৮. একটা সমস্যা

।। ।।

মাঝেমাঝে এমন হয় যে, আমরা শুরু করি একটা সমস্যা নিয়ে, কিন্তু হঠাৎ সেই সমস্যাটা আর থাকে না, তার বদলে অন্য একটা সমস্যা এসে হাজির হয়! নতুন সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আবার নতুনতর কোনো সমস্যার সম্মুখীন হই!

বেন্টুমাসির কাছ থেকে প্রথম দিকে রেগুলার তাড়া না খেলে, জসনানির অন্তর্ধান নিয়ে আমরা হয়তো কেউই খুব একটা মাথা ঘামাতাম না। বেন্টুমাসি জসনানিকে মার্ডারার ভাবলেও, আমরা তো জানতাম যে, হি হ্যাড নাথিং টু ডু উইথ এনি মার্ডার। আমার যে কারণে একটু ইন্টারেস্ট জেগেছিল, সেটা হল একটি বৃদ্ধ ভারতীয়, হু ইজ বাই নো মিনস এ রিচ পার্সন, তিনি কীভাবে এই অচেনা অজানা জায়গায় লুকিয়ে থাকতে পারবেন? যাই হোক, সমস্যাটা পালটে গেল যখন জানলাম যে, উনি খালি হাতে উধাও হননি, এক মিলিয়ন ডলার নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন! যাঁর পকেটে এক মিলিয়ন ডলারস আছে, তাঁর অন্তত এই পৃথিবীর কোনো জায়গাতেই খাওয়া পড়ার অভাব হবে না! এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে, সেক্ষেত্রে পুলিশ বা এফ.বি.আই.-এর নজর এড়িয়ে থাকা তাঁর পক্ষে বেশ কঠিন ব্যাপার হবে! কিন্তু এখানে ঘটনাচক্র সম্পূর্ণ অন্য দিকে মোড় নিয়েছে! জসনানিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তবে সেই মৃত্যুতে কারও কারসাজি নেই, কেউ তাঁকে হত্যা করেনি! এদিকে টাকাগুলোর কোনো হদিশ নেই! প্রশ্ন, জসনানিই কি টাকাটা চুরি করেছিলেন? না, আর কেউ? শুধু ইন্সপেক্টর লান্ডি নয়, আমাদের সবার কাছেই, ‘দ্যাট্‌স এ ভেরি গুড কোয়েশ্চেন। কিন্তু তার উত্তর যদি পাওয়াও যায়, দ্যাট উইল নট এক্সপ্লেইন যে, জসনানির ডেডবডিটা ওখানে পাওয়া গেল কেন!

.

পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে গাড়িতে যখন উঠলাম, তখন শুধু আমি আর একা নই, প্রমথ আর একেনবাবুও দেখলাম গম্ভীর ভাবে কী সব যেন ভাবছেন। বেশ খানিকটা পথ কেউ আর কোনো কথা বললাম না। কয়েকটা ব্লক যাবার পর একটা সুপারমার্কেটে আমরা থামলাম। একেনবাবুর সিগারেট ফুরিয়ে গেছে। ছাড়ব-ছাড়ব করেও এখনও উনি ব্যাড হ্যাবিটটা ছাড়তে পারেননি। আমি আর প্রমথ গাড়িতে বসে আছি, কিছুক্ষণ বাদে দেখি সুধীর শিকদার –একেনবাবুর সঙ্গে গল্প করতে করতে ফিরছেন! আমাদের দেখে বললেন, “কোনো কথা শুনব না, একটু চা খেয়ে যেতে হবে।”

লোকটা অত্যন্ত নাছোড়বান্দা। আমার আর প্রমথর অনেক আপত্তি ছিল, কিন্তু এমন পীড়াপীড়ি শুরু করলেন যে, আশেপাশে সবাই আমাদের দিকে তাকাতে শুরু করল, যেন কী না কী হচ্ছে! আমি শেষ চেষ্টা করলাম। বললাম, “আমার ভীষণ রাস্তা গুলিয়ে যায়।”

শিকদারমশাই বললেন, “ঠিক আছে, তাহলে গাড়িটা রেখে আমার গাড়িতে আসুন। চা-টা খেয়ে আমি আপনাদের এখানে পৌঁছে দিয়ে যাব।”

এর পর আর ‘না’ বলা যায় কী করে!

ওঁর গাড়িতে উঠে অবশ্য বুঝলাম, এত পীড়াপীড়ির কারণটা কী! একেনবাবুকে বললেন, “বুঝলেন মশাই, বেরিয়েছিলাম সেই ছ’টায়, গিন্নীর জন্য স্কিমড মিল্ক কিনতে। আর এখন বাজে সাড়ে আটটা! টু এন্ড হাফ আওয়ার্স! ভাগ্যিস আপনারা সঙ্গে আছেন, নইলে একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড হত!”

“কী করছিলেন স্যার এতক্ষণ?”

“একটা লন মোয়ারের খোঁজ করছিলাম। রবার্টসে বুঝলেন মশাই প্রচুর কালেকশন –নিউ, ইউজড, ফ্যাক্টরি রিকন্ডিশন্ড, কী চান! একেবারে মাথা ঘুরে যায় দামগুলো দেখে! নতুন হলে তো কথাই নেই, আকাশছোঁয়া দর মশাই!”

শিকদারমশাইয়ের প্রফেশন কী জানি না, কিন্তু ওঁর উচিত ছিল মাস্টারি করা।

সত্যি, কী অসম্ভব ভালোবাসেন লেকচার দিতে!

“বুঝলেন মিস্টার সেন, এভরিথিং আই বাই ইজ ইউজড। এই যে গাড়িটা দেখছেন –এটাও কিন্তু ইউজড কার। কিন্তু বোঝার জো আছে?”

একেনবাবুর মুখ দেখে বুঝলাম এদেশের ‘ইউজড’ কথাটার তাৎপর্যটা ওঁর জানা নেই। তাই বললাম, “ইউজড মানে হল সেকেন্ড হ্যান্ড।”

“ও তাই বলুন স্যার। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমি তো বুঝতেই পারিনি এটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি, ভাবছিলাম একদম ব্র্যান্ড নিউ!”

.

গাড়ির কমপ্লিমেন্ট শুনে শিকদারমশাইয়ের মুখ আত্মপ্রসাদে ভরে উঠল।

“দ্য ফ্যাক্ট ইজ, লোকে অবশ্য বোঝে না, ইউজড গুডস আর ওয়ার্থ এভরি পেনি। প্রথমত, আপনি জলের দরে কিনছেন, দ্বিতীয়ত, পুরোনো বলে এই বুঝি ভেঙে গেল’ ‘এই বুঝি চুরি হল’ –এইসব নিয়ে দুর্ভাবনা করবেন না। তার থেকেও বড় কথা ইউজড জিনিস সাধারণত রিলায়েবল হবে।”

হোয়াট ননসেন্স! মনে মনে বললাম। সেই সঙ্গে প্রমথর হাতে একটা চাপ দিলাম, যাতে হঠাৎ অপমানকর কিছু না বলে ফেলে! কিন্তু একেনবাবু দেখলাম শিকদারমশাইয়ের বক্তৃতাতে একেবারে মুগ্ধ।

“এটা খুব গভীর তাৎপর্যের কথা বললেন স্যার। আমার মাথাতে একদম আসেনি।”

শিকদারমশাই তাতে উৎসাহিত হয়ে বললেন, “আরে বাড়ির কথাই ধরুন না কেন। আমার বন্ধুবান্ধব, যারা একদম নতুন বাড়ি কিনেছে, তারা যে কী ভুগেছে!

বেসমেন্টে জল লিক করছে, দেয়াল ক্র্যাক করছে, প্লাম্বিং ঠিকমতো কাজ করছে না –থাউসেন্ড অ্যান্ড ওয়ান প্রবলেমস মশাই। অথচ আমার বাড়ি দেখবেন। কিনেছি যখন তখন টোয়েন্টি ইয়ার্স ওল্ড, বাট ডিভয়ড অফ অল প্রবলেমস!”

ভাগ্যক্রমে খুব বেশিক্ষণ বকবকানি শুনতে হল না, ওঁর বাড়ি এসে গেল। মিসেস শিকদার বেশ মারমূর্তি ধরেই দরজাটা খুলেছিলেন, আমাদের দেখে একটু থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। সুধীর শিকদারও আমরা যে কত মান্যগণ্য লোক স্ত্রীকে বারবার বোঝালেন। তারপর কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “একটু চা হলে বোধহয় মন্দ হত না, কী বল?” তারপরই বললেন, “না, না, তুমি বস, আমি বানাচ্ছি।”

মিসেস শিকদার বাধা দিলেন, “থাক তোমাকে আর রান্নাঘরে যেতে হবে না, যে অবস্থা করে রাখবে, আমার কাজ আরও বাড়বে!”

“আহা, কী মুশকিল! তাতে আর কি, পরিষ্কার করে দেবো!”

শিকদারমশাই আমাদের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা এক্সপ্লেন করলেন, “পুজোর রান্নাটা আর কি! নর্মালি একটা কিচেন ভাড়া করি। এবার হঠাৎ আগে কিছু জিনিসপত্র এসে পড়ায়, আমার বাড়িতেও কিছু কিছু করতে হয়েছে।”

“সে তো তোমার দোষ, না করলেই পারতে।”

“কী যে বলো, ভোগের জন্য দেওয়া জিনিস ফেলে দিতে আছে?”

আমাদের অবশ্য বেশ কিছুক্ষণ লাগলো ব্যাপারটা বুঝতে। মিসেস শিকদারই পরে পরিষ্কার করে বললেন। মিস্টার সাহানিদের ফ্রিজার হঠাৎ খারাপ হয়ে যাওয়ায় ওঁরা অনেক ফ্রোজেন ভেজিটেবল শিকদারমশাইকে পুজোর দিন পাঁচেক আগে দিয়ে যান। নর্মালি শীতকালে ওগুলো বাড়ির বাইরে রাখলে হয়তো ফ্রোজেনই থাকত, কিন্তু পুজোর ক’দিন আগে একটু গরম পড়ায়, মিস্টার শিকদার আর রিস্কই নিতে চাননি। নিজের বাড়িতেই ওগুলো রান্না করে ফেলেন। চারশো লোকের রান্না তো আর ছেলেখেলা নয়। কিচেনের অবস্থা তাই সহজেই অনুমেয়!

মিসেস শিকদার রান্নাঘরে যেতেই, শিকদারমশাই দেখলাম অদৃশ্য হয়েছেন।

এই ফাঁকে প্রমথ বললল, “কী রে তোকে সেদিন আমি বলিনি যে, ফ্রোজেন ফুড! তখন তো পাত্তা দিলি না!”

আমি বললাম, “চুপ কর, ফ্রোজেন, নট ফ্রোজেন, কী এসে যায়? ফুড ইজ ফুড!”

“তোর মুণ্ডু! পুজোর ভোগ রান্না হচ্ছে দু’শো বছরের পুরোনো ভেজিটেবল দিয়ে! কী পার্টি রে সব!”

“বাজে বকিস না,” আমি ধমক দিয়ে বললোম, “বড়জোর ছ’মাস কি এক বছরের পুরোনো ফসল।”

“তাই বা হবে কেন,” বলে প্রমথ আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু সুধীর শিকদার ঘরে ঢুকছেন দেখে থেমে গেল।

শিকদারমশাই দু’-আঙুলে একটা ডিবে নাচাতে নাচাতে সোফায় এসে বসলেন। ডিবেটার দিকে তাকিয়ে একেনবাবু প্রশ্ন করলেন, “বস্তুটা কী স্যার?”

“গেস করুন তো?”

“নস্যি?” একেনবাবুর চোখ দেখি জুলজুল করছে। তেলোর ওপর ডিবেটা ঠুকতে ঠুকতে শিকদারমশাই বললেন, “আদি এবং অকৃত্রিম হানড্রেড পার্সেন্ট ইন্ডিয়ান নস্যি!” তারপর আমাকে আর প্রমথকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “কী মশাই, চলবে?”

আমি সোজা বললাম “না।” কিন্তু প্রমথটা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “দিন একটু ট্রাই করি। তবে একটা টিস্যু পেপার দিন, যদি হাঁচি আসে!”

শিকদারমশাই বাথরুম থেকে টিস্যু পেপার আনতে যেতেই আমি ফিসফিস করে প্রমথকে বললাম, “ওদিকে তো ফ্রোজেন ফুড নিয়ে চেঁচামেচি করিস। আর এদিকে ওরকম একটা আনহাইজিনিক লোকের নস্যি তুই নিচ্ছিস?”

প্রমথ উলটে বলল, “চুপ কর, তুই এখানে চা খাচ্ছিস না!”

.

টিস্যু পেপার এল। তারপর সেই টিস্যু পেপার হাতে ধরে তিনজনের নস্যি নাকে টেনে জলভেজা চোখে আঃ, আঃ করা! জাস্ট ডিসগাস্টিং! আমি আর সহ্য না করতে পেরে সোজা ডাইনিং রুমে গিয়ে দেয়ালে বাটিকের কয়েকটা কাজ ছিল, সেগুলোই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। তখনই কিচেনে চোখ পড়ল। উঃ কী নোংরা! চা যখন এল, তখন সেটা গলা দিয়ে নামছিল না। তার ওপর সুধীর শিকদার এক প্লেট নিমকি সামনে ধরে আদর আপ্যায়নের চেষ্টা করলেন যে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি-র অবস্থা! প্রমথটা এদিকে অম্লান বদনে পেট খারাপ হয়েছে বলে সব কিছু অ্যাভয়েড করল। আমি জানি, কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে। আজ দুপুরেও ও একটা মিডিয়াম সাইজের পিৎজা সাঁটিয়েছে। শুধু একেনবাবু হাসিমুখে সবকিছু খেলেন, আর যথারীতি অজস্র প্রশংসা করলেন!