৮. একাগ্র ও নিঃসঙ্গ
ব্র্যাডম্যানের প্রথম ইংল্যাণ্ড সফরে (১৯৩০) টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে অনুমান করা হয়েছিল ইংল্যাণ্ডই সিরিজ জিতবে। অভিজ্ঞ বলতে অস্ট্রেলিয়া দলে আছে তো মাত্র চার জন- উডফুল, পন্সফোর্ড, গ্রিমেট আর ওল্ডফিল্ড। কিন্তু সিরিজ শেষে দেখা গেল অস্ট্রেলিয়া দুটি ও ইংল্যাণ্ড একটি টেস্ট ম্যাচ জিতেছে আর বাকি দুটি ড্র।
মাত্র চার বছর আগে ‘জংলি ক্রিকেটার’ বলে অভিহিত যে— ছেলেটি সিডনিতে ট্রায়াল দিতে এসেছিল, তাকে এখন সদ্য অবসর নেওয়া জ্যাক হবসের উত্তরাধিকারীরূপে বিশ্বের চমৎকারতম ব্যাটসম্যান হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে। হবসের থেকেও সেবড়ো হবে, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। প্রথম সফরেই সেক্রিকেটে রূপান্তর ঘটিয়েছে। ডন দেখিয়ে দিয়েছে, পরাজয় থেকে রক্ষার গ্যারান্টি হিসাবে ৪০০ রানের ইনিংস হলেও কোনো দল আর নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারবে না। তখন পর্যন্ত তাই ভাবা হত। কিন্তু ডন দেখাল অন্যে যতক্ষণে ১০০ করে, সেততক্ষণে ২০০ রান তুলতে পারে।
কিন্তু আর একদিক থেকে দেখলে বলা যায়, ডনের আগমনে ক্রিকেট আরও বিরস হয়ে পড়ল। এখন থেকে কোনো দল আর চট করে ইনিংস ডিক্লেয়ার করতে সাহস পায় না। উইকেট কামড়ে তারা বড়ো রান তোলার চেষ্টা করে বিপক্ষের সম্ভাব্য বড়ো রানের সামনে দাঁড়াবার জন্য। ত্রিশের দশকে অস্ট্রেলিয়া দল গড়ে ওঠে তার ব্যাটিংকে ঘিরে। জনসাধারণের কাছে ডন ছিল চুম্বক। ডন হয়ে ওঠে নায়ক।
সাফল্যের পর সাফল্য আর তার ফলেই ডন নিজের জন্য ডেকে আনে এক মুশকিলের ব্যাপার। লোকে এখন আশা করে ব্যাট হাতে নামলেই ডন শতরান করবে। একশোর কম রান করলেই রব ওঠে, ডন ব্যর্থ হয়েছে। একবার ৫৮ রান করায় খবরের কাগজে হেডলাইন বেরোল ‘ডন ব্যর্থ’। অন্য কেউ ৭০ বা ৮০ রান করলে চমকপ্রদ ইনিংস হিসাবে সেটা হয়তো গ্রাহ্য হবে, ডন করলে হয় না। সাফল্যের এটা অন্যতম জরিমানা।
লেখকরা তাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম রান-সংগ্রাহক যন্ত্র বলেছেন। বলাটা খুব সুপ্রযুক্ত নয়। যদিও ডনের মসৃণ স্ট্রোক তার বড়ো বড়ো ইনিংসগুলিকে যেন অনায়াসে নির্মিত হিসাবে চোখের সামনে তুলে ধরে, কিন্তু যন্ত্র ছিল না সে। উইকেটে দীর্ঘকাল থেকে বোলিংকে ছত্রখান করার কাজ তাকে দৈহিক এবং মানসিক দিক থেকে ক্ষয় করিয়ে দিত। দৈহিক ধকলটা প্রচন্ড ছিল। প্রায়ই তাকে সারাদিন ব্যাট করার পর স্নান করে, পোশাক বদলে, ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে ট্রেনে উঠতে হত পরের ম্যাচ খেলার উদ্দেশ্যে রওনা হবার জন্য। হয়তো মধ্যরাত্রের আগে পেটে কিছু পড়ত না। কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়েই আবার খেলতে নামতে হত। কিন্তু মানসিক ধকলটাই ছিল ক্ষতিকর। বড়ো ইনিংস খেলতে হলে অত্যন্ত কঠোর একাগ্রতা, মনোনিবেশ দরকার হয়। নেভিল কার্ডাস একবার ডনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তার এই সাফল্যের মূলমন্ত্রটি কী? ডন বলেছিল, ‘একাগ্র মনোনিবেশ। আমার কাছে প্রত্যেকটা বলই প্রথম বল, তখন আমার স্কোর শূন্য বা ২০০ যাই-হোক-না।’
ডন যখন উইকেটে থাকে তখন তার দৃষ্টি থেকে দর্শকরা একদম মুছে যায়। শুধু সেদেখতে পায় বোলার ও তার সাজানো ফিল্ডকে। ঠিক যেমন অর্জুন একমাত্র পাখিটির চোখ ছাড়া আর কিছু দেখতে পায়নি, তেমনিই ডন কিংবা বলা যায় যারাই একাগ্র হয়ে উদ্দেশ্যসাধনে মনোনিবেশ করে, তাদেরই এই অবস্থা হয়। ডন লক্ষ করেছে, বহু ব্যাটসম্যান স্বচ্ছন্দে রান তুলে যায়, যতক্ষণ-না তাদের একাগ্রতায় চিড় ধরে। ডনের একাগ্রতায় চিড় ধরত না। একবার বোল্ড আউট হবার পর ডন অবাক হয়ে উইকেটকিপারকে বলে, ‘নিশ্চয়ই আমি একাগ্রতা হারিয়েছি!’
অন্যরা শতরান করার পরই ঢিলে দেয়, মজাদার ব্যাট চালিয়ে আউট হয়ে যায়। একশোটা রান কষ্ট করে সংগ্রহ করা সুতরাং ঢিলে দেবে নাই-বা কেন? কিন্তু একশো রান হয়ে যাওয়ার পরও ডনের একাগ্রতায় ঢিলেমি আসে না, এমনকী দ্বিশত বা ত্রিশত রানের পরেও। যতক্ষণ সেউইকেটে থাকে ততক্ষণ যাকে বলা হয় স্নায়বিক, এমন কোনো ব্যাপারে ডন কখনো ভোগেনি। তবে বড়ো ম্যাচের আগে সেউদবিগ্ন হয়ে উঠত। যখন উইকেটে এসে দাঁড়াত, উদবেগটা রূপান্তরিত হত শীতল উত্তেজনায়। টেস্ট সিরিজ চলাকালে ডন ঠিকমতো আহার করতে পারত না। পাকস্থলী তখন সহ্য করতে পারত না আহার্য।
দীর্ঘক্ষণ ব্যাট করার পর ডনের দরকার হত শান্ত নিরালা পরিবেশ, যেখানে সেসারাদিনে গুটিয়ে থাকা একাগ্রতার স্প্রিংটিকে ধীরে ধীরে শিথিল করে দিতে পারে। শিথিল করার জন্য ডন গান শুনত—শাস্ত্রীয় সংগীত অথবা বিলিয়ার্ডস খেলত। তখন সেচাইত পারিবারিক সান্নিধ্য, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই গৃহকোণের বদলে তাকে কাটাতে হয়েছে হোটেলকক্ষে। তার দলের বহু খেলোয়াড়ই নির্জনতার প্রতি ডনের আসক্তির এই ব্যাপারটা বুঝত না। তাদের কাছে রেকর্ড ইনিংসের অর্থ হইহল্লা আর পার্টি। কিন্তু গ্রামের ছেলে ডন কখনোই মদ বা সিগারেট খায়নি, হুল্লোড় পছন্দ করেনি। কয়েক কাপ চা আর শান্ত পরিবেশে আহার সেপছন্দ করত।
এই মনোভঙ্গির জন্যই সেউন্নাসিক, অসামাজিক আখ্যা পেয়েছিল। ১৯৩০ সালে ইংল্যাণ্ড সফরে ডন ৩৩৪ রান করে বিশ্ব টেস্ট রেকর্ড করার পর দলের খেলোয়াড়রা আশা করেছিল সেপার্টি দেবে। কিন্তু তার বদলে ডন তার হোটেলঘরের দরজা বন্ধ করে গ্রামোফোন রেকর্ড বাজিয়ে শুনছিল। এতে অন্যরা অসন্তুষ্ট হয়, ডনকে সেকথা বলা হলে সেমনে আঘাত পায়। ‘আমাকে ওরা কী করতে দেখলে খুশি হত?’ ডন বলেছিল, ‘রাস্তায় নেমে প্যারেড?’ এ সম্পর্কে ডনের বক্তব্য ছিল খুবই সরল। ওরা যখন মাতামাতি করে তখন সেআপত্তি করে না, সুতরাং সেযখন নি:সঙ্গতা চায় তখন অন্যে কেন আপত্তি করবে?
নিজের শিক্ষা ও রুচি উন্নীত করার জন্য ডন একাকীই চেষ্টা করেছে। যাতে মানসিক বিকাশ ঘটে এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা যায় এমন বই পড়ার জন্য ডন তালিকা চায় নেভিল কার্ডাসের কাছে। কার্ডাস তাকে যে বইয়ের তালিকা দেন, সেগুলি মোটেই সহজ বা সুখপাঠ্য ছিল না। ডন তার প্রত্যেকটিই গভীরভাবে পড়েছিল।
নি:সঙ্গ কিন্তু স্বয়ংনির্ভর, বন্ধু সংগ্রহে অনিচ্ছুক ডন তার খেলার জীবনে সহ-খেলোয়াড়দের কাছে চিরদিনই ধাঁধা ছিল। যদি ডন তাদের মতো হত তাহলে সম্ভবত আর পাঁচজন টেস্ট খেলোয়াড়ের মতোই সেহয়তো আর একজন হত। তা না হয়ে ডন সকলকে ছাড়িয়ে উপরে ওঠে।