৮. পরিশিষ্ট ১ – শিলচরে ’৬১-র ভাষা শহিদেরা

পরিশিষ্ট ১ –  শিলচরে ’৬১-র ভাষা শহিদেরা

১. শহিদ কমলা ভট্টাচার্য

কমলা ভট্টাচার্য উপমহাদেশ তো বটেই সম্ভবত বিশ্বের প্রথম নারী যিনি মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় শিলচর স্টেশন এলাকায় ১৯ মে ১৯৬১-তে পিকেটিংরত অবস্থায় সরকারি বাহিনীর গুলিতে সত্যাগ্রহী প্রাণত্যাগ করেন। গুলি চোখ ভেদ করে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। এ বছরেই দরিদ্র পরিবারের এই মেয়ে শিলচর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন বি এ পাস করবেন, চাকরি করে সংসারের ভার কিছুটা লাঘব করবেন। কিন্তু ঘাতকের বুলেট তাঁকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়। যথাসময়ে পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল কমলা পাস করেছেন।

কমলার ছোটো বোন মঙ্গলা ভট্টাচার্যকেও পুলিশের নারকীয় নির্যাতনে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। মঙ্গলা প্রাণে বেঁচেছিলেন বটে, কিন্তু চলার মতো শক্তি তাঁর ছিল না।

অবিভক্ত ভারতের সিলেট জেলার ঢাকা দক্ষিণের আমুরা গ্রামে ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন কমলা। শৈশবেই পিতা রামরমণ ভট্টাচার্যকে হারান। পরিবারের অভিভাবক বলতে ছিলেন মা সুপ্রভাসিনী ভট্টাচার্য। কমলারা ছিলেন দুভাই, চার বোন। বড়দা রমেন্দ্র ভট্টাচার্য এবং ছোড়দা বকুল ভট্টাচার্য। বোনেরা ছিলেন—বেণুবালা ভট্টাচার্য, প্রতিভা ভট্টাচার্য, কমলা ভট্টাচার্য এবং মঙ্গলা ভট্টাচার্য। পিতৃহারা পরিবারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়। গণভোটে আসামের সঙ্গে যুক্ত সিলেট জেলাও ভাগ হয়ে যায়। ভাগাভাগিতে সিলেটের প্রায় সবটাই পাকিস্তানভুক্ত হয়। এ সময় সিলেটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও দেখা দেয়। ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গে দাঙ্গা ভয়াবহ রূপ নেয়। একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামেও দাঙ্গা শুরু হয়। কমলাদের বাড়িঘর, বিষয়-আশয় পাকিস্তানভুক্ত সিলেটে পড়ায় তাঁরা রাতারাতি হয়ে পড়লেন ‘পাকিস্তানি’। কিন্তু সেখানে থাকা যাচ্ছে না। মা সুপ্রভাসিনী ছেলে-মেয়েদের হাত ধরে অপর প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেশত্যাগে বাধ্য হন। তাঁদের নতুন পরিচয় জোটে ‘উদবাস্তু’। এই উদবাস্তু পরিবার ১৯৫০ সালে শিলচর বিলপার পেদাপট্টিতে এক ভাড়াঘরে বসবাস শুরু করেন।

তারপর তো নিরন্তর বাঁচার লড়াই। কেবল বেঁচে থাকার জন্য নয়, ভাষার লড়াইয়েও নেমেছিলেন। দুই বোন-ই সত্যাগ্রহী কার্ড সংগ্রহ করে অন্য সাথি, বন্ধুদের সঙ্গে রেল রুখতে শিলচর স্টেশন এলাকায় খুব ভোরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ওঁরা ছিলেন নিরস্ত্র, অহিংস। কমলাকে ওরা বাঁচতে দিল না। মায়ের বড়ো আশা ছিল কমলাকে নিয়ে, কিন্তু সে-আশা আর পূরণ হয়নি। কমলা শহিদ হলেন।

পেদাপট্টি আজ শহিদ কমলা রোড— যা শহিদের স্মৃতিকেই স্মরণ করিয়ে দেবে পথ চলতি পথিককে।

২. শহিদ শচীন্দ্রচন্দ্র পাল

শচীন্দ্রকে নিয়ে পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। ম্যাট্রিক পাস করে সে কোন বিষয় নিয়ে পড়বে— বিজ্ঞান, আর্টস না কর্মাস— এই নিয়ে পরিবারে জোর আলোচনা হত। এমনকী ঠাকুরমা পর্যন্ত তর্কে জড়িয়ে পড়তেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া নিয়েও কথা চলত পরিবারে। কিন্তু তাঁদের সতু আকস্মিকভাবেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি দিলেন। স্বচ্ছল পরিবার। পিতা গোপেশচন্দ্র পাল দেওয়ানজি বাজারের বড়ো ব্যবসায়ী। মাতা সুবর্ণপ্রভা গৃহিণী। পিতামহ গোপালচন্দ্র পাল।

শচীন্দ্র পালের জন্ম ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ১৯ আশ্বিন। ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। দাদা গঙ্গেশচন্দ্র পাল এ সময় গুরুচরণ কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। অপর ভাইয়েরা ছিলেন— অরবিন্দ পাল, গীতেশচন্দ্র পাল এবং গৌতমচন্দ্র পাল। একমাত্র বোন সুলেখা পাল।

শচীন্দ্রদের আদিবাড়ি ছিল শ্রীহট্ট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমায়। আর দশজনের মতো তাঁদেরকেও ভিটেমাটি ত্যাগ করে শিলচরে চলে আসতে হয়। শিলচরের নাজিরপট্টি মডেল প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা এবং কাছাড় হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন ১৯৬১ সালে, সতেরো বছর বয়সে। দাদার মতো তিনিও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেন। ১৭ মে পরীক্ষা শেষে শিলচর গণসংগ্রাম পরিষদ অফিস থেকে সত্যাগ্রহী কার্ডও সংগ্রহ করেন ১৯ মে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেবেন বলে।

১৯ মে ভোররাতে জানিগঞ্জ-গোপালগঞ্জ এলাকার প্রায় আড়াইশো মতো সত্যাগ্রহী শচীন্দ্রদের বাড়িতে জমায়েত হন। সংগ্রাম পরিষদ থেকে বলা হয়েছিল, ভোর পাঁচটার পূর্বেই তারাপুর স্টেশন এলাকায় রেল অবরোধের জন্য পৌঁছে যেতে হবে। সত্যাগ্রহীরা তৈরি। শচীন্দ্রর ঠাকুরমা, জ্যাঠাইমা, মাসি, দিদি— সবাই সত্যাগ্রহীদের কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন যেন বাংলা ভাষার জয় হয়। সত্যাগ্রহীরাও তাঁদের প্রণাম করলেন।

ভাষা-সৈনিকরা ভোর পাঁচটার মধ্যে রেললাইন ধরে পদব্রজে অতিদ্রুত সবাই নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে যান। তাঁরা ছিলেন নিরস্ত্র, নিরুপদ্রব। সরকারি বাহিনী ট্রেন চালাতে না পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে সত্যাগ্রহীদের ওপর বেপরোয়া লাঠি চালায়। কিন্তু না, নড়েননি কেউ। কিছুক্ষণ পর আবারও লাঠি চার্জ, টিয়ার গ্যাস সেল জনতাকে লক্ষ করে ছোড়া হয়। এই হামলার হাত থেকে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ কেউ-ই বাদ গেলেন না। তারপরও তারা স্টেশন থেকে ট্রেন নড়াতে পারেনি। কিন্তু বিকেল আড়াইটার দিকে হঠাৎ করেই নিরস্ত্র জনতাকে লক্ষ করে গুলিচালানো হল। আর তাতেই গুলিবিদ্ধ হলেন শচীন্দ্র পালসহ অসংখ্য মানুষ। সাধারণ মানুষই শচীন্দ্রকে তুলে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র এবং সেখান থেকে তাঁদের বাড়ি দেওয়ানজি বাজারে নিয়ে যায়। পরে শিলচর সিভিল হাসপাতালে নেওয়া হয়। ততক্ষণে শচীন্দ্রর জীবনদীপ নিভে গেছে। পাড়ি দিয়েছেন অনন্তলোকে। তিনি শহিদ হলেন। দেওয়ানজি বাজার সড়কটির নতুন নামকরণ করা হল শহিদ শচীন্দ্রচন্দ্র পাল অ্যাভিনিউ নামে। শিলচর পৌর সভাপতি মহীতোষ পুরকায়স্থের যত্ন ও প্রয়াসে একে একে গড়ে ওঠে শহিদ সড়ক।

(তথ্য উৎস— আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫ মে ১৯৬১ এবং বার্ষিক রক্তিম দিগন্ত, মিতা দাশপুরকায়স্থ সম্পাদিত, শিলচর, ১৯ মে ২০১৩)

৩. শহিদ বীরেন্দ্র সূত্রধর

বীরেন্দ্র সূত্রধর শ্রীহট্ট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার বহরমপুরে ১৯৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। এ সময় শ্রীহট্ট বা সিলেট আসাম প্রদেশের অন্তর্গত একটি জেলা। পিতার নাম নীলমণি সূত্রধর। টানাটানির সংসার। বীরেন্দ্র শৈশবেই প্রথমে মা এবং পরে পিতৃদেবকে হারান। পিতৃ-মাতৃহীন এই শিশুকে ঠাকুরমা পরমযত্নে কোলে তুলে নেন। ঠাকুরমা বীরেন্দ্রকে স্কুলে ভরতি করে দেন। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ভালোভাবেই পড়াশুনো চালিয়ে যান। কিন্তু বীরেন্দ্র বুঝতে পারলেন ঠাকুরমার পক্ষে তাঁর পড়াশুনো অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়।

আসে দেশভাগের ঝড়, সিলেটও ভাগ হল। সাম্প্রদায়িক সংঘাত দেখা দিল। চেনা মানুষও অচেনা হয়ে গেল। কিশোর বীরেন্দ্র ভালোই বুঝতে পারলেন এখানে আর থাকা সম্ভব নয়, পালাতে হবে। ঠাকুরমাকে বুঝিয়ে তাঁকে নিয়ে দেশ ছাড়লেন, চলে আসেন শিলচরে। শুরু হয় নতুন জীবন।

বংশপরম্পরায় বীরেন্দ্ররা কাঠের কাজে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। শিলচরে এসে সেই কাঠের কাজকেই আঁকড়ে ধরলেন তিনি। এক ঠিকাদারের অধীনে কাজও পেয়ে গেলেন। ঘরের আসবাব এবং গৃহ-নির্মাণ দুটোতেই তিনি পারদর্শী ছিলেন। ঠাকুরমাকে নিয়ে বীরেন্দ্র-র বেশ ভালোই দিন কাটছিল। কিন্তু ঠাকুরমা জেদ ধরলেন বিয়ে করতে হবে, কারণ তিনি কবে আছেন; কবে নেই। শেষপর্যন্ত বীরেন্দ্র রাজি হলেন। ১৯৫৯ সালে বীরেন্দ্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ধনকুমারী দেবীর সঙ্গে। স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হলে তাঁকে ধর্মনগরে দাদার কাছে রেখে আসেন। সেখানেই জন্ম হয় বীরেন্দ্র সূত্রধরের একমাত্র কন্যা রানির। বীরেন্দ্র স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে শিলচরে ফিরে আসেন।

সংসার বড়ো হচ্ছে, ব্যয়ও বাড়ছে। সুতরাং, আয় বাড়াতে হবে। সুঠাম দেহের অধিকারী বীরেন্দ্র পরিশ্রম করতে পারতেন, একগুঁয়েও বটে। স্ত্রী-কন্যার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অর্থ রোজগারে চলে যান মিজোরামের আইজলে। স্ত্রী-কন্যাকে রেখে আসলেন হাইলাকান্দির মণিপুরে, কাকার কাছে। বীরেন্দ্র আইজলে এক কনট্রাক্টরের অধীনে কাজ জুটিয়ে নিলেন। আইজল তখন কাঁচা পয়সার দেশ হিসেবে খ্যাত। তাঁর রোজগার কয়েকগুণ বেড়ে গেল। কাঠমিস্ত্রি হিসেবে তখন তাঁর বেশ নামডাক।

হঠাৎ মেয়ের অসুখের সংবাদ পেয়ে কনট্রাক্টরের বার বার অনুরোধ-নিষেধ উপেক্ষা করে হাইলাকান্দিতে কাকার বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়ে শিলচর পৌঁছোন বীরেন্দ্র। শিলচর তখন ভাষা আন্দোলনে তোলপাড়। সকাল-সন্ধ্যে মিটিং, মিছিল, স্লোগানে সরগরম। ১৯ মে বাংলা ভাষার দাবিতে অসহযোগ, সব বন্ধ থাকবে, রেলের চাকাও ঘুরবে না। গণসংগ্রাম পরিষদে নাম লেখালেন বীরেন্দ্র। ভিটেমাটি স্বদেশ ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন, এখানে মুখের ভাষাটাও কি হারাতে হবে? রাগে, ক্ষোভে সিংহপুরুষ বীরেন্দ্র আপন মনেই হয়তো বলে উঠেছিলেন ‘জান দেব, জবান দেব না।’

১৯ মে ভোররাতে শিলচর রেলস্টেশনের পথে পা বাড়ালেন তিনি আরও অনেক সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে। সরকারি পুলিশ, আধাসেনা তো ছিলই, নিরস্ত্র সত্যাগ্রহী রুখতে সেনাবাহিনী পর্যন্ত নামানো হয়। ট্রেন চালাতে ব্যর্থ সরকারপক্ষ দু-দফায় লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে সাধারণ মানুষদের আধমরা করেও ক্ষান্ত দেয়নি। দুপুর আড়াইটার দিকে যখন পরিস্থিতি শান্ত তখনই বেপরোয়া গুলি চালানো হয় জনতাকে লক্ষ করে। বীরেন্দ্র গুলিবিদ্ধ হন। তাঁকে ধরাধরি করে সাধারণ মানুষই শিলচর সিভিল হাসপাতালে নিয়ে যায়। ২০ মে ভোরে সামান্য সময়ের জন্য তাঁর জ্ঞান ফিরলে তিনি স্ত্রী-কন্যাকে দেখতে চাইলেন। হাসপাতাল কতৃপক্ষ স্ত্রী-কন্যাকে আনতে ছুটলেন হাইলাকান্দি। স্ত্রী-কন্যাকে হাসপাতালে আনা হয় বটে, কিন্তু ততক্ষণে বীরেন্দ্রর প্রাণ-পাখি অনন্তযাত্রায় পাড়ি দিয়েছেন। স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে শেষ দেখাটা তাঁর আর হল না। বীরেন্দ্র সূত্রধর শহিদ হলেন।

শিলচরের মালুগ্রাম কালিবাড়ি থেকে শিববাড়ি পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হল ‘শহিদ বীরেন্দ্র’ সূত্রধর রোড— যা আজও শহিদের স্মৃতিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

৪. শহিদ তরণীমোহন দেবনাথ

তরণীমোহন দেবনাথ বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪০ সালে। এ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল কুমিল্লা জেলার একটি মহকুমা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম স্থান হিসেবে খ্যাতি ছিল। বিশ্বখ্যাত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁসহ অসংখ্য গুণী শিল্পীর জন্ম এই মাটিতেই।

তরণীমোহন দেবনাথ-এর পিতা ছিলেন যোগেন্দ্রচন্দ্র দেবনাথ, মাতা জগতীবালা। ব্যবসায়ী পরিবার। বংশানুক্রমে সুতোর ব্যাবসা ছিল। তরণীর দাদার নাম রমণীমোহন দেবনাথ। বাবা-মা দুই ছেলেকে নিয়ে সুখেই ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তাঁদের দেশত্যাগে বাধ্য করে। দেশভাগের পরপরই এই পরিবার শিলচর চলে আসেন এবং রাঙ্গিরখাড়িতে ঘর বাঁধলেন।

পিতা-মাতার কনিষ্ঠ সন্তান তরণীমোহন অম্বিকাপট্টির দুর্গাশংকর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনো শুরু করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি ভরতি হন শিলচর পাবলিক হাই স্কুলে। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় পিতা গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ফলে, দাদা রমণীমোহন দেবনাথকে পিতার ব্যাবসা এবং সংসারের হাল ধরতে হয়। এই অবস্থায় তরণীমোহন দেবনাথকেও পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে পৈতৃক ব্যবসায়ে নেমে পড়তে হয়। তিনি বয়নশিল্পীদের একত্রিত করার চেষ্টা করেন এবং তাঁদের দাবিদাওয়া, অভাব-অভিযোগ যথাযথ স্থানে তুলে ধরতে গড়ে তোলেন ‘বয়ন সমিতি’। তরণী দেবনাথের সাংগঠনিক শক্তির গুণে এই সংগঠন অচিরেই শক্তপোক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে যায়। সমিতির তিনি সম্পাদক ছিলেন আমৃত্যু। ‘ক্ষুদিরাম ক্লাব’ নামক একটি সংগঠনেরও তিনি সম্পাদক ছিলেন। সংগঠক হিসেবে তাঁর দক্ষতা এবং কর্মতৎপরতার কারণেই ১৯৬১ সালে ভাষা আন্দোলনের একজন উল্লেখযোগ্য সংগঠক হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন।

১৯ মে ১৯৬১। তরণীমোহন পিসতুতো ভাই ক্ষেত্রমোহন ও অন্যান্য সত্যাগ্রহীদের নিয়ে ভোর চারটেয় শিলচর রেলস্টেশনের উদ্দেশে রওনা দেন। রেল রুখতে হবে। সবাই স্টেশন এলাকায় যার যার মতো রেললাইনে বসে পড়লেন। ট্রেন চালানো সম্ভব হয়নি। ক্ষিপ্ত পুলিশ ও অন্যান্য ফোর্স লাঠিচার্জ করে সকালের দিকেই। কাঁদানে গ্যাসও ছোড়া হয়। কিন্তু সত্যাগ্রহী তরণীসহ কেউ-ই জায়গা ছাড়েননি অসহ্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও। কারণ লাঠিপেটা আর গ্যাসের জ্বালায় অধিকাংশ মানুষই আহত হয়েছেন। কিন্তু তারপরও তরণীমোহন ধ্বনি দিয়ে চলেছেন—মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বন্দে মাতরম। উত্তেজিত তরণী একপর্যায়ে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং স্লোগান দেওয়া অব্যাহত রাখেন। তখন দুটো বেজে গেছে। হঠাৎ করেই গুলি। কিন্তু তখন পরিস্থিতি ছিল শান্ত। আর এসময় ঘাতকের বুলেট এসে তরণীর মাথায় বিদ্ধ হয়। তিনি লুটিয়ে পড়েন এবং ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। বাংলা ভাষার মান রাখতে তিনি শহিদ হলেন।

সরকারিভাবে রাঙ্গিরখাড়ি সড়ক আজ শহিদ তরণীমোহন দেবনাথ রোড। ভাষা সৈনিকরা তো চির অমর।

৫. শহিদ চন্ডীচরণ সূত্রধর

চন্ডীচরণ সূত্রধর সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার উচাইল অন্তর্গত জাফরপুরে ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নিয়ে মতান্তর রয়েছে। দিলীপকান্তি লস্কর তাঁর গ্রন্থে চিন্তাহরণ সূত্রধর বলে উল্লেখ করেছেন।

বার্ষিক রক্তিম দিগন্ত পত্রিকাতেও পিতার নাম চিন্তাহরণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কানু আইচ তাঁর বরাকের পঞ্চদশ ভাষা শহিদ গ্রন্থে শহিদের পিতার নাম চন্দ্রকান্ত সূত্রধর বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কেউ-ই তথ্য সূত্র উল্লেখ করেননি।

শহিদ চন্ডীচরণরা কয় ভাই-বোন ছিলেন—তা নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। দিলীপকান্তি লস্কর চন্ডীচরণ সূত্রধর-এর একমাত্র বোনের কথা উল্লেখ করেছেন। বার্ষিক রক্তিম দিগন্ত-তে বলা হয়েছে দু-ভাইয়ের কথা। কানু আইচ জানিয়েছেন, চন্ডীচরণের কেবল এক বোন ছিল এবং তিনি তাঁর বিয়ে দেন সিলেট জেলাতেই (বরাকের পঞ্চদশ ভাষা শহিদ, পৃ. ১৮)। ইমাদ উদ্দিন বুলবুল তাঁর অপ্রকাশিত পান্ডুলিপিতে চন্ডীচরণেরা দুভাই এবং এক বোন বলে উল্লেখ করেছেন। ভাই-বোন নিয়ে বিভ্রান্তি আজও বর্তমান।

আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে তা থেকে পিতার নাম চিন্তাহরণ সূত্রধর বলেই মনে হয়। চন্ডীচরণ সূত্রধর লেখাপড়া করেছিলেন এম ই পর্যন্ত। তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হন। ১৯৫০ সালে চলে আসেন শিলচরে। শিলচরের রাঙ্গিরখাড়িতে চন্দ্রমোহন সূত্রধরের বাড়িতে আশ্রয় নেন। শৈশবেই তিনি পিতৃ-মাতৃহীন হয়েছেন, একা বাঁধনহীন জীবন। পৈতৃক পেশা কাঠের কাজেই তিনি মনোনিবেশ করেন। অচিরেই মিস্ত্রি হিসেবে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন।

১৯৬১ সালের মে মাস, কাছাড়ে বাংলা ভাষা আন্দোলন তখন তুঙ্গে। রাঙ্গিরখাড়িতে চন্ডীচরণের আস্তানায় একদিন তরণীমোহন দেবনাথ ও তাঁর সঙ্গীদের কয়েকজন চলে আসেন ভাষা আন্দোলন নিয়ে কথা বলার জন্য। চন্ডীচরণ সব শুনে ১৯ মে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিতে প্রস্তুত বলে জানিয়ে দিলেন। তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘আমার তো কেউ নেই, কিছুই নেই, সর্বস্বহারা, বাংলা ভাষার জন্য না হয় আমার জীবনটাও দিয়ে দেব।’

১৯ মে শেষ রাতের দিকে কয়েকজন সহযাত্রীসহ শিলচর রেলস্টেশনের দিকে রওনা দিলেন চন্ডীচরণ। নির্বিঘ্নে স্টেশন এলাকায় পৌঁছে রেললাইন বরাবর অবস্থান নেন। ভোর ছ-টা থেকেই রেললাইন ও তার আশপাশ এলাকা থেকে সত্যাগ্রহীদের হটাতে দফায় দফায় লাঠিচার্জ এবং কাঁদুনে গ্যাস ছোড়া হয়। কিন্তু কেউ-ই নিজের অবস্থান থেকে নড়েননি। ট্রেনের চাকা ঘোরেনি, ট্রেনও চলেনি, চলতে পারেনি হাজার হাজার জনতার অবরোধের কারণেই। কিন্তু বিনামেঘে বজ্রপাতের মতোই হঠাৎ গুলি চালানো হল সরাসরি জনতাকে লক্ষ করে। মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি, ছুটোছুটি পড়ে যায়। আর এসময়ই চন্ডীচরণ গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যান। শিলচর সিভিল হাসপাতালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বটে, কিন্তু ততক্ষণে প্রাণ-পাখিটি খাঁচা ছেড়ে পালিয়েছে।

তাঁর স্মৃতিকে জাগরুক রাখতে রাঙ্গিরখাড়ির একটি সড়কের নামকরণ করা হয় ‘শহিদ চন্ডীচরণ সূত্রধর রোড’। তিনি আজ নেই, কিন্তু তাঁর উত্তরসূরিরা আছেন।

৬. শহিদ হীতেশ বিশ্বাস

হীতেশ বিশ্বাসদের আদিনিবাস পূর্ববঙ্গে। সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার ব্রাহ্মণডোরা গ্রামে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে তাঁর জন্ম। পিতা হরিশচন্দ্র বিশ্বাস পোস্ট অফিসে স্বল্প বেতনের চাকরি করতেন। মায়ের নাম কিরণবালা। হীতেশরা চার ভাই-বোন ছিলেন। দুই ভাই, দুই বোন। বোন সবার বড়ো, বাসন্তীবালা, দ্বিতীয়জন হীতেশ। তৃতীয় অজিত এবং চতুর্থ কন্যা শংকরী।

মাত্র বারো বছর বয়সে হীতেশ পিতৃহারা হন। ১৯৪৭-এ সিলেট গণভোটকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি বেশ নাজুক অবস্থায় চলে যায়। ফলে, দলে দলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মাতৃভূমি ত্যাগ করে ভারত অভিমুখে রওনা দেন। হীতেশ বিধবা মা, ভাই-বোনদের সঙ্গে নিয়ে ত্রিপুরা চলে আসেন। ঠাঁই পেলেন খোয়াইয়ের একটি শরণার্থী ক্যাম্পে। সরকারি অর্থ সহায়তায় হীতেশ নিজেদের জন্য একটি ছোট্ট মাথা গোঁজার ঠাঁই গড়ে তোলেন। তারপর চলে চাকরির খোঁজ। কিন্তু কোনো কাজ তিনি পেলেন না। কোনো পথ না পেয়ে পিতার স্বল্প সঞ্চয় সম্বল করে একটি দোকান খোলেন; ভাইকে ভরতিও করে দিলেন স্কুলে। কিন্তু দোকান জমল না। পুঁজি ক্রমশ পেটপুজোতেই ব্যয় হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে দিদি বাসন্তীর বিয়ে দিয়েছেন শিলচরের অম্বিকাপট্টিতে। ভাগ্যান্বেষণে হীতেশ ছুটলেন জামাইবাবু গজেন্দ্রচন্দ্র করের মতান্তরে রমেশ করের বাড়িতে। আর ছোটোভাই অজিত চলে যান আসামের যোরহাটে। সেখানে তিনি ছোটো একটি দোকান খোলেন। হীতেশের জামাইবাবুর প্রচেষ্টায় জানিগঞ্জের শ্রীদুর্গা স্টোর্স নামের একটি কাপড়ের দোকানে কাজ পান তিনি। দু-ভাই মাসে মাসে মা-কে টাকা পাঠাতে শুরু করেন। সংসারে খানিকটা স্বস্তি ফিরে আসে। দিদি-জামাইবাবু হীতেশের বিয়ের তোড়জোড় শুরু করলেন। কিন্তু বিধি বাম।

১৯৬১ সাল থেকে ভাষা আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হয়। হীতেশও আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯ মে ছিল অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিন। শিলচর গণসংগ্রাম পরিষদ থেকে দু-টি সত্যাগ্রহী কার্ডও সংগ্রহ করেন তিনি। কারণ তাঁর দিদিও সঙ্গী হবেন। এ দিন ভোর না হতেই আরও অনেকের সঙ্গে ভাই-বোন রওনা দিলেন শিলচর স্টেশন এলাকায় রেল অবরোধে। লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস তো ছিলই, কিন্তু দুপুরের পরপরই হঠাৎ করে গুলিচালানো হল জনতাকে উদ্দেশ করে। হীতেশ গুলিবিদ্ধ হলেন, গুলি লাগে পায়ে। তিনি চিৎকার করে দিদিকে গুলি লাগার কথা জানান এবং তাঁকে পালাতে বলেন। আবারও গুলি। আর এই গুলিই তাঁর দেহকে ঝাঁঝরা করে দেয়। হীতেশ ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন।

হীতেশ স্মরণে টিকরবস্তী সড়কের নামকরণ করা হয় ‘শহিদ হীতেশ বিশ্বাস রোড’। হীতেশ থাকলেন মানুষের হৃদয়ে।

৭. শহিদ কুমুদরঞ্জন দাস

অতিসাধারণ ঘরের সন্তান কুমুদরঞ্জন দাস। কিন্তু কাজ করলেন অসাধারণ, দৃষ্টান্তমূলক। ১৯৪০ সালে সিলেটের মৌলভিবাজার মহকুমার জুরি গ্রামে তাঁর জন্ম। সিলেট এ সময় আসাম প্রদেশের একটি জেলা। পিতা কুঞ্জমোহন দাস। কুমুদ শৈশবেই মাতৃহারা হন। ফলে, মায়ের স্নেহ-আদর তিনি পাননি। পিতা কুঞ্জমোহন দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে সন্তান লাভের পর থেকে কুমুদের ভাগ্যে কেবলই অবহেলা, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা। তাঁকে স্কুলে ভরতি করে দেওয়া হয় বটে, কিন্তু বেশি পথ পেরোতে পারেননি। পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর তাঁকে পড়াশুনোয় ইতি টানতে হয়। টানাটানির সংসার, পিতা কুঞ্জমোহন তাঁর মুদি-দোকানে ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দেন।

সাতচল্লিশে ভারত ভাগ হওয়ার পর গণভোটে সিলেটও ভাগ হয় এবং প্রায় পুরোটাই পাকিস্তানভুক্ত হয়ে যায়। সাম্প্রদায়িক সংঘাত পরিবেশকে অশান্ত করে তোলে। কুমুদদের দেশত্যাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে। কুমুদের মামা নলিনীমোহন দাস জন্মভূমি ত্যাগ করে শিলচরে চলে আসেন। সঙ্গে আসেন কুমুদরঞ্জন। শিলচরে মামা-মামির আদরযত্নে দিনগুলো ভালোই কাটছিল।

কিন্তু কুমুদরঞ্জন একটা কিছু করতে চাচ্ছিলেন। মামার প্রচেষ্টায় তিনি আগরতলা রওনা দিলেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ড্রাইভিং শিক্ষার উদ্দেশ্যে। অনেকদূর অগ্রসরও হয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ মামার অসুস্থতার খবর পেয়ে দ্বিতীয়বার কিছু না ভেবে শিলচর চলে যান এবং সব ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন।

এ সময় শিলচর বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে সরগরম ছিল। কুমুদও এ আন্দোলনে যোগ দিলেন। সত্যাগ্রহী কার্ডও সংগ্রহ করেন। ১৯ মে রেল অবরোধে শিলচর স্টেশন এলাকায় অবস্থান নেওয়ার কথা সংগ্রাম পরিষদ অফিস থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এ দিন ভোররাতে অপর সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে রেল অবরোধে রওনা দিলেন কুমুদ। নিরাপদে স্টেশন এলাকায় পৌঁছে সকলের সঙ্গে পিকেটিং শুরু করেন ঘন ঘন স্লোগানে — ‘বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ’। ট্রেন চলেনি। সরকারি বাহিনী দফায় দফায় লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এত অত্যাচারেও জনতা হার মানেনি। শেষপর্যন্ত সরকারি বাহিনী মানুষ হত্যায় মেতে ওঠে। হঠাৎ করেই গুলি চালানো হল। কোনো সতর্কতা নয়, সরাসরি মানুষ লক্ষ করেই গুলি। গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন কুমুদরঞ্জন। সব শেষ, ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন খেটে-খাওয়া এই মানুষটি, শহিদ হলেন তিনি।

শিলচরের ম্যাগাজিন রোড আজ শহিদ কুমুদরঞ্জন দাস রোড—যা শহিদের স্মৃতিকেই স্মরণ করিয়ে দেবে বারংবার।

৮. শহিদ সত্যেন্দ্র দেব

সিলেটের হবিগঞ্জ মহকুমার দেওন্দি গ্রামে ১৯৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন ভাষা শহিদ সত্যেন্দ্র দেব। পিতার নাম শশীমোহন দেব এবং মাতার নাম সুরবালা দেব। সাতচল্লিশে ভারত ভাগের পর আর পাঁচটা পরিবারের মতো শশীমোহনকেও জন্মভূমি ছাড়তে হয়। তাঁদের নতুন পরিচয় জোটে উদবাস্তু। শশীমোহন হবিগঞ্জ থেকে স্ত্রী সুরবালা, পুত্র সত্যেন্দ্র দেব ও তিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ত্রিপুরার উদ্দেশে রওনা দিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। সত্যেন্দ্র দেবরা ত্রিপুরার কৈলাশহরে ফটিক রায় রাজনগর কলোনিতে আশ্রয় লাভ করেন। নতুন আশ্রয়, নতুন ঠিকানায় পিতা শশীমোহন পরলোকে গমন করলে সত্যেন্দ্র মা-বোনদের নিয়ে অথৈ সমুদ্রে পড়লেন। তাঁর লেখাপড়া নিম্ন প্রাইমারি, বয়সও খুব বেশি না, কী করবেন তিনি?

শেষপর্যন্ত রাজমিস্ত্রির কাজে লেগে পড়লেন। সতেন্দ্র পাকা রাজমিস্ত্রিতে পরিণত হন। একসময় কনট্রাক্টরের অধীনে কাজ নিয়ে মা, বোনদের ত্রিপুরা রেখে শিলচর চলে যান। ফাটকবাজারে থাকার জায়গা করে নিলেন। এ সময় শিলচরে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাজ্যভাষা করার জন্য জোরদার আন্দোলন চলছিল। তিনি মা-বোনের কথা ভুলে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। বাংলা ভাষার দাবির লড়াইয়ে তাঁদের জিততে হবে—এ ছিল তাঁর মনের কথা। ১৯ মে সত্যেন্দ্র অন্যান্য স্থানের সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে রেল রুখতে ফাটকবাজার থেকে তারাপুর রেলস্টেশনের উদ্দেশে রওনা দেন ভোররাতে। নির্বিঘ্নে যথাস্থানে পৌঁছে নিজের অবস্থানে বসে পড়েন। সকাল গড়িয়ে দুপুর। ইতিমধ্যে পুলিশি হামলা কয়েকদফা হয়ে গেছে। উপস্থিত সত্যাগ্রহীরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন ট্রেন চলতে দেবেন না, চলেওনি। সত্যেন্দ্র এ সময় দেখলেন, স্টেশন থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটি মোটরগাড়িতে আগুন জ্বলছে এবং মানুষজন আগুন নেভাতে ছুটোছুটি করছে— কেউ জল, কেউ নিকটবর্তী পুকুর থেকে কচুরিপানা এনে আগুন নেভাতে চেষ্টা করছে। সত্যেন্দ্র ছুটলেন আগুন লক্ষ করে, তিনিও আগুন নেভানো কাজে অংশ নিতে চান। কিন্তু হঠাৎ বেপরোয়া গুলি শুরু হয়। সত্যেন্দ্র রেলওয়ে পুকুর থেকে কচুরিপানা নিয়ে যেতে মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু সে-সুযোগ তাঁর হয়নি। ব্যাপক গুলি তাঁদের দিকটাতেই। গুলি থেকে বাঁচতে সত্যেন্দ্র পুকুরে নেমে পড়েন হয়তো ভেবেছিলেন গুলিবৃষ্টি থেমে গেলে তিনি স্বস্থানে ফিরে যাবেন। কিন্তু তা হয়নি। পুকুরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করেন। এ ঘটনা কারো নজরে আসেনি। পরদিন অর্থাৎ ২০ মে তাঁর মৃতদেহ ভেসে ওঠায় মানুষ তাঁকে পুকুর থেকে উদ্ধার করেন। এদিকে বীরেন্দ্র সূত্রধর শিলচর সিভিল হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে এ দিন অনন্তলোকে যাত্রা করেন। এই দুই শহিদের দেহ নিয়ে ২১ মে বিশাল শোক মিছিল বের করা হয়। হাজার হাজার মানুষ এই শোকযাত্রায় অংশ নেন।

শিলচর পৌরসভার পক্ষ থেকে সত্যেন্দ্র দেব-এর স্মৃতি স্মরণে পানপট্টির রাস্তাটির নামকরণ করা হয় ‘শহিদ সত্যেন্দ্র দেব রোড’।

৯. শহিদ সুনীল সরকার

সুনীল সরকার পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার মানুষ ছিলেন। পিতার নাম সুরেন্দ্র দে সরকার এবং মাতা সুভাষিণী দে সরকার। সুনীলরা ছিলেন চারভাই—রঞ্জন দে সরকার, বীরেন্দ্রকুমার দে সরকার, অনিলকুমার দে সরকার এবং সর্বকনিষ্ঠ সুনীল দে সরকার। বোনেরা ছিলেন— নীহারকণা দে সরকার, মলিনা দে সরকার এবং গীতা দে সরকার।

সুনীল সরকার ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমার স্বর্ণগ্রামে ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সাতচল্লিশে দেশভাগজনিত দাঙ্গা কেবল পূর্ববঙ্গে নয়, পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামেও ছিল। এই পরিস্থিতিতে পরিবারপ্রধান সুরেন্দ্র সরকার ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী সকলকে নিয়ে বহু পথ পাড়ি দিয়ে শিলচর চলে আসেন। বসবাস শুরু করেন নতুনপট্টিতে।

শিলচরে সুনীল সরকারকে ভরতি করে দেওয়া হয় অভয়াচরণ পাঠশালাতে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তাঁকে ভরতি করা হয় নরসিং হাই স্কুলে। কিন্তু আর্থিক কারণে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাঁকে পড়াশোনার পাঠ চুকাতে হয়। সংসারে আর্থিক টানাটানি কিছুটা লাঘব করতে সেই বয়সে সেন্ট্রাল রোড মোড়ে একটা দোকান খোলেন। শুরু করলেন পান, বিড়ি, সিগারেট ইত্যাদি দিয়ে। ক্রমশ দোকানে অন্যান্য সামগ্রীও আনা হয়। দোকানটা একটু বড়োও করলেন। দিন ভালোই যাচ্ছিল, পরিবারে বেশ খানিকটা অর্থ সাহায্যও করতে পারতেন।

১৯৬১ সালের শুরু থেকেই শিলচরে বাংলা ভাষা আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। সুনীল সরকারও ভাষা আন্দোলনে যোগ দিলেন। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, আবার মুখের ভাষাটাও কি চলে যাবে— এই ভাবনা তাঁকে তাড়িত করছিল। সত্যাগ্রহী কার্ড সংগ্রহ করলেন ১৯ মে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিতে। গণসংগ্রাম পরিষদ অফিসে তিনি নাম লেখালেন ‘সুনীল সরকার’ এবং তারপর থেকেই তিনি পরিচিত হলেন সুনীল সরকার নামে।

১৯ মে ভোরে অন্ধকার থাকতেই তিনি শিলচর স্টেশন এলাকায় পৌঁছে যান। তাঁদের ওপর দায়িত্ব ছিল ট্রেন অবরোধ, ট্রেন চলতে দেওয়া হবে না এ দিন। পুলিশি নির্যাতন চলে, কাঁদানে গ্যাসে পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলা হয়, কিন্তু তারপরও সত্যাগ্রহীরা অবস্থান ছেড়ে যাননি। শুধুই কি পুরুষ, পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অবস্থান নিয়েছিলেন। দুপুরে হঠাৎ করেই গুলি চালানো হয়। আর তাতেই অনেকের সঙ্গে সুনীলও গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয় বলে জানা যায়। সুনীল বাংলা ভাষার মান রাখতে গিয়ে প্রাণ দিলেন, শহিদ হলেন।

তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে শিলচর পৌরসভা হাসপাতাল রোড থেকে শ্মশান রোডের সংযোগকারী রাস্তাটিকে ‘শহিদ সুনীল সরকার রোড’ নামে ঘোষণা করে।

(তথ্য উৎস: ১৯-এর ভাষা শহিদেরা, দিলীপকান্তি লস্কর সম্পাদিত ২০০২ এবং বার্ষিক রক্তিম দিগন্ত, ২০১৩, মিতা দাস পুরকায়স্থ সম্পাদিত)

১০. শহিদ কানাইলাল নিয়োগী

বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডের টাঙ্গাইলের কালিহাতি থানার খিলদা গ্রামে ১৯২২ সালে জন্মগ্রহণ করেন কানাইলাল নিয়োগী। পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল গুহ নিয়োগী এবং মাতা মনোরমা গুহ নিয়োগী। কানাইলাল স্থানীয় স্কুল থেকে প্রাইমারি ও হাই স্কুল থেকে ১৯৪০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। কানু আইচ কানাইলাল সম্পর্কে জানান, ‘১৯৪৫ সালের এপ্রিলে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলে টালি ক্লার্ক হিসাবে নিয়োগ পেতে কাছাড়ের বদরপুর রেলস্টেশনে যোগ দিলেন। কিছুদিন বদলি হয়ে হাইলাকান্দিতেও কাজ করেছেন, এর পরে শিলচরে’। (কানু আইচ, বরাকের পঞ্চদশ ভাষা শহিদ, শিলচর, ২০১৩, পৃ. ১৬)।

তিনি আরও জানান, ‘১৯৪৭ সালের শেষের দিকে বাংলার ২০ মাঘ যতীন্দ্র সরকারের প্রথমা কন্যা শান্তিকণার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।’

অপরদিকে শহিদের স্ত্রী একষট্টির ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী শান্তিকণা নিয়োগী শিলচরের মাসিমপুর রোডের নিজবাড়িতে দিলীপকান্তি লস্করের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ১৯৯৭ সালের ২২ মে বলেন, ‘… দেশ বিভাগের পর পরই কানাইলাল নিয়োগী (তখন তিনি রেলে চাকরি করতেন আখাউড়ায়) অপশন নিয়ে চলে আসেন শিলচরে রেল বিভাগে। ভাষা আন্দোলনের সময় উনি শিলচরে রেলের পার্সেল-ক্লার্ক হিসেবে কাজ করছিলেন। সে-সময় তিনি রেলের মজদুর ইউনিয়নের শিলচর শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের আগে থেকেই তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কমরেড অচিন্ত্য ভট্টাচার্য, বীরেশ মিশ্র, দিগেন দাশগুপ্ত, প্রিয় গুপ্ত প্রমুখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এই সূত্রেই তিনি কাছাড়ের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।’ (১৯-এর ভাষা শহিদেরা, পৃ. ৩১-৩২)

আমরা লক্ষ করব, বিশিষ্ট লেখক কানু আইচের বক্তব্যের সঙ্গে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কানাইলাল নিয়োগীর স্ত্রী শান্তিকণা নিয়োগীর বয়ানে স্পষ্ট পার্থক্য বর্তমান। সেক্ষেত্রে আমরা শহিদের স্ত্রীর সাক্ষ্যকেই মান্যতা দেব। কানাইলাল দুই ছেলে, দুই মেয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে রেলওয়ে কোয়ার্টারে থাকতেন। অফিস ছিল রেলওয়ে স্টেশনে। ১৯ মে তিনি অফিসেই ছিলেন। এ দিন কানাইলাল দুপুরে বাড়ি থেকে খাওয়া-দাওয়াও সেরে আসেন। স্টেশনে এসে অস্থিরভাবে তিনি পাইচারি করছিলেন। হঠাৎ-ই গুলি। অথচ গুলি চালাবার মতো পরিস্থিতি তখন ছিল না। তিনি নিকটবর্তী মানুষজনকে সামলাতে বিশেষ করে মেয়েদের নিরাপদে রাখার জন্য দৌড়াদৌড়ি করছিলেন। আর এ সময় ঘাতকের বুলেট তাঁকে স্তব্ধ করে দেয়। শহিদ হলেন তিনি।

তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে স্থানীয় পৌর প্রশাসন শিলচর স্টেশন রোড ও মাদার টেরেসা রোড সংযোগকারী তারাপুর পুলিশ ফাঁড়ি সংলগ্ন সড়কটিকে ‘শহিদ কানাইলাল নিয়োগী রোড’ হিসেবে চিহ্নিত করেন।

১১. শহিদ সুকোমল পুরকায়স্থ

করিমগঞ্জ মহকুমার বাগবাড়ি গ্রামে ১৯২৫ সালে সুকোমল পুরকায়স্থ জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম সঞ্জীব পুরকায়স্থ এবং মাতা শৈবলিনী পুরকায়স্থ। সুকোমলরা ছিলেন সাত ভাই-বোন। তিন ভাই, চার বোন। ভাইয়েরা ছিলেন— স্বর্ণকমল, সুকোমল ও সুনির্মল। বোনেরা ছিলেন—নীহারনলিনী, বিভা, ইভা ও কনকনলিনী (মিলি)।

শিলচরে থাকতেন জ্যাঠামশায় মহেন্দ্র পুরকায়স্থের বাড়িতে। সেখানে থেকেই প্রাথমিক এবং হাই স্কুলে পড়াশুনো করেছিলেন সুকোমল। অভয়াচরণ পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা এবং নরসিং হাই স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনো করেছিলেন। দারিদ্র্যের কারণে তাঁকে পড়াশুনো ছাড়তে হয়। শেষপর্যন্ত রোজগারের পথ খুঁজতে লাগলেন তিনি। ভাগ্যান্বেষণে বহুদূরের পথ ডিব্রুগড় চলে গেলেন। সেখানে একটি দোকান খোলেন। ছোটো আকারে হলেও ব্যাবসা ভালোই শুরু হয়। নিজে পড়াশুনো করতে পারলেন না বলে মনে কষ্ট ছিল। আর এই না পাওয়ার অতৃপ্তি মেটাতে চাইলেন ভাই-বোনদের শিক্ষিত করার মধ্য দিয়ে। ভাই-বোনদের তাঁর কাছে নিয়ে আসলেন লেখাপড়া করাবেন বলে।

১৯৬০ সালে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ভয়াবহ ভাষা দাঙ্গা সংঘটিত হয়। দাঙ্গায় অসমিয়াদের হামলার শিকার হন এই অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠী। ভয়াবহ এই দাঙ্গা ‘বঙ্গাল খেদা আন্দোলন’ নামে পরিচিত ছিল। অসমিয়াদের এই হামলা থেকে নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কেউ-ই রেহাই পাননি। ধর্ষণের শিকার হন অসংখ্য বাঙালি নারী। তাই সুকোমল তাঁর বোনদের ডিব্রুগড়ে রাখার ভরসা পেলেন না। এ সময় সুকোমলের দাদা স্বর্ণকমল শিলচরের শ্রীকোণাতে চাকরি সূত্রে অবস্থান করছিলেন। দাদার কাছেই বোনদের রেখে আসলেন তিনি।

১৯৬১ সালের মে মাসের দিকে সুকোমল ছোটো বোন মিলির বড়ো রকমের অসুখের সংবাদ পেয়ে ছুটে চলে যান শিলচরে দাদার বাড়িতে। সেখানে পৌঁছে বোনের উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তিনি শিলচরে কিছুদিন থাকারও মনস্থির করেন।

এ সময় ভাষা আন্দোলন তুঙ্গে, রোজই সভা, মিছিল। সুকোমল সংগ্রাম পরিষদে গিয়ে নাম লেখালেন। অফিস থেকে সত্যাগ্রহী কার্ডও সংগ্রহ করেন। ১৯ মে সুকোমল আরও অনেক সত্যাগ্রহীর সঙ্গে শিলচর স্টেশন এলাকায় ভোররাতে পৌঁছে রেললাইনে বসে পড়েন। দায়িত্ব ছিল যেন ট্রেন চলতে না পারে। আর আসাম সরকার চেয়েছেন যেকোনো শক্তি প্রয়োগ করে ট্রেন চালাতে হবে।

১৯-এর সকালে সবাই লক্ষ করলেন যে, স্টেশন ও সংলগ্ন এলাকায় পুলিশ, আধা সেনা, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীতে ছয়লাপ। জনতা স্লোগান তোলেন ‘বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ’ ‘জান দেব, জবান দেব না’, ‘বন্দে মাতরম’। শুরু হয় নিরাপত্তা বাহিনীর লাঠিচার্জ, বেত্রাঘাত টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ। কিন্তু তারপরও জনতাকে হটিয়ে দেওয়া যায়নি। রক্তাক্ত, আহত অবস্থাতেই ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’ বলে চলেন তাঁরা। ট্রেন চলতে পারেনি। অস্থির নিরাপত্তা বাহিনী শেষে গুলিচালিয়ে বসল। না, কোনো সতর্ক বার্তা নয়, সত্যাগ্রহীদের লক্ষ করে সরাসরি গুলি। হায়েনাদের গুলি সুকোমলের বাম ঊরু ভেদ করে চলে যায়। তীব্র বেগে রক্তপাত শুরু হয়। সকলে ধরাধরি করে সুকোমলকে নিয়ে যায় প্রথমে প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রে যা ভাষা আন্দোলনকারীগণই প্রস্তুত রেখেছিলেন এবং সেখান থেকে শিলচর সিভিল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু না, চিকিৎসকদের নিরলস চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে সুকোলম পাড়ি দিলেন অনন্তলোকে। তাঁর রক্তপাত কিছুতেই বন্ধ করা যায়নি। আর এভাবেই নি:সাড় হয়ে পড়েন তিনি। বাংলা ভাষার মান বাঁচাতে সুকোমল স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এগিয়ে এসেছিলেন, জীবনও দিলেন। কিন্তু মাতৃভাষা বাংলা কি তাঁর যোগ্য মর্যাদা লাভ করেছে?

শিলচর পৌরসভা শহিদের স্মৃতি রক্ষার্থে শ্মশান সড়কের নামকরণ করেন ‘শহিদ সুকোমল পুরকায়স্থ রোড’।

কেবল মাতৃভাষার জন্য একজন নারীসহ ১১ জনের প্রাণহানি খুব ছোটো ঘটনা ছিল না। কিন্তু তারপরও বিষয়টি কাছাড়ের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই থেকে গেল। এমনকী পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পর্যন্ত মিটিং, মিছিল, বক্তৃতা ছাড়া প্রতিকারের পথ বের করতে পারেননি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, কবি-সাহিত্যিক (কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত) একই পথ অনুসরণ করেছেন— যা বেদনাদায়ক। আরও যন্ত্রণাদায়ক যে, অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেলেও শহিদেরা আজও বিচার পেলেন না। তাঁদের পরিবার বা কাছাড়বাসী আজও জানলেন না শহিদদের কেন গুলি করে হত্যা করা হল, কী তাঁদের অপরাধ? আন্দোলন ছিল গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ। কোনো সশস্ত্র বিপ্লব ছিল না, সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা বা সরকারি সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতিতেও কেউ নিয়োজিত ছিলেন না। সত্যাগ্রহীরা সকলেই ছিলেন নিরস্ত্র। বিচারের বাণী নীরবেই থেকে গেল। শহিদদের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত থেকে যেসব বিষয় আমাদের সামনে আসে তা হল এ রকম:

এক. শহিদেরা সবাই বাঙালি এবং সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত।

দুই. সকলেই সাবেক পূর্ববঙ্গ থেকে আগত। এঁদের মধ্যে বৃহত্তর সিলেট জেলারই ৮ জন, ঢাকা থেকে একজন, টাঙ্গাইল থেকে একজন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন। সুতরাং, শহিদদের মূল শিকড় ছিল পূর্ববঙ্গে, পূর্ববঙ্গের বাঙালি। উদবাস্তু হয়ে এ সব মানুষ প্রাণ এবং মান রক্ষার্থে ভারতে চলে আসেন।

তিন. ১১ জন শহিদের মধ্যে কেবল একজন—কানাইলাল নিয়োগী ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন এবং রেলওয়েতে চাকরিরত ছিলেন। দু-জন শহিদ—কমলা ভট্টাচার্য ও শচীন্দ্রচন্দ্র পাল ১৯৬১-র মে মাসে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। মৃত্যুর পর ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় দু-জনেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। অবশিষ্ট আর কেউ-ই মাধ্যমিক পর্যন্ত পৌঁছোতে পারেননি—তার প্রধানতম কারণ দারিদ্র্য, দেশভাগ।

চার. পেশাগত দিক থেকে একমাত্র কানাইলাল ব্যতীত আর প্রায় সকলেই ছিলেন শ্রমজীবী। ছাত্রাবস্থা ছিল দু-জনের, কেউ উচ্চশিক্ষিত নন।

পাঁচ. শহিদদের প্রায় সকলেই নিম্নবিত্ত ঘর থেকে উঠে এসেছেন। তাঁরা রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন না।

ছয়. শহিদদের কেউ ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন না। কেবল বাংলা ভাষার জন্য, প্রাণের টানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। আসলে লড়াইটা ছিল সাধারণ গণ মানুষের। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মানুষের চরিত্র তো সে-কথাই বলে।

পরিশিষ্ট ২

বেসরকারি তদন্ত কমিশনে-র সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট : ১৯৬১

কাছাড়ের ভাষা আন্দোলনের চরিত্র ও প্রকৃতি, সরকারি দমনযন্ত্রের প্রকৃতি ও ব্যাপ্তি, শিলচরে গুলিবর্ষণের কারণ ইত্যাদি বিষয়গুলি খতিয়ে দেখে রিপোর্ট পেশ নিমিত্ত পাঁচজন বিশিষ্ট আইনজীবীকে নিয়ে গঠিত হয় বেসরকারি তদন্ত কমিশন। কমিশনে ছিলেন— শ্রী এন সি চ্যাটার্জি, ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল, শ্রী অজিতকুমার দত্ত, অ্যাডভোকেট, সুপ্রিমকোর্ট অব ইণ্ডিয়া, শ্রী রণদেব চৌধুরী, ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল, শ্রী স্নেহাংশুকান্ত আচার্য, এম এল সি, ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল এবং শ্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, এম এল এ ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল। কমিশন সভাপতি শ্রী এন সি চ্যাটার্জি শ্রীমতী মায়া রায়, ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল-কে কমিশনে সেক্রেটারি হিসাবে নিয়োগ দান করেন।

কমিশন ৩১ মে কলকাতা থেকে শিলচর পৌঁছোন এবং ৩ জুন পর্যন্ত কাছাড়ে অবস্থান করেন। শিলচরে তাঁরা রেলস্টেশন ও সংলগ্ন এলাকা, কোয়াটার্স ও সিভিল হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। কমিশন শ্রী সতীন্দ্রমোহন দেব-এর বাসভবন—যেখানে ১৯৬১ সালের ১৯ মে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছিল, সেই স্থানও পরিদর্শন করেন। তাঁরা ২৩ জন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ গ্রহণ করেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ২২ জন আহত সত্যাগ্রহীর লিখিত বিবরণও গ্রহণ করেন তাঁরা।

কমিশন করিমগঞ্জ যান ২ জুন ৬১ তারিখে। কমিশন সদস্যগণ যথাযথ কতৃপক্ষের অনুমতিক্রমে করিমগঞ্জ সাবজেলে আটক কতিপয় নেতার সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। তাঁরা অপর ১৩ জন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণও রেকর্ড করেন। কমিশন আক্রান্ত রেলওয়ে কোয়াটার্সের বিভিন্ন স্থানও পরিদর্শন করেন।

কমিশন চেয়ারম্যান শ্রী এন সি চ্যাটার্জি নিরোধক নিরোধ অ্যাক্টে আটক কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব শ্রী রথীন্দ্রনাথ সেন এবং শ্রী নলিনীকান্ত দাস-এর সাক্ষ্যও গ্রহণ করেন। কমিশন প্রচুর লিখিত দলিল দস্তাবেজ, সরকারি ভাষ্য, স্মারকলিপি ও প্রচারপত্র সংগ্রহ করেন। এ সব সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে কমিশন রিপোর্টে বলা হয়, কাছাড়ে সমস্ত পুলিশি ব্যবস্থাই অপ্রয়োজনীয় ও অসংগত ছিল। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমনে বেপরোয়া, ইচ্ছাকৃত ও নৃশংস গুলিবর্ষণ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ছিল।

কমিশন রিপোর্টের কয়েকটি দিকের প্রতি আলোকপাত করে সংবাদপত্রে বলা হল:

ব্যাপক হত্যার সুপরিকল্পিত চক্রান্ত

আসামে বঙ্গভাষাকে অন্যতম সরকারী ভাষারূপে গণ্য করার দাবিতে শিলচরে সমবেত সত্যাগ্রহীদের উপর গত ১৯শে মে যে গুলীচালনা হয়, (যাহাতে ১১ জন নিহত হইয়াছেন) তাহা ‘বিনা প্ররোচনায় এবং অন্যায়ভাবে’ করা হয়।

ওই গুলীচালনা সম্পর্কে কলিকাতার বিশিষ্ট আইনজীবীদের লইয়া যে বেসরকারি তদন্ত কমিশন গঠিত হয়, ওই কমিশন উপরিউক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছেন বলিয়া জানা গিয়াছে। প্রকাশ, রবিবার কমিশনের সভাপতি শ্রী এন সি চ্যাটার্জি ওই রিপোর্টে স্বাক্ষর করেন।

মে মাসের শেষভাগে কমিশনের সদস্যগণ কাছাড়ে পৌঁছেন এবং প্রায় সপ্তাহকাল বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করিয়া শতাধিক ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। শিলচর হাসপাতালে আহত ২৩জন সত্যাগ্রহীর সাক্ষ্যও তাঁহারা নথিভুক্ত করেন। তন্মধ্যে চারিজন মহিলাও সাক্ষ্য দেন।

কমিশন শিলচরে সত্যাগ্রহী ও অন্যান্য নাগরিকদের সাক্ষ্য এবং বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া প্রকাশ। যথা:

১. সম্পূর্ণ বিনা প্ররোচনায় পুলিশ বেপরোয়াভাবে গুলীবর্ষণ করিয়াছে;

২ .সত্যাগ্রহীরা নিরস্ত্র এবং সম্পূর্ণ শান্ত ছিল;

৩. পুলিশের উপর কোন হামলা হয় নাই;

৪. পুলিশের উপর ‘হত্যার জন্য গুলীচালনার’ নির্দেশ ছিল;

৫. পুলিশ কতৃক ঐরূপ চরম ব্যবস্থা অবলম্বনের উদ্দেশ্যই ছিল সত্যাগ্রহ আন্দোলন ভাঙ্গিয়া দেওয়া;

৬. পুলিশ যে কোন মুহূর্তেই সত্যাগ্রহীদের গ্রেপ্তার করিতে পারিত এবং সত্যাগ্রহীরাও গ্রেপ্তার বরণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন।

গুলীবর্ষণ কে করিয়াছে?

কমিশন শিলচরে গুলীবর্ষণ সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তদন্ত করিয়াছেন। শিলচর ষ্টেশনের সন্নিকটে যে স্থানে গুলি চালনা করা হয়। সদস্যগণ সে-স্থানটিও পরিদর্শন করেন এবং রেলওয়ে কোয়ার্টারে গিয়া বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন বলিয়া প্রকাশ।

কমিশন এই গুলীবর্ষণ সম্পর্কে তিনটি ভাষ্য পাইয়াছেন বলিয়া জানা যায়। তন্মধ্যে একটি সরকারী ভাষ্য—এই সকল ভাষ্য হইতে কমিশনের পক্ষে গুলীবর্ষণের আদেশ কে দিয়াছিল তাহা বাহির করা নাকি সম্ভব হয় নাই।

একটি ভাষ্য অনুসারে জানা যায়, এইদিন সকাল হইতেই সত্যাগ্রহীরা শিলচর ষ্টেশনে শান্তিপূর্ণভাবে পিকেটিং সুরু করে। বেলা ২-৩০ টার সময় উহাদের উপর অকস্মাৎ ও অতর্কিতে গুলীবর্ষণ করা হয়। তাহার অব্যবহিত পূর্বেই ক্ষুধার্ত সত্যাগ্রহীগণ খাদ্য গ্রহণ করিতেছিলেন এবং নিজেদের খাদ্য হইতে কিছু অংশ প্রহরারত পুলিসের মধ্যেও বণ্টন করিয়া দেন।

গুলীবর্ষণের কারণস্বরূপ পুলিস ভাষ্যে বলা হইয়াছে যে, বিশৃঙ্খল সত্যাগ্রহীগণ একটি ট্রাকে আগুন লাগাইয়া দেন। ইহার পর পুলিস গুলীবর্ষণ করে। কিন্তু কমিশন যে-সকল প্রমাণ সংগ্রহ করিয়াছেন, তাহাতে এই অভিযোগের সততা প্রমাণিত হয় নাই। জানা গিয়াছে ঐ ট্রাকটি সত্যাগ্রহীদের নিকট হইতে দুই ফার্লং তফাতে ছিল। পুলিসের ছাউনি আরও দূরে অবস্থিত ছিল। প্রকাশ, কোনো একটি কনষ্টেবল পুলিস ছাউনীতে ছুটিয়া গিয়া বলে যে সত্যাগ্রহীরা ট্রাকে আগুন লাগাইয়াছে। তারপরই গুলীবর্ষণের আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকাশ, কমিশন নি:সন্দেহ হইয়াছেন যে, ট্রাকে আগুন লাগাইবার সহিত সত্যাগ্রহীরা কোনোভাবেই যুক্ত ছিল না।

করিমগঞ্জের ঘটনা

করিমগঞ্জে যাহা ঘটিয়াছে তাহাও ভয়ানক বলিয়া কমিশন মন্তব্য করিয়াছেন জানা যায়। করিমগঞ্জেও নিরস্ত্র ও শান্ত সত্যাগ্রহীদের উপর পুলিস বিনা প্ররোচনায় বেপরোয়াভাবে কাঁদুনে গ্যাস ছুড়িয়াছে এবং নৃশংসভাবে লাঠিচালনা করিয়াছে। ফলে বহু সত্যাগ্রহী আহত হন। কমিশন করিমগঞ্জে কয়েকজন মহিলা সমেত ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।

প্রকাশ, কমিশন এইরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, আসাম পুলিস সত্যাগ্রহীদের উপর বর্বরতার চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছে।

কমিশনের সুপারিশ

প্রকাশ, কমিশন তাঁহার ৩০ পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ রিপোর্টে এই অভিমতও জানাইয়াছেন যে, আসাম একটি অদ্ভুত রাজ্য—যেখানে অসমিয়াভাষীর সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশের বেশি নাই। কাজেই আসামকে দ্বিভাষী বা ত্রিভাষী রাষ্ট্রে পরিণত করা ছাড়া সমস্যার সমাধান হইবে না। আসামে বর্তমানে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে, তাহাতে বঙ্গভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষারূপে স্বীকার করিয়া না লইলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হইতে পারে। যে সব সত্যাগ্রহী পুলিশ কতৃক নিপীড়িত হইয়া নিহত অথবা আহত হইয়াছেন, তাঁহাদের এবং তাঁহাদের পরিজনবর্গকে ইহার জন্য আসাম সরকারের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত বলিয়া কমিশন মনে করেন।

কমিশনের সদস্যবর্গ

নিম্নলিখিত আইনজীবী সদস্যগণকে লইয়া বেসরকারি তদন্ত কমিশন গঠিত হয়:

শ্রী এন সি চ্যাটার্জি (সভাপতি), শ্রীরণদেব চৌধুরী, শ্রীস্নেহাংশু আচার্য এম এল সি, শ্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এম এল এ, শ্রী অজিতকুমার দত্ত ও শ্রীমতী মায়া রায়।

জনসভায় শ্রী এন সি চ্যাটার্জির বক্তৃতা

রবিবার সন্ধ্যায় খিদিরপুর মনসাতলা পার্কে এক জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে শ্রী এন সি চ্যাটার্জি বলেন যে, বাঙালিদের বিরুদ্ধে আজকাল প্রাদেশিকতা ও সঙ্কীর্ণতার অপবাদ দেওয়া হইয়া থাকে। ইহা অপপ্রচার মাত্র। বস্তুত, তাঁহারা বাঙালি হইলেও আসামের বিপর্যয়ে সব সময়েই তাঁহারা তাহাদের পার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইয়াছেন।

শ্রী চ্যাটার্জি আরও বলেন যে, পাকিস্তান যখন তুকেরগ্রাম অধিকার করে এবং করিমগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে উপদ্রব শুরু করে তখন আসাম নেতৃবৃন্দের অনুরোধক্রমে তিনি তথায় অনুষ্ঠিত ‘গণ-সম্মেলন’-এর সভাপতিত্ব করেন। তিনি তুকেরগ্রামকে ভারতের মানচিত্রে তুলিয়া ধরেন। এবং শেষপর্যন্ত তুকেরগ্রাম আসাম ফিরিয়া পায়। করিমগঞ্জে হামলা বন্ধ হয়। তৎপূর্বে স্বর্গত কংগ্রেস নেতা গোপীনাথ বরদলৈ-এর অনুরোধে তিনি সীমানা নির্ধারণ কমিশনে আসামের পক্ষাবলম্বন করিয়াছিলেন এবং সেই সময় করিমগঞ্জ, বদরপুরকে আসামের অন্তর্ভুক্ত রাখার জন্য চেষ্টা করিয়া সফলকাম হন।

শ্রী চ্যাটার্জি আরও বলেন যে, বাংলার অধিবাসীগণ অসমিয়াদের প্রতি কোনোরূপ বিদ্বেষভাব পোষণ করে না। আসামে ৩০ লক্ষ বঙ্গভাষাভাষী অধিবাসী আছে। সুতরাং, বঙ্গভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য করা সমীচীন। ইহা মানবিকতার দাবি এবং সংবিধানসম্মত।

পরিশেষে শ্রী চ্যাটার্জি এই মন্তব্য করেন যে, কাছাড়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষার যে আন্দোলন চলিয়াছে উহা যদি সফল না হয় তাহা হইলে ভারতের ঐক্য ধ্বংস হইবে।

অপর আর এক প্রতিবেদনে বলা হল এ ভাবে:

কাছাড়ে আন্দোলন দমনে পুলিশি সন্ত্রাস

মেয়েদের তলপেটে পদাঘাত ও বস্ত্রহরণের বর্বর ঘটনা

বেসরকারি তদন্ত কমিটির রিপোর্টে অত্যাচারের লোমহর্ষক বিবরণ (স্টাফ রিপোর্টার)

শিলচর ও করিমগঞ্জে কাছাড়ের ভাষা আন্দোলনের সত্যাগ্রহীদের উপর অত্যাচার, বিশেষ করিয়া গত ১৯শে মে শিলচরের গুলীচালনা সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য প্রখ্যাত আইনজীবীদের লইয়া গঠিত বেসরকারী কমিটি সোমবার এক সাংবাদিক বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁহাদের রিপোর্ট প্রকাশ করেন। শ্রী এন সি চ্যাটার্জির সভাপতিত্বে ছয়জন সদস্য লইয়া গঠিত ঐ কমিটি তাঁহাদের রিপোর্টে শিলচর ও করিমগঞ্জে নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের উপর গুলী ও লাঠিচালনা এবং কাঁদুনে গ্যাস প্রয়োগের এক লোমহর্ষক ও বীভৎস বিবরণ উপস্থাপিত করেন।

শ্রী চ্যাটার্জি সাংবাদিকদের সহিত ঐ রিপোর্ট সম্বন্ধে আলোচনাকালে এইরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহের আন্দোলনের দিক হইতে কাছাড় সারা ভারতের নিকট দৃষ্টান্তস্থল হইয়া থাকিবে। তিনি বিশেষ করিয়া নারী সত্যাগ্রহীদের অকুতোভয় সাহস এবং পুলিসের বর্বর পীড়নের সম্মুখে আদর্শের প্রতি অবিচলিত নিষ্ঠা, ত্যাগ, লাঞ্ছনা ও দুঃখবরণের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

শ্রী চ্যাটার্জির মতে শিলচরের গুলীচালনার মর্মন্তুদ ঘটনা যদিও সারা ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে এবং ইহা লইয়া প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি হইয়াছে, তবুও তদন্তকালে তাঁহারা জানিতে পারিয়ছেন যে, পুলিসি নির্যাতনের দিক হইতে করিমগঞ্জেই সর্বাধিক ভয়াবহ অত্যাচার অনুষ্ঠিত হইয়াছে। এখানে পুলিস নির্বিচারে নারী-শিশুর উপর লাঠিচালনা করে। প্রকৃতপক্ষে এখানে পুলিস ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ সৃষ্টি করিয়াছিল। নারীর সম্ভ্রমও এখানে ক্ষুণ্ণ হয়। শিলচরে ও করিমগঞ্জে মেয়েদের তলপেটে লাথি মারা হয় এবং এমনকি, তাহাদের শাড়ীও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাড়িয়া লওয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রীর নিকট রিপোর্ট প্রেরণ

কমিশনের পক্ষ হইতে শ্রী চ্যাটার্জি জানান যে, এই রিপোর্ট তিনি অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরুর নিকট প্রেরণ করিতেছেন। ইহা ছাড়া রিপোর্টটি মুদ্রিত করিয়া উহা বিভিন্ন রাজ্য বিধানমন্ডলী ও সংসদের নিকট প্রেরণের ব্যবস্থা করা হইবে।

শ্রী চ্যাটার্জি ইতিমধ্যে তাঁহাদের বেসরকারী তদন্তের অভিজ্ঞতা প্রধানমন্ত্রীর সমীপে জানাইয়াছেন। তিনি আজ, মঙ্গলবার পুনরায় গৌহাটি যাত্রা করিতেছেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা অঞ্চল এবং তথাকার বাঙালিদের অবস্থা তিনি পর্যালোচনা করিবেন।

কমিশন তাঁহাদের তদন্তকালে ইহাও জানিতে পারিয়াছেন যে, সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ভিতরে যাহাতে সাম্প্রদায়িক বিভেদের সৃষ্টি হয় তজ্জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই। কমিশন জানিতে পারিয়াছেন যে, রাস্তা হইতে ধৃত সত্যাগ্রহীদের ভিতরে মণিপুরি ও মুসলমানদের ছাড়িয়া দেওয়া হয়।

কমিশন তাঁহাদের রিপোর্টে ভাষা-আন্দোলনের ঐতিহাসিক পটভূমিকা ও আসাম সরকারের যে বৈষম্যমূলক নীতির ফলে বর্তমান বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে, তাহা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপ বিশ্লেষণ করেন।

কমিশনের সিদ্ধান্ত

তদন্ত করিয়া কমিশন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছেন যে, সত্যাগ্রহী অথবা কাছাড়ের জনসাধারণ এই আন্দোলন চলাকালে এমন কোনো হাঙ্গামার সৃষ্টি করে নাই যাহা আসাম সরকার ও উহার কাছাড়স্থিত প্রশাসনিক কতৃপক্ষের দ্বারা অনুসৃত হিংসাত্মক ও বলপ্রয়োগের নীতি সমর্থিত হইতে পারে। সরকারের পক্ষ হইতে সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র পুলিসের রুট মার্চ ও অবিরাম টহল এবং সশস্ত্র শক্তির মহড়াই পক্ষান্তরে জনসাধারণের শান্তি বিঘ্নিত করিয়াছে। তাঁহাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, আসাম সরকার এবং তাঁহাদের কাছাড়স্থিত প্রশাসনিক কতৃপক্ষ, আসাম রাইফেলস, সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিস ফোর্স এবং সশস্ত্র পুলিশের দ্বারা কাছাড়ের জনসাধারণের মধ্যে সন্ত্রাস ও বিভীষিকা সৃষ্টির চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাঁহারা এই বিষয়ে সন্তুষ্ট হইয়াছেন যে, কাছাড়ের ভাষা আন্দোলন কোনো সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি হইতে পরিচালিত হয় নাই। পরন্তু আসাম রাজ্যে বসবাসী জাতি ও বিবিধ ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত জনসাধারণের অস্তিত্ব রক্ষার আদর্শই ওই সংগ্রামের প্রেরণা জোগাইয়াছে।

সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে কমিশন বিনা দ্বিধায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে, আন্দোলন শুরু হওয়ার অনেক আগে সেনাবাহিনী তলব অহেতুক এবং কি আইনগত, কি অবস্থাগত কোনো দিক দিয়াই উহার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

যে ভাষা একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোকের ভাষা তাহা অন্যতম সরকারী ভাষারূপে স্বীকার করিয়া লওয়ার দাবি যে-কোন রাজ্যের জনসাধারণের ন্যায়সংগত দাবি। যতক্ষণ পর্যন্ত এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ও অহিংস থাকিতেছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন সরকারেরই ওই আন্দোলন হিংসাত্মক পন্থায় দমন করিবার কোনো অধিকারই নাই। আন্দোলনকালে কাছাড়বাসীরা কোনো সম্পত্তি বিনষ্ট করে নাই, কোনো হিংস্র আচরণ করে নাই। সেক্ষেত্রে আসাম সরকারের পক্ষে এই আন্দোলন বলপ্রয়োগের দ্বারা দমন করিবার কোনো যৌক্তিকতা থাকিতে পারে না। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ কিংবা বে-আইনি জনতার সহিত মোকাবিলা করিবার ব্যাপারে আইনেই উপযুক্ত বিধান আছে। সাক্ষ্য প্রমাণে তাঁহাদের নিকট ইহাই প্রতিভাত হইয়াছে যে, যে স্থানীয় কতৃপক্ষ শিলচরে শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহীদের উপর গুলিচালনা এবং শিলচর ও করিমগঞ্জে লাঠিচালনা ও কাঁদানে গ্যাস ছাড়িবার জন্য দায়ী, তাঁহারা ফৌজদারি আইন বা পুলিস আইনের বিধান গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করিয়াছেন।

পুলিস ম্যানুয়েলে এরূপ বিধি আছে যে, একমাত্র শেষ অবস্থায়ই যখন জীবন অথবা সম্পত্তি রক্ষার একান্ত প্রয়োজন দেখা দেয়, তখনই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা যাইতে পারে। কমিশন এই বিষয়ে সন্তুষ্ট হইয়াছেন যে, এরূপ কোনো জরুরী অবস্থার উদ্ভব হয় নাই। জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় নাই, বা জীবন ও সম্পত্তি বিনষ্ট হয় নাই—যে জন্য নিরস্ত্র জনতার উপর গুলীচালনার মতো চরম ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন হইতে পারে।

সাক্ষ্য প্রমাণ হইতে কমিশন এই বিষয়ে সন্তুষ্ট হইয়াছেন যে, শিলচরে রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম এবং রেললাইন এই দুইটি স্থান হইতে সশস্ত্র পুলিসের দুইটি পৃথক বাহিনী সম্মুখ ও পার্শ্বভাগ (ক্রশ ফায়ারিং) হইতে গুলী চালায়। ইহা সম্পূর্ণ বেপরোয়া, নৃশংস এবং অযৌক্তিক ছিল।

শিলচরে স্থানীয়ভাবে অনুসন্ধান করিয়া কমিশন দেখিয়াছেন যে, দেওয়াল এবং বাড়ির বেড়া ভেদ করিয়া গুলী দূরে ও উঁচু ও নীচু স্থানে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে। তাঁহারা ওইসব গুলীর চিহ্ন প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। গৃহের ভিতরে এবং বারান্দায় অবস্থানকারী লোকও গুলীর আঘাতে নিহত হইয়াছে। ১৬ ফুট উঁচুতে একটি জলাধারের উপর দন্ডায়মান লোকও গুলীতে মারা পড়িয়াছেন। রেল প্ল্যাটফর্ম হইতে অনেক দূরে অবস্থিত বাড়ীতেও তাঁহারা বুলেট সংগৃহীত হইতে দেখিয়াছেন। তদন্তকালে তাঁহারা ইহাও দেখিয়াছেন যে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই হতাহতদের কোমরের উপর গুলী লাগিয়াছে এবং এতদ্দারা ইহাই প্রতিভাত হইয়াছে যে, হত্যা করিবার জন্যই গুলীচালনা হইয়াছে। কতকগুলি ক্ষেত্রে দেহের পিছনের দিকে গুলীর আঘাত দেখা গিয়াছে। ইহার দ্বারা ইহাই প্রমাণিত হয় যে, ওই সময় তাঁহারা দৌড়াইয়া আত্মরক্ষা করিতেছিলেন। অন্ততঃপক্ষে ওইসব সত্যাগ্রহীরা কোনো বাধার সৃষ্টি করিতেছিলেন না।

কোনো বাধা দেওয়া হয় নাই

সত্যাগ্রহীরা গ্রেপ্তারকালে বাধা দেন নাই। বরং তাঁহারা গ্রেপ্তার বরণের জন্য প্রস্তুতই ছিলেন। এমতাবস্থায় সত্যাগ্রহীদের গ্রেপ্তার ও ছত্রভঙ্গ করিবার জন্য কোন বলপ্রয়োগের প্রয়োজন ছিল না। তাঁহারা এইরূপ প্রমাণ পাইয়াছেন যে, নারী-বৃদ্ধ-শিশুনির্বিশেষে সকলকেই শিলচর ও করিমগঞ্জে নৃশংসভাবে প্রহার করা হয় এবং কাঁদানে গ্যাস ছাড়া হয়। মেয়েদের শাড়ী কাড়িয়া লওয়া হয়। তাহাদের কাহাকে কাহাকেও লাথি ও লাঠি মারা হয়।

কমিশন ইহাও জানিতে পারিয়াছেন যে, পলায়নরত এক বালককে পুলিশের লোকেরা একটি পুকুরে নিক্ষেপ করে এবং তাহাদের সম্মুখে যাহারা পড়িয়াছে, তাহাদেরই হাতে যাহা পাইয়াছে, তাহা দিয়া প্রহার করিয়াছে। করিমগঞ্জ রেলস্টেশনের লাগাও বাড়ীগুলিতেও পুলিশ হানা দেয়, বাসিন্দাদের মারপিট করে এবং সম্পত্তির হানি করে।

সাক্ষ্য প্রমাণে তাঁহারা এইরূপ জানিতে পারিয়াছেন যে, সশস্ত্র পুলিশ যখন শিলচর রেলস্টেশনে গুলী চালায়, তখন অন্ততঃপক্ষে একজন ম্যাজিষ্ট্রেট সেখানে হাজির ছিলেন। কিন্তু কমিশন যতদূর জানিতে পারিয়াছেন, তাহাতে মনে হয়, গুলীচালনার জন্য তাঁহার অনুমতি বা আদেশ লওয়া হয় নাই। কাছাড়ের ডি আই জি এবং আসাম সরকার কতৃক প্রচারিত দুইটি বিবৃতি এবং অন্যান্য বিবরণ কমিশন পাঠ করিয়াছেন। এইসব বিবৃতির ভিতরে যে অসংগতি আছে, তাহা লক্ষ্য করিয়া তাঁহারা বিস্মিত হইয়াছেন। ওইসব বিবৃতি বিশ্লেষণ করিলে দায়িত্ব এড়াইবার চেষ্টা এবং সরকারের পদস্থ অফিসারদের দুষ্কার্য ধামাচাপা দিবার প্রয়াসই সুস্পষ্ট হইয়া উঠে। সশস্ত্র পুলিসবাহিনীর পক্ষে আত্মরক্ষা অথবা সম্পত্তি রক্ষা প্রভৃতি কোনো প্রশ্নই উঠে নাই— যাহাতে গুলিচালনা এবং হত্যাকান্ডের সমর্থন মিলিতে পারে।

কমিশন সন্তুষ্ট হইয়াছেন যে, আসাম রাইফেলস অথবা পুলিস যেভাবে কাছাড়ের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র এবং শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহীদের উপর লাঠি চালাইয়াছে ও কাঁদানে গ্যাস ছাড়িয়াছে, তাহা আইনের সীমা অনেকখানি লঙ্ঘন করিয়াছে। করিমগঞ্জে পুলিস এবং আসাম রাইফেলস-এর লোকেরা বাড়ীতে বাড়ীতে অনধিকার প্রবেশ করিয়াছে এবং সম্পত্তির হানি ঘটাইয়াছে। কমিশনের মতে, এজন্য দায়ী লোকদের আসাম সরকার কতৃক বিচারের ব্যবস্থা করা উচিত।

মানবিক অধিকার লঙ্ঘন

কমিশন ইহা লক্ষ্য করিয়া সন্তুষ্ট হইয়াছেন যে, চরম প্ররোচনা ও হিংসাত্মক আচরণ সত্ত্বেও কাছাড়ের জনসাধারণ শান্তিপূর্ণ ছিলেন এবং পাশবিক শক্তির সম্মুখে তাঁহাদের মনোবল অক্ষুণ্ণ থাকে। আসাম সরকার যেভাবে কাছাড়ের ভাষা সত্যাগ্রহীদের আন্দোলন দমন করিবার চেষ্টা করিয়াছেন এবং আসামের এক শ্রেণীর লোক যেভাবে ‘অসমিয়াকরণ’ প্রচেষ্টায় উদ্যোগী হইয়াছেন, তাহা বিশ্লেষণ করিয়া কমিশনের ইহাই মনে হইয়াছে যে, এই প্রচেষ্টা শুধু যে আসামের ভাষাগত সংখ্যালঘুদের মৌল অধিকারই যে লঙ্ঘন করা হইয়াছে তাহা নহে, উহার দ্বারা মানবিক অধিকারও লঙ্ঘিত হইয়াছে।

কমিশনের মতে কাছাড়ের প্রশাসনিক কতৃপক্ষ আইনের সীমা এমনভাবে লঙ্ঘন করিয়াছেন, যাহাতে তাঁহারা আইনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় পড়িতে পারেন। কমিশন আসাম সরকারের নিকট উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানাইয়াছেন।

কমিশন মনে করেন, পুলিসের গুলীচালনায় যাঁহারা হতাহত হইয়াছেন বা যাঁহারা কিছু সময়ের জন্যও পঙ্গু হইয়াছেন, তাঁহাদের এবং তাঁহাদের পরিজনবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিবার ব্যবস্থা করা উচিত।

পরিশেষে কমিশন জনপদের বাণী উদ্ধৃত করিয়া এইরূপ সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন যে, নিজ ভাষায় নিজের অন্তরের কথা প্রকাশ করা মৌল মানবিক অধিকারের অন্যতম। পীড়নমূলক ব্যবস্থার দ্বারা এই মৌল অধিকার অস্বীকার বা ইহা হইতে বঞ্চিত করিলে আসাম বা সমগ্রভাবে ভারতের কোনো কল্যাণ সাধিত হইবে না।

সাংবাদিক বৈঠকে কমিশনের অন্যতম সদস্য শ্রী স্নেহাংশু আচার্য, শ্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এবং শ্রীমতী মায়া রায়ও ছিলেন। শ্রীআচার্য ও শ্রীরায় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।

অপর আর একটি প্রতিবেদনে বলা হল:

গত ১৯ শে মে শিলচর রেলস্টেশনে আসাম সরকারের নর-মৃগয়ায় একাদশ শহিদের জীবনাবসান ছাড়াও শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহীদলের উপর পুলিস ও সৈন্যবাহিনীর লোকেরা নারী-পুরুষ বালক-বালিকা নির্বিশেষে যেভাবে বর্বর অত্যাচার চালাইয়াছিল, তাহার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় প্রখ্যাত আইনজীবীদের লইয়া গঠিত বেসরকারি তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে।

শ্রীনির্মলচন্দ্র চ্যাটার্জির নেতৃত্বে পাঁচজন সদস্যের ঐ কমিশন গুলীচালনার ঘটনা সম্পর্কে শিলচরে ২৩ জন প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশিষ্ট নাগরিকের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। ওই সকল সাক্ষ্য হইতে সংগৃহীত তথ্য অনুসারে কমিশন উল্লেখ করিয়াছেন, নির্মম লাঠিচালনায় ও বন্দুকের কুঁদায় সত্যাগ্রহীদের দেহ ক্ষতবিক্ষত এবং রক্তাপ্লুত করিয়াও পুলিস ও সৈন্যবাহিনী তৃপ্ত হয় নাই, পৈশাচিক উল্লাসে তাহারা রেললাইনের উপরেই শান্তিপূর্ণ মেয়ে সত্যাগ্রহীদের লাথি মারিয়া, বুটের আঘাত দিয়া, হিঁচড়াইয়া টানিয়া ধরাশায়ী করিয়া দেয়।

কমিশনের রিপোর্টে দেখা যায় ঐ আরণ্যক বিভীষিকার কবলে যাহারা পড়েন তাহাদের মধ্যে আছেন অষ্টাদশী তরুণী শ্রীমতী গীতা দে এবং চব্বিশ বছরের যুবতী শ্রীমতী গৌরী বিশ্বাস। শ্রীমতী দে-র তলপেটে সশস্ত্র বাহিনীর জনৈক লোক এমন জোরে লাথি মারে যে- তিনি যন্ত্রণায় তৎক্ষণাৎ অজ্ঞান হইয়া পড়েন। শ্রীমতী বিশ্বাসের বুকে-পিঠে-পেটে এত লাথি মারা হয় যে তিনিও সংজ্ঞা হারান। শুধু তাহাই নহে, চল্লিশ বছরের শ্রীরজনী মালাকার এবং সাত বছরের এক ছোটো মেয়ের উপর লাঠিতে লাথিতে এত অত্যাচার করা হয় যে, তাহাদের উভয়ের অবস্থা শোচনীয় হইয়া পড়ে।

তাহা ছাড়া কমিশন রিপোর্টে উল্লেখ করেন, অষ্টাদশী ছাত্রী শ্রীমতী দীপালি দে-র বাম হাতে প্রচন্ড জোরে লাঠির আঘাত করা হয়। তারপরেই তাঁহার পিঠে বেয়নেটের অগ্রভাগ দিয়া খোঁচা মারা হয়। উহার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমতী দে মাটিতে লুটাইয়া পড়েন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাহার বুকের উপর আবার আঘাত করা হয়।

কমিশন বলেন, হারান মন্ডল নামক এক ব্যক্তির মণিবন্ধ লাঠির আঘাতে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে এবং সুবিনয় ধর বিধানচন্দ্র রায় প্রভৃতি সত্যাগ্রহীদের নাকে-মুখে-চোখে বেপরোয়া লাঠিচালনা করা হয়।

বিভীষিকার পূর্বাভাস

কমিশনের রিপোর্টে এই ধরনের বহু ঘটনার উল্লেখ আছে। প্রত্যেকটি ঘটনাই মর্মন্তুদ। বিভিন্ন দলিলপত্র ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে শিলচরের ঘটনাবলি সম্পর্কে কমিশনের অভিমত সংক্ষেপে নিম্নরূপ :-

‘১৯শে মে’ তারিখের অন্তত এক সপ্তাহ পূর্ব হইতেই সরকার শিলচর শহরে তাঁহাদের সশস্ত্র দাপট দেখাইতে ছিলেন। আসাম রাইফেলস, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের লোকেরা ১২ই মে হইতে টহল দিয়া বেড়াইতেছিল। তাহা ছাড়া ১৭ই, ১৮ই মে হইতে ১৪৪ ধারা ও পুলিশ আইনের ৩০ ধারা শহরে জারী করা হয় এবং ‘গণ-সংগ্রাম’ পরিষদের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন হিন্দু-মুসলমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ভাষা আন্দোলন দমনের জন্য সরকার সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ করিতে কীরূপ বদ্ধ পরিকর ছিলেন তাহা পরিষ্কার বুঝা যায় জেলার বিভিন্ন অফিসারের নিকট এবং সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিস ফোর্সের দ্বিতীয় অফিসারের নিকট প্রেরিত পুলিস সুপারের গোপন সার্কুলার (মেমো নং ৪১২৩৩-৭০। সি তাং শিলচর ১৭/৫/৬১ইং)। ঐ সার্কুলারে শিলচর রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে কাঁদুনে গ্যাস ও অন্যান্য সরঞ্জামসহ সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপক ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়।

১৯শে মে ভোর ৪টার পূর্ব হইতে সত্যাগ্রহীরা রেলস্টেশনে রেল গাড়ি চলাচল বিকাল ৪টা পর্যন্ত বন্ধ রাখার জন্য রেললাইনের উপর বসিয়া পড়ে। সকাল ৫-৪০ মি: প্রথম ট্রেন ছাড়ার কথা। গাড়ি প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করানো ছিল এবং ইঞ্জিন ছিল কিছু দূরে পশ্চিমে জল ভরার জায়গায়।

রেলস্টেশনে সৈন্যবাহিনীর দাপট

সত্যাগ্রহীদের অবস্থান ধর্মঘটের অব্যবহিত পরেই সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্স এবং মাদ্রাজ রেজিমেন্টের লোকেরা স্টেশন প্ল্যাটফর্ম ও সেন্ট্রাল ইয়ার্ডের উত্তর প্রান্তে ‘পজিশন’ নিয়া দাঁড়াইয়া পড়ে। স্টেশনের প্রবেশ পথের বাহিরে মোতায়েন হয় আসাম রাইফেলসের লোকেরা। সকাল ৬টা নাগাদ পুলিস সুপার ও জনৈক ম্যাজিস্ট্রেট স্টেশন প্ল্যাটফর্মে আসেন এবং পুলিস সুপার শ্রীবীরেশচন্দ্র মিশ্রকে (বেসরকারি তদন্ত কমিশনের এক নম্বর সাক্ষী) জিজ্ঞাসা করেন, গ্রেপ্তার করা হইলে সত্যাগ্রহীরা কি বাধা দিবে? শ্রীমিশ্র নেতিবাচক উত্তর দিয়া বলেন, সত্যাগ্রহীরা শান্তিপূর্ণভাবে গ্রেপ্তার বরণ করিতে প্রস্তুত।

অতর্কিত আক্রমণ

কিন্তু সত্যাগ্রহীদের গ্রেপ্তার করার বদলে সশস্ত্র বাহিনীর একদল লোক হঠাৎ মহিলা ও বালিকাসহ সত্যাগ্রহীদলের উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে এবং টানিয়া হাঁচড়াইয়া তাহাদের রেললাইন হইতে সরাইয়া আনার ব্যর্থ চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পরেই ৬-২০ মিনিট নাগাদ ছোট মেয়ে, মধ্যবয়স্কা মহিলা ও অন্যান্য সত্যাগ্রহীর উপর বেদম লাঠি চার্জ শুরু হয়। কিন্তু ওই লাঠি চার্জে আহত হওয়া সত্ত্বেও সত্যাগ্রহীদের সরাইতে অক্ষম হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে কাঁদুনে গ্যাস ফাটানো হয়। তৎসত্ত্বেও বহু সত্যাগ্রহী শান্তিপূর্ণভাবে বসিয়া থাকে। কাঁদুনে গ্যাসের যন্ত্রণায় যাহারা স্থান ত্যাগ করে তাহাদের জায়গায় আসে নতুন আর একদল সত্যাগ্রহী। আবার নির্মমভাবে বর্বর লাঠিচালনা শুরু হয়। সাত বছরের মেয়ে, সপ্তদর্শী তরুণী, চব্বিশ বছরের যুবতী, চল্লিশ বছরের প্রৌঢ় কেহই ওই অত্যাচার হইতে বাদ যায় না। পদাঘাতে বুটের ঘায়ে লাঠির আঘাতে সত্যাগ্রহী দলকে জর্জরিত করা হয়। তলপেটে পদাঘাত খাইয়া অনেক মহিলা সত্যাগ্রহী সংজ্ঞা হারান। তাঁহাদের মধ্যে আছেন সীতা দে, গৌরী বিশ্বাস প্রভৃতি। এই নির্মম অত্যাচারে আহত কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করিতে হয় এবং কয়েকজনকে ঘটনাস্থলে রেডক্রশ মারফত প্রাথমিক শুশ্রূষার ব্যবস্থা করা হয়।

এই বর্বর অভিযান চালনার সময় ডি আই জি ও কাছাড়ের ডেপুটি কমিশনার রেলস্টেশনে আসেন। সত্যাগ্রহীরা তখনও অবিচলিতভাবে বসিয়া থাকে। স্টেশন ফটক সশস্ত্র বাহিনী দিয়া ঘেরাও করা হয়। এত অত্যাচার সত্ত্বেও সত্যাগ্রহীরা অনড় থাকায় ডি আই জি সত্যাগ্রহীনেতাদের নিকট প্রস্তাব করেন, চারজনের এক-একটি দলে সকল সত্যাগ্রহীকে অতঃপর গ্রেপ্তার করা হইবে। ৭-৩০ মিনিট নাগাদ গ্রেপ্তারবরণ শুরু হয়। কিন্তু তাহাদের অনেককে জেলে না পাঠাইয়া শহর হইতে দূর দূর স্থানে লইয়া রাখিয়া আসা হয়, অবস্থা তখন মোটামুটি শান্ত। বেলা ১২টার পর হইতে পুলিস আর গ্রেপ্তার করাও বন্ধ রাখে এবং সত্যাগ্রহীরা সশস্ত্র বাহনীর সঙ্গে গল্পগুজব শুরু করে, এমনকি জনসাধারণ ও রেডক্রশ কতৃক সত্যাগ্রহীদের নিকট বিতরিত কলা, বাদাম, লজেন্স প্রভৃতি পুলিশকেও সত্যাগ্রহীরা দেয়। পুলিশও ওই উপহার গ্রহণ করিয়া সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে গল্পগুজব চালায়। ওই অবস্থায় সত্যাগ্রহীরা মনে করে, তাহাদের হরতাল সফল হইতে চলিয়াছে … কারণ নির্দিষ্ট সময় বেলা ৪টার মধ্যে আর কোনো ট্রেন চলাচলের সম্ভাবনা নাই। অনেকে তখন অপেক্ষমান ট্রেনের কামরায় উঠিয়া পড়ে এবং নিকটবর্তী জলের ট্যাঙ্কের উপর উঠিয়া বসিয়া যায়।

হঠাৎ গুলী

বেলা ২টা নাগাদ আবার অশান্তির আভাস। নিকটবর্তী বড় রাস্তা হইতে চীৎকার আসে যে, শিলচরের বাহির হইতে আগত ধৃত সত্যাগ্রহী বোঝাই এক ট্রাকে আগুন লাগিয়াছে। কাদা, বালি ইত্যাদির সাহায্যে সত্যাগ্রহীদের চেষ্টায় ওই আগুন ক্ষণকালের মধ্যেই নিভিয়া যায়। কিন্তু ঐ সদর রাস্তার উপর শান্তিপূর্ণভাবে দন্ডায়মান একদল সত্যাগ্রহীর উপর পুলিস হঠাৎ বেপরোয়া লাঠিচালনা শুরু করে। এই আঘাত এত অতর্কিত হয় যে, অনেকে এখানে-সেখানে ছোটাছুটি শুরু করে এবং কেউ কেউ রেললাইনে অবস্থানরত সত্যাগ্রহীদের নিকট চলিয়া আসে। কিয়ৎকাল পরেই শোনা যায়, গুলীচালনার আওয়াজ। অনেকে মনে করেন উহা বোধ হয় ফাঁকা আওয়াজ। কারণ হঠাৎ অকারণে কেন গুলীচালনা করা হইবে, তাহা কেহই বুঝিতে পারে না। কিন্তু এদিকে দেখা যায়, আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বিশেষে সত্যাগ্রহী দল গুলীর আঘাতে একে একে ধরাশায়ী হইতেছেন। প্ল্যাটফর্মের পশ্চিম প্রান্ত হইতে প্রথমে গুলীচালনা শুরু হয়। সশস্ত্র বাহিনী তৎপর রাইফেল হাতে সত্যাগ্রহীদের দিকে ছুটিতে থাকে এবং কেউ কেউ নিকট হইতে গুলী খাইয়া লুটাইয়া পড়েন। ইয়ার্ডের উত্তর প্রান্ত হইতেও গুলীচালনা শুরু হয়। এই মর্মান্তিক গুলীচালনা পাঁচ হইতে সাত মিনিট কাল চলে। ঠিক কত রাউণ্ড গুলী হয়, তাহা সঠিক না জানিতে পারিলেও মনে হয় ওই সংখ্যা যথেষ্ট। তাহাছাড়া গুলীচালনা ‘ক্রস-ফায়ার’ এবং ‘কভার-ফায়ার’। উভয় প্রকারেই হয়। সত্যাগ্রহী ছাড়া অন্যান্য লোকের উপরও বেপরোয়া গুলি চলে। উহা যে উদ্দেশে প্রণোদিত এবং মানুষ মারার জন্যই বর্ষিত হয় তাহা বুঝা গিয়াছে। কোনো স্থানই নিরাপদ ছিল না। বুলেট দক্ষিণে রেল কোয়ার্টারের গায়ে আঘাত করে। এমনকি একজন সত্যাগ্রহী এক রেল কোয়ার্টারে আশ্রয় লইতে গিয়া গুলীর আঘাতে মারা যান। ১৬ ফুট উঁচু ইস্পাতে তৈরি জলাধারটি ছিল বিশেষ লক্ষ্য স্থল। ওই জলাধারের একটি রেলিঙে উপবিষ্ট একজন গুলীবিদ্ধ হইয়া মারা যান।

গুলীর পরেই আবার লাঠি

এই নর-মৃগয়ার শিকার হইয়া প্রাণ হারান কমলা ভট্টাচার্য, তরণী দেবনাথ, চন্ডীচরণ সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দাস, কানাইলাল নিয়োগী, শচীন্দ্র পাল, সুনীল সরকার, হিতেশ বিশ্বাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর, তাহাছাড়া আরও শতাধিক আহত হন। মৃত বা আহত কাহাকেই পুলিশ সরায় নাই। সত্যাগ্রহী নিজেরা এবং জনসাধারণের কয়েকজন তাহাদের নিকটবর্তী সাময়িক রেডক্রশ কেন্দ্রে লইয়া যান এবং পরে হাসপাতালে প্রেরণের ব্যবস্থা হয়। গুলীচালনার পরেই আবার লাঠিচালনা শুরু হয়। রেল পুকুর বরাবর লোককে খেদাইয়া লইয়া যাওয়া হয়। অনেকে বেদম মার খাইয়া পুকুরের জলে ঝাঁপাইয়া পড়েন। এই লাঠিচালনায় গুরুতর আহত হন সত্যেন্দ্র দেব। … ২১ শে মে ভোরে ওই পুকুরে তাহার মৃতদেহ ভাসিয়া উঠে।

ওই বিভীষকরা রাজত্বের সময়ে এবং পরে তখনও বহু সত্যাগ্রহী শহীদের রক্তে লাল রেললাইনের উপর বসিয়া থাকেন।

সরকারী ভাষ্য

কমিশন ১৯শে মে তারিখের ঘটনা সম্পর্কে পৃথক তিনটি ভাষ্যের বিশ্লেষণ করিয়া রিপোর্টে বলেন, এই ব্যাপারে ১৯শে মে গৌহাটি হইতে একটি সরকারী প্রেসনোট বাহির করা হয়। ২০শে মে কাছাড়ের ডি সি আর একটি প্রেস হ্যাণ্ড অডিট দেন এবং ২১শে মে শিলচরের কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের উপস্থিতিতে ডি আই জি অব পুলিশ এক বিবৃতি দেন। তৃতীয় ভাষ্য বিভিন্ন সংবাদপত্রে বাহির হইয়াছে এবং ডি আই জি এখন পর্যন্ত উহার প্রতিবাদ করেন নাই।

কমিশন বলেন, ঐ তিনটি বিবৃতিই পরস্পরবিরোধী এবং তজ্জন্যই কমিশন উহার উপর আস্থা রাখিতে পারেন না। তাহা ছাড়া সকালের ঘটনায় একটি রাইফেল ছিনাইয়া লওয়া হইয়াছিল বলিয়া যে অভিযোগ আনা হইয়াছে, তাহাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কোনো সাক্ষীই কমিশনের নিকট তাহা বলেন নাই এবং সত্যাগ্রহী নিপীড়নে সদাব্যস্ত জবরদস্ত সিপাহির হাত হইতে রাইফেল কাড়িয়া লওয়া অসম্ভব ব্যাপার। কনস্টেবলদের মারপিট করার ঘটনা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ গণসংগ্রাম পরিষদের আবেদন অনুযায়ী সত্যাগ্রহীরা বরাবর অহিংস ছিল।

কমিশন রিপোর্টে আরও বলেন, ট্রাকের ঘটনাও কৌতূহলোদ্দীপক। সকাল হইতেই বহু ট্রাক ঐ সদর রাস্তা দিয়া ধৃত সত্যাগ্রহী লইয়া যাতায়াত করিতেছিল। পূর্বে ওইরূপ কোনো ঘটনাই হয় নাই। হরতাল সাফল্যজনকভাবে শেষ হওয়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে এইভাবে সত্যাগ্রহীদের পক্ষে ট্রাকে আগুন লাগানো বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাহা ছাড়া দমকল বাহিনীর লোক আসার আগেই সত্যাগ্রহী ও জনসাধারণ ট্রাকের আগুন নিভাইয়া ফেলে। উপরন্তু কয়েকজন সাক্ষীর অভিযোগ যে, ঐ আগুন লাগায় উস্কানিদাতারা। শিলচর থানায় রাখা সংশ্লিষ্ট ট্রাকটির ক্ষতি অল্পই। কমিশনের মতে ওই আগুন লাগানোর জন্য সত্যাগ্রহী বা জনসাধারণ কেহই দায়ী নয়।

গুলীর হুকুম কে দিল?

গুলীচালনায় হুকুম কে দিল এই সম্পর্কে কমিশন বলেন, বিভিন্ন সরকারী ভাষ্যে এই প্রশ্নে পরস্পর বিরোধিতা আছে। ২০শে মে বিভাগীয় কমিশনার ২নং সাক্ষীর (মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যান শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থ) এক প্রশ্নের উত্তরে সোজাসুজি বলেন, জনৈক অসমিয়া ম্যাজিস্ট্রেট ঐ হুকুম দিয়াছেন। কমিশনার ও ডি আই জি ঐ উক্তিতে তখন কোনো প্রতিবাদ জানান নাই। কিন্তু ২১শে মে তারিখে ডি আই জি ঐ গুলীচালনার হুকুম দানের দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে লন।

অতঃপর ২নং সাক্ষী কমিশনারকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘গুলী চালনার হুকুমদান সম্পর্কে পূর্ব দিন আপনি আমার নিকট যে উক্তি করেন, তাহার কি হইল?’’—কমিশনার তখন কোনো উত্তর দেন না।

কমিশন ইহাও উল্লেখ করেন যে, ১১নং সাক্ষীর (ধীরেন্দ্রকুমার চক্রবর্তী) বক্তব্য অনুসারে উপরিউক্ত অসমিয়া ম্যাজিস্ট্রেট ৩০শে মে প্রকাশ্য আদালতে এক বিবৃতি দিয়া বলিয়াছেন যে, তিনি (ওই অসমিয়া ম্যাজিস্ট্রেট) গুলীচালনার হুকুম দেন নাই;—যদিও তাঁহাকে হুকুমদানের জন্য অনুরোধ করা হইয়াছিল।

কমিশন বলেন, ডি আই জি বা কমিশনারের বা ওই অসমিয়া ম্যাজিস্ট্রেটের সাক্ষ্য গ্রহণ করিতে না পারায় তাঁহাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে, সঠিক কে গুলীচালনার হুকুম দিয়াছিলেন তবে ওই হুকুম যে অন্যায় হইয়াছিল যে বিষয়ে কমিশন একমত।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়:

ভাষা আন্দোলন দমন করিতে গিয়া আসাম সরকার করিমগঞ্জের অহিংস সত্যাগ্রহী দলের উপর কীরূপ নৃশংস অত্যাচার করিয়াছেন এবং নারীদের বস্ত্র ছিনাইয়া লইয়া ও পদাঘাত করিয়া কীভাবে জিঘাংসা বৃত্তি চরিতার্থ করিয়াছেন। তাহার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় শ্রীনির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গঠিত বেসরকারি তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে।

ঐ কমিশন গত ২রা জুন করিমগঞ্জে ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন এবং দেখিতে পাইয়াছেন, গত ১৯শে মে হরতালের দিন সরকার তথায় সত্যাগ্রহীদের বেদম পিটাইয়া সন্ত্রাসের সৃষ্টি করেন।

ঐ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, কমিশনের নিকট উপস্থিত ১নং সাক্ষী শ্রীময়না মিঞা চৌধুরীকে লাঠি দিয়া এমন প্রহার করা হয় যে, তাঁহার বাম চোখ, চিবুক, বাম কনুই, বাম হাঁটু, বাম পা ক্ষতবিক্ষত হইয়া গিয়াছে।

বস্ত্রহরণ

দুই নং সাক্ষী শ্রীমতী কমলারানী দাসকে শুধু প্রহার করা হয় নাই, পুলিস তাঁহার শাড়ি পর্যন্ত খুলিয়া লইয়া যায়। প্রহারের ঘায়ে জর্জরিত ও ধরাশায়ী শ্রীমতী দাসকে অন্য একজন সত্যাগ্রহী শাড়ি আনিয়া দিলে তিনি উঠিবার চেষ্টা করেন; কিন্তু তখনই তাহার দেহের নিম্নভাগে এবং তলপেটে পুলিশ পাশবিক উল্লাসে আবার এত প্রহার শুরু করে যে, শ্রীমতী দাস সংজ্ঞা হারান। তিনি হাসপাতালে ছিলেন প্রায় ছয় দিন।

তিন নম্বর সাক্ষী শ্রীমতী আশারানী দত্তের অবস্থাও প্রায় অনুরূপ। করিমগঞ্জ রেলস্টেশনের নিকট তাঁহার তলপেটে লাঠির আঘাত হানা হয় এবং তিনি সংজ্ঞা হারাইয়া কিছুদিন হাসপাতালে কাটান। শ্রীমতী দত্ত যখন কমিশনের নিকট সাক্ষ্য দিতে উপস্থিত হন, তখনও তাঁহার অবস্থা স্বাভাবিক হয় নাই, অত্যাচারের যন্ত্রণায় পা টলিতেছিল।

চার নম্বর সাক্ষীর নাম শ্রীমতী শেফালি চক্রবর্তী। বয়স ১৮। ১৯। পুলিশ এক্ষেত্রেও শাড়ি ছিনাইয়া লয় এবং শ্রীমতী চক্রবর্তী তলপেটে পদাঘাত খাইয়া নিকটবর্তী এক খালে অজ্ঞান অবস্থায় গড়াইয়া পড়েন। অন্যান্য সত্যাগ্রহী দৈবক্রমে দেখিতে পাইয়া তাঁহাকে তুলিয়া না আনিলে তিনি হয়ত এইভাবেই মারা যাইতেন।

পাঁচ নম্বর সাক্ষী শ্রীসুখবিন্দু সেনগুপ্তের বয়স সাতান্ন। তিনি সত্যাগ্রহী ছিলেন না, এক বন্ধুকে দেখিতে রেলকোয়ার্টারে গিয়াছিলেন। দুইজন পুলিশ তাঁহাকে সমানতালে এত আঘাত করে যে, তাঁহার বাম হাত ভাঙিয়া গিয়াছে। শুধু তাহাই নয়, শ্রীসেনগুপ্তের পকেট হইতে ২৫ টাকা ৫০ নয়া পয়সা এবং সিনেমা অপারেটারের লাইসেন্স পুলিস কাড়িয়া নিয়াছে।

শ্রীমান বাবুলকুমার রায়ের বয়স মাত্র আট। সে কমিশনের ৬নং সাক্ষী। ওই দিন রেললাইনের নিকটে দাঁড়াইবা মাত্র পুলিস রাইফেলের বাট দিয়া তাহার মাথায় প্রচন্ড আঘাত করে। কয়েক ঘণ্টা পর সে সংজ্ঞা ফিরিয়া পায় হাসপাতালে।

শ্রীভারতী চক্রবর্তী, শ্রীমতী প্রীতি দস্তিদার ও শ্রীসিপ্রা চক্রবর্তীরও (যথাক্রমে ৭নং, ৮নং ৯নং সাক্ষী) মাথায় ও তলপেটে আঘাত হানা হয়।

দশ নম্বর সাক্ষী এবং প্রত্যক্ষদর্শী শ্রীসন্তোষ মজুমদার কমিশনকে বলেন যে, অহিংস সত্যাগ্রহীদলের উপর ঐরূপ নির্মম অত্যাচার উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও জনৈক ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীমজুমদার জানান, নারীদের উপর জঘন্য অত্যাচারের প্রতিবাদ জানাইতে অগ্রসর হইলে তাঁহাকেও বেদম পেটানো হয়।

এগারো নম্বর সাক্ষী শ্রীমতী পুষ্পরানি কর্মকার পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু। তিনি পুনর্বাসিত হন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। গত জুলাই হাঙ্গামায় পুনর্বার উচ্ছেদ হইয়া তিনি করিমগঞ্জে আসেন। তাঁহাকে রেললাইনে এত প্রহার করা হয় যে, তিনি কমিশনের সম্মুখে যন্ত্রণায় ভালো করিয়া কথা পর্যন্ত বলিতে পারেন নাই।

গণসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি শ্রীআবদুর রহমান চৌধুরী (১২নং সাক্ষী) এবং পদত্যাগী প্রজা-সমাজতন্ত্রী বিধানসভা সদস্য শ্রীবিশ্বনাথ উপাধ্যায়ও কমিশনের নিকট পুলিসী বর্বরতার বিশদ বিবরণ দেন।

দুই বছরের শিশুকে পুকুরে নিক্ষেপ

কমিশনের সদস্যগণ রেল কোয়ার্টারগুলিও পরিদর্শন করেন এবং দেখিতে পান, বহু বাড়ির আসবাবপত্র, দরজা-জানালা, রেডিয়ো লাঠির আঘাতে ভাঙিয়া চুরমার করিয়া দেওয়া হইয়াছে। কমিশন রিপোর্টে উল্লেখ করেন, রেল কর্মীগণ সত্যাগ্রহী না হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাঙালি হওয়ার অপরাধে তাহাদের উপর এত অত্যাচার করা হয়। ওই সকল বাড়ির লোকদের নারী-পুরুষনির্বিশেষে পেটানো হয় এবং এমনকি ৮০ বছরের এক বুড়ির গায়েও লাঠির আঘাত আছে। শুধু তাহাই নয়, দুই বছরের এক ছোটো ছেলেকে নিকটবর্তী এক পুকুরে পুলিস ছুড়িয়া ফেলিয়া দেয়।

জেল পরিদর্শন

কমিশন করিমগঞ্জের জেল পরিদর্শন করেন এবং শ্রীবিধুভূষণ চৌধুরী, নরেন্দ্রকুমার সিংহ, গোপেশচন্দ্র নমঃশূদ্র (পদত্যাগী এম এল এ), যজ্ঞেশ্বর দাস, মৃণালকান্তি দাশগুপ্ত প্রভৃতির সঙ্গে দেখা করেন। কমিশন দেখিতে পান যে, জেলে মাত্র ৮৪ জনের স্থান সংকুলানের ব্যবস্থা থাকিলেও ১৯ মে ১৮৪ জনকে ঢুকাইয়া দেওয়া হয় এবং শেষপর্যন্ত ওই সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৮। শুধু স্থানাভাব নয়, সকল সত্যাগ্রহী বন্দীর খাওয়া-দাওয়ার কোনো ব্যবস্থাও প্রথম তিন দিন করা যায় নাই।

কমিশন রিপোর্টে উল্লেখ করেন, জেলাবাসীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য সরকার মুসলমান বা মণিপুরি সত্যাগ্রহীদের ইচ্ছাকৃতভাবে ছাড়িয়া দিয়াছেন। ধৃত সত্যাগ্রহীদের মধ্যে ৭০ জনের বয়স বারোর নীচে এবং দুইজনের বয়স আশির উপরে।

কমিশন তাঁদের রিপোর্টের উপসংহারে জানালেন:

1. The evidence placed before us has satisfied us that the movement launched by the people of Cachar was peaceful and they adhered strictly to the principle of non-violence inspite of grave provocations. The Satyagrahis conducted themselves with restraint and they were moved by a spirit of dedication to the cause and the general public also responded magnanimously to the call to act with restraint and discipline and excepting one or two occasions of sporadic pelting of brick-bats of very short duration when the armed force or the Police had been assaulting women Satyagrahis with extreme brutality, the public throughout the District had behaved with commendable restraint. There was, during the movement, no disturbance of the public peace caused either by the Satyagrahis or the people of Cachar which could necessitate or justify methods of violence or coercion adopted by the Government of Assam or its Agencies at Cachar. Threat to public peace, on the contrary, was caused and attempted to be caused by the uncalled-for demonstration of the armed might of the Government, by constant route marches by the army and armed police and an atmosphere of impending violence created by the authorities at Cachar. We are convinced that the Government of Assam and its agencies at Cachar intended to terrorise and overawe the people of Cachar by bringing in or reinforcing the army and the Central Reserve Police Force and the Assam Rifles and the armed police and by demonstrating this power of effective destruction. The demonstration of the armed might of the Government, however, had just the reverse effect on the morale of the people and they became more determined to resort to peaceful Satyagraha in assertion of their legitimate demand for recognition of Bengali language as one of the State languages of Assam and for the recognition of the languages of other linguistic groups. On the evidence placed we are satisfied that the movement in Cachar has not been motivated by parochial considerations but by the ideal of fighting for the existence and survival of all the racial and ethnic groups inhabiting the State of Assam and the leading people of Cachar asserted before the Commission that the basic approach of the sponsors of the movement should be appreciated properly and fully to evaluate the magnitude and intensity of the popular upsurge in Cachar.

2. On evidence we have come to this unhesitating conclusion that the requisitioning of the army long before the movement was launched was uncalled for and was neither warranted by the exigencies of the situation nor by the requirements of law.

3. The demand for recognition of the language of a substantial section of the people of a State as a State language is a legitimate demand and so long the demand is expressed by non-violent and peaceful methods no Government established by law has any right to repress that demand by violent means. The people of Cachar having not resorted to methods of violence either by destruction of property or use of criminal force on persons, the Government of Assam had and could have no justification to use force to repress or suppress the movement. If there was any violation of law by reason of disobedience of orders promulgated under Section 144 of the Criminal Procedure Code, law has provided the procedure for penalising the offenders. If an unlawful assembly was required to be dispersed, the law of the country has provided the machinery and procedure for that purpose and it appeared to us that the local authorities who were responsible for opening fire on peaceful Satyagrahis at Silchar and directing lathi charge and concentrated tear gassing at Silchar and Karimganj, rode roughshod over the procedure prescribed in the Code of Criminal Procedure or in the Police Acts and Regulations. Military and armed force can be requisitioned by the Magistrate of the highest rank present to disperse an unlawful assembly only when public security is manifestly endangered, and the law enjoins that any armed personnel on commission shall use as little force and do as little injury to person and Property as may be consistent with dispersing the assembly and arresting such persons.

4. On the evidence placed before us and on inspection of the places where firing had been resorted to we are satisfied that all this police action including the firing was unnecessary and unjustified. We were satisfied that the killing of eleven persons at Silchar by firing and injuring a large number of persons by bullets and lathis and maiming and injuring large number of unarmed Satyagrahis and innocent, members of the public including inmates of houses near about the places of occurance at Karimganj and other places of Cachar by brutal lathi charges, kicks and blows on vital parts of the bodies of men, women and children; molesting women and throwing away a child in a tank and beating to death man who had jumped into tank near the railway station at Silchar to save his life were not justified.

5. The Police Manual in this country strictly regulates under what circumstances armed police or the army can be called out and used and provides that recourse to use of firearms can be had only in the last resort when it becomes absolutely necessary for the defence of life or property. The evidence satisfied us that no such emergency or contingency had arisen, there was no danger to public security or loss of life or property for the protection of which the extreme measure of opening fire on unarmed assembly of persons had to be resorted to.

6. On the evidence we were further satisfied that there was cross firing at Silchar Railway Station by two sections of the armed Police Force who had taken positions on the Railway station platform and on the Railway track and the firing was indiscriminate, reckless, brutal and absolutely without any semblance of justification. There was no danger or loss of life of the Police personnel or other public officers present at the Railway station nor any damage to any public property. There was in our considered decision no immediate cause for ordering fire upon the peaceful Satyagrahis, who were squatting on the railway tracks, or on the members of the public who were watching the Satyagraha.

7. We found on local inspection at Silchar marks of firing penetrating walls and fences of houses at distant and different places and at high altitudes and low levels. We also got evidence of persons being killed inside rooms and verandahs of houses or while perched on a water reservour 16 feet high. We also found bullets collected from houses at considerable distance from the Railway platform. We also examined the injury reports of these who were killed and injured and found that almost each of the victims was shot above the waist line and stuck on vital parts of the body and it appeared that they were shot at to be killed. Injuries were also found on the back of several persons which indicate that the victims were either running away or at any event not offering resistance.

8. We also got evidence that there was no resistance to arrest. On the contrary the Satyagrahis were offering themselves to be arrested and hence no use of force was necessary to secure the arrest of the Satyagrahis or for their dispersal.

9. We got evidence that women, old or young were not spared and even boys and girls of tender age were brutally assaulted and teargassed at Silchar and Karimganj. Clothes of women were snatched away and some of them were kicked at and lathi charged.

10. We got evidence that a child was thrown into a tank by members of the Police who ran wild and assaulted every one they could lay their hands on. They raided homes adjoining the Railway station of Karimganj, assaulted inmates and damaged and destroyed furnitures and other articles indiscriminately.

11. We got evidence that at least one Magistrate was at the Railway station at Silchar, when the armed police opened fire but his sanction or order or permission, so far we could gather, was not obtained. We have persued the statement made by the Deputy Inspector General of Police, Cachar, before the leading citizens of Silchar and the two Press statements issued by the Government of Assam and also the Press Report of the purported statement of Sri B. Sen, Commissioner (Plains) and we were surprised to note the glaring and irreconcilable inconsistencies in the various statements. An analysis of the said statements discloses a deplorable attempt to disown responsibilities and cover up misdeeds committed by highly placed officials of the Government. Inspite of shifting of position and attempts to prop up a defence in justification of firing on an unarmed crowd— even from the various official versions we have come to the unhesitating conclusion that the firing resorted to in the afternoon of the 19th May at Silchar railway yard was uncalled for and unjustified.

12. We are satisfied on evidence that there was no question of the armed police force acting in self-defence or in defence of property justifying any shooting or killing, and there was no question of the Officer giving order or the members of the force who actually killed acting in good faith.

13. We are also satisfied that the manner in which the Assam Rifles or the Police Force deployed for the purpose lathi-charged or teargassed unarmed and peaceful Satyagrahis at various places in Cachar were much in excess of the limits prescribed by law and there was no justification for the user of such force to disperse peaceful Satyagrahis.

14. We are also satisfied on the evidence that the attack on persons other than Satyagrahis by trespassing into private houses at Karimganj and damage to properties caused by the police and members of the Assam Rifles at Karimganj were unjustified and the offenders should be brought to book by the Government of Assam by placing them on trial. Although there was no firing at Karimganj, we feel it our duty to record that the lathi charge, teargassing and assault on men and women, specially young girls, was more brutal there than at other places.

15. We have noted with satisfaction that inspire of the acts of extreme provocation and violence committed by those whose duty was to maintain peace, law and order, the people of Cachar remained peaceful and did not allow their spirit to be cowed down by exhibition of brute force.

16. We have arrived at this unhesitating conclusion on a close scrutiny of the happenings at Cachar in the context of the Assamisation move on the part of a section of the people of Assam that the manner in which the Government of Assam has tried to repress the popular upsurge in Cachar for recognition of their language amounted to not only a violation of the fundamental rights of the linguistic minority in Assam but there has been a violation of human rights.

17. In all modern societies, the Executive is necessarily entrusted with wide powers in the application of the laws, but where the Executive has a power as distinguished from a duty under the law, the exercise of the power must be within whatever limits the law prescribes. We are of the opinion that the Executive authorities in Cachar have transgressed the bounds of law in a manner and to such an extent that the officers and personnel concerned appear to have made themselves amenable to the disciplinary law of the country. We recommend to the Government of Assam to take appropriate action in the matter.

18. We are of opinion that adequate compensation should be given to the families of those who have died as the result of police firing and to those who have been disabled or grievously injured or incapacitated for some length of time.

19. In conclusion we desire to sound a note of warning in the language of John Locke—‘Just and moderate Governments are everywhere quite, everywhere safe, but oppression raises ferments and makes men struggle to cast off an uneasy and tyrannical yoke….There is only one thing which gathers people into seditious commotions and that is oppression’. Expression of one’s self in his own language is one of the basic human right. Denial of that right and deprivation of that basic right by oppressive methods can never ensure to the benefit either of Assam or of India as a whole.

Sd/- N. C. ChatterjeeChairman

Sd/- Ranadeb Chaudhuri

Sd/- Ajit Kumar Dutta

Sd/-S. K. Acharrya

Sd/-Siddhartha Ray

তথ্য নির্দেশ

১. স্বাধীনতা, কলকাতা, জুন ১৩, ১৯৬১

২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, জুন ১২, ১৯৬১

৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, জুন ১৩, ১৯৬১

৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, জুন ১৫, ১৯৬১

৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, জুন ১৬, ১৯৬১

৬. Report of Non-official Enquiry Commission on Cochar, A. K. Das Memorial Trust, PP 30-35, (তারিখ উল্লেখ নেই)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *