৮. পার্লামেন্ট বিল্ডিংয়ে

“আমি জানি তুমি কী বলতে চাও, ড্যাডি।” পার্লামেন্ট বিল্ডিংয়ে ব্লেইনের অফিসে বসে আছে ম্যাথিল্ডা জ্যানিন।

“তাই নাকি, তুমি জানো?” জানতে চাইলেন ব্লেইন, “তাহলে চলো তোমার মুখ থেকেই শুনি।”

“প্রথমত, আঙুল তুলে বলল ম্যাথিল্ডা, “তুমি বলতে চাইছো যে ছেলে হিসেবে ডেভিড আব্রাহামস অসাধারণ; মেধাবী ছাত্র ছাড়াও বার্লিন অলিম্পিকস্ জেতা অ্যাথলেট। স্বভাবেও নম্র আর কৌতুকবোধও ভালো। সুদর্শন ছেলেটা তাই যে কোনো মেয়েরই আদর্শ স্বামী হবে। তারপর বলবে “কিন্তু” আর চেহারাটাও কঠিন করে ফেলবে।”

“আমি এসবই বলতে চাইছিলাম” অবাক হয়ে গেলেন ব্লেইন, “অল রাইট, এখন তাহলে বলছি “কিন্তু, প্লিজ কন্টিনিউ ম্যাটি।”

“কিন্তু বলবে যে ও ইহুদি। আর এবারে তোমার চেহারা আরো চিন্তান্বিত হয়ে যাবে।”

“ভেরি ওয়েল, তারপর?”

“মাই ডার্লিং ড্যাডি, এরপর হয়ত বলবে, আমাকে ভুল বুঝো না ম্যাটি, আমারও বেশ কয়কজন ইহুদি বন্ধু আছে।” মনে মনে হাসি পেলেও কিছু বললেন না ব্লেইন। তার এই ছোট মেয়েটার মাথায় বুদ্ধি কম হলেও কম তো ভালোবাসেন না!

“কিন্তু” তুমি হয়ত বলবে, মিক্সড ম্যারেজগুলো বেশ কঠিন হয় ম্যাটি।” বলে উঠল ম্যাথিল্ডা।

“ওহ, আমার মাথায় এত বুদ্ধি! তো এরপর তুমি কী বলবে?”

উত্তরে ম্যাথি বলল, “আমি তোমাকে বলব যে আমি গত এক বছর ধরে রাবির জ্যাকবের কাছ থেকে ইহুদি হবার মন্ত্র নিচ্ছি আর আগামী মাসেই ইহুদি হয়ে যাব।”

চোখ কুঁচকে তাকালেন ব্লেইন, “তুমি কিন্তু এর আগে আমার কাছ থেকে কখনো কিছু লুকাওনি ম্যাটি।”

“আমি মাকে বলেছি।”

 “ও আচ্ছা।

হাসছে ম্যাটি। ভাবছে ব্যাপারটা বুঝি খেলা, “তারপর তুমি বলবে কিন্তু ম্যাটি তুমি তো এখনো বাচ্চা একটা মেয়ে।”

 “আর তুমি বলবে, না আমি পরের জন্মদিনেই আঠারো হব।” উত্তর দিলেন ব্লেইন।

“তখন আবার গম্ভীর হয়ে বলবে, ডেভিডের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?”

আর তুমি বলবে, “ডেভিড এ বছরের শেষ থেকেই কোর্টনি মাইনিং অ্যান্ড ফিন্যান্সে যোগ দিয়ে বছরে দুই হাজার আয় শুরু করবে।”

“তুমি কীভাবে জানলে-” এবারে বিস্মিত হয়ে বাবার দিকে তাকাল ম্যাথিল্ডা, “ডেভিড তো শুধু আমাকে বলেছে।” আচমকাই থেমে গেল মেয়েটা। বুঝতে পেরেছে বাবার সোর্স কে। এমনি কিছু না বললেও সেনটেইন কোর্টনির সাথে বাবার সম্পর্ককে সে মোটেও পছন্দ করে না।

“তুমি কী ওকে ভালোবাসো ম্যাটি?”

“ইয়েস ড্যাডি; পাগলের মত।”

“আর এরই মাঝে মায়ের অনুমতিও পেয়ে গেছে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।”

অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ম্যাথিল্ডা। চুরুট হাতে নিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকালেন ব্লেইন, “ব্যাপারটা কিন্তু এত হালকাভাবে নেয়ার মত বিষয় নয়, ম্যাটি।”

“আমি নিচ্ছিও না। আমি ডেভিডকে দু’বছর ধরে চিনি।”

“আমি আরো সবসময় ভেবেছি তুমি হয়ত ক্যারিয়ার

“আমার ক্যারিয়ার হবে ডেভিডকে খুশি করা আর ওকে একগাদা ছেলেপুলে দেয়া ড্যাডি।”

চুরুটে আগুন ধরালেন ব্লেইন, ওয়েল, তোমার ডেভিডকে তাহলে আমার কাছে পাঠাও। আমি ওকে সাবধান করে দিব যে আমার ছোট্ট মেয়েটার খেয়াল না রাখলে ওর কপালে কী কী ঘটতে পারে।”

সাথে সাথে ডেস্কের এ পাড়ে এসে বাবার কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরল ম্যাথিল্ডা, “তোমার মত এত ভালো বাবা আর কারো নেই।”

***

বিয়েতে যোগ দেয়ার জন্য র‍্যাপিড নিয়ে উইন্ডহকে গিয়ে অ্যাবি আব্রাহামস আর তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এল শাসা আর ডেভিড। বাকি আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুরা এল ট্রেনে।

 রিসেপশন পার্টিতে তারা ম্যালকম্‌সের সাথে তেতো হয়ে যাওয়া সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ পেয়ে গেল শাসা। বার্লিন অলিম্পিকস’র পর থেকে গত দুই বছরে তাদের সম্পর্ক যেন এই রোদ এই বৃষ্টির মতন হয়ে আছে। প্রায় প্রতিটি বিষয়েই দু’জন পরস্পরের বিরুদ্ধে মত দেয়।

তারার চোখে সুবিধাবাদী শ্বেতাঙ্গ শাসক শ্রেণির ধনীর দুলালেরা খুবই বিরক্তকর। কারণ যখন হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে অপুষ্টিতে ভোগে তখন সেসব ধনীর ছেলেরা পোলো খেলে, টাইগার মথ প্লেন চালায়। শক্তিশালী রাইফেল দিয়ে বন্যপশু মেরে ফেলার মাঝেও কোনো “স্পোর্টসম্যানশিপ” খুঁজে পায় না তারা।

অন্যদিকে, শাসা ভেবেই পায় না যে দেবীর মত রূপ নিয়ে একটা তরুণী মেয়ে কেমন করে দিন-রাত বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। কিংবা শহরতলীর বস্তিতে ঘুরে বেড়ায়। এদিকে আবার মেডিক্যালের বলশেঙ্কি স্টুডেন্টগুলোকেও তার ঘোরতর অপছন্দ। কারণ ডিসেন্ট্রি, টিউবার কিউলোসিস, সিফিলিস রোগীদের মাঝে এদের সাথেই নার্স হিসেবে স্বেচ্ছা সেবকের কাজ করে তারা।

আসিসির সাধু ফ্রান্সিস ভাগ্যবান যে তখন তুমি ছিলে না। নয়তো দু’জনে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যেতে।” ঠাট্টা করে বসে শাসা।

তবে এসব তো কিছুই নয়। সত্যিকারে ঝামেলা বাধে যখন তারা ম্যালকমসের সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে শাসা, “ঈশ্বরের দোহাই তারা, এটা বিংশ শতাব্দী। রানি ভিক্টোরিয়াও সেই সাইত্রিশ বছর আগে মারা গেছেন।”

 “ইতিহাস শিক্ষা দেয়ার জন্য ধন্যবাদ শাসা কোর্টনি। কিন্তু আর একবার যদি তুমি আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করো তাহলে কিন্তু তোমার হাত ভেঙে তিন টুকরো করে দিব, বলে দিলাম।”

“নিজেকে তুমি এত স্পেশাল ভাবো কেন হ্যাঁ? আরো কত সুন্দর মেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে”

 “তো ঠিক আছে। ওদের দিকেই মনোযোগ দাও। আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে কেন?”

“আজ পুরো সন্ধ্যায় এই একটাই ভালো কথা বললে।”

শীতল এক ধরনের ক্রোধমাখা কণ্ঠে কথাগুলো বলেই নিজের জাগুয়ার স্পোর্টস কার চালিয়ে নিয়ে এসেছে শাসা। থামল এসে ম্যালকম গৃহের জোড়া সদর দরজার সামনে।

“আমার জন্য দরজা খুলে দেয়ার কোনো দরকার নেই।” সমান মাত্রায় শীতল কণ্ঠে জানিয়ে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল তারা। যাওয়ার আগে এত জোরে ঠাশ করে দরজা বন্ধ করল যে জ কুঁচকে ফেলল শাসা।

এটাও প্রায় দু’মাস আগের ঘটনা। তারপর থেকে অবশ্য এমন একটা দিনও যায়নি যে শাসা মেয়েটার কথা ভাবেনি।

গরমে ঘামতে ঘামতে হানি মাইনে কাজ করা কিংবা অরেঞ্জ নদীর ওপর দিয়ে যাওয়ার সময়ে বিনা নোটিশে আচমকাই মনে পড়ে যেত তারার চেহারা।

 কালাহারির ওপর দিয়ে টাইগার মথ চালিয়ে মেয়েটার স্মৃতি ভুলতে চাইলেও কোনো লাভ হত না। মরুভূমির বন্যতায় সিংহ শিকার কিংবা কোর্টনি কোম্পানির হিসাব মেলাবার সময়েও অমোঘ একটানে যেন বারবার ভেসে উঠত তারার স্মৃতি।

এবার ওর বোনের বিয়েতে এসে দেখা গেল যে হেয়ার স্টাইল বদলে ফেলেছে তারা। একেবারে খাটো করে ফেলায় উক্ত হয়ে গেছে নগ্ন ঘাড়। তাতে যেন আরো বেড়ে গেছে ওর উচ্চতা আর দৈহিক সৌন্দর্য।

এক মুহূর্তের জন্য শাসার সাথে তারার চোখাচোখি হতেই মনে হল যেন জ্বলে উঠল মেয়েটার চোখ। বোঝা গেল সেও শাসাকে মিস্ করেছে। যদিও হালকাভাবে একবার মাথা নেড়েই সাথে সাথে পাশের ছেলেটার সাথে কথা বলায় মগ্ন হয়ে গেল তারা।

হিউবার্ট ল্যাংলি নামের এই ছেলেটাকে শাসা আগেও একবার দেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সোসিওলজির লেকচারার হিউবার্ট সম্পর্কে তারা নিজেই একবার শাসার কাছে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিল, “ও কমুউনিস্ট পার্টির সদস্য, মজা না বলো? আর এত বুদ্ধিমান যে কী বলব!”

এখন বিয়ের আসরে হিউবার্ট তার বদসুরৎ হাতটা তারার মসৃণ বাহুতে রেখে গোলাপি কানের কাছে কী যেন ফিসফিস করছে দেখেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল শাসা। মনে মনে সিদ্ধান্তে নিল যে হিউবার্টের গলাটা টিপে ধরতে পারলেই ও সবচেয়ে বেশি শান্তি পাবে।

লম্বা লম্বা পা ফেলে তারার দিকে এগিয়ে গেল শাসা। ঠাণ্ডা চোখে তাকালেও তারা নিজের হৃৎপিণ্ড যেন খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আজ শাসাকে দেখার আগপর্যন্ত বুঝতেই পারেনি যে ওকে এতদিন কতটা মিস্ করেছে।

মনে মনে নিজেকে সাবধান করে দিয়ে শাসার সামনে নত না হবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে বসে রইল তারা। কিন্তু ওর পাশের চেয়ারে বসা শাসাও ভালোভাবেই জানে কীভাবে মেয়েটার মান ভাঙাতে হয়। তাই দেখা গেল একটু পরেই হিউবার্টের পাশ থেকে একসাথে হাসতে হাসতে উঠে এল তারা আর শাসা।

 ওদিকে ব্যালকনি থেকে বড় বোনকে দেখতে পেয়েই নিজের হাতের ফুলের তোড়া ছুঁড়ে মারল ম্যাথিল্ডা জ্যানিন। তারা কিন্তু তোড়াটা ধরার কোনো চেষ্টাই করল না। তবে শাসা ঠিক সময়ে লুফে নিয়ে মাথা নত করে সম্মান দেখানোর মত তারার হাতে তুলে দিল তোড়াটা আর সাথে সাথে হাততালি দিয়ে উঠল অন্যান্য অতিথি।

 পুরনো মরিসের পেছনে একগাদা ছেঁড়া জুতা আর টিনের ক্যানের গোছ নিয়ে ডেভিড আর ম্যাটি চলে যেতেই নিজের জাগুয়ারে চড়িয়ে তারাকেও বাইরে নিয়ে এল শাসা। হাউট বের কাছে চূড়ায় উঠে বন্ধ করল ইঞ্জিন। শান্ত সবুজ আটলান্টিকের জলে কমলা আর লালের মিশেল নিয়ে আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে সূর্য। অবশেষে বরফ গলল। তারা আর শাসার আবার ভাব হল।

এমনকি কোমর থেকে উপরে আর নিচে নিজের দেহকে দুভাগে বিভক্ত করে রাখলেও ভোরবেলা সদর দরজায় দীর্ঘ এক চুম্বনের পর শাসাকে ছাড়তে তারার খুব কষ্ট হল। যদিও কোমরের উর্ধাংশ পর্যন্তই শাসার স্পর্শাধিকার আছে।

 পুরো চার মাস স্থায়ী হল দু’জনের সম্পর্কের এই সাম্প্রতিকতম মধুর অবস্থা। বলা যায় নতুন রেকর্ডই হয়ে গেল। তাই সাবধানে সবকিছু মেলাবার পরে শাসার সিদ্ধান্ত হল, “এই মেয়েকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।” অতএব সরাসরি তারা ম্যালকমসূকে প্রস্তাব দিতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু তারার উত্তর শুনে তো বিস্মিত হল শাসা;

 “বোকার মত কথা বলো না শাসা কোর্টনি; কেবলমাত্র বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রাকৃতিক এক আকর্ষণ ব্যতীত তোমার আমার মাঝে আর কোনো মিল তো নেই।”

“তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে তারা?” তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ করে উঠল শাসা, “আমরা একই ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছি, একই ভাষায় কথা বলি, একই জোকস শুনে হাসি”।

“কিন্তু শাসা তাতে তোমার কী কিছু যায় আসে?”

“তুমি তো জানো পার্লামেন্টে যাওয়ার ইচ্ছে আমার।”

“এটা তো তোমার ক্যারিয়ার প্ল্যান, মন থেকে নেয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়; দরিদ্র কিংবা অসহায়দের স্বার্থে নয়।”

“আমি দরিদ্রদেরকে নিয়ে সত্যি ভাবি- “

“তুমি কেবল শাসা কোর্টনিকে নিয়েই ভাবো।” তারা এত ক্ষেপে গেল যে মনে হল খাপ খোলা ছুরি। “তোমার কাছে দরিদ্র মানে হল যার কাছে মাত্র পাঁচটা পোলো খেলার ঘোড়া আছে।”

“তোমার বাবার কাছেও কিন্তু অন্তত পনেরোটা ঘোড়া আছে।” তারাকে মনে করিয়ে দিল শাসা।

“খবরদার আমার বাবাকে এর মাঝে টেনে আনবে না।” চোখে আগুন নিয়ে শাসার দিকে তাকাল তারা।

“ড্যাডি এদেশের কৃষ্ণাঙ্গ আর ব্রাউন জনগণের জন্য অনেক কিছু করেছেন।”

 তাড়াতাড়ি দুহাত তুলে তারাকে থামানোর চেষ্টা করল শাসা।

“কাম অন তারা! তুমি তো জানো আমি ব্লেইন ম্যালকমসের কত বড় ভক্ত। আমি তো উনাকে অপমান করতে চাইছি না। আমি কেবল চাইছি যে তুমি আমাকে বিয়ে করো।”

“এতে কারো কোনো লাভ হবে না, শাসা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এদেশের বিশাল সম্পত্তি যা কেবল কোর্টনি আর ওপেনহেইমারদের হাতে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে তা পূর্ণ বণ্টন করে দিতে হবে।”

 “এটা হিউবার্ট ল্যাংলির কথা; তারা ম্যালকমসের নয়। তোমার সেই বেঁটে কমুউনিস্ট বন্ধুর উচিত নতুন করে সম্পদ আহরণের উপায় বের করা; যা আছে তা বিলিয়ে দেয়া নয়। যখন তুমি কোর্টনি আর ওপেন হেইমারদের সম্পদ সবার মাঝে বণ্টন করে দিবে তখন হয়ত সবাই খেতে পাবে। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা পার হলেই দেখা যাবে যে সবাই আবার উপোস করছে। যাদের মধ্যে কোর্টনি আর ওপেনহেইমাররাও থাকবে।”

“এই তো!” বিজয়ীর ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠল তারা, “নিজে বাদে বাকিরা অনাহারে থাকলেই তুমি বেশি খুশি।”

হাঁ হয়ে গেল শাসা। তাড়াতাড়ি আবার পাল্টা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল; কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই মেয়েটার চোখে যুদ্ধের আভাস দেখে নিজেকে সামলালো। এর পরিবর্তে নরম স্বরে জানালো, “যদি আমাদের দুজনের বিয়ে হয় তাহলে তুমি আমাকে প্রভাবিত করে তোমার পথে নিয়ে আসতে পারবে” এতক্ষণ মনে মনে আরেকটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া তারা শাসার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল। বলল, “তুমি যে কতবড় চালাক শাসা, আমার কথার হাত থেকে বাঁচতে চাইছো!”

 “আমি তোমার সাথে ঝগড়া করতে চাই না মাই ডিয়ার গার্ল। আমি এর বিপরীতটাই চাই।”

নিজের অজান্তেই খিকখিক করে হেসে ফেলল তারা। “তোমার এই জিনিসটাও আমার ভালো লাগে না। নিজের আন্ডারপ্যান্টের আশপাশ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারো না।”

“তুমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনিঃ আমাকে বিয়ে করবে?”

“কাল সকাল নয়টার মধ্যেই তোমাকে একটা রচনা লিখে পাঠাব। আজ সন্ধ্যা ছয়টা থেকে আমার ক্লিনিক ডিউটি আছে। এবারে আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো শাসা।”

“হ্যাঁ নাকি না?” আবারো জানতে চাইল শাসা।

“হয়ত জানাল তারা; কিন্তু তার আগে সামাজিক সচেতনতার বিষয়ে তোমাকে আরো অনেক উন্নতি করতে হবে আর আমারও মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ হোক।”

“তাতে তো আরো দুই বছর বাকি আছে?”

“আঠারো মাস।” শাসাকে শুধরে দিল তারা। আর তারপরেও আবার বলছি, আমি কিন্তু কোনো প্রমিজ করিনি। হয়ত বলেছি।”

“এতদিন পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারব কিনা জানি না।”

 “তাহলে বা-বাই শাসা কোর্টনি।”

চার মাসের বেশি টিকেনি তাদের রেকর্ড। তিন দিন পরে একটা ফোন পেল; মায়ের সাথে অফিসের মিটিংয়ে ব্যস্ত শাসা; এমন সময় সরাসরি রুমে এল সেনটেইনের সেক্রেটারি।

“আপনার কাছে একটা ফোন এসেছে মাস্টার শাসা।”

“আমি এখন আসতে পারব না। মেসেজ রেখে দিন। আমি পরে ফোন করব।” চোখ তুলে না তাকিয়েই উত্তর দিল শাসা। 

“মিস তারা ফোন করেছেন; বলেছেন খুব জরুরি।”

লাজুক চোখে সেনটেইনের দিকে তাকাল ব্লেইন। ব্যবসাকে খেলা কিংবা পারিবারিক জীবনের সাথে না মেলানোর ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর হলেও আজ মাথা নাড়লেন সেনটেইন কোর্টনি।

“এক মিনিটের বেশি সময় নিব না।” ত্রস্তপায়ে উঠে গিয়েই সেকেন্ড খানেক পরেই ফিরে এল শাসা।

“কী হয়েছে?” ছেলের চেহারা দেখে চট করে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন।

“তারা।”

 “ও ঠিক আছে তো?”

“তারা জেলে আটক হয়েছে।”

***

১৮৩৮ সালে বাফেলো নদীর তীরে আফ্রিকান জনগণের পূর্বপুরুষ ভোরট্রেকার বাহিনি জুলু রাজা ডিনগানের বাহিনিকে পরাজিত করে জুলু সাম্রাজ্যকেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

এ বছর পালিত হচ্ছে সেই বিজয়ের শততম বার্ষিকী। এ উৎসব উদযাপনের জন্য আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ন্যাশনালিস্ট পার্টির নেতা ঘোষণা করেন যে, “দক্ষিণ আফ্রিকাকে শ্বেতাঙ্গদের জন্য অত্যন্ত নিরাপদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাই শ্বেতাঙ্গদের সভ্যতাকে রক্ষা করতে হলে আমাদের আরেকটা মহান বিজয় প্রয়োজন।”

পরবর্তী মাসগুলোতে ডা. মালান আর তার ন্যাশনালিস্ট পার্টি বিভিন্ন ধরনের বিল উত্থাপন করে হাউজের সামনে। যেখানে মিক্সড ম্যারেজকে অপরাধ যোষণা করাসহ যেসব কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটর অধিকার আছে তাদের কাছ থেকে তা কেড়ে নেয়ার দাবি জানানো হয়। ১৯৩৯ পর্যন্ত হার্টজগ আর স্মুটস কোনোরকমে ঠেকিয়ে দেন এসব বিল। ফলে দেখা যায় তাদেরই অনেক অনুসারী ন্যাশনালিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়াতে ইউনাইটেড পাটির মধ্যে ভাঙন ধরাতে তৎপর হয়ে উঠেছে। তাই বাধ্য হয়েই তারা দুজনে এক ধরনের ভিন্ন আবাসিক ব্যবস্থার সমাধানের প্রস্তাব করেন।

কিন্তু এই প্রস্তাব তোলার এক সপ্তাহ পরেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য কেপটাউনের মাঝখানের গ্রিন মার্কেট স্কয়ারে জড়ো হয় বিপুলসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ জনগণ, সাথে লিবারেল শ্বেতাঙ্গ মানুষ।

 দক্ষিণ আফ্রিকান কমুউনিস্ট পার্টি আর আফ্রিকান পিপলস পার্টিও এতে যোগ দেয়। আর একেবারে সামনের সারির মাঝখানে তাড়াহুড়া করে বানানো স্পিকারদের মঞ্চের নিচে দাঁড়িয়ে আছে নীল নয়না স্বর্ণকেশী তারা ম্যালকমস। পাশে ওর চেয়ে উচ্চতায় খাটো হিউবার্ট ল্যাংলি আর তার ছাত্র-ছাত্রীর দল। সবাই একদৃষ্টে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আজকের বক্তার দিকে।

 “এই লোকটা তো বেশ ভালো ভালো কথা বলছে।” ফিসফিস করে উঠল হিউবার্ট, “আগে তো কখনো তার কথা শুনিনি।”

“উনি ট্রান্সভ্যাল থেকে এসেছেন।” উত্তরে জানাল হিউবার্টেরই এক ছাত্র। “উইটওয়াটারস্রান্ডে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতাদের প্রথম সারির একজন।”

মাথা নাড়ল হিউবার্ট, “তুমি ওর নাম জানো?”

“গামা, মোজেস গামা। মোজেস, এই নামটা উনার জন্য তার জনগণকে বন্ধিদশা থেকে মুক্তি দেয়।”

অন্যদিকে তারার মনে হল এত সুদর্শন আর কাউকে সে কখনোই দেখেনি।

লম্বা, ঋজুকায় দেহে মুখখানা ঠিক তরুণ ফারাওয়ের মতন বুদ্ধিমান, অভিজাত আর নিষ্ঠুর।

 “আমরা বাস করছি প্রচণ্ড কষ্ট আর এক মহাবিপদের মাঝে মোজেস গামার কণ্ঠস্বরের অনুরণন অনুভব করে মনের অজান্তেই কেঁপে উঠল তারা; হাত দুটোকে প্রসারিত করে গামা বললেন, “এখানে এমন এক প্রজন্ম আছে যাদের দাঁতগুলো যেন তরবারি আর ছুরির মত দুনিয়া থেকে দরিদ্র আর অসহায়কে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।”

“ওহ, অসাধারণ!” আবারও কেঁপে উঠল তারা।

“মাই ফ্রেন্ডস, আমরা হচ্ছি সেই দরিদ্র আর অসহায়। যদি আমরা একা থাকি তাহলেই আমরা দুর্বল হয়ে পড়ব, দাঁতের মত তরবারির শিকারে পরিণত হব। কিন্তু একত্রিত হলে হয়ে উঠব শক্তিমান। একসাথে হলেই কেবল ওদেরকে প্রতিহত করতে পারব।”

শুনে হাততালি দিল সমস্ত দর্শক। তাদের সাথে যোগ দিল তারা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবাই শান্ত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন মোজেস। তারপর বললেন, “পৃথিবীটা যেন ধীরে ধীরে ফুটতে থাকা তেলের এক মস্ত কড়াই। অতিরিক্ত গরম হয়ে গেলেই শুরু হবে বুদবুদ আর ধোয়া, নিচে আগুন। আমাদের চেনা পৃথিবী তখন চিরতরের জন্য বদলে যাবে। তবে আগামীকালের সূর্যোদয়ের মত নিশ্চিত একটা ব্যাপার হল, আগামীর দিন হবে জনগণের জন্য। আফ্রিকা, আফ্রিকাবাসীর জন্য।”

আনন্দে চিৎকার করে হাততালি দিতে দিতে হিস্টিয়ার রোগীর মত কাঁদতে লাগল তারা। এরপর অন্যান্য বক্তারা এলেও তেমনভাবে জমাতে পারল না। এদিক-সেদিক তাকিয়ে মোজেসকে খুঁজল তারা, কিন্তু লোকটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন।

 খানিক বাদে জমায়েত হওয়া তিন থেকে চার হাজার লোক বাদক দলের পিছু পিছু শোভাযাত্রা শুরু করল। এতটা লোকসমাগম হবে কেউ আশাও করেনি। যাই হোক, পঞ্চম সারিত ডা. গোলাম গুল আর তার মেয়ে সিসি ও অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গ নেতাদের সাথে হাঁটছে তারা।

 আডারলি স্ট্রিটে পা দিতেই ভবঘুরে আর অলস লোকজন এসেও জড়ো হওয়াতে পাঁচ হাজারের বিশাল বাহিনি একসাথে এগোল পার্লামেন্ট ভবনের দিকে।

পার্লামেন্ট লেনের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের ছোট্ট একটা দল। সামনেই ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র পুলিশ। হাতে অন্যান্য অস্ত্রের সাথে লম্বা চাবুকও আছে। তাদের পিছনে রেইলিংয়ের ওপাশে পার্লামেন্ট ভবন।

পুলিশ ব্যারিকেডের সামনে এসে থেমে গেল শোভাযাত্রা। বাদক দলকে হাত ইশারা করে থামালেন ড, গুল। তারপর এগিয়ে গেলেন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের দিকে। চারপাশ থেকে ভিড় করে তাদের আলোচনা শুনতে এলেন লোকাল সংবাদপত্রের সাংবাদিকগণ।

“আমি কেপ প্রদেশের কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা পিটিশন জানাতে চাই।” শুরু করলেন ড, গুল।

“ড, গুল, আপনি এখানে একটি অবৈধ সমাবেশ করছেন। তাই আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এই মুহূর্তে সবাইকে নিয়ে সরে যান।” পাল্টা উত্তর দিল পুলিশ ইন্সপেক্টর। তবে পরিবেশ তখনো পুরোপুরি শান্ত আর বন্ধুত্বপূর্ণ। ড. গুল আর ইন্সপেক্টর এভাবে খানিকক্ষণ কথা বলার পর অবশেষে পার্লামেন্টের উদ্দেশে বার্তাবাহক পাঠানোর ব্যাপারে সম্মত হল ইন্সপেক্টর। ড, গুল তার পিটিশন জমা দিয়ে আবার নিজের লোকদের কাছে চলে এলেন।

তবে ততক্ষণে ভিড়ের অলস লোকদের দল আগ্রহ হারিয়ে একে একে চলে যাওয়ায় রয়ে গেল কেবল প্রকৃত অনুসারীগণ। তাদের উদ্দেশে ড. গুল বললেন, বন্ধুরা আমাদের পিটিশন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আমাদে উদ্দেশ্য তাই পূর্ণ হয়েছে। এখন সদাচারী আর জনগণের বন্ধু জেনারেল হার্টজগের ওপর নির্ভর করছি যে তিনি সঠিক কাজটিই করবেন। আমি পুলিশের কাছে প্রমিজ করে এসেছি যে এখন আমরা শান্তভাবেই এখান থেকে চলে যাব; আর কোনো ঝামেলা হবে না।”

“আমাদেরকে অপমান করা হয়েছে।” চিৎকার করে উঠল হিউবার্ট ল্যাংলি, “ওরা আমাদের সাথে কথা বলার সৌজন্যটুকু পর্যন্ত দেখায়নি।”

“আমাদের কথা শুনতে ওদেরকে বাধ্য করতে হবে।” চড়া গলায় আরেকজন বলে উঠতেই সবাই তাকে সম্মতি জানাল। হঠাৎ করে বিশৃঙ্খলা দেখা গেল চারপাশে।

“প্লিজ! মাই ফ্রেন্ডস” হৈচৈ’র মাঝে চাপা পড়ে গেল ড. গুলের কণ্ঠস্বর। অন্যদিকে পুলিশ ইন্সপেক্টরের আদেশে ব্যারিকেডের পেছনে চলে এল সশস্ত্র পুলিশ সদস্য।

 খানিক বাদে দেখা গেল তিন থেকে চারশ’ মানুষ বাদে বাকি লোকজন সমাবেশ ছেড়ে চলে গেছে। রয়ে গেছে কেবল ছাত্র-ছাত্রীর দল। যাদের মাঝে তারাও আছে।

পুলিশ এগিয়ে এসে ওদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে চাইলেও হাতে হাত রেখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ডিস্ট্রিক্ট সিক্সের দিকে এগোতে লাগল ছাত্র-ছাত্রীর দল। এ অঞ্চলে বস্তুত কৃষ্ণাঙ্গরই বাস করে।

তরুণরা হাত ধরাধরি করে গান গাইতে গাইতে পথ চলছে। হিউবার্ট ল্যাংলির ছাত্ররা আরো এক কাঠি সরেস। তারা নিজেরাই গান বেঁধে গাইতে লাগল। অন্যদিকে পুলিশ তাদেরকে শহরের মধ্যে তাড়িয়ে আনতে চাইলেও পারল না।

ডিস্ট্রিক্ট সিক্সের মরু অলিগলিতে ঘুরতে ঘুরতে আবার ভবঘুরের দল যোগ দেয়াতে বেড়ে গেল মানুষের সংখ্যা।

এক শ্বেতাঙ্গ জেনারেল ডিলারের দোকানের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় আচমকা কে যেন একটা ইট ছুঁড়ে মারল দোকানের ভেতরে। নেকড়ের দলের মত চিৎকার শুরু করে দিল ছেলেরা। একজন আবার হাত বাড়িয়ে পুরুষদের স্যুট নিয়ে নিল। এভাবে ভাঙা হল আরেকটা গ্লাস।

ভিড়ের মধ্যেও শৃংখলা বজায় রাখার জন্য চেষ্টা চালাল তারা। লুটেরাদের সাথে কথা বলে শান্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু উল্টো তাকেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে প্রায় পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে গেল মানুষের ভিড়। আস্তে আস্তে ক্ষেপে উঠল পুলিশ। লাঠির বাড়ি মেরে, চাবুকের ঘা দিয়ে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার জন্যও চেষ্টা করল।

ছোটখাটো এক মালয় টেইলরকে লাঠির বাড়ি মারতে যাবে এক কনস্টেবল এমন সময় তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তারা। ঠিক যেন নিজের শাবক বাঁচাতে চেষ্টা করছে মা সিংহী। ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেল কনস্টেবল। কব্জিতে চাপ দিয়ে তারা লাঠি তুলে নিল।

হঠাৎ করেই মনে হল যে বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠীর ওপরে বুঝি জিতে গেছে সে।

চারপাশের দরিদ্র, নিগৃহীত মানুষের মাঝে লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা ম্যালকম।

***

সাধারণ সময়ে আধা ঘণ্টার মাঝেই জাগুয়ার চালিয়ে ওয়েল্টেভেদেন থেকে ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে চলে আসতে পারে শাসা; কিন্তু আজ তার প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল সাথে বিস্তর বাক বিতন্ডাও হল।

ডিস্ট্রিক্ট সিক্সের আকাশে অশনি সংকেতের মত কালো ধোয়া দেখা যাওয়ায় টেনশনে পড়ে গেছে রোড ব্লকের এপাশে দাঁড়ানো পুলিশের দল।

 “আপনি ওখানে যেতে পারবেন না স্যার” পতাকা উঠিয়ে জাগুয়ারকে থামিয়ে দিল এক পুলিশ। “ওখানে কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। কালো বেজন্মার দলেরা দেখলেই ইট ছুড়ছে আর সবকিছুতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে।”

সার্জেন্ট, আমি এই মাত্রই একটা মেসেজ পেয়েছি যে আমার বাগদত্তা ওখানে আছে। সে অনেক বিপদের মাঝে আছে, প্লিজ আমাকে ওর কাছে যেতে দিন।”

“আমাকে উপর থেকেই অর্ডার দেয়া হয়েছে স্যার আয়্যাম সরি।” ব্যারিকেডের ওপাশে চারজন হল কৃষ্ণাঙ্গ মিউনিসিপ্যাল পুলিশ।

“সার্জেন্ট এখন যদি আপনার নিজের স্ত্রী কিংবা মা হত তাহলে আপনি কী করতেন?

চোরা চোখে চারপাশে তাকাল সার্জেন্ট, “ঠিক আছে, স্যার। এক মিনিটের জন্য রোড ব্লক তুলে আমরা আপনার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াবো। তবে আপনাকে আমরা কখনোই দেখিনি, কিংবা আপনার সম্পর্কে কিছু জানিও না, ঠিক আছে?”

পরিত্যক্ত রাস্তায় পড়ে আছে একগাদা আবর্জনা, ভাঙা ইট আর কাঁচের টুকরা। চারপাশের ধ্বংসলীলা দেখে আরো জোরে গাড়ি ছোটাল শাসা। মাঝে মাঝে গলির ভেতরে এক দু’জন মানুষকে দেখা গেলেও কেউই ওকে বাধা দিল না। অবশেষে ভিক্টোরিয়া রোডে পৌঁছে স্বস্তি পেল শাসা। সোজা পুলিশ স্টেশনে চলে এল।

“তারা ম্যালকমস” নামটা শুনেই চিনে ফেলল ফ্রন্ট ডেস্কের সার্জন। “ইয়েস, আমরা তাকে ভালোভাবেই চিনি। কারণ আমার চারজন লোক লেগেছে তাকে এখানে আনতে।”

“চার্জ কী ওর বিরুদ্ধে সার্জেন্ট?”

“দাঁড়ান বলছি” খাতার উপর চোখ বোলাল সার্জেন্ট, “অবৈধ সমাবেশ, ইচ্ছেকৃতভাবে সম্পত্তি বিনষ্ট করা, অকথ্য ভাষার ব্যবহার, পুলিশকে নিজ দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়া।”

“আমি ওর জন্য বেইল চাইছি।”

“এর জন্য কিন্তু স্যার বিস্তর পয়সা খরচ করতে হবে বলে দিচ্ছি।”

 “ওর পিতা হলেন কেবিনেট মিনিস্টার ব্লেইন ম্যালকমস।”

“ওয়েল আগে বলবেন না? ঠিক আছে, দাঁড়ান, দেখছি কী করা যায় স্যার।”

কারাগারের গরাদের ফাঁক দিয়ে তাকাতেই দেখা গেল তারার চোখ দুটো কালো হয়ে আছে। চুলগুলোও উষ্কখুষ্ক; পরনের টিশার্ট ছেঁড়া।”

“হিউবার্টের কী খবর?” শাসাকে দেখেই জানতে চাইল তারা।

“তাতে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।”

“তাহলে ওকে ছাড়া আমিও এখান থেকে এক পাও নড়ব না।”

মেয়েটার ম্যাডোনার মত দৈহিক সৌন্দর্য দেখে আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলল শাসা। তার মানে তাকে এখন একশ’ পাউন্ড খরচ করতে হবে। পঞ্চাশ তারা আর পঞ্চাশ হিউবার্টের জন্য।

“ওকে লিফট দেয়ার কথাও বলো না কিন্তু আবার। ছোটখাটো বলশেভিকটার জন্য পঞ্চাশ পাউন্ডই যথেষ্ট হয়েছে। এখান থেকে পায়ে হেঁটেই নিজের গর্তে ফিরতে পারবে এখন।” ঘোষণা করল শাসা।

গোমড়া মুখে হাত দুটো ভাজ করে বুকের উপর রেখে জাগুয়ারের সামনে সিটে উঠে বসল তারা। পেছনের টায়ার থেকে নীল ধোয়া তুলে অকারণে খানিকটা জোরেই গাড়ি ছোটাল শাসা।

দক্ষিণের দিকে না গিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে এল ডেভিডস পীক’-এ। এমন জায়গায় দাঁড় করাল যেখানে থেকে দেখা যাচ্ছে ডিস্ট্রিক্ট সিক্সের ধোঁয়ায় ঢাকা কালো আকাশ।

“কী করছো তুমি?” শাসা ইঞ্জিনের সুইচ অফ করতেই জানতে চাইল। তারা।

“নিজের কৃতকর্মের উপরে একবার চোখ বোলাতে চাও না?” শীতল স্বরে জানতে চাইল শাসা; “যা পেয়েছে তাতে নিশ্চয়ই খুব গর্ববোধ করছে।”

 অস্বস্তিতে নিজের সিটে নড়েচড়ে বসল তারা। “এসব আমরা করিনি। ও পাড়ার গ্যাংস্টারদের কাজ।”

 “মাই ডিয়ার তারা, বিপ্লব আসলে এভাবেই কাজ করে। অপরাধীকে ধ্বংসলীলায় উৎসাহ দেয়া হয় যেন আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নষ্ট হয়ে যায়। আর তখন নেতারা এসে বিপ্লবীদেরকে আবার মেরে ফেলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। তুমি তোমার হিরো লেনিনের লেখা পড়োনি?”

“এটা পুলিশেরই ভুল ছিল—

“হ্যাঁ, ব্যাপারটা সবসময় পুলিশেরই ভুল থাকে; এটাও লেনিনেরই শিক্ষা।”

“না, তা নয়।

“চুপ” তারার উদ্দেশে খেঁকিয়ে উঠল শাসা, “একবারের জন্য হলেও চুপ থেকে আমার কথা শোনো। এখন পর্যন্ত তোমার জোয়ান অব আর্কের মত হাবভাব আমি সহ্য করে গেছি। কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু যখন থেকে তুমি লোকজনের বাড়ি জ্বালিয়ে ইট আর বোমা মারা শুরু করলে ব্যাপারটা কিন্তু আর ছেলেখেলার পর্যায়ে নেই।”

“আমাকে চোখ রাঙানোর চেষ্টা করবে না।” পাল্টা তেড়ে এল তারা।

“দেখো তারা, আগুন আর ধোয়ার দিকে তাকাও। তুমি ওদের জন্যই দরদ দেখাবার ভান করো। তাদেরকেই নাকি সাহায্য করতে চাও। এখন আবার তাদের বাড়ি আর ঘরেই তুমি আগুন দিলে।”

“আমি তো ভাবিনি যে—”।

“না, সেটাই। তবে আমি এখন যা বলবো সেটা দয়া করে স্মরণ রেখো। আমার ভালোবাসার এই ভূমিকে যদি তুমি নষ্ট করার চেষ্টা করো আর এর মানুষকে কষ্ট দাও তাহলে কিন্তু তোমার সাথে আমার শত্রুতা শুরু হয়ে যাবে আর এর জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি লড়াই করব।”।

দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইল তারা। অন্যদিকে ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে। তারপর একটু বাদে নরম স্বরে বলল, “আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাবে, প্লিজ?”

 বহু রাস্তা ঘুরে অবশেষে নিউল্যান্ডে ম্যালকস হাউজের সামনে এল জাগুয়ার। পথিমধ্যে শাসা কিংবা তারা কেউ কোনো কথা বলল না।

“হয়ত তুমি ঠিকই বলেছো। হয়ত আমরা আসলেই পরস্পরের শত্রু।” জাগুয়ার থেকে বের হয়ে ড্রাইভারের সিটে বসে থাকা শাসার দিকে তাকাল তারা। তারপর নরম স্বরে বলল, “গুডবাই, শাসা।

“গুডবাই, তারা।”

***

ওয়েল্টেলেদেনের সামনের রুমে এসে জড়ো হয়েছে সকল কোর্টনি সদস্য।

লম্বা সোফাটাতে বসেছেন স্যার গ্যারি আর অ্যানা। স্যার গ্যারির জন্মদিন উপলক্ষে সপ্তাহখানেক আগেই এই ঘরোয়া জমায়েত। কিন্তু এরই মাঝে পোল্যান্ডে জার্মানি আক্রমণ করে বসতেই সবকিছু উলট-পালট হয়ে গেল। পরিবারের সব সদস্য তাই ওয়েল্টেভ্রেদেনে একসাথেই আছে।

রেডিও কেবিনেটের ওপর ঝুঁকে সঠিক স্টেশন ধরার জন্য নব ঘুরিয়ে যাচ্ছে শাসা।

“বিবিসি একচল্লিশ মিটার ব্যান্ডে আছে।” তীক্ষ্ণস্বরে ছেলেকে কথাটা জানিয়েই হিরের রিস্টওয়াচ চেক্ করলেন সেনটেইন। “তাড়াতাড়ি করো নয়ত খবর মিস্ হয়ে যাবে।”

“আহ!” বিগ ব্যানের পরিষ্কার ঢং ঢং ঘন্টা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শাসা।

“গ্রিনউইচ মান টাইম ১২০০ আর খবরের বিপরীতে এখন প্রচারিত হবে প্রধানমন্ত্রী মি. নেভিল চ্যাম্বারলেইনের ভাষণ

 “আওয়াজ বাড়াও, শাসা।” উদ্বিগ্নমুখে আদেশ দিলেন সেনটেইন; পুরো রুম জুড়ে গমগম করে উঠল নিয়তি বদলে দেয়া সেসব শব্দ।

পিনপতন স্তব্ধতার মাঝে বসে পুরো ভাষণ শুনল সবাই। নাকের ওপর থেকে স্টিলের ফ্রেমের চশমা নামিয়ে রাখলেন স্যার গ্যারি আর অন্যমনষ্কতাবশত চিবোতে লাগলেন ফ্রেমের একপাশ।

 খানিকটা সামনে ঝুঁকে একদৃষ্টে মেহগনি কেবিনেটের ওপর রাখা রেডিওর দিকে তাকিয়ে রইল অ্যানা।

বিশাল পাথুরে ফায়ারপ্লেসের পাশে চেয়ারে বসে আছেন সেনটেইন। হোয়াইট সামার ড্রেস পরিহিত একত্রিশ বছর বয়স্ক সেনটেইনকে ঠিক কিশোরীদের মতই দেখাচ্ছে। চেয়ারের হাতলের ওপর কনুই রেখে বসে একমনে ছেলেকে দেখছেন সেনটেইন।

অস্থির ভঙ্গিতে সারা রুমে পায়চারি করছে শাসা। একবার সোজা বুককেস পর্যন্ত গিয়ে পিয়ানোর পাশ দিয়ে আবার আসছে রেডিওর সামনে।

অন্যদিকে সেনটেইন অবাক হয়ে ভাবছেন যে ছেলেটা একবারে বাবার মত হয়েছে। যদিও মাইকেল এতটা সুন্দর ছিলেন না; মনে পড়ে মাইকেলকে তিনি ভাবতেন ঠিক যেন এক তরুণ দেবতা যার কোনো ক্ষয় নেই আর আজ আবার বুকের মাঝে বাসা বাঁধল সেই একই আতঙ্ক, অসহায়ত্বে ভরা সেই দিনগুলো। দুনিয়ার বিরুদ্ধে দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলা এই অনিন্দ্যসুন্দর গৃহে আজ আবার শোনা গেল যুদ্ধের আওয়াজ।

“আমরা তাহলে আর নিরাপদ নই” আপন মনে ভাবলেন সেনটেইন, “আবার এগিয়ে আসছে সেই দুঃস্বপ্ন। এবার বুঝি ভালোবাসার মানুষগুলোকে আর বাঁচাতে পারব না। শাসা আর ব্লেইন দুজনেই আমি না চাইলেও যুদ্ধে যাবে। শেষবার পাপা আর মাইকেল, এবার শাসা আর ব্লেইন ওহ গড! যারা এটা করছে তাদের সবাইকে আমি ঘৃণা করি, হে ঈশ্বর! এবারের জন্য ছেড়ে দাও। তুমি তো পাপা আর মাইকেলকে নিয়ে গেছে; শাসা আর ব্লেইনকে রেহাই দাও। ওরা ছাড়া আমার আর কিছু নেই। আমার কাছ থেকে ওদেরকে কেড়ে নিও না।”

ওদিকে রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যেন জমে গেল শাস; রেডিওতে বলছে, “আর অত্যন্ত মর্মবেদনার সাথে জানাচ্ছি যে গ্রেট ব্রিটেন আর জার্মানি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।”

শেষ হয়ে গেল ভাষণ। “বন্ধ করে দাও, শাসা।” নরম স্বরে জানালেন সেনটেইন। আবার চুপচাপ হয়ে গেল পুরো কামরা।

কয়েক সেকেন্ডের জন্য কেউ নড়াচড়া পর্যন্ত করল না। হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন। ছেলের হাত ধরে হাসিমুখে বললেন, “সবাই চলো। লাঞ্চ রেডি হয়ে গেছে।” খানিকটা হালকা মুডে জানালেন, “এত সুন্দর আবহাওয়াতে আজ আমরা ছাদে বসে খাব। শাসা শ্যাম্পেন খুলবে আর আমি এই সিজনের প্রথম ওয়েস্টারও জোগাড় করেছি।”

সবাই লাঞ্চ টেবিলে না বসা পর্যন্ত বেশ হাসিখুশি ভাব ধরে রইলেন সেনটেইন। কিন্তু ওয়াইনের গ্লাস ভরে দেবার পর আর পারলেন না। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারা নিয়ে স্যার গ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমাদেরকে নিশ্চয় এতে জড়াতে হবে না। তাই না পাপা? জেনারেল হার্টজগ প্রমিজ করেছেন যে আমাদেরকে এসব থেকে দূরে রাখবেন। তিনি তো বলেন যে, এটা হল ইংরেজদের যুদ্ধ। আবার নিশ্চয় আমাদেরকে সৈন্য পাঠাতে হবে না, তাই না পাপা?”

