আট
মিস্টার প্যাটেলের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটা বিশাল। সামনের পার্কিং লট-এ গাড় পার্ক করতে করতে বললাম, “এবার বলুন তো আপনার খটকাটা কি?”
একেনবাবু আমার প্রশ্ন শুনলেন কিনা কে জানে ! দেখলাম মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছেন। হঠাৎ আমার হাতে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বললেন, “স্যার, তাড়াতাড়ি নামুন, নইলে চান্স মিস করব।”
আমি আচমকা টান খেয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি চান্স?”
একেনবাবু গলা নামিয়ে, “দেখছেন না স্যার, লোকটা এগোচ্ছে! আর দেরি নয়, চট করে নেমে পড়ুন, প্লিজ।”
কার কথা বলছেন উনি! আমি তো কোথাও কোনও সন্দেহজনক ক্যারেক্টার খুঁজে পেলাম না। থাকার মধ্যে শুধু একটা বেঁটে-খাটো আমেরিকান সাহেব বাজারের ব্যাগ হাতে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর দিকে যাচ্ছে। এই ঠাণ্ডায় আমার একদম নামতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু একেনবাবু এতো ছটফট করতে লাগলেন যে শেষে খানিকটা উত্ত্যক্ত হয়ে নেমে পড়লাম। একেনবাবু আমার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে সাহেবের পিছু নিলেন।
সাহেব চাবি দিয়ে বিল্ডিং-এর দরজাটা খুলতেই একেনবাবু টুক করে ঢুকে পড়লেন। তারপর এলিভেটর ধরে সোজা তিনি তলা। আমি যে কেন ওঁর পেছন পেছন গেলাম নিজেই জানি না। এতক্ষণ সাহেব সামনে ছিল বলে একটা কথাও বলি নি। এলিভেটর থেকে বেরিয়েই আমি বললাম, “আচ্ছা, আপনার মাথায় কি ঘুরছে বলুন তো?”
“এক্ষুণি ক্লিয়ার হয়ে যাবে স্যার।” উনি হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “আমাদের যেতে হবে তিনশো চার নম্বরে। তিনশো …তিনশো দুই…এই তো তিনশো চার। দেখুন স্যার মিস্টার প্যাটেলের নামও লেখা আছে।”
আমি কেমন একটু কনফিউসড হয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি করে জানলেন মিস্টার প্যাটেল কোনা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন?”
“বাঃ স্যার, আপনার মনে নেই – ওঁর ঠিকানা তো স্যুটকেস দুটোর ওপরেই লেখা ছিল!”
“তা না হয় ছিল, কিন্তু কি করতে চান আপনি?”
“আমি একটূ ঢুকবো স্যার।”
“ঢুকবেন মানে!” আমি ভীষণ ভয় পেয়ে বললাম, “সেটা তো ব্রেকিং এন্ড এন্টারিং, ধরা পড়লে কত বছরের জেল হবে এদেশে জানেন?”
“স্যার, আমি যাব আর আসব। একদম ঘাবড়াবেন না। ভয় করলে আপনি বরং দাঁড়িয়ে থাকুন, নয় গাড়িতে গিয়ে বসুন।”
ভয় আমি পাচ্ছিলাম ঠিকই। কিন্তু একা হলওয়েতে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা, বা নীচে গাড়িতে আধা-অন্ধকারে বসে থাকা – কোনওটাই খুব প্রীতিপ্রদ মনে হল না। একেনবাবু ইতিমধ্যে পকেট থেকে একটা স্ক্রু ড্রাইভার মত জিনিস বার করে চাবির মত সেটা দরকার লকে ঢুকিয়েছেন! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে খুট করে দরজাটা খুলে গেল। আমি দ্রুত গতিতে মনে মনে হিসেব করলাম – এ ধরণের বিল্ডিং-এ পেছনের জানলায় সব সময়ে একটা ফায়ার এসকেপ থালে। কেউ হঠাৎ এসে পড়লে সেখান দিয়ে পালানো যেতে পারে। আমি শুধু চাপা গলায় বললাম, “হয় আপনি জানেন কি করছেন, নয় পুরোপুরি বেপরোয়া ক্রেজি! ধরা পড়লে দশ বছরের জেল – খেয়াল আছে? এখনও সময় আছে, চলুন, কেটে পড়া যাক।”
একেনবাবু আমার হাতে একটা চাপ দিয়ে বললেন প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন, “চুপ স্যার, আর কথা নয়। জাস্ট মিনিট কয়েক, তার বেশী লাগবে না। আর সাবধান, কোনও কিছু টাচ করবেন না।” বলতে বলতেই পকেট থেকে দুটো প্লাস্টিকের গ্লাভস পরে নিয়েছেন।
অ্যাপার্টমেন্টটা খুবই ইমপ্রেসিভ। কারিস্তান কার্পেট, মার্বেল ফ্লোরের কিচেন, দামি কাউন্টার টপ, দরজা জানলাগুলোর ফিনিশ তাকিয়ে দেখার মত! ঘরের আসবাবপত্রগু্লো কিন্তু তার সঙ্গে খাপ খায় না। বাইরের ঘরে পুরনো সস্তা একটা সোফাসেট আর ভাঙ্গা কফি টেবিল – ব্যস!
ভিসিটার্স ক্লজেটে কয়েকটা কোট আর ওভারকোট ঝোলানো । একেনবাবু সেগুলোর পকেট একটু হাতড়ে বাথরুমে ঢুকলেন। বাথরুমে সিঙ্কের ওপর হাতল ভাঙা একটা পুরনো কাপের ওপর রাখা একটা টুথব্রাশ, সঙ্গে যে টুথপেস্টের টিউব, তাতে প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। মেডসিন ক্যাবিনেটে অ্যাসপিরিন, টাইলানল আর ওই জাতীয় কয়েকটি ওষুধের বোতল।
বাথরুমের পাশেই কিচেন। সেখানে ঢুকে একেনবাবু রেফ্রিজারেটর খুললেন। দুধ, মাখন, অরেঞ্জ জুস, চীজ – সব কিছুই চোখে পড়ল। এ ছাড়া কয়েকটা প্লাস্টিকের কৌটোয় খাবার তৈরি করে রাখা। ভেজটেবল ট্রেটাও ফাঁকা নয়, কিছু তরকারি পড়ে আছে।
মিস্টার প্যাটেলের বেডরুমটা আমার বেডরুমের প্রায় দ্বিগুণ। বেডরুমের ফার্নিচার বলতে একটা ডাবল বেড, চেস্ট অফ ড্রয়ার্স আর নাইট টেবিল। একটা বড় আয়না দেওয়ালে আটকানো। নাইট টেবিলে একটা ছবি – এক বৃদ্ধ মহিলার সাথে মিস্টার প্যাটেল। মুখের আদল দেখে মনে হয় মা। মাস্টার বেডরুমের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমটা মনে হল ব্যবহার করা হয় না।
দ্বিতীয় বেডরুমটা মনে হল অফিস গিসেবে ব্যবহার করা হত। কাঠের ছোট টেবিল, তার ওপর কয়েকটা থ্রি-রিং বাইন্ডার সাজানো। একটা ট্রে-তে ‘জেমস ইন্ডিয়া’ ছাপা চিঠির কাগজ। ডেস্ক ড্রয়ারে শ্রী মদ্ভাগবত গীতার ইংরেজি ট্র্যান্সলেশন আর কিছু অফিস স্টেশনারি।
আমি অধৈর্য হয়ে একেনবাবুর হাত ধরে টান দিয়ে চাপা স্বরে বললাম, “এবার চলুন।”
একেনবাবু কৌতুহল বোধহয় ফুরিয়েছে। আমার সঙ্গে দরজার দিকে এগোলেন। হঠাৎ কি খেয়াল হল, দাঁড়িয়ে থেমে ক্লজেটের দরজাটা খুললেন। ক্লজেটটা ফাঁকা, শুধু নীচে একটা লম্বা কার্ডবোর্ডের বাক্স খবরের কাগজে ভর্তি। কয়েকটা খবরের কাগজ সরাতেই বেরিয়ে পড়ল অনেকগুলো বাঁধানো খাতা। প্রত্যেকটা ওপর তারিখ লেখা। সবচেয়ে পুরানোটা হল ১৯৮১ সালের। খাতাগুলো ডায়রি, অ্যাড্রেসবুক, আপয়েন্টমেন্ট ক্যালেন্ডার – সবকিছু। একেনবাবু ১৮৮৯-৯০ লেখা খাতাটা তুলে নিয়ে বললেন, “চলুন স্যার, যাওয়া যাক।”
নীচে নেমে একেনবাবু মিস্টার প্যাটেলের মেলবক্সের ফুটো দিয়ে ভেতরে তাকালেন। তারপর আবার সেই স্ক্রু ড্রাইভার টাইপের জিনিসটা বার করছেন দেখে, আমি একেনবাবুকে সাবধান করলাম, “মশাই, অন্যের মেলবক্সে হাত দেওয়া কিন্তু এদেশে ফেডারেল অফেন্স – অনেক বছরের জেল।”
একেনবাবু এদিক ওদিক তাকিয়ে টুক করে বাক্সটা খুলে ফেললেন। উনি যখন চিঠিগুলোতে চোখ বুলোচ্ছেন, আমি দেখলাম একজন পার্কিং লট থেকে বিল্ডিং-এর দিকে আসছে।
“হারি-আপ। কেউ আসছে,” বলেই আমি কোনও দিকে না তাকিয়ে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়িতে। এই প্রথম খেয়াল করলাম বুকটা কি ভীষণ ধুকপুক করছে।
একেনবাবু এলেন একটু পরে। দ্রুত গতিতে লট থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় গাড়িটা নামিয়ে এনে আমি একেনবাবুকে এক চোট ঝাড়লাম। “আপনি কি সুরু করেছেন বলুন তো! শখের গোয়েন্দাগিরি করে কি জেলে যেতে চান?”
“ধরা তো পড়ি নি স্যার,” একেনবাবু একটা মোক্ষম আর্গুমেন্ট দেওয়ার চেষ্টা করলেন।
“এটা কোনও যুক্তি হল! আপনার জন্যে আজ আমরা ফেডারেল, স্টেট, কাউন্টি, সিটি – সব কটা পেনাল কোডই বোধহয় ভায়লেট করেছি। হোয়াট আই স্টিল ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড – ইজ ফর হোয়াট?”
“আপনি রেগেছেন স্যার।”
“আলবাত রেগেছি। ইন্ডিয়াতে যে সব চলে, এখানে সেগুলো চলে না। পুলিশ একবার ধরলে, ইনফ্লুয়েন্স দিয়ে কোনও কাজ হয় না। ইউ শুড আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট।”
একেনবাবু বকুনি খেয়ে কাঁচুমাচু হয়ে চুপ করে রইলেন।
এরকম ভাবে সাধারণত আমি কথা বলি নয়া। নিজেরই খারাপ লাগল। বললাম, “আমার বিরক্তি লাগছে লাগছে কেন জানেন – এই যে অনর্থক রিস্কটা নিলেন, কি হাতিঘোড়া দেখলেন ওখানে?”
“খুব কনফিউসিং স্যার।”
“কনফিউসিং!”
“হ্যাঁ স্যার। মিস্টার প্যাটেল প্রমথবাবুর কাছে আসার অন্তত তিন চারেক আগে বাড়ি ছেড়েছেন; সেটাই খুব কনফিউইসিং।”
“আপনি সেটা বুঝলেন কি করে!”
“ফার্স্ট ক্লু স্যার, রেফ্রিজারেটার থেকে। ভেবে দেখুন রেফ্রিজারেটরে যে পরিমাণ দুধ, কাঁচা সবজি আর খাবার দেখলাম, তা কখনোই দিন দুয়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব নয়। অথচ মিস্টার প্যাটেলের আজকেই ইন্ডিয়া রওনা দেবার কথা ছিল। যিনি এত কৃপণ, মানে বাড়ির জিনিসপত্রগুলো দেখে বলছি, তিনি হঠাৎ এত খাবার নষ্ট করে চলে যাবেন। চরিত্রের সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না – তাই না স্যার?”
দ্যাটস ট্রু, কিন্তু উনি হয়ত খাবারগুলো কাউকে দিয়ে যাবার প্ল্যান করেছিলেন।”
“আমারও সেটা একবার মনে হয়েছিল স্যার, সেইজন্যেই মেলবক্সটা খুললাম। বাক্সে নিউ ইয়র্ক থেকে পোস্ট করা দুটো চিঠি ছিল, দুটোতেই ডেট স্ট্যাম্প ছিল ১২ ফেব্রুয়ারির। আজ স্যার ২০ তারিখ, তাই না?”
নাঃ। একেনবাবুর এলেম আছে মানতে হবে। তবু বললাম, “হয়তো আর কাউকে বলে গিয়েছিলেন, খাবারগুলো নিয়ে যেতে। চিঠিও হয়তো সেই নিয়ে যেত।”
“হতে সব কিছুই পারে। তবে খটাকা লাগছে এইজন্যে স্যার, উনি প্রমথবাবুকে বলেছিলেন, হিটিং কাজ করছিল না বলে উনি প্রমথবাবুর কাছে চলে এসেছেন। কিন্তু উনি বাড়ি ছেড়েছিলেন বেশ কয়েকদিন আগে। মিথ্যে বললেন কেন স্যার?”
এর উত্তর আমার জানা নেই।
“আরও একটা ব্যাপার কনফিউসিং স্যার।”
“কি বলুন তো?”
“এরকম একজন কঞ্জুস লোক, এত দামি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলেন কেন?”
এর উত্তরটা আমার জানা ছিল। বললাম, “এটা ভাড়া বাড়ি নয়, এগুলো সব কন্ডোমোনিয়াম, অর্থাৎ কেনা অ্যাপার্টমেন্ট। নিউ ইয়র্কে বাড়ির দাম যে রেট-এ বাড়ছে, বাড়ি কেনা একটা চমৎকার ইনভেস্টমেন্ট।”
“তাই বলুন স্যার। ভারি খটকা লাগছিল।”