংস আর তোমার গায়ের ওই অ্যাপ্রন বিক্রি করবে আমার কাছে?’
‘সব মিলে চার মার্ক দাম হয়, ভেবে চিন্তে বললো তরুণ। অবশ্য যদি সব মাংস বিক্রি করতে পারি তবেই।’
কটিবন্ধে গোঁজা একটা থলে টেনে বের করলো রবিন, বাড়িয়ে দিল তরুণের দিকে। ‘ছয় মার্ক আছে এতে। আজকের জন্যে কসাই সেজে নটিংহাম শহরে যাওয়ার খুব ইচ্ছে হয়েছে আমার। এই ছয় মার্কের বিনিময়ে বেচবে এসব আমার কাছে?’
এক লাফে গাড়ি থেকে নেমে খুশি মনে থলিটা নিল তরুণ। বললো, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ। গাড়ি, ঘোড়া, মাংস আর এই অ্যাপ্রন এখন তোমার।’
‘গুনে নাও টাকাটা,’ অ্যাপ্রনটা গায়ে আঁটতে আঁটতে বললো রবিন 1
‘গোনা লাগবে না,’ জবার দিল তরুণ। ‘স্বয়ং রবিন হুডের হাত থেকে পেয়েছি এই থলে, আমি জানি, ছয় মার্কের একটা পয়সা কম নেই এতে।’
তরুণ মাংস-বিক্রেতাকে বিদায় দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে দিল রবিন নটিংহামের উদ্দেশে। বাজারে পৌঁছে কসাইদের জন্যে নির্দিষ্ট এলাকায় দোকান সাজিয়ে ফেললো সে ঝপট্। তারপর হাঁক ছাড়লোঃ ‘মাংস নেবে… মাংস? খাসী গরু যার যা খুশি। চলে এসো।’ চট্ করে একটা ছড়াও বানিয়ে ফেললো সে, গানের মত করে আবৃত্তি করছে সেটা বার বারঃ
‘তিন পেনির মাংস যদি
এক পেনিতে কিনতে চাও,
জলদি এসো আমার কাছে
যার যা লাগে নিয়ে যাও।’
আবৃত্তি শেষ করেই ঝন ঝন আওয়াজ করে সে ছুরি দিয়ে, তারপর আবার হাঁক ছাড়ে, ‘কই, কে নেবে, চলে এসো। তিন পেনির মাংস মোহান্ত বা বিশপের জন্যে ছয় পেনি, শহরের মান্যগণ্যদের জন্যে তিন পেনি, মোটাসোটা গিন্নীদের জন্যে এক পেনি, আর সুন্দরী তরুণীদের জন্যে বিনা পয়সায় যদি একটা চুমো দেয় আমার গালে। কই, কে নেবে, চলে এসো।’
ক্রমে ভিড় জমে উঠছে ওর দোকানে। যারা কথা শুনে হাসছিল, মনে করেছিল ঠাট্টা, তারা অবাক হয়ে দেখলো মুখে যা বলছে কাজেও ঠিক তাই করছে লোকটা। গৃহিণীদের এক পেনিতে দিয়ে দিচ্ছে তিন পেনির মাংস, হাসিখুশি সুন্দরী তরুণী যদি একটা চুমো দিচ্ছে তাহলে বিনা পয়সায় পেয়ে যাচ্ছে বড়সড় এক চাকা মাংস। তাছাড়া গরীব বা বিধবা স্ত্রীলোক মাংস কিনতে এলে একটা পয়সাও নিচ্ছে না লোকটা। হুড়োহুড়ি লেগে গেল ক্রেতাদের মধ্যে, কে কার আগে কিনবে তাই নিয়ে প্রতিযোগিতা। অল্পক্ষণেই শেষ হয়ে গেল সব মাংস।
আশেপাশের মাংস-বিক্রেতারা নিজেদের মধ্যে কানাঘুষো শুরু করলো রবিনকে নিয়ে। কেউ বলছে, লোকটা নিশ্চয়ই চোর, কারো মাংস ভর্তি গাড়ি চুরি করে নিয়ে এসেছে। অন্যজন বলছে, আরে দূর, চোর হলে এমন খোলামেলা হাসিখুশি ভাব থাকতো না, আমার মনে হয়, ব্যাটা কোন বড়লোকের উড়নচণ্ডী সন্তান, বাপের জমিজমা বেচে টাকা ওড়াচ্ছে ফুর্তি করে। দেখা গেল, বেশির ভাগ মাংস-বিক্রেতারই ধারণা লোকটা কোন ধনী কৃষকের বখে যাওয়া সন্তান।
কয়েকজন এগিয়ে এলো আলাপ পরিচয় করতে। রবিনকে নিমন্ত্রণ করলো একজন, ‘এসো না ভাই, আজ আমাদের কসাই-সমিতির পক্ষ থেকে গিল্ড হলে একটা ভোজ আছে, মাননীয় শেরিফ আয়োজন করেছেন এই ভোজের। আমাদের নতুন সদস্য হিসেবে তুমিও চলো সেখানে। ভাল খানাপিনার ব্যবস্থা করা হয়েছে, খারাপ লাগবে না তোমার।’
‘বেশ তো, যাব না হয়,’ জবাব দিল রবিন। প্রথম দিনই তোমাদের সাথে ভোজ খাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম, এটা আমার পরম সৌভাগ্য। দাঁড়াও, দোকানটা গুটিয়ে নিই আগে।’ একটু ভেবে আবার বললো, ‘ঘোড়াটা আমার দরকার, কিন্তু বাকি যা আছে সব বেচে দিতে চাই, লাগবে নাকি তোমাদের কারো?’
ঘোড়াটা রেখে বাকি যা ছিল পানির দামে বেচে দিল রবিন, তারপর খুশি মনে রওনা হলো ভোজ সভায় অংশ নিতে। শেরিফ সেখানে পৌঁছে গেছেন আগেই। হাসিখুশি রবিনকে ঢুকতে দেখে একজন কসাই তাঁর কানে কানে বললো, ‘ওই যে লোকটা ঢুকছে দেখছেন…একেবারে বদ্ধ উন্মাদ! তিন পেনির মাংস আজ বেচে দিয়েছে এক পেনিতে। অনেককে বিলিয়ে দিয়েছে বিনা পয়সায়।’
‘তাই নাকি?’ ভুরু কুঁচকে রবিনকে লক্ষ্য করলেন শেরিফ। কিন্তু কসাইয়ের বিচিত্র বেশ পরে থাকায় চিনতে পারলেন না। ‘কে লোকটা?’
‘মনে হয় কোন ধনী গৃহস্থের উড়নচণ্ডী বখাটে সন্তান। দু’হাতে ওড়াচ্ছে টাকা।’
এই কথা শুনে রবিনকে কাছে ডেকে বসালেন শেরিফ; কারণ, ধনী লোকের স্বল্পবুদ্ধি উড়নচণ্ডী ছেলে-পিলে তাঁর খুব পছন্দ বিশেষ করে যদি সে ছেলের পকেট হালকা করার কোন সম্ভাবনা থাকে। খাওয়ার সাথে সাথে হাসি ঠাট্টা গল্প-গুজবে মেতে উঠলো রবিন। ওর রসিকতায় সবার আগে হেসে উঠছেন শেরিফ, চেষ্টা করছেন কথাবার্তার মাধ্যমে আরো ঘনিষ্ঠ হতে, মাঝে মাঝে বাহবার চাপড়ও মেরে বসছেন ওর পিঠে।
ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছে রবিন, আজকের এই ভোজের সমস্ত খরচ বহন করবে সে নিজে, কেউ যেন প্রাণ ভরে খেতে বা পান করতে কোনরকম কার্পণ্য না করে। রবিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে এলেন শেরিফ। ‘যে দামে মাংস বিক্রি করেছো শুনলাম… অনেক গরু-ছাগল আছে বুঝি তোমাদের? জায়গা-জমি?’
‘ঠিক কত একর যে আছে আমি নিজেও জানি না,’ বললো রবিন হাসতে হাসতে। ‘ওসব হিসেব রাখতো বুড়ো বাপ। অত হিসেব নিকেশ করতে গিয়েই তো মারা পড়লো বেচারা। জমি…তা কয়েকশো একরের কম হবে না, এটুকু আমি জানি। শিংওয়ালা পশু রয়েছে আমার পাঁচশোর ওপর। কিন্তু হলে কি হবে, ওসব দিয়ে আমি কি করবো, আমার দরকার নগদ টাকা।’
লোভে চকচক করে উঠলো শেরিফের দু’চোখ। মনে মনে স্থির করে ফেললেন, এই অপব্যয়ী ছোকরার পকেট থেকে কিছু খসাতেই হবে, তা না পারলে দুঃখ থেকে যাবে আজীবন। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখনো বিক্রি হয়নি সে-সব?’
‘নাহ্, খরিদ্দার পাইনি। সত্যি কথা বলতে কি, খরিদ্দার আসলে খুঁজিওনি আমি এর আগে। এবার ভাবছি খুঁজতে হবে। খুব সস্তাতেই বেচে দেব আমি সব।’
‘কত?’ সামনে ঝুঁকে এলেন শেরিফ, ‘কত হলে বেচবে?’
ঘরের ছাদের দিকে চেয়ে মনে মনে হিসেবের ভান করলো রবিন, তারপর বললো, ‘আমার ভাইদের সাথে আলাপ না করে জমির কথা বলতে পারছি না, তবে পশুগুলো বেচে দিতে পারি আমি যখন তখন। ওগুলোর ন্যায্য দাম, আমার বিশ্বাস, কমপক্ষে সাড়ে সাতশো পাউণ্ড। তবে পাঁচশো পেলেই ছড়ে দেব আমি খুশি মনে।’
‘পাঁ-চ-শো!’ ভুরুজোড়া কপালে তুললেন শেরিফ। কিছু বলতে যাচ্ছিল কসাইদের একজন, চট্ করে হাত তুলে থামিয়ে দিলেন তাকে, তারপর বললেন, ‘নাহ্, অনেক বেশি দাম চাইছো। তাছাড়া অত টাকা নেইও আমার কাছে। যদি তিনশো পাউণ্ডে হয় তো আমি কিনতে পারি।
‘ঠকা হয়ে যায়,’ বললো রবিন। লক্ষ্য করলো দূর থেকে বেশ কয়েকজন মাথা নেড়ে বারণ করছে ওকে, যেন শেরিফকে কোন কথা দিয়ে না ফেলে। কাছাকাছি একজন ছটফট করে কিছু বলে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু থেমে গেল শেরিফের ভ্রুকুটি দেখে। যেন এসব কোনদিকে খেয়াল নেই, এমন ভঙ্গিতে রবিন বললো, ‘কি যে করি! নগদ টাকাটাও দরকার খুবই। আচ্ছা ঠিক আছে, যান, তিনশো পাউণ্ডই সই। আমি রাজি।’
‘ঠিক তো?’ হাত বাড়িয়ে দিলেন শেরিফ। সেই হাতের উপর চাপড় মারলো রবিন।
‘ঠিক। কিন্তু টাকাটা সাথে করে নিতে হবে আপনার। বাকি বকেয়া…’
‘আরে, না, না!’ হেসে উঠলেন শেরিফ। নগদ তিনশো পাউণ্ড সাথে নিয়ে যাব আমি তোমার সাথে। নামটা কি তোমার, ভাই?’
‘লকস্লির রবার্ট বলে ডাকে আমাকে সবাই।’
‘ঠিক আছে, রবার্ট, তাহলে এই কথাই থাকলো। আজই বিকেলে তোমার সাথে যাচ্ছি আমি, জিনিস পছন্দ হলে টাকা দিয়ে কিনে রেখে আসবো, কাল আমার লোক গিয়ে নিয়ে আসবে ওগুলো। কেমন?’
‘কোন আপত্তি নেই,’ বললো রবিন। সবাইকে তাড়া দিল, ‘কই, হাঁ করে রয়েছো কেন তোমরা সব? চালাও হাত চালাও, মুখ চালাও।’
ভোজ শেষ হলো। সবাই বলাবলি শুরু করলো, কাজটা শেরিফের উচিত হলো না। এমন ভাবে ঠকানো ঠিক হলো না হাসিখুশি, অপব্যয়ী, নির্বোধ ছেলেটাকে।
যাই হোক, বিকেল হতেই রওনা হয়ে গেল দু’জন ঘোড়ায় চেপে। শেরউড জঙ্গলের কাছাকাছি এসেই কেমন যেন ভয়-ভয় করতে লাগলো শেরিফের, চমকে চমকে তাকাতে শুরু করলেন তিনি এদিক ওদিক। জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে কথাবার্তা কমিয়ে দিলেন তিনি, রবিনের কথার উত্তরে হুঁ-হাঁ করেন শুধু, তাও আবার নিচু গলায়।
‘একটু আস্তে কথা বলো,’ আরো কিছুদূর এগিয়ে পরামর্শ দিলেন তিনি রবিনকে। ‘এই জঙ্গলেই বাস করে ভয়ঙ্কর দস্যু রবিন হুড! ওর হাতে পড়লে আর রক্ষা নেই।’
জোরে হেসে উঠলো রবিন এই কথা শুনে। ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, মিস্টার শেরিফ। ভাল করেই চিনি আমি রবিন হুডকে। অযথা ভয় পাবেন না। আমার মত নিরীহ একজন লোককে দিয়ে যতটুকু ভয়, তার চেয়ে বেশি ভয় নেই আজ আপনার রবিন হুডকে দিয়ে।’
চট্ করে রবিনের মুখের দিকে চাইলেন শেরিফ। মনে মনে বললেন, ‘রবিন হুডের সাথে তোমার এত খাতির থাকাটা তো মোটেই পছন্দ হচ্ছে না আমার, ছোকরা। শেরউড থেকে বেরোতে পারলে বেঁচে যাই।’
কিন্তু এগোতেই থাকলো রবিন। গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলে ঢুকছে আঁকাবাঁকা পথ ধরে। পাথরের মূর্তির মত এক্কেবারে চুপ হয়ে গেছেন শেরিফ। হঠাৎ একটা মোড়ে এসে ঘোড়ার রাশ টেনে ধরলো রবিন। বেশ কিছুটা দূরে একদল হরিণ পার হয়ে যাচ্ছে রাস্তা। হাত তুলে দেখালো সে শেরিফকে, ‘ওই দেখুন আমার শিংওয়ালা পশু। কেমন তাজা আর মোটাসোটা! পছন্দ হয়েছে আপনার?’
কথা শুনে ভুরুজোড়া কুঁচকে উঠলো শেরিফের। ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে চাইলেন তিনি রবিনের মুখের দিকে। ‘তামাশা করার জন্যে নিয়ে এসেছো তুমি আমাকে এতদূর? তোমার সঙ্গে আর এক কদম সামনে এগোচ্ছি না আমি! চললাম! তুমিও সিধে চলে যাও নিজের রাস্তায়!’
