৮. বিলকিস ভেতরে এলে

বিলকিস ভেতরে এলে তার মা বললেন, তোর আক্কেলটা কী বলতো?

বিলকিসের মনটা যেন হোঁচট খায়। নিজেকেই অবাক করে দিয়ে সে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, কেন, কী হয়েছে?

কী আবার? টুকু আর টুবলুকে নিয়ে বকুলের কাছে যাবি বলেছিলি। সেজেগুঁজে কাঁদছে। গল্পটা কমালে কী হয়?

বিলকিসের চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নিজেকে শান্ত করে বলে, তার আমি কী করব? আমি পারব না।

দুপদাপ করে নিজের ঘরে আসে বিলকিস। কোথায় যেন কী হচ্ছে। বুঝতে পারা যাচ্ছে না। এ বই সে বই ওলটাতে থাকে, চেয়ার বদলায়, জানালার পর্দাগুলো মুক্ত করে দেয় কিন্তু কিছুতেই স্বস্তি নেই তার।

টুকু আর টুবলু হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে। মায়ের কাছে আজ তারা ফিরে যাবে বলছিল। বেরিয়ে এসে তাদের ভীষণ আদর করতে থাকে সে। তারপর কান্না থামলে নিজের ঘরে এসে চিঠি লিখতে বসে। লেখে—-

মন্টি, আজ তোমার জন্মদিন।
সকালে মনে হলো, শিয়রে দাঁড়িয়ে তুমি আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলে।
আচ্ছা, তোমার যখন ঘুম ভাঙ্গল আজ, কার কথা মনে পড়েছিল? আমার গা ছুঁয়ে বল।
মন্টি, আমার একী হয়েছে? নিজেকে আমি কিছুতেই ধরে রাখতে পারছি না। রাগ হচ্ছে, অভিমান হচ্ছে, চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। আমি ভেঙ্গে পড়বার আগেই কী তুমি আসবে? নাকি এসে আমার মৃতদেহ দেখবে? তোমার অমন করে বাইরে না থাকলেই নয়? আজ রাতটা ইচ্ছে করছে তোমাকে যেন স্বপ্নে দেখি।

চিঠিটা শেষ হলে সুন্দর করে ঠিকানা লিখল। তারপর বন্ধ করবার আগে সমস্ত কাগজে মুখ বুলে বিলকিস; যেন তার সমস্ত অনুভব, সমস্ত কথা, সম্পূর্ণ মনটা যা লেখা গেল না, এমনি করে রেখে দিল চিঠিটায়।

টুকু আর টুবলুকে নিয়ে বেরুলো সে। ওদের দিয়ে আসার পথে নিজে ডাকবাক্সে ফেলে আসবে চিঠিখানা। কিছু চিঠি থাকে, নিজের হাতে না পাঠালে মনের মধ্যে সারাক্ষণ কেমন কেমন করতে থাকে।

.

বেলা শেষে মেঘের মতো বীথি ঘুমিয়ে ছিল। হাশেম তার পাশে বসে গালে হাত রাখল। নিজের গায়েই এত জ্বর তবু বীথির উত্তাপটা ধরা পড়ছে। কাল রাত থেকে কিছু খায়নি বীথি। কদিন থেকে যে দুর্বলতা যাচ্ছিল আজ তা জ্বর হয়ে দেখা দিয়েছে।

তোকে দেখতে এসেছি রে।

বীথি শুনতে পেল না হয়ত। নাকি খুব কষ্ট হচ্ছে? তার আঙ্গুলগুলো তুলে নিল হাশেম। ডাকল, বীথি, আমি।

হাশেমের গলা কাঁপছে থরথর করে। যেন ঝড়ের মধ্যে দৌড়ে এসে একটা মানুষ আর কথা বলতে পারছে না।

নিজের ওপর নিজে শোধ নিতে নিতে ক্লান্ত অসুস্থ হয়ে গেছে বীথি। সেই ক্লান্তির ভেতর থেকে যেন মনে হলো ডাক এসেছে। তখন ফিসফিস করে স্বপ্নের ভেতরে, স্বপ্ন থেকে জাগরণের দিকে যেতে যেতে বীথি উচ্চারণ করল, আবু ভাই এসেছ!

পাশেই ছিলেন আমেনা আর মরিয়ম। এ নাম শুনে তাঁরা দুজনেই বিব্রত হয়ে গেলেন। চোখ ফিরিয়ে নিলেন বীথির দিক থেকে। এবার দুজনে দুজনের দিকে চোখ পড়তেই অপ্রস্তুত মরিয়ম ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হাশেম আরো শক্ত করে ধরে রাখে বীথির আঙ্গুল। চোখ মেলে তাকে দেখে সংকুচিত হয়ে যায় বীথি। এ কী করছিল সে? বুকের ভেতর মোচড় ওঠে। হাশেমের হাতটা ধরে রাখে; উৎসুক চোখে সারা ঘর অনুসন্ধান করে কার জন্যে। পরে নিভে যায়।

তখন আমেনাও বেরিয়ে আসেন। তাকে দেখে মরিয়ম বলেন, হাশেমের কী আক্কেল আছে বুবু? এত জ্বর নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছে কাউকে কিছু না বলে।

মরিয়ম যেন জোর করে চিন্তা থেকে বীথিকে দূরে ঠেলে রাখতে চান। তাই হাশেমকে নিয়েই কথা বলতে থাকেন বিরতিহীন। যেন উপসর্গটা এতেই কমে যাবে। বলে চলেন, ঘরে গিয়ে দেখলাম, হাশেম নেই। মনে করলাম, আছে কোথাও। তাও এলো না। একা বাসায় আমি। আমাকে ও শুধু জ্বালাতেই এসেছে। কান্না ফুটে বেরুতে থাকে মরিয়মের কণ্ঠে। বিকেলে ছেলেকে না পেয়ে দিশাহারা হয়ে ছুটে এসেছিলেন এ বাসায়। মনে করেছিলেন, বীথির মায়ায় হাশেম বুঝি এখানে এসেছে। কিন্তু এখানেও ছিল না।

আমেনা তখন যেতে দেন নি মরিয়মকে। বলেছেন, ও এখানেই আসবে দেখিস। সত্যি সত্যি একটু আগে এখানে এসেছে হাশেম। আমেনা বললেন, তুই একটুতেই ঘাবড়াস মমো। বললাম, ছেলে যাবে কোথায়? বীথি অসুখে, দেখলি তো এখানেই এলো?

না বুবু, আমার বুকের ভেতর কেমন করছে।

আমেনা তখন মরিয়মকে মোড়া টেনে বসতে দেন। নিজেও সামনে বসেন। বলেন, আচ্ছা মমো, একটা কথা সত্যি করে বলতো।

মরিয়ম উদ্বিগ্ন হয়ে তাকান তার দিকে।

—-বীথিকে তোর বউ বলে পছন্দ হয় না? আমি বোধ হয় ওকে এ বাসায় এনে ভুলই করলাম।

কার কথা বলছ?

আহা, আবুর। তোর কী চোখ নেই, মমো? আবুর জন্যে ওর পরান পড়ে আছে দেখতে পাস না?

ওদিকে ঘরের মধ্যে হাশেম আর বীথি। বীথির আঙ্গুলগুলো তখনো তার হাতের মধ্যে। বীথিকে কী সুন্দর লাগছে তার। সে বলল, খুব কষ্ট হচ্ছে তোর? ডেকে আনবো ওকে?

বীথি মাথা নাড়ে—- না, না।

আজ হাশেমেরও অসীম কষ্ট। তাকে মাথা নাড়তে দেখে ভীষণ চটে যায়। তার হাত ফেলে দিয়ে বলে, তুই এত বোকা কেন রে? তুইও কি আমাকে শান্তিতে মরতে দিবিনে, বীথি? উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের মধ্যে অশান্ত পায়চারি করতে থাকে হাশেম। জানালাটা খুলে দেয় ভাল করে। রক্তিম আকাশ দেখা যায়। সেখান থেকে ফিরে এসে বীথির সমুখে স্থির হয়ে দাঁড়ায় সে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিটা এড়াবার জন্যে বীথি প্রশ্ন করে, অসুখ নিয়ে এলে কেন?

হাশেম আবার তার পাশে বসে পড়ে। বলে, অসুখ কইরে? আমি যে ভাল হয়ে গেছি। দ্যাখ আমার গা ছুঁয়ে। দ্যাখ তুই।

বীথির হাতটা তুলে নিজের কপালে রাখে।

—-কী দেখলি?

অসম্ভব জ্বর হাশেমের। বীথি ম্লান হাসল উত্তরে! তখন হাশেম ঝটকা মেরে তার হাতটা ফেলে দেয়। বলে, ও। তুইও বিশ্বাস করলি না?

আবার উঠে পায়চারি করতে থাকে। যেন মাঝে মাঝে কিসের টানে বাধা পড়ে যাচ্ছে, তাই বসতে হচ্ছে, নইলে এমনি করে হেঁটে হেঁটেই সে জীবনপাত করত।

ঘরের ভেতরে বাইরের রাঙ্গা আলো এসে পড়েছে। সেই অপূর্ব আলোর ভেতরে তন্ময় হয়ে চলতে চলতে ঠিক প্রথম দিনের মতো সমুখের শূন্যতাকে উদ্দেশ করে হাশেম বলতে থাকে, জানিস বীথি, পৃথিবী জুড়ে সবাই কষ্ট পাচ্ছে। মনে করলাম, বাইরে দাঁড়িয়ে সব মোহ ফেলে দিয়ে, সবার শান্তি দেখে বুক জুড়োবো। শুনতে পাচ্ছিস বীথি, আমি কী বোকা। আমার স্পর্ধা দেখেছিস তুই! —-দূর তুই কিসসু বুঝতে পারছিস না। তোর কেন অসুখ হলো রে? মরতে চাস বুঝি? বড্ড কষ্ট বীথি তুই, মরিস না।

বিছানায় উঠে বসতে চায় বীথি। মৃত্যুতে এত কষ্ট, তবে তার সান্ত্বনা কোথায়? আরো কী কষ্ট হয় মৃত্যুতে? হাশেম এগিয়ে এসে দ্রুত দুহাতে তাকে ভর দেয়, আস্তে আস্তে উঠিয়ে আনে বালিশ থেকে বিছানা থেকে। বলে, আমার সঙ্গে হাঁটবি? তাহলে আমাকে ভাল করে ধর। দ্যাখ কী সুন্দর সন্ধ্যে হচ্ছে।

বীথি তার হাত ধরে বলে, তোমার গা কাঁপছে হাশেম ভাই।

আর্তনাদের মতো শোনায় হাশেমের উত্তরটা তাই নাকি রে? বেশ, আমাকে ছেড়ে দে।

কিন্তু বীথি তবু ওর হাত ধরে রাখে। মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার আজ কী হয়েছে? নিজের অসুস্থতার কথা মনেও থাকে না বীথির। আবছা করে বুঝতে পারে এই মানুষটার মনের মধ্যে প্রচণ্ড এক ঘূর্ণি উঠেছে, যা আজ একেবারেই নতুন। চোখ বিস্ময়ে আকুল হয়ে ঠে। বীথি হাশেমের হাত ধরে নাড়া দেয়। তখন হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হাশেম বলে, তোকে দেখতে এলাম, আর তুই কী না আমাকে নিয়েই পড়লি। আমি জানি না বুঝি তোর মরতে সাধ হয়েছে।

হাঁটতে হাঁটতে হাশেম জানালার কাছে চলে যায়।

মানুষের মনটা, জানিস বীথি, বিরাট এক বনের মতো। কুল নেই, দিক নেই, মাথার ওপরে আলো নেই—- নিথর এক বন। আর তোর বাসনা, আকাক্ষা ওটা হচ্ছে বাঘ। সোনার মতো, রক্তের মতো সেই বাঘটা সেখানে রাজা হয়ে আছে। মানুষ তাকে আফিম খাইয়ে চিড়িয়াখানায় ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চায়। থাকবে কেন? ও যে রাজা। একদিন শিকল ছিঁড়ে অরণ্যে গিয়ে তোলপাড় করে তুলবে না?

হাশেমের চোখ কী অদ্ভুত রকমের শূন্য। ভূতগ্রস্তের মতো লাগছে তাকে। বীথির দেখে ভয় করতে থাকে। নিজের নিঃসঙ্গতা যেন আরো দশ গুণ হয়ে উঠতে চায়। হাশেম বলে চলে, হারে হা। আমি কি মিথ্যে বলছি? নইলে, সবাইকে ফাঁকি পর ফকির দিয়ে জীবনটাকে ভরিয়ে তুলতে দেখে এত খ্যাপা হয়ে গেলাম কেন?—-দ্যাখ দিকি, তোর অসুখ আর আমি বকবক করে যাচ্ছি। আয় তোর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দি। আয়।

বীথিকে কাছে আসতে হয় না। হাশেমই এগিয়ে তার কপালে হাত রাখে। আস্তে আস্তে বুলিয়ে দেয়। বীথির যেন মনে হয়, হাশেম এমনি করে নিজেকেই সান্তনা দিচ্ছে। হাশেম বালে, ভয় পাসনে বীথি। ভয় করতে নেই। জীবন কখনো ভয়কে মেনে নেয় না। কী তুই! এত কষ্ট শুধু শুধু পাস।

হাশেম ওর কপাল ছেড়ে হাতটা তুলে নেয়। আলতো করে অপ্রত্যাশিত একটা চুমো দেয় হাতে। তারপর কিছু না বলে চলে যায়। যেন, হঠাৎ কোথাও তারপর কিছু না বলে চলে যায়। তার ছিঁড়ে গেছে। এক মুহূর্তে তাই সব স্তব্ধ হয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে গেল বাইরের নেমে আসা সন্ধ্যের মতো। ঘর থেকে হনহন করে হাশেমকে বেরুতে দেখে আমেনা আর মরিয়ম দুজনেই অবাক হয়ে যান। হাশেম ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যায় মাতাল নৌকোর মতো। কিন্তু কী ভেবে আবার ফিরে আসে। এসে বলে, বীথিকে দেখো। আমি বাসায় যাই।

.

আবু বাসায় ফিরে দেখল একটাও বাতি জ্বলেনি। কেবল রান্না ঘরের খোল৷ দুয়ার দিয়ে নিম গাছের কোল অবধি এক ফালি আলো পড়েছে। সারাবাড়িতে কেউ নেই। যেন এমন একটা পরিবেশ তার জন্যে দরকার ছিল। বিলকিসের ওখান থেকে বেরিয়ে কোথায় গেছে, কী করেছে, কী ভেবেছে, কিছুই মনে পড়ছে না। মাথার ভেতর যন্ত্রণাও নেই, স্বস্তিও নেই। রাজ্যের অন্ধকারে তলিয়ে থাকা বাসায় ঢুকে তার মনে হল—- হ্যাঁ, এইতো আমার বাসা। অন্ধকার বড় ভালো লাগল তার। স্নায়ুর ভেতরে উদ্বেগ ছমছম করছে, কিন্তু তবু ভালো। চাকরটার কাছে শুনল, মা বড় চাচিদের ওখানে। শুধালো, হাশেম ভাই?

ওপরে আছেন।

তখন আবু উঠে এল ওপরে। এই মুহূর্তে বড় আপন মনে হচ্ছে তার মায়ের পেটের এই ভাইটাকে।

হাশেমের ঘরে বাতি জ্বেলে দিয়ে যায়নি কেউ। ভারী রাগ হলো তার চাকরটার ওপর। ভাইয়ের নাম ধরে ডাকল একবার। কোনো উত্তব এলো না। নিমের ডালে হঠাৎ দোলন। লাগল বাতাসে, যেন ওটাই তার উত্তর। বাতি জ্বালল আবু। এতক্ষণ অন্ধকারের পর আলোটা চোখ ধাধিয়ে দিয়ে গেল। চোখ সয়ে এলে দেখল, হাশেমের বিছানা শূন্য। বারান্দাটাও তেমনি শূন্য, নিঃশব্দ।

তখন বাতি নিবিয়ে নিজের ঘরে এসে বাতি জ্বালল। দেখল, তার টেবিলের ওপর একটা চিঠি চাপা দেয়া। কাছে আসতে হলো না। দূর থেকেই লেখা দেখে বুঝল, কার চিঠি।

চলে যাচ্ছি। না এলেই পারতাম। আমি তো মরেই গিয়েছিলাম, আবার মরতে এসেছিলাম কেন? বকুলের সঙ্গে দেখা করে আজ আমার নতুন চোখ খুলেছে। দেখলাম, একজনের মৃত্যু আরেকজনের কাছে কত অর্থহীন। তাই আবার আমি বিরাট পৃথিবীর কাছে ফিরে যাচ্ছি।

তুই অন্ধ আবু। তুই অন্ধ, বীথি তোকে ডাকছে, তুই শুনছে পাচ্ছিস না? এমন করে সব অপচয় করবি?

মনের অসুখটা বীথির শরীরে গিয়ে পৌঁছেছে। আমি তো জানি, কী হবে এরপর। আমার অভিশাপই কুড়োবি, না হাত বাড়িয়ে ওকে নিবি? ও তোকে এমন করে ডাকছে আজ, তুই শুনতে পাচ্ছিস না? তুই ছিলি কোথায়? আমার ভালোবাসা রইল।

ইতি, হাশেম।

চিঠি পড়ে প্রথমে আত্মায় কোন সাড়াই জাগে না। চিঠিটাকে ভাঁজ করে রেখে দেয় শূন্য ফুলদানির ভেতরে। এ ফুলদানিটা বীথি রোজ সাজিয়ে রাখত। বাতি নিবিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল আবু।

তখন ওই জানালার ওপারে অন্ধকার থেকে, অন্ধকারের ভেতর থেকে আস্তে আস্তে ভেসে উঠল হাশেমের মুখ। আর বকুল। বকুলের মুখটা কবরের মতো মনে হলো তার। হাশেম নেই, ছিলও না কোনদিন। চলে গেছে, এটা যেন কত সুন্দর একটা শেষ। বিলকিস যা বলেছে, তাও কত মহিমা জড়ানো শেষ। বীথিকে নিয়ে গেছে, বীথি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে—- এটাও একটা শেষ।

 আমি কিছু ভাবতে পারছি না—- আরো একটি শেষ, শেষের পর। আর এই অতল অন্ধকার সব কিছু কোলে করে রেখেছে তার অপরূপ অবোধ মমতা দিয়ে। নিশ্চল হয়ে শুয়ে রইল আবু। যেন তার মৃত্যু হচ্ছে। প্রেমিক, কুটিল, মহৎ, নিষ্ঠুর মৃত্যু। যন্ত্রণাহীন মৃত্যু। মৃত্যু যে এত স্বস্তি, এত সুন্দর, তা কে জানত? স্পষ্ট করে নিজের মৃত্যুকে দেখতে পায় আবু। এত স্পষ্ট, এত মায়া জড়ানো যে মনে হয় রাজার মুকুট মাথায় দিয়ে আছে সে। আহ, দীর্ঘ হোক মৃত্যুর এই মুহূর্ত। আসুক ধীরে ধীরে, নিয়ে যাক মেঘের ভেতর দিয়ে দূরে, আরো দূরে। চোখ বুজে তাকে কোথায় কোন রাজ্যে কে নিয়ে যাবে বলে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের দুয়ার খুলে অপেক্ষা করতে থাকে আবু। চোখ ভরে সে দেখতে পায় তার ঘর আলো হয়ে উঠেছে, যে আলো দেখা যায় না, অনুভব করতে হয়। আর এক সুদূর সুরেলা কণ্ঠ ভরে তুলেছে সারাটা পৃথিবী, পৃথিবী ছাড়িয়ে আকাশ, আর আকাশের নিচে মায়ার মতো ঘরের পর ঘর, বাঁশবন, প্রাঙ্গণ, ঐ রাস্তা। স্পষ্ট সে শুনতে পায়, ছোটবেলায় যে হাফেজের কাছে কোরান পড়ত, তিনি কবেকার রাত দুপুরের মতো অন্তরের শিখা জ্বালিয়ে আবৃত্তি করছেন পাক কোরান। তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। অনুভব করা যাচ্ছে, তিনি তার শিয়রে এসে হাঁটু মুড়ে বসেছেন। সারাটা ঘর ভরে উঠেছে গাঢ় লোবানের ঘ্রাণে। আর তার বিছানাটা হয়ে উঠেছে। প্রাচীন, আবলুস কালো একটা খাট—- যার পা বাঘের থাবার মতো। শাদা বালিশে মাথা রেখে, শাদা চাঁদর বুক অবধি টেনে সে ডুবে আছে। আলো অন্ধকারে মৃত্যুর বাড়ানো হাত তুলে নিচ্ছে তাকে। পাশে দাঁড়িয়ে বাবা, মা, মাহবুব ভাই, হাশেম ভাই। সবাই তাকে দেখছেন, ঈর্ষা করছেন। আজ যে আমার মৃত্যু হচ্ছে। মা, তুমি ছোটবেলায় গল্প বলতে?—-মানুষ মরে গেলে তাকে শাদা ঘোড়ায় পিঠে করে আকাশ দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যায়?

.

আবু নিস্পন্দ হয়ে পড়ে থাকে। ঐতো বাইরে শোনা যাচ্ছে কোন অতীত থেকে ছেলেদের হুল্লোড়। ঐতো সেই পাথর বাঁধানো রাস্তাটা, যে রাস্তার দুদিকে কেবল গাছ আর গাছ গাছের চূড়া ছড়ানো নীল আকাশে যে গাছের ছায়া ধরে হেঁটে অভিমান করে অনেক দূর চলে যাওয়া যেত।

বিছানায় শুয়ে থেকে, মৃত্যুর হাতের নিচে, আবু দেখে সেই রাস্তায় রোদ পড়েছে। রোদটা তাকে সোনা হয়ে ডাকছে। ছেলেরা উতল হয়ে উঠেছে। দূরে, কতদূরে, সেই নদীটা খলখল করে তাকে ডাকছে। আবু বিছানা থেকে স্বপ্নের মতো উঠে দাঁড়ায়। সম্মোহিতের মতো বারান্দা পার হয়ে নামতে থাকে সিঁড়ি দিয়ে। বাগানের ভেতরে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট শুনতে পায় ছেলেদের কোলাহল। রোদের ভেতরে বেড়িয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। পা বাড়ায়। কিন্তু সামনে যে নদী। নদীর কী নাম ছিল যেন? একেক দিন বাবার হাত ধরে এই নদীটার পাড়ে ঘুম থেকে উঠে আসা ভোরের মতো আজো যেন ডাক দিচ্ছে। যোজন কুয়াশার মতো বিছিয়ে আছে তার পাড়, তার স্রোত; তার। স্পন্দন যেন বুকের স্পন্দন। বেলি গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে অন্ধের মতো আবু ব্যাকুল দুহাত বাড়িয়ে কাকে যেন খুঁজতে থাকে।

খুঁজে পায় না। খুব কষ্ট হয়। অনেকদিন আগে মাহবুবকে বিছানা থেকে ফেলে দিয়েছিল আবু। পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে দরদর করে রক্ত পড়ছিল তার। তারপর রাতে ভীষণ জ্বর এসেছিল। সেই কবে, সেদিন যেন ঠিক এমনি কষ্ট হচ্ছিল আবুর। বাবা তো তাকে কিছু বলেননি।

তবু রাতে ঘুমোতে গিয়ে, তার ভেতর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাবার বুকে। বলেছিল, ও মরবে জানলে আমি কক্ষনো ধাক্কা দিতাম না। সত্যি বলছি, সত্যি বলছি। সেদিন বাবা তার পিঠে হাত বুলিয়ে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, মরবে না রে। তুই দৌড়ে গিয়ে ওকে চুমো দিয়ে আয়। ভালো হয়ে যাবে।

আবু পাগলের মতো আবার হাত বাড়ায়। উন্মত্তের মতো সারাটা বাগানে খুঁজে ফেরে। নদীটা কুয়াশা। সেই কুয়াশার অন্তঃস্থলে অভিমানী দীপ্তির মতো কার অনুভব যেন লুকিয়ে থাকে। সহস্র অশ্রুতে বিকৃত কণ্ঠে হাহাকার করা ডাক দিয়ে উঠে আবু, বীথি, বীথি–ই, বীথিরে। নামহীন কবেকার দেখা সেই নদীটার তীর থেকে তীরে ভোরের আলো কুয়াশার ভেতরে নৌকো থেকে নৌকোর দিকে ডাকের মতো ধ্বনিটা আছড়ে পড়ে আবুর চারদিকে। কুয়াশা যেন থরথর করে ফেটে ফেটে পড়তে চায়।

লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা
১৯৬০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *