ওবেলিস্ক
গত শনিবার বইমেলাতে গিয়েছিলাম। আমি আর পিজি দু-জনে যাব বলেই ঠিক হয়েছিল। কিন্তু সাড়ে দশটা নাগাদ হোস্টেল থেকে বেরিয়ে পিজি বলল, ‘চল, দেখি ভবেশদা কী করছেন।’ আমাদের চলমান মিশরীয় এনসাইক্লোপিডিয়া তখন সবেমাত্র গুমটিটা খোলা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সে-গুমটি আর তাঁরর খোলা হল না, আমি আর পিজি ওঁকেও বগলদাবা করে উঠে বসলাম করুণাময়ীর বাসে। ভবেশদা প্রথমে একটু গাঁইগুঁই করছিলেন বটে, সেন্ট্রাল পার্কে নাকি বইমেলার আমেজটাই পাওয়া যাবে না। তাই তিনি এবারে আর যাবেন না মেলাতে। কিন্তু পিজি ওর ব্রহ্মাস্ত্রটা বের করেছিল তখনই। তারপরে আর ভবেশদা না করতে পারেননি। বেনফিশের ফিশ কাটলেটকে না বলবে এমন বাঙালি খুব কমই আছে।
আট নম্বর গেট দিয়ে মেলায় ঢুকলাম। জায়গাটা ছোটো, তাই খুব একটা খোলামেলাভাবে স্টলগুলো ছিল না এবারে, বড়ো বড়ো পাবলিশারদের স্টলগুলোও যেন মাপে একটু ছোটো। তবে অবাক হওয়ার ব্যাপার এইটাই যে ভিড়টা বেশ কম। মেলাতেই এক স্টলের মালিকের কাছে শুনলাম চিংড়িঘাটাতে নাকি একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ওইদিকের রাস্তা একেবারে বন্ধ। তাই অনেকেই চাইলেও বইমেলার দিকে আসতে পারছে না। এতে আমাদের যদিও বেশ ভালোই হল। মোটামুটি কোনো স্টলেই লাইনে দাঁড়াতে হল না। রাজার মতো ঢুকলাম। স্টলের ভেতরে ধাক্কাধাক্কিটাও এড়ানো গেল। অবশ্য ওই ভিড়ে ঠেলাঠেলি করতে করতে বই দেখা, বই কেনারও একটা আলাদা মজা আছে।
গোটা মেলাটা ঘুরে দেখতে ঘণ্টাতিনেক মতো লাগল। মেলাতে বইয়ে তেমন ডিসকাউন্ট পাওয়া যায় না। অন্যদিকে আজকাল বাড়িতে বসেই অনলাইনে বেশ ভালো ছাড়ে বই কেনা যায়। কিন্তু তবু বইমেলাতে এসে বই না কিনে ফিরতেও কেমন একটা লাগে। বইয়ের গন্ধ নাকে এলেই মনে হয় কিনে ফেলি। আমি কিনলাম বুদ্ধদেব বসুর কালের পুতুল আর তিথিডোর। ভবেশদা কিছুই কিনলেন না। আর পিজি কিনল অ্যাস্টেরিক্স।
অ্যাস্টেরিক্সের ওপরে পিজির একটা অদ্ভুত মোহ আছে খেয়াল করেছি। বাংলায় লেখা সবকটা বই তো ওর আছেই। ইংরেজিগুলোও কিনেছে ও। এমনকী ২০১০-এ আলবার্তো ইউদের্জো অ্যাস্টেরিক্স আঁকা আর লেখা ছেড়ে দেওয়ার পরেও যে দুটো বই বেরিয়েছিল সেগুলোও আছে পিজির কাছে। আমাকে ওগুলো পড়িয়েছিল, আমার কিন্তু আগের অ্যাস্টেরিক্সের মতো ভালো লাগেনি। কিছু একটা যেন নেই। তবে পিজিই আমাকে দেখিয়েছিল ২০১৫-তে বেরোনো অ্যাস্টেরিক্স অ্যান্ড দ্য মিসিং স্ক্রল-এ অ্যাস্টেরিক্সের সেই দুটো ছবি যেটা ইউদের্জো নিজে এঁকেছিলেন অবসর কাটিয়ে ফিরে এসে। সেই বছরেই প্যারিসে চার্লি হেবদোর দপ্তরে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে খুন করা হয় সাতজন কার্টুনিস্টকে। ওঁদের স্মৃতিকে সম্মান করেই যে ইউদের্জো ওই ছবিগুলো আঁকেন সেটাও পিজির কাছ থেকেই জানা। ছেলেটা এই কমিক্সটাকে গুলে খেয়েছে একেবারে। ২০১৭-র অক্টোবর মাসে যখন এই কমিক্সের সাঁইত্রিশ নম্বর টাইটল অ্যাস্টেরিক্স অ্যান্ড দ্য চ্যারিওট রেস বের হয় তখনই পিজি বলেছিল কিনবে। ওর এবারের বইমেলার সংগ্রহ ওই বইটাই।
মেলায় ঘুরে ঘুরে খিদেটা ভালোই পেয়েছিল। পিজির ভবেশদাকে দেওয়া কথামতো বেনফিশের স্টল থেকে দুটো ফিশ কাটলেট কেনা হল। পিজি নিজের জন্য কিনল চিংড়ির কাটলেট। তারপরে আমরা গুছিয়ে বসলাম আনন্দ-র স্টলের সামনে বড়ো চাতালটাতে। কাটলেট খেতে খেতেই পিজি অ্যাস্টেরিক্সটা বের করে পড়তে শুরু করল। আমি আর ভবেশদা গল্প করছিলাম। ১৯৯৭ সালে ময়দানের যে মেলাতে আগুন লেগেছিল তার কথা বলছিলেন ভবেশদা। ময়দানের মেলার যে আমেজটা ছিল সেটা মিলনমেলা বা এখানে একেবারে মিসিং সেসব কথাও উঠে এল।
একসময় পিজি হাতে-লেগে-থাকা কাটলেটের গুঁড়ো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
‘বুঝলি, বইটা হাফ নামিয়ে দিলাম। ফেরি আর কনরাডের জুটি কিন্তু আগের দুটোর থেকে এটাকে বেটার বানিয়েছে।’
‘বলছিস?’
‘হুমম, তবে এই গল্পটা বািকগুেলার থেকে একটু অন্যরকম।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, ওবেলিক্সকে দেখছি এবারে অনেকটা বেশি স্পেস দিয়েছে। অ্যাস্টেরিক্সের থেকেও বেশি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে ও সাইডকিক না, মেন হিরোই।’
‘আচ্ছা, ওবেলিক্সের নামটা এমন কেন বলো দেখি?’
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ভবেশদা প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েই মুচকি হাসছে।
‘তা তো জানি না, ওই মেনহির পাথর চাগিয়ে ঘোরে বলেই কি?’
‘না ঠিক তা নয়, তবে ওই মেনরিরের সঙ্গে সামান্য মিল আছে বলতে পারো। ওবেলিক্স শব্দটা গ্রিক ওবেলিসকস থেকে এসেছে, যেটার উৎস আবার ওবেলস। এর মানে হল লম্বা পাথরের থাম, যার মাথাটা সূঁচলো। গ্রিকদের কাছে এটা ছিল শক্তির একটা প্রতীক। তবে জিনিসটা আদতে কিন্তু গ্রিক নয়।’
‘তাহলে?’
‘বিশাল উঁচু একটা থাম, একটাই পাথর কেটে তৈরি। তার মাথার উপরে বসানো একটা পিরামিড।’
‘এখানেও ইজিপ্ট!’
‘হ্যাঁ ভাই, ওই দেশটা না থাকলে আজকে হয়তো তোমার কমিকসের ওবেলিক্সের নামটাই অন্য কিছু হত।’
লাক্সর মন্দিরের ওবেলিস্ক
কাটলেটের সঙ্গেই কেনা কফিতে চুমুক দিয়ে ভবেশদা বলল,
‘পৃথিবীর সৃষ্টি হওয়া নিয়ে ইজিপশিয়ান মাইথোলজিতে অনেক রকমের গল্প আছে বুঝলে, তার মধ্যে একটা হল বেনু নামের এক পাখির। সৃষ্টিকর্তা নাকি বেনু পাখির রূপ ধরে একটা পাথরের ওপরে বসে আওয়াজ করেন। সেটাই প্রথম শব্দ। অসীম নিস্তব্ধতা ভেঙে সেই আওয়াজের সঙ্গেই জন্ম হয় পৃথিবীর। এই বেনু পাখির শরীর ছিল সূর্যের মতো উজ্জ্বল, একবার মারা যাওয়ার পরেও নাকি আবার সে বেঁচে ফিরত।’
‘অনেকটা ফিনিক্সের মতো না!’
‘অনেকটাই, গ্রিক পুরাণের বেশ কিছুটা মিশর থেকে ধার করা, এটাও হয়তো তার মধ্যে একটা। বেনু পাখি তৈরি হয়েছিল সূর্যের দেবতা ‘‘রা’’ আর মৃতদের দেবতা ‘‘ওসাইরিস’’কে মিলিয়ে। এবারে বেনু যে পাথরটায় বসে ডাক দিয়েছিল সেই পাথরটাই নাকি এই পৃথিবীর প্রথম বস্তু। এই পাথরটার নাম বেনবেন। উত্তর ইজিপ্টের হেলিওপলিসে ‘রা’-এর সঙ্গে সঙ্গে বেনবেনেরও পুজো হত। মিশরীয়রা এই বেনবেনের কল্পনা করেছিল পিরামিডের আকৃতিতে। আর সেখান থেকেই ওবেলিক্সের কনসেপ্টের সৃষ্টি। নেটে সার্চ ইজিপশিয়ান ওবেলিস্ক বলে সার্চ করো, তাহলেই পেয়ে যাবে।’
ওবেলিস্কের ছবিতে দেখলাম সত্যি একটা বিশাল পাথরের টুকরো, চারকোনা, গায়ে হায়রোগ্লিফ খোদাই করা। মাথাটায় একটা ছোটো পিরামিড। ভবেশদা বলতে লাগলেন,
‘ফারাওরা এই ওবেলিস্ক বানিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা করতেন, বুঝলে। ওবেলিস্কের গায়ে লেখা হত ফারাওয়ের গুণগান, আর ভগবানের স্তুতি। ওঁরা ভাবতেন মাটি থেকে অনেক উঁচু এই থামই ভগবানের কাছে রাজার বার্তা পৌঁছে দেবে। মাথার ওই ছোটো পিরামিডে খোদাই করা থাকত সূর্যদেবতা আর ফারাওয়ের ছবি। পিরামিডটা মোড়ানো থাকত সোনাতে। কারণ সূর্যের আলো পড়ে তা চকচক করে। আর তা ছাড়া ওরা ভাবত সোনা হল স্বয়ং ঈশ্বরের শরীরের মাংস, তাই খুব পবিত্র।
‘প্রথম ওবেলিস্ক তৈরি হয় টুয়েন্টিফিফথ সেঞ্চুরি বিসিতে। ফারাও উসারকাফের সময়। কিন্তু সেটা বানানো হয়েছিল চুনাপাথরের টুকরো একটার ওপরে আরেকটা সাজিয়ে। গোটা একটা পাথর কেটে ওবেলিস্ক বানানো শুরু হয় আরও পাঁচশো বছর পরে। প্রথম আর তৃতীয় তুতমোসিস, হাতসেপসুত, দ্বিতীয় রামেসিস এঁরা প্রচুর ওবেলিক্স বানিয়েছিলেন গোটা দেশ জুড়ে।’
পিজি এবারে বলল,
‘এগুলোর হাইট কেমন হত, ভবেশদা? দেখে তো বেশ উঁচুই মনে হচ্ছে।’
‘হ্যাঁ, মোটামুটি ধরো একটা দশতলা বাড়ির সমান।’
‘এত বড়ো একটা পাথর! ওভাবে বানাত কী করে! ওইটার ওজনও তো প্রচুর!’
‘ওবেলিস্ক বানানোর পদ্ধতিটা খুব ইন্টারেস্টিং ছিল, বুঝলে। সাধারণত গ্র্যানাইট, চুনাপাথর বা বালিপাথর কেটে বানানো হত। প্রথমে বিশেষজ্ঞরা পাথরের খনিতে গিয়ে একটা বড়ো পাথরের টুকরোকে পছন্দ করত। তারপরে সেই লম্বা পাথরের টুকরোর দু-পাশে দু-ফুট গভীর পরিখা কাটা হত। তার ভেতরে সারি দিয়ে বসত শ্রমিকেরা। তারা এবারে পাথরের টুকরোটাকে সমানভাবে কাটত। গা-টা পালিশ করত ডিওরাইটের মতো ভলক্যানিক পাথর দিয়ে। কারণ সেগুলো গ্র্যানাইটের থেকেও শক্ত হত। তারপরে তার গায়ে সম্রাটের আদেশ মতো হায়রোগ্লিফিক লিপি খোদাই করা হত। পাথরটাকে দু-পাশ থেকে কেটে চৌকো আকার দেওয়া হত। এবারে একদম শেষে পাথরের মাটিতে লেগে থাকা অংশটা ভাঙলেই তৈরি ওবেলিক্স!
যেভাবে ওবেলিস্ক তৈরি হত
‘তৈরি তো হল, কিন্তু এত ভারী জিনিসটাকে খনি থেকে তো নিয়েও যেতে হবে যেখানে বসাতে হবে সেখানে।’
‘হ্যাঁ, তারও পন্থা আছে বই কী। লাক্সরের মন্দিরের বাইরে বিশাল বড়ো একটা ওবেলিক্স আছে। সেটাকে কীভাবে আনা হয়েছিল, শোনো। আসওয়ানের খনিতে তো তাকে বানানো হল। তারপরে কাঠের পাটাতনের ওপরে চাপিয়ে তার নীচে কাঠের গুঁড়ি দিয়ে তাকে গড়িয়ে আনা হল নীল নদের তীরে। তারপরে সবাই অপেক্ষা করে রইল বর্ষার জন্য। বর্ষাকালে নীল নদে যখন বন্যা হল তখন জলের গভীরতা অনেক বেড়ে গেল। তখন সেই ওবেলিস্কটাকে একটা বিশাল নৌকোয় চাপিয়ে নিয়ে আসা হল লাক্সরে। এবারে আবার অপেক্ষা। কখন নদীর জল নামে। জল নেমে যাওয়ার পরে ওবেলিক্সকে আবার নৌকো থেকে নামিয়ে আগের মতো কাঠের পাটাতনের ওপরে চাপিয়ে নিয়ে আসা হল লাক্সরের মন্দিরের বাইরে। সেখানে আবার বালি দিয়ে একটা বিশাল উঁচু ঢিপি বানানো হল। তার গা বেয়ে এবারে ধীরে ধীরে দাঁড় করানো হল ওবেলিস্কটাকে। তারপরে বালি সরিয়ে নিতে যেটুকু সময় লাগে।’
যেভাবে ওবেলিস্ক দাঁড় করানো হত
‘বাবা রে! এ তো বিশাল ঝক্কির ব্যাপার! তবু ওদের ইঞ্জিনিয়ারিং স্কিলের তারিফ করতে হয়। কিন্তু ভবেশদা, একটা কথা বলুন, ওবেলিস্ক না হয় ফারাওদের সময় বেশ পপুলার ছিল। বললেন অনেকগুলো বানানোও হয়েছিল। কিন্তু আজকের আগে অবদি তো কখনো মিশরের কোনো ছবিতে এটাকে খেয়াল করিনি।’
‘সেটা না দেখারই কথা ভাই। কারণ বেশিরভাগ ওবেলিস্কই এখন সেদেশের বাইরে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ইউরোপ আর আমেরিকাতে।’
‘অত ভারী জিনিসও ওরা ছাড়েনি!’
‘ছাড়বে কেন? ওবেলিস্কগুলোকে দেখতেই তো দারুণ আকর্ষক ছিল। সেই রোমানদের সময় থেকে ওরা দেশছাড়া হওয়া শুরু করেছে। সম্রাট অগাস্টাস একটা ওবেলিস্ককে উপড়ে নিয়ে আসেন রোমে। সেই শুরু, তারপরে থিওডোসিয়াস আরেকটাকে আনেন কনস্ট্যান্টিনোপলে, যেটা এখন ইস্তানবুল। শ্যাম্পোলিয়নের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই?’
‘মনে থাকবে না আবার! যিনি হায়রোগ্লিফ আবিষ্কার করেছিলেন।’
প্যারিসের ওবেলিস্ক
‘এগজ্যাক্টলি, সেই শ্যাম্পোলিয়ন যখন ইজিপ্টে ঘুরতে এসেছিলেন তখন লাক্সরের রামেসিসের মন্দিরের বাইরের একজোড়া ওবেলিস্কের মধ্যে একটাকে তুলে আনেন। সেটা এখন আছে প্যারিসে। আবার ব্রিটিশরা যখন ফ্রেঞ্চদের হারিয়ে দিল তখন ইজিপ্টের সুলতান ওদের একটা ওবেলিস্ক উপহার দেন। সেটা এখন লন্ডনে, থেমসের ধারে। ‘‘ক্লিওপেট্রা’স নিডল’’ নামেই এখন সবাই ওঁকে চেনে।’
‘বলেন কী! তার মানে ক্লিওপেট্রার সময়ে এটা তৈরি হয়েছিল।’
‘ধুস, সেই ফারাও ক্লিওপেট্রার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কই নেই। এটা ফারাও তৃতীয় তুতমোসিসের সময়ের। তবে নামটা কেন হল সেটা বেশ মজার। প্রায় ২০০ টন ভারী ওবেলিস্কটাকে লন্ডনে নিয়ে আসার জন্য ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার জন ডিক্সন লোহার একটা লম্বা সিলিন্ডারের মতো দেখতে ডিঙি বানান। এরই মধ্যে ওবেলিস্কটাকে ভরে ওল্গা নামের একটা জাহাজে করে সেই ডিঙিটাকে টেনে নিয়ে আসা হয় জলপথে। ডিক্সন ওঁর বানানো ডিঙির গালভরা নাম দিয়েছিলেন ‘‘ক্লিওপেট্রা’’। তাই সেই থেকে ওবেলিক্সটার নামও হয়ে যায় ক্লিওপেট্রা’স নিডল। এখন এটার সঙ্গে নিউইয়র্কে থাকা আরেকটা ওবেলিস্ক আর প্যারিসের ওবেলিস্ককেও ওই একই নামে ডাকে সবাই।’
লন্ডনের ওবেলিস্ক
‘আচ্ছা, ভবেশদা, ওই নিউইয়র্কের ওবেলিস্কটাই সেই ফরেস্ট গাম্প সিনেমাতে দেখিয়েছিল না! টম হ্যাংক্সের সেই বিখ্যাত স্পিচটা! আর তারপরে… উফফ কী দারুণ সিন ছিল!’
সিনেমার কথা বলার সময় হলেই পিজি উত্তেজিত হয়ে পড়ে দেখেছি। এবারেও সেরকমই হল। ভবেশদা ওর কথায় একটু হেসে উত্তর দিলেন,
‘না ভাই, ওইটা তো ওয়াশিংটন মনুমেন্ট। আমেরিকাতেই বানানো। ইজিপ্টের নয়। আইকন হিসেবে এটা এমনই স্ট্রং যে গোটা পৃথিবী জুড়েই অজস্র ওবেলিস্ক বানানো হয়েছে পরে।’
‘আমাদের দেশে এরকম কিছু নেই!?’
‘আমাদের এই শহরেই তো ছিল, ভায়া।’
‘তাই নাকি!’
‘হুম, হলওয়েল মনুমেন্টের নাম শুনেছ?’
‘শুনব না আবার! সিরাজদৌল্লার ফোর্ট উইলিয়াম দখলের পরে অন্ধকূপে ঠেলে দেওয়া হয় ব্রিটিশ বন্দিদের। তাতে মারা যান অনেকে। এর স্মৃতিতেই বানানো হয় হলওয়েল মনুমেন্ট।’
লন্ডনে যেভাবে ওবেলিস্ক এল। ২০০ টন ভারী ওবেলিস্ককে সিলিন্ডারের মতো ডিঙিতে (ক্লিওপেট্রা) ভরে জলপথে জাহাজ দিয়ে টেনে এনে স্থাপন করা হল লন্ডনে। (উপর থেকে নীচে)
‘বাহ! একদম ঠিক বলেছ, ১৭৫৬ সালে অন্ধকূপের হত্যাকাণ্ড হয়। সেই অন্ধকূপ থেকে যে কয়েকজন প্রাণ হাতে করে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল তাদের মধ্যে একজন ছিলেন জন জেফানিয়া হলওয়েল। ১৭৫৯ সালে ইনিই উদ্যোগ নিয়ে হলওয়েল মনুমেন্ট বানান। এই মনুমেন্টটা ছিল ইজিপশিয়ান ওবেলিস্ক-এর আদলে।’
পিজি বলল,
‘বাহ! তাহলে এখন সেটা কোথায় গেল?’
‘সেটারও অনেক গল্প, ১৮২১ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস হলওয়েল মনুমেন্ট ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। সেইসময়কার পাদরি জেমস লঙের মত অনুযায়ী যেহেতু এই মনুমেন্ট এদেশীয়দের হাতে ব্রিটিশদের লাঞ্ছনার প্রতীক তাই এটাকে ভেঙে ফেলাটাই বেটার বলে মনে করেন হেস্টিংস। তবে ১৯০২ সালের ১৯ ডিসেম্বরে আবার হলওয়েল মনুমেন্টের একটা ছোট্ট মার্বেলের রেপ্লিকা বানানো হয়, মনুমেন্টের আগের জায়গাতেই। সেটা বানান লর্ড কার্জন।’
‘ওকে, তার মানে রেপ্লিকাটা অ্যাটলিস্ট এখনও ওখানেই আছে।’
‘ধুস, গোটাটা শোনো আগে, ১৯৪০ সালে নেতাজি হলওয়েল মনুমেন্ট ভেঙে ফেলার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। ঠিক হয় ৩ জুলাই, সিরাজের মৃত্যুদিনে এটাকে ভেঙে ফেলা হবে। ইংরেজরা বেগতিক বুঝে ২ জুলাই নেতাজিকে গ্রেফতার করে। কিন্তু তার পরেও আর রিস্ক নিতে চায়নি ওরা। কার্জনের বানানো রেপ্লিকাটাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেন্ট জর্জ চার্চের প্রাঙ্গণে। এখনও ওখানেই আছে সেটা। কিন্তু আকারে এতটাই ছোটো এই রেপ্লিকা যে একে ওবেলিস্ক ঠিক বলা যাবে না, বুঝলে। তবে এদেশে একটা ওবেলিস্ক দাঁড়িয়ে আছে দিল্লিতে। আর এর সঙ্গেও আমাদের শহরের নাম জড়িয়ে আছে, জানো!’
রাইটার্স বিল্ডিং-এর সামনে হলওয়েল মনুমেন্ট (১৮২১ সােলর আগের ছবি)
‘তাই নাকি!’
‘হুমম, ১৯১১ সালের জুন মাসে ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হন পঞ্চম জর্জ। সে-বছরেরই ১২ ডিসেম্বরে জর্জ আসেন দিল্লিতে। মুঘল রাজাদের আদলে পঞ্চম জর্জ দরবার বসান। সেইদিন একটা এমন ঘোষণা করেন যেটা স্মরণীয় করে রাখার জন্য একটা ওবেলিস্ক বানানো হয়। এখন সেটা আছে দিল্লির করোনেশন পার্কে।’
‘ঘোষণাটা কী ছিল?!’
‘আন্দাজ করতে পারো কি?’
যথারীতি অন্যবারের মতো এবারেও আমাকে আর পিজিকে চুপ করে থাকতে দেখে ভবেশদা নিজেই উত্তরটা দিয়ে দিলেন।
‘সেইদিনই আমাদের কলকাতা ব্রিটিশ রাজত্বের রাজধানীর তকমা হারায়। আর দিল্লি হয়ে যায় নতুন রাজধানী।’