হেসে উঠলো রবিন। ‘রাগ করছেন কেন, স্যার শেরিফ? আমার ভাইদের সাথে দেখা না করেই চলে যাবেন, তা কি হয়?’ চট্ করে এক হাতে চেপে ধরলো সে শেরিফের ঘোড়ার লাগাম, অপর হাতে শিঙাটা মুখে তুলে তিনটে ফুঁ দিল তাতে।
চারপাশ থেকে ছুটে এলো পাঁচ-কুড়ি সবুজ পোশাক পরা তাগড়া জোয়ান, সবার আগে রয়েছে লিটল জন।
‘আজ্ঞা করুন, প্রভু!’ বিনয়ের অবতার সেজে মাথা ঝুঁকালো লিটল জন রবিনের উদ্দেশে।
‘লাগামটা ধরো, লিটল জন,’ বললো রবিন। দেখতে পাচ্ছো না, আমাদের আজকের ভোজে প্রধান অতিথি হিসেবে কে এসেছেন? ছি, ছি, চিনতে পারছো না এঁকে? আমাদের প্রিয় আইন রক্ষক নটিংহামের মাননীয় শেরিফের চেহারাটা ভুলে গেছো এরই মধ্যে? আমাদের দাওয়াত কবুল করে ধন্য করেছেন তিনি আজ আমাদের।’
সম্মান প্রদর্শনের জন্যে সবাই খুলে ফেললো মাথার টুপি। কারো মুখে বিন্দুমাত্র হাসির আভাস নেই। এক হাতে লাগাম ধরে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো লিটল জন শেরিফের ঘোড়াটাকে। সবাই চললো পিছন পিছন
একটি কথাও বেরোলো না শেরিফের মুখ থেকে। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চারপাশে চাইছেন—যেন হঠাৎ জেগে উঠেছেন ঘুম থেকে। জঙ্গলের আরো গভীরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখে মনটা একেবারে দমে গেল তাঁর। তিনশো পাউণ্ড তো যাবেই, প্রাণটা থাকবে কিনা তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ, একবার নয়, পর পর বহুবার এদের প্রাণনাশের চেষ্টা করেছেন তিনি। যখন দেখলেন, সসম্ভ্রমে নিয়ে চলেছে ওরা তাঁকে, কেউ কোন রকম হুমকি দিচ্ছে না, তখন আরো ভয় পেয়ে গেলেন তিনি, টেনে ছেড়ে দেয়া ধনুকের ছিলার মত কাঁপতে শুরু করলো তাঁর বুকের ভেতরটা।
বিশাল এক ওক গাছের নিচে এসে থামলো রবিন, সবুজ ঘাসের ওপর বসে শেরিফকে বসালো তার ডান পাশে। ‘জলদি!’ হুকুম করলো সে, ‘জলদি করে খানাপিনার ব্যবস্থা করো। ভাল ভাল যা কিছু আছে নিয়ে এসো সব। আমাদের পরম পূজণীয় মহাত্মা শেরিফ আজ আমাকে নটিংহামের গিল্ড হলে দাওয়াত খাইয়েছেন…যদিও পয়সাটা দিতে হয়েছে আমাকেই… আমাদের এখানে পদার্পণ করে শুধু মুখে তিনি ফিরে যাবেন, সেটা হতেই পারে না।’
টাকা-পয়সার কথা একবারও উল্লেখ করা হলো না দেখে কিছুটা সামলে নিলেন শেরিফ। মনে মনে বললেন, হয়তো ভুলেই গেছে রবিন হুড যে তিনশো পাউণ্ড রয়েছে আমার কাছে।
শেরিফের সম্মানে লাঠি খেলার আয়োজন করা হলো। এদিকে বাতাসে ভেসে আসছে গনগনে আগুনে হরিণের মাংস আর খাসি-মোরগের রোস্ট, সেই সাথে মাংসের পিঠে ঝলসানোর জিভে পানি আসা গন্ধ। খুশি হয়ে উঠলো শেরিফের মন। লাঠি খেলার চমৎকার কৌশল দেখে নিজের অজান্তেই হাততালি দিয়ে উঠছেন তিনি, চেঁচিয়ে উঠছেন, ‘বাহ! বেড়ে মেরেছো হে, কালো দাড়ি!’ এই লোকটাই যে তাঁর কাছ থেকে রবিন হুডের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা নিয়ে শেরউডে আসা সেই ঝালাইকার, তা তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না।
