৮. প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থায়

প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থায় ফতেহপুর থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে নয়নকে। তাকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। ডাক্তার বলেছেন, তার শরীর সুস্থ হতে সময় লাগবে। এনিতেই ভয়াবহ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছিল সে। তার উপর ওষুধ, পথ্য, চিকিৎসাবিহীন দীর্ঘ সময় পড়েছিল ফতেহপুরে। এর সাথে যোগ হয়েছে দীর্ঘদিনের নানান অনিয়ম। সবকিছু মিলিয়ে শরীরে বাসা বেঁধেছে নানান ব্যাধি। ফখরুল আলম অফিস থেকে দীর্ঘ ছুটি নিয়েছেন। তিনি সারাক্ষণ ছেলের পাশে বসে থাকেন। আর খানিক পরপর রুম থেকে বেরিয়ে যান। বেরিয়ে গিয়ে তিনি রুমালে চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন। ঘুমন্ত নয়নের মুখভর্তি দাড়ি। চোখ ঢুকে গেছে কোটরে। গাল ভেঙে গেছে। এই বয়সের সন্তানের এমন অবস্থা দেখে কোনো বাবারই স্থির থাকার কথা নয়। ফখরুল আলমও নেই। তিনি নয়নের পাশেই জায়নামাজ বিছিয়ে বসে নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে হাউমাউ করে কাঁদেন, ইয়া রাব্বল আলামিন, ইয়া রহমানুর রহিম, ইয়া শাফি, ইয়া মাফি, তুমি আমার ছেলেকে সুস্থ করে দাও।

নয়ন বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়েই কাটায়। সেদিন কোহিনূর এলে নয়ন চুপচাপ মায়ের পাশে শুয়ে রইল। তখন মাগরিবের সময়। ফখরুল আলম জায়নামাজ বিছিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষে দীর্ঘ মোনাজাত করলেন। মোনাজাতে তিনি প্রতিদিনের মতোই আল্লাহর কাছে করুণ গলায় নয়নের আরোগ্য কামনা করলেন। নয়ন হঠাৎ ফখরুল আলমের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা, আমার ছেলেকে সুস্থ করে দাও, এর পরিবর্তে বলল, আল্লাহ, তুমি নয়নকে সুস্থ করে দাও।

ফখরুল আলম অবাক চোখে নয়নের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, কেন? আমার ছেলেকে সুস্থ করে দাও বললে কি সমস্যা?

নয়ন বলল, আছে। সমস্যা আছে। বিশাল সমস্যা। তোমাকে যা বলছি, তাই করো।

ফখরুল আলম আর কোনো কথা বললেন না। তিনি আবার মোনাজাত করলেন। মোনাজাতে কেঁদে কেটে আল্লাহর কাছে বললেন, ইয়া রাব্দুল আলামিন, ইয়া রহমানুর রহিম, ইয়া শাফি, ইয়া মাফি, তুমি নয়নকে সুস্থ করে দাও।

কিন্তু মোনাজাত শেষ করেও ফখরুল আলমের কেমন অস্থির লাগতে লাগল। তার মনে হলো আমার ছেলেকে সুস্থ করে দাও বলার মধ্যে যেই তৃপ্তিটা আছে, সেই তৃপ্তি নয়নকে সুস্থ করে দাও বলার মধ্যেই নেই। সারাটাক্ষণ তার গলার মধ্যে কেমন একটা তেষ্টা তেষ্টা ভাব। মনে হচ্ছে গলাটা পানির অভাবে শুকিয়ে আছে। তিনি এই শীতের মধ্যেও খানিক পর পর ঢকঢক করে ফ্রিজের কনকনে ঠান্ডা পানি খেয়ে ফেলেন। কিন্তু তাতেও তার তেষ্টা ভাবটা যায় না। পরের ওয়াক্ত থেকে তিনি দুইবার মোনাজাত করা শুরু করলেন। একবার শব্দ করে কেঁদে। আরেকবার মনে মনে। মনে মনে করার সময় তিনি প্ৰণভরে বলতে লাগলেন, ইয়া রাব্বল আলামিন, ইয়া রহমানুর রহিম, ইয়া শাফি, ইয়া মাফি, তুমি আমার ছেলেকে সুস্থ করে দাও। মোনাজাত শেষ হতেই তার মনে হলো, তার তেষ্টা ভাবটা একটু একটু কমছে। কিন্তু পুরোপুরি কমছে না। তিনি লিফটে পাঁচতলা হাসপাতালের ছাদে চলে এলেন। সেখানে এসে অন্ধকারে আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। আর আল্লাহর কাছে মোনাজাত ধরে তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে একই দোয়া করলেন।

ফখরুল আলম আবিষ্কার করলেন তিনি যত জোরে চিৎকার করে কথাটা বলছেন। তত বেশি তার ভালো লাগছে। তিনি পাগলের মতো চিৎকার করে কথাটা বলতে লাগলেন। বারবার একই বলতে লাগলেন।

ফখরুল আলম কোহিনূরের কথা বিশ্বাস করেন না। তিনি জানেন, কোহিনূর প্রায়ই আবোল-তাবোল বকে। নয়নকে নিয়ে কোহিনূর তাকে যা বলেছেন, তাও সেইসব আবোল-তাবোলেরই অংশ। তিনি কোহিনূরের কথা বিশ্বাস করেন না। একদম বিশ্বাস করেন না। তিনি যেন প্রবল চিৎকারে ওই নিঃসীম মহাশূন্যের অদৃশ্য মহা অস্তিত্বের কাছে তার দাবি পৌঁছে দিচ্ছেন। সেই দাবি সত্যাসত্য করার কোনো উপায় রয়েছে কিনা কে জানে!

তবে ফখরুল আলম এখন জানেন, এই মানবজন্ম কেবল রক্ত নয়। কেবল জন্মের পরিচয় নয়। বরং তার চেয়েও বেশি কিছু। সেই বেশি কিছুর নাম তেষ্টা। তার গলার ভেতর আটকে থাকা এই প্রবল তেষ্টা। সেই তেষ্টার নাম ভালোবাসা। এই ভালোবাসার তুল্য কিছু নেই। কিছু নাই।

*

ডিভোর্সটা হলো জানুয়ারির তেরো তারিখে। অনেকেই ভেবেছিল শেষ অবধি রেণু আর আসলাম সাহেবের ডিভোর্সটা বোধহয় আটকে যাবে। সে রকম নানান উপসর্গও দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তা আর হলো না। তবে আসলাম সাহেব আর আগের বাসায় ফিরেও এলেন না। হেমা বারকয়েক বাবার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু পারেনি। তার ফোন আবার বন্ধ। সে এখন পুরোপুরি মায়ের সাথেই থাকছে। নিয়মিত ক্লাস করছে। মাঝে-মধ্যে রাহাতের সাথে তার গানের স্টুডিওতে যায়। জায়গাটা তার ভালোই লাগে। তবে সবচেয়ে খারাপ লাগে বাসায় ফেরার পর। এই খারাপ লাগাটা কার জন্য হেমা জানে না। না বাবা-মার জন্য, না নয়নের জন্য, না রাহাতের জন্য, না তার নিজের জন্য? তাহলে?

অনেক ভেবে হেমার মনে হলো, এই খারাপ লাগাটা অভ্যস্ত একটা জীবনের জন্য। সে একটা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। একটা রুটিন মাফিক জীবন। সেই জীবনটা হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেল। তার ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় দাঁড়াতেই সে যখন সারি সারি অট্টালিকা দেখে, তখন তার মন খারাপ হয়ে যায়। তার সেই বারান্দা, বারান্দার পাশে দাঁড়ানো সজনে গাছটার জন্য মন খারাপ হয়। তার সেই বিছানাটার জন্য মন খারাপ হয়। বাথরুমের লাল টুকটুকে বালতি আর মগটার জন্যও মন খারাপ হয়। সে এখানে এসে অমন লাল টুকটুকে বালতি আর মগই কিনেছে। কিন্তু তারপরও তার কেমন মায়া হয়। সেই মগ আর বালতিটার জন্য? আচ্ছা, কেন? মায়া হয় কেন?

রোজ রোজ সে চোখের সামনে দেখত বলে? ছুঁয়ে দিত বলে? কিন্তু প্লাস্টিকের ওই বালতি, মগ, বিছানা, বারান্দাটার তো অনুভূতি নেই। গাছের নাকি অনুভূতি আছে, থাকলেও সে তো কখনোই টের পেত না। কিন্তু তারপরও সেই সকল কিছুর জন্য কেমন একটা মায়া, তীব্র মায়া। একটা শূন্যতাবোধ। মন খারাপ ভাব। কেন? কেবলই অভ্যাস হয়ে উঠেছিল বলে?

তাহলে মায়ের জন্য বাবার কি এখন মন খারাপ হয় না? কিংবা বাবার জন্য মায়ের? না হয় পরস্পরের প্রতি তাদের কোনো ভালোবাসা কখনোই ছিল না, কিন্তু ওই যে রোজকার চোখের সামনে থেকে জানান দেওয়া, আমি আছি। রোজকার উপস্থিতি ভালোবাসাহীন হলেও বলা, আমি আছি। বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে থাকা ঘরের জড়, কঠিন দেয়ালখানাও যদি হুট করে নাই হয়ে যায়, ভেঙে ফেলা হয়, তখনও তো কেমন একটা মন খারাপ ভাব হয়, দুম করে একটা প্রবল শূন্যতা গ্রাস করে। অথচ একটা আস্ত মানুষ, তার চেনা মুখ, চেনা চলন, চেনা স্বর, তার কোথাও কি কখনো এই এতটুকু মায়াও লেগে থাকে না?

হেমা প্রবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হয়তো থাকে, কিন্তু সেই মায়াকে অগ্রাহ্য করতে মানুষ শিখে যায়। আচ্ছা, নয়নের কি তার জন্য কষ্ট হয়? নিশ্চয়ই হয়। কিন্তু তার? হেমা ভেবে দেখেছে, নয়নের জন্য তার কষ্ট নেই। যা আছে তার নাম মায়া। তীব্র মায়া। নয়নকে তার কখনোই আর আট দশটা ছেলের মতো কঠিন, শক্ত-সমর্থ মানুষ মনে হয়নি। বরং সে যেন খানিকটা বেশিই নরম। একটা লতার মতো ব্যাপার। যে একা দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্ত। কিন্তু শক্ত কেউ একজন আলতো করে তাকে স্পর্শ করলে সে সেই স্পর্শ বুঝবার জন্য খানিকটা সময় নেয়। তারপর সেই স্পর্শ যদি তাকে নির্ভরতা দেয়, তবে সে তাকে জড়িয়ে ধরে। আর সকল মেয়েরা হয়তো শক্ত, কঠিন পুরুষকেই ভালোবাসে। বা পুরুষের মধ্যে ওই ভাবটা খোঁজে। কিন্তু হেমার কেন যেন এই নয়নকেই ভালো লাগত। আর সকল কিছুর চেয়ে বেশি। এই নরম, কোমল, বাচ্চাদের মতো সহজ করে হাসা নয়ন। কখনোই কোনো দাবি নেই। কিন্তু কোথায় যেন একটা প্রচণ্ড টান সে রেখে দিত। কখনো খুব কাছে আসা হয় না, কিন্তু কোথায়, কীভাবে যেন একটা খুব গভীর করে কাছে থেকে যাওয়া। এই তো নয়ন। চোখের ভেতর রাজ্যের সহজতা। নিজে কিছুটা শক্ত বলেই হয়তো, নয়নের এই সারল্য, এই শিশু সুলভ আচরণ, এই কোমলতাটা হেমাকে টানত। কী যে একটা মায়া! সেই মায়ায় একজন প্রেমিক পুরুষের চেয়ে একজন শিশুই যেন ঢের বেশি টেনে নিয়েছিল তাকে!

নয়ন এখন কোথায়? নয়নের অসুস্থতার খবরটা হেমাকে দিলো নয়নের এক স্টুডেন্ট। তার সাথে টিএসসিতে হেমার দেখা। হেমাকে দেখেই সে বলল, নয়ন ভাইয়ের এখন কি খবর হেমাপু?

হেমা ভ্যাবাচ্যকা খাওয়া গলায় বলল, হ্যাঁ। ভালো।

ছেলেটা বলল, আমরা তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।

হেমা দুম করে বলে বসল কেন?

ছেলেটা বলল, কেন? আপনি জানেন না? উনি কাউকে কিছু না জানিয়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। তারপর সেখান থেকে ভয়াবহ টাইফয়েড নিয়ে ফিরেছেন। সাথে আরো নানান সমস্যা। হাসপাতালে ভর্তি অবধি করতে হয়েছে!

হেমা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। নয়নকে তার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। প্রচণ্ড ইচ্ছে। কিন্তু এই ইচ্ছেটাকে সে দমাতে চায়। প্রচণ্ড ইচ্ছে দমানো কঠিন কাজ। হেমা এখন থেকে জগতের সকল কঠিন কাজগুলোই করতে চায়। সে যেন জানে, তার সামনের পৃথিবীটা কঠিন সময়ের পৃথিবী। কঠিন সময়ে টিকে থাকতে হলে মানুষকে হতে হয় কঠিন। সেখানে সহজ, কোমল মানুষ টিকতে পারে না। এই কঠিন সময়ে মানুষকে কঠিন হতে হলে সবচেয়ে বেশি হতে হয় ভালোবাসাহীন। ভালোবাসাহীন মানুষের চেয়ে কঠিন কোনো মানুষ আর পৃথিবীতে নেই।

মানুষ ভাবে, ভালোবাসার মানুষটাকে জোর করে, বা অনুরোধ করে আটকে রাখা যায়। আদায় করা যায়, কিন্তু হেমার উল্টোটাই মনে হয়। কারণ যাই হোক, কেউ যদি চলে যেতে চায়, তবে তাকে যেতে দেয়াই উচিত। কিন্তু যাবার আগে তাকে জানিয়ে দেয়া উচিত, কী গভীর মমতায় তার জন্য বুকের ভেতর পুষে রাখা হয়েছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা। যদি তারপরও সেই ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে সে চলে যেতে পারে। তবে তাকে শত কান্না, শত অনুরোধ, শত প্রার্থনায় ভেঙে পড়েও আর আটকে রাখা যায় না বা যাওয়া উচিত-ও নয়।

রাহাত এলো রাতে। তার নতুন অ্যালবামটা শেষ হয়েছে। সেই এই এতদিনেও হেমাকে অ্যালবামের নাম বলেনি। অ্যালবামের এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মোড়ক উন্মোচনও হয়নি। কিন্তু সে একটা কপি নিয়ে এসেছে। হেমার জন্য। হেমা প্যাকেটটা খুলল। প্যাকেটের ওপরে লেখা কান্নার গান।

হেমা বলল, কান্নার গান কেন?

রাহাত বলে, পৃথিবীর সব গানই তো কান্নার।

হেমা বলল, সব? সব গান কান্নার?

রাহাত বলল, হ্যাঁ।

হেমা বলল, কীভাবে?

রাহাত বলল, মানুষ গান কখন করে জানিস? যখন সে প্রবল আনন্দে থাকে, আর যখন সে প্রবল বিষাদে থাকে। প্রবল আনন্দের ভাষা কান্না। মানুষ প্রচণ্ড আনন্দে কেঁদে ফেলে। আবার প্রচণ্ড বিষাদেও কেঁদে ফেলে। এইজন্যই জগতের সকল গানই কান্নার। শুধু গানই না। সকল সৃষ্টিই। আর এই মুহূর্তেও সৃষ্টিগুলো একদম হৃদয়ের গভীরের। তীব্রতম অনুভূতি ছাড়া তো কান্না হয় না। আমার এই গানগুলোও তেমন। তীব্রতম অনুভূতির।

হেমা বলল, বাহ্।

রাহাত বলল, আসলে কান্না না। জল। জগতের সকল কিছুই জলের। আর কান্না তো জলই।

হেমা অবাক গলায় বলল, মানে?

রাহাত বলল, দেখ, জল ছাড়া পৃথিবীর কোনো প্রাণই বাঁচে না। কিছু না। আরেকটা জিনিস খেয়াল করেছিস?

হেমা বলল, কী?

রাহাত বলল, জগতের সকল কিছু ধরতে হয় মুঠো করে। কিন্তু একমাত্র জল, যা মুঠো করে ধরা যায় না।

হেমা বলল, তাতে কি?

রাহাত বলল, জল ধরতে হয় দুই হাত এক করে আঁজলা পেতে।

হেমা দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, হু।

রাহাত বলল, আর আঁজলার ভেতর কি থাকে বল তো?

হেমা বলল, কি?

রাহাত বলল, প্রার্থনা।

হেমা বলল, কীভাবে?

রাহাত বলল, কেন? আঁজলা পেতে দেখ, আঁজলার ভঙ্গিটাই তো প্রার্থনার ভঙ্গি। মোনাজাতের ভঙ্গি।

হেমা ভীষণ অবাক হলো। বলল, তাই তো!

রাহাত বলল, হ্যাঁ। ঠিক তাই। হয়তো নিমগ্ন প্রার্থনার জলেই থাকে সকল প্রাপ্তি।

হেমা কথা বলল না। সে অবাক চোখে রাহাতের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর অ্যালবাম বক্সটার পরের পাতায় গেল। সেখানে রাহাত লিখেছে, উৎসর্গ- হেমাকে। আমার নিমগ্ন প্রার্থনার জল।

হেমা ঝট করে রাহাতের দিকে তাকাল। রাহাত হাসছে। কিন্তু হেমার কেমন কান্না পেয়ে গেল। কিন্তু সে রাহাতের সামনে বসে কাঁদল না। কাঁদল রাহাত চলে যাবার পর। কিন্তু এই কান্না রাহাতের জন্য কিনা হেমা নিশ্চিত নয়। এমন হতে পারে, তার জন্য রাহাতের জন্য যে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে, রাহাতের সেই কষ্টটার জন্য তার এই কান্না। রাহাতের জন্য না। এ অনুভূতির বড় অদ্ভুত রহস্যময় টানাপড়েন। এর অর্থ হেমা কেন, কোনো মানুষই জানে না। হেমা কাঁদতে কাঁদতেই ঝাপসা চোখে দেখল, রাহাতের অ্যালবাম বক্সটার শেষ পাতায় বড় বড় করে লেখা,

আমি লিখেছিলাম ভুল পাতায়, কাগজ ওলটাতেই দেখি জলের শব্দ।
অক্ষর মিশে গেছে কান্নায়। শরীর জুড়ে অদ্ভুত খেয়াল!
মুছে যায় দাগ, অক্ষর, শব্দ বা আঁচড়।
কেউ কেউ বলে, জল মিশে যায় জলে।
অথচ সন্ধ্যার বিষণ্ণ মন,
ছুঁয়ে দেখি আজ–
ফোঁটা ফোঁটা জলের ভেতর, লেখা আছে গোটাটা জীবন!

*

রাজীবের সাথে পারুলের সেই শুক্রবার দেখা হলো। তারা আবারো সেই নদীর ধারে বসেছিল। পারুলকে দেখে রাজীব চমকে গেল। তার পরনে একখানা নীল শাড়ি। আর নাকে তার মায়ের নোলকখানা দুলছে। রাজীব মুগ্ধ চোখে নোলক পরা পারুলের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সে করুণ গলায় বলল, আপনার কি বিয়ে হয়ে গেছে?

পারুল বলল, হয় নাই, কিন্তু হইব।

রাজীব শুকনো মুখে বলল, আমি শুনেছি মেয়েরা বিয়ের পরে নাকে নোলক পরে। কিন্তু আপনি তো দেখি বিয়ের আগেই পরে ফেলেছেন। আপনার বিয়ে কি ঠিক?

পারুল বলল, জ্বে ঠিক।

রাজীব ঢোক গিলে বলল, বিয়ের তারিখ, পাত্র সবই ঠিক?

পারুল বলল, তারিখ এহনও ঠিক হয় নাই। তয় পাত্র ঠিক।

রাজীব স্নান গলায় বলল, ও, আচ্ছা।

পারুল রাজীবের দিকে তাকিয়ে বলল, তয়, একখান সমস্যাও আছে।

রাজীব ঝট করে মুখ তুলে পারুলের মুখের দিকে তাকাল। তারপর রাজ্যের কৌতূহল গলায় ঢেলে বলল, কী সমস্যা?

পারুল বলল, পাত্রীর লজ্জা শরম কম। পাত্রের লজ্জা শরম বেশি। হওনের কথা আছিল উল্টা। কিন্তু হইছে এইটা। এহন পাত্রীর তো লজ্জা শরম কম। এইজইন্য পাত্রী বিয়ার জইন্য দুই পায়ে খাড়া। কিন্তু পাত্রের ভাবসাব দেইখ্যা মনে হইতেছে না যে পাত্রীরে তার পছন্দ! সে মনে হয় বিয়ায় আতঙ্ক না।

রাজীব পারুলের কথা বুঝতে পারছে না। সে বলল, সে আতঙ্ক না, এটা বলেছে?

পারুল বলল, না বলে নাই। না বলনের অবশ্য কারণও আছে। সে এহনও জানেই না যে তার সাথে পাত্রীর বিয়া। না জানলে সে বলবো কেমনে? তবে সে বোকা। বুদ্ধিমান হইলে তার এতদিন বুইঝা ফেলনের কথা আছিল।

রাজীব বলল, সবার বুদ্ধি তো সমান হয় না। আপনি বুঝিয়ে বলুন।

পারুল বলল, এইটুক না বুঝলে কেমনে হইব? ঘর সংসার করতে হইব না? এত অবুঝ হইলে চলব?

রাজীব বলল, আপনি বুঝিয়ে নিবেন। তাহলেই তো হলো!

পারুল বলল, আমার ঠেকা! যার যার বুঝ, তার তার কাছে। সে না বুঝলে আমি কেন তারে বুঝাইতে যাব?

রাজীব বলল, সম্পর্কে কারো কারো একটু বেশিই দায়িত্ব থাকে। একজন একদিকে একটু বেশি হলে, অন্যজন হয়তো অন্যদিক থেকে তা পুষিয়ে দেয়।

পারুল বলল, অন্যজন কোন দিক দিয়া পোষাইয়া দিব? কি দিয়া?

রাজীব খানিক কাছে সরে বসল পারুলের। তারপর গাঢ় গলায় বলল, ভালোবাসা দিয়ে।

পারুল রাজীবের মুখের দিকে তাকাল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, সত্য?

রাজীব বলল, হুম। সত্য। পারুলের এবার কেন যেন লজ্জা লাগছে। সে রাজীবের চোখ থেকে তার চোখ সরিয়ে নিলো। তাকিয়ে রইল নিজের পায়ের কাছে সোনালি রোদ পড়ে ঝলমল করা ঘাসে। নদীর মৃদু হাওয়ায় পারুলের নাকের নোলকখানা দুলছে। কি যে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে। রাজীব হঠাৎ তার কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বলল, বোকাসোকা লাজুক পাত্রটা যদি খানিক সাহসী হতে চায়?

পারুল লজ্জায় যেন লাল হয়ে গেল। সে কোনো কথা বলল না। তার মুখটা যেন আরো নত করে ফেলল সে। রাজীব হঠাৎ পারুলকে তুমি করে বলল। সে বলল আমার তোমাকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে পারুল। অসম্ভব ইচ্ছে। আমি কি তোমাকে একটু ছুঁয়ে দিতে পারি?

রাজীবের গলায় তুমি শুনে পারুল যেন জল হয়ে গেল। রাজীব পারুলের কানের কাছে ঠোঁট এনে বলল, দেই পারুল।

পারুল কেমন ঘোর লাগা গলায় ফিসফিস করে বলল, জানি না।

রাজীব আলতো করে তার হাতখানা বাড়িয়ে পারুলের কোমড় জড়িয়ে ধরল। রাজীবের হাতের সেই স্পর্শে কি ছিল, কে জানে! পারুল যেন মোমের মতো গলে মিশে গেল রাজীবের শরীরে। রাজীব তাকে দুহাতে শক্ত করে বেষ্টন করল। পারুলের ঘন তপ্ত ভারি নিঃশ্বাস বইছে। সেই নিঃশ্বাসের ছন্দে ছন্দে তার নাকের নোলকখানা কী অদ্ভুত সুন্দর করেই না দুলছে! রাজীব ধীরে তার ঠোঁটখানা নিয়ে গেল পারুলের কানের কাছে। তারপর ফিসফিস করে বলল, আমায় তোমার নাকের নোলক করো। কাঁপতে দিও নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে।

পারুলের মনে হচ্ছিল সে দম আটকে মারা যাবে। তার সারা শরীর জুড়ে কেমন এক ঘোর। কেমন অন্য এক স্পর্শের মাতম। সে চোখ বন্ধ করে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে বসে রইল রাজীবের পাশে। কিন্তু রাজীব তাকে পুরোপুরি শুষে নিলো না। অথচ পারুল তখন পুরোপুরি নিঃশেষ হবার উদগ্র বাসনায় বিলীন।

রাজীব চলে গেল বিকেলে। তারপরের শুক্রবার আবার আসলো রাজীব। লতার কলেজ বন্ধ থাকে বলে শুক্রবারটা সুবিধা। কিন্তু এবার এলো রাজীব একা। লতার সাথে কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে আশিকের। এইজন্য আশিক রাগ করে আসেনি। কিন্তু রাজীব নিয়ম করেই আসতে থাকল। পারুল একটা বিষয় নিয়ে খুব বিরক্ত। শুক্রবার ছাড়া আর প্রতিটা দিন তার কাছে মনে হয় একেকটা বছর। কিন্তু শুক্রবারটা যুগের কাঁটায় এসে যেন সেকেন্ডের কাঁটায় চলে যায়। কি আশ্চর্য ব্যাপার।

রাজীব আগের চেয়ে অনেকটাই সপ্রতিভ হয়েছে। তবে এখনো তা নির্ভর করে পারুলের উপর। সে পারুলকে ভয় পায়। পারুল হাত বাড়ালেই সে কেবল হাতখানা ধরে। না বাড়ালে গুটিয়ে থাকে। তবে তারা আপনি থেকে তুমি হয়েছে। তারা কেউ কাউকে ভালোবাসি বলেনি। কিন্তু বলা হয়ে গেছে যেন তার চেয়েও ঢের ঢের বেশি কিছু। সেদিন পারুল বলেছিল, আমি আর থাকতে পারব না একলা একলা।

রাজীব বলেছিল, তাহলে?

পারুল বলেছিল, তাহলে আবার কি? বিয়ার ব্যবস্থা করো। তোমার বাসায়। কথা বলো। আমি আমার আব্বার লগে কথা বলি।

রাজীব বলল, আমি তোমাকে না জানিয়ে মার সাথে কথা বলেও ফেলেছি।

কথাটা শুনে পারুলের এত লজ্জা লাগছিল। সে আড়ষ্ট গলায় বলল, উনি কি বলছেন?

রাজীব বলল, বাবার সাথে কথা বলবেন।

পারুল বলল, আমি কি তাইলে আমার আব্বার সাথে কথা বলব?

রাজীব বলল, এখুনি না। আগে আমি বাবা-মায়ের কাছ থেকে অনুমতিটা পাই।

পারুল বলল, অনুমতি না পাইলে?

রাজীব তার হাতখানা পারুলের হাতের উপর রাখল। তারপর আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। এইটুকু তো বোঝো? বোঝো না?

কথাটুকু পারুলের কানে অপার্থিব সঙ্গিত হয়ে লেগে রইল। রাজীবের সেই এতটুকু হাতের স্পর্শ, এতটুকু কথার স্পর্শ, এতটুকু শব্দের অপার্থিব সঙ্গিত হয়ে কানে লেগে থাকা, আর কি চাই তার এই জনমে? আর কিছু চাই না। তারপরও পারুল অনেক কিছুই পায়। অনেক বেশি কিছু। রাজীব তার জন্য ঢাকা থেকে কত কিছু নিয়ে আসে! সেইসব জিনিস পারুল ব্যবহার করে না, খায় না। যদি শেষ হয়ে যায়! সে প্রতিদিন একটু একটু করে দেখে, হাত বাড়িয়ে ছোঁয়, আর ভাবে। এই তো জীবন। একটা হলুদ পাখির মতো। একটা রঙিন প্রজাপতির মতো, সোনালি রোদের মতো, শান্ত নদীর মতো। আহা।

পারুল সেদিন বাড়ি ফিরল আরো অন্য এক নতুন পৃথিবী উন্মোচনের আনন্দ নিয়ে। সে রাজীবকে লঞ্চের কেবিনে উঠিয়ে দিতে গেল। কেবিনটা চার দেয়ালের ছোট্ট একটা ঘর। দরজাটা সামান্য ফাঁক করে খোলা। পারুলের বুকের ভেতরটা দুরুদুরু করে কাঁপছিল। একটা ভয়ে, আবার উত্তেজনায়ও। রাজীবকে তার ভয় নেই। কিন্তু তারপরও। রাজীব অবশ্য আগালোও না। কেবল পারুলকে দু’হাতে বুকের ভেতর জাপটে ধরে বসে রইল। লঞ্চের শেষ ভেঁপু বাজতেই পারুল উঠে দাঁড়াল। সে এই সময়টা রাজীবের চোখের দিকে তাকাতে পারে না। দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হতেই রাজীব তার হাত ধরে টান দিলো। তারপর হঠাৎ পারুলের মুখখানা দু’হাতে চেপে ধরে সে তার ঠোঁট নামিয়ে আনল পারুলের ঠোঁটে। পারুলের তারপর আর কিছু মনে নেই। সে কেবল বিবশ হয়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইল। রাজীব কতক্ষণ এভাবে রেখেছিল পারুল জানে না। কিন্তু তার শরীর জুড়ে কী এক ঝিমঝিম ভাব। সেই রাত, পরদিন বাড়ি ফেরার পথের সারাটাক্ষণ সেই ঝিমঝিম ভাব লেগে রইল তার শরীরে। রাজীবের ঠোঁটের হঠাৎ অমন চুম্বক হয়ে তাকে শুষে নেওয়ার ওই সামান্য মুহূর্তটুকুই যেন পারুলকে জনিয়ে দিয়ে গেল, তার এই চেনা শরীরের ভেতরে রয়েছে অন্য এক শরীর। অন্য এক আস্বাদের অনাবিষ্কৃত জগৎ। এই আস্বাদ তার কাছে বড় বেশি অচেনা। এ যেন এক অবাক নতুন পৃথিবী।

পারুল তার দিন দুই বাদে আব্দুল ফকিরের সাথে কথা বলল। আব্দুল ফকির কথা শুনে তেমন কিছুই বললেন না। চুপ করে রইলেন। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে পারুল খানিক চমকালো। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে বাবার সাথে তার যেন এক অঘোষিত দূরত্ব। এই দূরত্বের কারণ স্পষ্ট না। কিন্তু দূরত্ব স্পষ্ট। বহুদিন বাদে আব্দুল ফকিরের দিকে খেয়াল করে পারুল একটু অবাক হলো। তার চেহারার আগের সেই মোলায়েম ভাবটা যেন আর নেই। কোথায় যেন একটা প্রকট নিষ্ঠুরতা ফুটে উঠেছে।

সেই রাতে পারুল দেখল ভয়ঙ্কর এক দৃশ্য। মাঝরাতে কিসের গোঙানিতে পারুলের ঘুম ভেঙে গেছে। গোঙানিটা চাপা কিন্তু স্পষ্ট। সে প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও মুহূর্তেই তার মনে হলো কণ্ঠটা তার চেনা। এটা তাবারনের গলা। পারুল পা টিপে টিপে ঘরের বাইরে এলো। উঠানে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। কিন্তু বাহির বাড়ির ঘর থেকে কয়েক চিলতে মৃদু আলো এসে পড়েছে উঠানে। সে সন্তর্পণে সেই আলো পেরিয়ে উঠানের অন্য পাশে এলো। বাহিরবাড়ির এই ঘরে বহুকাল থেকে আব্দুল ফকির থাকেন। পাশের ঘরে থাকে জুলফিকার আর রতন। কিন্তু গতরাতে জুলফিকার আর রতনকে কই যেন পাঠিয়েছেন আব্দুল ফকির। ঘরের কাছাকাছি আসতেই তাবারনের গোঙানির শব্দ যেন আরো স্পষ্ট হলো। পারুল বেড়ার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তাবারনের গোঙানির সাথে সাথে চাপা ফোঁস ফোঁস শব্দ। টিনের বেড়ার গায়ে উঠিয়ে ফেলা গজালের ছোট ছোট ফুটো। পারুল তার একটাতে চোখ রাখল। ভেতরে হারিকেনের মৃদু আলো। সেই আলোয় পারুল যা দেখল, তাতে তার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। ভয়ে তার শিরদাঁড়া কেঁপে উঠল। তাবারন পুরো নগ্ন হয়ে ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে। তার কোমড় পেঁচিয়ে আছে একটা সাপ। আরেকটা সাপ পেঁচিয়ে আছে তার গলা। তীব্র আতঙ্কে তার চোখ যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আব্দুল ফকির বসে আছেন তাবারনের পায়ের কাছে। তার পরনে লুঙ্গি। কিন্তু শরীরের উপরের অংশ খালি। তিনি দু’হাতে তাবারনের উরুর মাংস খামচে ধরে বসে আছেন। পারুল আর মুহূর্তের জন্যও সেখানে দাঁড়াতে পারল না। সে তার ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে কাঁপতে লাগল। ভয়ে, আতঙ্কে, ঘৃণায় তার শরীর গুলিয়ে বমি পাচ্ছিল। কিন্তু সে তেমন করেই স্থির বসে রইল সারারাত। ভোরের আলো ফুটতে সে ঘর থেকে বের হলো। আব্দুল ফকির তখন কেবল ফজরের। নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে ফিরেছেন। তার চোখেমুখে ঝলমলে একটা ভাব। গতকালের সেই কাঠিন্যটা যেন আর নেই। পারুলকে দেখে তিনি মোলায়েম গলায় বললেন, কি হইছে মা? শরীল খারাপ? চেহারা দেইখ্যা মনে হইতেছে রাইতে ঘুম হয় নাই।

পারুল কোনো কথা বলল না। আব্দুল ফকির বললেন, কোনো অসুবিধা হইলে আমারে বলবা মা।

পারুল হঠাৎ বলল, আমার এই বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হইতেছে। আমার বিয়ার ব্যবস্থা করেন। অতি সত্বর ব্যবস্থা করেন। আমি আর এই গ্রামে থাকব না। আমি শহরে চইলা যাব। আপনে যোগাড়-যন্তর করেন। রাজীবের বিষয়ে আমি দেখতেছি।

আব্দুল ফকির বললেন, কিন্তু মা, ছেলেরে চিনি না, জানি না। সয় সংবাদ কিছু নেওয় হয় নাই। বংশ কি? বিষয়-আশয় কি? বাপ-মা কী করে…

পারুল আব্দুল ফকিরকে কথা শেষ করতে দিলো না। সে হঠাৎ চাপা কিন্তু ঝাঁঝালো গলায় বলল, আপনের কিছু দেহন লাগব না। যা দেহনের আমি দেখব। আপনের যা দেহনের আপনে তা দেহেন। কথা শেষ। একদম শেষ।

*

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ধারণা, তার ডান হাতখানা ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যাচ্ছে এবং এই অবশ হয়ে যাওয়ার কারণ আব্দুল ফকির। সেদিন দহলিজ ঘরে আব্দুল ফকিরকে থাপ্পড় মারার পর থেকেই যেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মনে মনে এমন কিছু ঘটারই অপেক্ষায় ছিলেন। আব্দুল ফকিরকে নিয়ে একটা প্রচণ্ড ভয় তার মনে সব সময়ই ছিল। তিনি তার দীর্ঘ জীবনে নানান কিছু করেছেন। কিন্তু আব্দুল ফকিরের ওপর থেকে এই ভয়টা তার কখনোই কাটেনি। তিনি অনেক চেষ্টা করেও এই ভয়টা কাটাতে পারেননি। চোখ বন্ধ করলে এখনো তিনি স্পষ্ট দেখতে পান, আব্দুল ফকিরকে চেপে ধরে তার মাথা কেটে নিয়েছে হায়দার। আলী। কিন্তু সেই মাথা যখন বস্তা থেকে বের করা হলো, তা হয়ে গেল বজলু ব্যাপারীর মাথা। বিষয়টার নানান যুক্তি আছে, ব্যাখ্যাও আছে, কিন্তু তারপরও এখন পর্যন্ত ঘটনাটা মেনে নিতে পারেন না তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। এর পরের বারের ঘটনা আরো ভয়াবহ। সাবধানতা অবলম্বন করতে রাতের অন্ধকারে আব্দুল ফকিরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো শোলামুড়িয়ার বিশাল নদীতে। সেখানে তাকে খুন করে তার লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হবে নদীতে। তার হাত-পা বাঁধা। কাপড় দিয়ে মুখমণ্ডল ঢাকা। মাঝরাতে তাকে নেয়া হলো নৌকার গলুইয়ে। হায়দার আলীর হাতে ধারালো বড় দা। সে দা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ শেষ মুহূর্তে তার সাথে কয়েকটা কথা বলতে চান। এইজন্য তার মুখ খোলা হয়েছে।

আব্দুল ফকিরের সাথে কথা বলতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মনে হলো আব্দুল ফকিরের হাত খোলা। সে তার হাত পেছনে নিয়ে এমনভাবে বসে আছে যেন দেখলে মনে হবে তার হাত বাঁধা। কিন্তু আসলে তার হাত বাঁধা না। সে কোনোভাবে নৌকার ভেতরে বসে হাতের বাঁধন খুলে ফেলেছে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অবশ্য এতে চিন্তার কোনো কারণ দেখেননি। তিনি চিন্তিত ছিলেন আব্দুল ফকিরের মুখ দেখে। তার মুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছেন। বরং কেমন একটা হাসির আভাও লেগে আছে মুখে। মুখমণ্ডলের কাপড়টা সরাতেই আব্দুল ফকির তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে সালাম দিয়ে বললেন, খা সাব। আমার লাশখান গোর দিবেন কই?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তোমার লাশের ভাগ্যে মাটি নাই ফইর। তোমার লাশ নদীতে ভাসব। লাশ পইচ্যা ভাইস্যা উঠব। কাউয়া, চিলে খাইব। পচব। যার শাস্তি যেমন।

আব্দুল ফকির বলেছিলেন, এইটা কেমন কথা খা সাব। আপনের সাথে তো আমার জমিজমা লইয়া ঝামেলা না যে আপনে আমারে মরনের পর তিন হাত মাটি দিবেন না। শুনছি, যাগো সাথে জমিজমা লইয়া ঝামেলা, তারা কবরের লইগ্যা মাটি পায় না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কিছু বলতে যাবেন। এই মুহূর্তে দু’হাতে ভর দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে পানিতে লাফ দিলেন আব্দুল ফকির। সাথে সাথে দা চালিয়েছিল হায়দার আলী। কিন্তু দায়ের কোপ পড়েছিল আব্দুল ফকিরের পায়ে। বাঁ পায়ের প্রায় অর্ধেকটা কেটে রয়ে গিয়েছিল। সেই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে সাথে সাথেই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হায়দার আলীও। দীর্ঘ সময় তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো আব্দুল ফকিরকে। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। সে যেন পানির সাথে মিশে গেল। কোনো সাড়া-শব্দ নেই, চিহ্ন নেই, ঢেউ নেই। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর তখনও বিশ্বাস হয়নি, ওই অন্ধকারে, ওই অত বড় কূল-কিনারাহীন নদীতে ওই অবস্থায় কারো পক্ষে বেঁচে ফিরে আসা সম্ভব। কিন্তু আব্দুল ফকির লাফিয়ে পানিতে পড়ার মুহূর্তে তিনি যেন আব্দুল ফকিরের চোখে কি দেখেছিলেন। কি দেখেছিলেন, তৈয়ব উদ্দির খা জানেন না। কিন্তু তিনি বাড়ি ফেরেন তীব্র ভয় নিয়ে। বাড়ি ফিরে পড়েন ভয়াবহ জ্বরে। সেই জ্বর ছাড়ে মাসখানেক পরে। সুস্থ হয়ে তিনি শোনেন তার পাশের বাড়িতে ঢোল বাদ্যের আওয়াজ। তিনি আলী হায়দারকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ঢোল বাজায় কেডা?

আলী হায়দার বলেছিল, আব্দুল ফইর সাপের বিষ নামায়।

সেই শেষ। আব্দুল ফকিরকে নিয়ে তারপর আর কোনো আগ্রহ দেখাননি তিনি। কিন্তু এই দিনকয় আগে সেই আব্দুল ফকিরকে দহলিজ ঘরে বসে যখন চড় মেরেছেন তিনি, সেদিন সেই মুহূর্তেই যেন মনে মনে এর পরিণতি মেনে নিয়েছেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ।

আমোদি বেগমকে ডেকে ঘটনা খুলে বললেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। আমোদি বেগম তাকে নানাভাবে বোঝালেন। তিনি বললেন যে তার হাত আসলে অবশ হয়ে যাচ্ছে না। এমনিতেই তিনি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তার ওপর আব্দুল ফকিরের ঘটনা নিয়ে তার মধ্যে দীর্ঘদিনের ভয়। এছাড়া এত খারাপ শারীরিক অবস্থা তার আগে কখনো হয়নি। সবমিলিয়ে এটা তার মনের ভাবনা যে আব্দুল ফকিরকে থাপ্পড় মারার কারণেই তিনি তার ডান হাত নড়াতে পারছেন না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অবশ্য বহু চেষ্টা করেও হাতখানা খুব একটা নাড়াতে পারলেন না। তবে চেষ্টায়ও তিনি ক্ষ্যান্ত দিলেন না। তার চেষ্টা চলতেই থাকল। এই মুহূর্তে মনির এলো। সে এসে বলল, দাদাজান, আপনের ধারে বাড়ির কিছু চাবি আছে। চাবিগুলান আর কেউর কাছে নাই। এহন চাবিগুলান তো দরকার।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, চাবি দিয়া কি করবি?

মনির বলল, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জিনিসপত্র লাগে। বারবার তো আপনের কাছে আসন যায় না। আর দরকার তো। বোঝেন না?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বোঝেন না, তা না। তিনি বললেন, চাবিগুলান আর কয় দিন পর নে।”

মনির বলল, দাদাজান, আর কয়দিন পর নিলেও আমি নিবো। এহন নিলেও আমিই নিবো। দেরি হইলেই দেরি।

মনিরের কথাবার্তা শুনে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর অবাক হবার কথা ছিল। কিন্তু তিনি অবাক হলেন না। তিনি শান্ত গলায় বললেন, যহন দরকার পরব, তহন আমি নিজে তোরে ডাইক্যাই দিব।

মনির বলল, দাদাজান, দরকার আপনে বোঝতে আছেন না। ঘরে বিছনায় শুইয়া দরকার বোঝন যায় না। চাবিগুলান না দিলে, সিন্দুক, বাক্স আর আলমারিগুলান ভাঙ্গা লাগব দাদাজান।

মনির আর দাঁড়াল না। সে যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই চলে গেল। মনিরের আচরণে ভারি অবাক হয়েছেন আমোদি বেগম। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কথা ভেবে তার মায়াই হচ্ছে। এই পাহাড়ের মতো মানুষটা ক্রমশই কেমন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছেন। তিনি তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মুখের দিকে তাকালেন। মনিরের গমনপথের দিকে তাকিয়ে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মৃদু হাসলেন। তার হাসি দেখে আমোদি বেগম ভারি আশ্চর্য হলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হাসতেছেন ক্যান? এইটা হাসনের মতো কোনো ঘটনা?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, একটা কথা চিন্তা কইর‍্যা হাসতেছি।

আমোদি বেগম বললেন, কি কথা?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, জীবনের হিসাবের কথা। বড় পাক্কা হিসাব নিকাশ।

আমোদি বেগম বললেন, এইখানে হিসাব-নিকাশের কি দেখলেন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আমার বাজানের শেষদিকের কাজ কারবার আমার পছন্দ আছিল না। আমার খালি মনে হইত, এই কাজ যদি এমনে না কইরা, অমনে করা হইত। অমনে না কইরা এমনে করা হইত। তাইলে আরো ভালো হইত। আমার তখন চিন্তা-ভাবনা সব বিষয় সম্পত্তির উপর। বাজানের শরীল খুব খারাপ। আমি ডাক্তার কবিরাজ আনি। মসজিদে মিলাদ দেই, দোয়া পড়াই। কিন্তু মনে মনে আল্লাহর ধারে বলি, আল্লাহ বুড়ারে যত তাড়াতাড়ি পারো, লইয়া যাও। এর জইন্য আমি মন মতো কাজ করতে পারতেছি না। আইজ মনিররে দেইখ্যা আমার সেই নিজের কথা মনে পড়ল। মনির পারলে। এহন নিজ হাতে আমারে গলা টিপ্যা মাইরা ফালায়। তার মাথায় এহন খালি সয় সম্পত্তি। জীবনটা হইল একটা চোরপুলিশ খেলা বুঝলা? তুমি যত যাই করো, ধরা তোমারে খাইতেই হইব। আইজ বা কাইল।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ফজুরে বলছ কাগজপত্রের কিছু ব্যবস্থা করতে? আমি তো আর এই অবস্থায় জমি লেইখ্যা দিতে মাদারীপুর যাইতে পারব না। তারে বলল তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করতে। আমি চোউখ বোজলে কিন্তু শ্যাষ।

আমোদি বেগম বললেন, সে ব্যবস্থায় আছে।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কোহিনূরের কোনো খবর পাইছ?

আমোদি বেগম অনেকক্ষণ কোনো জবাব দিলেন না। তারপর মৃদু কণ্ঠে বললেন, সে আসব না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ যেন এই জবাবটা জানতেন। মনে মনে এমন কিছু শোনার প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু তারপরও বুকের কোথায় তীব্র ফলার মতো বিদ্ধ হলো কিছু। সেখানে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় রক্তক্ষরণ হতে থাকল। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বাইরে অবশ্য কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। যেমন ছিলেন, তেমন চুপ করেই রইলেন। তার চারপাশে একটা চাপা কষ্ট ভেসে বেড়ানো নিঃশব্দে। এই নিঃশব্দতা বাকিটা দিন ভেসেই রইল। আরো গাঢ় হলো। গম্ভীর হলো। তীব্র হলো। কিন্তু মিলিয়ে গেল না। নিঃশব্দতা ভাঙল পরদিন সন্ধ্যায়। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ছোট ছেলে দবির এসে উপস্থিত বাড়িতে। সাথে তার স্ত্রী এবং ছ’বছরের এক পুত্র সন্তান। তিনি এসে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সরুচোখে তাকিয়ে বললেন, ঘটনা কি?

দবির খাঁ বললেন, বাজান আপনেরে না জানাইয়া বিয়া কইরা ফালাইছিলাম। বরিশালের ঝালকাঠিতে গিয়া এই মাইয়ার মায়ায় পইরা গেছিলাম। সেই মায়া আর ছাড়াইতে পারি নাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ছেলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই ছেলেকে এতটা নজর করে কখনো দেখেননি তিনি। অন্য সময় হলে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কি করতেন তা তিনি জানেন না। তবে দবির খাকে স্ত্রী সন্তানসহ দেখে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ভেতরে ভেতরে একটু যেন আনন্দিতই হলেন। যদিও পুত্রবধূর চেহারা-ছবি দেখে তিনি খুশি হতে পারলেন না। বরং ভয়ানকভাবে আহতই হয়েছেন। নিজের ভেতরের সেই পুরনো জেদ, জাত্যাভিমান প্রবল আক্রোশে ফিরে আসতে চাইছিল। কিন্তু প্রবল চেষ্টায় তিনি তা প্রতিহত করলেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, বিয়ার কথা এতদিন বলস নাই ক্যান? তোর বিয়া নিয়া কি কারো কোনো আপত্তি ছিল? তুই বললেই তো বড় ঘর দেইখা জাঁকজমকভাবে বিয়া হইত। আর করছসই যহন, লুকাইয়া করলি কেন? জানাইয়াই করতি।

দবির খাঁ বললেন, এইহানেই সমস্যা বাজান।

তৈয়র উদ্দিন খাঁ বললেন, কি সমস্যা?

দবির খ বললেন, বংশ।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নিজেকে বোঝালেন। তিনি তার এই ক’দিনের ভাবনা, বোঝাবুঝিকে যেন আবার নতুন করে নিজের ভেতর প্রথিত করলেন। খানিক সময় নিয়ে নিজের সাথে বোঝাঁপড়া করে, তিনি নরম গলায় বললেন, বংশ ছোট হইলেও সমস্যা নাই। তোর ছোট মায়ের বংশও তো ছোট বংশ। আমি তারে বিবাহ করি নাই? বংশটা আসল নারে, কর্মটাই আসল। এই জিনিস বুঝতে বড় দেরি হইছে আমার।

দবির খাঁ বাবার কথা শুনে যারপরনাই অবাক হলেন। তিনি আহ্লাদিত গলায় বললেন, বাজান! বাজান!

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হেসে ছেলেকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন, কোনো সমস্যা। নাই বাজান। তুই এই বয়সেও শেষ পর্যন্ত বিয়া-শাদি করছস। সংসারী হইছস, এইতেই আমি খুশি। ছোট বংশ হোক সমস্যা নাই। তা মাইয়ার বাপ কি করে? বংশ কি?

দবির খাঁ বললেন, বংশে মেথর। গু পরিষ্কার করে।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ প্রথমে বিষয়টা বুঝতে পারলেন না। তিনি বললেন, কি করে?

দবির খা আগের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। বললেন, সে ঝালকাঠি জেলা পরিষদে চাকরি করত। মেথরের চাকরি। সরকারি অফিস-আদালতে পায়খানা পরিষ্কার। মাঝে-মধ্যে ছুটা টাইমে খ্যাপও মারত। প্রাইভেট খ্যাপ। বালতি কান্ধে লইয়া বাড়ি বাড়ি ঘুরত। খ্যাপ পাইলে পায়খানা পরিষ্কার করত। সেই লোকের মাইয়া বিয়া করছি। কী করব বলেন? দেইখ্যা মায়া পইড়া গেল। সেই মায়া আর কাটাইতে পারলাম না। মাইয়ার বয়সও কম। আমার অর্ধেক। চেহারা। ছবি ভালো না। মেথরের মাইয়া। বিয়া করব কেডা! মায়া পইড়া গেল বাজান। দুইন্যায় সব কিছু ছাড়া সহজ, মায়া ছাড়া সহজ না। আমার শ্বশুরের বয়সও। বেশি না। আমার সমানই হইব। কিন্তু সে হঠাৎ মারা গেল। এতদিন তার ঘাড়ে বইসা বইসা খাইছি। এহন কি করব? এইজইন্য চইলা আসছি। আপনে চাইলে আব্বা, আমি এই বাড়িতে থাকব না। আমারে দূরে কোনোখানে একটু জমি দেন, একখান ছনের ঘর তুইল্যা দেন। আমি সেইখানেই থাকব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আর কথা বললেন না। তার কেন যেন বমি পাচ্ছে। একবার মেথরদের বাথরুম পরিষ্কারের দৃশ্য তৈয়ব উদ্দিন খাঁ দেখেছিলেন। পায়খানার স্লাবের ভেতর থেকে তারা দুইহাত ভর্তি করে মল উঠায়। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মাথা ঘোরাতে লাগল। বমি বমি ভাব হতে লাগল।

ঘটনা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না। চারদিক থেকে বাড়ির বাইরে মানুষ এসে জমা হতে লাগল। সকলেই এই বউ দেখতে চায়। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ছেলের বউ মেথরের ঘরের…! কারোরই যেন বিশ্বাস হয় না এই কথা! পরদিন সকাল নাগাদ দবির খাকে ঘরে আটকে তার স্ত্রী পুত্রকে বাড়ির বাইরে বের করে দেয়া হলো। সন্ধ্যা অবধি তারা সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। ছেলেটা মায়ের আঁচল ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা, খিদা লাগছে।

তার মা জবাব দিলো না। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। দবির খার স্ত্রী জানে না, সে তার সন্তান নিয়ে কই যাবে! এই অচেনা-অজানা এলাকায় তার যাওয়ার কোনো জায়গা নাই।

রাতভর তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নিজেকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলেন। গত কিছুদিনের নানান চিন্তা-ভাবনা, বোঝাঁপড়া একত্র করে তিনি বিষয়টা মেনে নেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। হাজার চেষ্টা করেও কিছুতেই কিছু মেনে নিতে পারলেন না তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। যতবার তিনি ভাবেন, ততবারই ঘেন্নায় তার সারা শরীর রি রি করে ওঠে। সেই রাতে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ভয়াবহ স্বপ্ন দেখলেন। দেখলেন দবির খাঁর স্ত্রী তাকে ভাত বেড়ে দিচ্ছে। তিনি প্লেটে ভাত নিয়ে তরকারি নিলেন। তারপর আরাম করে ভাত মেখে মুখে দিলেন। রান্না খুবই ভালো হয়েছে। তিনি তৃপ্তি করে ভাত খেলেন। সাধারণত এত ভাত তৈয়ব উদ্দিন খাঁ খান না। তিনি আবারো ভাত চাইলেন। এবার ভাত মেখে মুখে দিতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন ভয়াবহ দুর্গন্ধ আসছে কোথাও থেকে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আচমকা তাকিয়ে দেখেন তিনি এতক্ষণ ভাত ভেবে যা আরাম করে খাচ্ছিলেন, তা আসলে ভাত না। মানুষের মল। তিনি ওয়াক ওয়াক শব্দ তুলে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখলেন, তরকারির বাটিভর্তিও মানুষের নানারকম মল। ডালের বাটি ভর্তি পাতলা পায়খানা।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙেই তিনি হড়বড় করে বমি করলেন। সেই রাত তার কাটালো বমি করে। তিনি মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করতে পারলেন না। তার এই এতদিনকার চিন্তা-ভাবনা, কিছুই তাকে সামান্যতম প্রবোধও দিতে পারছে না। তিনি ভোরের আলো ফোঁটার আগেই আমোদি বেগমকে ডাকলেন। বললেন, আমোদি বেগম, এই ঘটনা ঘটার আগে আল্লাহ আমারে উঠাই নিয়া গেল না কেন?

আমোদি বেগম কথা বললেন না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আল্লাহ আমার মরনের আগে আমারে এই শাস্তি দেওনের কথা ভাবছিল? আমি এত বড় পাপ করছিলাম জীবনে!

আমোদি বেগম বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। এই ঘটনা তিনিও মেনে নিতে পারছেন না। ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ঘরে চলে এলো মনির, খবির খাঁ, মনিরের মা। মনির বলল, দাদাজান, বাড়ির দরজায় এহনো দুইজন বইস্যা আছে। লোকজন দিয়া মাদারীপুর পাঠাই দিব? ওইখান থেইকা বরিশালের গাড়িতে তুইল্যা দিব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আগে দেখ আপোষে কিছু করন যায় কিনা? মাইয়ারে দবির বিয়া করছে। মামলা-মোকদ্দমা করলে সমস্যা। মান-সম্মানের প্রশ্ন। এক কাজ কর। আগে এইহানে লইয়ায়। দেহি কথা বইল্যা, পয়সাপাতি দিয়া কিছু করন যায়নি!

সারারাত না খাওয়া, না ঘুমানো দবির খাঁর স্ত্রীর চেয়েও তার সন্তানের অবস্থা বেশি খারাপ। সে ঘরে ঢুকেই করুণ গলায় বলতে লাগল, দুইডা ভাত দ্যান, আল্লারস্তে দুইডা ভাত দেন।

কিন্তু কেউ কোনো শব্দ করল না। সকলেই তাকিয়ে আছে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর দিকে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর শরীর যারপরনাই খারাপ। কিন্তু সেটি তিনি কাউকেই বুঝতে দিচ্ছেন না। দবির খাঁর পুত্র তার নাতি, কিন্তু সেই নাতির করুণ আর্তনাদ শুনেও তার বিন্দুমাত্র মায়া হচ্ছে না। বরং রাগ এবং ঘেন্নায় তার শরীর রি রি করছে। সম্ভবত ছেলেটির মা-ই শিখিয়ে দিয়েছিল, সে হঠাৎ দৌড়ে এসে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর হাত ধরে কান্না শুরু করল, দাদাজান, খিদা, দাদাজান। খিদা। দুইডা ভাত দিতে কন, দাদাজান। নুন আর মরিচ হইলেই হইব দাদাজান। খিদা।

দুটো ভাতের জন্য ছ’বছরের ছেলের এমন অসহায় করুণ কান্না দেখলে যে কারো মন গলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মন তাতে এতটুকু গললো না। বরং ছেলেটা তার হাত ধরতেই তৈয়ব উদ্দিন খাঁর আবার রাতের সেই স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বহু কষ্টে যেন বমি চাপলেন। আচমকা পা ভাঁজ করে হাঁটুর ধাক্কায় তিনি ছেলেটাকে মেঝেতে ফেলে দিলেন। মনির এসে ছেলেটার সামনে দাঁড়াল। তারপর রক্তচক্ষু করে বলল, গলা চিপ দিয়া, ভাত খাওনের সাধ মিটাই দিব হারামজাদা! যা, পায়খানায় গিয়া গু খা।

ছেলেটা এবার আর কাঁদল না। সে চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে মনিরের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন তার এইটুকু জীবনে, এর চেয়ে খারাপ ঘটনা আর সে দেখেনি। সে আর একটুও কাঁদল না। উঠে গিয়ে মায়ের হাত ধরে টানতে লাগল। কিন্তু তার মা উঠল না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নানানভাবে দবির খার স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। নানান ভয়ভীতি দেখালেন। মনিরকে দিয়ে হম্বিতম্বি অবধি করালেন। পয়সাপাতির প্রলোভন দেখালেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। স্বামীকে ছাড়া সে এই বাড়ি থেকে কোথাও যাবে না। মেরে ফেললেও না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ শেষ অবধি সিদ্ধান্ত দিলেন। সলিমুদ্দি দফাদারের পরিত্যক্ত বাড়ির পেছনে যে জঙ্গল মতো জায়গাটা রয়েছে, সেখানে একখানা ছনের ঘর তুলে দিতে বললেন। তবে দবির খা সেই বাড়িতে যেতে পারবেন না। শুধু যে যেতেই পারবেন না, তাও না। স্ত্রীর সাথে কোনো সম্পর্কও তিনি রাখতে পারবেন না। সবচেয়ে ভালো হতো তালাকের ব্যবস্থা করতে পারলে। কিন্তু সেটিতে দবির খাকে কিছুতেই আতঙ্ক করানো গেল না।

সেই মুহূর্তেই দবির খাঁর স্ত্রী আর পুত্রকে খ-বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলো। দিনের মধ্যে ঘরামি ডেকে বাঁশ ছন দিয়ে কোনোমতে একখানা ঘরও তুলে দেয়া হলো। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অবশ্য তারপর দিন কয় আর খাওয়া-দাওয়া করতে পারলেন না। খাওয়া-দাওয়া করতে বসলেই তার কেবল সেই স্বপ্নের কথা মনে পড়ে। তার চেয়েও বড় কথা, দবির খাঁর ছেলে তার হাতের যেখানে স্পর্শ করেছে, তৈয়ব উদ্দিন খাঁর বারবার মনে হতে লাগল, সেই জায়গাটিতে বোধ হয় নোংরা লেগে আছে। তিনি সেদিন তিনবার গোসল করলেন। সাবান দিয়ে হাতের সেই জায়গাটা কম করে হলেও কুড়িবার ধুলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরপরই তার মনে হতে থাকল, তার শরীর জুড়ে বোধহয় ছড়িয়ে পড়ছে ভয়াবহ কোনো দুর্গন্ধ!

*

সংবাদটা শুনে পারুল হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। লতা দৌড়ে এসে পারুলকে জিজ্ঞেস করল, ও পারুল। পারুল। কি হইছে? ওই কি হইছে বল তো? রাজীব তোরে ফোনে খারাপ কিছু বলছে?

পারুল ডানে-বায়ে মাথা নাড়াল। কিন্তু কান্নার দমকে সে মুখে কিছু বলতে পারছে না। লতা পারুলের কান থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে দেখল রাজীব এখনো লাইনে। সে ফোন কানে নিয়ে বলল, কি হইছে রাজীব ভাই? লতা এমনে কান্দে কেন?

রাজীব হো হো হো করে হাসল। তারপর বলল, আব্বা-আম্মা বিয়ে মত। দিয়েছেন। সে এই সংবাদ শুনে কাঁদছে। ফোনে পারুলের কিছু ছবি তুলেছিলাম। মাকে দেখিয়েছিলাম আগেই। আজ বাবার সাথে কথা হলো। বাবা কি একটা কাজে বাইরে যাচ্ছেন। ফিরতে পনেরো-কুড়ি দিন লেগে যেতে পারে। তারপরই আমরা সবাই আসব। পারুলের বাড়িতে গিয়ে মা-বাবা বিয়ের তারিখ ঠিক করে আসবেন।

লতা আর কথা বলল না। সে ফোন কেটে দিয়ে পারুলকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো হাসতে লাগল। দুই বান্ধবী আনন্দে যেন দিশেহারা হয়ে গেছে। তারা রুম জুড়ে বাচ্চাদের মতো হুটোপুটি করতে লাগল। দিন দুই আগে লতার কাছে রায়গঞ্জে এসেছে পারুল। তারপর আজ সন্ধ্যায় এই ঘটনা! আর এক মুহূর্তের জন্যও বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না পারুলের। কিন্তু পারুল পরদিন বাড়ি ফিরল। বাড়ি না ফিরে বলা উচিত সে যেন এক ভয়ঙ্কর গোরস্থানে ফিরে এসেছে। এখানে যেন আলো নেই, মানুষ নেই, প্রাণ নেই। কেবল ভয় আছে। মৃত্যু আছে। মৃত্যুর অশনিসংকেত আছে। পারুলের কী যে অসহ্য লাগছে এই বাড়িটা। এই গ্রামটা। এই আলো, হাওয়া, জল। সকলই যেন ভেতরে নোংরা জঘন্য এক চেহারা লুকিয়ে রেখে হেসে চলেছে। কিন্তু এখন সে সব কিছুই দেখতে পায়। বাইরের ঝকঝকে, মোলায়েম, মায়াবী মুখের ভেতরের কদর্য চেহারা। লুকোনো মুখের এই দেখাটা বড় কষ্টের। বড় যন্ত্রণার। পারুলের খুব হাসফাস লাগে। সে আব্দুল ফকিরকে কথাটা বলল। আব্দুল ফকির বললেন, মারে, তোমারে ওই অতদূরে বিবাহ দিয়া আমি থাকব কেমনে?

পারুল বলল, সব বাপ মা-ই মাইয়ার বিয়া দেয়। আপনেও দিবেন।

আব্দুল ফকির বললেন, মা, বিয়া দেওয়া তো সমস্যা না। সমস্যা অতদূরে বিয়া দেওন। আর তুমি নাই, তোমার মাও নাই। আমি মানুষটা একলা কেমনে থাকব মা? তোমারে না দেইখ্যা আমি থাকতে পারব না গো মা।

পারুল বলল, বিয়ার পর আমার মায় আর কোনোদিন তার বাপের বাড়ি যাইতে পারে নাই। তার বাপে তারে দেখতে পারে নাই। সেও তার বাপেরে দেখতে পারে নাই। এই কথা আপনের অজানা থাকনের কথা না।

আব্দুল ফকির পারুলের কথায় থমকে গেলেন। তিনি আর কথা বললেন। পারুল অপেক্ষা করতে লাগল পরের শুক্রবারের। আরো তিনদিন বাকি। তারপর রাজীবের সাথে তার দেখা হবে। আচ্ছা, সে কি একবার রাজীবকে তাদের বাড়ি নিয়ে আসবে? আসলে রাজীবকে সে কোথায় বসতে দিবে? বাইরের ঘরে? নাকি তার ঘরে? এইটুক ভাবতেই লজ্জায় পারুলের গাল লাল হয়ে উঠল। নাহ, এখুনই রাজীবকে বাড়ি আনা ঠিক হবে না। তার চেয়ে বরং একসাথে বাবা মায়ের সাথেই সে আসবে! কিন্তু পরের শুক্রবার যখন রাজীবের সাথে দেখা হবে, সেদিন সে কি করবে? পারুলের কেন যেন মনে হচ্ছে, রাজীবের সামনে যেতে তার ভারি লজ্জা লাগবে!

.

দৃশ্যটা বেখাপ্পা কিন্তু সত্যি। আব্দুল ফকিরের ঘরে বসে আছে মনির। মনির বলল, ফইর সাব, আপনের লগে কোনোসময় কোনো বেয়াদবি করলে মাফ কইরা দিয়েন। দাদাজানের সাথে আপনের যা-ই কিছু থাকুক। সেইটা আপনাগো বিষয়। আমার লগে আপনের কোনো ঝামেলা আল্লাহর ইচ্ছা হইব না। আপনে আমার কোনো ক্ষতি কইরেন না ফইর সাব। আপনে কি জিনিস, সেইটা আমি জানি। কোনো ভুল টুল করলে মাফ কইরা দিয়েন ফইর সাব।

আব্দুল ফকির কোনো কথা বললেন না। তিনি তার হাতখানা বাড়িয়ে মনিরের মাথায় রাখলেন। মনির বলল, দাদাজানের ডাইন হাতখান অবশ হইয়া গেছে কাকু।

আব্দুল ফকির স্মিত হাসিতে বললেন, আল্লাহ তারে ভালো কইরা দিবেন।

মনির বলল, এই ঘটনা কেন ঘটছে আপনে জানেন কাকু। দাদাজান সেইদিনই আমারে বলছিল, দহলিজ ঘরে কি হইছে!

আব্দুল ফকির বললেন, মানুষমাত্রই দোষগুন থাহে মনির। আমারো দোষত্রুটি আছে। সে মুরুব্বী মানুষ। ভুল করছি, একটু শাসন কইরা দিছে। এইটা সে করতে পারে না? তুমি ভাবতেছ, সেই জইন্য আমি তার হাতে সমস্যা। করছি? না মনির। আল্লায় আমারে ওই ক্ষমতা দেয় নাই।

মনির বলল, তাইলে ঘটনা কি হইল কাকু? দাদারও ধারণা, এই ঘটনা ঘটছে আপনের কারণে। একটু সত্যি কইরা বলেন তো কাকু!

আব্দুল ফকির এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তিনি রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলেন। তার হাসিতে মনির পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেল। আব্দুল ফকির বললেন, তয় মনির, তোমার বিপদ কিন্তু সামনে।

মনিরের বুকের ভেতর থেকে তার কলিজাটা যেন লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসার দশা হলো। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কি বলেন ফইর কাকু। আপনে থাকতে আমার বিপদ কেমনে আসব। আপনে আমারে রক্ষা করবেন কাকু।

আব্দুল ফকির বললেন, শুনছি, তোমার ছোট চাচা দবির খা বউ পোলাসহ ফেরত আসছে। ঘটনার কিছু বুঝতে পারছ?

মনির বলল, কি ঘটনা?

আব্দুল ফকির বললেন, তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সম্পত্তির ভাগিদার কিন্তু বাইর‍্যা গেল। এতদিন তার সবকিছুর মালিক আছিলা তুমি আর তোমার ভাই। এহন? কোন না কোন মেথরের ঘরে বিয়া করছে, সেই ঘরের পোলা হইব খায়গো বংশের বাত্তি। মাইনষের কথায় জয়, মাইনষের কথায় লয়। কোন দিন না জানি, মাইনষে তার কারণেই খাঁ-বাড়ির মেথর বাড়ি বইলা ডাকন শুরু করে। তার হিসাব আছে? তার উপর ধরো আরো দুয়েকটা যদি বাচ্চা-কাচ্চা হয়, তাইলে কিন্তু ভাগিদার আরো বাড়ব।

এতদিনে এই কথা একবারও চিন্তা করেনি মনির। সে আব্দুল ফকিরের কথা শুনে মোটামুটি হতবুদ্ধ হয়ে রইল।

আব্দুল ফকির বললেন, খা সাব মুরুব্বি মানুষ, তার উপরে কথা বলন মানায় না। কিন্তু এইটা তিনি কি করলেন? ওই বউরে থাকতে দিলেন গ্রামে? তারপর আবার ঘর তুইল্যাও দিলেন? কি আশয়-বিষয় কিছুই জানি না। তয় খা সাব যে তোমারে খুব একটা পছন্দ করতেন না, তা তো আগে থেইকাই জানি। কে জানে, কার মনে কি! নাইলে, যে খাঁ বংশ নিয়া এত ভাবনা-চিন্তা করত, সে এই বিয়া মাইন্যা নিলো? ভিতরে ভিতরে কি আছে, কে জানে! আমি তো আর ভিতরের লোক না। তয় ঘটনা যে কিছু আছে, তা তো শুনছিই। শুনছি ফজুর গয়নার কলসও নাকি খাঁ-বাড়িতে!

মনিরের চোখ যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসলো। সে উত্তেজিত গলায় বলল, কি!

আব্দুল ফকির বললেন, তোমার দাদাজানে আমারে নিজ মুখে বলছেন! যা-ই করো মনির, চোউখ কান খোলা রাইখা কইরো।

মনির আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। সেই মুহূর্তে সে ফতেহপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।

.

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর শরীর যথেষ্ট খারাপ। তিনি শুয়ে আছেন তার ঘরে। তার সামনে বসে আছে ফজু আর তার ভাই নজু। তাদের কাছে জমিজমার নানা কাগজপত্র। দুইজন সাক্ষিও আছে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ দুই দিক থেকে চল্লিশ বিঘা জমি লিখে দিচ্ছেন ফজু আর নজুকে। তাকে দলিল পড়ে শোনাচ্ছেন গেসুদ্দিন আমিন। ইউনিয়ন পরিষদের তহশিলদারও রয়েছেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ডান হাত পুরোপুরি না হলেও মোটামুটি অকেজো হয়ে পড়েছে। তারপরও সেই হাতেই কোনোমতে টিপসইয়ের ব্যবস্থা করা হলো। টিপসই দেয়া শেষে আমোদি বেগম শাড়ির আঁচলে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর হাতের কালি মুছে দিলেন। কলসির গয়নার বিষয়ে এখনও কিছু সিদ্ধান্ত হয়নি। অবশ্য সকলের সামনে সেটি আলোচনার বিষয়ও না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ চিন্তা করছেন, অন্যান্যদের বিদায় দিয়ে তিনি, ফজুরা দুই ভাই, আর আমোদি বেগম মিলে গয়নার বিষয়ে কথা বলবেন। এই গয়না একসাথে বিক্রি করা কিংবা ঘরে রাখা উভয়ই যথেষ্টই। বিপজ্জনক কাজ। সুতরাং আর কি উপায় বের করা যায়, সেটি ভাবতে হবে। কিন্তু তাদের ভাবনা ভাবার সুযোগ হলো না। মনির ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল। তার সাথে সেই তাগড়া জোয়ান দুজন যুবক। তারা মনিরের সাথে ঘরে ঢুকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। আজ তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সাথে মনিরের বিস্তর বোঝাঁপড়া আছে! কিন্তু ঘরে ঢুকেই মনির থমকে গেল। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সামনে ফজু আর নজুকে দলিল পর্চা হাতে বসে থাকতে দেখে মনিরের মাথায় হঠাৎ রক্ত উঠে গেল।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বিছানায় শুয়ে শুয়ে মনিরের উন্মত্ত হয়ে ওঠা দেখলেন। বারকয়েক তার অসুস্থ ক্ষয়িষ্ণু কণ্ঠের ডাকে তিনি মনিরকে থামাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। মনির আর তার সাথের যুবক দুজন মিলে ফজু আর নজুকে ভয়ঙ্করভাবে পেটাল। তাদের যখন খাঁ-বাড়ি থেকে বের করা হলো, তখন দুজনেরই মৃতপ্রায় অবস্থা। তাদের সাথে থাকা সকল কাগজপত্র রেখে দেয়া হয়েছে। মনির অবশ্য এতেই ক্ষান্ত হলো না। সে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সামনে এসে চিৎকার করে বলল, সিন্দুক আলমারির চাবি চাইছিলাম, সেইগুলান কই? এক্ষণ সেই চাবি দিবেন। এক্ষণ।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এই প্রথম মনিরকে দেখে আতঙ্কিত বোধ করলেন। তার মনে হলো, তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে মনির না। একে তিনি আগে কখনো দেখেননি। এমন কারো কথা তিনি কখনো চিন্তাও করেননি। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হঠাৎ তীব্র আতঙ্কবোধ করতে লাগলেন। তার মনে হলো তিনি এতদিন তার কোলের ভেতর দুধ কলা দিয়ে একটি ফণা লুকিয়ে রাখা গোখরা সাপ পুষেছিলেন। তিনি খুব করে চেয়েছিলেন, এই সাপটা একদিন ফণা তুলুক। সে ফণা তুলে ছোবল মারতে শুরু করুক অন্যদের। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। সেই সাপটা আজ ফণা তুলেছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সাপটা ফণা তুলে আছে তারই দিকে। এখন কেবল ছোবল মারার অপেক্ষা!

লতার মন খারাপ। পারুল আর রাজীবের কত আগে থেকে তার সাথে আশিকের সম্পর্ক। অথচ পারুলের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার বিয়ের কোনো। খবর নেই। এই নিয়ে আশিকের সাথে আজ তুমুল ঝগড়া হয়েছে তার। আশিক এবার এসেছে প্রায় মাস দেড়েক পরে। কী সব কাজে ব্যস্ত ছিল সে। কিন্তু আসার পর থেকেই লতার ঝগড়া। আশিক অবশ্য নানাভাবেই লতার অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু কাজ হয়নি। প্রতিবার এই সময়টা তারা লঞ্চের কেবিনে একান্ত সময় কাটায়। কিন্তু আজ অভিমানী লতা তার হাতটা অবধি ধরতে দেয়নি আশিককে। সে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আর কিছু হবে না। হাত ধরাও না। আশিক শেষমেষ বিয়ে নিয়ে গুরুতর আলোচনা করার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু লতা তাতে সাড়া দেয়নি। তার এক কথা, বিয়ে নিয়ে সরাসরি কথা বলতে হবে দুই পরিবারে। সে আর পরীক্ষা অবধি অপেক্ষা করতে পারবে না। এত পড়াশোনার দরকার নেই তার। সে বিয়ে করবে, রান্নাবান্না করবে। বাচ্চা-কাচ্চার মা হয়ে ঘর-সংসার সামলাবে। এতেই সে খুশি। আশিক দীর্ঘ সময় চেষ্টা করেও যখন লতাকে বোঝাতে পারল না, তখন সেও দূরে গিয়ে একা একা বসে রইল। সেই নদীর পারে। যেখানে বসতো পারুল আর রাজীব। কিন্তু আজ যেন ঠিকানা বদল হয়েছে। লতার আশিকের জন্য যে মায়া হচ্ছে না, তা না। বেচারা একা একা মন খারাপ করে বসে আছে। অথচ প্রতিবার তার বুকের ভেতর ঢুকে বেড়ালের বাচ্চার মতো ওম খোঁজে সে। কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা করেছে, বিয়ের বিষয়ে কিছু চূড়ান্ত না হওয়া অবধি সে আর আশিকের কাছে যাবে না। লতা জানে আশিক তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। তাকে ছাড়া একমুহূর্তও সে থাকতে পারবে না। কিন্তু কেমন ছন্নছাড়া আর আলসে ধরনের ছেলে সে। কোনোকিছুতেই যেন গা নেই তার। লতা এবার এই আলসেমিটা ছাড়াবেই।

আশিকের কষ্ট হচ্ছে এটা লতা বোঝে। কিন্তু তারও কি কম কষ্ট হচ্ছে? কিন্তু এই কষ্টটা সে করতে চায়। তাদের ভালোর জন্যই করতে চায়। আশিককে। একটা ধাক্কা দেয়া জরুরি। যখন মানুষ হাতের নাগালে সবকিছু পেয়ে যায়, তখন তার মূল্যটা সে বোঝে না। লতা চায়, আশিক এটা বুঝুক।

আশিক আর রাজীব চলে যেতে লতা আর পারুলের আবার রাতভর গল্প। লতার মন ভীষণ খারাপ হলেও একটা বিষয় নিয়ে সে খুব উত্তেজিত। পারুল আজ প্রথম প্রায় সারাটা দিন রাজীবের সাথে একা একা কেবিনে আটকে ছিল। তাদের মধ্যে কি হয়েছে, কে জানে! লতা চোখ নাচিয়ে বলল, দেখিস, আবার প্রথম বারেই প্যাট বাধাইয়া ফেলাইস না।

পারুল প্রথমে লতার কথা বুঝতে পারল না। সে বলল, মানে? পেট বাধাইয়া ফেলাইবে মানে কি? প্যাট বাধাইব কেমনে?

লতা পারুলের গাল টেনে ধরে বলল, এহ! আমার কচি খুকি। নাক টিপলে যেন দুধ বাইর হইব। সারাদিন কি করছ? সাধু সাইজো না আমার ধারে বুঝছ?

পারুল যেন লতার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল। সে মুখ ঝামটা মেরে বলল, সবাইরে কি আশিক ভাই আর তুই পাইছস? সবাই তোগো মতো হইলে বাংলাদেশে আর মানুষজনে আটাইত না। পোলাপানে ভইরা যাইত।

লতা বলল, হু। কত ধোয়া তুলসি পাতা, দেখা যাইব নে!

পারুল বলল, ধোয়া তুলসি পাতা তো আর বলি নাই। শখ আহ্লাদ তো আমারো কিছু আছে না? তয় আফসোস, এমন এক ভ্যান্দা পোলারে জুটাই দিছস, ক কইলে কলিকাতা না বুইঝা, বোঝে কলম। কবে যে একটু কলিকাতা বুঝব!

লতা বলল, খুব না!

পারুল মুখ গম্ভীর করে বলল, কপাল বুঝছস। এই কপালে শখ আহ্লাদ বলতে কিছু নাই। আল্লায় কপালে একটা জামাই দিছে। তাও দেখি বোরকা পরইন্যা পুরুষ। মাইয়া মাইনষেরতন লজ্জা শরম বেশি।

লতা বলল, হ। কেমন লজ্জা বোঝন যাইব। বিয়ার বছর না ঘুরতেই দেহন যাইব গণ্ডায় গণ্ডায় পোলাপান। পারলে বছরে দুইবার বিয়ানোর ব্যবস্থা করে!

পারুল হাতের উল্টো পিঠে লতার মাথায় চাটি মেরে বলল, তোর মুখ যা হইছে না!

লতা বলল, হা। এহন তো আমার মুখ খারাপই হইব। সুখের দিনে আর দুখের বন্ধুরে মনে থাহে না। এইটাই জগতের নিয়ম।

এই কথায় পারুলের ভারি মন খারাপ হলো। সে লতাকে বুকের ভেতর টেনে নিয়ে বলল, তোর কি আশিক ভাইয়ের লগে ঝগড়া হইছে?

লতা কোনো কথা বলল না। তবে হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সে। আশিকের জন্য তার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট। আশিককে সে অনেকবার ফোন করেছে। কিন্তু আশিক রাগ করে ফোন বন্ধ করে রেখেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে কেউ একজন তার বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। আশিকের গলা না শোনা অবধি এই পাথর তার বুকের উপর থেকে সরবে না। পরেরবার আশিক এলে সে সারাটাদিন আশিককে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখবে। সারা রাত লতা ঘুমাল না। আশিক ফোন খুলল পরদিন দুপুরে। ফোন খুলতেই লতা ফোন করল। আশিক হ্যালো বলতেই লতা আর কিছু বলতে পারল না। তার মনে হলো সে বছরের পর বছর আশিকের গলা শুনতে পায়নি। সে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। আশিক কেবল ফিসফিস করে বলল, লতা, তুমি কি একটু চোখ বন্ধ করবে?

লতা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, উমম।

আশিক বলল, তুমি কি এবার একটু আমার কাছে আসবে?

লতা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, উমমম।

আশিক বলল, তুমি আমার কাছে আসো। আমার বুকের ভেতর। আমি তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখছি।

লতা আবার কাঁদল। হাউমাউ করে কাঁদল। সেই কান্নার জলে তার বুকের উপর চেপে বসে থাকা শক্ত পাথরটা ক্রমশই গলে যেতে থাকল।

লতা প্রবল প্রতীক্ষায় তাকিয়ে রইল পরের সপ্তাহের জন্য। আশিককে দেখামাত্র সে চিৎকার করে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরবে। তারপর পাগলের মতো চুমু খাবে তাকে। সে বাকি দু’দিন সারাটক্ষণ এই নিয়েই যেন ভাবল। কিন্তু লতার ভাগ্য খারাপ। পরের সপ্তায়ও আশিক আসতে পারল না। তার মায়ের বাইপাস সার্জারি হবে। গুরুতর অপারেশন। জীবন-মরণ সমস্যা। বন্ধুর মায়ের এমন গুরুতর অপারেশন রেখে আসতে পারল না রাজীবও। লতা সারারাত জায়নামাজে বসে মোনাজাতে কাঁদল। কাঁদল পারুলও। কিন্তু এই দুজনেরই মোনাজাতে একটা অদ্ভুত কথাই মনে হলো, তারা যতটা না আশিকের মায়ের সুস্থতার জন্য উদগ্রিব। তার চেয়েও বেশি উদগ্রিব তাদের মানুষ দুজনকে দেখার জন্য, কাছে পাওয়ার জন্য। আশিকের মা যত তাড়াতাড়ি সুস্থ হবেন, তত তাড়াতাড়িই তারা তাদের প্রিয়তম মানুষ দুজনকে কাছে পাবে! কিন্তু ভয়াবহ দুঃসংবাদটা এলো তিনদিন পর। আশিকের মা মারা গেছেন। লাশ নিয়ে যেতে হয়েছে আশিকের গ্রামের বাড়িতে। আশিক পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। সে খায় না, ঘুমায় না। ফোন ধরে না। কারো সাথে কথা বলে না। এই ভয়াবহ দুঃসময়ে আশিকের কাছে থাকতে যে কী ইচ্ছে করছে লতার। কিন্তু কীভাবে থাকবে সে! তার কেবল মনে হয়, সে কিছু পারে না। সে পারে শুধু একা একা কাঁদতে, আর আশিকের সাথে ঝগড়া করতে। এই ভেবে লতার কান্না আরো। বাড়ে। কষ্ট আরো বাড়ে। তেষ্টা আরো বাড়ে। পরের সপ্তায় এলো রাজীব একা। লতার সাথে তার কথা বেশি হলো না। সেদিন লতার মামার বাসা ফাঁকা ছিল বলে রাজীব আর পারুল সারাদিন সে বাসায়ই থাকল। দিনভর দরজা আটকে তাদের বিয়ের নানান পরিকল্পনা হলো। রাজীবের বাবা আর সপ্তাখানেকের মধ্যেই দেশে ফিরবেন। তারা পারুলকে দেখতে গ্রামে আসলে পারুল কীভাবে কথা বলবে, কীভাবে তাদের সম্ভাষণ জানাবে, এমন কত কত বিষয়ে যে তারা কথা বলল তার হিসেব নেই।

রাজীব চলে গেলেও পারুলের ঘোর যেন কাটে না। তাকে রাজীব ছাড়া আর কিছু স্পর্শ করতে পারে না। লতা যে সারাটাক্ষণ মন খারাপ করে থাকে। কেঁদে কেটে যে সে তার চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে, তাও যেন পারুলকে স্পর্শ করে না। সে বুঁদ হয়ে আছে অন্য এক স্বপ্নের জগতে।

.

পরদিন দুপুরে বাড়ি ফিরল পারুল। তাবারনের জ্বর। সারাক্ষণ সে তার ঘর থেকে বের হলো না। পারুলও অবশ্য ডাকল না। এই বাড়ি ঘর, এই মানুষজন কোনো কিছুর প্রতিই তার আর কোনো মায়া নেই। সে এখান থেকে একবার যেতে পারলেই বাঁচে। কিন্তু প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় পারুলের। তার মনে হয় সে তাবারনের গোঙানির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু আবারো সেই ঘৃণ্য, জঘন্য দৃশ্য দেখতে হবার আশঙ্কায় সে চুপ করে পড়ে থাকে। থাকুক আব্দুল ফকির তার ওই জঘন্য জীবন নিয়ে। পারুল আর এসব নিয়ে ভাবতে চায় না। সে দূরে চলে যাবে। বহুদূরে।

আবার গরম পড়তে শুরু করে দিয়েছে। মার্চ মাস চলেও এসেছে। সেদিন দুপুর বেলা খানিকটা তন্দ্রামতো এসেছিল পারুলের। এই সময়ে দরজায় কারো ধাক্কার শব্দে পারুলের ঘুম ভেঙে গেল। সে ঘুম জড়ানো গলায় বলল, কে?

দরজার ওপাশ থেকে তাবারনের গলা শোনা গেল। সে ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, আমি তাবারন।

পারুল দরজাটা খুলল। তাবারন দাঁড়িয়ে ছিল দরজায় হেলান দিয়ে। পারুল দরজা খুলতেই সে শেকড়কাটা গাছের মতো পারুলের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল। তারপর ভয়ার্ত গলায় কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, পারুল গো, আমি পাপ করছি গো পারুল। ও পারুল, আমি পাপ করছি। আমি বুঝি নাই পারুল। ইবলিশ শয়তান আমার চৌক্ষে ঠুলি পরাই রাখছিল গো পারুল। আমি তোমার মায়ের খাওনে বিষ মিশাই দিছিলাম গো পারুল। ও পারুল, এইটা আমি ইচ্ছা কইরা করিনাই গো পারুল। ও পারুল, তোমার বাপ, তোমার বাপ একটা জানোয়ার গো পারুল। সে একটা জানোয়ার। সেই আমারে বলছে, আমি যদি তোমার মায়ের খাওনে বিষ না মিশাই, তাইলে সে আমারে বাইর কইরা দিবো গো পারুল। ও পারুল। পারুল গো।

তাবারন সুর করে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই সুর করে কথা বলছে সে। পারুল কিছু বলল না। সে যেমন দাঁড়িয়ে ছিল, তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। সে অনেক কিছুই সে আন্দাজ করেছিল। কিন্তু বিশ্বাস করতে চায়নি। তার মনে হচ্ছিল, সে হয়তো কোথাও ভুল কিছু ভাবছে। তাবারন দুই হাতে পারুলের পা জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছে। পারুল হঠাৎ তাবারনের হাত ধরে তাকে দাঁড় করাল। তাবারনের গা অসম্ভব গরম। জ্বর এসেছে বোধ হয়। পারুল তাকে বিছানায় নিয়ে বসাল। তারপর বলল, কি হইছে বলেন?

তাবারন শঙ্কিত চোখে এদিক-সেদিক তাকাল। তারপর বলল, সে মানুষ। সে জানোয়ার। সে মানুষের চেহারার ইবলিশ শয়তান পারুল। আমার জীবনটা সে শ্যাষ করছে পারুল। আরো কত জনের জীবন যে সে শ্যাষ করছে। এই সব কথা তোমার মায় জানত। সে সব জানত। তুমি দেখবা পারুল? তুমি দেখবা?

এই বলে তাবারন তার পরনের শাড়ি টেনে খুলে ফেলল। তাবারনের তল পেটে তখনও দগদগে ঘা। তার উরুতেও শুকনো ক্ষত। বুকে পোড়া দাগ ছাড়াও আরো কত কত ক্ষত যে রয়েছে!

পারুল আতঙ্কিত গলায় বলল, এইগুলান কি?

তাবারন বলল, এইগুলান তোমার বাপে করছে পারুল। আমার কেউ নাই। ছোটবেলা থেইকা এই বাড়িতে আছিলাম। সে আমারে একদিন রাইতে জোর কইরা…

তাবারন কথা শেষ করতে পারল না। কান্নায় তার গলা জড়িয়ে এলো। পারুল এক হাতে তাবারনের হাত চেপে ধরল। তাবারন বলল, তারপর থেইকা প্রত্যেকটা দিন। সুযোগ পাইলেই। আর পেট নষ্ট করনের লইগা এইটা সেইটা খাওয়াইত। কি কি যে খাওয়াইছে পারুল! একদিন তোমার মায়ও দেইখ্যা ফালাইলো। তারে তো আরো আগেই পাগল বানাই থুইছিল। সেইদিনের পর থেইক্যা তার উপরও শুরু হইল গজব। শরীলে ব্যথা দিয়া সে মজা পায় পারুল। সে মানুষ না, মানুষ না। আল্লাগো, কি যে তইজ্যাগুলান সে দিছে। পারুল। এহন আর আমারে ভালো লাগে না। বান্দা নতুন মাগী লাগব। এইজইন্য আমারে খেদাইতে চায় পারুল। আমি কই যামু? আমার তো যাওনের কোনো জায়গা নাই গো মা…

পারুলের সারা শরীর কাঁপছে। সে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, তারে এতদিনেও খুন করেন নাই কেন?

তাবারন বলল, তার মইধ্যে কি জানি আছে পারুল। তারে ডর লাগে। কি আছে জানি না, তয় আছে। ডরে পরান কাঁপে পারুল।

তাবারন সামান্য থেমে আবারো সতর্ক চোখে এদিক-সেদিক তাকাল। তারপর বলল, ক্যান তুমি শোনো নাই? ফতেহপুরের তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তারে খুন করতে নিছিল। একবার না, দুইবার। সেই দুইবারই কেমনে কেমনে বাঁইচা গেছিল! তারে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কেন খুন করতে আইছিল, এই কথা তো কেউ জানে না। জানত তোমার মায়। সে মাঝে-মধ্যে কী সব খাইয়া অচেতন হইয়া যায়, তহন নানান কথা কইয়া দেয়। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মাইয়া কোহিনূররেও সাপে কামড়াইছিল। সেই বিষ নামাইতে গিয়া সে কোহিনূররেও…। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এই কথা তো কাউর ধারে কইতে পারে নাই। অন্য উছলায় তারে মারতে আইছিল। আর মাইয়ারে বিয়া দিয়া দ্যাশছাড়া করছিল… সেই কোহিনূরের পোলাই তো আইছিল আমাগো বাড়ি। কেন আইছিল কে জানে!

পারুল ঝট করে তাবারনের মুখের দিকে তাকাল। আর সাথে সাথে নয়নের মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। অনেকক্ষণ যেন নয়ন তার চোখের সামনে ভেসে রইল। একের পর এক ছবি। সেই প্রথম দিন দেখা হবার পর থেকে ভয়াবহ অসুস্থ অবস্থায় চলে যাওয়ার দিন অবধি। প্রত্যেকটা মুহূর্ত। হঠাৎ করেই কি এক তীব্র অপরাধবোধ পারুলকে জেঁকে ধরল। কী তীব্র লজ্জা, গ্লানি, কষ্ট, অপমান, বিষাদ, ক্রোধ, শূন্যতা, সকল কিছু মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গেল। নয়নের সেই উন্মাতাল চোহারা, ক্লান্ত চোখ, ভেঙে পড়া গাল, কান্না মাখা কথা, তার কোথাও না কোথাও কি সেই তিক্ষ্ণ সত্যটাই ছিল? আসলেই কি সেটি সত্যি?

এই প্রথম পারুলের মনে হলো, না হয়েই পারে না। না হলে অমন করে সে কেন এখানে ছুটে আসবে! পারুলের হঠাৎ নয়নের জন্য এত মায়া হতে লাগল, এত মায়া! তার কান্না পেয়ে গেল। মনে হলো নয়নকে যদি আরেকবার সে পেত, তবে আদরে আদরে ভরিয়ে দিত। ওই নিষ্পাপ মুখ, কেমন শিশুর মতো সহজ, সরল হাসি। কিন্তু সেই মুখের প্রতিটি রেখা জুড়ে ক্লান্তি, কান্না, ক্রোধ। এই প্রথম, পারুল তার জীবনে একটা বিশেষ অনুভূতি টের পেল। সেই অনুভূতির নাম ভালোবাসা। তবে এই ভালোবাসা আর সকল ভালোবাসার মতো নয়। এই ভালোবাসা ভাইয়ের জন্য মমতায় আর্দ্র হয়ে নিজের অজান্তেই চোখের জলে গাল ভিজিয়ে ফেলা অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকা এক বোনের ভালোবাসা।

*

আসলাম সাহেব তার লালমাটিয়ার বাসায় এসেছেন। এসেছে হেমাও। দুজন দীর্ঘ সময় মুখোমুখি বসে আছে। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছে না। নীরবতা ভাঙল হেমার ফোনের রিংটোন। কিন্তু সে ফোনটা ধরল না। কেটে দিলো। আবার বাজল। আবার কেটে দিলো। আসলাম সাহেব বললেন, এখানে সমস্যা হলে বারান্দায় গিয়ে কথা বলে আয়।

হেমা বলল, আমার এমন কোনো গোপন ফোন নেই বাবা, যা তোমার সামনে বসে ধরতে পারব না।

আসলাম সাহেব বললেন, না না। আমি তা মিন করিনি। সবারই কিছু প্রাইভেসি থাকে। থাকা উচিত।

হেমা বলল,সে আমি জানি বাবা।

আসলাম সাহেব বললেন, নয়নের খবর কি?

হেমা স্বাভাবিক গলায় বলল, কোনো খবর নেই বাবা।

আসলাম সাহেব বললেন, কেন, ঝগড়া হয়েছে?

হেমা বলল, বাদ দাও না বাবা!

আসলাম সাহেব বললেন, নয়নকে কিন্তু আমার বেশ পছন্দ।

হেমা বলল, তুমি আমায় কেন আসতে বলেছ বাবা? সেটা বলো প্লিজ।

আসলাম সাহেব খানিক চুপ করে থেকে বললেন, তোর মার সাথে থাকতে সমস্যা হচ্ছে না?

হেমা বলল, আমার কোনো কিছুতেই সমস্যা হয় না বাবা।

আসলাম সাহেব বললেন, সমস্যা হয় না? স্বীকার করিস না। মানিয়ে যাস?

হেমা বলল, হয়তো মানিয়েই যাই। যদি মানিয়ে না নেয়া যায়, তবে ঠিকঠাক থাকা মুশকিল। এখানে টিকে থাকতে হলে মানিয়ে নিতেই হয়। কারো কম, কারো বেশি।

আসলাম সাহেব বললেন, এইজন্যই বোধহয় তোর মা আর আমার সম্পর্কটা টিকল না। কিন্তু মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা তো আমি কম করিনি।

হেমা বলল, এই টপিকটা থাকুক বাবা?

আসলাম সাহেব বললেন, সরি। তোর খুব কষ্ট হয় তাই না? বন্ধুরা এটা সেটা বলে? তখন খুব খারাপ লাগে।

হেমা বলল, আমাকে নিয়ে কে কি বলল, তা নিয়ে আমি ভাবি না বাবা।

আসলাম সাহেব বললেন, একটা সময় ভাবতাম তুই আমার মতো হয়েছিল। কিন্তু আজকাল আমার মনে হয়, না, তুই হয়েছিস তোর মার মতো।

হেমা বলল, এটা কেন মনে হলো বাবা?

আসলাম সাহেব বললেন, এই যে সবকিছুই খুব নিয়ন্ত্রিত। একটা কন্ট্রোল থাকে নিজের উপর।

হেমা হাসল। বলল, একটা কথা বলি বাবা?

আসলাম সাহেব মাথা নাড়ালেন। হেমা বলল, ধরো প্রচণ্ড কষ্টে কারো চোখে পানি আসছে না। তার মানে কি সে কাঁদছে না? এমনও তো হতে পারে, যতটা কষ্টে মানুষ চোখে পানি এনে কাঁদে। তার কষ্ট তার চেয়েও বেশি। এইজন্য কান্নাটা হয়তো আর বের হতে পারে না। ধরো বরফের মতো। পানি জমে যেমন বরফ হয়ে যায়। হয়তো কষ্টটা এত বেশি যে কান্না জমে বরফের মতো হয়ে যায়। চোখ গলে আর বেরিয়ে আসতে পারে না।

আসলাম সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কথা বললেন না। হেমা বলল, তুমি বিয়ে করছ কবে বাবা?

আসলাম সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, দেখি।

হেমা বলল, বিয়ের কোনো প্রোগ্রাম হবে? মানে এই বয়সে এসে ঘটা করে তো কিছু হয় না। তা যেভাবেই করো, হবে তো?

আসলাম সাহেব বললেন, এগুলো নিয়ে কথা বলতে তোর খারাপ লাগছে।?

হেমা সামান্য চুপ করে রইল। তারপর বলল, হ্যাঁ, বাবা। লাগছে।

আসলাম সাহেব বললেন, তাহলে? বলছিস কেন?

হেমা বলল, তোমাকে ইজি করার জন্য। আমার জন্য ডিসিশন নিতে তোমার যেন কোনো দ্বিধা না হয়। আমার কারণে কখনো যেন মনে না হয়, এত বড় একটা মেয়ে আছে, এটা করা কি ঠিক হবে? ওটা করা কি ঠিক হবে? এই জন্য বাবা। আমি চাই না, আমার কারণে কোনোভাবেই তোমাদের ব্যক্তিগত জীবনের কোনো সিদ্ধান্ত, কোনো আনন্দে বাধাগ্রস্ত হোক। সো, আমি চাই বিষয়গুলো নিয়ে তুমি আমার সাথে সহজ থাকো।

আসলাম সাহেব বললন, তোকে আমি এমন করে আগে কখনো দেখিনি। আজকাল তোকে যত দেখছি, আমার মধ্যে দুটি জিনিস ঘটছে। খুব অবাক লাগছে আর খুব অপরাধবোধ হচ্ছে।

হেমা বলল, অপরাধবোধ কেন হচ্ছে বাবা?

আসলাম সাহেব বললেন, এই যে আমাদের ভালো থাকা নিয়ে, কমফোর্ট জোন নিয়ে তুই কত কনসার্ন। অথচ আমরা কেউ একবারও তোর কথা ভাবলাম না!

হেমা বলল, আমি ভালো আছি বাবা। আর একটা কথা, তোমার বিয়েতে কিন্তু আমি আসব। সেজেগুজেই আসব। নতুন মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলব। শি ইজ প্রিটি।

আসলাম সাহেব কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, তোর মা কষ্ট পাবে না?

হেমা বলল, তুমি বিয়ে করছ বলে? নাকি আমি তোমার বিয়েতে গিয়ে নাচব, গাইব, আনন্দ করব বলে?

আসলাম সাহেব এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। তিনি চুপ করে রইলেন। হেমা বলল, বাবা, আমাকে ডেট জানিও। ইউনিভার্সিটি থেকে একটা ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ কনফারেন্সে এটেন্ড করবার সুযোগ এসেছে। প্রথমে দিল্লি, তারপর কাঠমান্ডু। প্রায় সপ্তাহ দুয়েকের ট্যুর।

আসলাম সাহেব বললেন, গরম পড়ে যাচ্ছে তো।

হেমা বলল, সমস্যা হবে না বাবা।

তারপর দুজন চুপ। অনেকক্ষণ। হেমা হঠাৎ বলল, তুমি আর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছ না, তাই না বাবা? আমাকে এমনি এমনি ডেকে এনেছ কেন বলল তো? আমি উঠি?

আসলাম সাহেব বললেন, আরেকটু বস।

হেমা বসল। আসলাম সাহেব বললেন, আমি ভাবছি এই বাসাটায় আমি আর উঠব না। এটা এমন ফাঁকাই থাকবে।

হেমা হেসে বলল, কেন মায়ের স্মৃতিতে মেমোরিয়াল বানাবে?

আসলাম সাহেব বললেন, আমার ভালো লাগবে না। চোখের সামনে এতটা বছর একটা চেনা দৃশ্য। একেকটা চেনা দিন। সেখানে নতুন কোনো অচেনা দৃশ্য আমার ভালো লাগবে না।

হেমা বলল, অচেনাই তো চেনা হয় বাবা।

আসলাম সাহেব বললেন, কিন্তু আগের চেনাটা হারালে কষ্টও তো হয়।

হেমা বলল, ওই কষ্টটাই মায়া বাবা। ওটা আছে বলেই তো মানুষ বাঁচে। হলে দেখতে সব মানুষ কবে দলবল বেঁধে সুইসাইড করে ফেলেছে!

আসলাম সাহেব বললেন, কিন্তু মায়াতে তো কষ্ট।

হেমা বলল, মানুষ তো কষ্টটাই চায় বাবা। সে ভান করে সে আনন্দ চায়। কিন্তু আসলে সে চায় কষ্ট। কারণ সে জানে, তার কষ্ট তাকে আনন্দের উপলক্ষ দেবে। কাছের মানুষটা এসে হাত ধরবে। মন ভালো করবার চেষ্টা করবে। এক্সট্রা কেয়ার করবে। মানুষ এটা খুব চায় বাবা। কিন্তু যে মানুষ সব সময় আনন্দে থাকে সে এটা পায় না। মায়ার যে কষ্ট, তাও এর সাথেই থাকে। প্রিয় মানুষের মন খারাপ হলে, কষ্ট হলে যে মানুষটা এগিয়ে আসে, সে তো ওই মায়া থেকেই আসে।

আসলাম সাহেব বললেন, তোর মায়ের কি আমার জন্য মায়া হয়?

হেমা বলল, যে মায়া নিয়ে দ্বিধা থাকে, সংশয় থাকে, সে মায়া নিয়ে ভেবো না বাবা। ওইরকম মায়ার কথা ভাবলে যে কষ্ট, তা কাটাতে পারবে না। সব সময় কেবল অপূর্ণ মনে হবে। তার চেয়ে অপেক্ষায় না থেকে যেটুকু নগদ, আনডাউটেড পাচ্ছ, সেটুকু নিয়ে নাও।

আসলাম সাহেব বললেন, তুই এত কিছু কি করে বুঝিস? এমন চমৎকার করে গুছিয়ে বলা কোথায় শিখলি?

হেমা বলল, জীবন থেকে বাবা।

আসলাম সাহেব বললেন, তোর জীবন কি আমার চেয়ে বড়?

হেমা বলল, সময়ের বিবেচনায় জীবন বড় হয় না বাবা। বড় হয় বোধের বিবেচনায়। কে কতুটুকু বুঝল, অনুভব করল, কীভাবে করল তার উপর।

আসলাম সাহেব বললেন, তুই কি জানিস, আমি যখন কোনো বিপদে পড়ি, আমার যখন মন খারাপ হয়, কোনো সমস্যা যায়, যখন মনে হয় কারো সাথে কথা বললে আমার মন ভালো হয়ে যাবে, সে আমার সমস্যাগুলোর সমাধান করে দিবে, তখন আমার একমাত্র যে মানুষটার কথা মনে হয়, সেই মানুষটা তুই? তোর ভেতর একটা মা মা ব্যাপার আছে। মনে হয় তোর কাছে এলেই শান্তি। একটা আশ্রয়, ছায়া।

হেমা বলল, কেউ যদি এই শান্তি, ছায়া, আশ্রয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চায় বাবা?

আসলাম সাহেব বললেন, তাহলে সে হয়তো এই ছায়াটাকে ঠিকভাবে বুঝতেই পারেনি। অথবা তার কষ্টটা হয়তো এতই বেশি যে এই ছায়ায় সে কষ্টটা সারাতে পারছে না। শান্তি পাচ্ছে না।

হেমা হাসল, বলল, তাহলে কি লাভ হলো বাবা? তুমি যদি তোমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকেই ছায়া দিতে না পারো, তাহলে পুরো পৃথিবীকে ছায়ায় ঢেকে কি লাভ?

আসলাম সাহেব উঠে এসে হেমার পাশে দাঁড়ালেন। তারপর হেমার মাথায় আলতো করে হাত রেখে বললেন, প্রত্যেকটা মানুষের কিছু গোপন কষ্ট থাকে আমি জানিরে মা। সেগুলো জানতে চাওয়াও অন্যায়। কিন্তু তুই কি নিয়ে এমন কষ্ট পাচ্ছিস, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে রে মা!

হেমা উঠে দাঁড়াল। তারপর বাবার হাতখানা ধরে ফিসফিস করে বলল, বাবা, যে মানুষ নিজের কষ্ট গোপন করতে পারে না, সে বড় দুর্বল মানুষ বাবা। আমি দুর্বল মানুষ হতে চাই না।

হেমা আর কিছু বলল না। দাঁড়ালও না। আসলাম সাহেব কিছু বলতে গিয়েও আর বললেন না। ইচ্ছেটাকে দমালেন। কিছু কিছু সময় থাকে ইচ্ছের রাশ টানার। এই মুহূর্তটুকু তেমন।

হেমা সারাটাদিন এখানে-সেখানে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াল। বাসায় ফিরল সন্ধ্যার পর। রেণুর সাথে টুকটাক কথা হলো। কিন্তু ভালো লাগছিল না কিছুই। এই ভালো না লাগাটাকে পাত্তা দিতে চায় না হেমা। কিন্তু ভালো না লাগার। অনুভূতিগুলো সব সময়ই ভালো লাগার অনুভূতিগুলোর চেয়ে শক্তিশালী। ভালো লাগার অনুভূতিকে যত সহজে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলা যায়, তত সহজে ভালো না লাগার অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। হেমা ঘর অন্ধকার করে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। এই সময় রাহাতের ফোন আসলো। ফোন ধরতেই রাহাত বলল, ঝটপট দুটা প্রশ্নের উত্তর দে তো!

হেমার ভালো লাগছিল না কথা বলতে। তারপরও বলল, হা বল।

রাহাত বলল, যতটা সম্ভব চেষ্টা করার পরও ভালো থাকতে না পারলে কি করা উচিত?

হেমা বলল, কি হয়েছে?

রাহাত বলল, আমি ভালো নেই। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। অ্যান্ড দিস উজ টোটালি ইলজিক্যাল। মানে ধর বিষয়টা এমন না যে আমি তোকে চাই। বরং আমি তোকে চাই না। কিন্তু সব সময় একটা ভয়াবহ কষ্ট। অভ্যাসের মতো হয়ে গেছে। কষ্ট পাওয়ার অভ্যাস। নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা ইতর শ্রেণির প্রাণী আমি।

হেমা বলল, এই যে বললি না, আমাকে তুই চাস না। এই কথাটা সত্যি। এটা আমিও জানি। কিন্তু তোর এই কষ্ট পাওয়াটা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। ধর তোর সাথে আমার কোনো একটা সম্পর্ক হয়ে গেল, দেখবি এর। চেয়ে খারাপ ঘটনা আর হতে পারে না। তখন মনে হবে এখনই ভালো ছিলাম। ইশ, যদি আবার এখানে ফিরে আসতে পারতাম! এটা অনেকটা অবসেশনের মতো।

রাহাত বলল, আমি জানি। আমি টের পাই। নিজে নিজে ভাবি, ধর তোর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল বা প্রেম। চিন্তা করলেই আমার কেমন অস্বস্তি হয়। মনে হয় আমাদের মধ্যে তখন খুব বিব্রতকর একটা সম্পর্ক হবে। কাছে গিয়ে দূরত্বটা বাড়বে।

হেমা মৃদু হাসল। বলল, একদম ঠিক। ওভাবে কাছে গেলে দূরত্বটা বাড়বে। কিছু কিছু সম্পর্ক আলাদা রাহাত। সেটা আমরা ঠিকঠাক বুঝতে পারি না। যেহেতু এই বয়সের একটা ছেলে আর মেয়ের সম্পর্কের ম্যাক্সিমাম ইনটেনসিটি ওই প্রেম অবধি। সেজন্য আমরা যখন কেউ কাউকে প্রচণ্ড রকম মিস করি, ফিল করি, কেয়ার করি, তখন খুব সহজেই ভেবেই নেই যে, উই আর ইন লাভ। এটা এত বেশি প্রচলিত এবং সাধারণ একটা ভাবনা যে এর বাইরে গিয়ে কিছু চিন্তা করতে পারি না আমরা।

রাহাত বলল, কিন্তু তোর কি এতদিন এমন মনে হয়েছে?

হেমা বলল, না। মনে হয়নি। আমি তো আর সবার থেকে আলাদা নই। আমারো মনে হতো, আমি তোকে কষ্ট দিচ্ছি। একটা গিল্টি ফিলিংও কাজ করে। কিন্তু এইমাত্র তুই যখন বললি, তখন আমারও মনে হলো, আমরা যদি কখনো কাপল হই, বা ধর তুই আর আমি বিয়ে-টিয়ে করে ফেললাম। এই পর্যন্ত ভাবা সম্ভব। তারপর আর না। উই আর হাজবেন্ড অ্যান্ড ওয়াইফ! দ্যাট উইল বি দ্য মোস্ট টেরিবল থিং ক্যান হ্যাঁপেন। আমার এখন সত্যি মনে হচ্ছে, এখন যতটা কাছে আছি আমরা, তার চেয়ে হাজার হাজার গুন দূরে সরে যাব তখন।

রাহাত সাথে সাথে কথা বলল না। চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, অনুভূতিগুলো এমন অদ্ভুত কেন বল তো?

হেমা বলল, অনুভূতি অদ্ভুত না। অনুভূতি হয়তো ঠিকই আছে। আমরা বুঝতে ভুল করি। হয়তো যার বন্ধু বা অন্য কিছু হবার কথা ছিল, কিন্তু তাকে প্রেমিক ভেবে ফেলি। যার প্রেমিক হবার কথা তাকে বন্ধু বা ভাইয়া ভেবে ফেলি। মানে হয় কি, ধর কারো প্রতি কোনো একটা ফিলিং গ্রো করল। আমরা সাথে সাথে তড়িঘড়ি করে তার একটা শেপ দিয়ে ফেলি। ভাবার সময় নেই না। অস্থির হয়ে যাই সেটাকে ডিফাইন করতে। আর একবার ডিফাইন করে ফেলার পর ওই ভাবনা থেকে আর বের হওয়া যায় না। একদম বিয়ে-টিয়ে করে ফেলার পর গিয়ে মনে হয়, আরে, ধুর! এটা কি করলাম!

রাহাত বলল, এই যে এতক্ষণ এত কথা বললাম কেন জানিস?

হেমা বলল, কেন?

রাহাত বলল, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জানি এতে অপরাধবোধে ভোগার কিছু নেই। কিন্তু তারপরও লাগছে। এইজন্য এসব বলে সিদ্ধান্তটাকে লেজিটিমাইট করার চেষ্টা।

হেমা বলল, কি সিদ্ধান্ত?

রাহাত বলল, আমি দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি।

হেমার চমকানোর কথা ছিল কিনা হেমা জানে না। তবে সে চমকালো না। সে স্বাভাবিক গলায় বলল, কবে?

রাহাত বলল, নেক্সট উইকেই।

হেমা বলল, এত তাড়াতাড়ি?

রাহাত বলল, হু। একটা ভালো স্টাডি অপরচুনিটি আছে কানাডায়। ঘোট মামা থাকেন ওখানে। হুটহাট ডিসিশন। মাসখানেক ধরেই প্রসেস চলছিল। বাট আই ওয়াজ কনফিউজড।

হেমা বলল, নাও ইটস ফাইনাল?

রাহাত বলল, অলমোস্ট ফাইনাল।

হেমা বলল, তুই কি বিয়ে-টিয়ে করে যাচ্ছিস?

রাহাত চমকালো। বলল, তুই! মানে, এখনো তো বাসায় ছাড়া আর কেউ জানে না!

হেমা বলল, না না। আমাকে কেউ কিছু বলেনি। আন্দাজ করলাম।

রাহাত বলল, কীভাবে?

হেমা বলল, এমন হয়। এসব সিচুয়েশনে এমন হয়। করা সম্ভব, এমন অনেকগুলো সিদ্ধান্ত একসাথে নিয়ে নেয় মানুষ। একটা বড়োসড়ো চেঞ্জ নিয়ে আসার চেষ্টা। অনেকদিনের নিয়ম, অভ্যাসকে এলোমেলো করে দেয়ার চেষ্টা।

রাহাত বলল, আমি কি ভুল করছি হেমা?

হেমা বলল, অন্য কেউ হলে হয়তো বলতাম ভুল। কিন্তু তোর ক্ষেত্রে কেন যেন মনে হচ্ছে ঠিক।

রাহাত বলল, কেন?

হেমা বলল, তুই অনেকটা কেন্দ্রীভূত মানুষ। তোর সব সময় একটা কেন্দ্র দরকার। পৃথিবী উল্টে গেলেও তুই সহজে সেই কেন্দ্র থেকে সরবি না। আবার। কোনোভাবে কেন্দ্রটা বদলাতে পারলে দেখবি, নতুন কেন্দ্রটাতেও তুই ঠিক আগের মতোই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়বি। কনসাল্টেড হয়ে পড়বি। আমার মনে হয়, এটা তোর জন্য ভালো।

রাহাত চুপ করে রইল। হেমাও। তারপর হেমার হঠাৎ মনে হলো, এই পরিস্থিতিতে তার চুপ করে থাকা ভালো দেখায় না। সে কথা বলল, মেয়েটাকে কি আমি চিনি?

রাহাত বলল, হুম।

হেমা বলল, কে?

রাহাত বলল, গেজ কর?

হেমা খানিক ভাবল। তারপর বলল, বোটানির সেই মেয়েটা? ওই যে কবিতা পড়ে ভালো? কি যেন নাম! ওহ, শিউলী?

রাহাত বিস্মিত গলায় বলল, তুই কি বল তো! কেমনে পারিস?

হেমা হাসল, তুই না আমাকে নিয়ে হেমার মনস্তত্ব নামে বই লিখে ফেলবি বলেছিলি? এখন তো উল্টোটা হওয়া উচিত। তোকে নিয়ে আমি বই লিখে ফেলতে পারি।

রাহাত এ প্রসঙ্গে কোনো কথা বলল না। সে বলল অন্য প্রসঙ্গে, একটা কথা বলবি?

হেমা বলল, হুম। বলব।

রাহাত বলল, তুই কি করবি ভাবছিস? মানে নয়ন ভাই…।

হেমা হাসল। বলল, আমি ভালো থাকব রাহাত। পৃথিবীতে মানুষ যা কিছু করে সবই ভালো থাকতে। কে কার সাথে থাকল, কীভাবে থাকল এটা আসলে গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ ভালো থাকা। আমি ভালো আছি।

কথা আর বেশি এগুলো না। রাহাত চলে গেল পরের শনিবার। অদ্ভুত ব্যাপার হলো রাহাত চলে যাবার পরের কয়েকটা দিন হেমার খুবই শূন্য লাগতে লাগল। মনে হতে লাগল এই শহরটা যে কী ভীষণ ফাঁকা। যেন কেউ নেই এখানে। হেমা শক্ত মনের মানুষ। সম্পর্ক, অনুভূতি নিয়ে তার ভাবনাগুলোও। বেশ গোছানো। কিন্তু তারপরও রাহাত চলে যেতে তার ভীষণ একা লাগতে লাগল। মনে হতে লাগল, রাতদুপুরে মন খারাপ হলে কথা বলার আর কেউ রইল না। যখন ইচ্ছে তখন ফোন করার কেউ রইল না। আরো কতকিছুর যে কেউ একজন রইল না! রাহাতের উপস্থিতি তার জীবনে এত সরব ছিল যে, তার না থাকাটা তাই প্রবল হয়ে উঠল।

এই প্রথম হেমার মনে হলো, রোজকার অভ্যাসের মতো যে আছে, থাকে, তার সেই থাকাটা উপলদ্ধি করতে হলেও অনিবার্য হয়ে ওঠে হঠাৎ তার না থাকাটা। কী অদ্ভুত!

.

সে রাতে হেমা রেণুর কাছে ঘুমাল। রেণু দিন দিন কেমন যেন আরো গম্ভীর হয়ে উঠেছেন। অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হন না। কথা বলেন না। একই ফ্লাটের দুইটি ঘরে দু’জন প্রাণী। অথচ মনে হয় যেন যোজন যোজন দূরত্বে তাদের বসবাস। হেমা মাঝরাতে হঠাৎ রেণুকে ডাকল, মা।

রেণু সাথে সাথে জবাব দিলেন, হু।

হেমা বলল, কি ভাবছ বলো তো?

রেণু বললেন, কিছু ভাবছি না তো!

হেমা বলল, ভাবছ। এই মাঝরাতে কিছু না ভেবে কেউ একা একা চুপিচুপি শুয়ে জেগে থাকতে পারে না।

রেণু কথা বললেন না। হেমা বলল, তোমার খুব একলা লাগে তাই না মা?

রেণু বললেন, মানুষ তো একাই।

হেমা বলল, না মা। মানুষ দুই ধরনের। এক ধরনের মানুষ হাজার মানুষের ভালোবাসা পেয়েও, সঙ্গ পেয়েও এক ধরনের কাল্পনিক একাকীত্বে ভোগে। নিজেকে একলা ভেবে ভেবে দুঃখ বিলাস করে। এটার ভেতরও এক ধরনের আনন্দ আছে। আরেক ধরনের মানুষ আছে সত্যি সত্যিই একা।

রেণু কথা বললেন না। হেমা হঠাৎ গাঢ় গলায় বলল, আমার খুব একলা লাগে মা। খুব।

হেমার গলায় যেন কি ছিল! এমন করে হেমাকে কখনো কথা বলতে দেখেননি রেণু। তিনি অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে হেমার মাথাটা কাছে টানলেন। তারপর তার মাথার চুলে ধীরে বিলি কেটে দিতে লাগলেন। হেমা ফিসফিস করে বলল, আমার খুব কষ্ট হয় মা। আমি কাউকে বলি না। নিজেকেও না। আমি বলতে চাই না। কিন্তু আমার খুব কষ্ট হয়। আমার মনে হয় আমি সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে একটা বিশাল খোলা মাঠে একা দাঁড়িয়ে আছি। আমার চোখ যতদূরে যায়, শূন্য, ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। কোথাও না। আমার তখন খুব ভয় হয় মা।

রেণু মেয়ের মাথাটা নিজের গালের সাথে চেপে ধরেন। কেউ আর কোনো কথা বলে না। অন্ধকারে কেটে যায় নৈঃশব্দ্যের অনন্ত প্রহর। কিংবা ভিজে যায়।

*

শেষরাতের দিকে খিচুনির মতো উঠেছিল তৈয়ব উদ্দিন খাঁর। তারপর বুকের বাঁ দিকে প্রচণ্ড ব্যথা। তিনি দম নিতে পারছিলেন না। কাউকে ডাকতে পারছিলেন না। আমোদি বেগম কয়েকদিন থেকে তার সাথেই থাকছেন। কিন্তু আমোদি বেগমের নিজের শরীরটাও ভালো না। সারারাত জেগে জেগে ভোররাতের দিকে চোখের পাতাটা খানিক লেগে এসেছিল তার। আর সেইসময়ই এই ঘটনা। ভোরে ঘুম ভেঙে আমোদি বেগম দেখেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ঘুমাচ্ছেন। বার দুই ডাকলেন। কিন্তু সাড়া দিলেন না। ধীরে নিঃশ্বাস বইছে তার। উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন নিজের শরীরটাও প্রচণ্ড দুর্বল লাগছে। চোখে ঝাপসা দেখছেন। মাথা ঘোরাচ্ছে। তারপরও অনেক কষ্টে উঠে হাতমুখ ধুলেন আমোদি বেগম। কিন্তু ঘরে ঢোকার মুখে উঠানেই হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন তিনি। সেই যে নিজের ঘরের বিছানায় গিয়ে পড়লেন, সারাদিন আর বিছানা থেকে উঠতে পারলেন না। শুয়ে শুয়েই আমোদি বেগমের মনে হলো বাড়িটা বড় বেশি সুনসান। কোথাও কোনো লোকজন নেই। নিস্তেজ গলায় বারকয়েক একে ওকে ডাকলেনও। কিন্তু কেউ কোনো সাড়াশব্দ করল না। খানিকটা রোদ চড়তে ছোট ছেলে দবির খাঁকে চোখে পড়ল আমোদি বেগমের। তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির লোকজন সব কই?

দবির খাঁ বললেন, ফরাজি গো বাড়িতে কারে নাকি জ্বীনে ধরছে। আব্দুল ফইর গেছে সেই জ্বিন ছাড়াইতে। সবাই জ্বিন ছাড়ানি দেখতে গেছে।

আমোদি বেগম বললেন, এই জইন্য বাড়ি ঘর এমনে কবরস্থান বানাই রাইখা সবাইর যাইতে হইব?

দবির খা কোনো কথা বললেন না। আমোদি বেগম হঠাৎ বললেন, তোর বউরে একটু ডাইক্যা লইয়ায়। গিয়া বল আমি আসতে বলছি। তোর বাপের শরীল খুব খারাপ। কথা বলতেও পারে না। কিছু খায়ও নাই। তারে একটু নাওয়ান দিতে হইব। কাপড়-চোপড়গুলান বদলাইতে হইব। ঘরটাও পরিষ্কার করতে হইব। যা ডাইক্যা লইয়ায়।

দবির খাঁ বললেন, কোনো অসুবিধা হইত না তো?

আমোদি বেগম বললেন, না। হইত না। তুই যা।

দবির খ বললেন, আব্বায় যদি তার হাতের কিছু না নেয়?

আমোদি বেগম বললেন, তার এহন সেই অবস্থা নাই। বিপদে পড়লে বাঘেও ঘাস খায়।

বিপদে পড়লে বাঘ ঘাস খেলেও তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ঘোট পুত্রবধুকে তার ঘরেই ঢুকতে দিলেন না। দবির খাঁ বললেন, আব্বা, আপনের দিকে এহন আর কারও কোনো খেয়াল নাই। এস্কান্দারও বাড়িতে নাই। তারে মনির জানি কই পাঠাইছে। আপনে যে বেয়ান হইতে কিছু খান নাই এই নিয়াও কারো কোনো মাথাব্যথা নাই। আপনের রাইত-বিরাইতে ঘরে পায়খানা-প্রসাব করছেন। গন্ধ ছোটতেছে। সে আইসা ঘরদোর পরিষ্কার কইরা, আপনেরে একটু নাওয়াই ধোয়াই দেউক আব্বা। সে ছোটলোকের মাইয়া। এইসবে তার কোনো সমস্যা নাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কথা বলতে পারছেন না। তার শরীর কাঁপছে। কিন্তু তার মধ্যেও তিনি যতটা সম্ভব হম্বিতম্বি করে উঠলেন। বললেন, ওই মাইয়া জানি আমার ঘরে ঢোকে না। ওরে খাঁ-বাড়ি ঢোকতে দিছে কেডা? অরে এক্ষণ খা বাড়িরতন বাইর কর। এক্ষণ।

দবির উদ্দিন খাঁ আরো কি যেন বলতে গেলেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ধমকে উঠে বললেন, ওই মাইয়া যদি আমার ঘরে ঢোকে, আর আমার শরীলে হাত দেয়, আমি অক্ষণ মরব। আমারে বিষ আইন্যা দে, আমি বিষ খাইয়া মরব। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এতা পইচ্যা গেছে যে তার ঘরে মেথর ঢুকব? মেথরের হাতের রান্ধন-বাড়ন খাইয়া তৈয়ব উদ্দিন খাঁর বাইচ্যা থাকন লাগব! তার আগে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নিজে জীবন নিজে দিব।

দবির খা আর কথা বললেন না। কথা বললেন না তৈয়ব উদ্দিন খাঁও। রাগে তার সারা শরীর কাঁপছে। সেই সারাটাদিন তেমনই শুয়ে রইলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। কথা নেই, শব্দ নেই, যেন নিসাড় এক মৃত মানুষ। বিকেলের দিকে খানিকটা সুস্থ বোধ করলেন আমোদি বেগম। তিনি ঘরে ঢুকতেই তৈয়ব উদ্দিন খাঁ করুণ গলায় বললেন, আমারে একটু কিছু খাইতে দিবা বউ? প্যাটে বড় খিদা।

আমোদি বেগম তাকে সামান্য কিছু খাবার দিলেন। খাবার দিতে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, মনির কি বলছে কিছু শুনছেন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কি বলছে?

আমোদি বেগম বললেন, আপনের এই ঘরখান খালি কইরা দিতে বলছে। আপনেরে নিয়া রাখতে বলছে উত্তরের ছোট্ট ঘরে। এই ঘরখান সবচাইতে বড়। সে নাকি বিয়া করব। এইজন্য ঘর এইখান সাজাইতে গোজাইতে হইব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কথাটা শুনলেন। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। আমোদি বেগম বললেন, আপনের জইন্য যহন তহন কামের মানুষগোও আইতে নাকি মানা কইরা দিছে।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এবারও কথা বললেন না। তবে সেদিনের মতো মৃদু হাসলেন। কিন্তু তার চোখে পানি। দৃষ্টি শূন্যে। তিনি হঠাৎ বললেন, সে ঠিকই করতেছে। এইটা পাওন আমার দরকার আছিল। তুমি বট গাছ লাগাইলে ছায়া পাইবা, আমগাছ লাগাইলে ফল পাইবা, খাজুর গাছ আর মান্দার গাছ লাগাইলে পাইবা কাঁটা। এইটাই নিয়ম। সাপ পুষলে চুমা পাইবা না, সাপে আদর কইরা চুমা দিলেও সেইটা হইয়া যায় ছোবল। আমি তারে বানাইছি, পুষছি। যেমন বানাইছি, তেমন ফল পাইতেছি।

আমোদি বেগম বললেন, সে আমারে বলছে, আপনেরতন চাবিগুলান নিয়া দিতে। কলসির কথাও জিগাইছে।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কলসি কই রাখছ?

আমোদি বেগম কথা বললেন না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আমারে এহনও অবিশ্বাস করো বউ?

আমোদি বেগম বললেন, না। অবিশ্বাস করি না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তাইলে?

আমোদি বেগম বললেন, কিছু কথা আছে, অবিশ্বাসের লইগ্যা না, অন্য কারণে বলন যায় না। কিন্তু সেই কারণটা বললেও সমস্যা। সময় হইলে আমিই আপনেরে বলব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অতি কষ্টে হাসলেন। তারপর বললেন, আমার আর সময় হইব না বউ। সময় শ্যাষ।

তিনি একটু থামলেন। তারপর বললেন, শেষবার আরেকবার কোহিনূররে খবর পাঠাইবা বউ? একটা বার? আমি যদি মইরা যাই, তাও কি সে দেখতে আসব না?

আমোদি বেগম বললেন, খবর পাঠাইলে নজরুলরে দিয়া পাঠাইতে হইব। সময় লাগব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হায় সময়। সময়।

এই কথা ক’টিই তৈয়ব উদ্দিন খাঁর শেষ কথা। সেই রাতে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর গুরুতর স্ট্রোক হলো। স্ট্রোকে তার শরীরের ডানপাশটা পুরোপুরি নির্জীব হয়ে গেল। তার মুখ বাঁকা হয়ে গেল বীভৎসভাবে। প্রায় পুরোপুরিই রহিত হয়ে গেল তার বাশক্তি অনেক চেষ্টায় বিকৃত শব্দ বের হলেও তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল। এই নিয়ে অবশ্য বাড়ির কারো মধ্যেই তেমন কোনো হইচই দেখা গেল না। আমোদি বেগম বহুকষ্টে একবার এসে দেখে গেছেন। তার শরীরও সংকটাপন্ন। তিনি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতেই পারছেন না।

সেদিন সন্ধ্যায়ই তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে উত্তর দিকে ছোট ঘরখানায় স্থানান্তর করা হলো। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মস্তিষ্ক সচল। তিনি সকলই দেখতে পারছেন, বুঝতে পারছেন। কিন্তু কেবল কথা বলতে পারছেন না। তার সচল চেতনা যেন তাকে বারবার বলছে, মরে যাও তৈয়ব উদ্দিন খাঁ, মরে যাও। যদ্রুত সম্ভব মরে যাও। তোমার সামনে ভয়াবহ সময়। এই ভয়াবহ সময় থেকে তোমাকে একমাত্র যে বাঁচাতে পারে, তার নাম মৃত্যু। মৃত্যু ছাড়া আর কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। তুমি মরে যাও। এখন মৃত্যুর চেয়ে প্রিয় আর কিছু তোমার নেই।

সমস্যা হচ্ছে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ চাইলেও এখন মরতে পারবেন না। নিজেকে হনন করবার ক্ষমতাটুকুও তার নেই। তাকে বেঁচে থাকতে হবে স্বাভাবিক মৃত্যুর আগ অবধি। সেই মৃত্যু কতদূর কে জানে! সারাটা জীবন কত কত চাওয়ার পিছে পাগলের মতো হন্যে হয়ে ঘুরে ফেরা তৈয়ব উদ্দিন খাঁর এখন একটা মাত্র চাওয়া। সেই চাওয়ার নাম মৃত্যু। তার জীবনের পরম প্রার্থিত চাওয়া। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর হঠাৎ মনে হলো, এই জীবনে তিনি যত যা কিছু চেয়েছেন, যা কিছু পেয়েছেন, তার সকল কিছুর বিনিময়েও যদি সম্ভব হতো, তবে তিনি কেবল মৃত্যুই চাইতেন। এই জীবনে তার কাছে মৃত্যুর চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই নেই। কিছু না। এক জনমের সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম অলঙ্ঘনীয় সত্যের নাম মৃত্যু। অথচ সেই ভয়ঙ্কর সত্যিটি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি প্রার্থিতও।

কারণ মৃত্যুবিহীন মানবজনম অর্থহীন।

.

মনিরকে চাবি বুঝিয়ে দিয়েছেন আমোদি বেগম। কিন্তু এখনো কলসির খোঁজ সে পায়নি। বারকয়েক এসে তৈয়ব উদ্দিনের সাথে কলসির খোঁজে কথা বলার চেষ্টা করেছে মনির। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ চেষ্টা করেও কথা বলতে পারেননি। মনিরের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। তার ধারণা, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বোবার ভান ধরে বসে আছেন। সে নানাভাবে কথা বলানোর চেষ্টা করেও পারেনি। সন্ধ্যাবেলা তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে দেখতে এলেন আব্দুল ফকির। আব্দুল ফকিরকে খবর দিয়ে এনেছে মনির। তার ধারণা তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কাছ থেকে যদি কেউ এই খবর বের করতে পারে, তবে তিনি একমাত্র আব্দুল ফকির।

বাড়ির সকলেই মনিরের ভয়ে তটস্থ। এমনকি তার বাবা খবির খাঁও আজকাল মনিরের সামনে কথা বলতে ভয় পান। তরপরও আব্দুল ফকিরকে বাড়িতে দেখে তিনি মনিরের কাছে ঘটনা জানতে চাইলেন। মনির অবশ্য খবির খাঁকে খুব একটা গুরুত্ব দিলো না। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল যে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর চিকিৎসা করতেই এসেছেন আব্দুল ফকির। সন্ধ্যার পরে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ঘরে ঢুকলেন আব্দুল ফকির। তিনি ঢুকলেন একা। ঢুকেই ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিলেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মাথার কাছে একটা হারিকেন জ্বলছে। আব্দুল ফকির গিয়ে হারিকেনের আলো খানিক বাড়িয়ে দিলেন। তারপর বললেন, আস্সালামু আলাইকুম খাঁ সাব। ভালো আছেন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ফ্যালফ্যাল করে আব্দুল ফকিরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু কোনো কথা বললেন না। আব্দুল ফকির বললেন, খা সাব। শরীল কেমন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আব্দুল ফকিরের দিকে তাকিয়ে বার কয় কথা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার মুখ থেকে কেবল অর্থহীন শব্দছাড়া আর কিছুই বের হলো না। আব্দুল ফকির মমতামাখা গলায় বললেন, কথা কইতে কষ্ট হইতেছে খাঁ সাব? আহারে, এই বয়সে আইসা আল্লাহপাক এই বুড়া মানুষটারে এত কষ্ট দিতেছেন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ একদৃষ্টিতে আব্দুল ফকিরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আব্দুল ফকির তার একটা হাত রাখলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মাথায়। তারপর খুব আদুরে ভঙ্গিতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, খা সাব। আপনে ওই দিন আমার এক গালে থাপ্পড় মারছিলেন। এক গালে থাপ্পড় মারা অলক্ষণ। আপনে জানেন, আমার মেয়ে-ছেলে নিয়া কারবার। এই ঘটনায় একবার থাপ্পড় মারাটা বিরাট অলক্ষণ। আপনে কি আমার আরেক গালে আরেক খান থাপ্পড় মারবেন?

এই প্রথম তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ভয় পেলেন। তীব্র ভয়। তার চোখে-মুখে সেই ভয় ফুটে উঠল। আব্দুল ফকির বললেন, ডর লাগতেছে খাঁ সাব? ডর লাগতেছে কেন? আপনের এহন আর ডরের কি আছে? যহন ডর পাইলে কামে লাগত, তহন তো ডর পাইলেন না। তহন তো খুব সাহস দেহাইলেন। আব্দুল ফইররে আপনে চেনেন নাই খাঁ সাব?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বারকয়েক ঝাটকা মেরে তার মাথা থেকে আব্দুল ফকিরের হাত সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। আব্দুল ফকির বললেন, আপনে আমারে আরেকখান থাপ্পড় মারবেন খাঁ সাব?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ডান হাতখানা ধরে নিজের গালের সাথে ঘসতে লাগলেন আব্দুল ফকির। তার চোখ যেন সাপের চোখের মতো ঠান্ডা। গলার স্বর ক্রমশই সাপের মতো হিশহিশে হয়ে যাচ্ছে। তিনি বললেন, আর গয়নার কলসিখান কই খাঁ সাব? এইটা তো আপনেরে বলতেই হইব। এইটা না বইলা আপনেরে তো আব্দুল ফইর মরতেও দিব না খাঁ সাব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ক্রমাগত মুখে নানান ধরনের বিকৃত শব্দ করতে লাগলেন। তিনি আব্দুল ফকিরের হাতের নাগাল থেকে দূরে সরে যেতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। তার মুখ একদিকে বাঁকা হয়ে গেছে। মুখের কোল গড়িয়ে লালা ঝড়ছে। আব্দুল ফকির বললেন, মুখোন এমনে ব্যাকা হইয়া গ্যাছে খাঁ সাব? চিন্তা নিয়েন না। আব্দুল ফইর থাকতে চিন্তা কইরেন না। খাড়ান ঠিক কইরা দিতেছি।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মুখের বাঁকা হয়ে যাওয়া অংশে আব্দুল ফকির হঠাৎ সপাটে থাপ্পড় বসালেন। পরপর দুইবার। তারপর বললেন, এইবার কথা বলেন। খ সাব। এইবার কথা বলেন।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর চোখের কোল গড়িয়ে পানি পড়ছে। তার মুখের কোল গড়িয়ে লালা ঝড়ছে। আব্দুল ফকির তার পকেট থেকে লোহার খুব ছোট্ট একখানা পেরেক বের করলেন। তারপর বললেন, কলসির কথাটা কন না খা সাব। না হইলে ইশারায় জানান। জানান না খাঁ সাব? কলসি কই?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ স্থির শুয়ে রইলেন। নিথর, নিস্পলক। আব্দুল ফকির বললেন, আপনে কথা বলতে পারবেন খাঁ সাব। একটু চেষ্টা করলেই আপনে কথা বলতে পারবেন। কলসের কথাটা জানন খুব দরকার খাঁ সাব। মনির খা বাড়িতে কলস খুঁইজ্যা ফাতাফাতা কইরা ফালাইছে। কিন্তু কোথাও নাই। একটু ইশারায় হইলেও বলেন খাঁ সাব?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ যেমন ছিলেন, তেমনই তাকিয়ে রইলেন। আব্দুল ফকির হঠাৎ বললেন জিব্বায় সাড় পান না খাঁ সাব? জিব্বায় বোধ নাই? লড়ে চড়ে না? খাড়ান, সব ঠিক হইয়া যাইব, ব্যবস্থা নিতেছি।

হারিকেনর চিমনি তুলে দিয়ে পেরেকের আগার দিকটা কিছুক্ষণ আগুনে পুড়লেন আব্দুল ফকির। তারপর সেই গরম পেরেকখানা চেপে ধরলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁর জিভে। অসহ্য যন্ত্রণায় তৈয়ব উদ্দিন খাঁ চিৎকার করে উঠলেন। তার মুখ থেকে জান্তব স্বর বেরিয়ে এলো। সেই স্বর শুনে ছুটে এলেন খবির খাঁ, দবির খাঁ, মনির, মনিরের সাথের দুজন যুবকসহ আরো অনেকেই। আব্দুল ফকির গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। তারপর গম্ভীর মুখে বললেন, পেরেশানির কিছু নাই। এই পেরেক পুইড়া, দোয়া পইড়া ফুঁ দিয়া জিব্বায় ছ্যাঁক দিলাম। আইজ একবার দিলাম। দেখলাম অনেকটাই সাড় আইছে জিব্বায়। আর কয়েকদিন রেগুলার দিতে পারলেই আল্লাহর ইচ্ছা অল্পবিস্তর হইলেও জবান ফিরা আইব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার পুত্রদের দিকে তাকিয়ে বীভৎস শব্দে আর্তনাদ করতে লাগলেন। একটা ছোট্ট অবোধ শিশুর মতো ভীত-সন্ত্রস্ত কণ্ঠে অনুনয় করতে লাগলেন। কিন্তু তার সেই আর্তনাদে কেউই সাড়া দিলো না। আব্দুল ফকিরউঠে দাঁড়ালেন। তারপর আবারো হাত বোলালেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মাথায়, মুখে, গলায়। তারপর খানিক ঝুঁকে তার কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন, আল্লাহর উপর ভরসা রাহেন খাঁ সাব। আমি আর কি? সামান্য উছিলা মাত্র। সব ঠিক হইয়া যাইব খাঁ সাব।

আব্দুল ফকির খাঁ-বাড়ি থেকে বের হলেন গভীর রাতে। তার সাথে জুলফিকারও এসেছে। তবে জুলফিকারকে তিনি কী এক কাজে পাঠিয়েছেন ফজু ব্যাপারীর বাড়ি। খাঁ-বাড়ি থেকে বের হবার আগে মনির তাকে রাতের খাবার। খাওয়ালো। বহুদিন হয় মনির তার মাছ ধরার নেশার কথা বলতে গেলে ভুলেই। গেছে। নানান ব্যস্ততায় আর আগের মতো সময় হয় না তার। আজ যেন আবার। সেই মাছ ধরার কথা মনে পড়েছে মনিরের। সুযোগ বুঝে আব্দুল ফকিরের কাছ থেকে এই সংক্রান্ত নানান বুদ্ধি পরামর্শও নিলো সে। খাঁ-বাড়ি থেকে বের হয়ে আব্দুল ফকির পায়ে হেঁটে যাবেন নদীর ঘাটে। সেখানে নৌকা রাখা আছে। শীতকাল প্রায় শেষ হয়ে এলেও এখনও খালে-বিলে পানি বাড়তে শুরু করেনি। জুলফিকার কি ফজুর বাড়ি থেকে নদীর ঘাটে চলে গেছে? আব্দুল ফকির কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবলেন। তারপর নদীর ঘাটের দিকেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তার গায়ে একখানা চাদর। কিন্তু মিনিট দশেক হাঁটতেই গরম লাগতে লাগল। সলিমুদ্দি দফাদারের পরিত্যক্ত বাড়ির কাছাকাছি এসে গা থেকে। চাদরখানা খুলে ফেললেন আব্দুল ফকির। অন্ধকারে খানিক দাঁড়িয়ে চাদরটা ভাঁজ করে গলার দু’পাশে ঝুলিয়ে দিয়ে আবার যেই হাঁটার জন্য পা ফেলেছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে তার ঠিক সামনেই ভূতের মতো উদয় হলো একটি ছায়ামূর্তি। আব্দুল ফকির কিছু বলার আগেই ছায়ামূর্তিটি তার চাদরের দু’পাশের দু’প্রান্ত ধরে তাকে হ্যাঁচকা টানে শুইয়ে ফেলল মাটিতে। তারপর চাদর ধরে টেনে নিয়ে গেল রাস্তার পাশে সলিমুদ্দি দফাদারের ভেতর বাড়ির বাড়ির উঠানে। আব্দুল ফকিরের গলায় প্রায় ফাঁস আটকে রয়েছে চাদরখানা। চোখে যেন সর্ষে ফুল দেখছেন তিনি। ছায়ামূর্তিটি আব্দুল ফকিরকে ভেতর বাড়ির জংলা উঠানে নিয়ে ফেললেন। চাদরটা একটু শিথিল হতেই আব্দুল ফকির বুক ভরে দম নিলেন। তারপর বললেন, কেডা আপনে? কেডা?

আব্দুল ফকির আরো কিছু বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বলতে পারলেন না। তার আগেই সশব্দে, সপাটে এক থাপ্পড় পড়ল তার গালে। তিনি ছোটখাট হালকা পাতলা মানুষ। থাপ্পড় খেয়ে ছিটকে পড়লেন বাঁ পাশে। ছায়ামূর্তিটি এবার আব্দুল ফকিরকে চিৎ করে মাটিতে শোয়ালো। তারপর তার বুকের উপর। চেপে বসে চাদরের অনেকটা অংশ ঢুকিয়ে দিলো আব্দুল ফকিরের মুখে। আব্দুল ফকির হাত-পা ছুঁড়ে নানান কিছু বলতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। ছায়ামূর্তিটি এবার এক হাতে আব্দুল ফকিরের মাথা ঠেসে ধরল মাটিতে। আরেক হাতে আব্দুল ফকিরের থুতনির দাঁড়ি থেকে একগোছা দাঁড়ি মুঠো করে ধরে হ্যাঁচকা টানে তুলে ফেলল। তার শরীরে যেন অসুরের শক্তি। আব্দুল ফকির সর্বশক্তিতে চিৎকার করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। ছায়ামূর্তিটি অন্ধকারেই হাতে উঠে আসা মুঠোভর্তি দাড়িগুলো দেখল। তারপর আবার একগোছা দাড়ি ধরে টান মারল। আবারো উঠে এলো একগোছা দাড়ি। দাড়ির উঠে আসা ক্ষতস্থান থেকে দরদর করে রক্ত বের হচ্ছে। ছায়ামূর্তিটি এরপর আব্দুল ফকিরকে টেনে উঠে দাঁড় করাল। তারপর বলল, ডরায়েন না ফইর সাব। আমি জ্বিন ভূত কিছু না। আমি এস্কান্দার। আমি নিজেই জ্বিন ভূত খুব ডর পাই। দেখলাম আপনে হাচাই জ্বিন ভূতের কারবার করেননি। আমার বুদ্ধিসুদ্ধি একটু কম। এইজন্য পরীক্ষা কইরা দেখলাম, ঘটনা হাচানি? আর দাদাজান শ্যাষ কয়দিনে আমারে কয়টা মাডার করনের সুযোগ দিছিল। হাতটা এইজইন্য খালি নিশপিশ করতেছে। তয় ভাবতেছি এহনই আর মাডার করব না। মাডার করব আরো পরে। মাডার করনের আগে এমনে টাইন্যা টাইন্যা আপনের শরীলের সব লোম পরিষ্কার করব ফইর সাব। আমি বলদ মানুষ। বুদ্ধিসুদ্ধি কম। আমার কথায় বেয়াদবি নিয়েন না। দাদাজানের কষ্ট আমি দেখতে পারি না ফইর সাব। খালি কান্দন আহে ফইর সাব। খালি কান্দন আহে।

এস্কান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। সে আব্দুল ফকিরকে ছেড়ে দিয়েছে। আব্দুল ফকির ধীর পায়ে খানিক পিছিয়ে ঘুরে রাস্তার দিকে হাঁটা দিলেন। তারপর আর পেছন ফিরে তাকলেন না। রাস্তা অবধি স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই হেঁটে গেলেন আব্দুল ফকির। তার মুখের নিচের দিকটা ভয়ানকভাবে ছিলে দগদগে ঘা হয়ে আছে। আব্দুল ফকির ভেবে পাচ্ছেন না, কাল সকালে তিনি লোকজনকে মুখ দেখাবেন কি করে! এই মুহূর্তে তিনি শুনলেন, এস্কান্দার তাকে ডাকছে। সে ডাকতে ডাকতে বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে। আব্দুল ফকির আর কোনো দিকে তাকালেন না। তিনি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলেন নদীর ঘাটের দিকে।

এস্কান্দার অন্ধকারে তাকিয়ে আছে। তার চোখজোড়া যেন ভাটার আগুনের মতো জ্বলছে। গত কিছুদিন থেকেই খুনের নেশা চেপেছে তার। খুন করার জন্য সারাক্ষণ হাত-পা নিশপিশ করতে থাকে। এই এখনো করছে। এস্কান্দারের ধারণা খুন একটা নেশার মতো, একবার করলে বারবার করতে ইচ্ছে হয়। খুন করার সময় মানুষের চোখে যে ভয় ফুটে ওঠে, তা দেখতেও তার ভারি ভালো লাগে। এই মুহূর্তে এস্কান্দারের শরীরটা যেন খুন করার নেশায় আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে। একটা প্রবল আক্রোশে তার মাথা ক্রমশই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। নৃশংস খুনের তেষ্টায় এস্কান্দারের শরীরের প্রতিটি স্নায়ু যেন সরব হয়ে উঠছে। সে দৌড়ে রাস্তায় উঠে এলো। রাগে, ক্রোধে, জিঘাংসায় টগবগ করে ফুটতে থাকা এস্কান্দার হঠাৎ আবিষ্কার করল তার চোখ বেয়ে অঝরে নেমে যাচ্ছে অশ্রুধারা। কী অদ্ভুত! সে কাঁদছে কেন? তৈয়ব উদ্দিন খাঁর জন্য? এস্কান্দার তার চোখের সামনে থেকে একমুহূর্তের জন্যও তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মুখখানা সরাতে পারছে না। এই মানুষটাকে সে তার নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তার এমন অসহায় মুখ আর সহ্য করতে পারছে না সে। এস্কান্দারের কেবল খুন করতে ইচ্ছে করছে, খুন। সেই রাতের ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে চোখের কোলে একই সাথে জিঘাংসার আগুন আর ভালোবাসা কান্না নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল এস্কান্দার। এই নিকষ কালো অন্ধকার যেন সাক্ষী! সে যেন জানে, কী অদ্ভুত এই মানব মন, কারো জন্য খুনের ক্রোধে কেঁপে ওঠা বুকের ভেতর ঠিক সেই মুহূর্তেই আবার কারো জন্য যত্ন করে পুষে রাখে প্রবল মমতায় মাখামাখি অঝর কান্না।

*

বিষয়টা বুঝতে সময় লেগেছে লতার। তবে ঘটনাটা এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। বিশ্বাস হচ্ছে না পারুলেরও। এবং পারুল বিশ্বাস করছেও না। তার বিশ্বাস তারা ভুল বুঝছে। লতারও অবশ্য প্রথম প্রথম তাই-ই মনে হয়েছিল। কিন্তু শেষ প্রায় কুড়ি দিন ধরে আশিকের ফোন বন্ধ। সে ভেবেছিল আশিকের কোনো সমস্যা হয়েছে। তার মা মারা গিয়েছে, মানসিক অবস্থা ভালো না। নানান সমস্যা থাকতে পারে। এ কারণেই হয়তো তার ফোন বন্ধ। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে, লতার ভয় তত বেড়েছে। সেই সাথে মনে পড়ছে মায়ের বলা কথাগুলো। মা তাকে প্রায়ই বলতেন মোবাইল ফোনে এই ধরনের সম্পর্ক বিপজ্জনক। চেনা নেই জানা নেই, হুট করে প্রেম হয়ে গেল, আর মেয়েগুলোও বোকার মতো সবকিছু সপে দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে ফেলল। তারপর একদিন দেখা গেল ছেলে উধাও। তার ফোন বন্ধ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা যদি ঠিকানা বা নাম ধাম কিছু দিয়েও থাকে, তবে সেসবও হয় মিথ্যা। লতার কাছে আশিকের বাসার ঠিকানা নেই। একটা বন্ধুর ফোন নম্বর ছিল। সেই ফোন নম্বরও বন্ধ। লতা তারপরও আশায় ছিল। এই বুঝি আশিক তাকে ফোন করবে। সেই আগেরবারের মতো ফোন করে মাফ চাইবে। তারপর দেখা গেল এমন কারণে সে ফোন বন্ধ করে রেখেছিল যে, তা শুনে উল্টো মায়াই লাগবে লতার!

কিন্তু আশিক আর ফোন দিলো না। শুধু যে ফোনই দিলো না, তা-ই না। তার ফোন আর খুললই না। লতার খুব ছটফট লাগতে লাগল। সে রাজীবকেও বারকয়েক ফোন দিলো। কিন্তু রাজীব তখন ধরল না। রাজীব ফোন ধরল তারও কয়েকদিন পর। তার বাবা-মাকে নিয়ে পারুলকে দেখতে আসার কথা। রাজীব ফোন ধরতেই লতা প্রায় কেঁদেই ফেলল। সে হাউমাউ করে আশিকের খোঁজ জানতে চাইল। রাজীব অবশ্য লতাকে আশ্বস্ত করল। সে বলল আশিক আবার গ্রামে গেছে। হয়তো নেটওয়ার্ক সমস্যা, বা অন্য কোনো কারণে ফোন অফ। রাজীবের কথায় লতা যে পুরোপুরি আশ্বস্ত হয়েছিল, তা নয়। তবে একটা আশা তো ছিল।

সেই আশাটাও নিভে গেল তার দিন কয় বাদে। যেদিন বাবা-মাকে নিয়ে পারুলকে দেখতে আসার কথা রাজীবের, তার ঠিক আগের দিন। লতার সাথে যেন ফোনে সব সময় যোগাযোগ রাখতে পারে, এই জন্যই লতা থেকে গিয়েছিল রায়গঞ্জেই। পরদিন ভোরে রাজীবরা যখন লঞ্চ থেকে নামবে, তখন তাদের নিয়ে পারুলদের বাড়ি যাবে লতা। কিন্তু তার আগের দিন দুপুর থেকে হঠাৎ ফোন অফ রাজীবের। প্রথমবার ফোন বন্ধ পেতেই লতার বুকের ভেতরটা কেউ যেন খামচে ধরল। তার মনে হলো তীব্র আতঙ্কের একটা বরফ শীতল চিনচিনে স্রোত নেমে যাচ্ছিল তার গলা বেয়ে বুকের ভেতর। সারা শরীর কেমন অবশ হয়ে আসছিল। তারপর সারাটাক্ষণ ফোন হাতে নিয়ে বসে রইল লতা। আর মিনিটে মিনিটে ফোন দিতে লাগল। কিন্তু রাজীবের বন্ধ ফোন আর খুললই না। লতার কেমন অস্থিরতা শুরু হলো। সে কি করবে এখন? সে কি পারুলদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে? কিন্তু সেখানে গেলে ফোনের নেটওয়ার্ক থাকবে না। এর মধ্যে যদি রাজীব আবার ফোন দেয়! ওদিকে আবার পারুলের বাড়িতে একটা হুলস্থুল লেগে গেছে। এখনই গিয়ে কিছু একটা পরিকল্পনা না করলে বাড়ি ভরা মানুষের মাঝে একটা ভয়ানক বেইজ্জতি হয়ে যাবে! লতার দিশেহারা লাগতে লাগল। সে কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারছিল না। পারুলের সাথে কথা বলা দরকার। এক্ষুণি কথা বলা দরকার। সে জানে না কেন, তার বুকের ভেতর একটা স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ কু ডাক ডাকছে! আগেভাগে পারুলকে একটা কিছু না বলে সে থাকতে পারছে না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, রাত। লতার সত্যি সত্যি পাগল হবার দশা। সে কাঁদছে। ফোন করছে। একবার বাড়ির বাইরে যাচ্ছে, একবার ভেতরে। কিন্তু তার অস্থিরতা তাতে এতটুকুও কমল না। আর কখনো এমন অস্থিরতায় সে ভুগেছে কিনা, তা জানে না। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই লতা বাড়ি থেকে বের হলো। তখনো ঢাকার লঞ্চ এসে ঘাটে ভেড়েনি। সে গিয়ে লঞ্চঘাট দাঁড়িয়ে রইল। লঞ্চ আসলো। তারও কিছুক্ষণ পর। কিন্তু রাজীব এলো না। একের পর এক প্যাসেঞ্জার নেমে গেল লঞ্চ থেকে। ফাঁকা হয়ে গেল পন্টুন। কিন্তু কোথাও রাজীব নেই। লতা লঞ্চে উঠে দিশেহারার মতো একটা একটা করে কেবিনে গেল। লঞ্চের কেবিন বয়দের কাছে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু নেই!

লতার পারুলদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। পারুলদের উঠানের পাশে খোলা চুলা। সেখানে গাঁয়ের বৌ ঝিয়েরা মিলে তখনও নানান আয়োজন করছেন। কত রকমের খাবার! গ্রামের পিঠে, পায়েস, টক, মিষ্টি, ঝাল। কত কি! তারা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই লতা পাগলের মতো ছুটে পারুলের ঘরে ঢুকল। সেখানে কয়েকটা মেয়ে মিলে পারুলকে সাজাচ্ছে। লতাকে দেখে সকলের মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল, আইয়া পড়ছে? বাইরের ঘরে বইতে দিছেন?

লতা কি বলবে? সে তাকিয়ে আছে পারুলের দিকে। পারুলের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে হয়ে আছে। পারুল প্রবল কৌতূহল নিয়ে তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎই যেন লতার মুখের ভাষা পড়তে পারল সে। পারুল ঝট করে উঠে দাঁড়াল। তারপর প্রবল আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের মতো রুদ্ধশ্বাস গলায় বলল, কি হইছে লতা?

লতা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর খুব ধীরে, যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত করে স্বাভাবিক গলায় বলল, বাসা থেইক্যা লঞ্চে আসনের পথে গাড়ি একসিডেন্ট করছে। রাজীবের বাপ মাথায় আঘাত পাইছে। তারে নিয়া হাসপাতালে ভর্তি করান লাগছে। আমারে তহন জানাইতে পারে নাই। ফোন টোন বন্ধ হইয়া গেছিল। জানাইছে রাইতে।

ঘরের প্রতিটি মানুষ মুহূর্তেই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। এতক্ষণের হইচই, আনন্দ-উল্লাস নিমেষেই বিষাদের গভীর মেঘ হয়ে নেমে এলো ঘরে। তারপরের সময়টুকু যেন মৃত বাড়ির শোকের। একে একে সবাই এসে পারুলকে শান্তনা দিয়ে চলে গেল। পারুল বসে আছে চুপচাপ। তার পরনে মায়ের সেই লাল শাড়িটা। সবাই তাকে নিষেধ করলেও সে মোলকটাও পড়েছিল। রাজীব তাকে পইপই করে বলে দিয়েছিল তার বাবা-মাকে সে গ্রামের সহজতা দিয়ে মুগ্ধ করে দিতে চায়। ঘটনা আব্দুল ফকিরকেও জানানো হলো। আব্দুল ফকির বিশেষ

কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তাকে দেখতে লাগছে অদ্ভুত। তিনি তার সব। দাড়ি চেছে ফেলেছেন। কিন্তু থুতনির দগদগে ঘা এখনো শুকায়নি। একসিডেন্টের ঘটনা শুনে আব্দুল ফকির যে মনে মনে কষ্ট পেয়েছেন, এমন না। তিনি বরং খুশিই হয়েছেন। পারুলকে তিনি তার চোখের আড়াল করতে চান না। ওই অতদূরে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তিনি তাকে না দেখে কীভাবে থাকবেন, এই নিয়ে তার মধ্যে একটা তীব্র মনোঃকষ্ট কাজ করছিল। কিন্তু এই বিয়ের জন্য পারুল যেভাবে উদগ্রিব হয়ে আছে, তাতে তার কথা কেন, কারো কোনো কথাই তার সামনে টিকত না। সেখানে এমন একটা ঘটনা ঘটায় আব্দুল ফকিরের চেয়ে খুশি আর কেউ হয়নি। আব্দুল ফকির একটা জিনিস আবিষ্কার করে খুব অবাক হন, তিনি মনে মনে যা চান না, বেশিরভাগ সময়ই কেমন কেমন করে যেন সেই ঘটনাগুলো শেষ অবধি ঘটে না। আবার যা চান, সেই ঘটনাগুলোও বেশিরভাগ সময়ই কেমন কেমন করে যেন ঘটে যায়! এ এক অদ্ভুত ব্যাপার! আব্দুল ফকির নিজেই নিজের এমন ক্ষমতায় মাঝে-মধ্যে অবাক হয়ে যান। সেখানে অন্যদের ভড়কে যাওয়া তো স্বাভাবিক।

মেয়েকে শান্তনা দিতে আব্দুল ফকির এসেছিলেনও। কিন্তু পারুল স্পষ্ট গলায় বলে দিয়েছে, এখন সে কারো সাথেই কোনো কথা বলতে চায় না। সে দরজা বন্ধ করে লতাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল।

অনেকক্ষণের নীরবতা ভেঙে লতা ডাকল, পারুল!

পারুল সেই ডাকে সাড়া দিলো না। তবে হঠাৎ ঝর্নার জলের মতো ভেঙে পড়ল। লতা তাকে আরো বার দুয়েক ডাকল, কিন্তু পারুল সাড়া দিলো না। অনেকটা সময় সে কাঁদল। তারপর শাড়ির আঁচলে নিজের চোখ মুখ মুছে পারুল বলল, তুই না বলছিলি, আমার কপালডা ভালো পারুল?

লতা শক্ত করে পারুলের কাঁধ ধরে রইল। পারুল বলল, আল্লায় আমার লগে কেন এমন করে লতা? আমি তো কোনো পাপ করি নাই। করলে আমার বাপ করছে। আল্লায় আমারে শাস্তি দেয় কেন লতা?

লতা এবারো জবাব দিলো না। সে এখনো বুঝতে পারছে না, আসল ঘটনা। সে পারুলকে কীভাবে বলবে! পারুল বলল, রাজীবের কোনো ক্ষতি হয় নাই। তো লতা? আল্লাহর কিরা, তুই আমারে মিথ্যা কথা বলবি না। ভালো-মন্দ যাই হোক, আমারে সত্য কথা বলবি। যাই হোক, সত্য কথাখানই আমারে ক। আমি আর মিথ্যা জিনিস নিতে পারতেছি না লতা।

কি বলবে লতা? সে পারুলের মাথাটা তার কাঁধে চেপে ধরে রাখল। পারুল বলল, রাজীবের যদি বড় কোনো দুর্ঘটনাও হইয়া থাহে, আমারে বল লতা। আমারে সত্য কথাটা বল।

লতা কি করবে সে ভেবে পাচ্ছে না। পারুলকে তার এখুনি বলে দেয়া। উচিত সত্যিটা। এখুনি। না হলে প্রতি মুহূর্তে তার ভেতর রাজীবকে নিয়ে নতুন নতুন অনুভূতির সৃষ্টি হবে। ভাবনা সৃষ্টি হবে। তার নিজের কষ্ট কি পারুলের চেয়ে এতটুকুও কম? নাকি বেশিই? সে এই এতটা দিনেও আশিককে চিনতে পারেনি? মুহূর্তের জন্যও না? কীভাবে? লতার বিশ্বাস হয় না। মনে হয় এটা কোনো ভয়ানক দুঃস্বপ্ন। ঘুম ভেঙে গেলেই দেখবে সব আবার আগের মতো। কিন্তু পারুলের জন্যও কি সে দায়ী নয়? তার জন্যই পারুলের সাথে রাজীবের এই সম্পর্ক। দিনের পর দিন সেই সম্পর্কে আলো, হাওয়া, জল দিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছে, সতেজ রেখেছে, বিস্তৃত, গভীর করেছে সে! কিন্তু লতা তো জানে, সে মুহূর্তের জন্যও পারুলের কোনো ক্ষতি চায়নি। বরং ভালো চেয়েছে। লতার নিজেকে কেমন অসহায়, নিঃস্ব, দায়গ্রস্ত এক মানুষ মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই জগৎ সংসারে তার চেয়ে বিপন্ন, বিধ্বস্ত, ভাগ্যাহত আর কেউ নেই। পারুল তো অন্তত কাঁদতে পারছে, কিন্তু সে তো কাঁদতেও পারছে না।

দীর্ঘ সময় বয়ে গেল। নৈঃশব্দ্যের দীর্ঘ সময়। কিন্তু সময় জানে, এই নৈঃশব্দ্যের ভেতর কষ্টের ছুড়ির তীক্ষ্ণ ফলায় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে লেখা হয়েছে কত কত শব্দ, কত কত কথা, কত কত কান্না!

লতা সেই নৈঃশব্দ্য ভেঙে পারুলের হাত ধরে বলল, পারুল। একটা কথা। খুবই জরুরি।

পারুল ঝট করে মাথা তুলে তাকাল। তারপর বলল, রাজীবের কিছু হইছে? খারাপ কিছু?

সে তার কথা শেষ করতে পারল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কান্নার দমকে তার শরীর কাঁপছে। সেই কান্না জড়ানো গলায়ই বলল, আমারে একটু ঢাকা লইয়া যাবি লতা? আমি অর মুখোন একবার খালি দেখব। একটা বার। ওই একটাবার দেইখ্যাই আমি সারাটা জীবন কাটাই দিতে পারব লতা। ও লতা! লতারে…।

লতা চুপ করে রইল। পারুলকে এই কথা বলার সাহস সে করে উঠতে পারছে না। কিন্তু তাকে বলতেই হবে। সে হঠাৎ দুম করে বলে বসল, রাজীবের গাড়ির কিছু হয় নাই পারুল। আমি যেইটা সন্দেহ করছিলাম সেইটাই। কাইল দুপুরেরতন তার ফোন বন্ধ। আমরা একটা ফাঁদে পড়ছিলাম পারুল। বড় ফাঁদ।

পারুল কান্না থামিয়ে স্থির চোখে তাকাল। তারপর বলল, এইগুলান সব মিথ্যা আছিল? তোর মা যা বলছিল, আশিক ভাইরে লইয়া প্রথম প্রথম আমি যা সন্দেহ করতাম, সেইটাই সত্য?

এবার লতা কাঁদল। সে ঝুঁকে পারুলের ভাঁজ করা হাঁটুর উপর মাথা রাখল। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। বলল, দুইন্যাটা এত খারাপ কেন পারুল? মানুষ এত খারাপ কেন? কেন মানুষ এত খারাপ?

পারুল কিন্তু আর ভেঙে পড়ল না। সে স্থির শান্ত গলায় বলল, আমি জানি না লতা। আমি বিশ্বাসও করি না। রাজীব! রাজীব এমন না লতা। আমি তারে দেখছি। তার চোউখ দেখছি। ওই চোখের ভিতর এইগুলান নাই লতা। তুই যেইটা বলছস, ওইরকম কোনো একটা ঝামেলা হইছে লতা। কোনো একটা ঝামেলা হইছেই হইছে। আমি জানি রাজীব আসবই। রাজীব না আইসা পারব না। সে আমারে ছাড়া থাকতে পারব না লতা। আমার আল্লায় জানে আর আমি জানি, সে কেমন মানুষ। ও আল্লাহ! আমি বিশ্বাস হারাই নাই। আমি বিশ্বাস হারাই নাই লতা। আমি বিশ্বাস হারাব না। আল্লাগো, আমি জানি সব ঠিক হইয়া যাইব। সব ঠিক হইয়া যাইব গো আল্লাহ। ও আল্লাহ!

পারুল আর লতা, সেই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের রাতখানা যেন কাটিয়ে দিলো মৃতপ্রায় দুজন মানুষের মতো। পরদিন ভোরেও তাদের ঘরের দরজা খুলল না। তাবারন ডাকল, আব্দুল ফকির ডাকলেন। শেষ অবধি তারা উঠল। কিন্তু শেকড় কাঁটা গাছের মতো নেতিয়ে রইল তারা। কেউ কারো সাথে কোনো কথাও বলল না। দুপুরের দিকে লতা তাদের বাড়িতে গেল। সে ফিরল সন্ধ্যার খানিক পর। তখনো পারুলের ঘরের দরজা বন্ধ। লতার আর ইচ্ছে করছিল না পারুলকে ডাকতে। সে চুপচাপ গিয়ে বসে রইল পুকুর ঘাটে। অনেকটা সময়। চারপাশটা বড় বেশি সুনসান। সেই সুনসান স্তব্ধতায় লতার চোখের সামনে একটার পর একটা ছবি ভেসে আসতে লাগল আশিকের। কত কত স্মৃতি, কত কত অনুভূতি, ব্যাকুলতা, মন কেমন করা মুহূর্ত, কথা, গভীর অন্তরঙ্গতা, শরীরী স্পর্শ, আরও কত কত কিছু! অথচ তার সবই মিছে ছিল? কেবল সত্যি ছিল, ওই শরীরী স্পর্শটুকুই? কেবল ওই স্পর্শটুকুর জন্যই আর সব মিছেমিছি খেলা? আর সব? এই সব কিছু?

লতার বিশ্বাস হতে চায় না। মনের কোথায় যেন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটু আশা থেকে যায়। বিশ্বাস থেকে যায়। কিন্তু সে এও জানে, এই সম্পর্কে আরো কত বড় বড় ফাঁক যে রয়ে গিয়েছিল, তা সে মুহূর্তের জন্যও টের পায়নি। তখন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে ছিল সে। না হলে এই এত বড় বড় ফাঁকগুলো কি করে তার চোখের আড়ালে থেকে গেল? ভালোবাসলে আসলেই মানুষ অন্ধ হয়ে যায়? বোকা হয়ে যায়? কতবার সে আশিককে বলেছে তার ঠিকানা দিতে, তার মা-বাবা, বা নিদেনপক্ষে ভাই বা বোনের কারো ফোন নম্বর দিতে। যদি কখনো কোনো কারণে তাকে না পায়? তখন কি হবে? প্রতিবারই নানান ছল ছুঁতোয় এড়িয়ে গেছে আশিক।

একটা মানুষের জীবনে কতটা তীব্র কষ্টের অনুভূতি থাকতে পারে? কতটা। শূন্য লাগতে পারে একটা মানুষের? লতার মনে হয় না, এই মুহূর্তে তার যে অনুভূতি হচ্ছে, তার চেয়ে তীব্র কোনো কষ্ট এ জগতে কারো আছে! এর চেয়ে গভীর কোনো শূন্যতা আর কারো থাকতে পারে!

এভাবে কতক্ষণ একা বসেছিল লতা জানে না। কিন্তু হঠাই তার আশেপাশে অনভিপ্রেত কিছু একটার অস্তিত্ব যেন তার অবচেতন মনকে সতর্ক করে তুলল। মুখ তুলে তাকাতেই চমকে গেল লতা! খানিক ভয়ও। চারপাশে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার নেমে এসেছে। সেই অন্ধকারে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আব্দুল ফকির। লতা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। যদিও অন্ধকার, তারপরও মেয়েলি সংবেদনশীলতা থেকেই হয়তো সে চট করে তার গায়ের ওড়নাটা ঠিক করে ফেলল। তারপর বলল, চাচা, আপনে এইহানে?

আব্দুল ফকির নরম গলায় বললেন, মা, তুমি এইহানে একলা একলা কি করো? রাইত হইছে অনেক। সেই সইন্ধ্যা থেইক্যা দেহি তুমি এইহানেই বইস্যা রইছো?

লতা বলল, না চাচা। তেমন কিছু না। পারুলের দেখলাম মন অনেক খারাপ। এইজন্য অরে আর ডাকলাম না। ও কি আমারে খোঁজতেছে চাচা?

আব্দুল ফকির কেমন যেন একটা অন্যরকম গলায় বললেন, তুমি যে আইছ, এইটাই তো কেউ জানে না লতা।

লতার হঠাৎ কেমন যেন খুব অস্বস্তি লাগতে লাগল। সে বলল, আন্ধারও অনেক হইয়া আসছে চাচা। দেহি একটু সইরা জায়গা দেন। পারুল আমার উপর মনে মনে রাগই হইব।

আব্দুল ফকির সামান্য সরে জায়গা দিয়ে বললেন, আবার গরমটা কি। পড়ছে দেখছ? এই একটু গরম পড়লেই সাপ-খোপ সব হাওয়া খাইতে ভোলা জায়গায় বাইর হইয়া আসে। সাবধানে যাইতে হইব। আর আমাগো এই অঞ্চলের মতো সাপ আর কোনো অঞ্চলে আছে শোনছ? দেহি দেহি, হাতখান দেও। আমি ধইরা নিয়া যাই। আন্ধারে কোন দিকে না কোন দিকে পাও দিবা, সাথে সাথে কামড়। দেও দেও।

লতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আব্দুল ফকির তার হাতখানা ধরে তাকে টেনে উঠালেন। লতা জানে না কেন, তার ভারি অস্বস্তি এবং ভয় হতে লাগল। সে বলল, আমি যাইতে পারব চাচা।

আব্দুল ফকির বললেন, না না। তুমি যাইতে পারলেই তো আমি যাইতে দিব না মা। বড়গো কথা শোনতে হয়।

কথা শেষ করতে না করতেই আব্দুল ফকির হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন লতা এতক্ষণ যেখানে বসেছিল, সেখানে। আর সেই সাথে লতাকে একটানে বসিয়ে ফেললেন তার কোলে। তারপর পেছন দিক থেকে দুইহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন লতাকে। তার মুখ তখন লতার চুলের ভেতর। লতার সবগুলো ইন্দ্রিয় মুহূর্তেই সতর্ক হয়ে উঠল। মুহূর্তের ঘটনা, কিন্তু তার আর বুঝতে বাকি রইল না কিছুই। সে বার দুই ঝটকা মেরে তার হাত ছাড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। প্রবল আতঙ্কে লতা কাঁপছে। আব্দুল ফকির বললেন, অস্থির হইতেছ কেন লতা? আসো, একটু গপসপ করি।

লতা হঠাৎ তীব্র ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, আপনে আমারে যাইতে দিবেন। না চিক্কর দিয়া পারুলরে ডাকব?

আব্দুল ফকির বললেন, ডাকলে তোমারই ক্ষতি। এই এত রাইতে তুমি আমার লগে এইহানে কি করো? এইটা মানুষ জানাজানি হওন কি ভালো হইব লতা?

লতা আর একটা কথাও বলল না। সে চিৎকার করে পারুলকে ডাকল। একবার, দুইবার, তিনবার। তিনবারের বার ভেতর বাড়ি থেকে পারুল সাড়া দিলো। আব্দুল ফকির সাথে সাথে লতাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, এই যে দেখো, তুমি আমারে ভুল বুঝলা। আমি তাল সামলাইতে না পাইরা পইড়া গেলাম ঘাটের উপরে। সাথে তোমারে নিয়া পড়লাম। আমি বুড়া মানুষ…।

লতা আর আব্দুল ফকিরের বাকি কথা শুনল না। সে দৌড়ে ছুটে গেল বাড়ির দিকে। পারুল ততক্ষণে অনেকটাই সামনে এগিয়ে এসেছে। সে বলল, কি হইছে লতা? তুই এত রাইতে ওই দিকে কি করতেছিলি?

লতা তখনো নিজেকে সামলে নিতে পারেনি। তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তীব্র আতঙ্কে অস্থির হয়ে আছে সে। পারুল আবারো বলল, কি হইছে?

লতা বলল, না, কিছু হয় নাই। পুকুর ঘাটে একলা একলা বইসা আছিলাম। আচুক্কা চাইয়া দেহি আন্ধার। ভয় পাইয়া গেছিলাম।

লতা কিছুক্ষণ থেমে থেকে বলল, আমি বাড়ি যাব পারুল। আমার ভালো লাগতেছে না।

পারুল খুবই অবাক হলো তার কথায়। কিন্তু সেও কেন যেন আর জোর করল না। সেই অত রাতে তাবারন আর পারুল মিলে লতাকে দিয়ে আসলো তাদের বাড়িতে। সারারাত দুই চোখের পাতা আর এক করতে পারল না লতা। এই ঘটনা সে কার কাছে বলবে? কীভাবে বলবে? কী ভয়ানক লজ্জার কথা! এই কথা সে না পারুলকে বলতে পারবে, তার মা-বাবাকে বলতে পারবে। ঘেন্নায়, ভয়ে, অপমানে পারুলের নিজেকেই নিজের অশুচি লাগতে লাগল। তার। হঠাৎ মনে হতে লাগল, এই আব্দুল ফকির মানুষটার চোখের দৃষ্টি যে খারাপ তা সে বহু আগে থেকেই বুঝতে পারছিল, কিন্তু কখনোই সেভাবে গ্রাহ্য করেনি। আসলে এই এত বয়স্ক একটা মানুষ। তার ওপর তার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবীর বাবা, তার ঘুণাক্ষরেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি। তার সেই রাতে আরো একটা ঘটনা মনে পড়ল। যেদিন প্রথমবার আশিকের ফোন বন্ধ ছিল। প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে সে আর পারুল ঘুরতে গিয়েছিল নদীর ঘাটে, আর তখন আব্দুল ফকির এসেছিলেন নৌকা নিয়ে। সেই নৌকায় উঠতে যাবার সময় তাকে ধরে নৌকায় উঠিয়েছিলেন আব্দুল ফকির। আর তখনও তার স্পর্শে লতা কুঁকড়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিজেকে এই ভেবে লতা প্রবোধ দিয়েছিল যে সে ভুল বুঝেছে!

.

সে রাতে ঘুমাতে পারেনি পারুলও। তার পরের রাতও না। তার পরের রাতও না। নিঘুম পারুলের চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। তার খাওয়া, ঘুম, গোসল সকলই যেন উধাও হয়ে গেছে। জগতের কোনো কিছুর প্রতিই কোনো আগ্রহ নেই তার। সারাক্ষণ কেমন আনমনা হয়ে ঘরের দাওয়ায় বা তার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। কারো সাথে কথা বলে না। কিন্তু পারুল জানে, রাজীব আসবে। আসবেই। সে না এসে পারে না। এই বিশ্বাস তার আছে। পারুল রাজীবের অপেক্ষায় থাকবে। রাজীব যেন কোনোদিন ফিরে এসে বলতে না পারে, পারুল, আমার প্রতি এই তোমার বিশ্বাস? তুমি জানতে না, আমি ফিরে আসব? তাহলে? একটু অপেক্ষা করতে পারলে না আমার জন্য?

এই কথা বলার সুযোগ রাজীবকে দিবে না পারুল। সে বরং রাজীবকে বলবে, আমি জানতাম তুমি আসবে। এই বিশ্বাস আমার আছে। আর তোমার একটা উপহার তো আমার কাছে রয়ে গেছে, সেটা তোমাকে না দিয়েই আমি চলে যাব? কখনোই না।

রাজীব তখন কি করবে?

পারুল একা একা কত কিছু যে ভাবে! রাজীবের সাথে কথা বলে। প্রশ্ন করে, উত্তর পায়। গল্প করে। কত কত পরিকল্পনা করে। কিন্তু একটা কথা সে রাজীবকে একবারও বলে না। তার খুব অভিমান হয়, রাজীব কেন সেই কথাটা তাকে একবারও জিজ্ঞেস করে না? একবারও না! সে তো রাজীবকে বলবে বলেই এই কথাটা এখনো কাউকেই বলেনি। কাউকেই না। রাজীব তাকে জিজ্ঞেস না করলে সে এই কথাটা বলবে না। কোনোদিন না। পারুল একা একা ঘরের দরজা বন্ধ করে কত কত কথা বলে। মাঝে-মধ্যে কথা বলার সময় সে তার জামাটা পেটের উপর থেকে তুলে দেয়। তারপর পেটের উপর হাত রেখে ফিসফিস করে কথা বলে, তুই যে আমার প্যাটে আইসা পড়ছস, এইটা কিন্তু আমি চাই নাই, এইজইন্য তুই আমারে ভুল বুঝিস না। আমার তো ডর করতে আছিল। তারপরও কেমনে কেমনে হইয়া গেল। কিন্তু তোর বাপ তো তোর কোনো খোঁজ নিতেছে না। এহন? এহন কি করব আমি বল? আমি কিছু করতে পারব না। আমার কি একলা ঠ্যাকা? আমার একলা ঠ্যাকা না। তোর বাপ আসলে তার বলবো, আমি প্যাটে নিয়া আর কষ্ট করতে পারব না। এহন তুমি কয়দিন কষ্ট করো। নেও, প্যাটে নেও। তহন দেখব সে কি করে? হা হা হা!” পারুল তার পেটের ভেতর বেড়ে ওঠা এক মানবণের সাথে কথা বলতে থাকে। কথা বলতে থাকে আরো একটি মানবজন্মের সাথে। যেই জন্মের মানবজন্ম ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *