শেখর
সকালবেলা সারা শরীর ব্যথা করে প্রত্যেক দিন। অধিকাংশ দিনই রাত্রে আলো নেভাতে মনে থাকে না। দিনেরবেলা আলোটা নেভাতে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে তাকাই। কী করুণ মূর্তি এই আলোর। আমাদের তিন-পুরুষের বাড়িতে এখনও কিছু কিছু ঝাড়লণ্ঠন আছে, সেগুলো নষ্ট করিনি। ভেতরে বা বসিয়ে জ্বালি। রাত্তিরবেলা খুব জমজমাট দেখায়। প্রাচীন রাজপুরুষের মতো। কিন্তু দিনেরবেলা কী মলিন রুগ্ন চেহারা আলোটার। আমি দিনের বেলাতেই এটাকে দেখতে ভালবাসি। রাত্তিরের অত প্রখরতা সহ্য হয় না। সুইচ টিপে আলোটা একবার নেভাই ও জ্বালি। আলোটা নেভালেই রোদ্দুর চোখে পড়ে বিশেষ ভাবে। রোদ্দুর দেখলেই মনে হয় দূরে চলে গেছি, ধানবাদের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি অথবা কুচবিহারে অথবা ছেলেবেলায় খুলনায় যেমন হাঁটতাম শশাঙ্কর সঙ্গে। সকালে উঠলেই শরীর ব্যথা করে। এ বেশ মজা, রাত্তিরে কোনও দিন ঘুম আসতে চায় না, প্রতি দিন স্লিপিং পিল খেতে হয়, তবু ঘুম আসে না। দেয়ালে ছবি দেখি, ছবি তৈরি করি, ছবি নষ্ট করি। শেষরাত্রে ঘুমের মতো আচ্ছন্নতা। সকালে গা ব্যথা। সেই ব্যথা সারাবার জন্য আবার ট্যাবলেট খাই। শুনেছি, বেশি ট্যাবলেট খেলে রাত্রে ঘুম হয় না। ঘুম হয় না বলে রাত্রে ট্যাবলেট খাই, সেই জন্য সকালে গা ব্যথা। আবার গা ব্যথা সারাবার জন্য ট্যাবলেট খাই, সেই জন্য আবার রাত্রে ঘুম হয় না। সকালে মার সঙ্গে দেখা হয়, আমার বিরস মুখ দেখে শারীরিক ব্যাপারে প্রশ্ন করে। আমার সেই গা ব্যথার কারণ বলি। ওই ট্যাবলেটটা খাস না কেন? খুব ভাল কাজ দেয়, শরীর একেবারে ঝরঝরে করে দেবে। এই বলে একটা ট্যাবলেটের নাম করে। রাত্রে যার সঙ্গেই দেখা হয়, কথায় কথায় বলি, রাত্রে একদম ঘুম হচ্ছে না ভাই। সঙ্গে সঙ্গে কেউ না কেউ বলে, অমুক ওষুধটা খেয়ে দ্যাখ। মন্ত্রের মতো অ্যাকসান, দশটা ভেড়া গোনার আগেই ঘুমিয়ে পড়বি। প্রত্যেকেই কিছু না-কিছু ওষুধ জানে। সবগুলিই কার্যকরী। কিন্তু সবগুলোই আংশিক। সকলেই আংশিক ওষুধ নিয়ে আছে।
তিনফর্মা প্রুফ জমে গেছে, কখন দেখব জানি না। একেবারে সময় পাই না। মাথার মধ্যে অনেকগুলো সরু সরু রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে। সেই সব ক’টা রাস্তার ট্রাফিক আমাকে একা সামলাতে হয়। সবুজ, লাল, হলুদ আলো জ্বলে, আমি টের পাই। মাথার মধ্যে একটা জাঁদরেল পুলিশ অফিসার সব সময় ব্যাট হাতে রাগে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারই আশেপাশে আর একটা রোগা উদ্ৰান্ত লোক, ছেঁড়া জামা, তিন দিন দাড়ি কামায়নি। সেই লোকটা বলছে, ক্ষমা করুন, ক্ষমা করুন। এই ক্ষমতাপ্রার্থী। নিবীহ লোকটি ও ক্রুদ্ধ পুলিশ অফিসার ঘুরছে আমার মাথার মধ্যে, নানা রাস্তা দিয়ে ছুটছে, কখনও হাঁটু মুড়ে বসছে, লুকোচ্ছে। এবা কী নাটক তৈবি করছে জানি না। এবা আমারই মাথার মধ্যে, তবু এদের চিনি না আমি। কখনও-বা পুলিশ অফিসারের মতো লোকটা গর্জন করে বলছে, না, ক্ষমা করব, ক্ষমা নেই। এই বলে পাছে ক্ষমা করে ফেলে এ জন্য ছুটে পালাচ্ছে, আর নিরীহ করুণ লোকটা ক্ষমা করুন, ক্ষমা করতেই হবে বলে তাড়া করছে তাকে। সেই অদ্ভুত দৌড়-প্রতিযোগিতা মাথায় নিয়ে আমি বসে থাকি টেবিলের সামনে। গায়ে ব্যথা, প্রফ যেমন তেমন পড়ে থাকে, ডানাভাঙা পাখির মতো উলটানো আদ্দেক শেষ-করা বই, ড্রয়াবে আদ্দেক শেষ করা উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। ওই পাগলাটে দৌড়ের জন্য মাথায়ও ব্যথা হয়।
এ ছাড়া আছে মাধবী। সপ্তাহে তিন দিন মাধবী আসে আমার বাড়িতে দুপুরবেলা। এখন কলেজ বন্ধ বলে সন্ধেবেলাটা শুধু শুধু ছাত্রী পড়িয়ে নষ্ট করতে চাই না। তাই ওকে দুপুরেই আসতে বলেছি। শুধু দুপুরবেলাটুকু ও থাকে, কিন্তু আমাকে ব্যাপৃত রাখে সারা দিন। যদি দেখা হয়, সমস্ত দিনটা মাধবীর কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না। অতি কষ্টে তবু বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে দুপুরবেলাটা ছিনিয়ে নিয়েছি। আমার বাড়িতে যে যখন ইচ্ছে আসে, আমি থাকি বা না থাকি আমার ঘরে এসে আড্ডা মারে। মাকে ডেকে চায়ের হুকুম করে। বন্ধুরা বসে থাকরে বলে আমাকে সব সময় তাড়াতাড়ি ফিরতে হয় বাড়িতে। বলতে গেলে আমার স্বাধীন সময় কিছুই নেই। প্রত্যেকে আলাদা ভাবে আচ্ছা মারতে আসে আমার সঙ্গে, কিন্তু আমার কোনও নির্বাচনের অধিকার নেই। কারণ আড্ডার জায়গা আমার বাড়ি। অনেকে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আমার বাড়িতে। কেউ হয়তো এসে বলল, ওমুক এসেছে? বললাম, না। সে বসে রইল, বইয়ের পাতা ওলটাতে লাগল। খানিকটা বাদে ওমুক এসে বলল, আরে তুই কতক্ষণ এসেছিস? আমি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। খানিকটা বাদে তারা নিজেদের কথা সেরে তারপর আমার সঙ্গে দু-একটা মুখরাখা কথা বলে আচ্ছা চলি, বিদায় নেয়। অতি কষ্টে সবাইকে নোটিশ দিয়ে বলেছি, দুপুরবেলা কেউ আসবেনা। দুপুরবেলা আমি একা থাকতে চাই। দুপুরবেলা মাধবী আসে ইতিহাস পড়তে।
টেবিলের ও-পাশে বসে যখন আমি ওকেমিউজিয়ামের পাথর বিষয়ে বই-পড়া বক্তৃতা শোনাই, তখন চুপ করে বসে থাকে মাধবী, একটাও শব্দ করে না। খানিকটা বাদে লক্ষ্য করি, ও একটাও কথা শুনছেনা আমার, শুধুই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি থেমে যাই, জিজ্ঞেস করি, কী দেখছ?
ওটা কার ছবি?
তখন বুঝতে পারি, ও আমাকে দেখছে না, দেখছে আমার পিছনের দেয়াল। বলি, সালভাদোর দালি, ছবিটার নাম জ্বলন্ত জিরাফ।
ওঃ আচ্ছা, তারপর বলুন।
কখনও কখনও শুধুই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখনও জিজ্ঞেস করি, কী দেখছ?
আপনাকে।
এরকম পরিষ্কার ভাবে কোনও মেয়ে কথা বলে না। অধ্যাপকের দিকে তাকিয়ে কোনও ছাত্রী বলে না, আমি আপনাকে দেখছি। শুনে আমি একটু থতমত খেয়ে যাই। কিন্তু ছাত্রীদের এসব ব্যবহারের প্রশ্রয় দিতে নেই। তাহলে চাকরি রাখা যাবেনা। সেই জন্য আমি খানিকটা নির্বিকার ভাবেই বলি, আমাকে কী দেখার আছে? এমন কিছু দর্শনীয় নই। নিয়নডার্থাল স্কাল আমার, লক্ষ্য করছ?
তা নয়। আপনাকেআমার একজন চেনা লোকের মতো দেখতে। খুব মিল আছে। সত্যি আপনি অনেকটা অবনীভূষণের মতো দেখতে।
এ-কথা মাধবী আরও কয়েক বার বলেছে। কে অবনীভূষণ, আমি জিজ্ঞেস করিনি কখনও। মাধবীর সঙ্গে তার কী সম্পর্ক, সে কোথায় এখন, বেঁচে আছে কিনা, কিছুই জানিনা। যেন ওর সঙ্গে আমার একটা লুকোচুরি খেলা চলছে এই নিয়ে। আমি কিছুতে জিজ্ঞেস করবনা, মাধবী জিজ্ঞেস না। করলে বলবে না। দু’জন মানুষ কখনও এক রকম দেখতে হয় না। অবনীভূষণকে আমার মতো দেখতে, অর্থাৎ তার মুখ বা চোয়াল আমার মতো, অব্বা তার চোখ, অথবা আমার মতো কোনও ভঙ্গি। কোথাও আমার মতো আর একজন লোক আছে, এই দুশ্চিন্তা আমাকে বিষম বিব্রত করে। লোকটি সম্বন্ধে খুবই কৌতূহল হয়, ঈর্ষা নয়, সে যদি মাধবীর প্রেমিকও হয়, তবুও না। আমি নিজের চিন্তা ভুলে গিয়ে আমারই মতো অন্য একটা লোক, অবনীভূষণ, তার চিন্তায় বিভোর হয়ে যাই। ক্রমশ, এই ধারণা আমার মনে বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, অবনীভূষণ নিশ্চিতই মাধবীর প্রেমিক, মাধবী যে-ভাবেনামটা উচ্চারণ করে। লোকটা হয় এ-দেশে নেই এখন, বা মারা গেছে। মাধবীর মতো ধনীর দুহিতার সঙ্গেযখন প্রেম তখন সে-ও নিশ্চয়ই খুবউঁচু বংশের ছেলে। মাধবীর সঙ্গে টেনিস খেলতে খেলতে কিংবা গ্র্যান্ড ট্যাঙ্ক রোড দিয়ে ষাট মাইল স্পিডে গাড়ি চালাতে চালাতে কী করে আমারই মতো চেহারার এক জন লোক মাধবীকে প্রণয় জানাত। কী ভাষা ব্যবহার করত, ভাবতে ভাবতে আমিও এক দিন মাধবীর প্রেমিক হয়ে পড়ি। এর আগে, কত মেয়ের সঙ্গেই তো চেনাশুনা, জানা, আরও অনেক কিছু হল, কিন্তু কখনও কোনও মেয়ের সম্পর্কে আমি এত বেশি ভাবিনি, বিশেষত ছাত্রীদের সম্পর্কে তো নয়ই। ছাত্রীদের ব্যাপারে আমি কখনও মাথা ঘামাইনি, আগে অনেক সুযোগ এসেছিল, মাধবীর চেয়ে অনেক সুন্দরী মেয়ে –তবুও না। কিন্তু হঠাৎ মাধবী আমার হৃদয়ের তিন ভাগের একভাগ দখল করে ফেলেছে। সত্যি, আমি একদিনে অনেক বদলে গেছি। আমার চিন্তা ও স্বভাবের অনেক বদল হয়েছে। আর, চিন্তার দিক দিয়ে বদলে গেছি বলেই কি আমার চেহারাও বদলে গেছে? কোথাকার কোন এক অবনীভূষণের মতো দেখতে হয়েছে আমাকে? রাত্তিরবেলা, বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি অবনীভূষণ হয়ে যাই, হয়ে গিয়ে মাধবীর কথা ভাবি। মাধবীর জন্য বিষম মন কেমন করে, নিজেকে অবনীভূষণ ভেবে।
মাধবীর ধরন-ধারণ ঠিক ছাত্রীর মতো নয়, অনেকটা প্রভুপত্নীর মত। বড়লোকের মেয়ে বলেই বোধহয় একটু দেমাকি স্বভাব। আগে এ জন্য ওকে পছন্দ করতাম না। এখন ওর এই অভিজাত ভঙ্গি ও আমার খুব ভাল লাগে। আমার সিগারেটের ছাই ঝাড়ার ধরন দেখে এক দিন মাধবী বলল, অবনীভূষণও ঠিক এই রকম ভাবে ছাই ঝাড়ত। বস্তুত, আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। কারণ আঙুলে টুসকি মেরে আমিও আগে কখনওই ছাই ঝাড়িনি, আজকেই প্রথম। কী করে এ স্বভাব আমার হল! তবে কি আমি সত্যিই ক্রমশ অবনীভূষণ হয়ে যাচ্ছি? প্রসঙ্গ পালটাবার জন্য আমি বললাম, আমি এ-রকম টুসকি মারার কায়দা শিখেছি আমার বন্ধু পরীক্ষিতের কাছ থেকে। তুমি তাকে চেনো?