এবার শুরু হলো তীর-ধনুকের খেলা। একশো ষাট গজ দূরের লক্ষ্য ভেদ করছে একজনের পর একজন তুখোড় তীরন্দাজ। কিন্তু এসব দেখে আনন্দিত না হয়ে বরং বিমর্ষ হয়ে পড়লেন শেরিফ। কারণ, কিছুদিন আগেই তাঁকে বোকা বানিয়ে আশ্চর্য পারদর্শিতা দেখিয়ে পুরস্কার জিতে নিয়ে এসেছে রবিন নটিংহাম থেকে, সেই সোনার তীরটা দেখতে পাচ্ছেন তিনি, ঝুলছে গাছের ডালে। তাঁর মনের ভাব টের পেয়ে এই খেলা বন্ধ করে দিল রবিন। তলোয়ারের খেলা দেখতে হলে আরো খারাপ লাগবে শেরিফের, মনে পড়ে যাবে উইল স্টিউটলিকে উদ্ধার করার সেই দৃশ্য, তাই সেটাও বাদ দিয়ে গানবাজনার আয়োজন করতে বললো সে অনুচরদের। চমৎকার জমে উঠলো গানের আসর, হার্পের সুরলহরী সৃষ্টি করলো অপূর্ব পরিবেশ।
খাবার তৈরি হয়ে যেতেই কয়েকজন এসে ঘাসের উপর বিছিয়ে দিল দস্তরখান, কয়েকজন নিয়ে এলো পিপে ভর্তি নানান জাতের সুপেয় মদ। দস্তরখানের দুই পাশে লাইন করে বসে গেল সবাই। শুরু হলো পরিবেশন। তৃপ্তির সাথে পেট পুরে খেল সবাই, মদ খেল আকণ্ঠ। খাওয়া যখন শেষ হলো, অস্ত গেছে সূর্য, আধখানা ফ্যাকাসে চাঁদ ম্লান আলো দিচ্ছে পাতার ফাঁক দিয়ে।
খাওয়া শেষ করে ঢেকুর তুললেন শেরিফ, তারপর উঠে দাঁড়ালেন। ‘তোমাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ,’ বললেন তিনি। ‘প্রাণ ভরে খেলাম আজ। তোমাদের ব্যবহারেও আন্তরিকতার স্পর্শ পেয়ে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি আমি। আমি এবার উঠতে চাই। সাঁঝ হয়ে এলো, আর দেরি করলে রাত হয়ে যাবে, পথ হারিয়ে ফেলবো জঙ্গলে।
রবিন হুডও উঠে দাঁড়ালো, তার সাথে সাথে আর সবাই। ‘আপনাকে যেতে যখন হবেই, আটকাবো না,’ বললো রবিন। হাসলো। তবে মনে হয় কিছু একটা বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন আপনি।
‘কই, না তো! কিছুই তো ভুলে ফেলে যাচ্ছি না!’ মুখে কথাটা বললেন বটে কিন্তু মনটা দমে গেল শেরিফের।
‘ফেলে যাচ্ছেন না, ভুলে নিয়ে চলে যাচ্ছেন, মাননীয় শেরিফ!’ বললো রবিন ‘আমাদের এই শেরউডের সরাইখানায় যাঁরাই অতিথি হন তাঁদের ভোজের খরচটা দিয়ে যাওয়াই নিয়ম।’
‘ও, এই কথা!’ হা হা করে প্রাণহীন ফাঁকা হাসি হেসে উঠলেন শেরিফ। ‘তোমাদের সঙ্গে চমৎকার কাটলো সময়টা। চাওয়ার আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, বিশটা পাউণ্ড দিয়ে যাবো আমি তোমাদের।’
‘এ কথা বলে দয়া করে লজ্জা দেবেন না,’ বললো রবিন। ‘আপনি মাত্র বিশটা পাউণ্ড দিলে মুখ দেখাতে পারবো না আমি আর কোনদিন কারো কাছে। সবাই ছি ছি করবে আমাকে কিপ্টে অতিথি ডেকে আনার জন্যে। তাছাড়া আপনি এতবড় একজন রাজ-কর্মচারী, এই সামান্য টাকা দেয়া কি আপনার সাজে? আমার মনে হয় শ তিনেক পাউণ্ড দিলে মানায়-কি বলো তোমরা?’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়!’ চেঁচিয়ে উঠলো সবাই।
‘তিনশো পাউণ্ড!’ আঁৎকে উঠলেন শেরিফ। তুমি কি মনে করো তোমার এই ফকিরী খানার দাম তিন পাউণ্ডের চেয়ে এক পেনি বেশি হবে?’
‘অত কড়া কথা বলবেন না, স্যার শেরিফ’ গম্ভীর হয়ে উঠলো রবিন। ‘যদিও আমাকেই দামটা দিতে হয়েছে, তবু আজকের ওই গিল্ড হলের ভোজের জন্যে আপনাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। কিন্তু আমাদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছে যারা আপনাকে অতটা ভালবাসে না। এই যেমন ধরুন, উইল স্টিউটলির কথা-কদিন আগে যাকে ফাঁসীকাঠে ঝোলাতে যাচ্ছিলেন, কিংবা ধরুন আরো দু’জনের কথা-ক’দিন আগে নটিংহামের খণ্ডযুদ্ধে যারা আহত হয়েছিল, তাদের মধ্যে আপনার প্রতি তেমন কোন ভালবাসার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না, বরং কেমন একটা আক্রমণাত্মক ভাব লক্ষ্য করছি। ওদেরকে একটু ঠাণ্ডা করার জন্যে যদি কিছু বেশি খরচ হয়ে যায়, সেটা আপনার নিজের মঙ্গলের জন্যেই হবে।’
এই কথা শুনে রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেল শেরিফের মুখটা, মাটির দিকে চেয়ে কি যেন ভাবলেন কিছুক্ষণ, তারপর কোন কথা না বলে ধীরে ধীরে কোমরে গোঁজা থলিটা বের করে ছুঁড়ে দিলেন দস্তরখানের উপর।
‘গুনে দেখো, লিটল জন,’ বললো রবিন হুড। আমরাও দেখি। কম-টম থাকলে কে যাবে আবার নটিংহামে বাকিটুকু চেয়ে আনতে?’
গুনতে শুরু করলো লিটল জন। টুং-টাং আওয়াজ হচ্ছে আর কানের ভিতর যেন শেল ঢুকছে শেরিফের। স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রায় ঠিক তিনশো পাউণ্ডই পাওয়া গেল থলিতে। গোণা শেষ হতেই মুদ্রাগুলোর উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন শেরিফ, নীরবে এগিয়ে গিয়ে উঠে বসলেন নিজের ঘোড়ায়।
‘চলুন, স্যার শেরিফ, আপনাকে কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে আসি,’ বলে ঘোড়ার লাগামটা হাতে নিল রবিন। রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বললো, ‘এরপর আর কাউকে সর্বস্বান্ত করার আগে দয়া করে আজকের ঘটনাটা একটু স্মরণ করবেন। বিদায়, স্যার শেরিফ। হয়তো আবার দেখা হবে কোনদিন।’ এই বলে ঘোড়ার পিঠে জোরে একটা চাপড় দিল রবিন।
ছুটতে শুরু করলো ঘোড়া নটিংহামের পথে।