গঙ্গামহলে জরুরি আলোচনা বসেছে। আলোচনায় গণ্যমান্য সকলেই আছেন। দ্বিজেন্দ্র, বীণাবালা, বিভূতিনাথ সাহা, ভুজঙ্গ দেব, গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে, এমনকি দিবাকর চাটুজ্জেও রয়েছেন।
শেষ অবধি সিন্দুক খোয়া যাওয়ার কথা সকলকেই জানালেন বীণাবালা। কেবল দীপেন্দ্রনারায়ণের বিষয়ে কোনো কথা বললেন না। তবে বেণুচন্দের বাজারে লখাই স্যাকরার দোকানে পাওয়া স্বর্ণালঙ্কারের কথাও বললেন। শুনে উপস্থিত সকলেই দারুণভাবে চমকে গেলেন। মজার বিষয় হচ্ছে চমকে গেলেন দিবাকর চাটুজ্জেও। দিবাকর চাটুজ্জে ভেবে পাচ্ছেন না, ওই সিন্দুকের স্বর্ণালঙ্কার লখাই স্যাকরার দোকানে কে বিক্রি করতে নেবে! দীপেন্দ্রনারায়ণ তার ভাগের যা তাকে দিয়ে গেছেন, তা তিনি অতি যত্নে সবচেয়ে দুর্ভেদ্য জায়গায় লুকিয়ে রেখেছেন। তিনি অতটা বোকাও নন যে সেই স্বর্ণালঙ্কার থেকে একটি টুকরোও তিনি এই বিষ্ণুপুরের আশেপাশের কোনো বাজারে বা স্যাকরার দোকানে বিক্রি করতে নেবেন! তাহলে?
দিবাকর চাটুজ্জে ভালো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। গঙ্গামহলের ওই সিন্দুকের স্বর্ণালঙ্কার সে আর দীপেন্দ্রনারায়ণ ছাড়া আর কারো কাছেই কিছু থাকার কথা নয়। তাহলে? এই বিষ্ণুপুর তল্লাটেই ও স্বর্ণালঙ্কার আর কার কাছে রয়েছে? তার চেয়েও বড় কথা কোন সাহসে সে আবার সেই অলঙ্কার বিক্রি করতে নিয়ে এসেছিল!
বৈঠকের বাদবাকি অংশে কী আলোচনা হলো তাতে আর মন বসাতে পারলেন না দিবাকর চাটুজ্জে। রাজ্যের দুশ্চিন্তা আর প্রশ্নে জট পাকিয়ে যাচ্ছিল বাদবাকি সকল ভাবনা। বৈঠকে আরো একজন মনোযোগ বসাতে পারলেন না। তিনি হলেন ভুজঙ্গ দেব। কেউ খেয়াল করলে দেখতে পেতেন, রাগে-ক্ষোভে তার দু’পাশের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। আলোচনায় বার কয়েক ভুজঙ্গ দেব আর দিবাকর চাটুজ্জেকে নানান প্রশ্ন এবং পরামর্শ চাইলেন বীণাবালা ও বিভূতিনাথ সাহা। কিন্তু এই দু’জনের কেউই সেই অর্থে আলোচনায় অংশ নেয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন না। বিষয়টি বীণাবালার দৃষ্টি এড়াল না। তিনি আসলে অনেক ভেবে-চিন্তে ইচ্ছে করেই এই বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল তিনি যাদের বিশ্বাস করেন, যাদের নিয়ে এই এতদিন সকল বুদ্ধি পরামর্শ, ষড়যন্ত্র করে এসেছেন, তাদের পরখ করে নিতে।
এমনিতেই ভয়ানক সন্দেহ প্রবণতায় ভুগছিলেন বীণাবালা। তার ওপর গত কয়েক মাস ধরে ভুজঙ্গ দেব এবং দিবাকর চাটুজ্জের নানা কর্মকাণ্ডে তাদের ওপর মনটাও বিষিয়ে ছিল তার। সুতরাং পুরো বৈঠকজুড়েই তাদের দু’জনের উপর আলাদা দৃষ্টি রাখছিলেন বীণাবালা। বৈঠকজুড়েই দিবাকর চাটুজ্জে আর ভুজঙ্গ দেবের সন্দেহজনক আচরণ বীণাবালাকে আরো সন্ধিগ্ধ করে তুলল। তিনি বৈঠক শেষ করলেন নিজের ভেতরে ভয়াবহ চাপা ক্রোধ নিয়ে। তিনি জানেন এই ক্রোধ তিনি যতদিন চেপে রাখবেন, ততদিন বাড়তেই থাকবেই। ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে থাকবে। তিনি দিন দিন হয়ে উঠবেন আরো ক্রোধোন্মত্ত। এই ক্রোধোন্মত্ত বীণাবালাকে তিনি নিজেই ভয় পান।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো, সকল স্যাকরাদেরকে জানিয়ে দেয়া হবে যে তারা যদি এই পুরনো স্বর্ণালঙ্কারের আদলে আর কোনো স্বর্ণালঙ্কারের খোঁজ পান, তাহলে তারা যেন সেই স্বর্ণালঙ্কার বিক্রেতাকে যেকোনো মূল্যে ধরিয়ে দেন। বিনিময়ে ওই স্বর্ণালঙ্কারসহ আরো বহুমূল্যবান স্বর্ণালঙ্কার তাদের উপহার দেওয়া। হবে।
সেই রাতে বীণাবালা ঘুমাতে পারলেন না। ঘুমাতে পারলেন না পরদিন রাতেও। তার বুকের ভেতর কী ভয়ংকর যন্ত্রণা! বিছানায় ঘুমাতে গেলেও তার মনে হচ্ছে পালঙ্কের তলায় কেউ ছুরি হাতে অপেক্ষা করছে। তিনি ঘুমানো মাত্রই সে সেই ছুরি হাতে উঠে এসে তার গলায় বসিয়ে দেবে। গত কয়েকমাস ধরেই তার এমন হচ্ছে। শেষ বৈঠকের পর এই অবস্থা আরো বাড়ল। দীর্ঘ অপেক্ষার পর সামান্য যেটুকু তন্দ্রার মতো লেগে আসে, তাও ভেঙে যায় খানিক পরপর। কিছুক্ষণ বাদ দিয়েই চমকে ওঠেন তিনি। এই অদ্ভুত অসুখের কথা। বীণাবালা কাউকেই বললেন না। কারণ এই অসুখের কারণ তিনি জানেন। গঙ্গামহলের অন্দরমহলে দিনে দিনে যে ষড়যন্ত্রের বিষবৃক্ষ তিনি বপন করেছিলেন তার পুরোটাজুড়েই ছিল অজস্র পরিকল্পনা, সন্দেহ, মিথ্যে এবং তার সদা সতর্ক স্নায়ু। অতন্দ্রপ্রহরীর ন্যায় সর্বক্ষণ জেগে ছিল তার সমগ্র সত্তা। কিন্তু দিন শেষে এসে তিনি এখন আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। যাদের এতদিন অন্ধের মতোন বিশ্বাস করে এসেছেন, আবার মুকুন্দর মতো যাদের। বিশ্বাস করার মতো গুরুত্বপূর্ণও ভাবেননি, তারাও যে হয়ে উঠতে পারে ছায়ায় লুকানো গুপ্ত-শিকারি, তা তিনি ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে পারছেন। এ তাকে চূড়ান্ত পর্যায়ের অস্থির ও সন্দেহবাতিকগ্রস্ত করে তুলতে লাগল। আবার অনেককেই পুরোপুরি সন্দেহ না করলেও পুরোপুরি নিঃসন্দেহও হয়ে উঠতে পারছেন না। এ এক অসহ্য মানসিক দশা। সদাসতর্ক বীণাবালা ক্রমশই অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন। তার মাথার ভেতর সর্বক্ষণ অজস্র সন্দেহ-ষড়যন্ত্রের গিজগিজে জীবাণুরা ক্রমাগত ফিসফিস করতে থাকে। সেই ফিসফিসানির কথাগুলো আলাদা করে শোনা যায় না, বোঝা যায় না। তবে তাদের শক্তি ক্রমশই বাড়তেই থাকে। চিৎকার বাড়তেই থাকে। তারা সহ্যের বাইরে চলে যায়। বীণাবালা কখনো কখনো নিজের ছায়া দেখেই ভয়ে থমকে যান। কেঁপে ওঠেন। ওই ছায়ার ভেতরই কী লুকিয়ে রয়েছে কোনো ছদ্মবেশী আততায়ী!
.
সেদিন গভীর রাতে বীণাবালা শোয়া থেকে উঠে বসলেন। তিনি আর পারছেন না। মনে হচ্ছে মাথার ভেতর অজস্র মৌমাছি একযোগে গুনগুন করছে। তিনি দু’হাতে মাথা চেপে বসে রইলেন। কিন্তু শব্দগুলো ক্রমাগত বাড়ছিল। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। বীণাবালার মনে হচ্ছিল শক্ত কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করলে তার ভালো লাগত। তিনি দেয়ালের সাথে আস্তে আস্তে মাথা ঠুকতে লাগলেন। তারপর আরও খানিক জোরে। আরো খানিক। তার মনে হচ্ছিল দেয়ালে মাথা ঠোকার সাথে সাথেই সেই অসহ্য গুঞ্জন মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। আবার মাথা সরিয়ে নিতেই গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। তিনি ক্রমাগত দেয়ালে মাথা ঠুকতে লাগলেন। তার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেতে থাকল। তিনি মাথা ঠোকার গতি আর শক্তি দু’টোই বাড়িয়ে দিতে থাকলেন।
কতক্ষণ দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকেছেন বীণাবালার মনে নেই। ভোরবেলা দাসী কমলা বীণাবালাকে পেল ঘরের মেঝেতে। বীণাবালা পড়ে রয়েছেন, তার মাথা রক্তাক্ত। দাসী কমলা চিৎকার করতে গিয়েও করল না। সে বীণাবালাকে পালঙ্কে তুলে দিলো। জল গরম করে তার মাথা মোছালো। বীণাবালার কপালে, মাথায় আঘাতের চিহ্ন। বীণাবালার জ্ঞান ফিরল বিকেলে। শান্ত সমাহিত জাগরণ। মাথার ভেতর সেই অসহ্য অনুভূতিটা আর নেই। তিনি আয়নার দিকে তাকিয়ে আঁৎকে উঠলেন, এ কী অবস্থা তার! কপাল ফুলে ঢোল হয়ে আছে। আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে কপালের, মাথার চামড়া। তবু বীণাবালার মুখজুড়ে প্রশান্তি। কত কত দিন পরে তিনি এমন শান্ত নদীর মতোন নিঃশব্দ হতে পেরেছেন। তার শরীরজুড়ে শান্তিময় অবসাদ। তিনি সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পড়লেন। তার ঘুম ভাঙল পরদিন ভোরে। পুরোপুরি সুস্থ স্বাভাবিক বীণাবালা। আবার সেই আগের আত্মবিশ্বাসী, তীক্ষ্ণ বীণাবালা। এই বীণাবালা কাউকে পরোয়া করেন না। যার ইচ্ছে যত ষড়যন্ত্র করুক, তিনি জানেন বিশ্বাসঘাতকদের কী করে শায়েস্তা করতে হয়।
.
দিবাকর চাটুজ্জে সেই রাতে ঘরে ফিরেই তার ভাগের স্বর্ণালঙ্কারগুলোকে ঘরের গোপন জায়গা থেকে সরিয়ে ফেললেন। এবার রাখলেন ঘোড়ার ঘরের মেঝে খুঁড়ে মাটির তলায়। তারপর সেই মাটির ওপর বসালেন ঘোড়ার জল খাবার হাড়ি। চারপাশে খড়পাতা বিছিয়ে দিলেন।
পরের দুটি দিন কেটে গেল ভয়াবহ দুশ্চিন্তায়। ওই স্বর্ণালঙ্কার আর কার কাছে থাকতে পারে? দিনভর ভেবেও কোনো জবাব পেলেন না দিবাকর চাটুজ্জে। তবে অস্থির হয়ে রইলেন প্রতিটি মুহূর্ত। পরদিন সন্ধ্যায় সামনের ঘরে বসে কি করছিলেন দিবাকর চাটুজ্জে! এই মুহূর্তে প্রচণ্ড শব্দ আর গোলমালে কেঁপে উঠল নীরব নিস্তব্ধ সন্ধ্যা। অনেকক্ষণ শব্দের কারণ বুঝলেন না দিবাকর চাটুজ্জে। তিনি মূল দরজা খুলে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। আর তৎক্ষণাৎ ই দেখতে পেলেন সরু লম্বাদেহী এক লোক পাগলের মতোন দৌড়ে ছুটে আসছে তার দিকেই। দিবাকর চাটুজ্জে ভড়কে গিয়ে সরে দাঁড়ালেন। কিন্তু লোকটা সেই ফাঁকে টুপ করে ঢুকে গেল তার বাড়ির ভেতর। তিনি কিছু বুঝে উঠবার আগেই লোকটা তার বাড়ির অন্দরমহলেও ঢুকে গেল। তিনি ঘুরে বাড়ির ভেতর ঢুকতে যাবেন। এই মুহূর্তেই দেখলেন দ্বিজেন্দ্র ঘোড়ার পিঠে ছুটে আসছে। তার সাথে আরো ক’জন পেয়াদা। সকলের হাতেই ধারালো অস্ত্র।
সন্ত্রস্ত দিবাকর চাটুজ্জে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই দ্বিজেন্দ্র কড়া গলায় বলল, কাউকে এদিকে আসতে দেখেছেন চাটুজ্জে মশাই? স্বর্ণালঙ্কার চোরের খোঁজ পাওয়া গেছে। কিন্তু ব্যাটা পালিয়েছে। তাকে ধাওয়া করেই আমরা এসেছি।
দিবাকর চাটুজ্জে কী বলবেন খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তার আগেই পেছন থেকে এক পেয়াদা বলল, আজ্ঞে কর্তাবাবু, আমি নিজ চোখে দেখেছি, চোরটা এই পথেই এ বাড়িতে ঢুকেছে। চলুন তাড়াতাড়ি। না হলে আবার পালাবে।
দ্বিজেন্দ্র আর দিবাকর চাটুজ্জের উত্তরের অপেক্ষা করল না। সে পেয়াদাদের নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। পেছন পেছন ঢুকলেন দিবাকর চাটুজ্জেও। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, সেই চোরের খোঁজে তার বাড়ির প্রতিটি কক্ষে তল্লাশি চালানো হলো। তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো মানুষটিকে। কিন্তু মানুষটিকে কোথাও পাওয়া গেল না। পাওয়ার কথাও নয়। মানুষটি খুব সহজেই বাড়ির পেছনের পাঁচিল টপকে পালিয়ে যেতে পারে। এর চেয়ে সহজ আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু দ্বিজেন্দ্র সেদিকে না গিয়ে তল্লাশি চালালো দিবাকর চাটুজ্জের বাড়ির অন্দরমহলের প্রতিটি কোণায়।
দিবাকর চাটুজ্জের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তিনি বীণাবালার সন্দেহের তালিকায় ঢুকে পড়েছেন। এই চোর পালানো আর তা খুঁজতে তার বাড়ি অবধি আসার ঘটনা পুরোটাই বীণাবালার সাজানো নাটক। সে আসলে দ্বিজেন্দ্রকে পাঠিয়েছে তার বাড়ি তল্লাশি করতে। তার বিরুদ্ধে এই চুরির বিন্দুমাত্র প্রমাণও যদি দাঁড় করাতে পারেন বীণাবালা, তবে দিবাকর চাটুজ্জের পরিণাম হবে ভয়াবহ! বীণাবালা কাউকেই ছাড়বেন না।
তবে তার ভাগ্য ভালো। সময়মতোই তিনি স্বর্ণালঙ্কারগুলো সরিয়ে রেখেছিলেন। এবারের মতো বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন। কিন্তু অতি সতর্ক না হলে বীণাবালার কাছ থেকে বারবার ভাগ্যের জোরে বাঁচা সম্ভব নয়।
.
বীণাবালা শুধু যে দিবাকর চাটুজ্জের বাড়ি তল্লাশি চালালেন, তা-ই নয়। তিনি তল্লাশি চালালেন গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে আর ভুজঙ্গ দেবের বাড়িতেও। তবে সবগুলো বাড়ি তল্লাশি চালানোর ধরন এক হলো না। হলো ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে। কিন্তু সবখান থেকেই বীণাবালাকে ফিরতে হলো বিফল মনোরথেই। ক্রুদ্ধ, ক্ষুদ্ধ, প্রতিহিংসাপরায়ণ বীণাবালা যেন এতে আরো তেঁতে উঠলেন।
সেই রাতে নায়েব গোপীনাথ সরকারকে সকলের সম্মুখে একশ’ চাবুক মারা হলো। গোপীনাথ সরকারের দোষ, তিনি গঙ্গামহলের এতদিনের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেননি। তার অবহেলায়ই গঙ্গামহল থেকে এই এত এত সম্পদ চুরি হয়েছে। তার এই শাস্তি গঙ্গামহলের সকল ভৃত্য, পেয়াদা, দাসী থেকে সকলের জন্যই এক উদাহরণ। কেউ যদি কখনো গঙ্গামহলের বিরুদ্ধে সামান্যতম ক্ষতিকর বা কোনো স্বার্থহানিকর কাজও করে, তবে তাকে এর চেয়েও ভয়ংকর পরিণতি ভোগ করতে হবে। বীণাবালা জানেন গোপীনাথ। সরকার নির্দোষ। কিন্তু এ যেন ঝিকে মেরে বউকে শেখানোর কৌশল।
অসুস্থ গোপীনাথ সরকার অবশ্য এই ধকল সইতে পারলেন না। তিনি চাবুক মারার কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা গেলেন। উন্মত্ত বীণাবালা সেই রাতে সকলের সম্মুখেই গোপীনাথ সরকারের লাশ ভাসিয়ে দিতে বললেন গঙ্গাবতীতে। ঈশান কোণে তখন মেঘ জমেছে। হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ায় উত্তাল হয়ে উঠেছে গঙ্গাবতী। গঙ্গাবতীর সেই উত্তাল জলে ভেসে গেল নির্দোষ গোপীনাথ সরকারের নিথর দেহ। উপস্থিত কেউ কেউ পরে নিজেদের মধ্যে বলছিল, গোপীনাথ সরকারের হাত নাকি জলের ভেতরও প্রার্থনার ভঙ্গিতে ভেসে ছিল। এ কী অদ্ভুত কথা!
মৃত গোপীনাথ সরকার কি গঙ্গাবতীর জলে বিচার চেয়ে গেল?
*
ভুজঙ্গ দেব বসে আছেন বারোহাটিতে রামচরণ কারিগরের ঘরে। রামচরণ কারিগর ভয়াবহ অসুস্থ। যেকোনো সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারে এই অবস্থা। অবশ্য এই অবস্থা যে তার এই প্রথম হচ্ছে তা নয়। এর আগেও বহুবার এমন হয়েছে। আসলে বারোহাটি বাগানবাড়ি তৈরীর ঘটনায় দেবেন্দ্রনারায়ণ যখন তার হাত কর্তনের ঘোষণা দিয়েছিল, সেই তখন থেকেই মনে মনে ভেঙে পড়েছিল রামচরণ কারিগর। প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিল। তারপর বিষ্ণুনারায়ণ তার সেই শাস্তি কমিয়ে তাকে কাজ থেকে স্থায়ী অব্যাহতি দিয়ে লঘু শাস্তি দিয়েছিলেন। সেই থেকে বলতে গেলে অতি প্রয়োজনে দু’চার বার ব্যতীত আর কখনো বাড়ির চৌহদ্দির বাইরেই যায়নি রামচরণ কারিগর। দিনে দিনে ভেতরে ভেতরে যেমন ক্ষয়ে গেছে সে, তেমনি ক্ষয়ে গেছে শরীরেও। কিন্তু মৃত্যু যেন তাকে শেষ অবধি নেয়নি।
রামচরণ কারিগর এই নিয়ে অনেক ভেবেছে। সে অদৃষ্টবাদী মানুষ। সে তার অদৃষ্ট মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু যতবার মৃত্যুর একদম কাছে গিয়ে ফিরে এসেছে, ততবারই তার মনে হয়েছে তার এই অদৃষ্টই কি তার মৃত্যুকে বিলম্বিত করছে! এই বিলম্বিত করার কারণ কী? কারণটি সে তার নিজের মতো করে খুঁজেও পেয়েছে। তার মনে হয়েছিল, এর কারণ তার অদৃষ্ট তাকে কিছু দেখাতে চেয়েছিল। এটা ভেবে সে নিজে নিজেও আঁৎকে উঠেছিল। সে কি তবে দেবেন্দ্রনারায়ণের কোনো পরিণতির জন্য এই এতটা দিন মৃত্যুর খুব কাছ থেকেও বারবার ফিরে এসেছে! এই ভাবনাটি রামচরণ কারিগর ভাবতে চায়নি। সে জানে দেবেন্দ্রনারায়ণ তার প্রতি চূড়ান্ত অন্যায় করেছে। বারোহাটি বাগানবাড়ির ঘটনায় তার ইচ্ছাকৃত কোনো ভুল নেই। বরং সে তার সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছে বাগানবাড়িটিকে দেবেন্দ্রনারায়ণের মনের মতো করে গড়ে তুলতে! যার ফলাফল হিসেবে এই শাস্তি তার প্রাপ্য ছিল না।
কিন্তু তারপরও দেবেন্দ্রনারায়ণের প্রতি তার কোনো ক্ষোভও ছিল না। সে তার অদৃষ্ট মেনে নিয়েছিল। এই দীর্ঘজীবনে রামচরণ কারিগর একটি বিষয় খেয়াল করেছেন, মানুষ এই জগতেই তার প্রাপ্তি অনেকাংশেই বুঝে পায়। আর এই কারণেই সে মনে মনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়েছিল, তবে কি দেবেন্দ্রনারায়ণের কোনো পরিণতির জন্য সে অবচেতনেই অপেক্ষা করছিল? তার প্রতি দেবেন্দ্রনারায়ণ যে অবিচার করেছিলেন, তার পরিণতির জন্য? গত দীর্ঘ কুড়ি বছরেরও বেশি সময়ের প্রায় পুরোটাজুড়েই সে বন্দী হয়েছিল তার বাড়ির এই ছোট্ট চৌহদ্দিতেই!
দেবেন্দ্রনারায়ণের পক্ষাঘাতগ্রস্ততার কথা শুনে রামচরণ কারিগর থমকে গিয়েছিল। সে প্রবল ভয়ে কেঁপে উঠেছিল। সে নিজেকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে সে এটি চায়নি। মোটেও চায়নি। তবে কি তার অদৃষ্ট চেয়েছিল? চেয়েছিল বলেই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল? এই অদৃষ্ট নিয়ন্ত্রের ক্ষমতা কারো নেই। তাহলে? ভগবানই কি অদৃষ্ট?
রামচরণ কারিগরের ধারণা এবার তার মৃত্যু ঘটবে। মৃত্যু নিয়ে তার ভয় কখনোই ছিল না। সকলই অদৃষ্টের নিয়ম। এ মেনে নিতে মানুষ বাধ্য। সুতরাং ভয় পেয়ে কী হবে! কিন্তু আবার যখন অসুস্থ হয়ে পড়ল, তখন হঠাৎ প্রবল মৃত্যুভয় হতে লাগল তার। এর কারণ অবশ্য সে খুঁজে পেল না। তবে বারকয়েক হুটহাট মনে হলো, দেবেন্দ্রনারায়ণ তার প্রতি যে অবিচার করেছিলেন, তার বিনিময়ে প্রাপ্তি হিসেবে কি সে অন্য জন্মে কিছু প্রত্যাশা করছিল? এখন দেবেন্দ্রনারায়ণ এই জগতেই তার প্রাপ্য পেয়ে গেলে সকলই তো শোধবোধ হয়ে গেল। তাহলে আর কী রইল? এই ভাবনাই কি আবার তার মৃত্যু ভয় ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে? রামচরণ কারিগর জানে না। অবশ্য এই মুহূর্তে সে জানার অবস্থায় নেইও।
রামচরণ কারিগরের সামনে বসে আছে তার পুত্র সনাতন মিস্ত্রি। বাবার এই অবস্থায় নিয়ে সে যে খুব চিন্তিত বিষয়টি এমন নয়। তবে এই মুহূর্তে সে বাবার সামনে থেকে উঠতে চাইছে না। উঠতে না চাইবার কারণটি অবশ্য গুরুতর। সে একটি অমার্জনীয় অপরাধ করে ফেলেছে। অপরাধটি যার সাথে করেছে তিনি ভুজঙ্গ দেব। সনাতন ভাবেনি অপরাধটির কথা ভুজঙ্গ দেব জেনে ফেলবেন। তার ধারণা ছিল ভুজঙ্গ দেব জেনে ফেলার আগেই সে আসল কাজটি করে ফেলতে পারবে। আর আসল কাজটি করে ফেলতে পারলে ভুজঙ্গ দেব আর তার এই অপরাধটি নিয়ে কথা বলবেন না।
সনাতনের ভয়াবহ অপরাধটি হলো সে ভুজঙ্গ দেবের দেওয়া একখানা অতি পুরনো স্বর্ণালঙ্কার বেণুচন্দের বাজারে লখাই স্যাকরার দোকানে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে এসেছে। সে কাজটির বিপদ সম্পর্কে অবগত ছিল না। যদিও ভুজঙ্গ দেব তাকে বারবার নিষেধ করে দিয়েছিলেন যে সে যেন এই অলঙ্কারখানা ভুলেও বিষ্ণুপুরের কাউকে না দেখায়। কিন্তু শেষ অবধি আর উপায় ছিল না। বহুদিন থেকে কোনো কাজ জুটছিল না। দেবেন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় বারোহাটি বাগানবাড়ি থেকেও কেউ তাকে কোনো কাজে ডাকছিল না। শেষ অবধি উপোষ করে মরার দশা হয়েছিল। ঘরের জিনিসপত্রের মধ্যে ওই অলঙ্কারখানাই তার সবচেয়ে বেশি বিক্রয়যোগ্য মনে হয়েছে। তাছাড়া ভুজঙ্গ দেব ওই অলঙ্কারখানা তাকে দিয়েছিলেন একটি বিশেষ কাজের অগ্রীম মূল্য হিসেবে। বলেছিলেন সেই বিশেষ কাজখানা ঠিকভাবে করতে পারলে এমন আরো ক’খানা স্বর্ণালঙ্কার সে পাবে। এই বাজারে ওই একেকখানা স্বর্ণালঙ্কারের যে মূল্য তা সে সারাজীবন মিস্ত্রীর কাজ করেও রোজগার করতে পারবে না।
কিন্তু ভুজঙ্গ দেব এর কাজটি ঠিকঠাকমতো করতেও পারেনি সনাতন। আর তার মনের ভেতর খানিক দ্বিধাও ছিল এই স্বর্ণালঙ্কারের প্রকৃত মূল্য নিয়ে। এর মধ্যে ঘরে আহারও নেই, কাজ নেই, রোজগার নেই। এই সকল কিছু মিলিয়েই শেষ অবধি সে লখাই স্যাকরার কাছে নিয়ে গিয়েছিল অলঙ্কারখানা। সে জানে যে লখাই স্যাকরা তাকে অনেক ঠকিয়েছে। এই অলঙ্কারের দশভাগের একভাগ দামও তাকে দেয়নি। কিন্তু তারপরও যা দিয়েছে, তাতেই তার চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। কিন্তু এই বিক্রির জন্য যে তাকে এত বড় বিপদে পড়তে হবে তা সে ভাবেনি। এখন সেই অলঙ্কার বিক্রেতাকে খুঁজে পেতে বিষ্ণুপুরের জমিদার বাড়ি গঙ্গামহল থেকে অবধি পাইক পেয়াদা পাঠিয়ে পুরো বিষ্ণুপুর চষে বেড়ানো হচ্ছে। ভাগ্যিস সেদিন বুদ্ধি করে সে চাদরে মুখ ঢেকে গিয়েছিল বলে লখাই স্যাকরা তাকে চিনতে পারেনি।
কিন্তু এখন ভুজঙ্গ দেবকে সে কী জবাব দেবে? ভুজঙ্গ দেবের কাজটিও সে করতে পারেনি! সেই ভোর বেলা ভুজঙ্গ দেব তার খোঁজে বাড়ি এসে পৌঁছেছে। সেই থেকে সে গঁাট হয়ে বাবার পাশে বসে আছে। নড়ছে না। মুমূর্ষ বাবার পাশে বসে আছে বলেই ভুজঙ্গ দেবও খুব একটা জোর দিয়ে কিছু বলতে পারছেন না। তবে তিনিও নাছোড়বান্দা বসে রয়েছেন তার বাবার পাশেই। সনাতনের কপাল খারাপ। রামচরণ কারিগরের যন্ত্রণা যেন খানিক কমে এলো। তিনি অনেকটাই শান্ত হয়ে এলেন। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়লেন। এখন? সনাতন মিস্ত্রি বুঝল, এখন আর কোনো উপায় নেই। তাকে ভুজঙ্গ দেবের প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হবে।
সনাতন শেষ পর্যন্ত ভুজঙ্গ দেবকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে এসে দাঁড়াল। ভুজঙ্গ দেব কিছু বলার আগেই সে ঝট করে তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ভুজঙ্গ দেব তাকে বারকয়েক হাত ধরে উঠানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু সনাতন উঠল না। সে কান্নাজড়ানো গলায় তার পরিস্থিতি বলতে লাগল। ভুজঙ্গ দেব রাগলেন না, তিনি সময় নিয়ে সনাতনের কথা শুনলেন। তারপর বললেন, তুই জানিস, ওই অলঙ্কার আমি কোথায় পেয়েছি?
সনাতন খানিক ধাতস্ত হয়েছে। সে ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল। ভুজঙ্গ দেব বললেন, আমি দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো মানুষ। ওই অলঙ্কারের মূল্য আমি জানি। জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ যখন বেঁচে ছিলেন তখন তার অনেক কাজ আমি করেছি। তো যেবার আমার বড় মেয়ের জন্ম হলো, সেবার খুশি হয়ে তিনি আমায় ওই অলঙ্কারখানা দিয়েছিলেন। অলঙ্কারখানা দেখেই আমার সন্দেহ হলো, এ বড় মূল্যবান জিনিস! আমি নিয়ে গিয়েছিলাম রাইপুরের এক বুড়ো স্যাকরার কাছে। সে আমায় নিশ্চিত করল, ও সেই আসল জিনিসই। সেই থেকে আমি কত বছর ধরে অপেক্ষা করেছি, তুই জানিস? কিন্তু সুযোগ কখনো এলো না। সুযোগ এলো যখন দেবেন্দ্রনারায়ণ বারোহাটির বাগানবাড়ি করছিলেন। তখন গঙ্গামহল থেকে একখানা সিন্দুক তিনি নিয়ে এলেন বারোহাটি। কিন্তু সেখানে তো এত দামি অলঙ্কার তেমন ছিল না। তো এরপর আরো একখানা নিয়ে এলেন। সেখান থেকে তিনি নানান লোকজনকে খুশি হয়ে গয়না বিলাতেন। তার দু’একখানা আমিও পেয়েছি। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ যতই খেয়ালি হয়ে থাকেন, তিনি আসল অলঙ্কারগুলো ঠিকই আলাদা করে রেখেছিলেন। তার একখানাও তিনি কাউকে দেননি। আবার এমনও হতে পারে, তিনি যেই সিন্দুক এনেছেন, তাতে ওই গয়না নাও থাকতে পারে। তারপরও যা রয়েছে তাও কম মূল্যবান নয়। কিন্তু বারোহাটির বাগানবাড়িতে সেই অলঙ্কার রাখার জায়গা কই? এই জায়গা খুঁজে বের করতেও আমার বহু বছর লেগে গেল। শেষ অবধি তুই-ই আমায় বললি যে ও বাড়িতে মাটির তলায় একখানা ঘর রয়েছে। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল ও ঘরেই সেই জিনিস রেখেছেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। তো একদিন বারোহাটির বাগানবাড়িতে মদের ঘোরে সে কথা স্বীকারও করলেন তিনি।
ভুজঙ্গ দেব খানিক দম নিলেন। তারপর আবার বললেন, তারপর বছরের পর বছর কত সুযোগ যে খুঁজেছি, কত রকম চেষ্টা যে করেছি, কিন্তু সেই ঘরের ভেতর অবধি যেতে পারিনি। তবে এই এতদিনের চেষ্টায় বুঝে ফেলেছিলাম বারোহাটি বাগানবাড়ির ভেতর থেকে ওই জিনিস বের করা সম্ভব নয়। বের করতে হলে অন্য উপায় ধরতে হবে। বাগানবাড়ির বাইরে থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে সেই ঘরে পৌঁছাতে হবে। কাজটা বহু পরিশ্রমের হলেও অসম্ভব নয়। অত সম্পদের জন্য ওইটুকু কষ্ট করাই যায়। কিন্তু সেজন্যও আমায় অপেক্ষা করতে হয়েছে বহু বছর। শেষ অবধি তো সুযোগ এলোই। কিন্তু এই এতদিনেও তুই কিছুই করতে পারিসনি! মাঝখান থেকে তোকে আগেভাগেই দিয়ে দেওয়া। গয়নাখানাও বোকার মতো বেচতে গিয়ে সকলকে জাগিয়ে তুললি!
সনাতন এই ঘটনার সব না জানলেও কিছু জানে। ভুজঙ্গ দেব যখন প্রথম এই কাজের কথা তাকে বলেছিল, সে রাজি হতে চায়নি। কিন্তু অত সম্পদের লোভও সে ছাড়তে পারেনি। তাছাড়া দেবেন্দ্রনারায়ণের অতবড় ক্ষতির সুযোগ সে আর কিভাবে পাবে? সব ভেবে সে প্রায় অসম্ভব ওই কাজখানা করতেই রাজি হয়ে গিয়েছিল। তা কাজ এগোচ্ছিলও ভালোই। কিন্তু সকলই ভণ্ডুল করে দিলো ওই ভয়ঙ্কর প্রাণীটা। অনেকটা মানুষের মতোই দেখতে প্রাণীটা যেভাবে অন্ধকারে গাছ থেকে নেমে আসছিল, এরপর আর একা যাওয়ার সাহস পায়নি। সনাতন। এদিকে ভুজঙ্গ দেবও স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছিলেন, এই কাজে আর কাউকে সঙ্গী করা যাবে না। কিন্তু এখন কী করবে সে!
সনাতন আবারও ঝাঁপিয়ে পড়ল ভুজঙ্গ দেবের পায়ের কাছে। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল, আমায় রক্ষা করুন কর্তা। আমার কথা জানলে ওরা আমায় নির্ঘাত পুড়িয়ে মারবে। আমায় রক্ষা করুন। আপনি যা করতে বলবেন, আমি তাই করতে রাজি আছি। আমায় বাঁচান কর্তা।
ভুজঙ্গ দেব সাথে সাথেই কোনো কথা বললেন না। ক্রন্দনরত সনাতন মিস্ত্রীকে সতর্ক চোখে পরখ করে দেখলেন। তারপর বললেন, ওই গয়নার কথা আর কাউকে বলিসনি তো?
সনাতনের কান্নার দমক যেন আরো বেড়ে গেল। সে বলল, না কর্তা, এই যে ভগবানের দিব্যি। আমায় বিশ্বাস করুন। আর কেউ জানে না।
ভুজঙ্গ দেব বললেন, ঠিক বলছিস তো?
সনাতন বলল, ভগবানের দিব্যি দিচ্ছি গো কর্তা।
ভুজঙ্গ দেব বললেন, আর বারোহাটি বাগানবাড়ির পাতাল ঘরের সিন্দুকের গয়নার কথা?
সনাতন বলল, আর কাউকে কিছু বলিনি গো কর্তা। আমায় বিশ্বাস করুন।
ভুজঙ্গ দেব খানিক সময় নিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ঠিক আছে। আমি কাউকে বলব না। তবে একটাই শর্ত।
সনাতন বলল, আজ্ঞে, আপনি যা বলবেন, আমি করব কর্তা। আমার জীবন দিয়ে দেব।
ভুজঙ্গ দেব বললেন, তাহলে আজ থেকেই আবার সুড়ঙ্গ খুঁড়তে লেগে যা। মনে রাখিস, ওই গাছে কী দেখেছিস, সে যদি তোর ঘাড় লটকেও দেয়, তাহলেও মরবি, আর তা না হলেও মরবি। তার চেয়ে চেষ্টা করে দেখ। ও যদি ঘাড় না লটকে তো বেঁচে তো গেলিই। মাঝখান থেকে কত বড়লোক হয়ে যাবি, সে ভেবে দেখেছিস?
সনাতন ভীত চোখে ভুজঙ্গ দেবের দিকে তাকিয়ে রইল। ভুজঙ্গ দেব বললেন, আর কথা না শুনলে কী হবে, তা তো জানিসই। নিতাই আর সেই ছেলের মতোন তোকেও জীবন্ত অগ্নিদাহের ব্যবস্থা আমি করব। এবার ভেবে ঠিক কর, কী করবি?
ভুজঙ্গ দেব আর সনাতনের উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়ালেন না, তিনি গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন বাড়ির বাইরে। তিনি একটা জিনিস এখনো বুঝছেন না, যে জিনিসের জন্য তিনি গঙ্গামহলের অন্দরমহলে বছরের পর বছর বিষ্ণুনারায়ণের পেছনে সার্বক্ষণিক প্রভুভক্ত কুকুরের ন্যায় লেজ নেড়ে নেড়ে লেগে রয়েছিলেন, সেই জিনিস তিনি বের করতে পারলেন না। অথচ বের করে নিয়ে গেল অন্য কেউ। কে সে?
পরপর কয়েকরাত ঘুম হলো না ভুজঙ্গ দেবের। ঘুম হলো পঞ্চম দিন বিকেলে। অসময়ের ঘুম। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যারও পরে। ঘুম ভেঙে তার মনে হলো, ঘুমের ভেতর কোনো একটা ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু কী ঘটনা, তা তিনি ধরতে পারছিলেন না। ঘটনা ধরতে পারলেন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে। তিনি আসলে কিছু একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন সন্ধ্যায়। তার হঠাৎ স্পষ্ট মনে পড়ল, দীপেন্দ্রনারায়ণের সাথে তার শ্বশুরালয়ের সেই নদীতে যেদিন তিনি বজরায় ঘুরতে গিয়েছিলেন, সেদিন দীপেন্দ্রনারায়ণ তাকে অনেক রহস্যময় কথাই বলেছিলেন। যার অনেক কিছুর অর্থই তিনি পরিষ্কার ধরতে পারেননি। কিন্তু এখন সকলই তার কাছে ক্রমশই পরিষ্কার হয়ে উঠছে। দীপেন্দ্রনারায়ণ সেই যে নদীভাঙন-আক্রান্ত এলাকার এক অশথবৃক্ষের তলায় এক সাধুর কাছে। গিয়েছিলেন সেই কথাও ভুজঙ্গ দেবের স্পষ্ট মনে পড়ল। আশ্চর্য বিষয় হলো খুবই অভাবনীয়ভাবেই আজ ঘুমের ভেতর সেই সাধুকে তিনি স্বপ্নে দেখেছেন। এই ঘটনাটিই তিনি এতক্ষণ মনে করতে পারছিলেন না। সেই সাধু সেদিন দীপেন্দ্রনারায়ণকে বলেছিলেন যে দীপেন্দ্রনারায়ণ সেখানে জমিদারি কিনতে এসেছে কিনা!
ভুজঙ্গ দেব পালঙ্ক থেকে উঠে দাঁড়ালেন। জমিদারি কেনার এত টাকা দীপেন্দ্রনারায়ণ কোথায় পাবেন? এত অর্থ কোনোমতেই তার থাকার কথা নয়। তাহলে কি গঙ্গামহলের সিন্দুক উধাওয়ের কাজ দীপেন্দ্রনারায়ণ করেছেন। আর এ কারণেই তিনি বাদবাকি সকল কিছু নিয়েই এমন নির্লিপ্ত ছিলেন! যেন কোনো কিছু নিয়েই তার কোনো আগ্রহই নেই! আচমকা আরো একখানা কথা মনে পড়ল ভুজঙ্গ দেবের। অশথ বৃক্ষের তলার সেই সাধু দীপেন্দ্রনারায়ণকে এই কথাও বলেছিল যে মহাপ্রলয় আসছে, সে যদি পার্থিব জীবনের জন্যই বাঁচতে চায় তবে যেন সে পার্থিব জিনিসপত্র নিয়েই ভালোভাবে বাঁচে। সে যেন তার সোনা-দানা, ধন-সম্পদের সিন্দুক নিয়ে বহু দূরে চলে যায়। তাহলে? তাহলে কি সেই স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যেতেই দীপেন্দ্রনারায়ণ এবার তার সাথে বিষ্ণুপুরে এসেছিলেন?
হতভম্ব ভুজঙ্গ দেব উত্তেজনায়, অবিশ্বাসে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। অথচ তিনি কিনা ভেবেছিল দীপেন্দ্রনারায়ণ তার পরামর্শে প্রভাবিত হয়ে বীণাবালার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে লড়াই করতে গঙ্গামহলে ফিরেছে! নিজেকে প্রচণ্ড বোকা আর অথর্ব মনে হতে লাগল ভুজঙ্গ দেবের। সেই রাতেও তার আর ঘুম। হলো না। তিনি এমনিতেই সাধু সন্ন্যাসী বিশ্বাস করা মানুষ। সেই অশথ বৃক্ষের তলার সাধুর কথা মনে হতেই তার বুকের ভেতর শিরশির করে উঠল। ওই সাধু কী করে জানলেন দীপেন্দ্রনারায়ণের এই সিন্দুকের কথা? মুহূর্তেই সেই সাধুর প্রতি ভক্তি আর বিশ্বাসে ভুজঙ্গ দেব মনে মনে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পিত করে দিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি সেই সাধুর সাথে দেখা করতে যাবেন। তিনিও তার নিজের সম্পর্কে জানতে চাইবেন। সাধুর পদপ্রান্তে বসে থাকবেন, যতক্ষণ না অবধি সাধু তার সম্পর্কে ভালো কিছু বলবেন।
ভোরবেলাই ভুজঙ্গ দেব তার বজরা প্রস্তুত করতে বললেন। কিন্তু তখনই তার মনে পড়ল, তিনি তো সেই জায়গাটির নামই জানেন না। অবশ্য তাতে সমস্যাও খুব একটা নেই। তাকে প্রথমে যেতে হবে দীপেন্দ্র নারায়ণের শ্বশুরালয়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটিতে। তারপর সেই নদী ধরে এগোলেই তিনি জায়গাটি চিনে নেবেন।
সেদিন রাতেই ভুজঙ্গ দেব যাত্রা শুরু করলেন। সমস্যা হচ্ছে ভরা পূর্ণিমার আকাশও কুচকুচে কালো হয়ে আছে। ঘন মেঘে ছেয়ে আছে চারপাশ। তবে পূর্ণিমার রাত হওয়ায় চারপাশে আবছা আলো। মাঝরাতের আগেই হঠাৎ ঝড় উঠল। গঙ্গাবতী হয়ে উঠল উন্মত্ত দানবীনী। তার ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল ভুজঙ্গ দেবের বজরায়। বজরার জানালা দিয়ে এই গঙ্গাবতাঁকে দেখে আতঙ্কে কেঁপে উঠলেন ভুজঙ্গ দেব। এমন গঙ্গাবতাঁকে তিনি আগে কখনো দেখেননি। উন্মত্ত গঙ্গাবতীর ঢেউজুড়ে যেন রাক্ষুসে খিদে। গঙ্গাবতী যেন মহাপ্রলয় নামিয়ে নিয়ে আসছে পৃথিবীতে। ভুজঙ্গ দেব আতঙ্কিত চোখে দেখলেন পাহাড় সমান একেকটা ঢেউ ছুটে আসছে তার দিকে। তিনি তার ভীত, সন্ত্রন্ত চোখে তাকিয়ে থেকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে ওই ঢেউ তাকে আঘাত করতে পারে। তার বজরাখানা ডুবিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তার সেই অবিশ্বাসকে এক লহমে ভেঙে দিয়ে গঙ্গাবতীর ঢেউয়ের তীব্র আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ভুজঙ্গ দেবের বজরাখানি। প্রমত্তা গঙ্গাবতীর বুকে আছড়ে পড়তে পড়তে ভুজঙ্গ দেবের হঠাৎ সেই সাধুর কথা মনে পড়ল। তিনি বলেছিলেন, মহাপ্রলয় আসছে। মহাপ্রলয়। বহুবছর পরে নদীতে আবার অসুর নেমেছে, অসুর!
ভুজঙ্গ দেব গঙ্গাবতীর জলে তলিয়ে যেতে যেতে আবিষ্কার করলেন, এ গঙ্গাবতী নয়। এ সাক্ষাৎ অসুর!
*
দেবেন্দ্রনারায়ণপুত্র বীরেন্দ্র হাঁটতে শিখেছে। আধো বোলও ফুটেছে মুখে। সে দেবেন্দ্রনারায়ণকে ডাকে ব্বা! ব্বা উচ্চারণের সময় তার ভারি কসরত হয়। সে বহুকষ্টে দুই ঠোঁট এক করে চুম্বকের মতোন আটকে ফেলে। তারপর তার চেয়েও বেশি কষ্টে সেই চুম্বকের মতোন এক হয়ে আটকে থাকা ঠোঁট ছাড়ায়। এই ছাড়াতে গেলেই ঠোঁটজোড়া আচমকা ছুটে গিয়ে যেই শব্দ হয়, সেই শব্দটিই ব্বা। আটকে থাকা ঠোঁটযুগল ছাড়াতে গিয়ে শেষমুহূর্তে তাকে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। এই শক্তিপ্রয়োগে তার চোখ অবধি বন্ধ হয়ে আসে। দেবেন্দ্রনারায়ণ সেই বন্ধ চোখের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থাকেন। বীরেন্দ্রকে দেখে তার বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে! তেমন ভিজে যাওয়া হাওয়া। কেমন শান্ত কিন্তু অনন্ত হাহাকার। এই হাহাকার মিটবে কিনা বোঝা যায় না। তবে বীরেন্দ্রকে বুকে চেপে ধরলে মুহূর্তেই পূর্ণ হয়ে যায় বুক। তিনি মনে করতে পারেন না, সর্বজয়া-সুদক্ষিণার ক্ষেত্রেও তার এমন হয়েছিল কিনা!
বীরেন্দ্র বেড়ে উঠছে দ্রুত। আজকাল তার আধো বোল আরো স্পষ্ট, আরো পরিস্ফুটিত হয়েছে। বীরেন্দ্রকে নিয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণ কষ্টে সৃষ্টে প্রায়ই নিচে যান। সাথে থাকে খগেন। নিচে বলতে নিচতলার খোলা ঘর অবধি। বা খানিক উঠোন অবধিও। এই নিচে আসার কারণ যে শুধুমাত্র নতুন হাঁটতে থাকা বীরেন্দ্রকে নিয়ে আরো খানিক হেঁটে আসা তাই-ই নয়। বরং এর মূল কারণ বিভূঁই। বিভূঁইয়ের সাথে দেখা হওয়া, কথা বলা। এ বাড়িতে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই বিভুঁই শরীরে বেড়ে উঠেছে অনেক। শুধুই কি শরীরে, না কি মনে তার চেয়েও বেশি? বিভূঁইর কথা শুনে এই প্রশ্নটি প্রায়ই উঁকি দেয় দেবেন্দ্রনারায়ণের মনে। এইটুকু এক ছেলে কিভাবে রোজ আরো বেশি পরিণত, আরো বেশি গভীর, আরো বেশি ঋদ্ধ হয়ে উঠছে! বিভুঁই তার কাছে এক অস্বাভাবিক বিস্ময়!
বিভূঁইয়ের সাথে অল্পবিস্তর কথা হলেই এই ভাবনা হয় দেবেন্দ্রনারায়ণের। কিন্তু ছেলেটার সামনে তিনি বেশ অস্বস্তি বোধ করেন। তার কেবল মনে হয় অন্ধ এই ছেলেটি তার চারপাশের সকল কিছুই দেখতে পায়। শুধু যে দেখতেই পায় তা-ই নয়, সেসব কিছু অনুধাবন করতে পারে আর সকলের চেয়ে বেশি। তিনি বিভূঁইয়ের সামনে গেলেই তার নিজেকে কেমন আড়ালবিহীন লাগে। মনে। হয়, বিভুঁই বুঝি তার বুকের ভেতর অবধি দেখছে। অন্ধ বিভূঁইয়ে কাছ থেকে যেন কোনো কিছুই লুকানোর উপায় নেই।
সেদিন বীরেন্দ্রকে নিয়ে বিভূঁইয়ের ঘরের সামনে দাঁড়াতেই বিভুঁই বলল, বীরেন্দ্র কি কথা বলতে পারে?
দেবেন্দ্রনারায়ণ বিভুঁইকে বলে দিয়েছেন, সে যেন তাকে কর্তাবাবু সম্বোধন করে। বিভুঁই অবশ্য এর কারণ যেমন জিজ্ঞেস করেনি, তেমনি কর্তাবাবুর পরিবর্তে সে তাকে কী ডাকবে, সেটিও জিজ্ঞেস করেনি। তার সাথে দেবেন্দ্রনারায়ণের সম্পর্ক তাই হয়ে রইল সম্বোধনবিহীন সম্পর্ক। এ এক অদ্ভুত খেলা, ঘটনাচক্রে প্রকৃতই সম্বোধনবিহীন এক সম্পর্কের জালে আবদ্ধ এই মানুষ দু’জন। যার রহস্য তারা কেউই জানে না। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, তুমি জিজ্ঞেস করে দেখো।
বিভুঁই খানিক চুপ করে থেকে বলল, তার আগে একখানা কথা বলি?
দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, হ্যাঁ। বলো।
বিভুঁই বলল, আপনি বীরেন্দ্রকে এখানে এনে আমায় কখনো ছুঁতে দেন না। ও আশেপাশে হেঁটে বেড়ায়। ঘুরে বেড়ায়। কখনো কখনো আমার খুব কাছাকাছি চলে আসে। কিন্তু আপনি তাকে তার বেশি কাছে আর আসতে দেন না। কেন?
দেবেন্দ্রনারায়ণ এই কথায় ভারি অবাক হলেন। বিষয়টি তিনি কখনো আলাদাভাবে খেয়াল করেননি। তবে এখন তার মনে হচ্ছে, বিভুঁইর কথা সত্য, তিনি আসলেই বীরেন্দ্রকে বিভুঁইর কাছাকাছি আসতে দেন না। কিন্তু কেন দেন না, তা নিয়ে কি তিনি কখনো কিছু ভেবেছেন? দেবেন্দ্রনারায়ণ কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলেন না। তিনি বললেন, কী বলছ? তা কেন হবে?
বিভুঁই জবাব দিল না। সে মৃদু হাসলো কেবল। তারপর বলল, আপনি কি আর কখনো আমায় আমার মার কাছে যেতে দেবেন না?
দেবেন্দ্রনারায়ণ এবার খানিক বিরক্ত হলেন। তিনি বললেন, আমি তো তোমায় আটকে রাখিনি, বা তোমার মাকেও না। সে কোথায়? তাকে আমি কোথায় খুঁজব? আমার পরিস্থিতি তো তুমি কিছুটা হলেও জানো! এ বাড়িতে তোমায় কেন তোমার আসল ঘটনাও লুকিয়ে রাখতে হবে সে কথাও কিছু বলেছি তোমায়।
বিভুঁই বলল, আমার মাকে কি আপনি ভয় পান?
দেবেন্দ্রনারায়ণ এই কথায় থমকে গেলেন। আজ এসব কী বলছে বিভুঁই! হেমাঙ্গিনী দেবীকে তিনি ভয় পাবেন কেন? বরং হেমাঙ্গিনী দেবী তার ভয়ে ভীত হয়ে উধাও হয়েছে। আর সকল কিছুই যদি আগের মতো থাকত, আর তিনি নিজে যদি সুস্থ থাকতেন তাহলে এতদিনে তিনি হেমাঙ্গিনী দেবীকে অবশ্যই খুঁজে বের করতেন! তাহলে? কী বলছে এই ছেলে! তাছাড়া বিভূঁইয়ের মা হেমাঙ্গিনী দেবীকে যে তিনি চেনেন, একথাও বিভুঁই’র জানার কথা নয়।
দেবেন্দ্রনারায়ণ খানিকট উগ্র গলায় বললেন, তোমার মাকে আমি ভয় পাবো কেন?
বিভঁই নির্বিকারভাবে বলল, আমি জানি না কেন। কিন্তু আমার মন বলছে আপনি তাকে চেনেন। আর আপনি তার মুখোমুখি হতে ভয় পান।
দেবেন্দ্রনারায়ণ ভীষণরকম ধাক্কা খেয়েছেন। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিভূঁইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একজোড়া নিষ্কম্প ভাবলেশহীন চোখ। সামান্য ফাঁক হয়ে রয়েছে চোখের পাতা। পাতার উপরের জোড়া খানিক কুঞ্চিত। বিভূঁইয়ের নানান কর্মকাণ্ডে এতদিন তিনি বিস্মিত হলেও বিচলিত বোধ করেননি। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তিনি বিচলিত বোধ করছেন। তার চেয়েও বড় কথা তিনি ভয় পাচ্ছেন। বিষয়টাকে তিনি উপেক্ষা করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। তার মনে হলো, বিভূঁইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে তিনি ভয় পাচ্ছেন। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই বিভুঁই হয়তো আরো নির্মম কোনো গোপন অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য বোস বলে ফেলবে। কিন্তু বিভূঁইয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে অস্বস্তি হলেও তিনি সরে যেতেও পারছেন না।
বিভুঁই বলল, আমার কথা শুনে আপনি রেগে যাবেন না। আমি একা একা থাকি তো। রোজ নানান ভাবনা মাথায় আসে। আগে মা’র জন্য খুব কান্না পেত। কষ্ট হতো। চোখ বন্ধ করলেই মায়ের মুখ খুব মনে পড়ত। মায়ের ঘ্রাণ মনে পড়ত। এখন আর পড়ে না। কী যে কষ্ট হয়! কী যে কষ্ট! তখন সেই ভাবনা ভুলতেই রাজ্যের জিনিসপত্তর ভাবি। সেই ভাবনা যদি বাইরে থেকে কেউ দেখতে পেত, তবে আমায় নির্ঘাৎ পাগল বা তার চেয়েও খারাপ কিছু ভাবতে পারত। মানুষের সবচেয়ে বড় সুবিধা কী জানেন?
দেবেন্দ্রনারায়ণ অদ্ভুত গলায় বললেন, কী?
বিভুঁই বলল, এক মানুষ অন্য মানুষের সত্যিকারের মনের খবর জানে না। জানে নকল মনের খবর।
দেবেন্দ্রনারায়ণ বিভূঁইয়ের কথার কিছুই বুঝলেন না। তিনি বিভ্রান্ত এবং ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। এই বিভুঁইকে তার কাছে মনে হচ্ছে বয়সের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ, ঋদ্ধ এক বৃদ্ধ মানুষ। যে তার অন্তদৃষ্টিতে সকল কিছু দেখতে পায় নির্ভুলভাবে। এইটুকু মানুষ এমন কথা কী করে বলে তা তিনি জানেন না। জানতে চান না। তার কেন যেন মনে হচ্ছে এই ছেলেটি অস্বাভাবিক ক্ষমতাধর এক মানুষ। তার সেই অস্বাভাবিক ক্ষমতা সহ্য করার ক্ষমতা দেবেন্দ্রনারায়ণের মতো অতি সাধারণ মানুষদের নেই।
বিভুঁই আবার বলল, এই ক’দিনে আমি একখানা সত্য জেনেছি। পৃথিবীতে মানুষের দুই রকমের মহল থাকে। সেই দুই রকমের মহলে দুই রকমের অন্দর থাকে। অন্দরমহল। একখানা অন্দরমহল আসল, আরেকখানা নকল। আসলখানা ইট-পাথরের মহল নয়। সেখানা থাকে বুকের ভেতর। বুকের ভেতরের মহল। কিন্তু সেখানার কথা কেউ ভাবে না। সকলে কেবল বাইরের যে ইট-কাঠ-পাথরের মহল, সেখানার কথা ভাবে। সেখানা দখলের জন্য কত ষড়যন্ত্র, কত লড়াই, জোর-দখল, খুনোখুনি। কিন্তু আসলখানা নিয়েই কেউ ভাবে না।
দেবেন্দ্রনারায়ণ এবার পুরোপুরিই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তিনি ভেবে পেলেন না, এইটুকুন এক ছেলে এ কী বলছে! কিভাবে বলছে! কে তাকে এমন কঠিন কঠিন সব কথা রোজ রোজ শিখিয়ে দেয়!
বিভুঁই খানিক থেমে বলল, মানুষের সুবিধা যে এক মানুষ অন্য মানুষের এই নকল অন্দরমহলের খবরই শুধু জানে। কিন্তু আসল অন্দরমহলের খবর। জানে না। একজন আরেকজনের মন দেখতে পায় না, ভাবনা-চিন্তা দেখতে পায় না। পেলে কি ভয়ানক ব্যাপারই না হয়ে যেত! এই যে আমি কত কিছু ভাবি, কত কত মানুষকে নিয়ে, কত কতকিছু নিয়ে, সারাটাক্ষণ, তা যদি সেই সকল। মানুষেরা জানত যে আমি তাদের নিয়ে এই সকল ভাবছি, তাহলে কী হতো ভাবলেই আমার ভয় হয়! এই আপনাকে নিয়েও আমি কত কী ভাবি। আমার কী মনে হয় জানেন, আমার মনে হয় আপনি আমায় আগে থেকেই চেনেন, জানেন, আমার মাকেও। সেটি না হলে আমায় নিয়ে আপনার এত দুশ্চিন্তা কিসের? আর আপনি বলেছিলেন আপনি আমায় নদীতীরে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। আমার সারা শরীরজুড়ে গুটিবসন্ত। আপনিই বলুন, আপনার মতো জমিদার বাড়ির কেউ এমন কখনো করবে? করবে না। কখনোই না। কে না কে গুটিবসন্তে মরে পড়ে রয়েছে! এ সকল আপনার মতোন মানুষেরা ভাবেন না। অথচ সেই যে আমায় নিয়ে এলেন, তারপর থেকে আপনি আমায় আগলে রেখেছেন। আবার এই বাড়িতে এসে আমায় বললেন আমায় যে নদীর তীরে কুড়িয়ে পেয়েছেন সে কথাও লুকিয়ে রাখতে। আমি জানি না, কী হয়েছে। কিন্তু এইটুকু বুঝি, আপনি আমায় চেনেন, আর আমার মাকেও!
দেবেন্দ্রনারায়ণ কী বলবেন! অনেক চেষ্টা করেও বলার মতো একটি শব্দও যেন তিনি আর খুঁজে পেলেন না। বিভুঁই-ই আবার বলল, আমি কী আর কোনোদিন আমার মায়ের কাছে যেতে পারব না?
দেবেন্দ্রনারায়ণ এবার অনুচ্চ গলায় বললেন, আমি জানি না তোমার মা কোথায়!
বিভুঁই বলল, আপনি তাকে খুঁজেছেন?
দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, কোথায় খুঁজব!
বিভুঁই বলল, রাইপুরে? ওখানে মায়ের বাড়ি রয়েছে।
দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, ওখানে খোঁজ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সে নেই সেখানে। দেবেন্দ্রনারায়ণের কথা শেষ হবার সাথে সাথেই বিভুঁই হাসল। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ বিভূঁইয়ের সেই হাসির কারণ ধরতে পারলেন না। তবে দ্বিধামিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। বিভুঁই বলল, আমি জানতাম আপনি আমার মাকে চেনেন।
দেবেন্দ্রনারায়ণ নিজের বোকামিতে নিজেই হতবুদ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি বিভূঁইয়ের সামনে কি করে বললেন যে তিনি হেমাঙ্গিনী দেবীকে খুঁজতে রাইপুরে লোক পাঠিয়েছিলেন! বিভূঁইকে বারোহাটিতে নিয়ে আসার পর বিভুঁই বলেছিল তার গুটিবসন্ত হয়েছিল বিনয়পুরের এক ছাত্রাবাসে। কিন্তু সে রাইপুরের কথা তাকে কিছুই বলেনি! তাহলে? যদি হেমাঙ্গিনী দেবীকে তিনি না-ই চেনেন, তবে তিনি কী করে জানলেন বিভূঁইয়ের মায়ের রাইপুরের বাড়ির কথা!
বিভুঁই বলল, আর কোথাও খোঁজেননি?
দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, আর কোথায় খুঁজব?
এই প্রশ্নের উত্তর বিভূঁইও জানে না। আসলেই তো, তার মাকে কোথায় খুঁজবেন দেবেন্দ্রনারায়ণ! সে তো বিভুঁই নিজেও জানে না। এবার আর কোনো কথা বলল না বিভুঁই। চুপ করে মাথা নামিয়ে নিল নিচে। তারপর বসে রইল নিশ্চুপ। দেবেন্দ্রনারায়ণ দীর্ঘসময় এই অদ্ভুত বালকটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর অতিকষ্টে দেয়াল আঁকড়ে ধরে পা ঘষটে ঘষটে হেঁটে বিভূঁইয়ের সামনে এসে বসলেন। বসে রইলেন অনেকটা সময়। বিভুঁই জানে দেবেন্দ্রনারায়ণ তার কত কাছে এসে বসে আছেন। কিন্তু সে কোনো কথা বলছে না। কথা বলছেন দেবেন্দ্রনারায়ণও। এই দুই নিঃশব্দ মানুষই জানে তাদের এই নির্বাক বসে থাকা দূরত্বটুকুর মাঝখানে জমে যাচ্ছে অজস্র কথা, অজস্র শব্দ, অজস্র আক্ষেপ, কষ্ট, অভিযোগ আর অনুভূতি। কিন্তু সেই অনুভূতিরা কেবল ব্যক্ত হচ্ছে না মুখে। দেবেন্দ্রনারায়ণের হঠাৎ কী হলো, তিনি তার ডান হাতখানা বাড়িয়ে বিভূঁইয়ের গাল ছুঁয়ে দিলেন। অন্ধ বিভূঁইয়ের চোখের পাতারা কি মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল!
দেবেন্দ্রনারায়ণের সহসা মনে হলো উঠোনে হেঁটে বেড়ানো ওই বীরেন্দ্র আর এই অন্ধ বিভুঁই, এই দু’জনের পরিচয় এক অথচ তারা কোনোভাবেই এক নয়। তিনি একজনকে সন্তানের স্নেহে মমতায় বুকে চেপে ধরে রাখতে পারেন আর অন্যজনকে পড়ে থাকতে হয় অনাদরে-অবহেলায় মৃত্যদের ঘরে। অথচ এই দু’জনের পিতাই তিনি! তিনি তার সবল হাতখানি বাড়িয়ে বিভূঁইয়ের মাথা টেনে আনলেন তার বুকের কাছে। বিভূঁইও এগিয়ে এলো।
এই বিভুঁই খানিক আগের সেই বয়সের চেয়েও অনেক অনেক বেশি পরিণত বিভুঁই নয়, বরং এই বিভুঁই যেন বয়সের চেয়েও আরো ছোট এক শিশু। খানিক স্নেহ, খানিক মমতার জন্য বুকের ভেতর আকুলি-বিকুলি করা এক তৃষ্ণার্ত বালক। সে দেবেন্দ্রনারায়ণের বুকে মাথা রেখে হু হু করে কাঁদল। কাঁদতে কাঁদতেই সে বলল, আপনি ভাবেন বীরেন্দ্রকে যদি আমি ছুঁই, তাহলে বীরেন্দ্রর ক্ষতি হতে পারে, তাই না? সে যদি পাছে আমার মতো অন্ধ হয়ে যায়! এই ভয়ে আপনি বীরেন্দ্রকে আমার কাছে আসতে দেন না। ছুঁতে দেন না। তাই না? আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কষ্ট। মনে হয়, আমি অভিশপ্ত একজন মানুষ!
দেবেন্দ্রনারায়ণ বিভুয়ের এই গভীর অভিমানী অভিযোগ মানতে চাইলেন না। কিন্তু তার মনে হলো বিভুঁই ভুল কিছু বলেনি। তার মনের কোথাও এই আশঙ্কাটিই ছিল যে অন্ধ বিভুঁইর ছোঁয়ায় যদি বীরেন্দ্র’র কিছু হয়! কোনো অকল্যাণ হয়!
তিনি ফিসফিস করে বললেন, এখন থেকে তুমি যখন ইচ্ছে বীরেন্দ্রকে তোমার সাথে রেখো। কোনো ক্ষতি নেই। কেউ তোমাকে আটকাবেও না।
খানিক আগের সেই গভীর, অতল বিভুঁই যেন অভিমানে এলোমেলো এক শিশু। সে দু’হাতে চোখ মুছতে মুছতে বলল, আপনি সত্যি করে আমায় বলবেন? আমার সাথে আপনার সম্পর্ক কী? আমি আপনার কী হই?
দেবেন্দ্রনারায়ণ কী বলবেন! তিনি যেমন বসে ছিলেন তেমনই নির্বাক বসে রইলেন। তার বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। হেমাঙ্গিনী দেবীকে তার দরকার। খুব দরকার। কিছু বিষয় জলের মতো স্বচ্ছ, স্পষ্ট হওয়া দরকার। কিছু রহস্য, কিছু প্রশ্ন রয়েই গেছে। কিন্তু জগতে কি সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়? সকল রহস্য কি উঘাটিত হয়? কিছু রহস্য অনুনন্মাচিতই থেকে যায়। কিছু প্রশ্ন রয়ে যায় উত্তরহীন। হয়তো বিভুঁইও কখনো জানবে না তার প্রকৃত পরিচয়। এই ভাবতে ভাবতে দেবেন্দ্রনারায়ণের ভাবনারা সকলি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তার সেই সকল ভাবনা, সেই সকল চিন্তা, সকল যোগসূত্র অনুসন্ধানের অভীপ্সা, সকলই প্রবল সর্বগ্রাসী এক কম্পনে যেন ঝরঝর করে ভেঙে পড়ল বিভূঁইয়ের এক কথায়।
বিভুঁই তার অন্ধ চোখের জল মুছতে মুছতে দৃঢ় গলায় বলল, আমি জানি না, কী উত্তর আপনি দেবেন! বা আসলেই দেবেন কিনা, তাও আমি জানি না। তবে এ আমি জানি, এখানে আমি পরিচয়বিহীন হলেও,আসলে পরিচয়বিহীন কেউ আমি নই। হয়তো এই জমিদার বাড়ি গঙ্গামহলই আমার সত্যিকারের পরিচয়।
বিভুঁই সামান্য থামল। তারপর মুখে অদ্ভুত হাসি টেনে বলল, অবশ্য কেউই কি জানে, সে সত্যিই আসলে কে? তার সত্যিকারের পরিচয় আসলে
কী? জানে?
দেবেন্দ্রনারায়ণ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে রইলেন। কিন্তু বিভুঁই হাসলো। স্মিত হাসি। সেই হাসির অর্থ সে ছাড়া আর কেউ জানে না!
*
রতনকান্তি মায়ার জালে আটকে আছে। এই মায়া উপেক্ষা করার ক্ষমতা সকলের থাকে না। খুব কম মানুষের থাকে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে রতনকান্তিরও নেই। রতনকান্তির সেই ছোট্ট ঝোলাখানা আবার খোলা হয়েছিল। সেখানা নিয়ে গঙ্গামহল ছেড়ে পরদিন আর তার পথে বের হওয়া হয়নি। আবার রোজকার ছাদখানা তার আর সুদক্ষিণার গানের সুরে আন্দোলিত হয়েছে। সময় কেটে গেছে। রতনকান্তির আর পথে নামা হয়নি। সে জড়িয়ে যাচ্ছে তীব্র মায়ায়। এই মায়ার নামই কি বিভ্রম!
রতনকান্তি আজকাল এ সকল নিয়ে ভাবে না। সে ভাবে সর্বজয়াকে নিয়ে। সেই দিনের পর অনেকগুলো দিন, অনেকগুলো মাস শেষে বছরেরও বেশি কেটে গিয়েছে। কিন্তু সর্বজয়ার সাথে যে তার খুব বেশি কথা হয়েছে, এমন নয়। কিন্তু সে অনুভব করে সর্বজয়া প্রতি মুহূর্তে তার চারপাশজুড়েই রয়েছে। এই একটুখানি তার মুখ, তার হাসি, তার ছায়া দেখলেও বুকের ভেতরটা কেমন ওলট-পালট হয়ে যায়। এর নাম কী?
রতনকান্তি এই অবধি ভাবে। তারপর আর ভাবতে পারে না। সর্বজয়ার সাথে তার কী যে প্রবল জীবনবোধ, আর সেই জীবনবোধে নির্মোহ এক জীবনের সন্ধানে সে পথে পথে ঘুরে বেরিয়েছিল তা যেন এই বেলা এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে গঙ্গামহলের অন্দরে। এই ইট-কাঠ-পাথরের এক অন্দরমহলে আটকে থাকা রতনকান্তি ভেবে দেখেছে, সে আসলে আটকে রয়েছে আরো গভীর কিছুতে। কিন্তু সেই গভীর কিছু কতটা সত্য তা সে জানে না, আবার মায়ার বেশে কতটুকু মিথ্যে কুহেলিকা তাও সে জানে না। কিন্তু এর প্রবল সম্মোহনও সে অস্বীকার করতে পারে না। এ যেন তার জীবনের এক অমোঘ বিধান। এর থেকে যেন তার পরিত্রাণ নেই।
সর্বজয়া আজকাল বীরেন্দ্রকে নিয়ে প্রায়ই ছাদে আসে। বীরেন্দ্র বড় হয়ে উঠেছে। সে এখন কেমন কাটাকাটা কথা বলে। খিলখিল করে হাসে। ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথা অবধি দৌড়ায়। ছুটে এসে লাফিয়ে দিদির কোলে ওঠে। একা একা সিঁড়ি টপকে নিচে বিভূঁইয়ের কাছে যায়। বিভূঁইয়ে কোলের ভেতর বসে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে। বিভুঁইকে তার ভারি অদ্ভুত লাগে। অত বড় একটা মানুষ, কিন্তু চোখে দেখতে পায় না! এ বড় অবাক করে বীরেন্দ্রকে। এই নিয়ে তার নিজের গর্বও কম নয়। সে কেবল বিভুঁইর কাছে গেলেই তার নিজের দৃষ্টিশক্তি নিয়ে আলাদা গর্ব অনুভব করে। সে চারপাশের নানান কিছু নিয়ে বিভূঁইকে ক্রমাগত প্রশ্ন করতে থাকে। বিভুঁই সে সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে সে বিজয়ীর ভঙ্গিতে হাসে। সেই হাসি শুনে শুনে বিভুঁই বীরেন্দ্র’র মুখ কল্পনা করে। হাসি কল্পনা করে। কল্পনা করে করে সে ভারি আনন্দিত হয়। সেই আনন্দে তার চোখজোড়া কেঁপে কেঁপে ওঠে। সেও বীরেন্দ্রকে কত কিছু জিজ্ঞেস করে, উঠানে এখন কী কী আছে বীরেন্দ্র?
বীরেন্দ্র সতর্ক নজরে উঠানে তাকায়। তারপর বিভূঁইয়ের চোখের সামনে আঙুল তুলে ধরে বলে, তোমার চোখের সামনে আঙুল। বলো তো ক’খানা আঙুল?
বিভুঁই বলল, আমি তো দেখতে পাই না। কী করে বলব?
বীরেন্দ্র বলল, তুমি কেন দেখতে পাও না? আমি তো ছোট, আমি যে দেখতে পাই।
বিভুঁই বলল, তুমি সত্যি সত্যি দেখতে পাও?
বীরেন্দ্র বলল, হ্যাঁ। পাই। একটা কাক, দুইটা কাক। একটা মানুষ, দুইটা মানুষ। খগেন মানুষ। সে উঠোনে যা দেখে তা এভাবে গোনে। সে দুইয়ের বেশি গুনতে পারে না। তাই সকলই সে দুই অবধি গোনে।
বিভুঁই বলে, আর কী?
বীরেন্দ্র জবাব দেয় না। সে পাল্টা প্রশ্ন করে, তুমি কি দেখতে পাও?
বিভুঁই খানিক চুপ করে থেকে বলল, আমি সকলই দেখতে পাই।
বিভূঁইয়ের এই কথা শুনে বীরেন্দ্র ভারি হাসল। তারপর বলল, আমায় দেখতে পাও?
বিভুঁই বলল, হ্যাঁ, পাই।
বীরেন্দ্র বলল, কী দেখতে পাও?
বিভুঁই বলল, তোমার দুটো চোখ রয়েছে। দু’খানা হাত, দু’খানা পা, দু’খানা কান রয়েছে।
বীরেন্দ্র আবারও হেসে গড়িয়ে পড়ল। সে বলল, সে তো সকলেরই আছে।
বিভুঁইও হাসল। বলল, তা অবশ্য ঠিক।
কিন্তু বীরেন্দ্র আচমকা বলল, না, সকলের তো নেই। তোমার তো নেই।
বিভুঁই বলল, কী নেই?
বীরেন্দ্র বিভুঁইয়ের কাছে এসে তার চোখ ছুঁয়ে দিয়ে বলল, তোমার তো চোখ নেই।
বিভুঁই হাত বাড়িয়ে হাতের আঙুলগুলো নিজের চোখের উপর বিছিয়ে দিয়ে। বলল, কই? এই যে আছে। এই যে আমার চোখ।
বীরেন্দ্র বলল, ও তো মিথ্যে চোখ। খেলনা চোখ। ও চোখে তো তো দেখা যায় না। আমার খেলনা মাটির ঘোড়াখানিও তোমার খেলনা চোখের মতো। জানো, ঘোড়াখানাও দেখতে একদম সত্যিকারের ঘোড়ার মতো, কিন্তু দৌড়াতে পারে না।
এই কথায় বিভুঁই থমকে গেল। আসলেই তো, তার কপালে যে চোখজোড়া রয়েছে, তা তো তার আসল চোখ নয়। নকল একজোড়া চোখ নিয়ে সে ঘুরছে। এই চোখে সে কিছুই দেখতে পায় না। এ তো মিথ্যে একজোড়া চোখ। বিভুঁই। সেই সারাটিদিন আর কারো সাথে কথা বলল না। চুপচাপ ডুবে রইল তার ভাবনার জগতে। তার মনে হলো, এই জগতে আর সকল মানুষেরা যারা এমন চোখ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তারা আসলে কী দেখতে পায়?
বিভুঁই অনেক ভাবল। এই ভাবনার যেন কোনো শেষ নেই। তার মনে হলো, মানুষেরা আসলে ওই চোখে কেবল আদল দেখতে পায়। কেবল চেহারা দেখতে পায়। একখানা ঘর, ঘরের আকৃতি, ইট, ইটের আকুতি, মানুষ, মানুষের আকৃতি, নদী, নদীর আকৃতি, জল, জলের আকৃতি। আচ্ছা, এ সকল তো সেও দেখতে পায়। সে চাইলেই দেখতে পায়! তাহলে? তার চেয়ে বেশি আর কি দেখতে পায় অন্য সকল মানুষ? তারা কি ওই ঘর, ইট, মানুষ, নদী, জলের শরীর বা আকৃতির বাইরেও আরো বেশি কিছু দেখতে পায়? আরো গভীর কিছু? কিন্তু কই? সে যখন চোখে দেখতে পেত, সে তো ওই বাইরের আদল ছাড়া, আকৃতি ছাড়া তার সেই চোখে আর কিছুই দেখতে পেত না!
এখনও তো সে চাইলেই সে সকল আদল তার কল্পনার চোখে দেখতে পারে। নদী কেমন, মানুষের আকার কেমন, জল কেমন, ঘর কেমন! তাহলে? তার সাথে ওই চোখে দেখা মানুষগুলোর পার্থক্য কোথায়! তার এই চোখজোড়া যদি নকল হবে, খেলনা চোখ হবে, তাহলে আর সকলেরটা কেন নয়? ওই চোখে কি বুকের ভেতর অবধি দেখা যায়? শুধু বাহ্যিক আকারের বাইরেও আরো গভীর কিছু কি দেখা যায়?
বিভুঁই জানে না। তবে সে এ জানে, ওই কপালের চোখে দেখতে না পেলেও, সে ওই আদলের বাইরের গভীর জগৎকে সে প্রায়ই দেখতে পায়। এ এক অদ্ভুত জগৎ। এই জগতে মানুষের বুকের ভেতর দেখা যায়। কপালের চোখ এই দেখাকে বাধাগ্রস্ত করে। মন এই দর্শনে তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে। এ দর্শন। বড় কঠিন। এই দর্শন বড় একাগ্রতায়, সাধনায় অর্জিত হয়। এ সহজ দর্শন নয়। চোখের পাতা মেলেই জগত দেখবার মতোন সহজ দর্শন এ নয়। এ অন্তদৃষ্টির দেখা। এই দেখা দেখতে হলে বুকের ভেতরের চোখখানা মেলে ধরতে হয়। বোধের গভীরতম অংশ ছুঁয়ে দিতে হয়। কিন্তু বুকের ভেতর অমন একাগ্রতায়, অমন গভীর সাধনায় দেখবার সময় মানুষের কই! মানুষ ব্যস্ত পোশাক দেখতে, মুখোশ দেখতে, ভান দেখতে। মানুষেরা জীবনজুড়েই ডুবে থাকে শরীরে। বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা অথৈ রহস্যের অতল হৃদয় দেখবার সময় তাদের কই! তারা সকলেই তাই একেকজোড়া নকল চোখ নিয়ে নিয়ত সর্বদ্রষ্টার ভান ধরে ঘুরে বেড়ায়।
.
সর্বজয়া কতদিন বাদে আজ গঙ্গামহল থেকে বের হলো, তার মনে নেই। কিন্তু গঙ্গামহলের বাইরে গঙ্গাবতীর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে তার হঠাৎ পাখি হয়ে যেতে ইচ্ছে হলো। এই এতটা দিন সে কিভাবে অমন চার দেয়ালের অন্ধকারে আটকে ছিল, তা ভেবে ভীষণ আফসোস হতে লাগল তার! সর্বজয়ার সাথে রয়েছে সুদক্ষিণা আর দাসী অতসীবালা। সে নিজে ইচ্ছে করেই আজ বাইরে বেরিয়েছে। শেষ বিকেলের আকাশখানা ক্রমশই রক্তিম হয়ে উঠছে। খানিকবাদেই সন্ধ্যা নামবে। গঙ্গাবতী কানায় কানায় পূর্ণ। তবে শান্ত। মৃদু হাওয়া বইছে। ভারি নরম একখানা বিকেল। রতনকান্তি দিন দুই হলো। গঙ্গামহলে নেই। সে কোথায় গেছে, সর্বজয়া তা জানে না। সুদক্ষিণা আচমকা রতনকান্তির প্রসঙ্গ তুলল। সে বলল, দিদি, মাস্টারমশাই থাকলে দিব্যি একখানা গান বানিয়ে ফেলতে পারত, তাই না?
সর্বজয়া গম্ভীর গলায় বলল, সারাক্ষণ মাস্টার মশাই ছাড়া মাথায় আর কিছু থাকে না তোর?
সুদক্ষিণা বলল, তুমি আবার আমায় বকছ। আবার তোমার অসুখের আগে যেমন ছিলে, ঠিক তেমন হয়ে যাচ্ছ!
সর্বজয়া হাসল। বলল, তাহলে কী, অসুখের মতোন হয়ে যাবো? চুপচাপ অসুখের মতোন?
সুদক্ষিণা দিদির হাত ধরে ঘনিষ্ট হলো। বলল, না, তুমি বকো।
সর্বজয়া প্রাণখুলে হাসল। বহুকাল পর পৃথিবীটা তার কাছে আবার আনন্দময় মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে পঙ্কিলতা ছাড়াও আরো অনেক কিছুই রয়েছে। এখানে আরো কিছু দিন বেঁচে থাকা যায়। তারা হেঁটে পশ্চিমে গঙ্গামহলের সীমানার একদম শেষে চলে এসেছে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। এই মুহূর্তে একখানা জুড়িগাড়ির শব্দে কৌতূহলী হয়ে তাকালো। সর্বজয়া। সোজা রাস্তাখানা ধরে গঙ্গামহলেরই একখানা জুড়িগাড়ি ছুটে আসছে। গাড়িখানা তীব্রগতিতে ছুটে আসছিল। কিন্তু সর্বজয়াদের পাশে এসে অকস্মাৎ থমকে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নেমে সর্বজয়ার সামনে এসে দাঁড়াল দ্বিজেন্দ্র। কিন্তু সর্বজয়া কোনো কথা বলল না। দ্বিজেন্দ্রও না। অনড় দাঁড়িয়ে রইল দু’জনই। সুদক্ষিণা কী বুঝল কে জানে! সে সর্বজয়ার হাত ধরে টানল, দিদি, চলো।
সর্বজয়া ঘুরে হাঁটতে যাচ্ছিল। এই মুহূর্তে দ্বিজেন্দ্র কথা বলল, তা এতদিন কোথায় ছিলি? কোথাও দেখা পাইনি তোর!
সর্বজয়া জবাব দিলো না। সে যেমন হাঁটছিল, তেমনই হেঁটে এগোতে থাকল। সর্বজয়ার আচরণে দ্বিজেন্দ্র হতভম্ব হয়ে গেল। সে সর্বজয়ার পেছন পেছন আসতে লাগল। কিন্তু সর্বজয়ার কোনো তাড়া দেখা গেল না। সে যেমন হাঁটছিল, তেমন নির্বিকার ভঙ্গিতেই এগুতে থাকল। দ্বিজেন্দ্র এবার খানিক শক্ত গলায় বলল, আমি কী বলছি, শুনছিস না?
সর্বজয়া ফিরেও তাকাল না। দ্বিজেন্দ্র হাঁটার গতি বাড়িয়ে সর্বজয়ার সামনে এসে পথরোধ করে দাঁড়াল। তারপর বলল, তুই বড় জেদি সর্বজয়া। মেয়ে মানুষের এত জেদ ভালো নয়।
এবার কথা বলল সর্বজয়া। শান্ত, স্থিরকণ্ঠে সে বলল, সে কথা রাণী মা কে গিয়ে বোঝাও। তিনিও তো মেয়েমানুষ, নাকি?
সর্বজয়ার উত্তরে দ্বিজেন্দ্র ধাক্কার মতো খেল। এই দীর্ঘসময়ে বাইরে অনেকটাই বদলে গেলেও ভেতরে ভেতরে তো বিন্দুমাত্র বদলায়নি এই মেয়ে। তেজ কমেনি এতটুকু। বরং তেজের সাথে এবার সংযমও রয়েছে।
দ্বিজেন্দ্র বলল, তোর তো দেখি কিছুই বদলায়নি!
সর্বজয়া বলল, আমি তো গিরগিটি নই যে ক্ষণেক্ষণে বদলাবো।
দ্বিজেন্দ্ৰ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হতাশ গলায় বলল, তুই বোধ হয় ভুলে যাচ্ছিস, তুই বিষ্ণুপুরের জমিদার দ্বিজেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে কথা বলছিস।
সর্বজয়া শ্লেষের ভঙ্গিতে হাসল। তারপর মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে বলল, আজ্ঞে কর্তাবাবু, কসুর নেবেন না। আমার অপরাধ হয়েছে, মার্জনা করুন।
দ্বিজেন্দ্র’র সমগ্র শরীর মুহূর্তেই রাগে, ক্রোধে জ্বলে উঠল। একটা মানুষ কী করে এতটা উদ্ধত হতে পারে! এতটা নির্বিকার ভঙ্গিতে কাউকে কটাক্ষ করতে পারে! সে বলল, গঙ্গামহল বোধ হয় থাকার জন্য ভালো জায়গা নয়!
সর্বজয়া মৃদু হাসল। হাসিটুকু মুখে ঝুলিয়ে রেখেই বলল, আজ্ঞে কর্তাবাবু কি কোনো কারণে আমার উপর রুষ্ট হয়েছেন? গঙ্গামহল থেকে বের করে দিলে আমাদের যে পথে নামতে হবে জমিদার কর্তা! বিষ্ণুপুরের মেজো জমিদারপুত্র তার সন্তানদের নিয়ে পথে-ঘাটে ঘুরছেন, এ দেখতে আপনার কেমন লাগবে? আর প্রজারাই তখন আপনায় কী বলবে বলুন? সকলে আপনার মুখে তখন থুথু ছুঁড়ে মারবে! ওরা দরিদ্র প্রজা, ওদের মুখভর্তি দুর্গন্ধ। সেই মুখের থুতুর স্বাদ তো আপনার ভালো লাগার কথা নয় কর্তাবাবু!
দ্বিজেন্দ্র বজ্রাহতের মতোন তাকিয়ে রইল! তার পায়ের নখ থেকে চুলের ডগা অবধি স্থির আর অসাড় হয়ে গেল যেন! এই অনুভূতির নাম সে জানে না। এমন অবর্ণনীয় অনুভূতি তার আগে কখনো হয়নি। এ কী ভয়ানক দুঃসাহস সর্বজয়ার! এ কী অবশ্বিাস্য ঔদ্ধত্য! কিন্তু এখন কী করবে সে! কী বলবে! অনেক খুঁজেও কোনো যুতসই জবাব সে খুঁজে পেল না। তার মনে হচ্ছে হাত বাড়িয়ে খপ করে সর্বজয়ার গলা চেপে ধরে সে। তারপর পাশের টইটম্বুর গঙ্গাবতীর জলে মাথা চেপে ধরে। কিন্তু এ ঠিক হবে না, তাও সে বোঝে।
সর্বজয়া বলল, আজ্ঞে, কর্তাবাবু পথ ছাড়লে আমরা মহলে ফিরে যেতে পারি। এরকম পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকা জমিদার কর্তাদের কাজ নয়। এ সকল চোর ডাকাত, পাইক বরকন্দাজের কাজ। বিষ্ণুপুরের নয়া জমিদার চোর ডাকাত, কিংবা পাইক বরকন্দাজ তো নন!
সর্বজয়া নিশ্চল, স্থবির দ্বিজেন্দ্র’র পাশ কাটিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে সামনে এগোলো। সুদক্ষিণা তার দিদির হাত চেপে ধরে গায়ের সাথে মিশে রয়েছে। অতসীবালা হাঁটছে দূরে।
ভর সন্ধ্যা নেমে এসেছে গঙ্গামহলের আকাশে। সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে গঙ্গাবতীর তীরে একা দাঁড়িয়ে আছে জমিদার দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ। অন্ধকারে তার চোখ ঢেকে আছে বলে তার চোখের ভাষা পড়া যাচ্ছে না। কে জানে, সেই চোখের ভাষা সর্বজয়া পড়তে পেরেছিল কিনা!
*
দেবেন্দ্রনারায়ণ জানেন না, বিভুঁই তার আসল পরিচয় নিয়ে কী জানে! তবে সেই দিন সে যখন বলল যে তার সত্যিকারের পরিচয় এই জমিদার বাড়ি। তারপর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও স্থির হতে পারেননি তিনি। এই কথা বিভুঁই কেন বলেছে, তাও তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না। আবার বিভূঁইয়ের কাছে জিজ্ঞেস করবার মতোন সাহসও সঞ্চয় করে উঠতে পারছেন না। এমনিতেই ছেলেটার সামনে গেলেই তিনি এলোমেলো হয়ে যান। কথা বলতে গেলে আড়ষ্ট হয়ে যান। কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলেন, তা তিনি নিজেই জানেন না। তার ওপর এমন একখানা কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে কিসের কী অর্থ বের হয়, বা কী বলতে গিয়ে তিনি কী বলে ফেলেন এই নিয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণ ভারি শঙ্কিত। ফলে বিভূঁইকে তিনি আর কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। এরপর থেকে বিভুঁইকে তিনি এড়িয়েই চলছেন। তবে মনে মনে আর দু’দণ্ড শান্তিও খুঁজে পেলেন না দেবেন্দ্রনারায়ণ।
মাঝখানে ভুলে থাকলেও হেমাঙ্গিনী দেবীর চিন্তাটি আজকাল তার মাথায় খুব গেঁথে বসেছে। মানুষটা সেই যে বারোহাটির বাগানবাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেল। তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই! এ কেমনতর কথা? কোথায় যাবে সে! সে কি বেঁচে আছে?
পরদিন হরিহরণকে খবর দিয়ে আনালেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। তারপর গভীর রাত অবধি ঘরের দরজা বন্ধ করে সকলই খুলে বললেন হরিহরণকে। বিভূঁইয়ের পরিচয় অবধি। কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবীর সাথে যে কোনো উপায়ে মুখোমুখি বসতে চান তিনি। হেমাঙ্গিনী দেবী কেন এ সকল করল, তা তিনি তার মুখ থেকেই শুনতে চান। এই ঘটনায় প্রথম প্রথম হেমাঙ্গিনী দেবীর প্রতি যে প্রবল জিঘাংষা তিনি পুষে রেখেছিলেন, তা আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু তিনি শুধু হেমাঙ্গিনী দেবীর কাছে জানতে চাইবেন, বিভুঁই যদি তার সন্তানই হয়ে থাকে, তবে সে কথা সে নিজে কেন মুখ ফুটে তাকে বলেনি! সে কেন এই বিভ্রান্তিকর উপায়টি বেছে নিল!
হরিহরণ সকলই শুনল। পুরোটা সময় সে নির্বিকার মুখে বসে রইল। তারপর বলল, আজ্ঞে কর্তা, হেমাঙ্গিনী দেবীকে আমি কোথায় খুঁজে পাবো?
দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, সে আমি জানি না। তবে এ জানি, হেমাঙ্গিনী দেবী যদি বেঁচে থাকে। তাহলে এ জগতে তাকে তুমি ছাড়া আর কেউ খুঁজে বের করতে পারবে না হরিহরণ বন্নিক।
হরিহরণ কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু তার আগেই দেবেন্দ্রনারায়ণ আবার বললেন, জীবনভর খামখেয়ালি কম করিনি। আজকাল আর পোষাচ্ছে না। শরীর আর সময়ের বিরুদ্ধে গিয়ে বারকয়েক আবারও সকল কিছু নিয়ে আগের মতো হতে মন চাইছিল। কিন্তু মাথা বারবারই মনকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, তোমার সময় শেষ হে দেবেন্দ্রনারায়ণ। সকলের সময়ই একবার শেষ হয়। এখন তোমার সময়ও শেষ হয়ে এসেছে। শেষ সময়ে আর বাড়াবাড়ি করো না। তাই আজকাল আর বাড়াবাড়ির কথা ভাবিও না। কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবীর কাছ থেকে এই কথা না শুনে আমি মরতেও চাই না হরিহরণ। ওই ছেলের জন্য আমি কী করতে পারব, তাও আমি জানি না। তবে মরার আগে জেনে গেলে খানিক শান্তি তো পাবো!
শেষের দিকে এসে দেবেন্দ্রনারায়ণের গলা ধরে এলো। আজ এই প্রথম দেবেন্দ্রনারায়ণের দিকে ভালো করে চাইলো হরিহরণ। এমন দেবেন্দ্রনারায়ণকে কি সে কখনো দেখেছে! দেবেন্দ্রনারায়ণের মাথার চুলের অর্ধেকের বেশিই পাক ধরেছে। গাল ভেঙে ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে। কণ্ঠার হাড় জেগে উঠছে! এ কী অবস্থা দেবেন্দ্রনারায়ণের! এতক্ষণ সে এসবের কিছুই খেয়াল করেনি!
দেবেন্দ্রনারায়ণ আবারও বললেন, হেমাঙ্গিনীর প্রতি অবিচার করেছি মানি। কিন্তু এও মানি, তাকে কখনও হৃদয় থেকে অস্বীকার তো করতে পারিনি। জগতের সকল ভালোবাসার পরিণতি তো প্রাপ্তিতে হয় না। বরং অপ্রাপ্তিই যে ভালোবাসার পরিণতি, সে ভালোবাসাই রয়ে যায় চিরকাল। এর কথা কেউ মৃত্যুর আগ অবধিও ভুলতে পারে না। আমি রেগে গেলে আগুন হয়ে সব দাউদাউ পুড়িয়েছি। হেমাঙ্গিনীকেও বহুবার। অন্যায় করেছি, অত্যাচার করেছি। কিন্তু কাউকে ভালোও যদি বেসে থাকি, সে ওই একজনকেই, হরিহরণ।
দেবেন্দ্রনারায়ণ থেমে খানিক ঢোক গিলে বললেন, বুনো বাঘকে পোষ মানালে কী হয়, দেখেছ হরিহরণ? সে ভেতরে ভেতরে মরে যায়। তার সেই ভেতরের মৃত্যু কেউ দেখে না। সকলে দেখে তার বাইরের রূপ। কিন্তু সে কেবল তার সকল আগুন ভেতরে পুষে পুষে ক্রমাগত দগ্ধ হয়। তার শরীরের মৃত্যুর আগে যে রোজ অসহ্য যন্ত্রণায় সে খানিকটা করে মরেছে, তা কেউ জানে না। কেউ দেখে না।
হরিহরণ কথা বলল না। দেবেন্দ্রনারায়ণ আরো নানান কথা বললেন। হরিহরণ রইল চুপচাপ। সেই চুপচাপ হরিহরণের হঠাৎ মনে হলো ভেতরে ভেতরে দিনের পর দিন কোনো এক ভয়ঙ্কর ঘুণপোকা দেবেন্দ্রনারায়ণের শক্ত সমর্থ শরীরখানাকে ক্রমাগত কেটে গেছে। হরিহরণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দেবেন্দ্রনারায়ণের দিকে। শেষবার সে গঙ্গামহল থেকে সকলের অগোচরেই চলে গিয়েছিল। চলে যাওয়ার কারণটি খানিকটা অদ্ভুতই। সেদিন রতনকান্তি হঠাৎ বলল দেবেন্দ্রনারায়ণের মহলের সকলকে নিয়ে বজরাযোগে প্রমোদ-ভ্রমণের আয়োজনের কথা। কিন্তু কথাটি শুনেই কী যে হলো তার! সাথে সাথেই মনে পড়ে গেল সেই বহুবছর আগের তাদের প্রমোদ-ভ্রমণের কথা। সেই তার ভাই শশীচরণ, বৌদি চন্দ্রাবতী, সে নিজে, বাবা-মা, আর সকলে। সাথে সাথেই মাথাটা আবার এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। গঙ্গামহলের উপর সেই পুরনো রাগ। আবার ফিরে এসেছিল। নিজেকে আর সামলাতে না পেরে পরদিন ভোরের আলো ফোঁটার আগেই সে চলে গিয়েছিল হরিহরণ।
কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ ডাকতেই আবার না এসে সে পারেনি সে। আর এখন মানুষটার জন্য তার প্রবল মায়া হতে লাগল। মানুষটির বাইরের কঠিন আদলটিকেই সকলে দেখেছে, তার বুকের ভেতরটা কেউ কখনো দেখেনি, দেখতে চায়নি। সেই বুকের ভেতরটা নরম কাদা জলের মাটির মতোন। আর এই অদ্ভুত বিষয়টি অন্য কেউ না দেখলেও হরিহরণ যেন কোনো এক বিস্ময়কর উপায়ে নিজের অবচেতনেই টের পেয়েছিল। আর পেয়েছিল বলেই হয়তো দেবেন্দ্রনারায়ণকে কখনো সে তার শত্রু ভাবতে পারেনি। অথচ সেটিই হবার কথাই ছিল সবচেয়ে স্বাভাবিক। দেবেন্দ্রনারায়ণ এই বিষ্ণুপুর জমিদারির মেজোপুত্র। যে বিষ্ণুপুর জমিদারির একজনই আজকের এই হরিহরণ কিংবা হেমাঙ্গিনী দেবীর এই পরিণতির জন্য দায়ী। সেই জমিদারির বিরুদ্ধে হরিহরণ তার বুকে প্রবল আক্রোশ পুষেও রেখেছিল। কিন্তু তা যেন দেবেন্দ্রনারায়ণের ক্ষেত্রে এসে হয়ে গেল পুরোপুরি উল্টো। হরিহরণ জানে না, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখন সে এই মানুষটার এত আপন হয়ে উঠেছিল।
.
হেমাঙ্গিনী দেবীর শরীর ভালো নেই। আজকাল শরীরে তেমন বল পায় না সে। অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে। দেয়ালে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। তার গাল বেয়ে অঝরধারায় অশ্রু ঝরছে। তার সামনে বসে রয়েছে হরিহরণ। দেবেন্দ্রনারায়ণের সকল কথাই হেমাঙ্গিনী দেবীকে বলেছে হরিহরণ। সেই থেকে মুহূর্তের জন্য কান্না থামছে না হেমাঙ্গিনী দেবীর। হরিহরণও তার কান্না থামানোর চেষ্টা করছে না। সে পলকহীন তাকিয়ে আছে কেবল। এই জীবনে কী পেয়েছে হেমাঙ্গিনী দেবী? সেই অতটুকু থেকে তাকে দেখে এসেছে হরিহরণ। জীবন তাকে কী দিয়েছে! এই চোখের জলই তো? আর কী?
হেমাঙ্গিনী দেবীকে দেখে হরিহরণের মনে হয়, ফোঁটা ফোঁটা জলের ভেতরই মানুষের গোটা জীবন লেখা থাকে। এই জল ছাড়া মানুষের জীবনে আর কিছুই নেই। হেমাঙ্গিনী দেবী কাঁদুক। এই কান্নায় তার কেবল দুঃখই নেই, কেবল অপ্রাপ্তিই নেই। এই কান্নার কোথাও না কোথাও খুব সামান্য হলেও খানিক গভীর সুখও যে মিশে আছে। জগতের সকল পুরুষই তাকে কেবল ভোগ করেনি। কেউ একজন তাকে সত্যিকারের ভালোবেসেছে। আর সেই মানুষটি দেবেন্দ্রনারায়ণ। এই সত্যের চেয়ে বড় আর কিছু কি চেয়েছিল হেমাঙ্গিনী দেবী? কিন্তু যেই মানুষটি তাকে সত্যিকারের ভালোবাসল, সেই মানুষটির সামনে কী করে এমন মিথ্যে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াবে সে! নাকি পারবে বিভূঁইয়ের সত্যি পরিচয় প্রকাশ করে তার সামনে দাঁড়াতে!
এই যন্ত্রণার চেয়ে তীব্র যন্ত্রণা আর এই এক জীবনে কী আছে! এক জনমের সবচেয়ে আরাধ্যতম প্রিয় মানুষটির সত্যিকারের অনুভূতিজুড়ে নিজের অস্তিত্বের সার্বক্ষণিক জ্বলজ্বলে উপস্থিতির কথা জেনেও তার সামনে গিয়ে না। দাঁড়াতে পারার চেয়ে কষ্টের আর কী আছে! হেমাঙ্গিনী দেবী সেই সারাটিদিন অমন বসেই রইল। তারপর দিনও। হরিহরণ বারকয়েক জিজ্ঞেস করেছে সে দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে দেখা করতে চায় কিনা। কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবী কোনো জবাব দেয়নি। সে কী করে দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে! কোন মিথ্যে পরিচয়ে? কিংবা কোন নতুন সত্য উন্মোচিত করে? বিভূঁইয়ের জন্য তার বুকটা পুড়ে যায় প্রতিমুহূর্তেই। কিন্তু এও তো সত্য যে বিভুঁই সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়টিতেই রয়েছে। এর চেয়ে নিরাপদ আর কোথায় থাকতে পারত সে?
আরও দিনকয় বাদে হেমাঙ্গিনী দেবী খানিক ধাতস্ত হলে হরিহরণ তাকে দেবেন্দ্রনারায়ণের শরীরের অবস্থাও খুলে বলল। দেবেন্দ্রনারায়ণকে দেখে হরিহরণের কেমন ভয় হয়েছে। তার মনে হয়েছে, এইবার যেন দেবেন্দ্রনারায়ণ প্রকৃত অর্থেই ক্ষয়ে যাওয়া এক মানুষ। হরিহরণ জানে না, এ তার কেন মনে হয়েছে। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণের ক্লিষ্ট মুখ, ভাঙা চোয়াল আর শিথীল শরীরের দিকে তাকিয়ে তার কেন যেন মনে হয়েছে এই জীবন বয়ে বেড়ানোর শক্তি আর অবশিষ্ট নেই দেবেন্দ্রনারায়ণের। এই এতদিন অবধি সেই আগের মানুষটার তেজ না থাকলেও মানুষটা কোথাও না কোথাও ঠিকই ছিলেন। তা সে অসাড় শরীর নিয়ে হোন কিংবা তার আগের সেই পরাক্রমশালী অবয়বের ছায়া হয়েই হোন। কিন্তু সেদিনের শেষরাতের দেবেন্দ্রনারায়ণকে দেখে সে চমকে গেছে। এবার যেন ভেতরে বাইরে একইসাথে নিঃশেষ হতে চলেছেন তিনি।
সকল কথা শুনেও হেমাঙ্গিনী দেবী জবাব দেয়নি। সে জানে না, তার জীবন এমন জটিল কেন? সকল মানুষের জীবনই কম-বেশি জটিলতায় পূর্ণ। কিন্তু তার মতোন এমন কেউ কি রয়েছে! যার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তজুড়েই কেবল কাঁটা। অজস্র কাঁটা। সেই কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে, রক্তাক্ত হয়েও প্রতি মুহূর্তেই তাকে পথ হেঁটে যেতে হয়েছে। এই পথের শেষ কোথায়?
এর দিন দুই বাদে গভীর রাতে হেমাঙ্গিনী দেবীর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমভাঙা হেমাঙ্গিনী দেবী প্রবল জল তেষ্টায় হাহাকার করতে লাগল। হরিহরণ ঘুমিয়ে ছিল মেঝেতে। হেমাঙ্গিনী দেবী তাকে বারকয়েক ডেকে তোলার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরুল না। সে হাঁসফাঁস করতে লাগল। হাঁসফাস করতে করতেই তার মনে হলো সে ভয়ংকর একখানা কাজ করে ফেলেছে। নৃশংস এক কাজ। কিন্তু কাজটি কী তা সে এখনো বুঝে উঠতে পারছে না। হেমাঙ্গিনী দেবী প্রবল আতঙ্ক বুকে চেপে বসে রইল। খানিক আগের স্বপ্নের কথা তার ধীরে ধীরে মনে পড়তে শুরু করল।
সে স্বপ্ন দেখেছে, বারোহাটির বাগানবাড়িতে দেবেন্দ্রনারায়ণের ঘরে। পালঙ্কে বসে আছে সে। পুরো ঘর আর পালঙ্কজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। নানান রঙের ফুল। ফুলের সুবাসে সুরভিত ঘরখানাতে খানিক বাদে ঢুকলেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। দেবেন্দ্রনারায়ণের পরনে নতুন বরের পোশাক। সেই পোশাক দেখে হেমাঙ্গিনী দেবী এতক্ষণে সামনের আয়নায় তাকাল। তাকিয়ে সে চমকে গেল। সে নববধুরূপে সেজে আছে। বিছানাজুড়ে ফুলের পাপড়ি। কোথাও কি মৃদু শব্দে সানাই বাজছে! আজ কি তবে দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে তার ফুলশয্যা!
মুহূর্তেই যেন হেমাঙ্গিনী দেবীর বুকের ভেতর অজস্র পাখি ডানা ঝাঁপটে উড়ে গেল। সে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকাল দেবেন্দ্রনারায়ণের দিকে। দেবেন্দ্রনারায়ণের মুখ প্রসন্ন। তিনি পালঙ্কে পা তুলে বসলেন। তারপর দু’হাতে হেমাঙ্গিনী দেবীর মুখ তুলে ধরলেন। তার এই এতটুকু স্পর্শেই হেমাঙ্গিনী দেবীর শরীর অবশ হয়ে আসছিল। তার কেবল দেবেন্দ্রনারায়ণের বুকের ভেতর মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কী এক লজ্জায় সে আড়ষ্ট হয়ে রইল। দেবেন্দ্রনারায়ণ হেমাঙ্গিনী দেবীর সেই আড়ষ্টতা ভেঙে দিলেন। তিনি হেমাঙ্গিনী দেবীকে শক্ত আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর তার তপ্ত নিঃশ্বাস ছড়িয়ে দিয়ে ঠোঁট ডুবালেন হেমাঙ্গিনী দেবীর ঘাড়ে। দেবেন্দ্রনারায়ণের সেই তপ্ত নিঃশ্বাসে সর্বগ্রাসী ঝড়ো হাওয়ায় কেঁপে ওঠা ছোট্ট পাখির মতোন কেঁপে উঠল হেমাঙ্গিনী দেবী। সে তার সর্বস্ব নিয়ে মিশে যেতে থাকল দেবেন্দ্রনারায়ণের বুকের ভেতর। আবেশে তার। দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল।
হেমাঙ্গিনী দেবী আর দম নিতে পারছিল না। তার বুকের ভেতরটা প্রবল তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছিল। সে তার সেই দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া বুকের ভেতর থেকে আচমকা টের পেল কী এক প্রগাঢ়, সুতীক্ষ্ণ যন্ত্রণায় তার সমগ্র শরীর কুঁকড়ে যাচ্ছে। সেই যন্ত্রণা ক্রমশই কেন্দ্রীভুত হচ্ছে তার ঠোঁটে। ভয়ানক যন্ত্রণা। হেমাঙ্গিনী দেবী সর্বশক্তিতে তার এক ঠোঁটে আরেক ঠোঁট চেপে রেখেছে। তার মনে হলো সেই আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে থাকা ঠোঁটযুগল ছাড়াতে পারলেই সে আবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবে। কিন্তু সে কোনোভাবেই তার সেই ঠোঁটজোড়া পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারছে না। কী যে যন্ত্রণা! কী ভয়ংকর অপারগতা! কী প্রবল স্পর্শ। সেই প্রবল স্পর্শের কারণেই সে হঠাৎ চোখ মেলে চাইল। আর সাথে সাথে আতঙ্কে তার শরীর জমে গেল। সে দেখল সে বসে আছে দেবেন্দ্রনারায়ণের বুকের উপর। তার হাতে একখানা নিরেট পাথর। সেই পাথরখানা উঁচুতে তুলে সে সর্বশক্তিতে আঘাত করে চলেছে দেবেন্দ্রনারায়ণের মুখে। তার আঘাতে-আঘাতে দেবেন্দ্রনারায়ণের সমগ্র মুখমণ্ডল বীভৎসভাবে থেঁতলে গেছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে ফুলের পাপড়ি বেছানো ফুলশয্যায়। দেবেন্দ্রনারায়ণ পড়ে রয়েছেন নীরব-নিথর।
এই অবধি দেখে হেমাঙ্গিনী দেবীর ঘুম ভেঙে গেল। বাকি রাত হেমাঙ্গিনী দেবী আর ঘুমাতে পারল না। জেগে রইল ভোরের অপেক্ষায়। তার মনে হতে লাগল, বুকের ভেতর ওই মানুষটার জন্য এক সমুদ্র তেষ্টা সে বয়ে বেরিয়েছে সারাটাজীবন। এই তেষ্টা অপেক্ষার, এই তেষ্টা উপেক্ষারও। এর চেয়ে বড় তেষ্টা, যন্ত্রণা আর নেই। দেবেন্দ্রনারায়ণের জন্য যে তেষ্টা রয়ে গেছে, সেই তেষ্টাকে কে সে সবসময় অস্বীকার করতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। কোথায় যেন কী অদ্ভুত জাদুবলে মানুষটা তাকে ছুঁয়ে গেছে রোজ রোজ। আরো গভীরভাবে। আরো তীব্রভাবে। আরো বিশালতায়। এই স্পর্শ সারাজনম বয়ে বেরিয়েছে সে। বয়ে বেরাবে বাকিটা জনমও। মানুষ এমন অদ্ভুত কেন?
কেউ কেউ একজনমেও ছুঁয়ে দিতে পারে না, আবার কেউ কেউ ছুঁয়ে দেয় একমুহূর্তেই। সেই একমুহূর্তের স্পর্শেই কেটে যায় জনম জনম।
যে করেই হোক, অন্তত একবারের জন্য হলেও দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে দেখা করতে চায় হেমাঙ্গিনী দেবী। এক মুহূর্তের জন্য হলেও। হরিহরণ ঘুম থেকে উঠলেই সে হরিহরণকে বলবে, যতদ্রুত সম্ভব দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে সে দেখা করতে চায়। এই জীবনে আর একবার হলেও সে মানুষটার সাথে দেখা করতে চায়। মানুষটা কি তার জন্যও ভেতরে ভেতরে এমন রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে! সে কি প্রতিনিয়ত মানুষটার বুকের ভেতর প্রচণ্ড আঘাতে আঘাতে থেঁতলে দিয়েছে!
পরদিন প্রত্যুষের অপেক্ষায় বাকি রাত জেগে রইল হেমাঙ্গিনী দেবী। সে দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে দাঁড়াবেই। দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে যাই বলুন না কেন, সে সকল সত্য নিয়েই তার কাছে যাবে। দেবেন্দ্রনারায়ণের প্রতি তার কোনো রাগ-ক্ষোভ, অভিমান-জিঘাংসা থেকে থাকলে, সে সকল কথাও সে তাকে বলবে। বলবে বিষ্ণুনারায়ণের কথা, বিভূঁইয়ের কথা, বীণাবালার কথা। সকলই সে তার কাছে প্রকাশ করবে। মানুষটা একটা গোলকধাঁধার ভেতর ঘুরে ঘুরে কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু সেই কষ্টের কথা মানুষটা কাউকে বলতেও পারছে না। এ বড় অসহনীয় যন্ত্রণার। বুকের ভেতর অবিরাম দ্বিধা, প্রশ্ন অমীমাংসিত অসংখ্য রহস্য পুষে জীবন কাটানো বড় কষ্টের। দেবেন্দ্রনারায়ণের এই কষ্ট লাঘব করতে পারে একজনই, সে হেমাঙ্গিনী দেবী। অথচ এই এতটা দিন এই কথাটি একবারও ভাবেনি হেমাঙ্গিনী দেবী। কেবল স্বার্থপরের মতোন নিজের কথাই সে ভেবেছে। অথচ ওই মানুষটা বয়ে বেরিয়েছে তার বোঝা! এইবার মানুষটাকে সে খানিক শান্তি দিতে চায়। খানিক বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চায়। এতে যদি হেমাঙ্গিনী দেবীকে মানুষটি ছুঁড়েও ফেলে, তাতেও আপত্তি নেই হেমাঙ্গিনী দেবীর। বুকের ভেতর হেমাঙ্গিনী দেবীর জন্য যে নিখাদ ভালোবাসা এই এতটাকাল পুষে রেখেছেন, এই সত্য প্রকাশে তা যদি ঘৃণাও পরিণত হয়, তারপরও হেমাঙ্গিনী দেবীর আপত্তি নেই। কেবল একটু শান্তি পাক মানুষটি।
হরিহরণের ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় বসে রইল হেমাঙ্গিনী দেবী। অপেক্ষায় বসে রইল ভোরের। প্রতিটিমুহূর্তকে তার মনে হতে লাগল সহস্র বছর। এই অপেক্ষার প্রহর যেন আর ফুরায় না। সারাজনম উপেক্ষিত থাকা দেবেন্দ্রনারায়ণের জন্যই জগতের সবচেয়ে আরাধ্যতম ভোরের অপেক্ষায় থাকা। হেমাঙ্গিনী দেবী তখনও জানে না, সেই ভোর তার জন্য কী নিয়ে অপেক্ষা করছে! সে জানে না, জীবন কারো কারো জন্য কেবল অপেক্ষা আর উপেক্ষারই। এর চেয়ে অধিক কষ্টকর কিছু নেই। কিংবা কে জানে, হয়তো হেমাঙ্গিনী দেবী তার এই চাতক জীবন থেকেই জেনে গেছে এক অকাট্য সত্য, মানবজনমের সবচেয়ে কষ্টকর দুই অনুভূতির নাম অপেক্ষা আর উপেক্ষা।
.
দেবেন্দ্রনারায়ণ মারা গেলেন গভীর রাতে। মৃত্যু তাকে তার জীবনের অতিগুরুত্বপূর্ণ বহু প্রশ্নের উত্তর, বহু অমীমাংসিত রহস্যের সমাধান পেতে দিলো না। মৃত্যুর কাছে জীবনের আর সকল প্রয়োজন মূল্যহীন। তাই দেবেন্দ্রনারায়ণের আর জানা হলো না কিছুই। দেবেন্দ্রনারায়ণের পাশে শুয়ে। থাকা রেণুকা কিছুই টের পেলেন না। তার ঘুম ভাঙল ভোরের আলো ফোঁটার আগেই। ঘুম ভাঙা রেণুকা অন্ধকারে তাকিয়ে দেখলেন দেবেন্দ্রনারায়ণ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। তিনি নানান কাজকর্ম সেরে এসে দেখেন দেবেন্দ্রনারায়ণ তখনও জাগেননি। এত বেলা অবধি তো দেবেন্দ্রনারায়ণ বহুকাল ঘুমান না! আজ হঠাৎ কী হয়েছে! শরীর খারাপ করেনি তো! রেণুকা দেবেন্দ্রনারায়ণের কপালে হাত দিয়ে তার শরীরের উত্তাপ বোঝার চেষ্টা করলেন। এই উত্তাপ বুঝতে গিয়ে রেণুকা আসল ঘটনা আবিষ্কার করলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণের শরীর বরফ শীতল। স্পন্দনহীন, অসাড়।
রেণুকা দেবেন্দ্রনারায়ণের কপাল থেকে হাত সরালেন না। স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন। অনেকটা সময়। তারপর হাতখানা সরিয়ে নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে এসে তার পাশে বসলেন। বসেই রইলেন। কাউকে ডাকলেন না, কাঁদলেন না, চিৎকার করলেন না। তিনি মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন দীর্ঘসময়। রেণুকা কী ভাবছেন কে জানে! তবে জীবন জানে, মৃত্যুজগতের কত হিসেবই। পুরোপুরি মেটাতে দেয় না। মৃত্যু বড় খেয়ালি, তার প্রয়োজন থেকে সে কাউকে অব্যাহতি দেয় না। দেবেন্দ্রনারায়ণকেও দেয়নি। দেবেন্দ্রনারায়ণের জীবন ছিল এক রহস্য। সেই রহস্যের জট তিনি ছাড়াতে পারেননি। মৃত্যু তাকে সে সুযোগ দেয়নি। দেয়ও না। একমাত্র মৃত্যুই জানে, জগতের রহস্য কখনো শেষ হবার নয়। কারণ রহস্য অনন্ত, কিন্তু জীবন নয়।
*
দীপেন্দ্রনারায়ণ জমিদারি মহল কিনেছেন। বিশাল জায়গাজুড়ে তার এই নতুন জমিদারি। তার শ্বশুরালয় থেকেও আরো বহু দক্ষিণ-পূর্বে সরে গিয়ে এই অঞ্চল। বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলের নাম রাজপঠিয়াগড়। এককালে পঠিয়ার রাজাদের অধীনে ছিল এই বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। দীপেন্দ্রনারায়ণ মহল কিনে মহালের নতুন নাম দিয়েছেন। নাম হয়েছে চন্দ্রদীপপুর। চন্দ্রদীপপুর নামের ব্যাখ্যা রয়েছে। তিনি তার পুত্রের নাম রেখেছিলেন চন্দ্রনারায়ণ। আর তার নাম দীপেন্দ্রনারায়ণ। পিতা-পুত্রের নামের আদ্যাক্ষর মিলে নাম হয়েছে চন্দ্রদীপপুর।
জমিদারি মহল হিসেবে চন্দ্রদীপপুর অতি বিশাল না হলেও খুব অকিঞ্চিৎকরও নয়। দীপেন্দ্রনারায়ণের ভেতরে জমিদারি-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে যে এমন প্রবল অভিন্স লুকিয়ে ছিল তা তার খুব কাছের কেউও কখনো ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। তিনি হয়তো অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে গঙ্গামহলে তাকে চিরকালই আড়ালের ছায়া হয়েই থাকতে হবে। সেই ছায়া থেকে তিনি কখনোই বের হতে পারবেন না। কিংবা বীণাবালার মুখোমুখি তিনি হয়তো কখনোই দাঁড়াতে চাননি। তাই নিজের ভেতরে ভেতরে সকলের অগোচরেই দীর্ঘসময় ধরে তিনি তার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছেন। আজ সেই পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের দিন। এখানে একখানা পুরনো জমিদার বাড়িও ছিল। তিনি সেখানাও ন্যায্যমূল্যে খরিদ করেছেন। সেই জমিদার বাড়িখানাকে কারিগর খাঁটিয়ে পুনঃনির্মাণ করে গড়ে তুলেছেন অনেকটাই গঙ্গামহলের আদলে। তবে এখানে বাড়ির সামনে গঙ্গাবতীর ন্যায় বিস্তৃত নদী নেই। রয়েছে একখানা সুদীর্ঘ সুদৃশ্য দীঘি। নদী নেই বলে অবশ্য দীপেন্দ্রনারায়ণের আক্ষেপও নেই। তিনি বরং নদী থেকে দূরেই থাকতে চেয়েছিলেন। নদী সম্পর্কে তার ভেতরে এক অবদমিত ভীতি রয়েছে। নদী তার বুকের ভেতর সবসময়ই এক সর্বগ্রাসী রাক্ষুসীকে পুষে রাখে। সেই রাক্ষুসী একবার জেগে উঠলে সে তার দু’কূলজুড়ে মহাপ্রলয় নামিয়ে নিয়ে আসে। তার চেয়ে এই দীঘিখানাই ঢের ভালো। কী সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া দেয়। এর বুকের ভেতর কোনো রাক্ষুসে তাণ্ডব লুকিয়ে নেই।
আজ তার নতুন জমিদার মহলে পদার্পণ। এই উপলক্ষে অসংখ্য মানুষের জন্য ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। জমিদার মহলের পাশেই বিশাল খোলা মাঠ। সেই ভোলা মাঠে শামিয়ানা টাঙিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাঠের এক পাশে অতি প্রাচীন এক বটবৃক্ষ। সেই বৃক্ষের তলায় অদ্ভুত রকম দেখতে এক বাউল গান গাইছেন। তার গানের সুরে বিমোহিত অভ্যাগত সকলে। বাউলের লম্বা চুল, দাড়ি। তার চক্ষুযুগল মুদ্রিত। হাতে একখানা একতারা। তিনি সেই একতারাখানায় টুংটাং শব্দ তুলে গান গাইছেন–
মানুষ তোর মানস ধন রইল পড়ে, তুই তবু কোন ধন খুঁজিস?
সোনা-দানায় কি ধন থাকে, যদি বা তুই মন বুঝিস!
যে সুখের খোঁজে তুই ধন কাড়িলি, সেই সুখখানি তোর কোথা রয়,
মনের মাঝেই সুখের বসত, তবু সেই মনখানা তোর আড়াল রয়।
জগত যে এক ভ্রমের নগর, সেই নগরে অন্ধ সকল,
ইটের ভেতর মহল খোঁজে, আসল তো মন, অন্দরমহল।
বাউলের মুদ্রিত চোখের পাতা তার সুরের ছন্দে মৃদু কাঁপছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে না এই জগতের আর কোনো কিছুর প্রতি তার কোনো মনোযোগ আছে। মনে হচ্ছে কোনো এক গভীর ধ্যানে মগ্ন এক তপস্বী। তার চারপাশে ক্রমেই জড় হচ্ছে কৌতূহলী মানুষ। বাউলের চারপাশে তারা চক্রাকারে ভিড় করছে। বাউলের গলায় সুর কতটা আছে, তা নিয়ে কেউ ভাবছে না, সকলেই যেন আপনা আপনি ক্রমশই ডুবে যাচ্ছে বাউলের গানের কথায়, তার কণ্ঠের দরদে। কী গভীর মমতা ছড়িয়েই না তিনি গাইছেন। যেন পাখির ভেজা পালক ছুঁয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতর।
বাউলের গান শেষ হলেও তিনি চোখ খুললেন না। তেমন মুদ্রিত চোখেই স্থির বসে রইলেন বটবৃক্ষের তলায়। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে তার চারপাশজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোও কোনো শব্দ করল না। কেউ কোনো কথা বলল না। যে যেমন ছিল তেমনি ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। খানিকক্ষণ বাদে বাউল চোখ মেলে তাকালেন। চারপাশে এত মানুষ দেখে তিনি কিঞ্চিৎ অবাক হলেন। তবে তা তার আচরণে প্রকাশিত হলো না। প্রবল জল তেষ্টায় তার বুক ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি কারো কাছে জল চাইলেন না। আরো খানিকক্ষণ তেমন নিশ্চল বসেই রইলেন। তারপর বহুকষ্টে গাছে হেলান দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে থাকা কৌতূহলী মানুষদের মধ্য থেকে কেউ কেউ তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করার জন্য ছুটে আসছিল। কিন্তু তিনি হাত উঁচু করে তাদের নিবৃত্ত করলেন। তারপর গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দম নিলেন। চারপাশের মানুষগুলো যে তার মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য প্রবল আগ্রহে অপেক্ষা করছে তা তাদের কৌতূহলী চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু বাউল তেমন কৌতূহল মেটানোর মতো কিছুই বললেন না। তিনি শান্ত সমাহিত গলায় বললেন, এদিকে জল পাই কোথায়? বড় তেষ্টা পেয়েছে।
তিনি প্রশ্ন শেষ করলেও কেউ কোনো জবাব দিলো না। তবে দু’চার জন ভিড় ছেড়ে ছুটে গেল। তিনি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে দেখলেন ভিড় ছেড়ে ছুটে যাওয়া মানুষগুলো খানিকবাদেই আবার ফিরে এলো। তাদের হাতে জলপূর্ণ পাত্র। তিনি সেই জলপান করে মৃদু হাসিতে বললেন, রাতের অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি। পথঘাট ঠিক চিনি না। তা এ কোন জায়গা?
ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলল, এ রাজপাঠিয়াগড়।
তবে মানুষটি তার কথা শেষ করবার আগেই পাশ থেকে অন্য একজন বলে উঠল, এ কী বলছ গো! নতুন জমিদার বাবু শুনলে ভারি রেগে যাবেন। কত করে বললেন এ অঞ্চলের নাম এখন চন্দ্রদীপপুর। ঢ্যাড়া পিটিয়ে ঘোষণা দিলেন অবধি। তা কেউ কি শুনেছে! সকলে একে এখনো রাজপাঠিয়াগড়ই। বলছে।
অন্য একজন বলল, তা কথা তুমি মন্দ বলোনি। নতুন জমিদারবাবু এমন। সদাশয় লোক বলেই এখনো কাউকে কিছু বলছেন না। তবে মনে মনে তিনি ঠিকই তেতে উঠছেন।
এতক্ষণে কথা বললেন শশ্রুমণ্ডিত বাউল। তিনি বললেন, এ এলাকায় নতুন জমিদার এসেছেন বুঝি? তা নামখানা কিন্তু তিনি ভারি চমৎকার রেখেছেন। চন্দ্রদীপপুর।
দ্বিতীয় যে লোকটি কথা বলছিল, সে বলল, জ্বি সাধু বাবা। তিনি মানুষও বড় ভালো। প্রজাদের ভালো-মন্দ দেখেন। ভগবানের দয়া, এমন একজন জমিদার আমাদের দিয়েছেন।
বাউল বললেন, আমি তো সাধু নই। সাধু হতে হলে সাধন বড় প্রয়োজন বাবা। তা কার সাধন করব? এমন কাউকে তো খুঁজে পেলাম না। আজকাল বড় বিভ্রান্ত লাগে। মনে হয়, নিজের অন্তর ছাড়া সাধনা করার আর কিছু জগতে নেই। মিছেমিছি আমরা আলেয়ার পিছে ছুটে মরি। এই অন্তরের সাধনার চেয়ে বড় আর কী আছে!
বাউল খানিক থেমে আবার বললেন, আপনাদের জমিদার বাবু হয়তো সেই অন্তরের খোঁজ পেয়েছেন। নিজের অন্তরের খোঁজ পেলে, অন্যের অন্তরের খোঁজ আপনাই চলে আসে। তিনি তাই পেয়েছেন বলেই তার প্রজারা এমন বলতে পারছে। ক’জন অগোচরে কারো গুণের কথা বলে? সকলে থাকে অন্যের অগোচরে তার পরচর্চা নিয়ে। এই যে তার অগোচরে তার এমন সাধুতার কথা বললেন, এই তো সাধনা। নিজের অন্তরের কাছে সৎ থাকার সাধনা।
চারপাশের মানুষ কী বুঝল কে জানে! তবে সকলেই গভীর আগ্রহ নিয়ে বাউলের কথা শুনতে লাগল। বাউলের শরীর খানিকটা ভঙ্গুর এবং দুর্বল মনে হলেও তার চেহারায় আশ্চর্য এক আভা। তার চোখজোড়া ঝকঝকে স্বচ্ছ। মনে হয় এই চোখে তাকালে তিনি সকলের বুকের ভেতর অবধি দেখতে পান। ভিড় ঠেলে একজন এগিয়ে এসে বলল, বাউল বাবা, জীবনে বহু সাধু-বাউল দেখেছি। কিন্তু আজ আপনার ওই গানখানা শুনে, আপনার মুখ দেখে, আপনার কথা শুনে, সব মিলিয়ে কী যেন একটা হয়েছে। গানখানার ভেতর কী যে দরদ ছিল। সে আপনায় বোঝাতে পারব না। সে সাধ্য আমার নেই। আপনার মুদ্রিত চোখ, সৌম্য মুখ, গলাখানি শুধু খানিক নড়ছে। আর হাওয়ায় যেন মায়া ভেসে ভেসে যাচ্ছে। সেই থেকে বুকের ভেতর কেমন একটা শান্তি নেমে এসেছে। এমন কখনো হয়নি বাবা।
বাউল কথা বললেন না। মৃদু হাসলেন কেবল। লোকটি বলল, আমায় আপনার সঙ্গী করুন বাবা। আমি আপনার সাথে সাথে পথে-প্রান্তরে ঘুরব। আপনার সঙ্গী হতে চাই। মনের ভেতর বড় অশান্তি।
বাউল বললেন, আমার সঙ্গী হলে কি অশান্তি কমবে?
লোকটি বলল, কমবে।
বাউল বললেন, কী করে বুঝলেন?
লোকটি বলল, আপনায় দেখেই মনের ভেতরটা কেমন শীতল হয়ে এলো।
বাউল হাসলেন। বললেন, আমরা সকলেই মানুষের বাইরের চেহারা দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই। কিন্তু বাইরের চেহারা তো পোশাক মাত্র। আসল মানুষ তো অন্তরে। সেই অন্তর কি দেখা যায়?
লোকটা বলল, যায় বাবা। কারো কারো চেহারা দেখেই তার অন্তর দেখা যায়।
বাউল বলল, সীতাকে কি করে হরণ করা হয়েছে, সে তো জানেন? এক শান্ত সৌম্য চেহারার সাধু এসে সীতার কাছে অন্নভিক্ষা চাইল। কিন্তু সীতা লক্ষণরেখা অতিক্রম করলে সেই সাধুই সীতাকে হরণ করে। আসলে সাধুর আড়ালে লুকিয়ে ছিল স্বয়ং রাবণ। দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। সে নানা রূপ ধরে ঘুরে বেড়ায়। অন্যকে বিভ্রান্ত করে।
বাউল খানিক থামলেন। তারপর চাণক্য শ্লোক থেকে আওড়ালেন, দুর্জনঃ প্রিয়বাদীচ নৈব বিশ্বকারনম মধু তিষ্ঠতি জিহ্বাগ্রে হৃদয়ে তু ছলাছলম। দুর্জনকে কখনোই বিশ্বাস করা উচিত নয়, কারণ তার জিভে থাকে মধু আর হৃদয়ে থাকে বিষ। এখন এ জগতে কে দুর্জন আর কে সাধু তা কী তার মুখ দেখে বোঝা যায়? যায় না।
লোকটা বলল, কিন্তু বাবা, অন্যের অন্তর চেনার উপায় কী?
বাউল বললেন, অন্যের অন্তর কেন চিনতে হবে? নিজের অন্তর চিনতে হবে। নিজেকে চেনাই সবচেয়ে বড়। আমাদের একটা জীবন চলে যায় অন্যকে চিনতে চিনতে। কিন্তু নিজের দিকে তাকানোর সময় আমাদের হয় না। অথচ নিজেই রয়ে যাই নিজের কাছে সবচেয়ে বেশি অচেনা।
বাউল কথার এই পর্যায়ে এসে আবার গান ধরলেন–
‘ওহে নিজ রয়ে যায় অগোচরে, অন্যরে করি সন্ধান,
নিজের ভেতর খুঁজলে পাবি, এই জগতের সকল প্রাণ।’
বাউলের গান শেষ হলেও গানের সুর যেন বাতাসে ভেসে রয়। শ্রোতারা। তন্ময় হয়ে থাকে সেই সুরে। সেই কথায়। বাউল বললেন, জগতে প্রত্যেকেই একা। এ জগতে সঙ্গী বলে কিছু নেই। মানুষ নিজেই কেবল নিজের সঙ্গী। সে যদি তার নিজের সঙ্গী হতে পারে, তাহলে এই পার্থিব জগতের সুখ-দুঃখের ক্ষমতা নেই তাকে স্পর্শ করার। আপনার মনে কী খেদ, সে আমি জানি না। কিন্তু সেই খেদ, সেই যন্ত্রণা, আমার সাথে ঘুরলে চলে যাবে, এ কথা ঠিক নয়। আপনাকে আপনার নিজের সাথে ঘুরতে হবে। নিজের মনের সাথে থাকতে হবে।
লোকটা বলল, কিন্তু নিজেকে চিনতে, জানতে হলে সাহস দরকার বাবা। নিজের মুখোমুখি হতে সাহস লাগে। ওই সাহসটাই যে নেই। আমি ভীতু মানুষ।
বাউল হাসলেন। হেসে বললনে, জগতে সাহসী মানুষের চেয়ে ভীতু মানুষ অধিক দরকার, অথচ জগত সাহসী মানুষে পরিপূর্ণ। অসৎ কাজ করতে সবচেয়ে বেশি দরকার হয় সাহসের। ভীতু মানুষেরা অসৎ হতে পারে না। ভীতু মানুষেরা সৎ হয়, সাহসীরা হয় অসৎ। কিন্তু এই জগৎ এখন সাহসী অসৎ মানুষে পরিপূর্ণ এক জগৎ। সাহসী মানুষেরা নিজেকে খোঁজার দায় অনুভব করে না। তারা সবসময়ে অন্যকে খুঁজে বেড়ায়। অন্যের দোষ, ত্রুটি, ভুল। কিন্তু নিজেকে খোঁজার তাড়না তাদের থাকে না। ভীতুদের থাকে। ভীতুরা নিজেকে নিয়ে খুব ভাবে। এই ভাবনাটাই জরুরি। নিজেকে জানা। নিজেকে চেনা।
লোকটি এবার আর কোনো কথা বলল না। কথা বলল না কেউই। সকলেই মুগ্ধ হয়ে বাউলের দিকে তাকিয়ে রইল। বাউল বললেন, আমার বড় খিদে পেয়েছে। জমিদার বাড়িতে কি সামান্য আহারের ব্যবস্থা হবে? কিংবা আশেপাশে কোথাও? কেউ চাইলে যতটা সম্ভব কায়িক শ্রমে আমি আহারের . মূল্য শোধ করে দিতাম।
জনতার পেছন থেকে ভিড় ঠেলে সামনে এসে দাঁড়াল এক লোক। সে বাউলের সামনে এসে বিনীত গলায় বলল, আজ্ঞে, জমিদার কর্তার কানে আপনার কথা পৌঁছেছে। তিনি দূরে বসেই আপনার গানও শুনেছেন। তিনি চাইছেন, আজ এই শুভদিনে তার আয়োজনে আপনি আহার গ্রহণ করবেন।
বাউল স্মিত হাসলেন। বললেন, আপনাদের জমিদার বড় দরাজ হৃদয়ের মানুষ। ভগবান তার মঙ্গল করুন।
বাউল সেই শামিয়ানা টাঙানো মাঠে সকলের সাথে বসে আহার গ্রহণ করলেন। আহারের মাঝামাঝি সময়ে জমিদার দীপেন্দ্রনারায়ণ অভ্যাগতদের আহার তদারকি করতে আসলেন। ওই সামান্য সময়ে বাউলের প্রতি মানুষের আগ্রহ দেখে দীপেন্দ্রনারায়ণ ভারি অবাক হয়েছেন। দূর থেকে বাউলের কণ্ঠস্বর শুনে তার আহামরি কিছু মনে হয়নি। কিন্তু কী যেন একটা বিষয় ছিল, যা তাকে বাউলকে দেখবার জন্য কৌতূহলী করে তুলেছে। তিনি দূর থেকে বাউলকে দেখলেন, লম্বা চুল দাড়িতে বাউলের চেহারা প্রায় ঢেকেই রয়েছে। মুখের বেশির ভাগ অংশই দেখা যায় না। কিন্তু এতদূর থেকেও তিনি বাউলের স্বচ্ছ গভীর চোখজোড়া দেখে কেমন চমকে গেলেন। দীর্ঘসময় তিনি বাউলের চোখে নিমগ্ন হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বাউলের ওই চোখে, আংশিক উন্মুক্ত চেহারায় কিছু একটা রয়েছে, যা তিনি ধরতে পারছেন না। কিন্তু বিষয়টি তাকে এক ধরনের অস্বস্তি দিচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে দূর থেকে বাউলও সরাসরি দীপেন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকালেন। একদম দীপেন্দ্রনারায়ণের চোখে চোখ। মুহূর্তকালের সেই তাকানোতে জমিদার দীপেন্দ্রনারায়ণকে দেখে বাউলের দৃষ্টি কি মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল!
.
বাউল আহার শেষে তার পথ ধরলেন। চমৎকার মধ্যাহ্নভোজের জন্য তিনি জমিদার দীপেন্দ্রনারায়ণকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে সরাসরি কথা হয়নি। দীপেন্দ্রনারায়ণ ভেবেছিলেন আহার শেষে সকলে চলে গেলে বাউলের সাথে তিনি একান্তে কথা বলবেন। কিন্তু সে আর হলো না। তার একমাত্র পুত্র চন্দ্রনারায়ণ পালঙ্ক থেকে পড়ে আহত হয়েছে। তিনি সকল কিছু ফেলে ছুটে গেছেন পুত্রের কাছে। পুত্রের সেবা শুশ্রূষা শেষে ফিরে এসে দেখেন বাউল নেই। সেই দিন বাদবাকি সময় ভারি অস্থির হয়ে রইলেন দীপেন্দ্রনারায়ণ। কে এই বাউল! তাকে দেখার পর থেকে তার এমন অস্থির লাগছে কেন? মানুষটার চোখে কিছু ছিল, যা তাকে এমন অস্থির করে তুলেছে। কিন্তু সেই বিষয়টি কী, তা দীপেন্দ্রনারায়ণ সারাদিনেও খুঁজে পেলেন না। খুঁজে পেলেন গভীর রাতে। খানিকটা তন্দ্রামতো লেগে এসেছিল তার। এই মুহূর্তে মনে হলো তাকে কেউ ডাকছেন, দিপেন, দিপেন, উঠ। প্রত্যুষে আলো হাওয়া বড় ভালো। খানিক শরীর মনে লাগিয়ে নে।
দীপেন্দ্রনারায়ণ ঝট করে উঠে বসলেন। তিনি বাউলকে চিনতে পেরেছেন। বাউল আর কেউ নন, তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা অবনীন্দ্রনারায়ণ।
বাউলরূপী অবনীন্দ্রনারায়ণ বসে রয়েছেন প্রমত্তা এক নদীর তীরে। এই নদীর নাম তিনি জানেন না। তবে এই নদী বেয়ে উজানে পাহাড়ি ঢল নেমে আসছে। সেই ঢল বন্যা হয়ে প্লাবিত করছে আশেপাশের এলাকা। তিনি চন্দ্রদীপপুর থেকে যাত্রা শুরু করবার পরপরই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই বৃষ্টি টানা তিন দিন ধরে চলছে। মুহূর্তের জন্য থামার নাম নেই। সেই বৃষ্টিতে আশেপাশের পাহাড়ি ঢলও নেমে এসছে উন্মত্ত গতিতে। অবনীন্দ্রনারায়ণ উন্মত্ত নদীর দিকে তাকিয়ে আঁৎকে উঠলেন। এ যেন এক সর্বগ্রাসী দানব। নদীর স্রোত আর প্রবল ঢেউয়ে ধ্বসে যাচ্ছে তার উল্টোপাশের পাড়। ভেঙে যাওয়া অংশে পরক্ষণেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে আরো বড় ঢেউ। যেন থাবা মেরে তুলে নিচ্ছে পাড়ের মাটি। তারপর ডুবে মিশে যাচ্ছে আরেক ঢেউয়ের শরীরে।
অবনীন্দ্রনারায়ণ দীর্ঘসময় বসে থেকে এই ধ্বংসলীলা দেখলেন। দেখতে দেখতে তার হঠাৎ মনে হলো নদীর এ কূল ভাঙলে ও কূল গড়ে, এ তো নিয়ম। এই নিয়ম কি জগতের সকল কিছু ঘিরেই? এই জগত কি ভাঙা আর গড়ার খেলা?
এইমুহূর্তে তার দীপেন্দ্রনারায়ণের কথা মনে পড়ল। তিনি আজকাল আর পার্থিব হিসেব নিকেশ নিয়ে ভাবেন না। কখনো কখনো যে ভাবনাগুলো তার মাথায় আসে না তা নয়। কিন্তু সেই ভাবনাগুলোকে তিনি মাথা থেকে তাড়িয়ে দেন। সেদিন চন্দ্রদীপপুর নামের জমিদারির জমিদার হিসেবে দীপেন্দ্রনারায়ণকে দেখে তিনি ভীষণ চমকে গিয়েছিলেন। মুহূর্তেরও ভগ্নাংশ সময়ে যেন তার চিন্তার জগতে অজস্র প্রশ্ন উঁকি দিয়ে গিয়েছে। তিনি ভুল কিছু দেখছেন না তো! দীপেন্দ্রনারায়ণের মতো দেখতে ওই মানুষটি কি আসলেই দীপেন্দ্রনারায়ণ। মুহূর্তের জন্য দ্বিধান্বিত হয়ে গেলেও তার সেই দ্বিধা কেটেছে দীপেন্দ্রনারায়ণের দৃষ্টিতে। দীপেন্দ্রনারায়ণ তার দিকে যে দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে ছিলেন, সেই দৃষ্টি পড়তে বাউলরূপী অবনীন্দ্রনারায়ণের অসুবিধা হয়নি। তার দ্বিধারা সাথে সাথেই দূরীভূত হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে তিনি আর ভাবতে চাননি। যে লোকটি তাকে মধ্যাহ্ন ভোজে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, সেই লোকটিকেও তিনি চিনেছিলেন, কিন্তু ধরা দেননি। লোকটি মুকুন্দ।
দীপেন্দ্রনারায়ণ কিভাবে এখানে এলেন, তা নিয়ে অবনীন্দ্রনারায়ণ আর ভাবলেন না। এ সকল ভাবনা থেকে বহু আগেই তিনি নিবৃত হয়েছেন। তার এখন নির্দিষ্ট ঘর নেই, সংসার নেই, স্ত্রী, পুত্র, পরিজন নেই। এই জগতই তার ঘর-সংসার। বৃষ্টিতে ভিজে অবনীন্দ্রনারায়ণের শীত শীত লাগছিল। তার পেছনেই হেঁটে গেলে দূরে ক’খানা বাড়ি তিনি দেখেছেন। জেলেদের বাড়ি। তিনি সেই বাড়ি লক্ষ্য করে হাঁটতে শুরু করলেন। সেখানে এক মধ্যবয়স্ক জেলের বাড়িতে সেই রাতের জন্য তার আশ্রয় হলো। কিন্তু সেই রাতই না, অবনীন্দ্রনারায়ণকে সেখানে থাকতে হলো টানা কয়েকদিন। পরদিন ভোরবেলা তার ঘুম ভাঙল না। বাউল অবনীন্দ্রনারায়ণ কথা শুনে ভারি মুগ্ধ হয়ে গেল গৃহকর্তা দরিদ্র জেলে। সে ভোরবেলা অবনীন্দ্রনারায়ণকে ডাকতে এসে দেখে জ্বরে অবনীন্দ্রনারায়ণের গা পুড়ে যাচ্ছে। সেই দিন আর অবনীন্দ্রনারায়ণের যাওয়া হলো না। দিনভর অবনীন্দ্রনারায়ণ বিছানায় শুয়ে রইলেন। জেলে আর তার স্ত্রী মিলে অবনীন্দ্রনারায়ণের সেবা শুশ্রূষার কোনো কমতি রাখল না। জেলে দম্পতির দুটি সন্তান রয়েছে। এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তান। কন্যা সন্তানের বয়স বারো, পুত্রের দশ।
স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ফারাক চোখে লাগার মতো হলেও এ নিয়ে অবনীন্দ্রনারায়ণ ভাবলেন না। বরং সংসারটিকে তার খুব ভালো লেগে গেল। এদের আলাদা কোনো চাহিদা নেই। রোজ দিন দরিদ্র জেলে যা রোজগার করে তাতেই তার কমবয়সী স্ত্রী খুশি। ভারি সুখী পরিবার। কিন্তু সন্তানদের সাথে বাবার চেয়ে মায়ের সংশ্রব যেন ঢের বেশি। অবশ্য এর কারণও রয়েছে, জেলে সারারাত নদীতে মাছ ধরে এসে দিনভর ঘুমায়। আবার সন্ধ্যে হলেই বেরিয়ে যায়। সন্তানদের সাথে তার দেখা সাক্ষাৎ খুব একটা হয় না।
পরিবারটির সাথে থাকতে থাকতে অবনীন্দ্রনারায়ণের মনে হলো জগতে মানুষ আসলে সুখের পেছনে ছোটে। সে ওই ধনসম্পদ হোক, আর তার মতোন চিন্তার অনুসন্ধান হোক। সকলই আসলে মনের শান্তির জন্য। এই পরিবারটিকে দেখে তার মনে হলো এরা সেই শান্তির খোঁজ পেয়েছে। এদের শান্তি খুঁজতে হয়নি। এর কারণ অবশ্য এদের চাহিদার স্বল্পতা। দু’বেলা আহার আর মাথা গোঁজার এই ঠাইটুকুন ছাড়া যেন এদের আর কোনো চাহিদা নেই। এমন একখানা সংসার দেখে অবনীন্দ্রনারায়ণের ভীষণ শান্তি হলো। জগজুড়ে সকলেই যেখানে আরো প্রাপ্তির পিছে ছুটছে, আরো ভোগ আর বিলাসের পিছে। তখন এই পরিবারটি, এই পরিবারের মানুষগুলো কী সহজ, কী স্বাভাবিক, সাধারণ এক শান্তির জীবন বেছে নিয়েছে অকপটে। এখানে যেন কোনো ভান নেই, কোনো মুখোশের আড়ালে আশ্রয়ের তাড়া নেই। সকলই টলটলে জলের মতোন স্বচ্ছ।
এক মাঝরাতে অবনীন্দ্রনারায়ণের হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে ঘুম ভাঙার কারণ বুঝতে পারলেন না অবনীন্দ্রনারায়ণ। মূলঘর লাগোয়া ছোট একখানা বাহির বারান্দা। সেখানে তক্তপোষ বিছানো। সেই তক্তপোষে শুয়ে ছিলেন অবনীন্দ্রনারায়ণ। তিনি ঘুম থেকে উঠে বসলেন। বাঁশের বেড়ার ওপার থেকে। জেলের স্ত্রীর মৃদু কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। অবনীন্দ্রনারায়ণ কী করবেন বুঝতে পারছেন না। এত রাতে ঘরে স্বামী নেই এমন অল্পবয়সী এক মেয়ের ঘরের দরজায় কি তিনি শব্দ করবেন? ভেতরে কী হচ্ছে তা জানতে চাইবেন? সেটি কি ঠিক হবে? কিন্তু তিনি চমকে গিয়ে আবিষ্কার করলেন, ভেতরে মেয়েটি একা নয়। একটি পুরুষ কণ্ঠের শব্দ শোনা যাচ্ছে। পুরুষ কণ্ঠটি চাপা গলায় বলল, তোকে প্রতি হপ্তায় টাকা দিয়ে যাই না? ওই বাচ্চা দুটার জন্যই তো দেই। তা কী ভেবেছিস? ওই বুড়াহদ্দ জেলের মাল গেলার জন্য দিই?
জেলের স্ত্রী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আপনি আমায় এখান থেকে নিয়ে যান। আমি আর এখানে থাকতে পারব না। রোজ সারারাত মদ গিলে এসে বলে টাকা দে। বাচ্চাগুলাকেও ঠিক মতোন দু’বেলা খাবার দিতে পারি না। আপনি যে টাকা দিয়ে যান, হপ্তাহ যেতেই এসে বলে, তোর নাগর এসেছিল গতরাতে? তা গতর বেঁচে কত পেয়েছিস, দেখি, দে দেখি। তারপর সব কেড়ে নিয়ে যায়। বাচ্চা দুটোর দিকে ফিরেও তাকায় না।
পুরুষ কণ্ঠ বলল, বাচ্চার বাপ হবার মুরোদ থাকলে না বাচ্চাদের জন্য মায়া থাকবে। বুড়ো হাবড়া, বিয়ে করেছে জোয়ান মেয়ে ছেলে। তা সে রাখতেও জানে না, ফেলতেও জানে না।
পুরুষ কণ্ঠ খানিক থামল। তারপর আবার বলল, এ ছেলে-মেয়ে ওর হলে না ও ফিরে তাকাত! এ আমার ছেলে-মেয়ে, আমিই ফিরে তাকাবো। ভদ্র সমাজে তো আর বাপ হিসেবে পরিচয় দিতে পারি না। কিন্তু মায়া তো হয় নাকি!
জেলের স্ত্রী বলল, আমাদের আপনি আপনার সাথে নিয়ে চলুন।
পুরুষ কণ্ঠ এবার খানিক চড়ল। জেলের স্ত্রীর কথাটিই লোকটি ব্যঙ্গ করে বলল, আমাদেরও আপনি নিয়ে চলুন। তা কী করে নেব শুনি? আমার স্ত্রী সন্তান রয়েছে। সমাজে মান-সম্মান রয়েছে। এখন এই তোকে দু’দুটো ছেলে মেয়ে নিয়ে কোন চুলোয় রাখব? আর তুই কি আমার বিয়ে করা বউ? বুড়ো হাবড়া হোক, মাতাল হোক, ওই ব্যাটা জেলেই শাস্ত্রমতে তোর বিয়ে করা স্বামী। আরেকজনের বউ ভাগিয়ে নিয়ে বিপদে পড়ি আর কি!
এবার জেলের স্ত্রীর খানিক ঝঝিয়ে উঠল যেন। বলল, এ কথা আগে খেয়াল ছিল না? যখন আমার কাঁচা গতর দেখে হাভাতের মতোন হামলে পড়েছিলেন?
পুরুষ কণ্ঠটি এবার খেপেই গেল। বলল, চুপ মাগী। তুই তো বারোভাতারি। আমার আগে কম মর্দ এই গতরে নিয়েছিস? তোর গতরের খাই তাতেও তো মেটে না। এমন খাইখাই গতরের মেয়েকে কিনা তোর বাপ বিয়ে দিয়েছিল ওই বুড়োর কাছে! তা সে তোকে দিয়ে তো দিব্যি ব্যবসা পাতিয়ে বসেছিল। আমি থাকায় রক্ষে। না হলে এতদিনে শেয়াল-শকুনে তোর এই গতর ছিঁড়ে-খুঁড়ে খেত। আর ঘটে বুদ্ধিও তো কম রাখিসনি। সময়মতো দু’দুবার পেট বাধিয়েছিস, যাতে ওই দুটো ছেলে-মেয়ের কারণে হলেও তোকে ছেড়ে যেতে না পারি। এবার এই টাকা দিয়ে যাচ্ছি। খবরদার, ওদের মুখে দু’চারটা ভালো-মন্দ খাবার দিস কিন্তু।
অবনীন্দ্রনারায়ণের মাথা ঝিমঝিম করছিল। এ তিনি কী শুনছেন! দিনের আলোয় যেই ঝলমলে হাসিখুশি সুখী পরিবারটি দেখে তিনি এতদিনকার ছেড়ে আসা সংসারের প্রতি খানিক ভালোলাগা নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন, সেই সংসারে রাতের অন্ধকারে এ তিনি কী দেখছেন! কোন সত্য আবিষ্কার করলেন! এই সত্য আবিষ্কার না করলেই বোধ হয় ভালো হতো। একটি সুন্দর বিশ্বাস, অনুভূতি বুকের ভেতর লেগে থাকত!
পুরুষকণ্ঠটি টাকা গুনে দিতে দিতে বলল, নে, এবার কাপড় খোল। কাপড় খুলে পা ফাঁক করে শুয়ে পড়। দুই পায়ের মাঝে আছেই তো ওই এক জিনিস। তা-ও যত দিন আছে, ততদিন আর চিন্তা কী? এমন পা ফাঁক করে। শুয়ে পড়লে পয়সার আর অভাব কী তোর?
সেই সারারাত অবনীন্দ্রনারায়ণ আর ঘুমাতে পারলেন না। জেগে রইলেন। ভোর অবধি। বুকের ভেতর যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সকল কিছু ভেঙে ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। সেদিন দেখা নদীর পাড় ভাঙার মতোন ভেঙে যাচ্ছে সকল কিছু। এলোমেলো লাগছে সকলই। ভোরের আলো ফোঁটার খানিক আগে তার চোখের পাতা লেগে এলো। কতক্ষণ চোখ লেগে ছিল তিনি জানেন না। তবে সেইটুকু সময়ে বহু দিন বাদে আবারো তিনি সেই ভয়াবহ দুঃস্বপ্নটি দেখলেন। পরদিন অবনীন্দ্রনারায়ণ আবার পথে নামলেন। কিন্তু এবার বুকের ভেতরের সেই প্রশান্তি যেন আর নেই। তিনি হেঁটে চললেন অনিশ্চিত। কিন্তু তার মনে হতে লাগল, জগৎ-সংসারের হিসেব-নিকেশ ভুলে থাকা সহজ নয়। এ বড় কঠিন হিসেব। সেই কঠিন হিসেবের ভেতর থাকে মস্ত বড় সব ফাঁকি। মানুষকে সেই ফাঁকি জেনেশুনেই বেঁচে থাকতে হয়। জীবন এমনই। কিন্তু এই জগৎ-সংসারে অবনীন্দ্রনারায়ণের জীবনের ফাঁকিটি কী?