৮. পারমাণবিক অনুমোদন

অধ্যায় : ৮ – পারমাণবিক অনুমোদন

The Nuclear Sanction

ভারতীয় বৈজ্ঞানিকরা প্লুটোনিয়াম প্ল্যান্টের কার্যক্রম শুরু করার চার বছর পর ১৯৬৮ সালে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্লুটোনিয়াম জমানো সম্ভব হয়। ‘বিক্রম সারাভাই’ তখন ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন ও প্রধানমন্ত্রীকে পরীক্ষা শুরু করার পরামর্শ দেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সহকর্মীদের সাথে আলোচনার পর এ ব্যাপারে ‘এগিয়ে যাবার’ সবুজ সংকেত প্রদান করেন। এরপরই ‘পূর্ণিমা প্রকল্প’ অনুমোদিত হয়। নিরাপত্তার প্রয়োজনে উক্ত প্রকল্পকে ‘ছদ্মাবরণে’ ঢেকে রাখা অত্যন্ত জরুরি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর তাই ‘নিরাপত্তার শক্ত বাঁধনে বেঁধে রাখার’ জটিল কাজটি ‘র’-এর ওপর বর্তায়। এভাবেই ‘র’ প্রথমবারের মতো ভারতের অভ্যন্তরে এরূপ একটি প্রকল্পের কাজে জড়িয়ে পড়ে।

ক। পূর্ণিমা (Poornima )

প্রধানমন্ত্রীর ‘এগিয়ে যাও’ আদেশ থেকে শুরু করে পূর্ণিমা ‘প্রকল্পের খরচ’ কখনই প্রকাশ করা হয়নি। এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয় খরচাদি মাদ্রাজের নিকটবর্তী কালপাক্কাম-এ অবস্থিত পরীক্ষামূলক ‘ব্রিডার রি-এ্যাক্টর’-এর বাজেটের অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়। যে সব সংবাদ শিকারি এ সংক্রান্ত কোনো অস্পষ্ট ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করেন, তাদের খুব সুন্দর ও উজ্জ্বল ‘হ্যান্ড আউট’ প্রদানের মাধ্যমে প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্য হতে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়। ওই সব হ্যান্ড আউটগুলো তাদের মনে বদ্ধমূল ধারণার সৃষ্টি করে যে, ‘পূর্ণিমা’ প্রকল্প আসলে ‘ব্রিডার রি-এ্যাক্টর’ প্রকল্পের একটি অংশ মাত্র। ‘র’-এর পরামর্শ অনুযায়ী প্রকল্পে নিযুক্ত বৈজ্ঞানিকদের বিভিন্ন ‘কর্ম গ্রুপে’ এমনভাবে বিভক্ত করে রাখা হয়, যাতে তাঁরা একে অপরের সাথে কচিৎ কখনো যোগাযোগ করতে পারেন এবং এভাবে এই পদ্ধতিতে নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হলেও তা হবে সহনীয় পর্যায়ের কম মাত্রার। ‘র’-কে এরূপ প্রাথমিক কাজ করার জন্যই ডেকে আনা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ‘সম্পূর্ণ নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।

১৯৬৪ সালের শেষদিকে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ‘হোমি ভাবা’ তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন, যেখানে তিনি দৃঢ়চিত্তে উল্লেখ করেন, ‘ভারতীয় বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলীরা আর মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে একটি পারমাণবিক বোমার সফল বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হবেন’। ভারতীয় বৈজ্ঞানিকরা ‘পারমাণবিক জ্বালানী চক্রের’ প্রতিটি খুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে ততোদিনে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন। অন্যকথায়, ভূ-তাত্ত্বিক খনিজ ও ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা সকলেই বিহারের জাদুগুদায় ইউরেনিয়াম উত্তোলনের শুরু থেকেই জ্বালানী উৎপাদনের কৌশল সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন বলেই ধরে নেয়া যায়। ধাতুবিদরা ‘ট্রোম্বেতে’ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও হায়দরাবাদের জ্বালানী সামগ্রীর কথা সম্যক অবহিত ছিলেন। পারমাণবিক প্রকৌশলীরা ইতোমধ্যে তিনটি ‘রি-অ্যাক্টর’ (Apsara, Cirus S Zerlina ) সচল করার জন্য তাদের নিজস্ব ‘হেভি ওয়াটার প্রকল্প’ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন পারমাণবিক রসায়নবিদগণ ফরাসী সহায়তায় ‘ট্রোম্বে’তে একটি ‘প্রোটো টাইপ’ প্লুটোনিয়াম বিযুক্তকরণ প্রকল্প তৈরি ও চালু করতে সমর্থন হন। এই সাফল্যকে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ও আকর্ষণীয় সাফল্য বলে ধরে নেয়া যায়, কারণ এর মাধ্যমে ভারতীয় প্রকৌশলী ও বৈজ্ঞানিকদের অতি উঁচুমানের জটিল প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহারে অভ্যন্তরীণ সাফল্য অর্জিত হয়।

১৯৬৪ সালের পর কানাডার সরবরাহকৃত দু’টো রি অ্যাক্টর ভারতের পশ্চিমে রাজস্থানে নির্মাণ করার সময় বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলীদের অভিজ্ঞতা আরো বিস্তৃতি লাভ করে। কানাডীয়দের উৎসাহে এই সব রি-অ্যাক্টরের অনেক যন্ত্রাংশ পুরোপুরি বা আংশিক পর্যায়ে ভারতে তৈরি করা হয়। এ ধরনের পদক্ষেপ দেশজ পারমাণবিক প্রক্রিয়ার দ্রুত বিস্তৃতি ঘটায়। এর সাথে অনুঘটক হিসেবে বিভিন্ন বেসরকারি প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান যেমন ‘লারসন টার্বো (ইন্ডিয়া) লি.’, ‘মূলচান্দ নাগর লি.’, ও ‘ভারত ইলেক্ট্রনিক্স লি.’, বিশেষ সাহায্যে এগিয়ে আসে। লব্ধ অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে ‘অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের’ অন্তর্গত ‘পাওয়ার প্ল্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশন’ (PPED) ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজার হতে ১২০ টন ওজন সম্পন্ন অ্যালয় স্টিলের তৈরি ‘রি-অ্যাক্টর শিল্ড’-এর দরপত্র আহ্বান করতে সমর্থ হয়। (India’s Nuclear Bomb, Shyam Bhatia, Vikas 1979)

১৯৭০ সালে রি-অ্যাক্টর তৈরির কাজ প্রায় শেষ হয়ে আসে। এ সময় সরকারের পারমাণবিক কৌশলের একটি কুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্ট অবয়ব ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে থাকে। এ ধরনের প্রথম সংবাদ প্রকাশিত হয় সানডে টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায়। ওই সংবাদ সূত্রে দাবি করা হয়, ১৯৭০ সালের ২৫ জানুয়ারি পারমাণবিক বোমা তৈরির খরচাদি তদারকের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই সংবাদকে অনুসরণ করে ২৫ মে ‘৭০ সালে মাদ্রাজের ‘দি হিন্দু’ পত্রিকায় ‘পারমাণবিক কথকতা’ (A Nuclear Profile) শিরোনামে আরেকটি ফলোআপ সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই পত্রিকায় অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ১৯৮০ সাল নাগাদ ২৭০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক শক্তি ও ১৯৭৪ সালের মধ্যে ভারতে প্রস্তুত উপগ্রহ উৎক্ষেপণের ব্যাপারে পরামর্শ প্রদান করা হয়। এরপর বিভিন্ন ধরনের অনুমান নির্ভর গল্প বাইরে চালু হয়ে যায়।

ভারতের পারমাণবিক যন্ত্রপাতি ক্রয় সীমিত থাকায় ‘র’-এর স্পেশাল ডেস্কের জন্য বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও বিদেশী গোয়েন্দা বিশ্লেষকদের মধ্যে অনুমান নির্ভর কল্পনাতে ইন্ধন জোগাতে সুবিধা হয়। যখন তাৎক্ষণিকভাবে কোনো স্থানীয় প্রযুক্তিগত সুবিধা পাওয়া যেত না, তখন ‘র’-এর মাধ্যমে স্থানীয় প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান হতে বাছাই করা প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদদের অত্যন্ত কঠিনভাবে বেঁধে দেয়া সময়সূচি অনুযায়ী কানাডায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে পাঠানো হতো। কানাডায় প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞরা জ্বালানী প্রযুক্তি সংক্রান্ত পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ লাভের পর অত্যন্ত উপযোগী বলে প্রতীয়মান হন।

এর অনেক পরে, বিদেশেও অফিস আছে এমন কিছু সংস্থা হতে, ‘র’-এজেন্ট হিসেবে কিছু লোককে নিয়োগ করে। এ সব এজেন্ট সুনির্দিষ্টভাবে, বিশেষ করে পাকিস্তানের প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিশেষ দক্ষতা সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে সমর্থ হন। সে সময় ‘র’ ধারণা করে যে, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত বিশেষ দক্ষতা ছাড়াও পাকিস্তান ১৯৮৫ সালের পূর্বে কোনো পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হবে না।

ভারতে সে সময়ে স্থানীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নত ইউরেনিয়াম তৈরি সম্ভব ছিল না। অবশ্য এখন পর্যন্ত তা সম্ভব নয়। তাই পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রযুক্তিতে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্য প্লুটোনিয়ামের ওপর সার্বিকভাবে নির্ভর করতে হয়। ১৯৬৪ সালে ‘Cirus’ প্রকল্পে ১০ কেজি প্লুটোনিয়াম (বছরে ২টি পারমাণবিক বোমা তৈরিতে যথেষ্ট) উৎপাদন সম্ভব ছিল, অবশ্য বাস্তবে ‘Cirus’ প্রকল্পে কিছু সমস্যা দেখা দেয়ায় উৎপাদন ক্ষমতার কম পরিমাণ প্লুটোনিয়াম তৈরি হচ্ছিল। ১৯৬৮ সালের মধ্যে এই ক্ষুদ্র প্রকল্পের পাশাপাশি আরেকটি বৃহৎ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে যায়।

১৯৭২ সালের ডিসেম্বর এ ‘Implosion’ পদ্ধতি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ পদ্ধতিতে বোমার প্লুটোনিয়াম জাত অংশকে রাসায়নিক বিস্ফোরক দ্বারা বাইরে ঢেকে সংযুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রযুক্তিতে রাসায়নিক বিস্ফোরণ প্লুটোনিয়ামকে চাপ প্রয়োগ করে যার ফলশ্রুতিতে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটার জন্য প্রয়োজনীয় ‘চেইন রি- অ্যাকশন’ শুরু হয়ে যায়। এবার অ্যাটমিক এনার্জি বিভাগের ও ‘র’-এর লোকজন একত্রিত হয় পরবর্তি ধাপের জন্য (র-এর লোকজন পোখরান টেস্টের নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত হয়েছিল)। উল্লেখ্য, এই পর্যায়ে ভারত ‘আংশিক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে’ একজন স্বাক্ষরদাতা হিসেবে থাকায় যে কোনো পরীক্ষা চালানোর ক্ষেত্র হলে তা ভূ-গর্ভে চালানে আবশ্যক ছিল।

খ। নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনি (Tight Security Wraps )

‘র’-এর আরোপিত ‘যার যতটুকু জানা প্রয়োজন’ দর্শনের ফলশ্রুতিতে পারমাণবিক প্রকল্প সংক্রান্ত তথ্যাদি উচ্চপর্যায়ের গুটিকয়েক ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এঁরা হলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, অ্যাটমিক এনার্জি বিভাগের সচিব ও অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান ‘হোমি সেথনা’ (যিনি ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে ড. সারাভাই মারা যাবার পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন), পারমাণবিক পদার্থবিদ ড. রাজা রামান্না (তিনি ট্রোম্বের ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের প্রধান পারমাণবিক পদার্থবিদ ছিলেন), ড. পি কে আয়েনগার ও ‘র’-প্রধান আর এন কাও।

উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গ ভারতের বিভিন্ন স্থানে আলাদা আলাদা বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য বিভিন্ন দলকে নিয়োজিত করেন। পৃথকভাগে বিভক্ত এই দলগুলো শুধু পরীক্ষা শুরুর কিছু পূর্বে পরীক্ষা স্থলে গিয়ে জড়ো হয়। পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনানুযায়ী আর্মি ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দলকে জানুয়ারি মাসের কোনো এক সময় পরীক্ষা স্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ধরনের সেনা তৎপরতাকে যে কোনো পর্যবেক্ষকই নিয়মিত সাধারণ কোনো মহড়ার জন্য সেনা চলাচল বলে মনে করবেন। তবে আর্মি ইঞ্জিনিয়ারদের এ তৎপরতার সাথে ‘পোখরান’ পরীক্ষার কোনো সম্পর্ক ছিল না।

১৯৭৩-এর মার্চ মাসে রাসায়নিক বিস্ফোরক ব্যবহার করে দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের জঙ্গলে একটি নকল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল, পর্যবেক্ষকদের “ভারতের পারমাণবিক বিস্ফোরণ ব্যর্থ হয়েছে”-এ ধারণা দেয়া। ‘র’ তাদের এই ‘ভুল তথ্য প্রদানের মহড়ায় নিজেরাই আরো বেশি করে ওই ব্যর্থতার কাহিনী প্রচার করতে থাকে। যার দরুন বিদেশী পর্যবেক্ষকরা কিছুটা শান্ত বোধ করার সুযোগ পান।

অন্যদিকে রাজনৈতিক পর্যায়ে ইন্দিরা গান্ধীকে প্রতিদিনের কার্যক্রমের বিস্তৃত বিবরণ প্রদান করা হতে থাকে। এদিকে গুজব রটে যায় যে, কমিটির মিটিং-এর একটি ‘নোট অসাবধানতাবশত সভাস্থলে ছেড়ে আসা হয়েছে। যার ফলে ‘র’ এর পরামর্শক্রমে পরবর্তীতে পারমাণবিক গবেষণা সংক্রান্ত সভায় কোনো মন্তব্য রেকর্ড করা নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হয়। কেবিনেট মিটিংয়ে পর্যন্ত এ সম্পর্কিত কোনো আলোচনা বন্ধ থাকে। এরপর থেকে সভায় ছেড়ে আসা কোনো কাগজ, টাইপ রাইটার-এর রিবন ও কেবিনেট মিটিংয়ের রিপোর্ট তৈরিতে ব্যবহৃত কার্বন পেপার পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলা একটি ‘ধর্মীয় আচার’ অনুষ্ঠানের মতো অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। (‘র’-এ ক্ষেত্রে কঠোরভাবে এই পদ্ধতির অনুশীল করে থাকে)।

গ। পোখরানের বিস্ময় (The Pokhran Surprise )

১৯৭৪ সালের ১৮ মে, শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে নির্মিত ১৫ কিলোটন ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। পোখরান পরীক্ষার খবরাখবর সারা পৃথিবীর পত্রিকায় হেডলাইন নিউজ হিসেবে প্রচারিত হয়, যা বিদেশী পর্যবেক্ষকদের সম্পূর্ণরূপে হতবাক করে দেয়।

‘র’-এভাবেই পরীক্ষার জন্য গৃহীত সকল কার্যক্রমকে সঠিকভাবে নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনিতে বেঁধে রাখতে সমর্থ হয়েছিল।

ঘ। অঙ্গীকার (The Commitment)

জওহরলাল নেহরুর জীবদ্দশায় ১৯৬৩ সালে ভারতের পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল এবং ১৯৬৪ সালে চীনের পারমাণবিক ক্ষমতা অর্জনের পর তা আরো দৃঢ় ভিত্তি পায়। কংগ্রেসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এ ব্যাপারে সরকারকে প্রবল চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। শাস্ত্রী যিনি ১৯৬৪ সালের মে মাসে নেহরুর স্থলাভিষিক্ত হন তিনি পারমাণবিক ক্ষমতার উন্নয়নে অনেকটা নমনীয় মনোভাব পোষণ করেন। বিভিন্ন কারণে বিশেষ করে খরচ, বিদেশী দেশগুলোর ‘অতি ভঙ্গুর’ মনোভাব ও সর্বোপরি শান্তিপূর্ণ কাজে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি মানসিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করে। এদিকে ড. হোমিভাবা ১৯৬৫ সালের শেষ দিকে ‘মন্ট ব্লাঙ্কে’ এক প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত হন। প্লেনের অভ্যন্তরের বিস্ফোরণ যা প্লেনটির মর্মান্তিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী তা অনেকের সন্দেহের উদ্রেক করে। এ ক্ষেত্রে স্যাবোটাজের কথাও একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না। ভাবা, যিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত পারমাণবিক পদার্থবিদ, তিনি ভারতের জন্য একটি দেশীয় প্রযুক্তিগত পারমাণবিক গবেষণা কার্যক্রমের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন, যা ভারতীয় বৈজ্ঞানিকদের এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাবে যেখানে পারমাণবিক প্রকল্পগুলোকে পারমাণবিক শক্তির বর্ম দ্বারা সুসজ্জিত করা হবে। তবে শান্তি পূর্ণ কাজে ব্যবহারের জন্য সংগৃহীত পারমাণবিক শক্তিকে কখনই সামরিক খাতে পরিচালিত করা হবে না। এ দুটো ‘দিক’ এমন অঙ্গাঙ্গীভাবে অবিচ্ছেদ্য যে, পারমাণবিক শক্তি কার্যক্রম প্রকল্পকে অনায়াসেই অস্ত্র তৈরির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়।

১৯৪৬ সালের ২৬ জুনের জনসমাবেশে প্রদত্ত নেহরুর ভাষণ থেকে তাঁর চিন্তা-চেতনা সম্যক উপলব্ধি করা যেতে পারে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন:

“যতোদিন পর্যন্ত পৃথিবী এখনকার মতো পরিচালিত হবে, ততোদিন পর্যন্ত প্রতিটি দেশের একটি যথার্থ উপকরণ থাকবে এবং সে তার নিরাপত্তার খাতিরে সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করবে। আমার এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, ভারত তার নিজস্ব বৈজ্ঞানিক গবেষণার উন্নয়ন সাধন করবে এবং আমি আশা করি ভারতীয় বৈজ্ঞানিকরা পারমাণবিক শক্তিকে গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করবেন। কিন্তু ভারত যদি আক্রান্ত হয় তবে সে অতি অবশ্যই তার ভাণ্ডারে যা কিছু মজুদ আছে তা নিয়ে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে। আমি আশা রাখি যে, সাধারণত ভারত অন্যান্য দেশের সাথে মিলিতভাবে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের বিরোধিতা করবে।”

চৌত্রিশ বছর পরও নেহরুর দিক-নির্দেশনা এখনো কার্যকরী বলেই প্রতিভাত হচ্ছে। বিদেশী ইন্টেলিজেন্স সংস্থাগুলো ভারতের প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণের খরব সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তবে তারা অবশ্যই ভারতের পারমাণবিক অগ্রগতির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখবে, যদিও তা নিতান্তই শান্তিপূর্ণ কাজের জন্যও হয়ে থাকে। তাদের এ আড়িপাতায় সাফল্য নির্ভর করে ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স সংস্থার কর্মদক্ষতার ওপর ও তাদের সে সাফল্য লাভের শুভ (1) ক্ষণ পর্যন্ত তারা ‘আঁতুড় ঘরেই’ আবদ্ধ থাকবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *