দুপুরের পর থেকে ঝড়ো বাতাস শুরু হয়েছিলো। বিকেল থেকে শুরু হলো বৃষ্টি। ঝমঝমে বৃষ্টি নয়, বাতাসের সঙ্গে দমকা বৃষ্টি। মাঝে মাঝে জোরে হচ্ছিলো, মাঝে মাঝে থেমেও যাচ্ছিলো। বরফ পড়ার পূর্বলক্ষণ এটা।
দুপুরে লাঞ্চ পর্যন্ত শার্লির সঙ্গে আমাদের বৈঠক হলেও বোঝা গেলো না রাতে ওর বাড়িতে আসলে কারা আসে। শার্লি প্রথমে অতৃপ্ত আত্মার কথাই বলেছিলো। জেনের কথা শুনে ভিন গ্রহের আগন্তুকের সম্ভাবনাও নাকচ করে দেয়নি। শীলা একবার বলেছিলো, কোনো খারাপ লোক হতে পারে। শার্লি ওর কথা উড়িয়ে দিয়েছে। শেষে ঠিক হয়েছে রাতে আমরা না ঘুমিয়ে পাহারা দেবো। দেখবো কারা আসে।
রাত এখন দশটা। আটটার ভেতর সবাই ডিনার সেরে ফেলেছি। শার্লির কাজের মেয়ে কারমেলা আর আসেনি। তাতে খুব একটা অসুবিধেও হয়নি। আমাদের পেয়ে শার্লি এত খুশি হয়েছিলো যে মনের মতো করে নিজেই রান্না করেছে। শীলাও ওকে রান্নায় সাহায্য করেছে। জেন আমাদের সঙ্গে বসে ভিসিআরে হরর ছবি দেখেছে। শার্লির ছবির সংগ্রহ দেখার মতো বটে। রহস্য আর ভৌতিক বইয়ের সংখ্যা হাজারের কাছে হবে।
সাড়ে নটার সময় জোর করে শার্লি আর আলফ্রেডকে ওপরে শুতে পাঠিয়ে আমরা নিচের তলায় আমাদের ঘরে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে গল্প করছিলাম। রাত জাগতে হবে বলে দুপুরে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়েছি। একটু আগে আমরা চারজন বড় মগভর্তি গরম কফি খেয়েছি। বাইরে বৃষ্টি ততক্ষণে থেমে গেছে। তবে আকাশের মেঘ কাটেনি। আবহাওয়ার বুলেটিনে বলেছে আগামী চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর বরফ পড়বে। বরফ পড়ার ঠিক আগে শীতটা ভীষণ ধারালো হয়।
ভিকি বললো, নিক তুই কি বিশ্বাস করিস গলায় ক্রস ঝোলানো থাকলে খারাপ আত্মা কাছে আসে না?
শার্লি শুতে যাওয়ার আগে আমাদের চারজনের গলায় চারটি ক্রস ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে। বলেছে–নাস্তিকরা এসব বিশ্বাস করে না। আমাকে যে এখনও ওরা দখল করতে পারেনি সেটা এই ক্রসের জন্য। এখান থেকে যাওয়ার সময় খুলে রেখে যেও। কিন্তু এখানে যে কদিন থাকবে তোমাদের ভালোমন্দের দায়িত্ব আমার। কারও কিছু
হলে আমাকে গলায় দড়ি দিতে হবে।
ভিকির কথা শুনে মনে হলো গলায় ক্রস ঝোলানোটা ওর পছন্দ হয়নি। বললাম, আমি এসব বিশ্বাস করি না।
তা হলে গলায় ঝুলিয়ে রেখেছিস কেন, খুলে ফেল?
আমি বললাম, ভিকি, একজন বুড়ো মহিলা আমাদের মঙ্গলের কথা ভেবে বিশ্বাস করে এটা পরিয়ে দিয়েছে। সে জানে আমরা তার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবো না। কী দরকার খুলে–থাক না।
মনে হচ্ছে তুই ভয় পেয়েছিস। ভিকি খোঁচা মেরে বললো, আমরা কেউ ধর্ম মানি না। কেন মিছেমিছি খৃষ্টানদের একটা ক্রস অযথা ঝোলাতে যাবো?
শীলা বললো, নিক ঠিকই বলেছে ভিকি। এটা যদি খুলে ফেলি শার্লি মনে কষ্ট পাবে। দুদিনের জন্য আমরা বেড়াতে এসে অসহায় এক বুড়িকে কেন কষ্ট দিতে যাবো?
