মানিকচক থেকে ইংরেজবাজার পর্যন্ত ছেড়ে দিলেও, ইংরেজবাজার থেকে এ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ মাইল রাস্তা গাড়ি একটানা চলেছে। উদিত হাত উলটে ঘড়ি দেখল। প্রায় একটা বাজে। ওয়ারি থেকে বিহার রাজ্য পড়বে। পূর্ণিয়া জেলার ভিতর দিয়ে যেতে হবে। সেখানকার রাস্তার অবস্থা কোথায় কী, জানা নেই। তবে এই পথেই নারায়ণ আর মিহির এ গাড়ি নিয়ে এসেছিল। তার থেকেও দুশ্চিন্তার বিষয়, ছিনতাই আর ডাকাতদের জন্য। একটাই রক্ষে, ছোট গাড়ি নয়, ট্রাক। লুট করবার উদ্দেশ্য থাকলে, ট্রাকও আক্রমণ করতে পারে। ভেবে অবিশ্যি লাভ নেই, করলে দেখা যাবে।
সুতপার গা আর চুল থেকে সুন্দর একটা গন্ধ লাগছে। সুতপার মাথা ওর কাঁধে ঠেকে রয়েছে। ওর নাম কি সত্যি সুতপা। ও কে, মেটেলিতে কেন যাচ্ছে। পরিচয় চাপছে, বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কেন। উদিত নারায়ণ যদি ওর পরিচয় পায়, তা হলে ক্ষতির কী থাকতে পারে। নারায়ণের কি সত্যি চেনা মুখ বলে মনে হয়েছে সুতপাকে, নাকি একটা বাজে কথা বলছে। অবিশ্যি, নারায়ণের অনেক জায়গায় যাতায়াত, অনেক রকম পরিবেশে। জিপের লোকগুলো সুতপাকে এমনভাবে দেখছিল, যেন চেনে, অথবা অন্য কোনও মতলায় এক বার তাকাল। হঠাৎ যেন বিমনা মহকিছর মধ্যে উদিতের ওপর সুতপার কোনও মতলব নিয়ে, পিছন নিতে চাইছিল। সুতপা সুন্দরী, বেশ বড়লোকের মেয়ে, বোঝা যায়।
উদিত ঘাড় ফিরিয়ে এক বার তাকাল। হঠাৎ যেন বিমনা হয়ে পড়ল। সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি ঠিক রাখল। কিন্তু মনটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল। বিপদ ভয়, সবকিছুর মধ্যে উদিতের ওপর সুতপার এত ভরসা কীসের। এত নির্ভরতা কেন, কেবল কি তা-ই। আজ সকালের দিকে হাওড়ার বুকস্টলে যে মেয়েকে দেখেছিল, মানিকচক থেকে যে মেয়েকে সে হাতে ধরে ট্রাকে তুলেছিল, একি সেই মেয়ে, যে অনায়াসে ওর কাঁধে মাথা পেতে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। এ কি কেবল বিশ্বাস, না আর কিছু মীনা আর নারায়ণের কথা মনে পড়ে গেল, উদিতকে নাকি সুতপার খুব ভাল লেগেছে।
কী থেকে সেটা বোঝা যায়, উদিত জানে না। শুধু এইটুকু মনে হচ্ছে, কলকাতায় বউদির বোনও বোধ হয়, এমন অনায়াসে ওর কাছে নিজেকে ছেড়ে দিতে পারেনি। অথচ আজ সকালে সুতপাকে ও চোখে দেখেছে, সন্ধ্যায় কথা, তাও অপরিচিতই বলতে হবে। এটা কী করে সম্ভব হচ্ছে পুরুষ হিসাবে উদিতকে কি সুতপার ভয় নেই।
কাঁধের কাছে একটু চাপ লাগতে উদিত আর এক বার তাকাল। সুতপা ওর দিকে চেয়ে আছে। নিচু স্বরে বলল, খুব কষ্ট হচ্ছে, না?
কেন?
একলা জেগে জেগে গাড়ি চালাচ্ছেন?
কষ্ট হচ্ছে না, চোখ বুজে আসার ভয় লাগছে।
একটু চুপচাপ। সুতপার গলা আবার শোনা গেল, আপনি আমাকে মেটেলি অবধি পৌঁছে দেবেন?
উদিত অবাক হয়ে বলল, শিলিগুড়ি থেকে ট্রেনেই তো যেতে পারবেন।
রেলরাস্তা যদি ঠিক থাকে।
তা সত্যি।
যদি ঠিক না থাকে?
তা হলে একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
কী ব্যবস্থা?
