কর্কশভাষী বিহারীটা শোয়েবকে এনে হাজির করলো পাশের পাকা বাড়ির একটা কামরায়। চারপাশে তাকিয়ে শোয়েবের মনে হলো কক্সবাজারের জঙ্গলে এ ধরনের ঘর খুবই বেমানান। বড় একটা দামী সেক্রেটারিয়েট টেবিল, ওপরটা কালো কাঁচে ঢাকা। ওপাশে রিভলভিং চেয়ারে মাঝবয়সী যে লোকটা বসে আছে ওর গোঁফ দেখে মনে হচ্ছে। আর্মির কোনও হোমরা চোমরা অফিসার হবে, মুখে বসন্তের দাগ, পরনে পাকিস্তানীদের মতো সালোয়ার কোর্তা। বা পাশে সাদা কালো দাঁড়িওয়ালা এক লোক, পরনে আলখাল্লার বদলে থ্রি পিস স্যুট।
ঘরের এক পাশে নরম চামড়ার দামী সোফা। দেয়াল ঘেঁষে রাখা স্টিলের কেবিনেটের ওপর একটা ইলেক্ট্রনিক্স গেজেট, দেখতে অনেকটা সিডি প্লেয়ারের মতো, তবে আকারে অনেক বড়। এক পাশের দেয়ালে কাবা শরিফের ছবিওয়ালা ভেলভেটের বিরাট কার্পেট নকশাকরা কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো।
গোঁফওয়ালা আর্মি অফিসার টাইপের লোকটা খসখসে গলায় শোয়েবকে উর্দুতে বললো, বায়ঠো।
কথা শুনেই শোয়েব বুঝলো লোকটা পাকিস্তানী। ওর হাত তখনও পিছমোড়া করে বাঁধা। হাত বাঁধা অবস্থায় হাতলওয়ালা চেয়ারে বসতে অসুবিধে হবে ভেবে শোয়েব দাঁড়িয়ে রইলো। পাকিস্তানীটার পাশে বসা সাদাকালো দাড়িওয়ালা লোকটা বিহারীটাকে বললো, এর হাত খুলে তুমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াও।
জী সরকার। বলে দ্রুত হাতে শোয়েবের বাঁধন খুলে বিহারীটা ঘরে থেকে বেরিয়ে গেলো।
গলাটা যতদূর সম্ভব মোলায়েম করে পাকিস্তানীটা বললো; আব বায়ঠো।
শোয়েব গদি মোড়া চেয়ারে বসার পর আগের মত নরম গলায় লোকটা বললো, কফি পিয়োগি?
গলা যতই নরম করার চেষ্টা করুক না কেন, লোকটার চেহারায় এমন এক ধরনের নিষ্ঠুরতা ছিলো, মনে হয় ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করতে পারবে। সে তুলনায় সাদা কালো দাড়িকে মনে হচ্ছিলো ধূর্ত আর মতলববাজ টাইপের। কফি খাওয়াটা উচিৎ হবে কি হবে না এ নিয়ে মনস্থির করতে পারছিলো না। লোকটা আবার আগের মতো নরম করে বললো, বেটা, কফি পিয়োগি?
শোয়েব কোনও কথা না বলে মাথা নেড়ে সায় জানালো।
পাকিস্তানীটা কলিং বেল টিপে এক উর্দিপরা বেয়ারাকে তিন কাপ কফি আনতে বললো। খাস পাকিস্তানী উর্দুতে শোয়েবকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি উর্দু কথা বোঝো?
কিছুটা বুঝি।
নিশ্চয় হিন্দি ভালো বোঝে। তোমাদের বয়সী ছেলেরা তো খুব জিটিভি দেখে। বলে একটু হাসলো পাকিস্তানী।
শোয়েব বাংলায় বললো, উর্দুর চেয়ে হিন্দি বাঙালিদের জন্য বোঝা সহজ।
বাড়িতে তোমার কে কে আছে।
বাবা, মা, দুই ভাই, এক বোন।
তুমি কি সবার বড়?
ভাইদের ভেতর আমি বড়। সবার বড় বোন।
তোমার বোন কি করে?
কিছু করে না। অনার্স পাশ করে ঘরে বসে আছে।
বোনকে নিশ্চয় তুমি বেশি ভালোবাসো।
ভাই বোন বাবা মা সবাইকে ভালোবাসি।
তুমি খুব ভালো ছেলে।
শোয়েব কোনও কথা বললো না বেয়ারা এসে তিন কাপ কফি আর দামী ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কিট দিয়ে গেলো। শোয়েব বললো, আমার সঙ্গীদের রেখে কফি খেতে আমার খুব খারাপ লাগছে।
মাথা নেড়ে সায় জানালো পাকিস্তানী। বেয়ারাকে বললো, এই সাহেবের সঙ্গে যারা এসেছে তাদের কফি আর নাশতা দাও।
শোয়েব কফির কাপে চুমুক দিলো। সারা দিনের ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরে কফি খেতে খুব ভালো লাগলো ওর। কফির সঙ্গে চারটা বিস্কিটও খেলো। এখনও ও বুঝতে পারছে না আলোচনা কোন দিকে গড়াচ্ছে। গোঁফওয়ালা যদি পাকিস্তানী হয় কালোসাদা দাড়ি নিশ্চয় জামাতী। মাহবুব যখন ওদের এখানে এসেছে ওরা নিশ্চয় শোয়েবের পরিচয় জানে। কাগজের ব্যাপার নিয়ে জেরা করার জন্য এত ভনিতা করছে কেন ও বুঝতে পারছিলো না। মনে মনে ঠিক করলো সেও সহযোগিতার ভান করে ওদের মতলব বোঝার চেষ্টা করবে।
কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে পাকিস্তানী সিগারেট ধরিয়ে শোয়েবের দিকে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলো।
ধন্যবাদ, আমি স্মোক করি না।
তুমি আসলেই ভালো ছেলে।
ধন্যবাদ।
একগাল ধোঁয়া ছেড়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে পাকিস্তানী বললো, তোমাকে যেভাবে ধরে এনেছে এর জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
আমরা কিন্তু এখনও জানি না আমাদের এখানে কেন আনা হয়েছে।
তুমি আমাদের কিছু দরকারী কাগজ চুরি করেছে। এতক্ষণ পর কথা বললো সাদাকালো দাড়িওয়ালা লোকটা। পাকিস্তানীর মতোই নিচু মোলায়েম গলায় বললো, কাগজগুলো আমাদের দরকার।
কাগজ আমার সঙ্গে নেই।
জানি। কোথায় আছে বলে দাও। আমাদের লোক গিয়ে নিয়ে আসবে।
কয়েক মুহূর্ত ভেবে শোয়েব বললো, ওগুলো আমি ইকবাল স্যারের বাসায় রেখেছি।
তুমি ওঁকে একটা চিঠি লিখে দাও। আমি এখনই লোক পাঠাচ্ছি।
লোক পাঠালে হবে না। আমাকে যেতে হবে। ইকবাল স্যারকে বলেছি আমি ছাড়া কাউকে যেন ওগুলো না দেন।
অনুত্তেজিত গলায় সাদাকালো দাড়ি বললো, তুমি এমনভাবে চিঠি লেখো যাতে তিনি ওগুলো দিতে বাধ্য হন।
আমি কি লিখবো আমরা বিপদে পড়েছি। কাগজগুলো না পাঠালো আমাকে খুন করা হবে।
তা কেন লিখবে? আমি যা বলবো তাই লিখবে। এই বলে লোকটা পাকিস্তানীর দিকে তাকালো জনাব, মেহেরবাণী করে টুকরো কাগজ আর কলম দিন।
মৃদু হেসে পাকিস্তানী ওর টেবিলের ড্রয়ার থেকে কাগজ আর বলপেন বের করে দিলো। সাদাকালো দাড়ি কাগজের টুকরোটা শোয়েবের দিকে এগিয়ে দিলো লেখো। বলে লোকটা কয়েক মিনিট ভাবলো। তারপর বললো, স্যারকে ডাকার সময় কি তাদের নাম উচ্চারণ করো?
না শুধু স্যার বলি।
ঠিক আছে, লেখো। স্যার, আপনাকে আমি যে কাগজগুলো দিয়েছিলাম ওগুলো ঢাকার সাংবাদিকরা চাইছেন। আমি জরুরী কাজে কক্সবাজারে আটকে যাওয়ায় আমার ভাইকে পাঠাচ্ছি। ও খুবই বিশ্বস্ত ছেলে, এখানে নির্মূল কমিটি করে। কাগজগুলো আজ রাতে পেলেই ভালো হত। সাংবাদিকদের যে দলটা আজ সকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কক্সবাজার এসেছিলো তাদের অনেকেই থেকে গেছে। জনকণ্ঠ ওটা প্রথম পাতায় ছাপাতে চায়। এই সুযোগ আমাদের হারানো ঠিক হবে না। জনকণ্ঠের রিপোর্টার কাল চলে যাবে। আপনি যদি পত্রবাহকের হাতে কাগজগুলো পাঠিয়ে দেন খুব ভালো হয়। মনে হয় জামাতকে শেষ করতে আর বেশি সময় লাগবে না। ইতি শোয়েব।
ধীরে ধীরে ডিক্টেশন দিচ্ছিলো সাদাকালো দাড়ি। ওর কথা মতো লিখতে গিয়ে রাগে সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছিলো শোয়েবের। তবু চুপচাপ ওদের হুকুম তামিল করছিলো হাতে কিছু সময় পাওয়া যাবে বলে।
শোয়েবের লেখা শেষ হওয়ার পর দাড়িওয়ালা ওটা ভালো মতো পড়ে দেখলো। কে জানে কোথাও কোনও চালাকি করেছে কি না? এই ইবলিশগুলো পারে না এমন কাজ আল্লার দুনিয়াতে নেই। কী রকম শয়তানী করে ওদের ছাত্র সংগঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মীর ঘর থেকে গোপন কাগজগুলো চুরি করেছে কথাটা ভাবতে গিয়ে কক্সবাজারের আমীর মওলানা রুহুল আমীন বার বার অবাক হয়েছে। খবরটা ঢাকা পর্যন্ত চলে গেছে। যে কোনও মূল্যে কাগজগুলো উদ্ধার করতে হবে। কাগজগুলো উদ্ধার না করা পর্যন্ত শয়তানটাকে কিছু করা যাবে না। চিঠি পড়ে সাদাকালো দাড়ি রুহুল আমিন ওদের পাকিস্তানী বন্ধু আসলাম গুলের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলো–জনাব ঠিকই বলেছেন। এই ছেলেটা আসলেই ভালো। মনে হয় খারাপ লোকদের সঙ্গে থেকে একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। আমাদের মদদ পেলে জরুরি তরক্কী করবে। এই বলে চিঠি হাতে নিয়ে ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আসলাম গুল মৃদু হেসে বললো, বেটা শোয়েব, আমি তোমার বাড়ির সব খবর জানি। তোমার আব্বা তো আগামী বছর চাকরি থেকে রিটায়ার করবেন।
শোয়েব মাথা নেড়ে সায় জানালো।
তুমি যদি ঠিক ঠিক মতো পাশ করে না বের হও ভাবতে পারো কী হবে?
আমি ভালোভাবেই পাশ করবো।
আমি জানি তুমি লেখাপড়ায়ও ভালো। তবে বহু ফার্স্ট ক্লাস এখনও চাকরি পায়নি, ঠিক কি না বলো।
এবারও শোয়েবকে সায় জানাতে হলো। পাশ করে বেরুলেই যে চাকরি পাবে এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই।
বিশেষ করে ওর জন্য কোথাও চাকরির সুপারিশ করতে পারে এমন মামা চাচা তিন কূলেও নেই।
আসলাম গুল এতক্ষণ সূতো ছেড়ে ছেড়ে মাছ খেলানোর মতো করে শোয়েবকে খেলাচ্ছিলো। ওর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার জন্য বললো, আমি কিন্তু তোমাকে এখনই একটা চাকরি দিতে পারি।
কী চাকরি?
তুমি অনুমান করো।
আমাকে কি জামাত করতে হবে?
আরে না, তুমি কেন জামাত করবে? তোমাকে জামাতের লোকেরা বিশ্বাসই বা করবে কেন? তুমি বরং জামাতের বিরুদ্ধে কাজ করবে।
আসলাম গুলের কথা শুনে শোয়েব খুবই অবাক হলো। ও ধরেই নিয়েছিলো পাকিস্তানীটা জামাতের লোক। বিভ্রান্ত গলায় বললো, আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি আসলে কে?
আমি কে সেটা নিশ্চয় জানবে তুমি। আগে বলো তোমার চাকরির দরকার আছে কি না।
পড়াশোনার ক্ষতি করে বাবা মা আমাকে চাকরি করার অনুমতি দেবেন না।
পড়াশোনা করছো তো ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য। তুমি অনার্স পাশ করেছে। যদি এই যোগ্যতা নিয়ে এম এ পাশের চেয়ে ভালো চাকরি করতে পারে সেটা ছাড়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে শোয়েব বললো, আমাকে একটু ভাবতে হবে। বাবার সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।
তোমার বাবা আপত্তি করবেন না।
আপনি কিভাবে জানেন বাবা আপত্তি করবেন না?
তোমার বাড়ির খবর তোমার চেয়ে বেশি আমি জানি।
মানে?
তুমি কি জানো তিন দিন আগে তোমার বোন সায়মার জন্য ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে?
অবাক হয়ে শোয়েব বললো, না জানি না।
ছেলেটা ডাক্তার। আমেরিকায় যাবার একটা সুযোগ পেয়েছে। এমনিতে কোনও যৌতুক নেবে না। আমেরিকা যাওয়ার জন্য ওকে এক লাখ টাকা দিতে হবে।
টাকা দিয়ে বোনের বিয়ে দেবো না।
শোয়েব বেটা, ইমোশনাল হচ্ছে কেন? তোমার বোনের গায়ের রং কালো। দেখতেও খুব সুন্দর নয়। তোমরা ভাইরা হয়েছে মার মতো, বোনটা হয়েছে বাবার মতো। এই বোনের জন্য এর চেয়ে ভালো ছেলে পাবে না। তোমার বাবা মা দুজনই ছেলে দেখে মুগ্ধ। আসলে ছেলেটা তোমার বোনের প্রেমে পড়েছে। নইলে অনেক সুন্দর মেয়ে ও বিয়ে করতে পারতো।
বড় বোন কার সঙ্গে প্রেম করে শোয়েব সেসব কথা জানে না। পাকিস্তানীটা যে ওদের হাড়ির খবর পর্যন্ত জানে এতে কোনও সন্দেহ নেই। বোন যদি ছেলেটাকে পছন্দ। করে ওদের বিয়ে হলে নিশ্চয় খুব ভালো হবে। কিন্তু এক লাখ কেন পঞ্চাশ হাজার টাকা যোগাড় করাও ওর বাবার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রাইভেট ফার্মে চাকরি টিকিয়ে রাখাই কঠিন। গত বছর বাবাদের কোম্পানির পুরোনো মালিক মারা যাওয়ার পর তার ছেলে নতুন এমডি হয়েছে। পয়লা মাসেই দশজনকে ছাঁটাই করেছে। বাবার চাকরি অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। তিনি অফিস থেকে এখন এক মাসের বেতন অগ্রিম চাইতেও সাহস পান না।
কোত্থেকে বোনের বিয়ের টাকা জোগাড় করবেন?
আসলাম গুল মোলায়েম গলায় বললো, বেটা শোয়েব, তুমি কী ভাবছো আমি বুঝতে পারছি। তোমাকে আমরা এমন কাজ দেবো যে লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকেই তুমি তা করতে পারবে। পাশ না করা পর্যন্ত পার্ট টাইম। পাশ করে বেরুলে ফুল টাইম।
সঙ্গে সঙ্গে শোয়েব ভুলে গেলো ও কোথায় আছে, কার সঙ্গে কথা বলছে। গত এক বছর ধরে ও চেষ্টা করছে একটা টিউশনি জোগাড়ের জন্য, পারেনি। কখনও বাবার টাকা পাঠাতে দু চার দিন দেরি হলে চোখে ও অন্ধকার দেখে।
ব্যগ্র গলায় বললো, আমি চাকরি করবো। বলুন, কী করতে হবে আমাকে।
তুমি তো ছাত্র ফ্রন্ট করো, তাই না?
হ্যাঁ। শোয়েব বুঝতে পারলো না চাকরির সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের কী সম্পর্ক।
ছাত্র ইউনিয়নের অনেক ছেলে ছাত্রলীগে জয়েন করেছে তাই না?
হ্যাঁ করেছে।
তুমি করছো না কেন?
বারে খামখা কেন ছাত্রলীগ করবো। কলেজ থেকেই আমি ছাত্র ফ্রন্ট করি। ক্যাম্পাসে আমার বন্ধুরাও সবাই ছাত্র ফ্রন্ট করে।
আমি জানি। তোমরা সবাই মিলে ছাত্রলীগে জয়েন করো।
বিনা কারণে কেন ছাত্রলীগ করতে যাবো? গত মাসেই মেডিক্যালে লীগের সঙ্গে আমাদের মারামারি হয়েছে।
জানি। তুমি ছাত্রলীগে জয়েন করবে তোমার বন্ধুদের নিয়ে–এটা হচ্ছে তোমার চাকরির একটা শর্ত।
আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না। অবাক হয়ে শোয়েব বললো, আপনি কি ছাত্র লীগ করার জন্য আমাকে চাকরি দেবেন?
ঠিক ধরেছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বুঝি এখন টাকা দিয়ে কর্মী কিনছে?
আমি আওয়ামী লীগের কোনও নেতা নই। একজন ওয়েল উইশার বলতে পারো।
আপনি আসলে কী চান?
দেখো বেটা, আওয়ামী লীগ দল হিসেবে খুবই বড় এতে কোনও সন্দেহ নেই। তোমাদের আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতবে বলে আমরা মনে করি। তবে দুঃখের কথা হচ্ছে এই দলের বেশির ভাগ নেতা ভারতের দালাল। ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশকে তারা ভারতের কাছে বিক্রি করে দেবে।
আসলাম গুলের কথার কোনও খেই ধরতে পারছিলো না শোয়েব। কখনও ওকে মনে হচ্ছে জামাতের লোক, কখনও মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের, এখন মনে হচ্ছে বিএনপির। বললো, বিএনপির লোকেরা আওয়ামী লীগকে ভারতের দালাল বলে।
না, শুধু বিএনপি বলে না, সাধারণ পাবলিকও বলে।
পাবলিক যদি বিশ্বাস করবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে ইন্ডিয়ার কাছে বাংলাদেশকে বিক্রি করে দেবে, তারপরও কি আওয়ামী লীগ ইলেকশনে জিতবে?
জিতবে। কারণ বিএনপির ভেতরও অনেক ইন্ডিয়ান এজেন্ট আছে। আর্মিতেও আছে। অরাও চায় ইলেকশনে এবার আওয়ামী লীগ জিতুক।
আপনি কী চান সেটাই তো বলছেন না।
আমিও চাই ইলেকশনে আওয়ামী লীগ জিতুক।তবে জিতে যেন বাংলাদেশকে ইন্ডিয়ার হাতে তুলে দিতে না পারে সেটা আমাদের দেখতে হবে।
আমার কাজটা কি হবে?
তুমি যদি রাজনীতিটা একটু বোঝার চেষ্টা করো কাজটা তোমার জন্য সহজ হয়ে যাবে। তোমরা এখন কোথাকার এক জাহানারা ইমামের কথায় জামাতের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের শক্তি ক্ষয় করছে। ক্ষমতায় যদি যেতে চাও আক্রমণের লক্ষ্য হবে যে দল ক্ষমতায় আছে তারা, জামাত কখনও আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়া আটকাতে পারে না, পারে শুধু বিএনপি। বিএনপি ক্ষমতায় এসে যে সব দুর্নীতি করছে মানুষ যদি তা জানে তাহলে বিএনপিকে ওরা আগামী বার ভোট দেবে না। ছাত্রদলের কথাই ধরো। তোমরা মারামারি করছে শিবিরের সঙ্গে। ওদিকে বিএনপি একটার পর একটা কলেজ দখল করে ফেলছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি দেখে মনে হয় ওরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি : করছে না, ইন্ডিয়াকে খুশি করার জন্য যখন যা করা দরকার করছে।
আমার কাজ কী হবে? নির্দিষ্টভাবে জানতে চাইলো শোয়েব।
শুধু তোমার নয়, তোমাদের সবার কাজ হবে আওয়ামী লীগ যে ভারতের দালাল। নয়, সত্যিকারের একটা দেশপ্রেমিকদের দল এটা প্রমাণ করা। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ইন্ডিয়াকে পছন্দ করে না। ইন্ডিয়া ফারাক্কার পানি বন্ধ করে দিয়েছে। গোটা উত্তরবঙ্গ বিরান মরুভূমি হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ার জন্য এখানে কোনও ইন্ডাস্ট্রি হতে পারছে না। যে বাংলার জন্য তোমরা জীবন দিয়েছে সেই তোমরা সারাদিন টেলিভিশনে হিন্দি প্রোগ্রাম দেখো। বাঙালি জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে যদি তোমরা ইন্ডিয়ার খপ্পর থেকে বেরুতে না পারো।
শোয়েব গম্ভীর হয়ে বললো, ইন্ডিয়ার দালালি না করা এক জিনিস আর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ইন্ডিয়াকে গালি দেয়া আরেক জিনিস।
গালি দিতে কে বলছে তোমাকে? তোমরা বলো তিরিশ লাখ মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়েছে, নিশ্চয় তারা, ইন্ডিয়ার সঙ্গে পঁচিশ বছরের গোলামি চুক্তি চায়নি।
ইন্ডিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের পঁচিশ বছরের একটা চুক্তি হয়েছিলো এটা শোয়েব জানে। অনেকে এটাকে গোলামি চুক্তি বলে কিন্তু ও নিজেও জানে না চুক্তিতে কী আছে।
আসলাম গুলের কথাগুলো খুব নির্মম শোনালেও–যুক্তি যে আছে এটা শোয়েব অস্বীকার করতে পারলো না।
শোয়েবের চেহারা দেখে আসলাম গুল বুঝলো ওষুধ ধরেছে। বললো, বাংলাদেশ একটা রাষ্ট্র হিসেবে ছোট হতে পারে, কিন্তু ভুলে যেও না বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। বাঙালি মুসলমানদের মতো সাহসী যোদ্ধা জাতি পৃথিবীতে খুব কমই আছে। এই জাতিকে নেতৃত্ব দেয়া খালেদা জিয়ার বিএনপির মতো দলের পক্ষে সম্ভব নয়। জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকলে না হয় কথা ছিলো। দেশের অবস্থা এখন এমনই দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে হবে। এটা শুধু মনে চাইলে হবে না, এর জন্য কাজ করতে হবে, সঠিক কৌশল বের করতে হবে।
কৌশলটা কী?
যুদ্ধের একটা সাধারণ নিয়ম হচ্ছে এক গুলিতে তুমি একজনকেই মারতে পারো। যদি ভাবো এক গুলিতে তুমি তিনজনকে মারবে তাহলে দেখা যাবে একজনকেও তুমি মারতে পারোনি। ক্ষমতায় যেতে হলে শুধু বিএনপিকে টার্গেট করো। বিএনপির বিরুদ্ধে যারা লড়তে চায় তাদের একাট্টা করো। দেখবে আগামী নির্বাচনে বিএনপির নাম নিশানা থাকবে না।
আসলাম গুলের প্রস্তাব না মানার কোনও কারণ খুঁজে পেলো না শোয়েব। ওকে যদি বলতো টাকা দেবো জামাত করো, কিংবা বিএনপিতে জয়েন করো, তাহলে সেটা মানা ওর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আওয়ামী লীগের যত দোষই থাক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবচেয়ে বড় দল আওয়ামীলীগই। যতই ছাত্র ইউনিয়ন করুক ওদের দল সিপিবি কোনও দিন ক্ষমতায় যেতে পারবে না।
শোয়েবকে কিছুক্ষণ ভাববার সুযোগ দিয়ে আসলাম গুল বললো, তাহলে এই কথাই থাকলো। তুমি আর তোমার বন্ধুরা ছাত্র লীগে জয়েন করছে।
শোয়েবের মুখে হাসি ফুটলো। বললো, করবো।
তাহলে সামনের মাসে আমি তোমার বাবাকে এক লাখ টাকার বন্দোবস্ত করে দেবো। তবে তুমি ছাত্র যতদিন আছো মাসে দুহাজারের বেশি পাবে না।
বলে কী, দু হাজারের বেশি পাবে না। মাসে এক হাজার টাকা পেলেই শোয়েব বর্তে যায়। দুহাজার পেলে তো কথাই নেই। বললো, শুধু ছাত্র লীগে জয়েন করলে চলবে, না আর কিছু করতে হবে?
কিছু কিছু প্রোগ্রাম নিতে হবে। তবে তার জন্য ফান্ডের কোনও অভাব হবে না। সবার আগে আওয়ামী লীগের শরীর থেকে ইন্ডিয়ার দালালির গন্ধটুকু ভালো মতো মুছে ফেলতে হবে। এই বলে আসলাম বেগ উঠে দাঁড়ালো–রহমত তোমাকে তোমাদের ঘরে পৌঁছে দেবে। তিন দিন তোমাকে আমাদের মেহমান হয়ে থাকতে হবে।
শোয়েব যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে বললো, আমার সঙ্গে যে তিনটা ছেলেকে ধরে আনা হয়েছে ওদের কী হবে?
আজ রাত হয়ে গেছে। কাল ওরা যেখানে যেতে চায় সেখানে পৌঁছে দেয়া হবে। তোমার চাকরির ব্যাপারটা আশা করি গোপন থাকবে। এই বলে, আসলাম গুল কলিং বেল টিপতেই বিহারী রহমত ঘরে ঢুকে বললো, হুকুম কিজিয়ে মালিক।
সাবকো আপনা কামরা দেখাও।
চলিয়ে জনাব। অত্যন্ত বিনীত গলায় কথাটা বলার চেষ্টা করলো কর্কশভাষী বিহারীটা।