জেন বললো, আমি অন্য একটা কারণে এটা খোলার পক্ষপাতী। যদি সত্যিই অতৃপ্ত আত্মারা রাতে এ বাড়িতে আসে তা হলে দেখা যাবে ক্রসের জন্যেই হয়তো তারা আমাদের কাছে ঘেঁষছে না। আমার অতৃপ্ত আত্মা দেখার ভারি সখ।
কী করে দেখবে? আমি হেসে বললাম, ওরা তো অশরীরী, চোখে দেখা যায় না।
তা হলে আমাদের কপালটাই খারাপ বলতে হবে। বাড়ি থেকে বেরোলাম হন্টেড ক্যাসল্ দেখবো বলে। সেটা দেখা হলো না। এখানে এলাম ভূতের দেখা পাবো বলে। তাও কপালে জুটবে না?
জুটতেও পারে। আমি রহস্য করে বললাম, গোটা রাত পড়ে আছে। দেখতে না পেলেও শুনতে তো পাবে। শার্লি বলেছে ওদের দেখা যায় না, শোনা যায়।
জেন বললো, শুনতে পেলেও মন্দ হয় না।
শীলা বললো, নিক, তুমি ঠাট্টা করছো কেন? তোমার কি মনে হয় না এটা কোনো খারাপ লোকের কাজ?
শীলাকে বললাম, কথাটা ভেবে দেখার মতো। এমন তো হতেই পারে শার্লিকে একা পেয়ে ভয় দেখিয়ে ওর বাড়িটা দখল করতে চাইছে। সমুদ্রের তীরে পাহাড়ের ওপর এ ধরনের বাড়ি স্মাগলারদের জন্যে তো স্বর্গ। গত বছর নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড় নামে একটা বাংলা রহস্য উপন্যাস পড়েছিলাম। ওখানে ছিলো এরকম একটা বাড়ি দখল করার জন্য বদমাশরা ভূতের ভয় দেখিয়ে বাড়ির লোকদের তাড়াতে চাইছে। চোখ কান খোলা রাখলে আমরাও শার্লির বাড়ির ভৌতিক উৎপাতের রহস্য উঘাটন করতে পারবো।
ভিকি উত্তেজিত গলায় বললো, তুই তা হলে বলছিস, হার্ডি সিক্স-এর মতো আমরা হার্ডি ফোর নামে একটা দল করতে পারি?
তা পারিস। আমি হেসে বললাম, দল পাকাবার জন্য তুই উপযুক্ত লোক।
আমি তাহলে টিম লিডার হবো।
জেন বললো, তুমি কেন টিম লিডার হবে? শীলা নয় নিক হবে টিম লিডার।
ভিকি তবু বললো, গায়ের জোরে আমার সঙ্গে কেউ পারবে না।
বুদ্ধির জোরে তুমি ওদের সঙ্গে পারবে না।
আমি বললাম, জেন, আমি সারেন্ডার করছি। ভিকিই আমাদের লিডার হোক। তবে এক শর্তে।
কী শর্ত? ব্যগ্র হয়ে জানতে চাইলে ভিকি।
শার্লির দেয়া ক্রসটা তুই গলায় ঝুলিয়ে রাখবি।
ভিকি উল্লসিত হয়ে বললো, একটা কেন, টিম লিডার হওয়ার জন্য দশটা ক্রস গলায় ঝোলাতেও রাজি আছি আমি।
জেন বললো, এবার টের পাচ্ছো তো ভিকি, বুদ্ধি কার বেশি?
ভিকি বললো, নিশ্চয় সারেন্ডার করে নিক বুদ্ধিমানের কাজ করেছে।
জেন হেসে বললো, তা নয় ভিকি। নিক তোমাকে ঠিকই গলায় ক্রস ঝুলিয়ে ছেড়েছে।
তাই নাকি! জেনকে খোঁচা দিয়ে ভিকি বললো, তোমার তো দারুণ বুদ্ধি! এত বুদ্ধি নিয়ে রাতে ঘুমাও কী করে?
বেশি হলে তোমার মতো অপাত্রে বাড়তিটুকু ঢেলে দেই।
আমরা সবাই এমনভাবে শুয়েছিলাম যাতে কাঁচের জানালাগুলোর ওপর নজর রাখা যায়। তখন এগারোটার মতো হবে। হঠাৎ বাইরে খুট করে শব্দ হলো। আমরা সবাই কান খাড়া করলাম। ভিকি হাত বাড়িয়ে আমাকে খোঁচা দিলো।
তারপর বাইরের কাঠের বারান্দায় মনে হলো কে যেন খটখট করে হাঁটছে। জেন ভাঙা গলায় আর্তনাদ করে উঠলো–কে?
সঙ্গে সঙ্গে পায়ের আওয়াজ থেমে গেলো। শীলা চাপা গলায় ওকে ধমক দিলো–দিলে তো সব নষ্ট করে। চিৎকার করতে কে বলেছিলো তোমাকে?
ভিকি গম্ভীর হয়ে বললো, শীলা, জেনকে যদি কিছু বলতে হয় আমি বলবো। মনে রেখো, টিম লিডার আমি।
আমি চেইন খুলে স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরোলাম। ওদের বললাম, বাইরের বারান্দা থেকে একটু ঘুরে আসি।
শীলা বললো, একা যেয়ো না। আমিও যাবো।
আমার মতো স্লিপিং ব্যাগের চেইন খুলে শীলাও বেরিয়ে এলো। দুজনে বারান্দায় এসে দেখি কেউ কোথাও নেই। শার্লির পোষা বিড়াল দুটো হঠাৎ ঘরের কোণ থেকে মিয়াও বলতেই শীলা লাফ দিয়ে এসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, ওটাতো শার্লির বেড়াল। ভয় পাচ্ছো কেন?
শীলা লজ্জা পেয়ে বললো, ভয় নয়, চমকে উঠেছিলাম।
আমরা দুজনে ঘরে ফিরে এলাম। ভিকি বললো, এভাবে শুয়ে থাকলে এমনিতেই ঘুম এসে যাবে।
জেন বললো, আমারও ঘুম পাচ্ছে।
শীলা বললো, তোমাদের ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি আর নিক এখন ঘুমোচ্ছি না।
ওরা আর কোনো কথা বললো না। কিছুক্ষণ পর ভিকির ফিনফিনে নাক ডাকার শব্দ শুনে শীলা বললো, ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে। চলো বাইরের ঘরে গিয়ে বসি।
আমি কোনো কথা না বলে শীলার সঙ্গে ড্রইংরুমে এসে বসলাম। শীলা বললো, কফি খাবে আরেক কাপ?
বললাম, পেলে মন্দ হতো না।
শীলা উঠে গিয়ে কফি বানিয়ে আনলো। বললো, বাড়িতে এক কাপের বেশি দুকাপ কফি খেলেই মা কী চাচামেচিই না করে! মনে হয় গোটা সভ্যতা বুঝি রসাতলে গেছে।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললাম, আমার মাও বেশি কফি খাওয়া পছন্দ করে না।
পৃথিবীর সব মা-ই একরকম।
তুমি যখন মা হবে তখন তুমিও তোমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এরকম করবে।
আমাকে দেখে কি তোমার তাই মনে হয়?
মানুষ কি সব সময় একরকম থাকে?
তার মানে তুমিও একদিন বদলে যাবে।
জানি না, হয়তো হবো।
তখন আমাকে আর বন্ধু ভাববে না।
যদি সত্যিকারের বন্ধুত্ব থাকে কখনও তা পুরোনো হয় না।
আমাদের বন্ধুত্ব কি সত্যিকারের?
নিশ্চয়ই শীলা, তোমার কি সন্দেহ আছে।
শীলা কিছুক্ষণ কোনো কথা বললো না। চুপচাপ কী যেন ভাবলো। তারপর বললো, তুমি খুব ভালো নিক। তোমার মতো বন্ধু পেয়ে আমি গর্বিত।
ড্রইংরুমের অন্ধকারে বসেছিলাম আমরা দুজন। একটু পর বাইরে আবার শব্দ হলো। খট, খট, খট, খট বুট পায়ে কে যেন হাঁটছে। শব্দ শুনে মনে হয় মানুষের পায়ের আওয়াজ নয়। ঠিক ড্রইংরুমের দরজার সামনে এসে শব্দটা থেমে গেলো। যেন বন্ধ দরজা ভেদ করেই সে ঘরে ঢুকবে। ফিসফিস করে শীলাকে বললাম, চলো দেখে আসি।
শীলা আমার হাত ধরলো। মনে হলো এবার ও ভয় পেয়েছে। শব্দটা আসলেই অন্যরকম ছিলো। যেন কোনো নরকঙ্কাল হেঁটে বেড়াচ্ছে। কথাটা মনে হতেই মেরুদন্ড বেয়ে ঠান্ডা রক্তের স্রোত নেমে এলো। শিরশির করে উঠলো সারা শরীর।
তবু আমরা উঠলাম। দুজন একসঙ্গে পা টিপে টিপে এসে ঝট করে দরজাটা খুলোম। যা ভেবেছিলাম–কোথাও কেউ নেই ।
শীলা বললো, সত্যিকারের মানুষ হলে এত তাড়াতাড়ি লুকোবে কোথায়?
দরজা বন্ধ করে আবার ড্রইংরুমে এসে বসলাম, ভিকি জেনকে ডাকবে?
থাক, কাজের চেয়ে ওরা কথাই বলে বেশি।
ঠিক বলেছো। তবু ভিকি খুব মজার ছেলে।
জেনের মনটাও সুন্দর।
না হলে কি আমাদের বন্ধু হতে পারতো?
আমি কথা না বলে শুধু হাসলাম। আমাদের চারজনের বন্ধুত্ব নিয়ে স্কুলে টিচাররাও হাসাহাসি করেছে। এখন নিশ্চয় হার্ডি ফোর বলে সবাই ঠাট্টা করবে।
সেই রাতে আরও অনেকক্ষণ জেগেছিলাম আমি আর শীলা। দুজনে নিচু গলায় কথা বলছিলাম। আলফ্রেডের কথা মনে হলো। ও বলেছিলো, আমার নিজের জগতের কথা। সেই রাতে মনে হয়েছিলো শীলাই আমার জগৎ। এটা আমাদের নিজস্ব জগৎ। এখানে অন্য কারও জায়গা নেই। মা আর দিব্যেন্দুর নিশ্চয় এমন একটা জগৎ আছে। আমার উচিত হবে না দুজনের মাঝখানে দেয়াল হয়ে থাকা।
পরদিন ভিকি আমার ঘুম ভাঙালো। বললো, সবার ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে। বাকি শুধু তুই আর শীলা।
ঘুম-জড়ানো চোখে জিজ্ঞেস করলাম–কটা বাজে ভিকি?
বেশি নয়, মাত্র সাড়ে দশটা।
বলিস কী! বলে লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম। আগে ডাকলি না কেন?
তোর প্রিয় বান্ধবী শার্লি বারণ করলো যে! আহা, তোর জন্য বুড়ির কত ভাবনা। বলে, বাছা আমার সারারাত জেগেছে, আর একটু ঘুমোক। সত্যি নাকি দোস্ত, তুই কি সারারাত জেগে ছিলি?
সারারাত কেন হবে? হাই তুলে বললাম, তিনটার দিকে শুয়েছি। শীলা উঠেছে?
ওকে ওঠানোর দায়িত্ব জেনের। শীলাও কি তোর সঙ্গে রাত জেগেছে?
আমি কোনো কথা না বলে বাথরুমে ঢুকলাম। একবারে তৈরি হয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে দেখি শীলা বসে আছে। ওর চোখ দুটো সামান্য ফোলা, সাদা-কালো নকশা করা কার্ডিগান গায়ে, ভারি সুন্দর লাগছিলো।
শার্লি আর আলফ্রেড ড্রইংরুমে বসে ওদের ছোটবেলার কথা বলছিলো। নাশতা খেতে খেতে শুনলাম শার্লি বলছে, তোর মনে আছে আলফ্রেড, একবার তুই আর তোর আরেক বন্ধু বাবার পকেট থেকে দুই পাউন্ড চুরি করে সিনেমা দেখেছিলি? ফেরার পর কী মারটাই না খেলি! তোকে বাঁচাতে গিয়ে আমিও মার খেয়েছিলাম।
আলফ্রেডের মুখে নরম হাসি। বললো, মনে থাকবে না কেন শার্লি, মা মারা যাওয়ার পর তুমি আমাকে মার মতোই আগলে রাখতে। গায়ে এতটুকু আঁচ লাগতে দাওনি।
তুই নিজে কি কম করেছিস? একবার পাড়ার এক ছেলে আমাকে নিয়ে একটা বাজে কথা বলেছিলো। তুই গিয়ে ওর নাক ফাটিয়ে দিয়ে এলি। তারপর কত ঝামেলা!
সব মনে আছে শার্লি। নিচু গলায় বললো আলফ্রেড-তোমার মতো বোন পাওয়া ভাগ্যের কথা।
শার্লি ভাইয়ের গালে চুমু খেয়ে বললো, তোর মতো ভাই কটা বোনের আছে শুনি?
আমি শীলার দিকে তাকালাম। শীলা মুখ টিপে শুধু হাসলো । ভিকি আর জেন বাইরে কী নিয়ে হল্লা করছে। এখান থেকে ওদের গলা শুনতে পাচ্ছিলাম।
নাশতা সেরে বাইরে এসে দেখি ঝলমলে বোদের ঝরণাধারায় ভাসছে ছোট্ট কার্ডিগান শহর। দূরে শান্ত নীল কার্ডিগান উপসাগর কাঁচের টুকরোর মতো পড়ে আছে। শার্লির বাড়িটা বেশ উঁচু একটা পাহাড়ের ওপর। কাছাকাছি কারও বাড়ি নেই। শুধু একটা গির্জা রয়েছে পাশের নিচু টিলায়। উত্তর আর পূর্ব দিকে উঁচু পাহাড়, সেখানে শুধু গাছের সারি, দু একটা ছাড়া কোনো গাছে পাতা নেই।
আমাদের বেরোতে দেখে ভিকি এগিয়ে এসে বললো, তদন্ত শুরু করার আগে আশেপাশে একটু ভালো করে ঘুরে দেখা দরকার, লোকজনের সঙ্গে কথাও বলা দরকার, সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়তে পারে।
শীলা হেসে বললো, এসব করার জন্য শার্লি আর আলফ্রেডের অনুমতি নেয়া দরকার।
অনুমতি আগেই নেয়া হয়েছে। বিচক্ষণ দলনেতার মতো বললো ভিকি। ঘুম থেকে উঠে যথারীতি রিপোর্ট করাও হয়ে গেছে। কাল রাতেও ওরা এসেছিলো শুনে শার্লি আলফ্রেডকে একচোট নিয়েছে।
শীলা অবাক হয়ে জানতে চাইলো–একচোট নেয়ার মতো আবার কী ঘটলো?
শার্লির কথা আলফ্রেড বোধহয় বিশ্বাস করেনি। রাতে নিশ্চয় এ নিয়ে ওদের কথা হয়েছে। আমার কথা শুনে ও একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আলফ্রেডের ওপর–বলিনি ওরা রোজ রাতে আসে। আমার কথা বিশ্বাস হয়নি। এরা তো সব ফেরেশতার মতো ছেলেমেয়ে। বল, এরাও বানিয়ে বলেছে। তুই একটা–
শার্লির গলা আর বলার ঢং নকল করে ভিকি ওর কথাগুলো আমাদের শোনাবার আগেই আমরা সবাই হেসে খুন হলাম। আমাদের বাঁধভাঙ্গা হাসির শব্দ শুনে ভেতর থেকে শার্লি আর আলফ্রেড বেরিয়ে এলো হাত ধরাধরি করে। প্রসন্ন মুখে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওরা আমাদের দেখছিলো। শার্লি বললো, ভারি চমৎকার আবহাওয়া আজ। তোমরা ঘুরে এসো। বেশিক্ষণ থাকবে না। আমি তোমাদের জন্য বাঁধাকপি, মাংসের সুপ আর গলদা চিংড়ি রান্না করছি।
ভিকি বললো, তা হলে তো ভালোমতো ঘুরে খিদেটা বাড়িয়ে আনতে হয়।
শার্লি হেসে বললো, কার্ডিগানের বাতাসে ঘন্টায় ঘন্টায় লোকের খিদে পায়।
আমরা চারজন কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পাথরে বাঁধানো রাস্তাটা পাহাড়টাকে এক পাক দিয়ে নিচে নেমে গেছে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ছোট বড় এঁচোলো পাতার পাইন গাছ গজিয়েছে। মাটির অভাবে অনেক পাইন গাছ বেঁটে বনসাই হয়ে গেছে, ভিকি আমাকে বললো, আমাদের তদন্ত কোত্থেকে শুরু হবে কিছু ভেবেছিস? আমার মাথায় তো কিছু ঢুকছে না।
আমি হাসি চেপে বললাম, তুই দলের লিডার। তুই ঠিক করবি কোত্থেকে আমরা শুরু করবো। আমি কীভাবে জানবো?
জেন হেসে বললো, ভালো বলেছো নিক। এবার ভিকি লিডার হওয়ার মজা টের পাবে।
ভিকি বিরক্ত হয়ে বললো, আহা লিডাররা কি ডেপুটিদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারবে না?
নিশ্চয় পারবে। শীলা বললো, গোড়াতেই একটা ভুল করেছি আমরা। প্রথমে আমাদের উচিত ছিলো শার্লির বাড়িটাকে ভালোভাবে ঘুরেফিরে দেখা।
অপ্রস্তুত হয়ে ভিকি বললো, কথাটা আমিও ভেবেছিলাম। পরে ভুলে গেলাম।
জেন বললো, জালিয়াতি কোরো না ভিকি। আমরা পরামর্শ দেবো আর তুমি বলবে কথাটা তুমি আগেই ভেবেছো–এরকম বললে কোনো পরমার্শ জুটবে না।
আহত গলায় ভিকি আমাকে নালিশের গলায় বললো, সহকর্মীদের কাছ থেকে এতটা অসহযোগিতা পেলে আমাকে লিডারের পদ থেকে ইস্তফা দিতে হবে।
ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, তুই অযথা চটছিস। বন্ধু হিসেবে জেন একটু ঠাট্টাও করতে পারবে না!
ঠিক আছে, জেন না হয় ঠাট্টা করছে বুঝলাম। তুই কেন এত দাম বাড়াচ্ছিস? কাল শার্লি যেসব কথা বলেছে সেখান থেকে কু খুঁজে বের কর।
সকাল থেকে সেটাই ভাবছি। ভেবে কোনো কূল কিনারা না পেয়ে তবেই তো কথাটা তোকে বলেছি।
তোর নিজের কী মনে হয়?
কাল রাতে আমরাও শব্দ শুনেছি। গিয়ে দেখেছি কোথাও কেউ নেই।
তোদের ঘুমোনোর পরও শব্দ হয়েছে।
এই শব্দের উৎসটা খুঁজে বের করতে হবে।
শীলা বললো, কারণ জানলে উৎস খুঁজে বের করাও সম্ভব হবে।
আমি বললাম, আগে তা হলে জানা দরকার শার্লি যদি ভয় পেয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, সেক্ষেত্রে কে বা কারা লাভবান হবে।
জেন বললো, আশেপাশে লোকজনও তো কেউ নেই। কাকে জিজ্ঞেস করবো?
আমি বললাম, গির্জার ফাদার ফানান্দোকে দিয়ে শুরু করতে পারি।
ভিকি হেসে বললো, এতক্ষণে একটা কাজের কথা বললি।
গিজার পাশেই থাকে ফাদার ফার্নান্দো। ছোট্ট ছবির মতো কাঠের বাড়ি। আমাদের দেখে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। আমরা সুপ্রভাত বলতে ফাদারও সুপ্রভাত জানিয়ে বললো, ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন বাছারা।
ফাদারকে বললাম, আমরা লন্ডনে থাকি। শার্লি উডওয়ার্ডের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি ওর ভাই আলফ্রেডের সঙ্গে।
ফাদার হেসে বললো, লন্ডন থেকে এখানে কেউ বেড়াতে আসে না। তবে বেড়াবার জন্য কার্ডিগান চমৎকার জায়গা। এসো, ভেতরে এসে বসো।
ছোট্ট ছিমছাম করে সাজানো বসার ঘর। আমাদের বসিয়ে ফাদার গেলো চা বানাতে। ভিকি চাপা গলায় বললো, ফাদার বুঝে গেছে আমরা যে তদন্ত করতে এসেছি।
একটু পরেই ফাদার একটা ট্রেতে করে পাঁচ কাপ চা বানিয়ে আনলো–আমার কোনো কাজের লোক নেই। সব কাজ আমি নিজেই করি।
শীলা বললো, আপনার অসুবিধে না হলেও শার্লির খুব অসুবিধে হচ্ছে। এ বয়সে বাড়ির সব কাজ করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফাদার একটা চুরুট ধরালো। একগাল ধোয়া ছাড়তেই সারা ঘর তামাকের কড়া গন্ধে ভরে গেলো। বললো, শার্লি আমাকে বলেছিলো বটে ওর বাড়িতে কাজের লোক বেশিদিন থাকে না।
আমি বললাম, তার কারণও নিশ্চয় আপনি জানেন।
হ্যাঁ, শার্লি বলেছিলো রাতে নাকি কী সব অতৃপ্ত আত্মা আসে ওর বাড়িতে। ওরা নাকি ওকে দিয়ে ওদের কোন কাজ করিয়ে নিতে চায়।
আপনার কি মনে হয় না ও বাড়ির ওপর কোনো খারাপ আত্মার নজর পড়েছে?
শার্লিকে আমি বলেছিলাম এটা ওর মনের ভুল। কিংবা কোনো খারাপ লোক হতে পারে। শার্লির বদ্ধমূল ধারণা এসব হচ্ছে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী অশুভ কোনো শক্তির কাজ।
জেন বললো, আপনি শার্লির বাড়ির খারাপ আত্মা তাড়াবার কোনো ব্যবস্থা নেননি?
শার্লিকে আমি বলেছি কোনো ওঝাকে খবর দিতে। আমি শুধু ওকে একটা ক্রস দিয়েছি সব সময় গলায় পরে থাকার জন্য।
ভিকি বললো, আপনি কি বিশ্বাস করেন না শার্লির বাড়িতে খারাপ আত্মা ভর করেছে?
আমি বিশ্বাস অবিশ্বাস কোনোটাই করি না। ঈশ্বরের পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, বুদ্ধি দিয়ে যার ব্যাখ্যা মেলে না।
আচ্ছা ফাদার–একটু ইতস্তত করে আমি বললাম, শার্লির বাড়ির ওপর আত্মা ছাড়া কোনো মানুষেরও তো নজর পড়তে পারে।
ফাদার হেসে বললো, একশবার পারে। সত্যি কথা বলতে কি শার্লিদের বাড়িটা মাস তিনেক আগে জন হলওয়েল কিনতেও চেয়েছিলো। বলেছিলো সস্তায় পেলে কিনব। নাকি কী সব পরিকল্পনা আছে ওর।
তারপর?
শার্লির সঙ্গে জন কথা বলেছিলো। দাম শুনে শার্লি ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি বুঝি না শার্লি কেন একা এ বাড়ি আঁকড়ে পড়ে থাকতে চাইছে।
জন হলওয়েলের পেশা কী?
কিছুই করে না। একা বুড়ো মানুষ। বাপদাদারা জমিদার ছিলো, সম্পত্তি আছে অনেক। এককালে নাটকের দল করে অনেক পয়সা উড়িয়েছে। এখন নিজের খেয়াল খুশিমতো নানান দেশ ঘুরে বেড়ায়।
কোথায় থাকেন?
এখান থেকে পনেরো মিনিটের রাস্তা। বাদিকে নেমে সোজা চলে যাবে সমুদ্রের কাছে। হলওয়েল ক্যাসূল বললে সবাই দেখিয়ে দেবে।
ফাদারের বাড়ি থেকে আমরা যখন বেরোলাম তখন প্রায় বারোটা বাজে। শীলা বললো, হলওয়েলের বাড়িতে এখন যাওয়া কি ঠিক হবে? একেবারে লাঞ্চ টাইম।
আমি বললাম, বিকেলে যেতে পারি। আপাতত আমাদের শার্লির বাড়িতে ফেরা দরকার। একটু ভালোমতো দেখতে চাই, ওর বিশেষ কোনো আকর্ষণ আছে কিনা।
যেতে যেতে ভিকি বললো, ফাদার ফার্নান্দোর সঙ্গে কথা বলে তোর কী মনে হলো!
রহস্যময় ব্যক্তি। শার্লি ওকে বাড়িতে ডেকে মন্ত্রট পড়িয়েছে, ও বলেছে বাড়ির ওপর খুব শক্তিশালী আর দুষ্ট প্রকৃতির আত্মা ভর করেছে। এখন বলছে অন্য কথা।
তোর কি মনে হয় ফাদার হলওয়েলদের লোক হতে পারে? মনে হলো ফাদার নিজেও চায় না শার্লি এ বাড়িতে থাকুক।
হতে পারে। ভিকির সঙ্গে কথা আর বাড়ালাম না। আমি তখন অন্য কিছু ভাবছিলাম।