৮. পালা বদল: সাদায় কালোয়

৮. পালা বদল : সাদায় কালোয়

“১৯৬৭ সাল থেকে তো চাকাটা ঘুরতে শুরু করল, তাই না?”—উত্তরে বসু বললেন, “হ্যাঁ, তবে চাকায় তখন বহু বছরের অন্যায় অবিচারের মরচে, তাই চাকা ঘোরানোর কাজটা খুব সহজ ছিল না।” শুরু হল পালা বদলের পালা। রাজ্যে কংগ্রেসের আধিপত্য খর্ব হল, বামপন্থীরা পেলেন সংখ্যাগরিষ্ঠের মর্যাদা। বসুর রাজনৈতিক জীবনে এল বিরাট পরিবর্তন। আর বিরোধীপক্ষে নয়, যুক্তফ্রন্টের সদস্য হিসাবে তাঁকে যেতে হল ট্রেজারি বেঞ্চের দিকে। গঠিত হল প্রথম কোয়ালিশন সরকার। কোয়ালিশন সরকার মসৃণভাবে কি করে চালাতে হয়, আর কেনই বা কোয়ালিশন সরকার টুকরো টুকরো হয়ে যায় এ সবই বসু তখন প্ৰত্যক্ষভাবে শিখেছিলেন। বিশ বছরের সফল কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার পিছনে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সালের অভিজ্ঞতার অবদান নেহাৎ কম নয়।

১৯৬৭ সালের চতুর্থ নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর শুরু হয় অ-কংগ্রেসী কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রচেষ্টা। আগেই গড়ে উঠেছিল তিনটি শিবির। কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) সমেত সাতটি পার্টি নিয়ে তৈরি হয়েছিল সংযুক্ত বামফ্রন্ট বা ইউ. এস. এফ.—এই সাতটি পার্টি হল সি. পি. আই(এম), আর. এস. পি, মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক, আর. সি. পি. আই, এস. এস. পি, এস. ইউ. সি, এবং ওয়ার্কার্স পার্টি। বাংলা কংগ্রেস ও দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেছিল পি. ইউ. এস. এফ। এতে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি (দক্ষিণপন্থী), বাংলা কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লক। আর ছিল কংগ্রেস।

ফলাফল প্রকাশের পর দেখা গেল কংগ্রেসের তাবড় তাবড় অনেক নেতাই পরাজিত হয়েছেন—যেমন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন, অতুল্য ঘোষ প্রমুখ। বিধানসভায় ২৮০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে ১২৭টি আসন আর অন্যদিকে অ-কংগ্রেসী পার্টির জোট পেয়েছে ১৩৩, তার মধ্যে সি. পি. আই(এম) পেয়েছে সবচেয়ে বেশি আসন- ৪৪টি। বসু আবার জিতলেন বরানগর কেন্দ্র থেকে। এবার বসু পেলেন ৩১,৩৫৪টি ভোট। তিনি কংগ্রেসের অমর ভট্টাচার্যকে হারিয়ে ছিলেন এক বিপুল মার্জিনে। সারা দেশেও কংগ্রেসের অবস্থা তখন এমন কিছু আশাপ্রদ নয়, আটটি রাজ্যে তাদের বিপর্যয় হয়েছে, বিহার, উড়িষ্যা এবং পশ্চিমবঙ্গের ফল রীতিমত খারাপ।

বিরোধীপক্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী দলের নেতা নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও বসু হলেন উপ-মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী হলেন অজয় মুখার্জী। বসু এটা মেনে নিয়েছিলেন কারণ তিনি বুঝেছিলেন ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দকে প্রশ্রয় দিলে কোয়ালিশন সরকার ঢেঁকানো মুস্কিল হবে। যখন হুমায়ুন কবীর অজয় মুখার্জীকে মুখ্যমন্ত্রী করার প্রস্তাব নিয়ে বসুর কাছে এসেছিলেন, বসু বলেছিলেন, “আমি জানি আপনারা ঐভাবেই ভাবনা চিন্তা করেন। কে কি হবে তাই নিয়েই আপনারা মাথা ঘামান, সাধারণ মানুষের কথা তো আপনারা ভাবেন না, যাক ঠিকই আছে, তাই করুন, আমি ডেপুটি চিফ মিনিস্টারই হতে রাজি আছি।”

২৪শে ফেব্রুয়ারি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট হস্টেলের ৪নং ঘরে সভা বসল। সি. পি. আই. (এম)-এর পক্ষে ছিলেন জ্যোতি বসু এবং নিরঞ্জন সেন। বাংলা কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন হুমায়ুন কবীর, জাহাঙ্গীর কবীর এবং নলিনাক্ষ সান্যাল। সোমনাথ লাহিড়ী এবং বিশ্বনাথ মুখার্জী উপস্থিত ছিলেন সি. পি. আই-এর পক্ষে। ফরওয়ার্ড ব্লকের পক্ষে ছিলেন অশোক ঘোষ এবং অমর চক্রবর্তী। আর.এস.পি-র প্রতিনিধিত্ব করছিলেন ত্রিদিব চৌধুরি এবং যতীন চক্রবর্তী। বসুই ছিলেন প্রথম বক্তা। যুক্তফ্রন্টের স্থায়িত্ব নিয়ে অনেক সদস্যের মনে যে সংশয় ছিল সেটা দূর করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। বসু বলেছিলেন ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে, ছোটখাটো মতানৈক্যের ঊর্ধ্বে উঠতে। “অনেকটা এখনকার সাম্প্রদায়িক বি. জে. পি. দলকে ঠেকানোর মতই অবস্থাটা ছিল”—মন্তব্য করলেন বসু। যাই হোক শেষ পর্যন্ত কোয়ালিশন সরকার গড়া হল, চোদ্দ সদস্যের মন্ত্রীসভা গঠিত হল, অজয় মুখার্জী মুখ্যমন্ত্রী হলেন। উপমুখ্যমন্ত্রীত্ব ছাড়াও বসু নিলেন পরিবহণ এবং অর্থদপ্তরের ভার। বসু বললেন, “আমি যদি তখন জেদ করতাম, ঐ পদ নিতে অস্বীকার করতাম, কোয়ালিশন তখন সেখানেই ভেঙে যেত, তাতে কংগ্রেসের খুবই আনন্দ হত আর সাধারণ লোকের হত সর্বনাশ। তাই আমার দল খুব সতর্কভাবে সেই অবস্থাটা এড়াবার চেষ্টা করেছিল।”

১৯৬৭ সালের ২রা মার্চ, বিশ বছর বিরোধীপক্ষে থাকার পর বসু পশ্চিমবঙ্গের উপ-মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন। “নতুন পদ মানেই বাড়তি দায়িত্ব, বাড়তি ক্ষমতা নয়, একথাটাই মনে হয়েছিল তখন”–বসু বললেন, “আমার এখনও একই কথা মনে হয়, জনগণই আমাদের ক্ষমতার উৎস, তখনও মনে হয়েছিল, আমি নয়, জনগণই ক্ষমতায় এসেছে।”

যুক্তফ্রন্টের প্রথম মন্ত্রীসভার বৈঠকেই ঠিক হল ট্রাম কোম্পানির ছাঁটাই হয়ে যাওয়া কর্মীদের কাজে পুনর্বহাল করতে হবে, স্টেট বাস কোম্পানির কর্মীদের ক্ষেত্রেও এই একই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ৯ই মার্চ বিধানসভায় বসু অর্থমন্ত্রী হিসাবে বাজেট পেশ করলেন। এতদিনকার প্রতিরোধ করা ‘কালাকানুন’ তুলে দেওয়া হল। সবচেয়ে বড় কথা, পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এই প্রথম ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে জমিবণ্টনের কাজ শুরু করা হল। ভূমিসংস্কার এক নতুন চেহারা নিল। দরিদ্রদের ত্রাণ ও পুনর্বণ্টনে প্রশাসন বিশেষ দৃষ্টি দিতে শুরু করল। সব মিলিয়ে যুক্তফ্রণ্ট প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল ‘সাধারণ মানুষের সরকার’—এই ভাবমূর্তি কাজের মাধ্যমে বজায় রাখতে।