এখন কী করে বলব।
আমি আপনার সঙ্গে যেতে চাই।
উদিত সুতপার দিকে তাকাল। সুতপার মতো মেয়ের চোখের অনুরাগ ওর চেনা নেই। কিন্তু সুতপার চোখের দিকে চেয়ে ওর বুকে কেমন দোলা লেগে গেল। সুতপা মাথাটা সরাচ্ছে না। আবার বলল, আপনার কি অনেক কাজ আছে?
উদিত বলল, আমি বেকার।
আবার চুপচাপ, কেবল এঞ্জিনের শব্দ।
এবার উদিত জিজ্ঞেস করল, আমাকে এত বিশ্বাস করছেন কেন বলুন তো।
সুতপা বলল, কথাটা আমিও সন্ধেবেলা থেকে ভাবছি। কেন তা আমিও জানি না।
উদিত আবার তাকাল। সুতপার স্থির চোখ, ওর ওপর নিবদ্ধ। ঠোঁটে কেমন একটা হাসি, দাঁত দেখা যাচ্ছে না। উদিত সামনে তাকাল। সুতপার নিচু স্বর শোনা গেল আবার, মানুষের মন বোঝা যায় না, আমি আমার মনই বুঝি না। বুঝতে পারছি না।
উদিতের এক বার মনে হল, বড়লোকের মেয়ে, প্রেম প্রেম খেলার অভ্যাস আছে হয়তো। কিন্তু কথাটা ওর নিজের কাছেই বেমানান লাগল। প্রেম প্রেম খেলা কি এইরকম। সেরকম চটুলতা তো সুতপা এক বারও দেখায়নি। ঢং বা ঢলাঢলি যাকে বলে, সুতপার আচার আচরণে তার কিছুই নেই। যেন অনেক দিনের চেনাশোনার মতো, উদিতের কাছে অনায়াসে নিজেকে সঁপে দিয়েছে।
সুতপার গলা আবার শোনা গেল, মানুষ চিনতে পারি কি না, জানি না। কিন্তু আমার এরকম কখনও হয়নি।
উদিত জিজ্ঞেস করল, কী রকম?
সামান্য চেনা একটা মানুষের সঙ্গে–পুরুষের সঙ্গে, এভাবে মিশে যাওয়া।
উদিত কিছু বলল না। ওর কাঁধে, সুতপার নরম চুলের চাপ লাগল আবার। শোনা গেল, আপনার কী মনে হয়।
উদিত জিজ্ঞেস করল, কীসের?
আমাকে? আমাকে আপনার কী মনে হচ্ছে। রাস্তার একটা বাজে খারাপ মেয়ে, না?
তা কেন মনে হবে।
তবে?
উদিতের বুকের কাছে কিছু যেন দাপাদাপি করছে। কথা বলতে পারছে না। এখন তাকাতেও পারছে না। ওর ভিতরের আবেগটা যেন কেমন রক্তিম আর মাতাল হয়ে উঠতে চাইছে। একটু পরে বলল, আমি যেন ঠিক ভাবতে পারছি না।
আমিও না।
বলতে বলতে সুতপা এক হাত দিয়ে উদিতের বলিষ্ঠ গলা স্পর্শ করল, উদিত সুতপার মুখের দিকে তাকাল, ওর বুকটা ধকধক করতে লাগল, কনুইয়ের কাছে ওর হাতের ওপর রাখা সুতপার নখ-রাঙানো ফরসা হাতটা এক বার দেখল। বলল, আমি একটা সামান্য ছেলে।
আমি কি অসামান্য?
মনে হয়।
কী রকম?
সব ব্যাপারেই। রূপ গুণ অবস্থা। সকালবেলা স্টলের কথা মনে আছে?
মানিকচক থেকে প্রথম মনে পড়েছিল, কোথায় যেন এ মুখ সকালে দেখেছি।
তখন আমার মনে হয়েছিল, বড়লোকের অহংকারী মেয়ে।
বড়লোক হয়তো, হ্যাঁ আমি বড়লোকের মেয়ে, কিন্তু অহংকারী না।
উদিত আবার তাকাল। সুতপার মুখটা একটু এগিয়ে এল, বলল, আমি অসামান্য নই।
উদিতের বুকের মধ্যে ধকধকানি বাড়ল। গাড়ির স্পিড ক্রমে কমতে লাগল। সুতপার শরীরের স্পর্শ লাগছে ওর বাঁদিকের গায়ে। সুতপা আবার বলল, আমার মনে হচ্ছে, আমার পিছনে কিছু নেই, সামনে কিছু নেই, আছে শুধু এই বর্তমানটা। এই বর্তমানের মধ্যেই আমার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
উদিত বলল, তা কি যাওয়া যায়?
বিচার করতে ইচ্ছা করছে না। বরং আমার গান করতে ইচ্ছা করছে।
গান?
হ্যাঁ, এই ভদ্রলোক না থাকলে, আমি গান করতাম। যাব না যাব না যাব না ঘরে।
সুতপার কথা শেষ হল না। পিছনে একটা আলোর ঝলক দেখা গেল। উদিত চকিত হয়ে, ভিউ ফাইন্ডারের দিকে তাকাল। সেই জিপ, দুরন্ত গতিতে এগিয়ে আসছে। ওর ভুরু কুঁচকে উঠল, মুখ শক্ত হল। সুতপা এত কাছে, ওর কোলের ওপর দিয়ে, গিয়ারে হাত দিল। স্পিড অনেক বাড়িয়ে দিল।
সুতপার চোখে উদ্বেগ ফুটল আবার, জিজ্ঞেস করল, সেই তারা?
মনে হচ্ছে।
আমার মনে হয় ওদের একটা উদ্দেশ্য আছে।
কী উদ্দেশ্য?
আমাকে ধরতে চায়।
ধরতে চাইবে কেন?
হয়তো ধরিয়ে দিতে চায়।
তার মানে?
তার মানে, আমি পালিয়েছি।
উদিত দ্রুত এক বার সুতপার মুখে চোখ বুলিয়ে নিল। জিপটা অনেকখানি এসে পড়েছে। বোধ হয়। ওরাও আশি মাইল স্পিড তুলেছে। নারায়ণের ঘুম ভেঙে গেল। জানালা দিয়ে তাকাল। জিপটা প্রায় পিছনেই। নারায়ণ কোমর থেকে রিভলবার বের করল। জিপটা বারে বারে হর্ন দিচ্ছে।
নারায়ণ বলল, না আর পারা যাচ্ছে না, আমি ওদের চাকায় গুলি করব।
উদিত ধমকে উঠল, একেবারেই না, বসে থাক।
কিন্তু এভাবে কতক্ষণ চলতে পারে?
ওদের আমি এগোতে দেব না।
কী চায় ওরা?
উদিত সুতপাকে এক বার দেখে নিয়ে বলল, কিছু হয়তো চায়।
নারায়ণ রাস্তার দিকে তাকাল। বলল, ওয়ারি পার হয়ে এসেছি না?
হ্যাঁ।
মহানন্দার জল রাস্তায় উঠে পড়েছে কি না কে জানে। সকালবেলা তো ওঠেনি দেখেছি।
দেখা যাক।
এই সময় সামনের দিক থেকে একটা গাড়ি আসতে দেখা গেল। সামনের গাড়িটাও জিপ বলে মনে হচ্ছে। উদিত লাইটের সিগনালিং করল, অফ করল, জ্বালল। সামনের গাড়িটা রেসপনস করল, আলো জ্বালিয়েই এগিয়ে আসতে লাগল। উদিত দু-তিনবার সিগনাল করল, তারপরে আলো জ্বেলেই, সমান গতিতে এগিয়ে চলল। যা হয় হবে, স্পিড কমানো চলবে না। ওর হাবভাব দেখে, সামনের জিপ আলোটা একবার অফ করল। উদিতের মনে হল, পুলিশের গাড়ি। উদিত বেরিয়ে যেতে চাইল, সামান্য একটু সাইড রেখে, একই গতিতে চলল, আলো নেভাল না। এখন সামনে পিছনে হর্ন বাজছে।
সুতপা এক বার বলে উঠল, পুলিশের গাড়ি না?
উদিত বলল, মনে হচ্ছে।
এ গাড়িটা দাঁড় করাতে চাইছে, মনে হচ্ছে।
চলে যাব।
মাঝখান থেকে সরছে না তো।
সরবে।
উদিত শক্ত গলায় বলল। ও যতই এগিয়ে গেল, সামনের গাড়িটা ততই হর্ন দিচ্ছে, সিগনাল করছে। উদিত কোনওরকম রেসপনস না করে গোঁ গোঁ করে এগিয়ে গেল। সামনের জিপটা যেন ছিটকে খানিকটা সরে গেল আর একটা চিৎকার শোনা গেল, সোয়াইন।
নারায়ণ সঙ্গে সঙ্গে পিছনে তাকিয়ে বলল, পিছনের জিপটা দাঁড়িয়ে পড়েছে, অন্য জিপটা তার পাশে।
উদিত চালাতেই লাগল। সুতপা পিঠের কাছে ওর জামা চেপে ধরে আছে। নারায়ণ আবার বলল, দুটো জিপই এদিকে আসছে মনে হচ্ছে।
উদিত বলল, পিছনে যে-ই আসুক, জোর করে না থামাতে পারলে, আমি থামছি না।
অত্যন্ত দৃঢ় শোনাল ওর গলা। ও সুতপার দিকে তাকাল! সুতপাও ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। বলল, আপনাকে কেউ থামাতে পারবে না।