০৮.
বাড়ি থেকে বেরোবার সময় কিকিরা বললেন, “স্যান্ডেল উড, পাঁজিতে আজ কী লিখেছে জানো? মঙ্গলবার কালরাত্রি–ঘ ৬/২৭ গতে ৮/৫ মধ্যে। যোগিনী-পূর্বে। মাসদগ্ধা। ক্লীং রিং হিং…।”
চন্দন আর তারাপদ হেসে উঠল। কিকিরাও হাসছিলেন। চন্দন বলল, “আপনি কি পঞ্জিকা-পণ্ডিত?”
“কে বলেছে হে! সংসারে সব জিনিস একটু-একটু চেখে রাখতে হয়। চিংড়ি মাছের পায়েস থেকে পঞ্জিকার কালরাত্রি পর্যন্ত। আজ মঙ্গলবার। যাচ্ছি তন্ত্রাচার্য শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধ কল্পবৃক্ষর কাছে। এমন শুভ বা অশুভ দিন-যাই বলো একবার দেখে নিতে হয় বইকি! জয় মা তারা।”
তারাপদ হাসতে-হাসতে বলল, “আপনাকে কিন্তু সুপার্ব দেখাচ্ছে। মেটে ফিরিঙ্গি।”
কিকিরা হেসে ফেললেন। চন্দন বলল, “মেটে ফিরিঙ্গি কাকে বলে, জানেন?”
“না।”
“মেটেবুরুজের ফিরিঙ্গি।”
তিনজনে হাসতে হাসতে নিচে রাস্তায় নেমে এল। সন্ধে হয়নি তখনও তবু এই হেমন্তের মরা বিকেলে অন্ধকার নেমে গিয়েছিল।
কিকিরাকে সত্যিই অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। লম্বা লম্বা ডোরাকাটা এক প্যান্ট পরেছেন। ডোরাগুলো কালো। প্যান্টের জমিটা খয়েরি রঙের। এ-প্যান্টের কাটছাঁট কোন দরজির কে জানে! পাগুলো সরু-সরু, কোমরের কাছে ঢোললা। গায়ে চেক শার্ট, শার্টের ওপর এক হাফ হাতা সোয়েটার। গায়ের কোটটা কুচকুচে কালো, তার ঝুল নেমেছে হাঁটু পর্যন্ত। গলায় এক সিল্কের মাফলার। মাথায় ফেলট হ্যাট। চোখে গোল কাঁচের চশমা। ফ্রেমটিও সেই রকম, তারের ফ্রেম কানে জড়ানো সেকেলে ছিরি, চশমার।
রাস্তায় এসে কিকিরা বললেন, “আমার নাম কী জানো?”
“কী?”
“বিভুপদ হংস।”
“হংস?”
“আজ্ঞে, হংস। হাঁস। ডাক্।” কিকিরা হাতের ছড়িটা দোলাতে দোলাতে গম্ভীরভাবে বললেন, “বিপদ হাঁস হল আদ্রা পুরুলিয়ার লোক। বাবা ষষ্ঠীপদ। হাঁস। বিভুপদ কাঠ, সিমেন্ট, মাটি, মশলা, গুড়-এর কারবারি। তার গাঁটে-গাঁটে দশ-পঞ্চাশ-একশোর বাজারি নোট গোঁজা থাকে। ভেরি রিচ, বাট ড্যাম্প ফুল। বিভুপদ তার বাবার সঙ্গে দুটো কথা বলতে চায়। বাবা পাঁচ বছর আগে হেভেনে চলে গেছেন। তাঁর একটা উইল ছিল। সেই উইল যে কেমন করে আগাগোড়া পালটে গেল কে জানে। বিভুপদ তার বাবার কাছে দুটো কথা জানতে চায়। ব্যস। …”
চন্দন একটা ট্যাক্সি দেখতে পেয়ে হাত তুলে চেঁচাল, “ট্যাক্সি।”
ট্যাক্সি দাঁড়াল।
কিকিরারা উঠে পড়লেন। ট্যাক্সিঅলা যেন মজার চোখে দেখলেন কিকিরাকে।
“যাবেন কোথায়?”
কিকিরা বললেন, “নিমতলার দিকে।”
ট্যাক্সিঅলা অদ্ভুতভাবে “ও,” বলল।
ট্যাক্সিতে যেতে-যেতে তারাপদ বলল, “আচ্ছা স্যার, জোয়ারদারকে তো আপনি বিশ্বাস করলেন। ওই সাহেব যদি ফাঁসিয়ে দিয়ে থাকে।”
“দেবে না। ও নিজে বেশ চটে আছে।”
“তবু…”
“কোনো চিন্তা নেই। আমি কিকিরা দি ওয়ান্ডার। আমার এই মেটে ফিরিঙ্গি ড্রেসের তলায় ম্যাজিশিয়ান কিকিরা বিরাজ করছে হে! কল্পতরু আমার কিছু করতে পারবেন না। তবে ষণ্ডাদের দিয়ে মারধোর করলে মরে যেতে পারি। দেহ অতটা সইতে পারবে না।”
চন্দন বলল, “আমরা থাকব কিকিরা, ওয়াচ রাখব। আপনি শুধু একবার ত্রাহি-ত্রাহি চেঁচাবেন।”
তারাপদ হেসে বলল, “আগে বললে ক’টা পটকা কিনে আনতাম কিকিরা। কালীপুজোর রেশ চলছে।”
কিকিরা বললেন, “তারাপদ, ছেলেবেলায় আমাদের পাড়ার ক্লাবে যাত্রা হত। তাতে একবার আমি এক সেনাপতির পার্ট করেছিলাম। কথা কম কাজ বেশি মাকা পার্ট। মানে যখন-তখন আমাকে তরোয়াল বার করতে হত খাপ থেকে আর ঢোকাতে হত। আর বলতে হত, যথা আজ্ঞা মহারাজ।’ তা অন্য সময় তরোয়াল কোনো গণ্ডগোল বল না, খুললাম বন্ধ করলাম। কিন্তু মহারাজের যখন বিপদ, গুপ্তশত্রু এসে লাফিয়ে পড়েছে মহারাজের ঘাড়ে তখন আমার তরোয়াল খাপে আটকে গেল। কিছুতেই খুলল না। ওদিকে মহারাজেরও যাই-যাই অবস্থা। তখন কী করলাম বলো তো?”
“কী?”
“কোমর থেকে খাপসুষ্ঠু তরোয়াল খুলেই লড়তে লাগলাম। সে কী হাসির ধুম। লোকে চেঁচাতে লাগল–ওরে বেটা, খাপ থেকে তরোয়াল বার কর, খাপ নিয়ে কি লড়া যায়?”
তারাপদ আর চন্দন হো-হো করে হাসতে লাগল।
কিকিরাও হাসতে-হাসতে বললেন, “ম্যানেজ আমি করে ফেলব। তোমরা ভেব না।”
.
যথাস্থানে জোয়ারদার অপেক্ষা করছিলেন। কিকিরাকে দেখে চমকে গেলেন। বললেন, “ব্যাপার কী মশাই?”
“কিছু নয়। বিভুপদ হাঁস, আদ্রা-পুরুলিয়ার লোক, নানা ধরনের ব্যবসা। টাকার গাছ। ব্য–এই পর্যন্ত আপনি। বাকিটা আমি। আমার ওপর ছেড়ে দেবেন।”
“তা না হয় দেব। পারবেন?”
“দেখবেন তখন।”
“ওর কতকগুলো ষণ্ডামার্কা চেলা আছে..”
“আমার কাছে পিস্তল আছে।”
“পিস্তল?” জোয়ারদার আঁতকে উঠলেন।
“আসল নয়। নকল। ম্যাজিশিয়ানের পিস্তল। ফায়ার হবে, গুলি বেরোবে না। … চলুন।”
দু’জনে পা বাড়ালেন গলির দিকে। চন্দন আর তারাপদ তফাতে থেকে গেল। তারা সামান্য পরে যাবে।
ব্যবস্থায় কোনো ফাঁক নেই। কিকিরার মনে হল, এ যেন কোনো নিষিদ্ধ এলাকায় ঢোকার মতন।
শুদ্ধানন্দর বাড়ির বাইরে থেকে ভেতর বোঝার উপায় নেই। বাইরেটার যতই ভাঙাচোরা, ঝোঁপঝাড়ভরা চেহারা হোক না কেন, ভেতরটা তেমন নয়। বাড়ি যে বেশ পুরনো, আদ্যিকালের, সেটা বোঝা যায়; বোঝা যায় এককালে সাহেব-সুবোই থাকত, কুঠিবাড়ির ছাদ আর বাংলোবাড়ির খোলামেলা বারান্দা। বারান্দাগুলো বড়, চওড়া। দেওয়ালের থাম মোটা-মোটা। আর্চগুলোও বেশ বড়। তবে সবই ভাঙাচোরা, ফাটাফুটো। ইলেকট্রিকও আছে। মিটমিটে আলো এদিকে-ওদিকে জ্বলছে। গুটি দুয়েক। তাতে আলো তেমন হয় না।
শুদ্ধানন্দর এক চেলা জোয়ারদারকে ডেকে নিয়ে গেল। এই লোকটা সেদিনের সেই ষণ্ডা কি না বোঝা গেল না। হতে পারে, নাও পারে। লোকটাকে দেখলে মনে হয়, গঙ্গার ঘাটে দলাইমলাই করে বেড়ায় পালোয়ান ধরনের চেহারা।
কিকিরার কোনো অসুবিধে হল না। জোয়ারদার যে শুদ্ধানন্দর স্থায়ী মক্কেল একথা জানার পর তার খাতির বোধ হয় বেড়ে গিয়েছে। তা ছাড়া জোয়ারদার আগে থেকেই বলে কয়ে ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন বলে কিকিরাকে ষণ্ডা-লোকটা কিছু বলল না। শুধু চেয়ে-চেয়ে দেখল বিচিত্র পোশাকের কিকিরাকে।
ঘরের গালাগানো প্যাসেজ দিয়ে দু-তিনটে ঘর পেরিয়ে একটা মাঝারি ঘরে নিয়ে গিয়ে জোয়ারদারদের বসাল লোটা। তারপর বলল, “মহারাজকে খবর দিচ্ছি।”
এই ঘরটায় দেখার মতন কিছুই নেই। ন্যাড়া দেওয়াল। একপাশে এক টিমটিমে বাতি। বসার জন্য কাঠের বেঞ্চি। একটিমাত্র চেয়ার। দেওয়ালের রং বোঝা যায় না, এমন ময়লা। ফাটা দাগ। সিমেন্টের মেঝেও ফেটে গিয়েছে। দেওয়ালে অবশ্য টিকটিকি-গিরগিটির অভাব নেই।
জোয়ারদার কী বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন, তারপর ঠোঁটে আঙুল চেপে ইশারায় বোঝালেন, এখানে কথাবার্তা না বলাই ভাল।
খানিকটা পরে অন্য একজন এল। এর চেহারা ঠিক ষণ্ডামার্কা নয়। ছিপছিপে। বড় বড় বাবরি চুল। পরনে গেরুয়া লুঙ্গি, গায়ে আলখাল্লা, একটা সুতির মোটা চাদর রয়েছে গায়ে।
ইশারায় ডাকল জোয়ারদারদের।
পাশের ঘরে এনে লোকটি বলল, “জুতো খুলুন। টুপি পরা চলবে না। পকেটে চামড়ার জিনিস থাকলে রেখে দিন। টর্চ রাখবেন না। এখানে রেখে যান। “
জোয়ারদার জানেন সব। ক’ দফা এলেন। জুতোটুতো খুলতে লাগলেন।
লোকটা চলে গেল।
জোয়ারদার নিচু গলায় বললেন, “এরপর সার্চ হবে।”
কিকিরা বললেন, “আন্দাজ করেই এসেছি।” বলে বেশ জোরে হেঁচে ফেললেন।
“হাত দিয়ে ঘেঁটেঘুঁটে দেখবে।”
“বুঝতে পারছি।” বলতে না বলতে আবার হাঁচি।
“হল কী আপনার?”
“সিজন চেঞ্জ, ঠাণ্ডা লেগে গিয়েছে।”
সামান্য পরে আবার সেই লোকটি ফিরে এল। এসে বলল, “রেখেছেন সব?”
“আজ্ঞে?”
“আপনি আসুন..” জোয়ারদারকে ডাকল।
এগিয়ে গেলেন জোয়ারদার। তাঁকে সার্চ করা হল।
কিকিরা আবার হাঁচলেন।
এবার কিকিরার পালা।
“নাম?”
“বিভুপদ হাঁস।”
“পাতি না রাজহাঁস?”
“রাজহাঁস। আমার বাবা ষষ্ঠীপদ হাঁসকে লোকে রাজাবাবু বলত আদ্রা-পুরুলিয়া বাউলডিঙ্গিতে আমাদের ঘরবাড়ি জমিজায়গা। চার-পাঁচ রকম কারবার, “বলতে বলতে কিকিরা আবার হাঁচলেন, বিরাট হাঁচি।
লোকটা দু পা পিছিয়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বলল, “কী হয়েছে আপনার?”
“ঋতু পরিবর্তন। নতুন শীত আসছে। সর্দি..”
“সর্দি নিয়ে এসেছেন কেন?”
“রাস্তায় হল।”
জোয়ারদার বললেন, “আমার বন্ধু। আসার কথা ছিল।”
“নাকে রুমাল চাপা দিন।”
“আজ্ঞে দিয়েছি।”
লোকটা আবার এগিয়ে এসে কিকিরার গা হাতড়াতে না হাতড়াতেই উনি হেঁচে ফেললেন।
“হল কী মশাই আপনার?”
“হাঁচি।”
“হাঁসদের হাঁচি হয় শুনিনি। …যাকগে ওখানে গঙ্গাজল আছে, হাতটাত ধুয়ে নিন আপনারা। শুদ্ধ হয়ে নিন।”
কিকিরা শুদ্ধ হতে-হতে শুনলেন–প্রথম ঘণ্টা বাজছে।
ঘরের একদিকে একটা কাঠের বাক্স মতন ছিল। তালা খুলে তার ভেতর থেকে দুটো কালো জোব্বা বার করল লোকটি। বলল, “নিন পরে নিন। মাথা কান কপালও ঢেকে রাখবেন। খুলবেন না।”
জোয়ারদার কালো জোব্বা গায়ে চাপালেন।
কিকিরা একবার করে হাঁচছেন, আর কালো আলখাল্লা পরছেন। বুদ্ধি করে রুমালটা তিনি রঙিন এনেছিলেন, মেরুন রঙের। নয়ত ওই চেলা হয়ত রুমালটাও ফেলে দিতে বলত।
কিকিরাকে ভাল করে দেখে নিয়ে গেরুয়াধারী চলে গেল। বলে গেল, “আসছি।”
ও চলে যেতেই জোয়ারদার ফিসফিস করে বলল, “এবার ওই ঘরে যেতে হবে।”
কিকিরা মাথা হেলালেন।
“একটু হুঁশিয়ার থাকবেন। টাকা এনেছেন?”
“দুশো দুই।”
“দুশো দুই?”
“এখন দুশো; পরের দিন তিনশো। প্লাস একটা মোহর।”
“মোহর!”
“বাবার আমলের। কাজ হলে তবে…”
“মশাই, সাবধান।”
চেলাটি এসে পড়ল। “আসুন। প্রণামী হাতে রাখুন।”
সরু এক গলিপথের মতন প্যাসেজ দিয়ে কিকিরারা একটা ঘরের সামনে এলেন। দরজা বন্ধ।
শুদ্ধানন্দর চেলাটি দরজা খুলল ধীরে-ধীরে। কিকিরা আবার হাঁচলেন। লোকটা বিরক্ত হল। বলল, “যান, ভেতরে গিয়ে বসুন। মাটিতে। …প্রণামীটা?”
দুজনেই টাকা দিলেন।
কিকিরার হাত থেকে দু’শো টাকা পেয়ে লোটা বোধ হয় খুশি হল না। বলল, “আজ স্পেশ্যাল ছিল। মাত্র দুশো টাকা?”
কিকিরা বললেন, “আবার আসব। তিনশো দেব। সঙ্গে একটা মোহর। পুরনো আমলের।”
“যান।”
ঘরে ঢুকে কিছু আর দেখা যায় না। ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। ধুনোর ধোঁয়া। তার সঙ্গে ধূপের গন্ধ। গন্ধটা এতই উগ্র যে, ধুনোর গন্ধকেও ছাড়িয়ে যায়।
চোখ সইয়ে নিতে সময় লাগল। ততক্ষণে ঘরের এক কোণে একটা লাল আলো, টুনি বাবের আলো যেমন হয়, এক ফোঁটা জ্বলে উঠেছে।
.
জোয়ারদার গায়ে ঠেলা মারলেন।
কাছেই একটা তক্তাপোশ। তার ওপর ফরাস পাতা। দেখা না গেলেও অনুমান করে নিতে হয়।
জোয়ারদারের দেখাদেখি কিকিরা ফরাসের ওপর বসলেন। হাঁটু ভেঙে আসন করে। পায়ে লাগে। কিন্তু উপায় কী?
কিকিরার চোখ খানিকটা সয়ে গিয়েছে। অনুমানে মনে হল, এই ঘরটা হলঘরের মতন। বড়ই বলা যায়। কিকিরা যে-জায়গায় বসে আছেন, সেই জায়গাটা কি সামান্য ঢালু? হতে পারে। বেশ খানিকটা তফাতে, অন্তত গজ-তিরিশ দূরে একটা কী যেন রয়েছে। উঁচু মতন। ওখানেও কি কোনো তক্তাপোশ বা মঞ্চ পাতা আছে। হলঘরে কি কোনো স্টেজ বাঁধা আছে?
এমন সময় লাল মিটমিটে বাতিটা নিভে গেল। জ্বলল পর মুহূর্তে। আবার নিভল।
“উনি আসছেন?” জোয়ারদার বলল।
কিকিরা আবার হাঁচলেন, নাক পরিষ্কার করলেন।
এবার এক হালকা বেগুনি বাতি জ্বলে উঠল। বাতিটা এমন জায়গায় জ্বলল যাতে দূরের উঁচু জায়গাটা আবছাভাবে চোখে পড়ে।
কিকিরা ঠিকই অনুমান করেছিলেন। দূরে একটা মঞ্চ পাতা রয়েছে। ছোট। তক্তাপোশের ওপর মোটা কোনো জিনিস, তার ওপর কালো চাদর। দু পাশে দুই ধুনোর পাত্র, একটা থালায় গাঁদা ফুলের মালা। মঞ্চের দুধারে পেছনে দুই ত্রিশূল। একটা ত্রিশূলের ডগায় মরা কাক, অন্যটার মাথায় খুলি।
এমন সময় শব্দ হল ঘণ্টার। কে যেন পুজোর ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে, খুবই ধীরে খড়মের শব্দ করতে করতে পেছন থেকে এগিয়ে এল। মুখে অত সব শব্দ “ক্লীং রিং হিং। ওঁ অপসৰ্পন্তু তে ভূতাঃ যে ভূতাঃ ভুবি সংস্থিতা। যে ভূতাঃ বিকতারম্ভে পশ্য..চ হুং ফট। আং হ্রীং ক্রোং যং রং লং হৌং হঃ…ফট…।”
ইনিই তবে শুদ্ধানন্দ? একাদশ তন্ত্রমন্ত্র-সিদ্ধ শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধ কল্পং বৃক্ষঃ! ফট বাবাজি!
কিকিরা ভাল করে লক্ষ করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। বড়ই অস্পষ্ট। তবু শুদ্ধানন্দর চেহারা এবং পোশাকটি আন্দাজ করা যায়। পোশাক একেবারে ঘন রক্তবর্ণ। গায়ের চাদরটিও লাল। গলায় মোটা-মোটা রুদ্রাক্ষ-মালা। মাথার চুল ঘাড় পর্যন্ত, বাবরি ছাঁট। রুক্ষ ঝাঁকড়া চুল। কপালে রক্তচন্দন। দুটি চোখ লাল। তবে চোখের তলা কালো। ভূরু মোটা। টানা টানা। কিকিরার সন্দেহ হল, শুদ্ধানন্দ চোখের ভুরু আর চোখের তলায় কাজল লেপেছেন।
শুদ্ধানন্দ বসলেন। আসনে বসার মতন করে। চোখ বন্ধ। নিজের মনে বিদঘুঁটে মন্ত্র আওড়াচ্ছেন–তে ভূতাঃ যে ভূতাঃ…চ হুং ফট…ক্রোং যং বং লং হে হঃ…ফট।’
কিছুক্ষণ মন্ত্র আওড়ানোর পর শুদ্ধানন্দ হাত উঠিয়ে কী যেন ছুঁড়ে দিলেন। একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে। ধুনোর পাত্র থেকে ধক করে আগুন জ্বলে উঠল। নিভেও গেল।
সেই আগুনের আলোয় কিকিরা শুদ্ধানন্দকে দেখে নিতে পারলেন অল্পের জন্য। চেহারায় না থোক সাজে-পোশাকে চারপাশের সাজেসজ্জায় একটা গা-ছমছমে ভাব হয়।
আগুন নিভে যাবার পর শুদ্ধানন্দ আরও একবার মন্ত্র আওড়ালেন। তারপর কথা শুরু করলেন।
“জোয়ারদারবাবু, তুমি এসেছ?”
“আজ্ঞে!”
“পরশু তিন যামে ভন্তরালিকা স্তরে তোমার আত্মীয় বাসুদেবের সঙ্গে দেখা হল। আহা, বেচারি ব্রীহিবৃক্ষের তলায় অবস্থান করছিল। বলল, কোন্ অপরাধে কে জানে সে নিম্নগামী হতে পারছে না। বাধা পাচ্ছে। আগামী অমাবস্যার পর সে আসতে পারবে।”
“আর কিছু জানাল মহারাজ?”
“বলল, ও যখন আসবে মুখোমুখি তোমায় শুনিয়ে যাবে।”
“বড় বিপদে পড়েছি মহারাজ! ব্যবসার ব্যাপার। বাড়িতেও খানিকটা অসুবিধে হচ্ছে। ভাগনেটা…”
“ধৈর্য ধরো জোয়ারদার। আত্মা দেহধারী জীব নয়। তার আসতে কষ্ট, যেতেও কষ্ট। সে কষ্ট তুমি বুঝবে না।”
“আগামী অমাবস্যা?”
“হ্যাঁ।”
“সে কবে?”
“দেরি নেই।”
জোয়ারদার চুপ করে গেলেন।
সামান্য পরে শুদ্ধানন্দ বললেন, “তোমার সঙ্গীটি এসেছে দেখছি।”
কিকিরা হাতজোড় করে বিনীতস্বরে বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“কী নাম?”
“বিভুপদ হাঁস। পিতার নাম ষষ্ঠীপদ হাঁস। তিনি পাঁচ বছর আগে স্বর্গে গিয়েছেন। নিবাস বাউলডিঙি, আদ্রা-পুরুলিয়া।”
“পেশা?”
“মহারাজজি, পেশা আর কী বলব! ব্যবসা! কাঠগোলা, সিমেন্ট, মশলাপাতি, গুড়, এই সব। একটা ছোট কলকারখানা…ইচ্ছে তো ছিল, কিন্তু বড় বিপদে পড়ে গিয়েছি।”
“কী বিপদ?”
“কী বলব মহারাজ! আমার শিবতুল্য বাবা একটা উইল করে গিয়েছিলেন। আমরা তিন ভাই। উইলে আমার ছিল অনেক কিছু। এখন এক অন্য উইল বার করে ভাইরা…কী বলব, মহারাজ!”
“বুঝেছি।…উইল জাল হয়েছে।”
“কেমন করে হল! জগতে কাউকে বিশ্বাস নেই।” বলতে বলতে আবার হাঁচলেন কিকিরা। নাকে-মুখে রুমাল চাপা দিলেন।
“পিতা গিয়েছেন কবে?”
“তা পাঁচ বছর। “
“পাঁচ বছর!…পঞ্চম হল ভৌরিক স্তর, পঞ্চদশ গৌরিব। পাঁচ হলে সেই আত্মা অর্ধ-নিদ্রিত।…তা এই সব আত্মাকে আনানো কঠিন। ওঁদের নিদ্রাকাল তো মানুষের মতন নয়।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ…কিন্তু কী করব! আপনি আমায় সাহায্য করুন।”
শুদ্ধানন্দ চুপ করে থাকলেন। তারপর আবার কী যেন ছুঁড়লেন ধুনোর পাত্রে। এবারে আর আগুন জ্বলল না, ধোঁয়া হল সামান্য।
নিজের মনে কয়েকটা অদ্ভুত মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে শুদ্ধানন্দ বললেন, “দেখি…। খোঁজ করতে হবে। সময়সাপেক্ষ।”
কিকিরা বললেন, “আমি আপনার কাছে এসে পড়েছি। আপনি না পারলে কে পারবে মহারাজজি। খরচের জন্যে আপনি ভাববেন না। আমি ব্যবসাদার মানুষ…বিপদ উদ্ধারের জন্যে দু-চার হাজার টাকা খরচ করায় আমার আটকাবে না।”
“বুঝলাম, কিন্তু তুমি বড় অধৈর্য হচ্ছ! এ-সব কাজ..”
“জানি। আপনি ইচ্ছে করলে পারেন মহারাজ।”
“পারি?” শুদ্ধানন্দ একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ তালি দিলেন হাতে। ঘন্টি নাড়লেন। সঙ্গে-সঙ্গে সব অন্ধকার। ঘুটঘুটে হয়ে গেল ঘর।
একেবারে স্তব্ধ ভাব। নিঃসাড়।
কিছুক্ষণ পরে শুদ্ধানন্দের গম্ভীর গলা শোনা গেল, “হে ধেনুক, আপনি কি এসেছেন?”
কোনো সাড়াশব্দ নেই।
অপেক্ষা করে শুদ্ধানন্দ বললেন, “হে সর্বগামী ধেনুক, আমি আপনাকে আহ্বান করছি। যদি এসে থাকেন–দেখা দিন।”
কেউ দেখা দিল না।
শুদ্ধানন্দ আবার ডাকলেন, “ধেনুক! আপনি কি আসবেন না?”
হঠাৎ যেন একটি জোনাকি জ্বলে উঠল শুদ্ধানন্দের পিছনে, ত্রিশূলের দিকে। জোনাকির আলো বারকয়েক নাচল। মনে হল, মরা কাকের মাথার দিকেই জোনাকি নাচল।
“আপনি এসেছেন?”
একটা শব্দ হল। খট খট।
“হে ধেনুক। আমার এখানে একজন হতভাগ্য অতিথি এসেছেন। তিনি “তাঁর পিতার কাছে একটি কথা জানতে চান। পিতা ভৌরিক স্তরে আছেন। পুত্রের নাম বিভুপদ। …আপনি কি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন?”
জোনাকির মতন আলোর কণাটি স্থির হয়ে থাকল।
শুদ্ধানন্দ বললেন, “ঠিক আছে।”
আলোর কণাটি নিভে গেল।
শুদ্ধানন্দ বললেন, “বিভুপদ?”
“মহারাজ?”
“আপনি আসুন অন্য একদিন।”
“রবিবার আসব মহারাজ। সোমবার আমাকে একবার আদ্রা যেতে হবে।”
“রবিবার?”
“আমাকে কৃপা করুন মহারাজ।”
“আসুন।..অর্থাৎ অর্থাদি বিষয়ে…”
“আপনি ভাববেন না।”