৮. ডিজাইনার ইউনিভার্স
এই সিস্টেম যাত্রা শুরুর আগেই বিপুলসংখ্যক মহাবিশ্ব হয়তো অনন্তকাল বিশৃঙ্খল ও তালগোল পাকিয়ে ছিল। মহাবিশ্ব তৈরিতে অনেক শ্রম নষ্ট হয়েছে, অনেক বিফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে এবং অসীম সময় ধরে ধীরগতির, কিন্তু অবিরাম উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।
—ডেভিড হিউম
.
ছোটবেলায় স্কুলে সেকেন্ড গ্রেডে পড়ার সময় আমার এক শিক্ষিকা হঠাৎ একটা মন্তব্য করে বসেন। তাঁর কথাটা কখনো ভুলতে পারিনি। তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীকে ঈশ্বর খুব ভালোবাসেন বলেই সূর্য থেকে পৃথিবীকে একদম সঠিক এক জায়গায় রেখেছেন।’ ছয় বছরের শিশু হিসেবে এই যুক্তির সরলতা আর শক্তিতে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমি। ঈশ্বর যদি পৃথিবীকে সূর্য থেকে অনেক দূরে কোথাও রাখতেন, তাহলে সবগুলো মহাসাগর জমে বরফ হয়ে যেত। আবার পৃথিবীকে খুব বেশি কাছে রাখলেও বাষ্পীভূত হয়ে যেত সাগর-মহাসাগরগুলো। আমার শিক্ষিকার কাছে এর মানে, শুধু ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণই নয়, সেই সঙ্গে তিনি দয়ালুও বটে। আবার পৃথিবীকে এতই ভালোবাসেন যে গ্রহটিকে একবারে সঠিক জায়গায় রেখেছেন তিনি। এটা আমার ভেতরে অনেক বড় প্রভাব ফেলে।
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বলেন, সূর্য থেকে পৃথিবীর অবস্থান একটা গোল্ডিলকস জোনে। তরল পানি বা সর্বজনীন দ্রাবক জীবনের রসায়ন তৈরির জন্য একদম যথাযথ দূরত্ব। সূর্য থেকে পৃথিবী যদি আরও দূরে থাকত, তাহলে সেটা মঙ্গল গ্রহের মতো জমাটবাঁধা এক মরুভূমিতে পরিণত হতে পারত। তাপমাত্রার কারণে মঙ্গল গ্রহ রুক্ষ। সেখানকার অনুর্বর ভূমিতে পানি, এমনকি কার্বন ডাই- অক্সাইডও প্রায় জমাটবদ্ধ কঠিন। আবার মঙ্গল গ্রহের মাটির নিচেও চিরজমাটবদ্ধ। সেখানে জমাট পানির স্থায়ী স্তর খুঁজে পাওয়া যায়।
আবার পৃথিবী সূর্যের খুব কাছে হলে গ্রহটা অনেকটা শুক্র গ্রহের মতো হতে পারত। শুক্র গ্রহ আকৃতির দিক থেকে প্রায় পৃথিবীর মতো। কিন্তু গ্রিনহাউস প্ল্যানেট নামে পরিচিত গ্রহটা। শুক্র গ্রহ সূর্যের অনেক কাছে অবস্থিত। তার বায়ুমণ্ডল কার্বন ডাই-অক্সাইডে গঠিত। এসব কারণে গ্রহটি সূর্য থেকে পাওয়া শক্তি ধরে রাখে। তাতে শুক্রের তাপমাত্রা উঠে যায় প্রায় ৯০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে। তাই সৌরজগতের সবচেয়ে উত্তপ্ত গ্রহ শুক্র। সেখানে সালফিউরিক অ্যাসিডের বৃষ্টি হয়, বায়ুমণ্ডলের চাপ পৃথিবীর তুলনায় শতগুণ বেশি। প্রচণ্ড তাপমাত্রার কারণে সৌরজগতের সম্ভবত সবচেয়ে নরকতুল্য গ্রহ এটিই। এ রকম হওয়ার পেছনে প্রধানতম কারণ, গ্রহটি পৃথিবীর তুলনায় সূর্যের অনেক কাছে অবস্থিত।
আমার সেকেন্ড গ্রেড ক্লাসের শিক্ষিকার যুক্তি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা হয়তো বলবেন, তাঁর কথাটা অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপলের একটা উদাহরণ। অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল-মতে, প্রকৃতির সূত্রগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে প্রাণ ও চেতনা একদিন সম্ভব হয়ে ওঠে। তবে এ সূত্রগুলো কোনো মহান ডিজাইনের মাধ্যমে, নাকি দুর্ঘটনাক্রমে সজ্জিত হয়েছে তা বলা বিতর্কের বিষয়। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাণ ও চেতনা সম্ভব করে তোলার মতো বিপুলসংখ্যক দুর্ঘটনা বা কাকতালীয় ঘটনার খোঁজ পাওয়ার কারণেই এ বিতর্কের জন্ম। অনেকের কাছে এটা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ। তিনি প্রাণ এবং আমাদের সম্ভব করে তুলতে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকৃতির নিয়মগুলো এভাবে সাজিয়েছেন। কিন্তু অন্য বিজ্ঞানীদের কাছে এর মানে, আমরা ধারাবাহিক কিছু সৌভাগ্যজনক দুর্ঘটনার উপজাত মাত্র। কিংবা হয়তো যে ব্যক্তি স্ফীতি এবং এম-থিওরির ফলাফলে বিশ্বাস করে, তার কাছে এটি হয়তো মাল্টিভার্সের অস্তিত্বের প্রমাণ।
এসব যুক্তির জটিলতা মূল্যায়ন করতে গেলে পৃথিবীতে যেসব কাকতালীয় ঘটনা প্রাণের উদ্ভব সম্ভব করে তুলেছে, প্রথমে সেগুলো বিবেচনা করা দরকার। আমরা যে সূর্যের একটা গোল্ডিলকস জোনেই বাস করি, শুধু তা-ই নয়, সঙ্গে আরও কিছু গোল্ডিলকস জোনে বসবাস করি। যেমন পৃথিবীর কক্ষপথকে স্থিতিশীল রাখার জন্য আমাদের চাঁদের আকার একেবারে যথার্থ। চাঁদ খানিকটা ছোট হলে কয়েক মিলিয়ন বছরে পৃথিবীর ঘূর্ণনে সামান্য অস্থিরতাও ধীরে ধীরে জমে বেশ বড় আকার ধারণ করত। ফলে পৃথিবী ভয়ানকভাবে টলমল করে উঠত। মারাত্মকভাবে বদলে যেত তার জলবায়ু। এখানে জীবনের উদ্ভবও হয়ে উঠত অসম্ভব। কম্পিউটার প্রোগ্রামে দেখা গেছে, বড় আকারের একটি চাঁদের কারণে (পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ) পৃথিবীর অক্ষরেখা হয়তো কয়েক মিলিয়ন বছরে ৯০ ডিগ্রি পর্যন্ত সরে যেত। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, ডিএনএ সৃষ্টির জন্য কয়েক শ মিলিয়ন বছর স্থিতিশীল জলবায়ু প্রয়োজন। তাই পৃথিবী পর্যায়ক্রমে তার অক্ষরেখা থেকে সরে গেলে আবহাওয়ায় বিপর্যয়কর পরিবর্তন আসত। অসম্ভব হয়ে উঠত ডিএনএর গঠন। সৌভাগ্যক্রমে পৃথিবীর কক্ষপথকে স্থিতিশীল করার জন্য আমাদের চাঁদের আকৃতি যথাযথ। তাই শেষ পর্যন্ত এই বিপর্যয় ঘটেনি। (মঙ্গল গ্রহের চাঁদগুলোর আকৃতি তার ঘূর্ণন স্থিতিশীল করার পক্ষে যথেষ্ট বড় নয়। ফলে মঙ্গল গ্রহ ধীরে ধীরে অস্থিতিশীলতার আরেকটা পর্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। অতীতে মঙ্গল গ্রহ সম্ভবত তার অক্ষরেখার প্রায় ৪৫ ডিগ্রিতে ঘুরত বলে বিশ্বাস করেন জ্যোতির্বিদেরা।)