নাম শুনেছি। লেখেন তো? আপনার বন্ধুদের মধ্যে আমি শুধু অবিনাশ মিত্রকে চিনি, এক দিন আলাপহয়েছিল। খুব চমৎকার লোক।
অবিনাশ কী বিশ্বসুন্ধু মেয়েকে চেনে? অবিনাশের সঙ্গে করে কোথায় আলাপ হয়েছিল জিজ্ঞেস করতেও ভয় হল। কী জানি অবিনাশ এর হৃদয়ও রক্তাক্ত করেছে কি না। না করেনি। যে-রকম আলতো ভাবে মাধবী চায়ের কাপে চামচ নাড়ছে, তাতে বুঝতে পারা যায়। এ-রকম কোমলতা কোনও আহত নারীর থাকে না। আগে মাধবীকে খুব একটা রূপসী মনে হত না, কিছুটা স্কুল, শরীর থেকে অন্তত দশ পাউন্ডওজন কমালে ফিগার সুন্দর হবে ভাবতাম, নাকটাও একটু চাপা। ক্রমশমনে। হচ্ছে ও-রকম গ্রীবার লাবণ্য আমি আগে কোনও মেয়ের দেখিনি, ও-রকম মিগ্ধ অথচ চুম্বকের হাসি। অর্থাৎ মাধবীর প্রতি আমি মায়ায় আরদ্ধ হয়ে গেছি, যাকে বলে ভালবাসা। মনে হয়, মাধবীর দুই বাহু পেলে এ-জীবনে উদ্ধার পেয়ে যাব। হঠাৎ আজকাল এ-রকম উদ্ধার পাবার ইচ্ছেই-বা কেন মনে জাগছে?
এ ছাড়া আর একটাও দৃশ্য আমাকে খুব বিরক্ত করছে আজ কয়েক দিন। ঢালু অন্ধকার রাস্তা, দু’পাশে গাছের সারি, একটা মোটরগাড়ি হেডলাইট জ্বেলে স্পিডে নেমে আসছে। কোনও কিছু লিখতে গেলেই প্রথমে এ দৃশ্যটা চোখে ভাসে। অথচ এমনকী গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য এটা, কোথায় দেখেছি তা-ও মনে পড়ে না। অন্ধকার ঢালু রাস্তায় মোটরগাড়ি দু’পাশের গাছের সারির মধ্য দিয়ে তীব্র আলো জ্বেলে নেমে আসছে। কোথাকার অন্ধকার, কোন ঢালু রাস্তা, কে গাড়ির চালক, কিছুই জানি না। অথচ দৃশ্যটা তাড়িয়ে দিতেও ইচ্ছে করে না, আপনা থেকে কেন এল জানতে ইচ্ছে হয়।
সামনে এক তাড়া প্রুফ ছড়ানো। আমি মাথার মধ্যে পুলিশ ও ক্ষমাপ্রার্থী, মাধবী, অবনীভূষণ, অন্ধকার ঢালু পথে গাড়ির দৃশ্য নিয়ে চুপ করে বসে আছি। এই সময় পরীক্ষিৎ ও অনিমেষ এল। অনিমেষ কাল ফিরে যাবে এক ছেলে ও গায়ত্রীকে নিয়ে। আর একটা ছেলে বাঁচেনি। সিগারেটের ছাইয়ের সঙ্গে প্রচুর কথা উড়ে গেল। অনিমেষ শান্ত গলায় থেমে থেকে পুরনো দিনের কথা বলল। বলল, ছেলেটাকে শ্মশানে পোড়াতে গিয়ে পুরনো কথা সব মনে পড়ল আবার। বোধহয় বছর চারেক পর শ্মশানে গেলাম।
আগে তো প্রতি দিন সন্ধেবেলা ওখানেই আমাদের আজ্ঞা ছিল। এত দিন পর শ্মশানে গিয়ে অনিমেষের মনটা একটু ভারিহয়ে গেছে মনে হল। ছেলেমরার জন্য ওরকি খুব দুঃখ হয়েছে। ছেলে মরার পর দুঃখ হওয়াই তো স্বাভাবিক। কিন্তু যমজ এক ছেলে বেঁচে আছে, এক জন মরেছে, সুতরাং এক জনের জন্য আনন্দ, আরেক জনের জন্য দুঃখ, কিন্তু কোনটা বেশি? যাই হোক, অনিমেষকে কিছুটা অন্য কথা বলে ভোলানো দরকার। আমি বললাম, তোমার মনে পড়ে অনিমেষ, শ্মশানের পাশে আমাদের রাত্রে শুয়ে থাকা? বগলে ব্র্যান্ডির বোতল, ইট বানো ঢালু গঙ্গার পাড়ে? কে যেন গান গাইতে গাইতে পড়ে গেল–পরীক্ষিৎ না অরুণাংশু? ওঃ, গগন, মনে আছে।
কেন, সেবার সেই দুর্গাপুজোর সময়ে মনে নেই?
মনে পড়তেই হাসি পেয়ে গেল। অরুণাংশু দুটো হুইস্কির পাঁইট পকেটে নিয়ে ঘুরছে, কোথাও বসে খাবার জায়গা নেই। আমি বললাম, চল, গঙ্গার পাড়ে যাই। দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন, কিন্তু গঙ্গার পাড় ভিড়ে ভর্তি। অন্ধকারে জোড়ায় জোড়ায় ছেলে-মেয়ে বসে আছে। আমরা কোথাও আর জায়গা পাইনা, ওদের বিরক্ত করতেও ইচ্ছে করে না। শেষ পর্যন্ত বটগাছের নিচে এক সাধুর আশ্রমের কাছে আমরাও সাধু সেজে বসে গেলাম গোল হয়ে। দু’এক চুমুক দেবার পর মনে হল খানিকটা জল দরকার। সাধুটাকে বললাম। সে বলল, গঙ্গাজীমে ইতনা পানি হায়, পি লেও। তাই নিতাম, কিন্তু তাপসটা খানিকটা শৌখিন, ও কিছুতে গঙ্গার জল মেশাবে না। তখন অরুণাংশু একটা চাঅলাকে ডেকে চা না কিনে খালি ছটা ভাড় কিনল। শুধু ভাড দিয়ে কী করব দেখার জন্য কৌতূহলী চাঅলা খানিকটা দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ অরুণাংশু জমিদারি কায়দায় তাকে হুকুম করল, এই চাঅলা, তোমার কলসীটা রেখে এক বালতি পরিষ্কার জল নিয়ে এসো তো। লোকটা ইতস্তত করতে অরুণাংশু বিষম ধমক দিল, যা-ও! দেখছ কী হাঁ করে? পরীক্ষিৎ গাঁজার খোঁজে ঝুলিতে হাত দিয়ে —
কী রে পরীক্ষিৎ, তোর মনে পড়ে?
পরীক্ষিৎ চুপ করে বসে ছিল। শুকনো হাসি হেসে বলল, হুঁ।
আমি বললাম, কী রে, তোর শরীর খারাপ নাকি?
না, কিছুটা। ভাবছি অনিমেষের সঙ্গেই বাইরে চলে যাব। কয়েক দিন ঘুরে এলে ভাল লাগবে। তোর এখানে অবিনাশ আসে?
না, অনেকদিন আসেনি।
আমার সঙ্গে কাল দেখা হয়েছিল, অনিমেষ বলল, কাল রাইটার্স বিল্ডিং-এ ওর অফিসে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে বেরিয়ে এল। দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে বহু দূর গিয়েছিলাম, প্রায় খিদিরপুর পর্যন্ত। অনেক কথা বলল অবিনাশ।
নিশ্চয়ই ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা? পরীক্ষিৎ বলল।
না। খুবই আন্তরিক। অনেক বদলে গেছে অবিনাশ। অনেক সরল হয়েছে।
না, সরল না, সরলতার ভান!
তাতেই-বা ক্ষতি কী? ভান করতে কেউ যদি সত্যিই সরল হয়, তা-ও কম নয়। নিষ্ঠুরতার ভান করার চেয়ে তা অনেক ভাল।
ও কি বুঝেছে যে, ও সারা জীবন যত পাপ করেছে তার ফল ভোগ করতে হবে?
পাপ কথাটা অত সহজে উচ্চারণ করিস না পরীক্ষিৎ কোনও মানুষ যদি নিজেকে সত্যিকারের পাপী মনে করে, তবে তার পক্ষে আর বেঁচে থাকাই মুশকিল।
হঠাৎ অবিনাশকে নিয়ে এত কথা কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
আমার অবিনাশকে দরকার। পরীক্ষিৎ বলল, ওর সঙ্গে আমার কয়েকটা অ্যাকাউন্ট মেটাতে হবে।
অনিমেষ পরীক্ষিতের দিকে তেরছা ভাবে তাকায়। তারপর আচমকা প্রশ্ন করে, তুই কেমন আছিস রে পরীক্ষিৎ?
পরীক্ষিৎ প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারে না। চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করে, কেন হঠাৎ একথা?
কী-রকম যেন মনে হচ্ছে, তুই কিছু দিন ধরে মনের মধ্যে কোনও কষ্ট নিয়ে আছিস।
কষ্ট? না, মনের মধ্যে কোনও কষ্ট নেই। তবে মাথায় যন্ত্রণা হয় মাঝে মাঝে। সেই যে তোর ওখানে মাথায় লেগেছিল।
ওঃ, সেই অ্যাকসিডেন্টের কথা ভাবলেও এখন ভয় হয়! ও-রকম ভাবে ব্রিজ থেকে পড়ে গেলে কেউ –।
ও মোটেই অ্যাকসিডেন্ট নয়। আমি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম।
আত্মহত্যা? যাঃ! বেশ তো রেলিং-এর ওপর বসে বসে গান গাইছিলি। যাঃ ও ভাবে কেউ আত্মহত্যা করে? কেন, আত্মহত্যা করবি কেন?
এখন তো করতে চাইনা। সেদিন চেয়েছিলাম।
কেন?
আজ আর কারণটা মনে নেই। তবে সে-দিন মনে হয়েছিল, আর এক মুহূর্তও আমি বাঁচতে চাই ।
আমি চুপ করে অনিমেষ আর পরীক্ষিতের কথা শুনছিলাম। পরীক্ষিতের কথা শুনে আমার হাসি পেল। বললাম, তুই আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলি? কিন্তু অবিনাশ যে অন্য কথা বলে।
কী বলে অবিনাশ?
অবিনাশ তো বলে, ও-ই নাকি হঠাৎ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল তোকে?
অনিমেষ চমকে উঠে বলল, অবিনাশ ঠেলে ফেলে দেবে? হাঃ, আমি বিশ্বাস করি না। তাছাড়া অবিনাশ তো তখন কাছাকাছি ছিলই না। ও তো সিগারেট কিনতে গিয়েছিল।
তোমার মনে নেই। সিগারেট তো কিনতে গিয়েছিল তাপস। অবিনাশ নাকি।
পরীক্ষিৎ গম্ভীর ভাবে বলল, অবিনাশ বলে নাকি এই কথা? অবিনাশ আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল? কেন? সে এ-কথা বলেছে?
জানি না। তোর আর অবিনাশের মধ্যে কী যে ব্যাপার আছে! যাক গে, তোর মাথায় এখন ব্যথা করে, তুই ডাক্তারের কাছে যা না।
যাব। কিছু টাকা ধার দিবি?
ওই তো! কিছু একটা ভাল কথা বললেই অমনি টাকা। দরকার নেই তোর ডাক্তারের কাছে যাবার।
দেনা। ক’টা টাকা ধার দেনা। বড়লোকের মেয়েকে পড়াচ্ছিস, তোর অনেক টাকা।
ধার বলিস কেন? কোনও দিন টাকা ফেরত দিয়েছিস? ভিক্ষে চাইতে পারিস না?
ঠিক এই সময় অবিনাশ ঢুকল আমার ঘরে। শান্ত মুখমণ্ডল। অবিনাশকে দেখে প্রথমেই আমার মনে হল, ওর কাছে অবনীভূষণের কথাটা জিজ্ঞেস করতে হবে। ও যখন মাধবীকে চেনে তখন হয়তো অবনীভূষণকেও।
অবিনাশকে দেখেই পরীক্ষিৎ দাঁড়িয়ে উঠে বলল, তোকে আমি এক মাস ধরে খুঁজছি।
অবিনাশ ওর বিশাল চেহারাটা নিয়ে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল। পরিষ্কার দাড়ি কামানো, ওর কপালের কাছে কাটা দাগটা জ্বল জ্বল করছে। অবিনাশকে আমি পছন্দ করি ওর স্পষ্ট চোখ দুটোর জন্য। কত রকম বদমাইশিকরে অবিনাশ, কিন্তু ওর চোখে কোনও গ্লানি থাকেনা। চৌরঙ্গীতে চারটে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের সঙ্গে যখন মারামারি করেছিল, তখনও ওর চোখ যে-রকম। কোনও মেয়ের সঙ্গে যখন সর্বনাশের ভূমিকা করে তখনও চোখ এক রকম।
পরীক্ষিৎ ও অবিনাশ দরজার আড়ালে গিয়ে কিছু বলাবলি করতে লাগল। আমি ও অনিমেষ চুপ। পরীক্ষিং আস্তে আস্তে কী বলল, শোনা গেল না। অবিনাশ শান্তভাবে বলল, না! পরীক্ষিৎ আবার অস্ফুট গলায় কিছু বলল, অবিনাশ পুনরায় শান্ত গলায়, না। পরীক্ষিৎ ক্রুদ্ধভাবে চেঁচিয়ে বলল, আমি তোর সর্বনাশ করে দেব। অবিনাশ বলল, আমি তো সর্বস্বান্ত, আমার আবার সর্বনাশ কী হবে?
অনিমেষের সঙ্গে চোখাচোখি করে আমি বললাম, ও দুটো কী করছে? অনিমেষ উত্তর না দিয়ে শুধুহাসল। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই দুর্বোধ্য লাগছে। মনে পড়ল, কয়েক দিন আগে হেমকান্তির অসুখ দেখতে গিয়েছিলাম। হেমকান্তিহয়তো বাঁচবেনা। সেদিনও, ঘরের মধ্যে গায়ত্রী হঠাৎ অবিনাশকে দেখে থমকে গেল। কঠিন গলায় বলল, আপনার সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল। অবিনাশ আলতো ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, বলল, কিন্তু যত ভয়ঙ্কর কথাই হোক, রাগ করে বলতে পারবে না, হাসতে হাসতে বলল। গায়ত্রী আমার দিকে তাকাল। কী অস্বাভাবিক জ্বল জ্বলে তখন গায়ত্রীর চোখ। কোনও কারণে ও খুবই রেগে আছে। অবিনাশ আমাকে বলেছিল, তুই একটু বাইরে যা।
ওদের কী এমন কথা ছিল, যা আমার সামনে বলা যায় না? বন্ধুরা সবাই ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। এখন সবারই আপন কথা বাড়ছে।
খানিকটা বাদে অনিমেষ উঠে গেল ওদের কাছে। একটু পরে তিন জনেই ফিরে এল ঘরে। অবিনাশের চোখ আগের মতোই অবিচলিত, পরীক্ষিতেরমুখ ও চোখ লাল, অনিমেষের চোখ হলুদ। হলুদ চোখ–একথার কী মানে হয় জানি না, কিন্তু পরীক্ষিতের চোখ লাল দেখার পর অনিমেষের চোখ স্বাভাবিক ভাবেই হলুদ মনে হল। দুর্বোধ্যতার রঙ হলুদ। ফুলের মধ্যে যেগুলির রঙ হলুদ, সেগুলোই অপদার্থ। দুর্বোধ্যতা ফুলের মানায় না।
অবিনাশ ঠাণ্ডভাবে পরীক্ষিতের কাঁধে হাত দিয়ে ডাকল, পরীক্ষিৎ –সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষিৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে চটাং করে এক থাপ্পড় কষাল অবিনাশের গালে (অনিমেষ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল, আমি হাততালি দেবার জন্য তৈরি হলাম। দুজনেই বেশ তেজি, মারামারি হলে জমবে ভাল। থাপ্পড় খেয়ে অবিনাশের মুখ নীল হয়ে গেল। তারপর অবিনাশ একটু হাসল। বলল, এটা হয়তো আমার পাওনা ছিল। কিন্তু তোর জন্য আমার দুঃখ হয় পরীক্ষিৎ।
বা–তোর শাস্তি, ইত্যাদি কিছু বলে পরীক্ষিৎ আর একটা থাপ্পড় মারার জন্য রেডি হতেই আমি ওকে ধরলাম। কী পাগলামি করছিস? তোদের ব্যাপারটা কী?
কিছুনা। তুই এর মধ্যে থাকিস না শেখর।
কেন আমি থাকবনা?
বলছি, তুই এর মধ্যে থাকিস না। তুই সব ব্যাপার জানিস না।
আচ্ছা থাকবনা, কিন্তু উলটে অবিনাশ একখানা ঝাড়লে তোর দাঁত ক’খানা আস্ত থাকরে?
ওকে ছেড়ে দে, শেখর, অবিনাশ বলল। যদি মারতে চায় মারুক। সব আঘাতেরই যে প্রতি আঘাত দিতে নেই, আমি এখন এই কথা শিখছি। রাগ আর ঈষাই হল পরীক্ষিতের ধর্ম। রাগ আর ঈর্ষা থেকেই পরীক্ষিৎ ওর বিখ্যাত লেখাগুলো লেখে। তাছাড়া ও বাঁচতে পারে না। ওকে থামিয়ে লাভ কী?
পরীক্ষিৎকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল। রেগে গেলেই পরীক্ষিৎকে সুন্দর দেখায়, তখন ওকে মনে হয় অসহায়। ওর দর্পও অহঙ্কার কোথায় লুকোয়, করুণ মুখখানি ফুটে ওঠে। কী নিয়ে রাগারাগি তা আমি বুঝতে না পারলেও পরীক্ষিতের জন্য আমার দুঃখ হয়। যে-পরীক্ষিৎ সব সময় বন্ধুত্ব কিংবা সঙঘবদ্ধতার কথা বলে, হঠাৎ অবিনাশের ওপর ওর এত ক্রোধ কেন, কী জানি।
কাল তোর সঙ্গে যখন আবার দেখা হবে পরীক্ষিৎ, আমি সব ভুলে যাব। অবিনাশ আবার বলল, তুই সব কাজ করিস অত্যন্ত ভেবে-চিন্তে, আগে থেকে পরিকল্পনা করে। কিন্তু আমার সব ব্যবহার উদ্দেশ্যহীন, সেই জন্যেই অনুতাপহীন।
এই ভাবেই জীবনটা চালাবি?
জীবন মানে তো পঞ্চাশ কি ষাট-সত্তর বছর এই পৃথিবীতে কাটিয়ে যাওয়া? যার যে-রকম ইচ্ছে, সে সেই রকম কাটিয়ে যাবে। যতই চেষ্টা করিস-সত্তর, আশি, বড়জোর একশো বছর বাদে চলে যেতেই হবে, আর ফেরা হবে না। পাপপূণ্য যাই হোক, চামড়া শিথিল হবেই, চোখে ছানি পড়বেই, যৌনশক্তিও হরণ করে নেবে সময়। সুতরাং এই কটা বছর আমি প্রতি মুহূর্তের ইচ্ছা অনুযায়ী চলতে চাই। কেউ জুয়া খেলে সময় কাটায়, কেউ কবিতা লিখে– কোনটা ভাল বা বড় কেউ জানে না, যার যেটাতে নিশ্বাস নেওয়ার সুবিধে। কিন্তু সাহিত্য কিংবা শিল্পের জন্য আত্মত্যাগ কিংবা নিজেকে কষ্ট দেওয়া সম্পূর্ণ বোকাদের কাণ্ড। জীবনটা নষ্ট করে অমরত্বের লোভ মাইরি, ভাবলে হাসি চাপতে পারি না। তিরিশ বছর কেটে গেছে, আরও তিরিশ কী চল্লিশ বছরের ভিসা আছে এখানে থাকায়। তারপর চলে যেতেই হবে, আর ফেরা যাবে না। মৃত্যুর পর তোর বইয়ের আর ক’টা এডিশান হল, কিংবা ইউনিভার্সিটিতে থিসিস লেখা হল –আর ফিরে এসে দেখতে পারবি না। একটাই জীবন, সেটাতে আমি প্রতি মুহূর্তে বাঁচতে চাই।
পরীক্ষিৎ স্তম্ভিত ভাবে তাকিয়ে ছিল অবিনাশের দিকে। এই দীর্ঘ বক্তৃতা ও এতক্ষণ ধরে কী করে শুনল, কে জানে! অবিনাশও এ-রকম ঠাণ্ডাভাবে তো কোনও কথা বলে না। ওদের কিছু হয়েছে বোধহয়। অনিমেষ খুব আস্তে আস্তে বলল, কথাটা আপনি এমন ভাবে বললেন যেন খুবইনতুন এবং নিজস্ব। তা কিন্তু নয়।
কিন্তু আমার জীবনটা আমার নিজস্ব। সেটা আমার মত অনুযায়ীই চলবে আশা করি। অবশ্য, যদি হঠাৎ জেলে আটকে রাখে। আমি স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চাই।
অনিমেষ একটু হাসল। তারপর বলল, জেলে আটকে রাখবে কেন? অবিনাশবাবু, আপনাকে আমার খুব ভাল লাগে। আমি যদি আপনার মতো হতে পারতাম।
আমার মতো মানে? আমার মতো কী? আমি তো কিছুই হয়নি। লেখা-ফেখা ছেড়ে দিয়েছি। বিশেষ কোনও কাজকন্মও করি না। আমার মতো আবার হবার কী আছে?
তবু আপনার এই যে হালকা ভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা, আমার বড় ভাল লাগে। যখন যা ইচ্ছে তাই করা, জীবন সম্পর্কে আপনার কোনও ভয় নেই, ভয় নেই বলেই আপনার মুখখানা খুব সুন্দর। যখন যে-কোনও মেয়েকে দেখলেই আপনার ছুঁতে ইচ্ছে করে, ভোগ করতে ইচ্ছে করে, আপনি চেষ্টাও করেন তৎক্ষণাৎ কিছু না ভেবে। জানেন, আমি এগুলো একদম পারি না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমারও এ-রকম ইচ্ছে। কিন্তু পারি না।
অবিনাশ হাসতে হাসতে বলল, আসুন, আপনার সঙ্গে আমার জীবনটা বদলাবদলি করি।
অনিমেষ ব্যগ্রভাবে বলল, করবেন? সত্যি যদি করা যেত। আমি হঠাৎ বিয়ে করে জড়িয়ে গেলাম। মফঃস্বলে চাকরি। একদম ভাল লাগে না। ইচ্ছে করে কলকাতায় থেকে আপনার কাছে ট্রেনিং নিই।
পরীক্ষিৎ বলল, মেয়ে পটানো ছাড়াও আর কী বিষয়ে ট্রেনিং দিতে পারবে?
অনিমেষ বলল, সেটাই-বা মন্দ কী। একটা কিছু পাবার চেষ্টা তো বটে। আচ্ছা অবিনাশবাবু, কোনও মেয়েকে পাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলে কেমন লাগে? আমার এ অভিজ্ঞতাও নেই। আমার প্রথম যে-মেয়েটির সঙ্গে পরিচয়, তাকেই বিয়ে করেছি। ও ব্যাপারটা বুঝতেই পারলাম না।
কিছু একটা যেন বলা দরকার, এই জন্যই আমি বললাম, এখনও সময় যায়নি। আফশোসের কিছু নেই। কথাটা বলার পরই আমি অন্য মনস্ক হয়ে পড়লাম আবার।
অনিমেষ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কীসের সময় যায়নি?
আমি অনিমেষের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও কী প্রশ্ন করছে বুঝতে পারলাম না।
অনিমেষ রোগা তীক্ষ্ণ মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখের চাহনিতে প্রশ্ন। কীসের সময় যায়নি? আমিও ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কীসের সময় যায়নি?
বাঃ, তুমিই তো আমাকে এ-কথা জিজ্ঞেস করলে?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, সময় গেছে কী যায়নি? তোমাকে? কেন? কী মুশকিল।
অবিনাশ হা-হা করে হেসে উঠল। বলল, কী রে শেখর, তুই ঘুমোচ্ছিস নাকি?
কেন, ঘুমোব কেন?
তুই আগের কথা কিছু শুনিসনি বুঝি?
আগের কথা তো তোরা কিছুই বলিসনি আমাকে। যেটুকু বলেছিস, সেটুকু শুনব না কেন? কিন্তু ও আমাকে জিজ্ঞেস করছে কেন, কীসের সময় যায়নি? সময় আবার কীসের কী? সময় কি তোর কিংবা আমার, আলু-পটলের কিংবা মানুষের? এ-রকম হয় নাকি? আমি বলেছি, এখনও সময় যায়নি, তার আবার কীসের কী? সময় যায়নি, সময় যায়নি, ব্যাস ফুরিয়ে গেল! আমার কি চুল পেকেছে, দাঁত পড়েছে? সুতরাং সময় যায়নি
অবিনাশ উদাস ভাবে বলল, শেখরের মেজাজটা আজ খারাপ হয়েছে। চল কেটে পড়ি।
সত্যিই হয়তো আমি ওদের কথা মন দিয়ে শুনছিলাম না। চোখের সামনে প্রফ, মাথার মধ্যে ক্ষমাপ্রার্থী আর পুলিশের লুকোচুরি, ঘরের মধ্যে তিন বন্ধুর বকবকানি এ-সব কিছুতেই আমার মন লাগছে না, এক একবার বিদ্যুতের মতো মনে ছায়া ফেলে যাচ্ছি। এক মাথা কোঁকড়া চুলসুদ্ধ মাধবীর মুখ, সেই মুখও বেশিক্ষণ থাকছে না। তার পরই মনে হচ্ছে, আমি যেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, কী সুন্দর ভাবে আমার চুল আঁচড়নো, বোধহয় ক্রিম মেখেছি। আমার মুখের চামড়া এমন চকচকে, আমার গায়ে একটা হালকা সিল্কের শার্ট, আমি জামার হাতায় বোম পাচ্ছি। এ কে? আমি না অবনীভূষণ? আপনাকে অবনীভূষণের মতো দেখতে? ওঃ! ড্যাম ইট! হু দা হেল ওয়াজ অবনীভূষণ? আমি কেন অবনীভূষণের মতো দেখতে হব? অথবা, আমাকে দেখে কেন অবনীভূষণের কথা মনে পড়বে? আমার নিজেরই বার বার মনে পড়ছে অবনীভূষণের কথা। নিজের কথা ভাবতে পারছি না, অবনীভূষণের কথা মনে পড়ছে আমার। ড্যাম ইট! আমাকে ভুলতে হবে এ সব। আমার রাত্রে ঘুম চাই। আমাকে ভুলতে হবেই এ সব কথা, অর্থাৎ আমার নিজের মুখও আমাকে ভুলতে হবে। মাধবী-ফাধবী সকলের কথা আমায় ভুলতে হবে। গগনেন্দ্র একটা নেশার কথা বলেছিল, কালো রঙের সন্দেশ, সন্দেশের মধ্যে কী যেন মেশানো থাকে, দুটো সন্দেশ খেলেই পাঁচ ছঘন্টার মতো আর কিছু মনে থাকে না। গগন খেয়ে দেখেছে, একবার গেলে হয় গগনের কাছে। পরীক্ষিৎ অবিনাশরা এখন বিদায় হলেই বাঁচি।
ওরা এখনও সেই প্রেম-ফ্রেম নিয়েই কথা বলে যাচ্ছে। এখনও বড় ছেলেমানুষ রয়ে গেল! যার যা ইচ্ছে কর না গিয়ে, তাই নিয়ে অত আলোচনা করার কী আছে? অনিমেষটা মহা ন্যাকার মতো তখনও অবিনাশকে জিজ্ঞেস করছে, বলুন না, কোনও মেয়ে প্রত্যাখ্যান করলে বুকের মধ্যে কীরকম লাগে?
পরীক্ষিৎ বলল, অবিনাশ এ পর্যন্ত কোনও মেয়ের কাছে হার মানেনি। একবার যার ওপর চোখ ফেলেছে, তার আর নিস্তার নেই, শালা এমন শয়তান।
অনিমেষ বলল, যাঃ, তা কখনও হতে পারে না। এত মেয়ের সঙ্গে রোজ কাণ্ড কারখানা চললে একবার না একবার আঘাত পেতেই হবে। সব মেয়েই কি অমনি রাজি হয়ে যায়?
পরীক্ষিৎ বলল, তুই অবিনাশকে চিনিস না। ওকে কোনও ভদ্দরলোকের বাড়িতে ঢুকতেই দেওয়া উচিত নয়। ও যে-বাড়িতেই যাবে, সে-বাড়িতে যে-কোনও মেয়ে থাকলেই.সম্পর্ক যাই হোক না।
অনিমেষ মাথায় চুলের মধ্যে আঙুলগুলো ঢুকিয়ে চিরুনির মতো চালিয়ে বলল, আমি কিন্তু জানি, অন্তত একটি জায়গায় অবিনাশ হেরে গিয়েছিল। একটি মেয়ে অবিনাশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়নি।
অবিনাশ চুপ করে সিগারেট টানছিল, এর মুখ তুলে তাকাল। আমার অধৈর্য লাগছিল, এরা গেলে বাঁচি! তবু আমি অনিমেষকে বললাম, অবিনাশ কোথায় ব্যর্থ হয়েছে, তা তুমি জানলে কী করে?
অনিমেষ বলল, হ্যাঁ জানি। অন্তত একটি মেয়ের কাছেও যে অবিনাশ ব্যর্থ হয়েছে, আমি সেকথা জানি।
অবিনাশ এবার বলল, এ-সব কী হচ্ছে কী? একটা কেন, আমি বহু মেয়ের কাছেই ব্যর্থ হয়েছি। বলতে গেলে আমি সব মেয়ের কাছেই ব্যর্থ হয়েছি। কারুর কাছেই আমি কিছু পাইনি। মেয়েদের দেবার কিছু নেই। সব গুজব।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, অবিনাশ, তুই মেয়েদের কাছে কী চেয়েছিস রে, যে ব্যর্থ হয়েছিস?
অবিনাশ বলল, কী চেয়েছি, তা জানি না। তবে প্রত্যেক বারই মনে হয়েছে, চেয়েছিলাম নাক, পেলাম তার বদলে নরুণ।
তার মানে? ঠিক ঠিক মেয়ের সঙ্গে তোর এখনও দেখা হয়নি।
তুই যদি তেমন মেয়ের দেখা পেয়ে থাকিস, তাহলেই ভাল। যাকগে ও-সব কথা, অনিমেষবাবু, আপনি যা জানতে চাইছিলেন, তার উত্তরে শুনে রাখুন, অনেক মেয়ের কাছেই নেহাৎ শারীরিক সম্পর্ক পাতাতে গিয়েই আমি ব্যর্থ হয়েছি। পরীক্ষিৎ যা বলছে তা বাজে কথা, আসলে বেশির ভাগ মেয়েই আমাকে পছন্দ করে না। কেউ কেউ একবারের বেশি দু’বার পছন্দ করে না।
পরীক্ষিৎ উঠে দাঁড়াল, সোজা এগিয়ে এল অবিনাশের সামনে, তারপর রুক্ষ গলায় বলল, হারামজাদা। সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষিৎ অবিনাশের ঠিক মুখের ওপর একটা প্রবল ঘুষি চালাল, অবিনাশের নাকের পাশ দিয়ে গড়িয়ে এল রক্ত। অবিনাশ উঠে দাঁড়াবার আগেই আমি আর অনিমেষ ওদের মাঝখানে দাঁড়ালাম।
অবিনাশ রুমাল দিয়ে মুখ মুছল, আমাকে বলল, আমার হাত ছেড়ে দে। আমি পরীক্ষিৎকে কিছু বলবনা। ওর ওপর আমার রাগ হচ্ছে না। রাস্তার একটা লোকও এ-রকম করলে এতক্ষণে তার মাথা ফাটিয়ে দিতাম, কিন্তু পরীক্ষিৎটা নেহাত বোকা বলেই ওর ওপর আমার রাগ হচ্ছে না।
পরীক্ষিৎ তখনও গজরাচ্ছিল, আমার খুবই অস্বাভাবিক লাগছিল পরীক্ষিতের ব্যবহার। এ-রকম শিশুরমতো রাগ দেখাচ্ছে কেন? কী করেছে ওর অবিনাশ? আমি জিজ্ঞেস করলাম, পরীক্ষিৎ, তুই এমন পাগলের মতো রাগ করছিস কেন?
পরীক্ষিৎ গর্জন করে উঠল, জোচ্চোর মিথ্যুকটাকে একদিন আমি শেষ করে দেব বলে দিচ্ছি।
কী মিথ্যে কথা বলেছে অবিনাশ?
ও কেন বলেছে, ও আমাকে ব্রিজ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল। কী ওর মতলব?
সত্যি ও ধাক্কা দিয়ে ফেলেনি? কী রে অবিনাশ?
অবিনাশ তখনও মুখ মুছছিল, কোনও উত্তর না দিয়ে হাসল। পরীক্ষিৎ বলল, মোটেই ও ধাক্কা দেয়নি, ও আমার কাছেই ছিল না। আমি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম।
অনিমেষ বলল, আত্মহত্যার ব্যাপারটা খুব রোমান্টিক, না? আমার কিন্তু স্পষ্ট ধারণা ওটা একটা দুর্ঘটনা।
আমি অবাক ও বিরক্ত হয়ে বললাম, এ-সব কী হচ্ছে কী গাড়লের কাণ্ড? আত্মহত্যা, ঠেলে ফেলা, দুর্ঘটনা– যাই হোক না, ব্যাপারটা তো হয়ে গেছে এক বছর আগে। তাই নিয়ে এখন মারামারি করার কী আছে? পরীক্ষিৎ, তোকে যখন অবিনাশ ঠেলে ফেলে দেয়নি জানিস, তবু তুই কেন অবিনাশের ওপর রাগ করছিস? তাহলে তো ওর কোনও দোষই নেই।
ও বলছে কেন, ও আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে? ও মিথ্যে কথা বলছে কেন? ওর কিছু একটা মতলব আছে এ ব্যাপারে। আমি সেটা জানতে চাই।
অনিমেষ বলল, দু’একটা মিথ্যে কথা বলার অধিকার সবারই আছে। অবিনাশই-বা কেন মাঝে মাঝে দু’একটা মিথ্যে কথা বলবেনা? এতে রাগের কী আছে?
অবিনাশ আবার হাসল। এবার সরাসরি পরীক্ষিৎকে বলল, পরীক্ষিৎ, আমি কি দুটো-একটা মিথ্যে কথাও বলতে পারব না এমন প্রতিক্ষা করেছিলাম নাকি তোরকাছে? তুই মাঝে মাঝে দু’একটা মাত্র সত্যি কথা বলতে পারিস, আমিই-বা তাহলে ঠেলে ফেলার মিথ্যে কথাটা বলতে পারব না কেন? মুশকিল হচ্ছে, তোর সত্যি কথাও সবাই মিথ্যে বলে মনে করে। আসলে তুই কী বলতে চাইছিস, আমি জানি। বলেই ফেল না! তুই তো বলতে চাইছিস, অনিমেষের ওখানে গিয়ে আমি ওর বউ গায়ত্রীর সঙ্গেও কিছু একটা করেছি।
আমি চমকে উঠলাম। অবিনাশের মুখ ভাবলেশহীন। এই কথাটা আমি অন্য কোথাও শুনলে হেসে উঠতাম কিংবা একটা অশ্লীল ইয়ার্কি করতাম। কিন্তু যেহেতু নিজের বাড়িতে বসে আছি এবং নিজের বাড়িতে সকলেই কিছুনা-কিছু সংরক্ষণশীল, তাই আমি বললাম, ছি ছি, এ-সব কী বলছিস অবিনাশ? তোর মুখে কিছুই আটকায় না?
অবিনাশ অবিচলিত ভাবে বলল, কেন, এতে দোষের কী আছে? মুখের কথা তো। গায়ত্রী তো আরশুনছেনা?
অনিমেষও বিচলিত হয়নি। সে বলল, আপনি কী করে জানলেন, পরীক্ষিৎ এ-কথাটাই বলতে চাইছে?
অবিনাশ বলল, পরীক্ষিতের ব্যবহারেইস্পষ্ট বোঝায়। অনেক দিন থেকেই ও এ-রকম একটা কথা বলতে চাইছে।
অনিমেষ বেশ সহাস্য মুখে বলল, এ-সব কথা নিয়ে বন্ধু-বান্ধবরা আলোচনা করে নাকি? মনে করুন, যদি ব্যাপারটা সত্যি হয়, তাহলেইবা পরীক্ষিৎ সেটা বলার জন্য ব্যাকুল হবে কেন? আমি বুঝতে পারছি না, আপনারই-বা এত মিথ্যে কথা বলার চেষ্টা কেন, আর পরীক্ষিতেরই-বা সত্য প্রকাশ করার এত ব্যাকুলতা কীসের?
অবিনাশ বলল, সেইটাই তো আমিও বুঝতে পারছি না। আমি মিথ্যে কথা বলি এমনিই, শখ করে, কিন্তু পরীক্ষিতের তো সত্য কথা বলার সখ কোনও দিন ছিল না।
পরীক্ষিৎ এবার গম্ভীর ভাবে বলল, না, ও-কথা আমি বলতে চাইনি মোটেই। ও-সব কথা আমি কখনও ভাবিইনি। এইটাও অবিনাশের আর একটা ধাপ্পা। হঠাৎ কেন একথা বলল, কে জানে।
আমি আর থাকতে পারলাম না। আমি চেঁচিয়ে বললাম, গেট আউট, সব্বাই এক্ষুনি গেট আউট। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আমার মাথা ধরেছে তখন থেকে, আর তোরা এখানে বসে ইয়ার্কি মারছিস। বিদায় হএখন, ওফ।
অবিনাশ বলল, দাঁড়া না, পরীক্ষিতের সমস্যাটার একটা মীমাংসা হয়ে যাক। পরীক্ষিৎ কী চায় সেটা দেখাই যাক না। আমি যতই সরল ভাবে বাঁচতে চাইছি, পরীক্ষিৎ ততই আমাকে জড়াতে চাইছে কেন, কে জানে।
আমি বললাম, মীমাংসা করতে হয়, ময়দানে যাও। আমার ঘরে বসেও-সব ধাঁধা-মার্কা কথাবার্তা চলবেন। আমি মরছি নিজের জ্বালায়।
ওরা বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ওদের কথা ভুলে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আবার ফিরে এল মাধবী এবং অবনীভূষণের ব্যাপার। এগুলোও ভুলতে হবে। আমি উঠে জামাটা গায় দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম গগনেন্দ্র খোঁজ করতে।
সে-দিন সন্ধেবেলা খুব বৃষ্টি, অনেক দিন পর বৃষ্টিতে ভিজে বেশ ভাল লাগছে, মাথার মধ্যেটা পরিষ্কার, মনে হচ্ছে মাথা ধরাটাও সেরে গেছে। আর, এমন ঝরঝরে লাগছেশরীর। এই শরীর নিয়ে সন্ধেবেলা আমি কী করব? একটা কিছু করার দরকার। আর যাই করি, কোনও বন্ধু-বান্ধবের ছায়াও মাড়াতে চাই না আজ। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গ দু’এক দিন ধরে অসহ্য লাগছে। ছায়াদির বাড়িতেও যাওয়া যাবে না, ওখানে গেলেও কারুর না-কারুর সঙ্গে তো দেখা হবেই। বারীনদার ওখানে গিয়ে তাস খেলারও সেই অসুবিধে, ওখানে তো অবিনাশ থাকরেই।
শরীরটা ছটফট করছে। কিছুক্ষণ বৃষ্টির মধ্যেই ছপ ছপকরেহটলাম। চৌরঙ্গির রাস্তাটা কী সুন্দর দেখাচ্ছে। ঘণ্টা খানেক ধরে বৃষ্টি হচ্ছে, তাই পথে একজনও পথচারী নেই। আমি ছাড়া গাড়িগুলো ছুটে যাচ্ছে শুধু, আর কালো পিচঢালা রাস্তা। এই রাস্তায় আমি একা, আমার সর্বাঙ্গ ভিজে, আমি চুপচাপ করে হাঁটছি। আঃ, এত ভাল লাগছে, একাকিত্ব এত সুন্দর, এমন উপভোগ্য আগে কখনও ভাবিনি। মিথ্যে মিথ্যে কী বিশ্রী হুল্লোড়ে সময় কাটিয়েছি। এক একটা রাত অবিনাশ, তাপস, গগনেন্দ্র, পরীক্ষিতের সঙ্গে মল্লিকা কিংবা রমলার ঘরে, ও-সবকথা আর ভাবতেও ভাল লাগে না।
মাধবীকে একটা টেলিফোন করা যেতে পারে না? মাধবীকে কোনও দিন টেলিফোন করিনি, সন্ধেবেলায় মাধবীকে কেমন দেখতে লাগে তা-ও তো দেখিনি। ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে শুধু দুপুরবেলা। মাধবীর সঙ্গে অরুণা আর চিত্রলেখা নামে আরও দুটি মেয়ে পড়তে আসত আমার কাছে। যত দিন ওরা তিন জন ছিল তত দিন ওরা শুধু ছাত্রীই ছিল, কোনও দিন ওদের মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়েও দেখিনি, এমনকী কোনও মাসে টাকা দিতে দেরি করলে ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছি পর্যন্ত। তারপর চিত্রলেখার হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেল, অরুণার বাবা বদলি হলেন দিল্লিতে, তখন মাধবী একা, সেই একা মাধবীর দিকেই আমি প্রথম চোখ তুলে তাকালাম। মাধবী একা একা আমার কাছে আসেই বা কেন? অমন বড়লোকের মেয়ে, ইচ্ছে করলে বাড়িতেই তিনটে প্রফেসার রাখতে পারে, তবু দুপুরবেলা একা, আমার মতো ছোকরা মাস্টারের কাছে আসে কেন? তার কারণ কী, আমাকে অবনীভূষণের মতো দেখতে, সেই জন্য?
আঃ, আবার অবনীভূষণ! না, আমি অবনীভূষণের কথা কিছুতেই ভাবতে চাই না।
পার্ক স্ট্রিটের একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে সোজাকাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, একটা টেলিফোন করতে দেবে?
ম্যানেজারটা চিৎকার করে বলল, করছেন কী, করছেন কী! সারা গা দিয়ে জল পড়ছে, আমার কার্পেটটা ভিজিয়ে দিলেন যে।
দোকানে বেশি ভিড় নেই, সত্যি কার্পেটটা অনেকখানি ভিজে গেছে। আমি একটু অপ্রতিভ ভাবে বললাম, হ্যাঁ, খুব ভিজে গেছি। একটা জরুরি টেলিফোন– ।
টেলিফোন পরে করবেন। আগে গা মুছে ফেলুন। বেয়ারা, সাবকো একটা টাওয়েল দো।
বেয়ারা একটা ধপধপেটাওয়লে নিয়ে এল। আমি কৃতজ্ঞতায় একেবারে অভিভূত হয়ে পড়লাম। পার্ক স্ট্রিটের রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার বাংলা কথা বলবে তাই-ই আশা করিনি, তার ওপর এমন সহৃদয়তা। অনায়াসে আমাকে বার করে দিতে পারত। কিছু দিন আগে এই দোকানেই তো অবিনাশ এক দিন মাড়োয়াড়ি দলের সঙ্গে হাতাহাতি করেছিল। আমিও দলে ছিলাম। ম্যানেজার আমাকে চিনতে পারেনি। আমি ওকে প্রকৃত ধন্যবাদ জানিয়ে এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে টেলিফোন ডিরেকটারিটা নিলাম। যাঃ চলে, মাধবীর তো বাবা মারা গেছেন জানি, তাহলে টেলিফোনটা কার নামে? মাধবীর নামে নিশ্চয়ই নয়। ওর মা কিংবা বাবার নামে যদি হয় –জানার উপায় নেই। তবে ওদের বাড়ির ঠিকানা জানি। ইনফরমেশনের ডায়াল ঘুরিয়ে মাধবীদের বাড়ির ঠিকানা বলে টেলিফোন নম্বর জানতে খুব অসুবিধে হল না।
মাধবীদের নম্বর ঘোরালাম। ও-দিকে এক জন পুরুষ কণ্ঠ। বলুন?
আমি কোনও দ্বিধা না করে বললাম, মাধবীকে ডেকে দিন।
লোকটি যদি জানতে চাইত কে টেলিফোন করছে, তাহলে কী বলব আমি ভেবেই রেখেছিলাম। কিন্তু তা জিজ্ঞেস করল না, বলল, ধরুন। তারপর ধরেই রইলাম। বহুক্ষণ, কেউ আর আসে না। কোনও সাড়া শব্দ নেই। ছেড়ে দেব কিনা ভাবছিলাম, তখন মাধবীর গলা পেলাম, হ্যালো? কে?
মাধবী, আমি মাস্টারমশাই কথা বলছি।
মাধবী একটুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর আচমকা জিজ্ঞেস করল, কোন মাস্টারমশাই?
তোমার ক’জন মাস্টারমশাই আছেন?
উপস্থিত তিন জন, ছেলেবেলা থেকে হিসেব করলে দশ-বারো জন হবেন নিশ্চয়ই।
তুমি আমাকে চিনতে পারছ না?
উঁহু।
আমি তো গলার আওয়াজ শুনেই তোমাকে চিনতে পেরেছি।
কিন্তু আপনার সঙ্গে তো আমি কখনও টেলিফোনে কথা বলিনি, তাই চিনতে পারছি না।
মাধবী, তুমি কী করছিলে?
সাজগোজ করছিলাম। এক্ষুনি সিনেমা দেখতে বেরুব।
কার সঙ্গে?
তা আপনাকে বলব কেন?
ও
আমি একটুক্ষণ চুপ করে রইলাম। আর কোনও কথা কি বলার আছে? মাধবীই প্রশ্ন করল, কোনও দরকারি কাজের কথা ছিল?
হ্যাঁ। মাধবী, অবনীভূষণ কে?
এই জন্য আপনি ফোন করছেন? আচ্ছা পাগল তো!
মাধবী হাসল। জলের মধ্যে কুলকুচা করার মতো টেলিফোনে সেই হাসির আওয়াজ। আমি তবু বললাম, হ্যাঁ, একথাটা জানা আমার খুবই দরকার। অবনীভূষণকে আমি একবার চোখে দেখতে চাই। সে কোথায় আছে?
এক্ষুনি তা শুনতে হবে? কেন? কাল দুপুরে যাব, তখন বলব। এখন ছেড়ে দিচ্ছি, অ্যাঁ?
কেন, ছেড়ে দেবে কেন? আরও কথা আছে।
টেলিফোনে আপনি মেটেই কথা বলতে পারেন না ভাল করে। আপনার গলা কীরকম যেন অন্য রকম শোনাচ্ছে। বরং আপনি যখন চুপকরে চেয়ে বসে থাকেন, তখন –।
তখন কী?
কিছুনা।
মাধবী লাইন কেটে দিল। আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ল না, আঘাত পেলাম না কোনও। খানিকটা অবাক লাগল। আমি যখন চুপ করে বসে থাকি, তখন কী হয়? তখন কী আমাকে অবনীভূষণের মতো দেখায়? সেই জন্যই কি আমার চুপ করে বসে থাকতেই আজকাল বেশি ভাল লাগে? আঃ, অবিনাশের কাছে অবনীভূষণের কথাটা জিজ্ঞেস করা হল না আজও।
কফিটা খেয়ে বেরুলাম। তখনও বৃষ্টি পড়ছে। গাড়ি বারান্দার নিচে একটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটা চোখের পাতায় বোধহয় সবুজ রঙ মেখেছে। তাই ওর চোখের দিকে আমি দু’বার তাকালাম। মেয়েটিও আমার চোখের দিকে সোজা তাকাল। আমি তো আর চোখে রঙ মাখিনি, তবে আমার দিকে ও তাকাচ্ছে কেন? সেইটাই জানার জন্য আমি ওর দিকে আবার তাকালাম। মেয়েটি এবার আমার দিকে একটু এগিয়ে এল, একটা ঝলমলে সোনালি রঙের গাউন পরেছে। চুলের রঙও কিছুটা সোনালি ওর, কিন্তু চেহারা রোগাটে। মেয়েটি বলল, হ্যালো মিস্টার!
আমি বললাম, কী?
স্যাডার স্ট্রিটটা কোন দিকে বলতে পারো?
আমি একটু হাসলাম। উত্তর দিলাম, এই বৃষ্টিতে পার্ক স্ট্রিটে এসে একা দাঁড়িয়ে আছ, আর স্যাডার স্ট্রিট চেনো না?
মেয়েটি আমার সঙ্গে হাঁটছিল, সে-ও হেসে বলল, আমি চিনি। দেখছিলাম তুমি চেনো কি না।
স্যাডার স্ট্রিটে তোমার ঘর আছে?
না, হোটেল রুম, দশ টাকা প্রতি ঘণ্টা।
আর তোমার?
তিরিশ টাকা, যদি এক ঘণ্টা থাকো।
তিরিশ আর দশ চল্লিশ, এক ঘণ্টা তোমার সাহচর্যের জন্য? বড় বেশি নয় কি?
ডোন্ট বি মিন।
তোমার শরীরের জন্য চল্লিশ টাকা, আর আমারও তো শরীর আছে, তার কোনও দাম নেই? তার জন্য তোমারও কিছু দেওয়া উচিত। তুমি আমাকে কত দেবে বলো?
আই উইস, আই কুড। কিন্তু তুমি তো জানো–
শুধু শুধু সময় নষ্ট করলে। আমার কাছে তোমার কোনও সুবিধে হবে না।
কেন? তোমার কাছে টাকা কম আছে? কত আছে?
টাকার জন্য নয়। আমার ভাল লাগে না।
ইয়ং ম্যান, আজ এই রকম লাভলি ওয়েদার, ডোঞ্চায়ু নিড আ কমপ্যানিয়ন?
কিন্তু তোমার কমপ্যানি আমার ভাল লাগবেনা।
কেন, আমি কি দেখতে খারাপ?
না, তা নয়। তোমাদের আর আমার ভাল লাগে না। আই অ্যাম ইন লাভ।
ইন লাভ? উইথ আ বেঙ্গলি গার্ল? ডাজ সি লাভ য়ু টু?
ঠিক জানি না। আচ্ছা, আমার কী করা উচিত বলে তো? আমি একটি মেয়েকে ভালবাসি, কিন্তু সে আমাকে ভালবাসে কি না জানি না। এখন আমি কী করব?
মেয়েটি হাঁটতে হাঁটতে আমার সঙ্গে চৌরঙ্গির মোড় পর্যন্ত এসেছে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে খুবই চিন্তিত ভঙ্গি করে বলল, দেয়ার আর সেভরাল ওয়েজ। আচ্ছা, মেয়েটি তোমাকে চেনে তো? তার বাড়ি কি খুবকনজারভেটিভ?
না। মেয়েটি আমাকে চেনে।
মেয়েটি খুব সুন্দর দেখতে? সুইটলুকিং?
প্রায়।
আচ্ছা, ওকে এক দিন আলাদা তোমার সঙ্গে ডিনারে নেমন্তন্ন করো না।
আমি হঠাৎ হাসতে লাগলাম। বেশ জোরে হাসি বেরিয়ে গেল। মেয়েটি একটু আহত ভাবে বলল, হোয়াটস ফানি ইন ইট?
তোমার সঙ্গে আমার ভালবাসার কথা আলোচনা করছি। এটা ফানি নয়?
কেন, আমরা স্ট্রিট গার্ল বলে কি ভালবাসা সম্পর্কে কিছু জানি না? জানো, আমিও—।
প্লিজ, আমাকে ও-সব গল্প শুনিও না। আমি ওগুলো সব জানি।
তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না? আমিও–।
বিশ্বাস করছি, কিন্তু গল্পটা শুনতে চাইনা। ওসব গল্প এক রকম।
মেয়েটি আহত, অপমানিত মুখে চুপ করে যায়। আমার সঙ্গে একটু বৃষ্টিতে ভিজে ওর মুখের চেহারা আরও করুণ হয়ে এসেছে। তখন আর কোনও লোকের সঙ্গে দেখা হবার আশা নেই। মেয়েটি শেষ চেষ্টা হিসেবে বলে, চলোনা, কাছেই তো আমার হোটেল, একটুক্ষণ গিয়ে বসবে। আর কিছু না, জাস্ট লাইক ফ্রেন্ডস। সেখানে আমরা তোমার প্রব্লেম নিয়ে আলোচনা করব? প্লিজ।
আমার কোনও প্রব্লেম নেই। তোমাকে মিথ্যে কথা বলছিলাম। আসলে আমি জানি, আমি যে-মেয়েটিকে ভালবাসি, সে অন্য একটি ছেলেকে ভালবাসে।
স্যাড। কিন্তু এ নিয়ে তোমার বেশি দিন দুঃখ করার কোনও মানে হয় না।
নাঃ বেশি দিন করবনা।
তোমার নাম জানতে পারি? আমার নাম মার্থা হে, এম সি হোটেলে থাকি।
আমার নাম অনীভূষণ রায়। আমার দুঃখ কেটে গেলে তোমার সঙ্গে এসে দেখা করব।
.
পরদিন দুপুরে মাধবী এল না, এরপর এক সপ্তাহের মধ্যে আর এল না, কোনও খবরও পাঠাল । মাধবীনা আসায় একহিসেবে আমি খুশিই হয়েছি। হঠাৎ বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম কাল সন্ধে থেকে, মাধবীর সামনেও হয়তো উত্তেজনা প্রকাশ করে ফেলতাম। হয়তো মাধবীকে বলে ফেলতাম, তোমাকে আমি ভালবাসি। ওকথা বললে খুবই খারাপ হত, ও কথা বলা যায় না, মাধবীকে এখনও বলা যায় না। আসলে মাধবকে আমি ভালবাসি কি না সত্যিই তো জানি না। মাধবীর সামনে শুধু একা বসে থাকতে ইচ্ছে হয়। এর নাম কি ভালবাসা? না, এখনই ভালবাসার কথা বলা যায় না। তার আগে, অবনীভূষণের সমস্যা আমাকে দুর করতে হবে।
মাধবী আসেনি, কিন্তু আমি জানি মাধবীর সঙ্গে আমার আবার দেখা হবেই। আমি যা চাই, তা চিরকালই পেয়ে থাকি। যা পাবনা কখনও, তা আমি আগে থেকেই জানতে পারি। তা পেতেও চাই না আমি। চেয়ে ব্যর্থ হওয়া আমার স্বভাবনয়। সূর্যকে যে আমার ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখিনি, তার কারণ, আমি কখনও তা চাইনি বলে। যেদিন আমি চাইব, সে-দিন শালা সূর্যকেও আমার ঘরে আসতে হবে। আপাতত, আমি মাধবীকে চাই কিনা ভাবিনি, ওর ভালবাসা চাই কিনা ভাবিনি, আমি ওকে দেখতে চাই। জানি ওর সঙ্গে দেখা হবেই। অবনীভূষণকেও ঠিক আমি দেখতে চাই কিনা জানি না, হঠাৎ অবনীভূষণকে দেখলে আমার কী অবস্থা হবে তা-ও বুঝতে পারছি না। আমার মুখোমুখি যদি আমারই মতো দেখতে আরেক জন মানুষ দাঁড়ায়, তবে সে-দৃশ্য তো ভয়াবহ। হয়তো ওকে আমার মতো দেখতে নয়, কোনও একটা ভঙ্গি বা মুখের রেখা, কিংবা অভ্যেসের মিল আছে, আর কিছুনা। অবনীভূষণ বেঁচে আছে কিনা, তা-ও জানতে হবে। অবিনাশের কাছে কিছুই জানা গেল না। এর মধ্যে অবিনাশের সঙ্গে এক দিন দেখা হল। কী ভয়ঙ্কর চেহারা সে-দিন অবিনাশের। কোথাকার কোন পার্টি থেকে ফিরছিল, সঙ্গে দু’জন অচেনা লোক ওর দু’হাত ধরে আছে, ধর্মতলায় অবিনাশের সঙ্গে আমার রাত সাড়ে দশটায় দেখা। অবিনাশ তখনও বদ্ধ মাতাল। চোখ দুটো টকটকে লাল, মাথার চুল হাতের মুঠোয়, অসম্ভব করুণ মুখখানা। যেন নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। অবিনাশ আঃ আঃ করে আওয়াজ করছিল আর্তনাদের মতো, অথচ তখন ওর বেশ জ্ঞান আছে। আমাকে দেখে অবিনাশ জড়িয়ে ধরল, বলল, শেখর, আমার বড় কষ্ট হচ্ছে। আমার বড় কষ্ট হচ্ছে রে।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, বেশি খেয়ে ফেলেছিস?
ও বলল, না না, বেশি খাইনি। আমার বুকের মধ্যে কষ্ট হচ্ছে।
কীসের কষ্ট?
তা জানি না। আঃ, আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে যে। বেশি মদ খেয়েছি তো, তাই কষ্টের কথা বলতে পারছি, অন্য সময় তো বলতে পারি না!
কেন, কষ্ট হচ্ছে কেন?
তাই তো জানি না। দ্যাখ শেখর, আমি বার বার জীবনে ফিরে যাবার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। সেই জন্যই কি আমার কষ্ট হচ্ছে? কী জানি! চল, তুই একটু খাবি!
না।
তুই আজকাল আর খেতে চাস না কেন রে?
আমার আর ভাল লাগে না।
তোর তো কোনও কষ্ট নেই, তুই আর খাবি না কেন?
তুই কি কষ্টের জন্য মদ খাস নাকি? দেবদাস হচ্ছিস?
উহুঁ, ও-সব মেয়েছেলের জন্য কষ্ট নয়, অন্য রকম, ওঃ!
অবিনাশকে এ-রকম কাতর কখনও দেখিনি। অবিনাশ আরও মদ খাবার জন্য পেড়াপিড়ি করে। আমি ওর হাত ছাড়িয়ে চলে যাব ঠিক করেই, হঠাৎ সেই কথাটা মনে পড়। জিজ্ঞেস করলাম, তুই মাধবী সান্যালকে চিনিস?
অবিনাশ বলল, কে মাধবী? তোর কাছে যে-মেয়েটা পড়তে আসে। হ্যাঁ, খুব ফাইন মেয়ে, একটু মোটার ধাঁচ, কিন্তু বুক দুটো কী চমৎকার।
ওসব বাজে কথা রাখ। তুই ওর বন্ধু অবনীভূষণ বলে কারুকে চিনিস?
অবনীভূষণ? টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরিতে আবার এ-রকম নাম হয় নাকি? কেন? তাকে চিনে কী হবে?
না, এমনিই। মাধবী প্রায়ই বলে, আমি নাকি অবনীভূষণের মতো দেখতে।
তাই বলে নাকি? আশ্চর্য তো! সত্যিই তো, তোকে অবিকল অবনীভুষণের মতই তো দেখতে। মাইরি শেখর, বিশ্বাস কর, অবিকল, হুবহু অবনীভূষণের মতোই তোকে—হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ!
মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে অবিনাশ গলা ফাটিয়ে মাতালের হাসি হাসতে থাকে। আমি ওর হাত ছাড়িয়ে সোজা চলে এসেছিলাম সেদিন।
কদিন থেকেই ছায়াদির অসুখ শুনছিলাম, অনেক দিন ওদের বাড়িতে যাইনি। কলেজের ছুটিও ফুরিয়ে এল, আর ছুটি নেওয়া যাবে না। কলেজটা ছাড়তে হবে এবার, সকালবেলা গিয়ে পড়ানো আমার দ্বারা আর সম্ভব হবে না। কোনও দিন রাত্রে ভাল ঘুম হয় না, সকালবেলা দশটার মধ্যেই ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো করে কলেজে ছুটতে একেবারেই ইচ্ছে করে না।
সকালে চা খেয়েই একবার ছায়াদির বাড়িতে ঘুরে এলাম। গায়ত্রী বারান্দায় রোদ্দুরে বসে ছেলেকে অলিভ অয়েল মাখাচ্ছিল। অনিমেষরা তাহলে এখনও যায়নি। একটা হলদে রঙের শাড়ি পরে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে গায়ত্রী ছেলেকে তেল মাখাচ্ছে। বেশ দেখাচ্ছে ওকে, মহিমাময়ী মাতৃমূর্তি। গায়ত্রী আমাকে দেখে বলল, অনেক দিন আপনাকে দেখিনি। একটু রোগা হয়ে গেছেন!
আমি বললাম, আপনিও তো অনেক রোগা হয়ে গেছেন! গায়ত্রী লজ্জিত ভাবে হাসল। অয়েল ক্লথের ওপর শুয়ে ছেলেটা খল খল করে হাসছিল। সেদিকে তাকিয়ে আমি আলগা ভাবে বললাম, ভারি সুন্দর দেখতে হয়েছে আপনার ছেলেকে! গায়ত্রী এবারও হেসে ছেলেকে বুকে তুলে নিল। কথাটা আমি এমনিই বলতে হয় বলেই বলেছি। ওইটুকু একটা বাচ্চা, নাক চোখ কিছুই ভাল করে ফোটেনি, ওকে আবার দেখতে সুন্দর আর কুৎসিত কী? যখন বড় হবে, পৃথিবীতে নিজের জায়গা করে নিতে পারবে, তখনই বুঝব, বাছা মুখের ওপর সুন্দরকে রাখতে পারে, না মুখখানা ভূতের মতো বানিয়ে তুলবে। ছেলেকে বুকে তোলার গায়ত্রীকে একেবারে ছবির মাতৃমূর্তির মতো সুন্দর দেখাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল, মা হবার পরেও সেই মেয়ের সঙ্গে পুরুষরা এক বিছানায় শোয় কী করে? দেখলেই তো ভক্তি আসে, তখন আর ওসব ব্যাপার– । যাকগে, এ তো আর আমার সমস্যা নয়। গায়ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, অনিমেষ কোথায়? ও বলল, অনিমেষ একটু বেরিয়েছে।
সাদা চাদর ঢাকা দিয়ে ছায়াদি শুয়ে ছিল। ছায়াদির মুখের ভাব এমন, যেন কোনও গুরুতর অসুখ হয়েছে। আসলে ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়তো। শীর্ণ হেসে হাত বাড়িয়ে ছায়াদি বলল, এসো শেখর, বসোনা না, বিছানায় বোসোনা, ওই চেয়ারটা টেনে নাও।
কেন, বিছানায় বসবনা কেন?
এসব অসুখ বড় ছোঁয়াচে।
আমি একটু হেসে বিছানাতেই ছায়াদির পায়ের দিকে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আজ, ছায়াদি?
অপ্রত্যাশিত ভাবে ছায়াদি উত্তর দিল, ভাল আছি। খুব ভাল আছি এখন। খুব ভাল লাগছে।
জ্বর ছেড়ে গেছে?
না, সকালেই আবার জ্বর এসেছে। সেই জন্যই ভাল লাগছে। অসুখ হলেই আমার ভাল লাগে। অন্য সময় কীরকম যেন ঠিক বুঝতে পারি না।
চাদরের বাইরে ছায়াদির পা বেরিয়ে ছিল। আমি একটা হাত ছায়াদির পায়ে বোলাতে লাগলাম। বরফের মতো ঠাণ্ডা পা। জ্বর-টর কিছু নেই। তবু ছায়াদি কেন বলল, একটু আগেই ওর জ্বর এসেছে? কেন যে লোকে অকারণে মিথ্যে কথা বলে। আমি হাতটা সরিয়ে নিলাম।
ছায়াদি হঠাৎ হাসতে লাগল। বলল, চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যাকে খুঁজছ, সে নেই।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কে নেই? কাকে খুঁজছি আমি?
ছায়াদি সেই রকমই মুখ টিপে হেসে বলল, মায়া পরশু দিন মামার বাড়িতে গেছে।
আমি মায়াকে খুঁজব কেন?
সবাই তো আজকাল এ বাড়িতে এসে মায়াকেই খোঁজে। আমি বুড়ি হয়ে গেছি, আমাকে দেখতে বিচ্ছিরি, আমার সঙ্গে আর কে কথা বলতে চায় বলো! মায়া কিন্তু তোমাদের কাউকে পাত্তা দিতে চায় না। লেখক-টেখকদের সে একদম পছন্দ করে না।
শুনে সত্যিই দুঃখিত হলাম।
আমার অসুখ শুনেই তবু যা হোক এলে। তাই তো বললাম, অসুখ হলেই আমি ভাল থাকি। তাপস তো অসুখ শুনেও এক দিনও এল না।
কী ব্যাপার, তাপসের নামে যেন গলাটা ছল ছল করে উঠল?
মোটেই না। তাপসকে আমি মোটেই গ্রাহ্য করি না। সে-ও অবশ্য আমরা কথা কখনও ভাবেনা।
বিমলেন্দু আসে?
রোজ। সে তোমাদের মতো অমন দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলে নয়।
ছায়াদির মুখে তাপসের নাম শুনেই মনে পড়ল, অনেক দিন আমারও তাপসের সঙ্গে দেখা হয়নি। আজ দেখা করলে মন্দ হয় না। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ছায়াদি, আমি তাপসের কাছেই যাচ্ছি। তোমার সঙ্গে দেখা করতে বলব নাকি?
না না।
তাপসের মেসে দেখি, তাপস জামা কাপড় নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড বাধিযেছে। ওর রুমমেট রামহরিবাবুর একটা প্যান্ট গলিয়ে ও কিছুতেই সেটা ম্যানেজ করতে পারছে না। বামহবিবাবুর কোমর বিষম মোটা, আর তাপসের কোমর না খেয়ে খেয়ে মেয়েদের মতো সরু। বামহরিবাবুর প্যান্ট ওর লাগে কখনও? যে-জামাটা তাপস গায়ে দিয়েছে, সেটারও পুট নেমে এসেছে প্রায় কোমর পর্যন্ত। তাপসের বিব্রত মুখের দিকে তাকিয়ে আমি হেসে ফেললাম। বলালম কী ব্যাপার? কোথায় জয়যাত্রায় যাচ্ছিস?
বিরক্ত মুখে তাপস বলল, রেডিয়োতে একটা চাকরির ইন্টারভিউ পেয়েছি। চিঠিটা আজই সকালবেলা এসেছে, আজই সাড়ে বারোটায় ইন্টারভিউ। এর কোনও মানে হয়? একটাও ফর্সা জামা কাপড় নেই আমার।
রামহরিবাবু এমন কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছেন, যেন ওঁর জামাপ্যান্ট তাপসের গায়ে না লাগলে তারই দোষ। আহা, লোকটি বড় ভাল। আমি তাপসকে বললাম, যাঃ, ওই রকম হাস্যকর পোশাক পরে কেউ ইন্টারভিউতে যায়? নিজের যা আছে, তাই-ই পরে যা।
নিজের কী আছে? কচু আছে? এক পেয়ার লন্ড্রিতে দিয়েছি, আর ওই তো যেটা কাল পরেছিলাম।
সেটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। খাটের পাশে ওর প্যান্টটা তালগোল পাকানো অবস্থায় পড়ে আছে, সেটা ভর্তি যে দাগ, তা মাংসের ঝোলের কিংবা বমির। বললাম, জামা কাপড় লন্ড্রিতে পাঠাস কেন? বাড়িতে কাঁচতে পারিস না?
তাপস খেঁকিয়ে উঠল, যাঃ, যাঃ ফোঁপর দালালি করতে হবে না।
তা বলে ওই পাঁচটা সেফটিপিন লাগানো প্যান্ট পরে ইন্টারভিউ দিতে যাবি।
তাহলে কী করব?
যাবার দরকার কিইন্টারভিউ দিতে? ও-চাকরি তো পাবিই না। আজ ইন্টারভিউ, আজই সকালে যদি চিঠি আসে তার মানে বুঝিস না? ও-চাকরি তোর হবে না।
হবে না মানে? চালাকি বার করে দেব। তোরা শালারা প্রফেসারি-ট্রফেসারি জুটিয়ে খুব হেরফের দেখাচ্ছিস। এবার দ্যাখ, আমিও রেডিয়োর চাকরি পাচ্ছি, একবার রেডিয়োর মাইকটা হাতে আসুক, সারা দেশে বিপ্লব ডেকে আনব। আমার যা কিছু কথা আছে রেডিয়োতে একদিন ঘোষণা করে দেব।
আমার পরনের প্যান্টটা কিছুটা পরিষ্কার ছিল, সেইটাই তাপসকে আমি খুলে দিলাম। তাপসের মোটামুটি লেগে গেল। বাধ্য হয়ে তাপসের বমি মাখানো প্যান্টটা আমাকে পরতে হল। গা ঘিন ঘিন করছে আমার।
তাপস ব্যস্ত হয়ে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে ঘরের মধ্যে। আর বেশি সময় নেই, ঠিক পৌঁছুতে পারবে কিনা সন্দেহ।
তাপসের খুবই দেরি হয়ে গেছে, ঠিক সময় পৌঁছুতে গেলে ওর বোধহয় ট্যাক্সি করে যাওযা দরকার। কিন্তু সে-কথা ওকে বলতে আমার সাহস হল না। তাহলে নিশ্চয়ই আমার কাছেহ ট্যাক্সি ভাড়া চাইবে। একেবারে জাত ভিখিরি তো, টাকা চাইতে একটুও লজ্জা নেই। নেহাৎ বাধ্য হয়েই ওকে আমার জামাটা খুলে দিতে হল। ওরবিকট ময়লা, বমির দাগধরা জামা-প্যান্ট পরে এখন আমার মনে হচ্ছে, তাপসের এখানে আজ না এলেই কত ভাল হত। কেন যে মরতে এখানে এলাম।
তাপসকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর খাওয়া হয়ে গেছে তো?
জুতোর ফিতে বাঁধছিল তাপস, বলল, না,
তাহলে এখন আর তো সময় নেই।
দুপুরে কিছু খেয়ে নেব।
তাহলে আজ আর কিছু খাওয়া হল না তোর। এ-সব ইন্টারভিউ-এর ব্যাপার তো জানিস না। ঘন্টা চার-পাঁচ বাইরে ঠায় বসিয়ে রাখবে।
তাহলে খাবনা! একেবারে চাকরিটা পাবার পর খাব। তখন দেখিস কী-রকম খাই। জানিস শালা, আমারও খুব শখ তোদের মতো সকালে চায়ের সঙ্গে রোজ ডিম আর মাখন টোস্ট খাওয়ার। আমারও ইচ্ছে করে মাঝে মাজে ভাতের বদলে স্যান্ডউইচ খেতে। দ্যাখ না, একবার চাকরিটা পাই।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, এখন চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
একটুও কৃতজ্ঞতা বোধ নেই তাপসের। আমার জামা-প্যান্ট পরার পর ওর চেহারাটা মোটামুটি ভদ্রই দেখাচ্ছিল। চুল আঁচড়ানো শেষ করার পর অকস্মাৎ ও আমার দিকে তাকিয়ে অসভ্যের মতো হ্যা-হ্যা করে হাসতে লাগল। বলল, তোক কী বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে, শেখর!
আমি রেগে গিয়ে বললাম, তা তো দেখাবেই, ভিখিরির পোশাক পরলে তাই দেখাবে না?
সত্যি মাইরি, তোর মতো শৌখিন ছেলে, সব সময় ফিটফাট থাকিস, তোকে এ-রকম পোশাকে কখনও দেখিনি। একেবারে অন্য রকম দেখাচ্ছে।
আমার আবার নতুন করে গা ঘিন ঘিন করতে লাগল। বিরক্ত হয়ে বললাম, তোদর যা কাণ্ড। তুই তো ইন্টারভিউতে যাচ্ছিস, আমি এখন কী করে বাড়ি যাই?
তুই এখানে বসে থাক না। আমি ফিরে এলে —
তোর এই বিচ্ছিরি ঘরে আমি ততক্ষণ বসে থাকব?
তাহলে ট্যাক্সি করে বাড়ি চলে যা।
কী অনায়াস ভাবেতাপস বলল। ও যাচ্ছে ইন্টারভিউ দিতে, তার জন্য আমাকে ট্যাক্সি ভাড়া খরচ করতে হবে? একটুও ওর লজ্জা নেই পর্যন্ত। তাপসের সঙ্গে আমিও বেরিয়ে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে একটু কৈফিয়তের সুরে তাপস বলল, জামাটা তো কাল নষ্ট হল পরীক্ষিতের জন্য, এমন গায় বমি করে দিল কাল!
কোথায়? রোজ রোজ এত –।
কে জানে কোথায়? আমার সঙ্গে রাস্তায় দেখা, তখন লটপট করছে।
থাক, ও-সব আর আমি শুনতে চাই না।
শোনারও কিছু নেই। সেই তো একঘেয়ে ব্যাপার। কত নম্বর বাসে উঠব বলতো? তিন নম্বর, তিন নম্বরই অনেকটা কাছাকাছি যাবে।
ওই সময় ট্যাক্সি পাওয়াও অসম্ভব। সুতরাং তাপসকে ট্যাক্সি চড়ে যেতে বললেও কোনও লাভ হত না, এমনকী আমি ভাড়া দিয়ে দিলেও না। ওর সঙ্গে বাস স্টপে এসে দাঁড়ালাম। মনে হল রাস্তার সব লোক যেন আমার পোশাকের দিকে তাকাচ্ছে আর অবাক হয়ে যাচ্ছে। বাসে ওঠার আগে তাপস বলে গেল, তুই আমার জামা-প্যান্টটা কাচিয়ে রাখিস। আমি তোর এগুলো এখন তিন-চার দিন পরব।
তাপসের বাস চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা খালি ট্যাক্সি চোখ পড়ল। আমি ট্যাক্সিটা ডাকলাম। একবার মনে হল, বাসের পরের স্টপে তাড়াতাড়ি ট্যাক্সি ছুটিয়ে গিয়ে তাপসকে ডেকে নামানো যায়, তারপর ওকে রেডিয়ো স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসাই আমার উচিত। কিন্তু সে-ইচ্ছেও বদলে গেল। ভাবলাম, এত বেশি বন্ধুত্ব দেখাবার কোনও দরকার নেই। জামা-প্যান্ট খুলে দিয়েছি তাই যথেষ্ট, আর কী চাই? এখন বন্ধু বান্ধবদের থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতেই আমার মন চাইছে।
ট্যাক্সি নিয়ে সোজা বাড়িতেই চলে এলাম। আমার বাড়ির সামনে একটা সাদা রঙের গাড়ি। গাড়িটা দেখেই বুকটা কেঁপে উঠল। এ আমার চেনা গাড়ি। বাইরের ঘরের মাধবী বসে আছে। হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পরা, মাথার চুল সব খোলা, পিঠ ভর্তি ওর কোঁকড়া চুল। মাধবীকে দেখে হঠাৎ আমার বুক অভিমানে ভরে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এ কদিন আসোনি কেন?
আমাকে দেখেই মাধবী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। আমার সর্বাঙ্গে চোখ বুলিয়ে গেল। চোখের দৃষ্টিতে বিস্ময় ও প্রশ্ন, কিন্তু সে-সব কিছু বলল, না। বলল, হ্যাঁ, আসা হয়নি।
বনেদি ঘরের মেয়ে তো, মনে এলেও সব কথা মুখে বলে না। পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কে এ ধরনের প্রশ্ন তো করবেই না। সকালের দিকেই আমার এ ধরনের পোশাক দেখলে, যে কারুরইমনে হবে, আমি সারা রাত বাড়ির বাইরে কোথাও বেলেল্লা সেরে এখন ফিরছি। কিন্তু মাধবীর সামনে চায়ের কাপ ও খাবারের প্লেট, অর্থাৎ বাড়ির কেউ নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে দেখা করে বলেছে যে আমি সকালেই বেরিয়েছি। কিন্তু এই রকম পোশাক পরে তো আমি বেরুতে পারি না, এবং এই সাত সকালেই কি আমি বেরিয়ে মদগিলে বমি টমি সেরে ফেলেছি? কিংবা অন্য কোনও অসুখে বমি– যে কারুরই এ সম্পর্কে কৌতূহল হয়। যে-কেউ আমাকে দেখলে বলত, কী ব্যাপার? জামায় ও কী? কিন্তু মাধবী তা বলবেনা কিছুতেই, মাধবী বার বার আমার পোশাকের দিকে তাকাল, নির্লিপ্ত গলায় বলল, হ্যাঁ, আসা হয়নি।
আমি ফের বললাম, তুমি একদিন আসোনি কেন?
মাধবী বলল, আসিনি। আমি আর আসতেও পারব না।
শুনে আমার বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। মাধবী আর আসবে না? কেন? ওর বিয়ে হয়ে যাবে? কার সঙ্গে, সেই অবনীভূষণের সঙ্গে? না। তা হতেই পারে না। কিন্তু আমি কোনও প্রশ্ন করতে পারলাম না। মাধবীকে তো আমি এ পর্যন্ত অন্য কোনও কথাই বলিনি, যা বলেছি সবই আমার মনে মনে। অবনীভূষণ কে? একথাও মাধবীকে এ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করতে পারিনি। অধ্যাপক-ছাত্রী ছাড়া অন্য কোনও সম্পর্ক তো মাধবীর সঙ্গে আমার হয়নি।
কণ্ঠস্বর যেন বিচলিত না হয় এই জন্য আমি সিগারেট ধরিয়ে মুখের ভঙ্গি যথাসম্ভব নির্বিকার রেখে বললাম, একথাই বলতে তুমি এসেছিলে?
হ্যাঁ।
তুমি পড়াশুনো ছেড়ে দিচ্ছ?
না।
সংক্ষিপ্ত এক অক্ষরের উত্তর। মাধবী যেন চাইছে, আমি ওকে খোলাখুলি প্রশ্ন করি। নইলে ও কিছুই বলবে না। কিন্তু এ-কথাও বুঝতে পারলাম, মাধবী পড়াশুনা ছাড়বে না, কিন্তু আমার বাড়িতে এসে আর পড়বে না। এর একটাই মানে হয়, প্রাইভেট টিউটর হিসাবে আমাকে বরখাস্ত করছে। বরখাস্ত করছে কোনও কারণ না দেখিয়ে, এক কথায়। এরপর আর আমার কোনও কথা বলা চলে না। এরপর, অন্য যে-কোনও কথা বলার মানেই হল, আমি চাকরি হারাবার জন্য দুঃখিত হয়েছি। মাধবী আমাকে আড়াইশো টাকা মাইনে দিত, সোজা কথা নয়। এখন যদি বলি, মাধবী, তোমাকে না দেখলে আমার খুব কষ্ট হবে, তাহলে সে কথার সবাই মনে করবে, প্রতি মাসে আড়াইশো টাকা হারাবার কষ্ট। যদি ওকে এখন প্রেম জানাতে চাই, তাহলে সেটারও মানে হবেও যেন আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত না করে, সেই চেষ্টা করছি। কেন মাধবীকে আগে থাকতেই ভালবাসার কথা বলে রাখিনি? এখন আর উপায় নেই। সুতরাং মাধবীকে আমি বিদায় দেবার ভঙ্গি করে বললাম, আচ্ছা, মন দিয়ে পড়াশুনো কোরো। সন তারিখ তোমার প্রায়ই ভুল হয়, ওটা লক্ষ্য রেখো।
মাধবী তবু না গিয়ে আমার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপব বলল, আমি এখানে আসতে পারব না। আপনি বাড়িতে এসে পড়াতে পারবেন?
এখানে প্রশ্ন করা উচিত, কাদের বাড়িতে? ওর যদি বিয়ে হয় এবং তখনও পড়তে চায়, তখন কোন বাড়িতে? বিয়ের পরও কি ও নিজের বাড়িতেই থাকরে না, অন্য বাড়িতে? কিন্তু আমি ওকে কোনও প্রশ্ন করবনা ঠিক করেছি, কিছু জানাব না, তাহলেই তার অন্য মানে হবে। সুতরাং আমি বললাম, না, অন্য কোথাও যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভবন।
আমাদের বাড়িতে আসতে পারবেন না? সপ্তাহে অন্তত দুদিন?
না।
কেন?
এমনিই। আমার ভাল লাগবে কি না বুঝতে পারছি না।
হ্যাঁ, আপনার ভাল লাগবে। আসবেন?
এবার মাধবী ওর নির্লিপ্ততার আররণ একটু সরিয়েছে। একটু যেন জোর দিয়ে কথা বলতে চাইছে। তবু আমি বললাম, আচ্ছা, ভেবে দেখি। পবে তোমাকে জানাব।
মাধবী দরজার কাছে পৌঁছেছিল, ওকে বিদায় দেবার জন্য আমি এগিয়ে এলাম। এবং একেবারে অপ্রত্যাশিত ভাবে, আগের মুহূর্তেও ভাবিনি, মুখ ফসকে আমার মুখ দিয়ে একটা প্রশ্ন বেরিয়ে গেল, মাধবী, অবনীভূষণ কে?
মাধবী ফিরে দাঁড়াল। এক মুখ হাসিতে ওর মুখটা ঝলমলে হয়ে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল, অবনীভূষণের কথা আপনাকে পেয়ে বসেছে দেখছি। এত ভাবছেন কেন?
অবনীভূষণ কে?
কেউ না, এক জন মানুষ। অবনীভূষণ সেনগুপ্ত। আপনাকে দেখে তার কথা মনে পড়েছিল আমার। আপনি অনেকটা তার মতো।
আজ, এই পোশাকেও কি আমাকে অবনীভূষণের মতো দেখাচ্ছে?
হ্যাঁ। আজও আপনাকে প্রথম দেখেই তার কথা মনে পড়েছিল।
মনে পড়েছিল মানে? সে এখন কোথায়?
সেকথা আজ বলবনা।
আজ নয়, তবে আর করে বলবে!
আবার যখন দেখা হবে। আবার করে দেখা হবে তা তো আপনার ওপরেই নির্ভর করছে। আজ যাই।
মাধবী আর একটু বসো। তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলব।
আজ নয়। আজ বাড়ি থেকে অনেকক্ষণ বেরিয়েছি। মাকে বলে এসেছি তাড়াতাড়ি ফিরব। এখন যাই।
তুমি আমার বাড়িতে আর আসবে না কেন?
সে-কথাও আজ বলবনা। যদি আমার বাড়িতে আসেন আজ হঠাৎ এত প্রশ্ন করছেন কেন?
না, আর প্রশ্ন করবনা। তুমি যাও।
মাধবী গিয়ে গাড়িতে উঠল। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার বুক থেকে পাষাণভার নেমে গেছে। একথা তো অবধারিত যে, মাধবীর সঙ্গে আবার আমার দেখা হবেই। হবেই, কেননা, আমি মন থেকে তাই-ই চেয়েছি। দেখা হলে মাধবীকে আর কোনও প্রশ্ন করব না, কোনও কথা জানাবও না।
মাধবী আমাকে যে-দিন বলেছে, আমাকে অবনীভূষণের মতো দেখতে, সেদিন থেকেই আমি বদলাতে শুরু করেছি। আমি অন্য রকম হয়ে যাচ্ছি। সত্যি সত্যি অবনীভূষণের মতন কিনা, তা অবশ্য জানি না। তাকে তো আমি চিনিই না। কিন্তু একথাও ঠিক, আমি এখন শেখরও ঠিকনই। কে তবে আমি!
ফিরে এসে চটপট স্নান সেরে, আমার সব চেয়ে শৌখিন পোশাক পরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম। মাধবী এতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে গেছে। স্নান সেরে মাধবীও কী আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে? অবনীভূষণ কি বেঁচে আছে? যদি বেঁচে থাকে, তবে ও কি এখন মাধবীদের বাড়িতে? ছোকরা কী-রকম, খুব চালিয়াৎ কিনা কে জানে! ব্যাকব্রাশ করা চুল, পরিচ্ছন্ন চেহারার অবনীভূষণ মাধবীদের বাড়ির দোতলার ব্যালকনিতে বসে ইয়ার্কি করছে — এই ছবিটা মনে এল। কী ধরনের রসিকতা ও করে, ঠিক ভেবে পেলাম না। আকাশ থেকে এক ঝলক আলাদা রোদ মাধবীর জন্য এসে ওর পায়ে লুটোচ্ছে। মাধবীর পায়ে হরিণের চামড়ার চটি। অবনীভূষণ নিশ্চিত সিল্কের পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরে আছে। মুখে সিগারেট না পাইপ? এমনও হতে পারে, অবনীভূষণ সত্যিই বেঁচে নেই। ও বেঁচে আছে না মরে গেছে, কিছুতে বুঝতে পারি না। যদি বেঁচে থাকে তবে, আপনাকে অবনীভূষণের মতো দেখতে, এ কথা বলেই মাধবী চুপ করে যায় কেন? আমার কাছে সম্পূর্ণ অজানা একটি লোকের নাম বলে, তার পরিচয় না বলার কী কারণ থাকতে পারে দুঃখের স্মৃতি ছাড়া! যদি বেঁচে থাকে, তবে সে কোথায়? একদিন মাধবীর গা শুঁকে দেখতে হবে, ওর গায়ে অবনীভূষণের গন্ধ আছে কিনা। না না, বেঁচে থাকো, তুমি বেঁচে থাকো অবনীভূষণ, আমি চাই তুমি বেঁচে থাকো। জীবিত লোককে পরাজিত করা সোজা। যদি মরে গিয়ে থাকে, তবে মাধবীর বুক থেকে ওর দাগ কোনও দিন উঠবে না। সারা শরীর আবার ব্যথা ব্যথা করছে। সারা দিন ঘর থেকে বেরোলাম না। বিকেলেও তিন জন বন্ধু এল, প্রত্যেকের নিজস্ব ধরনের অনেক কথা বলে গেল। যাবার সময় আমাকে ডেকে নিয়ে গেল না। বাড়িতে একা পড়ে রইলাম। নিজে থেকে কোথাও যেতে ইচ্ছে হল না। ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছি। ভালই, যত আমি একা হব, তত আমি মাধবীর কাছাকাছি যাব। অনেক হুল্লোড় করেছি, এখন স্নেহছায়া চাই। ইচ্ছে করে মাধবীর চোখের সামনে পা ছড়িয়ে বসে থাকি। মাধবীর দৃষ্টি ঝরনার জলের মতো। মনে পড়ে, অনেকদিন আগে সাঁওতাল পরগনায় একটা ছোট্ট ঝিরঝিরে ঝরনার সামনে অনেকক্ষণ একা বসে ছিলাম। বসে ছিলাম রাখাল বালকের মতো। হাতে বাঁশি ছিল না, পরনে কর্ডের প্যান্ট ও মুখে চুরুট ছিল, তবু রাখাল বালকের মতো, একথায় কোনও ভুল নেই। প্রায় তিন ঘণ্টা বসে ছিলাম, চুপ করে, নিজের সঙ্গেও কথা বলিনি, এক লাইন গান গাইনি। আমার স্মরণকালে সেই একমাত্র চুপ করে বসে থাকা। মাধবীর সামনে ওই রকম চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে হয়। চুপ করে বসে থাকলে, এক দিন না একদিন আমাকে ঠিক আমারই মতো দেখাবে।