৮. মঞ্চসজ্জা একই

০৮.

মঞ্চসজ্জা একই। সুবিনয়ের সাউথ এন্ড পার্কের ফ্ল্যাটের বাইরের ঘর। তেমনি আন্ডারওয়্যার আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে সুবিনয় সোফায় চিতপাত হয়ে বসে আছে। সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে একটানা। ফ্ল্যাটে ফিরে এসেই সে প্রীতির কাছ থেকে টুকে-আনা তার প্রেমিকের বাড়ির ফোন নম্বরে ডায়াল করে জানিয়ে দিয়েছে, ঠিক কোথায় এলে তারা লোকটার অচৈতন্য দেহটি খুঁজে পাবে। এখন সে খুবই শান্ত মেজাজে বসে আছে।

আমার গাল থেকে ডেটলের গন্ধ নাকে আসছে। শরীর কিছু দুর্বল লাগছিল। বুকে একটা ভয়।

সুবিনয় তেমনি মুখের এক পাশে আলো আর অন্য পাশে অন্ধকার নিয়ে হঠাৎ মাথাতোলা দিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি স্পষ্ট দেখলাম, ও আর বাঙালি সুবিনয় নেই। ওর মুখে, চোখে চেহারায় বিদেশি ছাপ পড়ে গেছে। কখন যে পড়ল কে জানে!

ও হুবহু মার্কিন উচ্চারণে বলল, ইউ নো সামথিং বাডি?

 আমি সভয়ে তাকিয়ে রইলাম।

 ও আপন মনে একটু হেসে বলল, উই আঃ গোয়িন টু সেল ইন দ্য স্টেটস। হেল্লুভা গুড কান্ট্রি।

আমি মাথা নাড়লাম। ডেটলের গন্ধটাউবে যাচ্ছে ক্রমে। গালটা জ্বালা করছে অল্প অল্প।

সুবিনয় উঠল। দেওয়াল-আলমারি খুলে একটা হুইস্কির বোতল বার করে ঢক ঢক করে খেয়ে নিল খানিকটা। হাতের পিঠে মুখটা মুছে নিয়ে উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে ফিরে বলল, উই ওয়্যার লাভারস ইন আমেরিকা, উই শ্যাল বি লাভারস ইন আমেরিকা। ইউ নো বাডি?

আমি মাথা নাড়লাম। বুঝেছি।

সুবিনয় আরও খানিকটা নিট হুইস্কি খেয়ে এসে আবার চিতপাত হয়ে সোফায় বসে বলল, আই’ল হ্যাভ প্রীতি, প্রসপেক্ট অ্যান্ড এভরিথিং ইন দ্য স্টেটস। দ্যাটস দ্য কান্ট্রি ফর আস। গিমমি আমেরিকা বাডি, গিমমি আমেরিকা।

বলে একটু হাসে সুবিনয়। তারপর গম্ভীর হয়ে হঠাৎ উঠে সোজা হয়ে বসে বাংলায় বলে, কিন্তু যাওয়ার আগে দুটো খুব জরুরি কাজ আছে।

আমার খিদেটা ক্রমে পেটের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। জাগছে। খোঁচা দিচ্ছে আমাকে। আমি একটু কোলকুঁজো হয়ে বসে সুবিনয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকি।

সুবিনয় বলে, প্রথম কাজ, ক্ষণাকে ডিভোর্স করা। দ্বিতীয় কাজ, টু ইনভেন্ট এ প্যালেটেবল পয়জন ফর দ্য মাইস অফ ইন্ডিয়া। ভারতবর্ষের ইঁদুরদের জন্য একটি সুস্বাদু বিষ।

উঠে পায়চারি করতে করতে সে বলল, দ্বিতীয় কাজটা অনেকখানি এগিয়েছে। ইট উইল বি এ রিভলিউশনারি ইনভেনশন। কী রকম জানিস?

কী রকম?

অনেকটা যেন স্বপ্নের ভিতর থেকে সুবিনয় বলল, অসম্ভব টেস্টফুল বিষ। যেখানেই রাখবি গন্ধে গন্ধে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি ইঁদুর ছুটে আসবে আনাচকানাচ থেকে। গর্ত থেকে বেরিয়ে আসবে, আসবে আলমারির তলা থেকে, বইয়ের র‍্যাক থেকে, ভাড়ার ঘর থেকে। অসম্ভব তৃপ্তির সঙ্গে চেটেপুটে খাবে, তারপর ঘুমিয়ে পড়বে চিরদিনের মতো। হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা যেমন টেনে নিয়ে গিয়েছিল ইঁদুরদের, অনেকটা তেমনি। সারা দেশে ইঁদুরদের সমস্ত নড়াচড়ার শব্দ থেমে যাবে। শুধু জমে থাকবে এখানে-সেখানে ইঁদুরের স্তূপ।

আমি সুবিনয়ের দিকে চেয়ে আছি গাড়লের মতো। আমার পেটের ভিতর অন্ধকারে একটা ইঁদুর আমার নাড়ি কাটছে, ছ্যাঁদা করছে পাকস্থলী, নিপুণ দাঁতে করাতের মতো চিরে দু’ভাগ করছে অন্ত্র।

আর-এক ঢোঁক হুইস্কি খেয়ে সুবিনয় উদগার তুলে বলল, দ্যাট উইল বি হেল্লুভা গুড ইনভেনশন। বিষটা বের করতে পারলে ওরা আমাকে নোবেল প্রাইজ দেবে। আই শ্যাল বি দ্য থার্ড ইন্ডিয়ান নোবেল লরিয়েট। অ্যান্ড দেন আমেরিকা। গট দ্য আইডিয়া চাম?

আমি মাথা নাড়ালাম।

সুবিনয় আমার কাছে এসে আঁচড়ানো গালটায় এক বার খুব আস্তে হাত রাখল। তাইতে আমার গাল জ্বালা করে উঠে। সুবিনয় একটা দুঃখের চুক চুক শব্দ করে বলল, খুব জোর আঁচড়ে দিয়েছে তোকে। হাঃ হাঃ।

টারজানের মতো আবার খানিক হেসে সুবিনয় ফের গম্ভীর হয়ে বলল, আমি কি তোকে বিশ্বাস করতে পারি উপল?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, আমি নিজেই নিজেকে করি না সুবিনয়। আমাকে বিশ্বাস করাটা ঠিক হবে না।

খুব করুণ মুখ করে সুবিনয় বলল, কিন্তু আমার যে আর কেউ নেই যাকে খুব বিশ্বাসের সঙ্গে একটা জরুরি কাজের ভার দেওয়া যায়।

আমি গালে আঙুল ঘষে ডেটলের গন্ধ আঙুলের ডগায় তুলে এনে শুঁকতে শুঁকতে বলি, কী কাজ?

সুবিনয় তার সোফায় চিতপাত হয়ে বসে মুখটা আড়াল করল। তারপর বলল, পরশুদিন আমি আমার উকিলের সঙ্গে কথা বলেছি।

কী ব্যাপারে? ডিভোর্স।

ও।

সুবিনয় সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, কিন্তু কাজটা সহজ নয়। আমার একটা ক্লিন ডিভোর্স চাই।

আমি হেলাভরে বললাম, মামলা কর।

সুবিনয় একটুও না নড়ে বলল, পয়েন্ট কী? এ দেশে ডিভোর্স করা কি সোজা! হাজার রকম ঝামেলা। তা ছাড়া ক্ষণা কিছুতেই ডিভোর্স দেবে না। আমি ওকে চিনি।

তা হলে?

ডিভোর্স আমার চাই-ই। উকিল বলছিল, আমি যদি অ্যাডালট্রিতে ইনভলভল্ড হতে পারি তবে আমার বউ সহজেই এভিডেন্স দেখিয়ে ডিভোর্স পেয়ে যাবে। শুনে আমি হেসেছি। আমি কয়েক শ’ অ্যাডালট্রি করলেও ক্ষণা আমার এগেনস্টে মামলা করতে যাবে না, ডিভোর্সও চাইবে না। এ দেশের মেয়েরা যেমন হয় আর কী, ভয়েড অফ অল সেলফ রেসপেকটস।

তা হলে?

 একটা উপায় আছে। ক্ষণাকেই যদি অ্যাডালটিতে ইনভলভড করা যায় তবে আমি এভিডেন্স দেখিয়ে মামলা করতে পারি।

আমি স্থির চোখে চেয়ে থাকি।

বুঝলি?– সুবিনয় বলে।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, বুঝেছি। কিন্তু আমাকে কী করতে হবে?

অ্যাডালট্রি।

কার সঙ্গে?

তেমনি চিতপাত শুয়ে থাকা, মুখ আড়াল করা সুবিনয় একটুও না নড়ে বলল, ক্ষণা।

বলিস কী? আমি আঁতকে উঠে বলি।

সুবিনয় আস্তে করে উঠে বসে। মুখের এক ধারে আলো পড়ে, অন্য ধারে অন্ধকার। গ্রানাইট পাথরের তৈরি মুখ। আমার দিকে চেয়ে থেকে বলে, দেয়ার উইল বি মানি ফর ইট। এনাফ মানি।

আমি মাথা নেড়ে বলি, পাগল!

 সুবিনয় স্থির চোখে আমাকে দেখে গম্ভীর গলায় বলে, তুই কি মরালিস্ট উপল?

 দ্বিধাভরে বলি, নননা!

কোথা থেকে হঠাৎ একটা টাকার তোড়া আমার দিকে ছুড়ে দেয় সুবিনয়। আমার হাঁটুতে লেগে সেটা মেঝেতে পড়ে। তুলে নিয়ে দেখি, একশো টাকার দশখানা নোট, টাটকা তাজা নোট, সদ্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে আনা। এখনও স্টেপলারের পিনে আটকে আছে।

সুবিনয় বলল, স্টার্ট উইথ এ থাউজ্যান্ড। দেয়ার উইল বি মোর থাউজ্যান্ডস

আমি মাথা নেড়ে বলি, এ হয় না সুবিনয়।

 কিন্তু আমার গলাটা কেঁপে যায়।

সুবিনয় অতি করুণ স্বরে বলে, অবলাইজ এ ফ্রেন্ড বাডি। গিভ পিস টু এ সাফারিং সোল।

আমি কী করব তা বুঝতে পারি না। টাকার জন্য আমি চুরি-ডাকাতি করতে গেছি, আমি অনায়াসে নিয়েছি মানিক সাহার চার নম্বর বউ ঝুমুরকে। আমার গোটা জীবনে কোনও নৈতিকতা নেই। উপরন্তু আমার আছে কালব্যাধির মতো একটা খিদে। যখন খিদে মিটে যায় তখনও আবার খিদের চিন্তা থাকে, ভয় থাকে। ক্যানসারের মতো, কুষ্ঠের মতো সেই খিদে কখনও সরে না।

সারাটা জীবন আমার বাবার মতোই আমি কেবল নিষ্ফল পয়সা খুঁজেছি। পাইনি যে তা নয়। কিন্তু গুপ্তধনের মতো, জলপ্রপাতের মতো, বিস্ফোরণের মতো পয়সা কখনও আমরা খুঁজে পাইনি। আগে ছিল, মফসসলে শহরের সিনেমার নতুন ছবি এলে ড্রাম বাজিয়ে রিকশায় বিজ্ঞাপন বেরোত, একটা লোক রিকশা থেকে অবিরল বিলি করত হ্যান্ডবিল। বাচ্চারা প্রাণপণ ছুটত সেই রিকশার সঙ্গে, মুঠো মুঠো হ্যান্ডবিল কেড়ে আনত। একদিন স্বপ্নে দেখেছিলাম, ঠিক ওইরকম একটা ছ্যাকড়া রিকশা থেকে হুবহু ওইরকম একটা লোক হ্যান্ডবিলের বদলে টাকা বিলি করতে করতে যাচ্ছে। আমি বরাবর ওইরকম অনায়াসে হ্যান্ডবিলের মতো টাকা চেয়েছি। চেষ্টাহীন টাকা, বিনা কষ্টের টাকা।

হাতের আঁজলায় হাজার টাকার দিকে চেয়ে একটু হাসলাম। একটু কি কাঁদলামও? বললাম, তুমি এলে?

ক্ষণার কথা মনেও রইল না, সুবিনয়ের কথাও না, প্রীতি বা আর কারও কথাও নয়, ডেটলের গন্ধ নাকে আসছিল না আর, গালের জ্বলুনি টেরও পাচ্ছি না। শুধু অনেক টাকার দিকে চেয়ে আছি। ভাবছি, তুমি এলে? কী সুন্দর তুমি?

করবি তো উপল?– সুবিনয় জিজ্ঞেস করল, তারপর বলল, দেয়ার উইল বি মোর থাউজ্যান্ডস।

কী করার কথা বলছে সুবিনয় তা আর আমার মনে পড়ল না। প্রাণভরে টাকার সৌন্দর্য দেখে আমি দুই মুগ্ধ, জলভরা চোখ তুলে তাকাই। ঝাপসা ঘর। ঝাপসা এক অস্পষ্ট মানুষ। ঝাপসা আলো-আঁধারি।

বললাম, করব।