সামান্য জোয়ারের বলের কারণে পৃথিবী থেকে প্রতিবছর চাঁদ দূরে সরে যাচ্ছে প্রায় ৪ সেন্টিমিটার হারে। প্রায় দুই বিলিয়ন বছরে এটি এতই দূরে চলে যাবে যে তা আর পৃথিবীর ঘূর্ণনকে স্থিতিশীল রাখতে পারবে না। পৃথিবীর প্রাণের অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে এ ঘটনা। এখন থেকে কয়েক বিলিয়ন বছর পর রাতের আকাশ শুধু চাঁদহীনই হবে না, সঙ্গে আমরা হয়তো পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের নক্ষত্রমণ্ডল দেখতে পাব। কারণ, পৃথিবী, তার কক্ষপথ তখন গোলমেলে হয়ে যাবে। পৃথিবীর আবহাওয়াও হয়ে উঠবে অচেনা ও জীবনধারণের জন্য অসম্ভব।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক পিটার ওয়ার্ড এবং জ্যোতির্বিদ ডোনাল্ড ব্রাউনলি লিখেছেন, ‘চাঁদ ছাড়া জ্যোৎস্না থাকবে না, কোনো মাস, কোনো পাগলামি, কোনো অ্যাপোলো প্রোগ্রাম থাকবে না, কবিতা কম লেখা হবে। বিশ্বের প্রতিটি রাতই হবে অন্ধকার আর তমসাচ্ছন্ন। চাঁদ না থাকায় সম্ভবত কোনো পাখি, রেডউড, তিমি, ট্রিলোবাইট কিংবা অন্যান্য উন্নত জীবও আর কখনো পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে না।’
একইভাবে আমাদের সৌরজগত সম্পর্কিত কম্পিউটার মডেলে দেখা যায়, সৌরজগতে বৃহস্পতি গ্রহের উপস্থিতি পৃথিবীতে জীবনের টিকে থাকার জন্য একটি আশীর্বাদ। কারণ, এ গ্রহের শক্তিশালী মহাকর্ষ গ্রহাণুগুলোকে বাইরের মহাকাশে ছুড়ে মারতে সহায়তা করে। আমাদের সৌরজগৎ গঠনের পর গ্রহাণু ও ধূমকেতুর ধ্বংসাবশেষগুলো সাফ করতে বৃহস্পতির সময় লেগেছিল প্রায় এক বিলিয়ন বছর। এটি ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন বছর আগের ঘটনা। বৃহস্পতি যদি অনেক ছোট হতো এবং তার মহাকর্ষ যদি অনেক দুর্বল হতো, তাহলে সৌরজগতে এখনো গ্রহাণুতে ভরে থাকত। তাতে পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব হয়ে উঠত অসম্ভব। কারণ, গ্রহাণু আমাদের মহাসাগরে এসে নিমজ্জিত হতো এবং প্রাণও ধ্বংস করে দিত। কাজেই বৃহস্পতি গ্রহের আকারও আমাদের জন্য যথার্থ।
গ্রহের ভরের দিক দিয়েও আমরা আরেক গোল্ডিলকস জোনে বাস করি। পৃথিবী আরেকটু ছোট হলে এর মহাকর্ষ এতই দুর্বল হতো যে পৃথিবী অক্সিজেন আটকে রাখতে পারত না। পৃথিবী আরেকটু বড় হলে, এটি অনেক আদিম, বিষাক্ত গ্যাস আটকে রাখত, তাতেও জীবনের উদ্ভব হতো অসম্ভব। তাই আবারও বলতে হয়, প্রাণধারণের উপযোগী বায়ুমণ্ডল গঠনের জন্য পৃথিবীর ওজন একেবারে যথার্থ।
আবার আমরা সহনীয় বা গ্রহণযোগ্য গ্রহের কক্ষপথের এক গোল্ডিলকস জোনেও বাস করি। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, প্লুটো বাদে অন্যান্য গ্রহের কক্ষপথ প্রায় বৃত্তাকার। তার মানে, সৌরজগতে গ্রহসংক্রান্ত প্রভাব খুবই বিরল ঘটনা। অর্থাৎ পৃথিবী এমন কোনো গ্যাসীয় দানব গ্রহের কাছে যায় না, যার মহাকর্ষ খুব সহজে পৃথিবীর কক্ষপথে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। বলা বাহুল্য, এটা প্রাণের টিকে থাকার জন্য বেশ ভালো। এর জন্য কয়েক শ মিলিয়ন বছরের স্থিতিশীলতার প্রয়োজন।
একইভাবে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির একটা গোল্ডিলকস জোনের ভেতর অবস্থান পৃথিবীর। ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দূরে রয়েছে পৃথিবী। আমাদের গ্যালাকটিক কেন্দ্রের কাছে একটা কৃষ্ণগহ্বর ওত পেতে রয়েছে। আমাদের সৌরজগৎ যদি গ্যালাকটিক কেন্দ্রের খুব কাছে হতো, তাহলে ওত পেতে থাকা কৃষ্ণগহ্বরের বিকিরণ ক্ষেত্র এতই তীব্র হতো যে তা প্রাণধারণের পক্ষে হয়ে উঠত অসম্ভব। আবার সৌরজগৎ যদি ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে হতো, তাহলে সেখানে উচ্চ শ্রেণির মৌল পর্যাপ্ত পাওয়া যেত না। অথচ এগুলো প্রাণ সৃষ্টির জন্য দরকারি মৌল।
বিজ্ঞানীরা এ রকম অসংখ্য উদাহরণ দিতে পারেন, যেখানে পৃথিবী অগণিত গোল্ডিলকস জোনে অবস্থিত। জ্যোতির্বিদ ওয়ার্ড এবং ব্রাউনলি যুক্তি দিয়েছেন, আমরা এত বেশি এ ধরনের ছোট্ট পরিসর বা গোল্ডিলকস জোনের ভেতর বাস করি যে এই ছায়াপথের জন্য, এমনকি হতে পারে গোটা মহাবিশ্বের জন্যও বুদ্ধিমান জীব অনন্য ঘটনা। তারা আরও উল্লেখযোগ্য তালিকার বিবরণ দিয়েছেন। যেমন পৃথিবীর মহাসাগরের পরিমাণ একেবারে যথার্থ, প্লেট টেকটোনিকস, অক্সিজেনের পরিমাণ, অক্ষরেখা কোণ এবং এ রকম আরও অনেক কিছুই বুদ্ধিমান জীব সৃষ্টির জন্য যথার্থ। পৃথিবী যদি এসব ছোট্ট পরিসরের কোনোটির বাইরে থাকত, তাহলে এই প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনার জন্য আজ আমরা আর এখানে থাকতাম না।
পৃথিবী সব গোল্ডিলকস জোনের মাঝখানে থাকার কারণ কি ঈশ্বর একে ভালোবাসেন? হয়তো তাই। তবে আমরা এমন একটা সিদ্ধান্তেও পৌঁছাতে পারি, যেখানে ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করতে হয় না। হয়তো মহাকাশে কোটি কোটি মৃত গ্রহ রয়েছে, যাদের অবস্থান তাদের নিজ নিজ সূর্যের খুব কাছে। কে জানে, তাদের চাঁদগুলোও হয়তো খুব ছোট। তাদের বৃহস্পতি টাইপের গ্রহও অনেক ছোট হতে পারে। কিংবা গ্রহগুলোর অবস্থান হয়তো ছায়াপথের কেন্দ্রের অনেক কাছে। পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে গোল্ডিলকস জোনের অস্তিত্বের মানে এই নয় যে ঈশ্বর আমাদের জন্য বিশেষ আশীর্বাদ দান করেছেন। এটা হয়তো কাকতালীয় ঘটনাও হতে পারে। হয়তো মহাকাশে গোল্ডিলকস জোনের বাইরে থাকা কোটি কোটি মৃত গ্রহের মধ্যে একটা বিরল উদাহরণ।
গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস অ্যাটম বা পরমাণুর অস্তিত্বের কথা অনুমান করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘সংখ্যা ও আকারের দিক দিয়ে বিশ্ব অসীম। অনেকগুলোর কোনো সূর্যও নেই, চাঁদও নেই। আবার অন্যদের একাধিক চাঁদ ও সূর্য রয়েছে। বিশ্বগুলোর মধ্যে দূরত্ব সমান নয়, কিছু দিকে তাদের মধ্যে দূরত্ব অনেক বেশি।…তাদের একটার সঙ্গে আরেকটার সংঘর্ষের কারণে ধ্বংস নেমে আসে। কিছু বিশ্ব প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবন এবং সব আর্দ্রতা থেকে বঞ্চিত।’
২০০২ সালের মধ্যে এক শ বহিঃসৌরজাগতিক গ্রহ বা এক্সটাসোলার প্ল্যানেট আবিষ্কার করেছেন জ্যোতির্বিদেরা। এসব গ্রহ তাদের নিজ নিজ সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। বহিঃসৌরগ্রহ আবিষ্কারের হার প্রায় প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে। বহিঃসৌরগ্রহ নিজস্ব কোনো আলো দেয় না। তাই তাদের বিভিন্ন রকম পরোক্ষ উপায়ে শনাক্ত করেন জ্যোতির্বিদেরা। সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হলো মাতৃনক্ষত্রের কম্পন অনুসন্ধান। বৃহস্পতি আকৃতির কোনো গ্রহ যদি ওই মাতৃনক্ষত্রের চারপাশে ঘোরে, তাহলে নক্ষত্রটি এপাশ- ওপাশ নড়াচড়া করে। কম্পিত ওই নক্ষত্র থেকে নিঃসৃত আলোর ডপলার শিফট বিশ্লেষণ করে নির্ণয় করা যায়, সেটি কতটা জোরে চলাফেরা করছে। আবার নিউটনের সূত্র ব্যবহার করে নক্ষত্রটির চারপাশের ঘূর্ণনরত গ্রহগুলোর ভরও নির্ণয় করা যায়।
‘নক্ষত্রটি এবং তার বড় গ্রহটিকে নাচের সঙ্গী হিসেবে ভেবে নেওয়া যায়। যেন গ্রহটি নক্ষত্রটির চারপাশের ঘোরার সময় তাদের প্রসারিত হাত করমর্দন করে। নক্ষত্রটির বাইরের দিকে ছোট সঙ্গী গ্রহ অনেক দূরে বড় একটা বৃত্তে ঘুরছে। অন্যদিকে ভেতরের বড় সঙ্গী গ্রহটি খুব ছোট বৃত্তাকার পথে ঘোরে। খুব ছোট এই ভেতরের বৃত্তাকার পথের চারদিকে চলা আসলে কম্পন বা এপাশ-ওপাশ নড়া। সেটাই আমরা এসব নক্ষত্রে দেখতে পাই।’ এ কথা বলেছেন কার্নেগি ইনস্টিটিউটের ক্রিস ম্যাককার্থি। এ পদ্ধতিটা এখন এতই নিখুঁত যে আমরা কয়েক শ আলোকবর্ষ দূরের কোনো নক্ষত্রে সেকেন্ডে ৩ মিটার ক্ষুদ্র পার্থক্যও শনাক্ত করতে পারি (দ্রুত হাঁটার গতি)।
অন্যান্য আরও উদ্ভাবনী পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছে আরও গ্রহ অনুসন্ধানের জন্য। এর মধ্যে একটি হলো, মাতৃনক্ষত্রে গ্রহণ খুঁজে দেখা। এ সময় মাতৃনক্ষত্রের সামনে দিয়ে গ্রহগুলো অতিক্রম করার কারণে নক্ষত্রটির উজ্জ্বলতা কিছুটা কমে যায়। আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে কক্ষপথে ইন্টারফেরোমেট্রি স্পেস স্যাটেলাইট পাঠাবে নাসা। এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাইরের মহাকাশে পৃথিবীর মতো ছোট গ্রহ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে। (মাতৃনক্ষত্রের উজ্জ্বলতায় গ্রহটি আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। এই স্যাটেলাইট আলোক ব্যতিচার ব্যবহার করে মাতৃনক্ষত্রের তীব্র জ্যোতির্বলয় বাতিল করে দিতে পারবে। তাতে পৃথিবীর মতো গ্রহ আর গুপ্ত থাকবে না।)
এখন পর্যন্ত বৃহস্পতি আকৃতির যেসব বহিঃসৌরগ্রহ আমরা আবিষ্কারে করেছি, তার কোনোটির সঙ্গেই পৃথিবীর কোনো মিল নেই। সম্ভবত সেগুলো মৃত গ্রহ। জ্যোতির্বিদেরা সেগুলোকে অত্যন্ত অস্বাভাবিক কক্ষপথে কিংবা তাদের মাতৃনক্ষত্রের খুব কাছের কক্ষপথে আবিষ্কার করেছেন। দুটো ক্ষেত্রেই পৃথিবীর মতো কোনো গ্রহ গোল্ডিলকস জোনে থাকা অসম্ভব। ওই সব সৌরজগতে বৃহস্পতি গ্রহ আকৃতির গ্রহ গোল্ডিলকস জোন অতিক্রম করবে এবং পৃথিবী আকৃতির যেকোনো ছোট গ্রহকে বাইরের মহাকাশে ছুড়ে ফেলে দেবে। বলা বাহুল্য, এর কারণে সেখানে আমাদের জানা কোনো জীবনের উদ্ভবে বাধা দেবে।
অত্যন্ত ভিন্নকেন্দ্রী বা অস্বাভাবিক কক্ষপথ মহাকাশে সাধারণ ঘটনা। এটা এত সাধারণ ব্যাপার যে ২০০৩ সালে মহাকাশে স্বাভাবিক একটি সৌরজগৎ আবিষ্কৃত হওয়ার কারণে তা সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ও অস্ট্রেলিয়ার জ্যোতির্বিদেরা HD 70642 নক্ষত্রের চারপাশে ঘূর্ণনরত বৃহস্পতি আকৃতির একটি গ্রহ আবিষ্কারের পর সেটাও শিরোনাম হয়েছিল। গ্রহটির (গ্রহটি আমাদের বৃহস্পতির প্রায় দ্বিগুণ আকৃতির) অস্বাভাবিকতা হলো, এর কক্ষপথ মোটামুটি সূর্যের সঙ্গে আমাদের বৃহস্পতির অনুপাতের সমান।
তবে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য সৌরজগতের জন্য আমাদের পার্শ্ববর্তী সবগুলো নক্ষত্রের তালিকা তৈরি করতে পারা উচিত জ্যোতির্বিদদের। ‘আমরা সূর্যের মতো পার্শ্ববর্তী ২০০০টি নক্ষত্রে জরিপ চালাচ্ছি। সূর্যের মতো নক্ষত্রের সবগুলো ১৫০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।’ ওয়াশিংটনের কার্নেগি ইনস্টিটিউটের পল বাটলার বলেছেন এ কথা। ১৯৯৫ সালে প্রথম বহিঃসৌরগ্রহ আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। ‘আমাদের লক্ষ্য দ্বিমুখী। এর মধ্যে একটা হলো মহাকাশে আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশীদের নিয়ে প্রথম জরিপের পুনর্বিবেচনা করা। পাশাপাশি মৌলিক একটা প্রশ্নের জন্য প্রথম কোনো উপাত্তের জোগান দেওয়া। প্রশ্নটি হলো, আমাদের নিজেদের সৌরজগৎ কতটা সাধারণ কিংবা কতটা বিরল’, তিনি উল্লেখ করেন।
মহাজাগতিক দুর্ঘটনা
প্রাণ সৃষ্টির জন্য আমাদের গ্রহটিকে অবশ্যই কয়েক শ মিলিয়ন বছর ধরে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল পর্যায়ে থাকতে হয়েছে। কিন্তু কোনো গ্ৰহ কয়েক শ মিলিয়ন বছরের জন্য স্থিতিশীল হওয়া বিস্ময়করভাবে কঠিন।