মন্ত্রী হয়েও বসু জনগণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ রেখেছিলেন। নিত্য নতুন সমস্যার মোকাবিলাও তিনি নিজে প্রত্যক্ষভাবেই করতেন। ২৯শে মার্চ হঠাৎ শহরে উত্তেজনা ছড়ায়—শিখ সম্প্রদায়ের এক ধর্মীয় মিছিলকে কেন্দ্র করে আবহাওয়া বিষিয়ে ওঠে। এগারজন লোক নিহত হয় এবং সংঘর্ষে প্রায় দেড়শজন আহত হয়। সেনাবাহিনীর তলব পড়ে। বসু সরেজমিনে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তিনি এবং সে সময়কার সেচমন্ত্রী, সি. পি. আই. নেতা বিশ্বনাথ মুখার্জী শিখ সম্প্রদায়ের মিছিলের পুরোধায় হেঁটে নির্বিঘ্নে সেই মিছিলকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বাগমারীতে। ফলে অবস্থা আয়ত্তে চলে আসে, শান্তি ফিরে আসে শহরে। আর একবার পার্কসার্কাস এলাকায় হিন্দু মুসলমান সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে গোলমাল শুরু হয়। বসু নিজে পুলিস ভ্যানে করে ঘটনাস্থলে গিয়ে, বিবাদমান দুই দলকে আলাদা করেন, পুলিসকে ১২ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করার আদেশ দেন, ক্ষুব্ধ জনতা শান্ত হয়।

যুক্তফ্রন্ট সরকারের তিনমাসও তখন পুরো হয়নি, তখন দেখা দিল আর এক বিপদ। নকশালবাড়ি আন্দোলন। তাদের পথ ছিল হিংসা আর হত্যার। তাদের লক্ষ ছিল জোতদার, পুলিস এবং ক্ষমতাবান কর্তৃপক্ষ। যুক্তফ্রন্ট সরকার এই নকশালপন্থীদের মনে করতেন ভ্রান্ত উগ্রবাদী। বসু নিজে প্রথম থেকেই এর শেষ দেখতে পেয়েছিলেন : “আসলে বাড়াবাড়ির পথে, হিংসার পথে কোনও সদর্থক ভাল কাজ হতে পারে না। আর হয়ও নি”, বসু বললেন, “তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছিল। দেশের মধ্যে আমাকে আর ই. এম. এস-কে গালাগালি দেওয়া হত চীনের দালাল’ বলে, আবার এদিকে বেজিং রেডিও আমাদের বলত ‘সাম্রাজ্যবাদের দালাল’।”

বসু তখন আর একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন—সেটি হল ট্রাম কোম্পানি অধিগ্রহণ। “ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর ব্রিটিশ পরিচালিত ট্রাম কোম্পানির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়ে”, বসু বললেন, “অনেকদিন ধরেই কর্মচারীরা নানারকম বিক্ষোভ, অভিযোগ জানাত। তাই আমি প্রথমেই বিষয়টায় নজর দিই।” ট্রাইবুনাল রিপোর্ট দিল সত্যিই ট্রাম কোম্পানিতে চূড়ান্ত অব্যবস্থা আর অরাজকতা চলছে। বসু অধিগ্রহণের আদেশ দিলেন। ১৪ই জুলাই বিধানসভায় বিল পেশ করলেন। সর্বসম্মতিক্রমে বিল পাশ হয়ে গেল। এমনকি কংগ্রেস সদস্য বদ্রী পোদ্দার, ভারতে ট্রাম কোম্পানির একমাত্র ভারতীয় ডিরেক্টরও এই বিল সমর্থন করেছিলেন। বসু এই অধিগ্রহণে সফল হলেও ব্রিটিশ কোম্পানি কাজটা ভাল চোখে দেখেনি।

এদিকে কংগ্রেসও চুপচাপ বসে ছিল না। কি করে যুক্তফ্রন্ট ভাঙা যায় এই চক্রান্ত শুরু হয়ে গিয়েছিল। এতে যোগ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্যের কিছু আমলা। রাজ্যের খাদ্যের বরাদ্দ কোটা বন্ধ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হল। অন্যান্য চক্রান্তও শুরু হল। এর সঙ্গে ফ্রন্টের মধ্যেও নানা বিষয়ে মতভেদ দেখা দিতে লাগল। মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জী ঘনঘন দিল্লী গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে লাগলেন। ইন্দিরা গান্ধী যুক্তফ্রণ্ট ভেঙে দিতে বিশেষ সচেষ্ট ছিলেন। সরকার ভাঙার জন্য কাদের ধরপাকড় করা উচিত তাদের নামের তালিকা তৈরি করে ইন্দিরা গান্ধীর হাতে দিয়েছিলেন অজয় মুখার্জী। বসু মুখ্যমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন : “শুনলাম আপনি নাকি যাদের আটক করা হবে তাদের নামের একটা তালিকা তৈরি করেছেন!” “না না, আপনাকে আটক করা হবে না”, মুখ্যমন্ত্রী “বসুকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওদিকে যুক্তফ্রন্টের ফাটল বাড়াবার চেষ্টাও চালাতে থাকেন। তাঁকে এই কাজে সাহায্য করতে থাকেন সে সময়কার রাজ্যপাল ধরমবীর, হুমায়ুন কবীর এবং প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। আসলে ওঁরা কেউই নিজেদের স্বার্থের বাইরে আর কিছুই দেখতে পেতেন না”–বসু বললেন। প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের দলত্যাগের ফলে ফ্রন্ট পতনের পথে দ্রুত এগিয়ে যায়। প্রফুল্ল ঘোষের সঙ্গে চলে যান আর সতেরজন বিধায়ক। রাজ্যপাল মুখ্যস্ত্রীকে তড়িঘড়ি বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডাকার নির্দেশ দেন, অজয় মুখার্জী চাইছিলেন ১৮ই ডিসেম্বর এই অধিবেশন ডাকতে কিন্তু ধরমবীর আর অপেক্ষা করতে রাজী হলেন না। যখন তলে তলে এই চক্রান্তের ব্যাপারে প্রায় সব সদস্যই অন্ধকারে, ২১শে নভেম্বর হঠাৎ ধরমবীর ঘোষণা করলেন এই সরকার ভেঙে দেওয়া হল। “যেভাবে সরকার ভাঙা হয়েছিল, সেটা কেবল অনৈতিকই নয়”, বসু মন্তব্য করেন, “রীতিমত বেআইনিও ছিল। নয়মাস ধরে কোয়ালিশন সরকারকে ঐক্যবদ্ধ করে রাখার প্রাণপণ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল।”

আবার প্রশাসনের চেহারা পালটে গেল। ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ নতুন মুখ্যমন্ত্ৰী হলেন, প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্র হলেন উপমুখ্যমন্ত্রী। খুব স্বল্পদিন এই ব্যবস্থা চলল। ২০শে ফেব্রুয়ারি রাজ্যে প্রেসিডেন্টের শাসন জারি করা হল। রাজ্যে দেখা দিল চরম নৈরাজ্য। শাসকদলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ বিবাদ তুঙ্গে উঠল, প্রকাশ্যে শুরু হল হানাহানি। এদিকে নকশালবাদী ও সি. পি. আই. (এম) বিরোধও চরম শিখরে উঠল। ১৯৬৯ সালের মে দিবসে নকশালবাদী ও যুক্তফ্রন্টের সমর্থকদের মধ্যে বিরাট সংঘর্ষ হল। নকশালপন্থীদের সন্ত্রাস প্রসঙ্গে বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন :

“…এইসব ছদ্মবিপ্লবীরা তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি ও কাজকর্মের দ্বারা গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির ঐক্য ভেঙে দেবার জঘন্য খেলায় লিপ্ত কংগ্রেসী শিবিরকে যথেষ্ট খোরাক যোগাল। যেমন সংশোধনবাদীরা দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদের দিক থেকে তেমনি বামপন্থী হঠকারীরা ও তাদের বামপন্থী সুবিধাবাদের দিক থেকে প্রতিক্রিয়ার শক্তিকেই সাহায্য করছিল। কংগ্রেস সহ সকল জনবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে দেশে গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী শক্তিগুলির যে অতি গুরুত্বপূর্ণ লড়াই তখন ক্রমশ গড়ে উঠেছিল এবং যার মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) একটি প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল, দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী সুবিধাবাদীরা দুই দিক থেকেই সেই লড়াইয়ে ক্ষতিসাধন করছিল। যুক্তফ্রন্ট সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-কে বিচ্ছিন্ন করতে কংগ্রেস যে আক্রমণ, কুৎসা, ষড়যন্ত্র করছিল, এই উগ্র বামপন্থীরাও একই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল এবং আমাদের পার্টিকে তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য করে তুলল। বিপ্লবের নামে ব্যক্তিহত্যা ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ তারা শুরু করল—যার প্রধান লক্ষ্য সি. পি. আই. (এম)…এইভাবে শক্তির সঙ্গে উগ্র বামপন্থীদের অদ্ভুত ও উৎকট মিলনটি বেশ প্রকট হয়ে উঠল।”[১]

প্রায় এক বছর রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন চালু রইল। এই সময়টা বসুর চরম ব্যস্ততায় দিন কেটেছে। চোদ্দটা বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ করে রাখা সহজ কথা নয়। এর মধ্যেই ১৯৬৮ সালের ২৩ থেকে ২৯শে ডিসেম্বর পার্টির অষ্টম কংগ্রেসে উপস্থিত থেকেছেন বসু, পলিটব্যুরোয় আবার নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে তিনি অনেক কিছু দেখেছেন এবং শিখেছেন। শিখেছেন বুর্জোয়া রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতরে থেকে বামপন্থী সরকার চালানো কত দূরূহ কাজ। বুঝেছেন ক্ষমতার উৎস কেন্দ্র, রাজ্যের ক্ষমতার সীমা। বড় বেশি কাছ থেকে দেখেছেন রাজনীতির নির্মম, কর্কশ দিক। নিজেদের সমালোচনার ঊর্ধ্বে কখনও মনে করেন নি। ‘ঘেরাও’ করার পদ্ধতিটা কি ঠিক ছিল? “না, ঠিক নয়” বসু জবাব দিলেন “ওটা এক ধরনের বাড়াবাড়ি ছিল, কি রাজনীতিতে, কি জীবনে বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় না দেওয়াই ভাল। এটা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের পদ্ধতি নয়।” রাইটাস বিল্ডিংস্ থেকে ঘর ঠাণ্ডা করার মেশিন খুলে নেওয়া? “কাজটা খারাপ না, তবে সেটাও একটু বাড়াবাড়িই করা হয়েছিল” বসু বললেন।

১৯৬৯ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি রাজ্যে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। জনসাধারণের প্রতি বসুর অগাধ আস্থা, বামপন্থী দলগুলি আবার ক্ষমতায় ফিরবে তাই আত্মবিশ্বাসে আবার ভোটের যুদ্ধে নামলেন। এবার লড়াইটা ছিল একটু অন্য রকমের, আগের মত ত্রিকোণ যুদ্ধ নয়, একেবারে সরাসরি লড়াই। যুক্তফ্রণ্ট আবার বিপুলভোটে জিতল। ২৮০টি আসনের মধ্যে ফ্রন্ট পেল ২১৮টি আসন। বসু বরানগর কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের অমরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে বিরাট মার্জিনে পরাজিত করে আবার জিতলেন। আবার তাঁর পার্টিও সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসন পেল—৮০টি, তবুও তাঁদের কেউ মুখ্যমন্ত্রী হতে পারলেন না, মূলত ফরওয়ার্ড ব্লক, সি. পি. আই. আর বাংলা কংগ্রেসের বিরোধিতার কারণে। বসু বিষয়টিকে অবশ্য তেমন গুরুত্ব দেন নি।— “আসলে একসঙ্গে কাজ করাটাই ছিল বড় কথা, তাহলে যুক্তফ্রন্টের ‘যুক্ত’ কথাটার মানেটাই তো থাকে না” বলেন বসু। ভেতরের কথাটা ছিল বাংলা কংগ্রেসের অজয় মুখার্জীকে মুখ্যমন্ত্রী না করলে বাংলা কংগ্রেস ফ্রন্ট ছেড়ে চলেই যেত, সঙ্গে নিয়ে যেত আরও চারজন সদস্য, ফলে ফ্রন্ট আর টিকত না। বসু দ্বিতীয়বার উপ-মুখ্যমন্ত্রী পদ গ্রহণ করতে অসম্মত হলেন না। ২৩শে ফ্রেব্রুয়ারি ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডে এক বিশাল জনসভায় বসু ভাষণ দিলেন। ২৫শে ফ্রেব্রুয়ারি দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার শপথ গ্রহণ করল। রাইটার্স বিল্ডিংস্ এবং রাজভবনের সামনে উচ্ছ্বসিত জনতার আনন্দধ্বনির মাঝে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এল। বিধানসভার প্রথম অধিবেশনে একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটল। ধরমবীরের অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আগেকার ফ্রণ্ট সরকার ভেঙে দেওয়ার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন একদল সদস্য। ধরমবীর ঢুকতেই স্লোগান আরও জোরদার হয়ে ওঠে, গোলমাল শুরু হয়, কংগ্রেস সদস্য আর ফ্রন্ট সদস্যদের মধ্যে জোর বিতর্ক শুরু হয়।

কিছুদিন পরেই ধরমবীরের জায়গায় রাজ্যপাল হয়ে আসেন শান্তিস্বরূপ ধাওয়ান। বসু আবার পুরোনো রুটিনে ফিরে যান—চাঁপদানিতে মার্চ মাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সামলাতে ছুটে যান। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার বিষয়ে তিনি বিশেষ চিন্তিত হয়ে পড়েন। ঐ মাসেই অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সাম্প্রদায়িক মৈত্রীর ওপর একটি বক্তৃতা দেন। বক্তৃতাটি শুনলে বোঝা যায় সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতপাতের ব্যাপারে বসুর বিদ্বেষ কতটা আন্তরিক ছিল। যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে আবার নতুন কিছু করার উদ্যোগ নিল। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বসবার জন্য টুলের বদলে এল চেয়ার। সাধারণ মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেওয়ার জন্যই এইসব ব্যবস্থা নেওয়া হল। বসু নিলেন স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ভার। এ প্রসঙ্গে বসু বললেন : “আগে পুলিসকে সরকারের স্বার্থে ব্যবহার করা হত। আমি একেবারেই এই একপেশে নিয়মের পক্ষে ছিলাম না, কিন্তু পুরো সিস্টেমটা পালটানো নেহাত সহজ কাজ ছিল না।”

এই সময় এপ্রিল মাসে শহরে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায়। দক্ষিণ কলকাতায় লেকের কাছে রবীন্দ্র সরোবর ষ্টেডিয়ামে অশোককুমার নাইট নামে এক সান্ধ্য জলসার আসরে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। পুলিসকে আক্রমণ করা হয়, গ্রেনেড, বোমা চলে, ফলে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়, প্রায় পঞ্চাশজন লোক আহত হয়। গণমাধ্যমগুলি ঘটনার বিশদ বিবরণ দেয়, লেকের জলে মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে ইত্যাদি মিথ্যা বিবরণও ছাপা হয়। রাজনারায়ণ, সে সময়কার এক পাগলাটে রাজনীতিক দুম্ করে একটা সরকারি বিবৃতিই দিয়ে ফেললেন। বললেন— ট্রাকভর্তি মেয়েদের জামাকাপড় পাওয়া গেছে। বসু সে সময় দিল্লীতে। জনসংঘের একজন সুসজ্জিত মহিলা বসুর সঙ্গে দেখা করে ঐ ঘটনা সম্পর্কে একটি অভিযোগপত্র পেশ করেন। বসু পরে রাজনারায়ণকে বলেছিলেন, “আপনি হঠাৎ এরকম মিথ্যা বিবৃতি দিলেন কেন?”—উত্তরে রাজনারায়ণ বলেছিলেন, বসু জানালেন, “আমি শুনেছিলাম ঐ রকম একটা ঘটনা ঘটেছে, তাই”, বসু বলেছিলেন “শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে আপনি ঐ রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে দিলেন!”

যাইহোক যুক্তফ্রন্ট সরকার ঐ ঘটনা সম্পর্কে বিচারবিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেয়। এদিকে কংগ্রেস কেন্দ্রের মদতে যুক্তফ্রন্টকে উচ্ছেদ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। বলা হয় যুক্তফ্রন্ট সরকারী প্রশাসনযন্ত্রের অপব্যবহার করছে। নানাভাবে কেন্দ্র- বিরোধি বিদ্বেষের আগুন উসকে দিতে থাকে। ৮ই এপ্রিল আবার আর এক দুর্ঘটনা ঘটে। নিরাপত্তারক্ষীবাহিনীর গুলিতে কাশীপুর বন্দুক কারখানায় চারজন কর্মী মারা যায়, আহত হয় ষোলজন। দোষীদের শাস্তি দেওয়ার এক্তিয়ার নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে গোলমাল লেগে যায়। বসু সরেজমিনে কারখানা ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন, দোষীদের আটক করার আদেশও দেন কিন্তু কেন্দ্র তাতে বাধা দেয়। ফ্রন্টের সদস্যরা বসুর সিদ্ধান্তের সমর্থনে ও ঐ ঘটনার প্রতিবাদে ১০ই এপ্রিল এক ‘বন্ধ’ ডাকে। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে চাপান-উতোর চলতেই থাকে। অর্থ, অনুদান দেওয়ার ব্যাপারে, বরাদ্দ কোটার ব্যাপারে কেন্দ্র নানারকম টালবাহানা করতেই থাকে। এ প্রসঙ্গে বসু জানালেন—”ঐ সময় কেন্দ্র একটা বিষয়েও আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেনি। কোনও প্রোজেক্টই রূপায়িত করতে দেয়নি, হলদিয়া প্রকল্প, সাঁওতালডিহি বিদ্যুৎ প্রকল্প, এমন কি মেট্রো রেল—একটার পর একটা প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।” বলা হল মেট্রো রেল কলকাতায় হবে না, কলকাতার মাটি বেশি নরম। “লেনিনগ্রাদে তাহলে কি করে সম্ভব হল?”—বসু শুধিয়েছিলেন, “এর কোনও সন্তোষজনক উত্তর ছিল না, প্রস্তাবটা শেষমেশ আটকে দেওয়া হল।” পরে যখন সিদ্ধার্থশংকর রায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে বুঝিয়েছিলেন এই ‘প্রজেক্ট স্যাংশন’ করলে ‘রাজনৈতিক ফায়দা’ তোলা সম্ভব হবে।

দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের প্রথম কয়েক মাস চলে গেল কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্ক ঠিক করতে। তাছাড়া ছিল আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার সমস্যা, পুলিসি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং সর্বোপরি নকশাল আন্দোলন দমন করা। নকশাল আর মার্কসবাদীদের মধ্যে তুলকালাম যুদ্ধ লেগে থাকত প্রায়ই কলকাতার রাস্তায়। যখন তখন চলত এলাকাজুড়ে সার্চ। পুলিশ ঘিরে ফেলত সম্ভাব্য বিপজ্জনক এলাকা, নকশাল সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হত বাড়ির অল্পবয়সী ছেলেদের। নকশালদের হিংস্রতাও উঠেছিল চরমে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় চলত তাদের বোমাবর্ষণ, যানবাহন বন্ধ হয়ে যেত কখনও কখনও। কলেজ স্ট্রীটে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর হয়ে উঠেছিল ছোটখাটো যুদ্ধক্ষেত্রের মত। জুন আর জুলাই মাসে কলেজগুলিতে ক্লাস নেওয়াও ব্যাহত হতে শুরু করে। এই সময় বসু কঠিন হাতে, অসীম সাহসের সঙ্গে অবস্থার মোকাবিলা করেন। একটা ঘটনার উল্লেখ করা যাক। একবার ভরতগড়ে পুলিসবাহিনীর কাজের সময় এক পুলিস কনস্টেবল নিহত হয়। ৩১শে জুলাই এই ঘটনার প্রতিবাদে পুলিশবাহিনী এক মিছিল বার করে। তারা আলিপুর থানা তছনছ করে, তারপর বিধানসভার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সেখানে গিয়ে তারা তাণ্ডব শুরু করে দেয়। চেয়ার টেবিল ভাঙে, পর্দা ছিঁড়ে ফেলে, মাইক ভেঙে দেয়, দরকারী কাগজপত্র টুকরো টুকরো করে দেয়। বোঝাই যাচ্ছিল, মিছিলকারীদের উদ্দেশ্য ছিল অন্য, নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর অবশ্য শারীরিক অত্যাচার করে তারা ঢুকে পড়ে স্পীকার বিজয় ব্যানার্জীর ঘরে। বিজয় ব্যানার্জী জানলা দিয়ে পালিয়ে যান। এরপর তারা গিয়ে ঢোকে জ্যোতি বসুর ঘরে। উন্মত্ত পুলিসের দল ঘরে ঢুকতেই বসুর রক্ষী তৎপর হয়ে ওঠে। “দাঁড়াও, গুলি ছুঁড়ো না”—বসু বলে ওঠেন। তারপর সেই দাঙ্গাবাজদের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠেন “দাঁড়াও, আর এক পা এগোবে না, এখানে কেন এসেছ? কি চাই তোমাদের? এই কি প্রতিবাদ জানাবার উপায়? তোমরা নিজেরা না পুলিস? তোমাদের সাহসের দৌড় আমার জানা আছে—আমি তোমাদের শিক্ষা দেবার জন্য আমার লোক পাঠাব?”—আক্রমণকারীরা বসুর নির্ঘোষে হতবাক হয়ে যায়। একজন বসুর পায়ে পড়ে। “ভুল হয়ে গেছে স্যার, আমরা একটু ক্ষেপে গিয়েছিলাম”–বলে আর একজন। বসুর কথার সুর নরম হয়, উন্মত্ত পুলিসের দল শান্তভাবে বসুর ঘর ছেড়ে চলে যায়। পরে বসু জেনেছিলেন ঐ দলটিকে প্ররোচিত করে বসুর ঘর দেখিয়ে দিয়েছিলেন কংগ্রেসের এক মহিলা সদস্য। প্রমাণস্বরূপ তিনি এই ঘটনার একটি আলোকচিত্রও পেয়েছিলেন।

ইতিমধ্যে ফ্রন্টের ঐক্য ক্রমশ দুর্বল হতে আরম্ভ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মুখ্যমন্ত্রী ও উপমুখ্যমন্ত্রী অর্থাৎ অজয় মুখার্জী এবং জ্যোতি বসুর মধ্যে নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রথমে মন কষাকষি, তারপর বিবাদবিতর্ক। পরবর্তী পর্যায়ে দু’তরফের মধ্যে কড়া চিঠি চালাচালি। শেষ পর্যন্ত প্রায় কথা বন্ধ, চিঠি লিখে কাজ চালানো। চিঠিতে পরস্পরের প্রতি তীব্র আক্রমণ। একবার মালদহের গাজোল থানার এক অফিসারের বদলিকে কেন্দ্র করে তাঁদের বিবাদ তুঙ্গে ওঠে। মুখোমুখি কথা হয় না, কেউ কারো ঘরে যান না, চিঠিতেই তাঁদের ঝগড়া। এমনই এক পত্রাঘাতের কিছু অংশ : জ্যোতি বসু, উপমুখ্যমন্ত্রী লিখছেন মুখ্যমন্ত্রীকে, তারিখ ১২ জানুয়ারি ১৯৭০ কলকাতা।

“…প্রথাগত রীতি অনুযায়ী যুক্তফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়নি। আপনি খুব ভাল করেই জানেন কি পরিস্থিতিতে আপনাকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছিল। … সমানদের মধ্যে প্রথম’ এই কথাটা এখন আর বৈধ নয় আর এখন কথাটা খাটেও না। এখন কেউ অন্যের থেকে ‘বেশি সমান’ নয়। আপনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটা আপনি অন্যান্য সদস্যদের অভিমত এবং সব সদস্যদের সম্পূর্ণ সহমত ছাড়া কখনও নিতে পারেন না। আমি আপনাকে এই প্রসঙ্গে একবার প্রাক্তন রাজ্যপাল ধরমবীরের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে কি দুর্ভাগ্য হয়েছিল সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি।”…

জ্যোতি বসু। এই চিঠির উত্তরে অজয়বাবু কিছু মধু ঝরাননি। কিন্তু বসুর মাথায় তখন আগুন জ্বলছে। তিনি আবার লিখলেন :

২৪শে জানুয়ারি ১৯৭০
কলকাতা

‘প্রিয়’ অজয়বাবু

আপনার ২২শে জানুয়ারির চিঠি পেলাম। চিঠিটা ভুল ধারণা আর ভুল কথায় ভর্তি। মনে হচ্ছে আপনার ভ্রান্ত ধারণাগুলো এবার ঠিক করা দরকার। আপনি ‘আচরণবিধি’র উল্লেখ করেছেন। আমার মনে হয় কখনও কখনও আপনার নিয়মগুলো যদি নিজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেখান তো ভাল হয়!…আপনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংল্যাণ্ডে কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের উল্লেখ করেছেন। এর প্রাসঙ্গিকতাটা ঠিক বুঝলাম না। চার্চিল কি এইভাবে অন্য মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ, আলোচনা না করে তাঁদের কাজে হস্তক্ষেপ করতেন? তিনি কি তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে কথাই বলতেন না, চিঠির উত্তর দিতেন না, কেবল তাঁর মন্ত্রণাদাতাদের’ কথাই শুনতেন?

….আপনি আপনার চিঠিতে মিঃ ম্যাকমিলান এবং মিঃ উইলসন এই দুইজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কথা বলেছেন। অতদূরে যাবার প্রয়োজন নেই। স্বদেশেই দেখুন, এই তো সেদিন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর কয়েকজন ক্যাবিনেট সহকর্মীকে দপ্তর ছাড়া করেছিলেন। তাঁর প্রয়াত পিতাও এই কাজ কয়েকবার করেছেন। এতে কি প্রমাণিত হয়? এতে প্রমাণিত হয় যে যেখানে একটি পার্টি সরকার চালায় সেখানে পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর থাকলে এমন কাজ করা চলে। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের পরিস্থিতি অন্য রকম। ফ্রন্ট না ভেঙে আপনি কোনও মন্ত্রীকে সরিয়ে দিতে কখনই পারেন না—

…আপনি প্রায় আমাকে লিখছেন আমার সঙ্গে আলোচনা করতে আপনি প্রস্তুত। কিন্তু আমার প্রশ্ন, আপনি কি সত্যিই প্রস্তুত? আমি তো কবে থেকে বলে আসছি, আলোচনায় বসুন, সহমত করুন। আমি আবার বলছি, আমরা দেখা করি এবং সরকারের সমস্যার সমাধান বিষয়ে আলোচনায় বসি।….

জ্যোতি বসু।

অজয়বাবু ছিলেন অসম্ভব অনমনীয়। তিনি উত্তরে লিখলেন : …আপনি মুখ্যমন্ত্রীর স্টেটাস নিয়ে যে কথা আমাকে লিখেছেন সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই। আপনি আমাকে বলেছেন ‘আমি সংবিধানের অপব্যবহার করছি’, আমার হিটলারের কথা মনে পড়ছে, প্রতিটি যুদ্ধ আর আক্রমণের আগে হিটলার তাঁর ‘শিকার’কে বলতেন যুদ্ধোন্মাদ আর নিজেকে বলতেন ‘শান্তিকামী’। আক্রমণ করার আগে পোল্যাণ্ড, নরওয়ে, বেলজিয়াম, হল্যাণ্ড, ফ্রান্স এবং এমনকি ইউ এস এস আর-কেও বলা হয়েছিল ‘আক্রমণকারী দেশ”।

…কোনও মন্ত্রী বিশেষের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিপদ কোয়ালিশন সরকারে থেকেই থাকে। আর যদি সেই কোয়ালিশন তৈরি হয় ভিন্ন ভিন্ন মতের মানুষকে নিয়ে তাহলে সেই বিপদ বাস্তব আকার নেয়। পাইথন সাপের মত একটা পার্টি অন্য পার্টিগুলোকে গিলে না ফেলে, সেটা দেখতে হয়।

অজয় মুখার্জী।

চিঠিপত্রের এইরকম উত্তপ্ত আদান প্রদান চলতেই থাকে, শেষে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে সরকারের শেষ চার মাস দুজনের মধ্যে বাক্যালাপ বন্ধ হয়ে যায়। বিধানসভায় অজয় মুখার্জী হয়তো ভাষণ দিতে উঠলেন, তিনি সাধারণতঃ বেশ অনেকক্ষণ ধরে টানা একসুরে কথা বলতেন, বলার মধ্যে কোনও উদ্দীপনা ছিল না, সভায় সবাই চুপচাপ বসেই আছেন, অখণ্ড নীরবতা বিরাজ করছে। এক সময় ভাষণ শেষ হয়, বসু মন্তব্য করেন: “পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল।” একদিন অজয় মুখার্জী চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, “এ এক অসভ্য সরকার”, বসুর চট জলদি জবাব “এমন সভ্য সরকার ভূভারতে নেই।” বসুর ঘর ছিল অজয় মুখার্জীর পাশেই। কিন্তু চিঠিপত্রের মাধ্যমেই কথা চলত, সাক্ষাতে নয়। চিঠি দেওয়ার রেওয়াজটা শুরু করেছিলেন অজয় মুখার্জী। দুজনের মনকষাকষি প্রকাশ্যেই বোঝা যেত। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি রাজভবনে যখন মহম্মদ আমিন পরিবহণমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করলেন তখন দুজনেই উপস্থিত অথচ একটাও কথা নেই। আবার ৫ই ফেব্রুয়ারি যখন প্রধানমন্ত্রী কলকাতায় এলেন, দুজনেই গেলেন এয়ারপোর্টে। দুজনেই প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানালেন। একে অপরের সঙ্গে একটাও কথা বললেন না। রাজ্যপাল ধাওয়ান বসুকে বললেন, “আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে যাচ্ছি, আপনি যদি অনুগ্রহ করে আমার স্ত্রীকে রাজভবনে নামিয়ে দেন।” ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িতে কোনও ভয় নেই’—মন্তব্য করেন অজয় মুখার্জী। বসু গম্ভীর। কোন জবাব দেন না। মিসেস ধাওয়ানকে রাজভবনে নামিয়ে দেন।

মুখ্যমন্ত্রী নিজেই পরিস্থিতি আরও ঘোরালো করে তোলেন। ১৯৬৯ সালের পয়লা ডিসেম্বর কার্জন পার্কে তাঁবু খাটিয়ে তিনি অনশন শুরু করেন। কারণ—রাজ্যে তখন ‘জঙ্গলের রাজত্ব’ চলছে, চলছে ‘বর্বরের প্রশাসন’। নিজের প্রশাসনের বিরুদ্ধে নিজেই প্রতিবাদ করলেন—সে এক অদ্ভুত অবস্থা। সংসদীয় গণতন্ত্রে এই ধরনের ঘটনা সেই প্রথম। নিজের বক্তব্যের সমর্থনে বিধানসভায় কোনও তথ্যও তিনি দেন নি। এর ফল খুব খারাপ হল। সি. পি. আই. (এম)-বিরোধী সরকারি অফিসাররা সরকারের আদেশ নির্দেশ অমান্য করতে শুরু করল। আসল উদ্দেশ্য ছিল বসুর স্বরাষ্ট্র দপ্তর কব্‌জা করা। সে সময় দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি বাংলা কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একই সুরে বলতে লাগল—সি. পি. আই. (এম) ছাড়াই ফ্রণ্ট দিব্যি টিঁকে যাবে, এই মর্মে একটা বিবৃতিও দেওয়া হল।

এর উত্তর দিলেন কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) রাজ্য কমিটির সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত। তিনি ফ্রন্টের সব সদস্যদলের উদ্দেশ্যে লিখলেন :

আপনারা নিশ্চয় জানেন যে, আমাদের পার্টি প্রথম থেকেই বলে আসছে- যুক্তফ্রণ্ট চলুক এবং জনগণের নির্দেশ পালন করুক। এবং সময় সময় যে সব মতপার্থক্য ও সমস্যা দেখা দিচ্ছে তা যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরেই আলোচনার মধ্য দিয়ে মীমাংসা করা হোক’। “…কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহায়তায় সি. পি. আই. (এম)-কে বাদ দিয়ে মিনিফ্রন্ট সরকার গঠনের ব্যাপারে যে সব বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে আমরা দ্বিধাহীন কণ্ঠে তার নিন্দা করছি। কারণ আমরা মনে করি তা হবে জনগণের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা এবং তাদের নির্দেশ অমান্য করা। কিন্তু বাংলা কংগ্রেসের যুক্তফ্রন্ট পরিত্যাগ এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটানোর জন্য একতরফা সিদ্ধান্তের ফলে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে।” ২

অথচ ঘটনাটা ছিল অন্য রকম। বাংলা কংগ্রেস ছাড়াই ফ্রন্ট টিঁকে যেতো। কিন্তু দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক, আর এস. ইউ. সি. আই. সি. পি. আই. (এম)-এর ফ্রন্টে থাকতে অসম্মত হয়। ফলে ফ্রন্টের ঐক্যে বড় ফাটল ধরে, জোড়া লাগার আর কোনও উপায় থাকে না। ১৬ই মার্চ ১৯৭০ অজয় মুখার্জী পদত্যাগ করেন। পরের দিন সি. পি. আই. (এম)-এর শ্রমিক সংস্থা স্ট্রাইক ডাকে। বসু রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টিকে সরকার গড়তে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অনুরোধ করেন। অন্য পার্টিরা এই প্রস্তাবের জোর বিরোধিতা করেন। রাজ্যপাল তখন প্রেসিডেন্টের শাসন জারি করাই যুক্তিযুক্ত মনে করলেন। সেদিন তারিখটা ছিল ২১শে মার্চ। দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন হল মাত্র তের মাসের মাথায়। সি. পি. আই. (এম) রাষ্ট্রপতির শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করল। তারা চেয়েছিল বিধানসভা ভেঙে দিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচন করা হোক। ১৯৭১ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচন হল। “আমাদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না, কিন্তু ওদের ধ্যানধারণা ছিল অদ্ভুত। ফলে বারেবারেই কোয়ালিশন সরকার ভেঙে যেতে লাগল। প্রতিটি কোয়ালিশন সরকারই এক নতুন পরীক্ষা বৈকি—” মন্তব্য করেন বসু।

দিন পনের হল যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে গেছে। ৩১শে মার্চ ১৯৭০ সাল। বসু সবে পাটনা রেল স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমেছেন। তখন সকাল আটটা। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে লাল পতাকা, ফুলের মালা নিয়ে পার্টির লোক তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে। ‘বিহারে পার্টি কাজকর্ম বেশ ভালই করছে’, বসু মনে মনে ভাবলেন। কমরেডদের সঙ্গে বসু এগিয়ে চললেন বাইরের গেটের দিকে, কমরেডরা স্লোগান দিতে দিতে এগোতে থাকলেন। হঠাৎ কি যেন ঘটে গেল। বসু দেখলেন তাঁর বাঁ পাশ দিয়ে এক ঝলক আগুনের মত কি ছিটকে বেরিয়ে গেল। কি ঘটল তা বোঝার আগেই দেখলেন তাঁর পাশে যে কমরেড হাঁটছিলেন তিনি মাটিতে পড়ে ছটফট করছেন, চারিদিকে চাপ চাপ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে বসু বুঝলেন কি ঘটে গেল। একচুলের জন্য আততায়ীর গুলি থেকে বেঁচে গেছেন তিনি আর আততায়ীর লক্ষ্য ব্যর্থ হওয়ায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তাঁর পাশের কমরেড। সকলের সঙ্গে বসুও চিৎকার করে ওঠেন ‘ধর, ধর’। কোনও লাভ হয় না। ঘন ভিড়ের মধ্যে আততায়ী গা ঢাকা দেয়।

যিনি মারা গেলেন, তাঁর নাম আলি ইমাম। লাইফ ইনসিওর‍্যান্স কোম্পানির কাজ করতেন। এই ঘটনার কিছুদিন আগেই ই. এম. এস. নাম্বুদিরিপাদ ইমামের পাটনার বাড়িতে কয়েকদিন থেকে ছিলেন। কথা ছিল বসুও সেদিন ইমামের বাড়িতেই দুপুরের খাওয়া সারবেন। ইমামের একটি মেয়ে আর একটি ছেলে, স্ত্রী বছর দুয়েক আগেই গত হয়েছেন। ইমামের মেয়ে শিরিন ইমাম (বর্তমানে বিয়ের পর শিরিন কুমার) এখন বাঙ্গালোরে থাকে, স্বামী এয়ারফোর্সের অফিসার। সে চিঠিতে আমাকে জানিয়েছিল তার জীবনের সেই দুর্ঘটনার কথা। “প্রায় আটটা দশ নাগাদ ঘটনাটা ঘটেছিল। ফার্স্টক্লাস বুকিং ঘরের প্রায় কাছাকাছি। বাবার বুকে গুলি লেগেছিল একেবারে সরাসরি, বাবা সেইখানেই মারা গিয়েছিলেন। ‘বাসু আংকল’-এর আমাদের বাড়ি এসে খাওয়ার কথা ছিল। আমাদের তন্দুরি চিকেন রান্না হয়েছিল, আর হালকা বিরিয়ানি। কিন্তু সব ওলটপালট হয়ে গেল। শহরটা থমথম করতে লাগল। ‘বাসু আংকল’ আমাদের বাড়ি এলেন, আমাদের কত সান্ত্বনা দিলেন। আর কিছু তখন মনে নেই। কিন্তু পরে বহুবার ‘কমল আন্টি’ আর ‘বাসু আংকল’ আমাদের খোঁজখবর নিয়েছেন, কত সাহায্য করেছেন, আমাদের ক্ষতে প্রলেপ লাগাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। ওঁদের পরিবারের সমব্যথী মনের পরিচয় পেয়েছি অনেকবার। আমি একসময় কোলকাতায় লোরেটোতে পড়তাম, তখনও ওঁরা আমার খোঁজখবর রাখতেন, দেখাশোনাও করতেন।”

এই ঘটনার কথা পাটনা শহরে ছড়িয়ে পড়তেই শহরের চেহারা পালটে গেল। দোকানপাট প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। আবহাওয়া হয়ে উঠল থমথমে। বিশ হাজার লোক মিছিল করে বিহার বিধানসভার সামনে দাঁড়িয়ে এই ঘটনার প্রতিবাদে স্লোগান দিতে লাগল। সন্ধ্যেবেলা বসু পাটনায় এক জনসমাবেশে বক্তৃতা দিলেন। সাংবাদিকরা বসুকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি কাউকে সন্দেহ করেন কিনা, বসু বললেন, “আমি কোনও ব্যক্তিবিশেষকে সন্দেহ করি না, কারণ আমার সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই।” পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের খবর অনুযায়ী জানা যায়, বসুকে হত্যার চেষ্টার পেছনে আনন্দমার্গীদের হাত ছিল।

এদিকে কলকাতায় খবরটা আসতেই জনজীবন অচল হয়ে পড়ে। ট্রামবাস, অন্যান্য যানবাহন বন্ধ হয়ে যায়। কলকাতায় মিছিলের পর মিছিল বেরোতে থাকে। দিল্লী থেকে ইন্দিরা গান্ধী টেলিফোন করেন, অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারাও বাইরে থেকে টেলিফোন করে বসুর কুশল জিজ্ঞাসা করেন। বসুর নিজের বিধানসভা নির্বাচনী কেন্দ্র বরানগরে শ্রমিকরা ধর্মঘট ডাকে। শহরের ব্যস্ততম জায়গা ডালহৌসি স্কোয়ার আচমকা নির্জন, নিস্তব্ধ হয়ে যায়। পার্টি অফিসের সামনে তখন বিরাট ভিড়, লোকজন ঠেলাঠেলি করছে, প্রত্যেকেই জানতে চায় বসু কেমন আছেন।

এদিকে বাড়ির অবস্থা আরও খারাপ। স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন, শ্যালিকা মঞ্জুলা রায় সবাই শুনছেন বসুর কি হয়েছে, হাওয়ায় যেন খারাপ সংবাদ ভাসছে, অথচ সঠিক, সুস্পষ্ট কিছুই জানা যাচ্ছে না। মঞ্জুলা রায় বললেন, “লোকমুখে শোনার পর পার্টি অফিসে বোধহয় হাজারবার ফোন করেছি, হাজারবার ফোন করছি দিদির কাছে—কোনও খবর পাচ্ছি না, সব লাইন একটানা এনগেজড়, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, গলার কাছে কান্না ডেলা পাকিয়ে উঠছে—যখন বহুক্ষণ বাদে খবর পেলাম, জামাইবাবু ভাল আছেন, কোনও ক্ষতি হয়নি—ঝরঝর করে আমার চোখ দিয়ে তখন জল পড়তে লাগল।” বসুর স্ত্রীও খবর শুনেছিলেন—উনি ভাল আছেন তবুও উদ্বেগে আশংকায় মনটা অস্থির হয়েছিল। কিন্তু তাঁর মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এইভাবে কখনও তাঁর স্বামীর জীবন শেষ হবে না, ‘হতে পারে না’। পাটনা যাবার আগে বসুর পকেটে তিনি দিয়ে দিয়েছিলেন—পণ্ডিচেরীর মাদার-এর প্রসাদী ফুল। বসু সে সব একেবারেই মানেন না, কিন্তু স্ত্রীর মনে দুঃখ দিতেও মন চায় না, পকেটে সেই ফুল ছিল। স্ত্রী ও শ্যালিকা দুজনেরই বিশ্বাস ঈশ্বরই তাঁকে রক্ষা করেছেন। যদিও বসু হাসতে হাসতে বার বার বলেন “তোমরা ওসবে বিশ্বাস কর, তাই তোমাদের কাজ হয়, আমার বিশ্বাস নেই। আমার কাজ হবে কি করে?”

“আসলে সাধারণ মানুষ আমাদের সঙ্গে ছিল”, বসু বললেন, “বোঝাই যাচ্ছিল কংগ্রেস আর আমাদের বিরোধী দলরা তাদের ওপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি।” পয়লা এপ্রিল শহীদ মিনারে এক বিপুল জনসমাবেশে বসু বার বার একটা কথাই বলেছিলেন “মানুষের ভালবাসার থেকে বড় কিছু নেই, জীবনটা মানুষের স্বার্থে বিসর্জন দিলে সার্থক হয়।” এই সভা থেকে ফেরার সময় বসুর মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল—”এই এত মানুষ আমাদের সঙ্গে রয়েছে, আর বেশি কি চাই!” ভয়ডর কাকে বলে বসু জানতেন না। জীবনের মায়া তেমন ছিল না। আত্মরক্ষার স্বাভাবিক চেষ্টা ছিল, বাড়াবাড়ি ছিল না। অনেকবার তাঁর ওপরে শারীরিক আক্রমণের প্রচেষ্টা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর ওপর দু-দু’বার আক্রমণ হয়। একবার আমডাঙায় সভা করে কমরেড বদরুদ্দাজার সঙ্গে ফেরার সময় তাঁর গাড়ির ওপর বোমা পড়ে। অল্পের জন্য বসু বেঁচে যান। আবার একদিন বসিরহাটের কাছাকাছি সভায় যাবার সময় তাঁর গাড়িতে তিনটে বোমা মারা হয়। সঙ্গে ছিলেন আবদুল্লাহ রসুল এবং শান্তিময় ঘোষ। সেবারও কানঘেঁষে বোমা ফেটেছিল। আর একবার বারুইপুরে জ্যোতির্ময় বসুর সঙ্গে এক সভায় যাচ্ছিলেন। কংগ্রেসি গুণ্ডারা সেখানে মাইকের তার কেটে দেয়, সভা পণ্ড করে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। বসু পার্টির ভলান্টিয়ারদের শান্ত থাকতে আদেশ দেন। গাড়িতে যেই উঠে বসেন, একদল গুণ্ডা গাড়ির ওপর হামলা শুরু করে, পুলিশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। জ্যোতিময় বসু আহত হন। “আশ্চর্যের ব্যাপার”, বসু বললেন, “সিদ্ধার্থ (সিদ্ধার্থশংকর রায়) করল কি, পুলিশকে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে বলল, দুটো ছেলেকে আমাদের গাড়ি ধাক্কা দিয়েছে, তারা আহতও হয়েছে। শুধু তাই নয়, দুটো ছেলেকে ফল্স ব্যাণ্ডেজ লাগিয়ে থানায় পাঠানোও হল।”

“এইসব আক্রমণগুলো আর কিছুই নয়”, বসু মন্তব্য করেন, “প্ল্যান করে ফ্যাসিস্ট কায়দায় সি. পি. আই. (এম)-কে কোণঠাসা করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা।”

চরম অস্থিরতার পটভূমিতেই অনুষ্ঠিত হল ১৯৭১ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচন। ৯ই মার্চ। সি. পি. আই. (এম) কর্মীদের ওপর তখন চলছে অকথ্য অত্যাচার। বসুর নির্বাচনী কেন্দ্র বরানগরেও একই অবস্থা। ভোটারদের ভয় দেখিয়ে বুথে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। বিরোধী দল, নকশালপন্থী সবাই চাইছে ভোটটা পণ্ড হোক। শেষ পর্যন্ত মিলিটারি দিয়ে জায়গাটা ঘেরাতে হল এবং বসু কেবলমাত্র নির্বাচনী প্রচারের শেষদিন সেখানে যেতে পারলেন। তার আগে এই হানাহানিতে সত্তরজন পার্টিকমরেড নিহত হয়েছেন। অন্যান্য দলেও হিংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু হয়েছে। আকস্মিকভাবে একদিন উত্তর কলকাতায় টাউন স্কুলের সামনে নৃশংসভাবে ভাড়া করা আততায়ীর হাতে নিহত হলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রবীণ নেতা হেমন্ত বসু। “আমরা খুবই বিস্মিত এবং মর্মাহত হয়েছিলাম এই দুঃখজনক ঘটনায়”, বসু বললেন “বলা হল আমাদের দল তাঁকে হত্যা করেছে, এটা একটা অসম্ভব মিথ্যা অভিযোগ, তিনি আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় প্রবীণ নেতা ছিলেন, তাঁর সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত কোনও বিরোধ ছিল না। আমরা একসঙ্গে গণ-আন্দোলন করেছি, আসলে এই হত্যা করা হয়েছিল আমাদের দোষারোপ করার জন্যই—আমাদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য এটা একটা চক্রান্ত ছিল, আর এই সব কাজে মদত ছিল দিল্লীর।”

প্রমোদ দাশগুপ্ত পার্টির পক্ষ থেকে এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান। বসু হেমন্ত বসুকে দীর্ঘদিন ধরে জানতেন কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁর মরদেহে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে একটি ফুলের মালাও দিতে দেওয়া হয়নি। এমনকি তাঁর শোকসভাতেও বসুকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

প্রসঙ্গত বসু ভারতে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ডেনিয়েল প্যাট্রিক মইনিহান -এর উল্লেখ করলেন। এ বইটিতে মইনিহান স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন, সি. আই. এ কংগ্রেসকে দু’বার টাকা দিয়েছিল, দু’বারই কমিউনিস্টদের খর্ব করার জন্য, একবার কেরালায়, আর একবার পশ্চিমবঙ্গে। দ্বিতীয়বার টাকাটা দেওয়া হয়েছিল স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীকে, তিনি তখন একজন ‘পার্টির বড় কর্মী।

নির্বাচনের সময় যথেষ্ট গোলমাল হওয়া সত্ত্বেও ফলাফল বের হবার পর দেখা গেল সি. পি. আই. (এম) বিধানসভায় ১১৩টি আসন জিতেছে। আগে তাদের ছিল ৮০টি আসন। বসু তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী অজয় মুখার্জিকে সরাসরি ১১হাজার ৫৩ ভোটের মার্জিনে হারিয়ে দিলেন। সংযুক্ত বাম ফ্রন্টের নেতা নির্বাচিত হলেন এবং রাজ্যপালকে চিঠি লিখে নতুন সরকার গঠন করার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অনুরোধ করলেন। পার্টির রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত ও সংযুক্ত বামপন্থী ফ্রন্ট এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে সরকার গঠনের দাবিও জানালেন। কিন্তু রাজ্যপাল কিছুতেই সম্মত হলেন না। বসু তাঁকে আবার চিঠি লিখলেন :

“…আমার চিঠির যে জবাব আপনি দিয়েছেন তা পেয়েছি। কেন্দ্রে কংগ্রেসের বিরাট সাফল্যের পটভূমিকায় আপনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় বৃহত্তম দল সি. পি. আই. (এম) এবং ব্লক সংযুক্ত বামপন্থী ফ্রন্টের সরকার গঠনের দাবি সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তের কথা আপনার চিঠিতে জানিয়েছেন, তাতে কেউ বিস্মিত হন নি। যদিও এটা সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক বিপজ্জনক।…আপনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে যদি রাষ্ট্রপতির শাসন না থাকত তবে প্রধান দলকে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখানোর সুযোগ দেওয়া যেত। এই যুক্তি অসময়োচিত, অযৌক্তিক, শিশুসুলভ।”“

এই চিঠি দিয়েও কোন লাভ হল না। কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের মদতে আবার এক কোয়ালিশন সরকার গড়া হল—সরকারে রইল কংগ্রেস, সি. পি. আই. এবং সি. পি. আই. (এম)-বিরোধী অন্যান্য দল। অজয় মুখার্জীর বাংলা কংগ্রেস পেয়েছিল মোট ২৮০টি আসনের মধ্যে মাত্র ৫টি। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলা কংগ্রেসের সেই অজয় মুখার্জীকেই আবার মুখ্যমন্ত্রী করা হল। নির্বাচনী রাজনীতি তখন দুঃসহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বসু বললেন, “এর ব্লু প্রিন্ট করা হত দিল্লীতে, ইন্দিরা গান্ধী আর তাঁর মন্ত্রণাদাতারা এই সব সিদ্ধান্ত নিতেন।”

মে মাসের ৩ তারিখে বিধানসভার অধিবেশন বসল। স্পীকার নির্বাচনের আগে বসু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তাঁর দলের দুজন বিনয় কোঙার এবং এস. ইউ. সি. আই-এর রবীন মণ্ডলকে ছেড়ে না দিলে তাঁরা ভোট দেবেন কি করে। সুবোধ ব্যানার্জি, অন্য একজন সদস্য বসুকে সমর্থন করলেন। অজয়বাবু বললেন, “কোর্টই একমাত্র বন্দীকে মুক্তি দিতে পারে, সরকার এ ব্যাপারে কিছু করতে পারবে না।” বসু জবাবে বললেন, “তাহলে ২৩শে এপ্রিল শপথ গ্রহণের সময় তাঁদের এখানে কি করে আনা হয়েছিল।” এর উত্তর অজয়বাবুর কাছে ছিল না। তৎকালীন অ্যাডভোকেট জেনারেল বনমালী দাসের পরামর্শ নেওয়া হল—তিনি বললেন, এ বিষয়ে সরকারের কিছু করার এক্তিয়ার নেই। বসু প্রশ্ন তুললেন “তাহলে কি বলতে চান সরকার ২৩শে এপ্রিল বেআইনি কাজ করেছিল?” অজয় মুখার্জী বলেন “ব্যাপারটা অপ্রাসঙ্গিক।” বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। স্পীকার নির্বাচিত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বসু মুখার্জী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। ১৫ই মে ১৩২-১৪১ ভোটে সরকার পড়ে যায়। তবুও অবশ্য একক বৃহত্তম পার্টির নেতাকে সরকার গড়তে ডাকা হয় না।

আবার জারি করা হয় রাষ্ট্রপতির শাসন। শুরু হয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অন্ধকার যুগ। পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে রাজ্যে নিয়মশৃঙ্খলা বলে কিছু থাকে না, মৌলিক অধিকার সব রীতিমত খর্ব করা হয়, হিংসাত্মক কার্যকলাপ প্রতিদিন বাড়তে থাকে। এই সময়কার কথা মনে করে বসু বললেন,”কে বলে ভারতবর্ষ অহিংসার দেশ? —তখন সিদ্ধার্থ পশ্চিমবঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর লোক ছিল, আমরা যাতে একেবারে শেষ হয়ে যাই, সব চেষ্টাই সে তখন করেছিল।”

সিদ্ধার্থশংকর রায় ব্যক্তিগত জীবনে বসুর বন্ধু হলেও রাজনীতিতে বরাবরই পরম শত্রুর মত আচরণ করে এসেছেন। ১৯৬২ সালে ইন্দোচীন সীমান্ত সংঘর্ষের সময় বসু যখন নানাভাবে অসম্মানিত হচ্ছিলেন সেই সময় সিদ্ধার্থশংকর রায় কংগ্রেসের গুণগানে আর কমিউনিস্টদের নিন্দায় মুখর হয়েছিলেন। একদিন বসু উঠে দাঁড়িয়ে সিদ্ধার্থশংকর রায়ের ১৯৫৮ সালে লেখা ৭৮ পাতা কংগ্রেসবিরোধী সেই পুরোনো চিঠির অংশ বিশেষ পড়ে শুনিয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের ৭ই জুলাই সিদ্ধার্থশংকর রায় রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মহাকরণে এক সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন। বসু এবং হরেকৃষ্ণ কোঙার তাঁকে পার্টির পক্ষ থেকে পাঁচপাতার এক স্মারকলিপি দেন। এই স্মারকলিপিতে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল। তার মধ্যে কয়েকটি প্রশ্ন ছিল এইরকম :

…“এই খুনের (হেমন্ত বসু হত্যাকাণ্ডের) তথাকথিত রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য তদন্তের কি হল? পুলিসের কুকুর যা করতে পারেনি, খুনীরা আমাদের পার্টির লোক বলে ঘোষণা করে তরুণকান্তি ঘোষ ও আপনি সে কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। তেমনি, সে খুনের আধ ঘণ্টার মধ্যে জনৈক পদস্থ পুলিস অফিসার সাংবাদিকদের জানালেন যে, আমাদের পার্টি ঐ খুনের সাথে জড়িত বলে তিনি সন্দেহ করছেন, আর নিজেদের পার্টির অন্যতম নেতা নেপাল রায়কে কে হত্যা করেছে? উখড়া ও দমদমের অনুগত সংবাদপত্রগুলি এইসব আবিষ্কারগুলিকে প্রচার করেছিল। আপনার নির্বাচন প্রার্থীদের হত্যা করেছিল কে? বারাসতে যে আটটি যুবকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, সে খুনের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য নিযুক্ত বিচারপতি টি. পি. মুখার্জীকে ছুরিকাহত করেছিল কে? অজিত বিশ্বাস ও বিচারপতি কে এল রায়কে হত্যা করেছে কারা?”

ঐ একই দিনে শহীদ মিনারে এক সভায় বসু বলেন : “এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে কংগ্রেস আর তাদের রাজ্যপালদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না, তাই রাজ্যে সিদ্ধার্থশংকর রায়ের মত বিবেকহীন ব্যক্তিকে পাঠাচ্ছে, যারা এই রাজ্যে সব রকমের সর্বনাশের জন্য দায়ী।” ২৩শে জুলাই বসু দিল্লীতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে রাজ্যে তাড়াতাড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য অনুরোধ জানালেন। এদিকে রাজ্যে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে। পার্টির পলিটব্যুরোর পক্ষ থেকে বসু এবং হরকিষেণ সিং সুরজিৎ আবার প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনের জন্য অনুরোধ করেন। রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির জন্যও তাঁরা কেন্দ্রের কাছে দরবার করেন। ইন্দিরা গান্ধী কোনও ব্যাপারেই কোনও উচ্চবাচ্য করেন না। ৩১শে জানুয়ারি বসু ইন্দিরা গান্ধীর কাছে এক স্মারকলিপি নিয়ে দেখা করেন। বসু বলেন ‘আমি কংগ্রেসনেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে আসিনি, আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে এসেছি।” ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “না, আমি শুনেছি কমিউনিস্টরাই যত গোলমাল করছে।” “তাহলে সেটা প্রমাণ করুন” বসু বললেন “ওঁর মধ্যে কোন রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ছিল না, জনসাধারণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনও যাওয়া যায়?’

কিন্তু তখন ইন্দিরার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইন্দিরা আত্মবিশ্বাসে টগবগ করছেন। নির্বাচন হবে এই আশায় আশায় কেটে যায় ১৯৭১ সাল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *