যুদ্ধ
১৭০৭ সালে মোগলসম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ১৮০ বছরের পুরনো সাম্রাজ্যে ফাটল দেখা দিল। তিনটি ধনী ও জনবহুল প্রদেশ— অবধ, বাংলা, হায়দ্রাবাদ— কার্যত স্বাধীন রাজ্যে রূপান্তরিত হল। পশ্চিম মহারাষ্ট্রে মারাঠা সেনাধিপতিরা মধ্য ভারতের মোগল প্রদেশ বেরার, বুন্দেলখণ্ড ও মালোয়ার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করল। পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে ছোটবড় এলাকায় রাজপুত ও নায়ক প্রধানরা স্বাধীন রাজ্য তৈরি করে নিল। এই রাজনৈতিক টালমাটাল ভারতে ইংরেজ শাসনের উত্থানের পেছনে একটা বড় কারণ তাতে সন্দেহ নেই, যদিও কার্যকারণ সম্বন্ধ নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি।
এটুকু বলা যায় যে অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে কোম্পানি ভারতের রাজনীতিতে জড়াতে না চাইলেও একেবারে নির্লিপ্ত থাকাও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষ ভাগে তিন বার কোম্পানির সঙ্গে মোগলদের গন্ডগোল বাধে— বম্বের জলদস্যুদের নিয়ে, কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ নিয়ে, আর প্রতিযোগী লন্ডন কোম্পানির সঙ্গে রেষারেষি নিয়ে। শেষোক্ত ঘটনার সময় ঔরঙ্গজেবের নাতি আজিম-উস-শান বাংলার শাসনকর্তা (সুবাদার)। নিজে যোগ্য সেনাধিপতি, এবং দারুণ আত্মপ্রত্যয়ী, আজিম-উস-শান প্রথমে দুই কোম্পানির কাছ থেকেই প্রচুর ঘুষ নিলেন। দুই দলকেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল যে বিপক্ষ দলকে বাড়তে দেওয়া হবে না। তারপর স্থির করলেন দুটোকেই তাড়িয়ে দিয়ে নিজে একচেটিয়া ব্যাবসা শুরু করবেন। এই গোলমালের মধ্যে পুরনো কোম্পানি গোপনে দিল্লির দরবারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াবার চেষ্টা শুরু করে, ও নিঃশব্দে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে থাকে। হঠাৎ দিল্লিতে গদি খালি হওয়ায় আজিম-উস-শান ব্যাবসার মতলব ছেড়ে দিয়ে দিল্লি রওনা দিলেন। ক্ষমতার লড়াই শুরু না হলে ব্যাপারটা আরও গড়াত।
বাইরের ঘটনা ছাড়াও, কোম্পানির ভিতরকার কাঠামোর মধ্যেও এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল যার থেকে রাজনৈতিক ব্যাপারে নাক গলানোর প্রবণতা বাড়তে থাকে। প্রাইভেট ব্যবসায়ীর ভূমিকায় কোম্পানির কর্মচারীদের সঙ্গে ভারতীয় শাসক, বণিক ও জমিদারদের নিয়মিত মোলাকাত হত। এইসব উচ্চপদস্থ ও উচ্চাভিলাষী কর্মচারীরা স্থানীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝত লন্ডন সদর দফতরের থেকে অনেক বেশি। তাদের নিকট বন্ধু ছিল সেইসব সেনাধ্যক্ষরা যাদের ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো হয় বোম্বাই, মাদ্রাজ ও কলকাতার ইংরেজ নাগরিকদের রক্ষা করার জন্যে। সামাজিক দিক দিয়ে এই দুই শ্রেণি লন্ডন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তুলনায় পরস্পরের কাছাকাছি। এদের পক্ষে নিজেদের সমৃদ্ধি ও ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যৌথ উদ্যোগ নেওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। ১৭৪০-এর পরে এই স্থানীয় নেতাদের নেওয়া অনেক সিদ্ধান্তেই লন্ডনের সায় ছিল না।
সে যাই হোক, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি ভারতের জোড়াতালি দেওয়া স্থিতাবস্থা নষ্ট হওয়ার পেছনে তাৎক্ষণিক ভূমিকা নেয় ইউরোপে ইংরেজ- ফরাসি যুদ্ধ।
কর্ণাটকের নাটক
পশ্চিম ইউরোপের প্রধান ব্যাবসাদার দেশগুলির মধ্যে ফরাসিরা সবথেকে পরে ভারতে ঘাঁটি গাড়ে। ১৬০৪ সালে তাদের সর্বপ্রথম উদ্যোগ নিজেদের মধ্যে মারামারির কারণে ব্যর্থ হয়। ১৬১৫ সালে দ্বিতীয় উদ্যোগ ব্যর্থ হয় ডাচ নাবিকদের উপর বেশি নির্ভরশীল হওয়ার কারণে। পরবর্তী বিশ বছরের প্রচেষ্টা মাদাগাস্কারে একটি ট্রেডিং ঘাঁটি গড়ে তোলে, তবে তার ফলাফল লাভজনক কিছু হয়নি। তা হলেও, মরিশাস, রেয়ুনিয়ঁ ও মাস্কারেনা দ্বীপগুলিতে— উত্তরকালে ইল-দ্য-ফ্রাঁস— ফরাসি উপনিবেশ গড়ে ওঠে। যখন আবার ১৬৪২ সালে একটি ফরাসি ইন্ডিয়া কোম্পানি পুনর্গঠিত করা হল, মাদাগাস্কার ছিল প্রধান লক্ষ্য, দাসব্যাবসার জন্য সম্ভাব্য বন্দর হিসেবে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে মারাত্মক শত্রুতা ছাড়া এই উদ্যোগ থেকে বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি।
১৬৬১ সালে জাঁ-বাতিস্ত কলবেয়ার ফরাসি কোষাগারের হাল ফেরাতে সচেষ্ট হলেন। নিজে ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কার হওয়ার দৌলতে কলবেয়ার বুঝতেন নৌবল বাড়ানো আর সামুদ্রিক ব্যাবসা বাড়ানোর মধ্যে সম্বন্ধ কতটা নিকট। ১৬৬৬ সালে এঁরই উৎসাহে নতুন একটি কোম্পানি গড়ে তোলা হল। পরের বছর তাঁদের প্রথম ভারতযাত্রা।
পরবর্তী পাঁচ-ছয় বছরে কয়েকটি ঘটনা ভারতে ফরাসি উপস্থিতি সুদৃঢ় করে। ১৬৭২ সালে মাদাগাস্কারে এক ভয়াবহ গণহত্যা থেকে পালিয়ে বেঁচে আসা ফরাসি লোকজন ভারতে কাজেকর্মে যোগ দেয়। এবং যদিও ডাচদের তাড়া খেয়ে অনেক জায়গায় দুর্গ বানাবার আশা ছেড়ে পালাতে হয়, শেষ পর্যন্ত তারা পণ্ডিচেরিতে ফ্রান্সিস মার্টিনের নেতৃত্বে দুর্গ ও উপনিবেশও গড়ে তোলে। ১৬৮৮ সালে চন্দননগরে উপনিবেশ শুরু। ১৭৪০ নাগাদ ভারত মহাসাগর অঞ্চলে ফরাসি উপনিবেশ বলতে ইল-দ্য-ফ্রাঁস, পণ্ডিচেরি, চন্দননগর ছাড়াও বোঝাত পূর্ব উপকূলে কারাইকাল ও মালাবার উপকূলে মাহে।
যখন ইংরেজ ও ফরাসিরা অস্ট্রিয়ান উত্তরাধিকার যুদ্ধে (১৭৪০-৪৮) বিরুদ্ধ পক্ষে যোগ দেয়, তখন দুই ফরাসি মহারথী ভারত মহাসাগর রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ১৭৪২ সালে জোসেফ ফ্রাঁসোয়া দুপ্লে ভারতে ফরাসি রাজত্বের কর্তা নিযুক্ত হন। আঠারো বছর বয়সে জমিদার বাড়ির ছেলে দুপ্লে ফরাসি কোম্পানির জাহাজে কাজ নিয়ে বিদেশ যাত্রা করেন। ব্যাবসায় সাফল্য অর্জন থেকে রাজনীতিতে প্রবেশ। কিছু দিনের জন্য বাংলায় সর্বেসর্বা হয়ে কাটানোর পর দুপ্লে সারা ভারতের ভার নিলেন। দুপ্লের নেতৃত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য ভারত থেকে ইংরেজদের তাড়ানোর অদম্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সারা ভারতের কর্তা হয়ে তাঁর প্রথম কাজ হল সেনাবাহিনী ঢেলে সাজানো। অস্ট্রিয়ান উত্তরাধিকার যুদ্ধের সময় দুপ্লে ভারতে বন্ধু জোগাড় করে ইংরেজ-বিরোধী জোট বানাবার উপায় খুঁজলেন। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বেরত্রা-ফ্রাঁসোয়া মাহে দ্য লা বুৰ্দনে, ১৭১৮ থেকে ১৭২৪ পর্যন্ত দক্ষ, সাহসী, সফল জাহাজি অফিসার হিসেবে খ্যাত, এবং ১৭৩৫ সাল থেকে ইল-দ্য-ফ্রাঁসের গভর্নর। ফরাসি উচ্চাশার পেছনে দুপ্লে জোগালেন কূটনীতি, লা বুর্দনে সামুদ্রিক যুদ্ধের সেনাপতিত্ব।
এই দুটি রেখা, দুপ্লে এবং লা বুর্দনে, যুক্ত হল কার্নাটিকে এসে। কার্নাটিক ছিল বর্তমান তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটকের সীমানায় একটি ছোট রাজ্য। বিগত ষাট বছরে এই অঞ্চলে তেলুগু নায়ক, গোলকোন্ডা, বিজাপুর ও মারাঠাদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ের শেষে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের এক সামন্ত রাজার শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৭৪০ সালে এই রাজপরিবারে গদি নিয়ে ঝগড়া বাধল। যদিও কার্নাটিকের নিজের আয় খুব কম, এবং ব্যাবসার অবস্থাও তেমন কিছু নয়, প্রতিবেশী হিসেবে ইংরেজ ও ফরাসি দুই তরফের কাছেই এই রাজ্যের গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট। কার্নাটিকের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর এই সুযোগও ছাড়া যায় না। তার উপরে ইউরোপে যুদ্ধ চলছে। অতএব দুই ইউরোপীয় শক্তি ঝগড়ায় যোগ দিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করল। ফরাসিদের প্রেরণা দুপ্লের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎবাণী এবং লা বুর্দনের যুদ্ধকৌশল। আর ইংরেজ পক্ষে?
১৭৪৬ সাল থেকে ১৭৪৮ সাল পর্যন্ত সময় ইংরেজ পক্ষ পিছু হটতে বাধ্য হয়। এমনকী মাদ্রাজ থেকে পালিয়ে পণ্ডিচেরির কয়েক মাইল দক্ষিণে ফোর্ট সেন্ট ডেভিড নামে নতুন উপনিবেশ তৈরি করতে হল। ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠার পরে মাদ্রাজ ফিরে পাওয়া গেল বটে, কিন্তু ততদিনে স্থানীয় নেতারা বুঝে ফেলেছে যে তাদের ভালমন্দ নির্ভর করবে নিজেদের বাহুবলের উপরে, লন্ডনের কর্মকর্তারা বিপদে রক্ষা করতে আসবে না। কাজেই তাদের সতর্ক নির্দেশের উপর বেশি গুরুত্ব দিলে চলবে না। রবার্ট ক্লাইভ নামে মাদ্রাজের এক ছোকরা কেরানি কার্নাটিকের এই প্রথম লড়াইয়ে বিশেষ সাহসের পরিচয় দেয়। ক্লাইভের প্ররোচনায় মাদ্রাজ গোষ্ঠীর স্বায়ত্বশাসনের ইচ্ছে আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
১৭৪৮ সালে আবার সিংহাসন-বিতর্ক চাগিয়ে উঠল। এবার ইংরেজরা পক্ষ নিল মহম্মদ আলি নামে এক দাবিদারের, আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী চন্দা সাহেবের দল ফরাসিদের সাহায্য পেল। ইংরেজ কোম্পানি বালক রাজকুমার মহম্মদ আলির দেখভালের জন্যে তাকে মাদ্রাজে একটি জায়গির দান করল। জায়গিরের পরিধি যদিও দুটো গ্রামে সীমাবদ্ধ, লন্ডনে মাদ্রাজ অফিসের এই উদারতা এবং ঝগড়ায় যোগদানের নীতির ভয়ানক সমালোচনা হল। কিন্তু ততদিনে জল অনেক দূর গড়িয়েছে।
১৭৪৯ থেকে ১৭৫৪ সালের মধ্যে তিরুচিরাপল্লির কাছে সংঘটিত কতগুলি এলোমেলো লড়াইকে দ্বিতীয় কার্নাটিক যুদ্ধ আখ্যা দেওয়া হয়। লড়াই হয় দুই ইউরোপীয় অধিনায়ক এবং দুই পক্ষের ভাড়াটে সৈন্যদের মধ্যে। এই লড়াইয়ের শেষে ফরাসি দলের হার হলে মহম্মদ আলি ‘ওয়ালাজা’ উপাধি নিয়ে কার্নাটিকের রাজা ঘোষিত হলেন। অঘোষিত রাজা অবশ্য রবার্ট ক্লাইভের বন্ধুরা।
ভারতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ গড়তে কার্নাটিক যুদ্ধের গুরুত্ব খুব বেশি নয়। কিন্তু এই যুদ্ধই যে মাদ্রাজে কোম্পানির চরিত্র একদম বদলে দেয় তাতে সন্দেহ নেই। বিচক্ষণ দুপ্লে কিন্তু এই বদল দেখে দমে যাননি। বরং তিনি সিদ্ধান্তে এলেন যে ইংরেজ কোম্পানি যত ঝুঁকি নেবে তত তাড়াতাড়ি ধ্বংসের পথে এগোবে। আনন্দরঙ্গ পিল্লাইকে বললেন, ‘ইংরেজ কোম্পানির সর্বনাশ আসন্ন; এদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ, নিজেদের মূলধন যা ছিল সব এমন এক রাজাকে ধার দিয়ে বসে আছে যার রাজত্ব শেষ হতে দেরি নেই। দেখবেন, আমার কথা সত্যি না হয়ে যায় না।’ ১৭৫০-এর কাছাকাছি এই সিদ্ধান্ত একেবারেই অস্বাভাবিক ছিল না। তবু, দুপ্লে এই হিসেবের ভুল না করলে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্য রাস্তায় যেতে পারত।
ইংরেজদের চরম আঘাত হানবেন বলে দুপ্লে তৈরি হলেন। দুই দলে তৃতীয় ও অন্তিম কার্নাটিক যুদ্ধ ঘটল ইউরোপে সাত বছরের যুদ্ধ (১৭৫৬- ৬৩) চলাকালীন। ক্লাইভ ইংরেজ পক্ষের অধিনায়ক। ফরাসি সেনাবাহিনীর অধ্যক্ষ আইরিশ-জেকোবিট বাবা-মার সন্তান টমাস আর্থার, বা কঁত দ্য লালী। ১৭৬০ সালে বান্দিবাসের যুদ্ধে ফরাসিদের হার হল। ১৭৬৩ সালে প্যারিসে যে সন্ধিচুক্তিতে সাত বছরের যুদ্ধ শেষ হয়, সেই চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনায় কোম্পানির লন্ডন অফিস আর মাদ্রাজ অফিসের মধ্যে বিরোধ স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল। কোম্পানির প্রতিনিধি ইংরেজরাজ। এই প্রথম ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইউরোপের কোনও আলোচনাসভায় এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্লাইভ পেশ করলেন একদফা দাবি, সে দাবি এমনই যা মানলে ভারতে ফরাসি কোম্পানির সামরিক ও বাণিজ্যিক ক্ষমতা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। কোম্পানির লন্ডন অধ্যক্ষ লরেন্স সালিভান পরাজিত দলের উপর এতটা আক্রমণাত্মক হওয়ার দরকারটা কী বুঝতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত ক্লাইভ জিতলেন। কিন্তু লন্ডনপক্ষ আর ক্লাইভপক্ষের মধ্যে যে তীব্র মনোমালিন্যের শুরু হল, তার জের এখানেই শেষ হল না।
ভারতে ফরাসিরাজ প্রতিষ্ঠার পেছনে যে তিন জন হিরোর অবদান সবথেকে বেশি— লা বুর্দনে, দুপ্লে, ও দ্য লালী— স্বদেশে ফিরলেন নিন্দা ও লাঞ্ছনা মাথায় নিয়ে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কোন দূর দেশে যুদ্ধ বাধিয়ে তাঁরা কোষাগার ও কোম্পানির টাকা নয়ছয় করেছেন। লা বুর্দনের সম্পত্তি হাতছাড়া হল, তাঁর জীবন শেষ হল জেলখানায় ও দারিদ্রের মধ্যে। দুপ্লেও সর্বস্ব হারিয়ে অখ্যাত ও গরিব অবস্থায় মারা যান। দ্য লালীর মৃত্যুদণ্ড হল।
কার্নাটিকের প্রক্সি যুদ্ধে ক্লাইভের সেনাপতিত্বের হাতেখড়ি। কার্নাটিকে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই বাংলায় প্রত্যক্ষ যুদ্ধে ক্লাইভের সেনাপতিত্বের চরম পরীক্ষা হয়ে গেছে।
ক্লাইভ (১৭২৫-১৭৭৪)
শপশায়ারের এক অভাবী জমিদার পরিবারে জন্ম রবার্ট ক্লাইভের। তেরো জন ভাইবোনের সবথেকে বড় দাদা। বাল্যকাল কাটে মাসির তত্ত্বাবধানে আর বোর্ডিং স্কুলে। ছেলেবেলায় বদনাম ছিল লেখাপড়ায় অমনোযোগী, বেজায় ডানপিটে এবং পাড়ার একদল মস্তান ছেলের সর্দার। এই তোলাবাজ ছোঁড়াদের উৎপাতে বর্ধিষ্ণু গ্রাম মার্কেট ড্রেটনের দোকানদাররা ক্লাইভের উপর খাপ্পা। এ রকম ছেলেদের তখনকার দিনে গতি ছিল বিদেশযাত্রা। আঠারো বছর বয়েসে কোম্পানির কেরানি হয়ে ক্লাইভ পাড়ি দিলেন মাদ্রাজে। কিন্তু জুনিয়র লেজার ক্লার্কের জীবনযাত্রার দুর্বিসহ একঘেয়েমি নিয়ে এল চরম অবসাদ এবং আত্মহত্যার ইচ্ছে। কেবল চরম সময়ে পিস্তলের ঘোড়াটা আটকে যাওয়ায় আত্মহত্যার চেষ্টা সফল হয়নি।
কার্নাটিকের যুদ্ধ এই হতাশ যুবকের জীবনে আশার আলো জাগিয়ে তুলল। যুদ্ধে এই ছোকরা কেরানির বেপরোয়া সাহসের পরিচয় পেয়ে মাদ্রাজের কর্তারা ক্লাইভকে কমিসারিয়েট বা সৈন্যবাহিনীর রসদ জোগান দেবার দপ্তরের ভার দিলেন। যুগে যুগে সাপ্লাই বিভাগের চাকরি ঘুষ খাওয়া ও পয়সা করার উৎকৃষ্ট উপায়। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না। মাঝেমাঝেই ডিপ্রেশনের আক্রমণ সত্ত্বেও ক্লাইভ বড়লোক হলেন, বিয়ে করলেন ও ১৭৫৩ সালে সস্ত্রীক দেশে ফিরলেন। ক্লাইভ সবে রাজনীতির জগতে পা ফেলছেন এমন সময় খবর এল ফোর্ট সেন্ট ডেভিডের গভর্নর পদ ক্লাইভকে দেওয়া হবে।
মাদ্রাজে দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খবর পৌঁছল কলকাতায় ইতিমধ্যে একটি ভয়াবহ গণহত্যা ঘটে গেছে। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার নেতৃত্বে এক সৈন্যবাহিনী ১৭৫৬-র জুন মাসে কলকাতা আক্রমণ করে শহর দখল করেছে এবং কয়েক জন নিরস্ত্র ব্রিটিশ আধিকারিক ও ব্যবসায়ীকে খুন করেছে। বাংলায় নবাব-কোম্পানি বিবাদ এতদূর গড়াল কী করে?
মোগল প্রদেশ বাংলায় সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু কোনও দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক বদলের সূত্রপাত করেনি। ঔরঙ্গজেবের সবথেকে দক্ষ প্রশাসকদের একজন, মুর্শিদকুলি খাঁ, নবাব হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, এবং ধীরে ধীরে দিল্লির দরবারের প্রতি সবরকম দায়দায়িত্ব পালন করা থেকে সরে আসছিলেন। ১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলির মৃত্যুর সময়ে বাংলা নামেই মোগল প্রদেশ, কার্যত স্বাধীন রাজ্য। ছোটখাটো ঘটনা বাদ দিলে এই পরিবর্তন ইংরেজদের বিশেষ ঝামেলায় ফেলেনি। বাংলার নবাবরা রাজস্ব বাড়ানোর চিন্তায় ব্যস্ত থাকতেন, মুর্শিদকুলির প্রধান মাথাব্যথা ছিল জমিদাররা, যাদের অনেকেই মোগল সাম্রাজ্য পতনের সময় ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল। তাঁর উত্তরাধিকারীরা পশ্চিম বাংলায় মারাঠাদের আক্রমণ নিয়ে হয়রান হয়ে উঠেছিল, ইংরেজদের নিয়ে ভাবনা করার সময় তাদের ছিল না।
অন্যদিকে ইংরেজরাও দরবারের বিশিষ্ট কর্মচারীদের খুশি রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিল। নবাব ও রাজকর্মচারীদের সহায়তা ছাড়া ব্যাবসার ব্যাপারে এক-পা এগোনো তাদের পক্ষে কঠিন হত। যেমন, আর্থিক ব্যবস্থার মাথা ছিল সরকারের প্রতিনিধি জগৎশেঠ নামক প্রতিষ্ঠান বা পরিবার, বড় লেনদেন ও মুদ্রাবিনিময়ের কাজে কোম্পানিকে এদের দ্বারস্থ হতে হত।
১৭৪০-এর দশকে বেরারের মারাঠাবাহিনী বাংলা আক্রমণ করল, উদ্দেশ্য বাংলার রাজস্বের একটা অংশ জোর করে আদায় করা। নবাব আলিবর্দি খাঁ এদের বারবার আক্রমণে জেরবার হলেও টাকা দিতে অস্বীকার করলেন। উচ্ছৃঙ্খল ভাড়াটে সৈনিকরা (বর্গি) গ্রামগুলিতে লুঠতরাজ শুরু করল, শস্যের গোলা ও দোকানদারদের বাড়িঘর তছনছ করল এবং গ্রামের মেয়েদের ধরে নিয়ে গেল। এই অত্যাচারের স্মৃতি বাংলার লোককাহিনিতে টিঁকে ছিল দুশো বছরেরও বেশি।
এই উপদ্রব বাংলার নবাবকে নাকাল ও দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের গ্রামের মানুষদের ক্ষতিসাধন করলেও কলকাতায় বিশেষ প্রভাব ফেলেনি। বরং বলা যায় এর ফলে কলকাতা শহর জনসংখ্যা, সম্পদ ও সামরিক শক্তি, সবদিক দিয়েই লাভবান হয়। অন্যান্য ইউরোপিয়ান বসতিগুলি ছিল হুগলি নদীর পশ্চিম পারে অবস্থিত, অর্থাৎ প্রায় মারাঠাদের রাস্তায়। কলকাতা পূর্ব পারে। এই বিশাল প্রাকৃতিক পরিখা ছাড়াও ছিল ‘মারাঠা ডিচ’ নামে শহরের দক্ষিণ-পূর্ব ধরে কাটা খাল, যা পরে বুজিয়ে তৈরি হয় সার্কুলার রোড।
১৭৫০ সালে এই শহরের পরিবেশ খুব মনোরম ছিল বলা চলে না। জলাজঙ্গলে ভরা, অতিশয় নোংরা, এবং রোগের ডিপো এই শহরে মৃত্যুর হার ছিল অত্যন্ত বেশি। এতটাই বেশি যে এক ডাচ আগন্তুক কলকাতার ডাকনাম রাখেন গলগোথা, যে পাহাড়ে যিশুখ্রিস্টকে হত্যা করা হয়। এত শ্রীহীনতা সত্ত্বেও কলকাতা হয়ে দাঁড়ায় সে যুগের সবথেকে নিরাপদ ব্যবসায়ী শহর। ১৭০৪ ও ১৭৫৬-র মধ্যে কলকাতা শহরের জমিদারি আয় ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে হয় ৩০০০ টাকা, জনসংখ্যা ১০০০০ থেকে ৪০০০০০ ও শহর অঞ্চলের পরিধি ৮০ থেকে বেড়ে ১৬০০ একরে দাঁড়ায়। নিরাপত্তার আকর্ষণে অনেক বাঙালি ব্যবসায়ী, কারিগর এবং শিক্ষিত এলিট লোকজন সপরিবারে কলকাতায় চলে আসে।
কোম্পানির জমিদারি আয় বৃদ্ধির কারণ ছিল নতুন বাজার প্রতিষ্ঠা, আবার জমিদারি আয় দিয়েই তৈরি হল আরও জোরদার নিরাপত্তা ও পুলিশি ব্যবস্থা। কলকাতাকে আর ঠিক কোম্পানির বসতি বলা যেত না, বাঙালি উদ্যোগ ও সংস্কৃতির কেন্দ্রও হয়ে উঠছিল কলকাতা। অনেক নামকরা আগন্তুকদের মধ্যে দু’জন বিশেষ উল্লেখযোগ্য, নবকৃষ্ণ দেব ও রামদুলাল দে। দু’জনেরই পরিবার পশ্চিম বাংলায় এবং তাঁদের সাবেক বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেয়। পরিণত বয়েসে নবকৃষ্ণ ছিলেন ইংরেজদের স্নেহধন্য দক্ষ রাজকর্মচারী এবং রামদুলাল হয়ে ওঠেন ব্যবসায়ী কলকাতায় আমেরিকান ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি। আরও অনেক নবাগত বাঙালি কলকাতার জমিদারির দেখাশোনার কাজে যুক্ত ছিলেন।
এই ভাবে, অষ্টাদশ শতকের চতুর্থ ও পঞ্চম দশকে বাংলার নবাবরা যতই দুর্বল হচ্ছিল, কলকাতায় কোম্পানি ততই শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠছিল। হঠাৎ ১৭৫৬ সালে দু’জনের সম্পর্কে চিড় ধরল। ঝগড়ার কারণ কিছু দিন ধরেই তৈরি হচ্ছিল। ইংরেজ ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরা কোম্পানির ছাড়পত্র ব্যবহার করে মালের উপর শুল্ক দিতে অস্বীকার করত। কোম্পানির উচ্চপদস্থ অফিসাররা অনেকেই এদের পৃষ্ঠপোষক বা পার্টনার ছিল। এই আঁতাতটাকে ভালমতো শিক্ষা দিতে নবাবের বাহিনী কলকাতা আক্রমণ করে।
সিরাজ কলকাতায় প্রবেশ করতেই শহরের ইউরোপিয়ান বাসিন্দারা যত নৌকা নদীতে বাঁধা ছিল সব ভাড়া করে দূরে মাঝনদীতে গিয়ে নোঙর বাঁধল, তাদের সঙ্গে কোম্পানির ক্যাশ বাক্সগুলি। কেবল ১৪৬ জন ইংরেজ কর্মচারী ও কিছু মহিলা, তাদের মধ্যে কয়েক জন আবার যুদ্ধে আহত, আত্মসমৰ্পণ করল। জুন মাসের অগ্নিদগ্ধ এক রাতে এই যুদ্ধবন্দিদের ঢোকানো হল ফোর্ট উইলিয়ামের মধ্যে ১৮ ফুট বাই ১৮ ফুট আয়তনের এক ঘরে, যার তিন দিক দেয়ালঘেরা আর একদিকে মোটামোটা লোহার শিকের বেড়া। বন্দিরা অনেক টাকা ঘুষ দিয়ে দুটো ঘরে থাকবার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করল। কোনও রহস্যজনক কারণে যারা পাহারায় ছিল তারা ঘুষ নিতে রাজি হল না। সকাল হতে দেখা গেল একশোরও বেশি বন্দি দমবন্ধ হয়ে, অন্যদের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে, বা পিপাসায় মৃত। ঘুম থেকে উঠে নবাব সিরাজ অন্যমনস্কভাবে বন্দিদের মৃত্যুর খবর শুনলেন। কিন্তু ক্যাশ বাক্স হাওয়া শুনে বেজায় খেপে গেলেন।
ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনার গুরুত্ব অপরিসীম। অনেকটা ১৭০ বছর পরে সংঘটিত ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’ হত্যাকাণ্ডের মতো, ‘অন্ধকূপ’ হত্যাকাণ্ড একটি ভঙ্গুর সম্পর্ক এক আঘাতে চুরমার করে দেয়। মিটমাট, দরাদরি বা মধ্যস্থতা— অর্থাৎ সাধারণত ব্যবসায়ীরা ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসার যেসব উপায় অবলম্বন করে থাকে— তার জায়গায় দেখা দিল প্রতিহিংসার প্রবৃত্তি। এতদিন ভারতে ইংরেজদের শত্রু বলতে ছিল ফরাসিরা। এবার একটি শক্তিশালী ভারতীয় রাজার সঙ্গে লড়াই আসন্ন হয়ে উঠল।
কলকাতা হাতছাড়া হওয়ার ছ’মাস পরে ক্লাইভ ও ভাইস অ্যাডমিরাল চার্লস ওয়াটসন এসে পৌঁছলেন হুগলি নদীর মোহানায়, মাদ্রাজের ১৪০০ জন সৈন্য সহ। ওয়াটসন ও ক্লাইভ পরস্পরকে ভীষণ অপছন্দ করতেন। ওয়াটসন ক্লাইভকে মনে করতেন সেনাপতির পোশাক পরা ফন্দিবাজ সিভিলিয়ান, আর ক্লাইভ মনে করতেন ওয়াটসন একজন অপদার্থ কূটনীতিক। তীব্র পরস্পরবিদ্বেষ সত্ত্বেও কী করে যে দু’জনে মিলে নিমেষের মধ্যে কলকাতা ফের দখল করে বসলেন তা বেশ বিস্ময়কর কাণ্ড। ওয়াটসনের কাছে এটাই গল্পের ইতি। ক্লাইভ অবশ্য ক্ষান্ত দেওয়ার লোক ছিলেন না। ক্লাইভ খোঁজখবর করে ঠিকই জেনেছিলেন যে ছোকরা নবাব সিরাজের অবস্থা নড়বড়ে। গোঁয়ার্তুমি করে অনেক বন্ধু হারিয়েছেন, তাদের মধ্যে সবথেকে বিপজ্জনক হল দরবারের কাছের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। ক্লাইভ গোপনে এদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন।
এদের মধ্যে সবথেকে ক্ষমতাশালী মধ্যস্থ ছিলেন আমিরচাঁদ, বাংলায় কোম্পানির দালালদের মধ্যে অগ্রগণ্য। আমিরচাঁদের সাহায্য মূল্যবান হলেও তাঁর ইংরেজ বন্ধুরা লোকটিকে একেবারেই বিশ্বাস করত না। যে রাতে সিরাজের বাহিনী কলকাতা দখল করে, আমিরচাঁদ নিজেও জেলখানায় ছিলেন। সিরাজ তাঁকে মুক্তি দেওয়ার কথাটা কোনও কারণে ভুলে গিয়েছিলেন। যে কতিপয় ইংরেজ ফোর্ট উইলিয়ামের অন্ধকূপ থেকে বেঁচে বেরিয়ে আসে, তারা পাহারাওয়ালাদের মুখে গুজব শোনে যে বন্দিদের ওই ছোট্ট খাঁচাটিতে পোরা হয় আমিরচাদের হুকুমে। তা সত্ত্বেও, আমিরচাঁদ মুর্শিদাবাদের দরবারে এতটাই প্রতিপত্তিশালী যে ইংরেজদের এঁকে ছাড়া চলত না। সিরাজের শত্রুদের সংগঠিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমিরচাঁদ ক্লাইভের কাছে চাইলেন সিরাজের তোষাখানার ৫ পার্সেন্ট বখরা, আর সেই ষড়যন্ত্রে রাজি না হলে ভয় দেখালেন যে সব ফন্দি নবাবকে জানিয়ে দেওয়া হবে। ক্লাইভ আরও অনেকের মতোই বিশ্বাস করতেন যে আমিরচাঁদ হাড় স্বার্থপর এবং সুযোগ পেলেই নবাবের আশ্রয় নিয়ে কোম্পানির গলা কাটবেন। অতএব হেসে ৫ পার্সেন্ট তোলা দিতে রাজি হয়ে নিয়মমাফিক একটি হলফনামায় সই করলেন। ইংরেজদের আইনকানুনে অনভিজ্ঞ আমিরচাঁদ টের পেলেন না যে চুক্তিতে ওয়াটসনের সইটা জাল। পলাশির যুদ্ধের পরে আমিরচাঁদ যখন জানতে পারলেন যে চুক্তিটা নকল, তখন ৫ পার্সেন্টের শোকে ভদ্রলোকের মাথা খারাপ হয়ে যায়।
সিংহাসনের সম্ভাব্য দাবিদারেরা এবং কতিপয় অনুগত সেনাধিপতি বাদ দিলে প্রায় সবকজন প্রধান রাজকর্মচারী ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পেয়ে ক্লাইভ সদলবলে মুর্শিদাবাদের দিকে চললেন। ১৩ জুন, ১৭৫৭ পলাশির মাঠে যে যুদ্ধ হল, তাতে নবাবের দল নামেমাত্র বাধা দেয়। বন্ধু ও আত্মীয়দের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের হার হল।
বিজয়ী বাহিনী মুর্শিদাবাদ পৌঁছল পরদিন। সিরাজ শহর ছেড়ে পালিয়েছেন। (কয়েক দিন পরে তাঁকে নদীর কাছে ধরে ফেলে হত্যা করা হয়)। দরবার ডাকা হল ১৪ জুন দুপুরে। ক্লাইভ সিরাজের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মিরজাফরের হাত ধরে নিয়ে গেলেন সিংহাসনের কাছে, তারপর তাঁকে গদিতে বসিয়ে দিয়ে কয়েক পা পিছু হটে ঘাড় হেঁট করে নতুন নবাবকে কুর্নিশ করলেন।
এই সব গুরুগম্ভীর অনুষ্ঠান শেষ হলে ইংরেজ অফিসাররা চলল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য সাধন করতে, নবাবের তোষাখানার সন্ধানে। আনুমানিক ২০ লক্ষ পাউন্ড তারা নবাবের কোষাগার থেকে পারিশ্রমিক হিসেবে পায়, বা নিয়ে নেয়। তবে সিরাজের খাস মহলের একটি গোপন কুঠরির কথা ইংরেজরা জানতে পারেনি। গুজব শোনা যায় যে সব গোলমাল সমাপ্ত হলে, রাতের অন্ধকারে চার জন ভারতীয় চক্রান্তকারী, যাদের মুখ্য ছিলেন নবকৃষ্ণ দেব ও মিরজাফর, সেই ঘরে ঢোকেন ও ৮০ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের রত্ন, স্বর্ণমুদ্রা ও মুক্তো সরিয়ে ফেলেন।
আরও তিন বছর ক্লাইভ ভারতে ছিলেন, এখন তাঁর খেতাব ‘ব্যারন অফ প্ল্যাসি’। এই তিন বছরে কয়েক লক্ষ পাউন্ড অর্থ তিনি দেশে পাঠান, ডাচ কোম্পানির চালান ও গোলকোন্ডার হিরে কিনে।
বাংলা তথা কোম্পানির ইতিহাসে এবার শুরু হল কলঙ্কময় একটি পর্যায়, যা মোটামুটি ১৫ বছর স্থায়ী হয়। বাংলায় এই সময়ে কোনও কার্যকরী শাসক ছিল না। ইংরেজরা নবাবের মুরুব্বির জায়গা নেয় অথচ নিজেরা শাসনব্যবস্থার পুরো দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। ক্লাইভ ও তাঁর সবথেকে বিশ্বস্ত ও কর্মঠ অফিসার হেনরি ভ্যান্সিটার্ট রাজকার্য দেখাশোনা করতেন। কোম্পানির উপর ভার ছিল প্রতিরক্ষার। বিনিময়ে বাংলার রাজস্বের একটা অংশ তাদের প্রাপ্য ছিল। সুযোগসন্ধানী ইংরেজ ব্যবসায়ীরা বাংলার প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে গেল। কোম্পানির নামে ব্যাবসা চালাতে লাগল, অর্থাৎ কোনও ট্যাক্স দেওয়ার নাম না করে ও দরকার হলে সাধারণ মানুষদের ভয় দেখিয়ে, হয়রানি করে। নতুন নবাব ছিলেন পাকা আফিমখোর, কিন্তু রাজকার্যে নির্লিপ্ত। তাঁর মুরুব্বিরাই শেষে এই অরাজকতা দেখে ভয় পেতে শুরু করল। রাজকোষে যদি টাকা না আসে তা হলে কোম্পানি খাবে কী?
১৭৬০ সালে ভ্যান্সিটার্ট সগর্বে ঘোষণা করলেন যে বাংলায় বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। মানে মিরজাফরকে হটিয়ে আর এক দাবিদার মিরকাসিমকে সিংহাসনে বসানো হয়েছে। মিরকাসিমের ধ্যানধারণা ও জীবন নিয়ে বিশেষ কিছু জানা যায় না। নিঃসন্দেহে তিনি অনেক দিক দিয়ে যোগ্য শাসক ছিলেন। তাঁর উচ্চাশাও ছিল অনেক। কার্যকলাপ দেখে মনে হয় তিনি চেয়েছিলেন মুর্শিদকুলির মতো জমিদারদের পকেট থেকে আরও রাজস্ব আদায় করে সে টাকা দিয়ে সরকারি সেনাবাহিনীর উন্নতিসাধন করতে। ভ্যান্সিটার্টের সম্মতি থাকলেও, এই রাস্তায় নিশ্চিন্তে হাঁটা সম্ভব ছিল না। এক, রাজস্ব বাড়াতে হলে প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের বাগে আনতে হবে। আর দুই, সেনাবাহিনী বাড়াতে গেলে কোম্পানির এক অংশের সন্দেহ উদ্ৰেক করা হবে।
আগামী বছর দুই অস্বস্তি বেড়েই চলল। বিস্ফোরণ ঘটল ১৭৬৩ সালে, যখন মিরকাসিমের বিরুদ্ধ দলের এক ইংরেজ অফিসার খুন হলেন মুর্শিদাবাদে। সংঘর্ষ আসন্ন। মরিয়া হয়ে নবাব সাহায্য চাইলেন উত্তর ভারতের নড়বড়ে রাজাদের কাছে। মোগলসম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ও অবধের নবাব এগিয়ে এলেন। সারা উত্তর ভারত জুড়ে তখন কোম্পানির অভিসন্ধি নিয়ে রাজাদের মনে ভয়ানক দুশ্চিন্তা। কিন্তু যুদ্ধে অনভ্যস্ত আর আত্মগৌরবে ভরপুর এইসব রাজাদের চেষ্টায় যে সেনাবাহিনী তৈরি হল তার ঠিকঠাক নেতৃত্বই ছিল না। কাটোয়া, গিরিয়া, উধুয়ানালা (১৭৬৩) ও সবশেষে বক্সারের যুদ্ধে (১৭৬৪) হার হতে উত্তরের জোট কোম্পানির সঙ্গে সন্ধি করল।
মোগলসম্রাট মুখ বাঁচানোর উপায় করলেন কোম্পানিকে বাংলা-বিহার- উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের প্রতিনিধিত্ব দান করে। বলাই বাহুল্য এই রাজস্বের কিছুই দিল্লিতে পাঠানো হবে না। তবে বিনিময়ে সম্রাট কিছু টাকা পেলেন ও মাঝেমাঝে আরও পকেট-মানি পাবার আশা রাখলেন। পকেট-মানি যদিও বন্ধ হয় দশ বছর পরে, বৃদ্ধ মোগলসম্রাট কোম্পানির বন্ধু হয়ে গেলেন। জীবনের শেষ কয়েকটা বছর তিনি ইউরোপিয়ান জীবনযাত্রার অনেক উপকরণ তারিফ করতে শিখলেন। মিরকাসিম শেষ জীবন কাটান সম্ভবত অবধে, দারিদ্রের মধ্যে।
লুঠ
বান্দিবাস যেমন মাদ্রাজে, বক্সার তেমনি বাংলায় কোম্পানির চরিত্র পুরোপুরি বদলে দিল। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। মোগল সম্রাটের সার্টিফিকেট তাদের দেওয়ানি, সামরিক ও বিচারসংক্রান্ত ক্ষমতার অধিকার এনে দিল। কীভাবে এই ক্ষমতার ব্যবহার হল?
পলাশির অব্যবহিত পরে রাজস্বের এক অংশ দিয়ে কেনা হত কোম্পানির রপ্তানির মাল। অর্থাৎ চাষিদের পকেট থেকে টাকা নিয়ে দেওয়া হত তাঁতিদের বিক্রিত মালের দাম। পুরোটাই কোম্পানির লাভ। এই ব্যবস্থা শুরু হতে কোম্পানির লন্ডন অফিসের লোকজন আশান্বিত হল যে এবার আর ভারতে রুপো পাঠাতে হবে না। রুপো আমদানি সত্যিই অনেক কমে যায়। তবে এ বিষয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা (বিশেষ করে হিউ বোওয়েনের কাজ) থেকে দেখা যায় যে এই আশা পুরোপুরি মেটেনি। কোম্পানিকে প্রচুর পরিমাণে রুপো আমদানি করে চলতে হয়, কারণ তখন ব্যাবসার কেন্দ্র ভারত থেকে চলে যাচ্ছে চিনে। তা ছাড়া প্রাইভেট ব্যবসায়ীরাও রুপো আমদানি করে চলে, যার পরিমাণ সঠিকভাবে জানা যায়নি। এ ছাড়া এই সময় থেকেই ব্রিটিশ পণ্যের বাজার ভারতে বাড়তে থাকে, বিশেষ করে লোহার তৈরি জিনিস, কামান, বন্দুক ইত্যাদি। ধারকর্ডের বাজারও কোম্পানি সরকার শুরু হওয়ায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। কাজেই চাষির পকেট মেরে ও রুপোর আমদানি বাঁচিয়ে ব্যাবসা চালানোর পর্যায় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
রাজস্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কোম্পানি একটি অনেক দিনের সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট হয়, সমস্যাটি হল তাঁতিদের সঙ্গে চুক্তি বলবৎকরণের। ইংরেজরা ক্ষমতা বিস্তারের সঙ্গে চালু করে কাপড় কেনাবেচায় নতুন ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। দালাল, বেনিয়ান, এজেন্ট জাতীয় স্বাধীন প্রতিনিধিদের জায়গায় মাইনে-করা কর্মচারীদের নিযুক্ত করা হল। এই সব অফিসারদের হাতে কিছু পুলিশি অর্থাৎ জোর-জবরদস্তি করার ক্ষমতা তুলে দেওয়া হল। সেই ক্ষমতার যথেচ্ছ অপব্যবহারও চলতে লাগল। ঘুষের প্রচলন বাড়ল।
অন্যদিকে বাংলায় অরাজকতা বেড়েই চলেছে। জমিদাররা বিদ্রোহ করার জন্যে মুখিয়ে আছে। সৎ অফিসারের একান্ত অভাব। কোম্পানির ভিতরে একটা বড় দল সুযোগের অপেক্ষায় আছে কবে আবার ক্লাইভের মতো একটা দাঁও মারা যাবে, অর্থাৎ ধনী সম্ভ্রান্ত লোকেদের ভাণ্ডার ঘেঁটে ধনরত্ন নিয়ে ‘ন্যাবোব’ হয়ে দেশে ফিরে যাওয়া যাবে। কোম্পানির বঙ্গবিজয়কাণ্ড ইংল্যান্ডে প্রথম-প্রথম বাহবা পেলেও পরে একটা স্ক্যান্ডাল হয়ে দাঁড়াল। লন্ডনে কোম্পানির শেয়ারের দাম বারবার পড়তে লাগল, বেশ কয়েক জন প্রতিপত্তিশালী পার্লামেন্টের সদস্য ক্ষতিগ্রস্ত হল। ১৭৭০ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এই অর্থগৃধ্ন ও অপদার্থ রাজত্বের মুখোশ খুলে দিল।
ক্লাইভের স্বল্পস্থায়ী রাজত্বে ও পরবর্তী নেতা হ্যারি ভেরেলস্টের আমলে প্রশাসনের উন্নতি করার চেষ্টা করা হয়, তবে সে চেষ্টার পিছনে উদ্যম ছিল না। ভেরেলস্ট নিজে এককালে ছিলেন ব্যবসায়ী। গভর্নর হওয়ার পরে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যাপারে যে সব কথাবার্তা বলতেন তা কারও কাছেই খুব বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। ভেরেলস্ট-এর অনেক সমালোচকদের একজন, এককালে কোম্পানির কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস লন্ডনে বই ছাপালেন বাংলার অপশাসন ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে। বইটি বেরতেই ভেরেলস্ট খেপে গিয়ে বই লিখলেন প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্যে। ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে দু’জনে চাপান-উতোর চালু রাখলেন। ঝগড়া শেষ পর্যন্ত মামলায় গিয়ে দাঁড়াল। মামলা করে দুই ব্যক্তিই ফতুর হয়ে যান। এই মামলা থেকে প্রশাসনে কোনও পরিবর্তন এল না। শুধু বাংলার অপশাসন ইংল্যান্ডে একটা গল্পগুজবের বিষয় হয়ে ওঠে।
এক দিক দিয়ে দেখলে ভেরেলস্টের দূরদর্শিতা মানতে হয়। ইনিই প্রথম কীভাবে ইংরেজদের দ্বারা ভারত শাসন করা উচিত এই বিষয়টি নিয়ে সাধারণে আলোচনার সূত্রপাত করেন। ভেরেলস্ট পরোক্ষ রাজত্ব সমর্থন করেন, যার সূত্র হল ভারতীয়দের হাতে সিভিল আইন তুলে দেওয়া ও তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা রক্ষা করা। ভেরেলস্ট-এর সুপ্রসিদ্ধ উত্তরাধিকারী ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৩২-১৮১৮) এই ধারণাকেই সুস্পষ্ট রূপ দিলেন।
হেস্টিংস
বাংলার গভর্নর (১৭৭২-১৭৭৩) এবং ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর-জেনারেল (১৭৭৪-১৭৮৪) হেস্টিংসের নেতৃত্ব দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দুটি কিছুটা পরস্পরবিরোধী। প্রথমত, হেস্টিংস প্রশাসনের হাল ধরেন, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন, ও প্রশাসনের একটা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি করার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, নিজের স্বজনপোষণ ও অন্যায় কার্যকলাপের কারণে একটি বিরুদ্ধ দলের হাত শক্ত করেন, যাদের তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য ছিল হেস্টিংসের পেছনে লাগা, দীর্ঘস্থায়ী উদ্দেশ্য ছিল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের হাতে ভারত শাসনের রাশ তুলে দেওয়া। দুই ভাবেই হেস্টিংসের রাজত্ব ভারতে কোম্পানির রাজ শেষ করে সাম্রাজ্যবাদ চালু করল বলা চলে।
পাদরির সন্তান হেস্টিংসের বাবা অল্পবয়েসেই ছেলেকে পরিত্যাগ করেন। হেস্টিংস শিক্ষা শুরু করেন কাকার তত্ত্বাবধানে লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার স্কুলে। কাকার অকালমৃত্যুতে শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে হেস্টিংসকে কাজ নিতে হল কোম্পানির ‘রাইটার’ হিসেবে (১৭৫০ সালে)। বাংলায় তাঁর কর্মজীবনের প্রথম কয়েক বছর চরিত্র গঠনে বিশেষ ভূমিকা নেয়। হেস্টিংস নবকৃষ্ণর কাছে ফারসি শিখলেন। দু’জন প্রায় সমবয়সি হওয়ায় তাঁদের মধ্যে নিকট বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ফলে হেস্টিংস পরিণত বয়সে পৌঁছলেন ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজ সম্বন্ধে গভীর ব্যক্তিগত পরিচয় ও ভালবাসা নিয়ে। ১৭৬০-এর বাংলায় এই সমাহার দুর্লভ ছিল।
পলাশির ষড়যন্ত্রের সময়ে হেস্টিংস সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৭৫৮ সালে তাঁর কাজে খুশি হয়ে ঊর্ধ্বতনরা তাঁকে মুর্শিদাবাদে ‘রেসিডেন্ট’ করে পাঠালেন। মুর্শিদাবাদে তখন দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে, হেস্টিংস ভ্যান্সিটার্টের সঙ্গে মিলে মিরকাসিমের মুরুব্বিদের দলে ভিড়লেন। কিন্তু ১৭৬৩ সালে যখন মিরকাসিমের সঙ্গে কোম্পানির ঝগড়া চরমে, মুর্শিদাবাদে হেস্টিংসের জীবন সংশয় হয়ে উঠল।
টানা তিন দিন নবাবের পেয়াদা হেস্টিংসকে খুঁজে চলল। ওই তিন দিন হেস্টিংস লুকিয়ে রইলেন বাঙালি বন্ধু কান্তবাবুর জমিতে এক অন্ধকার কুঁড়েঘরে, তাঁর খাদ্য ছিল পান্তাভাত আর চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি। শেষ পর্যন্ত শত্রুপুরী থেকে বেঁচে বেরলেন বটে, কিন্তু এই ঘটনা হেস্টিংসের জীবনে দুটো বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে। অনুগত বিশ্বাসী কর্মচারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করার ব্যাপারে বরাবর অটল ছিলেন। আর আজীবন পান্তাভাত ও মেঠো স্টাইলে রান্না ঝাল চিংড়ির ভক্ত ছিলেন।
কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই হেস্টিংসকে ভ্যান্সিটার্ট-বিরোধী দলের আক্রোশের সামনে পড়তে হয়। দেউলে অবস্থায় অপদস্থ হেস্টিংস ইংল্যান্ডে পাড়ি দিলেন। ইংল্যান্ডে তখন কোম্পানির রাজ নিয়ে কৌতূহল বাড়ছে। হেস্টিংস বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল ভবিষ্যতে ভারতে ইংরেজ শাসন কেমন হওয়া উচিত। একদিকে বাংলা এখন ব্রিটেনের একটি প্রদেশ, কাজেই এখানে আর কোম্পানির জোড়াতালি দেওয়া শাসন চলবে না, বরং এখন প্রয়োজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ সরকারি অফিসার। আবার অন্যদিকে, বাংলা ব্রিটেনের অন্যান্য প্রদেশের মতো নয়। এখানে একটা স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও শাসনিক ঐতিহ্য আগে থেকেই বজায় আছে। অতএব যেটা দরকার সেটা হল এমন একদল দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রশাসক যারা ফারসি, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা শিখে ভারতীয় প্রথাগত আইন শিখে রাজ্য চালাতে প্রস্তুত। বক্তৃতায় লোক হত। হেস্টিংসের বক্তব্য অনেককেই ভারত শাসন নিয়ে ভাবাল।
১৭৭২ সালে হেস্টিংসকে ভারত শাসনের ভার দেওয়া হল। প্রায় দশ বছর পরে বাংলায় ফিরে এসে হেস্টিংস তাঁর পরিকল্পনামাফিক শাসনব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে শুরু করলেন। বিচারব্যবস্থায় ভারতীয় আইনের সংপ্রবেশ ঘটল। স্থানীয় রাজা-জমিদারদের ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি বজায় হল। নিজে ফারসি ভাষা ভাল জানতেন বলে ফারসি ভাষাভাষীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা কঠিন হয়নি। একই কারণে ইংরেজ অফিসার নিয়োগের ব্যাপারে হেস্টিংস সাবধানী ও খুঁতখুঁতে ছিলেন। তিনি জানতেন যে কোম্পানি অফিসারদের মধ্যে শাসনকাজের জন্যে দরকারি দক্ষতা ও চরিত্রের অভাব রয়েছে, এবং এদের অনেকেই অতিমাত্রায় লোভী। বরং এদের সরিয়ে বিচক্ষণ ভারতীয় কর্মচারী রাখলে কাজ ভাল হবে। হেস্টিংস, বলা যেতে পারে, শাসনের একটা নতুন মডেল চালু করলেন। ব্যবসায়ীদের হাত থেকে রাজকার্য সরিয়ে অ্যাংলো-ভারতীয় আমলাতন্ত্র চালু করলেন।
কিন্তু অনেকগুলি বড় ব্যাপারে হেস্টিংস শাসক হিসেবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, প্রধানত নিজের চারিত্রিক অসংগতির কারণে। মোটামুটি ন্যায়পরায়ণ হলেও তাঁর নিজের পেটোয়া লোকেদের প্রতি হেস্টিংসের দাক্ষিণ্য ছিল বেপরোয়া রকমের। অনুগত জমিদারদের কোনও অপরাধকেই অপরাধ বলে গণ্য করা হত না। কান্তবাবু জলের দরে একের পর এক জমিদারি কিনে চললেন, অনেক ক্ষেত্রে কাগজপত্র জাল করে। আরেক অনুগত জমিদার রংপুরের দেবী সিং প্রজাদের উপর এমনই অত্যাচার চালালেন যে নিজের এলাকায় কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেল। অপেক্ষাকৃত অখ্যাত স্নেহের পাত্রদের মধ্যে ছিলেন এক জাফর, সম্ভবত দেহরক্ষকদের একজন, যিনি ধর্মতলা স্ট্রিটের উপর বিশাল এলাকার জমি উপহার পান।
বাংলায় শান্তি বজায় থাকলেও উত্তর ভারতে হেস্টিংসের যুদ্ধযাত্রা ও কূটনীতি পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বেনারস, রোহিলখণ্ড, অবধ রাজ্যগুলিতে কোম্পানি এই সময়ে আধিপত্য বিস্তার করে, মারাঠা আক্রমণ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। শান্তি ফিরে এল, কিন্তু রোহিলখণ্ডের অর্থনীতি তছনছ করে দিয়ে, বেনারস ও অবধকে প্রায় উপনিবেশে পরিণত করে দিয়ে।
কোম্পানির ভিতরের অন্তর্দ্বন্দ্ব ঠান্ডা করার ব্যাপারেও হেস্টিংস ব্যর্থ হয়েছিলেন। ১৭৭৩ সালে পার্লামেন্ট কলকাতায় একটি সুপ্রিম কাউন্সিল সুপারিশ করে, যাতে রাজ্যের কাজ নীতিগত ভাবে চলছে কি না তা দেখবার জন্যে উপরে কেউ থাকে। এই কাউন্সিলের মাতব্বর ছিলেন ফিলিপ ফ্রান্সিস নামে এক রাইটার, যাঁর আসল লক্ষ্য ছিল হেস্টিংসের গদি। এই দু’জনের মধ্যে রেষারেষির বলি হলেন নবাবি শাসনব্যবস্থার একজন মাতব্বর স্থানীয় ব্যক্তি, যাঁর নাম নন্দকুমার।
নন্দকুমার দু’জনকেই ভাল করে চিনতেন ও একসময়ে হেস্টিংসের সঙ্গে কাজও করেন। ১৭৭৫ সালে তিনি অভিযোগ আনলেন যে হেস্টিংস নবাবের কাছ থেকে ঘুষ খেয়েছেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে হেস্টিংসকে গদি ছাড়তে হত ও নন্দকুমার মোটা টাকা পুরস্কার পেতেন, কারণ নিঃসন্দেহে তিনি ফিলিপ ফ্রান্সিসের দলের হয়ে এবং হেস্টিংসের পুরনো বন্ধু নবকৃষ্ণ দেবের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন। দুঃখের বিষয় ঘটনার চাকা অন্যদিকে গড়াতে থাকে। নবকৃষ্ণ-লবি সদ্যপ্রতিষ্ঠিত সুপ্রিমকোর্টে পালটা মামলা দায়ের করল যে নন্দকুমার নথি জাল করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইলায়জা ইম্পে হেস্টিংসের বাল্যবন্ধু, নিমেষের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করে নন্দকুমারের ফাঁসির রায় দিলেন। সেকালে নথি জাল করার জন্যে ফাঁসি দেওয়া আইনবিরুদ্ধ ছিল না এবং এই ঘটনার কিছু দিন আগেই আরও একটি নথি জালের কেসে ফাঁসির হুকুম হয়। তা ছাড়া নন্দকুমার যে গোলমেলে লোক ছিলেন এবং নথি জাল করার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন সে ব্যাপারেও বিশেষ সন্দেহ ছিল না (অনিলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৯০)।
কিন্তু এই মামলার পরিণাম হেস্টিংসের পক্ষে সুখকর হয়নি। যদি কোনও একটি বিশেষ ঘটনা হেস্টিংসের সুখ্যাতি সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে থাকে, তা হল নন্দকুমারের ফাঁসি। সাধারণ বাঙালির দৃষ্টিতে এই রায় কোম্পানিরাজের নীতিহীনতার, সমসাময়িক এক ইংরেজ ব্যবসায়ীর ভাষায় ‘ইংরেজ স্বৈরতন্ত্রের চিহ্ন’ হয়ে রইল। ফাঁসির দিন মাঠে লোক ভেঙে পড়ল। ফাঁসি শেষ হতেই বিশাল জনতা ছুটল গঙ্গার ঘাটের দিকে, ব্রহ্মহত্যা দর্শনের পাপ স্খালনের জন্যে।
ফ্রান্সিস যখন হেস্টিংসের চেয়ার দখল করতে অসমর্থ হলেন, তখন তিনি এক বিশাল ফাইল তৈরি করলেন হেস্টিংস তথা কোম্পানির যাবতীয় দুষ্কৃতির বিবরণ নিয়ে। ১৭৮৫-৮৬ সালে এক উৎসাহী ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তির হাতে সেই ফাইল এসে পড়ল।
বার্ক
এডমান্ড বার্ক (১৭২৯-১৭৯৭), দার্শনিক, পার্লামেন্টারিয়ান, হুইগ দলের মুখপাত্র এবং সেই সময়ের সবথেকে প্রভাবশালী বাগ্মী, কোম্পানির ব্যাপারে আগ্রহী হন ষাটের দশকের শেষে, যখন কোম্পানির শেয়ার পড়ে যায়। তাঁর নিজের পরিবারেও কেউ কেউ শেয়ারের ওঠাপড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু বার্কের আগ্রহের কারণ ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, কোম্পানিসৃষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে কৌতূহল।
সত্তরের দশকের প্রথমে বার্ক পার্লামেন্ট-নিযুক্ত ভারত শাসন বিষয়ে একটি কমিটির সদস্য পদে যোগ দিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাংলা শাসন তাঁর প্রধান চিন্তাভাবনার বিষয় হয়ে উঠল। পরবর্তী দশ বছরে বার্ক কোম্পানি শাসনের একটা যথাযথ সমালোচনা তৈরি করে জনসভায় এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করলেন। তিনি এই অবস্থানে পৌঁছলেন যে, মুনাফা-সন্ধানী ব্যবসায়ীদের সৃষ্ট রাষ্ট্র, যেখানে প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলি তৈরি হয়নি বা দুর্বল হয়ে পড়েছে, অপশাসনের আরেক নাম। এহ বাহ্য। কিন্তু বার্কের এই সমালোচনার মধ্যে একটা বড় গলদ ছিল, এবং মনে হয় তিনি সে ব্যাপারে সচেতনও ছিলেন। অপশাসনের অনেকগুলি উদাহরণ ভারতে শুধু কোম্পানিরাজের ক্ষেত্রেই যে প্রযোজ্য ছিল এমন নয়, যেমন সরকারি আমলাদের টাকা দিয়ে কাজ উদ্ধার করা। বরং কোম্পানির স্থানীয় অফিসাররা মনে করত ভারতে রাজ্য চালনার এটাই দস্তুর।
কর্ণাটকের যুদ্ধ বার্কের চোখে কোম্পানির নিজের স্বার্থে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার প্রয়াস। প্রকৃতপক্ষে অষ্টাদশ শতকের ভারতে বেশির ভাগ শক্তিশালী রাষ্ট্র গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার জন্যে তৈরি হয়েই থাকত, কারণ এ ছাড়া সহজে রাজস্ব বাড়ানোর উপায় তাদের হাতে ছিল না।
যুক্তির বাইরে, বার্কের আক্রমণ জোরালো করার জন্যে দরকার ছিল ধরাছোঁয়া যায় এ রকম টার্গেট। ফিলিপ ফ্রান্সিসের হেস্টিংস ফাইল সেই টার্গেট হাতের মুঠোয় এনে দিল। একজন মানুষ একটা পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিনিধি হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে। সমস্ত নৈতিক এনার্জি জড়ো করে বার্ক লেগে গেলেন হেস্টিংসের পেছনে। পার্লামেন্টকে রাজি করানো হল ইমপিচমেন্ট বা লর্ডসদের দিয়ে বিচারে। হেস্টিংসের বিরুদ্ধে তিনটে প্রধান অভিযোগ— ঘুষ নেওয়া, নন্দকুমারের ফাঁসি ও নিষ্ঠুর দুর্নীতিপরায়ণ জমিদারদের পোষণ।
১৭৮৮ সালে যখন বিচার শুরু হয়, হেস্টিংস দেশে ফিরে এসেছেন, গ্রামের জমিদার হয়ে নিশ্চিন্তে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে। প্রথম প্রথম ইমপিচমেন্ট ব্যাপারটা হেস্টিংসের মন্দ লাগেনি। গ্রামের জীবন শান্ত হলেও একঘেয়ে। এই বিচার আবার তাঁকে খবরের হেড লাইনে নিয়ে এল। তা ছাড়া তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন যে তাঁর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মনগড়া, বরং আদালতে দাঁড়িয়ে জনতাকে উদ্দেশ করে অনেক হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা দেওয়া যাবে। বিচার যত এগোতে থাকল, মামলা লড়ার খরচ বেড়ে চলল, বার্কের বাগ্মিতা যত খুলতে লাগল, বাংলার রাজনীতির যত নোংরামি সাধারণের সামনে আলোচনা হতে লাগল, ততই হেস্টিংস বুঝলেন তাঁর জীবনের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জের সামনে তিনি দাঁড়িয়ে।
অভিযোগগুলি গুরুতর হলেও নয় বছরব্যাপী মামলা শেষ হল সম্পূৰ্ণ নির্দোষ রায় দিয়ে। তার অনেক আগেই জনতার দরবারে হেস্টিংস নির্দোষ সাব্যস্ত হয়েছেন। বার্ক নন্দকুমারের খুনের দায় হেস্টিংসের ঘাড়ে চাপিয়ে শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়েছেন। প্রায় কোনও ব্যক্তিগত অপরাধ প্রমাণ করা যায়নি। এবং বার্কের বাগ্মিতা যতই লম্বাচওড়া হতে থাকে ততই প্রকাশ পায় যে ভদ্রলোকের টার্গেট ঠিক হেস্টিংস মানুষটা নন, রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে একটা ধারণা মাত্র। সেই রাষ্ট্রের আসল রূপ কী তা নিয়ে বার্কের প্রত্যক্ষ জ্ঞান সামান্য। হেস্টিংসের জ্ঞান আরও বেশি।
বার্ক মামলা হারলেন বটে, তবে বাংলার শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতি ও সুযোগসন্ধানীদের ভূমিকা এতদিন কত বেশি ছিল পার্লামেন্টকে সেটা দেখিয়ে দিয়ে গেলেন। এই বিচারের পরেই সাম্রাজ্যবাদ চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিল পার্লামেন্ট কর্তৃক ভারত শাসন চালু করে।
বার্কের অনুপ্রেরণা ছিল বিচারের বারো বছর আগে প্রকাশিত একটি বই, যা ইতিমধ্যেই কোম্পানির বিরোধীদের প্রচুর ইন্ধন জুগিয়েছে।
ওয়েলথ অফ নেশনস
১৭৭৬ সালে প্রকাশিত হল অ্যাডাম স্মিথের (১৭২৩-১৭৯০) বই An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations। বইটি মুক্ত বাজারের ম্যানিফেস্টো। কিন্তু মুক্ত বাজারের হয়ে লড়তে গেলে একচেটিয়া ব্যাবসার বিরোধিতা করা দরকার। একচেটিয়া ব্যাবসা নিয়ে কথা বলতে গেলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রসঙ্গ আসবেই।
স্মিথই প্রথম ইন্টেলেকচুয়াল নন যিনি কোম্পানির চার্টারের কারণে স্বাধীন ব্যাবসা কত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই প্রসঙ্গ আলোচনা করেন। তবে স্মিথই প্রথম এই আলোচনায় বাংলার অর্থনীতিতে কত ক্ষয় হয়েছে সেই বিষয় টেনে আনেন। কোম্পানি তাঁর দৃষ্টিতে একটি বিশেষ ধরনের একচেটিয়া ব্যাবসা। একচেটিয়া ব্যাবসা যথেষ্ট খারাপ, আরও অনেক বেশি খারাপ এমন একচেটিয়া ব্যাবসা যাদের হাতে রয়েছে সরকার চালানোর দায়িত্ব। স্মিথ দেখালেন যে এর ফলে ইংল্যান্ডের বাজারে ভারতীয় দ্রব্য অহেতুক বেশি দামে বিক্রি হয়। আর শাসনব্যবস্থার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় সাধারণের হিত- সাধনের জায়গায় ব্যক্তিবিশেষের লাভ-সাধন। শুধু তাই নয়, এ ধরনের দু’মুখো প্রতিষ্ঠান শেষ পর্যন্ত বাজার নষ্ট করে ছাড়ে। ‘ব্যবসায়ী মনোবৃত্তির কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজ্যচালনায় ব্যর্থ; রাজ্যচালনার মনোবৃত্তির কারণে ব্যবসায় ব্যর্থ।’ যুদ্ধ আর রাজনীতিক প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে গিয়ে কোম্পানি দেউলে হওয়ার পথে, আর ক্রমাগত সরকারি সহযোগিতা ও দানের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। স্মিথের এই মতামত অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।
স্মিথ বাংলার পরিস্থিতি ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছিলেন এমন বলা চলে না। তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে বাংলার মতো যে সব দেশে ইউরোপিয়ানরা গিয়ে ব্যাবসা বা রাজত্ব করছে সেগুলি সব ‘গ্রেট ব্রিটেনের তুলনায় বেশি উর্বর, বৃহত্তর, জনসম্পদ ও আর্থিক দিক দিয়ে অনেক বেশি ধনী’– এই ধারণা থেকে শুরু করলে মানতে হয় যে ইউরোপিয়ানরাই লুঠপাট করে ধনী জাতিগুলিকে গরিব করে দিচ্ছে। এই ধারণার কোনও ভিত্তি নেই। লুঠপাঠ যে হয়নি তা নয়। তবে লুঠের টার্গেট ছিল সবসময়েই রাজাদের ব্যক্তিগত সম্পদ। অর্থাৎ লুকিয়ে রাখা ধনরত্ন, সাধারণ মানুষের সঞ্চয় নয়। এই ধনরত্ন হাতবদল হলে সাধারণ মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হবে এমন ধরে নেওয়ার কোনও কারণ ছিল না। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় যে বাংলা অঞ্চল ব্রিটিশরা আসার আগেই পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় গরিব ছিল।
এ ছাড়াও, একচেটিয়া ব্যাবসার বিরুদ্ধতা করতে গিয়ে কোম্পানির ভিতরে যেসব অসংগতি ছিল সেগুলি স্মিথের চোখে পড়েনি। সংগঠন হিসেবে কোম্পানি পুরোপুরি একচেটিয়া নয়, এমনকী লন্ডনের দ্বারা চালিতও নয়। ভারতে রাজত্ব বিস্তার আর একচেটিয়া ব্যাবসা রক্ষা কোম্পানির মধ্যেই দুটি পরস্পরবিরোধী ব্যক্তিত্বের দুটি স্বতন্ত্র লক্ষ্য ছিল। রাজত্ব বিস্তার চেয়েছে নাবিক, সেনাধ্যক্ষ, ও স্থানীয় কর্মীরা, যারা আবার একচেটিয়া-বিরোধী প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের নিকট বন্ধু। একচেটিয়ার প্রতিনিধি লন্ডন অফিস অন্যদিকে রাজত্ব বিস্তারে রাশ টানতে চেয়ে অসফল হয়েছে। মোটমাট স্মিথের বিশ্লেষণ ছিল ভুল। কোম্পানির বাংলা-বিজয় সংগঠন হিসেবে কোম্পানির দুর্বলতার চিহ্ন, তাদের বিভাজিত ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক, তাদের একচেটিয়া-জনিত শক্তির পরিচায়ক নয়।
সে যাই হোক, নিঃসন্দেহে স্মিথ মনোপলি-বিরুদ্ধতার একটা তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করে দিলেন। শুধু তাই নয়, এটা করতে গিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ভারতের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যবসায়ীদের কী ভূমিকা হওয়া উচিত এই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গগুলি সামনে এনে দিলেন।
রেগুলেটিং অ্যাক্ট
যদিও মনোপলি নিয়ে পার্লামেন্টের মধ্যে তখনও মতবিরোধ ছিল, তাও অনেকেই মেনে নিয়েছিল যে কোম্পানির হাতে রাজত্বের ভার থাকা উচিত নয়। ভারতে কোম্পানিরাজের উপরে খবরদারির ব্যবস্থা বেশ কিছু দিন ধরে তৈরি হচ্ছিল। দেওয়ানি-প্রাপ্তির পরবর্তী দশ বছরের (১৭৬৫-১৭৭৫) কার্যকলাপ ইংল্যান্ডে নানাভাবে অস্বস্তির সৃষ্টি করে। কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধিরা লন্ডনের হুকুম সরাসরি অগ্রাহ্য করে চলে। যে সব ছোকরা ক্লার্ক বা লেফটেনান্ট হয়ে ভারতে গিয়েছিল তারা ফিরে এল বহু হিরে-জহরতের মালিক হয়ে। বোল্টস-ভার্সেস-ভেরেলস্ট মামলা স্ক্যান্ডালের পর্যায়ে চলে যায়।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোম্পানির অবস্থা ভাল চলছিল না। সামরিক খাতে
খরচ বেড়ে গেছে, কাপড়ের ব্যাবসা কমে গেছে ভারতে দাম বেড়ে যাওয়ার জন্যে, চা বিক্রি করে আয় কমেছে নতুন ট্যাক্সের কারণে। বাংলার রাজস্ব সত্তরের মন্বন্তরের পর কমে গেছে, তা যুদ্ধ ও ব্যাবসা চালানোর জন্যে যথেষ্ট নয়। শেয়ারের বাজার এই সব অনিশ্চয়তার কারণে ওঠানামা করে চলেছে। মোটামুটি বলা যায়, একদল ‘ন্যাবোব’ জুটে তাদের মনিবকে দেউলে করে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে।
রাজ্যবিস্তার পুরনো প্রশ্ন চাগিয়ে তোলে, এই লক্ষ লক্ষ বর্গমাইল জমি কার সম্পত্তি— রাজা না কোম্পানি? ব্রিটেনের নামে দু’জন রাজা থাকতে পারে কি? না কি সমস্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিকার একজনের হাতেই ন্যস্ত হওয়া উচিত? রাজা তৃতীয় জর্জ এতরকম ঝামেলায় জড়িয়ে ছিলেন যে বঙ্গাধিপতি খেতাব নিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবার সময় তাঁর ছিল না। অন্যদিকে তারাও যে রাজারই প্রতিনিধি এই ভাবটা কোম্পানি বজায় রাখার চেষ্টা করত। কিন্তু তাতে স্ক্যান্ডাল আরও বেড়ে চলে। ব্রিটেনের রাজার নাম নিয়ে কোম্পানি দূর দেশে অপশাসন চালায় কোন সাহসে?
শেষমেশ পার্লামেন্ট মাঠে নামল কোম্পানির রাজত্ব নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে। ১৭৭২ সালে প্রধানমন্ত্রী লর্ড নর্থ কোম্পানিকে একটা বড় ধার পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে কথাবার্তা তুললেন। পরের বছর চালু হল ইস্ট ইন্ডিয়া রেগুলেটিং অ্যাক্ট। ভারতে কর্মরত সরকারি আমলাদের মাইনে বাড়ল এবং তাদের দ্বারা প্রাইভেট ব্যাবসা বেআইনি হল। কলকাতায় একটি সুপ্রিমকোর্ট বসল।
মজার কথা, ভারতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ যখন সাম্রাজ্যের ভিত্তি তৈরি করছে ঠিক তখনই আমেরিকায় সরকারি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা সাম্রাজ্যের ভিত্তি ভেঙে দিতে চলেছে। ঐতিহাসিক পিটার মার্শাল দেখিয়েছেন যে আটলান্টিকের উপনিবেশে এই চেষ্টা তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয়, কারণ সেখানে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করত যে তারা ব্রিটিশ নাগরিক, স্বাধীনতা তাদের মৌলিক অধিকার, বাইরের কোনও শক্তি তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
১৭৭৩-এর নিয়ন্ত্রণ প্রায় নামে মাত্র হয়েছিল। ১৭৮৪ সালে প্রধানমন্ত্ৰী উইলিয়াম পিট যে নতুন আইন চালু করলেন তাতে রাজ্যচালনার জন্যে মোটামুটি দীর্ঘস্থায়ী একটা কাঠামো তৈরি হল। এই আইনে কোম্পানির সমস্ত রাজনীতিক কার্যকলাপ রাজার নির্মিত এক কমিটি, বোর্ড অফ কন্ট্রোলের, আওতায় এল। ব্যাবসা ও রাজনীতি— কোম্পানির দুটো দায়িত্ব— অনেকাংশে আলাদা হয়ে গেল, যদিও কার্যত এই দুটো দিক এর পরেও অনেক দিন ধরে পরস্পরবিজড়িত হয়ে ছিল।
এই দুটো দিককে আলাদা করার ব্যাপারে বড় ভূমিকা নেয় গভর্নর- জেনারেল নির্বাচন। ক্রমশ এই গুরুত্বপূর্ণ অফিসটি কোম্পানি এবং পার্লামেন্টের প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে স্বতন্ত্র হতে থাকে। ভারত শাসনের মাথায় এসে বসেন সাম্রাজ্যবাদী অভিজাত পরিবারের প্রতিভূরা। পরের পরিচ্ছেদে এই বিবর্তনের পরবর্তী যুগ নিয়ে আলোচনা করা হবে।