০৮.
ঝেং-এর বাচ্চাটা বোধহয় টুকুনের অবস্থা বুঝতে পারে। আজ যে টুকুন মন খারাপ করেছে মনে হচ্ছে সে বুঝতে পারছে। কারণ সে ঘুরছে টুকুনের পায়ে পায়ে। টুকুন বিছনায় এসে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর সেও বিছানায় এসে টুকুনের পাশে বসে রইল। তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। টুকুন বলল,
আজ আমার খুব মন খারাপ।
ঝেং-এর বাচ্চা কান নাড়ল। যেন সে বুঝতে পারছে।
অনেকগুলি কারণে মন খারাপ। প্রথম কারণ– আমার জন্যে ছোট ফুপু আজ কেঁদেছেন। আর দ্বিতীয় কারণ, আমার কথা কেউ বিশ্বাস করছে না। বাবার ধারণা, আমি পাগল হয়ে গেছি। আচ্ছা, আমি কি পাগল হয়েছি?
ঝেং-এর বাচ্চা উত্তর দিল না। কান নাড়ল। কান নেড়ে বুঝিয়ে দিল –না।
কি করি বল তো?
ঝেং-এর বাচ্চা কিছু বলল না। টুকুন কেঁদে ফেলল। এম্নিতে সে কাঁদে না। বড় হয়েছে তো। বড় হলে কাঁদতে নেই। ঝেং-এর বাচ্চা টুকুনকে কাঁদতে দেখে বিছানা থেকে নেমে গেল। রবারের বলের মত ঝাঁপ দিয়ে পড়ল মেঝেতে। পড়েই বলের মত কয়েকবার উঠানামা করে গড়াতে গড়াতে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে টুকুন দেখল বালিশের কাছে তার রঙের বাক্স পড়ে আছে। আশ্চর্য কাণ্ড। তো! রঙের বাক্সটা বাবা ড্রয়ারে তালাবন্ধ করে রেখেছিলেন। ঝেং নিশ্চয়ই নিয়ে এসেছে। সে কি তালা না খুলেই নিয়ে এসেছে?
টুকুনের মন একটু একটু ভাল হতে শুরু করেছে। রঙ দিয়ে দেয়ালে সুন্দর একটা ছবি আঁকলে মনটা হয়তো পুরোপুরি ভাল হয়ে যাবে। ঝেং-এর বাচ্চার একটা বড় ছবি। কেউ যদি দেখতে চায় তাহলে –ছবি দেখালেই হবে।
সন্ধ্যার মধ্যে টুকুন সারা দেয়াল জুড়ে প্রকাণ্ড একটা ছবি আঁকল। কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে ঝেং-এর বাচ্চাটাকে! গোলাপী চোখ, নীল দত। লম্বা লম্বা কান।
সন্ধ্যার পর রশিদ সাহেব ছেলের ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে দেয়ালে আঁকা ছবি দেখলেন। শান্ত গলায় বললেন, ছবি তুমি এঁকেছ টুকুন?
জি বাবা। সুন্দর হয়েছে না?
হ্যাঁ, ছবি সুন্দর হয়েছে। এটাই কি তোমার সেই বিখ্যাত ঝেং-এর বাচ্চা?
জি।
তুমি কি ড্রয়ারের তালা খুলে তোমার রঙ-তুলির বাক্স বের করেছ?
না বাবা। ঝেং-এর বাচ্চা এনে দিয়েছে।
রশিদ সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, ঝেং-এর বাচ্চা এনে দেয়নি। তুমি নিজেই। এনেছ। টেবিলের উপর চাবি ছিল। চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলে এনেছ। তুমি একসঙ্গে অনেকগুলি অপরাধ করেছ। প্রথম অপরাধ –আমার ড্রয়ার খুলেছ। দ্বিতীয় অপরাধ –দেয়ালে ছবি এঁকেছ। তৃতীয় অপরাধ –মিথ্যা কথা বলেছ। চতুর্থ অপরাধ– তোমার ছোট ফুপুকে মাথামোটা বলেছ।
আমি বলিনি বাবা। কাক বলেছে।
কাক কিছু বলেনি টুকুন। কাক কিছু বলতে পারে না। তুমি বানিয়ে বানিয়ে বলেছ, দোষটা দিচ্ছ কাককে। আমি বাচ্চাদের শাস্তি দিতে চাই না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তোমাকে শাস্তি দেয়া দরকার। কি শাস্তি দেয়া যায় বল তো?
আমি জানি না বাবা।
কি তুমি সবচে ভয় পাও?
বাথরুমে আটকা পড়ে গেলে আমি খুব ভয় পাই।
বেশ, তাহলে তাই করা হবে। তোমাকে বাথরুমে আটকে রাখা হবে। যতক্ষণ না তুমি সব অপরাধ স্বীকার কর ততক্ষণ বাথরুমে বন্দি থাকবে।
টুকুনের কান্না এসে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে কান্না আটকে বলল, কখন আটকাবে বাথরুমে?
এইত এখন। এসো আমার সঙ্গে?
বাতি কি নিভিয়ে দেবে, না বাতি জ্বালানো থাকবে?
বাতি নেভানো থাকবে।
টুকুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ছোটদের এরকম শাস্তি দেয়া কি উচিত?
না, উচিত নয়। কিন্তু ছোটদেরও এ জাতীয় অপরাধ করা উচিত নয়– সে কারণেই শাস্তি। অপরাধ করলে শাস্তি হয়। অপরাধীর কোন বড় ছোট নেই। বুঝতে পারছ?
পারছি।
তিনি ছেলেকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন বাতি নেভাবেন না। বাথরুম অন্ধকার হলে শাস্তি বেশি হয়ে যাবে। শেষে ঠিক করলেন, নেভাবেন। কিছুটা ভয় টুকুনের পাওয়া দরকার।
রশিদ সাহেব চিন্তিত মুখে তার লেখার টেবিলে গেলেন। ছেলেটাকে নিয়ে খুব সমস্যায় পড়া গেছে। কি করা যায় কিছুই বুঝতে পারছেন না। মানসিক অশান্তির কারণে তাঁর নিজের লেখাও এগুচ্ছে না। একি কান্ড! উপন্যাসটা প্রায় শেষ করে নিয়ে এসেছেন –দ্রুত লিখছিলেন। গল্পটা সুন্দর দাঁড়া হয়েছিল। এখন আর এগুচ্ছে না।
লেখার টেবিলে বসে রশিদ সাহেব চমকে উঠলেন। লেখা কাগজগুলি নেই। তিনি টেবিলে খুঁজলেন, মেঝেতে খুঁজলেন। না, কোথাও কিছু নেই। মাঝে মাঝে মৃদুলার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে লেখার কাগজ বইয়ের আলমিরায় ঢুকিয়ে রাখেন। বোধহয় তাই করেছেন– তিনি বইয়ের আলমিরা খুললেন। না, লেখার কাগজ নেই। শুধু যে তাই — তা না আলমিরায় বইও নেই। বিরাট আলমিরা, ঠাসা ছিল বই-এ। কালও বইগুলি ছিল। রাতে শোবার সময় বই নিয়ে পড়েছেন। এখন নেই। একটি বইও নেই। কোথায় যাবে এতগুলি বই? ব্যাপারটা কি?
রশিদ সাহেব রান্নাঘরে ঢুকে ক্লান্ত গলায় ডাকলেন, মুনা মুনা।
মুনা এল।
রশিদ সাহেব বললেন, আমাকে এক কাপ চা দাও –আর বাড়িটা একটু ঘুরে ফিরে দেখ তো তুমি কোথাও কোন পরিবর্তন দেখছ কিনা। মনে হচ্ছে ভয়ংকর কিছু ঘটেছে।
মুনা হতভম্ব গলায় বললেন, দেয়ালের ছবিগুলি কোথায়? ছবি?
দেখা গেল –ঘরের দেয়ালে কোন ছবি নেই– ফ্রেম আছে, কিন্তু ছবি নেই। মিনিট পাঁচেক সময়ের মধ্যে তাঁরা আবিষ্কার করলেন –ঘরে কোন কাগজ নেই। এক টুকরো কাগজও নেই।
মুনা ছুটে গিয়ে স্টীলের আলমিরা খুললেন। আলমিরার ভেতর সার্টিফিকেট রাখা আছে। জমির দলিল আছে। কিছুই নেই। সংসার খরচের টাকা আলাদা করা ছিল টিনের কৌটায়। তাও নেই। পুরো বাড়ি কাগজ শূন্য।
রশিদ সাহেব বললেন, ব্যাপার কি কিছু বুঝতে পারছ?
মুনা ভীত গলায় বললেন, পারছি।
তোমার অনুমানটা কি বলতো?
মুনা ইতস্ততঃ করে বললেন, ঝেং এর বাচ্চা খেয়ে ফেলেছে।
অপলাকে টেলিফোন করে আসতে বল। এক্ষুণি আসতে বল।
ও এসে কি করবে?
সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে কি করা বা না করা।
মুনা বললেন, টুকুন কোথায়?
ওকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে।
কি শাস্তি?
কি শাস্তি তা পরে বলব। এখন তুমি অপলাকে আসতে বল। এক্ষুণি আসতে বল। আমার হাত-পা কাঁপছে। কি সমস্যা বলতো?
.
টুকুন একা একা বাথরুমে দাঁড়িয়ে আছে। সে ক্রমাগত কাঁদছে। শার্টের হাতায় চোখ মুছছে। ইচ্ছা করছে চিৎকার করে বলে –বাবা, এতদিন আমি যা বলেছি বানিয়ে বানিয়ে বলেছি। আর বলব না। ঝেং-এর বাচ্চা বলে কিছু নেই। সব মিথ্যা। সব মিথ্যা। আবার প্রচণ্ড অভিমানও হচ্ছে। কারণ সে জানে যা ঘটছে সবই সত্যি। মিথ্যা কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
মিষ্টি করে কে যেন ডাকল টুকুন!
টুকুন ভয়ঙ্কর চমকে উঠল। তাকিয়ে দেখে ঝেং-এর বাচ্চা বেসিনের উপর বসে আছে। অন্ধকারেও তাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সেই কি কথা বলছে? খুব হালকা গলা। ফিস ফিস করে কথা বলছে। এত অস্পষ্ট যে প্রায় বোঝাই যায় না।
তুমি কথা বলতে পার?
হু।
তাহলে এতদিন কথা বলনি কেন?
কথা বলতে আমার ভাল লাগে না। খুব কষ্ট হয়।
তাহলে এখন কথা বলছ কেন?
আমার জন্যে তুমি শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছ এই জন্যেই কথা বলছি। শোন টুকুন, আমি ঠিক করেছি –আমি চলে যাব।
কি বললে?
আমি চলে যাব।
কেন?
আমি থাকলেই তোমার নানান সমস্যা হবে। কি দরকার। তোমাকে যখন বাথরুমে দরজা বন্ধ করল তখন এমন রাগ লাগল যে তোমাদের বাসার সব কাগজ খেয়ে ফেলেছি।
সে কি?
কাজটা ঠিক হয়নি। ভুল হয়েছে। ঝেং-এর বাচ্চারা কখনো ভুল করে না। আমি রাগের কারণে ভুল করে ফেলেছি –তবে ভুল করলে ভুল শুধরানো যায়। আমি যেসব কাগজ খেয়ে ফেলেছি সব আবার ফেরত দিয়ে যাচ্ছি। যাই টুকুন।
আর কিছুক্ষণ থাক। অল্প কিছুক্ষণ।
না টুকুন। আমি যাই।
ঝেং-এর বাচ্চা চলে গেল কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ঝেং এর বাচ্চাই কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে।
বাথরুমের দরজায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে।
টুকুন ভয় পেয়ে বলল, কে?
আমি, আমি দাঁড়কাক। তোমাকে এরা বাথরুমে আটকে রেখেছে শুনে খুবই মন খারাপ হল। তোমাকে সাহস দেবার জন্যে এসেছি।
আপনাকে ধন্যবাদ। আমি বাথরুমে আটকা পড়েছি আপনাকে কে বলল?
ঝেং-এর বাচ্চা বলল, ও দেখি কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে। শোন টুকুন, আমি ঠিক করেছি আমিও আর তোমার কাছে আসব না। আমার জন্যেও তোমার সমস্যা হচ্ছে। হচ্ছে না?
হচ্ছে।
আমার মনে হয়, তোমার বাবাকে তুমি বল যে এতদিন যা বলেছ –সব বানিয়ে বানিয়ে বলেছ, আর বলবে না। তাহলে তোমার সমস্যা মিটে।
আচ্ছা বলব।
মিথ্যা কথা বলা হবে –উপায় কি! মানুষ মিথ্যাটাই সহজে বিশ্বাস করে। মানুষ বড়ই অদ্ভুত জীব।
.
বাথরুমের বাতি জ্বলে উঠল।
রশিদ সাহেবের ভয়ার্ত গলা শোনা গেল –টুকুন! টুকুন!
জি।
বেশি ভয়ে পেয়েছিস?
না বাবা।
তিনি বাথরুমের দরজা খুলে টুকুনকে কোলে তুলে নিলেন। বাবার পাশে মা দাঁড়িয়ে আছেন। মার পাশে ছোট ফুপু। তাদের পেছনে রহিমার মা। রহিমার মার কোলে মৃদুলা। মৃদুলা ঘুমুচ্ছে।
টুকুন ফুপাতে ফুপাতে বলল, এতদিন যা বলেছি সব বানিয়ে বানিয়ে বলেছি, বাবা। আর কোনদিন বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলব না।
রশিদ সাহেব অবাক হয়ে তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মুনা তাকাল অপলার দিকে।
টুকুন ছোট ফুপুর দিকে তাকিয়ে বলল, ছোট ফুপু! আসলে আমিই তোমাকে মাথামোটা বলেছি। আর কোনদিন বলব না।
টুকুন শব্দ করে কাঁদতে লাগল। অপলা এসে টুকুনকে কোলে নিল। অপালার নিজের চোখেও পানি এসে গেছে। সে ইতস্ততঃ করে বলল, টুকুন, হয়ত তোর কথাই ঠিক। হয়ত ঝেং-এর বাচ্চা বলে একটা কিছু আছে যে কাগজ খায়। হয়ত আমরাই ভুল করেছি।
টুকুন বলল, তোমরা কোন ভুল করনি। সব আমার বানানো।
তারা সবাই শোবার ঘরে ঢুকল। রশিদ সাহেব দেখলেন –লেখার টেবিলে তার লেখা ঠিকঠাক আছে। আলমিরার বই সব আছে। দেয়ালের ছবিও ফিরে এসেছে –শুধু একটা ছবি উল্টো হয়ে গেছে। মাথাটা নিচের দিকে।
রশিদ সাহেব দীর্ঘ সময় উল্টো হয়ে যাওয়া ছবিটির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, অনেকদিন ধরে আমরা কোথাও বেড়াতে যাই না। বলতে গেলে ঘরের মধ্যে বন্দি। মনে হচ্ছে এজন্যেই আমাদের সবার মাথা খানিকটা জট পাকিয়ে গেছে –দল বেঁধে সবাই সমুদ্রের কাছে গেলে কেমন হয়?
টুকুন বলল, খুব ভাল হয় বাবা।
.
টুকুনরা খুব আনন্দ করে সমুদ্রের কাছ থেকে ঘুরে এল।
তারপর কতদিন কেটে গেল। তাদের বাড়িটার কত অদল-বদল হল— শুধু উল্টে-যাওয়া ছবিটা সেই জায়গাতেই রইল। রশিদ সাহেব প্রায়ই এই ছবিটার সামনে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকেন। ছবিটার দিকে তাকিয়ে তিনি কি ভাবেন তা কাউকে বলেন না। কেউ জানতেও চায় না। এই পৃথিবী বড়ই বিচিত্র! এই পৃথিবীর সব রহস্য জানতে চাওয়া ঠিক না।