অষ্টম অধ্যায়
ক্রিপস মিশন
একচল্লিশের শেষ দিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করে এবং তা ভারত উপমহাদেশের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। জাপানের হাতে বৃটেন ও তার মিত্রশক্তির দুর্গ সিংগাপুরের পতন ঘটে এবং বার্মার পতনও ছিল আসন্ন। কিছু লোকের সহানুভূতি ছিল জাপানের প্রতি। কংগ্রেস নেতাদের অনেকেই বৃটেন ও তার শত্রুকে একই চোখে দেখতেন। গান্ধী বলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দুষ্কর্মের শাস্তিস্বরূপ ভগবান হিটলারকে পাঠিয়েছেন। কংগ্রেস মনে করতো যুদ্ধে বৃটেন কোণঠাসা হয়ে পড়লে তার থেকে বেশী বেশী রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা যাবে।
সাতই মার্চ ১৯৪২, জাপান বার্মা দখল করে। তার মাত্র চার দিন পর ১১ই মার্চ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিল হাউস অব কমন্সে গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দানের পর ওয়ার কেবিনেট (War Cabinet) কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। সিদ্ধান্তগুলো একটি খসড়া ঘোষণায় সন্নিবেশিত হয়। সেই খসড়া ঘোষণা নিয়ে স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস ২৯ শে মার্চ ভারতে আগমণ করেন। খসড়ার ভুমিকায় বলা হয় যে
, একটি নতুন ভারতীয় ডমিনিয়ন গঠন এ ঘোষনার উদ্দেশ্য।
খসড়া ঘোষণার সারমর্ম নিম্নরূপঃ
যুদ্ধশেষ হওয়ার সাথে সাথে সংবিধান রচনার জন্যে ভারতে একটি ‘বডি’ বা পরিষদ গঠন করা হবে। দেশের প্রাদেশিক পরিষদগুলোর আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে এ পরিষদ নির্বাচিত করবে। এতে দেশীয় রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
এ বডি বা পরিষদ কর্তৃক রচিত যে কোন সংবিধান বৃটেন গ্রহণ করবে তিনটি শর্তেঃ
১। যে কোন প্রদেশ প্রস্তাবিত ইউনিয়নে যোগদান করা থেকে বিরত থাকতে পারতে তাদের শাসনতান্ত্রিক মর্যাদাসহ। এ ধরনের প্রদেশগুলো ইচ্ছা করলে প্রস্তাবিত ইউনিয়নের অনুরূপ নিজেদের পৃথক ইউনিয়নও গঠন করতে পারবে।
২। যেহেতু ব্রিটিশের হাত থেকে ভারতীয়দদের হাতে ক্ষমতা পরিপূর্ণরূপে হস্তান্তরিত হতে যাচ্ছে, সেজন্য এ সম্পর্কিত যাবতীয় ব্যাপারে বৃটেন এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী পরিষদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পন্ন হবে। এ চুক্তি সংখ্যালঘুদের স্বার্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে।
৩। দেশীয় রাজ্যসমূহ যদি শাসনতন্ত্র মেনে না নেয়, তাহলে তাদের চুক্তি ব্যবস্থায় কিছু রদবদলের জন্যে তাদের সাথে আলোচনার প্রয়োজন হবে।
স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস ৩০শে মার্চ বেতার ভাষণের মাধ্যমে খসড়া ঘোষণার ব্যাখ্যা দান করেন। বেতার ভাষণের পর ক্রিপস স্কীমটি গ্রহণ করার জন্যে সকল ভারতবাসীর প্রতি আবেদন জানান।
ভারতীয়তের প্রতিক্রিয়া
স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলাপ আলোচনা অব্যাহত রাখেন। তিনিটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই এ আলোচনা চলতে থাকে। (এক) প্রস্তাবিত ভারতীয় ইউনিয়নের প্রদেশের যোগদান না করার স্বাধীনতা। (দুই) শাসনতন্ত্র প্রণয়ন পরিষদের দেশীয় রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিত্ব এবং (তিন) সত্বর একটি দায়িত্বশীল সরকার গঠন।
খসড়া ঘোষণার নন ক্লজে (Non-accession Clause) প্রদেশগুলোকে এ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে যে, ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করা থেকে তারা বা কোন কোন প্রদেশ বিরত থাকতে পারে। এ সম্পর্কে কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়ানক তীব্র। তার ধারণা, এতে ভারতের অখন্ডতার প্রতি চরম আঘাত হানা হবে। তাই তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
দেশীয় রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়ানক তীব্র। তার ধারণা, এতে ভারতের অখন্ডতার প্রতি চরম আঘাত হানা হবে। তাই তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
দেশীয় রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে কংগ্রেসের দাবী হলো যে, যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। এতে কংগ্রেসের সুবিধা এই যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ কংগ্রেসকে সমর্থন করবে। এ ব্যবস্থা কিন্তু মুসলিম লীগ মেনে নিতে পারেনা। তৃতীয়তঃ কংগ্রেসের জোর দাবী এই কেন্দ্রে সত্বর একটি দায়িত্বশীল সরকার গঠন করা হোক। এতে মুসলিম লীগ ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে বলে তারা এ দাবী মেনে নিতে পারেনা।
স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপসের সাথে কংগ্রেস পেসিডেন্ট কিছু দিন যাবত পত্র বিনিময় হয়। কিন্তু কংগ্রেসের দাবী মেনে নেয়া হয়নি বলে ১১ই এপ্রিল কংগ্রেস ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার ঘোষণা করে।
মুসলিম লীগও ক্রিপস প্রস্তাব মেনে নিতে পারেনি। মুসলিম লীগের কথা এই যে, যতোক্ষণ না পাকিস্তান স্কীমের মূলনীতি মেনে নেয়া হয়েছে এবং মুসলিম ভারতে সত্যিকার রায় প্রতিফলিত হয় এমন কোন পদ্দতিতে মুসলিমদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার মেনে নেয়া না হয়েছে, ভবিষ্যতের কোন স্কীম বা প্রস্তাব মুসলিম লীগ মেনে নিতে পারবে না।
ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার পর
ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হওয়ারপর কংগ্রেস চরম ব্যর্থতা ও নৈরাশ্যের শিকার হয়। কংগ্রেস চেয়েছিল একটি জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে উপমহাদেশের উপর তার শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে। এ ছিল ভারতীয় মুসলমানদের পদদলিত করে রাখার এক নির্মম দুরভিসন্ধি। যাহোক ব্রিটিশ সরকার তাঁদের স্বার্থেই কংগ্রেসের এ অন্যায় আবদার মেনে নিতে পারেননি।
বৃটেন যুদ্ধে হেরে গেছে এটাকে স্বতঃসিদ্ধ মনে করে গান্ধী ১৯৪০-এর মে মাসে ভাইসরয়কে লিখিত এক পত্রে বলেন, “এ নরহত্যা বন্ধ করতে হবে। তোমরা ত হেরে যাচ্ছ। এর পরও যদি জিদ ধরে থাক, তাহলে অধিকতর রক্তপাত ঘটবে। হিটলার একজন মন্দ লোক নয়। তোমরা আজ যুদ্ধ বন্ধ করলে, সেও তোমাদের অনুসরণ করবে”। ভাইসরয় এ ঔদ্ধত্য ও বিশ্বাসঘাতকতার জবাব অতি নম্রভাবে দিয়ে বলেন, আমরা এখন যুদ্ধরত আছি। আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছারপূর্বে আমরা নড়চড় করব না। আমাদের জন্যে আপনার উৎকণ্ঠা বুঝতে পারছি। তবে সব ঠিক ঠাক হয়ে যাবে।
গান্ধী ভাইসরয়ের জবাবে তুষ্ট না হয়ে ৬ই জুলাই প্রত্যেক ইংলন্ডবাসীর প্রতি এক আবেদনে বলেন, অস্ত্র সংবরণ কর। কারণ এ তোমাদের নিজেদেরকে এবং মানবতাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তোমরা হিটলার ও মুসোলিনিকে ডেকে আনবে এবং তারা তোমাদের সব কিছুই কেড়ে নেবে। ঠিক আছে, তাদেরকে তোমাদের মনোরম অট্টালিকাদিসহ তোমাদের সুন্দর দ্বীপ দখল করতে দাও।
-(The Struggle for Pakistan, I.H. Quershi: Both the letter are pouted in G.D. Birla in the Shadow of the Mahatma A Personal Memoir (Bombay , 1953, p.302)
ক্রিপসের বেতার ভাষণ
স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস ২৬শে জুলাই, আমেরিকাবাসীদের জন্যে তাঁর প্রদত্ত বেতার ভাষণে, তাঁর ভারত ভ্রমণের সময় থেকে সর্বশেষ ভীতিপ্রদর্শন পর্যন্ত কংগ্রেস রাজনীতির পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, কোন দায়িত্বশীল সরকার কংগ্রেসের দাবী বিবেচনা করতে পারেননা। কংগ্রেস আধিপত্যের চরমবিরোধী মুসলমানগণ এবং কয়েক কোটি অনুন্নত সম্প্রদায়ও এ দাবী মানতে পারে না। গান্ধীর দাবী মেনে নেয়ার অর্থ চরম অরাজকতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করা।
তিনি আরও বলেন, আমরা একজন কল্পনাপ্রবণকে প্রাচ্যে জাতিসংঘের বিজয় প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতি দিতে পারি না, তিনি অতীতে যতোবড়োই স্বাধীনতা সংগ্রামী থাকুন না কেন।
পন্ডিত নেহরু উক্ত বেতার ভাষণের প্রতিবাদে স্টাফোর্ড ক্রিপসকে ‘শয়তানের উকিল’ (Devil’s Advocate) বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, বৃটেনে ভারতের যে অনিষ্ট করেছে এবং এখন ও করছে, তার জন্য তার উচিত ছিল অনুতপ্ত হ’য়ে অতি বিনীতভাবে আমাদের নিকটে আবেদন পেশ করা।
মুসলমানদের কংগ্রেস দাবীর বিরোধিতাকে নেহরু প্রত্যাখ্যান করে বলেন, আমার মুসলমান দেশবাসীকে আমি স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস অপেক্ষা ভালোভাবে জানি এবং তাদের সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা অপবাদ মাত্র। (The Struggle for Pakistan, I.H. Quershi; Documents in the Indian Situations Since the Cripps Mission, pp 47-48)
‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন (Quite India Movement)
নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি ১৯৪২ সালের ৮ই আগষ্ট বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত তার অধিবেশনে ‘ভারত ছাড়’ (Quite India) প্রস্তাব গ্রহণ করে। এর মনস্তাত্বিক কারণ বড়ো দুঃখজনক।
কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ মনে করেছিলেন যে যুদ্ধে মিত্র শক্তির পরাজয় অবধারিত। এই সুযোগে দেশে চরম বিশৃংখলা সৃষ্টি করে সমগ্র দেশের শাসন ক্ষমতা হস্তগত করা ছিল কংগ্রেসের পরিকল্পনার অধীন। এবাবেই মুসলমানদের সকল দাবী দাওয়া প্রত্যাখ্যান করে উপমহাদেশে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। কংগ্রেসের এ পরিকল্পনার স্বীকৃতি পাওয়া যায় মাওলানা আবুল কালাম আযাদ-এর ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রীডম’ গ্রন্থে। তিনি বলেনঃ
তাঁর মনে এ পরিকল্পনা ছিল যে, যেইমাত্র জাপানীরা বাংলায় পৌঁছে যাবে এবং ব্রিটিশ সৈন্য বিহারে পিছু হটে আসবে, কংগ্রেস গোটা দেশের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করবে। কিন্তু কংগ্রেসরে এ পরিকল্পনা অমূলক ও অবাস্তব প্রমাণিত হয়।
যাহোক, কংগ্রেস ৮ই আগষ্টে গৃহীত তার প্রস্তাবে ঘোষণা করে যে, সময়ের দাবী এই যে ভারতে ব্রিটিশ শাসন শেষ হতে হবে। ভবিষ্যতের কোন প্রতিশ্রুতি অথবা নিশ্চয়তা দান বর্তমান পরিস্থিতির কোন উন্নতি সাধন করবেনা। অতএব অতি সত্বর ভারতের স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হবে। অতঃপর দেশের প্রধান প্রধান দলগুলের সহযোগিতায় একটি সাময়িক সরকার গঠিত হবে। তার কাজ হবে ভারতের প্রতিরক্ষা এবং আগ্রাসন প্রতিরোধ করা। কংগ্রেস কমিটি ভারতের স্বাধীনতানর সমর্থনে অহিংসা পন্থায় চরম গণআন্দোলন শুরু করার প্রস্তাব অনুমোদন করে। গান্ধী একে প্রকাশ্য বিদ্রোহ (Open rebellion) বলে অভিহিত করেন যা কোন সরকারই বরদাশত করতে পারেনা। অতএব পরদিন ৯ই আগষ্ট সকল কংগ্রেস নেতাকে গ্রেফতার করা হয় এবং কংগ্রেসকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়।
এমন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের পরও কংগ্রেসের কর্মসূচী ব্যাহত করা সম্ভব হয়নি। গান্ধী যেটাকে অহিংস বলেন তাই প্রকৃত পক্ষে সহিংস। অতএব দেকা গেল সকল হিন্দু প্রদেশগুলোতে ব্যাপকহারে বিশৃখলা ও ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকান্ড শুরু হয়েছে। রেলষ্টেশন জ্বালিয়ে দেয়া, রেল লাইন উৎপাটন, টেলিগ্রাফ তার কেটে দেয়া, পোষ্ট অফিস লুণ্ঠন করা ও জ্বালিয়ে দেয়া প্রভৃতি ‘অহিংস’ (?) তৎপরতা পুরা মাত্রায় চলতে থাকে। বহু স্থানে হত্যাকান্ডও সংঘটিত হয়।
মুসলিম লীগ ত দূরের কথা বহু হিন্দু সংগঠনও কংগ্রেসের এহেন হঠকারী কর্মসূচী সমর্থন করতে পারেনি। ডঃ আস্বেদকার কংগ্রেস অভিযানের তীব্র সমালোচনা করেন। লিবারালগণ এবং তেজবাহাদুর সাপ্রু ও জয়াকর বিরূপ মন্তব্য করেন। ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্ট লীগ গান্ধীর এ নির্বোধ আচরণের নিন্দা করেন। ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টিও এ আন্দোলন থেকে দূরে থাকে। ভাই পরমানন্দ, হিন্দু মহাসভার ভাইস প্রেসিডেন্ট ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সমালোচনা করেন এবং প্রেসিডেন্ট ভিভি সাভারকার তাঁর অনুসারিদেরকে কংগ্রেস অভিযান সমর্থন না করার নির্দেশ দেন। (The Struggle for Pakistan, I.H. Wuershi, p.190)
কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনকে বেয়নেটের মুখে বল প্রয়োগে তাদের দাবী মেনে নিতে বাধ্য করার এবং মারাত্মক গৃহযুদ্ধের সমতুল্য মনে করেন। সরকারের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহ প্রকৃত পক্ষে মুসলিম লীগ ও অন্যান্য অকংগ্রেসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে কংগ্রেসের এ আন্দোলন অবৈধ এবং অসাংবিধানিক। কারণ এর উদ্দেশ্য একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার উচ্ছেদ করা।
বৃটেনবাসী এবং তথাকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এ আন্দোলনের তীব্র সমালোচনা করে। ইউরোপ আমেরিকার পত্র পত্রিকাও আগষ্ট আন্দোলনের বিরূপ সমালোচনা করে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সংকটপূর্ণ সময়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের বিদ্রোহ ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল তড়িঘড়ি সমগ্র ভারতের ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। তার জন্যে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক তৎপরতা পরিচালনা করা হয়। এ কারণেই ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখান করা হয়।
এ আগষ্ট আন্দোলনের আরও একটি কারণ ছিল এই যে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ক্ষমতা হস্তান্তর বিলম্বিত হলে দেশ বিভাগ তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হয়ে পড়বে। অতএব ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা বানচাল করতে হলে ভারতের ক্ষমতা হস্তগত করা ব্যতীত গত্যন্তর নেই। এ ছিল কংগ্রেসের অপরিণামদর্শী চিন্তা ও পলিসি।
সি, আর ফর্মূলা
উপমহাদেশে মুসলমানদের প্রতি হিন্দুকংগ্রেসের বিদ্বেসাত্মক মনোভাব এবং তাদের নির্মূল করে অথবা নিদেনপক্ষে পদদলিত করে রেখে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার দুঃস্বপন্ন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলেছিল। এ কারণে তার আগাগোড়া পলিসি এই ছিল যে, যে কোন ব্যাপারে যদি দেখা যায় যে মুসলমানগণ সামান্য কিছু সুযোগ সুবিধা লাভ করছে, তখন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভংগ করার ন্যায় কংগ্রেস তা কিচুতেই হতে দেবে না। ক্রিপস প্রস্তাবে কিছুটা পাকিস্তান বা ভারত বিভাগের গন্ধ আবিস্কার করে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। অতঃপর যুদ্ধে ব্রিটিশের পরাজয় অবধারিত মনে করে ‘ভারত ছাড়’ (Quite India) আন্দোলন তথা ভারতের সর্বত্র বিশেষ করে হিন্দু অধ্যুষিত প্রদেশগুলোতে চরম ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড শুরু করে। আশা করেছিল, জাপানীরা ভারতের একাংশ দখল করে ফেল্লে ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের দাবী মানতে বাধ্য হবে এবং সারা ভারতে সে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে। কিন্তু ফলটি হয়েছে উল্টো। ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন কোন মহলই সমর্থন করেনি। এমন কি হিন্দু মহাসভা ও কমিউনিষ্ট পার্টি পর্যন্ত এর তীব্র সমালোচান করেছে। কংগ্রেসকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, গান্ধীসহ সকল নেতাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
অপরদিকে মুসলিম লগের দুরদৃষ্টিসম্পন্ন পলিসি তার জনপ্রিয়তা ভেতরে বাইরে বর্ধিত করেছে। ১৯৪৩ এবং ১৯৪৪ সালে বাংলা, আসাম, সিন্ধুও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা বলবৎ ছিল। পাঞ্জাবে ইউনিয়নিষ্ট পার্টির মন্ত্রীসভা বলবৎ থাকলেও তাঁরা মুসলিম লীগ ও ভারত বিভাগ সমর্থন করতেন। ফলে জনগণের সাথে গভীর যোগাযোগ থাকার কারণে মুসলিম লীগরে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এবং পাকিস্তান আন্দোলনও শক্তিশালী হতে থাকে। এতে করে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
সাতাশে জুলাই ১৯৪৩, ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের কাছে লিখিত এক পত্রে গান্ধী বলেন, অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করতঃ যুদ্ধ প্রচেষ্টায় পূর্ণ সহযোগিতা করার জন্যে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিকে পরামর্শ দিতে তিনি প্রস্তুত, যদি সত্বর ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় এ শর্তে যে যুদ্ধ চলাকারে সামরিক তৎপরতা যেমন আছে তেমন চলতে থাকবে কিন্তু ভারতের উপর কোন আর্থিক বোঝা চাপানো হবেনা।
ভাইসরয় এ পত্রের জবাব দেন ১৫ই আগষ্টে। এতে গান্ধীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়। বলা হয়, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সর্বসম্মত শাসনতন্ত্র প্রণীত হলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে প্রস্তুত আছেন। তারা পূর্বে বৃটেনের সাথে একটি চুক্তিও সম্পাদিত হতে হবে। গান্ধীর দাবী অনুযায়ী কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের নিকট দায়ী একটি জাতীয় সরকার গঠন করতে হলে বর্তমান শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করতে হবে। তা এখন কিছুতেই সম্ভব নয়। তবে ভাইসরয় বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রচলিত শাসনতন্ত্রের অধীন একটি পরিবর্তনকালীন সরকার (Transitional Govt.) গঠনে সহযোগিতা করার জন্যে সকলের প্রতি আহবাদ জানাচ্ছি। সকল দল ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পন্থা পদ্ধতি নিয়ে নীতিগতভাবে একমত হলে প্রস্তাবিত সরকার ভাল কাজ করতে পারবে।
গান্ধী তাঁর স্বভাবসুলভ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ব্রিটিশ সরকার ৪০ কোটি মানুষের উপর যে শাসন ক্ষমতা লাভ করে আছেন, তা ততোক্ষণ পর্যন্ত হস্তান্তর করতে রাজী নন, যতোক্ষণ না ভারতবাসী তা ছিনিয়ে নেয়ার ক্ষমতা লাভ করেছে।
মিঃ গান্ধীর এ কথায় আর একটি সহিংহ আন্দোলনের হুকমি প্রচ্ছন্ন ছিল।
যাহোক ভাইসরয়ের নিকট থেকে নৈরাশ্যজনক জবাবে কতিপয় কংগ্রেস নেতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে যোগাযোগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাঁদের ধারণা, কংগ্রেস তার প্রচেষ্টায় সরকারের সাথে একটা সমঝোতায় আসতে পারলে ত খুবই ভালো হতো। কিন্তু তা যখন সম্ভব নয়, তখন মুসলিম লীগের সাথেই একটি সমঝোতা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।
কংগ্রেসের এ ধরনের মনোভাব পরিবর্তনের পূর্বে প্রবীণ কংগ্রেসী নেতা রাজা গোপালাচারিয়া এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, শাসনতান্ত্রিক অবলাবস্থায় অবসানের জন্যে ভারত বিভাগ অপরিহার্য। তিনি এ বিষয়ে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে সম্মত করার জন্যে জনভায় তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করতে থাকেন। তেতাল্লিশের এপ্রিলে মাদ্রাজের এক জনসভায় তিনি বলেন, আমি পাকিস্তানের পক্ষে। কারণ আমি এমন রাষ্ট্র চাই না, যেখানে আমাদের হিন্দু ও মুসলিম উভয়ের কোন মান সম্মান নেই। মুসলমান পাকিস্তান লাভ করুক। আমরা হিন্দু ও মুসলিম উভয়ের কোন মান সম্মান পারে। ব্রিটিশ সরকার অসুবিধা সৃষ্টি করলে তার মুকাবিলা আমরা করবো। …আমি পাকিস্তানের পক্ষে –তবে আমি মনে করি কংগ্রেস এতে রাজী হবে না। (The Struggle for Pakistan, I.H. Quershi p.205, Speech in Madras –April, 1943, quoted in Khaliquzzaman, p.309)
রাজা গোপালাচারিয়া আরও বলেন, আমরা ব্রিটিশ শাসনের অবসান চাই। হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক মতানৈক্যও আমরা মিটাতে চাই। মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বশীল হিসাবে মুসলিম লীগকে আমাদের মেনে নিতে হবে। তারা চায় যে আমরা তাদের দাবী মেনে নিই। তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবী পাকিস্তান।
(The Struggle for Pakistan, I.H. Quershi, pp.205)
রাজা গোপালচারিয়া তেতাল্লিশ সালে একটি ফর্মূলা তৈয়ার করেন যা সি, আর ফর্মূলা নামে অভিহিত। ফর্মূলাটি কংগ্রেস লীগের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে বলে তিনি মনে করেন। জেলে গান্ধীর অনশনরত অবস্থায় তার সাথে সাক্ষাৎ করে ফর্মূলাটি তাঁকে দেখানো হয় এবং গান্ধী তা অনুমোদন করেন। অতঃপর ১০ই জুলাই ১৯৪৩
, ফর্মূলাটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।
কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিস্বরূপ ফর্মূলাটি মহাত্মা গান্ধী এবং মিঃ জিন্নাহ মেনে নিয়ে তাঁরা যথাক্রমে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগকে মেনে নেয়ার জন্যে চেষ্টা চালাবেন। ফর্মূলার বিষয়বস্তু নিম্নরূপঃ
১। স্বাধীন ভারতের শাসনতন্ত্র সম্পর্কে নিম্নোক্ত শর্তাবলী সাপেক্ষে মুসলিম লীগ ভারত স্বাধীনতার দাবী সমর্থন করছে এবং পরিবর্তনশীল সময়ে একটি সাময়িক মধ্যবর্তী সরকার গঠনে কংগ্রেসের সাথে সযোগিতা করবে।
২। ভারতের উত্তর পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে, যেখানে মুসলমান নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে সীমানা নির্ধারণের জন্যে একটি কমিশন নিয়োগ করা হবে। তারপর সে সব অঞ্চলে বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে এবং গণভোট দ্বারা ভারত থেকে পৃথক হওয়ার বিষয়টি মীমাংসি হবে। ভারত থেকে পৃথক একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সপক্ষে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাওয়া যায় তাহলে সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। তবে সীমান্তের জেলাগুলোর যে কোন রাষ্ট্র যোগদানের অধিকার থাকবে।
৩। গভভোট অনুষ্ঠানের পূর্বে সকল দলের বক্তব্য পেশ করার অধিকার থাকবে।
৪। ভারত থেকে আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্তের পর প্রতিরক্ষা, ব্যবসাবাণিজ্য এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্যে পারস্পরিক চুক্তি সম্পন্ন করতে হবে।
৫। অধিবাসী স্থানান্তর হবে সম্পূর্ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত ও ঐচ্ছিক।
৬। ভারত শাসনের জন্যে বৃটেন কর্তৃক সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব হস্তান্তরের বেলায় ফর্মূলার শর্তাবলী অবশ্য পালনীয় হবে।
মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ফর্মূলাটি পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব জিন্নাহর উপর অর্পিত হয়।
বিষয়টি নিয়ে গান্ধী-জিন্নাহর মধ্যে বহু পত্র বিনিময় হয়। জিন্নাহ কতকগুলো প্রশ্ন উত্থাপন করেন। গান্ধী সকল প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হন।
সি, আর ফর্মূলার ব্যর্থতার কারণ
রাজা গোপালাচারিয়ার ফর্মূলার ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে মনে কতকগুলো প্রশ্নের উদয় হয়। এ নিয়ে গান্ধীর জিন্নাহর সাথে দীর্ঘ পত্র বিনিময়ের উদ্দেশ্য কি ছিল? এ ব্যাপারে কংগ্রেসের মনোভাব কি ছিল? অন্যান্য দলের অভিমত কি ছিল?
আলোচনার ব্যর্থতার প্রধান কারণ, গান্ধী মুসলমানদের পাকিস্তান দাবী কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। টু নেশন থিয়রী তিনি প্রত্যখ্যান করেন এবং একমাত্র কংগ্রেসকেই তিনি সকল ভারতবাসীর প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন বলে বিশ্বাস করেন। আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববাসীকে দেখানো যে তিনি একটা সমঝোতায় উপনীত হওয়ার চেষ্টা করেছেন।
সাপ্রু প্রস্তাব
সি,আর ফর্মূলা ব্যর্থ হওয়ার পর স্যার তেজবাহাদুর সাপ্রু কতিপয় প্রস্তাব পেশ করেন কংগ্রেস-মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। বিগত ১৯৪১ সালে তিনি একটি নির্দলীয় সম্মেলন আহবান করেন। তাতে ফল কিছু হয়নি।
সাপ্রু নির্দলীয় সম্মেলনের স্ট্যান্ডিং কমিটি ১৯৪৪ সালের ৩রা ডিসেম্বর এলাহাবাদে মিলিত হয় এবং একটি কনসিলিয়েশন কমিটি গঠন করেন। তার সদস্য হলেন, স্যার তেজবাহাদুর সাপ্রু (চেয়ারম্যান), এম, আর জয়াকর (তিনি হাজির হননি), বিশপ ফস ওয়েস্টকট, এস, রাধাকৃষ্ণন, স্যার হোসি মোদী, স্যার মহারাজ সিংহ, মুহাম্মদ ইউনুস, এন আর সরকার, ফ্ল্যাংক এন্টনী এবং সন্ত সিংহ।
অতঃপর সাপ্রু ১০ই ডিসেম্বর জিন্নাহর নিকটে লিখিত পত্রে কনসিলিয়েশন বোর্ডের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বর্ণনা করে সাক্ষাতপ্রার্থী হন।
জিন্নাহ ১৪ই ডিসেম্বর পত্রের জবাবে বলেন, তিনি কোন নির্দলীয় সম্মেলন অথবা তার স্ট্যান্ডিং কমিটিকে কোনরূপ স্বীকৃতি দানে নারাজ। সাপ্রু পরের বছর, ১৯৪৫ সালের ৮ই এপ্রিল তার কনসিলিয়েশন কমিটির প্রস্তাবগুলির ঘোষণা দেন।
কমিটির প্রস্তাবগুলোতে মনোভাবই পরিস্ফুট হয়েছে। প্রস্তাবের প্রথম দফায় ভারত বিভাগের দৃঢ়তার সাথে বিরোধিতা করা হয়েছে। পৃথক নির্বাচন রহিত করারও প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাবগুলো মুসলমানদের নিকটে যে কিছুইতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা তা বলার প্রয়োজন করে না। জিন্নাহ এ কমিটিকে কংগ্রেসের গৃহ চাকরানীর সাথে তুলনা করে বলেন, এ কমিটি গান্ধীর সুরে সুর মিলিয়েই কথা বলেছে।
দেশাই-লিয়াকত চুক্তি
নতুন বছর ১৯৪৫ আগমনের পর নতুন রাজনৈতিক হাওয়া প্রবাহিত হতে থাকে। বিগত আগষ্ট আন্দোলনের অপরাধে তখনও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ কারাগারে। ভারতের পত্রপত্রিকায় কংগ্রেস-লীগের মধ্যে চুক্তির খবর বা গুজব প্রকাশিত হতে থাকে। কেন্দ্রীয় আইনসভার কংগ্রেস সদস্যগণ কয়েক মাস ধরে নিয়মিত আইনসভায় যোগদান করতে থাকেন এবং আইনসভার মুসলিম লীগ সদস্যদের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে থাকেন। কংগ্রেস পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা ভুলাভাই দেশাই লীগ দলের নেতা লিয়াকত আলী খানের সাফে পুরোপুরি একমত হয়ে কাজ করছেন বলে শুনা যায়। একটি সাময়িক জাতীয় সরকারের সংবিধান নিয়ে উভয় নেতা একটি সমঝোতায় উপনীত হয়েছেন বলেও শুনা যায়। দেশাই ১৩ই জানুয়ারী ভাইসরয়ের প্রাইভেট সেক্রেটারী স্যার ইভান জেনকিন্সের সাথে এবং ২০শে জানুয়ারী ভাইসরয়ের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাতে দেশাই-লিয়াকতের মধ্যে একটা চুক্তি হয়েছে বলে ভাইসরয়কে অবহিত করা হয়। দেশাই বলেন, এ চুক্তির প্রতি গান্ধীর সমর্থন আছে। তিনি আরও বলেন যে, লিয়াকত আলীর সাথে আলোচনার বিষয় সম্পর্কে জিন্নাহ অবহিত আছেন এবং তিনি এ কথিত চুক্তি অনুমোদন করেন।
কথিত চুক্তিটি ছিল নিম্নরূপঃ
কংগ্রেস এবং লীগ একমত যে তাঁরা কেন্দ্রে একটি মধ্যবর্তী সরকারে যোগদান করবেন। তা নিম্ন পদ্ধতিতে গঠিত হবেঃ
(ক) কংগ্রেস এবং লীগ সমসংখ্যক সদস্য মনোনয়ন করবে (মনোনিত ব্যক্তিগণের কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য হওয়া জরুরী নয়)
(খ) সংখ্যালঘুরেদ প্রতিনিধি (বিশেষ করে তফশিলি সম্প্রদায় এবং শিখ)
(গ) সামরিক বাহিনী প্রধান।
সরকার গঠিত হওয়ার পর তা ভারত সরকার আইনের (১৯৩৫) অধীন কাজ করতে থাকবে। মন্ত্রীসভা যদি কোন বিমেষ কর্মপন্থা বা ব্যবস্থা আইনসভার দ্বারা পাশ করতে সক্ষম না হয়, তাহলে গভর্ণর জেনারেল বা ভাইসরয়ের বিমেষ ক্ষমতার শরণাপন্ন হয়ে তা বলবৎ করতে যাবেনা। এতে করে ভাইসরয়ের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ হবে।
এ বিষয়েও কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে ঐকমত্য হয় যে, এ ধরনের সাময়িক সরকার গঠিত হলে তার প্রথম কাজ হবে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যগণ কে কারামুক্ত করা।
এ চুক্তির ভিত্তিতে গভর্ণর জেনারেলকে অনুরোধ করা হবে তিনি যেন সরকারের নিকটে এ ধরনের প্রস্তাব পেশ করেন যে, কংগ্রেস ও লীগের চক্তির ভিত্তিতে একটি সাময়িক সরকার গঠনে তিনি আগ্রহী।
গভর্ণর জেনারেল দেশাই-লিয়াকত চুক্তির প্রস্তাবগুলো ভারত সচিবকে জানিয়ে দেন। তিনি এ সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করে তার ব্যাখ্যা দাবী করেন।
গভর্ণর জেনারেল দেশাই ও লিয়াকত আলীর সাথে সাক্ষাৎ করবেন এমন সময় জিন্নাহ এক বিবৃতির মাধ্যমে বলেন, তিনি চুক্তি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। দেশাই হতাশ না হয়ে চুক্তির বৈধতা সম্পর্কে দৃঢ়তা প্রকাশ করতে থাকেন। গভর্ণর জেনারেল বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্যে বোম্বাই-এর গভর্ণর স্যার জন কোলভিনকে জিন্নাহর সাথে দেখা করে অনুরোধ করতে বলেন যে তিনি তাঁর সাথে দিল্লীতে দেখা করলে খুশী হবেন। জিন্নাহ বলেন, তিনি দেশাই-লিয়াকত চুক্তি সম্পর্কে কিছুই জানেন না এবং এ চুক্তি মুসলিম লীগের অনুমতি ব্যতিরেকেই করা হয়েছে।
এদিকে গান্ধীর অনুমোদন থাকলেও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ দেশাই-এর সমালোচনা করেন। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগে উভয়েই চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করে।