আঠারোই এপ্রিল, রবিবার, দ্রুত বিচার আইনে আলাউদ্দিনের সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়ে গেল। বিচারক তার রায়ে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক সমাজের নৈতিক অধঃপতনের জন্যে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, শাস্তি আরো কঠোর করার ইচ্ছা ছিল। আসামির বয়স এবং স্বাস্থ্য বিবেচনা করে লঘু দণ্ড দেয়া হয়েছে।
পরিশিষ্ট
আজ বুধবার।
মুহিবের মিথ্যাদিবস। সে অপেক্ষা করছে জেলখানার গেটে অজ তার বাবা আলাউদ্দিন মুক্তি পাবেন। তার সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে।
মুহিবের পাশে লীলা দাঁড়িয়ে আছে। লীলা বলল, বাবার জন্যে একটা ফুলের মালা আনার দরকার ছিল না?
মুহিব বলল, বাবা কোনো রাজনৈতিক নেতা না লীলা যে ফুলের মালা গলায় দিয়ে তাকে বের করতে হবে।
দীর্ঘদিন অন্যায় শাস্তি তিনি ভোগ করেছেন। একটা ফুলের মালা তার অবশ্যই প্রাপ্য।
এখন ফুলের মালা আমি পাব কোথায়?
লীলা বলল, ফুলের মালা আমি নিয়ে এসেছি।
গুড।
লীলা বলল, আমাকে কি তোমার বাবা পছন্দ করবেন?
মুহিব বলল, না। উনি কাউকেই পছন্দ করেন না। তবে দীর্ঘদিন জেলে থেকেছেন। তার মানসিকতা বদলাতেও পারে।
লীলা বলল, আজ যে তোমাকে রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছে সেটা কি তুমি জানো?
মুহিব বলল, এখন জানলাম। লীলা বলল, তোমার কেমন আনন্দ হচ্ছে একটু বলবে?
মুহিব বলল, বাবা ঘরে ফিরবেন। আগের মতো আমাকে গাধাপুত্র বলে গালি দেবেন, ভাবতেই ভালো লাগছে।
লীলা বলল, Home এর defination কি মনে আছে? তোমাকে শিখিয়েছিলাম।
মুহিব বলল, Home is the place where if you want to go there, they have to take you in.
লোকজন মুহিবকে চিনতে পেরেছে। তাকে ঘিরে ভিড় বাড়ছে। ক্রমাগত মোবাইল ক্লিক ক্লিক করছে। ছবির পর ছবি উঠছে। ভিড় সামলানোর জন্যে পুলিশ এসেছে। পুলিশের ওসি ওয়াকিটকিতে আরো কিছু পুলিশ চেয়েছেন। ওসি সাহেব মুহিবকে বললেন, স্যার, আপনি গাড়িতে বসুন। সব কন্ট্রোল করা যাবে না। পাবলিকের বিশ্রী স্বভাব, সেলিব্রেটি দেখলে হুশ থাকে না।
মুহিবের মা এবং বোন জেলগেটে আসে নি। অশ্রুর বিয়ে হয়েছে। সে স্বামীর সঙ্গে রাজশাহীতে থাকে। তাদের একটা মেয়ে হয়েছে। মেয়ের নাম মুহিব রেখেছে নিলি। এই নাম অশ্রু বা অশ্রুর স্বামীর কারোই পছন্দ হয় নি। মুহিব বলেছে—এই নামের মেয়ের হার্ট হয় পৃথিবীর মতো বড়। নামটা রেখে দেখ! অশ্রু স্বামী এবং মেয়েকে নিয়ে ভোরবেলা ঢাকা পৌঁছেছে। নিলির সামান্য জ্বর এসেছে বলে তারা আসে নি। অশ্রুর স্বামীর নাম সাজ্জাদ। তার ভুবনে স্ত্রী এবং মেয়ে ছাড়া আর কিছুই নেই। মাঝে মাঝে অশ্রুর খুবই বিরক্ত লাগে। সে বলে, আমি খাটের নিচে যে ভূতটা দেখতাম তুমি তারচেয়ে খারাপ। ভূতটা শুধু রাতে থাকত। তুমি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা থাক। ভূতটার চেহারার সঙ্গে তোমার মিল আছে। ভূতটার মাথায় চুল ছিল না। তোমার মাথায় টাক। ভূতটার মুখ ছিল লম্বা, তোমার মুখও লম্বা। কোনো কথাতেই সাজ্জাদের কিছু হয় না। সাজ্জাদের ধারণা, অশ্রু যখন বেশি রাগারাগি করে তখন তার চেহারা অনেক সুন্দর হয়ে যায়। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে।
রাজিয়া বেগম জেলগেটে যান নি। কারণ তার অনেক কাজ। মানুষটা কতদিন পরে ঘরে আসবে। ঘরের ভাত খাবে। দীর্ঘ ছয় বছরের জেলখানায় এক বছর শাস্তি রেয়াত হয়েছে, জেলের বছর নয় মাসে হয়) কত কথা জমা আছে। কোনটার পর কোনটা বলবেন সেটা একটা সমস্যা।
অশ্রুর বিয়ের দিন কত বড় ঝামেলা হলো। বিয়ে ভেঙে যায় ভেঙে যায় অবস্থা। তারপর হঠাৎ করেই সব সমস্যার কী আশ্চর্য সমাধান! অশ্রুর স্বামীকে শুরুতে তার পছন্দ হয় নি। বুড়োটে চেহারা। মাথায় চুলের বংশও নাই। কথাবার্তাও যেন কেমন কেমন। অর্ধেক কথা বলে তো অর্ধেক বলে না। এখন মনে হচ্ছে, এরকম জামাই পাওয়া যে-কোনো মেয়ের জন্যেই ভাগ্যের কথা।
হিশাম সাহেবের গল্পটা গুছিয়ে বলতে হবে। সালমা মেয়েটাকে বিয়ে করেছে। ধুমধাম করে। বিয়ের কার্ড দিতে এসেছিল। কী সুন্দর সুন্দর কথা–ভাবি মেয়েটাকে উদ্ধারের জন্যে এই কাজটা করলাম গাঁয়েক গছে কে এই মেয়েকে বিয়ে করবে বলুন?
মুহিবের ফ্ল্যাট কেনার ঘটনাটা সুন্দর করে বলতে হবে। ঘটনা বলতে গিয়ে আগপিছ হয় কি-না সেই ভয়ও আছে। আগপিছ হলে ঘটনার মজাই শেষ হয়ে যাবে। একদিন মুহিবকে নিয়ে গেল। ফ্ল্যাট দেখাতে সে চারতলার একট ফ্ল্যাট কিনেছে। এখনো লিফট বসে নি। তিনি বললেন, বাবারে, আমি তো সিঁড়ি বাইতে পারব না। মুহিব বলল, কোনো চিন্তা নাই মা। আমি কোলে করে তুলব।
রাজিয়া বললেন, পাগল না-কি? তুই কোলে করে তুলবি কীভাবে?
মুহিব বলল, দেখ না কীভাবে তুলি। সত্যি সত্যি সে তাঁকে কোলে করে চারতলায় তুলে বলল, সবচেয়ে সুন্দর ঘর ঘর কোনটা মা খুঁজে বের কর। তিনি খুঁজে বের করলেন। বারান্দাওয়ালা বিরাট ঘর। দক্ষিণ দিকে জানালা। সারাক্ষণ হাওয়া আসছে। মুহিব বলব, মা, এই ঘরটা তোমার আর বাবার। এই ঘরের পাশের ঘরটাও তোমার। বাবার সঙ্গে যখন রাগারাগি হবে, তখন এই ঘরে দরজা বন্ধ করে ঘুমাবে।
মুহিব তার বাবার ঘরটা আগের মতো করে সাজিয়েছে। পুরনো চটি জুতা। পুরনো কাপড়। দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো মুহিবের ছেঁড়া BA-র সার্টিফিকেট। টিভি নষ্ট হয়ে গেছে বনে টিভি কেনা হয়েছে। একটা বেতের ইজিচেয়ার কেনা হয়েছে। ঘরে এসি লাগানো হয়েছে। মানুষটা যেন এসির বাতাসে আরাম করে ঘুমাতে পারে।
রাজিয়া বেগম দুপুরের খাবার আয়োজন করছেন। কাজের ছেলেটি বাজার নিয়ে এসেছে। ঘরে রান্নার মেয়ে আছে। রাজিয়া ঠিক করেছে আজ নিজেই রাঁধরেন। সবই মুহিবের বাবার পছন্দের খাবার।
করল ভাজি (সঙ্গে কুচি কুচি আলু দিতে হবে। অল্প ভাজা হবে, যেন করলা সবুজ থাকে।)
সাজন (সর্ষে বাটা দিয়ে, সঙ্গে কাঁচামরিচ।)
কৈ মাছের ঝোল (টমেটো দিয়ে। কাঁচা টমেটো পেলে ভালো হয়।)
মাষকালাইয়ের ডাল (সঙ্গে টাকি মাছ দিতে হবে।)
রাতে করবেন হাঁসের মাংস। চালের আটার রুটি।
মুহিবকে ঘিরে ভিড় প্রচও বেড়েছে। ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়েছে। লীলা ডানে সরতে সরতে ঝুপ করে নোংরা নর্দমায় পড়ে গেল। পুরনো দিনের কথা মনে করে খিলখিল করে হেসে ফেলল। প্রকৃতি বড়ই অদ্ভুত। প্রকৃতি পুনরাবৃত্তি পছন্দ করে।
আলাউদ্দিন জেলগেট থেকে বের হয়েছেন। মুহিব ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছে।
আলাউদ্দিন বলেন, নর্দমায় পড়ে আছে মেয়েটা কে?
মুহিব বলল, বাবা, ও তোমার বৌমা। ওর নাম লীলা।
আলাউদ্দিন ছেলেকে কঠিন ধমক দিলেন, বৌমা নর্দমায় পড়ে আছে, তুই তাকে তুলবি না? গাধা। অর্ধমানব।
লীলার হাতে ফুলের মালা। সে চেষ্টা করছে মালায় যেন নোংরা না লাগে।
———-