ফ্রয়েডের মূল প্ৰকল্প
ফ্রয়েডবাদের মূল প্রকল্প বা fundamental hypothesis বলতে নিজ্ঞান এবং সংজ্ঞানের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের কথাকেই ধরতে হবে। এগুলির বৈজ্ঞানিক যাথার্থ্য কি কতোখানি সে-বিচার তো করতেই হবে। কিন্তু তার আগে দেখা যাক, দর্শনের ইতিহাসের কোন্ পর্যায় থেকে এগুলির উৎস। প্রথমে দুটো উদ্ধৃতিকে বিচার করে দেখুন:
… a terrible, fierce, and lawless class of desires exist in every man even in those of us who have every appearance of being decent people. Its existence is revealed in dreams…
আর—
When the rest of the soul the reasoning, gentle and ruling part of it, is asleep, then the bestial and savage part, when it has had its feel of food or wine, beings to leap about, pushes sleep aside, and tries to go and gratify its instincts. You know how in such a state it. will dare everything, as though it were freed and released from all shame or discernment. It does not shrink from attempting incestrial intercourse in its dreams, with a mother or with any man or god or beast. It is ready for any deed of blood, and there is no unhallowed food it will not eat. In a world it falls short of no extereme of folly or shamelessness.
কার রচনা থেকে এই উদ্ধৃতি? নিশ্চয়ই ফ্রয়েডের রচনা হতে পারতো। কেননা বলবার মোদ্দা কথাটায় ফ্রয়েডের সঙ্গে এতোটুকুও অমিল নেই। কিন্তু এ-উদ্ধৃতি ফ্রয়েডের রচনা থেকে সত্যিই নয়। তার বদলে য়ুরোপীয় দর্শনের ইতিহাসে যিনি সবচেয়ে চূড়ান্ত ভাববাদী দার্শনিক তাঁর রচনা থেকেই। অর্থাৎ কিনা কথাগুলো স্বয়ং প্লেটোর কথা (Republic IX, 573 ও 571)। তার মানে, এই বিংশ শতাব্দীর চিন্তাশীল সিগমুন্ড ফ্রয়েড অনেক রকম আপাত-বৈজ্ঞানিক দোহাই দিয়ে যে-মনস্তত্ত্বের খসড়া করলেন সেই মনস্তত্ত্বও প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো আর চরম ভাববাদী—অতএব বিজ্ঞান-বিরোধী—এক দার্শনিক কল্পনার ওপরেই প্রতিষ্ঠিত!
আপত্তি জানিয়ে কেউ নিশ্চয়ই বলতে পারেন, প্লেটো থেকে মাত্র দুটো খাপছাড়া উদ্ধৃতিকে সম্বল করে এতো বড়ো একটা কথা বলে বসা নেহাতই হঠকারিতার লক্ষণ! উত্তরে বলবো, উদ্ধৃতি দুটো প্লেটোর রচনায় কোনো খাপছাড়া ব্যাপার সত্যিই নয়। কেননা, প্রতিক্রিয়ার শিবিরে প্লেটো যতো বড়ো অধিনায়কই হোন না কেন, অসংলগ্ন চিন্তার অপবাদ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অস্বাভাবিক—অর্থাৎ, স্বপ্নাদি সম্বন্ধে তাঁর ওই উক্তির মূলে রয়েছে মনস্তত্ত্বের এক নির্দিষ্ট মতবাদ, মানবমনের এক নির্দিষ্ট কাঠামোর কল্পনা, আর যেটা বিশেষ করে নজর করবার কথা, সেই কাঠামোর সঙ্গে ফ্রয়েডীয় কাঠামোটার মূলে কোনো তফাত নেই।
প্রথমে ওই প্রথমে ওই প্লেটোনিক কাঠামোটাই কথা বিচার করা যাক, তাহলেই ধরা পড়বে ফ্রয়েডীয় কাঠামোর সঙ্গে তার মিল কতো মৌলিক।
মানস সত্তাকে প্লেটো মোটের ওপর তিনটি স্বাধীন অংশে ভাগ করতে চেয়েছেন। তাঁর পরিভাষায় এই তিনটির নাম হলো desiring, reasoning আর spirited অংশ। অর্থাৎ, প্লেটোর মতে আমাদের মনের যে-তিনটি ভাগ তার মধ্যে একটি নিছক অন্ধ বাসনামাত্র, আর একটি নিছক বিচারবিবেক, আর তৃতীয়টির নাম তিনি দিচ্ছেন সংগ্রামী অংশ। সংগ্রাম মানে অবশ্যই, বেঁচে থাকবার ব্যাপারে আমাদের পক্ষে যে-ভাবে আত্মরক্ষা করা একান্তই প্রয়োজন তাইই। আর দীর্ঘ তর্ক তুলে প্লেটো প্ৰমাণ করতে চাইছেন এই তিনটি অংশ স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। এমন কি, ওই তিনটি অংশের মধ্যে প্রবল বিরোধ ও দ্বন্দ্ব। বিরোধটা অবশ্য সবচেয়ে তীব্র ওই অন্ধ বাসনা আর বিবেক-বুদ্ধির মধ্যেই—সংগ্রামী অংশটাকে তাই প্রায়ই এ-বিরোধের মধ্যস্থতা করতে হয়। তার মধ্যস্থতা যদি না থাকতো তাহলে বাসনা আর বিবেকের দ্বন্দ্বে আমরা একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে যেতাম। (Republic, Bk. IV)
এর পাশাপাশি ফ্রয়েডীয় কাঠামোটা মিলিয়ে দেখুন। ফ্রয়েডও মানবমনকে তিনটি স্পষ্ট অংশে ভাগ করতে চান। তাঁর মতে এই তিনটি অংশের মধ্যে বিভাগ অত্যন্ত স্পষ্ট—তিনটি অংশই স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধিকারমত্ত। শুধু তাই নয়; এদের ভিতর দুটি অংশের মধ্যে বিরোধ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। তাঁর পরিভাষায় সেই দুটি অংশের নাম Id এবং Super Ego। ফ্রয়েডের ওই ঈড্ অন্ধ বাসনা ছাড়া আর কিছুই নয়—সে শুধুই নিজের তৃপ্তি চায়, চায় ওই তৃপ্তির পথে বিবেক-বিচারের বা Super Ego-র সমস্ত রকম বাধাবিঘ্ন অগ্রাহ্য করে এগুতে। অপর পক্ষে সুপার-ঈগোই আমাদের বিচার-বিবেক। তাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, অন্ধ বাসনার ওই তাগিদকে খর্ব করবার। ফলে ঈড় এবং সুপার-ঈগোর মধ্যে সংঘাতটা অত্যন্ত তীব্র—ঠিক প্লেটো যে-ভাবে কল্পনা করেছেন, বাসনা আর বিবেকের মধ্যে সংঘাত ও দ্বন্দ্বের। আর প্লেটোর মতোই ফ্রয়েড বলতে চান, এই সংঘাতের মধ্যস্থতা করছে আমাদেরই মনের এক তৃতীয় অংশ। ফ্রয়েডের ভাষায় তারই নাম ঈগো বা Ego, অর্থের দিক থেকে এই অংশই হলো আমাদের মনে বাস্তবের প্রতিনিধি, বা এক কথায়, বাস্তববোধ বলে মনের অংশটা। এই বাস্তব-বোধের কৃপাতেই আমরা জীবনসংগ্রামে টিকে যাই। তাই একে প্লেটোর spirited element-এর সঙ্গে তুলনা করাটা মোটেই বাড়াবাড়ি হবে না।
এইখানে, প্লেটোর সঙ্গে ফ্রয়েডের তুলনা-ব্যাপারে আরো একটি দ্রষ্টব্য বিষয় আছে। সুপার-ঈগো-আর ঈগো—এই ফ্রয়েডীয় নামকরণ থেকেই বুঝতে পারা যায় যে, ফ্রয়েডের মতে এই দুয়ের মধ্যে যোগাযোগটা ঘনিষ্ঠ। অর্থাৎ, যদিও বা বাসনা আর বিবেকের দ্বন্দ্বে এই বাস্তব-বোধই মধ্যস্থতার কাজ করে তবুও আসলে ঈগোর পক্ষে ওই সুপার-ঈগোর দিকেই পক্ষপাত। আর এই কথাতেও ফ্রয়েড-প্লেটোর মিলটা বেশ ঘনিষ্ঠই। প্লেটো বলছেন :
Then we shall have reason in affirming that these are two and distinct from one another. The first, that with which the soul reasons, we shall call the rational part; the second, that with which it loves, and hungers and thirsts, and flutters round the other desires, we shall call the irrational and desiring part, the companion of various indulgences and pleasures…Now, is spirit or that by which we feel indignant, a third part, or, with which of these two is it naturally connected?…Rather in the war of the soul it rages itself on the side of the rational part. (Plato : Republic. Book IV, 439-440).
অবশ্যই, সাধারণভাবে ফ্রয়েডীয় কাঠামোর সঙ্গে প্লেটনিক চিন্তার মিলটা এতোখানি সুস্পষ্ট হলেও ফ্রয়েডীয় বক্তব্যের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন ধরুন, ফ্রয়েড বলবেন, অন্ধ বাসনা বলে মনের ওই অংশটা আসলে নিজ্ঞান এবং তার একমাত্র চাহিদা হলো যৌন চাহিদা। প্লেটো অবশ্যই ফ্রয়েডের মতো ফলাও করে নিজ্ঞান-তত্ত্বের আলোচনা ফাঁদেননি এবং ফ্রয়েডের মতো যৌন শব্দের অর্থকে ব্যাপকতর করে সমস্ত রকম বাসনাকেই যৌন বাসনা আখ্যা দিতে চাননি। কিন্তু এই জাতীয় তফাতের কথাটা আসলে সত্যিই বড়ো কথা নয়। কেননা, স্বপ্ন সম্বন্ধে প্লেটোর যে-উক্তি ইতিপূর্বে উদ্ধৃত করেছি তার স্পষ্ট তাৎপর্য হলো প্লেটোর মতেও মানবমনের বাসনাময় অংশটা সম্বন্ধে আমরা সবসময় সচেতন নই, ঘুমের ঘোরে যখন আমাদের সচেতন বিচারবুদ্ধিটা ঢলে পড়ে তখনই ওই বাসনাময় অংশটি আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায়। তাই, প্লেটোর তরফ থেকেও একে নিজ্ঞান বলে মানতে কোনো বাধা নেই।
অবশ্য, খুঁটিনাটির দিক থেকে ফ্রয়েডীয় বক্তব্যের সঙ্গে প্লেটনিক বক্তব্যের মিল ঠিক কতোখানি তারই বিশদ আলোচনা তোলা আমার উপস্থিত উদ্দেশ্যের বাইরে, আমি শুধু দেখাতে চাই যে ফ্রয়েড মানব-মনস্তত্ত্বের যে-কাঠামো আমাদের সামনে পেশ করেছেন, তা আসলে কোনো ভূয়োদর্শনের ভিত্তিতে পাওয়া বৈজ্ঞানিক সামান্যকরণ বা scientific generalisation নয়, এর পেছনে রয়েছে এক অতি প্রাচীন ভাববাদী দর্শনের প্রভাব।
এইখানেই অবশ্য কেউ তর্ক তুলে বলতে পারেন: প্লেটোর সঙ্গে ফ্রয়েডীয় উপসংহারের সাদৃশ্যটা সত্যিই চিত্তাকর্ষক। কেননা, এই সাদৃশ্য থেকে বুঝতে পারা যায়, বিশুদ্ধ চিন্তার নির্ভয়ে প্লেটো যে তথ্যের সন্ধান পেয়েছিলেন ফ্রয়েডও শেষ পর্যন্ত সেইখানেই পৌঁছলেন, যদিও অন্য পথে অগ্রসর হয়ে, কেননা, ফ্রয়েডীয় পথটা হলো, অভিজ্ঞতা-লব্ধ বাস্তব দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবার পথ। কিন্তু বিশুদ্ধ দার্শনিক চিন্তা আর অভিজ্ঞতা——এই দুটি বিপরীত পথ যদি শেষ পর্যন্ত একই উপসংহারে পৌঁছোয় তাহলে তার থেকে তো উপসংহারের যাথার্থ্যই প্রমাণিত হয়। তাই প্লেটোর সঙ্গে সাদৃশ্য-প্রদর্শন ফ্রয়েডবাদের সমালোচনা নয়, ফ্রয়েডবাদের সমর্থনেই পর্যবসিত হতে বাধ্য।
উত্তরে বলবো, পূর্বপক্ষের ওই যুক্তিটার গোড়াতেই গলদ রয়েছে। কেননা মানব-মনস্তত্ত্বসংক্রান্ত প্লেটোর ওই সিদ্ধান্তও আসলে বিশুদ্ধ দার্শনিক চিন্তার ফল নয়, তার মধ্যে সমাজ বাস্তবেরই প্রতিচ্ছবি। প্লেটোর রিপাবলিকটা ভালো করে পড়লে এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। কেননা, প্লেটোর নিজেই খুব স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন যে মানবমনের এই তিনটি অংশকে অনুমান করার পক্ষে একমাত্র উপাত্ত বা data হলো মানুষের সমাজ-সম্পর্ক। মানবসমাজকে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে তিন শ্রেণীর মানুষ: এক দল অন্ধের মতো শুধু গতর খাটাচ্ছে, শুধুমাত্র বেঁচে থাকবার তাগিদেই তারা অস্থির। আর এক দল হলো চিন্তাশীলের দল, তারা শুধুই মাথা খাটায়, শুধুই বিচার করে। আর তৃতীয় দলটার নাম তিনি দিচ্ছেন যোদ্ধার দল, ক্ষত্রিয়ের দল – সমাজটাকে রক্ষা করবার ভার তাদের ওপর। আর প্লেটো বলছেন, সমাজ বাস্তবে যদি ওই তিন চরিত্রের মানুষ দেখতে পাওয়া যায়, তাহলে নিশ্চয়ই অনুমান করতে হবে মানবচরিত্রের মধ্যেও এই তিন রকমের বৈশিষ্ট্য বর্তমান। তাই, মানবাত্মার একটা অংশ হলো ওই অন্ধ বাসনা, আর একটা অংশ হলো বিশুদ্ধ বিচার বিবেক, আর তৃতীয় অংশের নাম প্লেটোর ভাষায় সংগ্রামী অংশ।
এইখানে, প্রসঙ্গত, একটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক বিষয়ের প্রতি নজর না পড়ে পারে না। আমাদের দেশের প্রাচীনেরাও সমাজ বাস্তবকে প্রধানত তিন অংশ বিভক্ত বলে মনে করছেন: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য। আর ব্রাহ্মণ তাঁদের কাছে সত্ত্বগুণ প্রধান, ক্ষত্রিয় রজঃগুণ-প্রধান, বৈশ্য তমঃগুণ-প্রধান। ফলে, মানব—মনস্তত্ত্বের কাঠমো নির্ণয় করবার সময় তাঁরাও প্লেটোর মতোই মনকে তিনটি স্বাধীন বৃত্তিতে ভাগ করতে চাইলেন: সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ। এর সঙ্গে, আসলে প্লেটনিক কল্পনার খুব মৌলিক তফাত নেই—প্লেটোর ওই reasoning, spirited আর desiring অংশের তুলনা করে দেখুন। আর এই সঙ্গেই মনে রাখতে হবে, আধুনিক যুরোপের সাবেকী মনোবিজ্ঞানও মানবমনকে তিনটি স্বতন্ত্র বৃত্তিতে ভাগ করবার চেষ্টার উপরই প্রতিষ্ঠিত। সাবেকী পরিভাষায় তার নাম হলো thinking, feeling and willing এর পাশাপাশি কান্ট-এর Theoretical reason, Judgement এবং Practical reason-এর কথাটাও মনে রাখবেন। কিন্তু এইসব সাদৃশ্য থেকে কি এমন কোনো কথা আন্দাজ করা যায় যে শ্রেণীসমাজের মনস্তত্ত্ব শ্রেণীসমাজের প্রতিবিম্ব হলেই তা এ-হেন একটা ত্রয়ীকরণের উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়ে পারেনি? আর তাই জন্যই হয়তো বা ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের পক্ষে এই ত্রয়ীকরণ থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব হয় নি। তার মানেই কিন্তু, মনস্তত্ত্ব যতোদিন পর্যন্ত এই রকম ত্রয়ীকরণের হাত থেকে নিস্তার লাভ না করছে ততোদিন পর্যন্ত তার পক্ষে প্রকৃত বিজ্ঞানের স্তরে উঠে আসা সম্ভব নয়। অবশ্যই এটা একটা স্বতন্ত্র আলোচনা এবং অনিবার্যভাবেই অত্যন্ত দীর্ঘ আলোচনা। পুরোনো প্রশ্ন আর নতুন পৃথিবী গ্রন্থে এই আলোচনাকে সাধ্যমতো সম্পাদন করবার চেষ্টা করেছি।