উঠে এসে সেনটেইনের হাত ধরলেন স্যার গ্যারি, “গতবার কতটা মূল্য দিতে হয়েছে তা তুমি আর আমি জানি” ধরাগলায় ছেলের নামটা আর উচ্চারণ করলেন না। বললেন, “তোমাকে কী বলে সান্তনা দেবো বুঝতে পারছি না।”

“এসব ঠিক না” বিষাদমাখা কণ্ঠে জানালেন সেনটেইন, “একদম ঠিক

“না, আমিও বলছি এসব ঠিক না। কিন্তু ভয়ংকর এক দানব আমাদের আর এই পৃথিবীকে গিলে খাবে যদি আমরা এটাকে প্রতিহত করতে না পারি।”

চট করে উঠে দাঁড়িয়েই ঘরের ভেতরে দৌড় দিলেন সেনটেইন। শাসাও উঠে মায়ের পিছু নিতে চাইছিল; কিন্তু হাত বাড়িয়ে নাতিকে থামালেন স্যার গ্যারি। মিনিট দশেক বাদেই আবার ফিরে এলেন সেনটেইন। মুখ ধুয়ে মেকআপ ঠিক করে এলেও বোঝা গেল চোখের কোণে কান্না লেগে আছে।

 “আজ আমরা সবাই খুব ফুর্তি করব।” হেসে ফেললেন সেনটেইন, “এটা আমার আদেশ। কোনো মন খারাপ করা কথা হবে না, আমরা কেবল আনন্দ করব” আচমকা থেমে গেলেন আবার। মুছে গেল মুখের হাসি। কারণ আরেকটু হলেই বলে ফেলছিলেন যে, “হতে পারে একত্রে বসে আনন্দ করার আজই আমাদের শেষ দিন।”

***

১৯৩৯ সালের চৌঠা সেপ্টেম্বর, গ্রেট ব্রিটেন আর ফ্রান্স নাজি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার পরদিন দক্ষিণ আফ্রিকার পার্লামেন্টে ভাষণ দিতে উঠে দাঁড়ালেন জেনারেল ব্যারি হার্টজগ।

 “অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, সরকারের কেবিনেট বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতির ব্যাপারে বিভক্ত মত পোষণ করছে।” চোখের চশমা ঠিক করে নিয়ে সামনে বসা মুখগুলোকে একবার মনোযোগ দিয়ে দেখে নিলেন হটজগ; তারপর আবার বললেন, “পোল্যান্ডের ওপর জার্মান আক্রমণ কিংবা গ্রেট ব্রিটেনের দেয়া চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কোনোটাই ইউনিয়ন অব সাউথ আফ্রিকার জন্য হুমকি নয়” এ অংশে বিরোধী দল হাততালি দিয়ে স্বাগত জানাল এ বক্তব্য। অথচ সরকারপক্ষীয় স্মুটস, তার দল নিয়ে পাল্টা বিরোধিতা করলেন।

হার্টজগ আবার বললেন, “এটা জার্মানি আর পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আর আমি দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিরপেক্ষ থাকার প্রস্তাব করছি।”

বর্ষীয়ান প্রধানমন্ত্রী একের পর এক কথার জাল বিছিয়ে নিজের যুক্তি দেখাচ্ছেন। অন্যদিকে ব্লেইন ম্যালকমস চোরাচোখে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছেন স্মুটস সমর্থকদের কাণ্ড।

তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে, কে কার পক্ষে আছে আর হাউজই বা কী সিদ্ধান্ত নিবে। আনমনে একটা নোট লিখে ওড় বাসের কাছে পাঠাবেন এমন সময় আবার শুনলেন যে হার্টজগ বলছেন, “অবশেষে পোল্যান্ডের ওপর জার্মান আক্রমণের যৌক্তিক দিক নিয়ে যদি বলতে চাই, তাহলে জার্মানির নিরাপত্তা।

আগের চিরকুট ছিঁড়ে নতুন একটা নোট লিখলেন ব্লেইন, “প্রধানমন্ত্রী তো হিটলারের আগ্রাসনকে সমর্থন করছেন। অতএব আমরা জিতে গেছি।”

চিরকুটটা পড়ে আলতোভাবে মাথা নাড়লেন জেনারেল স্মুটস। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে এ বক্তব্যের বিপক্ষে বললেন, “ব্রিটেন আমাদের সবচেয়ে পুরনো আর শ্রেষ্ঠ বন্ধু। তাই আমাদের উচিত শেষপর্যন্ত তার সাথে থাকা।” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে নিজের মত পরিবেশন করলেন স্মুটস, “দুনিয়ার প্রতিটি কোনায় বসবাসরত মুক্তমনা মানুষের হৃদয়ে আঘাত করেছে এ আগ্রাসন।

খানিক বাদে শুরু হল ভোটের লড়াই। আর শেষতক দেখা গেল আশি  ভোট পেয়ে জয় হল যুদ্ধ। দক্ষিণ আফ্রিকা নাজি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল।

একেবারে শেষ চেষ্টা হিসেবে হার্টজগ সংসদ ভেঙে দিয়ে সাধারণ নির্বাচন দেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু গভর্নর জেনারেল স্যার প্যাটিক ডানকান বৃদ্ধ প্রধানমন্ত্রীর রেজিগনেশন মেনে নিয়ে জেনারেল জ্যান স্মুটসকে নতুন সরকার গঠন ও যুদ্ধে যোগদানের দায়িত্ব প্রদান করলেন।

***

“ওড বাস আমাকে যেতে দিবেন না।” খানিকটা তিক্ত কণ্ঠেই জানালেন ব্লেইন। কিন্তু দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন সেনটেইন। দুজনে এখন তাদের কটেজের বেডরুমে বসে আছেন।

“ওহ, থ্যাঙ্ক গড, ব্লেইন, মাই ডার্লিং আমি এত প্রার্থনা করেছি যে এবার ঈশ্বর আমার প্রার্থনা শুনেছেন। আমি তোমাদের দুজনকে হারাতে চাই না। না তুমি না শাসা, আমি তাহলে বাঁচব না।”

“অন্যরা যখন যুদ্ধে যাবে তখন আমি বসে থাকব, ব্যাপারটা ভাবতেও ভালো লাগছে না।”

“তুমি তো একবার সাহসের সাথে নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধ করেছে।” বলে উঠলেন সেনটেইন, “বিদেশের মাটিতে মরে পড়ে থাকার চেয়েও অনেক হাজার হাজার বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার আছে তোমার।”

 “ওড বাসও আমাকে এটা বলেই মানিয়েছেন।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ব্লেইন। তারপর সেনটেইনের কোমর ধরে চলে এলেন সিটিংরুমে। অর্থাৎ আজ রাতে আর অন্য কিছু হবে না। কেবল মন খুলে কথা বলে হালকা হতে চাইছেন ব্লেইন।

পাশাপাশি বসলেন দু’জনে; যেন হাত বাড়ালেই পরস্পরকে ছোঁয়া যায়। ব্লেইন বললেন, “আমাদের বিরোধী নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে যেন জনগণকেও বিভক্ত করে দেয়া যায়। তাছাড়া নিজেদের সীমানার ভেতরেই তো নাজিদের মতন ভয়ংকর শত্রু তৈরি আছে- ওসেয়া ব্রান্ডওয়াগ।”

ব্লেইনকে হুইস্কি আর সোড়া এগিয়ে দিলেন সেনটেইন। এ নিয়ে আজ সন্ধ্যায় দুটো ড্রিংক নিলেন ব্লেইন। কিন্তু সেনটেইন আগে তাকে কখনো একটার বেশি নিতে দেখেননি।

 “পিরো আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেও এখন তাদের দলে ভিড়েছে।” ওসওয়াল্ড পিরো হার্টজগ সরকারের আমলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন।

“আমরা তাকে ছাপ্পান্ন মিলিয়নের বাজেট দিলেও সে আধুনিক এক সেনাবাহিনির বিরুদ্ধে আমাদেরকে দিয়েছে কাগুঁজে সেনাবাহিনি। তার সমস্ত রিপোর্ট বিশ্বাস করেছিলাম। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে আমাদের কাছে আধুনিক কোনো অস্ত্রই নেই। সে আর হার্টজগ ভেবেছিল আমাদেরকে কখনো যুদ্ধ করতে হবে না তাই কোনো অস্ত্রও রাখেনি।”

সে রাতে দুজনেই এতটাই উত্তেজনায় মগ্ন রইলেন যে ঘুমের কথা মাথায়ও এল না। তার বদলে একসাথে দাঁড়িয়ে কফি বানিয়ে আনলেন। পানি না ফোটা পর্যন্ত সেনটেইনের কোমর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ব্লেইন।

“জেনারেল স্মুটস নতুন মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে। কারণ এরই মাঝে আমি ওসেয়া ব্রান্ডওয়াগের অনুসন্ধান কমিটির প্রধান ছিলাম। তাই এখন মাথাব্যথা হল ওরা যাতে আমাদের প্রস্তুতিতে বাধা দিতে না পারে আমাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। ওড বাস নিজে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে ব্রিটেনের কাছে প্রমিজ করেছে, যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত এমন পঞ্চাশ হাজার স্বেচ্ছাসেবক দিবেন।”

একসাথে কফি ট্রে নিয়ে সিটিং রুমে এসে বসলেন দুজনে। কিন্তু হঠাৎ করেই সমস্ত নির্জনতা ভেঙে বেজে উঠল টেলিফোন। সেনটেইন এতটাই চমকে উঠলেন যে-কফি ছলকে পড়ল ট্রেতে।

“কয়টা বাজে ব্লেইন?”

 “একটা বাজার দশ মিনিট বাকি।”

“আমি ধরব না বাজতে থাকুক।” মাথা নেড়ে খানিক একদৃষ্টে যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে রইলেও কী মনে হতেই উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন।

“কেবল ভোরিস জানে যে আমি এখানে। বাধ্য হয়েই ওকে জানাতে হয়েছে— আর কিছু বলতে হল না। ডোরিস মেয়েটাকে সেনটেইনও বিশ্বাস করেন। তাই ফোন ধরলেন।

“মিসেস কোর্টনি স্পিকিং।” খানিক ও প্রান্তের কথা শুনে বললেন, “ইয়েস ডোরিস ও এখানে আছে।” ব্লেইনের হাতে টেলিফোন দিয়ে অন্যদিকে তাকালেন সেনটেইন। ব্লেইন খানিক বাদে বলে উঠলেন, “ধন্যবাদ ডোরিস, আমি বিশ মিনিটের মাঝেই পৌঁছে যাব।” ফোন রেখে সেনটেইনের দিকে তাকালেন ব্লেইন, “আয়্যাম সরি।” “আমি তোমার কোট নিয়ে আসছি।”

কোট গায়ে দিয়ে সেনটেইনের দিকে তাকালেন ব্লেইন; বোতাম লাগানোর সময়ে বললেন, “ইসাবেলা। ডাক্তারও এসেছে। ডোরিস বেশি কিছু না। বললেও মনে হয়েছে বেশ সিরিয়াস।” প্রকৃতই বিস্মিত হলেন সেনটেইন।

ব্লেইন চলে যাবার পরে কফি কাপ রান্নাঘরে নিয়ে সিঙ্কে ধুয়ে ফেললেন সেনটেইন। মাঝে মাঝে এত একা বোধ করেন যে! জানেন এখন আর ঘুমাতে পারবেন না। তাই লাউঞ্জে এসে গ্রামাফোনে রেকর্ড চাপালেন। গান শুনতে শুনতে চোখের সামনে ভেসে উঠল অতীতের স্মৃতি, মাইকেল, মর্ট হোম, বহু আগের সেই যুদ্ধ। বিষণ্ণতা যেন আরো বেশি করে চেপে ধরল তাকে।

কখন যেন আমচেয়ারে পা ভাজ করে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাই টেলিফোনের শব্দ শুনেই আবার ধড়মড় করে জেগে উঠতে হল; আধা ঘুমের মাঝেই ফোন ধরে কথা বললেন।

“ব্লেইন!” কণ্ঠটা শোনার সাথে সাথে বললেন, “এখন কয়টা বাজে?”

 “চারটার কয়েক মিনিট এদিকে।”

“কিছু হয়েছে ব্লেইন? কোনো সমস্যা?” এবারে পুরোপুরি জেগে উঠলেন সেনটেইন।

“ইসাবেলা! ও তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।”

 “আমার সাথে?” দ্বিধায় পড়ে গেলেন সেনটেইন।

 “ও চাইছে তুমি এখানে আসা।”

 “আমি পারব না। তুমি জানো এটা সম্ভব না ব্লেইন।”

 “ও মারা যাচ্ছে সেনটেইন। ডাক্তার বলেছে ও আর একদিনও টিকবে না।”

“ওহ, গড ব্লেইন, অ্যায়াম সো সরি।” আর অবাক হয়ে খেয়াল করল যে তার সত্যিই খারাপ লাগছে।

“বেচারা ইসাবেলা”।

“তুমি আসবে?”

“তুমি চাও যে আমি আসি?”

 “এটা ওর শেষ ইচ্ছে। যদি মানা করি তাহলেও অত্যন্ত অপরাধবোধে ভুগব।”

“ঠিক আছে, আমি আসছি।” ফোন রেখে দিলেন সেনটেইন।

মাত্র কয়েক মিনিটেই মুখ ধুয়ে হালকা মেকআপ নিলেন। গাড়ি চালিয়ে যখন নিউল্যান্ডস্ এভিনিউয়ে এলেন দেখা গেল কেবল ব্লেইনের বাড়িতেই আলো জ্বলছে।

মেহগনির জোড়া সদর দরজায় সেনটেইনকে অভ্যর্থনা জানালেন ব্লেইন। জড়িয়ে ধরে নয়, মুখে কেবল বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ সেনটেইন।” আর তখন চোখে পড়ল যে পিছনের হলে ব্লেইনের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“হ্যালো, তারা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন সেনটেইন। মেয়েটা দেখা গেল সমানে কাঁদছে। বড় বড় চোখ দুটো ফুলে ঢোল হয়ে আছে। মুখটা এত পাড়ুর বর্ণ ধারণ করেছে যে তামাটে চুল দেখে মনে হচ্ছে মাথার ওপরে আগুন লেগে আছে।

“তোমার মায়ের খবর শুনে খারাপ লাগল।”

 “না, সেটা সত্যি নয়।” এতক্ষণ কড়া চোখে সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে থাকা তারা কথাটা বলেই ছুটে ভেতর দিকে চলে গেল। ঠাস করে শোনা গেল কোনো একটা দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ।

“ও আসলে অনেক আপসেট হয়ে আছে। ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি।” বলে উঠলেন ব্লেইন।

“বুঝতে পেরেছি। এটার খানিকটা দায় আমারও আছে।” উত্তরে জানালেন সেনটেইন।

মাথা নেড়ে কথাটা উড়িয়ে দিয়ে সহজ সুরে ব্লেইন বললেন, “ভেতরে এসো।”

একসাথে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সেনটেইন জানতে চাইলেন, “কী হয়েছে বলে তো ব্লেইন।”

“মেরুদণ্ড আর নার্ভাস সিস্টেমের ক্ষয়। যা গত কয়েক বছর ধরেই আস্তে আস্তে ঘটেছে। এখন আবার নিউমোনিয়া হওয়াতে সে আর ধকল সামলাতে পারছে না।”

“ব্যথা?”

“হ্যাঁ। ওর সবসময় প্রচণ্ড ব্যথা থাকত। সাধারণ মানুষ যা এত বেশি সহ্য করতে পারে না।”

কার্পেটে মোড়ানো প্যাসেজওয়ের শেষ দরজায় এসে নক করলেন ব্লেইন।

 “ভেতরে এসো, প্লিজ।”

বিশাল বড়সড় রুমটাতে নীল আর সবুজ রঙের সব আসবাব। বেডসাইড টেবিলে বাতি জ্বলছে। বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তার। মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে এলেও বিছানার উপরে শুয়ে থাকা ইসাবেলাকে দেখে সত্যি থতমত খেয়ে গেলেন সেনটেইন।

মনে পড়ল ইসাবেলা ম্যালকমসের একদা শান্ত সুন্দর রূপের কথা। এখন চোখগুলো কোটরে বসে গেছে, দাঁত পুরো হলুদ। অন্যদিকে মাথার ওপর মেঘের মত জমে আছে ঘন তামাটে চুল।

“ধন্যবাদ যে আপনি দয়া করে এসেছেন।” ইসাবেলার কথা শোনার জন্য সেনটেইনকে একেবারে কাছে ঝুঁকে আসতে হল।

“আপনি আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন শোনার সাথে সাথে ছুটে এসেছি আমি।”

এই ফাঁকে ডাক্তার আস্তে করে বললেন যে, “আপনি হয়ত মাত্র কয়েক মিনিট থাকার সুযোগ পাবেন। মিসেস ম্যালকমসের বিশ্রাম প্রয়োজন। কিন্তু অধৈর্যভাবে হাত নাড়লেন ইসাবেলা।

“আমি উনার সাথে একা কথা বলতে চাই।” ফিসফিস করে বাকিদেরকে জানিয়ে দিলেন, “প্লিজ, এখান থেকে বাইরে যান প্লিজ।”

 নিচু হয়ে স্ত্রীর মাথার বালিশ ঠিক করে দিতে গেলেন ব্লেইন। এমন সময় ইসাবেলা বললেন, “প্লিজ তুমি কোনো কষ্ট করো না, ডিয়ার।” আচমকা মৃত্যুপথচারী ইসাবেলার জন্য কেন যেন হিংসা অনুভব করলেন সেনটেইন।

আর কিছু না বলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন ব্লেইন আর ডাক্তার। প্রথমবারের মত একাকী হলেন ইসাবেলা আর সেনটেইন। এত বছর ধরে আপন মনে অপরাধবোধ, ঘৃণা, রাগ আর হিংসে অনুভব করে এসেছেন সেনটেইন। কিন্তু আজ এখানে দাঁড়িয়ে ভুলে গেলেন সেসব কিছু।

“কাছে আসুন, সেনটেইন” হাত বাড়িয়ে ফিসফিস করে উঠলেন ইসাবেলা, “এখন কথা বলতেও এত কষ্ট হয় কী যে বলব।”

বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসলেন সেনটেইন। ফলে ইঞ্চিখানেক দূরত্বে দু’জনে দেখছেন পরস্পরের চোখ। হঠাৎ করেই মন চাইল ইসাবেলার কাছে ক্ষমা চাইবেন; কিন্তু তার আগেই ইসাবেলা বললেন, “আমি ব্লেইনকে বলেছি যে আপনার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই সেনটেইন। এও জানিয়েছি যে, আপনারা দু’জনে আসলে না চাইতেই ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে পড়লেও চেষ্টা করেছেন আমার যাতে কোনো ক্ষতি না হয়। আরও বলেছি যদিও ব্লেইনকে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছেন। তারপরেও আমার শেষ মর্যাদাটুকুর যেন হানি না হয় আপনি সেদিকেও খেয়াল রেখেছেন।”

 মনে মনে সত্যি বেশ দুঃখ পেলেন সেনটেইন; মন চাইল দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরেন ইসাবেলার রুগ্ন শরীর। কিন্তু তার চোখে এমন এক গর্বের আলো খেলা করছে যে কিছু না বলে চুপ করে রইলেন সেনটেইন।

 “ব্লেইনকে বলেছি যে আমি ওকে যা দিতে পারিনি আপনি সেই খুশি তাকে দিয়েছেন। কিন্তু এরপরেও আপনারই দাক্ষিণ্যে ওর একটা অংশ নিজের করে রাখতে পেরেছি।”

“ওহ, ইসাবেলা, বুঝতে পারছি না, কীভাবে আপনাকে বলব যে” ধরে এল সেনটেইনের গলা। হাত নেড়ে তাকে চুপ থাকতে বললেন ইসাবেলা।

তারপর কয়েক মুহূর্তে যেন বহুকষ্টে নিজেকে ধাতস্থ করলেন। হঠাৎ করেই রাঙা হয়ে উঠল গাল আর চোখেও ধকধক করে উঠল প্রতিহিংসা। দ্রুত শ্বাস ফেলতে ফেলতে শক্ত গলায় বললেন, “আমি এসব ওকে বলেছি যেন আপনাকে এখানে নিয়ে আসতে পারি। যদি বুঝতে পারতো যে আমি সত্যিই কী বলতে চাই তাহলে কখনো আপনাকে এখানে আসার অনুমতি দিত না।” মাথা তুলে তাকালেন ইসাবেলা। কেমন যেন সাপের মত হিসহিস করে উঠল তার কণ্ঠস্বর।

“এখন আমি বলব যে আমি আপনাকে কতটা ঘৃণা করি আর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে নির্গত এই ঘৃণাই আমাকে এতদিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে যেন ওকে আপনি স্বামী হিসেবে পেতে না পারেন আর এখন যখন মারা যাচ্ছি আরো শতগুণে বেড়ে যাচ্ছে এ ঘৃণা–” কথা থামিয়ে হাপাতে লাগলেন ইসাবেলা। চুপসে গেলেন সেনটেইন। বুঝতে পেরেছেন যে মনোকষ্টে বিকারগ্রস্তের মত আচরণ করছে এই নারী।

 “যদি মৃত্যুপথযাত্রী নারীর অভিশাপের কোনো শক্তি থাকে তাহলে আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস দিয়ে অভিশাপ দিচ্ছি সেনটেইন কোর্টনি, একই ব্যথা অনুভব করবেন; একই নির্যাতন ভোগ করবেন। যেদিন আমার স্বামীর সাথে বেদীতে দাঁড়াবেন ঠিক সেদিন আমি কবর ছেড়ে উঠে আসব”

“না!” চট করে উঠে দাঁড়িয়েই দরজার দিকে হাঁটা ধরলেন সেনটেইন, “স্টপ ইট, প্লিজ স্টপ ইট?”।

গা শিরশির করে ওঠা এক কণ্ঠে হেসে উঠলেন ইসাবেলা, “আমি আপনাকে অভিশাপ দিলাম আর এর হাত থেকে বাঁচার এখন আর কোনোই পথ নেই। অভিশাপ দিচ্ছি সেই প্রতিটি মুহূর্তকে; আমি চলে যাবার পর আপনারা দুজন যখন একসাথে কাটাবেন! চোখের বদলে চোখ, সেনটেইন কোটনি; মনে রাখবেন!”।

ঠাস করে দরজা খুলেই প্যাসেজ ধরে দৌড় লাগালেন সেনটেইন। অন্যদিকে শব্দ পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে এসেছেন ব্লেইন। চাইলেন সেনটেইনকে জড়িয়ে ধরতে; কিন্তু তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে সদর দরজা খুলে ডেইমলারের দিকে চলে গেলে সেনটেইন।

***

সেদিন সেই ঘটনার পরে কালাহারি মরুভূমিতে চলে গিয়েছিলেন সেনটেইন। ফিরে এলেন দু’মাস বাদে। এর ভেতরে ব্লেইন শত চেষ্টা করলেও তার সাথেও টেলিফোন কিংবা চিঠিতে কোনো যোগাযোগ করেননি।

প্রকাশিত হওয়ার এক সপ্তাহ পরে হানি মাইনে যে নিউজ পেপার আসে সেখানকার শোক কলামে ইসাবেলা ম্যালকমসের মৃত্যু-সংবাদও পড়েছেন। কিন্তু তাতে কেবল মন খারাপ অবস্থা বেড়েই গেল। বারবার মনে পড়ল ইসাবেলার অভিশাপের কথা।

অবশেষে শাসার জোরাজুরিতে ওয়েল্টেভ্রেদেনে ফিরে এলেন সেনটেইন। শাসা নিশ্চয়ই তার টেলিগ্রাম পেয়েছে। তাই ছেলেটা তার জন্য অপেক্ষা করবে ভেবেছিলেন সেনটেইন। কিন্তু সদর দরজায় ওকে না দেখে খানিকটা অবাক হয়েই স্টাডিতে গেলেন সেনটেইন। এতক্ষণ জানালা দিয়ে মায়ের গাড়ি দেখছিল শাসা; এবারে যখন সেনটেইনকে দেখে এগিয়ে এল, বিস্মিত মা দেখলেন ইউনিফর্ম পরিহিত শাসাকে।

দরজার কাছে দাঁড়িয়েই যেন বরফের মত জমে গেলেন সেনটেইন। ছেলেকে কাছে এগিয়ে আসতে দেখে মনের মাঝে তরতাজা হয়ে উঠল বহু বছর আগেকার এমনই এক দিনের স্মৃতি। একই ধরনের খাকি ইউনিফর্ম পরে কাছে এসেছিলেন লম্বা, চওড়া সুদর্শন মাইকেল।

“থ্যাঙ্ক গড, যে তুমি এসেছো মা” মাকে বলে উঠল শাসা। “আমি চলে যাবার আগে তোমাকে দেখতে চাইছিলাম।”

“কখন?” এক নিঃশ্বাসে প্রশ্ন করে উঠলেন সেনটেইন; কী উত্তর শুনবেন তা ভাবতেও আতঙ্ক জাগছে মনে, “তুমি কখন যাবে?”

“কাল।”

“কোথায়? ওরা তোমাকে কোথায় পাঠাচ্ছে?”

“প্রথমে আমরা যোবাটস হাইটসে যাব, এটা হল ট্রান্সভ্যালে এয়ারফোর্সের ট্রেনিং বেস। সেখানে গিয়ে ফাইটার হওয়ার পরে ওরা যেখানে পাঠাবে সেখানে যাব। আমাকে শুভ কামনা জানাও মা।”

ছেলের টিউনিকে স্বেচ্ছাসেবকদের কমলা রঙা ব্যাচ দেখলেন সেনটেইন; ধরাগলায় জানালেন, “ইয়েস মাই ডার্লিং, আই উইশ ইউ লাক।” অথচ জানেন ছেলেকে বিদায় দিতে গেলে তার বুক ভেঙে যাবে।

***

চামড়ার ফ্লাইং হেলমেটের ওপরে রেডিওর ইয়ারফোন কানে গোজা থাকলেও রোলস রয়েস মার্লিন ইঞ্জিনের আওয়াজ কিছুতেই এড়ানো যাচ্ছে না।

হকার হারিকেন ফাইটার এয়ারক্রাফটের ককপিটের ছাদ একেবারে খোলা থাকায় চোখের সামনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নীল আফ্রিকান আকাশ। তীরের মত প্লেন নিয়ে ছুটছে তিন ফাইটার।

সবার আগে শাসা। একের পর এক দ্রুত প্রমোশন পেয়ে আজ এখানে এসেছে : স্বভাবজাতভাবেই সে আদেশ দিতে পারদর্শী। মা সেনটেইন কোর্টনির কাছে পেয়েছে এই জ্ঞান আর তাই মাত্র আঠারো মাসেই স্কোয়াড্রন লিডার হয়ে গেছে শাসা।

 খাটো, খাকি টিউনিক আর খাকি শর্টস পরে কোমরে ওয়েবলি সার্ভিস রিভলবার খুঁজে বেরিয়েছে শাসা। এর আগে আবিসিনিয়ান পাহাড়ি ডাকাত শুফটাদের হাতে অকথ্য নির্যাতন স্বীকার করে মারা গেছেন দু’জন দক্ষিণ আফ্রিকান পাইলট। তারপর থেকে নিজেদের রক্ষার্থে অস্ত্র বহন করছে বাকি পাইলটেরা আর এটাও খেয়াল রাখতে হচ্ছে যেন কিছুতেই জীবন্ত ধরা না পড়ে।

মেঘহীন উজ্জ্বল নীলাকাশে আজ চমৎকার বাতাস বইছে। বহু নিচে ছড়িয়ে আছে আবিসিনিয়ান উচচভূমি, সমান্তরাল পর্বতমালা। মরুভূমি আর পাথর।

 নিজেদের সর্বোচ্চ উচ্চতায় উড়ে বেড়াচ্ছে তিন পাইলট। মাত্র মিনিট আগেই জিরগা আলেগের ধূলিময় এয়ারস্ট্রিপ থেকে যাত্রা শুরু করেছে তিনজনে। কারণ রেডিওতে মরিয়া হয়ে সাহায্য চেয়েছে সামনের অগ্রসরমান পদাতিক বাহিনি। উত্তরে, প্লেন ভাসিয়ে নিচের পর্বতের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা রাস্তাটা খুঁজে বের করলো শাসা।

সাথে সাথে মাথা ঘুরিয়ে চোখ সরু করে খুঁজতেই প্লেনগুলোকে পেয়েও গেল। এত উপর থেকে মনে হচ্ছে যেন কালো রঙা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পোকার মেঘ।

“পপি ফ্লাইট, দিস ইজ লিডার। ট্যালি হো!” রেডিও টেলিফোনের মাইক্রোফোনে চিৎকার করে উঠল শাসা,

“ইলেভেন ও ক্লক হাই! দশজনের বেশি, আর দেখতে ক্যানোর মত লাগছে। বাস্টার! বাস্টার!” এর মানে হল পূর্ণ বেগে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দেয়া হল।

“পেয়েছি। সাথে সাথে উত্তর দিল ডেভিড আব্রাহাম। ব্যাপারটা ভাগ্যই বলতে হবে যে সেই রোবটস হাইটস্ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সর্বত্র একসাথে থাকার সুযোগ পেয়েছে দুই বন্ধু। ইটালিয়ান বাহিনিকে আদ্দিস আবাবার পর্বতের মাঝে আটকে দেয়ার জন্য জান পিয়েনার’স সাউথ আফ্রিকান কর্পসের হয়ে যুদ্ধ করছে শাসা আর ডেভ।

 আড়চোখে বন্ধুর দিকে তাকাল শাসা। ওর স্টারবোর্ডের কাছে নিজের হারিকেন নিয়ে চলে এসেছে ডেভ। দুজনেরই খোলা ককপিট হওয়াতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল দু’বন্ধু। একসাথে থাকতে পেরে দুজনেই বেশ খুশি। তারপর আক্রমণের প্রস্তুতিস্বরূপ নিজেদের ককপিটের ছাদ নামিয়ে সূর্যের কাছাকাছি উঠে এল শাসা।

অন্যদিকে দুরের সেই পোকাগুলো দ্রুত আকার পাচ্ছে। বোঝা গেল এগুলো তিন ইঞ্জিনঅলা ক্যানি বোম্বার। বারোটা আছে, গুনে দেখল শাসা। এগুলো কেরিনের দিকে বোমাবর্ষণ করতে যাচ্ছে আর সেখানেই আটকে আছে দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাডভান্স টিম। কিন্তু শাসা পৌঁছাবার আগেই একেবারে সামনের বোম্বার প্লেনটা থেকে নিচে নোমা ফেলা হল। •

ফুল থ্রটল থাকা অবস্থাতেই সূর্যের দিকে মোড় নিয়ে পাখা নামিয়ে আক্রমণ করতে ছুটে এল শাসা।

বোমাটারও বিস্ফোরণ হয়ে গেছে। ধুলার ঝরনা ঝরে পড়ল পিপড়ার মত এগোতে থাকা নিচের যানবাহনের সারি উপর। দ্বিতীয়বার বোমা ছুড়ল ক্যানি। ধীরে ধীরে গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে যেন মোটাসোটা একটা ডিম। চোখ কুঁচকে ইটালিয়ান কোনো অ্যামবুশ পার্টি আছে কিনা দেখে নিল শাসা। তারপর গানসাইটে চোখ রাখল।

একেবারে প্রথম ক্যানিকে নিশানা করল শাসা। বাম রাডারে স্পর্শ করে হারিকেনের নাকটাকে নিচু করে নিল। তারপর ক্যাপ্রনিকে গান সাইটে পেতেই ছয়শ’ গজ দূরে আছে। তাই ফায়ার করল না শাসা। ফিউজিলাজের প্রতীকটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ককপিটের দু’জন ইটালিয়ান পাইলটই মাটির দিকে তাকিয়ে বিস্ফোরণের দৃশ্য দেখছে।

 পাঁচশ’ গজ বাকি আছে এখনো। প্রতিপক্ষ গানারের মাথা আর কাধও দেখতে পাচ্ছে শাসা। বেচারা এখন পর্যন্ত বুঝতেই পারল না যে তার স্টারবোর্ড কোয়ার্টারের ওপর এসে গেছে তিনটা প্রাণঘাতী মেশিন।

 চারশ’ গজ কাছে চলে এল শাসা। ক্যানি ইঞ্জিনের একজাস্ট পোর্টের ধোঁয়া পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে অথচ গানার এখনো অন্য দিকেই তাকিয়ে আছে।

তিনশ’ গজ। আবারও খুলে যাচ্ছে ক্যানির ফোলা পেট। আরেকটা বোমা ফেলতে যাচ্ছে পাইলট। এবারে হাঁটুর মাঝে রাখা জয়স্টিক চেপে ধরল শাসা। ফায়ারিং বাটনের সেফটি লক স্লিপ করে দিল। সাথে সাথে গর্জন করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল ওর পাখার উপরে থাকা এইট ব্রাউনিং মেশিনগান।

দুইশ গজ। রাডার বার ঘুরিয়ে অখন্ড মনোযোগে গান সাইটে দেখছে ক্যানির ফিউজিলাজ। কিন্তু আচমকাই তার হারিকেনের নাক বরাবর ভেসে উঠল ভয়ংকর উজ্জ্বল ফসফোরোসেন্টের পুঁতি। দ্বিতীয় ক্যানির পাইলট অবশেষে তাকে দেখতে পেয়েছে। আর সতর্কতা হিসেবে ওর নাক বরাবর ফায়ার করেছে।

 একশ গজ। প্রথম ক্যানির গানার আর দুই পাইলট গুলির আওয়াজ পেয়ে মাথা ঘোরাতেই ওকে দেখে ফেলল। সাথে সাথে আতঙ্কে মেশিন গানের নাক ঘোরালো গানার। গান সাইটের মধ্যে দিয়ে লোকটার ছাইরঙা চোহারাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে শাসা।

আশি গজ। ভ্রু কুঁচকে ফায়ারিং বাটনে বুড়ো আঙুল চেপে ধরল শাসা। সাথে সাথে প্রচণ্ড ধাক্কায় সোল্ডার স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে।

গুলি করার কোনো সুযোগই পেল না ইটালিয়ান গানার। মাথার ছাদ উড়ে গিয়ে একের পর এক গুলি এসে তাকে ঝাঁঝরা করে দিল। মাথার একপাশ আর একটা হাত এমনভাবে খুলে গেল যেন ছোট্ট কোনো শিশুর ন্যাকড়ার পুতুল। ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পড়ল প্রপেলারের ভেতরে। সাথে সাথে নিশানা পরিবর্তন করল শাসা। মোমের মত গলে গলে পড়ছে ক্যানির ডানা।

 এবার মোড় নিয়ে দ্বিতীয় ক্যানির নাক বরাবর দাঁড়িয়ে গেল শাসার হারিকেন। কিন্তু প্রচণ্ড জোরে টার্ন নেয়াতে ওর নিজের ব্লেইন থেকেই যেন রক্ত সরে গিয়ে ঝাপসা হয়ে উঠল দৃষ্টিশক্তি।

 ভয়ংকর গতিতে পরস্পরের দিকে ছুটে আসছে দুইটা ফাইটার প্লেন। কাকতালীয়ভাবে ক্যানির নাকটা সামনে আসা মাত্রই স্বচ্ছ হয়ে গেল শাসার দৃষ্টিশক্তি। একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাংকরেঞ্জ থেকে গুলি করে চুলের সমান দূরত্ব দিয়ে পার হয়ে এল শাসা। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আবার ঘুরে এল। মোড় নিয়ে ডাইভ দিয়ে গুলি করে ছত্রভঙ্গ করে দিল ইটালিয়ান ফর্মেশন। অবশেষে লেজ গুটিয়ে পালাল শত্রুপক্ষ।

বিশাল শূন্য নীলাকাশে একা হয়ে গেল শাসা। এড্রেলানিলের প্রভাবে ঘামছে ও দরদর করে। অজান্তেই কন্ট্রোল কলাম এত জোরে চেপে ধরে রেখেছে যে আঙুলের গিটগুলো ব্যথা করছে। ফুয়েল গজ চেক করে দেখল। থ্রটল ফুল থাকাতে মাত্র কয়েক মিনিটেই হাফ ট্যাঙ্ক খালি হয়ে গেছে।

 “পপি ফ্লাইট, দিস ইজ লিডার, সব ইউনিট নিয়ে আসছি।” মাইক্রোফোনে কথা বলতেই সাথে সাথে উত্তর পেয়ে গেল শাসা।

“লিডার, দিস ইজ থ্রি!” তিন নম্বর হারিকেন থেকে কথা বলে উঠল তরুণ লিরক্স, “আমার ট্যাংক চারভাগের এক ভাগ ভর্তি হওয়াতে নিচে যাচ্ছি।”

“অল রাইট থ্রি, বেসে ফিরে যাও।” আদেশ দিল শাসা। তারপর আবার জানতে চাইল, “টু, দিস ইজ লিডার, শুনতে পাচ্ছ?”

চারপাশে তাকিয়ে ডেভিডের এয়ারক্রাফট খুঁজে না পেয়ে খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল শাসা।

“কাম ইন, টু” আবারো চিৎকার করে উঠল। কী মনে করে নিচে তাকাতেই দেখা গেল বাদামি ভূমি থেকে উঠছে ভাঙা এয়ারক্রাফটের ধোঁয়া। সাথে সাথে জীবন্ত হয়ে উঠল মাইক্রোফোন। ডেভিড স্পষ্ট গলায় জানাল, “লিডার দিস ইজ টু। আমার ড্যামেজ হয়েছে।

“ডেভিড, তুমি কোথায়?”

 “কেরিন থেকে প্রায় দশ মাইল পূর্বদিকে, উচ্চতা আট হাজার ফুট।”

পূর্বদিকে তাকাতেই নীল আকাশে ধূসর রঙের পাতলা একটা ধোঁয়ার রেখা দেখতে পেল শাসা। ঠিক যেন পাখির পালক।

“ডেভিড আমি তোমার এরিয়াতে ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছি। আগুন লাগেনি তো?”

“হ্যাঁ। আমার ইঞ্জিনে আগুন লেগেছে।”

“আমি আসছি ডেভিড, হোন্ড অন।”

 হারিকেনের ডানা খাড়া করে প্রটল পুরোপুরি খুলে দিল শাসা।

ওর একটু নিচেই চিৎকার করে উড়ছে ডেভিড।

 “ডেভিড অবস্থা কতটা খারাপ?” জানতে চাইল শাসা।

“মনে হচ্ছে টার্কির রোস্ট হচ্ছে। এবারে জ্বলন্ত হারিকেনটাকে দেখতে পেল শাসা।

মেশিনটাকে একপাশে কাত করে রেখেছে ডেভিড। ফলে আগুনের শিখা ককপিটের ছাদে না গিয়ে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। খুব দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে প্লেন।

ডেভিডের চেয়ে দুইশ গজ উপরে থেকে নিজের স্পিড কমাল শাসা। ডেভিডের হারিকেনের ডানা আর ইঞ্জিনে বুলেটের গর্ত দেখা যাচ্ছে। ইটালিয়ানদের কেউ একজন ডেভিডের উপরে ভালো শোধ নিয়েছে। এদিকে আটকে গেছে ককপিটের ঢাকনা। তাই খোলার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে ডেভিড।

“ভেতরে তো ডেভিড সিদ্ধ হয়ে যাবে।” মনে মনে ভাবল শাসা আর ঠিক সে মুহূর্তেই সহজভাবে খুলে গেল ককপিটের ঢাকনা। চোখ তুলে শাসার দিকে তাকাল ডেভিড। আর ঠিক তখনই বাতাসে ভেসে আসা এক ফুলকি থেকে ছেলেটার টিউনিকের হাতায় আগুন লেগে গেল।

 “কোনো দরকারই নেই এটার! আমি গলে যাচ্ছি শাসা!” ডেভিডের ঠোঁট নড়ে উঠতেই ইয়ারফোনে শুনতে পেল শাসা। কিন্তু ও কিছু বলার আগেই ডেভিড মাথা থেকে হেলমেট খুলে কাঁধের শোল্ডার স্ট্রাপও নামিয়ে রাখল। বিদায় দেয়ার মত করে এক হাত উপরে তুলে স্যালুট করেই খোলা ককপিট থেকে নিচে লাফ দিল ডেভিড।

স্টারফিশের মত হাত-পা ছড়িয়ে ভাসতে ভাসতে নিচে নামছে ডেভিড। তারপর হঠাৎ করেই খুলে গেল পিঠের প্যারাস্যুট। খানিকটা ঝাঁকুনি খেয়েই আবার সিধে হয়ে গেল ডেভিড। আরো পাঁচ হাজার ফুট নিচে আছে মাটি। মৃদু বাতাসে দক্ষিণের দিকে ভেসে গেল ডেভিডের প্যারাস্যুট।

নিচে অবতরণরত প্যারাস্মুটের মতই একই উচ্চতায় হারিকেন নিয়ে নেমে এল শাসা। মাঝখানে দুই থেকে তিনশ’ গজ দূরত্ব রেখে আস্তে আস্তে ডেভিডকে ঘিরে চক্কর কাটছে। ককপিট থেকে বকের মত গলা বাড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করল যে ছেলেটা কোথায় নামবে। কিন্তু রেড লাইনের ঠিক উপরে কাঁপছে ওর ফুয়েল গজের কাঁটা।

বহু নিচের ধূলিময় সমতল ভূমির ওপর পড়ে চূর্ণ হয়ে গেল ডেভিডের জ্বলন্ত হারিকেন। শাসার ঠিক নিচেই বেশ কয়েকটা গিরিখাদের পরে মসৃণ একটা উপত্যকা দেখা যাচ্ছে। একেবারে শেষ খাদটার কাছাকাছি নামতে যাচ্ছে ডেভিড।

চোখ সরু করে তাকাল শাসা! মানুষের বসতি! উপত্যকার শেষ মাথায় কয়েকটা কুঁড়েঘর দেখে খুশি হয়ে উঠল শাসা। কিন্তু তারপরেই মনে পড়ে গেল ক্ষত-বিক্ষত হতভাগ্য পাইলটদের ছবি। সাথে সাথে শক্ত হয়ে গেল চোয়াল। ওদিকে প্যারাসুট নিয়ে দোল খেতে খেতে নামছে ডেভিড।

হারিকেন নিয়ে নেমে এসে মাটি থেকে পঞ্চাশ ফুট উপরে স্থির হল শাসা। তারপর আবার উপত্যকার পাথুরে খাদের কিনারে চলে এল। চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন মানুষ।

গ্রামেরই কয়েকজন মানুষ উপত্যকা বেয়ে নিচে নামছে। খালি আর কালো পাগুলোর উপর দুলছে নোংরা ছাই রঙা আলখাল্লা। তবে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে লোকগুলো সবাই সশস্ত্র। কারো হাতে সম্ভবত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আনা আধুনিক কার্বাইন আর কারো হাতে লম্বা মাজলঅলা পিস্তল।

 নিচু দিয়ে লোকগুলোর মাথা প্রায় স্পর্শ করে উড়ে গেল হারিকেন। সাথে সাথেই কাঁধে রাইফেল তুলে শাসার দিকে তাক করল কয়েকজন। গুলি করাতে কালো পাউডারের ধোয়াও দেখা গেল। কিন্তু হারিকেনে একটাও লাগল না।

তাই লোকগুলো কোন জাতের বুঝতে একটুও কষ্ট হল না শাসার। খাদের তলদেশের দিকে রাইফেল হাতে ছুটছে লোকগুলো, যেন ডেভিডকে ধরতে পারে।

আরেকটু নিচে নেমে পাঁচশ গজ উপরে থাকতেই এইট ব্রাউনিং চালু করল শাসা। সাথে সাথে যেন ধূলিঝড়ে ছেয়ে গেল চারপাশ।

কিন্তু উপত্যকার মাথায় একটা পাহাড় আছে দেখে বাধ্য হয়ে মেশিন গান বন্ধ করে উপরে উঠে এল শাসা। আবার ঘুরে পুনরায় দলবেঁধে এগোচ্ছে শুটা। ওদিকে এক হাজার ফুট উচ্চতায় নেমে এসেছে ডেভিডের প্যারাস্যুট। বোঝাই যাচ্ছে যে ও খাদের ঢালুতেই পড়বে।

দ্বিতীয় আক্রমণের জন্য তৈরি হল শাসা। কিন্তু এবার হারিকেন দেখে আগেই পাথরের পেছনে লুকিয়ে পড়েছে শুফটা ডাকাত দল। ফলে মেশিনগান গর্জে উঠলেও আদতে কোনো লাভই হল না।

ঘাড় ঘুরিয়ে ডেভিডের দিকে তাকাল শাসা। খাদ থেকে কয়েক ফুট দূরে পড়াতে সোজা নিচে পড়ে গেল প্যারাসুট।

 মাটিতে মাথা দিয়ে পড়ল ডেভিড। বেশ কয়েকবার পাথুরে ঢালুতে গড়ান দিয়ে অবশেষে স্থির হল প্যারাস্যুট।

 গায়ে পেঁচিয়ে যাওয়া প্যারাস্যুটটাকে খুলতে গিয়ে প্রচণ্ড ঝামেলা হল। তারপরেও হানেশ খুলে মুক্ত হতেই দেখতে পেল দূর থেকে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে শুফটা বাহিনি। শাসা দেখল হোলস্টার খুলে সার্ভিস পিস্তলটাকে হাতে নিয়ে চোখ তুলে ওর দিকে তাকাল ডেভিড।

প্রায় ওর কাছাকাছি নেমে এল হারিকেন। ইশারা করে ঢালুর নিচের জায়গাটা দেখাল শাসা। কিন্তু কিছুই না বুঝে তাকিয়ে আছে ডেভিড। আসলে ও হাল ছেড়ে দিয়েছে। এতবড় পাহাড়ে বেচারাকে দেখাচ্ছে একেবারে এতটুকুন মাত্র। হাত নেড়ে শাসাকে বিদায় জানিয়েই উদ্যত ডাকাত দলের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হল ডেভিড।

গর্জন করে ছুটে গিয়ে আরেকবার শুফটাদের ওপরে ফায়ার করল শাসা। কিন্তু লোকগুলো তার আগেই কাভার নিয়ে নিয়েছে। তবে এখনো ডেভিডের কাছ থেকে হাফ মাইল দূরে আছে। হারিকেনের নাক যতটা সম্ভব ঘুরিয়ে ডেভিডের দিকে উড়ে এল শাসা। আর সাথে সাথে নামিয়ে দিল দড়ির মই। ডেভিডের পাশ দিয়ে আসার সময় আবার উপত্যকার নিচে ইশারা করে দেখাল।

এবারে বুঝতে পেরে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ডেভিডের চেহারা। লম্বা লম্বা পায়ে পাথরের উপর দিয়ে দৌড়ানো শুরু করল ডেভিড।

উপত্যকার শেষ মাথায় ঢালুর নিচে এবড়ো-খেবড়ো একটা ল্যাভস্ট্রিপের উপর সমান্তরাল হয়ে ভাসতে লাগল শাসার হারিকেন। ডেভিড প্রায় অর্ধেক নেমে এসেছে। ওফটারাও জোর চেষ্টা চালাচ্ছে ওকে ধরার জন্য; একেবারে শেষ মুহূর্তে হারিকেন নামাতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ে গেল শাসা। পাথুরে জমিনে ঝাঁকি খেতে খেতে শাসার শোল্ডার স্ট্র্যাপ খুলে ছিঁড়ে গেল।

যাক তারপরেও নিচে নামতে পেরেছে হারিকেন। অন্যদিকে ডেভিডও প্রায় খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে।

কিন্তু ও যে পারবে না তা সাথে সাথে বুঝে গেল শাসা। কারণ শুফটাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী চার রানার প্রায় ডেভিডকে ধরেই ফেলেছে। অন্য একটা শুফটা থেমে লংরেঞ্জে গুলি করা শুরু করল। পুরো ঢালু জুড়ে ধুলাবৃষ্টির পাশাপাশি শাসা ভয় পেয়ে দেখে যে কয়েকটা বুলেট একেবারে ডেভিডের আশপাশেই পড়েছে।

এরপরই হারিকেনকে ঘুরিয়ে নিয়ে সোজা চার শুফটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্রাউনিং চালিয়ে দিল শাসা। পুরো জায়গাটা জুড়ে সৃষ্টি হল টর্নেডোর মত গুলিবৃষ্টি। উন্মাদের মত দৌড়াতে থাকা দু’জন শুফটা সাথে সাথে হয়ে গেল লাল ন্যাকড়ার দলা। ধুলার মেঘের ভেতরে হারিয়ে গেল তৃতীয় জন আর চতুর্থ জন মাটিতে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল।

আর মাত্র কয়েকশ’ গজ দূরে আছে ডেভিড। ককপিটের নিচে ঝুঁকে এল শাসা, কাম অন ডেভি, এইবার গোল্ড মেডেল হবে বয়!” চিৎকার করে উঠল শাসা।

হঠাৎ করে কিছু একটা ককপিটের ছাদে লাগতেই ঠং করে আওয়াজ হল। সাথে উঠে গেল রঙের ছিলকা। চট করে মাথা পেছনে ঘোরাল শাসা। দেখে যে পেছন থেকে দৌড়ের মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে ফায়ার করছে এক শুফটা। আরেকটা বুলেট ছুটে আসতেই বাধ্য হয়ে মাথা নামিয়ে নিল শাসা।

“কাম অন ডেভি” মনে মনে যেন রোলস রয়েস ইঞ্জিনের গর্জন ছাপিয়েও শুনতে পাচ্ছে ডেভিডের হাঁপানোর আওয়াজ। ঠিক সেই মুহূর্তে ছিটকে এসে ডানা ছিদ্র করে দিল আরেকটা বুলেট।

“কাম অন ডেভি।” ঘামে ভিজে চকচক করছে ডেভিডের সারা মুখ আর শরীরের টিউনিক। যাই হোক, শেষবার একটা লাফ দিয়েই হারিকেনের ডানা ধরে ফেলল ডেভিড। ওর ভারে কাত হয়ে গেল এয়ারক্রাফট।

“আমার কোলে উঠে আসো!” হাঁপাতে হাঁপাতে শাসার উপর উঠে এল ডেভিড।

“আরে আমি তো সামনে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। চিৎকার করে উঠল শাসা। তুমি স্টিক আর থ্রটল ধরো। আমি রাডার নিয়ে কাজ করছি।” দ্রুত হয়ে উঠল ইঞ্জিনের গতি। পূর্ণগতিতে আগে বাড়ল হারিকেন।

“বাম পাশের রাডারটা স্পর্শ করো।” ভাঙা ভাঙা ক্লান্তিমাখা কণ্ঠে জানাল ডেভিড। বাম রাডার এক ইঞ্চি ঠেলে দিল শাসা।

এদিকে ডেভিডের নিচে সিটের ওপর প্রায় ডুবে গেছে শাসা। সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কেবল মাথা ঘুরিয়ে ককপিটের কিনার দিয়ে দেখল যে দ্রুত ছুটে চলেছে হারিকেন। শুকনো ভুট্টার গাছে ডানার বাড়ি লেগে ঠিক বুলেটের শিষ কাটার মত শব্দ হচ্ছে চারপাশে। সমস্ত শুফটা এখন একযোগে ফায়ার করছে। কিন্তু দ্রুত বাড়ছে দু’পক্ষের মধ্যকার দূরত্ব।

“আমরা পেরেছি!” সফলতার আনন্দে চিৎকার করে উঠল শাসা। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু একটা এসে আঘাত করল ওর মুখে।

মানুষের বুড়ো আঙুলের সমান মোটা আর লম্বা একটা বুলেট এসে ঠিক শাসার মাথার পাশের ককপিটের ছাদে লাগায় ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ল ওর মুখের উপরে। কিন্তু গতি কমে একপাশে আঘাত করল কেবল।

তারপরেও জ্ঞান হারায়নি শাসা। শুধু মনে হল যেন বাম চোখের কোনায় হাতুড়ির বাড়ি খেয়েছে। মাথা এত জোরে ঝাঁকুনি খেলো যে ককপিটের অপর পাশে গিয়ে ধাক্কা খেলো শাসা। সাথে সাথে চোখ থেকে গড়াতে লাগল রক্ত। মুখের উপর যেন একটা পর্দা নেমে এল। “ডেভিড!” আর্ত চিৎকার দিয়ে উঠল শাসা, “আয়্যাম হিট! আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না!”

মাথা ঘুরিয়ে শাসার মুখের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল ডেভিড। ওর মুখে এসেও লাগল শাসার রক্তের ছিটে।

“আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।” ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে শাসা। মনে হচ্ছে যেন ওর মুখের মাংস গলে পড়ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি না। ওহ গড ডেভি!”

নিজের গলায় পেঁচানো সিল্কের স্কার্ফ খুলে শাসার হাতে দিল ডেভিড।

“এটা দিয়ে চেপে ধরে। রক্ত পড়া বন্ধ করতে হবে।” ইঞ্জিনের গর্জন ছাপিয়ে চিৎকার করে উঠল ডেভিড। স্কার্ফটাকে দলা বানিয়ে ক্ষতের ওপর চেপে ধরল শাসা। হারিকেন চালানোয় মনোযোগ দিল ডেভিড।

মিনিট পনেরো বাদেই জিরগা আলেম এয়ারস্ট্রিপের গাছগুলোর মাথায় চলে এল হারিকেন। ট্যাক্সিং করে নিচে নামতেই দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে অ্যাম্বুলেন্স।

চারপাশে রক্তের দাগ লেগে যাওয়া ককপিট থেকে শাসাকে বের করে আনা হল। ডেভিড আর স্বাস্থ্যকর্মী মিলে খানিকটা হটিয়ে শাসাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিল। এর মিনিট পনেরোর মধ্যেই হাসপাতালের তাঁবুতে অ্যানেশথেসিয়া দিয়ে অপারেশন টেবিলে শুইয়ে দেয়া হল শাসাকে।

এরপর যখন ওর জ্ঞান ফিরল; মনে হল চারপাশ গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। হাত উঠিয়ে মুখ স্পর্শ করল শাসা। সাথে সাথে সারা মুখে ব্যান্ডেজের ছোঁয়া পেতেই আতঙ্কে ভরে গেল বুক।

 “ডেভিড!” মন চাইল চিৎকার করে ওঠে; কিন্তু গলা দিয়ে কেমন চিহি একটা আওয়াজ বেরোলো।

“অল রাইট শাসা, আমি এখানেই আছি।” কাছেই বন্ধুর কন্ঠ শুনে হাতড়াতে লাগল শাসা।

“ডেভি! ডেভি!”

“কিছু হয়নি শাসা, সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ডেভিডের হাত পেয়ে চেপে ধরল শাসা, “আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। অন্ধ হয়ে গেছি।”

“এগুলো কেবল ব্যান্ডেজ। আর কিছু না।” ওকে আশ্বস্ত করল ডেভিড। “ডাক্তার তোমার অবস্থা নিয়ে খুব খুশি।”

“আমার সাথে মিথ্যে বলছো না তো? বলল যে আমি অন্ধ হয়ে যাইনি?” আকুতি জানাল শাসা।

“না, তুমি অন্ধ হয়ে যাওনি।” ফিসফিস করে উঠল ডেভিড; কিন্তু ভাগ্য ভালো যে শাসা ওর চেহারা দেখছে না। এক মিনিট বাদে আবারো পেইন কিলারের কল্যাণে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল শাসা।

 সারারাত ওর পাশে বসে রইল ডেভিড। ওভেনের মত গরম চারপাশে। তাই শাসার গলা আর বুকের ঘাম মুছে দিল ও। নিদ্রার ঘোরে মাঝে মাঝেই মাকে ডাকছে শাসা, “মা? তুমি কী এসেছো?”

মাঝরাতে এসে ডাক্তার ডেভিডকে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বললেও নড়ল না ডেভিড।

“ও যদি জেগে ওঠে! তাই আমার এখানে থাকতেই হবে। আমিই ওকে কথাটা বলতে চাই। আমার জন্যই আজ ওর এই অবস্থা।”

ভোর হতেই বাইরে শোনা গেল নেকড়ের ডাক। আর সূর্যের প্রথম রশি ক্যানভাসের ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকতেই জেগে উঠল শাসা; সাথে সাথে জানতে চাইল, “ডেভিড?”

“এই তো আমি এখানে শাসা।” “ব্যথায় অনেক কষ্ট পাচ্ছি ডেভি। কিন্তু তুমি তো বলেছিলে যে সব ঠিক হয়ে যাবে। মনে আছে?”

“হ্যাঁ। আমি তাই বলেছিলাম।”

“আমরা একসাথে আবার আকাশে উড়ব, তাই না ডেভি বয়? কোর্টনি আর আব্রাহামস টিম, একসাথে?”

উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করল শাসা। কিন্তু চারপাশ চুপচাপ শুনেই বদলে গেল ওর গলা। “আমি কি অন্ধ হয়ে গেছি, ডেভিড? আমরা আর আকাশে উড়তে পারব না?”

“তুমি অন্ধ হয়ে যাওনি।” নরম স্বরে জানাল ডেভিড; “কিন্তু আর প্লেন চালাতে পারবে না। শাসা, তোমাকে এবার বাড়ি ফিরে যেতে হবে।”

“আমাকে বলল কী হয়েছে!” তীক্ষ্ণ স্বরে আদেশ দিলো শাসা।

 “এরকম লুকোচুরিতে ব্যাপারটা আরো খারাপ হচ্ছে।”

“অল রাইট। সোজাভাবেই বলছি, শোনো, বুলেটে তোমার বাম চোখের মণি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ডাক্তার তাই এটা বের করে ফেলেছে।”

 হাত তুলে মুখের বাম পাশে স্পর্শ করল শাসা। কিছুতেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।

 “ডান চোখের কোনো সমস্যা নেই। দৃষ্টিশক্তিও পুরোটাই অক্ষুণ্ণ আছে। কিন্তু তুমি আর হারিকেন চালাতে পারবে না। আয়্যাম সরি শাসা।”

“ইয়েস” ফিসফিস করে উঠল শাসা, “আমিও।”

সন্ধ্যাবেলা আবার ওকে দেখতে এল ডেভিড, “সিও তোমাকে ডিএফসি দিয়েছে। পেয়ে যাবে আশা করছি।”

“যাক, তার দয়া।” বলে উঠল শাসা; তারপরেই হঠাৎ করে চুপ করে গেল দুই বন্ধু। খানিকক্ষণ বাদে ডেভিড বলল,

“তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ শাসা।”

 “ওহ, শাট আপ ডেভিড, এসব হাবিজাবি কথা শুনতে ভালো লাগছে না।”

“কাল সকালে ডাকোটা প্লেনে করে তোমাকে উপকূলে নামিয়ে দিয়ে আসা হবে। বড়দিন কেপটাউনে করবে। ম্যাটি আর বেবিকে আমার হয়ে কিস দিও। এক্ষেত্রে তুমিই ভাগ্যবান হলে বুঝেছো?”

“সেটা বদলেও যেতে পারে। যাই হোক তুমি বাড়ি এলে দেখো কত বড় পার্টি দিব।”

“এখন কি তোমার জন্য কিছু করব? কিছু লাগবে?” উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল ডেভিড।

“তাহলে আমার জন্য এক বোতল হুইস্কি আনতে পারবে না ডেভি?”

***

টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে ম্যানফ্রেড ডি লা রে’র দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ইশারা করল সাবমেরিন কমান্ডার।

“এদিকে দেখুন প্লিজ!” কমান্ডারের জায়গায় ম্যানফ্রেড বসে রাবার প্যাডে কপাল চেপ ধরে একদৃষ্টে তাকাল লেন্সের ভেতর দিয়ে সামনে।

তীর থেকে তারা এখনো দুমাইল দূরে আছে। বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার। ডুবতে বসেছে সূর্য।

 “ল্যান্ডমার্কসটা পরিচিত লাগছে?” ইউ বোট কমান্ডারের প্রশ্নের চট করে কোনো উত্তর দিল না ম্যানফ্রেড। হঠাৎ করেই কেন যেন খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে।

 পাঁচ বছর, দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আবার দেখছে এই অতিপ্রিয় উপকূলভূমি। ভালোভাবেই জানে যে আফ্রিকা ছাড়া আর কোথাও গিয়ে সত্যিকারের খুশি হতে পারবে না কখনো।

যাই হোক, মাঝখানের বছরগুলোও একেবারে খারাপ কাটেনি। হেইডি। তো ছিলই; গত বছর পুত্রসন্তান লোথারেরও বাবা হয়েছে ম্যানফ্রেড। আর এর সাথে নিজের দায়িত্ব তো আছেই। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল’তে মাস্টার্সও শেষ হয়েছে।

 আরো ছিল বিভিন্ন ধরনের সামরিক প্রস্তুতি। এখন জার্মান আবওয়ের এক দক্ষ আর সুপ্রশিক্ষিত অপারেটর হিসেবে কাজ করছে ম্যানফ্রেড। দশবার প্যারাস্যুট নিয়ে জাম্প দেয়া ম্যানফ্রেড হালকা এয়ার ক্রাফট আর বিস্ফোরক ও ছোটখাটো অস্ত্র চালাতেও সমান পারদর্শী। যেকোনো ধরনের কোড পড়তে ও ভাঙতে দক্ষ ম্যানফ্রেড গুপ্ত হত্যার জন্য সুনিপুণভাবে প্রস্তুত থাকে সবসময়। জনসমাবেশে বক্তৃতা দিতে পটু মানি জানে দক্ষিণ আফ্রিকার নাজুক অংশ কোনগুলো আর কীভাবে এর ফায়দা নিতে হবে। তার ধারণা ওর মত এত সুযোগ আর কাউকে দেয়া হয়নি, আর তা হল ইতিহাসকে ভেঙেচুরে পৃথিবীকে নতুন ছাঁচে গড়ে তোলা।

 “ইয়েস” এতক্ষণে জার্মান ভাষায় উত্তর দিল ম্যানফ্রেড, “ল্যান্ডমার্কসটা স্পষ্ট চিনতে পেরেছি।”

এখানে একবার সামার হলিডে কাটিয়ে গেছে ম্যানি। দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার এই উপকূলে রুলফ স্ট্যান্ডারের পারিবারিক পাঁচ হাজার একর জমি আছে। ওই তো সূর্যাস্তের আলোয় পাহাড়ের নিচের হোয়াইট ওয়াশ করা ছোট্ট হলিডে কটেজটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যেখানে ওরা দুজন একসাথে হলিডে কাটিয়েছে মাছ ধরে আর পাহাড়ে চড়ে।

“ইয়েস” আবার জার্মানিতেই জানাল ম্যানফ্রেড, “এখানেই মিলিত হবার কথা বলা হয়েছে।”

“তাহলে আমাদেরকে সঠিক সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”

তীর থেকে দুই মাইল দূরে থাকা অবস্থাতেই পানির বিশ মিটার নিচে ইঞ্জিন বন্ধ করে পড়ে রইল সাবমেরিন। খানিক বাদে বাইরে রাত নামার পর সরু গলিপথ ধরে ছোট্ট কিউবিকলে গিয়ে তীরে নামার প্রস্তুতি নিল ম্যানফ্রেড।

ব্রেমারহ্যাভেন ছাড়ার পর থেকে গত কয়েক সপ্তাহে এই ছোট্ট কিউবিকলে আরো দু’জন জুনিয়র অফিসারের সাথে থাকতে থাকতে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠেছে ম্যানি। মাথা থেকে কখনোই এ ভাবনাটা দূর হয়নি যে একটা লোথার বাক্সে চেপে ঘুরছে সমুদ্রের পানির নিচে। তাই ফুসফুস ভরে পরিষ্কার বিশুদ্ধ বাতাস আর আফ্রিকান রোদের জন্য আঁকুপাকু করেছে প্রাণ।

দ্রুত গায়ের জার্সি আর জ্যাকেট খুলে গ্রাম্য এক আফ্রিকানের পোশাক পরে নিল। আর বহুদিন পাহাড়ে চড়ে ট্রেনিং করাতে গায়ের রঙও বাদামি হয়ে গেছে। ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে লম্বা চুল। ঘন আর কোঁকড়ানো দাড়ি থাকাতে বয়সও বেশিই মনে হয়। বাঙ্কের উপর ঝোলানো আয়নায় নিজের মুখটা দেখে আপন মনেই ভাবল, “আমার নিজের পরিবারই এখন আর আমাকে চিনতে পারবে না।”

চোখের ভ্রূ’র মত করে চুল আর দাড়িতেও কালো রঙ করে নিল। আমেরিকান সাইরাস লোম্যাক্স ভেঙে দেয়ার পরে নাকটাও বেঁকে গেছে। পুরোপুরি আর কখনোই স্বাভাবিক হয়নি। তাই পাঁচ বছর আগে আফ্রিকা থেকে আসা তরুণ আর সোনালি চুলের অ্যাথলেটের সাথে এখনকার ম্যানফ্রেডের আর কোনোই মিল নেই।

তারপর বাঙ্কের নিচে বের করে আনল ওয়াটার প্রুফ কন্টেইনারে ভরা ইকুপমেন্ট। লিস্টের সাথে মিলিয়ে প্রত্যেকটা আইটেম চেক করে দেখার পর জার্মান নাবিক যন্ত্রগুলোকে নিয়ে রেখে দিল সাবমেরিনের কনিং টাওয়ারের সিঁড়ির নিচে।

হাতঘড়ি চেক করে দেখল ম্যানফ্রেড। দ্রুত খেয়ে তৈরি হতে হবে। কিন্তু খানিক বাদেই ডাক আসাতে মুখে খাবার নিয়েই ইউ বোটের কন্ট্রোল রুমেছুটল।

 “তীরে আলো দেখা যাচ্ছে।” হাত ইশারা করে ম্যানফ্রেডকে পেরিস্কোপে বসতে বললেন ক্যাপ্টেন।

বাইরে অন্ধকার গাঢ় হলেও তিনটা বিকন ফায়ার পরিষ্কার দেখতে পেল ম্যানফ্রেড।

“এটাই সঠিক রিক্যানিশন সিগন্যাল, ক্যাপ্টেন” সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে। নেড়ে জানাল, “পানির উপরে উঠে আমাদেরও উত্তর দেয়া উচিত।”

ট্যাঙ্ক থেকে আবদ্ধ বাতাস বের করে দেয়ার পর গভীর পানি থেকে ভেসে উঠল ইউ বোট। মই বেয়ে ব্রিজে উঠে এলেন ক্যাপ্টেন আর ম্যানফ্রেড। বাইরের তাজা আর শীতল বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বাইনোকুলারে চোখ দিয়ে সামনে তাকাল ম্যানি।

সিগন্যালের দায়িত্বে থাকা নাবিককে ইশারা দিলেন ক্যাপ্টেন। সাথে অন্ধকার সমুদ্র চিরে দিল উজ্জ্বল হলুদ আলো। ফুটে উঠল মোর্স অক্ষর ডব্লিড এবং এস। যার মানে হল হোয়াইট সোর্ড। এর কিছুক্ষণ পরেই পরপর দু’বার জ্বলে উঠল উপকূলে থাকা বিকন লাইট।

 “ঠিক আছে, এইভাবেই উত্তর আসার কথা ছিল। প্লিজ আমার ইকুপমেন্টগুলো ডেকে নিয়ে আসুন ক্যাপ্টেন।” বলে উঠল ম্যানি।

 আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর খুব কাছ থেকে কেউ একজন বলে উঠল, “হোয়াইট সোর্ড?”

“চলে এসো।” আফ্রিকান ভাষায় উত্তর দিলো ম্যানি। লম্বা দাঁড় দিয়ে বেয়ে কাছে এগিয়ে এল ছোট্ট খোলা একটা ফিশিং বোট।

 তাড়াতাড়ি ইউ বোটের ক্যাপ্টেনের সাথে হাত মিলিয়ে স্যালুট করল ম্যানফ্রেড; বলল, “হেইল হিটলার!”

তারপর হামাগুড়ি দিয়ে নেমে এল ফিশিং বোটে। হঠাৎ করেই সামনের সিটের মাঝি ডেকে উঠল, “ম্যানি, তুমি?”

 “রুলফ!” বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল ম্যানফ্রেড। “তোমাকে দেখে বেশ ভালো লাগছে! আমার ইকুপমেন্ট তুলে নেই চলো।”

ইউ বোটের ক্রুরা রাবারের ক্যানিস্টারগুলো ফিশিং বোটে নামিয়ে দিয়েই ছোট্ট নৌকাটাকে ধাক্কা দিয়ে আবার ভাসিয়ে দিল। রুফের পাশে বসে দাঁড় টেনে নিল ম্যানি। আস্তে আস্তে আবার পানির নিচে ডুবে গেল সাবমেরিন।

তীরে ফিরে আসতে গিয়ে আস্তে করে জানতে চাইল ম্যানি, “অন্যেরা কারা?” চিবুক তুলে বাকি তিন মাঝির দিকে ইশারা করল।

“সবাই আমাদের লোক, এ জেলার স্থানীয় কৃষক। সেই ছোটবেলা থেকেই ওদেরকে চিনি। পুরোপুরি বিশস্ত, কোনো সমস্যা নেই।”

সৈকতে পৌঁছেই বালির ওপরে নৌকাটাকে টেনে নলখাগড়ার বনে লুকিয়ে ফেলা হল। তারপর রুলফ বলল, “আমি ট্রাক নিয়ে আসছি।” কয়েক মিনিট পরেই এবড়োখেবড়ো রাস্তায় দেখা গেল ট্রাকের হেডলাইট। তিনজন কৃষকও এসে সাহায্য করল।  ম্যানির সব ইকুপমেন্ট ট্রাকে ভোলার পর ক্যানিস্টারগুলোকে পুরনো তেরপল দিয়ে ঢেকে দেয়া হল। ক্যাবের প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসল ম্যানি; কৃষকেরা পেছনে।

 “সবার আগে আমাকে আমার পরিবারের কথা বল।” এতক্ষণে ব্যস্ত হয়ে উঠল ম্যানি, “বাকি কাজের কথা পরে।”

 “আংকেল ট্রম্প একদম আগের মতই আছেন, কী যে উপদেশ দেন। সারি আর আমি প্রতি রবিবারে যাই”।

“কেমন আছে সারাহ? আর বাচ্চাটা?” জানতে চাইল ম্যানফ্রেড।

“তুমি তো দেখছি সেই আদিম যুগেই পড়ে আছে।” হেসে ফেলল রুলফ, “এখন ছেলেমেয়ের সংখ্যা তিন। দুইজন ছেলে আর মেয়ের বয়স তিন মাস। শীঘই ওদেরকে দেখতেও পাবে।”

তারপর একে একে তিন কৃষককে ধন্যবাদ জানিয়ে যার যার ঘরে নামিয়ে দেয়ার পর আবার একা হল দুই বন্ধু। আরো কয়েক মাইল এগিয়ে রিভারসূডেল গ্রামের পাশ দিয়ে পশ্চিমে ছুটল কেপটাউনের উদ্দেশে। এভাবেই ছুটে চলল সারা রাত। মাঝখানে কেবল একবার থেমে ট্রাকে তেল ভরা হল।

 চার ঘণ্টা বাদে রাত তিনটায় স্টিলেনবশের কয়েক মাইল বাইরে কো অপারেটিভ ওয়াইন কোম্পানির সামনে এসে থামল ট্রাক। অপেক্ষারত ম্যানেজারও এসে রাবারের ক্যানিস্টারগুলোকে ট্রাক থেকে নামিয়ে সেলারে নিয়ে যেতে সাহায্য করল।

“এই হল সাক্কি ভ্যান ভুরেন” ম্যানেজারের সাথে ম্যানিকে পরিচয় করিয়ে দিলো রুলফ, “ও খুব ভালো আর তোমার ইকুপমেন্টের জন্য নিরাপদ জায়গাও খুঁজে বের করেছে।”

সেলারের ভেতরে ঢুকল তিনজনে। কাঠের তাকগুলোর একেবারে শেষ সারিতে দেখা গেল হাজার হাজার গ্যালন ভর্তি ওয়াইনের পিপা। কিন্তু ম্যানেজার একটার উপর বাড়ি মারতেই ভেসে এল ফাঁকা আওয়াজ। তার মানে এই গ্যালনটা ফাঁকা।

 “আমি নিজে এটা করেছি” পিপার দরজার খুলতেই ভেতরের শূন্যতা দেখিয়ে ম্যানেজার বলল, “কেউ এখানে ইকুপমেন্টগুলো কখনো খুঁজেই পাবে না।”

অতঃপর রাবারের ক্যানিস্টারগুলোকে পিপায় ভরে ঢাকনি লাগিয়ে দেয়া হল।

“সময় হলেই আমরা যাত্রা শুরু করব। কিন্তু সে সময়টা কখন?” জানতে চাইল ওয়াইনমেকার।

সোজা কোনো তারিখ না দিয়ে ম্যানফ্রেড কেবল জানাল, “শীঘ্রই।”

তারপর দু’বন্ধু মিলে চলে এল স্টিলেনবশ।

 “ঘরে ফেরার আনন্দই আলাদা।”

“তুমি এখানে কেবল আজ রাতটাই থাকবে ম্যানি।” জানিয়ে দিল রুলফ। “ভাঙা নাক আর কালো চুল সত্ত্বেও তোমাকে এখানকার সবাই দেখার সাথে সাথেই চিনে ফেলবে।”

রেলওয়ে স্টেশনের কাছে এক সেকেন্ড হ্যান্ড কার ডিলারের উঠানে ট্রাকটাকে পার্ক করে ফ্লোর ম্যাটের নিচে চাবি রেখে দিলো রুলফ। তারপর দু’জনে মিলে সুনসান রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে এল রুলফের বাড়িতে। রান্নাঘরের পেছনকার দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়াল অত্যন্ত পরিচিত এক অবয়ব, “আংকেল ট্রম্প!” সবিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল ম্যানি; হাত বাড়িয়ে দিলেন আংকেল। দৌড়ে গিয়ে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ম্যানি।

 “এই দাড়িতে তো তোমাকে ভয়ংকর এক গুণ্ডা লাগছে দেখতে” হেসে ফেললেন আংকেল, “আর আমেরিকানটা তো দেখি নাকটাকে চিরতরে ভোতা বানিয়ে দিয়েছে। এবারে আংকেলের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ানো সারাহকে দেখতে পেয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল ম্যানি, “সারাহ? হাউ আর ইউ মাই লিটল সিস্টার?”

“আমি কখনোই তোমার ছোট বোন ছিলাম না ম্যানফ্রেড। কিন্তু বেশ ভালো আছি, থ্যাঙ্ক ইউ।” এগিয়ে এসে ম্যানিকে জড়িয়ে ধরার কোনো চেষ্টাই করল না সারাহ্। দেখে খানিকটা থতমত খেয়ে গেলো ম্যানফ্রেড। “তুমি খুশি তো সারাহ?”

“আমার চমৎকার একজন স্বামী আর তিনজন ছেলেমেয়ে আছে। যাই হোক বসো; আমি নাশতা তৈরি করছি।” রুলফের দিকে তাকাল সারাহ।

 রান্নাঘরের টেবিলে বসে পড়ল তিন পুরুষ। কিন্তু কথা বলার ফাঁকেও বারবার আড়চোখে চুলায় রান্নারত সারাহকেই দেখছে ম্যানফ্রেড। পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়ায় অপরাধবোধেও দগ্ধ হল। যাই হোক, আস্তে করে চোখ সরিয়ে বাকি দুজনের কথায় মন দিলো ম্যানি।

“খবর সবই ভালো, ডানকার্কে ব্রিটিশরা ভালো মার খেয়েছে; নেদারল্যান্ডস আর ফ্রান্সেরও পতন ঘটেছে। আটলান্টিকে যুদ্ধে জিতে গেছে জার্মানির ইউবোটসমূহ আর উত্তর আফ্রিকাতে তো ইটালিয়ানরাও জিতে গেছে—

“আমি তো জানতামই না যে আপনিও আমাদের একজন আংকেল ট্রম্প।” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠল ম্যানফ্রেড।

“ইয়েস, মাই সান। আমিও তোমার মতই একজন দেশপ্রেমিক। চল্লিশ হাজার দেশপ্রেমিকের এক শক্তিশালী সংগঠন এখন ওসেয়া ব্রান্ডওয়াগ। ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি আছে এমন চল্লিশ হাজারের বিপরীতে মাত্র একশ ষাট হাজার ইংরেজপ্রেমীকে দেশের বাইরে পাঠিয়েছে। ফলে এখন তাকে আমাদের দয়ার উপরেই বেঁচে থাকতে হবে।”

“আমাদের লিডাররাও জানেন যে তুমি এসেছো ম্যানি।” এবার জানাল রুলফ, “তারা এও জানেন যে তুমি সরাসরি ফুয়েরারের কাছ থেকেই বার্তা নিয়ে এসেছে; তাই ওনারা তোমার সাথে দেখা করার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন।”

“তুমি তাহলে একটা মিটিংয়ের বন্দোবস্ত করে ফেল।” জানিয়ে দিল ম্যানি, “কারণ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ শুরু করতে হবে।” এদিকে চুপচাপ স্টোভের সামনে দাঁড়িয়ে কাজ করছে সারাহ। ডিম ভাজছে, চপ বানাচ্ছে। একবারও ছেলেদের দিকে কোনো মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করেনি; কিন্তু তারপরেও মনে মনে ভাবলো :

“তুমি আবার আমার জীবনে দুঃখ বয়ে এনেছে ম্যানি। তোমার প্রতিটি শব্দ আর আচরণে তাজা হয়ে উঠেছে সেই ক্ষত যার অস্তিত্ব আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার বাকি সবকিছুও তুমি ধ্বংস করতে এসেছে। অন্ধের মত তোমাকে অনুসরণ করছে রুলফ! আমার স্বামী আর বাচ্চাদেরকেও হুমকির মাঝে ফেলে দিয়েছো তুমি” ম্যানির প্রতি আরো তীব্র হয়ে উঠল ওর ঘৃণা।

***

সচরাচর একাই ভ্রমণ করে ম্যানফ্রেড। একা থাকলে কোনো রোডব্লক, পুলিশ সার্চ কিংবা আইডেন্টিফিকেশন পেপারসের ঝামেলায় পড়তে হয় না। প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা অনেক অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় এখানে কোনো প্রয়োজনীয় জিনিসেরই আকাল পড়েনি। কেবল সাদা ময়দার মিলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।

হাতে ছোট্ট একটা চামড়ার ব্যাগ নিয়ে ব্লোয়েমফন্টেনে যাওয়ার জন্য দ্বিতীয় শ্রেণির রেলের টিকিট কেটে নিল ম্যানি। পাঁচশ মাইল পাড়ি দেয়ার জন্য একই কম্পার্টমেন্টে উঠল আরো পাঁচজন যাত্রী।

পরিহাসের ব্যাপার হল, নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের জন্য যে মিটিং হবে তার স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হল আর্টিলারি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত প্রাদেশিক সরকারের অফিস। তাদের গোপন সংগঠন যে কতটা ক্ষমতাধর তা আরো একবার টের পেল ম্যানফ্রেড।

দরজা দিয়ে ঢুকতেই এগিয়ে এলেন ওবি’র কমান্ডার। এ লোকটাই সেই মধ্যরাতে মশালের আলোয় ওকে রক্তশপথ করিয়েছিল। ম্যানির কাঁধে চাপড় দিয়ে চওড়া হাসি হেসে কমান্ডার বললেন, “আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম ব্রাদার; তবে তার আগে গত কয়েক বছরে তুমি যা যা অর্জন করেছে তার জন্য জানাই সাধুবাদ।”

তারপর ভেতরে নিয়ে লম্বা টেবিলের চারপাশে বসে থাকা আরো পাঁচজনের সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দিলেন কমান্ডার।

“আমরা সবাই রক্ত দিয়ে শপথ নিয়েছি। তুমি মন খুলে কথা বলতে পারো।” ম্যানফ্রেঙ বুঝতে পারল যে এরাই হলেন ব্রাদারহুডের সবচেয়ে উচ্চপদস্থ কাউন্সিল।

 টেবিলের একেবারে শেষ মাথায় কমান্ডারের মুখোমুখি বসে শুরু করল ম্যানি, “জেন্টেলম্যান, আমি স্বয়ং ফুয়েরারের কাছ থেকে আপনাদের জন্য শুভকামনা বয়ে এনেছি। তিনি এও জানিয়েছেন যে, যা প্রকৃতই আমাদের সেই আফ্রিকা আফ্রিকাবাসীকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য তিনি সব রকমের সহায়তা করতে প্রস্তুত আছেন।” বেশ জোর দিয়ে কথাগুলো বলছে ম্যানি; আসার আগে বহুবার রিহার্সালও করে এসেছে যে কী বলবে, কীভাবে বলবে। সফলতার মাত্রা যে শতভাগ তা সামনে বসা লোকগুলোর চাহনি দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

“ফুয়েরার এও জানেন যে, সামরিক বাহিনিতে যাবার উপযুক্ত সমস্ত পুরুষ অর্থাৎ একশ ষাট হাজার পুরুষকে উত্তর সীমান্তে ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে আমাদের কাজ আরো সহজ হয়ে যাবে।”

“কিন্তু স্মুট তো ব্যক্তিগত সমস্ত অস্ত্রও নিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ করেই বক্তৃতার মাঝখানে একজন বলে উঠল, “স্পোর্টিং রাইফেল, শটগান সব জমা নিয়েছে। ফলে অস্ত্র ছাড়া কোনো আন্দোলন তো সম্ভব নয়।”

 “আপনি মূল সমস্যাটাই বুঝতে পেরেছেন ইতিমধ্যে।” সম্মতি জানিয়ে ম্যানি বলল, “সফলতার জন্য আমাদের টাকা আর অস্ত্র দরকার। সেগুলোও আমরা পেয়ে যাব।”

“জার্মানি দেবে?”

“না।” মাথা নাড়ল ম্যানফ্রেড। বলল, “এই আইডিয়া বাদ দেয়া হয়েছে। দূরত্ব বেশি হওয়াতে খরচ আর ঝুঁকিও আছে। কিন্তু যেই মুহূর্তে আমরা বন্দরের দখল নিয়ে নিব, তৎক্ষণাৎ ইউ বোট নিয়ে পৌঁছে যাবে জার্মান নেড়ি। এর পরিবর্তে আমরা আমাদের বন্দরগুলো জার্মানিদেরকে ব্যবহারের অধিকার দিব, ব্রিটিশদেরকে নয়।

“তাহলে আমরা আন্দোলনের জন্য অস্ত্র পেয়ে যাব?”

“কোথায়?”

“জ্যান স্মুটের কাছ থেকে।” অস্বস্তিতে পরস্পরের দিকে তাকালেন ম্যানফ্রেডের দর্শক।

“আপনাদের অনুমতি পেলেই আমি ছোট্ট একদল চৌকশ গ্রুপকে এ কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দিব। তারপর সরকারের অস্ত্রশালায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে সব নিয়ে আসব, একইভাবে অর্থ ব্যাংক থেকে।”

পুরো ব্যাপারটার বিশালতা আর এর জন্য প্রয়োজনীয় সাহসের কথা উপলব্ধি করে বিস্মিত হল সবাই। চুপচাপ শুনল ম্যানফ্রেডের বাকি বক্তব্য;

“খুব দ্রুত আমাদেরকে কাজ সারতে হবে। অস্ত্র পাওয়ার সাথে সাথে তা সবাইকে দিয়ে দিতে হবে। আর তারপর সিগন্যাল পেলেই শুরু হবে আন্দোলন। চল্লিশ হাজার দেশপ্রেমিক পুলিশ আর আমিসহ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, রেলওয়ে, বন্দর সমস্ত কিছুর দখল নিয়ে নিবে। এসব জায়গাতে এরই মাঝে আমাদের লোক মোতায়েন করা হয়েছে। আগে থেকেই নির্ধারিত একটা সিগন্যাল পেলেই সবকিছু শুরু হয়ে যাবে।”

“কী হবে এই সিগন্যাল?” জানতে চাইলেন-ওবি’র কমান্ডার।

“এমন একটা কিছু যা পুরো দেশের মাথা ঘুরিয়ে দিবে কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তা বলার সময় আসেনি। তবে এটুকু বলা প্রয়োজন যে সিগন্যাল বাছাই করাসহ কে দিবে সেটাও ঠিক হয়ে গেছে। সিরিয়াস ভঙ্গিতে কমান্ডারের দিকে তাকাল ম্যানি;

“আমাকে দেয়া হয়েছে এ সম্মান। এই কাজের জন্য প্রশিক্ষণ থাকাতে আমি একাই সবকিছু করব। এরপর আপনাদের কাজ হবে লাগাম ধরে আমাদের সহায়তা জার্মানিকে পৌঁছে দেয়া আর আমাদের জনগণের প্রাপ্য মাহাত্ম তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া।”

চুপচাপ খানিকক্ষণ লোকগুলোর অভিব্যক্তি পরীক্ষা করে দেখল ম্যানি। দেশপ্রেমের আগুনে ধকধক করে জ্বলছে সবার চোখ।

 “জেন্টলম্যান তাহলে কী আমি কাজ শুরু করতে পারি?” একে একে প্রত্যেকের দিকে তাকালেন কমান্ডার। সকলেই মাথা কাত করে সায় দিলেন।

তারপর ম্যানফ্রেডের দিকে তাকালেন কমান্ডার, “আমাদের সম্মতি আর আশীর্বাদ রইল তোমার সাথে। ব্রাদারহুডের প্রতিটি সদস্যই যেন তোমাকে সহযোগিতা করে সেটা দেখার দায়িত্ব আমার।”

ধন্যবাদ জেন্টলম্যান” আস্তে করে ম্যানফ্রেড জানাল, আর এখন আমি আপনাদেরকে হিটলারের মাইন ক্যাম্প থেকে অংশ বিশেষ পড়ে শোনাচ্ছি। “হে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, সময় এলে আমাদেরকে আশীর্বাদ করো। আমাদের প্রাপ্য মুক্তি আমাদেরকে দাও।”

“আমেন!” বুকের উপর মুষ্টিবদ্ধ হাত রেখে ওবি স্যালুট করলেন সকলে। “আমেন!”

***

রাস্তার পাশেই ভোলা জায়গায় পড়ে আছে সবুজ জাগুয়ার। দেখে মনে হচ্ছে। বহুদিন কেউ এটাতে চড়েনি। যেন গাড়িটা এখানেই পড়ে থেকেছে।

এর পেছনেই নিজের বেন্টলি পার্ক করে চূড়ার কিনারে গেলেন ব্লেইন ম্যালকম। পথটা ভয়ংকর নয়। জ্যাকেট খুলে বেন্টলিতেই রেখে দিলেন। এতটা পথ চড়লে নিশ্চয়ই গরম লাগবে। গাড়ির দরজা লক করে পথে নামলেন। আজ সেনটেইন অনুনয় করেছেন বলে নয় বরঞ্চ শাসা কোর্টনির জন্য তার মমতৃবোধ আর দায়িত্ব থেকেই এসেছেন ব্লেইন।

এর আগে অনেকবারই ভেবেছেন যে, শাসা হয়ত তার সৎ ছেলে কিংবা জামাতা কিছু একটা হবেই হবে। কিন্তু আজ সত্যিই অনুতাপ, না মন খারাপই হল যে এর একটাও এখন পর্যন্ত সত্যি হল না।

ইসাবেলা মারা গেছে প্রায় তিন বছর। কিন্তু এখনো তিনি সেনটেইনকে বিয়ে করেননি। এখনো মনে আছে যে সেই রাতে ইসাবেলার সাথে কথা বলার পর কতটা ভেঙে পড়েছিল সেনটেইন। যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছিল। এমনকি এর পরে আবার সবকিছু স্বাভাবিক হলেও মৃত্যুপথযাত্রী ইসাবেলা যে তাকে কী বলেছিল তা আর কখনোই বলেননি সেনটেইন। কেন যে সেদিন সেনটেইনকে ডেকেছিলেন তা ভাবতে গিয়ে আজও শরমে মরে যান ব্লেইন। প্রায় এক বছর লেগেছে সেনটেইনকে আবারো আগেকার রূপে ফিরে পেতে।

যাই হোক, এরপর তো বিয়ের নামও শুনতে পারে না সেনটেইন। এমনকি ব্লেইন কয়েকবার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ঠিক যেন ইসাবেলা বুঝি এখনো কোনো জাদুবলে জীবিত আছেন তাদের দুজনের মাঝে।

তাছাড়া শাসা আর তারাও আছে। দু’জনেই যেন অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছে দু’জনের হাত। সেই প্রথমবারেই ছেলেমেয়ে দুজনের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার কথা টের পেয়েছেন ব্লেইন; অথচ প্রতিবার তারা নিজেরাই একে অন্যকে আঘাত করে ভুলে যায় এর গভীরতা। এর পেছনে আর কিছু নয়, কাজ করে অহমিকা আর আত্মাভিমান। কিন্তু এটাও বুঝতে পারছে না যে দু’জনে অন্যজনকে ছাড়া অসম্পূর্ণ।

“আমি আর এমনটা হতে দিতে পারি না। মনে মনে দঢ় প্রত্যয়ে বলে উঠলেন ব্লেইন, “ওরা না চাইলেও আমাকে এবারে কিছু একটা করতেই হবে।”

পথটার শেষ মাথায় পৌঁছে এদিক-ওদিক তাকালেন ব্লেইন। যদিও বয়স পঞ্চাশ হয়ে গেছে তারপরেও এখনো আরো পনের বছর কম বয়সীদের চেয়েও ফিট আছেন। তবে এতটা উপরে ওঠার ধকলও কিন্তু একেবারে কম নয়।

স্মিথসউইনকেল বে’র চারপাশেই লম্বা লম্বা সব পাহাড়। সৈকতের পানিও এত শান্ত আর স্থির যে ত্রিশ ফুট নিচের সামুদ্রিক আগাছাও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

পাশাপাশি বানানো হয়েছে চারটা কুঁড়েঘর। প্রত্যেকটা জানালা বন্ধ হলেও একেবারে শেষ ঘরটির উদ্দেশে পা বাড়ালেন ব্লেইন।

কাছে এগোতেই দেখা গেল জানালাগুলো ভোলা হলেও সমুদ্রের নোনা জলে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া পর্দা দিয়ে ঘেরা। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে রাখা হয়েছে একজোড়া দাঁড় আর বঁড়শি। সৈকতে পড়ে আছে একটা ডিঙ্গি।

পাথরের সিঁড়ি বেয়ে সদর দরজায় পৌঁছে গেলেন ব্লেইন। খোলা পেয়ে ঢুকে পড়লেন সিঙ্গল রুমটাতে।

এক কোণে রাখা ডেভন স্টোভের ওপর পড়ে আছে এঁটো ফ্রাইপ্যান। সেন্টার টেবিলের উপর একগাদা নোংরা প্লেট আর মগ। কুঁড়েঘরের কাঠের মেঝেও বহুদিন ঝাড় দেয়া হয়নি। সবই সৈকতের বালি। জানালার বিপরীত পাশের দেয়ালে দুটো বাঙ্ক। উপরের বাঙ্কটা খালি হলেও নিচের বাঙ্কে শক্ত ম্যাট্রেসের রঙচটা কাভারের উপর শুয়ে আছে শাসা কোর্টনি।

দুপুর হতে এখনো কয়েক মিনিট বাকি আছে। তারপরও দেখা গেল ঘুমে বেহুশ হয়ে আছে শাসা। নিচে গড়াচ্ছে হুইস্কির খালি বোতল। পরনে পুরনো রাগবি শর্টস, সৈকতের কাছাকাছি থাকায় গাত্রবর্ণ হয়ে গেছে তেলতেলে মেহগনির মত। নোংরা বালিশের উপর ছড়িয়ে আছে লম্বা লম্বা চুল।

একেবারে শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে শাসা। কতটা মানসিক যন্ত্রণায় তাড়িত হয়ে এখানে চলে এসেছে ছেলেটা তা জানলেও ওর মুখে এসবের কোনো ছাপ দেখলেন না ব্লেইন। কিন্তু বাম চোখটা দেখলে আসলেই চমকে উঠতে হয়। শূন্য কোটরে ডেবে গেছে চোখের পাতা। ঘন পাপড়ি ভেদ করেও দেখা যাচ্ছে ভেজা লাল টিস্য।

কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে নিজেকে শান্ত করলেন ব্লেইন। কারণ যা করতে এসেছেন তা করতে হলে অনেক শক্ত হতে হবে।

“শাসা!” রুক্ষ্ম কণ্ঠে ডাক দিলেন ব্লেইন। নরম স্বরে গুঙ্গিয়ে উঠতেই কেঁপে উঠল ওর খালি চোখের পাতা।

“উঠো।” বাঙ্কের কাছে গিয়ে ওর কাধ ধরে নাড়া দিলেন ব্লেইন।

 “উঠো। আমরা দুজনে বসে তারপর কিছু কথা বলব।”

“চলে যান।” না জেগেই বিড়বিড় করে উঠল শাসা, “আমাকে একা থাকতে দিন।”

“উঠো বলছি এক্ষুণি!”

খুলে গেল শাসার সুস্থ চোখের পাতা। পিটপিট করে খানিক ব্লেইনের দিকে তাকাতেই বদলে গেল অভিব্যক্তি।

“আপনি এখানে কী করছেন?” মাথা ঘুরিয়ে নষ্ট চোখটাকে লুকাতে ইলাস্টিক ব্যান্ড লাগানো কালো কাপড়ের টুকরাটা খুঁজল শাসা। তারপর চোখের উপর পট্টির মত পরে নিয়ে আবার তাকালো ব্লেইনের দিকে। পট্টিটা পরে যদিও খানিকটা জলদস্যুর মত লাগছে। কিন্তু তাতে করে যেন আরো বেড়ে গেল ওর সৌন্দর্য। থমথম করতে করতে ঘরের বাইরে চলে গেল শাসা।

 কাঠের একটা টুল টেনে নিয়ে ধুলা ঝেড়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসলেন ব্লেইন। হাতে জ্বলন্ত লম্বা কালো চুরুট।

বাইরে থেকে এসে আবার বাঙ্কের ওপর বসে দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরল শাসা, “মুখের ভেতরটা এত তেতো লাগছে যে কী বলবো।” হাত বাড়িয়ে পায়ের কাছে থাকা বোতলটা তুলে গ্লাসে ঢেলে নিল বাকি হুইস্কি। ঠোঁট দিয়ে বোতলের মুখ থেকে শেষ বিন্দুটুকু পর্যন্ত চেটে নিয়ে বোতলটাকে গড়িয়ে দিল স্টোভের পাশের উপচানো ডাস্টবিনের বালতির দিকে।

গ্লাস তুলে এবার তাকাল ব্লেইনের দিকে, “খাবেন?” ব্লেইন না বোধকভাবে মাথা নাড়লেন।

ঢকঢক করে মুখে সবটুকু তরল ঢেলে দিয়ে শব্দ করে ঢেকুর তুলল শাসা। তারপর সোজা বলে বসল, “মা আপনাকে পাঠিয়েছেন।”

“ও বলেছে তোমাকে কোথায় পাওয়া যাবে। কিন্তু না, সে পাঠায়নি।”

“একই হল।” গ্লাসটাকে আবার ঠোঁটের কাছে ধরে শেষ বিন্দুটাকেও মুখে ঢেলে দিল; “সে চায় আমি যেন ময়লা থেকে হিরে বের করি, আঙুর তুলি, তুলা জন্মাই ধুত্তরি; আসল কথা কিছুতেই তার মাথায় ঢোকে না।

“তুমি যতটা ভাবছে তার চেয়েও বেশি অবশ্যই জানে।”

“বাইরে সবাই যুদ্ধ করছে। ডেভিড আর আমার সহযোদ্ধারা। ওরা আকাশে লড়ছে, আর আমি কিনা এই নোংরার মধ্যে পঙ্গুর মত পড়ে আছি।”

“এই নোংরা তুমিই বেছে নিয়েছো।” মুখ কুঁচকে চারপাশে তাকালেন ব্লেইন।

“আপনি এখান থেকে চলে গেলেই ভালো হয় স্যার।” বলে উঠল শাসা, “নয়তো দেখা যাবে আমি মাথা ঠিক রাখতে পারব না।”

“সানন্দে উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন, “তোমার ব্যাপারে আমার ধারণা আসলে পুরোপুরি ভুল ছিল। আমি তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সম্পর্কিত কাজের প্রস্তাব দিতে এসেছিলাম। কিন্তু তুমি যে তার উপযুক্ত নও তা তো দেখতেই পাচ্ছি।” হেঁটে সোজা দরজার কাছে চলে গেলেন ব্লেইন। তারপর কী মনে হতেই আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি আরেকটা নিমন্ত্রণও দিতে এসেছিলেন শুক্রবার রাতের পার্টি দাওয়াত। তারা হিটবার্ট ল্যাংলির সাথে এনগেজমেন্ট করবে সেদিন। ভাবলাম শুনে হয়ত তুমি খুশিই হবে কিন্তু থাক, বাদ দাও।”

লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন ব্লেইন। কয়েক সেকেন্ড বাদে শাসাও বেরিয়ে এল। কিন্তু ততক্ষণে চূড়ায় যাওয়ার রাস্তায় উঠে গেছেন ব্লেইন। একবারও পিছনে না তাকিয়ে চূড়া থেকে ওপাশের রাস্তার মাথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন ব্লেইন। আচমকা নিজেকে বড় নিঃস্ব আর একাকী বোধ করল শাসা।

এই মুহূর্তটার আগপর্যন্ত বুঝতেই পারেনি যে ব্লেইন ম্যালকম ওর জীবনের কতটুকু স্থান দখল করে আছে।

 “আমি উনার মতই হতে চেয়েছিলাম” চিৎকার করে উঠল শাসা। “কিন্তু এখন আর তা কিছুতেই সম্ভব না।” হাত দিয়ে চোখের উপরের পট্টিটাকে স্পর্শ করল শাসা।

 “আমিই কেন?” আপন মনেই গুমরে উঠল, “কেন আমার সাথেই এমনটা হল?”

 সিঁড়ির উপরেই ধপ করে বসে পড়ে দূরের শান্ত সবুজ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল শাসা।

আস্তে আস্তে মনে পড়ল ব্লেইনের কথা। গুরুত্বপূর্ণ এক যুদ্ধ সম্পর্কিত কাজ আর তারা-ল্যাংলির এনগেজমেন্ট। তারার কথা মনে পড়তেই চোখের সামনে ভেসে উঠল মেয়েটার লাল চুল, ধূসর চোখ।

বুকের ভেতরে অন্ধ রাগ দানা বাঁধতেই ধুপধাপ করে ভেতরে ঢুকে খুলে ফেলল সিঙ্কের উপরকার কাবার্ড। এক বোতল হেইগ পড়ে আছে কেবল।

“বাকিগুলো কোথায় গেল? ইঁদুর নিয়ে গেছে?”

বোতলের ঢাকনা খুলে গ্লাস খুঁজতেই দেখা গেল সবকটা নোংরা হয়ে আছে। কিন্তু ঠোঁটের কাছে ধরেও এবারে কেন যেন আর খেতে মন চাইল না। তার বদলে সিঙ্কের উপরে উপুড় করে দিলো পুরো বোতল। ফুটো দিয়ে গড়িয়ে গেল সবটুকু সোনালি তরল। বোতলটা অচিরেই খালি হয়েও গেল।

আচমকা ঠাস করে দেয়ালের সাথে বাড়ি মেরে বোতলটাকে ভেঙে ফেলল শাসা। তারপর এক দৌড়ে ছুটে গেল বাইরে। চোখের পট্টি আর রাগবি শর্টস খুলেই ঝাঁপ দিল সবুজ সমুদ্রে।

তারপর ঘণ্টার পর ঘন্টা কতবার যে সামনে পিছনে সাঁতার কেটে বেড়াল তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অবশেষে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে কোনোমতে ফিরে এল সৈকতে।

হামাগুড়ি দিয়ে বীচে উঠেই ভেজা বালিতে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে পড়ল। ঠিক যেন একটা লাশ। বিকেলের দিকে কোনোমতে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠে এল ঘরে।

কী মনে করে দরজার কাছে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল চারপাশে তার নিজেরই সৃষ্ট জঞ্জালের পাহাড়। দরজার পেছন থেকে ঝাড় নিয়ে কাজে লেগে পড়ল শাসা। সারা সন্ধ্যা ধরে সব পরিষ্কার করল। কেবল বিছানার নোংরা লিনেনটা কিছু করতে পারল না। তাই নিজের ময়লা কাপড়ের সাথে বান্ডেল বানিয়ে নিল ওয়েল্টেভ্রেদেনের পরিচারকের জন্য। তারপর দরজার পাশের রেইন ওয়াটার ট্যাঙ্কি থেকে এক কেটলি বিশুদ্ধ পানি এনে স্টোভে গরম করল।

খুব সাবধানে শেভ করে হাতের কাছে থাকা সবচেয়ে পরিষ্কার শার্ট পরে ঠিক করে নিল চোখের পট্টি। তারপর ঘরের দরজায় তালা দিয়ে চাবিটা লুকিয়ে ফেলল। সবশেষে হাতে নোংরা কাপড়ের গাট্টি নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠে এল জনপদে। নোনা বাতাসে জাগুয়ারও নোংরা হয়ে আছে। ব্যাটারিও বসে গেছে। তাই অনেকটুকু পথ ধাক্কা দিয়ে তারপর স্টার্ট দিতে হল।

একগাদা ডকুমেন্টস নিয়ে স্টাডিতে নিজের ডেস্কে বসে আছেন সেনটেইন। ছেলেকে দেখেই চট করে দাঁড়িয়ে গেলেও দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে পারলেন না।

 “হ্যালো শাসা, তোমাকে তো বেশ দেখাচ্ছে। আমি তো বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। প্রায় পাঁচ সপ্তাহ তুমি আসোনি।”

ছেলের চোখে পট্টিটা দেখলে এখনো ভয় পেয়ে যান সেনটেইন। যতবার এটা দেখেন মনে পড়ে যায় ইসাবেলা ম্যালকমসের শেষ কথা :

“চোখের বদলে চোখ সেনটেইন কোর্টনি, আমার কথা মনে রেখো।”

নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করেই আস্তে আস্তে শাসার কাছে এগিয়ে গেলেন; তারপর গালটাকে এগিয়ে দিলেন যেন ছেলে কি করতে পারে। বললেন, “তুমি আবার বাসায় ফিরে আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি চেরি!”

 “ব্লেইন ম্যালকমস আমাকে একটা কাজের প্রস্তাব দিয়েছেন। ভাবছি সেটা গ্রহণ করব।”

“নিশ্চয় খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু” মাথা নেড়ে সেনটেইন জানালেন, “তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি দুৰ্গটার দেখভাল করব।”

“আমি জানি তুমি তা পারবে মা।” খানিকটা বাঁকাভাবে হাসল শাসা, “কারণ গত বাইশ বছর ধরে তো তাই করছো, দুৰ্গটাকে ধরে রেখেছে।”

***

পণ্যবাহী ট্রাকের এক বিশাল সারি টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাষ্পীয় ইঞ্জিনচালিত ট্রেন। হেস্ক নদীর পাশের পর্বতমালা জুড়ে শোনা যাচ্ছে ট্রেনের গর্জন।

 আরো চল্লিশ মাইল এগিয়ে টোস নদীর জংশনে থেমে গেল লোকোমোটিভ। স্টেশন মাস্টারের অফিসে অপেক্ষারত কুদের দল হাসিখুশীভাবেই বাকিদের সাথে চড়ে বসল ট্রেনে। একেবারে প্রথম স্বয়ংক্রিয় ইঞ্জিনটাকে খুলে ফেলা হল। কারণ সামনে অপেক্ষাকৃত সমতলভূমি হওয়ায় দ্বিতীয় ইঞ্জিন সানন্দে বাকি পথ টেনে নিয়ে যেতে পারবে।

তাই নেমে এল প্রথম ইঞ্জিন রুমে কর্তব্যরত ত্রুদের দল। নিজেদের জিনিস নিয়ে সরু গলি ধরে চলল রেলওয়ে কলোনির দিকে। কেবল একজন ড্রাইভার প্লাটফর্মে রয়ে গেল। দেখল চোখের সামনে পণ্যবাহী ট্রেনটা ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে চলে গেল উত্তরের দিকে।

একের পর এক বগি গুনে মিলিয়ে দেখল আগেকার তালিকা। বারো আর তেরো নম্বর বগি পুরোপুরি আটকানো আর রুপালি রঙ দিয়ে এগুলোকে সূর্যের হাত থেকে বাঁচানোরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। বগির গায়ে লেখা :

বিস্ফোরক।” এখানে বিশ টন জেলিগনাইট আছে অ্যাংলো আমেরিকান গ্রুপের গোল্ড মাইনের জন্য।

গার্ডদের ভ্যান পাশ কাটিয়ে যেতেই স্টেশন মাস্টারের অফিসে ঢুকে দেয়ালে ঝোলানো টেলিফোনে বিশেষ একটা নাম্বার ডায়াল করল ড্রাইভার।

“সেন্ট্রাল আফ্রিকান ভাষায় জানাল, “আমাকে এগারো মোলতে লাইন দিন।”

খানিক বাদেই কানেকশন জুড়ে দিল অপারেটর; কিন্তু ক্লিক শব্দ করে অপারেটর লাইন থেকে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল ড্রাইভার। তারপর বলল, “ভ্যান নিয়েকার্ক বলছি” “দিস ইজ হোয়াইট সোর্ড।” এই উত্তরটাই শোনার জন্য অপেক্ষা করলেও নামটা শোনা মাত্র ড্রাইভারের গায়ের সব লোম যেন খাড়া হয়ে গেল। বলল, “তেইশ মিনিট লেইট হলেও দুই মিনিট আগে ছেড়ে গেছে। ট্রাকের নাম্বার দুটো হল বারো আর তেরো।”

“ঠিক আছে।”

টেলিফোন রেখে হাতঘড়ির দিকে তাকাল ম্যানফ্রেড ডি লা রে। তারপর তাকাল ফার্ম হাউজের রান্নাঘরে উদ্বিগ্ন মুখে ওর দিকে চেয়ে থাকা দু’জন নারীর দিকে।

 “ধন্যবাদ ম্যাডাম।” দুই নারীর মাঝে বর্ষীয়ান যিনি তার উদ্দেশে ম্যানি বলল, “আপনার সাহায্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। কথা দিচ্ছি এর জন্য আপনাকে কোনো ঝামেলায় পড়তে হবে না কখনো।”

“কী যে বলো বেটা” গর্বের ভাব ফুটে উঠল বৃদ্ধার কণ্ঠে, “৯৯ সালে তো আমার ফার্ম পুড়িয়ে স্বামীকেও মেরে ফেলেছিল রুনিক্কি।”

 গোলাঘরের পেছনেই মোটরসাইকেল পার্ক করে এসেছে ম্যানফ্রেড। স্টার্ট দিয়ে বাইকে চড়ে মাইলখানেক আসতেই পৌঁছে গেল মেইন রোডে। উত্তরে মোড় নিয়ে আবার কয়েক মাইল যেতেই দেখা গেল পাশাপাশি চলছে রেললাইনের উপরে ট্রেন আর মেইন রোডে ম্যানি। পাথুরে একটা পাহাড়ের নিচে পরস্পরকে ছেদ করে যাবে রেলপথ আর সড়ক পথ।

 মোটরসাইকেল থামিয়ে রাস্তা চেক করে দেখল ম্যানফ্রেড। আশপাশে কাক-পক্ষীও নেই। তারপর আরেকটা রাস্তা ধরে চলে এল পাহাড়ের পেছনে। রেলপথও এপাশ দিয়েই গেছে। তাছাড়া বুড়ির ফার্ম হাউস থেকে যথেষ্ট দূরে থাকায় কারো সন্দেহও হবে না। পাহাড় বেয়ে উঠে আসায় হাঁটার গতিতে এগোচ্ছে ট্রেন।

সামনেই কাটা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে তিন টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন চারটা ট্রাক। একটা আবার দশ টনী। রেলওয়ে লাইন থেকে একশ’ কদমের মত দূরত্বে ঘাসের ওপর, ট্রাকের পাশে শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিচ্ছে তার লোকজন। কিন্তু যেই না মোটরসাইকেলের আওয়াজ হল, সাথে সাথে সোজা হয়ে দাঁড়াল সবাই। ম্যানফ্রেডকে দেখে আগ্রহ নিয়ে ওর চারপাশে ভিড় করে দাঁড়াল। রুলফ স্ট্যান্ডার হল ওদের লিডার।

 “সাড়ে নয়টায় এখানে পৌঁছে যাবে। বগি নাম্বার বারো আর তেরো। কাজ সেরে ফেলল।”

বাকিদেরকে রেখে ম্যানফ্রেড আর রুলফ এগোল রেলপথের দিকে। ট্রেনটাকে থামাবার দায়িত্ব ম্যানির; যেন বগি দুটো তার লোকদের সামনেই থামে।

ঠিক সেই পয়েন্টে এসে ফিশ প্লেটের নিচে বোমা ফিট করে ফেলল ম্যানফ্রেড। তারপর ফিরে এসে লাল রঙের ফ্লেয়ার বসিয়ে ফেলল। এ কাজ করতে করতেই সন্ধে হয়ে যাওয়ায় পরের কাজে হাত দিল দু’জনে। বাকি দলকেও যার যার জায়গায় পাঠিয়ে দেয়া হল। সবার হাতে শটগান আর এনফিল্ড রাইফেল হলেও ম্যানফ্রেড আর রুলফ ইউ বোটের ক্যানিস্টারে চেপে আসা জার্মান লুগার নিয়েছে।

এবার অপেক্ষার পালা। সবার আগে ম্যানফ্রেডই শুনতে পেল। বেশ দূরে থাকলেও রাতের অন্ধকারে গুঞ্জন শুনলেই হুইসেলে তিনবার শব্দ করে সবাইকে সতর্ক করে তুলল। মুখে ফেস মাস্ক পরে রেলওয়ে লাইনের ঘাসের জমিতে অপেক্ষা করছে পুরো দল।

ঢালুর ওপর দিয়ে আসার সময় খানিকটা ধীর হয়ে গেল ট্রেনের গতি। আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে পা রাখল প্রথম ফ্লেয়ারে। সাথে সাথে তার জ্বলে আলোকিত হয়ে উঠল আশপাশের পঞ্চাশ গজ এলাকা।

ব্রেকের ধাতব কিচকিচ আওয়াজ শুনেই হাঁফ ছাড়ল ম্যানফ্রেড। উপস্থিত বুদ্ধিতেই ট্রেন থামিয়ে দিয়েছে ড্রাইভার। জ্বলে উঠল দ্বিতীয় ফ্লেয়ার।

চট করে লাফ দিয়েই বিস্মিত ড্রাইভার আর তার ফায়ারম্যানের দিকে সুগার তাক করল ম্যানফ্রেড।

 “ট্রেন থামাও! হেডলাইট বন্ধ করো!” মুখোশের আড়ালে চিৎকার করে আদেশ দিল, তারপর নিচে নেমে আসো।”

ব্রেক লক করে হাত মাথার উপরে তুলে নিচে নেমে এল রেলওয়ে ড্রাইভার। সাথে সাথে তাদেরকে মার্চ করে বেঁধে ফেলা হল। তারপর পেছন দিকে দৌড় দিল ম্যানি। কিন্তু ততক্ষণে রুলফের লোকজন জোর করে বগি দুটোর দরজা খুলে জেলিগনাইটের কাঠের বাক্স হাতে হাতে করে প্রথম লরিটাতে তোলা শুরু করে দিয়েছে।

“ট্রেনের পেছনকার গার্ড কোথায়?” জানতে চাইল ম্যানফ্রেড।

“বেঁধে ফেলেছি।” উত্তরে জানাল রুলফ। আবার দৌড়ে ট্রেনের মাথায় চলে এল ম্যানফ্রেড। তাড়াতাড়ি করে বাকি বোমাগুলো তুলে ফেলল। কাউকে গুলি করতে হয়নি দেখে বলা যায় খুশিই হয়েছে। আবার যখন পিছনে এল তখন প্রথম লরি পুরো ভরে গেছে।

“নিয়ে যাও!” রুলফের আদেশে ট্রাক চালিয়ে চলে গেল একজন।

 দ্বিতীয় ট্রাক এগিয়ে আসতেই সেটাও ভর্তি করা শুরু হল।

ঘড়ি দেখল ম্যানফ্রেড, “বারো মিনিট।” শিডিউল থেকে এগিয়েই আছে।

ড্রাইভার, গার্ড আর ফায়ার ম্যানকে গার্ডের ভ্যানে বেঁধে আটকে রাখায় কাজ আরো দ্রুত এগোল।

“সব শেষ।” চিৎকার করে খানিক বাদে জানিয়ে দিল রুলফ। “আমরা আর লোড করতে পারব না।”

“আটচল্লিশ মিনিট। ওয়েল ডান, চলো এখন সবাই!”

 “তুমি?”

 “যাও!” আদেশ দিল ম্যানি।

“আমি আমারটা দেখব।” সবকটা ট্রাক ফার্ম রোডে উঠে হেডলাইট না জ্বালানো পর্যন্ত অপেক্ষা করল ম্যানফ্রেড। কারণ রুল কিংবা বাকিরা যদি ওর এখনকার প্ল্যান জানত তাহলে হয়ত বাধা দেয়ার চেষ্টা করত।

বিস্ফোরক ভর্তি বগির খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল ম্যানফ্রেড। আরো প্রায় বগির অর্ধেক সাদা কাঠের বাক্স পড়ে আছে। তার মানে পঁচিশ টন বিস্ফোরক এখনো রয়ে গেছে।

তাই পনের মিনিট পরেই ফেটে যাবে এমনভাবে টাইম সেট করে কেসগুলোর আড়ালে বোমা রেখে দিলো। তারপর লাফ দিয়ে নেমেই দৌড় দিল। গার্ডের ভ্যানে ফেলে রাখা কেউই ওসেয়া ব্রান্ডওয়াগের সদস্য নয়। তাই ওরা পুলিশের কাছে যাবার সম্ভাবনা আছে। এখন আর ওদের জন্য মন খারাপ করে কোনো লাভ নেই। এসব যুদ্ধেরই অংশ। তারপর লোকোমোটিভের ক্যাবে উঠে হুইল ব্রেক খুলে থ্রটলও টেনে দিল। ঝনঝন করে আগে বাড়ল ট্রেন।

মাঝামাঝি জায়গায় থ্রটলটাকে লক করে দিল ম্যানি। তারপর আবার লাফ দিয়ে নিচে নেমে এসে চড়ে বসল নিজের মোটরসাইকেলে।

 কিন্তু অপেক্ষা যেন আর ফুরোতে চায় না। একটু পরপর অধৈর্য হয়ে ঘড়িও দেখছে। অবশেষে বহুদূরে উত্তরের দিগন্তে জ্বলে উঠল কমলা রঙা শিখা। শব্দ শুনে মনে হল যেন তীরে আছড়ে পড়েছে ঢেউয়ের সারি।

 মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিয়ে দক্ষিণে ছুটল ম্যানি। শুরু হিসেবে ভালোই হয়েছে কিন্তু কাজ এখনো অনেক বাকি।

***

শাসাকে তার অফিসের দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে দেখে চোখ তুলে তাকালেন ব্লেইন। ছেলেটার গায়ে পরিচ্ছন্ন এয়ারফোর্স ইউনিফর্ম। বুকে মেডেল, কাঁধে ওর র‍্যাঙ্ক।

 “মর্নিং শাসা” মাথা নেড়ে ব্লেইন বললেন, “দশটা বাজে। তোমাকে হুইস্কি দিতে বলব?”

কুঁকড়ে গেল শাসা, “আমি আসলে সেদিনকার আচরণের জন্য ক্ষমা চাইতে এসেছি স্যার। মাথা একদম কাজ করছিল না কেন যেন।”

 “বসো।” বুককেসের পাশের চামড়ায় মোড়ানো চেয়ারটা ইশারা করলেন ব্লেইন, “জীবনের কখনো না কখনো আমরা খানিকটা আহাম্মকী করেই থাকি। তবে কৌশলটা হল তুমি কখন করছো নিজে তা বুঝতে পারা। যাই হোক, তোমার ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণ করা হল।”

পায়ের ওপর পা উঁচিয়ে বসলেও সাথে সাথে আবার নামিয়ে নিল শাসা, “আপনি একটা কাজের কথা বলছিলেন স্যার?”

মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন। আপন মনেই ভাবলেন যা করতে চলেছেন তা ঠিক হবে তো? শাসা কী এই কাজের জন্য একটু বেশিই তরুণ আর অনভিজ্ঞ নয় কি? কিন্তু ইতিমধ্যেই যা ভাবার ভেবে ফেলেছেন। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।

 কালো রঙের একটা প্লেনন ফোল্ডার হাতে নিয়ে বললেন, “এটা কিন্তু হাইলি ক্লাসিফায়েড। অত্যন্ত গোপন আর সেনসিটিভ একটা রিপোর্ট।” ডান হাতে নিয়ে যেন ওজন দেখলেন তারপর শাসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এটা অফিসের বাইরে নেয়া যাবে না। এখানে পড়ো। আমি ফিল্ড মার্শাল সুটের সাথে মিটিংয়ে যাচ্ছি।” শার্টের হাতা গুটিয়ে ঘড়ি চেক করে জানালেন, “এক ঘণ্টার মাঝেই ফিরব। তারপর আবার আমাদের কথা হবে।”

কিন্তু এক ঘণ্টারও আরো অনেক পরে ফিরলেন ব্লেইন। এসে দেখেন যে শাসা তখনো পড়ছে। খোলা ফোল্ডার হাতে নিয়ে ব্লেইনের দিকে তাকাতেই ফুটে উঠল চিন্তার আভাস; ব্লেইন জানতে চাইলেন, “কী বুঝলে?”

 “আমিও ওবির কথা শুনেছি। কিন্তু যা পড়লাম এরকম যে হতে পারে সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। আমাদের ভেতরেই গোপন আরেকটা সেনাবাহিনি! যদি কখনো আমাদের বিরুদ্ধে যায় তোক মাথা নেড়ে বিস্মিত শাসা জানাল, “একটা বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ ঘটে যাবে। অথচ আমাদের সৈন্যেরা সবাই তো উত্তরে।”

“ওরা ইতিমধ্যেই নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে। নরম স্বরে জানালেন ব্লেইন, “এখন পর্যন্ত গড়পড়তা আফ্রিকানদের মত তারা কেবল নিজেদের মধ্যেই আলোচনা সীমিত রেখেছিল। কিন্তু অতি সাম্প্রতিক কয়েকটা ঘটনায় মনে হচ্ছে নতুন উদ্দেশ্যও দানা বেঁধেছে-” কথা থামিয়ে চুপ করে গেলেন ব্লেইন। তারপর একটু খানিক কী যেন ভেবে বললেন, “এটা মনে হয় বলার কোনো প্রয়োজন নেই যে, এখন আমরা যা আলোচনা করব তা কেবল আমাদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে শাসা। এমনকি খুব কাছের কোনো পরিবারের সদস্যের সাথেও তা শেয়ার করা যাবে না।”

 “অফ কোর্স স্যার” মনে হল খানিকটা মর্মাহত হল শাসা।

 “টোস নদীর তীরে রেলপথে গত সপ্তাহ দুয়েক আগে ডিনামাইট ভর্তি একটা ট্রেন বিস্ফোরিত হয়েছে শুনেছো?”

“ইয়েস স্যার। বেশ মর্মান্তিক একটা দুর্ঘটনা। ড্রাইভার আর তার ক্রুরাও মারা গেছে।”

“আমাদের কাছে নতুন একটা প্রমাণ আছে। আমাদের বিশ্বাস এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। ক্রুদের সবাইকে গার্ড ভ্যানে পাওয়া গেছে আর এও প্রমাণ হয়েছে যে, তাদের অন্তত একজনকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছিল। আর ট্রেন থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকও হাইজ্যাক করা হয়েছে। আর তারপর বাকিগুলোতে বোমা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে যেন চুরি ঢাকা পড়ে যায়।”

আস্তে করে শিস দিয়ে উঠল শাসা।

“আমার ধারণা এটা কেবল সূচনা। নতুন একটা অধ্যায় শুরু হয়েছে যা এখন থেকে নিয়মিত ঘটবে। আর যেমনটা বলেছিলাম কিছু একটা বড়সড় কারণও আছে যা খুঁজে বের করে ধ্বংস করে দিতে হবে।”

“আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি স্যার?”

“এটা পুরো দেশের সাথে জড়িত। সামরিক গোয়েন্দাদের পাশাপাশি আমাকে পুরো দেশের পুলিশ প্রধানদের সাথেও যোগাযোগ রাখতে হচ্ছে। পুরো অপারেশনটাই অনেক সন্তর্পণে সমাধান করতে হবে। তাই আমার একজন ব্যক্তিগত সহকারী প্রয়োজন। তোমাকে দিলাম এ প্রস্তাব।”

“আমি সত্যিই সম্মানিত বোধ করছি স্যার; কিন্তু আমাকেই কেন বেছে নিলেন তা বুঝতে পারছি না। আরো ডজন ডজন উপযুক্ত।

 “আমরা একে অন্যকে ভালোভাবেই চিনি শাসা।” ওকে থামিয়ে দিলেন ব্লেইস। “গত কয়েক বছর ধরেই একসাথে কাজ করছি। তাই কোনো সন্দেহ নেই যে দল হিসেবে আমরা অত্যন্ত চমৎকার। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। তোমার মেধা আর সক্ষমতাকে বিশ্বাস করি। আমার কোনো পুলিশম্যান নয় বরঞ্চ এমন কাউকে প্রয়োজন যে কিনা আমাকে বুঝবে আর আমার আদেশ মন দিয়ে পালন করবে।” আচমকা অট্টহাসি দিলেন ব্লেইন, “তাছাড়া তোমারও একটা চাকরি দরকার তাই না?”

“আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার, ধন্যবাদ।”

“আপাতত তুমি ছুটিতে থাকবে কিন্তু এয়ারফোর্স থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তোমাকে নিয়োগ দেয়া হল আর স্কোয়াড্রন লিডার হিসেবেই বেতন পাবে; কিন্তু রিপোর্ট করবে সরাসরি আমার কাছে।”

“বুঝতে পেরেছি স্যার।”

“শাসা, চোখ হারাবার পর থেকে আর ফ্লাই করেছ?” এতটা সরাসরি আর কেউ এটা শাসাকে বলেনি। লোকটার প্রতি ওর শ্রদ্ধা তাই আরো বেড়ে গেল।

“না, স্যার।” উত্তরে জানাল শাসা।

“শীঘই হয়ত তোমাকে সারা দেশ চষে বেড়াতে হবে।” ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ওর মুখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ দেখতে পেলেন ব্লেইন।

 “এটা শুধু প্র্যাকটিসের ব্যাপার।” শুনে সত্যিই চমৎকৃত হলেন ব্লেইন; আলতোভাবে জানালেন।

“পোলো বল নিয়েও চেষ্টা করো। প্র্যাকটিস যত হবে ততই ভালো, তবে এসো এখন আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। পুরো ব্যাপারটার দায়িত্বে আছে কেপটাউন সেন্ট্রাল স্টেশনের চিফ ইন্সপেক্টর লুইস নেল। আমি তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিব।”

এভাবে আরো ঘণ্টাখানেক আলোচনা-পরিকল্পনার পর ছুটি পেল শাসা; “আজ এ পর্যন্তই থাক। আগামীকাল সকাল সাড়ে আটটায় আমার কাছে রিপোর্ট করবে।” কিন্তু দরজার কাছে যেতেই আবার শাসাকে থামালেন ব্লেইন; বললেন, “ও আচ্ছা আরেকটা কথা শাসা, শুক্রবারের রাতের দাওয়াত কিন্তু এখনো উন্মুক্ত আছে। আটটায়। কালো টাই হল ড্রেস কোড। চেষ্টা করে দেখো, ঠিক আছে?”

***

বিছানায় একা শুয়ে আছে সারাহ্ স্ট্যান্ডার। পাশের দোলনায় ছোট্ট মেয়েটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

ঢং ঢং করে চারটা বাজল টাউন হলের ঘড়িতে। মাঝরাতের পর থেকে প্রতি ঘন্টায় এটার আওয়াজ শুনছে সারাহ্। ভাবল পাশের রুমে গিয়ে বাকি বাচ্চাদেরকে দেখে আসবে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে রান্নাঘরের দরজা খুলে যেতেই নিঃশ্বাস আটকে শরীর শক্ত করে পড়ে রইল বিছানায়।

 ঘরে এসেই বাথরুমে চলে গেল রুলফ। জুতো খুলে আস্তে আস্তে এসে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ল। সারাহ ভাব করল যেন সে ঘুমাচ্ছে। এতটা রাত অব্দি কখনো বাইরে থাকেনি রুলফ। ম্যানফ্রেড আসার পর থেকেই এসব শুরু হয়েছে।

অন্ধকারে শুয়েই আপন মনে সারা ভাবল, “তুমিই যত ঝামেলা ডেকে এনেছে। আই হেইট ইউ ম্যানফ্রেড।”

পাশে শুয়ে রুলফও ছটফট করছে। গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে সময়। এরই মাঝে ছোট্ট মেয়ে কেঁদে উঠতেই দোলনা থেকে ওকে নিয়ে এসে পাশে শুইয়ে দুধ খাওয়াতে লাগল সারাহ। মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে আবারো দোলনায় রেখে আসতেই দেখল রুলফ হাত বাড়িয়েছে। কিন্তু ওর সাথে শারীরিক সম্পর্কে কেন যেন কখনোই আগ্রহ পায় না সারাহ। সে আনন্দটুকুও নষ্ট করে দিয়েছে ম্যানফ্রেড। তবে আজ অন্যদিনের চেয়ে কেমন যেন নিষ্ঠুর আচরণ করল রুলফ। ঠিক পশুর মতই সারাহকে শুষে নিয়ে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে। বাকি রাতটুকুও জেগে রইল সারাহ্।

সকালে আস্তে করে জানতে চাইল, কাল রাতে কোথায় ছিলে?”

সাথে সাথে ক্ষেপে গেল রুলফ; চিৎকার করে বলল, “একদম চুপ। নিজের মুখ বন্ধ রাখো।”

“তুমি বোকার মত অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে” তারপরেও সাহস করে বলে ফেলল সারাহ, “তোমার ঘোট ঘোট তিনটা বাচ্চা আছে রুলফ। তুমি–

 “যথেষ্ট হয়েছে।” দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে উঠল রুলফ, “এসব পুরুষদের কাজ, তুমি নাক গলিয়ো না।”

আর একটাও কথা না বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেল রুলফ। ল’ ফ্যাকাল্টির লেকচারার হিসেবেই এখন কাজ করছে। এর ভেতরে আর কোনো ঝামেলা না হলে দশ বছরের মধ্যেই চেয়ারম্যান হয়ে যাবে রুলফ।

যাই হোক ও চলে যাবার পর গৃহস্থালি সামলে ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে হাঁটতে বের হল সারাহ। পথিমধ্যে আরেক অধ্যাপকের স্ত্রীর সাথেও দেখা হল। এরপর যেই না দোকানে গিয়ে বাচ্চাদের জন্য চকলেট কিনছে চোখ গেল কাউন্টারে স্তূপ করে রাখা নিউজ পেপারের হেডলাইনের দিকে।

রাস্তা পেরিয়ে পার্কের বেঞ্চে বসে গতরাতে কারুতে পণ্যবাহী ট্রেন বিস্ফোরণের কথা পড়ল সারাহ। তারপর হাতের পেপারটাকে ভাজ করে বসে বসে খানিক কী যেন ভাবল।

গতকাল লাঞ্চের পরেই বেরিয়ে গেছে রুলফ। রাত দশটার খানিক আগেই স্ফোরণটা হয়েছে। এভাবে দূরত্ব আর সময়ের হিসাব করতেই অজানা আশঙ্কায় মোচড় দিয়ে উঠল পেট। বাচ্চারাসহ তাড়াতাড়ি পোস্ট অফিসের কাছে গিয়ে টেলিফোন বুথে ঢুকল।

“সেন্ট্রাল, আমাকে কেপটাউনের মেইন পুলিশ স্টেশনে লাইন দিন।”

“অপেক্ষা করুন।”

 আচমকা মনে হল যে এটা সে কী করতে যাচ্ছে। কেমন করে রুলকে বাঁচিয়ে ম্যানফ্রেন্ডকে পুলিশে দেয়া যাবে, আর তাছাড়া রুলফকে এসব ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে দূরে রাখাটাও ওরই দায়িত্ব। তখননি শুনল অপারেটর বলছে।

“কেপটাউন পুলিশ স্টেশন থেকে বলছি; আপনাকে কোনো ধরনের সাহায্য করতে পারি?”

 “ইয়েস” বলে উঠেও তাড়াতাড়ি আবার কথা ঘুরিয়ে নিল সারাহ্, “না, না, আয়্যাম সরি। ব্যাপারটা তেমন জরুরি কিছু না।” ফোন রেখেই বাচ্চারদেরকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এল। এসেই রান্নাঘরেরর টেবিলে বসে হাউমাউ করে অনেকক্ষণ কাঁদল সারাহ। কেন যে নিজেকে এতটা একা আর নিঃস্ব লাগল!

***

ব্লেইন ম্যালকমসের বাড়ির গেইটে জাগুয়ার পার্ক করলেও চট করে নামতে পারল না শাসা। গাড়িতে বসেই আরেকবার ভাবল যে যা করতে চাইছে তা কি ঠিক হবে?

“হয়ত খামোকা আবার বোকা হতে হবে।” আপন মনে সাইড আয়নায় নিজের চেহারাও দেখে নিল। তারপর চোখের পট্টিটা সাবধানে ঠিক করে নেমে এল বাইরে।

নিউল্যান্ডস এভিনিউর চারপাশেই কেবল গাড়ি আর গাড়ি। ব্লেইন ম্যালকমসের মত গুরুত্বপূর্ণ এক লোকের মেয়ের এনগেজমেন্ট পার্টি সকলের কাছেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

রাস্তা পেরিয়ে সদর দরজার কাছে এল শাসা। ভিড়ে ভিড়াক্কার হয়ে আছে। লবি আর লাউঞ্জ। তোণ্ডতি করে বারের কাছে এল শাসা। যুদ্ধের ডামাডোলে হুইস্কি নয় কেপ ব্রান্ডি হল দেশপ্রেমিকের পরিচয়। যাই হোক সে জিনজার এলে অর্ডার করল।

 পুরনো অনেকের সাথেই দেখা হওয়ায় হ্যান্ডশেক করে তারার খোঁজে এদিক-সেদিক তাকাল শাসা। সবাই মনে হচ্ছে চোখের পট্টিটাকে না দেখারই ভান করছে।

 ওদিকে ডাইনিং রুমে কৃষ্ণাঙ্গ শেফ আর মেইডদের কাছে দাঁড়িয়ে বুফে ডিনারের তদারকি করছিল তারা।

 চোখ তুলে শাসাকে দেখেই যেন জমে গেল মেয়েটা। গোলাপি রঙা ইভনিং ড্রেস আর কাঁধে ছড়ানো চুলগুলো দেখে শাসার মনে হল সে ভুলেই। গিয়েছিল মুক্তোর মত দ্যুতি ছড়ায় তারার চোখ।

ইশারা দিয়ে পরিচায়কদেরকে সরিয়ে দিলো তারা। আস্তে আস্তে ওর কাছে এগিয়ে গেল শাসা;

“হ্যালো, তারা। আমি ফিরে এসেছি।”

“হ্যাঁ। শুনেছি। পাঁচ সপ্তাহ আগেই ফিরেছে। আমি ভেবেছিলাম হয়ত-” থেমে গিয়ে শাসার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাল তারা, “এও শুনেছি তুমি নাকি বিভিন্ন পদক পেয়েছো, আহতও হয়েছে।”

 সরাসরি ওর বাম চোখে তাকাল তারা; হেসে ফেলে বলল, “তোমাকে কিন্তু দেখতে আরো ড্যাশিং লাগছে।”

“আমার কিন্তু তা মোটেও মনে হয় না।”

 “বুঝতে পারছি কী বলতে চাইছে; তুমি অনেক বদলে গেছে।

 “তোমার তাই মনে হয়?”

“ইয়েস, আগের মত বেপরোয়া ভাবটা আর নেই।”

 “আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই, সিরিয়াসলি।”

“অল রাইট” মাথা নাড়ল তারা, “বলো।”

 “এখানে না।” উত্তরে জানাল শাসা, “এত লোকের ভিড়ে নয়।”

“কাল?”

 “কাল অনেক দেরি হয়ে যাবে। এক্ষুণি আমার সাথে এসো।”

“শাসা, তুমি পাগল? আজ তো আমার পার্টি হচ্ছে, এনগেজমেন্টের পার্টি।”

“আমি জাগুয়ার নিয়ে আসছি। তুমি গায়ের ওপর কিছু চাপিয়ে নাও, বাইরে বেশ ঠাণ্ডা।” শান্ত ভঙ্গিতে জানিয়ে দিল শাসা।

একটু পরেই দেয়ালের কাছে জাগুয়ার পার্ক করল। তারপর হেডলাইট নিভিয়ে দিল। জানে তারা আসবে না। তারপরেও সে অপেক্ষা করবে।

কিন্তু খানিকবাদেই স্ন্যাকস্ আর সোয়েটার পরিহিত তারাকে দেখে সত্যিকারের অবাক হল শাসা। প্যাসেঞ্জার সিটে বসেই আদেশ দিল।

“ড্রাইভ। এখান থেকে চলো।”

বেশ খানিকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। শুধু যতবার স্ট্রিট ল্যাম্পের আলো ভেতরে আসতো তারার মুখের দিকে তাকাত শাসা। মিটিমিটি হাসলেও সোজা সামনের দিকেই তাকিয়ে আছে মেয়েটা। অবশেষে বলল, “তোমার কখনোই কোনো কিছু কিংবা কারো সম্পর্কে অভাব বোধ ছিল না। এটাই আমার ভালো লাগত না।”

কোনো উত্তর দিল না শাসা। “আমার মনে হয় এখন তোমার আমাকে দরকার। অবশেষে সত্যিই আমাকে তোমার দরকার হল।”

এবারেও চুপ করে রইল শাসা। মনে হচ্ছে এ মূহর্তে কিছু বলাটা অর্থহীন হবে। তাই কেবল হাত বাড়িয়ে তারার হাত স্পর্শ করল।

“এখন আমি তোমার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত আছি শাসা। আমাকে এমন কোথাও নিয়ে চলো যেখানে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই।”

 বাইরে খেলা করছে চাঁদের আলো। শাসাকে আঁকড়ে ধরে উত্তেজনায় হাসছে তারা। চূড়োয় পৌঁছাবার রাস্তাটায় থেমে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কিসও করল দুই তরুণ হৃদয়।

 সৈকতের ধারে নিজের ঘরে তারাকে নিয়ে এল শাসা। স্বস্তি নিয়ে দেখল এরই মাঝে লিলেনের চাদর পেতে মেঝে মুছে গেছে ওয়েলেটভেদেনের পরিচারকেরা।

মেঝের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল তারা। স্পষ্টতই ভয় পাচ্ছে। সে অবস্থাতেই ওকে কোলে করে বিছানায় নিয়ে গেল শাসা।

“শাসা, আমার বড় ভয় করছে।” ফিসফিস করে উঠল তারা।

শাসা কিন্তু বেশ ধৈর্য নিয়েই এগোল। কিন্তু তারার জন্য যেহেতু এ অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন সে বুঝল না শাসা এ কাজে কতটা দক্ষ। খানিক বাদে তারা নিজেও শাসার সাথে তাল মেলালো; আবেগে ভরা মাদকতাময় কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, “আমি কখনোই ভাবিনি, স্বপ্নেও চিন্তা করিনি যে এটা এমন হবে। ওহ শাসা, তুমি ফিরে আসায় আমি কী যে খুশি হয়েছি।”

***

স্টান্ডার্ড ব্যাংকের ফোর্ডর্সবার্গ ব্রাঞ্চ সেন্ট্রাল ব্যান্ড কমপ্লেক্সের সমস্ত স্বর্ণ খনিগুলোর অর্থনৈতিক কাজকর্ম সামলায়। শত শত কৃষাঙ্গ খনি শ্রমিকরা এখান থেকেই তুলে নেয় তাদের সাপ্তাহিক পারিশ্রমিক আর এই ব্রাঞ্চের সিনিয়র অ্যাকাউন্ট্যান্টও ওবি’র সদস্য। নাম উইলেম ডি কক।

ছোটখাট গড়নের উইলেম চোখে অনেক মোটা পাওয়ারের চশমা পরলেও চাহনিটা বেশ দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষমতা রাখে। তার সাথে মিটিংয়ের কয়েক মুহূর্তের মাঝে ম্যানফ্রেড বুঝে গেল যে ভদ্রলোক সংগঠনের প্রতি পুরোপুরি নিবেদিতপ্রাণ ছাড়াও তার চিন্তাশক্তি যথেষ্ট ক্ষুরধার। আর এই শরীরে এতটা সাহস কীভাবে পেলেন সেটাও রহস্য।

 “বৃহস্পতিবার বিকেলে অর্থ আসবে। আর্মারড় কার ছাড়াও মোটরসাইকেলে পুলিশ এসকর্ট দেয়। তাই গোলাগুলি লাগবেই।”

 “বুঝতে পেরেছি” মাথা নাড়ল ম্যানফ্রেড; “তবে তার আগে বলুন সাধারণত কী পরিমাণ অর্থের লেনদেন হয়?”

“পঞ্চাশ থেকে সত্তর হাজার পাউন্ড, তবে মাসের শেষ বৃহস্পতিবারে এক লাখ। তার সাথে সাধারণ কাজে ব্যবহারের জন্য পঁচিশ হাজারও থাকে।”

মাইনের এক কর্মচারীর বাসায় বসেছে এই মিটিং। এই লোকটাই আবার অপারেশনের জন্য স্থানীয়ভাবে কর্মী সংগ্রহ করে দিচ্ছে। ক্রাউন ডিপ গোল্ড মাইনের এই কর্মচারী, নাম লরেন, দেখতে ঠিক মাতালের মতন। তবে ম্যানফ্রেডের মনে হচ্ছে কঠিন পরিস্থিতিতে লরেন হয়ত ভেঙে পড়তে পারে।

“ধন্যবাদ, ডি কক। বাকিটা বলুন।”

“ব্যাংক ম্যানেজার মি, কার্টরাইট বিল্ডিংয়ের পেছনের দরজা খুলে অর্থ ঢুকিয়ে নেন। সে সময় অবশ্য সাধারণ লেনদেন শেষ হয়ে যায়। আমি, মিঃ কার্টরাইট আর আরো দু’জন সিনিয়র টেলার মিলে টাকা গুনে রিসিট দিয়ে দেই।

 তারপর লক করে দেয়া হয় ভল্ট। আমার কাছে একটা চাবি আর হাফ কম্বিনেশন থাকে। বাকিটা মিঃ কার্টরাইটের কাছে।”

“তার মানে পুলিশ যাওয়ার পরে ভল্ট আটকাবার আগেই কাজ সারতে

“হুম, তখন একটা সম্ভাবনা আছে।” মাথা নাড়লেন ডি কক। “তখনো দিনের আলো থাকবে। রাস্তায় নোকজনও থাকবে। তাছাড়া কার্টরাইটও বেশ কঠিন বান্দা, যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। আমি কি বলতে পারি এর দায়িত্ব আমার হাতে থাকলে আমি কী করতাম?”

“ধন্যবাদ ডি কক। আপনার সাহায্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *