৮. এখানেই শেষ নয়

এখানেই শেষ নয়

সপ্তাহটি নীলার কেটে যায় সংসারী গৃহবধুর মতো। সকাল সাতটায় রেডিয়োর খবর প্রতিদিন বেনোয়াকে ঘুম থেকে জাগায়, সঙ্গে নীলাকেও। একবার সে বলেছিল, রেডিয়োটা এমন বোমার মতো বেজে ওঠে, যে আঁতকে উঠি। ঘুম পুরো হয় না। বেনোয়া বলেছে, খুব বেশি ঘুমোও তুমি, বেশি ঘুমোলে শরীর ভারী হয়ে যায়। শরীর ভারী হয়ে যাবার ভয়ে, নীলা ঘুম থেকে উঠতে থাকে রেডিয়োর শব্দে। উঠে বেনোয়ার জন্য সকালের খাবার তৈরি করতে রান্নাঘরে ঢোকে। এক একদিন একেক রকম প্রাতরাশের ব্যবস্থা করে সে, বেনোয়ার রুচি পরিবর্তনের জন্য। ঠোঁটে চুমু খেয়ে ও আপিসে চলে গেলে নীলা ঘরদোর গোছায়, কাছের দোকান থেকে বেনোয়া যা যা ভালবাসে তা কিনে এনে রান্না করে, আর ঘড়ি দেখে বেনোয়ার ফিরে আসার, ফোনের শব্দ হলে লাফিয়ে যায় ফোন ধরতে। বেনোয়া জিজ্ঞেস করে কী কী করেছে নীলা সারাদিন, নীলা বিস্তারিত বর্ণনা করে। শেষে জিজ্ঞেস করে, আমাকে ভালবাসো? নীলা বলে, হ্যাঁ বাসে। দিনে বেশ কয়েকবার বেনোয়ার এই নিশ্চিতি দরকার হয়। সন্ধেয় ঘরে ফিরে বেনোয়া প্রথম নীলাকে জড়িয়ে চুমু খেয়ে নেয়, তারপর টেলিভিশন খুলে বসে, খাবার ডাক পড়লে খেতে আসে। টেলিভিশনে এর মধ্যে একদিন ভারতের ওপর একটি তথ্যচিত্র দেখিয়েছে, বেনোয়া লাফিয়ে উঠেছে, এসো এসো ভারত ভারত। নীলাকে দেখতে হয়েছে সোনাগাছির মেয়েদের মিছিল। ওদের অধিকার আন্দোলন নিয়ে মূলত তথ্যচিত্রটি। বেনোয়া দেখেছে আর বলেছে, ইস তোমাদের দেশে এত বেশ্যা! নীলা অন্য কথা পেড়েছে বেনোয়ার মন ফেরাতে, আজ তোমার জন্য শামুক কিনেছি। চেখে দেখার আগেই বেনোয়া উমমম উমমম করেছে। ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত শুনিয়ে বেনোয়াকে চমকিত করতে হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশি চাপিয়ে দিয়ে বেনোয়ার উল্লসিত হওয়া দেখতে তাকিয়ে থেকেছে নির্নিমেষ, বেনোয়া বলেছে, নীলা তুমি কিছু মনে কোরো না, আমি এটা পালটে দিচ্ছি, বলে ফরাসি গানের একটি সি ডি চাপিয়েছে, কেন তুমি চৌরাশিয়ার এমন ভাল বাঁশি পছন্দ করলে না? বেনোয়া দুঃখিত স্বরে শুধু বলেছে, ওয়েল নীলা, ইটস নট মাই কাপ অব টি। বেনোয়া তার ফরাসি কাপ অব টি একাই পান করেছে, একাই পান করে। নীলাকে একদিন হাতে খেতে দেখে বেনোয়া বড় বড় চোখ করে যেন আফ্রিকার জঙ্গল দেখছে তাকিয়েছিল বলে নীলা হাত ধুয়ে কাঁটা আর ছুরিতে খেতে শুরু করে, দেখে বেনোয়া সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে, হাতেই খাও না, লজ্জা কীসের, আমরা আর কবে থেকে কাঁটা ছুরিতে খাই! আমাদের আদি পুরুষেরা তো হাতেই খেত। ধরো এক হাজার বছর আগে, তখন কি আর কাঁটা ছুরি ছিল? বেনোয়ার পছন্দের খাবার সাজিয়ে দেয় নীলা টেবিলে, প্রতি রাতেই। বেনোয়া খেতে খেতে মন্তব্য করে, কোন খাবারটি কেমন হয়েছে। কাল যেটা করেছিলে সেটা বেশ স্বাদ হয়েছিল। কোনটা? ওই মাংসের কালিয়াটা? হ্যাঁ। নীলা পরদিন আবার মাংসের কালিয়া করে। রাতে বিছানায় ঘুমোতে গিয়ে নীলার শরীর নিয়ে বেনোয়া মেতে ওঠে। বেনোয়ার নতুন একটি আগ্রহ জন্মেছে, মৈথুনের পুরোটা সময় জুড়ে সে নীলার কন্ঠে বাংলা শুনতে চায়, তোমাকে ভালবাসি থেকে শুরু করে তোমাকে আরও চাই, আরও গভীরে, এরকম যত যৌনআবদার বা সুখার্তনাদ আছে, সব। বেনোয়া মানে বুঝবে না, কিন্তু তার শুনতে অন্যরকম লাগবে, অন্যরকম আনন্দ নাকি সে পায়ও এতে। বেনোয়াকে আনন্দ দিতে নীলা তাই করতে শুরু করে, এবং নিজের কাছে নিজের কণ্ঠকে অদ্ভুত লাগে তার, কারণ বাংলায় এ সব বাক্য বলার অভ্যেস তার নেই। নীলা অভ্যেস ঝেড়ে ফেলার চর্চা শুরু করে, রান্না করতে করতে, কাপড় ধুতে ধুতে, ঘর ঝাড়ু দিতে দিতে, জানালার কাচ মুছতে মুছতে। প্রায়ই বেনোয়া বলে ভারতীয় মেয়ের শরীরের আনাচে কানাচে অন্যরকম রহস্য, এই স্বাদই অন্য। এই অন্যরকমটি বেশ লাগে বেনোয়ার। পাসকালের সঙ্গে মিলনে ঠিক যেন এরকম হয় না। নীলার পুলক হয় শুনে যে অন্যরকম এক আনন্দ সে বেনোয়াকে দিতে পারছে, পাসকাল যে অন্যরকমটি দিতে পারে না। তারপর ঝড়ো রতি শেষে শুভরাত বলে চুমু খেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া। রেডিয়োর খবরে আঁতকে উঠে ভোরের চোখ খুলে সুপ্রভাত বলে আরও একটি চুমু খাও। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন চুমুগুলো রপ্ত করতে নীলার যদিও সময় লেগেছে, এ সপ্তাহে সে নিষ্ঠার সঙ্গে ফরাসি চুমু সংস্কৃতি পালন করেছে, যত হোক ফরাসি প্রেমিক নিয়ে সংসার করতে গেলে এটি না করলে যে চলে না সে জ্ঞান তার আছে। সপ্তাহের একটি বিকেল কাটে পিকাসো জাদুঘরে আর পমপিডুতে। পিকাসোর আঁকা ছবি দেখে নীলা কোনওরকম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না। বেনোয়া জিজ্ঞেস করলে শুধু বলে, দুটো মেয়ে সমুদ্রপাড়ে দৌড়োচ্ছে, এটি ছাড়া আর কোনও ছবিই তার ভাল লাগেনি। শুনে বেনোয়া বলেছে, বুঝতে গেলে শিল্পবোদ্ধা হতে হয়। নীলা শিল্পবোদ্ধা নয়, তাই সে পিকাসোর দড়ি, ছেঁড়া কাপড় আর পেরেক বসানো শিল্পগুলো দেখে মূর্খের মতো তাকিয়ে থেকেছে।

এত নামী শিল্পী, এত বড় মাপের মানুষ পিকাসো…

 নীলা বলে, বড় শিল্পী হয়তো, মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ছোট ছিলেন, ফ্রাসোয়াজ তো লিখে গেছে জীবন কেমন ছিল পিকাসোর। স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন, আর নিজের গৃহেই যুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছিলেন। অলগা, মারি তেরেস, ডোরা, ফ্রাসোয়াজ, জ্যাকলিন কাকে না ঠকিয়েছেন!

 বাহ তুমি তো আমাদের পিকাসো সম্পর্কে বেশ ভাল জানো।

 পিকাসো তোমাদের নয়, পিকাসো স্প্যানিশদের।

ওই একই, পশ্চিমের তো!

নীলা পুবের, পশ্চিমের একবারে উলটোদিকে, নীলার স্মরণ হয়েছে।

পমপিডুর আধুনিক শিল্পকলা দেখতে গিয়ে নীলার বিশ্বাস হয়নি এগুলো আদৌ কোনও শিল্প। প্রথম যে শিল্পের সামনে এসে সে থমকায় সে একটি গোরুর মাংসের জামা, পাতলা করে মাংস কেটে মাংসগুলোকে সেলাই করে একটি জামা বানানো হয়েছে, সেই জামা একটি মেয়েকে পরিয়ে ছবিও ভোলা হয়েছে। কেবল এই নয়, একটি ছেঁড়া কাগজে পেনসিলে হাবিজাবি লেখা, ব্যাস এটিকে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে, এ নাকি শিল্প। পুরনো ছেঁড়া কাপড়, ভাঙা রেডিয়ো, ফাটা টায়ার, সিগারেটের খালি প্যাকেট, মোটকথা আবর্জনার স্তূপ থেকে জিনিসপত্র কুড়িয়ে এনে জড়ো করে বলা হচ্ছে এ নাকি শিল্প। একটি নীল ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে নীলা অনেকক্ষণ খোঁজার চেষ্টা করেছে, কোনও একটি দাগ আছে কিনা ওতে, কোনও একটি বিন্দু অন্তত, নেই, এটি নাকি শিল্প! বেনোয়াকে জিজ্ঞেস করেছে, ক্যানভাসে তো আঁকা নেই কিছু, এটি শিল্প হয় কী করে। বেনোয়া বলেছে, নিশ্চয়ই শিল্প, তা না হলে এখানে রাখা হত না! নীলা যুক্তি খুঁজে পায় না। রাখা হলেই কি শিল্প হয়? আধুনিক শিল্পের ওপর আস্থা হারিয়ে তার বরং অনাধুনিক শিল্প দেখতে ভরেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। পরদিন ল্যুভরে চোখ এবং মন জুড়োতে গিয়ে মিশরের, গ্রিসের আফ্রিকার প্রাচীন শিল্পকর্মের সামনে দাঁড়িয়ে নীলা বলে, এখন তো আর উপনিবেশ নেই, এই লুটের মালগুলো এখন ফেরত দিয়ে দিলেই তো হয়! যে দেশের শিল্পকর্ম সে দেশেই থাকুক।

বেনোয়ার উত্তর, আমরা রক্ষা করেছি বলে জিনিসগুলো আছে, ও সব দেশে হলে জিনিসগুলো থাকত না।

কী হত থাকলে? পোকায় খেত? নীলা বলে।

নীলা ভাবে, সম্ভব হলে এরা মাটি খুঁড়ে পিরামিডও তুলে আনত মিশর থেকে।

সপ্তাহের একটি সন্ধ্যা বেনোয়াকে নিয়ে মরুনির বাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে আসে নীলা, ধনী এলাকার এভিন্যু দ্য প্রেসিডেন্ট উইলসনে মরুনির বাড়ি, বাড়িটি মরুনি তার ফরাসি বাবার কাছ থেকে উপহার পেয়েছে।

নেমন্তন্ন খেয়ে ফেরার পথে বেনোয়া যখন বলেছে, মরুনির ভাগ্য খুব ভাল।

 নীলা বলেছে, কেবল ভাগ্যটাই কি সব, ওর প্রতিভা ছিল বলেই ও বড় হয়েছে।

.

প্রতি সন্ধেতেই পাসকাল বাড়িতে ফোন করেছে, নীলা হ্যালো বলতেই বলেছে, আমি পাসকাল, বেনোয়া আছে? নীলা বেনোয়াকে ফোন দিয়েছে কথা বলতে, বৃহস্পতিবার রাতে পাসকালের ফোন পাবার পর বেনোয়া রু দ্য রেন-এ চলে গেছে থাকতে, ওখান থেকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছে, রাতে সে আর বাড়ি ফিরছে না।

পরদিন বাড়ি ফিরে এলে নীলা দু একটি মামুলি কথার পর বলেছে, কী পাসকালের সঙ্গে শোওনি কাল রাতে?

না।

কেন?

কেন মানে?

ওকে তুমি ভালবাসো, ওর সঙ্গে শুতে তোমার আপত্তি কী?

যেদিন থেকে তোমাকে ভালবেসেছি, সেদিন থেকে কেবল তোমার সঙ্গেই শুই, ওর সঙ্গে নয়। সেই সমুদ্র পাড় থেকে আসার পর ওর সঙ্গে শুইনি।

সমুদ্র পাড়ে যখন ছিলে, তখনও তো তুমি বলতে যে আমাকে ভালবাসো।

আচ্ছা নীলা তুমি এত পেঁচাচ্ছ কেন এ সব নিয়ে। তুমি কি চাও না জ্যাকলিনের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক থাক।

নিশ্চয়ই চাই। আমি কেবল জানতে চাইছি, দুজনের সঙ্গে যৌনসম্পর্কে যেতে তোমার অসুবিধে কী? ভালবাসলে যৌনসম্পর্কে যাওয়াটা তো যৌক্তিক মনে করো, আমার সঙ্গে তাই ওই সম্পর্কে গেছ।

আমি পাসকালের সঙ্গে শুইনি, তোমার ভাল লাগবে না বলে।

আমার ভাল লাগবে না বলে তুমি নিজের ইচ্ছেকে দাবিয়ে রেখেছ? নীলা জিভে চুক চুক শব্দ করে দুঃখ করে।

আর তা ছাড়া পাসকালও চায় না আমার সঙ্গে ও সম্পর্কে যেতে।

কী করে জানো পাসকাল চায়নি? ওকে জিজ্ঞেস করেছিলে? তুমি চেয়েছিলে আর ও না বলেছে, এই তো?

নীলা তুমি অতিরিক্ত কথা বলছ।

অতিরিক্ত নয়, আমার কথার উত্তর দাও, পাসকাল যদি চাইত, কী করতে?

মানে?

মানে পাসকাল যদি চাইত তোমার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করতে! তা হলে কী করতে? পাসকাল চায়নি বলে নিজের ইচ্ছেকে দমন করেছ, চাইলে তো সম্পর্কটি করতে, তাই না?

না করতাম না। কারণ আমি জানি তুমি ওর সঙ্গে শোয়াটা পছন্দ করো না।

 ধরো আমি যদি পছন্দ করি?

মানে?

মানে হল আমি খুব পছন্দ করব, তুমি যদি আজ রাতে পাসকালের সঙ্গে ঘুমোও। ওকে ভোগ করো।

হঠাৎ এ ব্যাপারটা পছন্দ করছ কেন? তুমি তো ওকে সহ্যই করতে পারো না। হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরো।

আমি হিংসায় জ্বলছি ভেবে তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ। আমি এখন ভারতীয় মেয়েদের তুমি যেমন জানো, ঠিক তেমন, সহনশীল, তেমন নিষ্ঠ, কর্মঠ, এবং অস্বাভাবিক রকমের উদার।

বেনোয়া গুম হয়ে অনেকক্ষণ বসে থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। ফিরল দু বোতল ওয়াইন আর এক থোকা গোলাপ হাতে নিয়ে। নীলার হাতে দিয়ে নরম স্বরে বলল, তোমাকে আমি ভালবাসি, এর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই।

নীলা ফুলগুলো শুঁকে বলল, এ দেশের ফুলে দেখেছি একেবারে কোনও ঘ্রাণ নেই। কেবল দেখতেই যা। আমাদের দেশে যে গোলাপ ফোটে, তাতে কী সুন্দর ঘ্রাণ থাকে।

এ সব তো কৃত্রিম ভাবে ফলানো, তাই। ঘ্রাণ যা আছে, কৃত্রিমতা সব শুষে নেয়। বলে নীলার চুলে আঙুল বুলিয়ে বেনোয়া বলে, তোমার ভেতরে কোনও কৃত্রিম কিছু নেই। তাই তোমাকে আমি প্রতিদিনই আরও বেশি করে ভালবাসছি।

তারপর খুব ধীরে ধীরে নীলাকে পাশে বসিয়ে পাশে শুইয়ে সে বলে যায় গত রাতে পাসকালের সঙ্গে তার কী কথা হয়েছে। ওর জন্য বেনোয়ার যে ভালবাসা, অনেক ভেবে সে দেখেছে এটি নেহাত বন্ধুত্বের, আর হৃদয়ের দুকুল উপচে ওঠা ভালবাসাটি নীলার জন্য। ও বাড়িতে রাত কাটানোটা তার উচিত হয়নি, এ সে বুঝেছে। নীলাকে কষ্ট দেওয়ার কোনও অধিকার তার নেই। পাসকাল তাকে বলেছে কোনওরকম দোদুল্যমানতার ভেতরে না থেকে যে কোনও একটি সম্পর্ক বেছে নিতে। যদিও এটি খুবই কঠিন একটি সিদ্ধান্ত এমন সাজানো সুন্দর সংসার জন্মের মতো ছেড়ে দেওয়া, তারপরও বেনোয়া নীলাকেই বেছে নিয়েছে। এখন পাসকালের সঙ্গে একটি সমঝোতার ডিভোর্সে যেতে হবে, ডিভোর্স এ দেশে হুট করে হয় না, ধীরে ধীরে এর মীমাংসা হবে, এ নিয়ে দুজনই উকিলের সঙ্গে কথা বলতে যাবে। জিনিসপত্র ভাগাভাগির ব্যাপারটিও মিটিয়ে ফেলবে, কঠিন নয় তেমন। মাঝে মাঝে বেনোয়া এবং পাসকালের যে কথা হবে তা জ্যাকলিনের ব্যাপারেই হবে। অন্য কোনও ব্যাপারে নয়। পাসকাল বলেছে সে একটা চাকরি জোগাড় করে নেবে, যতদিন না নতুন চাকরির ব্যবস্থা হয়, ততদিন বেনোয়ার ওপর নির্ভর করতে না চাইলেও করতে হবে। আর জ্যাকলিনের জন্য পিতার কর্তব্য তার পালন করতেই হবে যেহেতু এদেশে এরকমই নিয়ম। এ আর কদিনই বা, যেভাবে বড় হচ্ছে, খুব শিগরি চৌদ্দ পনেরোয় পড়বে, তারপর তো বাড়ি ছেড়েই দেবে, নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নেবে।

বেনোয়া শুধু বলেই ক্ষান্ত হয়নি, ফ্রেমে বাঁধানো পাসকালের ছবিটি টেবিল থেকে সরিয়ে খালি সুটকেসে ফেলে রাখে, যার ছবি তাকে একসময় ফেরত পাঠিয়ে দেবে, বলে।

.

সেদিনই সেই শুক্রবারে নীলার কাছে রেজেস্ট্রি ডাকে কিষানলালের উকিলের পাঠানো চিঠি আসে। নীলার সঙ্গে কিষানলালের বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরুর বার্তা। চিঠিটি হাতে নিয়ে বসে সে নিজের বুকের ধুকপুকির শব্দ শোনে অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ চোখের সামনের আলোগুলো ঝাপসা হয়ে হয়ে নিবে আসে। বেনোয়া সেই অন্ধকারে ফস করে আলো জ্বেলে দেয়, আমার ওপর তোমার বুঝি আস্থা নেই?

নীলার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বেনোয়া আবার বলে, আমার মতো করে তোমাকে এত ভাল কেউ বাসবে না নীলা। কেউ না। বেনোয়ার হাত দুটোয় নিজের হাত দুটো বড় কালো দেখায়।

আমি তোমাকে সর্বস্ব দিয়েছি নীলা। এই আমাকে দিয়েছি। আর কী চাও তুমি বলো! বেনোয়ার নীল চোখ দুটোয় অতলান্তিকের উতল ঢেউ।

বুকের ধুকপুকুনি কেটে যায়। নীলার মুখটি বেনোয়া নিজের দিকে ফেরায়। বিমুগ্ধ নয়নে মহীরুহ দর্শন করে তুচ্ছ তৃণ।

.

কলকাতা থেকে ফেরার পর প্রথম কলকাতার বাড়িতে নীলা ফোন করে, চিঠি পাওয়ার রাতে। উদ্দেশ্য ডিভোর্সের কথা জানানো, অনির্বাণ আর নিখিলের চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার করা, নীলা যে বেঁচে আছে, এবং ভালই বেঁচে আছে, সে খবরটি দেওয়া।

তুই? পশ্চিম দিকে সূর্য উঠল নাকি আজ? নীলার কণ্ঠ শুনে নিখিল বলে।

সূর্য পুবেও ওঠে না, পশ্চিমেও ওঠে না। সূর্য যে জায়গায় আছে, সেই জায়গায়ই থাকে, অন্যদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়। বলে নীলা।

তা বল, আছিস কেমন। শুনেছি তুই নাকি এক সাহেবের সঙ্গে থাকছিস!

সুনীল বলল তো! ও আমার ফোন নম্বর বা ঠিকানাও দিয়েছে নিশ্চয়ই।

নীলা জানাল, কিষানলালের সঙ্গে তার কাগজপত্রে বিচ্ছেদের ব্যবস্থার কথা। সাহেবকে নিয়ে সে সুখে আছে, শিগরি তাদের বিয়ে হবে। সুতরাং কলকাতায় কেউ যেন রটিয়ে না বেড়ায়, নীলা পতিতা হয়ে গেছে।

তোমার খবর কী দাদা? বিয়ে করছ নাকি? নীলা জিজ্ঞেস করে।

 মেয়ে দেখছি। গত মাসে পাঁচটি মেয়ে দেখেছি।

 পছন্দ হয়েছে কাউকে?

আরে না।

 কেন?

 পাঁচটিই কালো। হা কপাল।

পাঁচটি মেয়েই কালো বলে নিখিলের বিয়ে করা হয়নি। কোনও ফরসা মেয়ে পেলে তবেই নিখিল বিয়ে করবে, তার আগে নয়।

নীলা বলে, তুমি তো কালো।

 পুরুষেরা কালো হলে কিছু যায় আসে না।

নীলা মনে মনে বলে, তা ঠিক পুরুষেরা কালো হলে, কুৎসিত হলে, কদাকার হলে, অসৎ হলে, নিকৃষ্ট হলে, বদমাশ হলে, দুশ্চরিত্র হলে, দানব হলে, অমানুষ হলে, লম্পট হলে, লোচ্চা হলেও কিছু যায় আসে না।

.

উৎসবের দিন

বেনোয়ার ছাব্বিশতম জন্মদিন পালন করা হবে ঘটা করে, নীলার ইচ্ছে ভোজ উৎসবে কাকে কাকে নেমন্তন্ন করবে তার একটি লিস্টি তৈরি করে প্রথম।

১ . মরুনি
২ . ফ্রেডেরিক
৩ . দানিয়েল
৪ . নাতালি
৫ . নিকল
৬ . মিশেল কজ
৭ . রিতা
 ৮ . মোজাম্মেল
৯ . মোজাম্মেলের বন্ধুরা (৩ অথবা ৪)
১০ . সানাল এডামারুকু
 ১১ . বাবু গোগিনি
 ১২ . বাবু গোগিনির বউ
 ১৩ . তারিক
১৪ . অডিল
 ১৫ . চৈতালি
১৬ . সুনীল

মরুনি আর ফ্রেডেরিক জানিয়ে দেয়, তারা আসছে। দানিয়েল জানায়, মঙ্গলবার বিকেলে তার ইস্কুলে যেতে হবে, সুতরাং আসা হবে না। সম্প্রতি সে নতুন একটি ইস্কুলে ভর্তি হয়েছে, ওখানে সপ্তাহে তিন দিন ‘কী করিয়া সাহিত্য রচনা করিতে হয়’-এর ক্লাস করে। আর নাতালি যাচ্ছে সোলারিয়ামে, ওরও আসা হবে না।

সোলারিয়ামটা কী জিনিস? এ হল কৃত্রিম সূর্যরশ্মি গায়ে ফেলা, রং বাদামি করার জন্য। নিকল মিশেল রিতা এই তিনজনের দুজন প্যারিসে নেই, একজন জানাল, ঠিক এই দিনটিতে কোনও এক বন্ধুর সঙ্গে তার কফি খাবার কথা আছে, আর এ ব্যাপারটি পাকা হয়ে আছে গত চার মাস থেকে, সুতরাং হচ্ছে না। মোজাম্মেলকে নেমন্তন্ন করলে ও লাফিয়ে ওঠে খুশিতে, দিদি এতদিন কোথায় ছিলেন? কত ভেবেছি আপনার কথা! ওই বাক্সবন্দির কারখানায় খুঁজেও এসেছি দুদিন। মোজাম্মেলের উচ্ছ্বাসকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে নীলা বলে, মোজাম্মেল তার বন্ধুদেরও নিয়ে আসতে পারে। সানাল জানাল সে আসছে। সানালের কাছ থেকে জানল বাবু গোগিনি আর তার বউ হায়দ্রাবাদ গেছে। তারিকের নম্বর নিয়ে জানল, তারিক আর অডিল আসতে চেষ্টা করবে। চৈতালি আর সুনীলকে নেমন্তন্ন করার কথা প্রথম যদিও ভেবেছিল, দ্বিতীয়বার ভেবে, নামদুটো কেটে দেয়। মোট তার অতিথির সংখ্যা দাঁড়ায় সাত। বেনোয়া তার বন্ধু বা আত্মীয় কাকে কাকে নেমন্তন্ন করতে চায় জিজ্ঞেস করলে, বলে, এই আগস্ট মাসে কেউ কি প্যারিসে থাকে নাকি! প্যারিস খালি হয়ে গেছে, পাসকালও আগস্ট কাটাতে চলে যাচ্ছে ক্যানারি দ্বীপে। বেনোয়ার ক্যানারি দ্বীপ দেখার খুব ইচ্ছে ছিল, এবার নীলার কারণেই তার যাওয়া হচ্ছে না।

উৎসবের আয়োজনে বিষম ব্যস্ত নীলা। মোজাম্মেল খবর নিয়ে জানিয়েছে বাজার সদাই করা আর রান্নায় সাহায্য করতে সে আগে ভাগেই চলে আসতে পারে। নীলা সায় দিল।

উৎসবের দিন দুপুরবেলাতেই মোজাম্মেল জুয়েলকে নিয়ে আসে, জুয়েলকে নীলা দেখেছে কিষানের রেস্তোরাঁয়, বাচ্চা বাচ্চা মুখের ছেলে, মেট্রোয় ফল বিক্রি করা পুলিশের জ্বালায় যার হয়ে ওঠেনি। জুয়েল পেঁয়াজ কাটায় লেগে গেল। ঘরে তো আদা নেই, মোজাম্মেল আদা কিনতে দৌড়োল, আদা নিয়ে আর বেনোয়ার জন্য একটি উপহারের প্যাকেট নিয়ে ফিরল। ছোটখাটো ফরসা মুখের বাইশ কি তেইশ বছর হবে বয়স জুয়েলের, মন দিয়ে পেঁয়াজ কাটল, রসুনও, জিজ্ঞেস করল মাংসটা কি সেই রেঁধে ফেলবে নাকি। রেস্তোরাঁয় কাজ করছে, রান্না শিখেছে, জুয়েলই মাংস রাঁধে। নীলা রুই মাছ ভাজে কড়াইয়ে। সপ্ত ব্যঞ্জন নয়, আয়োজন সপ্তদশ ব্যঞ্জনের। রান্নাঘরেই বনভোজনীয় উৎসব শুরু হয় তিন বাঙালির। রবীন্দ্রসংগীতে দোল খেতে খেতে রান্না শেষ হয়, সন্ধেও পেরিয়ে যায়। সন্ধের মুখে তারিক ফোন করে বলে, পুত্রধনের সিজোফ্রেনিয়া রোগ হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়েছে, মন মেজাজ ভাল নেই, আসা হচ্ছে না।

প্রচুর খাবার নষ্ট হবে গো! নীলা ফোন রেখে বলে।

মোজাম্মেল জিজ্ঞেস করে, একটি ছেলের সঙ্গে তার নতুন পরিচয় হয়েছে, নাম মডিবো, ওকে ডাকবে কি না। মাথা চুলকে বলে, ও কিন্তু কালো। মডিবো মালি থেকে খুব বেশিদিন হয়নি এসেছে। বেচারা পুলিশের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে থাকে, টাকা পয়সা নেই, ভাল খেতে পায় না।

নীলা আজ উদারহস্ত। মডিবো কেন, পারলে জডিবো সডিবো, সবাইকে ডাকুন।

.

বেনোয়া বিকেল হতেই নীলার দেওয়া নতুন প্যান্ট শার্ট পরে, টাই লাগিয়ে তৈরি হয়। নীলা নতুন একটি বালুচরি পরে।

অতিথিরা এসে গেলে শ্যাম্পেনের ফোয়ারা ওঠে ঘরে। ট্রেসি চ্যাপমেনের রেভুলশন নেপথ্যে। উৎসবের মধ্যমণি বেনোয়া। উপহার এদেশে হাতে পড়ামাত্র খোলার নিয়ম, সানাল তার জন্য এনেছে ভারতীয় মৃত্তিকাশিল্প, ইলোরা অজন্তার মিথুনমূর্তি আদলে। আর মোজাম্মেলের প্যাকেট থেকে বের হয় বুট, বেনোয়া প্রত্যেককে বাহ বেশ সুন্দর তো, বেশ ভাল তো, বলে বলে ধন্যবাদ দেয়। যদিও নীলা জানে, অন্তত অডি তয়লেত ব্রুট বেনোয়ার কাপ অব টি নয়। নীলার উপহারটি একবারে ছোট্ট, লাল কাগজে মোড়া। ওটি ঠিক এক্ষুনি খোলার অনুরোধ করে নীলা। হো হো হাসির রোল, সানালের এক চোখ স্বভাবতই ছোট হয়। নীল বেনোয়াকে ভরা আসরে ঠিক ফরাসি নয়, এই চুমুটি বাঙালি বলে শুকনো একটি চুমু খেয়ে বলে, এই চুমুতে লালা আর লালসা খানিকটা কম।

জন্মদিন বিষয়ে সানাল তার মত প্রকাশ করে, এই দিনটি খুব দুঃখের একটি দিন, এই দিনটি মনে করিয়ে দেয় মৃত্যুর দিকে একটি বছর এগিয়ে যাওয়া হল। সানাল নিজের জন্মদিনে শোক উৎসবের আয়োজন করে, নিজেই নিজেকে নিমন্ত্রণ করে, একা ঘরে দরজা জানালা সেঁটে অন্ধকারে বসে থাকে, উৎসবের নিয়ম হচ্ছে, সারাদিন উপোস থাকতে হবে, টেলিফোনের প্লাগ খুলে নিতে হবে, টেলিভিশনের রিমোট কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলতে হবে। মডিবো, নিকষ কালো অবৈধ ইমিগ্রেন্ট বড় বড় কালো চোখ আর ভোঁতা নাক নিয়ে ট্রেসি চ্যাপমেনের মতো নেপথ্যে থেকে যায়। হাতে গেলাস বটে, গেলাসের শ্যাম্পেন শেষ হয়ে গেলেও মুখ বুজে থাকে। নীলা লক্ষ করে মডিবোকে। সানাল চোস্ত হিন্দিতে বলে, এই হনুমানটাকে এখানে কে নেমন্তন্ন করেছে? সানালের মন্তব্যে মোজাম্মেল আর জুয়েল হেসে কুটিকুটি। নীলা মডিবোর গেলাসে শ্যাম্পেন ঢেলে দিয়ে বলে, আমি।

বাঙালি মশলার খাবারে বরদো নাকি ভাল যায়, বেনোয়ার তাই মত। একটি পর একটি বরদো শেষ হতে থাকে। উৎসব উৎসবের মতোই মাতাল ও রঙিন হয়ে ওঠে। রাত বারোটায় দিকে মরুনি, ফ্রেডেরিক আর সানাল চলে যায়। যাবার আগে, সানাল নীলাকে অভিনন্দন জানায় কারণ নীলার ফরাসি জ্যাকুয়েস লিভস ইন বরদুয়েক্স-এর পর্যায় থেকে যথেষ্ট ওপরে উঠেছে।

সানালের অভিনন্দনের জবাব দেয় নীলা মেরসি বিয়াকুপ বলে।

উৎসবে তুমুল হর্ষধ্বনি।

 বেনোয়া শোবার ঘরে চলে যাবার পরও নীলা মোজাম্মেল, জুয়েল আর মডিবোকে নিয়ে আরও রাত পার করতে থাকে। মোজাম্মেল সেই রাঁধুনি বাচ্চুর খবর দেয়, ফ্রান্সে কাগজ পায়নি, তাই ইতালি যাচ্ছিল, দালালকে প্রচুর টাকা দিয়ে ইতালি যাবার ব্যবস্থা করেছিল, দালালই বলে দিয়েছিল কী করে যেতে হবে, কখন দৌড়োতে হবে, কখন লাফিয়ে পড়তে হবে, সব। ইতালির সীমানায় পৌঁছোনোর আগে ট্রেন থেকে অন্ধকারে লাফ দিয়েছিল বাচ্চু, যা নিয়ম। তারপর ট্রেন চলে গেলে লাইনের ওপর দৌড়োনো, পেছনে কোনও ট্রেন এলে, আবার ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়া। এই করে যা হোক, কিছুটা এগিয়েছিল, পেছন থেকে বেমক্কা ধাক্কা দিয়েছে একটি ট্রেন, বাচ্চু ওখানেই শেষ।

মীলার বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে।

জুয়েলের এ দেশে আসার গল্পটি শুনতে শুনতে নীলা গেলাসে আরও ওয়াইন ঢালে।

জুয়েল ঢাকা থেকে মস্কো গিয়েছিল, মস্কো থেকে সবজির ট্রাকে করে পৌঁছেছে রুমানিয়ার এক শহরে, ওখান থেকে সীমানা পার হয়ে চেক রিপাবলিকের দিকে, তারপর ওখান থেকেই বরফের পথে সীমানা পার হয়ে জার্মানি। জুয়েলের ভাই রুবেল ছিল জুয়েলের সঙ্গে। জীবনে এর আগে কখনও কখনই বরফই দেখেনি, না জুয়েল, না রুবেল। দ্রুত দৌড়োত পারবে ভেবে জুতো খুলে দৌড়েছিল রুবেল, বরফের কামড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে ওখানেই…

নীলার মনোযোগ ভাঙে বেনোয়ার ডাকে।

শোবার ঘরে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে বেনোয়া, চোখে আর কপালে পনোরোটির জায়গায় ষোলোটি ভাঁজ, বাড়তিটি ছাব্বিশে পড়ার।

কারা এরা? কী এত কথা বলছ এদের সঙ্গে? দেখছ না এখানে একা বসে আছি!

বেনোয়ার বুকের ওপর ওয়ান্ডা বসা। নীলা বলে, একা নও তো, ওয়ান্ডা আছে।

 বেনোয়া কটমট চোখে তাকায় নীলার দিকে। নীলা বলে, ও ঘরে চলো।

 ও ঘরে যাব কেন? কী ভাষায় কথা বলছ ও সব!

বাংলায়। অনেকদিন বাংলা বলি না। বলতে ভাল লাগছে।

 আমি যখন তোমাকে বাংলা শোনাতে বলি, তখন তো বলো না।

তুমি তো বাংলা বোঝো না বেনোয়া। তুমি তো বাঙালি নও।

তা আগে বলতে আমাকে যে বাঙালির আড্ডার আয়োজন করেছ।

বাঙালির আড্ডার আয়োজন করলে মরুনি, ফ্রেডেরিক আর সানালকে ডাকতাম না। মডিবোর তো প্রশ্ন ওঠে না। ও জানেই না, বাংলা বলে জগতে কোনও ভাষা আছে।

তোমার বন্ধুদের তুমি খাওয়াবে, ওদের সঙ্গে আড্ডা দেবে, আসল উদ্দেশ্য তো এটাই ছিল। খামোকা আমার জন্মদিনের উৎসব করছ, তা বলার কী দরকার ছিল?

নীলা কোনও উত্তর না দিয়ে ও ঘরে জুয়েলের বাকি গল্প শুনতে যায়। পুলিশ এসে রুবেলকে তুলে নিয়ে যায়, রুবেলের পা কেটে ফেলতে হয়, দু পা-ই। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়ে পা পচে যাচ্ছিল। চিকিৎসার পর রুবেলকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে জার্মান সরকার। জমি জিরেত বিক্রি করে লক্ষ টাকা খরচ করে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করার স্বপ্ন দেখে ঢাকা ছেড়েছিল রুবেল, আর তাকে ঢাকায় পৌঁছোতে হল অর্থনৈতিক, শারীরিক, আর মানসিক পঙ্গুত্ব নিয়ে।

কুড়ি বছর বয়স ছিল রুবেলের। মোজাম্মেল বলে।

জুয়েল জুতো পরে দৌড়েছিল বলে বরফের কামড় থেকে বেঁচেছে, পুলিশের চোখ থেকেও। জার্মানি থেকে পালিয়ে ফ্রান্সে এসেছে। পুলিশ যে কোনও দিন ঘাড় ধরে পাঠিয়ে দিতে পারে দেশে, অনিশ্চয়তা প্রতি মুহূর্তে। ফেরতই যদি যেতে হয় দেশে, একটিই স্বপ্ন তার, যেন পঙ্গু না হয়ে ফেরত যেতে পারে।

 মডিবোও ভবিষ্যৎ গড়তে এদেশে এসেছে, তমবকটু শহরে স্রোতস্বিনী নাইজেরের তীরে শৈশব কৈশোর ফেলে। মডিবো সোনকনোর পুরু ঠোঁট ঝুলে থাকে তার ভবিষ্যতের মতো। পুলিশ থেকে পালিয়ে, বাতিল বাড়ির অন্ধকার কোঠায় ঘুমিয়ে, গির্জার দাঁতব্য খাবার খেয়ে মডিবো বেঁচে থাকছে। গায়ে শক্তি আছে, মনে সাহস, এ দুটোও দিন দিন ঠোঁটের মতো ঝুলে পড়ছে।

এ সময় সবাইকে হতবাক করে বেনোয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, কোথায় যাচ্ছ এত রাতে? কী হল কী? বলতে বলতে নীলা পেছনে পেছনে দৌড়েছিল। নাগাল পায়নি, কনকর্ডের চেয়েও দ্রুত গতি ছিল বেনোয়ার প্রস্থানের।

মডিবোর গল্প মাঝপথে থামাতে হয়। ওদের চলে যেতে হয়। বেনোয়ার গতি এক গুমোট হাওয়া ফেলে গেছে পেছনে, এ হাওয়া সবাইকেই, নীলাকেও উদ্বিগ্ন করে।

বেনোয়া মিনিট পনেরো পর ফোন করে লোকগুলো গেছে কি না জিজ্ঞেস করে, গেছে নিশ্চিত হয়ে, বাড়ি ফেরে।

ওরা সারারাত থেকে যেতে চেয়েছিল নাকি? তোমার আড্ডাবাজির উৎসব তো শেষ হতেই চাইছিল না। দিনটাই মাটি হল। পাসকাল চেয়েছিল আমাকে রেস্তোরাঁয় নিয়ে যেতে। তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে যাইনি। জ্যাকলিন জন্মে প্রথম দেখল, আমার জন্মদিনের দিন আমি ওর কাছে নেই। পাসকাল আজ সারাদিন আমাকে মনে করে কেঁদেছে। আর আমাকে তোমার এই রঙ্গ দেখতে হল।

নীলা বলে, তোমাকে তো আমি না করিনি ও বাড়িতে যেতে।

করোনি, কিন্তু চাও না তো! গেলেই তুমি জিজ্ঞেস করবে পাসকালের সঙ্গে শুয়েছি কি না। তোমার তো শোয়া ছাড়া আর কিছু মাথায় নেই।

গেলাসে ওয়াইন নিয়ে বিছানার সামনের সোফায় বেনোয়া ষোলো ভাঁজ নিয়ে বসে পান করে।

তুমি যে কী করো, তার মাথামুণ্ডু আমি কিছু বুঝি না, কী দিয়েছ আমাকে এটা কাগজে মুড়িয়ে? কীসের চাবি এটি। চাবিটি নীলার দিকে ছুঁড়ে দেয় বেনোয়া।

বেনোয়ার হাতে রেনো, মডেল অথেনটিক ১৪, ১৩৯ জি/কিলোমিটার, পাঁচ দরজা লেখা ডিলারের কাগজখানা দিয়ে নীলা বলে, কাল যে কোনও সময় গিয়ে গাড়িটি নিয়ে এসো।

.

নীলা শুতে যায়। ক্লান্ত সে।

.

অভিমান

কী জানো তুমি গাড়ির? একা একা গাড়ি কিনতে গেলে কেন? আমাকে বললেই পারতে? পুরো সকাল বেনোয়া চেঁচাল।

কেন গাড়িটি কি কাপুত হয়ে আছে? চলে না?

এ টাকায় আরও ভাল পাওয়া যেত। তুমি ঠকেছ।

নীলা হেসে বলে, আমি সারাজীবন ঠকেছি বেনোয়া। ঠকে আমার অভ্যেস আছে।

বেনোয়ার গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, তুমি খুশি হওনি?

 নীলার বাহুদুটো ছাড়িয়ে বেনোয়া দূরে গিয়ে বসে বলে, শোনো এরকম আর করবে, আমাকে না জানিয়ে অচেনা লোককে বাড়িতে ডাকবে না। আজকাল প্যারিসে অনেক চুরি ডাকাতি হচ্ছে।

.

দেড় সপ্তাহের ছুটি পেয়েছে বেনোয়া। এই ছুটিতে সে কী করবে, জানে না। ফোনে স্ত্রী কন্যার খবর নেয় সকাল বিকাল। ওরা দ্বীপে পৌঁছেছে, সমুদ্রে সাঁতার কাটছে, ভাল হোটেলে আছে।

প্যারিস খাঁ খাঁ করে, বেনোয়ার মনও খাঁ খাঁ করে। সে কখনও আগস্টের ছুটিতে প্যারিসে কাটায়নি।

নীলা বলে চলো মিউচুয়ালিতে তে যাই, ওখানে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে।

ছোঃ নারীবাদীদের অনুষ্ঠান। ওখানে খামোখা চিকন গলায় দাবি করবে এই চাই সেই চাই, এরা তুষ্ট হয় না কখনও। যতসব সমকামী আর কুৎসিত দেখতে মেয়েদের জমায়েত ওখানটায়।

বিজ্ঞাপনে মেয়েদের শরীর ব্যবহার করা যাবে না, কোনও যৌন ইঙ্গিত চলবে না, যে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সুড়সুড়ি জাগানো বিজ্ঞাপন দেবে তাদের দ্রব্যসামগ্রী বর্জনের পক্ষে জোর হাততালি পড়বে আজ মিউচুয়ালিতেতে, আজকের অনুষ্ঠানটিই এ নিয়ে। যৌন ব্যাপারটি নীলার কাছে মোটে অনাকর্ষণীয় মনে হয় না। ভারতে যৌনতা হচ্ছে নিষিদ্ধ জিনিস, ইয়োরোপে নয়, শরীর এবং মনের এই স্বাধীনতা ইয়োরোপে আছে বলেই নীলার মনে হয় যৌন কেলেঙ্কারি এখানে কম ঘটে, যে স্বচ্ছন্দে এ দেশে মেয়েরা স্বল্প পোশাকে হেঁটে বেড়ায়, তা ভারতে সম্ভব নয়। নীলার ইচ্ছে করে যেমন ইচ্ছে তেমন পোশাক পরতে। উলঙ্গ হতে ইচ্ছে করলে উলঙ্গ হবার অধিকার তার থাকবে না কেন। মেয়েরা গা ঢেকে রাখলেও, বিজ্ঞাপন যৌনহীন হলেও পুরুষের মনে যৌনকামনা জাগবে। বড় ব্যাপার হচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, সেটি থাকলে কোনও কিছুতে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে না। নীলা ভাবে, যদি মিঠুর নিশ্চল শরীরটি নিয়ে আজ মিউচুয়ালিতেতে রাখা যেত! যদি মলিনার পুরো জীবনের গল্প শোনানো যেত শ্রোতাদের। মলিনাকে বা মিঠুকে কেউ যৌনসামগ্রী হিসেবে বিবেচনা করেনি। কেউ ওদের দিকে লোভের হাত বাড়ায়নি! অথচ এক অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত কাটাতে হয়েছে মলিনাকে, মিঠুকেও। যৌনতাকে একরকম সম্পদ বলে মনে হয় নীলার, যৌনবোধ আছে বলেই, নীলা যৌনসুখ দিতে পারে বলেই বেনোয়া তাকে ভালবাসছে। তা না হলে, দুর্বিষহ একাকিত্ব নিয়ে মলিনার মতো জীবন পার করতে হত, অথবা করতে হত মিঠুর মতো আত্মহত্যা। কীটের মূল্যও সম্ভবত জুটত না নীলার, বেড়াল কুকুরের মূল্যও নয়। ওয়ান্ডাকে যেভাবে আদর করে বেনোয়া, নীলাকে করত না, যদি না নীলার স্তন এবং জঙ্ঘায়, নীলার যোনিরসে, যোনিদেশে অপার আনন্দের খোঁজ না পেত। ভালবাসার বড় কাঙাল সে, ভালবাসা পাওয়ার জন্য যৌনতার যদি প্রয়োজন হয় হোক।

হঠাৎ সুনীলের মুখটি চোখের সামনে ভাসে নীলার, গা গুলিয়ে ওঠে।

 আমার কিন্তু ও অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা। তুমি না গেলে বরং আমি একা যাই।

তুমি একা যেতে চাচ্ছ? আর আমি ঘরে একা বসে থেকে আমার ছুটিগুলো নষ্ট করব?

নীলার মিউচুয়ালিতেতে যাওয়া হয় না।

থমথমে দিন পেরোয়, পরদিনও। তার পরদিন বেনোয়া তার রু দ্য রেনের বাড়ি যায় কিছু নাকি কাগজপত্র আছে, গোছাতে। বাড়িতে নীলার একা লাগে খুব, সে বেরিয়ে যায়, বেরিয়ে এদিক ওদিক হেঁটে ঢোকে ক্যাটাকম্বে। মানুষের হাড়ে সাজানো পাতাল। মাটির তলে অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে দুপাশে রাখা কোটি কোটি মানুষের হাড়, খুলি দেখতে দেখতে সে নিশ্বাসের শব্দ শোনে, মৃত্যুর, মৃত্যু যেন তার কাঁধে এসে বসেছে, যেন তার পিঠের ওপর চড়েছে, নীলার হঠাৎ মনে হয় সে বেঁচে নেই। বুঝি সে ওখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে হাড় হয়ে গেছে, লক্ষ লক্ষ অচেনা হাড়ের সঙ্গে তার হাড়ও মিশে গেছে। দ্রুত সে পাতাল ছাড়ে। বাড়ি ফেরে। স্নান করে গা থেকে হাড়ের গন্ধ দূর করে আলোর দিকে মুখ করে বসে থাকে বারান্দায়, ট্রেসির ভারী গলায় গাওয়া গানটি তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়, ইফ ইউ থিঙ্ক অব মি, ইফ ইউ মিস মি ওয়ান্স ইন এ হোয়াইল, দেন আই উইল রিটার্ন টু ইউ, আই উইল রিটার্ন অ্যান্ড ফিল দেট স্পেস ইন ইওর হার্ট, রিমেমবারিং ইওর টাচ ইওর কিস ইওর ওয়ার্ম এমব্রেস আই উইল ফাইন্ড মাই ওয়ে ব্যাক টু ইউ ইট উড ফিল সো গুড টু বি ইন ইওর আর্মস হোয়ার অল মাই জানিস এন্ড…।

বেনোয়া ফিরে এলে, ওর মন খারাপ করা মুখের দিকে তাকিয়ে নীলা বলে, চলো ইতালি থেকে ঘুরে আসি। এ মুহূর্তে দেশের বাইরে যাওয়ার মতো কোনও টাকা নেই বেনোয়ার, জানায়। স্ত্রী কন্যাকে ক্যানারি দ্বীপে পাঠানোয় অনেক টাকা বেরিয়ে গেছে।

এ কোনও ব্যাপার হল, আমার কাছে আছে তো।

তা হলে তুমি যাও।

আমি একা যাব তুমি ভাবলে কী করে?

বেনোয়া বিষণ্ণ গলায় বলে, আমার যে দিন টাকা হবে সে দিন যাব।

 সে তো আর একসঙ্গে যাওয়া হল না!

এ আমার স্বপ্ন, জানো নীলা, আমরা দুজন কোথাও দূর দেশে হারিয়ে যাব, কেবল দুজন আমরা, চেনা কেউ নেই আশেপাশে, আমরা দুজন দুজনে ডুবে থাকব দিন রাত, এর চেয়ে কাঙ্ক্ষিত কিছু নেই আমার জীবনে, কিন্তু স্বপ্ন অনেক সময় স্বপ্নই থাকে।

বেনোয়ার স্বপ্নালু চোখে তাকিয়ে নীলা বলে, আমাকে কি তুমি আপন ভাবো না? এ তোমার টাকা ও আমার টাকা, এমন করে ভাবো কেন? আমি তো ভাবতে পারি না। আমি তো হিসেব করি না এ ভাবে।

বেনোয়া ম্লান হেসে বলে, ঠিক আছে তুমি এত যখন চাচ্ছ যেতে, চলো।

পত্রিকায় ডগসিটারের বিজ্ঞাপন খুঁজে ওয়ান্ডাকে রু দালেসিয়ায় এক ডগসিটারের কাছে দিনে পঞ্চাশ ফ্রাঁ দরে রাখা হল। এই পুরো মাসটি প্যারিসে কুকুর বেড়াল সিটারের ব্যবসা রীতিমতো রমরমা হয়ে ওঠে।

নীলার হাতে কার্তে ব্লু। বাড়ির পাশে ম্যাগিক্লার্ন। বেনোয়ার দুপাটি হলুদ দাঁত বিকশিত হয় হাতে যখন প্যারিস রোম ফ্লোরেন্স ভেনিসের টিকিট পড়ে।

ইতালি ইতালি ব্লু ব্লু।

ও নীলা, তুমি আমাকে সত্যিই এত ভালবাসো। এ আমার সৌভাগ্য যে আমি তোমার ভালবাসা পেয়েছি।

ফরাসি চুমুর ধকল যায় নীলার ওপর।       

.

বিমানবন্দর থেকে পুরনো রোমের পাঁচতারা হোটেল গালিওর স্যুট। কুজিনো ইতালিয়ানোতে খেয়ে, কলুসিয়ামে ঘুরে, রোমান সভ্যতা বা অসভ্যতার নিদর্শন দেখে, ফন্তানা দ্য ত্রেভির জলে পয়সা ছুড়ে, স্প্যানিশ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছোটবেলার সেই দাঁড়িয়ে থাকাটি এই সিঁড়ির কাছে কি না ভেবে, ভ্যাটিকেন সিটির গির্জায় মাথা নত করে বুকে ক্রশ করে বেনোয়া। সিসটিন চ্যাপেল থেকে বিমোহিত নীলাকে সরিয়ে নিয়ে শহরের আরও কিছু ভেঙে পড়া রোমান সভ্যতা দেখে চোখ জুড়িয়ে হোটেলে ফিরে শাতো মার্গোর স্বাদগন্ধসৌন্দর্য পান করতে করতে সদ্যস্নাত স্নিগ্ধ নীলাকে বলে, তোমাকে মনে হচ্ছে স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক অক্ষতযোনি সুন্দরী।

নীলা বলে, আমি এই মর্তলোকের এক ক্ষতযোনি অসুন্দরী।

বেনোয়া নীলাকে নিজের কোলে বসিয়ে বলে, ও রূপসি মেয়ে, তুমি কি একটু পান করবে না এই স্বর্গীয় সুধা। তুমি যে কী হারাচ্ছ, সে যদি বুঝতে।

শাতো মার্গো হারালে আমার কিছু যায় আসে না, তোমাকে যেন না হারাই।

মদির নীল চোখের সুধা পান করতে করতে বলে নীলা।

বেনোয়া চুমু খায় নীলার ঠোঁটে চিবুকে, স্তনে, স্তনবৃন্তে। এক হাতে শাতো মার্গোর গেলাস, আরেক হাতে নীলা। অসম্ভব সুখী দেখায় বেনোয়াকে।

.

রোম থেকে ফ্লোরেন্সে গিয়ে নীলা বিষম উত্তেজিত। ডেভিডকে সাধ মিটিয়ে দেখবে সে, তার স্বপ্নের ডেভিড।

মিউজি উফিজি সেরে, মিকেলেঞ্জেলোর ডেভিডের চারপাশ ঘোরে নীলা, ঘণ্টা পার করে ডেভিডে।

এত কী দেখো! চলো বেরোই। বেনোয়া তাড়া দেয়।

একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ, ডেভিড কিন্তু নিখুঁত নয়। ডান হাতটা দেখো, অতিরিক্ত বড়। নীলা ডেভিড থেকে চোখ না সরিয়ে বলে।

বেনোয়া বলে, এ থাকেই কারও কারও, আমার পুরুষাঙ্গও তো তুলনায় বড়। তুমি তো বলো, ওটির কারণে আমাকে নাকি সাংঘাতিক ভাল লাগে তোমার!

নীলা হেসে বলে, বলেছিলাম।

জাদুঘর থেকে বেরিয়ে বেনোয়া বলে, তুমি খামোকাই এখানে সারা দিনটাই নষ্ট করলে।

ভাড়া গাড়ির চালকের গদিতে বসে, বেনোয়া শব্দ করে শ্বাস ছাড়ে, তা মাদাম কোথায় যাবেন এখন?

তুমি চলো, যেখানে খুশি।

 আমার খুশিমতো কিছু কি আর হয়? তুমি বলো।

তোমার খুশিমতো কিছু হয় না? তুমি কি জাদুঘরে যাওয়া পছন্দ করোনি।

আমার এ সব জাদুঘর টাদুঘর ভাল লাগে না। তুমি পছন্দ করো, তাই গিয়েছি।

তা হলে কোথায় যেতে চাও, চলো।

না সময় নেই।

সময় থাকলে কোথায় যেতে?

সে আর বলে লাভ কী? আচ্ছা নীলা তুমি গাড়ি চালাও না কেন?

আমি চালাতে জানি না।

তুমি না বলেছ, কলকাতায় তোমাদের গাড়ি আছে।

 আছে, সে ড্রাইভার চালায়।

বেশ ধনী তোমরা, তাই না?

 গরিব দেশ, যাদের গাড়ি আছে, প্রায় সবাই চালক রাখে। খুব একটা খরচ না।

তুমি বলেছিলে, কাজের লোকও আছে তোমাদের বাড়িতে। নিশ্চয়ই তোমরা অনেক ধনী।

ওই একই উত্তর। কাজের লোক রাখতে খুব একটা পয়সা খরচ হয় না। ওখানে সবই সস্তায় পাওয়া যায়।

মানুষও সম্ভবত! আচ্ছা ওখানে ক্রীতদাসপ্রথা আছে, তাই না?

না।

গাড়িচালকের চাকরি দিয়েছ আমাকে। কোথায় যেতে হবে বলো, নিয়ে যাই। ম্যাপ আছে হাতের কাছে, দেখে খুঁজে বার করব ঠিকানা।

নীলা উত্তর দেয় না।

তুমি টাকা দিয়ে ভালবাসা কিনতে চাও নীলা। বেনোয়া উদ্দেশ্যহীন গাড়ি চালাতে চালাতে বলল।

কী জানি! হয়তো আমি তোমাকে জিগোলো ভাবছি!

অসভ্যের মতো কথা বলো না।

টাকা খরচা করছি তোমাকে ভালবেসে। তুমি কি ভয় পাচ্ছ ভেবে যে তোমার হয়তো কোনও বিনিময় দিতে হবে? ভয় পেও না, তোমার কিছু দিতে হবে না।

বেনোয়া চোয়াল শক্ত করে বলে, তুমি খুব স্বার্থপর। ইতালিতে বেড়াতে এসেছ, আমাকে এনেছ তোমার স্বার্থে। আমাকে তোমায় গাড়ির চালক হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এনেছ। তুমি আমাকে ভালবাসো না নীলা, তুমি আমাকে ব্যবহার করছ। কেবল আমিই তোমাকে ভালবাসি, উন্মাদের মতো ভালবাসি।

.

ফ্লোরেন্সে বাকি দুদিন থমথমে সময় কাটিয়ে ভেনিসে গেল দুজন। ভেনিসে কোনও গাড়ি ভাড়া করল না নীলা। দরকারও নেই। জলে থইথই করছে সব, গাড়িঘোড়া যা চলে, জলের ওপর চলে। নীলা স্বস্তি পায় এই ভেবে যে অন্তত বেনোয়া একরকম মুক্তি পেল চালক হওয়ার অপমান থেকে। এবার কী করবে, চলো গণ্ডোলায় ঘুরে বেড়াই। গণ্ডোলায় করে ভেনিসের প্রাসাদ দেখা, আস্তর খসে পড়া কদাকার বাড়ি দেখা, কারাগার দেখা সবই হল। ভেনেসিয়ানরা আর ভেনিসে থাকে না, চলে গেছে পাদোবায়, বা আশেপাশের গ্রামে, ভেনিসে এত চড়া দামে জীবনযাপন সম্ভব নয় ওদের। আমেরিকান আর জাপানের ধনীরা এসে ভেনেসিয়ানদের বাড়িঘর কিনে নিয়েছে, সারাবছর জানালা বন্ধ থাকে বাড়িগুলোর, বছরে একবার জানালা খোলে, ধনীদের যখন গণ্ডোলায় ভেসে বেড়াবার শখ হয়।

দীর্ঘশ্বাসের সেতুতে হাঁটতে গিয়ে নীলা দাঁড়ায়। জানো ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতা লিখেছেন এই দীর্ঘশ্বাসের সেতু নিয়ে। প্রাসাদ থেকে বন্দিরা কারাগারে ঢুকতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলত এই সেতুতে দাঁড়িয়ে, শেষবারের মতো দেখে নিত নীল লেগুন। আহা।

নীলা আহা বলল একশো কবুতরের সঙ্গে দাঁড়িয়ে প্রাসাদের পেছনের চত্তরে, উড়িয়ে দিয়ে ঝাঁক ঝাঁক কবুতর।

কী ব্যাপার, কবুতরদের ওড়াচ্ছ কেন এভাবে? ওরা খাচ্ছে খাক।

উড়িয়ে দিচ্ছি, কারণ আমার হিংসে হয় ওদের। তাই।

কবুতরকেও হিংসে করো?

 হ্যাঁ করি।

কেন?

ওদের মতো উড়তে পারি না বলে।

বেনোয়া একা হেঁটে গেল একটি ক্যাফের দিকে। নীলা দাঁড়িয়ে রইল ঝাঁক ঝাঁক নেমে আসা কবুতরের সঙ্গে। একা।

.

রাতে হোটেলের ঘরে শুয়ে নীলা জিজ্ঞেস করে, অভিমান বলে চমৎকার একটি বাংলা শব্দ আছে। অন্য কোনও ভাষায় এই শব্দটির ঠিক অনুবাদ হয় না। ফরাসি ভাষায় কি এই শব্দটির অনুরূপ কোনও শব্দ আছে?

উত্তর দেবার সময় হয় না বেনোয়ার, কারণ ওর মোবাইল বেজে ওঠে। পাসকালের ফোন।

ফোনে কথা শেষ করে এসে প্রায় ঘুমিয়ে পড়া নীলাকে জাগিয়ে অন্যরকম তরলের স্বাদ নেয় বেনোয়া। অন্যরকম শরীরের, অন্যরকম রঙের, অন্যরকম ভঙ্গিমার, অন্যরকম দোলের।

বেনোয়া তার না-নিখুঁত শরীর দিয়ে নীলার শরীর ঢেকে দিতে দিতে, নীলার অন্যরকম রহস্যের ভেতরে, ঢুকি কি ঢুকি না, ঢুকি কি ঢুকি না ধরনের খেলা খেলতে খেলতে বিষম বেগে নিজেকে ঠেলে দেয় ভেতরে।

আমাকে টের পাও? আমাকে অনুভব করো?

নীলার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বেনোয়া বলে যায়, বলো, বলো আমাকে ভালবাসো। বলো খুব ভালবাসো আমাকে। বলো আমাকে পাগলের মতো ভালবাসো। বলো জ তেম আলা ফলি। বলো আলা ফলি। বলো, আমি তোমার সব। বলো যে আমাকে ছাড়া বাঁচবে না তুমি। বলো যে আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসবে না। বলো নীলা বলো।

নীলা মুখ সরিয়ে নেয়, বেনোয়ার মুখ থেকে মরা ইঁদুরের গন্ধ বেরোচ্ছে। এ গন্ধ বেনোয়ার মুখ থেকে প্রায়ই বেরোয়, নীলার কেবল একে গন্ধ বলে কোনওদিন মনে হয়নি। অথবা, কী জানি, নীলা ভাবে, হয়তো সুগন্ধ বলেই মনে হয়েছে।

.

এখানেই শেষ

এ মাসে ঋতুর দেখা পায়নি বলে নীলা ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানায়, নীলার পেটে বাচ্চা। ডি এন এ পরীক্ষা করে বেনোয়া দুপঁ হচ্ছে বাচ্চার বাবা, তাও বলে কশঁ হাসপাতালের ডাক্তার।

বেনোয়া বিপুল উল্লাসে মেতে ওঠে। হাসপাতালের করিডোরে একশো লোকের মধ্যে নীলাকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে চুমু খায়। সারা পথ চুমু খেতে খেতে, আমার জীবন সার্থক হল, আমার স্বপ্ন পূর্ণ হল বলতে বলতে বাড়ি ফিরে নীলাকে কোলে তুলে দোল খায়, নীলাকে বুকের মধ্যে নিয়ে প্রচণ্ড আবেগে বলে, বারবার বলে জ তেম জ তেম জ তেম। জ তেম আলা ফলি।

এই পৃথিবীতে আমার মতো সুখী আর কেউ নেই নীলা, আমার মতো ভাগ্যবান আর কেউ নেই।

নীলার উদাস দুটো চোখ জানালায়।

উদাস মুখটি বেনোয়া নিজের দিকে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী ভাবছ এত! আমাদের ছেলের নাম কী দেবে তাই নিয়ে? বাংলা নাম দিতে চাচ্ছ তো।

নীলা বলে, ভাবছি আমার একটা চাকরি জোগাড় করতে হবে। টাকা পয়সা যা ছিল, সব ফুরিয়েছে।

ও ভেবো না, সে আমি দেখব। নীলার পেটের মসৃণ বাদামি ত্বকে চুমু খেতে খেতে বলে বেনোয়া।

এ বাড়িটা আর পোষাতে পারব না, ছেড়ে দিতে হবে পরের মাসে।

কী জানো, বেনোয়া উঠে বসে, মুখে তৃপ্তির হাসি, তোমাকে আমি আমার বাড়িতে ওঠাব। পাসকাল অন্য এলাকায় বাড়ি ভাড়া নেবে। বেশ হবে, তাই না?

বেনোয়ার চোখের ওপর নেমে আসা কটি সোনালি চুল সরিয়ে দিয়ে নীলা বলে, ও বাড়িতে তুমি পাসকালের সঙ্গে থেকো।

বেনোয়া লাফিয়ে বিছানা থেকে নামে। কী বলছ তুমি? তুমি কি ভাবো পাসকালকে আমি তোমার চেয়ে বেশি ভালবাসি?

নীলা বলে, না, এটা আমি ভাবছি না।

তা হলে তুমি জানো যে তোমাকে আমি কী ভীষণ রকম ভালবাসি।

না বেনোয়া তুমি আমাকে ভালবাসো না। অদ্ভুত শান্ত স্বর নীলার।

 নীলাকে এক ঝটকায় শোয়া থেকে ওঠায় বেনোয়া, কী বলছ কী তুমি?

বেনোয়ার হাত সরিয়ে নিজের বাহু থেকে, নীলা বলে, আমি ঠিকই বলছি।

তা হলে ওই হিংসেটা এখনও যায়নি তোমার, পাসকালের সঙ্গে আমার দুটো কথা বলাও তুমি সহ্য করতে পারো না! ভাবো যে পাসকালকে আমি ভালবাসি।

নীলা বেনোয়ার চোখে কালো গভীর শান্ত চোখ রেখে বলে, বেনোয়া তুমি পাসকালকে ভালবাসো না।

বেনোয়ার চোখ, চোখের পাতা কাঁপে, তা হলে কাকে বাসি।

 তুমি তোমাকে ভালবাসো। তোমার নিজেকে। আর কাউকে না।

বোকার মতো কথা বোলো না নীলা। বেনোয়া ধমকে ওঠে।

নীলা হাসে। সত্য কথা বললে বুঝি রাগ হয় তোমার? কী জানো বেনোয়া, এতদিনে আমি একটি জিনিস জানতে পেরেছি, আমার বাবা অনির্বাণ, আমার সেই প্রেমিক সুশান্ত, স্বামী কিষানলাল, আর ওই সুনীল এদের চেয়ে তুমি মোটেও আলাদা নও। বাইরেটা দেখলে অবশ্য আলাদা মনে হয়, সুন্দর সুন্দর প্রেমের বাক্য আওড়াও, যখন তখন চুমু খাও, লেডিস ফার্স্ট বলে লেডিসদের আগে যেতে দাও, বা ফুল বাড়িয়ে দাও, বা রান্নাঘরে এটা সেটা করতে সাহায্য করো, বা রাস্তায় প্যারামবুলেটর ঠেলো, তোমাদের মধ্যে খুব ভেতরে, অদ্ভুত এক মিল আছে।

নীলাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বেনোয়া বলে, তোমার পেটে আমার বাচ্চা নীলা। তুমি দেখতে পাচ্ছ না আমার কত আনন্দ হচ্ছে এ কারণে!

বেনোয়ার বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নীলা বলে, একজন মাদাম বাটারফ্লাইয়ের দরকার তোমার বেনোয়া, তাই না? কিন্তু আমার কোনও শখ নেই তা হওয়ার।

কেন একথা বলছ? বেনোয়ার সারা গা থরথর কাঁপে, ভয়ে কি রাগে নীলা ঠিক বুঝতে পারে না।

আমি তোমাকে অনেকদিন অন্যরকম স্বাদ দিয়েছি, একজোটিক সামগ্রীর স্বাদ গন্ধ সবই তোমার পাওয়া হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে। নিজের প্রতি আমার এতটুকু বিশ্বাস, এতটুকু শ্রদ্ধাবোধ ছিল না বলে তোমার ভালবাসার মোহে আমি এতদূর এসেছি। এবার মুক্তি দাও, মাদাম বাটারফ্লাইয়ের মতো বাকি জীবন কেঁদে কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্তত এ সুখ তোমাকে আমি দিতে চাই না। তুমি তো দেখে মজা পেতে চাও প্রাচ্যের বোকা সোকা মেয়ের প্রেম এবং বিরহ। শেষ অব্দি আত্মহত্যা! না। ওটি আমি করছি না।

বেনোয়া ঘন ঘন শ্বাস নেয়, বলে, আমি তোমাকে বিয়ে করব নীলা। তুমি আমার বউ হবে নীলা। পাসকালকে আমি কালই ডিভোর্স দেব। কালই। চলো বিয়ে করি। বিশ্বাস করো আমাকে, আমি তোমাকে বিয়ে করব। তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই।

নীলা বেনোয়ার কাঁধে হাত রেখে থরথর কাঁপুনি থামায়।

আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি যে তুমি আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করব না।

নীলা, তোমার বাচ্চা হবে। আমরা একসঙ্গে থাকব। আমাদের ছেলে নিয়ে আমরা সুখের সংসার করব। সারাজীবনের সুখের সংসার।

না এ বাচ্চা হবে না।

মানে?

হবে না মানে হবে না। আমি অ্যাবরশন করব।

বেনোয়া হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। নীলার পাদুটির ওপর মাথা রেখে কাঁদে। বেনোয়ার চোখের জলে নীলার পা ভিজে যেতে থাকে। অস্ফুট ভেজা কন্ঠে বেনোয়া বলতে থাকে, ন মে কিত পাঁ। ন মে কিত পাঁ। আমাকে ছেড়ো না।

এত নিষ্ঠুর হয়ো না তুমি, বলে বলে বেনোয়া কাঁদে আরও। বাড়ি কাঁপিয়ে কাঁদে। মাথা দেয়ালে ঠোকে। একবার দুবার তিনবার। কপাল কেটে রক্ত বের হয়। চিৎকার করে বলতে থাকে, এ কথা তুমি ফিরিয়ে নাও। সেই ফাটা কপাল মেঝেতে ঠোকে, বলতে বলতে তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না নীলা। নিষ্ঠুর হওয়া তোমাকে মানায় না।

নিষ্ঠুর হওয়া বুঝি কেবল তোমাকে মানায়?

বেনোয়াকে মেঝে থেকে তুলে বিছানায় বসিয়ে নীলা বলে, এমন পাগলামো করার কোনও মানে হয় না।

বেনোয়া নীলাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি আমার, তুমি আমার। তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না। আমি তোমাকে সব দিয়েছি, যত ভালবাসা আছে সব দিয়েছি। ভালবাসা কাকে বলে আবেগ কাকে বলে আমি তোমাকে ভালবেসে বুঝেছি, এত গভীর করে জীবনে কাউকে আমি ভালবাসিনি, আমাকে তুমি কষ্ট দিয়ো না। তুমি আমাকে ভুল বুঝছ নীলা। তুমি বুঝতে পারছ না, তুমি যদি আমাকে ছেড়ে যাও আমার এ জীবনের কোনও মানে হয় না, আমি আত্মহত্যা করব। পৃথিবীতে অনেক মেয়ে দেখেছি, তোমার মতো কাউকে দেখিনি, তোমার মতো এত ভাল, এত সৎ, এত উদার, এত মায়াময়ী, এত সহিষ্ণু, এত নিঃস্বার্থ কাউকে দেখিনি, কেউ হয় না তোমার মতো। তুমি এই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানবী। তোমার মতো হওয়ার কারও সাধ্য নেই। তোমার কোনও তুলনা হয় না। তুমি যে কত বড়, কত মহান এ তুমি নিজেও জানেন না, আমি জানি। আমার এই তুচ্ছ, ক্ষুদ্র, অন্ধকার জীবন তুমি আলোকিত করেছ, তোমাকে আমি হারাতে পারব না। যত ভালবাসা আছে আমার, আমি সব দেব, আর কাউকে না। আমাকে তুমি তোমার পায়ের তলায় রাখো। তবু ছেড়ো না।

.

নীলা হো হো করে হেসে ওঠে।

বেনোয়া তুমি পাগল হয়ে গেছ। আবোল তাবোল বকছ।

 বেনোয়া ঝটিতে উঠে হাতের সোনার আংটিটি আঙুল থেকে খুলে নীলাকে দেখিয়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দেয় বাইরে। তুমি আমার বউ হবে, নীলা, বলো, বউ হবে আমার।

নীলা মাথা নাড়ে। সে হবে না।

কেন আমাকে ভুল বুঝেছ? কী করেছি আমি? কোথায় আমার ভুল হয়েছে বলো? বলো শুধরে নিই। যদি হয়ে থাকে আমাকে ক্ষমা করো।

নীলা বলে বেনোয়ার কোনও ভুল হয়নি, ক্ষমা করার কিছু নেই। শোধরানোর কিছু নেই।

তা হলে কেন?

 তা হলে কেন, বেনোয়া বলে যায়, হাতের আঙুল গুনে গুনে, সেই প্রথম দিন থেকে আমি তোমার জন্য করেছি। প্রথম দিন গার দ্য নর্দে পৌঁছে দিয়েছি আমার গাড়ি করে। তোমাকে আমি প্যারিসের বিভিন্ন জায়গা চিনিয়েছি। নিজের জন্য সময় দিইনি, তোমার জন্য সমস্ত সময় খরচা করেছি আমি। বাড়ি ভাড়া নেবে বলে তোমার আমি বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি দেখতে নিয়ে গেছি। যখনই ডেকেছ, আপিসের কাজ ফেলে তোমার কাছে চলে এসেছি। এত বিশ্বাস করেছি তোমাকে, প্রথম থেকে তোমার সঙ্গে আমি কনডম ব্যবহার করিনি। তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছি। আমি নিজে হাতে রান্না করেছি, টেবিলে খাবার দিয়েছি। বাড়ি পরিষ্কার করেছি। ভ্যাকুয়াম করেছি। জল চাইলে জল এনে দিয়েছি। চা করে দিয়েছি। তোমার ওই বদমাশ বাঙালি বন্ধু তোমাকে ধর্ষণ করে গেলে আমি তোমাকে নিরাপত্তা দিয়েছি। আমি তোমার ভয় দূর করেছি।

নীলা মাঝপথে বলে, আঙুল গুনো না, এই তোমাদের একটি বিচিত্র স্বভাব, আঙুলে গোনা। এত হিসেবি তোমরা, এটা জানো না কেন? নীলা দু হাত চোখের সামনে তুলে বলে, আঙুলে গুনলে মাত্র দশটি সুযোগ পাবে, আর কড়ায় গুনলে দু হাতে চল্লিশটি পাবে। তোমাদের হিসেবে সুবিধে হবে।

বেনোয়া ধমকে থামায় নীলাকে, তোমাকে আমি আমার বাবা মার বাড়িতে নিয়ে গেছি। তোমার জন্য পাসকালকে ছেড়ে আমার ছোট্ট সুন্দরের আদরের বাচ্চাকে ফেলে তোমার সঙ্গে জীবনযাপন শুরু করেছি। পাসকালকে ডিভোর্স দিয়ে তোমাকে বিয়ে করার কথা ভেবেছি। পাসকালকে আঘাত দিয়েছি, জ্যাকলিনকে বাবার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করেছি। ইতালি যেতে ইচ্ছে করেছ, ইতালি গেছি। যেখানে যেখানে যেতে চেয়েছ, নিয়ে গেছি।

নীলা বলে, আমি জানি, বেনোয়া তুমি আমার জন্য অনেক করেছ।

তা হলে কেন স্বীকার করতে চাও না যে আমি তোমাকে ভালবাসি!

 নীলা হাসে।

তুমি কি অন্য কারও প্রেমে পড়েছ?

নীলা আবারও হাসে।

বলো সেই দিনের ওই লোকগুলোর সঙ্গে যে সারারাত ফুসুর ফুসুর করলে, ওদের কারও সঙ্গে কি তোমার কিছু হয়েছ? বলো, কাউকে কি ভাল লেগেছে?

নীলা হেসে বলে, ওই মডিবোকে লেগেছে ভাল।

ও তুমি ভেবেছ কালো লোকদের শিশ্ন তো বেশ বড় হয়, তাই আরও বড় পাবার লোভ করছ? ও ব্যাটার ওটা ধরে দেখেছ নাকি? নীলার হাত টেনে নিজের উরুর মাঝখানে রেখে বলে, দেখো তো এর চেয়ে বড়। আমারটির চেয়ে বড়? এর দশ ইঞ্চি দৈর্ঘ, আট ইঞ্চি ঘের, এটির চেয়ে বড়? আমি যত সুখ দিই তোমাকে, ও ব্যাটা কোথাকার কোন জঙ্গল থেকে আসা, ও দিতে পারবে? ওই বনমানুষটি কোনও শিল্প জানে?

নীলা হাত টেনে নেয় বেনোয়ার শক্ত মুঠো থেকে।

ধীর শান্ত কণ্ঠে বলে, বেনোয়া, এ বাড়িতে তোমার যা কিছু আছে নিয়ে এক্ষুনি চলে যাও।

তুমি মন থেকে বলছ এ কথা?

হ্যাঁ। মন থেকে বলছি।

 তুমি খুব বড় একটি ভুল করছ তা জানো?

আমি কোনও ভুল করছি না।

আমাকে ভালবাসো না?

না।

 ভেবে বলছ? বুঝে বলছ?

হ্যাঁ।

আমাদের সম্পর্ক তুমি আজ এখানে শেষ করে দিচ্ছ?

দিচ্ছি।

বেনোয়া উঠে দাঁড়ায়। ঘৃণা উপচে পড়ে তার দুচোখে।

নীলা পিঠের পেছনে দুটো বালিশ দিয়ে হাঁটু তুলে বসে।

তুমি আমার সঙ্গে এতদিন খেলেছ নীলা। আমাকে নিয়ে তুমি মজা করেছ। তুমি আমাকে বোকা বানিয়েছ। তুমি এই করে বেড়াও। তুমি একটা লোভী, একটা স্বার্থপর, একটা ইতর, নীচ, নষ্ট, নিকৃষ্ট মেয়েমানুষ। তুমি পাসকালের কথা বলো, পাসকালের নখের যোগ্য হওয়ার যোগ্যতা তোমার নেই। তুমি আগাগোড়া শূন্য, একটা ফাঁকা, ফাঁপা জিনিস। পৃথিবীতে অনেক মানুষ দেখেছি, এত জঘন্য কাউকে দেখিনি। তুমি আমাকে সর্বস্বান্ত করেছ। তুমি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছ। আমাকে ধ্বংস করেছ। আমার সংসার ধ্বংস করেছ। আমি কী ভীষণ বোকা ছিলাম, তোমার মতো একটা বাজে মেয়েকে আমি ভালবাসতে গেছি ছি ছি। তুমি অধমেরও অধম। তোমার মুখের দিকে তাকাতে আমার ঘৃণা হচ্ছে। তুমি একটা কুৎসিৎ কুশ্রী মেয়ে। নিকৃষ্টেরও নিকৃষ্ট। তোমাকে ভালবাসা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ। আমার নিজের ওপরই ঘেন্না হচ্ছে আমার। তুমি একটা খুনি, তুমি আমার বাচ্চাকে খুন করছ। তুমি একটা নিষ্পাপ শিশুকে খুন করছ। তোমার মতো এত বড় খুনি আমি সচক্ষে দেখিনি।

বেনোয়া থুতু ছোড় নীলার দিকে।

নীলা হাসে। বলে, আবারও বলছি আঙুলের কড়া গুনে হিসেব করো। এতে সুবিধে হবে। লম্বা লিস্টি তো।

বেনোয়া বলে যায়, মিমিজঁতে লাথি খেয়েছিলে না, বেশ করেছিল ওরা, এ দেশের সহজ সরল মানুষদের তোমার নিশ্বাসের বিষে মারতে চাচ্ছ, তোমার লাথি খাওয়াই উচিত। নিজেকে কী ভাবো? সবজান্তা কিছু একটা হয়ে গেছ। কিছু জানো না তুমি। কিচ্ছু না। তোমার কীসের এত অহংকার? অহংকারের কিছু নেই তোমার। আমার জ্যাকলিনও তোমার চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখে। তোমার মাথায় থাক থাক পচা গোবর ছাড়া আর কিছু নেই। আমি তোমাকে করুণা করেছি, তা না হলে কে তোমার দিকে ফিরে তাকাত! কেউ না। নর্দমার কোনও কীটও না। তুমি ভাবো যে তুমি বিছানায় বেশ ভাল। হা। তাও তো জানো না। তুমি একটা মরা কাঠ, তুমি একটা হাস্যকর বস্তু নীলা, স্রেফ একটা হাস্যকর বস্তু। তুমি একটা সমকামী। বাজে চরিত্রের মেয়ে। তোমাকে নিয়ে কেউ সংসার করতে পারবে না, তোমার স্বামী তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, তুমি যোগ্য নও কারও সঙ্গে বাস করার, তাই। সুনীল তোমাকে ধর্ষণ করেছিল? মিথ্যে কথা, তুমিই সুনীলের সঙ্গে শুয়েছ, আমাকে মিথ্যে বলেছ। আমার মতিভ্রম হয়েছিল, তাই তোমার আসল চেহারা দেখতে পারিনি। তোমার জগৎ হচ্ছে ওই তলপেটের নীচে তিন ইঞ্চি জায়গা। ও ছাড়া আর কিছু জানো না তুমি, একটা বেশ্যা তুমি, আমার আর কত বড় ক্ষতি তুমি করেছ জানি না। সম্ভবত এইডস ছড়িয়েছ আমার শরীরে। কে জানে। কত মানুষকে তোমার যৌনরোগ ছড়িয়েছ এ অব্দি, বলো। আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করার ফন্দি এঁটেছিলে। ভাগ্যিস তোমার মুখোশখানা আগেই খুলতে পেরেছি।

নীলা কোনও শব্দ উচ্চারণ করে না। বেনোয়া তার কাপড়চোপড় জুতো, ছবির ফ্রেম, উপহারসামগ্রী সুটকেসে ভরে নিল, এরামিস, কাপ অব টি। ব্রুট, নট কাপ অব টি। দুটোই।

দরজার দিকে যেতে নিলে নীলা বলে, বাড়ির চাবিটা রেখে যাও।

 বেনোয়া ঘুরে দাঁড়ায়। আমাকে ছুটি দিয়ে নিজে সুখে থাকতে চাইছ, বলে সুটকেস নামিয়ে রেখে, ঘরের জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলতে থাকে দু হাতে। বুটের তলায় চেপে ভেঙে ফেলে সিডিগুলো। গানের যন্ত্রটি আছাড় দিয়ে ভাঙে। ভাঙে ঘরের ফুলদানিগুলো। টেলিভিশন লাথি লাগিয়ে ভাঙে। হাতুড়ি নিয়ে কম্পিউটার ভেঙে গুঁড়ো করে। লাইব্রেরির বইগুলো ছিঁড়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে। রান্নাঘর থেকে দৌড়ে ছুরি নিয়ে এসে সোফার মাঝখানে চিরে দেয়। বিছানা টেনে নামিয়ে লেপ তোশক বালিশ কেটে ছিন্ন করে। আলমারি খুলে নীলার কাপড়চোপড় ছুরিতে কাটে। বিশাল তাণ্ডব বয়ে যায় ঘরের ওপর। নীলা নিঃশব্দে তাকিয়ে দেখে।

এরপর নীলার গলা চেপে ধরে দুহাতে বেনোয়া। বদমাশ বেটি, আমি তোকে খুন করব।

নীলার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। দুহাতে সমস্ত শক্তি দিয়ে সে বেনোয়ার হাত ছাড়ায়।

বেনোয়া ধাক্কা দিয়ে নীলাকে মেঝেয় ফেলে। মেঝেতে থুবড়ে পড়লে, পিঠে সেই শক্ত বুটের লাথি, ঠিক মিমিজঁর সমুদ্রপাড়ের লাথির মতো। মাংস কাটার বড় ছুরিটি হাতে নিয়ে নীলার বুক বরাবর উঁচু করে।

সারা গা হিম হয়ে থাকে নীলার। চোখ বুজে থেকে সে নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ শোনে।

ছুরিটি নীলার পিঠের পেছনে থুবড়ে পড়েছে। তোর মতো কীটকে মেরে, আমার হাত নোংরা করতে চাই না। তুই এমনিতেই পচে মরবি।

বেনোয়া বেরিয়ে যায়। নীলার ফরাসি প্রেমিক বেরিয়ে যায়। নীলার সুদর্শন সুপুরুষ বেরিয়ে যায়, নীল চোখ বেরিয়ে যায়, সোনালি চুল বেরিয়ে যায়। অনেকক্ষণ ওভাবেই পড়ে থাকে নীলা মেঝেয়। অনেকক্ষণ নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ শোনে না সে। উঠতে গেলেই সারা গায়ে যন্ত্রণা হয়।

উঠে যখন দাঁড়ায়, চারটে কাজ করে সে।

.

এক, ফুসফুস ভরে শুদ্ধ বাতাস নেয়। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখে সবুজে লালে হলুদে ছেয়ে আছে প্রকৃতি। আকাশের নীলের তলে, মেঘের সাদার তলে, পত্রপুষ্পাবলীর বর্ণিল উৎসব। নীলা আগে কখনও শরতের এমন আশ্চর্য রূপ দেখেনি, প্রকৃতিকে এমন অপরূপ সাজে সাজতে দেখেনি।

এই দেশ কি তার দেশ? নীলা জানে, শরতের বিচিত্র সাজে সাজা অনিন্দ্যসুন্দর এই দেশটি তার নয়।

.

দুই, দানিয়েলকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে যে তার গর্ভপাত করাতে হবে, ও কোনও সাহায্য করতে পারবে কিনা। দানিয়েল সোৎসাহে বলে, নিশ্চয়ই। তা ঘটনা কী?

ঘটনা ছোট্ট, প্রেমের ফাঁদে পড়েছিলাম, ফাঁদ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছি।

জানতাম। দানিয়েল দেখলে তো ধরনের হাসি হেসে বলে, আগেই সতর্ক করেছিলাম। আগেই বলেছিলাম, খামোখা এই লোকের পেছনে সময় নষ্ট করো না।

নীলা বলে, সময় কখনও নষ্ট হয় না দানিয়েল। এ সময়টা অভিজ্ঞতা অর্জনে গেছে। এর প্রয়োজন ছিল। না হলে সারাজীবন একটা ভুল বিশ্বাস নিয়ে থাকতাম। আমার মনে হচ্ছে, পুরুষেরা যে দেশেরই হোক না কেন, যে সমাজেরই, সব এক।

দানিয়েলের কৌতূহল টগবগ ফুটছে, তা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কী তোমার? দেশে ফিরে যাচ্ছ?

কোন দেশে? নীলা জিজ্ঞেস করে।

 কোন দেশে আবার? তোমার নিজের দেশে?

আমার কি নিজের বলে কোনও দেশ আছে? দেশ মানে যদি আশ্রয় হয়, নিরাপত্তা হয়, সুখ স্বস্তির নাম হয়, ভারত আমার দেশ নয়।

দানিয়েল বলে, তা হলে এখানেই থেকে যাও। তুমি তো একবার বলেছিলে, প্রতিটি মানুষের দুটি মাতৃভূমি, একটি তার নিজের, অন্যটি ফ্রান্স।

মেয়েদের কি আসলেই কোনও দেশ বা মাতৃভূমি থাকে দানিয়েল? আমার কিন্তু মনে হয় না।

.

এই প্যারিস শহরে পঞ্চাশের দশকে সিমোন দ্য বোভোয়া গর্ভপাতের পক্ষে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এই শহরের ছয় এরনদিসমোয় একটি ছোট বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে মেয়েদের অবৈধভাবে গর্ভপাত করাতেন। গর্ভপাত বৈধ করা হয়েছে ওই আন্দোলনের ফলে। নীলার আনন্দ হয় ভেবে যে এই শহরে ওই আন্দোলনের ফসল সে ভোগ করতে যাচ্ছে।

.

তিন, মোজাম্মেলকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে মডিবো কেমন আছে? মডিবোর কোনও ফোন নম্বর আছে কি না। ওর বাড়ির ঠিকানাই বা কী?

মোজাম্মেল যতটুকু জানে মডিবোর খবর তা জানায়। শেষে বলে, ও হন্যে হয়ে একটা ফরাসি মেয়ে খুঁজছিল যেন প্রেমে পড়িয়ে বিয়ে করতে পারে, এ দেশে থাকার অনুমতি পাওয়ার জন্য। সুখবর, মজিবো সাদা এক ফরাসি মেয়ে পেয়ে গেছে।

প্রায় চার হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়া থেকে গৌরবর্ণ আর্য এসে কালো দ্রাবিড়দের তাড়িয়ে দিয়েছিল ভারতের আরও দক্ষিণে। গৌরের জয় গেয়েছিল আর্যরা, গৌর উত্তম, কালো অধম, গৌর প্রভু, কালো দাস, গৌর বড়, কালো ছোট, বড় জাত, ছোট জাত, ওই ছিল ধর্ম ওদের, ওই ছিল সমাজ। রক্তের কণায় কণায় ঢুকে গেছে ওই বিশ্বাস। দুশো বছরের ইংরেজ শাসনকাল ওই বিশ্বাসকে আরও পোক্ত করেছে, সাদা ভাল, সাদা জ্ঞানী, সাদা প্রভু। নীলার রক্তকণিকাতেও ছিল ওই বিশ্বাস, মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছিল, ঝেড়ে বিদেয় করলেও কোথায় যেন সামান্য থেকে যায়, ওই সামান্যটুকুর শেষ কণা নিশ্চিহ্ন করা সহজ নয়, সে জানে, তবে সে কঠিন কাজটিই করে তৃপ্তি পেয়েছে।

.

চার, মরুনিকে বলে বাড়ি গোছানোর কাজে সাহায্য করার জন্য কাউকে পাঠাতে।

ঘন্টায় পঞ্চাশ ফ্রাঁ করে নেয় এক ফিলিপিনো মেয়ে, মারিলু, নীলার বাড়িতে চলে আসে বিকেলেই। ঘরের ভাঙা জিনিসগুলো বড় বড় কালো ব্যাগে ঢুকিয়ে নীচে ফেলে দিয়ে আসে ও। ঘণ্টা তিন লাগে ওর এ কাজ করতে।

এরপর মারিলুকে কাছে বসিয়ে ওর জীবনের গল্প শোনে নীলা।

মারিলু ফিলিপিন থেকে বছর ছয় আগে এ শহরে এসেছে। ওর আরও আত্মীয় থাকে এ শহরে। ওরাই এনেছে মারিলুকে। ও ম্যানিলায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। সমাজবিজ্ঞান ছিল ওর বিষয়। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে, জন্মের শহর ছেড়ে ফ্রান্সে এসেছে, আসাতক ধনীদের বাড়িতে কাজ করে জীবন চালাচ্ছে। ওর আত্মীয়দের অনেকে কাপড়ের কারখানায় কাজ করে। মারিলু কাপড় সেলাই শিখছে সানদানিতে তার আত্মীয়দের বাড়িতে। শিগরি কাজ নেবে কারখানায়।

নীলা জিজ্ঞেস করে, সানদানিতে কোনও ছোটখাটো ঘর পাওয়া যাবে অল্প দামে? ভাড়া নেব।

তা পাওয়া যাবে।

 মারিলু নীলাকে আগে থেকেই সাবধান করে অবশ্য, সানদানি তো খুব খারাপ জায়গা।

কীরকম খারাপ?

 লোক বেকার, চুরি ডাকাতি হয়, ছিনতাই হয়, লোকে নেশা করে, খুন করে, কালো লোকে ভর্তি।

.

আমার রংটা দেখো? এ কি খুব সাদা নাকি? এক রকম কালোই তো। বেকার লোকেরাই বুঝি চুরি ডাকাতি করে? যারা, বেকার নয়, মোটা টাকা কামাচ্ছে, তারা করে না? কালো লোকে ভর্তি, তাতে কী? সাদা লোকেরা বুঝি নেশা করে না? খুন করে না? পৃথিবীর কোন জায়গাটা ভাল বলো তো? কোথায় তুমি বলতে পারো নিরাপত্তা আছে? ম্যানিলায় লোকে নেশা করে না? ডাকাতি করে না? খুন করে না? করে। ওখানে দারিদ্র্য আছে, কষ্ট আছে, কুসংস্কার আছে, এখানেও আছে। এ দেশে বর্ণবাদী আছে, ভারতবর্ষে নেই? কলকাতায় ধর্ষণ হয়, এখানে হয় না? হয়। এই যে রু দ্য ভুইয়ে, এই এলাকায় সাদারা থাকে বেশি, এখানে কি খুন হয় না? হয়। আজই হতে পারত একটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *