৮. কত কী ঘটে

৩৬.

দিন চলে গেল দিনের মনে। মানুষের জীবনে কত কী ঘটে। এ সংসারে কত সমস্যা। কত ভাঙে, কত গড়ে। লোকে কত কথা বলে। যার যেমন, সে তেমনি বলে। কেউ বলে, দিনগুলি কোথা দিয়ে কেটে যায় টেরও পাইনে। কেউ বলে, দিনগুলি যেন কাটতেই চায় না।

তবু দিন চলে যায়। কারুর মন রাখতে গিয়ে সে আসে যায় না। লোকের মনের কাছে দু দণ্ড ধরা দিয়ে বিলম্ব করে না। যে অমোঘ নিয়মের বশবর্তী সমস্ত গ্রহ-উপগ্রহ, সেই নিয়মেই নির্ধারিত দিনের গতি।

জীবনের সব ভাঙাগড়া নিয়ে মানুষের জীবনও তাই। তার জীবনও একটি প্রকৃতি। তার নিজের রীতিনীতি নিয়ে সেও একটি অমোঘ নিয়মে নিয়ন্ত্রিত। বিশ্বপ্রকৃতির মতো জীবনের প্রকৃতির মধ্যেও আছে ভয় এবং অভয়। আছে, প্রসন্নতা ও ভয়ংকর। দান আছে, প্রতিশোধ আছে। সে নিরন্তর। সেই নিরন্তরের খুঁটিনাটি আমরা সবসময়ে দেখতে পাইনে।

দিন চলে যায়। সুমিতা দেখে। দিন চলে যায়, জীবনও চলে ধেয়ে নানা পথের অলি-গলি দিয়ে। দূর থেকে উঁকি দেয় অনাগত ফাইন্যাল পরীক্ষার দিনগুলি। যদিও তার দেরি আছে এখনও অনেক। তবু বর্ষা গেছে। ধূলি-ধূসর কলকাতার গাছে গাছেও শরতের রোদ ঝিকমিক করে সোনার মতো। অ্যাভির পথটি যখন জলে ভেজে, স্কোয়ারে তখন ঝলমল করে রোদ। মনুমেন্টের শির যখন মেঘ-চাপা পড়ে, ডালহৌসির আকাশ তখন নির্মেঘ নীল। শারদোৎসবের নানান বিজ্ঞাপনে কলকাতার সারা দেয়াল চিত্রিত হয়ে যায়। বারোয়ারি পুজোর চাঁদার বিলবই পথরোধ করে সর্বত্র। কলকাতার কোন গোপন ঘুমন্ত প্রাণ জাগে যেন ধীরে ধীরে। শহরের সেই উত্তরপ্রান্তে, কুমারটুলির কুমোরের ঘরে ঘোচে আহার-নিদ্রা। তারা প্রতিমা গড়ে। ইংরেজি বাংলা, নাচ-থিয়েটার, পত্র-পত্রিকা, সবকিছুতেই চোখ মেলে চায় ঘুমন্ত কলকাতা।

এ হল বাইরের দিন। এদিনও যাবে। আর আছে ভিতরের দিন। সে দিনও যাবে, কিন্তু কেমন করে যাবে, সেই ভয়। চারদিকে তার কত সংশয়ের বেড়া। সুমিতা দেখে, জীবন-প্রকৃতি বড় ভীষণ ও ভয়ংকরী। বিশ্ব-প্রকৃতির ভূমিকম্প, বন্যা, মহামারীর মতো, জীবন-প্রকৃতিও যেন কী এক নিদারুণ প্রতিশোধের জন্য দাঁড়িয়েছে ওর মুখোমুখি। ঘরে এখন মেজদি আর বাবা। বাইরে রাজেন। রাজেন তো শুধু একটি মানুষ নয় ওর কাছে। সে যে একটি মহাজীবনের বিস্তৃতি নিয়ে ছড়িয়ে আছে সুমিতার সামনে। কিন্তু ঘরে বাইরে সুমিতা দেখে, জীবনের দিকে দিকে বড় ভয়াল আবর্ত। ওর অকূল পাথার মনপ্রাণ নিয়ে, ও যে উজানে চলেছিল, জীবন-প্রকৃতি ওকে সেখানেই ধরেছে কঠিন হাতে।

বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী সুমিতা, বৈষ্ণব পদাবলী পড়তে গিয়ে দেখেছে, শ্রীরাধা দয়িত-সন্ধানে উজানগামিনী। ও তো শ্রীরাধা নয়। এ-যুগের এক মেয়ে, নিজের জীবনের ব্যাস পেরিয়ে নতুন গোলার্ধে পা দিয়েছে ও। আপনি আপনি দেয়নি। সুধাময়ী যে মহাপ্রাণীর কথা বলেন, ওর সেই মহাপ্রাণী সব বাধা পার হয়ে গেছে। তার আপন বেগে সে ছুটে গেছে উজানে। দুই দিদির জীবনের শেষ না হোক, অনেকখানি দেখে, উজানে না গিয়ে সুমিতা পারবে কেমন করে। কিন্তু জীবনের ঢল যেদিকে, গড়ান যে-পথে, তারই ঘূর্ণিতে পড়ে এখন মরছে পাক খেয়ে।

তবু ওর মহাপ্রাণ, সে যে উজানে।

এ সব কথা যত ভাবে, তত ছুটে যায় হাওড়ায়। ওখানকার রুদ্ধশ্বাস, ঘিঞ্জিপথ আর ওর পথ আটকায় না। আর কোনও ভুল হয় না অলি-গলি চিনতে। জীবনের ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন কোনও গলিপথ আর পারে না সুমিতাকে ভয় দেখাতে। বারে বারে এসে সব ওর সড়গড় হয়ে গেছে। চিনে গেছে অনেক মানুষের মুখ।

সেই পুরনো প্রাচীন ভাঙা বাড়িটার প্রতি রন্ধ্র এখন ভাসে চোখের সামনে। তার স্যাঁতা গলিপথ, দু পাশের দমচাপা ঘর, ভাঙা রক, সবখানে, সব কোণে রেখে এসেছে নিজের স্পর্শ। মন-প্রাণের সব আকাঙ্ক্ষা।

আজকাল সবসময় দেখা-ও পাওয়া যায় না রাজেনের। মাঝে যখন দুদিন দেখা হয়নি, তৃতীয় দিন আরও ব্যাকুল হয়ে ছুটে গেছে সুমিতা। সুধাময়ী দুহাত বাড়িয়ে তুলে নেন আদর করে। বারে বারে চেয়ে চেয়ে দেখেন। চিবুক তুলে, মুখখানি দেখেন কাছে এসে।

সারাদিন গেছে। বসে থেকেছে দুজনেই। সাজ গেছে, লজ্জা গেছে। সব জলাঞ্জলি দিয়ে বসে থেকেছে সুমিতা।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুমিতাকে দেখে টনটনিয়ে উঠেছে সুধাময়ীর বুক। উৎকর্ণ হয়ে শুনেছেন প্রতিটি শব্দ। সকালে বেরিয়েও সেদিন ফেরেনি রাজেন। তাঁর আবেগ এক বার প্রকাশ পেলে আর চাপতে পারেন না। পাত্রপাত্রী জ্ঞান থাকে না।

বিকেলের দিকে যখন দুটি প্রাণ প্রতীক্ষায় মরো মরো, তখন হঠাৎ, সুমিতাকে বুকের কাছে টেনে, ভাঙা গলায় বলে উলেন সুধাময়ী, কেন, কেন এমন কাজ করলি মা।

চোখের জল ধরে রাখতে পারল না সুমিতা। কোনও সংকোচ, কোনও লজ্জা রাখল না। বলল, আমি তো অন্যায় কিছু করিনি মা।

সুধাময়ী রুদ্ধ গলায় বললেন, অন্যায়, হাজার বার অন্যায় করেছ মা।

তুমি দেখেও শিখলে না, তোমার মেজদি ওকে কেমন করে ছেড়ে দিয়ে গেল, ফেলে রেখে গেল–

সুমিতা যেন ভয়ে হুতোশ চিৎকার করে উঠল, বলবেন না, বলবেন না মা ও সব কথা। ও কথা আমি শুনতে পারব না।

সুধাময়ীর ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠল। দু চোখ ভরে তার কী এক আলোর ছড়াছড়ি। রাজেন তার ছেলে। নিজে তো জানেন, রাজেন তার কী! বড় দুঃখে বলেছেন। এর চেয়ে কঠিন কথা বলতেও তার আটকায় না। কিন্তু সুমিতা যে তারই প্রাণের একটি অন্তরঙ্গ ছায়া, তা এমন করে আর কোনওদিন যেন টের পাননি।

সুধাময়ীর চোখে জল, মুখে হাসি। বললেন, কেন বলব না মা?

মুখ নিচু করে, দৃঢ়স্বরে বলল সুমিতা, কে কাকে ছেড়ে গেছে, সে খোঁজে আমার কী দরকার। আর

–আর কী, বলো?

–কেউ কি কাউকে ছেড়ে যেতে পারে মা। সংসারে তো এমন মানুষও আছে, যাদের ছাড়া যায় না। যেতে হলে, পালাতে হয় তার কাছ থেকে।

সুধাময়ী নিঃশব্দে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন সুমিতার দিকে। দেখতে দেখতে তার ঠোঁটের সব হাসিটুকু অদৃশ্য হল। গম্ভীর মুখে, ভারী গলায় বললেন, সুমিতা, বুঝেছি মা, তোমার বড় সাহস। যার কাছ থেকে তোমার মেজদি পালিয়ে গেছে, তার কাছেই তোমার প্রাণ টেনেছে। বলে সুমিতার মুখখানি তুলে ধরে বললেন, আমি বুঝেছি, তুমি পালাতে পারবে না। তোমার মুখ দেখে বুঝেছি, তোমার আসা দেখে বুঝেছি, তোমার বেশ দেখে চিনেছি মা। যেদিন থেকে দেখেছি, সেইদিন থেকেই মনে মনে বলেছি, এ কী করল মেয়েটা।

-কেন?

–কেন? তুমি পালাতে পারবে না, কিন্তু পালাবার ছল করে রাজেনের সঙ্গে কি লুকোচুরি খেলতে পারবে মা?

সুমিতা আবার মুখ নিচু করল। বলল, ও আপনার ছেলে। আপনি তো জানেন, ও সেই ছেলে নয়, যার সঙ্গে মেয়েরা লুকোচুরি খেলতে পারে। যে পারবে, তাকে যে ও শ্রদ্ধা করতে পারবে না।

সুধাময়ী সরু চাপা গলায়, চোখ বড় করে বললেন, আমি যে সেই কথাই তোকে বলছি মা, সেই কথাই বলছি। তুই পালাতে পারবিনে, লুকোচুরি খেলতে পারবিনে। কেন? না, তুই তো ওকে শুধু মানুষ বলে দেখিসনি, একটা জীবন ভেবে দেখেছিস। সেই জন্যেই তোকে যে শুধু কপাল কুটে কেঁদে মরতে হবে। আমি যে জানি, রাজেন আমার ছেলে। তুই ওকে ফেলে পালাতে পারবিনে, কিন্তু মা, তোকে ত্যাগ করতে হতে পারে রাজেনকে।

সুমিতার চোখেমুখে যেন ছোট্ট মেয়েটির ভয় ও ব্যথা। শিউরে উঠে মুখ ঢেকে চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। তারপরে যেন চুপি চুপি বলল, কেন মা?

সুধাময়ী বললেন, তুই তাকিয়ে দেখিসনি মা, রাজেনের চোখের দিকে।

ওর দু চোখে কী পরিমাণ জ্বালা। মাগো, কী আগুন ওর দু চোখে। শুধু রাগ, শুধু ঘৃণা, বিদ্বেষ। ও যে শুধু রুদ্র; কিন্তু রুদ্র যে শুধু পোড়ায়। কেবলি সর্বনাশ খোঁজে। ওর আর একটা চোখ নেই, আমরা যাকে বলি ত্রিনয়ন। ও দুচোখে যা দেখে, তাই ওর সব। তাই যদি ওর সব, তবে ও রাজেন কেন। তবে আমার কীসের গর্ব, তুই কেন ছুটে আসিস এমন করে। ওর যে আগুন দেখে সবাই ছুটে আসে ওর কাছে, সেই আগুনেই ও পুড়িয়ে মারবে সবাইকে। দূর করবে ওর আপনজনকে, নিজেকে ছোট করবে। মা, ছোট মুখে বড় কথা বলছি। মহাদেবের তুলনা দিয়ে বলছি, তাঁর দুই চোখে যত জ্বালা, তাঁর আর এক চোখে তত হাসি। রাজেন আমার মহাদেব নয়। কিন্তু ওরা সবাই মিলে যে বিষ নাশের ব্রত নিয়েছে, সেই ব্রত তো শুধু রাগ আর ঘৃণা নয়। ভালবাসা কই! যে মূল ধরে তুই এসেছিস, তোর সেই মূলটাকেই গেলি ভুলে। তাই বলি, এ আমার ভয় মা। ও যে দূরটাকে দেখতে পাচ্ছে না, শুধু কাছের সবকিছুই বড় করে দেখছে, তাতে ওর সব হারাবে। ভয় করে মা, তোকেও হারাবে।

সুমিতা তেমনি ভীরু-উৎকণ্ঠায় বলল, না না, আমাকে হারাবার কিছুই নেই। হারালে আমিই হারাব।

সুধাময়ীর দুচোখে জল। নিঃশব্দে ঘাড় দোলাতে লাগলেন। ফিসফিস করে বললেন, নানা-না-না।

তারপর পরিষ্কার গলায় বললেন, আমি জানি, আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে। আমি চলে যাব। তা ছাড়া আমার উপায় নেই। এর পরে যা হবে তা আমি চেয়ে দেখতে পারব না, তাই চলে যাব। তোমাকে একটি কথা বলে রাখি মা। তুমি ছাড়া বোধ হয় আর কেউ ওর চোখ ফোঁটাতে পারবে না।

সুমিতা বলল, না না, আমার সে সাহস নেই, আমি তত বড়ও নই। আপনি তো জানেন, যা ও নিজে দেখতে পারে না, জোর করে তা কেউ দেখাতেও পারবে না। তা ছাড়া আমারও যে অনেক সন্দেহ, কতটুকুই বা আমি জানি।

বলতে বলতে সুমিতা উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি একটু যাই।

একটু যাবে? একটু কোথায় যাবে?

 সুমিতার চোখে জল দেখা দিল। কিন্তু কথা বলতে পারল না।

সুধাময়ী বললেন, বুঝেছি। কোথায় যেতে হবে জান তো?

