৮. নাম বদল

শুধু নামটা লড থেকে বদলে বেন গারিয় হয়েছে, অ্যারাইভালস হলসহ এয়ারপোর্টের কিছুই বদলায়নি। বেন গারিয়র মতো যথেষ্ট সংখ্যক লাগেজ ট্রলি আর কোথাও দেখেনি ও, ফলে জিনিসপত্র নিয়ে আরোহীদের হিমশিম খেতে হয় না।

এক ইসরায়েলি যুবক কান পর্যন্ত বিস্তৃত হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অ্যারাইভাল হলে, দুহাতে ধরা বুকের কাছে একটা স্লেট, তাতে সাদা চক দিয়ে লেখা,

মি, স্যার স্টিভেন স্ট্রাইড।

অদ্ভুত একটা ক্যাপ পরে আছে যোকরা ড্রাইভার–নেভী ব্লু, মাঝখানটা কালো চামড়ার, মিনারের মতো ক্রমশ সরু হয়ে আধ হাত উঠে গেছে খাড়া। ইউনিফর্মের এই একটাই অংশ পরেছে সে, গায়ের শার্টটা সাদা পপলিনের, পায়ে কালো স্যান্ডেল। বেশ ভালোই ইংরেজি বলতে পারে, মার্কিন ঘেঁষা উচ্চারণ। সপ্রতিভ আচরণ দেখে মনে হতে পারে পিটারকে যেন কত যুগ ধরে চেনে সে। আজ এই ছেলেটাকে ড্রাইভার হিসেবে দেখা যাচ্ছে, কালই হয়তো দেখা যাবে কন্ট্রোল সামনে নিয়ে বসে আছে একটা সেঞ্চুরিয়ান ট্যাংকের ভেতর।

সালোম, সালোম, পিটারকে অভ্যর্থনা জানাল সে। এই একটাই লাগেজ আপনার?

হ্যাঁ।

আপনাকে আমার পছন্দ হয়ে গেল। সবিনয়ে পিটারকে সরে যেতে বলে ট্রলিটা নিজেই ঠেলতে শুরু করল ছোকরা। আসুন। অ্যারাইভাল হল থেকে বেরিয়ে লিমুসিনের দিকে এগোল ওরা। পবিত্র নগরী, আমাদের এই জেরুজালেম… বকবক করে চলেছে অল্প বয়েসী ড্রাইভার।

 গাড়িটা দেখে মুগ্ধ হলো পিটার। টু হানড্রেড ফরটি ডি মার্সিডিজ বেঞ্জ, প্রায় আনকোরা নতুন, ঝকঝক করছে। শুধু বুটে কে যেন একজোড়া বিস্ফারিত চোখ এঁকে রেখেছে।

এয়ারপোর্টের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসতেই একটা গন্ধ পেল পিটার। ইসরায়েলের এই গন্ধ ওর পরিচিত।

 ইসরায়েলের প্রায় প্রতিটি ফুটপাতের পাশে কিছু খালি জায়গা রাখা হয়েছে, সেখানে ফলের চাষ হয়। এখন কমলা পাকার সময়, বাতাসে তারই সুবাস।

কিন্তু ভালো লাগার অনুভূতিটা কেন যেন মিইয়ে এল, অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল পিটার–মনে হলো কি যেন দেখেও দেখতে পাচ্ছে না, গুরুত্বপূর্ণ কি একটা অবহেলা করছে।

নতুন ডাবল-ওয়ে রোডে উঠে এল মার্সিডিজ, মনের আনন্দে কথা বলে চলেছে, ড্রাইভার, মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করতে পারছে না পিটার। রাস্তাটা পাহাড়ের ওপর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, দুপাশে পাইন বন, সামনে আরো অনেকটা দূরে জেরুজালেম।

 ওরলিতে, হোটেলে বসে, একটা তালিকা তৈরি করেছিল পিটার, সেটা ছিঁড়ে ফেলায় নিজেকে এখন তিরস্কার করল ও। কি কি লেখা ছিল মনে পড়ে কিনা দেখছে।

পক্ষে ছিল বারোটা যুক্তি। তৃতীয়টা মনে পড়ছে;

ব্যারনেস আমাকে ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের কথা জানিয়েছে। সে খলিফা হলে জানাত কি?

বিপক্ষে তৃতীয় যুক্তিটা সাথে সাথে মনে পড়ল;

ব্যারনেস ম্যাগডা যদি খলিফা হয়, তাহলে ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের কোনো অস্তিত্বই নেই। কোনো অজ্ঞাত কারণে ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের অস্তিত্ব মিছিমিছি আবিষ্কার করা হয়েছে।

এই ব্যাপারটাই, এই ক্যাকটাস ফুলের ব্যাপারটাই ওর অস্বস্তি বোধ করার কারণ।

আরো একটা কারণ, ড্রাইভার। ছোকরা মুহূর্তের জন্যেও থামছে না। কেন? শুধু যে বকবক করে চলেছে তাই নয়, খানিক পরপরই ঘাড় ফিরিয়ে পিটারের দিকে তাকাচ্ছে, গাল ভরা হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করছে, তাই না, ঠিক বলিনি?

ভালো করে না শুনেই দু-একবার হু-হু করল পিটার, তারপর শুধু মাথা ঝাঁকাল। কমলার গন্ধ ওকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলবে কেন? কারণ কমলার গন্ধ ফুলের গন্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়? ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার? ধ্যেৎ, কষ্টকল্পনা মনে হচ্ছে।

ব্যারনেস যদি খলিফা না হয়, তাহলে… তাহলে কি?

 তাহলে ঠিক আছে, তাই না, কোনো অসুবিধে নেই? আবার বিরক্ত করছে। ড্রাইভার।

দুঃখিত, শুনতে পাইনি… কি বলছিলে?

বলছিলাম, আমার শাশুড়িকে একটা প্যাকেট দিয়ে আসতে হবে, আবার ব্যাখ্যা করল ড্রাইভার। আমার বউ পইপই করে বলে দিয়েছে কিনা।

 ঠিক আছে, ঝাঝের সাথে বলল পিটার, ছোকরার মধ্যে খারাপ কিছুই নেই অথচ ওর ঠিক পছন্দ হচ্ছে না তাকে। দুশ্চিন্তার কারণটা মন থেকে হারিয়ে গেল। ফাঁকিবাজ সব জায়গাতেই আছে।

এখানে আমরা বাঁক নেব, বলে আকাশছোঁয়া সার সার অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের দিকে গাড়ি ঘোরাল ছোকরা। ইসরায়েল সরকার মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে নাগরিকদের বাসস্থান সমস্যার সমাধান করতে, এ তারই ফলশ্রুতি।

মাইল জুড়ে শত শত ভবন, প্রতিটি ছয়তলা। সন্ধ্যার এই সময় রাস্তা-ঘাট প্রায় ফাঁকা।

সবগুলো ভবন আর রাস্তা একই রকম দেখতে, তবে বোঝা গেল এলাকাটা ভালো করে চেনা আছে ড্রাইভারের। তার আচরণে কোনো জড়তা নেই। দিয়াশলাই বাক্সের মতো দেখতে একটা হলুদ বহুতল ভবনের সামনে গাড়ি থামাল সে।

দুমিনিট, প্রতিশ্রুতি দিয়ে নেমে পড়ল, ছুটে চলে গেল পিছন দিকে। ব্যস্ত হাতে বুট খুলল সে, হিঁচড়ে কি যেন একটা সরাল, মৃদু একটা ঝাঁকি খেল মার্সিডিজ, পরমুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেল বুট। আবার পিটারের দৃষ্টি সীমার মধ্যে চলে এল সে, হাতে ব্রাউন রঙের একটা প্যাকেট।

 পিটারের মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল সে, অদ্ভুতদর্শন ক্যাপটা ঠেলে দিল মাথার পিছনে, দাঁত দেখিয়ে বলল, এই গেলাম আর এলাম। দরজার দিকে ছুটে গেল সে।

 বললেও, ছোকরা ফিরতে দেরি করতে পারে, ভাবল পিটার। এই মুহূর্তের অটুট নিস্তব্ধতাটুকু অমূল্য মনে হলো। চোখ বুজে গভীর মনোযোগ আনার চেষ্টা করল ও।

ব্যারনেস ম্যাগডা যদি খলিফা না হয়, তাহলে-ইঞ্জিন ঠাণ্ডা হচ্ছে, তার শব্দ পাচ্ছে পিটার। নাকি ড্যাশবোর্ড ঘড়ির আওয়াজ? আওয়াজটা ভুলে থাকার চেষ্টা করল ও।

তাহলে, তাহলে ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের অস্তিত্ব আছে! হ্যাঁ, এই তো, এতক্ষণে ব্যাপারটা ধরা পড়ল। ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার আছে, আর সে যদি থাকে তাহলে খলিফার একেবারে কাছাকাছি আছে, এত কাছাকাছি যে স্যার স্টিভেন স্ট্রাইড যে তার পরিচয় ফাস করে দিতে আসছে, এও তার অজানা থাকার কথা নয়।

শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল পিটারের, সেই সাথে অনুভূতিটা আবার ফিরে এল-চামড়ার নিচে পোকা চলছে। ওর বিশ্বাস ছিল, খলিফার সাথে দেখা না হওয়া পর্যন্ত স্টিভেন নিরাপদ। প্রাণঘাতী একটা ভুল ছিল ওটা।

ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার অবশ্যই খলিফার কাছে পৌঁছুতে বাধা দেবে স্টিভেনকে। হায় হায়, এমন সহজ একটা অঙ্ক ওর মাথায় আগে ঢোকেনি! ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার মোসাড আর পিটার বসে আছে জেরুজালেমে-মোসাডের উঠানে, স্টিভেন সেজে।

ঈশ্বর। পিটার উপলব্ধি করল, তাজা বোমার ওপর বসে রয়েছে সে। ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার সম্ভবত নিজে সব আয়োজন করেছে। ব্যারনেস ম্যাগডা যদি খলিফা না হয়, তাহলে ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের পাতা মরণ ফাঁদে আটকা পড়তে যাচ্ছে ও।

ঘড়িটা এখনো টিকটিক করে যাচ্ছে। কোমল, একঘেয়ে শব্দে বাড়ি মারছে। নার্ভে।

আমি ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের শহরে রয়েছি, তার গাড়িতে…

টিকটিক! ওহ গড! ড্যাশবোর্ড থেকে আসছে না। ঝট করে ঘাড় ফেরাল পিটার। আসছে ওর পিছন থেকে। বুট থেকে। ড্রাইভার খুলেছিল ওটা, কি যেন নাড়াচাড়া করেছিল। সেটা থেকেই আসছে আওয়াজটা, টি কিট টিক টি…

খপ করে ধরে হাতল ঘোরাল পিটার, একই সাথে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিল দরজার গায়ে, অপর হাতে চলে এসেছে ব্রিফকেসের হ্যান্ডেল।

 বুট আর ব্যাকসীটের মাঝখানে ধাতব পার্টিশন থাকার কথা, নির্ঘাত সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বোমা আর সীটের মাঝখানে সম্ভবত মোটা চামড়া ছাড়া আর কিছুই নেই। সেজন্যেই বোধ হয় কানে এত বাজছে আওয়াজটা।

মার্সিডিজ থেকে বেরিয়ে হোঁচট খেতে খেতে ছুটল পিটার। জিনিসটা সম্ভবত প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, ডিটোনেটরে টাইমার লাগানো আছে। কতক্ষণ পর বিস্কোরণ ঘটাতে চাইবে ওরা? ত্রিশ সেকেন্ড? না, আরো বেশি-ড্রাইভারকে নিরাপদ দুরত্বে সরে যেতে দিলে হবে। ছোকরা বলল, দুমিনিট, দুবার বলেছে কথাটা…।

ফুটপাথে উঠে লাফ দিয়ে মাটিতে নামল পিটার, ঝোঁপ-ঝাড় পেরিয়ে যতটা সম্ভব দূরে পালাচ্ছে। মিনিট দুয়েকই হয়েছে সরে গেছে ড্রাইভার…।

দশ কদম সামনে নিচু একটা পাঁচিল, ঘেরের মধ্যে ফুলবাগান করার জন্যে তৈরি করা হয়েছিল। হাঁটু সমান উঁচু, দুটো করে ইট পাশাপাশি রেখে গাঁথা হয়েছে, ঘেরের মধ্যে মাটির ঢেলা আলগা হয়ে আছে। ডাইভ দিয়ে পাঁচিলটা পেরোল পিটার, আলগা মাটির ওপর কাঁধ আর কনুই দিয়ে পড়ল, দুটো গড়ান দিয়ে ধাক্কা খেল দ্বিতীয় পাচিলের গায়ে।

 ওর মাথার ওপর একতলা অ্যাপার্টমেন্টের বড় বড় জানালা, মাটিতে পাজর ঠেকিয়ে ওগুলোর দিকে তাকাল পিটার, কাঁচের ওপর মার্সিডিজের ঝকঝকে প্রতিবিম্ব দেখতে পেল।

দুহাতের তাল দিয়ে কান ঢাকল পিটার, মার্সিডিজ মাত্র পঞ্চাশ ফিট দূরে। বুকের দুপাশে কনুই, মুখ যতটা সম্ভব খোলা, বিস্ফোরণের ধাক্কা সামলাবার জন্যে তৈরি হলো পিটার।

স্লো-মোশন ছবিতে যেভাবে ধীরে ধীরে পাপড়ি মেলে গোলা, মার্সিডিজটা ঠিক সেভাবে ধীরে ধীরে খুলে গেল। চকচকে মেটাল ফাঁক হলো, দুমড়েমুচড়ে কুঁকড়ে গেল অদ্ভুত দর্শন পাপড়ির মতো, ভেতর থেকে স্যাৎ করে বেরিয়ে এল লাল-জিভ আগুন। তারপরই দৃশ্যটা হারিয়ে গেল, চুরচুর হয়ে খসে পড়ল সব কটা জানালার কাঁচ। সেই সাথে বিস্ফোরণের ধাক্কা থেঁতলে দিয়ে গেল পিটারকে।

মনে হলো কোনো দৈত্য ওর পাঁজরে পা রেখে চাপ দিয়েছে, সমস্ত বাতাস হুস করে বেরিয়ে গেল ফুসফুস থেকে। প্রচণ্ড ঝাঁকিতে ঘাড় থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল খুলি। পিটারের ধারণা হলো, কিছুক্ষণ হুঁশ ছিল না তার। অনুভব করল কাঁচের টুকরো, প্লাস্টার, টুকরো কাঠ বৃষ্টির মতো পড়ছে গায়ে, বড় আর ভারী কি যেন একটা শিরদাঁড়ার ওপর আঘাত করল, ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল ও।

পিঠে একটা হাত রেখে দাঁড়াল ও। চারদিকে কিছুই নড়ছে না, অথচ মনে হলো তুমুল ঝড় বইছে। টলমল করতে করতে সিধে হলো, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে ভরে নিচ্ছে ফুসফুস। জানে পুলিশ চলে আসার আগেই সরে যাওয়া দরকার, কিন্তু পা নড়ছে না। হঠাৎ উপলব্ধি করল ওর দৌড়াতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু চেষ্টা করলে শুধু বোধ হয় হাঁটতে পারবে। বিস্ফোরণের ধাক্কা এখনো সামলে উঠতে পারেনি শরীরটা, এই মুহূর্তে একে দিয়ে কঠিন কাজ করানো সম্ভব নয়।

ধীরে ধীরে ফুটপাথে উঠে এল পিটার। রাস্তা এখনো ফাঁকা, তবে আশপাশ থেকে শোরগোল আর কান্নায় আওয়াজ আসছে। মোড়ে পৌঁছে সরু একটা গলির ভেতর ঢুকল, সেটা থেকে বেরিয়ে এল মেইন রোডে। শোরগোলের আয়োজটা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে এল। বাসের জন্যে লাইন দিয়েছে মানুষ, তাদের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল ও।

জাফা রোডে নেমে পড়ল পিটার। বাস স্টপেজের উল্টো দিকে একটা কফি শপ থেকে ভেতরে ঢুকল, এক কিনারায় বসে কাটলেট আর কফি চাইল।

পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আধঘণ্টা চিন্তা করল পিটার। ইতোমধ্যে একবার টয়লেট থেকে ঘুরে এসেছে–চেহারায় কোনো দাগ নেই। পরচুলা, দাড়ি, আর গোঁফও ঠিকঠাক আছে।

 ব্যারনেস ম্যাগডা যদি খলিফা না হয়ে থাকে… এভাবে চিন্তা করার ফলেই শেষ মুহূর্তে বিপদটা দেখতে পেয়েছিল, নতুন একটা জীবন পেয়ে গেছে।

ব্যারনেস ম্যাগডা খলিফা নয়! এখন নিশ্চিতভাবে জানে পিটার। নিজের পরিচয় ফাস হতে যাচ্ছে এ ভয়ে ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার স্টিভেনকে বাধা দিয়েছে, সে যাতে খলিফার কাছে পৌঁছুতে না পারে। তার মানে ব্যারনেস ওকে সত্যি কথাই বলেছে। বিপুল স্বস্তি, প্রায় পুলকের মতো সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। প্রথম যে চিন্তাটা মাথায় এল, এখুনি ম্যাগডার দেয়া মোসাডের নাম্বারে ফোন করবে ও, কথা বলবে তার সাথে। তারপর বিপদটা টের পেল। ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার মোসাড। এই মুহূর্তে ম্যাগডার কাছাকাছি যাওয়া মস্ত বোকামি হবে।

তাহলে কি করবে সে এখন? উত্তরটা খুঁজতে হলো না, তৈরি হয়েই ছিল মনের ভেতর। যা করার জন্যে এসেছে, তাই করবে ও। খলিফার সাথে দেখা করবে, আর দেখা করতে হলে তার পথ ধরেই সামনে বাড়তে হবে ওকে।

 কফি শপ থেকে বেরিয়ে রাস্তার মোড় পর্যন্ত হেঁটে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে চলে এল পিটার। কিং ডেভিড হোটেল, ড্রাইভারকে বলল ও, হেলান দিল সীটে।

নিজেকে অভয় দিল পিটার, এখন অন্তত জানা আছে ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার বাস্তব চরিত্র। পরবর্তী ফাঁদে অন্ধের মতো পা দেবে না সে।

.

চেহারায় অসন্তোষ নিয়ে চারদিকে চোখ বুলার পিটার, এই কামরাটাই রিজার্ভ করা হয়েছে ওর জন্যে। হোটেলের পিছন দিকে কামরাটা, রাস্তার ওপারে আকাশছোঁয়া একটা বিল্ডিং, মাত্র পনেরো গজ দূরে। দুটো জানালার যে কোনোটা দিয়ে আসতে পারে স্নাইপারের বুলেট।

 কিন্তু আমি তো একটা স্যুইট চেয়েছিলাম, সাথে উঠে আসা রিসেপশন ক্লার্ককে ধমকের সুরে বলর পিটার।

দুঃখিত, স্যার, সবিনয়ে বলল লোকটা। তাহলে নিশ্চয়ই ভুল হয়ে গেছে।

চারদিকে আরেকবার তাকাল পিটার, ভারী ফার্নিচারগুলোর আড়ালে অন্তত দশ-বারোটা জায়গা রয়েছে যেখানে ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার বিস্ফোরক পদার্থ রেখে গিয়ে থাকতে পারে, মার্সিডিজের পর বিকল্প হিসেবে। সাপের খাঁচায় রাত কাটাতে রাজি আছে পিটার, ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের তৈরি পরিবেশের চেয়ে সেটা অনেক নিরাপদ।

পিছিয়ে করিডোরে বেরিয়ে এল ও, তিরস্কার ভরা দৃষ্টিতে তাকাল ক্লার্কের দিকে। শশব্যস্ত হয়ে এলিভেটরের দিকে ছুটল বেচারা, ফিরে এল পাঁচ মিনিটের মাথায়, গালভরা হাসি নিয়ে। নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিল পিটার, জিনিসটা ভারী বিপজ্জনক–এই গালভরা হাসি।

 আমাদের সেরা সুইটের একটা, স্যার, এইমাত্র খালি হওয়ায় আপনাকে দেয়া গেল–আসুন, প্লিজ।

একশ বাইশ নম্বর সুইট। জানালা দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত উপত্যকা দেখা যায়, ওল্ড সিটির গায়ে জাফা গেটটাও পরিষ্কার নজরে আসে। শহরের মাঝখানে মাথা তুলে আছে লাস্ট সাপার চার্চ।

 হোটেলের বাগানে ফুল ফুটে আছে, লনগুলো সবুজ ঘাসে মোড়া, সুইমিং পুলের কিনারায় ছুটোছুটি করে খেলছে শিশুরা।

খোলা একটা টেরেস রয়েছে স্যুইটের সাথে, একা হতেই শাটার বন্ধ করে দিল পিটার, ওদিক দিয়ে খুব সহজেই লোক পাঠাতে পারে ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার। এরপর প্রাইভেট ব্যালকনিতে বেরিয়ে এল পিটার।

 বাগানের পাশেই ফ্রেঞ্চ কনসুলেট। দুর্গ আকৃতির একটা বাড়ি। বাড়ির পাশে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। সুইটের নিরাপত্তা নিয়ে আবার চিন্তা করল পিটার।

পাশের সাইট থেকে অনায়াসে একজন লোক ওর ঝুল-বারান্দায় চলে আসতে পারবে, শুধু যদি আটতলার জানালার কার্নিসে পা রাখার সাহস থাকে। কয়েক সেকেন্ড ইতস্তত করল পিটার, তারপর সিদ্ধান্ত নিল ঝুল-বারান্দার শাটার বন্ধ করবে না। সবদিক বন্ধ একটা জায়গায় নিজেকে আটকে রাখলে হীতে বিপরীতও ঘটতে পারে।

পর্দা টেনে দিল পিটার, তারপর রুম সার্ভিসকে ফোনে ডেকে হুইস্কি আর সোর্ডার অর্ডার দিল। দরকার, খুব ধকল গেছে সারাটা দিন।

 টাই আর শার্ট খুলল পিটার; তারপর চুল, গোঁফ আর দাড়ি। বাথরুমে ঢুকে সাবান দিয়ে মুখ ধুলো। তোয়ালে দিয়ে পানি মুছছে, টোকা পড়ল দরজায়।

রুম সার্ভিস? কিন্তু এত তাড়াতাড়ি? ব্যস্ত হতে উইগটা মাথায় চাপিয়ে লাউঞ্জে বেরিয়ে এল পিটার, কানে চাবির আওয়াজ পেল না, অথচ হাতল ঘুরে যাচ্ছে, পরমুহূর্তে দড়াম করে খুলে গেল কবাট। ঝট করে তোয়ালাটা মুখে তুলে ফেলেছে পিটার, ভান করল এখনো মুখ মোছা শেষ হয়নি–গোঁফ দাড়ি নেই সেটা গোপন করা সম্ভব হলো কোনো রকমে।

ভেতরে এসো, ভোয়ালের ভেতর থেকে ভোতা আওয়াজ বেরুল।

 স্যার স্টিভেন?

দোরগোড়ার সামনে স্থির পাথর হয়ে গেল পিটার, গলার আওয়াজটা যেন পিষে দিল হৃৎপিণ্ডকে, মাঝখানে থামিয়ে দিল নিঃশ্বাস।

পুরুষের বুক খোলা শার্ট পরেছে সে, বুকের দুপাশ ঢাকনি সহ ছোটো পকেট। কোমর আর ঊরুতে আঁটসাঁট হয়ে আছে খাকি কমব্যাট ট্রাউজার, পায়ে নরম সোলের ক্যানভেস বুট।

 স্যার স্টিভেন, পিছনে দ্রুত বন্ধ করে দিল দরজা, তার তালুতে সরু আর লম্বা একটা ইস্পাতের টুকরো দেখল পিটার, ওটা দিয়েই তালা খুলেছে সে। চোখ থেকে তোয়ালে সরান, এদিকে তাকান–আমি ব্যারনেস অল্টম্যান। আপনি মারাত্মক বিপদে আছেন, আমি আপনাকে সাবধান করতে এসেছি… সদ্য কাটা কোঁকড়া কালো চুলের মাঝখানে তার মুখ তাজা ফুলের মতো কোমল আর স্নিগ্ধ। এই মুহূর্তে ইসরাইল ত্যাগ করতে হবে আপনাকে। কাছাকাছি একটা এয়ারফিল্ডে আমার লিয়ার জেট আছে… তার বিশাল সবুজাভ চোখে দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতা।

কথা বলার জন্যে তোয়ালে একটু নামাল পিটার। এ-সব কথা কেন বলছেন আমাকে, বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল ও। আপনার কথা আমি বিশ্বাসই বা করব কেন?

পিটার দেখল, এক নিমেষে রাগে লালচে হয়ে উঠল ব্যারনেসের চেহারা।

আপনি বোকার মতো এমন জিনিসে নাক গলাচ্ছেন, হুঁশ ফেরার পর দেখবেন ওটা আর নেই।

আমাকে সাবধান করে আপনার কি লাভ, ব্যারনেস অল্টম্যান?

কারণ…,ইতস্তত করল ব্যারনেস, তারপর বলল, …কারণ আপনি পিটারের বন্ধু। শুধু এই একটা কারণে আমি চাই না আপনি খুন হয়ে যান।

হাত থেকে তোয়ালে ছেড়ে দিল পিটার, ঝটকা দিয়ে মাথা থেকে ফেলে দিল পরচুলা।

নো! ইমপসিবল! ওহ্ গড়, ইয়েস, ইটস ট্র! দুই সেকেন্ডে কয়েকবার ব্যারনেসের চেহারা বদলে যেতে দেখল পিটার–প্রথমে ফ্যাকাসে হয়ে গেল, তারপর অবিশ্বাসের ছায়া পড়ল, সবশেষে আনন্দে বিকৃত হয়ে উঠল। মনে হলো বিস্ময়ের ধাক্কায় পঙ্গু হয়ে গেছে সে, পিটারের দিকে ঝপিয়ে পড়ার ভঙ্গি করেও স্থির হয়ে থাকল, সেই শ্রুতিমধুর প্রলম্বিত সুরে বিড়বিড় করে চলেছে। পিটার, মাই লাভ…ওহ গড, ইটস্ ট্র!

 দাঁড়িয়েই থাকবে শুধু? পিটার থামতেই ঝাঁপ দেয়ার গতি পেল, ওর বুকে ধাক্কা খেল ব্যারনেস। পিটার অনুভব করল পেলব দুটো বাহু ওর ঘাড় জড়িয়ে ধরে সাপের মতো প্যাঁচ কষছে।

প্ল্যানটা কি, পিষে মেরে ফেলবে? দম নিতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে পিটারের।

পিছিয়ে এল ব্যারনেস, কিন্তু দুহাত দিয়ে ধরে রাখল পিটারের কাঁধ। পিটার, ডার্লিং–বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। অসম্ভব ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসেছি। হোটেলের ওপর নজর রাখছে ওরা, আর সুইচবোর্ডের মেয়েগুলো মোসাড। তা না হলে ফোন করলেও পারতাম…।

কি জানো সব বল, নির্দেশ দিল পিটার।

ঠিক আছে, কিন্তু ধরো আমাকে, শেরি। যতক্ষণ একসাথে আছি একটা সেকেন্ডও নষ্ট করতে চাই না।

 বাথরুমে লুকাল ব্যারনেস, রুম সার্ভিস হুইস্কি সোডা দিয়ে চলে গেল। বেরিয়ে এসে সোফায় পিটারের গায়ে হেলান দিয়ে আবার বসল ব্যারনেস।

 ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার,,,?

কন্ট্রোলকে রিপোর্ট করেছে, খলিফার সাথে দেখা করতে চেয়েছে স্টিভেন, এবং তার পরিচয় ফাস করে দিতে চাচ্ছে। কাল পর্যন্ত এইটুকু জানতাম আমি। তবে আন্দাজ করে নিতে অসুবিধে হয়নি। ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের প্রথম রিপোর্টে তোমার বদলে স্টিভেনের নাম রয়েছে দেখে প্রথমে আমি অবাক হয়ে যাই। তারপর আমার মনে পড়ে, আমার কন্ট্রোল স্টিভেনের নামটাও বলেছিল, ভাবলাম স্টিভেনই তাহলে খলিফার সমার্থক নাম, কিন্তু স্টিভেন আসছে কেন, আসার কথা তো তোমার! ধরে নিলাম, স্টিভেনের সাথে তোমার একটা সমঝোতা হয়েছে, ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের কথা তাকে তুমি জানিয়েছ…পিটার, মাই লাভ, আমরা তো বিছানায় শুয়েও কথা বলতে পারি, তাই না? ফিসফিস করে বলল ব্যারনেস। কতদিন তোমাকে আমি কাছে পাই না..।

তার ত্বক নিরাবরণ গরম সাটিনের মতো। তার গলা পিটারের গলার সাথে সেঁটে থাকল। তার সমতল মসৃণ তলপেটে ভারী আর শক্ত একটা ঊরু তুলে দিল পিটার।

 স্টিভেনের দেখা করার অনুরোধ অন্য একটা চ্যানেলে খলিফার কাছে পৌঁছায়, মেসেজটা পৌঁছুতে বাধা দেবে সে উপায় ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের ছিল না…

তার পরিচয় কি? জানতে পেরেছে কে সে?

 না। মাথা নাড়াল ব্যারনেস। এখনো জানতে পারেনি।

 পিটারের পেটে আঙ্গুল দিয়ে রেখা আঁকছে সে।

এমন করলে চিন্তা করতে পারছি না, প্রতিবাদ করল পিটার।

দুঃখিত। হাতটা পিটারের গালে তুলে আনল ব্যারনেস। তবে সাক্ষাৎকারের আয়োজন করার দায়িত্ব খলিফা ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের দিল। কি আয়োজন করা হয়েছে আমি জানতাম না। তারপর আজ সন্ধ্যায় ইমিগ্রেশন তালিকায় স্যার স্টিভেন স্ট্রাইড নামটা দেখলাম। দেখা মাত্র বুঝতে পারলাম কি হতে চলেছে। সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা ইসরায়েলে করা হয়েছে, কারণ এখানে স্টিভেনকে খুন করা ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের জন্যে পানির মতো সহজ। স্টিভেন কোথায় উঠবে জানতে তিন ঘণ্টা লেগে গেল আমার।

এখন ওরা দুজনেই চুপচাপ, পিটারের ঘাড়ে নামিয়ে মুখটা তুলে ধরল ব্যারনেস, পরম সুখে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। ওহ্ গড, পিটার! তুমি দূরে থাকলে আমার যে কি কষ্ট হয়!

 শোনো, ডার্লিং। আর কি জানো সব বল আমাকে। নরম আঙ্গুলে তার চিবুক ধরে উঁচু করল পিটার চোখ দেখার জন্যে, তার চোখে দৃষ্টি ফিরে এল। তুমি কি জানতে স্টিভেনকে খুন করার চেষ্টা করা হবে?

না–কিন্তু সঙ্গত কারণেই মোসাড সে চেষ্টা করতে পারে, ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের পরিচয় তারা গোপন রাখতে চাইবে।

আর কি জানো?

কিছু না।

খলিফা আর স্টিভেনের দেখা করার ব্যবস্থা আদৌ করা হয়েছে কিনা জানো?

না, স্বীকার করল ব্যারনেস। জানি না।

খলিফার পরিচয় সম্পর্কেও এখনো কিছু জানতে পারনি?

 না।

আবার ওরা চুপ করে গেল। কনুইয়ের ভর দিয়ে পিটারের বুকের ওপর উঁচু হয়ে আছে ব্যারনেস, ওর মুখ লক্ষ্য করছে।

পিটার বলল, খলিফার নির্দেশ অমান্য করার ঝুঁকি ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার নেবে না, সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে হয়েছে তাকে। খলিফা জড়িত, কাজেই কোনো ছল-চাতুরির আশ্রয় নিতেও সাহস করবে না।

নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল ব্যারনেস।

 তাহলে আমাদের বিশ্বাস করতে হয়, এই মুহূর্তে কাছে কোথাও রয়েছে। খলিফা, খুব কাছাকাছি কোথাও।

হ্যাঁ, আবার মাথা ঝাঁকাল ব্যারনেস, কিন্তু অনিচ্ছাসত্ত্বেও।

 তার মানে স্টিভেনের বদলে আমাকে যেতে হবে তার কাছে।

না, পিটার, না। ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে।

একবার এরইমধ্যে চেষ্টা করা হয়েছে, মার্সিডিজের ঘটনাটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করল পিটার, ওর শিরদাঁড়ার ওপর ক্ষতটায় নরম আঙুল ছোঁয়াল ব্যারনেস।

পিটার, ওরা তোমাকে খলিফার কাছে পৌঁছুতে দেবে না।

না দিয়ে উপায় নেই ওদের, বলল পিটার। খলিফা নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভারি উদ্বিগ্ন, স্টিভেনের কাছ থেকে তথ্য পাবার জন্যে অস্থির হয়ে আছে সে।

 ওরা তোমাকে তার আগেই যদি খুন করতে পারে? তাই করবে, পিটার, ওদের তুমি চেনো না!

 চেষ্টা করবে, হয়তো, বলল পিটার। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সাক্ষাৎকারের একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করা আছে, তার বেশি দেরি নেই। আরেকবার খুনের আয়োজন করার মতো সময় নেই ওদের হাতে। তাছাড়া, এখন আমি জানি, আমার ওপর হামলা হতে পারে। সব দিক ভেবেই বলছি, আমার এগোনো উচিত।

ওহ্ পিটার… ব্যারনেসের ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরল পিটার।

এসো ধরি, মোসাড জানে আমি স্যার স্টিভেন স্ট্রাইড নই এবং আমার আসল কাজ ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের পরিচয় ফাঁস করে দেয়াও নয়, তাহলে? মোসাডের ওরা এই পরিস্থিতিতে কি ভাববে?

কয়েক সেকেন্ড বিবেচনা করল ব্যারনেস। ঠিক বুঝতে পারছি না।

ওরা যদি জানে স্টিভেনের জায়গায় পিটার স্ট্রাইড এসেছে, আবার প্রশ্ন করল পিটার, তাহলে কি ঘটে দেখার কৌতূহলে মোসাড কি সাক্ষাৎকারটা অনুষ্ঠিত হতে দেবে?

তুমি কি চাইছ তোমার কথা জানিয়ে মোসাডে রিপোর্ট করি আমি?

 তাতে যদি আমার সুবিধে হয়, করবে না?

সুবিধে? ওদেরকে রিপোর্ট করা আর তোমার ডেথ ওয়ারেন্টে সই করা, একই ব্যাপার—পিটার, তুমি না আমার লক্ষ্মী সোনা!

কিংবা হয়তো সেটাই হবে আমার রক্ষাকবচ।

 পিটারকে জড়িয়ে ধরে ঝাঁকি দিল ব্যারনেস। রক্ষাকবচ হয় কি করে!

ঠিক জানি না, বলল পিটার। তবে একটা জিনিস বুঝি, আমি খলিফার সামনে দাঁড়াতে পারলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তার সামনে একবার পৌঁছুতে পারাই আমার উদ্দেশ্য। বাঁচা-মরা ভাগ্যেরও তো ব্যাপার ম্যাগডা। কিন্তু ভেবে দেখ, এরকম সুবর্ণ সুযোগ আর পাব না। খলিফা জানে, তোমাকে আমি খুন করেছি। জানে, আমার ভাইয়ের মাধ্যমে তাকে সাবধান করে দিতে চাইছি। এই মুহূর্তে সিকিউরিটির কথা ভেবে খুব একটা উদ্বেগে নেই সে। এরকম সুযোগ আর পাব?

কথা বলতে পারল না ব্যারনেস, নিঃশব্দে শুধু মাথা নাড়ল।

তোমার জন্যে আমার এত ভয় হয়, পিটার। যদি চাও আমি মারা যাই, তাহলে হও, যাও খুন হয়ে। প্রচণ্ড ভালোবাসা বোধহয় অভিশপ্ত… কথা শেষ না করে পা দুটো ভাজ করল ব্যারনেস, হাঁটু জোড়া তুলে আনল বুকের ওপর-ভ্রুণের ভঙ্গি।

করবে, ম্যাগডা?

তুমি চাও, কন্ট্রোলকে তোমার আসল পরিচয় জানিয়ে দিই, বলি ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের পরিচয় ফাস করার কোনো ইচ্ছে তোমার নেই, তুমি অজ্ঞাত কোনো কারণে খলিফার সাথে দেখা করতে চাও, এবং খলিফা লোক ভালো নয়, এই তো?

হ্যাঁ।

মাথা ঘুরিয়ে পিটারের দিকে তাকাল ব্যারনেস। তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে।

কি প্রতিজ্ঞা?

কন্ট্রোলের সাথে কথা বলে যদি বুঝি তোমার বিপদ কাটেনি, যদি বুঝি খলিফার সাথে দেখা করার আগে তোমাকে ওরা বাধা দেবে ঠিক করেছে, তাহলে তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে দেখা করার প্ল্যান বাদ দেবে তুমি। সোজা আমার লীয়ারের কাছে চলে যাবে, পিয়েরে তোমাকে নিরাপদ কোথাও পৌঁছে দেবে।

 তুমি আমার সাথে চালাকি করবে না, পুরোপুরি সৎ থাকবে? জিজ্ঞেস করল পিটার। মোসাডের প্রতিক্রিয়া নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিবেচনা করবে—আর, যদি দেখ দেখা করার ফিফটি-ফিফটি চান্স আছে, চান্সটা আমাকে নিতে দেবে?

মাথা ঝাঁকাল ব্যারনেস।

আমার মাথা ছুঁয়ে শপথ কর, জেদ ধরল পিটার।

পিটারের মাথায় হাত রাখল ব্যারনেস। বেঁচে ফিরে যাবার সম্ভাবনা আছে। দেখলে তোমাকে আমি বাধা দেব না—আমার ভালোবাসার নামে কসম।

পিটারের পেশিতে ঢিল পড়ল।

এবার তোমার পালা…

ব্যারনেসের মাথার হাত রেখে পিটার বলল, যদি দেখি খলিফার সাথে দেখা করার কোনো সুযোগ পাব না, তোমার কথা মতো লিয়ারের কাছে চলে যাব আমি…

পিটারের বুকের নিচে ঘুরে গেল ব্যারনেস, ওর ঘাড় পেঁচিয়ে ধরল দুহাতে। আমাকে ভালোবাসো পিটার। তাড়াতাড়ি। ভালোবাসো আমাকে।

.

কাপড় পরা শুরু করে ব্যারনেস বলল, ফোন করা সম্ভব নয়। এই কামরায় লোক পাঠাব আমি। ক্যানভাস বুটের ফিতে বাঁধল সে। শুধু বিপদের খবর হলে লোক পাঠাব। সে শুধু বলবে, ব্যারনেস আমাকে পাঠিয়েছে। সাথে সাথে তার সাথে বেরিয়ে পড়বে তুমি। সে তোমাকে লিয়ারের কাছে নিয়ে যাবে।

সিধে হয়ে দাঁড়াল ব্যারনেস, খাকি ট্রাউজার্স পরে আয়নার সামনে চলে এল, চুলে চিরুনি চালাচ্ছে। সাথে কিছু আছে তো, পিটার? আয়নায় ওকে দেখতে পাচ্ছে সে।

মাথা নাড়ল পিটার।

আমি জোগাড় করে পাঠাতে পারি, কি লাগবে বল-ছুরি, পিস্তল?

আবার মাথা নাড়ল পিটার। খলিফার সামনে যেতে দেয়ার আগে সার্চ করা হবে আমাকে।

 হ্যাঁ, তা ঠিক। শার্টের বোতাম লাগাল ব্যারনেস, ওর বুকের বৃন্ত দুটো সাম্প্রতিক ভালোবাসায় লালচে-বেগুনি আর উদ্ধত হয়ে আছে।

সবকিছু খুব দ্রুত ঘটবে, পিটার। আগামীকালের মধ্যে সবকিছু বোঝা যাবে– ভালো বা খারাপ। আমি অনুভব করতে পারছি ছোট্ট বুক দুটোর মাঝখানে হাত রাখল ম্যাগডা। এইখানে। চুমো খাও। বহুক্ষণ ছিলাম এখানে। দুজনের নিরাপত্তার কথা ভেবে এখন আমার চলে যাওয়া উচিত।

.

ভীষণ ক্লান্ত হলেও ব্যারনেস চলে যাবার পর সামান্য একটু ঘুমাতে পারল পিটার। সারা রাতে পঁচ-সাত বার ঘুম ভেঙে গেল, সটান বিছানার ওপর উঠে বসে নিস্তব্ধতার ভেতর কান পেতে থাকল। সূর্য ওঠার আগে ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিল ও, কিন্তু সেদ্ধ একটা ডিম আর কফি ছাড়া কিছু চুল না। শুরু হলো অপেক্ষার পালা।

দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে, ব্যারনেস কোনো মেসেজ পাঠায়নি। মোসাড সম্ভবত সিদ্ধান্ত নিয়েছে খলিফার সাথে দেখা করতে ওকে তারা বাধা দেবে না। ব্যারনেসের মনে ক্ষীণ একটু সন্দেহ থাকলেও ওকে খবর পাঠাত সে। রুম সার্ভিসকে দিয়ে হালকা লাঞ্চ আনিয়ে খেয়ে নিল পিটার। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিস্তেজ হতে দেখল কড়া রোদকে। বিকেল হয়ে গেছে।

সন্ধে হতে আধঘণ্টা বাকি, টেলিফোন বেজে উঠল। চমকে উঠে রিসিভার তুলল পিটার।

গুড ইভনিং, মি. স্টিভেন। আপনার ড্রাইভার আপনাকে নিতে এসেছে, রিসেপশন ডেস্ক থেকে একটা মেয়ে কথা বলছে।

ধন্যবাদ। ওকে বল আমি আসছি।

শুরু হলো ব্যাপারটা। এর শেষ কোথায় পিটারের জানা নেই। মস্ত ঝুঁকি নিয়েছে সে। জানে, এছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কাপড় পরে আগেই তৈরি হয়ে ছিল, কাবার্ডে ব্রিফকেসটা ভরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

এখনো সঠিক বলা যাচ্ছে না কোথায় যাচ্ছে ও। হয়তো খলিফার কাছে নয়, ব্যারনেসের লিয়ারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে ওকে। হয়তো ব্যারনেস রিপোর্ট করার পর তাকে বন্দী করেছে মোসাড, পিটারকে নিয়ে যাবার জন্যে ড্রাইভার পাঠিয়েছে।

 ডেস্কের সুন্দরী মেয়েটা ওকে বলল, আপনার গাড়ি বাইরে অপেক্ষা করছে, স্যার। হ্যাভ এ নাইস ইভনিং।

আই হোপ সো, বলল পিটার। ধন্যবাদ।

ছোট একটা জাপানী গাড়ি, ড্রাইভার একটা মেয়ে। পিটারকে হেঁটে আসতে দেখে সবিনয়ে হাসল সে, চেহারায় বন্ধু বন্ধু ভাব। পিছনের সীটে উঠল পিটার, অপেক্ষা করে আছে কখন শুনতে হবে, ব্যারনেস পাঠিয়েছে আমাকে।

তার বদলে মেয়েটা সালোম, সালোম, বলল ওকে, হেডলাইট জ্বেলে ছেড়ে দিল গাড়ি।

.

পুরানো শহর ঘিরে থাকা পাচিলের বাইরের দিক ঘেঁষে ছুটে চলেছে গাড়ি। দিনের আলো দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। রাস্তায় লোক চলাচল কম, যানবাহন আরো কম। এদিকের রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে গেছে কিরন উপত্যকায়। ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে একবার তাকাল পিটার। পাঁচিলের ভেতর পুরানো শহরের আকাশছোঁয়া অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলো দেখা গেল। পবিত্র নগরীতে একটুর জন্যে খুন হয়ে যাচ্ছিল

হাসল মেয়েটা, কিন্তু উত্তর দিল হিব্রুতে। ফ্রেঞ্চ ভাষায় একই প্রশ্ন করল পিটার, ফলাফল শূন্য। তার মানে, ভাবল পিটার, কথা বলতে নিষেধ করা আছে।

অলিভস পাহাড়ের নিচে পৌঁছুতে রাত হয়ে গেল, একটু পর আরব বসতির শেষ চিহ্নটা পেছনে ফেলে এল ওরা। রাস্তা ফাঁকা হলেও চল্লিশের ওপর স্পীড তুলল না মেয়েটা। অন্ধকার, অল্প নিচু একটা উপত্যকায় নেমে এল গাড়ি, চওড়া কংক্রিটের রাস্তার দুপাশে পাহাড়, পাহাড়ের দুপাশে ধূ-ধূ মরুভূমির আভাস।

খোলা আকাশে মেঘ নেই, মেলা বসেছে তারাদের।

শহর ছাড়ার পর রাস্তার পাশে খানিক পর পর সাইনপোস্ট দেখা গেল। পূর্বে জর্দান, ডেড সী, আর জেরিকোসেদিকেই যাচ্ছে ওরা। পঁচিশ মিনিট পর হেডলাইটের আলোর আরেকটা সাইনপোস্ট দেখল পিটার হাতের ডান দিকে ইংরেজি, আরবি, আর হিব্রুতে লেখা। সী লেভেলের নিচে নামছে এখন ওরা, ডেড সীর উপত্যকায়।

 মেয়েটাকে আরেকবার কথা বলাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো পিটার। নিজেকে সান্ত্বনা দিল এই বলে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানার কথা নয় তার। গাড়িটা কোনো রেন্ট এ-কার কোম্পানি থেকে ভাড়া করা, ড্যাশবোর্ডে নাম লেখা রয়েছে। তবে গন্তব্য সম্পর্কে জানে মেয়েটা। একটু পর ও নিজেও জানতে পারবে।

সামনে একটা সতর্কীকরণ সঙ্কেত দেখা গেল, সামনে ক্রসরোড। স্পীড কমিয়ে বাঁ দিকে বাঁক নেয়ার সিগনাল দিল ড্রাইভার। হেডলাইটের আলো পড়ল সাইনপোস্টে, জেরিকা রোড ধরছে ওরা, ডেড সী পিছনে থেকে যাচ্ছে। উত্তর দিকে যাচ্ছে ওরা, জর্দান উপত্যকা গ্যালিলির দিকে।

পাহাড়ের মাথার ওপর ষাঁড়ের শিং আকৃতি নিয়ে চাঁদ উঠল। আবার গাড়ির স্পীড কমাল ড্রাইভার, জেরিকো শহরের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে ওরা। দুনিয়ার সবচেয়ে পুরানো মানববসতি। এখানে ছয় হাজার বছর ধরে বাস করছে মানুষ, তাদের পরিত্যক্ত আবর্জনা মরু সমতলকে কয়েকশ ফিট উঁচু করে তুলেছে। বিধ্বস্ত পাঁচিলগুলো আবিষ্কার করেছে আর্কিওলজিস্টরা।

মেইন রোড ছেড়ে বাক নিল ড্রাইভার। রাস্তার দুপাশে বেশিরভাগ অ্যান্টিকসের দোকান, কিছু ক্যাফেও আছে, সব আরবদের। লোকালয় ছাড়িয়ে পাহাড়ি পথ ধরল ওরা, তারপর মেঠো পথে নেমে এল। পাউডারের মতো ধুলো ঢুকল ভেতরে, হাঁচি পেল পিটারের।

 আধমাইল সামনে পথটা দুভাগ হয়ে গেছে, ডান দিকেরটায় একটা সাইনবোর্ড নিষিদ্ধ এলাকা, মিলিটারি জোন। কিন্তু কোনো গার্ড নেই, সাইনবোর্ডটাকে আগ্রহ করে ডান দিকের পথেই গাড়ি চালাল সে।

 হঠাৎ করেই আকাশ ঢাকা বিশাল উঁচু একটা পাঁচিল দেখতে পেল পিটার–কালো, চওড়া। অর্ধেক আকাশ ঢেকে সামনে ওটা খাড়া একটা পাহাড়।

 আরো পাঁচশ গজ এগিয়ে গাড়ি থামাল ড্রাইভার, ক্যাবের আলো জ্বালল। ঘাড় ফিরিয়ে পিটারকে এক মুহূর্ত দেখল মেয়েটা। একটু কি করুণা ফুটল দৃষ্টিতে?

এখানেই, অস্ফুটে বলল সে।

ব্লেজারের ভেতরের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল পিটার।

না, আবার ইংরেজিতে বলল মেয়েটা। আপনার কোনো ঋণ নেই।

টোডা রাবা, ভাঙ্গা হিব্রুতে তাকে ধন্যবাদ দিল পিটার, দরজা খুলে নেমে পড়ল নিচে।

মরুর বাতাস স্থির কিন্তু হিম-শীতল, কাঁটাঝোঁপ থেকে বুনো ফুলের বিশ্রী গন্ধ আসছে।

সালোম, খোলা জানালা দিয়ে পিটারের দিকে তাকিয়ে বিদায় জানাল মেয়েটা, দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরতি পথে চলে গেল। গাড়ির নাক ঘোরার সময় হেডলাইটের আলোয় সামনে পাম গাছের ঝাড় দেখতে পেল পিটার।

 গাড়ির টেইল লাইট অদৃশ্য হয়ে গেল। সেদিকে পিছন ফিরল পিটার। নির্জন মরুতে একা ওকে ফেলে রেখে গেল নাকি? চাঁদ আর তারার আলোয় বেশিদূর দেখা গেল না। দৃষ্টিপথে বাধা হয়ে আছে পাম ঝাড়। কোথায় থেকে কোনো শব্দ না পেয়ে ধীরপায়ে এগোল পিটার, পাম ঝাড়ের ভেতর ঢুকে পোড়া পোড়া একটা গন্ধ পেল, খানিক দূরে গাছের মাথায় ক্ষীণ নীলচে ধোয়ার আভাস। ঝড়ের বাইরে, ওদিকে কোথাও থেকে একটা ছাগল ব্যা করে উঠল। তারপর ঝাঁকিয়ে কেঁদে উঠল একটা শিশু।

মরুর মাঝখানে এটা একটা মরুদ্যান, সম্ভবত বেদুইন যাযাবররা আস্তানা গেড়েছে। হঠাৎ করে ফাঁকা জায়গাটায় বেরিয়ে এল পিটার, চারদিক থেকে পাম ঝাড় দিয়ে ঘেরা। পশু আর জানোয়ার নদের শুকনো বিষ্ঠা ছড়িয়ে আছে নুড়ি পাথর আর ঝুরঝরে বালির ওপর, দ্রুত হাঁটা অসম্ভব ব্যাপার।

ফাঁকা জায়গাটার মাঝখানে একটা কুয়া, চারধারে মসৃণ পাথরের উঁচু চাতাল। চাতালের ওপর কারো একটা আকৃতি দেখতে পেল পিটার, প্রথমে ঠিক চিনতে পারল না।

সেটার দিকে সাবধানে এগোল পিটার, অজানা ভয়ে দুরদুর করছে বুক। হঠাৎ নড়ে উঠল আকৃতিটা।

মানুষের একটা মূর্তি, অস্বাভাবিক লম্বা একটা আলখাল্লা পরে আছে, পাগড়িটা শুধু মাথা নয় চোখ আর ঠোঁট বাদ দিয়ে গোটা মুখ ঢেকে দিয়েছে। আলখাল্লা অস্বাভাবিক লম্বা, মনে হলো লোকটার দিকে হেঁটে নয়, অন্ধকারে উড়ে আসছে।

পাঁচ হাত দূরে থামল মূর্তিটা, মুখ ঢাকা পাগড়িটা উলের।

কে তুমি? জিজ্ঞেস করল পিটার, নিজের কানেই তো আর কর্কশ শোনাল। সন্ন্যাসী উত্তর দিল না, চওড়া আস্তিনসহ হাতটা আলখাল্লার ভেতর থেকে বের করে নাড়ল শুধু, তারপর পিছু নেয়ার ইঙ্গিত করল। দ্রুত ঘুরল সে, হনহন করে হেঁটে ঢুকে গেল পাম ঝাড়ের ভেতর।

অনুসরণ করল পিটার। একশ গজ এগিয়ে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করল, হাঁটায় লোকটার সাথে সাথে পারছে না। বারবার গাছের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে সে, খুব জোরে হেঁটেও তাকে দৃষ্টিসীমার মধ্যে ধরে রাখা যাচ্ছে না।

 পাম ঝাড় থেকে বেরিয়ে এল ওরা, চাঁদের আলোয় প্রায় আধমাইল দূরে দেখা গেল পাহাড়ের কালো গা, আকাশ থেকে খাড়া নেমে এসেছে মরুভূমিতে।

মেঠো একটা পথ ধরে এগোল ওরা। সরু, এবড়োখেবড়ো, আঁকাবাঁকা পথ–তবে নিয়মিত লোক চলাচল করে। এখানেও মাঝখানের দূরত্ব কমিয়ে আনতে ব্যর্থ হলো পিটার। উপলব্ধি করল, লোকটাকে ধরতে হলে দৌড়াতে হবে। সন্ন্যাসী লম্বা-চওড়া, ভারী মানুষ, এ ধরনের পথে তার এত দ্রুত হাঁটতে পারাটা রীতিমতো একটা বিস্ময়।

পাহাড়ের সামনে পৌঁছল ওরা, পথটা এঁকেবেঁকে ওপর দিকে উঠে গেছে। সন্ন্যাসীকে নিঃশব্দে অনুসরণ করল পিটার। খুদে পাথর আর বালি মেশানো আলগা মাটিতে বারবার পা পিছলে যাবার উপক্রম হলো। ধীরে ধীরে আরো খাড়া হচ্ছে পাহাড়ের গা। খানিক পর পায়ের নিচে নিরেট পাথর অনুভব করল পিটার, মসৃণ ধাপ।

একদিকে নিচের খাদ ক্রমশ গম্ভীর হতে থাকল, আরেক দিকে পাহাড়ের গা ওদের দিকে আরো বেশি হেলান দিচ্ছে, যেন ঠেলে কিনারার দিকে নিয়ে যেতে চাইছে ওদেরকে।

 সব সময় পিটারের সামনে আর দূরে থাকল সন্ন্যাসী। অক্লান্ত শরীর, পায়ে দ্রুতগতি। মসৃণ ধাপে তার পা কোনো শব্দ করছে না। নিঃশ্বাসে কোনো আওয়াজ নেই। এই আকারের একজন মানুষ দম না হারিয়ে একনাগাড়ে পাহাড়ে উঠছে, শুধু বোধ হয় অসুরের পক্ষেই সম্ভব। ঈশ্বরের নাম জপে যার দিন কাটে, এভাবে সে হাঁটতে পারে না। সন্ন্যাসী নয়, এ লোকের অন্য কোনো পরিচয় আছে। অদ্ভুত একটা সতর্কতা লক্ষ্য করছে পিটার তার মধ্যে, ভারসাম্য রক্ষায় ট্রেনিং পাওয়া যোদ্ধাকেও বুঝি হার মানাবে। খলিফা যেখানে জড়িত, সেখানে সব কিছুরই দ্বিতীয় একটা চেহারা থাকে।

 যতই উপরে উঠল ওরা, নিচের জ্যোৎস্না মাখা দৃশ্য ততই নয়নাভিরাম হয়ে উঠল। ধূ-ধূ মরুতে চিকচিক করছে বালি, দৈত্যকার পাহাড়গুলোকে চোখের ভুলে সচল বলে মনে হতে লাগল, দূরে ডেড সী–তারা জ্বলা আকাশের নিচে টলটলে রুপালি পর্দা।

একবারও বিশ্রাম নেয়নি ওরা, কত উঁচুতে উঠতে হবে? এক হাজার ফিট, দেড় হাজার ফিট? নিয়মিত, ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে পিটার, এখনো হাঁপ ধরেনি, হালকা ঘামে বাতাস লাগায় কপালে যেন বরফ ঠেকে আছে।

স্মৃতি থেকে কি যেন একটা নাড়া দিতে চাইল ওকে। কিসের যেন একটা গন্ধ পাচ্ছে ও। সব সময় নয়, মাঝেমধ্যে। মনে হলো পরিচিত গন্ধ। তারপর অনেকক্ষণ আর পেল না–অন্যান্য জোরালো গন্ধে হারিয়ে গেল সেটা।

ধোয়ার গন্ধ আসছে, তার সাথে আবর্জনা আর মানুষের ঘামের গন্ধ।

অনেক পাহাড়েই সন্ন্যাসীরা বসবাস করে, কিছু কিছু ফটোও দেখা আছে পিটারের চূড়ায় সার সার গুহা থাকে, গুহার পিছন দিকে থাকে সুড়ঙ্গ, ভেতরের অন্যান্য গুহায় যাওয়া যায়।

মিষ্টি গন্ধের কথা ভোলেনি পিটার।

খাদের কিনারা ঘেঁষে শেষ একশ ফিট উঠতে ভয় পেল পিটার। পা কাঁপতে শুরু করেছিল, অনেক কষ্টে থামল ও। পাথুরে টাওয়ারের গায়ে একটা কাঠের দরজা, বারো ফিট উঁচু, লোহার আঙটা লাগানো।

ওরা পৌঁছবার আগেই খোলে সেটা। ওদের সামনে সরু একটা পাথরে প্যাসেজ, দরজার ভেতর দেয়ালের গায়ে ছোট খোপে জ্বলছে নিঃসঙ্গ একটা লণ্ঠন।

দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই অন্ধকার দুপাশ থেকে হঠাৎ দুটো মূর্তি পিটারের গা ঘেষে এল। আত্মরক্ষার জন্যে প্রথম আঘাতটা ওই করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে স্থির হয়ে গেল শরীর। অস্ত্রের খোঁজে সার্চ করা হলো ওকে।

দুজনেই তারা সিঙ্গল-পীস কমব্যাট স্যুট পরে আছে, পায়ে ক্যানভাস প্যারাট্রুপার বুট। মোটা, কর্কশ, উলেন পাগড়ি মাথা আর মুখে পেঁচানো, শুধু চোখ আর নাক খোলা। প্রত্যেকের হাতে উজি সাবমেশিন গান, লোড আর কক করা, শোল্ডার স্ট্র্যাপের। সাথে ঝুলছে।

সন্তুষ্ট হয়ে পিছিয়ে গেল তারা, প্রথম সন্ন্যাসী আবার পিটারকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। সরু প্যাসেজ খানিক পর পর বাঁক নিয়েছে, প্রতিটি বাঁক গুনছে পিটার। সম্মিলিত কণ্ঠের একটা গুঞ্জন ঢুকল কানে, দূরাগত এবং অস্পষ্ট।

ধীরে ধীরে প্রার্থনার সুর পরিষ্কার হলো। গ্রীক অর্থোডকস্ চার্চের সার্ভিস-রহস্যময়, ভোতা আর কর্কশ লাগল কানে। এই লোমহর্ষক শব্দের সাথে ধূপের ধোয়া মিশে গিয়ে পরিবেশটাকে আরো গা ছমছমে করে তুলেছে। পথ দেখিয়ে পিটারকে একটা বিশাল গুহার ভেতর নিয়ে এল সন্ন্যাসী। আলো এখানে খুব কম, গুহার বিশালত্ব বা লোকজনের সংখ্যা আন্দাজ করা অসম্ভব। যতদূর দেখা গেল, গ্রীক সন্ন্যাসীদের বড় বড় মাথা দেখতে পেল পিটার, লম্বা কাঠের আসনে সার সার মূর্তির মতো প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে আছে। প্রতিটি মুখ প্রাচীন, সাদা দাড়িতে ঢাকা। জ্যান্ত শুধু চোখগুলো, মহামূল্য পাথরের মতো জ্বলছে। ধূপের ঝাঁঝাল গন্ধে শ্বাস নিতে কষ্ট হলো পিটারের। সন্ন্যাসীদের ভেতর দিয়ে হনহন করে এগোল ওরা, কারো মুখে প্রার্থনার একটা শব্দও জড়িয়ে গেল না বা বাদ পড়ল না। কেউ এমনকি ওদের দিকে তাকাল না বা নড়েচড়ে বসল না।

 চার্চের পিছন দিকে গাঢ় অন্ধকার, সন্ন্যাসীরা আছে কিন্তু দেখা যায় না। ঘড়ঘড় শব্দ করে পিটারের সামনে একটা প্রাচীন দরজা খুলে গেল। আওয়াজটা লক্ষ্য করে অন্ধকারে পা বাড়াল পিটার। এটা অসম্ভব একটা গোপন দরজা, শুধু সন্ন্যাসীরা জানে।

অন্ধকারে কিছুই দেখার উপায় নেই, হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে দিয়ে হাতড়ে এগোল পিটার সাবধানে। ছোট ছোট পাথরে ধাপ ঠেকল পায়ে। সোজা নয়, এঁকেবেঁকে নেমে গেছে সিঁড়িটা। গুনল পিটার, পাঁচশ ধাপ, প্রতিটি ছয় ইঞ্চি উঁচু।

অকস্মাত আরব মরুভূমির হিম-শীতল তারকাখচিত আকাশের নিচে বেরিয়ে এল পিটার। খোলা একটা উঠান, সমতল পাথরের মেঝে। সামনে পাচিলের মতো তাও পাথরের। দুর্গ-প্রাচীরের পর, হাজার, বারো কিংবা পনেরোশ ফিট নিচে উপত্যকা, ঝপ করে নেমে গেছে।

সাক্ষাতের জন্য এর চেয়ে দুর্গম আর সুরক্ষিত জায়গা হতে পারে না। খলিফা যে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্নে মাত্রা ছাড়িয়ে সতর্ক, আরেকবার উপলব্ধি করল পিটার। এখানে আরো সশস্ত্র প্রহরী দেখল ও।

আবার ওরা বিনা নোটিসে পিটারের গা ঘেঁষে এল। দুজন লোক দক্ষ হাতে সার্চ করল ওকে। এই ফাঁকে নিজের চারদিকে ভালো করে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল ও। পাহাড়ের গায়ে উঠানটাকে একটা কার্নিস বলা যেতে পারে, দুর্গ-প্রাচীর পাঁচ ফিট উঁচু। উঠানের দুদিকে পাহাড়ের গা কেটে তৈরি করা হয়েছে গুহা-মুখ, পাশাপাশি অনেকগুলো। সন্ন্যাসীরা যখন নিঃসঙ্গ হতে চায় গুহাগুলো ব্যবহার করে তখন।

উঠানে আরো লোক রয়েছে, মাথা আর মুখ উলেন কাপড় দিয়ে পেঁচানো। তাদের মধ্যে দুজন লোক টর্চলাইটের আলো ফেলছে আকাশে—উজ্জ্বল জোড়া রশি পিরামিডের আকৃতি তৈরি করেছে কালো আকশের গায়ে।

পিটার বুঝল, কোনো প্লেন সঙ্গে দিচ্ছে না ওরা। না, প্লেন হতে পারে না–নিশ্চই হেলিকপ্টার। এই ছোট উঠানে হেলিকপ্টরটাই শুধু নামতে পারবে।

সার্চ করা শেষ হলো, একজন লোক ইঙ্গিতে সামনে এগোতে বলল পিটারকে। প্রকাণ্ডদেহী সন্ন্যাসী একটা গুহা-মুখে ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে অপেক্ষা করছে।

 এগিয়ে গিয়ে মাথা নিচু করল পিটার, ঢুকে পড়ল গুহাটার ভেতর। কেরোসিন ল্যাম্পের মৃদু আলায় গুহার অন্ধকার দূর হয়নি। অমসৃণ একটা কাঠের টেবিল রয়েছে এক দিকের দেয়াল ঘেঁষে, টেবিলের ওপর দেয়ালে সাদামাটা একটা ক্রুশ। আর কোথাও কোনো অলংকরণ চোখে পড়ল না। পাথর কেটে খোপ বানানো হয়েছে কয়েকটা, পোকায় কাটা বই আর বাসন-পেয়ালা রাখা হয়েছে। এই গুহাটাও সম্ভবত স্বেচ্ছা-নির্বাসনের জন্যে ব্যবহার করা হয়।

ইঙ্গিতে পিটারকে ভেতরে ঢুকতে বললেও, প্রথমে সন্ন্যাসী গুহামুখের বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকল, হাত দুটো ঢোলা আলখাল্লার ভেতর ঢোকানো, মুখ ঘুরে আছে অন্য দিকে।

গুহা বা গুহার বাইরে উঠানে পিন-পতন স্তব্ধতা। তবে ইলেকট্রিসিটির মতো জ্যান্ত আর ধনুকের ছিলার মতো টান টান। কেউ নড়ছে না, সবাই অপেক্ষায়।

 আবার হঠাৎ সেই গন্ধটা পেল পিটার। এখানে, এই গুহার ভেতর। সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল, বিস্ময়ের একটা ছোট ধাক্কার মতো, গন্ধটা চিনতে পারার সাথে সাথে। সন্ন্যাসীর কাছ থেকে আসছে।

 বিদ্যুৎ চমকের মতো সন্ন্যাসীর পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেল পিটারের কাছে। দীর্ঘ কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে থাকল ও। দিশেহারা মনে হলো নিজেকে।

তারপর দুয়ে দুয়ে চারের মতো খাপে খাপে মিলে গেল প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত সব। জানে, এখন পিটার জানে!

ডাচ চুরুটের সুগন্ধ, এত পরিচিত যে ভোলার মতো নয়। চিনতে এত দেরি হলো সেটাই আশ্চর্য! প্রকাণ্ডদেহী সন্ন্যাসীর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকল পিটার।

বাতাসে এখন মৃদু গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে, লণ্ঠনের কাছে যেন পোকাদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। সামান্য একটু কাত করল মাথাটা সন্ন্যাসী, গভীর মনোযোগের সাথে শুনতে চেষ্টা করছে।

 বাঁচতে হলে মাথা ঠাণ্ডা রেখে অঙ্ক কষতে হবে পিটারকে, হিসাবে এক চুল ভুল করা চলবে না।

সন্ন্যাসী প্রতিপক্ষ, উঠানে দাঁড়ানো পাঁচজন সশস্ত্র লোক প্রতিপক্ষ। হেলিকপ্টার আসছে, ওতেও আছে একাধিক শত্রু।

সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো সন্ন্যাসী দল। এখন যখন তাকে চেনে পিটার, জানে, এই ট্রেনিং পাওয়া অকুতোভয় যোদ্ধা কোনো অংশে তার চেয়ে কম যায় না। দুজন কখনো লাগেনি, কিন্তু লাগলে কে জিতবে কে হারবে বলা সত্যিই কঠিন।

তারপর রয়েছে উঠানের পাঁচজন সশস্ত্র লোক। চোখ পিটপিট করে হঠাৎ উপলব্ধি করল পিটার, ওরা ওখানে বেশিক্ষণ থাকবে না। সহজ একটা হিসাব। একান্ত বিশ্বস্ত লেফটেন্যান্ট ছাড়া আর কারও সামনে নিজের চেহারা প্রকাশ করবে না খলিফা, যদি কেউ দেখে ফেলে তাকে মরতে হবে। পাঁচজনকে সরে যেতে হবে, তবে কাছাকাছি কোথাও অপেক্ষা করবে তারা-সম্ভবত কোনো গুহার ভেতর। হঠাৎ তৎপর হতে একটু সময় লাগবে ওদের।

তাহলে থাকবে শুধু সন্ন্যাসী আর খলিফা। হেলিকপ্টার চড়ে আসছে সে।

শব্দ শুনে পিটারের মনে হলো, এরই মধ্যে সরাসরি মাথার ওপর পৌঁছে গেছে যান্ত্রিক ফড়িং। ঘাড় বাঁকা করে ওপর দিকে তাকিয়ে রয়েছে সন্ন্যাসী! এই প্রথম তাকে অসতর্ক অবস্থায় দেখল পিটার।

ইঞ্জিনের আওয়াজ বদলে গেল, খাড়াভাবে কপ্টার নামাচ্ছে পাইলট। ল্যান্ডিং লাইটের আলোয় মৃদু আলোকিত হয়ে উঠল গুহার ভেতরটা।

 রোটরের বাতাস উঠানটাকে ঢেকে দিল ধুলোয়। চোখের সামনে একটা হাত তুলে গুহা মুখের দিকে আরো একটু সরে এল সন্ন্যাসী।

দোরগোড়ায় পৌঁছে ঘাড় ফিরিয়ে পিটারকে একবার দেখল সে। মাত্র এক পলক। তারপর আবার তাকাল উঠানে।

ঠিক এই মুহূর্তটার জন্যে অপেক্ষা করছিল পিটার। ফণা ভোলা কেউটের মতো ছুটে গেল ও। দশ ফিট পেরোতে হবে, সব শব্দ চাপা পড়বে কপ্টারের গর্জনে। লাফ দিল পিটার, আর ঠিক তখনই ওর দিকে তাকাল সন্ন্যাসী।

আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে সন্ন্যাসীর মাথা নিচু হলো, ডাইভ দিয়ে মাঝপথে রয়েছে পিটার-বাধ্য হয়ে টার্গেট বদলাতে হলো ওকে। ভেবেছিল একটাই কোপ মারবে ঘাড়ে যাতে সাথে সাথে মৃত্যু হবে। এখন আর তা সম্ভব নয়। সন্ন্যাসীর ডান কাঁধের ওপর আঘাত হানল ও, যেন বজ্রপাত হলো।

সন্ন্যাসীর ঘাড় আর হাতের জয়েন্টের মাঝখানে কলার-বোন খুঁড়িয়ে গেল, ইঞ্জিনের আওয়াজ সত্ত্বেও পরিষ্কার শব্দ পেল পিটার। বাঁ হাতে শত্রুর অসাড় কনুই খপ করে ধরে হ্যাচকা টানে উপরে তুলল, ভাঙা কলার-বোনের দুই অসমান প্রান্ত কর্কশ শব্দে ঘষা খেল পরস্পরের সাথে। কনুই ছাড়ল না পিটার, শক্ত করে ধরে মোচড়াতে লাগল, ভাঙা হাড় ক্ষুরের মতো মাংস কাটছে। তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল সন্ন্যাসী, কাঁধের অসহ্য ব্যথা কমাবার ব্যর্থ প্রয়াসে কোমরের কাছে ভাঁজ করল শরীরটা।

 যেই কোমর ভাঁজ করতে দেখল পিটার, হ্যাচকা টান দিয়ে দেয়ালের দিকে সবেগে ঠেলে দিল তাকে। পাথরের সাথে সংঘর্ষ হলো খুলির, সমতল মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ল সন্ন্যাসী।

দ্রুতহাতে তাকে চিৎ করল পিটার, আলখাল্লার ভেতর ডান কবজি ঢুকিয়ে দিল। ভেতরে প্যারাট্রুপার বুট আর থোর কমান্ডের পুরোদস্তুর নীল ওভারঅল পরে আছে লোকটা। ওয়েবিং বেল্টে চকচক করছে ব্রাউনিং হাই-পাওয়ার পয়েন্ট ফরটি ফাইভ পিস্তল। এক ঝটকায় কুইক-রিলিজ হোলস্টার থেকে বের করে নিল পিটার ওটা, বাঁ হাতের ঝাপটা দিয়ে কক করল। জানে, ভেলেক্স এক্সপ্লোসিভ লোড করা আছে।

 কলিনের মাথা আর মুখ থেকে উলেন পাগড়ি খসে পড়েছে। চওড়া হাসিখুশি মুখটা এই মুহূর্তে যন্ত্রণায় নীল, ব্রিজের ঠিক নিচে ভাঙা নাকটা আরো যেন বেঁকে রয়েছে। পোড়া চকলেট রঙের চোখজোড়া ভোলা, তবে দৃষ্টি নেই। পিটারের প্রিয় একটা মুখ। এই লোকের কাছ থেকে শ্রদ্ধা আর ভক্তি পেয়েছে ও। কিন্তু কে জানত…।

কলিনের চুলের ভেতর থেকে কপালে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত, তবে এখনো জ্ঞান হারায়নি সে। তার নাকের ব্রিজে ব্রাউনিংয়ের মাজল ঠেকাল পিটার। ভেলেক্স বুলেট তার খুলির মাঝখানটা ফুটো করে বেরিয়ে যাবে। লাফিয়ে পড়ার পর কখন যেন নকল দাড়িটা হারিয়েছে পিটার, কলিনের চোখে দৃষ্টি ফিরে আসতে দেখল ও। ক্ষীণ একটু বিস্ফারিত হলো চোখজোড়া, চিনতে পারছে।

 পিটার! না! কলিন মিনতি জানাল, কাতর চোখে প্রাণভিক্ষার আবেদন, আমি ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার!

বিস্ময়ের আঘাত পঙ্গু করে দিল পিটারকে। সেই সাথে বিস্ময়ের একটা ধাক্কাও অনুভব করল পিটার। ব্রাউনিংয়ের ট্রিগারে ছিল হলো ওর আঙুল। ধীরে ধীরে সিধে হলো পিটার, তিন সেকেন্ড একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল কলিনের মুখের দিকে, তারপর অকস্মাৎ তার আহত কাঁধের ওপর ঘাড় লক্ষ্য করে প্রচণ্ড এক লাথি মারল। জ্ঞান হারাল ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার। ঝট করে মাথা নিচু করে গুহার বাইরে বেরিয়ে এল পিটার।

উঠানে নেমেছে হেলিকপ্টার। কিন্তু আকাশে আরো একটা উজ্জ্বল আলো দেখল পিটার। সার্চ লাইট, গভীর খাদের তলায় কি যেন খুঁজছে।

উঠানেরটা বেল জেট র‍্যাঞ্জার, ফাইভ সিটার, গায়ে থোর কমান্ডের নীল আর সোনালি রঙ করা, বড় বড় হরফে লেখা : থোর কমিউনিকেশনস

কন্ট্রোল সামনে নিয়ে এখনো নিজের সীটে বসে রয়েছে পাইলট, একজন মাত্র আরোহী কেবিন থেকে নেমে এসেছে, দীর্ঘ পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে সে।

মাথার ওপর রোটর ব্লেড ঘুরতে থাকায় ঘাড় নিচু করে আছে সে, তবু তার শালপ্রাংশু দেহ-কাঠামো চিনতে পারল পিটার। মাথাটা প্রকাণ্ড, শরীরের তুলনায় কাধ দুটো একটু বেশি চওড়া। খুলির দুপাশে পাক ধরা সোনালি চুল রোটরের বাতাসে উড়ছে। তাকে আলোকিত করে আছে ল্যান্ডিং লাইটের চোখ ধাঁধানো আলো। কোনো শেক্সপিরিয়ান ট্রাজেডির কেন্দ্রীয় চরিত্র বলে মনে হলো তাকে পিটারের।

রোটরের তলা থেকে বেরিয়ে এসে সিধে হলেন ডক্টর কিংস্টোন পার্কার, আর এই প্রথম গুহামুখের সামনে পিটারকে দেখতে পেলেন। দাড়িটা নেই, সাথে সাথে পিটারকে চিনতে পারলেন তিনি।

সেই মুহূর্তে খাঁচার বন্দি সিংহের মতো লাগল ডক্টর পার্কারকে।

খলিফা! কর্কশ কণ্ঠে ডাকল পিটার, পরমুহূর্তে ডক্টর পার্কার চরকির মতো আধ পাক ঘুরে যেতে ওর সমস্ত সন্দেহের অবসান হলো। বিশাল ধড় নিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে ছুটলেন ডক্টর পার্কার, চোখের নিমেষে পৌঁছে গেলেন কেবিন দরজার সামনে।

ব্রাউনিং ধরা হাত তুলেই গুলি করল পিটার। সময় নিয়ে লক্ষ্যস্থির করেনি, তবে লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হলো না। প্রথম গুলিটা পিঠে লাগল, খোলা দরজা দিয়ে কেবিনের ভেতর ছিটকে পড়লেন ডক্টর পার্কার। ঠিক পিঠে নয়, কোমরে লেগেছে গুলিটা, বুঝতে পারল পিটার–মৃত্যু হবে না। হঠাৎ পরাজয়ের গ্লানি গ্রাস করতে উদ্যত হলো ওকে। হেলিকপ্টার উঠান ছেড়ে শূন্যে উঠে যাচ্ছে। খাড়াভাবে উঠছে, সেই সাথে ঘুরে যাচ্ছে দ্রুত।

এক ছুটে বিশ ফিট পেরোল পিটার, লাফ দিয়ে প্যারাপেটের মাথায় চড়ল। ওর মাথার ওপর দিয়ে সগর্জনে চলে যাচ্ছে জেট র‍্যাঞ্জার, পেটটা মানুষখেকো হাঙরের মতো সাদা লাইটের, ল্যান্ডিং আলো ধাধিয়ে দিল ওর চোখ। দুর্গ-প্রাচীরের ওপর দিয়ে উড়ে গেল যান্ত্রিক ফড়িং।

প্রাচীরে দাঁড়িয়ে দুহাতে ধরল পিটার ব্রাউনিংটা। সরাসরি ওপর দিকে গুলি করছে ও। ফুয়েল ট্যাংক কোথায় জানা আছে ওর। পিস্তল থেকে এক এক করে বেরিয়ে গেল কয়েকটা বুলেট, প্রতিবার কাঁধে ঝাঁকি খেল পিটার।

কপ্টারের পেট কামড়াল ভেলেক্স বুলেট, বিস্ফোরিত হয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। তবু নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে জেট র‍্যাঞ্জার। গুনছিল পিটার, ব্রাউনিং খালি হয়ে এসেছে।

সাতটা, আটটা-এই সময় হঠাৎ মাথার ওপর আকাশটা আগুনে ভরাট হয়ে গেল। হুস করে প্রচণ্ড একটা আওয়াজ হলো, দুর্গ প্রাচীরে কেপে উঠল পিটারের পা। শূন্যে চিৎ হলো জেট র‍্যাঞ্জার, ওটাকে মুড়ে ফেলেছে আগুন। তারপর ডিগবাজি খেতে শুরু করল, আগুনের গোলাটা সবেগে নেমে গেল গভীর খাদের দিকে।

 উঠানের দিকে ঘুরছে পিটার, চোখের কোণ দিয়ে দেখল কাঠের দরজা দিয়ে উঠানে বেরিয়ে আসছে লোকজন।

ওরা সবাই থোর কমান্ডের কমান্ডো, ট্রেনিং পাওয়া দক্ষ যোদ্ধা, ওদের নিজ হাঁটে ট্রেনিং দিয়েছে পিটার। তবু উঠানে ঢোকার কাঠের দরজার দিকেই ছুটল ও, পালাবার ওটাই একমাত্র পথ।

 তীব্র আলো আর যান্ত্রিক গর্জন, পিটারের পিছন দিক থেকে আসছে। কোনো সন্দেহ নেই, সবশেষে উদয় হতে যাচ্ছে মোসাড, ভাবল পিটার। দুর্গ প্রাচীর ধরে ঝড়ের বেগে ছুটছে ও।

বুলেট বৃষ্টি শুরু হলো এক সেকেন্ড পর। বাতাসে শিস কেটে কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল কয়েকটা। প্যারাপেট ধরে ছুটতে ছুটতেই শেষ বুলেটটা উঠানে দাঁড়ানো লোকগুলোকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ল পিটার। পরমুহূর্তে ধাক্কা খেল, ওর শার্টের আস্তিন ধরে কে যেন হ্যাচকা টান দিল। দুর্গ-প্রাচীরের কিনারা থেকে পড়ে গেল পিটার।

পতনটা অনন্তকাল স্থায়ী হবে, উপলব্ধি করে চোখ বুজল পিটার। গলার ভেতর থেকে একটা আর্তচিংকার বেরিয়ে আসতে চাইল। এক হাজার কি দেড় হাজার ফিট নিচে খাদের তলা। ধাক্কা খাওয়ার আগেই নিজের মৃত্যু কামনা করল পিটার।

প্যারাপেটের দশ ফিট নিচে সরু, বিশ ইঞ্চি চওড়া কার্নিসে একজোড়া কাঁটাঝোঁপ গজিয়েছে, শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে যেন পিটারকে বিদ্ধ করার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। ঝোঁপের মধ্যে পড়ে দোল খেতে শুরু করল পিটার, মটমট করে ভেঙে গেল কয়েকটা ডাল। ব্লেজার, মোজা, টাইয়ের ভেতর ঢুকে গেছে কাটা, মাংসে কামড় বসাচ্ছে।

অচেতন হওয়ার আগে ও শুনতে পেল, কলিন নোবলস্ চিৎকার করছে, সিজ ফায়ার! কেউ আর গুলি করবে না।

আর তারপর, অন্ধকার ঘিরে ধরল পিটারকে।

.

চেতন-অচেতনের সীমানায় পিটার, নানান কণ্ঠস্বর, টুকরো-টুকরো কথা, নির্দেশ শুনতে পাচ্ছে সে। কিন্তু কোনো মানে করতে পারছে না কিছুর।

এয়ারক্রাফটের হ্যাচওয়ে দিয়ে ওকে টেনে তোলার কথা মনে পড়ে, থোর কমান্ডের আহতদের উপযোগী স্ট্রেচারে করে তোলা হয় তাকে।

ম্যাগডা অল্টম্যানের লিয়ার জেটের স্মৃতিও ওর মনে আছে। কেবিনের ছাদের। হাতে আঁকা ছবি। মাথার উপরে প্লাজমার বোতল। ক্রিস্টাল গ্লাসে রাখা ক্ল্যারেট। ওকে রক্ত দেয়া হচ্ছে। অসম্ভব ক্লান্ত পিটার–কিছুতেই ওর এখন কিছু আসে যায় না। দুদণ্ড ঘুমাতে চায় সে।

পরেরবার চোখ খোলার পর আলোকজ্জ্বল এক করিডোর দেখতে পেল পিটার। ট্রলির গতি অনুভব করতে পারছিল সে।

 মাথা কাত করে ম্যাগডার মিষ্টি মুখটা দেখতে পেল পিটার। ওর ট্রলির পাশে পাশে হাঁটছে।

 আমি ভালোবাসি, তোমাকে। বলল পিটার, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না ওর মুখ থেকে। ক্লান্তিতে চোখ বুজল পিটার।

 ওর অবস্থা কেমন? চমৎকার ফ্রেঞ্চে কেউ একজনের কাছে জানতে চাইল ম্যাগডা। একটা পুরুষ কণ্ঠস্বর উত্তর দেয়।

একটা বুলেট হৃৎপিণ্ডের খুব কাছে আটকে গেছে। ওটা বের করা জরুরি।

এরপর, পিটারের ভেইনে সুইয়ের একটা খোঁচা। জিষে পেন্টোখালের গন্ধ পেল সে। অল্প সময়ের মধ্যেই ঘোর অন্ধকার নামল চোখে।

খুব ধীরে চেতন জগতে ফিরে এল পিটার। বুকে বাঁধা একটা ব্যান্ডেজ ওর শ্বাসে বাধা দিচ্ছে।

এরপর ওর চিন্তার জগত অধিকার করে নিল ম্যাগডা অল্টম্যান। কী অসামান্য সুন্দরী মেয়েটা! সম্ভবত ওর অচেতনতার সময়টাতে ম্যাগডা পাশেই ছিল সর্বক্ষণ। চোখ মেলার পর তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

ধন্যবাদ, ডার্লিং ফিসফিসায় ম্যাগডা, আমার কাছে ফিরে আসার জন্যে ধন্যবাদ।

তারপর? লা পিয়েরে বেনিতের রুম। উঁচু ছাত, কারুকার্জ করা; বাইরে লন থেকে অপূর্ব হ্রদ দেখা যায়। প্রকৃতিতে বসন্তের আগমনী বার্তা। পাতায় ছেয়ে গেছে হ্রদের ধারের প্রতিটি গাছ। পুরোটা কামরা ফুলে ফুলে ভরে রেখেছে ম্যাগডা। ওর পাশে আছে সবসময়।

অল্টম্যান ইন্ড্রাস্ট্রির বোর্ডরুমে যখন হেঁটে গেলে তুমি, কি ঘটল? পিটারের করা অন্যতম প্রথম প্রশ্ন ছিল ওটা।

 বিহ্বলতা, শেরি, মুচকি হাসে ম্যাগডা। সেই পাগল-করা, খসখসে স্বরের হাসি। ওরা ততক্ষণে নিজেদের মধ্যে আমার কোম্পানি ভাগ-বাটোয়ারা করে ফেলেছে!

লা পিয়েরে বেনিতে পিটার থাকাকালে আটদিন পর্যন্ত দর্শনার্থী এল। জানালার পাশে চেয়ারে বসতে হলো ওকে।

পিটারের চেয়ারের পাশে বসে থেকে ওকে আগলে রাখল ম্যাগডা-কিছুতেই যেন কোনো শারীরিক চাপ না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখল।

প্রভুর তিরস্কার করা কুকুরের মতো রুমে প্রবেশ করেছিল কলিন নোবলস। ডান হাতটা স্লিং-এ বাধা, বুকের সঙ্গে ঝুলছে। ভালো হাত দিয়ে ওটা ধরে রেখেছিল সে।

যদি জানতাম, তিক্ত কণ্ঠে বলে উঠল কলিন নোবলস, স্যার স্টিভেন নয়, ওটা তুমি–তাহলে কি ভুলেও এই বান্দা পেছন ফিরত তোমার দিকে।

পিটারের কাঁধে এক হাত রেখে দাঁড়িয়ে ম্যাগডা। মুখ শক্ত হয়ে গেছে তার।

ধীরে, পিটার, ফিসফিস করে সতর্ক করে সে।

একটা ব্যাপার বল তো আমাকে, হিসহিস করে উঠে পিটার। মেলিসা জেইনের কিডন্যাপিংটা তুমি আয়োজন করেছিলে, কলিন?

মাথা নাড়ে কলিন। শপথ করে বলছি। পার্কার তার অন্যান্য এজেন্টদের ব্যবহার করেছিল। আমি জানতাম না এমন কিছু ঘটবে।

ক্ষমাহীন চোখে তার দিকে চেয়ে রইল পিটার।

মেলিসাকে উদ্ধার করার পর আমি জানতে পারি কাজটা খলিফার। আগে জানলে বাধা দিতাম। খলিফাও সেটা জানত। সেজন্যেই দায়িত্বটা আমাকে দেয়নি সে। দ্রুত কথা বলছে কলিন, জরুরি ভঙ্গিতে।

পার্কার আসলে চেয়েছিল কি? হিসহিস করে উঠল পিটারের গলা।

তিনটে জিনিস। এক, তোমাকে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিল, সে খলিফা নয়। সেজন্যেই কৌশলে নিজেকে খুন করার প্রস্তাব পাঠায় তোমার কাছে। অবশ্যই তুমি তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারতে না। তারপর মেলিসাকে উদ্ধার করার সুযোগ করে দেয়া হয় তোমাকে। খলিফা নিজে ফোন করে শওনেসির নাম আর ঠিকানা জানিয়ে দেয়। তারপর তোমাকে লেলিয়ে দেয়া হয় ব্যারনেস ম্যাগডা অল্টম্যানের পেছনে…, ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে ব্যারনেসের দিকে একবার তাকার কলিন। ওঁকে যদি তুমি খুন করতে পারতে, খলিফার মুঠোর ভেতর চলে যেতে তুমি।

এ-সব তুমি জানলে কখন?

মেলিসাকে উদ্ধার করার পর। তখন ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার কাভার ফাস না করে কিছুই আমার করার ছিল না। আমি শুধু মোসাডের মাধ্যমে ব্যারনেস অল্টম্যানকে সাবধান করে দেয়ার চেষ্টা করি।

কথাটা সত্যি, পিটার, শান্তগলায় বলল ব্যারনেস।

একটু একটু করে শিথিল হয় পিটার।

খলিফা তোমাকে চীফ লেফটেন্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব দিল কবে থেকে?

তোমার কাছ থেকে থোর কমান্ডের দায়িত্ব বুঝে নেয়ার পরদিন! তোমাকে সে প্রথম থেকেই অবিশ্বাস আর ভয় করত, পিটার, সেজন্যেই তো থোর কমান্ডের কমান্ডার হতে দিতে চায়নি। আর তাই, থোর কমান্ড থেকে তোমাকে সরাবার প্রথম সুযোগটা সাথে সাথে কাজে লাগায়। তুমি বিদায় হয়েছ দেখেও স্বস্তি পায়নি, বুইলে রোডে খুন করার চেষ্টা করল। কিন্তু তারপর, তুমি বেঁচে যাওয়ায়, তোমার গুরুত্ব নতুন করে উপলব্ধি করল সে।

অ্যাটলাসের অন্যান্য শাখার কমান্ডারাও কি খলিফার নিজের নোক– মারকারির ট্যানার এবং ডায়ানার পিটারসন?

আমরা তিনজনই–হ্যাঁ। মাথা ঝাঁকাল কলিন। নিস্তব্ধ হয়ে গেল কেবিন।

আর কিছু জানতে চাও তুমি, পিটার? নরম স্বরে জানতে চায় কলিন। আর কোনো প্রশ্নঃ

এখন না, মাথা ঝাঁকায় পিটার, দুর্বলভাবে। তবে পরে আসবে।

কলিন ম্যাগডার দিকে তাকায়। ও কি এখনো শক্ত হয়েছে? পুরোটা কি বলতে পারি ওকে?

এক মুহূর্ত দ্বিধায় ভুগল ম্যাগডা। এরপর সায় দিল। হ্যাঁ, বলতে পার।

পশ্চিমা দুনিয়ার আস্তিনে লুকানো একটা ছুরি হলো অ্যাটলাস। নিজের শত্রুদের সামনে যে দুনিয়া নিজেকে নপুংসক করছে। অন্তত একবার হলেও এখন আমরা ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে লড়তে পারব। শক্তিশালী মানুষজন এবং দেশের একটা যোগসূত্র হলো অ্যাটলাস। খলিফা ছিল এক্সিকিউটিভ চিফ। এটাই ছিল একমাত্র এজেন্সি যা যে কোনো দেশের সীমানা অতিক্রম করতে পারে। এর দায়িত্ব ছিল পশ্চিমা দুনিয়ার নিরাপত্তা বিধান। এখন অ্যাটলাস পরিপূর্ণ–কেবল খলিফা নেই। জর্ডান উপত্যকার উপরে এক দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনায় মারা গেছে সে। কিন্তু অ্যাটলাস আছে। খলিফার অংশ নেই, কিন্তু দুনিয়ার প্রয়োজনে অ্যাটলাসকে থাকতে হবে। চিরঅস্থির দুনিয়ার এই সংগঠনই একমাত্র ভরসা আমাদের।

পিটার কখনো কলিনকে এত চমৎকারভাবে বলতে শোনে নি।

তুমি তো জানো, পিটার, তুমি ছিলে অ্যাটলাসের প্রধান হওয়ার তালিকায়। যা হোক, ভুল মানুষ তোমার উপরের পদ পেয়েছিল। কিংস্টোন পার্কারের সমস্ত গুণাবলি ছিল বলেই মনে হয়েছিল তখন। কিন্তু কিছু লুকোনো ব্যাপার ছিল তার মধ্যে–যা পরে প্রকাশ পায়। সুস্থ হাত তুলে গুনতে শুরু করল কলিন।

প্রথমত, তার সাহস ছিল না। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত ছিল সে। নিজেকে রক্ষা করাই তার প্রধান ধ্যান-জ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়।

 দ্বিতীয়ত, অসম্ভব উচ্চাকাক্ষি লোক ছিল সে। লোভ ছিল অসীম ক্ষমতার। অ্যাটলাসকে নিজের বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছিল সে। তার প্রথম লক্ষ্যই ছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্সি। অ্যাটলাসের মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধ্বংস করছিল সে। একবার প্রেসিডেন্সি পেলে যে কি করত–কেউ বলতে পারে না।

হাত মুঠো পাকাল কলিন।

 জেরিকোতে, কিংস্টোন পার্কারের সাথে তোমার মোলাকাতের ব্যাপারে বেশ ক-জন কলকাঠি নাড়ছিল। বিভিন্ন দেশের।

 বল ওকে, ম্যাগডা শান্ত স্বরে বলে। পুরোটা বল, কলিন। বেচারা বেশ দুর্বল। দ্রুত শেষ কর।

হ্যাঁ, কলিন সায় দেয়। গত দুপুরে, অ্যাটলাসের অধিনায়ক হিসেবে কিংস্টোন পার্কারের পর তোমার হওয়ার কথা গোপনে পাকা করা হয়েছে।

 পিটারের কাছে এ যেন বহুকাল বন্ধ থাকা একটা দরজা খুলে যাওয়ার মতন। নিজের ভবিষ্যত দেখতে পারছে সে, ওই দরজার ওপাশে।

ওই পদের জন্যে শারীরিক সামর্থ এবং মানসিকতা মিলিয়ে তুমি যোগ্যতম লোক।

এমনকি নিজের দুর্বল, আহত শরীরেও শক্তির জোয়ার অনুভব করে পিটার। যেন আজকের মতো কোনো সময়ের জন্যেই ওর মধ্যে সঞ্চিত ছিল এই শক্তি।

অ্যাটলাসের কমান্ড নেবে তুমি? কলিন বলে। কি উত্তর নিয়ে যাব আমি, তোমার পক্ষ থেকে?

ম্যাগডার লম্বা আঙুলগুলো পিটারের কাধ আঁকড়ে ধরে রাখে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার সিন্ধান্ত জানায়। সাথে সাথেই উত্তর দেয় পিটার। আর কোনো পথ যে নেই–ওটাই তার নিয়তি।

 আমি রাজি, পরিষ্কার, দৃঢ়স্বরে জানায় সে। তুমি ওদের বলতে পারো, এই দায়িত্ব নিলাম আমি।

আরাধ্য একটি মুহূর্ত। দীর্ঘ একটা সেকেন্ড কেউ হাসে না, কথাও বলে না। আর তারপর, আস্তে আস্তে ম্যাগডা বলে, খলিফা মারা গেছে। সে দীর্ঘজীবী হোক!

মাথা উঁচিয়ে তাকে দেখল পিটার স্ট্রাইড। কণ্ঠস্বরে বরফের শীতলতা।

জীবনে কখনো ওই নামে ডাকবে না আমাকে! বলল সে।

আলতো করে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয় ম্যাগডা, পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে পিটারের পানে তাকিয়ে গাঢ় চুমো খায় ওর ঠোঁটে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *