০৮.
বাড়ি ফিরে চন্দনকে পাওয়া গেল। সে অপেক্ষা করছিল।
সামান্য রাত হয়েছে।
কিকিরা বললেন, “বোসো, একেবারে খেয়েদেয়ে বাড়ি ফিরো।”
পোশাক পালটে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলেন কিকিরারা। চন্দন বলল, “কী সার? কতটা এগুলো?” চন্দনের বলার মধ্যে একটু ঠাট্টার ভাব ছিল।
কিকিরা প্রথমে জবাব দিলেন না। পরে বললেন, “অমলেন্দু!”
“কে অমলেন্দু? মোহনের বন্ধু?”
“হ্যাঁ। মোহনের বন্ধু।” বলে তারাপদর দিকে তাকালেন কিকিরা।
“তারাপদ, তুমি এতদিনে এমন একজনকে দেখলে–যিনি অনেক কিছুর খোঁজ রাখেন। মিহিরবাবুর কথা বলছি। পাকা লোক। উনি কিন্তু জানেন এই অমলেন্দু ছোকরা কোথায় আছে। ..তারাপদ, মিহিরবাবুর মতলবটা কী?”
তারাপদ মাথা নাড়ল। “বুঝতে পারছি না।”
চুপচাপ। কথা বলল না কেউ কিছুক্ষণ। শেষে চন্দন বলল, “অমলেন্দু তা হলে এখন কলকাতায়?”
কিকিরা বললেন, “তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অমলেন্দু “শুধু কলকাতায় নেই, এই ঘটনাগুলো সেই ঘটাচ্ছে।”
“আপনি ফোনের কথা বলছেন?”
“হ্যাঁ, সে ফোন করছে। তুলসীবাবুর কাছে সে-ই গিয়েছিল। মিহিরবাবুর কথা থেকে বোঝা গেল, ও শুধু ভাল অভিনেতা নয়, ভাল মেক-আপ নিতে, গলার স্বর পালটাতেও পারে।”
তারাপদ হঠাৎ বলল, “আর-একটা জিনিস লক্ষ করেছেন? জাল মোহন ফোন করেছে চার জায়গায়, নিজে গিয়ে হাজির হয়েছে এক জায়গায়, আর চিঠি লিখেছে মাত্র এক জায়গায়–ওই মিহিরবাবুর কাছে। কেন? ফোনে গলা শোনা যায় চোখে দেখা যায় না। জাল মোহন এমনই একজনের কাছে সশরীরে দেখা দিয়েছিল, যে প্রায় অন্ধ। ছানিকাটানো চোখ। তাও দেখা দিয়েছিল সন্ধেবেলায়, টিমটিমে আলোর মধ্যে। আর চিঠি লিখেছে ওই মিহিরবাবুর কাছে। শুধুমাত্র তাঁকেই চিঠি লিখতে গেল কেন?”
চন্দন খেতে-খেতে বলল, “তোরা চিঠি দেখতে চাসনি?”
“না। দেখতে চেয়ে লাভই বা কী হত? আমরা তো হ্যান্ড রাইটিং এক্সপার্ট নই। তা ছাড়া মোহনের আগের হাতের খেলাও চিনি না। সেই লেখা পাব কোথায়? তার চেয়ে লোচনের কথাই স্বীকার করে নেওয়া ভাল। লোচন বলেছে, দেখতে তো একইরকম। মিহিরবাবু ওকে চিঠি দেখিয়েছেন।”
চন্দন যেন ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল। মিহিরবাবুর কাছে এই জাল মোহনের হাতের লেখা দেখে লোচন স্বীকার করে নিয়েছে লেখাটা মোহনের বলেই মনে হচ্ছে। আশ্চর্য কাণ্ড! এখানে তারাপদরা আর কী করতে পারে নতুন করে?
কিকিরা বললেন, “চাঁদু, এখন আমার মনে সন্দেহ হচ্ছে মিহিরবাবু এর মধ্যে আছেন। তিনি কোনো প্যাঁচ খেলছেন।”
“কেমন?”
“কেমন!..তুমি পুতুলনাচ দেখেছ! একটা লোক পরদার আড়াল থেকে লুকিয়ে পুতুল খেলা দেখায়? দেখেছ নিশ্চয়। মিহিরবাবু বোধ হয় সেই লোক। তিনিই নাচাচ্ছেন জাল মোহনকে।”
“মিহিরবাবুর স্বার্থ?”
মাথা নাড়লেন কিকিরা। “বুঝতে পারছি না। লোচন আর মোহনের মধ্যে মিহিরবাবু কেন? তাঁর কিসের স্বার্থ? তিনি তো তৃতীয় ব্যক্তি।”
তারাপদ বলল, “মোহনকে উনি খুবই ভালবাসতেন।”
চন্দন বলল, “মিহিরবাবু মানুষটি কেমন? মানে আসল চেহারাটি কেমন?”
“খারাপ বলে তো মনে হল না,” কিকিরা বললেন খেতে-খেতে, “গুড ম্যান। নাটক-পাগল। কথাবার্তায় মাই ডিয়ার। মানুষটিকে ভালই লাগে। তা ছাড়া বড় ফ্যামিলির ছেলে। নিজেরাও বেশ সচ্ছল। পড়াশোনা করা মানুষ। ওঁর নিজের কোনো স্বার্থ থাকার কথা নয়।”
“তবে?”
“সেটাই বুঝতে পারছি না।”
তারাপদ হঠাৎ বলল, “মোহনের হয়ে উনি লড়ছেন না তো?”
“মানে?”
“আমি বলছিলাম, মোহনের পক্ষ নিয়ে উনি লড়ছেন না তো?
চন্দন বলল, “উকিলরা বরাবরই তাদের মক্কেলের পক্ষ নিয়ে লড়ে। কিন্তু এখানে মক্কেল কই? সে তো মারা গিয়েছে। মরা মানুষের পক্ষ নিয়ে লড়া। তাতে লাভ। মোহনের হয়ে যদি কেউ মিহিরবাবুকে লড়াতে চায় অন্য কথা। তেমন কেউ নেই। মোহনের স্ত্রী নয়, নিজের কেউ নয়..”।
কিকিরা হঠাৎ বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, “তারাপদ, তুমি একটা জিনিস লক্ষ করেছ। মিহিরবাবু বারবার বলছিলেন, যদি ধরে নেওয়া যায় লোচনই খুনি–তবে তা প্রমাণ করা যাবে কেমন করে?…ওঁর কথা থেকে মনে হচ্ছিল, লোচনকে উনি পুরোপুরি সন্দেহ করলেও এমন কোনো প্রমাণ দেখতে পাচ্ছেন না-যা দিয়ে বলা যায়, লোচন খুনি।” খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল কিকিরার। উঠে পড়লেন। বাইরে গেলেন হাত-মুখ ধুতে।
তারাপদ বলল, “চাঁদু, কেসটা কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। মিহিরবাবু জটটাকে আরও পাকিয়ে দিলেন।”
চন্দন বলল, “ওই অমলেন্দুকে ট্রেস করতে পারিস না? খোঁজ লাগা।”
“আমি পারব না। কোথায় খোঁজ করব?”
“চেষ্টা কর।”
তারাপদ কিছু বলল না। একাজ তার পক্ষে অসম্ভব। কোথায় খোঁজ করবে অমলেন্দুর?
কিকিরা হাত মুছতে মুছতে ফিরে এলেন। বললেন, “মিহিরবাবুই এখন এক নম্বর হল তারাপদ। ভদ্রলোকের ওপর নজর রাখা দরকার। উনিই যে কলকাঠি নাড়ছেন, তাতে আমার সন্দেহ নেই। তবে কী উদ্দেশ্য, তা বুঝতে পারছি না।” বলেই কিকিরা কী ভেবে বললেন, “ইভনিং ক্লাবটা কোথায় যেন? ওই পাড়াতেই না!”
তারাপদ বলল, “হ্যাঁ। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছেই। “
“ওদের বোধ হয় রোজই রিহার্সাল হয়। সোমবার বাদে। আজ সোমবার ছিল। মিহিরবাবুর ছুটি। কাল থেকে দু-তিনদিন ইভনিং ক্লাবের ওপর নজরদারি লাগাও তো!”
“তাতে লাভ কী হবে?”
“কিছুই নয়। যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই বুঝলে কিনা! কে বলতে পারে, অমলেন্দুবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল…”
“আপনি কি পাগল? অমলেন্দু যাবে ইভনিং ক্লাবে?”
“যেতেও তো পারে। ধরো রাত্তিবেলায় দাড়ি, চশমা লাগিয়ে গা ঢাকা দিয়ে মিহিরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেল?”
“সে তো বাড়িতেও যেতে পারে।”
“তা পারে। তবে আমার সামনে মনে হয়, বাড়ির চেয়ে ইভনিং ক্লাব সেফ।”
“কী বলছেন স্যার? অত লোকের মধ্যে…”
“না, অত লোক নয়। রিহার্সাল ভাঙার পর–সবাই যখন চলে যায়, মিহিরবাবু বাড়ি ফেরেন, তখন যদি দেখা হয়?”
চন্দন বলল, “আপনি বাঁকাপথে নাক দেখাচ্ছেন। অমলেন্দুর সঙ্গে মিহিরবাবু ওভাবে যোগাযোগ করেন বলে আমারও মনে হচ্ছে না। ঠিক আছে, কাল একবার আমি আর তারা ইভনিং ক্লাবের দিকে ঘোরাফেরা করে আসব। আপনি বরং মিহিরবাবুকে আরও একটু জােন।”
ঘাড় হেলালেন কিকিরা। “জপাব। তবে দু-একটা দিন পরে। ওঁর একটা জিনিস আমি নিয়ে এসেছি, ফেরত দিতে যাব।”
“কী জিনিস?”
“ওঁর টেবিলের ওপর থেকে লাইটারটা নিয়ে চলে এসেছি। জাপানি লাইটার। ভেরি স্মল অ্যান্ড বিউটিফুল!” বলে কিকিরা হাসলেন।
চন্দন বলল, “নিয়ে এসেছেন মানে হাত সাফাই করেছেন?”
“ম্যাজিশিয়ানস হ্যাণ্ড!”
“আপনাকে চোর বলবে স্যার।”
“বলবে না। আমি আসল ফেরত দেব, তার সঙ্গে সুদ। মানে আরও একটা লাইটার, ভাল লাইটার হে, বেলজিয়ান, লাইটার জ্বললেই তার গায়ের রং খেলা করবে। নিভিয়ে দিলেই আবার যে কে সেই। কে, পি, সাহার দোকানে পাওয়া যায়। প্রায় দু’শো টাকা দাম। মিহিরবাবুকে প্রেজেন্ট করব। বলব স্যার, এ গিফট ফ্রম কিকিরা দ্য গ্রেট ম্যাজিশিয়ান।” বলে কিকিরা হাসতে লাগলেন। তাঁর হাসির গুঢ় অর্থটা বোঝা গেল না।