–খুঁজে নেব।

দু পাশের ঘর-চাপা সেই স্যাঁতা-গলি পার হয়ে দরজা অবধি সুমিতাকে এগিয়ে দিয়ে গেলেন সুধাময়ী।

কলকারখানা ছুটি হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। চারদিকে কারখানার মানুষের ভিড়। দেয়ালে দেয়ালে আসন্ন ধর্মঘটের পোস্টার পড়েছে। রাজনৈতিক ধর্মঘট। কেউ এক বার তাকিয়েও দেখছে না প্রাচীর পত্রগুলির দিকে। যেন কোন এক একলা ঝড়োপাখির শাণিত নাদে পোস্টারের লেখাগুলি চিৎকার করছে। কিন্তু কেউ শুনছে না কান পেতে। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। তাই দেখে–যেন বিক্ষুব্ধ রাজেন ফুটে রয়েছে দেয়ালে দেয়ালে। জামার বোতাম আঁটা নেই। সারা কপালে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রুক্ষ চুলের গোছা। আহার নেই, স্নান নেই, দৃষ্টি নেই কোনওদিকে।

অনেকখানি হেঁটে, গলির মধ্যে এসে দাঁড়াল সুমিতা, একটি ঘরের কাছে। খোলার ছাউনি দেওয়া নিচু ঘর। এক দিন রাজেন তাকে নিয়ে এসেছিল এখানে। কাঁচা মাটির মেঝে। প্রায়ান্ধকার সেই ঘরে একরাশ মানুষের নিশ্বাসে, রাস্তার ধুলোয়, বিড়ির ধোঁয়ায় এক ভয়ংকর পরিবেশ। ঘরের শেষ সীমান্তে একটি নড়বড়ে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজেন। যে মূর্তি ভেবেছিল সুমিতা, তার চেয়েও দুর্দশাগ্রস্ত দেখাচ্ছে ওকে। দেখে সুমিতার বুকের মধ্যে টনটন করে উঠল।

যারা বসে ছিল, তারা অনেকেই এখন চেনে সুমিতাকে। তাকে ঢোকবার পথ করে দিলে সবাই। কিন্তু সমস্ত ঘরটা যেন কীসের উত্তেজনায় থমথম করছে। সুমিতা রাজেনের কাছে এল।

রাজেন এক বার চোখ তুলে তাকাল। বলল, তুমি এখানে?

সুমিতা তাকিয়েছিল রাজেনের চোখের দিকে। ওর নিজের দুই চোখের কোলে দুর্জয় অভিমান ফুটে উঠছিল। দেখল, রাজেনের চোখের কোল বসা। বোঝা যাচ্ছে, কিছুই খায়নি সারাদিন। সুমিতা নিচু গলায় বলল, সারা দিন বসেছিলুম তোমার পথ চেয়ে। দুদিন ঘুরে গেছি, আজ না এসে পারলুম না। কিন্তু রাজেনের কঠিন গম্ভীর মুখ তেমনি রইল। বলল, একটু বোসো, আমাদের হয়ে গেছে।

একজন মধ্যবয়স্ক মজুর উঠে দাঁড়াল। বোঝা যাচ্ছে, কারখানা থেকে সে বাড়ি ফেরেনি। মেহেদি মাখা দাড়িতে তার তখনও লেগে রয়েছে পাটের ফেঁসো। মুখ তার গম্ভীর, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। ভাঙা বাংলায় বলল, তবে এইটাই হুকুম রাজেনদাদা।

রাজেনের চোখ বিদ্যুৎ-কষা। সমস্ত মুখ যেন আগুনের মতো দপদপ করছে। সুস্পষ্ট গম্ভীর গলায় জবাব দিল, হুকুম নয়, নির্দেশ।

আমাদের আর নতুন করে কিছু ভাববার অবসর নেই। মনপ্রাণ দিয়ে কেবল ধর্মঘটের প্রস্তুতি।

কয়েক মুহূর্ত সবাই স্তব্ধ। রাজেনের মূর্তি দেখে সুমিতার বুকের মধ্যে গুরু গুরু করে উঠল।

রাজেন আবার বলল, কালকেও আমরা বসছি। যারা আজ আসেনি কাল সবাইকে খবর দিতে হবে।

তবু যেন কী একটা হয়ে রইল। সকলেই নিশ্ৰুপ। তারপর একে একে বেরিয়ে গেল সবাই মাথা নিচু করে। রইল শুধু সেই মধ্যবয়স্ক দাড়িওয়ালা, আর একটি যুবক। রাজেন বেরুবার সময় বলল, সোলমান, আমি যাচ্ছি।

দাড়িওয়ালা সোলেমান অন্যদিকে মুখ রেখে বলল, রাজেনদাদা, তুমি এই ইলাকাটার কথা আর এক বার শোচ করো, তার বাদ আখেরি রাস্তায় চলো।

রাজেন বলল, আমি ভেবেছি সোলেমান। জানি, ভীরুর দল পড়ে থাকবে পিছনে, যার শক্তি আছে, সে আগে বেড়ে যাবে ঠিক।

সোলেমান চুপ করে রইল।

পথে পথে আলো জ্বলছে। দোকানে দোকানে ভিড়।

 সুমিতা বলল, বাড়ি চলো, উনি বসে আছেন।

রাজেন বলল, এখন যেতে পারব না সুমিতা। আমি একটু ফাঁকা জায়গায় কোথাও বসতে চাই। বাড়ি যাব খাবার জন্যে তো। সেখানে খেতেও ইচ্ছে করে না। মা আমার সঙ্গে কথা বলে না।

তারপর প্রসঙ্গ পালটে বলল, সুমিতা, কালকের সভাতেও প্রায় পঞ্চাশ জন মজুর এসেছিল, আজকে তার অর্ধেকও আসেনি।

রাজেনের দিকে তাকিয়ে সুমিতার মনে মনে যত অভিমান, তত বেদনা। বলল, তবে কেন চেষ্টা করছ?

–এইটাই আমরা সকলে মিলে সাব্যস্ত করেছিলুম। আমাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্যে এইটাই এখন আশু প্রয়োজন।

–তোমরা যা ঠিক করেছ, তা তো ভুলও হতে পারে।

রাজেন এক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে বলল, সুমিতা, যে রাস্তা দিয়ে চলেছ, এক বার এই পথের দিকে তাকিয়ে দেখ। ধাঙ্গড় বস্তির মধ্যে এগুলো শুয়োরের খাঁচা নয়, মানুষেরই বাসস্থান। এদের যার সঙ্গে খুশি তুমি কথা বলে দেখ, সকলের মনে অসীম ঘৃণা, প্রচণ্ড ক্রোধ। তবে কেমন করে ভাব, আমার ভুল?

 সুমিতা বলল, আমি তো সব বুঝিনে। কিন্তু এরাই যে তোমার কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। আর

বলো। থামলে কেন। এ সব ছাড়া যে আমার মাথায় আর কিছু আসছে না। কনকনিয়ে উঠল সুমিতার বুক। জানে, তা জানে সুমিতা। শুধু সুমিতার কথা শোনবার অবকাশ আর এক দিনও আসেনি রাজেনের। বলল, ওদের ক্রোধ আছে, ঘৃণা আছে জানি। সে কি শুধু তোমাদের ইচ্ছেতেই হঠাৎ বাইরে প্রকাশ হয়ে পড়বে? ওদের সংসার নেই, ঘর-গৃহস্থালি নেই, আনন্দ-ভালবাসা নেই। তুমি তো আমার চেয়ে ওদের ভাল করে চেন। তবু আমার ভয় হয়, তোমরা যা চাও, তার সময় আসেনি। শুধুই রাগে ফুসছ।

ফুসছি, হ্যাঁ, ফুসছি। জীবনের নীচের দিকে তাকিয়ে এদেশের কোন মানুষটা আনন্দে খলখল করে হাসতে পারে আমি জানিনে। কিন্তু তুমি যা বলছ, তা ভুল। আমি বিশ্বাস করি, জীবনের এই ভাঙা মরা ঝরা কাঠামোটা কেউ রাখতে চাইছে না। এই পচা ঘুণ ধরা পুরনো জীবনটাকে সবাই ফেলে দিতে চাইছে।

–এখুনি? এই মুহূর্তে?

 জবাব দিতে গিয়ে যেন থতিয়ে গেল রাজেন। হঠাৎ কিছু বলতে পারল না কেবল তার সারা মুখে মূক অস্থিরতা।

.

সেই জায়গাটিতেই আজও এসেছে রাজেন, সেই গঙ্গার ধারে। অন্ধকার নির্জন উঁচু তট। আশেপাশে ছড়ানো কালকাসুন্দে আর বিষকাটারির ঝাড়। শরতের কৃষ্ণপক্ষ কুচকুচে আকাশ জুড়ে নক্ষত্রের ভিড়। ওপারে খিদিরপুরের স্বল্পালোক তটরেখা, উত্তর ঘেঁষে বন্দরের জাহাজ-মাস্তুলের মেলা।

সুমিতা দেখল, রাজেন দু চোখ মেলে তাকিয়ে আছে গঙ্গার বুকে! উদ্দীপ্ত চোখে যেন নিশির ঘোর। ফিসফিস করে বলল রাজেন, হ্যাঁ সুমিতা, এখুনি এই মুহূর্তে। আমি সেই স্বপ্নই দেখি।

একেবারে যেন নতুন মানুষ রাজেন। গম্ভীর কঠিন, কিছু নয়। শিশুর সারল্য ও উদ্দীপনা। সমাজের নিচুতলাকে সে আলোময় আসনে এনে দাঁড় করানোর সফল স্বপ্ন প্রত্যাশা করছে এই মুহূর্তেই।

সুমিতা বলল, কিন্তু তোমার স্বপ্ন যদি সত্যি না হয়!

–সেই তো আমার মৃত্যু পণ।

শিউরে কেঁপে উঠল সুমিতা। রাজেনের একটি হাত নিজের মুখে চেপে রোরুদ্যমান কান্নায় উঠল ফুলে। বলল, সেই তো আমার ভয়, তোমার মৃত্যু দিয়েও স্বপ্ন হয়তো সার্থক হবে না। তুমি এক বার ভাল করে তাকিয়ে দেখো, তোমার মানুষদের এক বার দেখো। স্বপ্নের পিছনে ছুটো না।

রাজেনের বুকের মধ্যে চমকে চমকে উঠল। যেন মনে হয়, মায়ের আর এক রূপ ধরে সুমিতা এসেছে। সোলেমানের কথাগুলিই বলছে আর এক রকম করে। বলল, আমি কি মিথ্যে স্বপ্ন দেখি সুমিতা।

না সত্যি, শুধু তুমি যেভাবে চাও, সেভাবে নয়। যখন চাও, তখন নয়। রাজেন তুমি যে মেজদিকে চিঠি লিখেছিলে, এক বার সেই চিঠির কথা ভাবো। তুমি এই দেশের সুদূরতল পর্যন্ত দেখতে পেয়েছিলে।

তুমি কেন আরও বেশি দেখছ না।

সেইটিই রাজেনের জীবনের সবচেয়ে বড় কথা। প্রত্যক্ষ রাজনীতির চেয়েও অন্তরে ওর বড় ছিল জীবনধর্ম। কিন্তু শিক্ষিত প্রাণটাকে তো ফেলে আসতে পারেনি বুদ্ধির কচকচিতে। সেখানে ঠাসা আগুন। মহামানবের সুদূরতল দেখতে গিয়ে যতটুকু দেখেছে, তাইতেই ওর সমস্ত বিবেক রাগে দুঃখে অপমানে অন্ধ হয়ে উঠেছে। খোঁজ নেয়নি, আরও তল আছে। আরও, আরও। আরও অনেক জটিল, ভয়াল। রাজেন যত নিষ্ঠুর ভেবেছে, তার চেয়ে আরও অনেক নিষ্ঠুর, কঠিন কঠোর। জগদ্দল পাথরটাকে দেখেই সে ক্ষুব্ধ, তাকে টলানো আরও কঠিন, সেটুকু ভাবেনি। এ ওর অহংকার নয়, দুর্বুদ্ধি নয়, দুঃসাহসও নয়। ওর প্রজ্জ্বলিত বিবেক।

সেই বিবেক তো আজ কারুর কথা শুনবে না। এই বিবেকের রীতি, সে নিজেই নিজের পথে আসবে।

তবু অনেক দিন পর সুগতাকে লেখা সেই চিঠিটার কথা মনে পড়তে মনটা থমকে গেল রাজেনের। সুমিতার দু হাত নিজের মুঠিতে নিয়ে চুপ করে রইল সে। দু বছর আগের সেই মনটাকে যেন যাচাই করতে লাগল আপনি আপনি।

গঙ্গার ছলছলানি কেমন যেন একটি মায়া সৃষ্টি করছে অন্ধকারে। নদীর বুকে এখনও শেষ মরশুমের মাছমারা মাঝিদের নৌকা দেখা যায়।

অন্ধকারে রাজেন তাকাল সুমিতার মুখের দিকে। বলল, আমি তো চোখ বুজে থাকিনে সুমিতা। তোমার কথা আমার মনে রইল। আমি দেখেছি তুমি যার কথা বলছ। আরও দেখব।

একটু চুপ করে থেকে রাজেন সুমিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী দেখছ?

সুমিতা যেন কোন দুর থেকে ধীরে ধীরে বলল, যা দেখতে আসি। তবুও তো সবসময় দেখা পাইনে। একটা কথা রাখবে?

বলো।

যদি পারতুম, যদি সময় হত, তবে একেবারেই চলে আসতুম তোমার কাছে। কিন্তু, কিন্তু

গলার স্বর চেপে এল সুমিতার, তোমার কাছে আমাকে আসতে দিয়ো। আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে না।

রাজেন বিস্ময়ে চমকে বলল, তোমাকে তো আমি দূরে সরিয়ে দিতে চাইনি।

রুদ্ধ গলায় প্রায় যেন চুপিসারে বলল সুমিতা, চেয়েছ, চেয়েছ, মিথ্যুক, এক বারও কি নিজের মুখের দিকে, বুকের দিকে তাকিয়ে দেখনি। আমি সেখানে কতটুকু। তোমার নীতি যে আমাকে শুধুই শাসায়।

আবার কথা আটকে গেল রাজেনের। শুধু সুমিতার দুটি হাত ধরে ফিরে তাকাল নদীর দিকে।

 চলে গেছে সুমিতা। আবার এসেছে। এসেছে, গেছে। এই যাওয়া আসার মাঝে দেখে শুধু জীবন-প্রকৃতির প্রতিশোধের বাসনা। সবদিকে সেই জীবনের লীলা। সেই লীলাই বহন করে নিয়ে আসে সুজাতার চিঠিতে। বাবাকে লেখে সুমিতাকেও লেখে।

রুমনি, বাবাকে যেন বলিসনে, আমার এই বম্বেতেও বড় খারাপ লাগে এক এক সময়। অনেকের সঙ্গে আমার চেনাশোনা, অনেকেই আসে আমার বাড়িতে। তবু মনটা অষ্টপ্রহর কেমন যে, খাঁ খাঁ করে। এত লোকজন, তবু যেন কথা বলার মানুষ পাইনি। তার ওপরে আমি তো মেয়েমানুষ। একলা থাকি, নানান ভয়। যত ভয়, ততই নির্ভয়ের ভান করে চলি। ঝুমনোটার কথা মনে হলে আমার আর মাথাটা ঠিক থাকে না। পুরনো কথা আমি আর ভাবিনে। কিন্তু ঝুমনোর কথা মনে হলে দরজা বন্ধ করে দিই। কেউ না আবার আমার চিৎকার শুনে ফেলে। আর তখুনি বাবার মুখটা ভেসে ওঠে আমার চোখের সামনে। আমি দু হাতে চোখ ঢেকে থাকি।

যখন কিছু ভাল লাগে না, সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যাই। আশ্চর্য! সমুদ্রের সেই শেষে যেখানে আকাশটা নেমেছে, সেখানে আমি আমার সব চেনা মুখগুলো দেখতে পাই। ওইখানে যাওয়ার জন্যে আমার প্রাণটা ছটফট করে ওঠে।

রুমনি, পরীক্ষা হলে তুই চলে আসিস বেড়াতে।

বাবাকে লেখে, বাবা, তোমার জন্যেই যা মনটা খারাপ লাগে। নইলে ভালই আছি, কিছু ভেবো না।  

এইরকম চিঠি আসে প্রায়ই।

বিভূতি আসে প্রায় প্রত্যহই। আশ্চর্য শান্ত, কোমল, গম্ভীর মানুষ বিভূতি। সবসময়েই যেন কী ভাবে, কী দেখে। এমন আত্মভোলা মানুষ–সুগতাকে দেখা মাত্রই একটি বিচিত্র স্নিগ্ধ-লজ্জায় কেমন হয়ে যায়। লাল হয়ে ওঠে কান দুটি। দুজনে ছাড়া তৃতীয় মানুষটি থাকলে আর কিছুতেই তাকাতে পারে না সুগতার দিকে। সুমিতা বিভূতির আঙুল-জামা কাপড় খুঁটিয়ে দেখে। কোথাও রং-এর দাগ আছে কিনা। এত যে ছবি আঁকে, দাগ কোথায়। তবে, আঙুলগুলি যেন কেমন ধূসর মতোই দেখায়। মানুষটিকে দেখে অবাক হয়ে ভাবে, আশ্চর্য! এই মানুষটিরই হাতের তুলির টানে অমন বলিষ্ঠ তীব্র রেখার জাদু কেমন করে ফুটে ওঠে। আর বিভূতির অধিকাংশ ছবিই পথের ধারের বাসিন্দা। খেটে খাওয়া মানুষ আর সংগ্রামী জনতার।

মেজদিই কথা বলে, বিভূতি শোনে। কখনও কখনও কথা বলে, কিন্তু খুব আস্তে। সুগতার আঁচলের আড়ালে আড়ালে চলে যেন।

সুগতা এখন প্রতি দিনই উত্তর চব্বিশ পরগনার শ্রমিকাঞ্চলে যায়। সেখানেই এখন ওর কাজ। ইচ্ছেটা ভবিষ্যতে ওখানেই আস্তানা করবে। বিভূতি প্রতিদিনের সঙ্গী।

আর আসে আশীষ। জীবনের লীলাটা এইখানে সবচেয়ে ভয়ংকর। আশীষ, মাঝে মাঝে সঙ্গে করে আনে একজন মহিলাকে। বয়স ওঁর বছর পঁয়তাল্লিশ পরিচয় দেয় বান্ধবী বলে। বোঝে না সুমিতা, কেন ওই মহিলাকে আলাপ করিয়ে দিয়েছে আশীষ সুমিতার সঙ্গে। চব্বিশ বছরের আশীষ, পঁয়তাল্লিশ বছরের মহিলার সঙ্গে কথা বলে তুমি তুমি করে। বড় অবাক হয়েছে সুমিতা প্রথম প্রথম। ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হয় শান্ত। কিন্তু কী এক বিচিত্র কটাক্ষে দেখেন তাকিয়ে সুমিতাকে। গান করেন মাঝে মাঝে। শুনে মনে হয়েছে, ওঁর জীবনের কোথায় একটি বেদনা আছে লুকিয়ে। বিধবা, ছেলে আছে আশীষের সমবয়সি।

কিন্তু দুজনের সম্পর্কের মধ্যে বড় বিচিত্র গভীরতা।

আশীষ এর মধ্যেই আরও মোটা হয়েছে, চেহারার মধ্যেও এসেছে একটা ভারিক্কি ভাব। সুমিতার দিকে এখন তাকায় যেন, কুঁচকে মেয়েটা। যার দেহের কোনও রন্ধ্রই নেই ওর অজানা।

ভয় করে, ভয় করে সুমিতার। আশীষের বিদ্রূপ বেড়েছে। গোটা সংসারটাকে যেন ফিরছে করুণা করে।

তারপর এক দিন আশীষই বলেছে, প্রেম হয়েছে ওদের দুজনের মধ্যে। এ যুগের এক বিরাট জটিল করুণ আত্মাকে ও দেখতে পেয়েছে ওই মহিলার মধ্যে। ওরা বিয়ের কথাও ভাবছে।

সুমিতা চমকে উঠেছে, শিউরে উঠেছে। আশীষ নিঃশব্দে হেসেছে ভ্র টান করে। ওর বন্ধুরা বলেছে, এ যুগে এমন যুগান্তকারী প্রেম নাকি আর একটিও হয়নি। এ যুগের মতোই নাকি তা মহৎ আর জটিল।

শুধু খিল খিল করে হাসে পাশের বাড়ির তাপসী। বলে, কে? তোর আশীষ। দ্যাখ ও শিগগিরই সম্বন্ধ করে বিয়ে করল বলে।

সুমিতা মনে মনে কামনা করে, তাই যেন হয়, তাই যেন হয়। মুখে বলে, কী করে জানলি তুই?

 তাপসী বলে ঠোঁট টিপে হেসে, আমার চেয়ে তোরই তো বেশি জানার কথা। বেচারির এ সর্বনাশটা তো তুই করলি।

সুমিতার মনের মধ্যে চমকে চমকে ওঠে একটি অতি সূক্ষ্ম অপরাধ বোধ। বলে, আমি?

তাপসী হাসে। কপালে থাকে ওর কুঙ্কুমের টিপ, সিঁদুর টকটকে সিঁথি। যেখানে বিয়েতে ওর মন চায়নি, সেখানেই বিয়ে হয়েছে। সর্বাঙ্গে গহনা, অষ্টপ্রহরই থাকে সেজেগুজে। হাসিটা যে কী পরিমাণ বেড়েছে। এখন বাবা মা, কারুর ভয়ই যেন নেই ওর।

তাপসী বলে, আশীষেরই বন্ধু কৃষ্ণ রায় বলেছে। তোর কথা কিছু বলেনি। আশীষের কথাই বলেছে, ব্যাপারটা সত্যি হলে, মহৎ কতখানি হত জানিনে। কিন্তু এর ভেতরে যে এক সুগভীর বেদনা দুজনের অন্তরকে ব্যাকুল করে তুলত, সেটাকে অস্বীকার করা যেত না। ভদ্রমহিলাকে দেখে কষ্টই হয়, ওর দিক থেকে ব্যাপারটা সত্যি করুণ। আশীষের ব্যাপারটাও বেদনাদায়ক, কেনো ওটা ওর মনের গভীরের বিকৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। সাময়িক ব্যর্থতায় মানুষের কত রকমের বিকৃতি দেখা দেয়। কেউ মদ খায়, পাগল হয়, ইনস্যানিটি গ্রো করে। আর সিনিসিজম এখনকার দিনে প্রায় স্বাভাবিকতার পর‍্যায়ে এসে গেছে। আশীষ রাগে দুঃখে যেন ছেলেমানুষের মতো গোটা সমাজটাকে কাঁচকলা দেখিয়ে বেড়াচ্ছে, আর চলতি নিয়মের প্রেম, ভালবাসা, ইনটেলেকট সবকিছুকে দেখিয়ে বেড়াচ্ছে ওই মহিলার সঙ্গে ওর প্রেম। সবাইকে যেন বিদ্রূপ করে, ভয় দেখিয়ে বলছে, তোমরা আর যাই কর, এত দূর আসতে পারবে কি? সবাই যত বিস্মিত, ও ততই তৃপ্ত।

আসলে ওটা ওর যত যন্ত্রণার আর বিদ্বেষের একটা আউটবাস্ট। কিন্তু এ আর কদিন। ওকে যারা সবচেয়ে ভাল করে চেনে, ওর সেই বাবা মার বিস্ময় নেই, কোনও দুশ্চিন্তাও নেই। অসম জীবনের এত বড় দ্বন্দ্বকে আশীষ হজম করবে কেমন করে। তেমন সাহস ওর নেই। দেখো, ও একটা ছোট্ট মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এল বলে। বলেই তাপসীর আবার হাসি। বলে, তাই বলছি, ও বিয়ে করল বলে। তুই না ছাড়লে তোর সঙ্গেই হত।

সুমিতা বলে, আমি কাউকেই ছাড়িনি তাপসী। এইটাই বোধ হয় আমার জীবন, যাদের কাছে আমি যাব, তারাই শুধু আমাকে দূরে সরিয়ে দেবে।

তাপসী তবুও হাসে। হাসিটা যখন সবচেয়ে বেশি অবারিত হয়ে ওঠে, তখন ওর চোখ দিয়ে জল পড়ে।

যে তাপসীকে আগে কত কী মনে হত, ভয় করত, সেই তাপসীকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চায় সুমিতা। ওর কান্না পায়।

সবাই ওকে বলে ককেট। আরও কত কী! ওকে নিয়ে ওর স্বামীর বন্ধুরা, আশপাশের আর সমাজের যুবকেরা একটু নোংরা কথা বলে আনন্দ পায়। আড়ালে ওকে মন্দ বলে সবাই। কাছে এলে ওর শ্যামলী রূপের বলিষ্ঠ শরীরের প্রতিটি তরঙ্গে সবাই দুলতে থাকে। ওর কাজল চোখে, রং-ঠোঁটে স্থির বিদ্যুৎশিখা, চোখ রাখা যায় না।

শুধু ওর স্বামী কিছু বলে না। তাপসী বলে সুমিতাকে, তোর দুঃখের অনেক মানে আছে ভাই রুমনি। আমার কাছে খুবই বড় মানে। আমার তো কোনও দুঃখ নেই।

–কেন?

–আমি হলুম সাজানো বারান্দায় টবে দাঁড়ানো পাতাবাহারের গাছ। আমার দুঃখ কী। তবু হাসে তাপসী। আর ধুয়ে যায় চোখের কাজল।

সুমিতা ওর মুখখানি তুলে ধরে বলে, তুই হাসিস কেন বল তো?

 সুমিতার কানে কানে বলে তাপসী, বদমাইশি করব বলে।

তারপরে আর সত্যি হাসতে পারে না। অনেকক্ষণ পর বলে, কিন্তু রুমনি, তোকে দেখে আমার যত ভয়, তত বিস্ময়। কেমন করে তুই রাজেনকে পেলি।

সুমিতা তখন রুদ্ধ কান্নায় ভেঙে পড়ে, ওরে না, না, মিথ্যে। ওকে পাওয়া যায় না।

.

পাওয়া যায় না, তবু যায় সুমিতা। যাওয়া আসা শেষ হয় না।

আর দিন যায়। সুমিতা যায় ওর জীবনের উজানে।

 রাজেনের নেতৃত্ব মুখ থুবড়ে পড়ে মাটিতে। ধর্মঘট অসফল শুধু নয়, ওকে সারা দিনরাত্রি ঘিরে থাকত কলকারখানায় যারা ওর আশা ভরসা, সেই সব মজুরদের কাজ গেছে। পুলিশের জুলুম চলছে অনেকের উপর দিয়ে। ধর্মঘট মেনে নেয়নি কেউই। হাওড়ার সমস্ত অঞ্চলে প্রতিক্রিয়া হয়েছে ভয়ংকর।

আজ ওরই উপর সবাই খড়্গহস্ত। মারমুখী হয়ে দাঁড়িয়েছে সবাই ওরই মুখোমুখি।

সুধাময়ী চলে গেছেন বৃন্দাবনে। যাওয়ার আগে বলে গেছেন সুমিতাকে, ওর ওপর আমার কোনও মায়াদয়া নেই। লোকে আমাকে মন্দ বলবে? বলবে, এ তোমার কেমন মায়ের প্রাণ? বলুক, আমি এমনি মা। আমারও প্রাণ পণ, যাকে আমার প্রাণ সায় দেয়নি, তার সঙ্গে আমার আপস নেই। ও আমাকে বুজরুক বলুক, ধর্মের গোঁড়ামি বলুক, ওর নীতিবাদ নিয়ে থাকুক ও। এক বার লোকগুলোর বাড়ি গিয়ে আমি দেখে এসেছি তাদের অবস্থা। দেখতে গিয়ে কেবলি মনে হয়েছে, কেন আমি ওর মা হয়েছিলুম। ওর দিকবিদিক জ্ঞান নেই। মানুষের সঙ্গে ওর ব্যবহার যে পুলিশের চেয়েও খারাপ। জীবনের জন্যে লড়াই করবে বলে, তারা কি রাজেনের চাকর? ও কে? ওর কথাই কি সব? বাকি মানুষগুলো কেউ নয়। শুধু যে এতখানি করেছে, সে শুধু তাদের ভালবাসা, বিশ্বাস রাজেনদাদা তাদের ভগবান। ছি ছি ছি…।

সুমিতা যেতে দিতে চায়নি সুধাময়ীকে। কিন্তু আটকাতে পারেনি। তবে এটুকুনি শুনেছে, বৃন্দাবন যাওয়ার নাম করে হাওড়াতেই নাকি কোন আত্মীয়ের বাড়ি লুকিয়ে রয়েছেন।

সুমিতা যেন আঁচল উড়িয়ে যায়। হেঁকে নিয়ে আসবে রাজেনকে। কিন্তু রাজেন, তার সে সব খেয়াল নেই। যত স্বাস্থ্য ভেঙেছে, শ্রীহীন হয়েছে, চোখের কোল বসছে, ততই ওর চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ খরো হয়ে উঠেছে। শাপদ-তীক্ষ্ণ সেই চোখে কীসের জ্বালা। ওর এখনও আশা মরেনি। উলটে, সুমিতাকেই যেন কঠিন গলায় যুক্তি দিতে চায়। বলে, মনে হয়, আমারই সাহসের অভাব সুমিতা। আমার ওপর যত ভরসা করতে পারবে, ততই সবাই অগ্রসর হবে।

সুমিতা বলে, রাজেনের দুটি হাত ধরে বলে, রাজেন, তুমি সেই রাজেন। তুমি কেন এত অধৈর্য, কেন মরণের আর মারবার তপস্যায় ডুবে গেলে তুমি।

শুনবে না, শুনবে না তো রাজেন। প্রেম ভালবাসা, সংগ্রাম শিক্ষা, সব যে ওর এক চাওয়ার নেশায়, স্বপ্নের নেশায় মাতাল করে দিয়েছে।

তারপর এক দিন কারা ওকে অন্ধকারে প্রহার করে ফেলে রেখে গেল। মাথা ফাটিয়ে, হাত ভেঙে একটা ভয়ংকর আক্রোশের হিংস্র দাগ রেখে গেল সর্বাঙ্গে।

.

৩৭.

এমনি একটা ভয়ংকর কিছু ঘটবে, এই আশঙ্কাই করছিল সুমিতা। কিন্তু সে আশঙ্কা যে সত্যে পরিণত হবে, তা ওর অন্তর মানতে চায়নি। মানতে না চাইলে কী হবে। সুমিতা তো রাজেনদের মতো ভিতরে বসে সবকিছু দেখেনি। বাইরে থেকে দেখেছে। কিন্তু বাইরের মানুষের মন নিয়ে দেখেনি। জীবন-মন-প্রাণ সবই পড়ে ছিল ওখানে। তাই মিথ্যে আশঙ্কা করেনি সুমিতা।

সুমিতা যখন এল, সেই ভাঙা পুরনো বাড়িটার চেহারাও যেন বদলে গেছে। শরৎ গিয়ে আবির্ভাব হয়েছে হেমন্তের। উঠোনের আগাছাগুলি এর মধ্যেই হয়েছে কাঠিসার। বড় বড় গাছের পাতা ঝরতে আরম্ভ করেছে এর মধ্যেই। বাড়িটাকেও যেন দেখাচ্ছে আরও পুরনো।

রাজেন শুয়ে ছিল তার ঘরের সেই তক্তপোশে। আরও দুজন ছিল সেই ঘরে। তার মধ্যে একজন অবাঙালি। শ্রমিক নয়, এ অঞ্চলের দুজন সহকর্মী রাজেনের।

দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই সুমিতার বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। চেনা যায় না রাজেনকে। নিঃশব্দ, অনড় বন্ধ চোখ করুণ রাজেন। সহসা মনে হয়, যেন প্রাণ নেই মানুষটির। মাথায় আর হাতে ব্যান্ডেজ। বোম খোলা পাঞ্জাবিটার ফাঁকে তার প্রশস্ত বুকে হাড় দেখা দিয়েছে, উঁকি দিয়েছে কণ্ঠা।

একটা অব্যক্ত বেদনা টনটন করে উঠল সুমিতার বুকের মধ্যে। ওর সমস্ত অন্তর আকুলিবিকুলি করে উঠল রাজেনের গায়ে একটু হাত দেবার জন্যে। ওই খোলা বুকে, ক্লান্ত মুখে, আহত স্থানে। কিন্তু মনের সব সংকোচ কাটিয়ে অতটা পারল না সুমিতা! রাজেনের বন্ধুদের দিকে ফিরে কথা জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে কথা ফুটল না ওর গলায়। বুকের সমুদ্র মন্থন করে এল চোরাবান দুই চোখের তটে তটে।

রাজেনের বন্ধুদের চোখেও আগুন। ওদের চোখে মুখে শীর্ণতা, বেশে পোশাকে দীনতা। কিন্তু কী আগুন জ্বলছে ওদের অন্তরে। বহিরঙ্গে শুধু তাই ধকধকানি।

একজন বলল, আসুন।

সুমিতা নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, কেমন আছে?

ভাল, হাতের চোটটা একটু বেশি।

 রাজেন তাকাল চোখ মেলে। প্রথমেই চোখখাচোখি হল সুমিতার সঙ্গে। যে মুহূর্তে দুজনের চোখে চোখ পড়ল, সেই মুহূর্তে আর বাধা মানল না সুমিতার চোখের জল।

রাজেন আবার চোখ বুজল। কিন্তু মুখে একটুও বিকৃতি দেখা গেল না। সে ডেকে বলল, বিশু, এখনও যাওনি?

বিশু বলল, তোমাকে ফেলে যেতে পারিনি রাজেনদা।

রাজেনের মুখ শক্ত হয়ে উঠল। বলল, তোমার কাজের চেয়ে কি আমি বড় হয়ে উঠেছি। এই দুঃসময়ে তুমি মাঠে নেই, সভা হবে কেমন করে?

বিশু সংকুচিত হয়ে তাকাল তার সঙ্গীর দিকে। বলল, এইবার চলে যাচ্ছি। তোমার মাথার কাছেই ওষুধ রেখেছি, খেও। রাত্রি আটটার সময় এসে ডাক্তার আবার ইনজেকশন দিয়ে যাবে।

রাজেন আবার বলল, রামদেও কেন যায়নি? ভয় পেয়েছে ও, না?

লজ্জায় ও অপমানে রামদেওয়ের মুখখানি কালো হয়ে উঠল, বলল, নহিনহি রাজিনদাদা, ডরাবে কেন? আপনার তখলিফ–

রুগণ আহত সত্ত্বেও রাজেন যেন গর্জে উঠল চাপা গলায়, মিছে কথা বলো না রামদেও। ভয় পেয়েছ তুমি, আমার তখলিফের বাহানা করে পড়ে আছ এখানে।

রামদেওয়ের চোখে রক্ত ছুটে এল। তার সারা চোখমুখ যেন জ্বলে উঠল দপদপ করে। মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল সে বিশুর সঙ্গে।

শুনতে পারে না এ সব সুমিতা, দেখতে পারে না, ওর সারা অন্তর, সর্বাঙ্গ যেন কাঁটা দিয়ে ওঠে। বন্ধুদের সঙ্গে এই কি রাজেনের ব্যবহার। সবাইকে সে শাসন করতে, হুকুম দিতে উদ্যত। সমস্ত কিছুর মধ্যে একটা ভয়ংকর বুরোক্রাট যেন শাসিয়ে উঠছে। দেখে যেন সুমিতারও ভয় করে রাজেনের সঙ্গে কথা বলতে।

কিন্তু রাজেনের মুখের দিকে, শরীরের দিকে তাকিয়ে প্রাণ মানে না ওর। দু হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল রাজেনকে। রাজেনের বুকে মুখে হাত বুলিয়ে চাপা ভাঙা গলায় বলল, আমাকে কি কিছু বলবে না, কিছুটি নয়?

রাজেন সুমিতার একটি হাতের উপর হাত রেখে বলল, কী বলব সুমিতা?

রুদ্ধ গলায় বলল সুমিতা, এ কী করেছ তুমি, কত সর্বনাশ করতে চাও।

 রাজেন বলল, আমাকে আঘাত করেছে বলেই এটা সর্বনাশ নয়, নতুনও নয় সুমিতা। এইভাবে ওরা অনেককে খুন করেছে, আরও করবে।

কেঁপে উঠল সুমিতার বুকের মধ্যে। বলল, জানি জানি রাজেন। আজ মায়ের কথাই মনে পড়ছে আমার বারবার। ধরে রাখা যাবে না তোমাদের কাউকেই। এইটাই তোমাদের জীবন। কিন্তু রাজেন, জীবন কি এতই ছোট? সত্য মিথ্যে যাচাই করবে না?

সুমিতার হাতধরা মুষ্টি শিথিল হল রাজেনের। অমনি ভয়ে ও বেদনায় গুরগুর করে উঠল সুমিতার বুক। এমনি করেই আজ শিথিল করে নিতে চায় রাজেন নিজেকে। এমনি করেই সরে যেতে চায় দূরে। সুমিতা নিজে শক্ত করে ধরে রাখল রাজেনের হাত।

রাজেন বলল, সুমিতা, তোমার শুধুই সংশয়। এত সংশয় আমার ভাল লাগে না।

এর পরে কী বলবে রাজেন। চলে যেতে বলবে সুমিতাকে। থাক থাক আর কিছু বলবে না সুমিতা। কিন্তু নিজের কণ্ঠকে বারবার চাপতে গিয়েও না বলে পারল না, সংশয় নয়, এ যেন আমার বিশ্বাস রাজেন।

রাজেন বলল, কী তোমার বিশ্বাস?

সুমিতার প্রাণে ভয়, তবু অন্তর থেকে কে যেন আপনি কথা বলে গেল। বলল, রাজেন, তোমার এ অবস্থা দেখে আমি আর স্থির থাকতে পারছিনে। তোমার প্রাণের মূল্যের কথা আমি বললে, তুমি উড়িয়ে দেবে জানি। যতই উড়িয়ে দাও,–ই ভাব আমাকে, আমি নিশ্চিন্ত হতে পারব না কিছুতেই। তাই আমার বিশ্বাসের কথা আমি বারেবারে না বলে পারিনে।

রাজেন যেন মন-প্রাণ-দেহ, সব শক্ত করে রেখেছে। বলল, নানাভাবে সে কথা তুমি অনেক বার বলেছে।

বলেছি, অনেক বার বলেছি। আজকে আবার নতুনভাবে বলতে চাই।

সুমিতার সুদীর্ঘ রুক্ষ্ম বেণী পড়েছে লুটিয়ে রাজেনের গায়ে। ওর সর্বাঙ্গ ভয়ে ও স্নেহে স্পর্শ করেছে রাজেনের কূলে কূলে। বলল, আমি রাজনীতি হয়তো বুঝিনে, কিন্তু চারদিকের অবস্থাটা কি একটুও বুঝিনে? আমি তো বিলেত থেকে আসিনি, এ দেশের মানুষের একটুখানি তো বুঝি। তোমার কাছে এলেই আমি মজুরদের দিকে তাকিয়ে দেখেছি। সেখানে তারা আজ তোমাকে চায় না। তোমার নীতি, তোমার কাজ, তুমি, সবকিছুকে আজ তারা এড়িয়ে চলতে চায়। আমি দেখছি, তুমিই শুধু তোমার দল নিয়ে ছুটে চলেছ একদিকে, তারা রয়েছে আর একদিকে। কেন এমন হবে? কেন? তুমি যদি সত্য তবে তারা নেই কেন তোমার কাছে?

–সে কথা তো তোমাকে বলেছি সুমিতা। তারা যখন দেখবে, আমাদের উপর নির্ভর করা যায় তখুনি তারা আসবে।

–তোমরা ভরসা দেবে, তবে তারা আসবে? কেন? তাদের নিজেদের কি কোনও ভরসা নেই।

আপাত অবস্থায় এইটাই তো দেখছি সত্য।

 –সে তো তুমি দেখছ, তোমরা কয়েক জন দেখছ। কিন্তু সেটা তো সত্য নয়।

তবে কি তুমি যেটা দেখছ, সেটাই সত্য?

রুক্ষ হয়ে উঠছে রাজেনের গলা। সুমিতার বুকের মধ্যে তীক্ষ্ণ তিরের মতো বিধছে রাজেনের উষ্ণতা। বিদ্যুতের মতো চিকচিক করে উঠছে আশীষের মূর্তি। সেই অসহিষ্ণু, মর্মান্তিক বিদ্রূপভরা মুখ। আকাশ-পাতাল তফাত দুজনে। বিশ্বাসে, ব্যবহারে, জীবনধারণে, ধ্যান-আদর্শদর্শন, সবকিছুতে। তবু আশীষের মুখ মনে পড়ে সুমিতার। কিন্তু সেখানে সুমিতা নীরব থাকতে পেরেছিল। প্রাণ যদিও ওর উঠছে ছটফট করে, তাকে রাখতে পেরেছে চাপা দিয়ে। এখানে তা পারবে না। বলল, সত্য কি না জানিনে, আমি ঘটনার কথা বলছি। যা আমি দেখতে পাই আমার দু চোখ ভরে।

সুমিতা, তুমি যেখান থেকে এসেছ, সেখান থেকে শুধু কিছু ঘটনাই দেখা যায়। কিন্তু সত্যকে উপলব্ধি করা যায় না।

চকিত স্তব্ধ সুমিতা পাংশু হয়ে উঠল। এইবার রাজেন ওকে চরম আঘাত করতে উদ্যত হয়েছে। সুমিতাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছে, সমাজের কোন স্তর থেকে এসেছে ও। অধিকারকে সীমাবদ্ধ করে দিতে চাইছে। অসহ্য যন্ত্রণায় ওর কণ্ঠরোধ হল। চুপি চুপি বলল, এ কথা এক দিন তুমি বলবে, আমি জানতুম। এ কথার জবাব দেবার আমার সময় আসেনি। সত্যি, আমাদের ওই সমাজটার ঘরে বাইরে অনেক মিথ্যেয় ভরা। কিন্তু, তুমি তো রাজেন, তুমি তো সেই রাজেন। তোমাকে না বলে আমি পারব না, তুমি যে জ্বলছ, সেটা আমার মিথ্যে আগুন বলে মনে হচ্ছে। তোমার কথা দিয়েই তোমাকে বলছি, দেহ ও মনে শুধু তুমি সংগ্রাম করলেই হবে না। তুমি কে?

রাজেন মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। শুনতে চায় না যেন আর।

সুমিতা তবু বলল, কিন্তু তুমি যাতে বিশ্বাস করেছ, তাতে প্রাণ দিতে পেছ পা নও, জানি। আমার ভয়, তোমাদের নীতিতে, এ দেশের নিচু তলার মানুষের নীতি এসে একত্র হয়নি আজও। বড় ভয় রাজেন, আজকে তোমার সংশয় বোধ হয় আমার চেয়ে বেশি। তাই নিজের বন্ধুদের কটু কথা বলতে তোমার আটকায় না, তাদের সততা, সাহসকে সন্দেহ করতে বাধে না। এ যে ব্যর্থতা, ব্যর্থতা।

রাজেন বলল, এত বড় কথাটা এমন সহজ আবেগে বোলো না সুমিতা।

সুমিতা উঠে পড়েছিল রাজেনের তক্তপোশ ছেড়ে। বলল, প্রাণের এ কোন আবেগ, তা জানিনে। আমি দেখতে পাচ্ছি, তোমরা শুধু রক্তপাত করবে। করো। কিন্তু সে বৃথা যাবে, একেবারেই বৃথা। শুধু যাদের বুক খালি হবে তাদের ভরবার আর কিছুই থাকবে না।

চলে যাবে বলে পা বাড়িয়েছিল সুমিতা। কিন্তু দাঁড়াল দরজার কাছে। সন্ধ্যা ঘনায়মান। অন্ধকার নামবে এখুনি। হেমন্তের সন্ধ্যাকাশ যেন অশেষ মূকবেদনায় ভরা। আশ্চর্য! মনে হয়, বাসায়-ফেরা পাখিরা বুঝি গান করে এ সময়ে, ডাকে কিচিরমিচির। সুমিতা দেখল, জীর্ণ বাগানের গাছে গাছে অনেক পাখি। কিন্তু সবাই নীরব। সারা আকাশব্যাপী কী এক সন্ত্রাস যেন দেখছে দু চোখ মেলে। আসন্ন অন্ধকারের ত্রাসে বোবা হয়ে গেছে পাখিগুলি। জীবজগতের এইটিই বিচিত্র। বাতি জ্বালতে শেখেনি ওরা। এবার অন্ধ হয়ে যাবে।

সুমিতা এগিয়ে এসে জ্বেলে দিল টেবিল ল্যাম্প। ওর জুই ছড়ানো নীল ছিটের জামার রং আরও গাঢ় হয়ে উঠল। ছোট একটি কুমকুমের টিপ দিয়েছিল কপালে। হেমন্তের ধুলো লেগে সে টিপ যেন বাসি রক্তবিন্দুর মতো দেখাচ্ছে। এখানে আসবার আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রায় নিজেরই অজ্ঞাতসারে কেন যেন টিপ দিয়েছিল কপালে। বাতি জ্বালাল সুমিতা। কিন্তু আসন্ন-অন্ধকার বিষাদ-মৌন পাখির মতো ওর দু চোখে ব্যথিত ত্রাস।

রাজেনের দিকে তাকাল সুমিতা। চুপ করে পড়ে আছে রাজেন। কিছু বলবে না আর সুমিতাকে, কিছু বলবে না। কিন্তু ওই আহত মূর্তি, বন্ধুদের প্রতি রূঢ় সন্দেহান্বিত, দুর্জয় রাগে নিরন্তর ফোঁসা মানুষটিকে বড় অসহায় বোধ হল ওর। ইচ্ছে হয়, যা খুশি তাই করুক রাজেন। দুর্বিনীত শিশুকে কোলে করে রাখার মতো রাজেনের কাছে বসে থাকবে সুমিতা। কিন্তু সে সুমিতার ইচ্ছে। রাজেন তো তা দেবে না। সত্যি, কী পাষাণ সুধাময়ী। উপযুক্ত মা আর ছেলে।

রাজেনের কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে নিচু গলায় বলল সুমিতা, রাজেন, আমি চলে যাচ্ছি।

রাজেন তাকাল। এক বিচিত্র বাসনায় হঠাৎ সুমিতার বুকের রক্তধারা তোলপাড় করে উঠল। এমন আর কোনওদিন হয়নি। জীবনকে যখন ব্যর্থ মনে হচ্ছে, তিক্ত মনে হচ্ছে, সেই মুহূর্তে এ কী বিচিত্র বাসনার উল্লাস রক্তের কোষে কোষে। চোখের জলের মাঝে এমন করে আর কোনওদিন সুমিতার নারী-প্রবৃত্তি তো ব্যাকুল হয়ে ওঠেনি। কেন, কেন এমন হয়। আশ্চর্য! সন্ধিক্ষণের সমস্ত জিজ্ঞাসা, বিস্ময় আজও পুঞ্জীভূত হয়ে রইল ওর অন্তরে। ঠোঁট দুটি কেঁপে উঠল থরথর করে। যেন সেই কম্পন থামাবার জন্যেই রাজেনের হাত টেনে নিয়ে মুখে চাপল সুমিতা। রাজেনের আইডিন-গন্ধ কপালে স্পর্শ করল ঠোঁট।

রাজেন বলল, সুমিতা, রাগ করে যেয়ো না। আমার এই নীতি যদি বিচ্যুতির পথ হয়, আন্দোলনের পথে যদি আমি সন্ত্রাসের রাস্তা নিয়ে থাকি, তবে যে পথ দিয়ে চলেছি, তারই ভয়ংকর পথে আমাকে ফিরে আসতে হবে। আজ আমি নিজেকে যেখানে সঁপেছি, তার শেষ না দেখে আর আমার ফেরার উপায় নেই।

সুমিতা চাপা গলায় বলল, যাক যাক রাজেন, বোলো না আর ও কথা। জানি, আমি জানি, তোমার ফিরে আসা তোমার হাতে। শুধু একটু সাবধানে চলাফেরা করো।

ছায়ার মতো যেন ভেসে গেল সুমিতা। পোড়ো বাগানে মিলিয়ে গেল ওর ছায়া।

.

তারপর শুধু পড়া। পড়া আর পড়া। কিন্তু নিশ্চিন্তে অনার্স দেবে, এমন ভাগ্য করেনি সুমিতা। নিজেকে ও অনেকখানি নিরাসক্ত করতে চেয়েছে, রাজেনের দিক থেকে। বাইরে হয়তো পেরেছে, পারেনি ভিতরে।

একই ভাব সকলের। মহীতোষও সেরকম ভাবই দেখান। নিরাসক্ত নির্লিপ্ত, যেন কোন এক অজানালোকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন সংসার থেকে। চাকরির ব্যাপারেও অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন। কোনওদিন যান, যান না কোনওদিন।

জিজ্ঞেস করলে বলেন, ও চাকরির মেয়াদ তো আর বেশিদিন নেই। আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, নতুন ছেলেরা নামছে নির্বাচনে, মিউনিসিপ্যালিটিকে তারা আর সুপারসিডেড করে রাখতে দেবে না। আমাদের মতো বাইরের অ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের স্থানীয় লোকেরা দেখে বড় হীন চোখে। ও সব আর পারিনে। আর কী-ই বা দরকার।

যেন, এত দিন অনেক দরকার ছিল। তাই তাঁর সময় ছিল না। এখন সকালে বিকালে বাইরে যান। ফেরেন নিজের ইচ্ছে মতো। তাপসীর বাবার কাছেও যান না। বরং যেন বিরক্তিই বোধ করেন।

শুধু সুমিতার সঙ্গে যখন চোখাচোখি হয়, তখন কী একটি প্রশ্ন উঁকি দেয় তাঁর চোখে। হাতের ছড়িটা মাটিতে ঠুকে ঠুকে কী যেন ভাবেন। তারপরে বলেন, যেন হঠাৎ মনে পড়েছে, পাশ করবে তো?

সুমিতা বলে, দেখি।

 মহীতোষ একটা সুদীর্ঘ হুঁ দেন। গানের ইচ্ছেটা যায়নি। প্রায়ই গুনগুন করেন। যেন কতই নিমগ্ন আছেন আপন মনে। বিলাসকে বলেন, তুই তো আচ্ছা শয়তান। দেশে গিয়ে মাকে দেখে আসিসনে কেন? অকৃতজ্ঞ কোথাকার।

বিলাস কর্তার সোহাগ কেড়ে বলে, সময় পাইনে যে হুজুর, নইলে মায়ের কাছে যেতে কার না প্রাণ চায়।

ইস! কী রাজকার্য করতে হয় যে যাসনে?

–এই যে, বাড়ির কাজ?

–ছুটি নিতে পারিসনে?

–তবে রাঁধবে কে?

 মহীতোষ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকেন। তারপরে বলেন, ও।

–হ্যাঁ, মায়ের জন্যে প্রাণটা বড় কাঁদে বড়সাহেব।

যেন কী এক অভাবিত কথা শুনে বিস্মিত হন মহীতোষ।

.

হেমন্তের পরে শীত, তারপরে বসন্ত। পরীক্ষা হয়ে গেল সুমিতার। পরীক্ষার পরে যেদিন রাজেনের কাছে গেল, সেদিন সুমিতার শেষ যাওয়া। বৈশাখের প্রচণ্ড তাপে সুমিতা দেখল, রাজেন অপরিচিত হয়ে গেছে যেন! আজ আর ওর কেউ নেই। ওর কর্মীবন্ধুরা। জুটেছে কয়েকজন অল্পবয়সি ছাত্র। কিন্তু তাদের কোনও ক্ষমতা নেই। সহকর্মীরা অনেকেই জেলে। পরপর অসফল আন্দোলনে, অনেকেই বেকার হয়ে, কাজের ধান্দায় চলে গেছে নানান জায়গায়। কিন্তু রাজেন দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গাতেই। ঠিক যেন বৈশাখের রুদ্র দাপটে দগ্ধ শ্রীহীন গাছটা। কালো মূর্তি, ছেঁড়া জামাকাপড়। শীর্ণ শরীর, কোটরাগত চোখ। শুধু মাথায় রুক্ষ পিঙ্গল চুল যেন দাউ দাউ করে জ্বলে আগুনের মতো। নিজেদের রাজনৈতিক নীতি ও কৌশলের প্রতি কী ভয়াবহ নির্মম সততা আর আনুগত্য। যাদের তা নেই, তারা বহিস্কৃত, পরিত্যক্ত।

আত্মনাশের এমন ভয়ংকর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার দিন ফুরিয়েছে। শুধু বাড়িটার ভিতর দিকে তাকিয়ে সুধাময়ীর জন্য, সুধাময়ীর বুকে একটু আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রাণটা হাহাকার করে উঠল সুমিতার। আর ভাবল, ছেলের অদর্শনে যিনি গান করেন আপন মনে, তিনি কীভাবে দিন কাটাচ্ছেন। সুমিতা যেন পরিষ্কার দেখতে পেল, এই সর্বচরাচরের অন্তরালে, উঁকি দিয়ে আছেন সুধাময়ী। তাঁরও শীর্ণ শরীর, কোটরাগত চোখ, আলুলায়িত চুল। যেন বলছেন ধ্যানস্থ হয়ে, হে মহাপ্রাণ, হে মহাজীবন, তোমার পায়ে সঁপে দেওয়া ছেলেকে তুমি অন্ধ নীতি থেকে মুক্তি দাও, ওকে বৃহৎ সংসারের দিক ফিরাও।

রাজেন ডাকল সুমিতাকে, বলল, পরীক্ষা কেমন দিলে?

সুমিতা হেসে বলল, আমি যেমন দিই। আমার জীবনে তো শুধু ফেল।

রাজেন চুপ করে রইল। ফিরে এল সুমিতা।

.

সুগতার ডাইভোর্স হয়ে গেছে। সে এখন উত্তর চব্বিশ পরগনাতেই বাসা নিয়েছে। কিন্তু সেখানে যে থাকতে পারবে না সুগতা, সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। ওর আশা ছিল প্রচুর, শ্রমিক আন্দোলন করবে। কিন্তু সে সব যেন নিভে যাচ্ছে। জীবনের ও মনের কোথাও আজ আর কোনও মিল খুঁজে পায় না শহরতলির কারখানা অঞ্চলে। শ্রমিক মেয়েদের নিয়ে স্কুল চালায়, সঙ্গে থাকে শিশুরা। কিন্তু পড়া হয় না। সেরকম অর্থ নেই বিদ্যালয় চালাবার মত। সুগতার সামনেই সবাই ফস ফস করে বিড়ি ধরায়, সুযোগ পেলে শিশুরাও যোগ দেয়। কারখানার বিষয় আলোচনা হয় মাঝে মাঝে। সুগতা কিছু বললে, তাকিয়ে থাকে বড় বড় চোখে। তারপর জিজ্ঞেস করে সুমিতাকে, তার মরদ আছে কি না।

সুগতার মনে পড়ে, বিভূতিকে এরা সবসময়েই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দেখে। বলে, আছে।

 মেয়েরা বলে, তবে ওই জাদুটাই শিখিয়ে দিক সুগতা তাদের। মরদ থাকবে, তবু বাচ্চা হবে না।

বলে খিলখিল করে সবাই হাসে। সুগতা লাল হয়ে ওঠে লজ্জায়। বোঝে না, এই মানুষগুলি কখন দপ করে জ্বলে ওঠে, নেভে কখন। মন বলে, হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে। কিন্তু কোথায় যাবে। সামনে তাকিয়ে দেখে বিভূতিকে। নিরলস শিল্পী। গোটা উত্তর চব্বিশ পরগনাটাই যেন তার ক্যানভাসে আলাদা আলাদা হয়ে ফুটে উঠছে। আর তার সুদূরপ্রদীপ্ত চোখে আঁকা সুগ।

সুমিতা চিঠি লিখল—

রাজেন,

জীবন নিয়ে তোমাকে নাটকের কথা লিখেছি ইতিপূর্বে। নাটকটা ওপরের বিষয়। প্রতিমুহূর্তে মানুষের জীবনের গভীরে যা ঘটে চলেছে, তা হঠাৎ বাইরে রূপ ধরলেই নাটকীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু মানুষ কোনও দিন তার ভিতরটাকে খুলে দেখাতে পারেনি, এমনকী পুরোপুরি প্রকাশ করতেও পারেনি, তাই নাটকটা আঙ্গিকমাত্র। সেখানে মহানাটক, যেখানে কোনও সাজসজ্জা-রং কিছুই নেই।

তোমার কাছে আমি কেন গিয়েছি বারবার? অনেকে ভাববে হয়তো, দিদিদের দেখে, আমি সাহস করে তোমার কাছে গিয়েছি। সে কথা সত্যি নয়। আমার ভালবাসা আমাকে সাহস দিয়েছে।

তোমার কাছে যাওয়ার সাহস কীসের? তুমি গরিবের রাজনীতি কর বলেই? না, শুধু তাই নয়। তোমার জীবন যে মহাসমুদ্রে ধাবিত, আমি সেইখানে যেতে চেয়েছি তোমার সঙ্গে। রবিদার ভাষায়, তুমি সেই সাহসী নাবিক, আমাদের সমাজের ছোটখাটো সুখের দিকে যে ফিরে তাকায় না, যে জানতেও পারল না সমাজের একটা শ্ৰেণী, যার কিছু সীমিত শিক্ষা, অভিমান অহংকার, একটু কায়দাদুরস্ত জীবন, কিছু সম্মান, আরাম-আয়েশ-আনন্দ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কী নিদারুণ লালায়িত। সেদিকে তুমি ফিরেও তাকাওনি। সমাজের অধিকাংশের সঙ্গে সুখ ও দুঃখকে ভাগ করে নেওয়ার সংকল্প ও ব্রত নিয়েছ তুমি। আমি যে আমার দেহমন-প্রাণ, সব নিয়ে গিয়েছি তোমার কাছে, আসলে তোমার সেই জীবনবোধকেই আমি সঁপে দিয়েছি আমাকে। হয়তো দিদিদের জীবন অদৃশ্যে কিছু কাজ করেছে। কিন্তু তোমার কাছে যাওয়া তোমাকে পাওয়া, সে যে আমার কত বড় অহংকার। বড় অহংকার, তাই বোধ হয় বড় অভিমান আমার। তাই বলছি, তোমার সেই জীবনবোধেই যদি আমি আস্থা না পাই, তাতেই যদি ফাঁক থাকে, তবে কোন রাজেনের কাছে গিয়ে আমি তোমাকে কলুষিত করব। করব না তা, যাব না আমি আর তোমার কাছে। তোমার ভিতর দিয়ে, জীবনের যে মহাব্যাপ্তিকে আমি দেখেছিলুম, তা যদি না রইল, তবে আর আমাদের কী রইল। সেই বৃহৎ সুদূরব্যাপ্ত জীবন আজ নীতি কৌশলের কারায় বন্দি করেছ তোমরা। আমার মনে হয়েছে, জীবনবাদ থেকে অন্ধ যান্ত্রিক নিয়তির পথ ধরেছ। এই অংশের ভাগিদার আমি হতে পারলুম না, তাই বোধ হয় এ জীবনে তোমাকে আমার পাওয়া হল না। এই আমার প্রেমের ভাগ্য। তোমার রাজনীতির সঙ্গে আমার ততক্ষণ সম্পর্ক, যতক্ষণ পর্যন্ত তা জীবনের অনর্গল মুক্ত প্রবাহে চলমান। সেইজন্যে প্রত্যহের রাজনীতির মধ্যেও আমার বড় গ্লানির আশঙ্কা।

আমি জানি, তুমি রুষ্ট হচ্ছ, হয়তো এই অর্বাচীন মেয়েটাকে পলাতকা ভেবে হাসছ রাগে ও বিদ্রুপে। সে দিন আমাদের সমাজেরকথা বলেছিলে, এই অবিশ্বস্ত উচ্চ মধ্যবিত্ত ঠুনকো প্রাণীদের কথা। ঠিকই, কিন্তু আমি আমার নিজেকে খাটো মনে করতে পারলুম না। জানি, আমি কিছুই করলুম না, আসলে তুমিই বাঁচলে। বাঁচো। আমি বিবাগিনী হব না। কিন্তু মেয়ে বলেই কিনা জানিনে, জীবনবোধকে পার হয়েও তুমি যেখানটায় খচ খচ করবে, সেখানটাকে নিয়ে যে কী করব!সুমিতা।

চিঠিটা শেষ করে টেবিলের উপর বুক চেপে রাখল সুমিতা। সেখানে একটা ভয়ংকর বিস্ফোরণের জন্য কী এক প্রচণ্ড দাহ্য পদার্থ ফুলছে ফানুসের মতো।

এমন সময়, মাথায় হাতের স্পর্শ পেতেই চমকে ফিরে তাকাল সুমিতা। মহীতোষকে দেখেই চোখে জল এল।

মহীতোষ যেন এখনও নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত। অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে রইলেন। তারপর সুরহীন গলায় বললেন, আমার সামনে এরকম করে কেঁদো না রুমনো।

সুমিতা ভেজা গলায় বলল, কাঁদিনি বাবা।

 কী আশ্চর্য কথা। মানুষ এমন কথাই বলে এক একসময়।

মহীতোষ আবার বললেন, রুমনো, তোমার শরীরটা যে একেবারে গেল।

সত্যি, তাই। সুমিতার শরীরেও শীর্ণতা দেখা দিয়েছে। এবাড়ির ছোট মেয়ে রুমনি ও, ওর দিগন্ত জুড়েও নেমেছে অন্ধকার। ৪৪২

সুমিতা বলল, কিছু নয় বাবা, দুদিন গেলেই সেরে যাবে। মহীতোষ বললেন, না, রুমনো, আমাকে কেন ফাঁকি দাও। তোমাকে দেখলে আমার কষ্ট হয়।

বাবা, তোমার শুধু কষ্ট।

মানুষ যখন অক্ষম হয়, তখন তার কষ্ট কেউ রোধ করতে পারে না। কিন্তু তোমাদের সে কথা বললে হবে না। উমনোটা অনেক দিন একলা রয়েছে, আর পারে না। তোমার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে, তুমি যাও ওর কাছে।

দু চোখে আলো ফুটে উঠল সুমিতার। হ্যাঁ, বড়দি, এবার বড়দির কাছে যেতে হবে। পরমুহূর্তেই চমকে, লজ্জায় ও ব্যথায় বলে উঠল, তা কী করে যাব বাবা। তুমি? তোমাকে কে দেখবে?

মহীতোষ সুমিতাকে কাছে টেনে বললেন, আমার জন্যে তুমি ভেবো না। ঝুমনো কাছেই আছে। তা ছাড়া, রুমনো, আমার জীবনের কাল গেছে। তোমার কাল বয়ে যাবে, আমি তা দেখতে পারিনে। তাতে আমার অচল জীবনেও দুঃখ। রুমনো, যাও, চিঠিটা যার, তাকে পাঠিয়ে দাও। দু-একদিনের মধ্যেই যাবার ব্যবস্থা করো।

-বাবা!

রুমনো, আমি তোমাদের বাবা। তোমাদের জন্য আমাকে বেঁচে থাকতে দাও।

 তারপর জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন, তা ছাড়া আর কী রুমনো। জীবনকে তো এত অচেনা, লুকোনো ছড়ানো মনে হয়নি কখনও। তোমাদের জন্যে ভবিষ্যতে আরও কী অপেক্ষা করছে, জানিনে। রুমনো, তাই অন্ধের মতো জীবনের সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে আছি মা, অবোধ শিশুর মতো মাথা নত করে আছি, নমস্কার করছি। বলছি, আমার সন্তান কটিকে শান্তি দাও!

সুমিতাও অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে যেন সেই জীবনের সন্ধানেই তাকাল জানালার দিকে।

তারপর তিন দিন পরেই সুমিতাকে মহীতোষ নিজে তুলে দিয়ে এলেন বোম্বে মেলে। বললেন, অমন করে যেয়ো না রুমনো, একটু হেসে যাও।

বাপ মেয়ে দুজনের হাসি কান্নার দোলায় দোলায়িত গাড়ি চলে গেল।

.

৩৮.

বাড়ি ফিরে এলেন মহীতোষ। গেটের কাছে এসে, অন্ধকার বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়ালেন থমকে। তারপর আবার পায়ে পায়ে হেঁটে চলে গেলেন অ্যাভিনুর দিকে। কিন্তু গলি রাস্তাটা ঘোট, অ্যাভিটাও ছোট। সারা কলকাতাই ছোট। দিগদিগন্তহীন যে জীবনের থই পাওয়া যায় না, মনে হয়, সে জীবনও বড় ছোট। মহীতোষের মনে হয়, ওঁরা হলেন জীবনরথের চোখে ঠুলি আঁটা অশ্ব। সারথির চাবুক রথ নির্দেশ করছে নিয়ত। তারই চাবুক কষা আবার এনে হাজির করল ওঁকে গেটের কাছেই। সেখানে এসে আবার পা ঘষতে লাগলেন। যেন শুনতে পেলেন, সারথি নয়, গাড়োয়ান শাসাচ্ছে, ওরে বুড়ো ঘোড়া, জীবনভর তোকে আমি চালিয়ে নিয়ে এসেছি। মিছেই তুই বেয়াদপি করছিস আজ। মরণ তোর সামনে, তুই তাকেই স্মরণ কর।

কিন্তু মানুষের মন! যতই বাঁধা পড়ুক জালে, সে তো অনিত্যকালের নয়, নিত্য প্রবহমান। মরণের সামনে দাঁড়িয়েও ফাঁক খোঁজে সে।

তাই গেটের কাছে এসেও পালাতে চান মহীতোষ। কিন্তু উপায় নেই। যারা কাছে থাকলে দুঃখ, তারা দূরে গেলেও ব্যথা লাগে। জীবনের মাঝে এ যে কোন খেলোয়াড়ের কায়দা, কে জানে। জীবন বলে, এ একাকিত্ব সবচেয়ে কষ্টের। কিন্তু মূল্য অনেক। যাকে অচেনা লেগেছে, ভয় লেগেছে, সেই জীবনের সঙ্গে এইবার দেখা করতে হবে।

লোহার দরজা ঠেললেন মহীতোষ। একটি অস্ফুট দীর্ঘ শব্দ হল। এই শব্দটি কত দিন কতরকম ভাবে এ বাড়ির সবাই শুনতে চেয়েছে, শুনেছে। সুজাতার কোর্টে যাওয়ার দিন সুমিতা এই শব্দটি শোনার জন্য কেঁদে মরেছে মনে মনে।

সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে চেনা সুইচটা টিপে দিলেন। আলো জ্বলল। বেল টিপে দিলেন। বিলাস এসে খুলে দিল দরজা। ওর চোখ লাল। বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ঘরে ঢুকে বিলাসকে বললেন, অন্ধকার কেন ঘরগুলো। আলো জ্বেলে দে সব ঘরের। বিলাস আলো জ্বেলে দিল সব ঘরের। মহীতোষ কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলেন বাইরের ঘরে। নিঃশব্দ, ভয়ংকর নিঃশব্দ লাগছে চারদিক। কালকেও হয়তো এমনই ছিল, পরশুও। অনেক দিন, তবু এত ভয়ংকর মনে হয়নি। হাতের ছড়িটা রেখে দিয়ে, অর্গানের সামনে বসে ঢাকা খুললেন। তারপর বাজাতে লাগলেন। বেলো ফাটা হলেও শব্দটা কিছু আস্তে হচ্ছিল না। কিন্তু সন্তুষ্ট হচ্ছিলেন না। মহীতোষ। পা দিয়ে জোরে জোরে চাপ দিতে লাগলেন। সুরটা গলায় এল না। সেটা গুনগুন করতে লাগল মনের মধ্যেই, আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে।

শুধু বিলাস দাঁড়িয়ে রইল পরদাটা ধরে। ওর ঘুম-চোখে রাজ্যের বিস্ময়।

.

বোম্বে শহরের ঠিক কান ঘেঁষা উপকণ্ঠে সুজাতার বাস। সেখানে শুধু ট্রাম লাইনটাই নেই। আর সবই আছে। বেলা প্রায় দুটোর সময় ট্যাকসিটা সমতল থেকে হঠাৎ একটা টিলার ঢালুপথে উঠে দাঁড়াল একটি বাড়ির সামনে। দরজায় লেখা রয়েছে হ্যাপি লজ। বহু বার খামের উপর ওই নামটি লিখতে হয়েছে ওকে। কিন্তু কোনও সাড়া-শব্দ নেই। টেলিগ্রাম করে এসেছে সুমিতা। পায়নি নাকি।

সিল্ক শাড়ি পরা, একটি মারাঠি মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। দুপাশে তার বিনুনি দোলানো। মুখে একটু হাসির আভাস নিয়ে জিজ্ঞেস করল সুমিতাকে, মিস সুমিতা?

–হ্যাঁ। আপনি?

মেয়েটি সংকুচিত হয়ে জানাল, মেমসাহেবের সে নোকরানি। টেলিগ্রামটা এসেছে একটু আগেই, তার আগে মেমসাহেব অফিসে চলে গেছেন। টেলিগ্রাম সে নিজেই পড়ে নিয়েছে এবং অপেক্ষা করছে সুমিতার। সুমিতা আসুক ভিতরে। সে জানে, সুমিতা মেমসাহেবের ছোট বোন। চেহারা দেখেও বুঝতে পেরেছে সে। ড্রাইভারের সাহায্যে মালপত্র তুলল সে ঘরে। নিজেই জানাল সে, নাম তার চম্পা, চম্পা জ্যাকসন। ধর্মে সে খ্রিস্টান।

হ্যাপি লজ দেখে মনটা খুশি হলেও কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে রইল সুমিতা। ভেবেছিল, স্টেশনেই পাবে বড়দিকে। বাড়ি এসেও পাওয়া গেল না। কিন্তু কোনওকিছু ভাববার আগে চান করবার জন্যে পাগল হয়ে উঠল ও। ব্যবস্থা করে দিল সব চম্পা। স্নান করে এসে দেখল, খাবার প্রস্তুত।

দুরাত্রি ও দুদিনের পথের গ্লানি ও ক্লান্তিতে এখন অঘোরে ঘুমোবার কথা। কিন্তু একটুও ঘুম এল না সুমিতার। ঘুরে ঘুরে, খুঁটে খুঁটে বড়দির বাসা দেখতে লাগল। বড়দির জামাকাপড়, টেবিল, চেয়ার, খাট-বিছানা। সবকিছুতেই কলকাতার চেয়ে এখানে জাঁকজমক যেন বেশি। র‍্যাক ভরতি বাংলা বই। তারপর হঠাৎ নজরে পড়ে, টেবিলের ওপর একটি সিগারেটের প্যাকেট। ছাইদানিতে অনেকগুলো পোড়া সিগারেট। কে খায়? কই, কোথাও তো কোনও পুরুষের ছাপ নেই এ ঘরে।

হঠাৎ কেমন যেন ভয় করতে লাগল সুমিতার। বড় ক্লান্ত, তবু মনের মধ্যে একটি অসহ্য যন্ত্রণা হতে লাগল। কী আছে ওর সামনে। এত দিনের সমস্ত জীবনটা কি অতীত হয়ে গেল। ছিন্ন হয়ে গেল এত দিনের সব সূত্র। জীবনের সমস্ত যুক্তি তর্ক, আদর্শ, নিষ্ঠা, বিশ্বাস, হঠাৎ যেন সব অর্থহীন মনে হতে লাগল বম্বের এই হ্যাপি লজে। এ কী ভয়ংকর হাহাকার মনের মধ্যে। এত বড় একটা শূন্যতা নিয়ে বাঁচবে কেমন করে সুমিতা।

বিকেলে এল সুজাতা। পায়ের শব্দে সুমিতা ফিরে তাকাতেই, দুজনে নির্বাক নিস্পন্দ হয়ে গেল এক মুহূর্ত। সুজাতার অস্ফুট গলায় খালি শোনা গেল, রুমনি।

পরমুহূর্তেই দুজনে ছুটে গেল দুজনের কাছে। সুসংবাদ দুঃসংবাদের কোনও প্রশ্ন দাঁড়াল না ওদের সামনে। কোনও কথা জোগাল না মুখে। আনন্দে না দুঃখে, ওরা দুজনের কেউই জানে না, শুধু কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গেল অশেষ কান্নায়।

সুজাতা বারবার বলতে লাগল, সত্যি এসেছিস, সত্যি।

সুমিতা কেবলি ডাকতে লাগল, বড়দি, বড়দি।

দুই বোনের মিলন দেখে, আড়ালে চম্পার চোখেও কেন যেন জল এসে পড়ল।

তারপর সুজাতা প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, বাবা কেমন আছেন রুমনি।

সুমিতা বলল, বুঝতেই পারছ। ভাল কেমন করে থাকবেন।

–শরীরটা কেমন?

–মোটামুটি।

কী জিজ্ঞেস করতে গিয়ে হঠাৎ গলার স্বর চেপে এল সুজাতার। বলল, ঝুমনো? ঝুমনোটা কেমন আছে রে?

সুমিতা বলল, মেজদি ব্যারাকপুরের দিকে আছে। কলকাতায় আসে প্রায়ই।

তুই যে বিভূতির কথা লিখেছিলি, তার কিছু হয়েছে নাকি?

সুমিতা জানাল, একরকম ধরেই নেওয়া যায়। সুমিতা যতটুকু বুঝেছে, তাতে মনে হয়েছে, বিভূতি মানুষ হিসেবে অনেক বড়। সৎ, সরল, ভাবুক শিল্পী। প্রেমিক হিসেবে ওর কোনও হিরোইজম নেই। জীবনের কাজ ও ভাবনা, সমস্ত কিছুর সঙ্গে সে মেজদিকে মিশিয়ে ফেলেছে। মেজদি যদি তাকে আজ ছেড়ে দেয়, তবে বিভূতি একটি কথাও বলবে না। কিন্তু মনের যেখানটা তার শূন্য হবে, সেখানটা পূরণ করতে পারবে না বোধ হয় বিভূতি সারা জীবন ছবি এঁকেও।

সুজাতা বলল, কেন, ঝুমনোর সেরকম কোনও ইচ্ছেও আছে নাকি?

সুমিতা বড়দির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল। বলল, বড়দি, তুমি কের্ন এ কথা বলছ? ইচ্ছেই যদি সব করত, তবে আজ এমন হল কেন? ইচ্ছের পথে গিয়েও অনিচ্ছার পথে পালাতে হয় মানুষকে। তার জন্যে যে কী অবস্থা হয়, তা তো আমরা কম দেখলুম না। বড়দি, আমার বড় ভয়, মেজদি যদি বিভূতিকে ছাড়ে, তার চেয়ে দুঃখের আর কিছু নেই।

সুজাতা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ সুমিতার মুখের দিকে। তারপর চিবুক ধরে ওর মুখ তুলে বলল, তোর কথাগুলো শুনে আমার বড় ভয় লাগছে রুমনি।

শুকনো হেসে বলল সুমিতা, তবে থাক সে কথা বড়দি।

সুজাতা বলল, অন্য কোনও ভয় নয় রুমনি। নানান কথা এসে জড়ো হয় মনের চারপাশে। জীবনের যে নানান কথা আছে, প্রথম বয়সেই এড়িয়ে গেছি তাকে। কিন্তু সে ছেড়ে কথা কয়নি। মনে করেছি, দু হাত বাড়িয়ে নেব যতখানি পারি। কিন্তু কোন ফাঁক দিয়ে সে কোথায় বেরিয়ে গেছে কখন। রুমনি তুই আমার ছোেট, কিন্তু তোর কাছে আমার কোনও লজ্জা নেই। প্রাণের ইচ্ছে আর মনের ফাঁকি, দুটোই আমাকে বড় মার মেরেছে। তোর কথাগুলো শুনলে সে সবই আমার তোলপাড় করে ওঠে। কিন্তু রুমনি

বলো।

 –তোকে কেন এমন দেখছি রে?

–আমাকে আবার কেমন দেখছ?

 সুমিতার সর্বাঙ্গে এক বার চোখ বুলিয়ে বলল সুজাতা, যেমন এসেছিস, তেমনি দেখছি। পরীক্ষা দিয়েছিস, পাশ করেছিস অনার্স নিয়ে, শুধু সেইজন্যেই বুঝি এমন শুকিয়েছিস?

চোখাচোখি হতে, চোখ নামিয়ে বলল সুমিতা, শুকিয়েছি কোথায়?

সুজাতা ওর চুলের গোছা ধরে সামনে টেনে এনে বলল, রুমনি!

বলো।

–আমি যে জানতুম, তোর বড় সাহস। তুই যে মনপ্রাণের ফাঁকিটাকে দু হাতে সরিয়ে ছুটে গিয়েছিলি? তার কী হল? তুই যে কোনও কিছুকে পরোয়া না করে অনেক বড় জীবন চেয়েছিলি?

সুমিতা বলল, পারলুম না বড়দি। কোনও দুঃখকে আমি ভয় পাইনি। তবু না।

-কেন?

–সেখানেও জীবনটা বড় ছোট। যত সে ছোট, ততই সে কুর, নিষ্ঠুর অন্ধ। প্রথম দেখে যাকে আমার অনেক বড় মনে হয়েছিল, দেখলুম তার সংকীর্ণতাও কম নয়। বড়দি, রাজেনের ত্যাগ ছোট নয়, কিন্তু নীতির সংকীর্ণতা জীবনের মর্যাদা থেকে দূরে সরিয়ে দেয় মানুষকে। সেটা আমি সইতে পারলুম না।

সুজাতা অন্তহীন বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সুমিতার দিকে। দু চোখে ওর জল। বলল, তুইও যে বড় নিষ্ঠুর রুমনি। রাজেনকে যে তুই ভালবেসেছিস। জীবনবোধের জন্য তাকে ছেড়ে এলি কী করে তুই?

সুমিতা রুদ্ধ গলায় বলল, আমি ছাড়িনি, রাজেনই আমাকে ছাড়িয়েছে বড়দি। যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে ভালবাসা দু দিন বাদে অপমানের নামান্তর হত। তাই আমি সরে এসেছি, ও থাক, ওর জীবন নিয়ে। সেখানে আমার স্থান নেই।

এক ঘরে, এক বিছানায় পাশাপাশি দিন যায় দুই বোনের। দিনের পর দিন যায়।

অনেক লোকজন আসে সুজাতার বাড়িতে। যেন মৌচাক বাড়িটা। মক্ষীরানি ওরা দুই বোন। বোম্বে কারদেজো অফিসের ম্যানেজার, আর্টিস্টেরা আসে। আসে অনেক চেনাশোনা বাঙালি ছেলেরা। মেয়েরা আসে কম। বিশেষ বাঙালি মেয়েরা। তারা বরং দুর্নাম করে বেড়ায় সারা বোম্বেতে দু বোনের নামে। এক সুজাতার নামের সঙ্গেই যে কত লোকের নাম জড়িয়েছে ওরা, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু যারা আসে, তারা সবাই ওদের বাইরের জীবনের মানুষ। পশুপক্ষীর জগতের মতো এই পুরুষেরা পেখম খুলে, কেশর ফুলিয়ে যেন ভোলাতে আসে ময়ুরী, সিংহিনীদের। সামান্য ব্যাপারে স্নায়ুদ্বন্দ্বে মাতে নিজেরা।

আর ওরা দুটি মেয়ে, দুটি বোন জীবনের ঘূর্ণি আবর্তে পাক খেয়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরছে। সেখানে ওদের কোনও সঙ্গী নেই, পরস্পরকে ছাড়া।

একজন আসে অনেকদিন পর পর। লোকটির নাম সুন্দরলাল বাকায়া। সুমিতা বোঝে, ওই লোকটি বড়দির পুরোপুরি বাইরের নয়, আবার ভিতরেরও নয়। দেশ ছিল পঞ্জাবে। অধ্যাপক ছিল লাহোরের এক কলেজে। দেশ বিভাগের পর এসেছে বোম্বেতে। স্ত্রী ছিল, মারা গেছে। প্রায় মধ্যবয়সি লোক। কানের পাশে চুল সাদা হয়ে উঠেছে। চোখ দুটি সব সময়েই যেন ছায়াঘেরা। কেউ নেই লোকটির। এখন একটি বিলিতি কোম্পানির টুরিং এজেন্টের চাকুরি করে। মধ্য ও দক্ষিণ ভারত ঘুরতে বেরোয় প্রায়ই। কোম্পানির অ্যাডভারটাইজমেন্টের ব্যাপারেই কারদেজোর অফিসে যাতায়াত, সেই সূত্রেই আলাপ বড়দির সঙ্গে।

প্রথমে জানত সুমিতা, বাকায়া কথা বলে কম। কিন্তু তা নয়। বাকায় অনেক কথা বলে। শুধু বড়দির সঙ্গে বলে।

সুজাতা বলে, বাকায়া বড় অদ্ভুত মানুষ। আলাপের প্রথম দিনেই বুঝলুম, ও একটা পাকা বোহেমিয়ান। বাউল-বৈরাগীও বলা যায়। টুরিং-এর কথা এমনভাবে গল্প করে, এত বিচিত্র আর আশ্চর্য, মনে হয় যেন গান করে বলছে। আর বড় নির্বিরোধী, কারুর সঙ্গে ওর টক্কর লাগে না কখনও। এমনিতেও একটু ভিড় বাঁচিয়ে চলে।

সুমিতা দেখে, যখন লোক থাকে, তখন বাকায়া নীরব। সবাই চলে যাওয়ার পর, বাকায়া মুখ খোলে। সেটা যে ওর স্বার্থপরতা কিংবা সংকীর্ণতা, তা নয়। কে কী মনে করবে, কীভাবে নেবে, সেই ভাবনা। ওর সিগারেটের প্যাকেট পড়ে থাকে বড়দির ঘরে। ছাইদানিটা কিনে এনে রেখেছে বড়দি। প্রথম প্রথম সুমিতার সামনে সংকোচ করত বাকায়া। মাস দুয়েক পর সেটা কেটেছে আস্তে আস্তে।

কত জায়গার কথা, কত মানুষের কথা যে বলে বাকায়। সামান্য বাংলা জানে, ইংরেজি বাংলা মেশানো, বাকয়ার কথার ভঙ্গিটি সুন্দর। সেই কথার ভিতর দিয়ে ফুটে ওঠে একটি সহৃদয় অভিজ্ঞ কথাশিল্পী। ওই দিয়েই বাকায় মুগ্ধ করেছে বড়দিকে।

সুমিতা দেখে, বাকায়ার সুদুর চোখের ওপারে যেন একটি সকরুণ আবেদন মাথা কুটছে। কিন্তু কোনওদিন কোনও ব্যবহারে, কথায় সেটুকু প্রকাশ করেনি। শুধু কেমন করে যেন বুঝেছে, বড়দির প্রাণে আছে এক গোপন বেদনা। বাকায়া তার গল্প ও বিবরণ নিয়ে হাজির হয় বড়দির সেই অন্ধকার প্রাণের কাছে। তাকেও টেনে এনে ছড়িয়ে দেয় অচিন মানুষ ও জনপদের মাঝে।

বাকায় নিজের দুঃখের কথা কিছু বলে না। খুঁচিয়ে উসকে তোলে না অপরের দুঃখ। এর পরিণতি কী হবে। মেয়ে হয়ে সুজাতা কি বাকায়ার যাওয়া-আসার মর্মোদ্ধার করতে পারে না!

পারে বইকী। সুজাতা বলে, সুন্দরলালকে আমার কোনও ভয় নেই। ও যে আমাকে নির্ভয় করেছে, সেইজন্যেই ওর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। পরিণতি? মানুষ সবসময় পরিণতি কেন খোঁজে? বাকায়ার এই নিরন্তর যাওয়া-আসা, এই নিরন্তর কথা আর সুজাতার শোনা, এই তো পরিণতি। বাকায়ার সঙ্গে আমার ওইটুকু ভিতরের চেনাশোনা। এর কম হলে দুজনের কারুর প্রাণে সইবে না। বেশি হলে, অপমান আর ঘৃণা এসে বাসা বাঁধবে।

তারপর আবার ওরা দুই বোন দাঁড়ায় মুখোমুখি। তখন আর কোনও সুন্দরলাল বাকায়া থাকে না। থাকে না অন্যান্য পরিচিতেরা। শুধু দুই বোন, আর একটি রুদ্ধ যন্ত্রণা।

সুজাতা বলে, রুমনি, তোকে যে আর চেয়ে দেখতে পারিনে। দিনে দিনে তুই শুধু শুকোচ্ছিস।

 বাবাকে আমি কী কৈফিয়ত দেব?

 সুমিতা বলে, কী যে বলো বড়দি। চলো, আজ একটু ইন্ডিয়া গেটে ঘুরে আসি।

কিন্তু সত্যকে চাপবে কেমন করে সুমিতা। মনের সব যন্ত্রণা ওর হারিয়ে গেছে রক্তে। এমনিই তো হয়। মনের আগুন এমন করেই ধীরে ধীরে রক্ত-মাংসের মানুষটিকে নিয়ে পড়ে, এমনি করে নিঃশেষ করে। জড় দেহটা তো কিছু নয়। তার ভিতরের চৈতন্য যাকে মারে, উপায় কী তার বাঁচার।

সুমিতা যে লিখেছিল রাজেনকে, জীবনবোধকে পার হয়েও তুমি যেখানটায় খচ খচ করবে, তাকে নিয়ে কী যে করব। সেই খচখচানিতেই রক্ত ঝরছে সুমিতার। রাজেনের খবর কাউকে ও জিজ্ঞেস করতে পারে না, কেউ দেয়ও না। চিঠি লিখবে সুমিতা? কে জবাব দেবে। রাজেনের জীবনের চারপাশে একটা পরিবেশ কল্পনা করতে পারে ও। কে জানে, আবার কেউ ফেলে রেখে গেল কি না। কেমন আছে শরীরটা, কোথায় খায়, কোথায় আছে।

জীবন থেকে বিদায় করেছে রাজেন সুমিতাকে। কিন্তু বেঁচে থাকবে তো মানুষটা। কে জানে, এত দিনেও ফিরেছেন কিনা সুধাময়ী।

ওরা দুজনে ইন্ডিয়া গেটে যায়। সেখান থেকে একটু হেঁটে মেরিন ড্রাইভ। এদিকে সমুদ্র, ওদিকে সমুদ্র। কূল বড় ছোট। আর চারদিক অকূল হয়ে আছে।

সুমিতার মনে পড়ে বড়দির সেই চিঠির কথা, সমুদ্র আর আকাশ যেখানে মিশেছে, সেখানে দেখি আবার চেনা-অচেনা মানুষের ভিড়। আমার যেতে ইচ্ছে করে সেখানে। সুমিতা বুঝি স্বার্থপর। ও একজনকেই দেখতে পায়, একজন ছড়িয়ে থাকে সারা আরব সাগরের আকাশ জুড়ে। ওরও যেতে ইচ্ছে করে।

কখনও যায় জুহু সৈকতে, জুহুর নারকেল কুঞ্জে। সেখানে আকাশের যত ব্যাপ্তি, মোহিনীময়ী আরব সাগরের যত খিল খিল হাসি, নারকেল বীথির যত দীর্ঘশ্বাস, স্বপ্নলোকে সেখানে অকরুণ দুর্মর মিলন ও চুম্বনের হাহাকার তত। ঠোঁটের ধনুকে, কটাক্ষের তীরে, হাসির নিক্কণে সমুদ্র ততই মাতাল।

পালিয়ে যায় দুই বোন। সাতবাংলার নির্জন সৈকতে যায়। কখনও সময় বেশি নিয়ে ছুটে যায় কারজাত পাহাড়ে, পুনার পশ্চিমঘাট পর্বতমালার জটিল আবর্তে।

ওদিকে পর্বতের জটলা আদিগন্ত, এদিকে অকূল সমুদ্র। তাড়িয়ে নিয়ে আসে আবার হ্যাপি লজে। কী আশ্চর্য নাম বাড়িটার। এসে খোঁজে চিঠি, কলকাতার চিঠি।

কেমন আছ মা তোমরা। সাবধানে থাকবে। মন খারাপ না করে সবসময় প্রফুল্ল থাকতে চেষ্টা করবে। আমি এখন কী করে যাব? পরে অনেক সময় আসবে। ঝুমনো আর বিভূতি আছে ভালই। কলকাতায় আসাটা ওদের বেড়েছে। বোঝা যাচ্ছে, মফস্বল ওদের ধরে রাখতে পারছে না, কিংবা ওরাই পালিয়ে আসছে। ভাল আছি, চিন্তা কোরো না। আশীর্বাদ জেনো। তোমাদের বাবা।

তাপসী লেখে চিঠি। সমস্ত চিঠিতে তীক্ষ্ণ, তীব্র হাসি থাকে ছড়ানো। শুধু ঢাকা থাকে না নোনা স্বাদটুকু। একটা চিঠিতে লিখেছে তাপসী সুমিতাকে, তোর আশীষ আর একটা বড় চাকরি পেয়েছে, আর সাতপাক ঘুরিয়ে বরণকুলো ছুঁইয়ে নিয়ে এসেছে একটি অষ্টাদশী। কলকাতার বন্দরের মিঃ জনদের মতো তার কোমর ধরে নিয়ে বেড়ায়। মুখপুড়ি, ঠকে গেলি তো। শ্যাম রাখতে গিয়ে কুল হারালি। শুনেছি, সেই ভদ্রমহিলা এখন বরানগরের এক দূর-আত্মীয়ের বাড়িতে মাথা গুঁজে আছেন।

তারপরেই তাপসী লিখেছে, ভাবি, এই হৃদয়হীন ভণ্ড আত্মসুখপরায়ণ মিথ্যে সংসারটার ওপর বজ্রাঘাত হবে কবে।

শিবানী একটা চিঠি লিখেছে, ছোট পিসি–তোমাদের তিন বোনের কথা ভাবতেও আমার ভয় হয়। সেজদাদু তোমাদের এত স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যে, তোমাদের জীবনকে কখনও আমরা ভাল চোখে দেখতে পারিনি। তোমাদের কত খারাপই না ভেবেছি। তাই তোমাদের দুঃখ না-হয় কপালে ছিলই। কিন্তু আমার, আমার কী হল? সম্বন্ধ, বিয়ে, ভালবাসা, স্বামী পুত্র সংসার আমার জন্যে সবাই যা চেয়েছিল, আমিও চেয়েছিলুম। সব পেয়েও আমি কেন আমার ঘরের সুখ ও দুঃখ নিয়ে সুগৃহিণী হতে পারছিনে। ছোট পিসি, তোমাকে বলতে তো আমার বাধা নেই, আমার শরীরে যত দিন সৌষ্ঠব ছিল, তত দিন আমি সুখী ছিলুম। মনে হয়, মেয়েদের দেহ যখন মরে, মন তখনই জাগে। এখন আমি জেগে দেখছি, আমাদের এই ঘরে, ভালবাসা, সন্তান জন্মানো ঘরকন্নাটা শুধু একটা অভ্যাসের বিষয়। কী হবে আমার ছোট পিসি! কেন আমার মনে এই সব জাগছে?

চিঠি পড়ে দুই বোন। তারপর আবার মুখোমুখি দাঁড়ায়। জীবনের সমস্ত ধারা শুধু পাক খায়, আবর্তিত হয়।

সুজাতা বলে, রুমনি, একটু ভাল জামাকাপড় পর, হাতে পায়ে একটু সাজ। তোকে যে আমার চেয়ে বড় লাগে।

চোখের কালিতে বিচিত্র হাসি ফুটিয়ে বলে সুমিতা, কত তো সাজি।

–এই কি সাজ? এ তো সন্ন্যাসিনীর বেশ।

কী যে বলো বড়দি।

 রুমনি, রাজেনকে একটা চিঠি লেখ।

সুমিতা চমকে ওঠে। তারপর শান্ত হয়ে বলে, চিঠি লেখার পাট শেষ করে এসেছি। বড়দি, ও সব কথা বোলো না।

শুনতে পারে না সুমিতা। যে মন প্রতি মুহূর্তে ভেঙে পড়তে চাইছে, উজান ছেড়ে ভেসে যেতে চাইছে ঢলে, তার কথা শুনতে নেই।

দেখতে দেখতে আবার এল শীত। তবে বোম্বের শীত অকুল দরিয়ার বাতাসে, সূর‍্যাস্তের বিলম্বে বসন্তের নামান্তর যেন।

সুজাতা ভাবে, এত ছেলে আসে, রুমনি এত হাসে, বকে, কিন্তু মনটা তো ওর মুক্তি পায় না। সুমিতাকে না জানিয়ে চিঠি লেখে মহীতোষকে, বাবা, রুমনিকে তুমি কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে নাও। ওকে দেখে আমার মনও ভেঙে যেতে চায়।

সুজাতা যখন বাড়ি থাকে না, অফিসে যায়, তখন একটি লোক আসে, নিঃসাড়ে পা টিপে টিপে, এই হ্যাপি লজে। নাম তার মিঃ জ্যাকসন, কুচকুচে কালো, ভেঁড়া প্যান্ট শার্ট, নেশাখোর মদ্যপ। চম্পার স্বামী।

সুমিতা লুকিয়ে দেখে, চম্পাকে সে মারে। নিঃশব্দে মারে, পয়সা আদায় করে, তারপরে কাঁদে, তারপরে আদর করে চম্পাকে। দরজা বন্ধ করার সুযোগটুকুও দেয় না। তখন চম্পাও কাঁদে, আদরও করে স্বামীকে।

অবাক হয় সুমিতা। বুকের মধ্যে কেমন করে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে নিজেকে। অনেক যেন লম্বা হয়েছে সুমিতা, কৃশ হয়েছে। সোনা পুড়ে পুড়ে তার সব স্থূলত্ব হারিয়ে ভিন্ন রূপ ধরেছে। এ রূপ কি গলে গলে নিঃশেষ হবে না।

দুপুরেও পায়চারি করছিল সুমিতা বন্ধ ঘরে। খোলা চুল। জামাটাও অগোছালো। সুজাতা গেছে অফিসে।

চম্পা দরজায় করাঘাত করল। সুমিতা দরজা খুলল। চম্পা বলল, একজন বাঙালি বাবু ছোটা মেমসাহেবকে সেলাম জানাচ্ছে বাইরের ঘরে।

বিরক্ত হল সুমিতা। সন্ধ্যার আসরের কেউ দুপুরের ফাঁকে একলা এসেছে নিশ্চয়। বলল, বসতে বলো।

চম্পা চলে গেল। সুমিতা আবার ঘরের মধ্যে দাঁড়াল এসে। একী হেয় বাসনা পুরুষের। মেয়েদের অপমানটুকুও কি বোঝে না। জামাকাপড় একটু ঠিক করে, সুমিতা এসে দাঁড়াল বাইরের ঘরের দরজায়।

এক মাথা রুক্ষ চুল নিয়ে মুখ নিচু করে বসে আছে একজন। সুমিতার মনে হল, সর্বাঙ্গে একটা ভয়ংকর বিদ্যুৎ কষায় একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গেছে। একটি অস্ফুট শব্দ করে, নিজের পতনকে বাঁচাল শক্ত করে দরজা ধরে।

রাজেন ফিরে তাকাল। দাঁড়াল উঠে, বলল, যেন অনেক দুর, কোন সুগভীর তলের চাপা জলস্রোতের মতো, এসে পড়লুম।

এসে পড়লুম।কী বিচিত্র কথা! এসে পড়েছে, এসে পড়েছে! মাথার মধ্যে সহসা অনেক কোলাহল কেমন যেন জট পাকিয়ে যেতে লাগল সব। কী এনেছে। শুধু মানুষটি এসেছে, না জীবন এসেছে? সুমিতার এলো খোঁপা এলিয়ে পড়ল, আঁচল পড়ল লুটিয়ে।

রাজেনের গলা তেমনি সুদূর, চাপা। বলল, সুমিতা এসো, একটু বসো। আমি এইমাত্র বোম্বে মেল থেকে নেমে এসেছি।

তাই তো, এই তো সেই সময়। এমনি সময়েই তো সুমিতা এসে উঠেছিল হ্যাপি লজে।

রাজেন আবার বলল, বিরক্ত করবনা। শুধু বলতে এসেছি কয়েকটি কথা। তোমাকে না বললে চলে, চিঠিতেও লেখা যায় না। তাই এসেছি, তুমি একটু বসো।

বড় ভয়, আজ বড় ভয়। কী বলতে এসেছে। রাজেন কোন নীতির কথা বলতে এসেছে সশরীরে সুমিতার সামনে, এমন সর্বনাশের মূর্তি ধরে। সর্বনাশই তো। সুমিতার বুকের মধ্যে যে কাঁপছে থরথর করে।

ধীরে ধীরে এল সুমিতা। চোখ তুলতেই দেখতে পেল সেই মূর্তি। এই যেন, প্রথম দেখা। আর দেখামাত্রই বিস্মিত ব্যথায় চমকে উঠল। এ যে চেহারায় একেবারে অচেনা। চোয়াল উঁচুনো, সুগভীর পরিখা চোখের কোলে, শীর্ণকায় রাজেন। যেন এইমাত্র ঝড়ের ঝাপটা থেকে এসে ঢুকেছে বন্ধ ঘরে। যেন, দুদিন হল কঠিন রোগ থেকে আরোগ্যের পর ফিরেছে মুক্তি-স্নান করে।

ঠোঁটে ঠোঁট টিপে নিজেকেই নিজে বারবার বলতে লাগল চোখের জলে, তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে অন্ধ করো না, আমার দৃষ্টি স্বচ্ছ রাখো, হৃদয়কে নিরাবেগ করো।

রাজেন বসল। পাশে একটি বড় ক্যাম্বিসের ব্যাগ। ওর সারা মুখের মতো ব্যাগটিও ধুলো-মাখা।

 রাজেন বলল, সুমিতা, আমার নিচুতলার বন্ধুরা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারা দেখেছে, বুঝেছে, আমি অযোগ্য।

সুমিতার গলায় একটি অস্ফুট শব্দ শোনা গেল, তারপরেই জল এসে পড়ল চোখে।

রাজেন বলল, আমি বলে নিই সুমিতা।

 রাজেনের গলাও বোধ হয় ধরে এসেছিল। একটু চুপ করে থেকে বলল, তারা দেখেছে, আমি অন্ধরাগে ফুঁসেছি শত্রুর বিরুদ্ধে। আমি সংগ্রাম করেছি আমার নিজের নীতির জয়ের জন্যে, তাদের জন্যে নয়, তাই তারা আমাকে ত্যাগ করেছে, জবাব দিয়েছে।

সুমিতার মনে হল, ওর নিজেরই বুক ফেটে যাবে। চাপা গলায় শুধু উচ্চারণ করতে লাগল, রাজেন…রাজেন…

রাজেন বলল, তারা দেখেছে, আমি নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছি, বন্ধুত্বের মর্যাদা দিইনি, অপমান করেছি, অনেকের অনেক ক্ষতি করেছি। বুঝেছে, বলেছে তারা, আমি মূর্খ বিপ্লবী, যে শুধু নিজেদেরই কবর খোঁড়ে। দেখা গেছে, তাদের সঙ্গে আমার জীবনের গোড়াতেই অপরিচয়। আমাদের পরস্পরের জীবনবোধে চেনাশোনা হয়নি আজও। জীবনবোধের মধ্যে যে বিজ্ঞান, তা আমার আয়ত্ত হয়নি, অন্ধ আক্রোশে পাঁকে মুখ গুঁজেছে সে। মহাজীবনের ব্যাপ্তি আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। সুমিতা

রাজেন সোফা থেকে উঠে এসে সুমিতার কাছে জানু পেতে বসল। সুমিতার দুটি হাত টেনে নিয়ে বলল, সুমিতা আমার ভুল হয়েছে, আমি জীবন সন্ধানে যাব, তাই তোমার কাছে এসেছি।

সুমিতা দু হাতে রাজেনের রুক্ষ-চুল মাথাটি জড়িয়ে ধরে, মুখ চেপে কান্নাচাপা গলায় বলল, এমন কোরো না রাজেন, এমন কোরো না! তুমি যে অনেক বড়, অনেক, তুমি এমন করে ধুলোয় বসো না।

রাজেন বলল, ধুলো আমার ঠাঁই সুমিতা। মিথ্যেকে আমি টের পেয়েছি। তোমার কাছে নত হতে যে আমার কোনও সংকোচ নেই।

সুমিতা রুদ্ধ গলায় বলল, না, না, অমন কথা বোলো না রাজেন। তোমার ভিতরে আগুন, তাইতেই পুড়ে পুড়ে যে তুমি তোমার পথে এসেছ। জানতুম, আমি জানতুম, তোমার জীবনের পথে তুমি নিজে আসবে। তোমার সেই অগাধ ব্যাপ্তিতে ভেসে যাব আমি, এই আমার সাধ, এই তো আমার বাঁচা।

রাজেন বলল, সুমিতা তুমি রাজনীতি করনি। আমার মা করেনি। আমার মায়ের ধর্ম-বিশ্বাস আছে, থাকবেই। কিন্তু মানুষকে তোমরা ভালবেসেছ। তাই মহাজীবনের একটি দিক তোমাদের কাছে চিরদিন খোলা। সেদিকে তোমরা আমার গুরু।

সুমিতা রাজেনের মুখে হাত চাপা দিয়ে, ত্রাস-রুদ্ধ হয়ে বলল, চুপ,চুপ,–এ সব বলে আমাকে দূরে রেখো না।

রাজেন বলল, না দূরে নয়, তুমি আমার অগণিত গুরুর এক গুরু। এবার চলো অগণনের মধ্যে। তোমাকে নিয়ে ফিরে যাব আমি।

সুমিতা বলল, যাব, যাব, যাব বইকী। এবার বলো মায়ের কথা, তিনি কোথায়।

 রাজেন বলল, মা ফিরে এসেছে। তোমার চিঠি পড়ে বললে, সর্বনেশে, ভাগ্যে চাস তো শিগগির যা, তাকে নিয়ে আয়।

মেঘলাভাঙা রোদের মতো স্নিগ্ধ হাসি দেখা দিল সুমিতার ঠোঁটে।

.

সুমিতা বলল, বড়দি যাই?

 সাত দিন পর বিদায় নিচ্ছে সুমিতা। সুন্দরলাল বাকায়াও এসেছে বিদায় দিতে।

 সুজাতার চোখে জল। বলল, তুই না গেলে যে আমি মরব। তোর কথা ভেবে যে বাঁচব রে রুমনি এ যাত্রা। ঝুমনোও তাই, দেখিস। বলে রাজেনের চুলের মুঠি ধরে বলল, আবার এসো।

রাজেন বলল, না বললেও আসব।

 সুজাতা হাসতে গিয়ে কেঁদে বলল, তা আমি খুব জানি। তোমাদের আর চিনিনে?

 সুন্দরলাল দুজনের হাত চেপে ধরে বয়োজ্যেষ্ঠের মতো আদর করল। বলল, যেখানে যাবে, জীবনেরই পথে যাবে তোমরা। এ শুধু আরব সাগরের কূল থেকে বঙ্গোপসাগরের কূল বদল।

গাড়ি ছেড়ে গেল ওদের। আরব সাগর থেকে বঙ্গোপসাগরে, জীবনে, মহাজীবনে, জীবনারণ্যের জটিল জটলায় পথ করে।

সুজাতা আর বাকায়া তাকিয়ে রইল গাড়ির লাল আলোটির দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *