শেষ দৃশ্য
[মঞ্চে নকিব দাঁড়িয়ে আছে একা। তার মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। হাতে একটি চোঙ। সে চোঙ মুখে নিয়ে কিছু বলতে যাবে- তখন দেখা যাবে জ্ঞানবৃদ্ধ এসে ঢুকছে। তার হাতে প্লাকার্ড লেখা বসন্ত উৎসব, আনন্দ করুন।]
বৃদ্ধ : নকিব সাব, সেলাম। ভাল আছেন?
[নকিব কোন কথা বলবে না]
আমারে চিনছেন তো? আমার নাম ওসমান। আমি খুব জ্ঞানী লোক। এই দেখেন, রাজা সাব আমারে উপাধি দিয়েছে। আমি খুব জ্ঞানের কথা জানি। হে-হে-হে।
নকিব : জানেন ভাল কথা, এখন যান কোথায়?
বৃদ্ধ : দেশ দেশান্তরে। জ্ঞানের কথা কইব। বসন্ত উৎসবের কথা কইব।
নকিব : ভাল কথা। ..
বৃদ্ধ : মহারাজার কথাও কইব। মহারাজার কথা বলতে বড় ভাল লাগে।
নকিব : সময়টা কিন্তু ভাল না বুড়া মিয়া। কারো ঘরে ভাত নাই। পুলাপান কান্দে। বুড়াবুড়ি কান্দে। আর জোয়ানগুলি কেমুন-কেমুন কইরা চায়। লক্ষণ কিন্তু ভাল না বুড়া মিয়া। সময়টা খারাপ। বড় খারাপ। কানে কিছু শুনেন না?
বৃদ্ধ : বয়স হইছে, কানে ভাল শুনি না।
নকিব : কিছু দেখেন না?
বৃদ্ধ : বয়স হইছে, চউক্ষে ভাল দেখি না।
[দেখা যাবে দুটি লোক খাটিয়া নিয়ে যাচ্ছে।]
নকিব : কে যায়?
লোক দুটি : খাটিয়াতে হেতমপুরের খবিরুদ্দি যায়।
নকিব : বিষয় কি?
লোক দুটি : টুপিওয়ালা ভাই, বিষয়ডা রাজা সাবের কাছে বলতে চাই।
নকিব : রাজা সাব রাজধানীতে নাই।
লোক দুটি : রাজা সাব রাজাধানীতে নাই। রাজা সাব রাজাধানীতে নাই।
[হাসতে হাসতে তারা এগুবে। বুড়া চোঙ নিয়ে হঠাৎ বলবে।]
বৃদ্ধ : ভাই, ও আমার বন্ধু। আমার কথা শুনেন আমি জ্ঞানীলোক, বসন্ত উৎসবের কাথাডা বলি– আইজ সন্ধ্যা…। [হঠাৎ বৃদ্ধকে নকিব অবাক করে দিয়ে লাথি বসিয়ে দেবে।]
লাথি দিলেন ক্যান?
নকিব : জানি না কেন।
বৃদ্ধ : আমি রাজা সাবের আপনার লোক, আমারে লাথি দিলেন ক্যান?
নকিব : পায়ের মইধ্যে চুলকায়।
রাজা সাবের আপনার লোকরে লাথি দিবার মন চায়।
[বৃদ্ধ ভয়ে অনেকটা দূরে সরে যাবে এবং দ্রুত মঞ্চ ছেড়ে যাবে। নকিব হেসে উঠবে। রাজা ঢুকবেন, সঙ্গে রাণী।]
রাজা : কে হাসছিল? অমন বিকট স্বরে কে হাসছিল?
নকিব : হুজুর আমি।
রাজা : কেন হাসছিলে?
নকিব : আনন্দ করছিলাম হুজুর। আপনি সবাইকে আনন্দ করতে বলেছেন।
রাণী : না, না, আনন্দ নয়। এটা আনন্দের সময় নয়।
রাজা : আহ! কি বলছ তুমি! নিশ্চয় এটা আনন্দের সময়। উৎসবে আনন্দ করবে না তো কখন করবে? তুমি হাসো। শব্দ করে হাসো। আমিও হাসব তোমার সঙ্গে। হাসো, হাসো।
[রাজা উচ্চস্বরে হাসতে গিয়েও থেমে যাবেন। দেখা যাবে বৃদ্ধ মঞ্চে ঢুকছে। তার গলায় কোন পদক নেই, ছেঁড়া জুতা ঝুলছে। খালি গা।]
রাজা : তোমার এই অবস্থা করল কে?
বৃদ্ধ : সময়টা খারাপ রাজা সাব।
রাজা : ওর স্পর্ধা তো কম নয়, বলে সময় খারাপ। লাথি দিয়ে ওকে বের করে দাও।
বৃদ্ধ : হুজুর বহুত লোকজন আসতাছে। বড় ভয় লাগতাছে হুজুর।
রাজা : [ক্ষিপ্ত] এই অপদার্থ ভীরুকে এক্ষুনি…।
[বৃদ্ধ পালাবে]
রাণী, তুমি এসো আমার সঙ্গে।
[রাজা রাণীর হাত ধরে চলে যাবেন। বৃদ্ধ আবার মঞ্চে ঢুকবে। ভাত দেন, কাপড় দেন, বলতে বলতে একটি দল এসে ঢুকবে। তাদের পুরোভাগে মজনু চোরা।]
নকিব : চুপ! [সবাই থেমে যাবে। মজনুকে উদ্দেশ্য করে] তুমি এদের সঙ্গে?
মজনু : বাতাস উলটা বইতাছে নকিব সাব। আমি আছি বাতাসের সাথে। বলেন ভাই-ভাত দেন, কাপড় দেন, ভাত কাপড় দেন।
সবাইঃ ভাত দেন, কাপড় দেন। ভাত কাপড় দেন।
মজনু : আরো জোরে বলেন। গলায় শক্তি নাই?
সবাই : ভাত দেন কাপড় দেন। ভাত কাপড় দেন।
নকিব : মজনু!
মজনু : বলেন।
নকিব : রাজা সাব তার সৈন্য সামন্তরে বলেছে রাজধানী ঘিরে রাখতে। শুনেছেন?
মজনু : [ভীতস্বরে] জ্বে না।
নকিব : উৎসবের সময় যারা চেঁচামেচি করবে তাদের শহর থেকে বের করে দেবার হুকুম হয়েছে। শুনেছেন?
মজনু : [খুবই ভীত।] জ্বে না, শুনি নাই। [দলের অন্য জনের দিকে তাকিয়ে] এই তোমরা ভাগ। চিৎকার কইরা মাথা ধরাইয়া দিছে। ভাগ, ভাগ। আরে আবার চউখ ঘুরাইয়া চায়।
[সবাই চলে যাবে]
মজনু : আমি হইলাম গিয়া রাজা সাবের আপনার লোক। কি কন নকিব ভাই?
নকিব : পায়ের মইধ্যে চুলকায়
রাজা সাবের আপনার লোকরে লাথি দিবার মন চায়।
[লাথি বসাবে।]
মজনু : [অবাক! এগিয়ে যাবে বৃদ্ধের কাছে] বিষয়ডা কি কিছুই বুঝতেছি না। এই যে চাচা মিয়া।
বৃদ্ধ : পায়ের মইধ্যে চুলকায়
রাজা সাবের আপনার লোকরে লাথি দিবার মন চায়।
[সেও লাথি বসাবে। মজনু উল্টে পড়তে গিয়ে সামলিয়ে নিবে। দু’জনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দৌড়ে পালাবে। নিকিব ও বৃদ্ধ হেসে উঠবে।]
লাথি দিয়া পাওডার মইধ্যে আরাম পাইলাম, টুপিওয়ালা ভাই।
নকিব : খবরদার! টুপিওয়ালা বলবেন না।
[নকিব টুপি খুলে ফেলে দেবে এবং দু’জনেই হেসে উঠবে। দেখা যাবে অন্য পিঠ-বাঁকারা একে একে যাচ্ছে। ওদের হাতে প্লাকার্ড। সেখানে লেখা- “বসন্ত উৎসব। আনন্দ করুন।” ওদের দেখে নকিব হাসতে থাকবে।]
নকিব : তোমরা কোথায় যাও?
বাঁকাদের একজন : আনন্দ করতে যাই, উৎসব করতে চাই।
নকিব : মুখখান তো বড় শুকনা শুকনা লাগে।
বাকাঁদের একজন : যাইতে ভয় লাগে। মন চায় না। তবু যাইতে হয়।
সবাই : তবু যাইতে হয়। তবু যাইতে হয়।
[ওরা এগিয়ে যাবে। রাজার প্রবেশ]
রাজা : চারদিকে এমন নীরব কেন? আনন্দ কর। গান কর। হাসো। প্রাণ খুলে হাসো। আজ থেকে উৎসবের শুরু। আনন্দের শুরু। হাসো, সবাই হাসো।
[পিঠ-বাঁকারা ফিরে আসবে।]
গাও, গান গাও, হাসো। হাসো- হা-হা-হা সবাই হাসো আমার সঙ্গে।
[শোনা যাবে দূরাগত ধ্বনি–ভাত দেন, কাপড় দেন, ভাত কাপড় দেন।]
হাসো, সবাই হাসো। হাসো।
[দর্শকদের মাঝখান থেকে স্লোগান শোনা যাবে। এবং নকিব নিজেও স্লোগান দেবে।]
[রাজা পাগলের মত চারদিকে তাকাবেন। মঞ্চে সবাই উঠে আসছে।]