পরমাণু কীভাবে তৈরি হয়, সে কথা দিয়ে শুরু করি। এখানে একটি প্রোটনের ভর একটা নিউট্রনের চেয়ে সামান্য কিছুটা কম হতে হয়। সোজা কথায়, নিউট্রন ক্রমান্বয়ে ক্ষয় হয়ে প্রোটনে রূপান্তরিত হয়, যা একটা নিম্ন শক্তি স্তর দখল করে। কিন্তু প্রোটন মাত্র ১ ভাগ বেশি ভারী হলে ক্ষয় হয়ে নিউট্রনে পরিণত হতো। এতে সব নিউক্লিয়াস হয়ে উঠত অস্থিতিশীল ও বিশৃঙ্খল। ফলে পরমাণু ভেঙে যেত এবং প্রাণও হয়ে উঠত অসম্ভব।
প্রাণকে সম্ভব করে তুলছে আরেকটি মহাজাগতিক দুর্ঘটনা। সেটি হলো প্রোটন স্থিতিশীল এবং তা ক্ষয় হয়ে কোনো অ্যান্টি-ইলেকট্রনে পরিণত হয় না। পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রোটনের জীবনকাল সত্যিকার অর্থে অনেক বড়। মহাবিশ্বের জীবনকালের চেয়েও অনেক দীর্ঘ। কাজেই স্থিতিশীল ডিএনএ তৈরির উদ্দেশ্যে প্রোটনকে অন্তত কয়েক মিলিয়ন বছরের জন্য অবশ্যই স্থিতিশীল থাকতে হবে।
শক্তিশালী বা সবল নিউক্লিয়ার বল যদি সামান্য একটু দুর্বল হতো, তাহলে ডিউটেরিয়ামের মতো নিউক্লিও ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত। নক্ষত্রের ভেতর নিউক্লিওসিন্থেসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মহাবিশ্বের কোনো মৌল আর তৈরি হতো না তখন। আবার সবল নিউক্লিয়ার বল কিছুটা শক্তিশালী হলে, নক্ষত্রগুলো তাদের নিউক্লিয়ার জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলত অতি দ্রুততম সময়ে। তাতে প্ৰাণ বিকশিত হতে পারত না।
দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের শক্তিমত্তা পরিবর্তন করলে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রেও প্রাণের উদ্ভব অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের মিথস্ক্রিয়ায় কাজ করে নিউট্রিনো। বিস্ফোরিত সুপারনোভা থেকে শক্তি বাইরে বয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে নিউট্রিনোর। লোহার পর অন্যান্য ভারী মৌল সৃষ্টির পেছনেও এই শক্তির ভূমিকা আছে। দুর্বল নিউক্লিয়ার বল যদি আরেকটু দুর্বল হতো, তাহলে নিউট্রিনো মোটেও মিথস্ক্রিয়া করত না। সোজা কথায়, লোহার পরের ভারী মৌলগুলো তৈরি করত না সুপারনোভা। আবার দুর্বল নিউক্লিয়ার বল কিছুটা শক্তিশালী হলে, নক্ষত্রের কেন্দ্র থেকে নিউট্রিনো যথাযথভাবে বেরিয়ে আসতে পারত না। তাহলেও আমাদের দেহ ও আমাদের বিশ্বের জন্য উচ্চতর মৌলগুলো তৈরিতে বাধা পড়ত।
বিজ্ঞানীরা আসলে এ রকম বহুসংখ্যক সন্তোষজনক মহাজাগতিক দুর্ঘটনার দীর্ঘ তালিকা তৈরি করেছেন। এই মনোরম তালিকার মুখোমুখি হলে, কতগুলো পরিচিত মহাজাগতিক ধ্রুবক খুব ছোট্ট পরিসরের মধ্য থেকে প্রাণকে সম্ভবপর করে তুলেছে, তা দেখে বিস্মিত হতে হয়। এসব দুর্ঘটনার মাত্র একটাও যদি বদলে যায়, তাহলে নক্ষত্র কখনোই গঠিত হতো না, স্রেফ ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত মহাবিশ্ব। আবার ডিএনএর অস্তিত্বও থাকত না, প্ৰাণও হয়ে উঠত অসম্ভব। পৃথিবী বিপর্যস্ত হতো বা জমে যেত এবং আরও অনেক কিছু।
এই পরিস্থিতিটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা জোরালোভাবে বোঝাতে এর সঙ্গে একটা জাঙ্কইয়ার্ডে টর্নেডোর আঘাতে আপনা-আপনি একটা বোয়িং ৭৪৭ বিমান তৈরি হওয়ার তুলনা করেছেন জ্যোতির্বিদ হুগো রস।
অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল
আবার ওপরে বর্ণিত সব যুক্তি অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপলের অধীনে একত্র হয়। এই বিতর্কিত নীতিটি সম্পর্কে একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। আমার সেকেন্ড গ্রেডের সেই শিক্ষিকা মনে করতেন, এসব সন্তোষজনক কাকতালীয় ঘটনা আসলে একটা গ্র্যান্ড ডিজাইন বা মহাপরিকল্পনার অস্তিত্বের সম্পর্কও পরোক্ষভাবে প্রকাশ করে। পদার্থবিদ ফ্রিম্যান ডাইসন একবার বলেছিলেন, ‘এটা দেখে মনে হয় যেন মহাবিশ্ব জানত যে আমরা আসছি।’ এটা স্ট্রং অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপলের একটা উদাহরণ। এ ধারণাটি হলো, ভৌত ধ্রুবকগুলোর ফাইন টিউনিং নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং কোনো ধরনের নকশা বা ডিজাইনের ইঙ্গিত করে এটা। (দুর্বল বা উইক অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল সরলভাবে বলে, মহাবিশ্বের ভৌত ধ্রুবকগুলো এমন যে সেগুলো প্রাণ ও চেতনাকে সম্ভব করে তোলে। )
বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল সংক্ষিপ্ত করার প্রস্তাব করেছেন পদার্থবিদ ডন পেজ। সেগুলো নিম্নরূপ :
উইক অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল, ‘মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা যা পর্যবেক্ষণ করি, পর্যবেক্ষক হিসেবে তা আমাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তার মাধ্যমে সীমাবদ্ধ।’
স্ট্রং-উইক অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল, ‘অনেক বিশ্বের মহাবিশ্বের মধ্যে অন্তত একটা বিশ্বে…প্রাণ অবশ্যই বিকশিত হয়েছে।’
স্ট্রং অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল, ‘মহাবিশ্বকে ভেতরে প্রাণের বিকাশে অবশ্যই কিছু সময় তার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে।’
ফাইনাল অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল, ‘মহাবিশ্বের ভেতর অবশ্যই বুদ্ধিমত্তা বিকশিত হবে এবং এরপর তার আর কখনো মৃত্যু হবে না।
যে পদার্থবিদ স্ট্রং অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপলকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন এবং সেটা ঈশ্বরের ইঙ্গিত বলে দাবি করেছেন, তিনি ভেরা কিসটিয়াকোস্কি। এমআইটির পদার্থবিদ তিনি। ভেরা বলেন, ‘ভৌত বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির মাধ্যমে প্রকাশিত সূক্ষ্মশৃঙ্খলা ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ দাবি করে।’ দ্বিতীয় যে বিজ্ঞানী এই মতামত সমর্থন করেন, তিনি জন পোলকিংহর্ন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টিকেল ফিজিকসে নিজের অবস্থান ছেড়ে এখন চার্চ অব ইংল্যান্ডের যাজক হয়েছেন তিনি। তিনি লিখেছেন, ‘শুধু যেকোনো পুরোনো বিশ্বই নয়, বরং এটি প্রাণের জন্য বিশেষভাবে ও সূক্ষ্মভাবে সমন্বয় করা। কারণ, এটা সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। এটা হোক বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তিনি।’ আসলে স্বয়ং আইজ্যাক নিউটনও বিশ্বাস করতেন, এসব সূত্রের আভিজাত্য ঈশ্বরের অস্তিত্বের দিকেই ইঙ্গিত করে। তিনি ধ্রুব সূত্রের ধারণা চালু করেছিলেন, যা গ্রহ ও নক্ষত্রগুলোকে ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই পরিচালনা করে।
কিন্তু এতে নিশ্চিত হতে পারেননি পদার্থবিদ ও নোবেল বিজয়ী স্টিভেন ওয়াইনবার্গ। তিনি অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপলের আবেদন স্বীকার করে বলেছেন, ‘মানুষের পক্ষে এটা বিশ্বাস করা প্রায় অনিবার্য যে মহাবিশ্বের সঙ্গে আমাদের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের জীবন কেবল অতীতের প্রথম তিন মিনিটের ধারাবাহিক দুর্ঘটনার উদ্ভট পরিণতি নয়। বরং আমরা কোনোভাবে একদম শুরু থেকেই এর মধ্যে অন্তর্নিহিত ছিলাম।’ তিনি উপসংহারে বলেছেন, স্ট্রং অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল হলো ‘আধ্যাত্মিক অর্থহীনতার চেয়েও বেশি কিছু।’
অন্যরা অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপলের শক্তি সম্পর্কে কমই বিশ্বাস করেন। একসময় অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপলে মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রয়াত পদার্থবিদ হেইঞ্জ প্যাগেলস। কিন্তু একসময় এতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কারণ, কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা নেই এ তত্ত্বের। তত্ত্বটি পরীক্ষা করে দেখারও উপায় নেই। এমনকি এ থেকে নতুন কোনো তথ্যও বের করা যায় না। তার বদলে তত্ত্বটি একই কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার বলে। আর সে কথাটি হলো, আমরা এখানে, কারণ আমরা এখানেই আছি।
অ্যালান গুথও অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, “আমার পক্ষে বিশ্বাস করাও কঠিন যে কারও কাছে ভালো কোনো ব্যাখ্যা থাকা সত্ত্বেও সে কখনো অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল ব্যবহার করবে। তারপরও আমি বিশ্ব ইতিহাসের অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল শুনেছি…মানুষের কাছে ভালো কিছু চিন্তা করার না থাকলে, তারা অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল নিয়ে কাজ করে।’
মাল্টিভার্স
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার মার্টিন রিজের মতো অন্য আরও বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এসব মহাজাগতিক দুর্ঘটনা আসলে মাল্টিভার্সের অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়। রিজ বিশ্বাস করেন, শত শত কাকতালীয় ঘটনার মধ্যে আমরা যে অবিশ্বাস্য রকম অতি ক্ষুদ্র একটা পরিসরে বাস করি, সেই সত্যের একমাত্র সমাধান হলো কোটি কোটি প্যারালাল ইউনিভার্সের অস্তিত্ব স্বীকার করা। মহাবিশ্বসমূহের এসব মাল্টিভার্সের মধ্যে বেশির ভাগ মহাবিশ্বই মৃত। সেখানে প্রোটনও স্থিতিশীল নয়। পরমাণু কখনোই গঠিত হয়নি। গঠিত হয়নি কোনো ডিএনএও। মহাবিশ্বগুলো অকালে ধসে গেছে কিংবা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জমে হিমশীতল হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বের ভেতর ধারাবাহিক মহাজাগতিক দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। এর পেছনের কারণ অনিবার্যভাবে ঈশ্বরের কারণে নয়, বরং গড়পড়তা নিয়ম।
এক অর্থে স্যার মার্টিন রিজ হলেন সেই সর্বশেষ ব্যক্তি, যিনি বিশ্বাস করেন, প্যারালাল ইউনিভার্সের ধারণা হয়তো আরও এগিয়ে যাবে। ইংল্যান্ডের রাজকীয় জ্যোতির্বিদ তিনি। মহাবিশ্ব সম্পর্কে প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপনের জন্য দায়িত্বও রয়েছে তাঁর। শুভ্রকেশী, খানদানি, নিখুঁত পোশাক পরিহিত রিজ অনর্গল কথা বলেন মহাবিশ্বের অদ্ভুত ব্যাপারগুলো নিয়ে। একই সঙ্গে সাধারণ জনগণ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
তাঁর বিশ্বাস, প্রাণের অস্তিত্বের জন্য সুসংহত হওয়া মহাবিশ্ব কোনো দুর্ঘটনা নয়। প্রাণের অস্তিত্বের জন্য এ রকম সূক্ষ্ম স্বল্প পরিসর হতে মহাবিশ্বের জন্য অনেক বেশি দুর্ঘটনা দেখা যাচ্ছে। রিজ লিখেছেন, ‘আমাদের অস্তিত্ব যে আপাতসূক্ষ্ম সমন্বয়ের ওপর নির্ভর করে, তা কোনো কাকতালীয় ঘটনাও হতে পারে। একবার এ রকমই ভেবেছিলাম। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গিকে এখন সীমিত বলে মনে হয়…আমরা মহাবিশ্বের বিভিন্ন বিশেষ বৈশিষ্ট্য একবার মেনে নিলে—সেগুলো কিছু ধর্মতত্ত্ববিদ যে বিধাতার হস্তক্ষেপ বা নকশার প্রমাণ হিসেবে হাজির করবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।’
এসব ধারণার কয়েকটি সংখ্যায় প্রকাশের মাধ্যমে নিজের যুক্তিগুলোর সারাংশ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন রিজ। তিনি দাবি করেন, মহাবিশ্ব সম্ভবত মাত্র ছয়টি সংখ্যা দিয়ে পরিচালিত। এসব সংখ্যার প্রতিটি গণনাযোগ্য এবং সুষমভাবে সমন্বিত। এই ছয়টি সংখ্যাকে অবশ্যই প্রাণের শর্ত পূরণ করতে হবে। নয়তো মৃত মহাবিশ্ব সৃষ্টি করবে সংখ্যাগুলো।
ছয়টি সংখ্যার প্রথমটি হলো এপসাইলন (Epsilon)। এর মান ০.০০৭- এর সমান। সংখ্যাটি হাইড্রোজেনের আপেক্ষিক পরিমাণ, যা মহাবিস্ফোরণের ফিউশন প্রক্রিয়ায় হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয়। সংখ্যাটি যদি ০.০০৭ না হয়ে ০.০০৬ হতো, তাহলে নিউক্লিয়ার বল দুর্বল হয়ে যেত। আবার কোনোভাবেই একত্রে আবদ্ধ হতে পারত না প্রোটন ও নিউটন। গঠিত হতে পারত না ডিউটেরিয়ামও (একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রনসহ)। ফলে নক্ষত্রের ভেতর ভারী মৌলগুলো কখনো গঠিত হতো না। গঠিত হতো না আমাদের দেহের পরমাণুগুলোও। গোটা মহাবিশ্ব দ্রবীভূত হয়ে থাকত হাইড্রোজেন পরমাণুতে। এমনকি নিউক্লিয়ার বল সামান্য কমে গেলেও মৌলের পর্যায় সারণিতে অস্থিতিশীল দেখা দিত। মহাবিশ্বে প্রাণ সৃষ্টির জন্য জরুরি স্থিতিশীল মৌল দেখা যেত অতি অল্পসংখ্যক।
এপসাইলন যদি ০.০০৮ হতো, তাহলে ফিউশন প্রক্রিয়া এত দ্রুতগতিতে ঘটত যে মহাবিস্ফোরণ থেকে কোনো হাইড্রোজেন টিকে থাকতে পারত না। সে ক্ষেত্রে গ্রহগুলোতে শক্তির জোগান দেওয়ার জন্য আজ কোনো নক্ষত্রের দেখা পাওয়া যেত না। কিংবা দুটি প্রোটন একত্রে আবদ্ধ হয়েও অসম্ভব করে তুলত নক্ষত্রে ফিউশন বিক্রিয়া। আরেকটি সত্যের প্রতি রিজ ইঙ্গিত করেছেন, যে ফ্রেড হয়েল দেখতে পেয়েছিলেন যে নিউক্লিয়ার বলে মাত্র ৪ ভাগ বিচ্যুতিও নক্ষত্রগুলোতে কার্বন গঠন অসম্ভব করে তুলত। তাতে উচ্চতর মৌলও তৈরি হতো না এবং প্রাণের উদ্ভব হয়ে উঠত অসম্ভব। হয়েল দেখতে পান, নিউক্লিয়ার বল সামান্য বদলে দেওয়া হলে বেরিলিয়াম খুবই অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। তাতে কার্বন পরমাণু তৈরির করার জন্য কখনো আর সেটি সেতু হিসেবে কাজ করতে পারবে না।
দ্বিতীয়টি হলো N, যার মান ১০^৩৬। মহাকর্ষের শক্তিমত্তা দিয়ে বৈদ্যুতিক বলের শক্তিমত্তাকে ভাগ দিলে এই মানটি পাওয়া যায়। মহাকর্ষ কতটা দুর্বল, সেটিই দেখায় এ মানটি। মহাকর্ষ যদি আরও দুর্বল হতো, তাহলে নক্ষত্রগুলো কখনোই ঘনীভূত হতে পারত না। আবার কখনো তৈরিও হতো না ফিউশনের জন্য অতি দরকারি বিপুল পরিমাণ তাপমাত্রাও। কাজেই নক্ষত্ররা আর আলোকিত হতে পারত না। গ্রহগুলো ডুবে থাকত হিমশীতল চির অন্ধকারে।
কিন্তু মহাকর্ষ যদি কিছুটা শক্তিশালী হতো, তাহলে খুব দ্রুত হারে উত্তপ্ত হতো নক্ষত্রগুলো। পরিণতিতে খুব দ্রুত তাদের জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলত নক্ষত্ররা। তাই প্রাণের সূচনা কখনোই সম্ভব হতো না। আবার শক্তিশালী মহাকর্ষের মানে হলো, ছায়াপথগুলো অনেক আগেই গঠিত হতো এবং বেশ ছোট হতো তাদের আকৃতি। নক্ষত্রগুলোও অতি ঘন হয়ে উঠত। তাতে বিভিন্ন নক্ষত্র ও গ্রহগুলোর মধ্যে বেধে যেত বিপর্যয়কর সংঘর্ষ।
তৃতীয় সংখ্যা ওমেগা। এটি দিয়ে মহাবিশ্বের আপেক্ষিক ঘনত্ব বোঝায়। ওমেগার মান খুব ছোট হলে মহাবিশ্ব প্রসারিত ও শীতল হতো অতি দ্রুত হারে। কিন্তু ওমেগার মান খুব বেশি বড় হলে মহাবিশ্বে প্রাণের উদ্ভব হওয়ার অনেক আগে চুপসে যেত। রিজ লিখেছেন, ‘মহাবিস্ফোরণের এক সেকেন্ড পর, ওমেগার মান ইউনিটি (একতা) থেকে এক মিলিয়ন মিলিয়নের এক ভাগের বেশি (১০^১৫ এর মধ্যে এক) পার্থক্য হতে পারেনি। তাই মহাবিশ্ব ১০ বিলিয়ন বছর পর এখনো প্রসারিত হতে পারছে। ওমেগার মান ইউনিটি থেকে আলাদা হতে পারেনি নিঃসন্দেহে।’
চতুর্থটি হলো ল্যাম্বডা। অর্থাৎ মহাজাগতিক ধ্রুবক বা কসমোলজিক্যাল কন্সট্যান্ট, যা মহাবিশ্বের ত্বরণ নির্ধারণ করে। এই মানটি যদি কয়েক গুণ বড় হতো, তাহলে এটি যে অ্যান্টিগ্র্যাভিটি সৃষ্টি করবে, তা মহাবিশ্বকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। এমনকি তাৎক্ষণিকভাবে বিগ ফ্রিজেও পাঠিয়ে দেবে মহাবিশ্বকে। বলা বাহুল্য, তাতে প্রাণের টিকে থাকা অসম্ভব। কিন্তু মহাজাগতিক ধ্রুবকটি ঋণাত্মক হলে মহাবিশ্ব প্রচণ্ডভাবে সংকুচিত হয়ে একটা বিগ ক্রাঞ্চে বা মহাসংকোচনে চলে যেত। সেটি ঘটত প্রাণের সূচনার অনেক আগেভাগেই। অন্য কথায়, ওমেগার মতো মহাজাগতিক ধ্রুবকও অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট স্বল্প পরিসরে থেকে প্রাণের উদ্ভব সম্ভবপর করে তুলেছে।
পঞ্চম সংখ্যাটি হলো Q। কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বিকিরণে অনিয়মের ব্যাপকতা প্রকাশ করে এ সংখ্যাটি। এর মান ১০^-৫। এ সংখ্যাটি আরেকটু ছোট হলে মহাবিশ্ব চরম সুষম হতো। সেখানে থাকত প্ৰাণহীন গ্যাস ও ধূলিকণা। সেগুলো কখনোই ঘনবদ্ধ হয়ে আজকের নক্ষত্র বা গ্রহগুলো গঠিত হতে পারত না। মহাবিশ্ব হতো অন্ধকার, সুষম, বৈশিষ্ট্যহীন ও প্রাণহীন। Q আরেকটু বড় হলে পদার্থ মহাবিশ্বের ইতিহাসে অনেক আগে ঘনবদ্ধ হয়ে গঠিত হতো প্রকাণ্ড সুপারগ্যালাকটিক কাঠামো। রিজ বলেছেন, এসব ‘বড় ধরনের বস্তুগুলো সংকুচিত হয়ে পরিণত হতো বিশাল আকৃতির কৃষ্ণগহ্বরে।’ এসব কৃষ্ণগহ্বরের একেকটা গোটা একটা ছায়াপথের চেয়েও বেশি ভারী হতো। গ্যাসের এসব বিপুল আকৃতির ক্লাস্টারে নক্ষত্র গঠিত হলেও তা এতই ঠাসাঠাসি হয়ে থাকত যে গ্রহ ব্যবস্থাও হয়ে উঠত অসম্ভব।
সর্বশেষ সংখ্যাটি হলো D, যা স্থানিক মাত্রার সংখ্যা প্রকাশ করে। এম- থিওরিতে আগ্রহের কারণে পদার্থবিজ্ঞানীরা এ প্রশ্নেরও জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছেন যে উচ্চতর বা নিম্নমাত্রায় প্রাণ টিকে থাকা সম্ভব কি না। স্থান যদি একমাত্রিক হতো, তাহলে প্রাণের কোনো অস্তিত্ব থাকত না। কারণ, মহাবিশ্ব হতো তুচ্ছ। সাধারণত একমাত্রিক মহাবিশ্বে পদার্থবিদেরা যখন কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন, তখন দেখা গেছে, কণারা পরস্পরের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করে কোনো রকম মিথস্ক্রিয়া ছাড়াই। কাজেই এক মাত্রার মহাবিশ্বে প্রাণের উপযুক্ত নয় বলে মনে হয়। কারণ, সেখানে কণাগুলো পরস্পরের সঙ্গে একত্র হয়ে ক্রমবর্ধমান জটিল বস্তু গঠন করতে পারে না।
আবার সমস্যা আছে দুটি স্থানিক মাত্রাতেও। কারণ, সেখানে প্রাণের গঠন সম্ভবত খণ্ডিত হতো। একটি দ্বিমাত্রিক প্রজাতি কল্পনা করা যাক, যারা ফ্ল্যাট বা সমতলের প্রাণী। এদের বলা হয় ফ্ল্যাটল্যান্ডার। তারা একটা টেবিলের ওপর বসবাস করে। তাদের খাওয়ার কথা কল্পনা করুন। মুখ থেকে তাদের পেছন পর্যন্ত পথটি ফ্ল্যাটল্যান্ডারকে দুভাগে বিভক্ত করবে। টুকরো টুকরো হয়ে যাবে প্রাণীটা। কাজেই একটা জটিল জীব হিসেবে বিভক্ত বা টুকরো টুকরো না হয়ে, কোনো ফ্ল্যাটল্যান্ডার কীভাবে টিকে থাকতে পারে, তা কল্পনা করাও কঠিন।
জীববিজ্ঞানের আরেকটি যুক্তি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে বুদ্ধিমত্তা তিনমাত্রার চেয়ে কম মাত্রায় থাকতে পারে না। আমাদের মস্তিষ্ক বিপুল পরিমাণ ওভারল্যাপিং বা পরস্পরছেদি নিউরন ধারণ করে। নিউরনগুলো বড় ধরনের বৈদ্যুতিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংযুক্ত। একে বলা হয় নিউরাল নেটওয়ার্ক। মহাবিশ্ব এক বা দুই মাত্রিক হলে সেখানে জটিল নিউরাল নেটওয়ার্ক গঠন করা কঠিন হতো। বিশেষ করে, সেগুলো যদি একটির ওপর আরেকটি থাকত, তাহলে শর্টসার্কিট দেখা দিত সেগুলোতে। নিম্নমাত্রায় জটিল লজিক সার্কিটের সংখ্যার দিক দিয়ে এবং অল্প জায়গায় যে বিপুলসংখ্যক নিউরন রাখা সম্ভব, সেদিক দিয়ে আমরা মারাত্মক রকম সীমাবদ্ধ হতাম। যেমন আমাদের মস্তিষ্কে নিউরনের সংখ্যা প্রায় ১০০ বিলিয়ন। এর পরিমাণ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে যে পরিমাণ নক্ষত্র আছে তার সমান। প্রতিটি নিউরন প্রায় ১০ হাজার অন্য নিউরনের সঙ্গে সংযুক্ত। এ রকম জটিলতা নিম্নমাত্রায় আনা খুব কঠিন।
আবার চার মাত্রাতেও রয়েছে আরেক ধরনের সমস্যা। চার মাত্রায় গ্রহগুলো সূর্যের চারদিকের কক্ষপথে স্থিতিশীল নয়। নিউটনের বিপরীত বর্গীয় সূত্রটি এখানে প্রতিস্থাপিত করতে হয় বিপরীত ঘনকীয় সূত্র দিয়ে। অন্য মাত্রাগুলোতে পদার্থবিজ্ঞান কেমন হতে পারে, তা ১৯১৭ সালে অনুমান করেন আইনস্টাইনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী পল এহরেনফেস্ট। তাঁর সেই বিশ্লেষণকে এখন বলা হয় পয়সন-ল্যাপ্লাস সমীকরণ (যা গ্রহীয় বস্তুগুলোর গতিসহ পরমাণু বৈদ্যুতিক চার্জ নিয়ন্ত্রণ করে)। তিনি দেখতে পান, চার মাত্রায় কিংবা তার চেয়ে বেশি স্থানিক মাত্রায় কক্ষপথগুলো স্থিতিশীল নয়। কারণ, এতে পরমাণুর ইলেকট্রন এবং একইভাবে গ্রহগুলো বারবার সংঘর্ষের মুখে পড়ে। সোজা কথায়, পরমাণু এবং সৌরজগৎ সম্ভবত উচ্চতর মাত্রাগুলোয় টিকে থাকতে পারে না। কাজেই তিন মাত্রা আসলে বিশেষ কিছু।
রিজের কাছে অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল মাল্টিভার্সের জন্য খাড়া করা সবচেয়ে আকর্ষণীয় যুক্তিগুলোর একটি। পৃথিবীর জন্য গোল্ডিলকস জোনের অস্তিত্ব যেমন বহিঃসৌরগ্রহ বোঝায়, তেমনি মহাবিশ্বের গোল্ডিলকসের উপস্থিতি বোঝায় প্যারালাল মহাবিশ্ব থাকার কথা। রিজের মন্তব্য, ‘বিপুলসংখ্যক পোশাক থেকে একটা মানানসই স্যুট খুঁজে পাওয়া গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অসংখ্য মহাবিশ্বের অস্তিত্বও যদি থাকে, সেগুলোর প্রতিটি যদি বিভিন্ন সংখ্যার সেট দিয়ে পরিচালিত হয়, তাহলে সেখানে এমন একটাকে পাওয়া যাবে, যেটা প্রাণের উপযোগী নির্দিষ্ট সংখ্যার সেট দিয়ে পরিচালিত। আমরা হলাম তেমন একটি।’ অন্য কথায়, আমাদের মহাবিশ্ব এমন হওয়ার কারণ মাল্টিভার্সে অসংখ্য মহাবিশ্বের মধ্যে গড়পড়তা সূত্র দিয়ে এটি পরিচালিত, কোনো গ্র্যান্ড ডিজাইনের কারণে নয়।
ওয়াইনবার্গও এই বিষয়ে একমত বলে মনে হয়। আসলে মাল্টিভার্সের এ ধারণায় বুদ্ধিবৃত্তিক আনন্দ খুঁজে পান ওয়াইনবার্গ। মহাবিস্ফোরণের মুহূর্তে সময় হুট করে হাজির হতে পারে এবং তার আগে কোনো সময়ের অস্তিত্ব ছিল না—এই ধারণায় তিনি কখনো বিশ্বাস করতে পারেননি। একটা মাল্টিভার্সে আমরা হলাম মহাবিশ্বের চিরন্তন সৃষ্টি।
আরেক অদ্ভুত কারণে মাল্টিভার্সের ধারণা রিজের বেশ পছন্দের। তিনি দেখেছেন, মহাবিশ্বে সামান্য পরিমাণ কদর্যতা আছে। যেমন পৃথিবীর কক্ষপথ কিছুটা উপবৃত্তাকার। এই কক্ষপথ যদি নিখুঁতভাবে গোলকীয় হতো, তাহলে ধর্মতত্ত্ববিদদের মতো হয়তো যুক্তি দেওয়া যেত যে ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের উপজাত এটা। কিন্তু ঘটনা তো তা নয়। এতে আভাস পাওয়া যায়, স্বল্প পরিসরের গোল্ডিলকসের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ এলোমেলো স্বভাব রয়েছে। একইভাবে মহাজাগতিক ধ্রুবকও নিখুঁতভাবে শূন্য নয়, বরং এটা বেশ ছোট। এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, আমাদের উপস্থিতির প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের মহাবিশ্ব মোটেও বিশেষ কিছু নয়। এসব কিছুই আমাদের মহাবিশ্বে এলোমেলোভাবে দুর্ঘটনার মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে খাপ খায়।
মহাবিশ্বের বিবর্তন
রিজ দার্শনিক নন, বরং একজন জ্যোতির্বিদ। তাই রিজ বলেন, এর ফলাফল হলো সবগুলো তত্ত্বকেই পরীক্ষাযোগ্য হতে হবে। আসলে এ কারণে আধ্যাত্মিক তত্ত্বগুলোর চেয়ে মাল্টিভার্সের ধারণা বেশি পছন্দ করেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস, মাল্টিভার্স তত্ত্বটি আগামী ২০ বছরের মধ্যে পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব হবে।
মাল্টিভার্স ধারণার একটি ভিন্নতা হলো, এটা এখন পরীক্ষণযোগ্য। রিজের চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে পদার্থবিদ লি স্মোলিন অনুমান করেন, মহাবিশ্বের একটা বিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল। এর সঙ্গে ডারউইনের বিবর্তনের তুলনা চলে। এ বিবর্তন অবশেষে আমাদের মতো মহাবিশ্বের দিকে পরিচালিত করেছে। যেমন বিশৃঙ্খল স্ফীতি তত্ত্বে ‘ডটার’ বা অপত্য মহাবিশ্বের ভৌত ধ্রুবকগুলো মাতৃ মহাবিশ্বের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন হয়। কিছু পদার্থবিদদের বিশ্বাস মতো মহাবিশ্ব যদি কোনো কৃষ্ণগহ্বর থেকে অঙ্কুরিত হতে পারে, তাহলে যেসব মহাবিশ্বে বেশির ভাগ কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে, সেগুলো মাল্টিভার্সের ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে। সোজা কথায়, প্রাণিজগতের মতো যেসব মহাবিশ্ব বেশিসংখ্যক শিশু মহাবিশ্বের জন্ম দেবে, তারাই ক্রমান্বয়ে তাদের ‘জেনেটিক তথ্য’—অর্থাৎ প্রকৃতির ভৌত ধ্রুবকগুলো ছড়িয়ে দিতে আধিপত্য বিস্তার করবে। এ ধারণা সত্য হলে, আমাদের মহাবিশ্বের হয়তো অতীতে অসীমসংখ্যক পূর্বপুরুষ মহাবিশ্ব থাকতে পারে এবং আমাদের মহাবিশ্ব হয়তো ট্রিলিয়ন বছরের প্রাকৃতিক নির্বাচনের উপজাত। অন্য কথায়, আমাদের মহাবিশ্ব হলো সার্ভাভাইল অব দ্য ফিটেস্ট বা যোগ্যতমের টিকে থাকার উপজাত। এর অর্থ, এটি সর্বাধিকসংখ্যক কৃষ্ণগহ্বরবিশিষ্ট মহাবিশ্বগুলোর সন্তান।
মহাবিশ্বগুলোর মধ্যে ডারউইনের বিবর্তন অদ্ভুত ও অভিনব ধারণা হলেও স্মোলিনের বিশ্বাস, কৃষ্ণগহ্বরের সংখ্যা হিসাব করে সহজভাবে এটি পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব। আমাদের মহাবিশ্বকে কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টির জন্য সর্বাধিক অনুকূল হতে হবে। (তবে যে মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি কৃষ্ণগহ্বর থাকে, সেখানে আমাদের মতো প্রাণের জন্য অনুকূল তা প্রমাণ করতে হবে।)
এই ধারণাটি পরীক্ষণযোগ্য হওয়ার কারণে এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ উদাহরণগুলোও বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন মহাবিশ্বের ভৌত প্যারামিটারগুলো হাইপোথেটিক্যালি সমন্বয় করে হয়তো প্রমাণ করা যাবে যে কৃষ্ণগহ্বর মহাবিশ্বে সবচেয়ে অনায়াসে তৈরি হয়, যা প্রাণহীন। যেমন এটাও হয়তো প্রমাণ করা সম্ভব যে অনেক বেশি শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলসহ একটি মহাবিশ্বের নক্ষত্রগুলো চরম দ্রুত হারে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। ফলে বিপুলসংখ্যক সুপারনোভার সৃষ্টি হয়। সেগুলো এরপর চুপসে গিয়ে পরিণত হয় একেকটা কৃষ্ণগহ্বরে। এ রকম কোনো মহাবিশ্বে নিউক্লিয়ার বলের জন্য একটা বড় মানের অর্থ হলো, নক্ষত্রগুলোর জীবনকাল সংক্ষিপ্ত। তাই সেখানে প্রাণের সূচনা হতে পারে না। কিন্তু এই মহাবিশ্বে হয়তো আরও অনেক কৃষ্ণগহ্বর থাকতে পারে। তা যদি হয়, তাহলে স্মোলিনের ধারণা অস্বীকার করা যায়। এই ধারণার সুবিধা হলো, এটি পরীক্ষণযোগ্য, পুনরুৎপাদন করা যায় কিংবা মিথ্যা প্রমাণ করা হয় (যেকোনো সত্যিকার বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের জন্য যা একটা আদর্শ)। কাজেই এটি টিকে থাকবে নাকি থাকবে না, তা সময়ই বলে দেবে।
ওয়ার্মহোল, সুপারস্ট্রিং ও উচ্চতর মাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো তত্ত্ব আমাদের বর্তমানে পরীক্ষামূলক ক্ষমতার বাইরে। তবে নতুন পরীক্ষা- নিরীক্ষাও করে দেখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। সেগুলোই হয়তো নির্ধারণ করবে যে এসব তত্ত্ব সঠিক, নাকি বেঠিক। আমরা এখন পরীক্ষামূলক বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের মাঝখানে রয়েছি। এসব প্রশ্ন বহন করার জন্য এখন আমাদের কাছে আছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন স্যাটেলাইট, স্পেস টেলিস্কোপ, মহাকর্ষ তরঙ্গ ডিটেক্টর ও লেজার। এদের মাধ্যমে পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালিয়ে পর্যাপ্ত ফসল ঘরে তুলে কসমোলজির গভীরতম কিছু প্রশ্নের সমাধান হয়তো করা সম্ভব হতেও পারে।
তথ্যনির্দেশ
গোল্ডিলকস জোন : গোল্ডিলকস জোন বা বাস উপযোগী অঞ্চল, নক্ষত্রের কাছে এমন কোনো এলাকা যেখানে পানি তরল অবস্থায় থাকার জন্য সঠিক তাপমাত্রা বিরাজ করে। গোল্ডিলকস রূপকথার বিখ্যাত চরিত্র। ‘গোল্ডিলকা অ্যান্ড থ্রি বিয়ার’ নামের একটা রূপকথায় এই মেয়েটির দেখা মেলে। ওই গল্পে মেয়েটি ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছু ঘটনার মুখোমুখি হয়। সেখানে প্রতিবারই তিন ধরনের বস্তু থেকে তার জন্য সুবিধাজনক বা উপযোগী বস্তুটি বেছে নিতে দেখা যায় তাকে। এ বিষয়টাই পরে উদাহরণ হিসেবে রূপকথা থেকে খোদ বিজ্ঞানের রাজ্যে ঢুকে পড়েছে।
নিউরন : কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের গঠনমূলক এককের নাম নিউরন। একটি নিউরন সেলবডি, অ্যাক্সন ও ড্রেনডাইড এই তিনটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত। কাজের ওপর ভিত্তি করে নিউরন তিন ধরনের হতে পারে। যথা, সেন্সরি, মোটর এবং ইন্টারনিউরন।