৮. নুহাশের রিপোর্টগুলি

০৮.

ডাক্তার সাহেব নুহাশের রিপোর্টগুলি একবার, দুবার, তিনবার উল্টে দেখলেন। একবার করে দেখেন আর তাঁর মুখ অন্ধকার হয়। তিনবার দেখার পর ডাক্তার সাহেবের চেহারাই পাল্টে গেল। তিনি কয়েকবার ঢোঁক গিললেন।

রেবেকা বলল, কি হয়েছে ডাক্তার সাহেব?

না-না, কিছু না।

 রিপোর্ট দেখলেন?

হুঁ হুঁ দেখলাম।

 সব ঠিকঠাক আছে তো?

ডাক্তার সাহেব আমতা আমতা করতে লাগলেন। রেবেকা বলল, কি হয়েছে আমাকে বলুন তো ডাক্তার সাহেব।

রিপোর্টগুলি ঠিক ইয়ে না।

 ইয়ে না মানে কি? আপনি পরিষ্কার করে বলুন।

 আপনি একটু পাশের ঘরে আসুন।

রেবেকা বুক ধক করে উঠল–ডাক্তার সাহেব এমন করছেন কেন? রিপোর্টগুলি কি খুব খারাপ? কি হয়েছে নুহাশের?

পাশের ঘরে গিয়েও ডাক্তার সাহেব চট করে কিছু বলতে পারলেন না। আমতা আমতা করতে লাগলেন। ঢোঁক গিলতে লাগলেন। রেবেকা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কি হয়েছে আমার মেয়ের?

রিপোর্টগুলি ভাল না।

ভাল না মানে কি?

 রেড ব্লাড সেলগুলি ডিফরমড।

তার মানে কি?

আপনাকে শক্ত হতে হবে। বিপদে মাথা খারাপ করলে চলবে না।

 আমার মেয়ের কি হয়েছে বলুন?

এখন চট করে কিছু বলা ঠিক হবে না–আরো অনেক টেস্ট করতে হবে।

চিকিৎসা করলে আমার মেয়ে বাঁচবে কি বাঁচবে না, এইটা শুধু বলুন। যা চিকিৎসা করাতে হয় আমি করাব, যেখানে মেয়েকে নিতে হয় সেখানে নিয়ে যাব–আপনি শুধু বলুন আমার মেয়ে বাঁচবে কি-না …।

ডাক্তার সাহেব নিচু গলায় বললেন, যা সন্দেহ করছি তা যদি হয় … অবশ্য নাও হতে পারে … মানে হায়াৎ মউত তো মানুষের হাতে না … মানে ….

রেবেকা আর কিছু শুনল না। ঘর থেকে বের হয়ে এল। নুহাশকে নিয়ে রিকশায় উঠল। রেবেকা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নুহাশ বলল, কি হয়েছে?

রেবেকা কাঁদতে কাঁদতে বলল, কিছু হয় নি। মা শোন, আমার শরীরটা ভাল লাগছে না–চল আমরা দুজনে গিয়ে তোমার বাবাকে খুঁজে বের করে নিয়ে আসি।

নুহাশ মনের আনন্দ অনেক কষ্টে চাপা দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, এখন থেকে বাবা কি আমাদের সঙ্গে থাকবে?

রেবেকা চোখ মুছতে মুছতে বলল, হ্যাঁ আমাদের সঙ্গে থাকবে।

আমরা কি আগের বাসায় ফিরে যাব?

 তুমি যদি চাও অবশ্যই ফিরে যাব। তুমি কি তা চাও মা?

হ্যাঁ চাই। আর কি চাই জান? আর চাই বাবা যখন জোছনা দেখতে যাবে তখন বাবার সঙ্গে তুমি আর আমিও যাব।

অবশ্যই যাব। অবশ্যই যাব মা।

.

নুহাশ তার ঘরে একা।

তার বাবা-মা পাশের ঘরে। নুহাশ ফিসফিস করে বলল, আলাদিনের চেরাগের দৈত্য, আপনি কি আমার একটা কথা শুনবেন?

প্রদীপের ভেতর থেকে উত্তর এল–কি কথা?

একটু বের হয়ে আসুন না।

না, এখন আর বের হতে পারব না। আরাম করে শুয়েছি। কি বলবে বল।

আমি আর মা গিয়ে বাবাকে নিয়ে এসেছি।

ভাল করেছ।

এখন বাবা-মা কি করছে জানেন? দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।

উচিত শাস্তি হচ্ছে। আরো কাঁদুক। কাঁদতে কাঁদতে চোখে ঘা হয়ে যাক।

আমার খুব খারাপ লাগছে। ওরা ভাবছে আমি সত্যি সত্যি মরে যাচ্ছি।

ওরা যা ইচ্ছ ভাবুক, তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাও তো। কালই এরা তোমাকে অন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। সেই ডাক্তার বলবে তোমার কিছু হয় নি। তখন তারা আর কষ্ট পাবে না। একটা দিন তারা কষ্ট করুক। তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। কাজেই কিছু কষ্ট তাদের পাওনা।

দৈত্য ভাইয়া?

খবরদার বললাম, ভাইয়া ডাকবে না।

আপনি কি একটু বের হয়ে আসবেন? এক মিনিটের জন্যে?

কেন?

আপনাকে একটু দেখব। দেখতে ইচ্ছে করছে।

শোন নুহাশ। তুমি একটা সমস্যার মধ্যে পড়েছিলে। আমি তোমাকে সমস্যা থেকে মুক্ত করেছি। আমার কাজ শেষ হয়েছে। কাজেই তুমি আর আমাকে দেখবে না। এই যে কথা বলছি, আর কথাও বলব না। তুমি ভাল থেকো, কেমন?

নুহাশ খুব কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই সে বলল, আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে দৈত্য ভাইয়া। একবার শুধু বের হয়ে আসুন। শুধু একবার। আর আপনাকে আসতে হবে না।

দৈত্য বের হল না। কোন শব্দও করল না। যারা অসম্ভব দয়ালু তাদের পক্ষেই অসম্ভব নিষ্ঠুর হওয়া সম্ভব।

.

অনেক রাত। বড় খাটের মাঝখানে নুহাশ, এক পাশে বাবা আর অন্য পাশে মা। নুহাশ বলল, বাবা অনুস্বার কবিতাটা একবার বল না শুনি।

মিনহাজ কবিতা শুরু করল:

নুহাশ আব্বুটিং
 গোলটা চক্ষুং
হাসটুং করছিং
 ফিকফিকিং
হাসটুং দেখং, আদর লাগছিং।

কবিতা শুনে নুহাশ হাসছে। আকাশে বিরাট চাঁদ উঠেছে। জানালা গলে সেই চাঁদের আলো এসে পড়েছে নুহাশের মুখে। গভীর আনন্দ এবং গভীর দুঃখে নুহাশের চোখ বারবার ভিজে উঠছে। চাঁদের আলোয় কি সুন্দর লাগছে নুহাশের কান্নাভেজা মুখ!

.

পরিশিষ্ট

নুহাশ এখন অনেক বড়। তার একটি ভাইও হয়েছে। মিনহাজ সাহেব তার নাম রেখেছেন প্লাটিনাম। প্লাটিনামকে নিয়েও তিনি একটি অনুস্বার কবিতা লিখেছেন। সেই কবিতাটি নুহাশের কবিতার মত এত সুন্দর হয় নি।

নুহাশ যদিও অনেক বড় হয়েছে (এবার এস.এস.সি. দেবে) তবু তার ধারণা ছোটবেলা আলাদিনের দৈত্য এসে তার সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। কেউ তার এই গল্প বিশ্বাস করে না। সবাই হাসে। সবার ধারণা, নুহাশ বানিয়ে বানিয়ে গল্পটা বলে। শুধু নুহাশের বাবা-মার ধারণা, নুহাশ পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নে দেখেছিল। তবে একজন ডাক্তার প্রথমে যে বলেছিল, নুহাশের লিউকোমিয়া হয়েছে, পরে দেখা গিয়েছে এটা ঠিক না, তা কিন্তু সত্যি। নুহাশের লিউকোমিয়া (এক ধরনের রক্তের ক্যানসার) হয়েছে শুনেই যে তার মা নুহাশের বাবাকে নিয়ে আসেন তাও কিন্তু সত্যি। কে জানে হয়ত সত্যি সত্যি দৈত্য এসেছিল, কিংবা কে জানে হয়ত পুরোটাই শিশুমনের কল্পনা। শিশুদের কল্পনার শক্তি যেমন অসীম ঠিক তেমনি পৃথিবীর রহস্যময়তাও অসীম। এই রহস্যময় পৃথিবীতে অনেক কিছুই হতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *