আরও একজন সাংবাদিক
ডুয়েলিং? নিহত? খেপে গেলেন বাকিংহাম। মার্কিন কংগ্রেসের উভয় পক্ষের সম্মিলিত শোকসভায় দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, যে লড়াইয়ে একজন সদস্যকে হারালেন আপনারা, তা ‘বর্বরের লড়াই’। আমি চাই এই মধ্যযুগীয় বর্বরতার অবশেষটুকু আপনারা আইন করে চিরকালের মতো মুছে দিন।
সাংবাদিক বাকিংহাম আর সরকারি কর্মচারী জেমসন সাহেবের ডুয়েল সমাচারের কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু বাকিংহামের কথা বলা হয়নি।
কলকাতার সেই ঘটনার পনেরো বছর পরের কথা। বাকিংহাম তখন আমেরিকার ওয়াশিংটনে। একদিন খবর এল একজন নিহত।
ঠিক এই কথাই বাকিংহাম পর পর তিনবার বোঝাতে চেয়েছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে। ডুয়েলিং বর্বরের খেলা। এ খেলায় প্রকাশ্যে পার্লামেন্টের অসম্মতি জ্ঞাপন করা হোক।
অথচ আশ্চর্য, এই বাকিংহামকেও একদিন নামতে হয়েছিল পিস্তল হাতে। কলকাতার ঘোড়দৌড়ের মাঠে। অবতীর্ণ হতে হয়েছিল দ্বৈরথ সংগ্রামে। ডাঃ জেমসনের চ্যালেঞ্জের উত্তরে কলম ছেড়ে পিস্তলই হাতে তুলে নিয়েছিলেন সম্পাদক বাকিংহাম। সম্পাদকের পক্ষে কলমের লড়াই-ই অভিপ্রেত, বাকিংহাম তা জানতেন। তবুও পিস্তলে হাত দিতে ইতস্তত করেননি তিনি। কারণ, সেদিনের এই লড়াই পিস্তলের লড়াই হলেও আসলে ছিল কলমেরই লড়াই। কলমের ইজ্জতের নামে পিস্তলের লড়াই। কাহিনীটা বিস্তারিতভাবে শোনবার মতো।
ডাঃ জেমসন রাজানুগৃহীত ব্যক্তি। কর্তৃপক্ষের আনুকূল্যে ইতিমধ্যেই তিনি তিন-তিনটি বিশিষ্ট পদের অধিকারী। একাধারে তিনি মেডিকেল বোর্ডের সেক্রেটারি, স্টেশনারি বিভাগের কেরানি এবং ফ্রি স্কুলের সার্জন। তার উপর যখন কলকাতার সরকার বাহাদুর তাঁকে চতুর্থ পদ হিসেবে ভারতীয়দের জন্য মেডিকেল স্কুলের সুপারিন্টেন্ডেন্টের পদটিও উপহার দিয়ে বসেন তখন বাকিংহাম আর পারলেন না, তিনি সমস্ত ফলাফল জেনেও লিখলেন: এ অন্যায়। একজনকে চার-চারটি পদে বিভূষিত করা শুধু অশোভন নয়, অত্যন্ত অসঙ্গত। বিশেষত ডাঃ জেমসনের এ কাজ করার মতো সময় এবং যোগ্যতা দুটোই যখন নেই, তখন এতটা বাড়াবাড়ি করা কি কর্তৃপক্ষের উচিত?
কর্তৃপক্ষ তো খেপেই ছিলেন। খেপে গেলেন ডঃ জেমসনও। খবরের কাগজে তাঁর এতগুলো পদের খবর বের হয়ে যেতে পারে, কোনও দিন তা তিনি ভাবেননি। তিনি বাকিংহামের নামে অভিযোগ করলেন সরকারের কাছে। সে অভিযোগ কার্যকারণের যোগে বিফল হয়ে গেল।
সুতরাং বীরের মতো তাঁর যোগ্যতার প্রমাণ দিতে বাকিংহামকেই অগত্যা আহ্বান জানালেন জেমসন দ্বৈরথ সংগ্রামে।
সে লড়াইয়ের ফলাফল ‘সমাচার দর্পণের’ খবরেই আছে। কেউ হারলেন না। সম্মানে দু’জনেই রীতি অনুযায়ী সমান রইলেন।
কিন্তু বলা বাহুল্য, ডুয়েলে সমান হলেও জেমস সিল্ক বাকিংহাম শুধু ডাঃ জেমসনের থেকেই নয়, তাঁর কালের অনেক তথাকথিত বড় মানুষের চেয়েও অনেক বড় ছিলেন। লড়াইয়ের কথাই যদি বলি, তাঁর ঊনসত্তর বছরের জীবনে বাকিংহাম অনেক লড়াই লড়েছেন। অনেক ওয়াটারলু জিতেছেন, গড়ের মাঠের বৃক্ষতলে জনৈক ডাঃ জেমসনের সঙ্গে তথাকথিত লড়াই তাঁর কাছে তুচ্ছ নগণ্য। বস্তুত বাকিংহামের দীর্ঘ, ঘটনাবহুল ও রোমাঞ্চকর জীবনে কলকাতা একটা অধ্যায় মাত্র। ন’ বছর বয়সে কর্নওয়ালেসের এই ছেলে যখন একটা নগণ্য পরিচারক হিসেবে জাহাজে উঠেছিলেন, তখন তাঁর লক্ষ্য ভারতবর্ষ বা কলকাতা ছিল না। তেমনি ঘটনাচক্রে ভারতবর্ষের প্রথম দৈনিক পত্রের সম্পাদক, ভারতখ্যাত জেমস সিল্ক বাকিংহাম যখন আবার পা নামিয়েছিলেন স্বদেশের মাটিতে, কলকাতার ‘ক্যালকাটা জার্নালই তাঁর হাতে একমাত্র পরিচয়পত্র ছিল না। বাকিংহাম নিজের পরিচয়েই সেদিন সংবর্ধিত হয়েছিলেন, সম্মানিত হয়েছিলেন। কোনও দিনই কোনও বিশেষ পরিচয় তাঁর শেষ পরিচয় ছিল না। এদেশের মাটিতে বিচিত্র পরিচয়ের এই বিরাট মানুষটির পাতা খোলার আগে পারিপার্শ্বিকের দিকে একবার তাকিয়ে নেওয়া ভাল।
বিশেষত বাকিংহামের কলকাতার সঙ্গে সমসাময়িক সাংবাদিক হিকি বা ডুয়েনের কলকাতার মিলের মতো গরমিলও ছিল অনেক। কলকাতায় তখন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেস্লির রাজত্ব, এবং মন্ত্রিত্বে অর্থাৎ কাউন্সিলে, তখনও অ্যাডাম, বার্লোদেরই প্রভুত্ব। ওয়েলেস্লি নিজেকে ভাবতেন প্রাচ্যখণ্ডের মহিমান্বিত অধীশ্বর। সম্রাটোচিত জাঁকজমকের জন্য তাঁর খ্যাতি ছিল, খ্যাতি ছিল ততোধিক তেজ এবং শৃঙ্খলাপরায়ণতার জন্যও। তাঁর দৃঢ় ধারণা ছিল, তিনি বা তাঁর শাসন সমালোচনার অতীত। তা ছাড়া সম্পাদকের মতো ক্ষীণজীবী সাধারণ মানুষেরা লাট বাহাদুরের সমালোচনা করবে, এটা ভাবতে রীতিমতো পীড়া বোধ করতেন তিনি।
এ ব্যাপারে কাউন্সিলের সিনিয়র মেম্বার জন অ্যাডামও ছিলেন তাঁর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। সিভিলিয়ন-পুত্র অ্যাডাম ষোল বছর বয়স থেকেই ভারতবাসী। যে ইংল্যান্ডকে বাল্যে দেখেছেন তিনি, পরিণত বয়সেও সেই টোরি মতাবলম্বী ইংল্যান্ডের স্বপ্ন আর বিশ্বাস জড়িয়ে ছিল তাঁর চোখে-মনে। শাসন-শাসনই। স্বাধীনতা আর শাসন এক নয়, এক নয় সম্পাদক আর সরকারি শাসন-বিভাগের দায়িত্ব।
ফলে সম্পাদকের কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে ওয়েলেসলি যেদিন ঘোষণা করলেন: ‘আমি এর সংস্কার করব। এখানকার মানুষদের ব্যক্তিগত জীবনধারার পুরোপুরি পরিবর্তন ঘটাতে চাই আমি। নয়তো যা দেখতে পাচ্ছি, অদূর ভবিষ্যতে এমন দিন আসছে, যেদিন কলকাতার ইউরোপিয়ান সমাজ যদি একান্তই ব্রিটিশ-রাজ উৎখাতে সমর্থ না হয়, অন্ততপক্ষে নিজেরাই তা চালাবে। আমার বিশ্বাস: ইতিমধ্যে আমার মেজাজ এবং চরিত্র তাঁরা জানার সুযোগ পেয়েছেন, সুতরাং এ সময়েই আমি তাঁদের জানিয়ে দিতে চাই, সরকারি কুৎসা রটনায় যাঁরা নামতে চান, তাঁরা যেন এটা মনে রাখেন, এমন বাসনার অর্থ হবে একটা বিরাট গভর্নমেন্টের সমবেত শক্তির বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া।’
দেখতে দেখতে আরও অনেক দূর এগিয়ে গেল তাঁর সংকল্প। অধস্তন এক কর্মচারীকে আশ্বাস দিতে গিয়ে তিনি জানালেন ‘ব্যস্ত হবেন না, শিগগিরই আমি এমন বিধি প্রবর্তন করছি, যাতে সমগ্র সম্পাদকগোষ্ঠী (whole tribe of editors) ভবিষ্যতের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যাবেন। আর ইতিমধ্যে যদি এমনই বিপাকে পড়ে যান, তবে বলপ্রয়োগ করে ওদের কাগজ বন্ধ করে দিতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করবেন না। দরকার হয় তো বে-আদব সম্পাদকদের ধরে ইউরোপে চালান করে দেবেন। সম্পাদক মানে, তাঁর মতে একশ্রেণীর বাউন্ডুলে। অন্য কোনওমতেই রুজি-রোজগারের পথ যাঁদের নেই তারাই এখানে সম্পাদক।
বাচনে জন অ্যাডাম আরও স্পষ্ট। খবরের কাগজওয়ালারা সরকারের সমালোচনা করবে, মতামত নিয়ন্ত্রণ করবে, এ কেমন কথা। তারা কি সরকারের চেয়েও ক্ষমতাবান? ‘পাবলিক ওপিনিয়ন’ অর্থাৎ কিনা জনগণের মত ‘হাস্যকর প্রস্তাব’। I cannot imagine a greater political absurdity than a Government controlled by the voice of its own servants!’
সুতরাং অনতিবিলম্বেই বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটল। প্রথমবারের মতো ‘প্রেস সেনসর’ বা পত্র-পত্রিকা নিয়ন্ত্রণের আদেশ জারি হল কলকাতায়। সে ১৭৯৯ সালের ১৩ মে’র কথা। কলকাতার খবরের কাগজের মালিক এবং সম্পাদকেরা ভয়ে ভয়ে সরকারি চিঠি খুলে রুদ্ধশ্বাসে পড়লেন, এবার থেকে তাঁদের কাগজে মুদ্রাকরের এবং প্রকাশকের নাম দিতে হবে, প্রত্যেক সম্পাদক এবং মালিককে তাঁদের নাম-ঠিকানা ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য সরকার বাহাদুরকে জানাতে হবে, তৃতীয়ত, গির্জার দিনে অর্থাৎ রবিবারে ধর্মকর্ম বন্ধ রেখে বসে বসে কাগজ ছাপা চলবে না, চতুর্থত, আদৌ কোনও কাগজই ছাপা চলবে না, যদি আগে থেকেই তা সরকার বাহাদুরকে দেখিয়ে মঞ্জুর না করিয়ে নেওয়া হয়। এখানেই শেষ নয়, তার পরেও পঞ্চম তথা সর্বশেষ ধারায় স্পষ্টত বলে দেওয়া হল, যদি এই চারটে আদেশের কোনওটায় শৈথিল্য দেখানো হয়, তবে অবধারিত শাস্তি হবে সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশে চালান।
ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল সব সম্পাদকের। ইতিমধ্যেই উপযুক্ত আইনবিহীন কর্তৃপক্ষের বে-আইনি ক্ষমতা তাঁরা দেখেছেন। এবার তৈরি হয়েছে আইনও। সুতরাং সেই দিনই কলকাতার সব ক’টি কাগজ সরকারি চিঠির প্রাপ্তি সংবাদ জানিয়ে উত্তর দিলেন, ‘মহামান্য সরকার বাহাদুরের আদেশ প্রতিপালনে আমাদের তরফ থেকে কোনও অবহেলা হবে না, সবিনয়ে এই আশ্বাস দিচ্ছি। অনুগ্রহপূর্বক জানাবেন, কখন এবং কোথায় আপনাদের প্রুফ বা প্রকাশিতব্য কাগজের কপি দেখার সময় হবে।’
কপি যিনি দেখবেন, তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হল এগুলো যেন কোনও কাগজে না থাকে: (১) সরকারি ধনভাণ্ডারের কোনও সংবাদ (২) সৈন্যবাহিনী, রসদ ইত্যাদি বিষয়ক সংবাদ (৩) কোন জাহাজ কবে কোথায় আছে, থাকবে বা যাত্রা করবে এসব (৪) সিভিল কিংবা মিলিটারি যে কোনও বিভাগের কোনও সরকারি কর্মচারীর কাজের বা আচরণের সমালোচনা (৫) ব্যক্তিগত কেলেংকারি বা কেচ্ছা (৬) কোম্পানি ও দেশীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে যুদ্ধ বা শান্তির সম্ভাবনা বিষয়ে কোনও আলোচনা (৭) এমন কোনও সংবাদ, যা আমাদের শত্রুপক্ষকে সাহায্য করতে পারে কিংবা আমাদের অধীন প্রজাবর্গের মনে অসন্তুষ্টি বা আলোড়নের সৃষ্টি করতে পারে এবং সর্বশেষ (৮) ইউরোপীয় সংবাদপত্রাদি থেকে কোনও উদ্ধৃতি, যা আমাদের বা আমাদের শাসন কর্তৃপক্ষের এদেশের প্রভাব-প্রতিপত্তির পক্ষে প্রতিবন্ধক হতে পারে।
অর্থাৎ উপরোক্ত ব্যাপারগুলোর একটি কাগজে থাকবে না। এ ছাড়া যদি সংবাদপত্র হয়, তবে আপত্তি নেই, যদি না হয় তবে আমাদের করবারও কিছু নেই।
এই তখনকার কলকাতার সংবাদপত্র জগতের স্থায়ী বিধান। তার উপর আছে এখন-তখন নিত্য নতুন ফতোয়া। গভর্নর জেনারেল যুদ্ধে যাচ্ছেন। খবরদার, যদি সে সব বিষয় কেউ ছাপো, তবে টিপু সুলতানকে খতম না করে তোমাদেরই করব। এমনি সব ফতোয়া। অত্যন্ত রূঢ়, অত্যন্ত উদ্ধত। শোনা যায়, ওয়েলেস্লি নিজেই নাকি পরবর্তী কালে লজ্জা পেতেন এগুলো পড়তে। তাঁর গ্রন্থাবলি থেকে তিনি খবরের কাগজ সম্বন্ধে লেখা তাঁর বিবৃতিগুলো বাদ দিতে নাকি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছিলেন ওই সংগ্রহের সম্পাদককে।
সেনসর বিধির সঙ্গে ক্রমে এল আরও বিধি। সম্পাদক-শাসনের আইনসম্মত কৌশল। এর মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, কোনও ছাপা কাগজ, তা বই, বিজ্ঞাপন, বিবৃতি বা খবরের কাগজ যাই হোক, প্রত্যেকটির নীচে ছাপাখানা, মুদ্রাকর এবং প্রকাশকের নাম ছাপাতে হবে (১৮১১)। এ রীতিটা আজও চালু আছে। এর জন্ম লর্ড মিন্টোর আমলে। ওয়েলেসলির পরে দ্বিতীয়বারের মতো গভর্নর জেনারেল হয়ে এলেন লর্ড কর্নওয়ালিস। তারপর মিন্টো। মিন্টোর পর এলেন, লর্ড ময়রা বা লর্ড হেস্টিংস।
লর্ড হেস্টিংস ওয়ারেন হেস্টিংসের মতো তো ছিলেনই না, তাঁর পূর্ববর্তী তিনজন গভর্নর বাহাদুরের সঙ্গে বিন্দুমাত্র মিল ছিল না তাঁর চরিত্রের। দৃষ্টিতে এবং চরিত্রে অনেক উদার ছিলেন তিনি।
এদেশে এসেই ওয়েলেস্লির সম্পাদক-শাসনের কৌশলটি তাঁর কাছে মনে হল, একটু বাড়াবাড়ি, হয়তো অসঙ্গতও।
এক সম্পাদক হঠাৎ বেঁকে বসলেন একদিন। সরকারি বিভাগীয় কর্তাকে পরের দিনের কাগজের কপি দেখাতে নিয়ে গেছেন ভদ্রলোক। সেক্রেটারি একটা খবর দেখিয়ে বললেন, এটা বাদ দিতে হবে।
কেন?
কুড়ি বছর মাথা নিচু করে ফতোয়ার পর ফতোয়া হজম করে করে এবং অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য অনবরত ক্ষমা প্রার্থনা করে করে অবশেষে সহসা সেদিন একজন সম্পাদক সেক্রেটারি বেইলির মুখোমুখি বসে জানতে চাইলেন, কেন? কেন বাদ দেব?
আপত্তিকর বলে।
কে বললে আপত্তিকর?
আমি বলছি।
আমি ছাপব।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সম্পাদক। বসে বসে রাগে কাঁপতে লাগলেন ১৭৯৯-এর সেই আইনের অন্যতম জনক, সেক্রেটারি বেইলি।
পরদিন কাগজ বের হল। তাতে সেই ‘নিষিদ্ধ’ সংবাদটিও।
সম্পাদককে কৈফিয়ত তলব করা হল।
তিনি উত্তর দিলেন, আমি কোম্পানির দয়ায় ভারতবর্ষে বাস করছি না। যদিও আমার পিতা ইউরোপীয় এবং ব্রিটিশ রাজ্যের প্রজা, আমার মা এ দেশের মেয়ে। আমি এ দেশের সন্তান। আমি ডুয়েন নই, কোম্পানির রক্ষণাবেক্ষণের অযোগ্য বলে দেশে পাঠিয়ে দেবে। এইটেই আমার দেশ এবং সে দিক থেকে তোমাদের তথাকথিত এক্তিয়ারের বাইরে আমি।
বেইলি কর্তৃপক্ষকে জানালেন সেনসর মানে যদি এই হয়, আমার কর্তৃত্বের কোনও ক্ষমতাই না থাকে, তবে কাগজে কলমে এ আইন রাখার আর যৌক্তিকতা কি?
‘ঠিকই, কোনও যৌক্তিকতা নেই। মানুষের বাচনের স্বাধীনতার উপর এত বেশি আইনের পাষাণ চাপানোর কোনও যৌক্তিকতা নেই।’ ঘোষণা করলেন লর্ড হেস্টিংস।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্রদের সভায় দাঁড়িয়ে তিনি জানালেন: শুধু ইংরেজি কাগজ নয়, এ দেশের ভাষায় এ দেশবাসীদের কাগজ প্রকাশকে আমি অভিনন্দিত করি। ‘It is human, it is generous to protect the feeble; it is meritorious to redress the injured; but it is God-like bounty to bestow expansion of intellect, to infuse the Promethean spark into the statue and waken it into a man.’
তিনি পত্রিকা-নিয়ন্ত্রণ বিধি উঠিয়ে দিলেন। সেটি খুব সহজ কাজ ছিল না। কারণ হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল হলেও, তাঁর চার পাশে একটা কাউন্সিল ছিল। এবং অ্যাডামেরা ছিলেন তার সদস্য। তাই পূর্বতন বিধি উঠিয়ে দিলেও হেস্টিংসকে নতুন বিধি রচনা করতে হল। তাতে সম্পাদককে পূর্বাহ্নেই কাগজ দাখিল করার দায় থেকে অব্যাহতি দিলেও, নতুন দায়িত্ব চাপানো হল তাঁদের উপর। এবার থেকে তাঁরাই নজর রাখবেন, কাগজে যেন আপত্তিকর বা ক্ষতিকারক কিছু বের না হয়। এটা তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব এবং সরকারবাহাদুর আশা করেন, দায়িত্বশীল সম্পাদকেরা এ দায়িত্ব পালনে আপত্তি করবেন না।
যদিও প্রস্তাব হিসেবে এটা পূর্বতন বিধির চেয়ে অনেক ভদ্র এবং নরম বলে মনে হয়, তবুও দুটোর মধ্যে মূলগত পার্থক্য অতি সামান্য। কারণ সম্পাদকের দায় এবং দায়িত্ব এবার থেকে বেড়ে গেল, কমল না মোটেও।
তবুও লর্ড হেস্টিংসের এই সামান্য উদার ঘোষণাটাকেই কলকাতার সম্পাদকেরা গ্রহণ করলেন স্বাধীনতার সনদ বলে। শুধু কলকাতা নয়, মাদ্রাজ বোম্বাইয়ে যখন এ খবর পৌঁছল, তখন রীতিমতো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল বিধানে ও বিধিতে পীড়িত সম্পাদক মহলে। মাদ্রাজে লর্ড হেস্টিংসকে অভিনন্দন জানিয়ে সভাও হল, প্রায় পাঁচশো ‘গণ্যমান্য, বিশিষ্ট’ মাদ্রাজবাসীর স্বাক্ষর-সমন্বিত এক অভিনন্দন-পত্র রচিত হল। সেটি সঙ্গে করে একজন স্বাক্ষরকারী চলে এলেন কলকাতায়। গভর্নর জেনারেলের হাতে সেটি দেওয়া হবে।
লর্ড ওয়েলেস্লির তৈরি আজকের এই রাজভবনের দরবারকক্ষেই লর্ড হেস্টিংস পূর্বতন গভর্নর জেনারেলের সযত্ন রচিত বিধানসমূহের উপর লাল কালির কলম চালিয়ে গ্রহণ করলেন সেই নতুন সম্মান। হেস্টিংস অভিনন্দন-পত্ৰখানা হাতে নিয়ে ঘোষণা করলেন, আমি মনে করি, জরুরি বা বিশেষ সময় ছাড়া নিজ নিজ মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রজাসাধারণের জন্মগত অধিকার।…তা ছাড়া, সরকারের উদ্দেশ্য যত মহৎই হোক, তাঁদের উচিত হচ্ছে জনসাধারণের সমালোচনাকে প্রশ্রয় দেওয়া। তাতে কোনও অবস্থাতেই তার শক্তি হানি ঘটে না। বরং…
That Govt, which has nothng to disguise, wields the most poweful instrument that can appertain to Sovereign Rule.
হেস্টিংসের জয়ধ্বনির মধ্যে সভা শেষ হল। জন অ্যাডাম নীরবে দেখলেন। তিনি সুপ্রিম কাউন্সিলের সিনিয়র মেম্বার। আইন প্রণেতা না হলেও আইনের রক্ষাকর্তা। মনে মনে হাসলেন সেক্রেটারি বেইলি। আইন তাঁর কাছে কতকগুলো অর্থহীন শব্দমাত্র। ব্যবহারেই তার প্রকৃত অর্থ। কীভাবে কোন অর্থে কোনটি ব্যবহার করতে হয়, তিনি জানেন।
সুতরাং সম্পাদকদের আনন্দকে অ্যাডামের মতো তিনিও মনে করলেন, দুধের বদলে ঘোল খেয়ে নৃত্য।
এই নৃত্যের আসরে সে বছরই আবির্ভূত হলেন ধীরস্থির বাকিংহাম। জাহাজের কাপ্তেন, খবরের কাগজের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই তাঁর। তবুও ভারতবর্ষকে তিনি জানতেন। তিন বছর আগে, ১৮১৫ সালে, কোম্পানির লাইসেন্স পকেটে নেই, এই অজুহাতে বোম্বাই থেকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের মাটি ছেড়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। সুতরাং বাকিংহাম এদেশের শাসকদের চিনতেন। তবুও যাওয়ার সময় ‘ভারতের বন্ধুদের প্রতি’ আশ্বাস দিয়ে বলে গিয়েছিলেন, আবার আমি ফিরব, আজকের এই নিষেধাজ্ঞা যে অজ্ঞাত দেশেই তাড়িয়ে নিয়ে যাক আমায়, একদিন আবার ফিরে আসবই আমি এই বন্ধুদের মাঝে।’
কবিতার কথা। অনেক উচ্ছ্বাসে ভরা। বন্ধুরা হয়তো তাই ভেবেছিলেন। কিন্তু বাকিংহাম কলকাতায় যখন নামলেন, তখন তিনি খবরের কাগজের সম্পাদক নন, নিজেই আস্ত একখানা খবর। ছোট নেই, বড় নেই, গভর্নর চিফ জাস্টিস, বিশপ থেকে শুরু করে সকলের মুখে মুখে তাঁর কথা।
এমন লোভনীয় কাজ যে ছেড়ে দিতে পারে, সে কি সহজ মানুষ!
বাকিংহাম যে জাহাজের কাপ্তেন, সে জাহাজ কলকাতা থেকে যাওয়ার কথা মাদাগাস্কারে। দাস ভর্তি জাহাজ ছাড়ছে সেখান থেকে, সে জাহাজে পাহারা দিতে হবে তাঁকে। আফ্রিকার কালো কালো মানুষগুলোকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে হবে ইউরোপের বাজারে।
বাকিংহাম বেঁকে বসলেন। এ ঘৃণ্য কাজ তিনি পারবেন না। মানুষ হয়ে মানুষ বিকিকিনির কারবারে তিনি গররাজি। হোক না এক-এক দফায় দশ হাজার পাউন্ড মজুরি। বহু লোক আছে তার জন্যে। জেমস সিল্ক বাকিংহাম এ হেন কাজে নেই।
লোকে বলে, পাগল। ঈশ্বরের পৃথিবীতে সবাই প্রভু হবে, তাও কি হয়? বাগান চলবে কী করে? কারখানা, খনি এখন চলবে কী করে?
বাকিংহাম স্বপ্নের দেশের লোক হয়েই রইলেন। তাঁর সেই দেশে লোকেরা কেনা গোলাম না হয়েও খনি থেকে সোনা তোলে, বাগানে জমি চষে। ১৮৩৪ সালে সে স্বপ্ন তাঁর সফল হয়েছিল। পৃথিবী থেকে প্রকাশ্যভাবে অন্তত দাসপ্রথা উঠে গিয়েছিল সেদিন। অথচ তার বহু আগে ১৮২৫ সালেই এর পুরোপুরি উচ্ছেদ দাবি করে, বাকিংহাম হাসির উপলক্ষ হয়েছিলেন দাস-দরদিদের। আর তারও আগে দাস ব্যবসায়ে অসম্মতি জানিয়ে এই কলকাতায় বেকারত্ব বরণ করতেও সানন্দে রাজি হয়েছিলেন তিনি। বাকিংহাম একটা খবর বই কি!
এই অদ্ভুত লোকটিকে ঘিরে সেদিন ভিড় করেছিল যে কৌতুহলী জনতা, তার মধ্যে ছিলেন কলকাতার খ্যাতনামা ব্যবসায়ীরাও। তাঁরা বাকিংহামকে হাতছাড়া করতে রাজি হলেন না। যেমন বিজ্ঞ, তেমনি বুদ্ধিমান এবং আদর্শবান মানুষ এক বাকিংহাম। সুতরাং আলাপ-আলোচনার পর পাকা হল। বিখ্যাত ব্যবসায়ী পামার এবং অন্যান্যরাও এগিয়ে এলেন। স্থির হল কাগজই বার হবে। বাকিংহামের ব্যবসায়ী বুদ্ধি আছে, অভিজ্ঞতা আছে এবং হাতে আছে কলমও। সুতরাং কাগজই বের হোক। ব্যবসায়ীদের নিজেদের কাগজ, ব্যবসায়ের কাগজ।
অতএব বের হল ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ ১৮১৮ সালের ২ অক্টোবর। কলকাতার নয়টি সংবাদপত্রের সম্পাদকরা দেখলেন, এ যেন এক নতুন জগতের লোক। এর কথার সুর যেন একেবারে ভিন্ন, এ সম্পূর্ণ বেসুরো। বাকিংহাম প্রস্তাব-পত্রে লিখেছেন:
‘নবাগন্তুকের কাছে এ দেশের কাগজ এক বিস্ময়। যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই হতাশাপূর্ণ তাদের চেহারা। অবশ্য দীর্ঘদিন এ দেশে বাস করতে করতে ক্রমে তাই হয়ে যায়। মানসিক আপত্তি আর তত তীব্র থাকে না। তবুও এই জাতীয় কাগজের সমর্থকরাও স্বীকার করেন, এগুলোর সংস্কার অত্যাবশ্যক…কলকাতার যত কাগজ আছে, সবারই দাবি, তারা জনসাধারণের মতামতের বাহক, তারাই দেশের সব সংবাদ রাখেন, তারাই দেশবাসীকে নতুন কথা বলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় দু’একখানা কাগজকে বাদ দিলে, একটি কাগজও জনসাধারণের কথা বলে না। আমি এর ব্যতিক্রম হতে চাই। আমি চাই আমার কাগজকে পূর্ববর্তী সব কাগজের সব দোষ থেকে মুক্ত রাখতে।’
কাগজ যখন বের হল, দেখা গেল বাকিংহাম কথা রেখেছেন। তাঁর কাগজ কলকাতার আর কোনও দ্বিতীয় কাগজের মতো নয়। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের, নতুন সংবাদপত্র ‘ক্যালকাটা জার্নাল’। সুন্দর কাগজে ঝরঝরে (অবশ্য তখনকার দিনের মান অনুযায়ী) ছাপা আট পাতার অর্ধসাপ্তাহিক। দামও সস্তা। প্রতি সংখ্যা এক সিক্কা টাকা। মাসে ছ’ টাকা।
আর-সব কাগজের চেয়ে কমদামি কাগজ, কিন্তু মূল্যবান বিষয়-সূচি। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া কি আফ্রিকার সর্বত্র নিজস্ব সংবাদদাতা ছিল বাকিংহামের। তাঁরা দরকারি খবর পাঠাতেন। সেগুলো ছাপা হত। তারপর আছে পার্লামেন্টের ধারাবাহিক কার্য-বিবরণী। ভারতবর্ষের, বিশেষত বাংলা প্রেসিডেন্সির যাবতীয় সংবাদ, কলকাতার ব্যক্তিগত ও সামাজিক টুকরো খবর (জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ, আগমন, প্রস্থান ইত্যাদি), বাজার দর, আবহাওয়ার খবর, চিঠিপত্র ইত্যাদি। এক কথায়, আজকের দিনের যে কোনও সুসম্পাদিত খবরের কাগজের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, দেড়শো বছর আগেকার এই কাগজটি যেন এ কালেরই কাগজ। সবই এক। পার্থক্যটুকু শুধু পরিমাণগত। বয়সের অনিবার্য ব্যবধানই তার জন্যে দায়ী, সম্পাদক নন। এমনকী আজকের খবরের কাগজের সাহিত্য-প্রচারের যে কর্তব্যবোধ, তারও সূত্রপাত করেছিলেন সেদিন এই বাকিংহামই। ‘ক্যালকাটা জার্নালের’ প্রথম সংখ্যাতেই ছিল লর্ড বায়রনের ‘চাইল্ড হ্যারল্ড’ (Child Harold) এবং তাঁর নিজের বিখ্যাত ভ্রমণ-কাহিনী ‘প্যালেস্টাইন ভ্রমণের’ প্রথম অধ্যায়। ক্রমে বায়রনের ‘ডন য়ুয়ান’, স্কটের ‘আইভান-হো’ প্রমুখ ইউরোপীয় সাহিত্যের বিশিষ্ট রচনা কলকাতার পাঠককে উপহার দিয়েছেন তিনি খবরের কাগজের পাতায়। সাহিত্যশিল্পের নতুন খবর, ইউরোপীয় পত্রপত্রিকার বিশিষ্ট আলোচনা ইত্যাদির স্বাদ পেতে হলে কলকাতাবাসীর ‘ক্যালকাটা জার্নাল ছাড়া তখন উপায় নেই। অন্য কাগজে তখনও লঘুরসের কবির লড়াইই সাহিত্য।
সুতরাং অপেক্ষার প্রয়োজন হল না, ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ অচিরেই কলকাতাবাসীর মনোরাজ্যের অধীশ্বর হয়ে গেল। সৈনিক, ব্যবসায়ী, সিভিলিয়ান শত শত তার গ্রাহক। পাঠক সহস্র সহস্র। ক্রমে অর্ধ-সাপ্তাহিক থেকে ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ রূপান্তরিত হল দৈনিকে। দৈনিক বটে, তবে শুধু সোমবারে কাগজ নেই। কারণ রবিবার ছুটি। ধর্ম-কর্মের দিন। পরে অবশ্য সোমবারেও বের হত বাকিংহামের কাগজ।
দৈনিক কাগজ। শহরের প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র। হু-হু করে বেড়ে চলল গ্রাহকের সংখ্যা আর লাভের অঙ্ক। যেমন কাগজ তেমনি দাম। অন্য কাগজের প্রায় আধাআধি। নাম হয়ে গেল তার, সাধারণের কাগজ—‘পেপার অব দ্য পাবলিক’। ক্যালকাটা জার্নালের শীর্ষে স্পষ্ট করে ছাপা থাকত কথা কটি। কিন্তু জনতার কাগজের আর আগেকার ছাপাখানায় তখন চলে না। নতুন জমি কেনা হল, নতুন বিরাট বাড়ি উঠল। বিলেত থেকে এল নতুন কলম্বিয়ান ছাপাই যন্ত্র, নানা আকারের নানা হরফ।
‘ক্যালকাটা জানাল’ কাগজ, ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ ব্যবসাও। পূর্ববর্তী কাগজগুলো এবং সমসাময়িক অন্যান্য কাগজপত্র ছিল প্রায় শৌখিন ব্যাপার। লাভ-লোকসান তাদেরও হত বটে, কিন্তু ব্যবসায়ের চেয়ে ব্যক্তিগত লাভ বা লোকসানই অধিক ধর্তব্য মনে করতেন তৎকালীন পত্রিকা-পরিচালকেরা। বাকিংহাম এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এ দিক থেকে তিনি ভারতবর্ষের প্রথম শিল্পপতি, সংবাদপত্র যার শিল্প—ইন্ডাস্ট্রি।
চল্লিশ হাজার পাউন্ড মূলধন ‘ক্যালকাটা জার্নালের’। চারভাগের তিন ভাগের মালিক সম্পাদক নিজে। বাদবাকি মালিকানা শেয়ার হোল্ডারদের। একশো পাউন্ডের একশো শেয়ার। তাই নিয়ে গুটিকয় শেয়ার হোল্ডার। আর মজার কথা হল, ব্যবসায়ীপ্রতিম পামার স্বয়ং তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেখানে অসম্ভব, অথচ আত্মগর্ব যেখানে অনাবশ্যক রকম উঁচু, সেখানে অক্ষমের কাছে ঈর্ষাই একমাত্র মূলধন। পাঁচ-ছ’ খানা কাগজ একযোগে আক্রমণ চালালে বাকিংহামের উপর। কেউ লিখলে ভদ্রলোক আসলে ভদ্রলোকই নয়। এ অজ্ঞাতকুলশীল। কেউ বললে, ওর প্যালেস্টাইনের ভ্রমণ কথা স্রেফ অমুকের বই থেকে টুকে নেওয়া। যাঁরা আরও বুদ্ধিমান, তাঁরা বললেন, ব্যাটা একেবারে যাকে বলে অধার্মিক, বাইবেল মানে না, রীতিনীতি মানে না।
বাকিংহাম কোথাও উত্তর দিলেন, কোথাও চুপ করে রইলেন। এ যেন একটা হাতি চলে যাচ্ছে, পিছন থেকে কতকগুলো ছেলে-ছোকরা টিটকারি দিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। গজরাজ কখনও কখনও পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখছে ওদের মজা।
সে তাকানো, অর্থাৎ বাকিংহামের কলমের সেই তীব্র ব্যঙ্গ এতই তীব্র যে, তাকে সইবার বা উত্তর দেবার ক্ষমতা ওঁদের কারও ছিল না। আর ছিল না বলেই, আরও কষ্ট, আরও অসহ্য গাত্রদাহ।
প্রতিদ্বন্দ্বীদের সে জ্বালা জুড়িয়ে দিলেন পাঠকেরা। ‘ক্যালকাটা জার্নালে’র ক্রমাগত গ্রাহক হয়ে হয়ে তাঁরা ইনাম দিলেন সম্পাদকের যোগ্যতার। ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ একমাত্র প্রতিষ্ঠিত কাগজ হয়ে রইল কলকাতার।
দ্বিতীয় শত্ৰু, ওয়েলেস্লি কথিত সেই ‘একটা বিরাট গভর্নমেন্টের সংহত সমবেত ক্ষমতা’।
আমি মনে করি, গভর্নরদের তাঁদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে দেওয়া, কর্তব্যে ত্রুটি ঘটলে তাঁদের নিঃশঙ্কচিত্তে সতর্ক করে দেওয়া এবং প্রয়োজন হলে নির্ভয়ে অপ্রিয় সত্য বলা—সম্পাদক হিসেবে আমার কর্তব্য, আমার পুণ্য দায়িত্ব। বিশেষত যে দেশে কোনও পার্লামেন্ট বা আইনসভা নেই, সে দেশের সরকারকে সতত জনসাধারণের সমালোচনার অধীন রাখাই সঙ্গত।’ এই ঘোষণা করে বাকিংহাম যেদিন সম্পাদক হয়েছিলেন, সেদিন থেকেই ‘একটা বিরাট সরকারের সমুদয় শক্তি’ সতর্ক হয়েছিল।
তারপর কাগজে কাগজে কলমের লড়াইয়ে বাকিংহাম যখনই মুখ খুলেছেন, অলক্ষে তখনই চমকে উঠেছেন সরকার।
সহযোগী কাগজসমূহ অভিযোগ তুলেছেন, আমি নাকি অতিরিক্ত স্বাধীনচেতা হয়ে উঠেছি। ইতিপূর্বে এ দেশের কাগজে যেসব বিষয় কখনও আলোচনা করা যেত না, আমরা নাকি স্পষ্টাস্পষ্টি তারই আলোচনায় মত্ত হয়েছি। এই অভিযোগকে গর্বভরে আমি মাথা পেতে নিচ্ছি…আমি হয়তো তথাকথিত আইনের সীমানা লঙ্ঘন করেছি, কিন্তু আপনারা জানেন, সব মানুষের অনুভূতি সমান নয়, সবার কলমে সত্য সমানভাবে আসে না, সবার সমান সতর্কতার শিক্ষা নেই, সবাই সমান রেখে-ঢেকে বলতে পারে না।…আমি মনে করি, যাঁরা কলম হাতে নিয়ে সত্যের মান রাখতে পারেন না, তাঁরা বিশ্বাসঘাতক।…আর কথায় কথায় প্রশ্ন তুলি? যুক্তি চাই? যে যুক্তিতে বিশ্বাস করে না, সে তো ধর্মান্ধ, মূঢ়। যে যুক্তি মানে না, সে নির্বোধ। আর যে যুক্তি দাবি করতে ভয় পায়, সে তো দাস—স্লেভ।’
চমকে ওঠার মতোই কথা। স্বাধীনতার কথা শুনে সরকার চিন্তিত হলেন। কিন্তু বিন্দুমাত্র চিন্তার লক্ষণ দেখা গেল না বাকিংহামের কলমে। ঔদ্ধত্যের অভিযোগ তুলে অন্য কাগজগুলো যখন একযোগে আক্রমণ চালাল, বাকিংহাম তার জবাবে লিখলেন: We still glory in avowing that triumph of freedom over slavery, unshaken principle over time-serving equivocation, which the public Press in India has recently obtained, and we are still anxious to maintain, all the envious revilings of those who oppose instead of facilitating the progress of truth and sound doctrine, the flattering distinction…etc.
এ হল এক অভূতপূর্ব কাগজে-কাগজে লড়াই। অসহ্য হলেও সরকার এক্ষেত্রে অসহায় দর্শক মাত্র। এর একটি কথাও তার পক্ষে শান্তির কথা নয়। তবুও তাঁরা অপেক্ষায় রইলেন।
বেশিদিন অপেক্ষা করতে হল না। ১৮১৯ সালের মে মাসে ‘কালকাটা জার্নালে’ একটি খবর বের হল। তার মর্ম হচ্ছে ‘আমরা মাদ্রাজ থেকে একটি দীর্ঘ চিঠি পেয়েছি। তার চার পাশে শোকজ্ঞাপক কালো বর্ডার। তাতে একখানা মাত্র লাইন লেখা। ‘মিঃ ইলিয়ট আরও তিন বছরের জন্য মাদ্রাজের গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত থাকছেন।’ আমাদের আশঙ্কা: সংবাদটি মাদ্রাজের মতো ভারতের অন্যান্য অংশে শোকের কারণ হবে।’
গভর্নমেন্ট বাকিংহামকে সতর্ক করে দিলেন।
বাকিংহাম উত্তর দিলেন ‘কর্তৃপক্ষের মনোবেদনার কারণ হয়েছি বলে আমি নিরতিশয় দুঃখিত।’
ক্ষমা প্রার্থনা। অন্তত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অর্থ করলে তাই দাঁড়ায় বটে। কর্তৃপক্ষ চুপ করে রইলেন।
বিশেষত লর্ড হেস্টিংস তখনও গভর্নর জেনারেল। খবরের কাগজওয়ালাদের বেশি ঘাটাতে তাঁর মতো নেই।
দু’ বছর পরে বাকিংহাম আবার মনোবেদনার কারণ হলেন। ১৮২১ সালের ১০ জুলাই ‘ক্যালকাটা জার্নালে’ কলকাতার লর্ড বিশপ সম্পর্কে একটা খবর বের হল: ‘গত ডিসেম্বরে মহামান্য বিশপ সব যাজকদেরই অন্য কাজে লাগিয়েছেন। অসময়ে বিয়ের মরসুম পড়ে যাওয়ায় তাঁরা গির্জা ফেলে এখন সেইদিকেই ব্যস্ত। ফলে বড়দিন উপলক্ষে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি যা হওয়ার কথা, তা যথাযথভাবে হয়নি, এমনকী খ্রিস্টমাসের বিশেষ দিনটিই এবার কোনও অনুষ্ঠান ছাড়া প্রতিপালিত হয়েছে।’
গভর্নমেন্ট জানতে চাইলেন, কে লিখেছে এসব?
বাকিংহাম উত্তর দিলেন পত্রলেখকের নাম আমি জানি না। তবে আমার মনে হয়, ‘এতে ভাল হবে, এই ধারণা থেকেই নাম না জানা সত্ত্বেও এটি আমি ছেপেছি।’
সরকার বাহাদুর কিন্তু ওটুকুতেই সন্তুষ্ট হলেন না। দীর্ঘ এবং কড়া একখানা চিঠি লিখে বাকিংহামকে তাঁরা জানালেন, তিনি সম্পাদকের নৈতিক দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। সরকার বাহাদুর সেনসর উঠিয়ে নিয়েছেন, তার অর্থ এই নয় যে, বাকিংহাম তাঁর ইচ্ছেমতো যা খুশি তাই লিখতে পারেন। হেস্টিংসের নব-বিধি অনুযায়ী তাঁর দায়িত্ব আগের মতোই। যদি তিনি একান্তই এটা ভবিষ্যতে ভুলে যান, তবে সরকার তাঁকে অগৌণে চালান করে দিতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করবেন না।
বাকিংহাম এই দীর্ঘ চিঠির জবাবে এক দীর্ঘতর চিঠি লিখলেন:
‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকামী যাঁরা, তাঁরা আপনাদের চিঠির ভাষা দেখে বিস্মিত হবেন। এর চেয়ে সেনসর যে অনেক ভাল। নৈতিক বিধি বিধান। কোনটি তার মানদণ্ড? কে তার বিচারক? তথাকথিত এই সব মনগড়া বিধানভঙ্গের দায়ে যদি নির্বাসনের মতো কঠিন দণ্ড আপনারা আরোপ করতে পারেন, তবে আমার আশঙ্কা: আমার প্রাণপণ আন্তরিক চেষ্টাও আমাকে সেই দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করতে সমর্থ হবে না। আইনভঙ্গের বিপদ আমার যাত্রাপথে এমনভাবে ছড়িয়ে রয়েছে বলে আমার অনুমান যে তাকে এড়িয়ে চলা আমার পক্ষে অসম্ভব। কারণ, এই আইন আপনাদের মনে, এবং আপনারাই তার বিচারক।…’
সরকার জানালেন, বাকিংহামের চিঠি পড়ার পরেও তাঁদের পূর্বেকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা তাঁরা প্রয়োজন মনে করেন না। অর্থাৎ দরকার হলে তাঁরা বাকিংহামকে নির্বাসন দেবেন। বাকিংহাম দিন গুনতে লাগলেন।
ইতিমধ্যে নতুন করে কাগজে বিতর্ক উঠেছে। এবারকার বিষয়বস্তুও খবরের কাগজের স্বাধীনতা।
একটা কাগজ লিখল: খবরের কাগজের স্বাধীনতা আবার কী? ওটি মিঃ বাকিংহামের আবিষ্কার।
বাকিংহাম প্রশ্ন তুললেন, ‘তবে তোমরা সেনসর উঠে যাওয়ায় যে আনন্দ উৎসব করেছিলে সে কীসের নামে?’
‘মহামান্য হেস্টিংস বাহাদুরের উদারতার নামে।’
আমিও মহামান্য হেস্টিংস বাহাদুরের কথা অনুযায়ীই মনে করি, এ দেশের খবরের কাগজ স্বাধীন। অবশ্য যদি আইনের কথা বলো, তবে হেস্টিংসের বিধান আর একটা বাজে কাগজে পার্থক্য কিছু নেই। ধরো গভর্নর জেনারেল বললেন: অযোধ্যার নবাব আসছেন, তোমার বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে। তোমার শোবার ঘরটাও ছেড়ে দাও, ওখানে তাঁর বেগমেরা থাকবেন। আর তোমার বসবার ঘরে থাকবে তাঁর চাকর-বাকরেরা। তা হলেই কি আমরা ছেড়ে দিতে বাধ্য? নিশ্চয়ই নই। হেস্টিংস বাহাদুরের তথাকথিত ফতোয়াও তাই। যে পর্যন্ত সেটা সুপ্রিম কোর্ট বিধিবদ্ধ না করছে, ততক্ষণ সেটা আইন নয়, ফতোয়া। ব্যক্তিগত হুকুমনামা। তা মানা বা না মানা সম্পূর্ণ আমাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেটার চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে করি, হেস্টিংস সাহেবের মৌখিক কথাকে। তাতে স্বাধীনতার স্বীকৃতি আছে।’
বাকিংহাম তাঁর কাগজে একটা দীর্ঘ প্রবন্ধই লিখে বসলেন। নাম দিলেন তার, মার্কিস অব হেস্টিংসের সপক্ষে।’
সেই প্রবন্ধেই সরকারের নির্বাসনের হুমকি প্রসঙ্গে লিখলেন: ‘The more the monstrous doctrine of transmission is examined, the more it must excite the abhorrence of all just mind.’
অ্যাডামেরা সব দেখলেন। কিন্তু তাঁরা অসহায়। করবার তাঁদের কিছুই নেই। প্রবন্ধের নাম ‘মার্কিস অব হেস্টিংসের সপক্ষে’। লর্ড হেস্টিংস তাঁদের ওপরওয়ালা, গভর্নর জেনারেল। তাঁরা জানেন, বাকিংহাম আসলে নিজের স্বাধীনতা, নিজের যদৃচ্ছাচারিতাকেই রক্ষা করতে চেয়েছেন। আর সেটা তাঁর চারদিকে গবর্নর জেনারেলকে রক্ষাব্যূহ হিসাবে দাঁড় করিয়েই। সেই প্রবন্ধের ফাঁকে ফাঁকে হেস্টিংসের উদ্ধৃতি। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে ছাত্রদের সভায় তাঁর বক্তৃতা, মাদ্রাজবাসীর অভিনন্দনের উত্তরে তাঁর উদার ভাষণ—এসবই বাকিংহামের প্রতিপাদ্য। তিনি কতকগুলো দাস সম্পাদক এবং কিছু কিছু মূঢ় হীন সরকারি কর্মচারীর আক্রমণ থেকে লর্ড হেস্টিংসকে বাঁচাতে চান।
সুতরাং অগত্যা অ্যাডামের পক্ষে মুখ বুঁজে তা সহ্য করা ছাড়া আর উপায় কী?
কিন্তু বেশিদিন চুপ করে থাকতে হল না তাঁকে।
ওই বিতর্ক প্রসঙ্গেই বাকিংহাম একদিন মন্তব্য করলেন: সরকার যদি তাঁদের সেক্রেটারি কিংবা কর্মচারীদের মাধ্যম ছাড়া অন্য কারও অভিযোগে কর্ণপাত না করেন, মন্দকে ভাল করার ব্যাপারে অন্য কারও পরামর্শ না শোনেন, তবে স্বভাবতই কোনও অভিযোগেরই কোনও দিন নিষ্পত্তি হবে না। যদি কারও কিছু হয়, তবে একমাত্র হবে ওই সব কর্মচারীদের প্রিয়জনদেরই।
অ্যাডাম সুযোগ পেয়ে গেলেন। সাতজন সেক্রেটারির সই নিয়ে বাকিংহামের নামে অভিযোগ তুললেন আদালতে। মানহানির মামলা। বাকিংহাম বলতে চায়, আমরা সরকারি কর্মচারীরা আত্মীয় পোষণ করি। এ অন্যায়ের বিচার হোক।
বিচার হল।
কিন্তু আইনে অভিযোগ টিকল না। বাকিংহাম তো আর কারও নাম করে কিছু বলেননি। তাছাড়া তাঁর লেখা একটা মত মাত্র, কোনও ঘটনার বিবরণ নয়।
বাকিংহাম জিতে গেলেন। অবশ্য ৬০০ পাউন্ড পকেট থেকে গেল তাঁর, মামলার খরচ বাবদ। কিন্তু সে তুচ্ছ। যাঁদের বিরুদ্ধ তিনি জিতেছেন, শুধু টাকার বলে তাঁদের হারানো যায় না। তা ছাড়া, ‘ক্যালকাটা জার্নালের’ বছরের আয় তখন প্রায় বারো হাজার পাউন্ড। সুতরাং সম্পাদকের কাছে ৬০০ পাউন্ড তখন তুচ্ছ মামলা। এর চেয়েও আরও অনেক কঠিন, অনেক শক্ত মামলা আছে তাঁর জীবনে, বাকিংহাম তা জানতেন। জানতেন, তাঁর শত্রুপক্ষও।
‘ক্যালকাটা জার্নালে’ এর পর একদিন একটা চিঠি বের হল। ‘জনৈক অজ্ঞাত ব্যক্তি’ প্রেরিত চিঠি। তিনি লিখেছেন:
‘মিঃ এডিটর,
আপনি নেটিভদের যে কল্যাণ ইতিমধ্যেই সাধন করেছেন, তার জন্যে আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে আমি আপনাকে, এবং সেই সঙ্গে নেটিভদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি আশা রাখি, সে দিনটিও আমি দেখতে পাব, যেদিন আজ যাঁরা এদের তথাকথিত রক্ষাকর্তা বলে দাবি রাখেন— এদের হাতেই নেটিভেরা এদেরই রচিত বিধি-বিধানে আদালতে পর্যন্ত প্রপীড়িত হবে।’
অ্যাডাম জানতে চাইলেন, এ ভবিষ্যৎ বক্তাটি কে?
পীড়াপীড়িতে পড়ে বাকিংহাম জানালেন—অবশ্য পত্র প্রেরকের সম্মতি নিয়েই—তাঁর নাম লেঃ কর্নেল রবিনসন এবং তিনি নাগপুরে থাকেন।
এখানে বাকিংহামের ‘নেটিভ কল্যাণের’ একটু উল্লেখ প্রয়োজন। কারণ বাকিংহামই তৎকালে অন্তত একমাত্র প্রকাশ্য সম্পাদক, যিনি নেটিভ বা আমাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। সে সহানুভূতি নিচুর প্রতি উঁচুর করুণা নয়, দীনের দিকে ধনীর ছুড়ে-দেওয়া দাক্ষিণ্য নয়, সম্পূর্ণ যুক্তিবাদী এবং আদর্শবাদী বিজ্ঞের নিজস্ব ধ্যান-ধারণাই ছিল তার মূল। ‘ক্যালকাটা জার্নালের’ প্রস্তাব-পত্রে নেটিভদের সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি, নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁর কাগজে যোগ দিতে। যাঁরা লেখক, তাঁরা লিখুন। যাঁরা ধনবান ব্যবসায়ী, তাঁরা ব্যবসায়ের অংশীদার হোন। ‘ক্যালকাটা জার্নালের’ দরজা সকলের জন্যে খোলা।
গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের ‘বেঙ্গল গেজেট’ ‘ক্যালকাটা জার্নালের’ চেয়ে বয়স্ক কাগজ। দু’ বছর আগে তার জন্ম। বাকিংহাম এ কাগজটিকে গ্রহণ করেছিলেন আন্তরিকভাবে। ক’বছর পরে অন্তরঙ্গ বন্ধু রামমোহন রায় যেদিন গ্রহণ করলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সংবাদ-কৌমুদী’র দায়িত্ব, বাকিংহাম তখন ‘সংবাদ কোমুদী’কে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছিলেন:
‘The pleasure with which we regard the effusions of the native press does not arise from the intrinsic value of these production, but as an earnest of what it may produce when it has attained maturity.
অর্থাৎ ভালমন্দের বিচার করে নয়, এগুলোর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকেই আমি অভিনন্দিত করি। রামমোহনের অন্যান্য কাগজগুলোর প্রতি সংখ্যায় কী আছে, তাই তিনি নিয়মিতভাবে ছাপতেন ‘ক্যালকাটা জার্নালে।’ ‘Spirit of the Press’ শিরোনাম দিয়ে এসব দেশি কাগজের বক্তব্যও বের হত ‘ক্যালকাটা জার্নালের’ পাতায় ইউরোপীয় পাঠকদের জন্যে।
তা ছাড়া, এদেশের সমাজ, শাসন ব্যবস্থা, এদেশের রীতিনীতি বিষয়েও বাকিংহামের আগ্রহ ছিল প্রবল। এই আগ্রহই শেষে রূপান্তরিত হয়েছিল দায়িত্বশীল মমতায়। ‘ক্যালকাটা জার্নালের’ পাঁচ বছরের জীবনে বাকিংহাম এ দায়িত্বের অনেক পরিচয় দিয়ে গেছেন। তাঁর তখনকার লড়াইয়ের বিষয়বস্তু ছিল: (১) সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ (২) পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে কর আদায় বন্ধ (৩) ভারতে ইংরেজ কলোনি স্থাপন (বহু বাঙালি নেতা এর সপক্ষে ছিলেন) (৪) সংবাদপত্রের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা (৫) ইংরেজ অধিবাসীদের জুরির বিচারের আওতায় আনা (৬) সরকারি কর্মচারীদের বসবাসের উদ্দেশ্যে জমি কেনার অধিকার স্বীকার করা। (৭) ব্যবসায়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া কর্তৃত্ব বন্ধ করা (৮) স্বাধীন ব্যবসার অধিকার দান এবং (৯) এদেশে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার, ইত্যাদি।
ভারতীয়দের জন্যে বাকিংহামের আরও বিশিষ্ট কীর্তি হল, ভারতে শাসন-সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাব রচনা। সেটি অবশ্য কলকাতায় থাকাকালে রচিত হয়নি। এদেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে তার চিন্তাশীল মৌলিক প্রস্তাবনা—Plan of Future Government in India. ১৮৫৩ সালে প্রথম বের হয় বইয়ের আকারে। ১৮৫৪ সালে বের হয় এর সংশোধিত তৃতীয় সংস্করণ। বইখানা পড়লে তাঁর চিন্তার ব্যাপ্তি দেখে বিস্মিত হতে হয়। এখানে শুধু এটুকুই উল্লেখ করলে বোধ হয় যথেষ্ট হবে যে, ১৮৫৭-র বিস্ফোরণের আগেকার ইংল্যান্ডে যখন ভারতবর্ষে চিরাচরিত শাসন সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র চিন্তার কোনও কারণ ঘটেনি, বাকিংহাম তখন তাঁর এই লেখায়, কোম্পানির রাজত্বের অবসান ঘোষণা করে মহারানিকে স্বহস্তে রাজ্যভার গ্রহণ করতে দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি দাবি জানিয়েছিলেন: অগৌণে ভারতবর্ষে একটি সরকার গঠন করা হোক, পার্লামেন্টে ভারতের প্রতিনিধি গ্রহণ করা হোক, ভাইসরয় নিয়োগ করা হোক—ইত্যাদি। তা ছাড়া, ভারতের রাজস্ব বিভাগ কী করে পুনর্গঠন করা হবে, কী করে শাসনযন্ত্রকে দোষমুক্ত করা যাবে—সে সম্বন্ধেও কার্যকর পরামর্শ দিয়েছিলেন সে আলোচনায়। তৃতীয় সংস্করণে এর সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন তিনি, প্রতিনিধিস্থানীয় ভারতীয়দের ইংরেজের প্রস্তাবিত শাসন-সংস্কার বিষয়ে মনোভঙ্গি, ভারতস্থ ইংরেজদের মতামত ইত্যাদি।
বাকিংহামের এই প্রস্তাব অবশ্য তখন কেউ গ্রহণ করেনি, কিন্তু ক’বছরের মধ্যেই পার্লামেন্টকে এর অধিকাংশ মতই কাজে পরিণত করতে হয়েছিল। যদিও বলা বাহুল্য, বাকিংহামের উল্লেখ তাতে ছিল না।
যা হোক, বাকিংহামের প্রতি কর্নেল রবিনসনের শ্রদ্ধা নিবেদন যে ভিত্তিহীন ছিল না, এতেই তা বোঝা যায়। নেটিভদের কল্যাণ সত্যিই ছিল তাঁর নিত্য চিন্তা। এবং বুদ্ধিমান চিন্তাশীলের মতো বাকিংহাম তাদের সমস্যার সমাধানও খুঁজেছিলেন যথার্থ স্থানেই। কিন্তু অ্যাডাম বা বার্লো বেইলিদের অবস্থান সে স্থানে নয়। বেইলির মতে: সবচেয়ে দৃঢ়চিত্ত উন্মাদ সংস্কারকও নিশ্চয়ই কখনও এ নিয়ে তর্ক করবেন না যে, নেটিভদের তাদের ইচ্ছামত নিজেদের ভাষায় তাদেরই প্রভুদের কাজের বা চরিত্রের সমালোচনা করতে দেওয়া উচিত।
সুতরাং রবিনসন ও বাকিংহাম দু’জনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ গঠিত হল। প্রথম জনের অপরাধ—সৈন্য বিভাগের কর্মচারী হয়েও তিনি নেটিভ চিন্তায় বিব্রত। দ্বিতীয় জনের অপরাধ— তিনি নেটিভ কল্যাণে মত্ত। এবং এজন্য তিনি বিশ্বস্ত কর্মচারীদের মধ্যেও অবাধ্যতা জাগিয়ে তুলতে চান। কাউন্সিল বসল। অ্যাডাম প্রস্তাব করলেন: প্রথমত কর্নেল রবিনসনকে পদচ্যুত করা হোক। দ্বিতীয়ত এ খবরটা সৈন্য বিভাগের সর্বত্র জানিয়ে দেওয়া হোক, যাতে ভবিষ্যতে খবরের কাগজওয়ালাদের মনের দুঃখ জানাবার সাহস আর কারও কোনও দিন না হয়। এবং সর্বশেষে, বাকিংহামের লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হোক। তাঁকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বলা হোক।
বেইলি হাত তুললেন, সম্মতি জানালেন ফেনডেলও। কাউন্সিল সিদ্ধান্তে একমত হল। কিন্তু বাদ সাধলেন স্বয়ং গভর্নর জেনারেল।
তিনি বললেন—আপনারা আর আমি সমান নই। আমি গভর্নর জেনারেল, আর আপনারা হচ্ছেন আমার কাউন্সিলের সদস্য। আপনাদের কাজ এইখানেই শেষ। আর আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে পার্লামেন্টের কাছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করে আমি দেখেছি, মিঃ বাকিংহামের অপরাধের তুলনায় এটা গুরু দণ্ড হয়ে যায়। এতখানিতে আমার মত নেই।
বাকিংহাম ছাড়া পেলেন তখনকার মতো। কিন্তু কর্নেল রবিনসনের শাস্তি বহাল রইল। তেজদৃপ্তভাবে সে শাস্তি মাথা পেতে নিয়ে জাহাজে চড়লেন বেচারা। কিন্তু ইউরোপও পৌঁছাতে হল না তাঁকে। রাস্তায়ই তিনি মারা গেলেন।
এদিকে দেখতে দেখতে বাকিংহামের উপর ঘনিয়ে এল নতুন বিপদ। বাকিংহাম নিজেই বলেছিলেন—বিপদের জাল পাতা, পদে পদে বিপদ যেখানে, সেখানে আমার সাধ্য কী তার বাইরে থাকি। এবারকার অভিযোগ—ডাঃ জেমসনের তরফ থেকে। এ নিয়ে একদিকে কাউন্সিলের রায়, অন্যদিকে ডাঃ জেমসনের পিস্তল তাক করা হল সম্পাদককে লক্ষ করে। প্রথমটি থেকে যে তাঁকে তখনকার মতো বাঁচিয়েছিলেন হেস্টিংস এবং শেষেরটি থেকে নিতান্ত ভাগ্য এবং আকস্মিকতা, তা গোড়াতেই বলেছি। হেস্টিংস যদি না থাকতেন, তবে অ্যাডামের পক্ষে বাকিংহাম নিধনের এই ঘটনাটি ছিল যথেষ্ট। অন্যদিকে সাক্ষীহীন হলে, তৃতীয়বারের মতো ডাঃ জেমসন পিস্তল নিক্ষেপে বিরত থাকতেন কিনা তাও সন্দেহ। হয়তো সেদিনই, গড়ের মাঠের ওই কোণটিতে হয়ে যেত চিরকালের মতো সরকারি বিচার। কিন্তু সরকারের দুর্ভাগ্য। বাকিংহামের কলমে যে লড়াই চল্লিশ বছর ধরে চলবার, যে লড়াইয়ে সরকারি চেহারার দু’জন নয়, লক্ষ লক্ষ লোক সাক্ষী হবার, তা ভোর রাত্রির অন্ধকারে শেষ হয়ে গেল না। বোধ হয়, কোনও দিনই তা যায় না।
অগত্যা অ্যাডামদের অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া গতি রইল না। ক্রমে লর্ড হেস্টিংসের বিদায় নেওয়ার সময় এল। নতুন গভর্নর হয়ে আসার কথা ক্যানিং সাহেবের। কিন্তু তাঁকে হঠাৎ অন্য দায়িত্বে রেখে দিতে হল স্বদেশেই। সুতরাং অগত্যা পরবর্তী গভর্নর স্থির না হওয়া অবধি সুপ্রিম কাউন্সিলের সিনিয়র মেম্বার জন অ্যাডামই বসলেন লাট বাহাদুরের তখতে।
আত্মীয়-পোষণ এবং বাকিংহাম-শাসন যুগপৎ চালাতে মনস্থ করলেন তিনি। এবং কাল বিলম্ব না করেই। কলকাতার প্রেসবেটিরিয়ানদের প্রধান যাজক তখা বাকিংহামের চিরশত্রু রেঃ সাম্যুয়েল জেমস ব্রাইস সাহেবকে হাতে তুলে নিলেন তিনি অস্ত্র হিসেবে। বাকিংহামের কলকাতার জীবন শুরু হয়েছিল এই ডাঃ ব্রাইসের সঙ্গে বিতর্কের মধ্য দিয়ে। ব্রাইস তখন ‘এশিয়াটিক মিরার’ নামক সরকারপন্থী কাগজের সম্পাদক। এই বিতর্কের অবসান হয়েছিল ‘এশিয়াটিক মিরারের’ দরজা বন্ধে এবং সেই সঙ্গে ‘ক্যালকাটা জার্নালের’ নতুন বাড়ির উদ্বোধনে।
ব্রাইস ক’বছর পরে নবরূপে এলেন, কলকাতার টোরিদের একমাত্র মুখপত্র ‘জন বুলে’র সম্পাদক হয়ে। ‘জন বুল’ জন্ম থেকেই প্রায়-সরকারি কাগজ। সুতরাং বাকিংহামের সঙ্গে বিবাদ এবং বিতর্ক ছিল তাঁর নিয়মিত কাজ। এ কাজে দক্ষতা দেখিয়ে সম্পাদক ব্রাইস অ্যাডামের মন জয় করে নিলেন।
তারই পুরস্কার দেওয়ার সময় এখন অ্যাডামের। তিনি এখন গভর্নর জেনারেল। কলকাতার কোম্পানির রাজত্বের ‘শেষ কথা’ তাঁর মুখে। ব্রাইসকে তিনি বসিয়ে দিলেন সরকারি স্টেশনারি বিভাগের কেরানির পদে। অর্থাৎ যাজক ব্রাইসের এখন কাজ হবে দেখেশুনে ফাইল, কালি, কলম, আঠা, ফিতে ইত্যাদি কেনা।
বাকিংহাম খেপে গেলেন। তীব্র ব্যঙ্গ করে তিনি লিখলেন:
‘অ্যানুয়াল ডাইরেকটরি’ নামে যে ‘ইয়ারবুক’ খানা প্রকাশিত হয়, তার থেকে আমরা জানতে পেরেছি, এই মাননীয় ভদ্রমহোদয়টি ধর্মতত্ত্ববিষয়ের ‘ডকটর’ এবং তিনি এখানকার প্রেসবিটেরিয়ান সমাজের প্রধান। ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের আনুকূল্যে এবং পৃষ্ঠপোষণায় এখন যখন তিনি একই ব্যক্তি হয়ে একসঙ্গে একদেহেই কেরানি এবং যাজককে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছেন, তখন নিশ্চয়ই, তাঁর এ কাজে যোগ্যতা আছে।’
তার পরে বাকিংহাম লিখছেন, ‘ডাঃ ব্রাইস যেহেতু এ কাজে একেবারে অনভিজ্ঞ, সুতরাং তাঁর কেনা আঠায় কাগজ সাঁটবে না, তাঁর কেনা ফিতেয় ফাইল বাঁধতে গিয়ে দেখা যাবে ছোট হয়ে যাচ্ছে। তা যাক, তবুও তো নিজেদের লোক। নিজেদের লোকেরা সবাই সব কাজ পারে।’
‘This country abounds with surprising instances of that kind of genius which fits a man in a moment for any post to which he may be appointed.’
অর্থাৎ আশ্চর্য এই দেশ। এদেশে এমন প্রতিভাবান হামেশাই পাওয়া যায়, যাঁরা, যে কোনও কাজে দেওয়া হোক না কেন, মুহূর্তে তার যোগ্য হয়ে যেতে পারে।
স্কটল্যান্ডে তা হয় না। ডাঃ ব্রাইস যে দেশ থেকে এসেছেন, সে দেশের যাজকদের চাকুরি তো পরের কথা, খবরের কাগজ নিয়ে অনাবশ্যক কোন্দল করারই সময় হয় না তাঁদের।
কর্তৃপক্ষকে লিখলেন ‘দিন, তাঁকেই দিন, যাঁর অনেক দায়িত্ব আছে, তাঁকে আরও দিন, আর যাঁদের কিছু নেই, তাঁদের যতখানি আছে ততটুকুই কেড়ে নিন।’
ক্রোধে অন্ধ হয়ে গভর্নর অ্যাডাম কাউন্সিলের সভা ডাকলেন। এবার আর নয়। ঔদ্ধত্যের একটা সীমা আছে।
সকলে হাত তুললেন।
বাকিংহামের নির্বাসনের রায় হয়ে গেল।
৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮২৩ সাল। ‘ক্যালকাটা জার্নালের’ পাতায় বাকিংহাম সে সংবাদ দিলেন। ‘মহামান্য সরকার বাহাদুর নিরতিশয় বিজ্ঞ এবং নিশ্চয় সকল রকম অভিযোগের অতীত। তাঁরা নিশ্চয়ই বিজ্ঞতা প্রণোদিত হয়েই এই রায় দিয়েছেন। এজন্য আমি বাধিত। তবে কলকাতায় আমার স্বল্পকালের জীবনে তাঁরা যে দৃষ্টান্ত আজ দেখালেন, ভারতবর্ষের ইতিহাসে তা অভূতপূর্ব। আমার ধারণা ছিল, যদি নেহাত রাষ্ট্রের পক্ষে বিপদের কারণ না হয়, তবে কাউকে এমন শাস্তি দেওয়া হবে না। আর যদি একান্তই কাউকে দেওয়া হয়, তবে নিশ্চয়ই আইনের আশ্রয়ে তা করা হবে। তাঁকে অভিযুক্ত করা হবে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেওয়া হবে। কিন্তু হায় আমার ধারণা। এখানে যে গভর্নর জেনারেল নিজেই অভিযোগকারী, নিজেই নিজের সাক্ষী, নিজেই বিচারক, নিজেই জুরি এবং ঘাতক। বাকিংহাম পাঠকদের আশ্বাস দিলেন, আবার তিনি ফিরবেন। কলকাতা থেকে যদি সত্যিই তাঁকে একেবারে বিদায় নিয়ে যেতে হয় কোনও দিন, তবে কারও আদেশে তা তিনি করবেন না। এ রায় তিনি পালটাবেন। পৃথিবীতে অ্যাডামই একমাত্র রায় দানের কর্তা নয়।
সময় অল্প। কিন্তু কাজ অনেক। বিরাট বিষয়সম্পত্তি। দশ বছর সবেমাত্র স্ত্রী এসে মিলেছেন কলকাতায়। সমুদ্রে সমুদ্রে ভবঘুরে জীবনের অন্তে সবে মাত্র সংসার গড়ে উঠেছে এখানে। এ সংসারও গুটোতে হল। জিনিসপত্তর তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হল। কাগজ বন্ধ করলে চলবে না। বাকিংহাম সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পণ করলেন নতুন দু’ জন সাংবাদিকের উপর। স্ট্যান্ডফোর্ড আরনট ও জেমস সাদারল্যান্ড। নগদ সাতশো হাজার টাকা তুলে দিলেন তাদের হাতে, ‘কাগজ বন্ধ হতে দিয়ো না যেন, আমি আসছি।’
দেখাশুনার ভার পড়ল স্বভাবতই পামার এবং ব্যালার্ডের ওপর। আধাআধি শেয়ারের মালিক তাঁরা। তাড়াহুড়োয় মোটামুটি একটা চলনসই ব্যবস্থা করে বাকিংহাম স্ত্রীকে নিয়ে জাহাজে চড়লেন।
জেমস সিল্ক বাকিংহাম কলকাতা ত্যাগ করলেন। বিনা বিচারে ভারতের প্রথম দৈনিকপত্রের, প্রথম জনগণের কাগজের প্রিয় সম্পাদক দেশত্যাগে বাধ্য হলেন। কেউ প্রতিবাদ করল না, কেউ প্রশ্ন তুলল না, কিন্তু সবাই ভাবলেন। বাকিংহামের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের কথাও ভাবলেন কলকাতার অনেক ইংরেজ। কেউ কেউ হয়তো কাঁদলেনও। কিন্তু কোম্পানির রাজত্ব। কেউ কিছু বললেন না। বাকিংহাম চলে গেলেন।
এর পরের কাহিনী আরও দীর্ঘ। হিকির মতো মেরে ফেলা গেল না বাকিংহামকে, ডুয়েনের মতো জনগণ এড়িয়েও চলল না তাঁকে। শতাধিক বইয়ের লেখক, বুদ্ধিদীপ্ত বাকিংহামকে হিকির মতো উন্মাদ সাব্যস্ত করা গেল না, রক্তে আমেরিকান দোষ দেখিয়ে ডুয়েনের মতো খারিজ করেও দেওয়া গেল না। বাকিংহাম যোগ্যার্থে ইংরেজ সাংবাদিক।
সুতরাং গল্পটা যেখানে শেষ হয়ে যাওয়ার কর্তা, শুরু হল আবার সেখান থেকেই। এবার পুবের আর পশ্চিমের দুই নগরী তার পটভূমি। এদিকে কলকাতা, ওদিকে লন্ডন। একদিকে প্রজার দেশ ভারতবর্ষ, ওদিকে নিজেদের পিতৃভূমি, গণতন্ত্রের দেশ ইংল্যান্ড। দুই দেশকেই শুনতে হল বাকিংহামের কথা। শোনায় যাঁদের মত ছিল না, তাঁরাও শুনতে বাধ্য হলেন। এতদিন যাঁরা চোখ বুজে ছিলেন, এবার চোখ খুলতে হল তাঁদেরও। বাকিংহাম হিকির মতো মিলিয়ে গেলেন না, ডুয়েনের মতো হারিয়েও গেলেন না। অ্যাডামদের আতংক হয়ে এর পরেও বত্রিশ বছর বেঁচে রইলেন। এই বত্রিশ বছরের প্রতিটি দিন ভারতের কর্মচারীরা, লন্ডনের বোর্ড অব ডিরেকটর, বোর্ড অব কন্ট্রোল, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট—এক কথায় সমগ্র ব্রিটিশ জাতি জানলেন, ক্যালকাটা জার্নালের সম্পাদক জেমস সিল্ক বাকিংহাম জীবিত। অ্যাডামের পাপের ফল পোয়াতে হল তাঁদের দীর্ঘ বত্রিশ বছরের প্রতিটি দিন ধরেই।
ইংল্যান্ডের মাটিতে পা দিয়েই বাকিংহাম শুরু করলেন আন্দোলন। এই অন্যায় আচরণের বিচার চান তিনি। সেই সঙ্গে তিনি চান কোম্পানি শাসন, একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার বাতিল করা হোক।
এই আন্দোলনের মুখপত্র হয়ে প্রকাশিত হল ‘ওরিয়েন্টাল হেরাল্ড’। মাসিক রাজনীতি বিষয়ক পত্রিকা। অন্য কথায়, ক্যালকাটা জার্নালের লন্ডন সংস্করণ। এ আন্দোলনের প্রথম ফল হল ডাঃ ব্রাইসের নিয়োগ বন্ধ। যে নিয়োগের যৌক্তিকতা তুলে বাকিংহাম নির্বাসনের দণ্ড ডেকে এনেছিলেন, বিলাতের কর্তৃপক্ষও তা সমর্থন করতে পারলেন না। সঙ্গে সঙ্গে স্কটল্যান্ডের প্রেসবিটেরিয়ান চার্চ ডাঃ ব্রাইসকে জানাল, কেরানির কলম হাতে নেওয়ার আগে তিনি যেন যাজকের আলখাল্লাটা ছেড়ে নেন।
যদি ডাঃ ব্রাইসকে কেউ চাকরি দেওয়া আপনারা গর্হিত কর্ম বলে মনে করেন, তবে এ প্রশ্নে আমাকে নির্বাসন দেওয়া কি সংগত? বোর্ড অব ডিরেকটরসের সভায় প্রশ্ন তুললেন বাকিংহাম, ‘আমি ভারতে ফিরে যেতে চাই।’
কোম্পানি উত্তর দিলে, না তার অনুমতি দেওয়া হবে না।
‘কেন আমাকে যেতে দেওয়া হবে না?’ বোর্ড অব কন্ট্রোলের দরজায় হুংকার দিলেন বাকিংহাম।
‘কেন, তা আমরা বলছি না, তবে আপনাকে আবার ভারতবর্ষে যেতে দিতে আমরা সম্মত নই।’ বোর্ড অব কন্ট্রোল রায় দিলেন।
সেখান থেকে বাকিংহাম গেলেন পার্লামেন্টে। সবাই তাঁর কাহিনী শুনলেন। কিন্তু ভোটের বেলায় হাত উঠল মাত্র একখানা। একজন মাত্র টোরি সদস্য সমর্থন করলেন তাঁকে। বাকিংহাম জীবনে কোনও দিনই টোরি ছিলেন না। এর আগে অবধি টোরিরা তাঁকে ‘হুইগ’ বলতেন। কিন্তু বাকিংহাম ‘হুইগ’ও ছিলেন না। তিনি নিজেই ছিলেন একটি স্বতন্ত্র দল, একটি স্বতন্ত্র মত। টোরিদের অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল মতামতকে তিনি সমর্থন করতেন বটে, কিন্তু তাঁর কালের টোরিদের চেয়ে তিনি ছিলেন অন্তত পঁচিশ বছরের অগ্রবর্তী। কোম্পানির একচেটিয়া কারবার বন্ধের যে দাবি তিনি তুলেছিলেন ভারতবর্ষে থাকতে, ১৮৩৪ সালে তা পূর্ণ হয়েছিল। যে দাস প্রথা উচ্ছেদের দাবি তুলেছিলেন ১৮২৫ সালে সে বছর তাও উঠে গেছিল। ঠিক তেমনি ইংল্যান্ড একদিন স্বীকার করে নিয়েছিল নির্বাচনের ব্যাপ্তি, সংবাদপত্রের স্বাধিকার, সব। তবুও প্রতিটি ব্যাপার উপলক্ষে, বাকিংহামকে সহানুভূতিশীল হুইগরা পর্যন্ত আখ্যাত করেছেন স্বপ্নলোকের মানুষ বলে—মিঃ বাকিংহাম এ দুনিয়ার মানুষ নন, তিনি আজবলোকের বাসিন্দা।
সুতরাং পার্লামেন্টে বাকিংহাম হেরে গেলেন। প্রিভি-কাউন্সিলেও তাঁর মোকদ্দমা টিকল না। অ্যাডামের রায়ই বহাল রইল।
এদিকে কলকাতায় তখন জন অ্যাডাম ভূত দেখে বেড়াচ্ছেন। বাকিংহামের ভূত। যেদিকেই তাকান, সেদিকেই যেন এই নির্ভীক সাংবাদিকের ছায়া। অ্যাডাম চমকে ওঠেন।
খ্রিস্টান অ্যাডাম তখন ব্রাহ্মণ চাণক্যের নীতি ধরলেন। শত্রুর শেষ রাখতে নেই। তিনি তাই করবেন। যেমন করে হোক, ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ শেষ করা চাই।
লন্ডনের বাকিংহামের লড়াইয়ের খবর কলকাতায় পৌঁছায়। সম্পাদকেরা ‘ওরিয়েন্টাল হেরাল্ড’ও নিয়মিত টেবিলে পান। সুতরাং বাকিংহামকে কেউ আর ভুলতে পারেন না।
রেঃ ডাক্তার ব্রাইস, ‘জন বুলের’ পাতায় অনুপস্থিত সাংবাদিককে আক্রমণ করেন, গায়ের জ্বালা জুড়ান।
‘ক্যালকাটা জার্নালে’র সম্পাদক দু’জন—সাদারল্যান্ড আর আরনট তার জবাব দেন। বাকিংহামের কাগজের তাঁরা সম্পাদক। ‘ক্যালকাটা জার্নালে’র ভূতপূর্ব সম্পাদক তাঁদের আদর্শ। তাঁর ইজ্জত তাঁদেরও ইজ্জত।
অ্যাডাম স্বভাবতই এটা পছন্দ করলেন না। বাকিংহামকে নিয়ে আলোচনা হোক, এটা তিনি চান না। বড় অস্বস্তি বোধ করেন তিনি বাকিংহামের কথা এখনও মনে পড়লে। আরনট আর সাদারল্যান্ডের মধ্যে তিনি যেন বাকিংহামকেই দেখলেন। তাঁর ভয় হল।
কিন্তু সম্পাদক সাদারল্যান্ড ইংরেজ হলেও ভারতসন্তান। তাঁকে বাইরে চালান দেওয়া যাবে না। এক পারা যায় আরনটকে। ও শুধু ইংরেজ নয়, এদেশের বে-আইনি বাসিন্দা। খবর নিয়ে অ্যাডাম জেনেছেন, কোম্পানির ছাড়পত্র নেই ওর পকেটে। সুতরাং অচিরেই সেক্রেটারির চিঠি পৌঁছাল ক্যালকাটা জার্নালের মালিকদের কাছে:
‘যেহেতু এখনও তোমাদের কাগজে নির্বাসিত বাকিংহামকে নিয়ে আলোচনা হয়, সেই হেতু আমরা চাই তোমরা সম্পাদকদের অবিলম্বে পদচ্যুত করো। কাগজের স্বার্থে সেই তোমাদের কর্তব্য। আপাতত সম্পাদক সাদারল্যান্ডকে আমরা কিছু করতে পারছি না বটে, তবে অবিলম্বে আরনটকে আমরা দেশে পাঠাচ্ছি।’
আরনট বন্দি হলেন। তারপর পালিয়ে গেলেন চন্দননগরে। পরে অবশ্য সেখান থেকে ধরে এনে তাঁকে পাঠানো হয় বিলেতে।
এদিকে সাদারল্যান্ডও কিন্তু বশংবদ হতে পারলেন না। বাকিংহামকেই ধরে রইলেন তিনি তখন পর্যন্ত। বাকিংহামের ‘ওরিয়েন্টাল হেরল্ড’ থেকে তিনি ক্যালকাটা জার্নালে ছাপতে লাগলেন লিসেস্টার স্ট্যানহোপের বিখ্যাত রচনা—‘স্কেচ অব দ্য হিস্টরি অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স অব দ্য প্রেস ইন ইন্ডিয়া।’
তখন প্রেস আইন বলবৎ। ছাপাখানা ও ছাপার কাজ সরকারি লাইসেন্স ছাড়া অচল। সরকার আদেশ দিলেন ‘ক্যালকাটা জার্নালের’ প্রেস বন্ধ করো।
তার লাইসেন্স বাতিল করা হল।
মালিকেরা জানতে চাইলেন—অপরাধ?
‘অপরাধ, তোমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কিত এই বইখানা ছেপেছ।’ উত্তর দিলেন সরকার।
অবশেষে ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ সত্যিই বন্ধ হয়ে গেল।
হাজার হাজার টাকার কারবার। মালিকেরা প্রমাদ গনলেন। লন্ডনে বসে অন্যতম মালিক বাকিংহাম বুঝলেন, তাঁর চিহ্নও মুছে দিতে চায় ভীরু গভর্নমেন্ট।
এর আগে সরকারকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন কলকাতায় তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরিটি জনসাধারণের জন্যে খুলে দিতে। সরকার রাজি হননি। এবার কাগজও বন্ধ হল।
৪০ হাজার পাউন্ড মূলধন। বিরাট কারবার, অনেক কর্মী। বাকিংহাম পরামর্শ দিতে, মালিকেরা কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটোছুটি করতে লাগল। যদি শেষ অবধি আবার অনুমতি পাওয়া যায়। বাকিংহামের আশা: শেষ অবধি হয়তো ভারতবর্ষে ফিরতে পারবেন তিনি। সরকার কথা দিলেন, দেখা যাবে।
এই কথার উপর ভরসা করে লোকেদের মাইনে দেওয়া হল। কাজ নেই, তবুও কাউকে জবাব দিলেন না পামার।
শেষে ভাবলেন, সরকারি লোককে সম্পাদক করলে হয়তো সুফল ফলতে পারে। পামার বন্দোবস্ত করলেন জনৈক ডাঃ মাটসনের সঙ্গে। মাটসন কাউন্সিল-সদস্য হ্যারিংটনের জামাতা এবং কোম্পানির কর্মচারী। পামারের ভরসা: মাটসন সম্পাদক হলে কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিতে পারেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ আবার ছাপা হোক, এটা চান না। তা ছাড়া, মাটসন যে আর এক বাকিংহাম হবে না, তাই বা কে বললে। বিশেষত, কাগজটা যখন ‘ক্যালকাটা জার্নালই’ থাকছে। স্পষ্টতই তাঁরা বললেন সে কথা।
অবশেষে একটা রফা হল। বেশ, তবে মাটসনকে ছাপাখানাটা লিজ দিয়ে দাও। হ্যারিংটনের জামাতার যদি কাগজ বের করার সাধই হয়, তবে নতুন কাগজ বের করুক।
১৮২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ‘ক্যালকাটা জার্নালের’ প্রেস থেকে বের হল ডাঃ মাটসনের নতুন কাগজ—‘দ্যি স্কচম্যান ইন দ্য ইস্ট’। বাকিংহাম লিখছেন আমার ছাপাখানা, আমার টাইপ, আমার সব, অথচ আমি এক পয়সা পাই না।
প্রেসের ভাড়া সাব্যস্ত হয়েছিল মাসে পঁচিশ হাজার টাকা। বাকিংহাম ছাড়া বাকি সত্তর জন শেয়ার হোল্ডার সবাই কিছু পেতেন। কিন্তু যাঁর সম্পত্তি তিনি কিছুই না। এমনকী, এক কপি কাগজও না। এদিকে সম্পাদক হিসেবে মাটসন মাইনে নিতেন মাসে ৬০০ টাকা। তদুপরি লাভের অংশ তো আছেই।
দিব্যি চলছিল। অদূর ভবিষ্যতে কর্তৃপক্ষের এমনি আনুকূল্যে মাটসন হয়তো প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতেন জীবনে। কিন্তু হ্যারিংটনের জামাতাটি একটি অপদার্থ। তিনিও বাকিংহাম হতে চান। খবরের কাগজের স্বাধীনতা তাঁরও প্রিয় আলোচ্য।
কর্তৃপক্ষ মাটসনকে ধমক দিলেন। মাটসন ‘আন্তরিক দুঃখিত’ হয়ে ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু একবার স্বাধীনতায় পেয়ে বসলে তাকে ছাড়ানো সহজ নয়। সে ক্রমেই প্রলুব্ধ করে, ক্রমেই বাঁধা সড়ক থেকে নেমে চলতে বলে।
শুভানুধ্যায়ীরা ডেকে বোঝালেন। নিত্য ধমক, নিত্য ত্রুটি স্বীকার কত আর সহ্য হয়? মাটসন বললেন, খবরের কাগজে আমার কাজ নেই, চিকিৎসাবিদ্যাই ভাল।
মাটন কাগজ বেচে দিলেন। মালিকদের শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ হল। অগত্যা জন অ্যাডামের স্বপ্নকে সফল করে নিলামে উঠল ‘ক্যালকাটা জার্নালের’ প্রেস।
বলা বাহুল্য, রাজদ্রোহীর সম্পত্তি, দাম পাওয়া গেল অতি সামান্য। বাকিংহাম দুই সম্পাদকের হাতে যে নগদ সাতাশ হাজার টাকা তুলে দিয়েছিলেন, সে টাকা আগেই ফুরিয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই প্রেস আবার চালু হবে—এ ভরসায় পামারেরাও টাকা ঢেলেছেন বিস্তর। কাজ নেই, তবুও লোক ছাঁটাই করেনি। নিয়মিত মাইনে দিয়ে গেছেন। ফলে হিসেব-নিকেশ যখন হল, তখন দেখা গেল, উত্তমর্ণ থেকে বাকিংহাম অধমর্ণদের তালিকায় উঠেছেন। চল্লিশ হাজার পাউন্ড সম্পত্তির বদলে, তাঁর নামে খাতায় নতুন ঋণ। ভারতবর্ষে সম্পত্তি বাবদ সাতাশ হাজার টাকা তাঁর দেয়।
‘ক্যালকাটা জার্নালের’ দীর্ঘ ইতিবৃত্তের মতো তার উপসংহারটিও সত্যিই অভূতপূর্ব। কাগজ-হত্যার এমনি ধৈর্যশীল অধ্যবসায়ের সফল দৃষ্টান্ত সত্যিই বোধ হয় আর মেলে না।
‘ক্যালকাটা জার্নাল বধ’ অবশেষে সম্পন্ন হল বটে, কিন্তু বাকিংহাম মরলেন না। ‘ওরিয়েন্টাল হেরাল্ডের’ পাতার সীমানা পেরিয়ে ইতিমধ্যে তিনি এসে পৌঁছেছেন বৃহত্তর মানুষের মেলায়। বাকিংহাম তখন রাজনৈতিক পুরুষ, সমাজ-সংস্কারক। জনতার কাগজের সম্পাদক তখন জনতার নেতা। ব্রিটিশ-দ্বীপপুঞ্জের ছোট বড় বহু মানুষ তখন তাঁর পিছনে।
ভারতবর্ষে ফিরবার শেষ সম্ভাবনাও লুপ্ত হয়ে গেছে দেখে, বাকিংহাম এবার দাবি তুললেন— ক্ষতিপূরণ চাই।
হাউস অব কমনসের তিনশো জন সদস্য নিয়ে গঠিত হল এবার অনুসন্ধান সমিতি। মিঃ চার্লস গ্রান্ট, লর্ড জন রাসেল, রবার্ট পিল, গ্রানাভিল, সমরসেটের মতো বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি তার সদস্য।
কমিটি একমত হলেন: ক্ষতিপূরণের দাবি যথার্থ। কোম্পানির উচিত মিঃ বাকিংহামকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
‘কিন্তু কত?’
‘সেটা কোম্পানির উপরই ছেড়ে দেওয়া হোক।’ অনুসন্ধান কমিটি সুপারিশ করলেন।
হায়, বাকিংহাম ‘ওয়ারেন হেস্টিংস’ ছিলেন না। তিনি লাট বাহাদুর নন। সুতরাং কোম্পানি সে সুপারিশ অগ্রাহ্য করলেন। বাকিংহামের নামে তাঁরা বছরে দুশো পাউন্ড পেনসন মঞ্জুর করলেন। অথচ বিচারান্তে ওয়ারেন হেস্টিংসের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁরাই সত্তর হাজার পাউন্ডের তোড়া।
‘বাকিংহাম যে গভর্নর জেনারেল ছিলেন না। এই বৃহৎ পশ্চাদভূমিহীন ছিলেন বলেই বাকিংহাম শুধু বাকিংহামই থেকে গেলেন, নয়তো তিনিও স্বীকৃত হতেন ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বেকন বলে।’ খেদ করে মন্তব্য করেছিলেন একজন গুণগ্রাহী।
স্ট্যানহোপ বলেছিলেন এডমন্ড বার্ক, লর্ড কর্নওয়ালিস এবং মিলকে বাদ দিলে আজকে আমাদের বিচারে অপরাধী বাকিংহামের তুল্য ভারতের মঙ্গল এমন করে কেউই চিন্তা করেননি।
আগেই বলেছি, বাকিংহাম রচিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় একশো। সেগুলো শুধু দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর শিশুপাঠ্য কাহিনী নয়, তার মধ্যে আছে গুরুতর রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিষয়ে স্বাধীন মৌলিক চিন্তা। মদ্যপানের কুফল, রোগচিকিৎসা থেকে শুরু করে, ইংল্যান্ডের বা ভারতের, ভবিষ্যতের জন্যে অনেক যুক্তিপূর্ণ তথ্যবহুল আলোচনা। সে আলোচনার বৈশিষ্ট্য এই, সিদ্ধান্ত সব ক্ষেত্রেই তাঁর নিজস্ব—সম্পূর্ণ মৌলিক।
বোম্বাই থেকে একটা বেতের তৈরি ভেলা বানিয়ে, তার উপর গ্যাস বেলুন বেঁধে দাঁড় টেনে টেনে কী করে লন্ডন যাওয়া যায়, অ্যারোপ্লেন আবিষ্কারের বহু আগে ‘ক্যালকাটা জার্নালের’ পাতায় বাকিংহাম তা যেমন ভেবেছেন, তেমনি সুয়েজ খাল কাটার আগে মিশরের পাশার সঙ্গে বসে বসে পরামর্শ করেছেন, কী করে দুটো ভূখণ্ডকে সংক্ষেপে জুড়ে দেওয়া যায়, সে বিষয়ে।
পরবর্তী কালে প্যারিসের বিখ্যাত পলিটিক্যাল ইকনমি ক্লাব তাঁকে আমন্ত্রণ করে পরামর্শ চেয়েছিলেন, ভবিষ্যতের রাস্তাঘাট সম্পর্কে।
এমনি আরও বহু ঘটনা, বহু কাহিনী আছে বাকিংহামের জীবনে। যা অল্প লোকের জীবনেই সম্ভব হয়। যাঁদের হয়, তাঁদের আমরা অতিমানবের গৌরবে ভূষিত করি। তাঁদের নাম আমাদের কণ্ঠস্থ। দৈবাৎ যদি ভুলে যাই কখনও, তবে তার জন্যে লজ্জার আর অবধি থাকে না। কিন্তু বাকিংহামের ভাগ্যে এ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। সহসা কলকাতা এসে উপস্থিত না হলে কিংবা ঘটনাচক্রে ‘ক্যালকাটা জার্নালের’ সম্পাদক না হলে, চিরকালই হয়তো অজ্ঞাত থেকে যেতেন তিনি আমাদের দেশে।
নিজের দেশে অবশ্য নিজের একটা পরিচয় তিনি করিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু সেও যেন জোর করে আদায় করা জিনিস। প্রতিভা এবং কর্মের তুলনায় তাও অত্যন্ত পরিমিত। অনুদারতার কলংকে যেন রীতিমত সংকুচিত।
অথচ তাঁর কালের ইংল্যান্ডে বাকিংহাম যে জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। গ্রেটব্রিটেন এবং আমেরিকায় প্রায় হাজার চারেক জনসভায় বক্তৃতা করেছেন নাকি তিনি তাঁর জীবনে। লক্ষ লক্ষ লোক পয়সার বিনিময়ে তার শ্রোতা হয়েছেন। বক্তৃতা শেষে করতালি দিয়েছেন। বাকিংহাম তাঁদের অন্তরে পৌঁছেছিলেন।
১৮৩২ সনে শেফিল্ড থেকে বিপুল ভোটে পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়ে বাকিংহাম তাঁর এই জনপ্রিয়তার প্রমাণ দিয়েছিলেন। ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিতে সেদিন বাকিংহাম নির্ভীক সেনাপতি, ফ্রি ট্রেডের নায়ক। বাকিংহাম নাবিকদের বন্ধু, প্রকাশক সাহিত্যিকদের প্রিয় সুহৃদ। প্রগতিশীলেরা তাঁর কলম, তাঁর বাগ্মিতা ইত্যাদির কারণে তাঁর সমর্থনের জন্যে প্রগতিশীল মানুষ তখন পার্লামেন্টে নেই। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, নিজের দেশে নির্বাচনের অধিকারের আরও ব্যাপ্তি, গোপন ব্যালট প্রথায় নির্বাচন, শিক্ষার বিস্তার, বিশ্বশান্তি ইত্যাদি বহু বহু আন্দোলনের গৌরবে তাঁর জীবন ভূষিত।
তবুও ইংল্যান্ডের ইতিহাসে বাকিংহাম অজ্ঞাত পুরুষ। পার্লামেন্টারি কাহিনীতে প্রায় অবজ্ঞাত সদস্য। তাঁর বক্তব্য তাঁর কালের সীমানা ছাড়িয়ে বহু দূর বিস্তৃত হলেও, নাম তাঁর সেই সঙ্গে প্রসারিত হয়নি। পার্লামেন্টারি ইতিবৃত্তের সমুদ্র মন্থনে একালের মানুষ কৌতূহলাবৃত হয়ে সে কাহিনী উদ্ধার করে আনে মাত্র।
আমাদের মতো মানুষের কাছে মনে হয়, এ তাঁর দুর্ভাগ্য। সারা জীবনে ভাগ্যবানদের হাতে তৈরি দুর্ভাগ্যের গোলকধাঁধায় ঘুরে ঘুরে মুক্ত বাকিংহাম কিন্তু বলেছিলেন, এ তাঁর সৌভাগ্য যে যন্ত্রণা তাঁর জীবনগৌরব, নিষ্ঠুর হলেও তা ভাগ্য বই কি।
ভারতবর্ষ অ্যাডামেরা তাঁকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রের সেই সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে যেদিন তীরে পৌঁছালেন তিনি, সেদিন ভারতবর্ষের উপহারই জানিয়েছিল তাঁকে: অন্ধকারের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে তিনি আলোকের রাজ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
ভারতে প্রবাসী জনৈক অজ্ঞাত ইংরেজ তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় উইল করে তুলে দিয়ে গেছেন বাকিংহামের নিষিদ্ধ হাতে—মিঃ বাকিংহাম যেন সম্পাদকের জীবন ত্যাগ না করেন কোনও দিন। অন্তত যতদিন সম্ভব তাঁর এই সামান্য অর্থে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখেন স্বাধীন মত প্রকাশের শিখাটিকে।
বাকিংহামের তৃতীয় কাগজ, তদানীন্তন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সাহিত্য পত্র ‘এথেনিয়াম’ এই ভারত প্রবাসী স্বাধীনতাকামী বন্ধুর প্রাণের কাগজ।
বাকিংহামের হাতে উইল করে যাঁরা স্বাধীনতাকে সঁপে দিয়ে যান, সংখ্যায় তাঁরা অল্প হলেও, তাঁদের নিয়ে বাকিংহামের গর্ব কম হওয়ার কথা নয়, জীবন-যন্ত্রণা তাই তাঁর কাছে সৌভাগ্য। সমসাময়িক খ্যাতনামাদের খ্যাতি, শক্তিমানদের শঠতা কিছু গ্রাহ্য করেননি বাকিংহাম। তাঁর শেষ দিন অবধি বিশ্বাস ছিল, তিনি তাঁর কালের বহু অগ্রবর্তী, অনেক এগিয়ে গিয়ে জন্ম হয়েছে তাঁর, অন্তত তৎকালীন ইংল্যান্ডের চেয়ে চিন্তায় তিনি একশো বছরের আধুনিক।
বাকিংহাম বোধ হয় কমিয়ে বলেছেন। বাকিংহামের প্রগতিশীলতা সময়ের গজ-কাঠিতে মাপা যায় না। তিনি চিরকালের সাংবাদিক। তিনি চিরকালের স্বাধীন মানুষ। বিংশ শতকে সাংবাদিকতা সংজ্ঞা পালটালেও বাকিংহাম তাতে বাতিল হন না, আদর্শ হন মাত্র।
কলকাতার গান
‘রাজা নবকৃষ্ণ কবির বড় পেট্রন ছিলেন। ইংলন্ডের কুইন এলিজাবেথের আমলে যেমন বড় বড় কবি ও গ্রন্থকর্তা জন্মান, তেমনই তাঁর আমলেও সেই রকম রাম বসু, হরু, নিলু, রামপ্রসাদ ঠাকুর ও জগা প্রভৃতি বড় বড় কবিওয়ালা জন্মায়। তিনিই কবিগাওনার মান বাড়ান, তাঁর অনুরোধে ও দ্যাখাদেখি অনেক বড় মানুষ কবিতে মাতলেন।’ লিখছেন হুতোম প্যাঁচা। তাঁর বিখ্যাত ‘নকশা’ প্রচারিত হয় ১৮৬২-৬৩ সনে। কলকাতার গান বলতে তখনও যাত্রা, পাঁচালি, আখড়াই, হাফ আখড়াই আর এই কবিগান। হুতোম বর্ণনা দিচ্ছেন কবির আসরের: ‘এদিকে বারোইয়ারিতলায় জমিদারি কবি আরম্ভ হলো, ভাল্কোর জগা নিমতের রামা ঢোলে ‘মাহস্নস্তব’ ‘গঙ্গাবন্দনা’ ও ‘ভেটকিমাছের তিনখানা কাঁটা,’ অগ্গরদ্বীপের ‘গোপীনাথ’, যাবি তো যা যা ছুটে ছুটে যা, প্রভৃতি বোল বাজাতে লাগলো :কবিওয়ালারা বিষমের ঘরে (পঞ্চমের চারগুণ উঁচু) গান ধল্লেন—বড় বারে বারে এসো ঘরে মকদ্দমা করে ফাঁক, এইবারে, গেরে তোমার কল্লে সুর্পনখার নাক।’ ইত্যাদি।
কবিগান কলকাতার নয়, বাংলার গান। ইংরাজের আবির্ভাবের আগে যে বাংলা সাহিত্য, তা যত না পাঠ্য তার চেয়ে বুঝি বা বেশি শ্রাব্য। কথা তখন মূর্ত বহুলাংশে সুরকে ভর করেই। সেই ধারা অব্যাহত ইংরাজের পদসঞ্চারের পরেও অনেকদিন ধরে। অষ্টাদশ শতক তো বটেই এমনকী, উনিশ শতকের প্রথম দিকেও আমাদের সাহিত্য বহুলাংশে সংগীতাশ্রয়ী। কলকাতা অবশ্য ইংরেজাশ্রয়ী। কিন্তু ভাগীরথীতীরের এই বাঙালি প্রধান শহরের সাধ্য কী, সংগীতের সেই সর্বব্যাপ্ত হিল্লোল এড়িয়ে চলে। সেদিন আন্দোলিত অতএব নবীন নগরী কলকাতাও।
বাংলায় যোড়শ শতকে বৈষ্ণব প্রভাবের কালেই শুরু হয়েছিল মার্গ সংগীতের চর্চা। অবশ্য সমাজের সর্বস্তরে নয়। ধ্রুপদ, খেয়াল ছিল প্রধানত বড় মানুষদের বৈঠকখানার ব্যাপার। রাজা-রাজড়া, জমিদার কিংবা আমীর ওমরাহরা পাত্র-মিত্র নিয়ে আসর সাজিয়ে সে সব হিন্দুস্থানি গান শুনতেন। অষ্টাদশ শতকেও মোটামুটি চর্চা ছিল তার। কিন্তু সাধারণ তখন প্লাবিত হয় ভক্তি সংগীতে, নয়তো লোকগীতিতে। কিংবা উভয়ত। বৈষ্ণব কীর্তনের ঢেউ তখন অনেকাংশে স্তিমিত। আমাদের মধ্যযুগ ছিল বলতে গেলে নিস্তরঙ্গ। তাতে জোয়ারের লক্ষণ দেখা দেয় যোড়শ শতকে চৈতন্যের আবির্ভাবে। সে উত্তেজনাও ক্রমে বন্দি হয় ‘সাম্প্রদায়িক’ বা গোষ্ঠীগত নিয়ম এবং নীতির বদ্ধ জলায়। বাঙালির ধর্মীয় তৃষ্ণা তখন তৃপ্তি খোঁজে শাক্ত সংগীতে। শুধু রামপ্রসাদ আর কমলাকান্তের মতো সাধক কবি নন, শাক্তসংগীত রচয়িতাদের তালিকায় তখন রাজারাজড়া, জমিদার, দেওয়ানরাও। কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর দুই পুত্র, মহারাজা নন্দকুমার, বর্ধমানের দেওয়ান রঘুনাথ ও তাঁর ভাই দেওয়ান নন্দকিশোর, নাটোরের রাজা রামকৃষ্ণ এবং আরও কেউ কেউ। রামপ্রসাদের দুঃখবাদে যদি যুগের পরিমণ্ডলের আভাস মেলে, তবে একদা বলীদের এই শক্তি সাধনা এবং যুগপৎ বৈরাগ্যের সুরে স্পষ্টতই ভাগ্য বিবর্তনের ইঙ্গিত। দিন পালটাচ্ছে। বিদেশি শাসনের দমকা হাওয়ায় বড় ঘর কাঁপছে, ছোট বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
তার প্রতিচ্ছায়া কলকাতার জীবনেও। হুতোম লিখছেন ‘পাঠক। নবাবী আমল শীতকালের সূর্যের মত অস্ত গ্যাল। মেঘান্তের রৌদ্রের মত ইংরাজদের প্রতাপ বেড়ে উঠলো। বড় বড় বাঁশ ঝাড় সমূলে উচ্ছন্ন হলো। কঞ্চিতে বংশলোচন জন্মাতে লাগলো। নবো মুনসি, ছিরে বেনে, ও পুঁটিতেলি রাজা হলো। সেপাই পাহারা, আসা সোটা ও রাজা খেতাব ইন্ডিয়া রবারের জুতো ও শান্তিপুরের ডুরে উড়নির মত রাস্তায় পাদাড়ে ও ভাগাড়ে গড়াগড়ি যেতে লাগলো। কৃষ্ণচন্দ্র, রাজবল্লভ, মানসিংহ, নন্দকুমার, জগৎশেঠ প্রভৃতি বড় বড় ঘর উৎসন্নে যেতে লাগলো, তাই দেখে হিন্দুধর্ম, কবির মান, বিদ্যার উৎসাহ, পরোপকার ও নাটকের অভিনয় দেশ থেকে ছুটে পালালো। হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই, পাঁচালী ও যাত্রার দলেরা জন্মগ্রহণ কল্লে। শহরের যুবক দল গোথুরী, ঝকমারী ও পক্ষীর দলে বিভক্ত হলেন। টাকা বংশ গৌরব ছাপিয়ে উঠলেন।’
কলকাতায় টাকার কুমিরদের এক নেশা ছিল নাচ। ১৮১৯ সালের ১৯ অক্টোবর ‘সমাচার দর্পণ’-এর সংবাদ ‘শহর কলিকাতায় নিকী নামে এক প্রধান নর্তকী ছিল কোন ভাগ্যবান লোক তাহার গান শুনিয়া ও নৃত্য দেখিয়া অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া এক হাজার টাকা মাসে বেতন দিয়া তাহাকে চাকর রাখিয়াছেন।’ ১৮২২ সালে দেখি, নিকী জনাইয়ের মুখুজ্যে বাড়িতে বিয়ের আসরে নাচছেন। খবর ‘শ্বেত নীল পীত রক্তবর্ণ ঝাড় লণ্ঠন ও দেওয়ালগিরি প্রভৃতি নানাবিধ রোশনাই হইয়া বিবাহের পূর্ব্ব চারি দিবস নাচ ও গান হইল। তাহাতে বড় মিয়া ও ছোট মিয়া ও নেকী ও কাশ্মীরি প্রভৃতি প্রধান প্রধান গায়ক আর আর অনেক তরফাও আসিয়াছিল এ সকল গায়করা যে মজলিসে আইসে সে মজলিস সুখদায়ক হয়।’ পরের বছর রামমোহন রায়ের বাগানবাড়িতেও নেচেছে নিকী। সে বছরই (১৮২৩) দেখি, মতিলাল মল্লিকের শুঁড়োর বাগানবাড়িতে এক আসরে নাচছে বেগম জান এবং হিঙ্গুল নামে দুই নর্তকী। ১৮৪০-এ দ্বারকানাথ ঠাকুর তার বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে যে বিরাট ভোজ-সভার আয়োজন করেন, সেখানেও ‘বায়ীর নাচ হইয়াছিল তাহাতে কলিকাতার মধ্যে প্রাপ্য প্রধান নর্তকী ও প্রধান বাদ্যকার তাহাদের নৃত্যগীত বাদ্যাদির দ্বারা আমোদ জন্মাইলেন।’ কলকাতার বাবুদের আমোদ তখন বাইজির নাচ চাই-ই চাই। এমন কী, পূজা পার্বণেও। সাহেব-মেমদের আপ্যায়নেরও এক উপকরণ ছিল এই বাইজি। পুজোয় বাইজির নাচ নিয়ে সেকালে কেউ কেউ আপত্তি তুলেছেন। কিন্তু নেশা সহসা কাটতে চায়নি। নবাব বাদশাহর মেজাজ তখন কলকাতার নব-ধনিকদের। দরবারি নর্তকীদের বলতে গেলে, তাঁরাই তখন প্রধান পৃষ্ঠপোষক। দিল্লি লখনউ কিংবা ঢাকা মুর্শিদাবাদে তখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। পতঙ্গের মতো বাইজিরা তখন ছুটে আসছে নয়া-শহর কলকাতার দিকে। তার জলুস দূর থেকেও নজর কেড়ে নেয়। কিছু কিছু বাবু শুধু নাচ নয়, বাইজিদেরও ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৩৪ সালে ‘সমাচার দর্পণ’-এ এক পত্রলেখকের বক্তব্য, ‘এতন্নবস্থ কোন ব্যক্তি নান্নিজান ও সুপনজান ও নিক্কি প্রভৃতি জবনী নর্তকীদিগের সহিত তাবৎকাল নানারূপ আহার ও ব্যবহার করিয়া এবং মির্জাজান তপসের সহিত দ্বাদশ বৎসরের অধিককাল একান্নভুক্ত থাকিয়া নগর কীৰ্ত্তনোপলক্ষে পুনরায় হিন্দুদিগের মধ্যে গৃহীত হন।’ তাঁর জিজ্ঞাসা: এর কি কোনও সদুত্তর আছে?
লেখালেখির ফলে পরদিনই বিধান কিছু হয়নি। আরও অনেক আমোদের মতো বাইজির নূপুর নিক্কনও যদি পরবর্তী কালে স্তব্ধ হয়ে গিয়ে থাকে, তবে তার কৃতিত্ব কালের। পরিবর্তিত রুচির। আর্থিক অনটন, জ্ঞানের উন্মেষের ফলে পরিবর্তিত রুচিও ছিল তার পিছনে কারণ। হুতোমের কালেও কিন্তু দেখি, পুজোর আসরে চলছে বাইজির নৃত্য। তিনি লিখছেন:
‘বাইনাচের মজলিশ চূড়ান্ত সাজানো হয়েচে, গোপাল মল্লিকের বেজেন্দরের কুকুরের বের মজলিশ এর কাছে কোথায় লাগে? চক্বাজারের প্যালানাথবাবু, বাই মহলের ডাইরেকটরী, সুতরাং বাই ও খ্যামটা নাচের সমুদয় ভার তাঁকেই দেওয়া হয়েছিল। সহরের নন্নী মুন্নী, খুন্নী ও সন্নী প্রভৃতি ডিগ্রী মেডেল ও সার্টিফিকেটওয়ালা বড় বড় বাইয়েরা গোলাপ, শাস, বিদু, খুদু, মণি ও চুণী প্রভৃতি খ্যামটাওয়ালারা নিজ নিজ তোবড়া তুবড়ি সঙ্গে করে আসতে লাগলেন—প্যালানাথবাবু সকলকে মা গোঁসাইয়ের মত সমাদরে রিসিভ কচ্চেন—তাঁদেরও গরবে মাটিতে পা পড়ছে না। প্যালানাথবাবুর হীরের ওয়াচ গার্ডে ঝোলান আধুলি মত মেকাবি হান্টিঙের কাটা নটা পেরিয়েচে। মজলিশে বাতির আলো শরদের জ্যোৎস্নাকেও ঠাট্টা কচ্চে, সারঙ্গের কোঁয়া কোঁয়া ও তবলার মন্দিরের রুনঝুন তালে ‘আর সাঁইয়া মোরারে তেরি মেরো জানিরে’ গানের সঙ্গে একতরফা মজলিশ রেখেচে।’ ইত্যাদি। উল্লেখ্য: বাইজির গান ছিল মূলত হিন্দি-উর্দু মিশ্রিত ভাষায় রচিত গজল ও ঠুংরি।
এসব নবাবি আমলের জের। পাশাপাশি উচ্চাঙ্গ সংগীতের চর্চাও কিছু কিছু চলছিল। চলছিল বৈষ্ণব কীর্তন এবং শাক্ত ভক্তিগীতিও। এবং রামমোহনের পরে ব্রহ্মসংগীতও। ব্রহ্মসংগীত শুধু ‘সমাজ’ অনুরাগীদের মধ্যে আবদ্ধ ছিল এমন নয়, অন্যরাও গাইতেন। আউল বাউলের গান যেমন শুধু সাধকেরাই নন, অন্যরাও গেয়ে থাকেন। সুতরাং কলির শহর বলে কলকাতা অষ্টপ্রহর কেবল হাসির হররা আর আমোদের গররা—একথা বলা যাবে না। তবে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলেরই ঝোঁক কবি, আখড়াই, হাফ আখড়াইয়ের দিকে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ, কর্তাভজা বা ওই ধরনের কিছু কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী থাকলেও অষ্টাদশ শতক-উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাউলের উদার সংগীত এই কলির শহরের আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়ায়নি। বাউল সম্প্রদায়ের মতো তাঁদের সাধন-গীতিরও উন্মেষ সপ্তদশ শতকে। তার মনোভূমি রচনা করেছে যদি বৈষ্ণব ভাবমণ্ডল তবে অন্যতম বিকাশের পিছনে আর এক প্রেরণা ছিল প্রসারমান সুফিবাদ।
কবি গান, আগেই বলা হয়েছে, গ্রামীণ সমাজের অবদান। কিন্তু উনবিংশ শতকের গোড়াতেই দেখা যায়, শহরে অনায়াসে ছাড়পত্র পেয়ে গেছে গ্রাম বাংলার এই গান। কবির ‘কাটান জবাব’ ‘চাপান উতোর’-এ রীতিমত উত্তেজনার উপলক্ষ খুঁজে পেয়েছে কলকাতার সমাজ। এমনকী আখড়াই হাফ-আখড়াইও যেন আসরচ্যুত করতে পারছে না বাসু-নৃসিংহ, হরু ঠাকুর, নিত্যানন্দ বৈরাগী, রামবসু, লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস, কেষ্টামুচি, গোঁজলা গুঁই, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, কিংবা লালু নন্দলালের দলকে। তাঁদের চাপান-উতোর রীতিমত যুদ্ধের উত্তেজনা। যেন ‘কবিতা সংগীত সংগ্রাম’ নয়, সত্যিকারের লড়াই। তাঁদের খেউড়ে শ্রোতার দল আদিরসে ডুবুডুবু।
কবিগানের গায়কি ছিল: প্রথমে সপ্তমী বা ঠাকুরুন বা ভবানীবিষয়ক পদ, দ্বিতীয়ত সখী সংবাদ, তৃতীয়ত বিরহ এবং চতুর্থ খেউড়। ঈশ্বর গুপ্ত, অর্থাৎ আমাদের কবিদের প্রথম জীবনীকারের মতে ‘প্রথমে চিতেন, পরে মহড়া, সর্বশেষ অন্তরা গাইতে হয়, কিন্তু লিখনকালে অগ্রে মহড়া, পরে চিতেন, শেষে অন্তরা লিখিতে হইবে।’
কিন্তু সাধারণ শ্রোতার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় যেন খেউড়। কেউ কেউ বলেন, কৃষ্ণনগর বা নবদ্বীপ-শান্তিপুরের শিক্ষিত জনমণ্ডলীরই অবদান এই খেড়ু বা খেউড়। কেউ কেউ বলেন, কৃষ্ণনগর বা নবদ্বীপ-শান্তিপুরের শিক্ষিত জনমণ্ডলীর এই খেড় বা খেউড়। কবিগানের উৎপত্তি যদি ঝুমুর থেকে, তবে কবিতে খেউড় এসেছে নবদ্বীপ-শান্তিপুরের খেড়ু গান থেকেই। স্বদেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল সুন্দরকে প্রলোভন দেখিয়েছিল বিদ্যা, পুজোর সময় সে নতুন গান শোনাবে তাকে, ‘নদে শান্তিপুর হৈতে খেঁড়ু আনাইব। নতুন নতুন ঠাটে খেঁড়ু শোনাইব।’ খেউড়ের জন্য শ্রোতারা কেমন অধৈর্য হয়ে উঠত, সে-কাহিনী শুনিয়েছেন ঈশ্বর গুপ্ত। নিত্যানন্দ দাস বৈরাগী ‘সখীসংবাদ ও বিরহ গাহিয়া আসর অত্যন্ত জমাট করিয়াছেন, তাবৎ ভদ্রেই মুগ্ধ হইয়া শুনিতেছেন ও পুনঃ পুনঃ বিরহ গাহিতেই অনুরোধ করিতেছেন, তাহার ভাবার্থ গ্রহণে অক্ষম হইয়া ছোট লোকেরা আসরে দাঁড়াইয়া চিৎকার পূর্ব্বক কহিল, ‘হ্যাদ্ দেখ লেতাই, ফ্যার ঝদি কালকুকিলির গান ধল্লি, তো, দোঁ, খাড় গা’ নিতাই তচ্ছবনে মোটা ভজনের খেউড় ধরিয়া তাহারদিগের অস্থির চিত্তকে সুস্থির করিলেন।’
ঈশ্বর গুপ্ত এখানে ‘ছোটলোকের’ রুচি-বিকৃতির কথা বলেছেন। অন্যত্র, হরু ঠাকুর সম্পর্কে আলোচনা করতে বসে তিনি কিন্তু ‘বাবুদের’ বিকারের কথাও বলতে ভোলেননি। হরুর খেউড় এবং লহর বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘দুঃখের বিষয় এই যে, (খেউড়) অতি জঘন্য, অতি ঘৃণিত, অশ্রাব্য, অবাচ্য শব্দে পুরিত হইত, এ কারণ তাহা কোনও প্রকারেই প্রকাশ করা বিধেয় নহে। যখন তাহার নাম করিতে হইলেই রাম বলিয়া ঘাম নির্গত করিতে হয়, ভূত প্রেত প্রভৃতি কর্ণে হস্ত দিয়া কোথায় প্রস্থান করে তখন আমরা কি প্রকারে তাহা পত্রস্থ করিতে পারি। পূর্বেকার অতি প্রধান প্রধান মহিমান্বিত অর্থাৎ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় বাহাদুর, নবকৃষ্ণ বাহাদুর প্রভৃতি উচ্চ লোকেরা এবদ্ভূত সকার বকারে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইতেন, আমোদের পরিসীমা থাকিত না। জ্ঞাতি, কুটম্ব, স্বজন, সজ্জন, পরিজনে পরিবেষ্টিত হইয়া গদগদ চিত্তে শ্রবণ করিতেন। ইহার বাহুল্য ব্যাখ্যা আর কি করিব?’
সত্য বলতে কী, যদি কোনও দিন, বাঙালির যৌনতার ইতিহাস কেউ লিখতে বসেন, তবে অষ্টাদশ-উনিশ শতকের শহুরে বাঙালির এই রুচি বিকার থেকে তিনি প্রভূত উপকরণ খুঁজে পাবেন। নীরদচন্দ্র চৌধুরী তাঁর ‘বাঙালী জীবনে রমণী’ বইতে কিছু ইঙ্গিত মাত্র দিয়েছেন, বাঙালির জনপ্রিয় গানগুলোতেও কিন্তু লুকিয়ে আছে অনেক তথ্য।
সে কথা থাক। কবির কথায়ই ফিরি। কলকাতায় তখন কবি আর কবি। পেশাদার কবিওয়ালা, ‘শকের কবি’, ‘দাঁড়া কবি’, মেয়ে কবি। ‘দাঁড়া কবি’ বলা হত নাকি তাঁদের, যাঁরা দীর্ঘ দিন চর্চা করে, বিশুদ্ধ রাগ-রাগিণী অনুসরণ করে বাঁধা গীত গাইতেন। এসব নিয়ে একালেও অনেক মূল্যবান আলোচনা করেছেন সুশীলকুমার দে, সুকুমার সেন, ভবতোষ দত্ত, রাজ্যেশ্বর মিত্র, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রমাকান্ত চক্রবর্তী। এঁদের ঘনিষ্ঠ গবেষণার ফলে অষ্টাদশ উনিশ শতকের বাংলা তথা কলকাতার ‘সুর লোক’ আজ অনেকাংশে শ্রুতিগোচর। কেউ কেউ নয়, কলকাতায় নাকি অনেকেই তখন কবি। ‘সমাচার দর্পণ’-এ অভিযোগ করছেন জনৈক ‘ভবঘুরে মুচি ডোম কবিওয়ালা’: সম্প্রতি আমারদিগের অন্ন কতকগুলি বিশিষ্ট সন্তানেরা মারিয়াছেন যেহেতুন ইহারা শকের কবির দল করিয়া বিনামূল্যে অধিক পরিশ্রম করিয়া নৃত্যগীতাদি করেন। সুতরাং, আমারদিগের লোকেরা আর ডাকে না।’ আর একবার তাদের ওপর নাকি ‘নেড়ী বৈষ্ণবীরা’ দৌরাত্ম করেছিল। সে বিপদ কেটেছে। তাদের জিজ্ঞাসা—‘এক্ষণে এই সৌখিন নেড়ারদিগের দায় হইতে কীসে রক্ষা পাই?’
পরবর্তী কালের বিচারকরা অনেকেই কবিগানকে অনুমোদন করেননি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘এক দিন হঠাৎ গোধূলির সময়ে যেমন পতঙ্গে আকাশ ছাইয়া যায়, মধ্যাহ্নের আলোকেও তাহাদিগকে দেখা যায় না এবং অন্ধকার ঘনীভূত হইবার পূর্বেই তাহারা অদৃশ্য হইয়া যায়, এই কবির গানও সেইরূপ এক সময়ে বঙ্গসাহিত্যের স্বল্পক্ষণস্থায়ী গোধূলির আকাশে অকস্মাৎ দেখা দিয়াছিল।’ তুলনায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বরং কিছুটা সহনশীল। তাঁর মন্তব্য—‘তাঁহাদের ক্ষমতা ছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু সেই ঘোর অত্যাচার, অরাজক এবং বিশৃঙ্খলার সময়ে তাঁহাদের প্রতিভা বিকাশ না হইয়া ঐরূপেই বাহির হইতেছিল।’
কবিগানের মূল্যায়নের সুযোগ এখানে নেই। তবে রবীন্দ্রনাথ যে ‘গোধূলি’কে বলেছেন ‘স্বল্পক্ষণস্থায়ী’, তা কিন্তু খুব হ্রস্ব ছিল না। তা ছাড়া, শহরের সংগীতরুচিতে কবিগানের প্রভাবও রীতিমত দীর্ঘস্থায়ী। কেননা, কলকাতা ‘নগর’ হলেও, নাগরিক জীবনে বৈপরীত্যের অভাব ছিল না। এ শহরের নব্য ধনিকদের এক পা যদি নগরে অন্য পা তবে গ্রামে। ফলে তাঁদের জীবনাচারে একদিকে যদি ইংরাজি আচারের ছায়াপাত, অন্যদিকে তবে সেই গ্রাম্যতা। আধুনিকতার প্রবল প্রবাহে গা ভাসাতে গিয়েও তাঁরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন পায়ের তলায় গ্রাম-সংস্কৃতির সেই চেনাজানা পুরানো মাটি খুঁজে পেয়ে। ইংরাজি শিক্ষা, ব্রহ্ম উপাসনা, নব্যতন্ত্রের মধ্যেই অতএব জয়ধ্বনি তুলেছেন কবির নামে। ঢুলু ঢুলু চোখে রাতের পর রাত কাটিয়েছেন আখড়াই কিংবা হাফ-আখড়াইয়ের আসরে। ‘বল ননদী, গুণের ভাই, ওরে প্রাণ প্রাণরে শুনবো সমাচার, ওরে প্রাণ, প্রাণরে।’ হয়তো মহড়ার পর সওয়ারি চলছে তখন ‘ধন্য তোমার বোন যুবতী, একবার কল্লে অজাপতি, প্রাণরে এবার কে হে আসিবে, হোলো নতুন বোনাই প্রাণ তোমার।’
কলকাতায় তখন চলতি কথা—‘মানিয়া বুলবুল আখড়াই গান, খোষ পোষাকী যশমী দান, আড়িঘুড়ি কানন ভোজন, এই নবধা বাবুর লক্ষণ।’ সুতরাং, আখড়াই না বসাতে পারলে বাবুয়ানায় পাস-মার্ক পাওয়া ভার। আখড়াই গানের আদি কোথায়, বৈষ্ণবদের আখড়ায় না আর কোথাও তা নিয়ে এখানে ‘গবেষণা’ ফেঁদে বসার দরকার নেই। ঘটনা এই, আখড়াই যখন আখড়াই হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে, তখন তাতে বৈষ্ণবভাব প্রায় নেই বললেই চলে। রাধাকৃষ্ণের লীলার চেয়েও প্রবণতা তার মানবলীলার দিকে। ননদী দেওরা—আদিরসাত্মক কথাবার্তা সবাইকে নিয়েই।
আখড়াই যখন কলকাতায় পৌঁছেছে, তখন তা রীতিমত পুরানো গান। ঈশ্বর গুপ্তের মতে শান্তিপুরের ভদ্রজনদের সৃষ্টি এই গানের বয়স ’১৫০ শত বৎসরের ন্যূন নহে।’ কেউ কেউ অবশ্য বলেন, আখড়াইয়ের জন্মস্থান শান্তিপুর নয়, যশোর। সেখান থেকেই শান্তিপুরে তার আমদানি। তারপর শান্তিপুর থেকে হুগলি চুঁচুড়া হয়ে অবশেষে কলকাতায়। আদি আখড়াইয়ে ছিল নাকি শুধু খেউড় আর প্রভাতি। খেউড়ের সর্বস্ব—আদিরস। প্রভাতির বিষয়—নায়কের অনুপস্থিতিতে নিশিযাপন করে ভোরে নায়িকার বিলাপ। চুঁচুড়ায় পৌঁছে আখড়াইয়ে যুক্ত হল ভবানী বিষয়ক পদও। আর, নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র। ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন, ‘আখড়াই তিন গানের ভিন্ন তিনখানি সাজ, সে সাজের ভিতর যে কত সাজ, তাহার কি ব্যাখ্যা করিব? যখন বাজে তখন বাজে লোকের বুঝিবার সাধ্য কি?’ চুঁচুড়ার দল নাকি বাইশ রকম বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতেন। মায় হাঁড়ি কলসি পর্যন্ত। ওঁরা মাঝে মাঝে হানা দিতেন কলকাতায়, কাশীনাথ নামে এক অবাঙালি ধনীর বাগানবাড়িতে। সেই থেকে ধীরে ধীরে নেশা ধরে গেল শহরের।
এসব অষ্টাদশ শতকের শেষ দিককার কথা। কলকাতায় গড়ে উঠল একাধিক পেশাদার আখড়াই দল। ওঁদের গানের লড়াই চলত হালসিবাগানে। ‘কবির’ এ-গানেরও পেট্রন ‘হঠাৎ-অবতার’ বা নব্য ধনীরা। শহরে এ গানের সবচেয়ে স্ফূর্তি রামনিধি গুপ্তের মাতুল অথবা মাতুল পুত্র কলুই চন্দ্র সেনের চেষ্টায়। তার পৃষ্ঠপোষক নবকৃষ্ণ। এই কলুইচন্দ্ৰই আখড়াইকে পরিণত করেন সত্যিকারের বৈঠকী গানে। একদিকে আখড়াইকে আনা হল শাস্ত্রীয় রাগতালের শৃঙ্খলায়, অন্যদিকে নানা ধরনের বাদ্যের সমন্বয়ে রচিত হল বাদকবৃন্দ। আখড়াইয়ের ‘সাজ বাজানো’ অনেকটা ইউরোপীয় কনসার্টের মতো। বোঝা যায়, শুধু বাবুদের বাড়ির গড়ন আর বাগানের সজ্জা কিংবা কোনও কোনও আচারেই নয়, ইংরেজ-টোলার মৃদুমন্দ হাওয়া তাদের গানের আসরেও।
আখড়াইও গানের লড়াই। তবে কবিগানের মতো চাপান উতোর চলত না আখড়াইয়ের আসরে। বৈঠকে হাজির থাকতেন দুই দলের গায়ক এবং বাদ্যকর। প্রথম গান ভবানী বিষয়ক। গান শেষ হলে কনসার্ট। দ্বিতীয় পর্যায়ে খেউড়। মহড়া। চিতেন। অন্তরা। আবার বাদ্যবৃন্দ। তৃতীয় পর্যায়ে প্রভৃতি। ‘যামিনী কামিনী বেশ হয় কি কখন।’ শেষে আবার বাদ্য। উত্তর-প্রত্যুত্তর নয়, দুই দলে লড়াই চলত গান আর বাদ্যভাণ্ডের জোরে। রসিকদের বিচারে বিজয়ীরা পতাকা উড়িয়ে প্রভাতি গাইতে গাইতে ফিরে যেতেন ঘরে।
দেখতে দেখতে শহরে আবির্ভূত হতে লাগল শৌখিন আখড়াইয়ের দল। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়ি, জোড়াসাঁকোর সিংহবাড়ি, গরাণহাটার বসাকরা—অনেকেই তাঁদের পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু সবচেয়ে সেরা ছিল নাকি নিধুবাবুর দল। ছাপরা থেকে কলকাতায় ফিরে এসে তিনিও মাতামাতি শুরু করেছিলেন এই আখড়াই নিয়েই। তাঁর লেখা গান, তাঁরই দেওয়া সুরে গাইতেন প্রিয় শিষ্য মোহনচাঁদ বসু। ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন, বাঙ্গালীর মধ্যে এই বঙ্গদেশে তাঁহার ন্যায় বাঙ্গলা গাহনা বিষয়ে ইদানীং সর্বশ্রেষ্ঠ যোগ্যব্যক্তি দ্বিতীয় আর কেহই জন্মগ্রহণ করেন নাই।…মোহন চাঁদের স্বর শ্রবণে আহা, আহা শব্দে অশ্রুপাত না করিয়াছেন এমন ব্যক্তি কেহই নাই।’
নিধুবাবুর শিষ্য এই মোহনচাঁদই আখড়াইকে ভেঙে রচনা করেন হাফ-আখড়াই। অবশ্য হাফ-আখড়াইয়ের অন্য দাবিদারও ছিলেন। যথা: জোড়াসাঁকোর রামচাঁদ মুখোপাধ্যায় এবং পাথুরেঘাটার রামলোচন বসাক। কিন্তু ঈশ্বর গুপ্ত বলেন, ‘কিন্তু এ কথা কথাই নহে, তাহাকে কখনই হাফ-আখড়াই বলা যাইতে পারে না, তাঁহারা ‘পেশাদারি দাঁড়া-কবির সুরে’ গান করিয়া কেবল বসিয়া গাহিতেন।’
হাফ-আখড়াই সৃষ্টির কৃতিত্ব তাঁর মতে পুরোপুরি মোহনচাঁদের। যুগের প্রয়োজনেই তাঁকে তা করতে হয়েছে। কলুইচন্দ্র সেন আর রামনিধি গুপ্তের চেষ্টায় আখড়াই গান হিসাবে রীতিমত উচ্চাঙ্গের হয়ে উঠেছিল। অবশ্য ভাবে নয়, গায়কিতে। তার গায়কিপদ্ধতি বেশ জটিল। রপ্ত করতে হলে দীর্ঘ অনুশীলন চাই। তা ছাড়া চাই যোগ্য বাদকের দল। কলকাতা তখন হট্টমেলা। সেখানে এ গানের চর্চার সুযোগ কম। পাঁচমিশেলি শ্রোতাদের মন ভরাতে হলে চাই উত্তেজনার খোরাক। মোহনচাঁদ অতএব কবি আর আখড়াই মিশিয়ে তৈরি করলেন হাফ-আখড়াই। দাঁড়া কবির স্টাইলে অতঃপর আখড়াইয়েও এল চাপান-উতোর।
আখড়াই চালু ছিল উনিশ শতকের তৃতীয় দশক পর্যন্ত। আর হাফ-আখড়াই সপ্তম দশক পর্যন্ত। নিধুবাবুর মৃত্যু ১৮৩৯ সালে। আখড়াই তখন পুরোপুরি লুপ্ত। হাফ-আখড়াই অবশ্য সত্তর দশকের পরও টিকে ছিল কিছু দিন। ১৮৫৬ সালে সরস্বতী পুজো উপলক্ষে হাফ-আখড়াইয়ের এক প্রসিদ্ধ বৈঠক মদনমোহন মিত্রের বাড়িতে। সেখানে গানের বিষয় ছিল ‘বিধবা বিবাহ।’ একদল গায়ক বিধবা-বিবাহের পক্ষে, অন্যদল বিপক্ষে। লক্ষণীয়, কবিগানে যেমন কখনও সরাসরি সামাজিক অবস্থা বর্ণিত হয়েছে, ‘রূপচাঁদ পক্ষীর’ গানে বন্দিত অথবা বিবৃত হয়েছে নগরের জীবনাচার, দাশু রায়ের মতো পাঁচালিকার গাইতে বাধ্য হয়েছেন কালের পাঁচালি৷ তেমনই হাফআখড়াইয়ের মতো বৈঠকী গানেও হানা দিয়েছে সমকালের বিতর্ক। মোহনচাঁদের হাফ-আখড়াই সম্পর্কে ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘যৎকালে (মোহনচাঁদ) ষড়বাজারস্থ শ্ৰীযুত বাবু রামসেবক মল্লিকের ভবনে শীতকালে এক শনিবারের রাত্রিতে গাহনা করিলেন, বোধহয় তৎকালে প্রশংসার শব্দে বাটীর থাম পর্যন্ত কাঁপিয়াছিল।’ হুতোমের দেওয়া শকের দল বনাম ধোপাপুকুরের দলের হাফ-আখড়াই আসরের বর্ণনাটিও শোনার মতোই। বর্ণনাটি অন্ত-পর্বের।
‘তোপ পড়ে গিয়েছে, পূর্বদিক ফরসা হয়েছে, ফুরফুরে হাওয়া উঠেছে—ধোপাপুকুরের দলেরা আসর নিয়ে খেউড় ধল্লেন। গোঁড়াদের ‘সাবাস’। ‘বাহবা’। ‘শোভান্তরী’। ‘জিতা রও’। দিতে দিতে গলা চিরে গ্যালো, এরই তামাশা দেখতে যেন সূৰ্য্যদেব তাড়াতাড়ি উদয় হলেন। বাঙালিরা আজো এমন কুৎসিত আমোদে মত্ত হন বলেই যেন চাঁদ ভদ্রসমাজে মুখ দেখাতে লজ্জিত হলেন। কুমুদিনী মাতা হেঁট কল্লেন। পাখিরা ছি৷ ছি। করে চেঁচিয়ে উঠল। পদ্মিনী পাঁকের মধ্যে থেকে হাসতে লাগলেন।…’
এই উপহাস থেকে উনিশ শতকের কলকাতাকে যিনি রক্ষা করেছিলেন, তিনি রামনিধি গুপ্ত। সেদিনের কলকাতায় রঙ-বেরঙের রকমারি গান চালু হয়েছিল। কবি, দাঁড়া কবি, আখড়াই, হাফ-আখড়াই, পক্ষীর গান, মধুকানের ঢপ কীর্তন, যাত্রা সংগীত, থিয়েটারের গান, বাগানবাড়ির গান, আরও কত কী। সব গানের মধ্যেই রয়েছে যুগের খবর। রূপচাঁদের ভক্তিসংগীত, নীতিসংগীত এবং রঙ্গকৌতুকের গানে শহরের ভাবলোক বেশ স্পষ্ট। ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় যেমন, রূপচাঁদের গানেও তেমনই জীবন্ত হয়ে উঠেছে নগরচিত্র। ‘ধন্য ধন্য কলিকাতা শহর, স্বর্গের জ্যেষ্ঠ সহোদর। পশ্চিমে জাহ্নবীদেবী দক্ষিণে গঙ্গাসাগর’, দিয়ে তাঁর নগর বন্দনা শোনার মতো। তিনি যখন বলেন, ‘লেখাপড়া যাক গোল্লায়, যদি ডিনার পার্টিতে যায়, তথাচ শরীরে বল পায়/যদি দশজন ইংরেজে চেনে’, কিংবা ‘কি সাধ্য বন্ধ কর দেখি, এই দণ্ডে ফ্রেন্ডকে পত্র লিখি। চলে যাব চেপে পালকি কার সাধ্য আমায় ফেরায়’ তখন বুঝতে অসুবিধা নেই তাঁর ব্যঙ্গের লক্ষে কে বা কারা রূপচাঁদ তাঁর ‘হাফ ইংলিশ হাফ বাঙালি’। বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে গান লিখেও শহর কলকাতাকে আনন্দ দিয়েছেন বিস্তর। তাঁর ‘লেট মি গো ওরে দ্বারী। আই ভিজিট টু বংশীধারী’ অথবা ‘আমারে ফ্রড করে কালিয়া ড্যাম তুই কোথায় গেলি। আই অ্যাম ফর ইউ ভেরি সরি, গোলডেন বডি হল কালি’ জাতীয় গান শুনে বাবুরা নিশ্চয় হেসে গড়াগড়ি দিতেন। এবং সম্ভবত চিকের আড়ালে বসে বিবিরাও।
নিধুবাবু যা দিয়ে কলকাতাকে মজালেন, সে সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। তিনি বাঙালিকে উপহার দিলেন টপ্পা। টপ্পা নাকি আদিতে ছিল পাঞ্জাবের উটচালকদের গান। বাদশা মুহম্মদ শাহের আমলে জনৈক গোলাম নবী পাঞ্জাবি ভাষায় টপ্পাকে জনপ্রিয় করেন। গোলাম নবির এক প্রণয়িনী ছিল। নাম ছিল তাঁর শেরি। গোলাম নবির টপ্পায় তাই শেরির ভণিতা। নিধুবাবুর টপ্পা হিন্দি টপ্পার আদর্শে গড়া। টপ্পা ‘রঙিন’ গানও হয়ে উচ্চাঙ্গের গান, হিন্দুস্থানি সংগীতে ধ্রুপদ খেয়ালের পরেই তার ঠাঁই। বলা হয়, টপ্পা জানে লাফিয়ে চলা, সংক্ষেপে সারা। ধ্রুপদ খেয়ালের বিলম্বিত না হয়ে সংক্ষিপ্ত বলেই এ গান টপ্পা। ভাবের দিক থেকে এ গান প্রণয়মূলক, সেকালের ভাষার ‘প্রীতি গীতি।’
নিধুবাবু ওরফে রামনিধি গুপ্তের জন্ম হুগলিতে, ১৭৪১ সালে। কিন্তু তাঁর পারিবারিক নিবাস ছিল কলকাতায় কুমারটুলিতে। তিনি লেখাপড়া জানতেন। কিছু কিছু ইংরাজিও শিখেছিলেন। প্রথম যৌবনে কোম্পানির কাজ নিয়ে চলে যান ছাপরায়। আর সেখান থেকে শহরে ফিরে আসেন ১৭৯৪ সাল নাগাদ। প্রথমে তিনি গীতিকারের জীবন শুরু করেছিলেন আখড়াই গান রচনা করে। তাঁর রচিত সাত-আটখানা গানের সন্ধান আছে। সেখানে ‘দেওর’, ‘ননদীর’ ইঙ্গিতও বাদ নেই। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তিনি বুঝেছিলেন, শহরের রুচিতে পরিবর্তন ঘটছে, খেউড়ে আর চলবে না। তিনি হিন্দি টপ্পার আদর্শে সৃষ্টি করলেন বাংলা টপ্পা।
সম্ভবত যুগের তাগিদ ছাড়া ব্যক্তিমানবেরও তাগিদ ছিল এই নতুন সৃষ্টির পিছনে। পারিবারিক জীবনে নিধুবাবু অনেক বেদনা ভোগ করেছেন। পরপর দুই স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি তৃতীয় বার বিয়ে করেন পঞ্চাশ বছর বয়সে। শোনা যায়, তিনি মনে শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন শ্রীমতী নামে এক দেহপসারিণীর কাছে। অন্যদিকে তিনি একজন সাধকের কাছে দীক্ষাও নিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর কোনও বিশেষ পেট্রন ছিল না। কলকাতায় তিনি প্রথম গানের আড্ডা বসিয়েছিলেন শোভাবাজারের বটতলার কাছে এক আটচালায়, তারপর বাগবাজারের রসিকচাঁদ মল্লিকের আড্ডায়। সেখানেই তাঁকে ঘিরে নগরের মুগ্ধ রসিকদের ভিড়। ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন, ‘কি সাধন কি অধ্বন সর্বসাধারণ ব্যক্তিই নিধুবাবুকে ‘বাবু’ শব্দে সম্বোধন করিতেন। বাবুর বাটী, বাবুর সুর, বাবুর গীত, বাবু এলেন, বাবু গেলেন ইত্যাদি।…যেমন হিন্দুস্থানে ‘সরির টপ্পা’ তেমন বঙ্গদেশে ‘নিধুর টপ্পা’, অনেকেই ‘নিধু নিধু’ কহেন, কিন্তু নিধু শব্দটি কি, অর্থাৎ এই নিধু কি গীতের নাম, কি সুরের নাম, কি রাগের নাম, কি মানুষের নাম, কি, কি?’
এই সব কথা থেকেই বোঝা যায়, নিধুবাবু কতখানি জনপ্রিয় ছিলেন। দাশু রায়ের পাঁচালিতে আছে: ‘বেশ্যার আলয়ে যাও, বঁধু হে, নিধুর টপ্পা গাও।’ তিনি আরও গেয়েছেন, ‘যিনি মুখ দেখান না কুলের বধূ, তিনি সে রাত্রে গান নিধু, রসের ছড়ার খই ফুটে যার মুখে, ইত্যাদি। সে রাত্রে মানে বাসর-রাত্রে। দাশরথী ইঙ্গিতে বলতে চেয়েছেন, নিধুর গান আদিরসাত্মক। কিন্তু মোটেই তা নয়। টপ্পা গান মানেই আদিরসের গান নয়। টপ্পা ভালবাসার গান। শুধু নিধুবাবু কেন, অনেকেই টপ্পা গান রচনা করেছেন সেদিন: রাধামোহন সেন, কালী মির্জা, ছাতুবাবু, কালীদাস গাঙ্গুলি, ইংরাজিনবিশ কালীপ্রসাদ ঘোষ, এমনকী, স্বয়ং রামমোহন রায় পর্যন্ত। রামমোহন ‘রঙিন গানের’ ভক্ত ছিলেন। নিধুবাবু যেমন তাঁর অনুরোধে একটি ব্রহ্মসংগীত রচনা করেছিলেন, রামমোহনও নিজে তেমনই রচনা করেছেন বেশ কয়েকখানা রঙিন গান। নিধুবাবুর বাহাদুরি এই, তিনি গান রচনা করেই ক্ষান্ত হননি, তাতে সুর সংযোগ করেছেন, অনুশীলন করেছেন, অন্যদের দীক্ষিত এবং শিক্ষিত করেছেন।
নিধুবাবুর টপ্পা নিয়ে এখানে বিস্তৃত আলোচনার কোনও প্রয়োজন নেই। তাঁর ‘ধীরে ধীরে যায় দেখ চায় ফিরে ফিরে, কেমনে আমারে বল যাইতে ঘরে’, ‘পীরিতি পরম সুখ সেই সে জানে, বিরহে না বহে নীর যাহার নয়নে’—তেমন করে গাইলে এখনও সে সব কলি এই বিশ শতকের শ্রোতাদেরও অভিভূত করে। সত্যি বলতে কী, নিধুবাবু যুগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। পণ্ডিতদের মতে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের প্রতিনিধি যদি ভারতচন্দ্র, তবে দ্বিতীয়ার্ধের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি রামনিধি গুপ্ত। তিনি প্রথম সত্যকারের মধ্যবিত্ত কবি। অষ্টাদশ শতকের বাঙালির গান বলতে কবি, শাক্ত গান আর এই টপ্পা। সেই অগৌরবের যুগে গৌরবের ধন বলতে এগুলোই। শুধু টপ্পা রচনা করেছেন বলেই নয়, নিধুবাবুর টপ্পাতেই মিলেছে প্রথম লিরিকের পূর্বাভাস। একজন গবেষক লিখেছেন: ‘রেনাশাঁর মূলকথা যদি হয় আত্মআবিষ্কার তবে নিধুবাবুর গানেই কি তার ক্ষীণ সূচনা পাচ্ছি না?…নিধুবাবুর প্রেমের গানগুলির মধ্যে একটা অনুভূতি বেজে উঠল, সে অনুভূতি আপন অন্তরের রহস্য-রসে স্নিগ্ধ। ধর্ম এবং শাস্ত্রের বন্ধন থেকে তিনি প্রেমকে মুক্তি দিলেন। বৈষ্ণবীয় প্রেমের সঙ্গে এর যোগ নেই, শাস্ত্রের বিধি দিয়ে এ প্রেম নির্ধারিত নয়। ব্যক্তির প্রেমানুভূতির এক স্বাধীন বিকাশ ঘটল এই গানগুলিতে। ব্যক্তির রুদ্ধ হৃদয়দ্বারকে উন্মোচিত করে কবি সত্যই আত্মআবিষ্কার করলেন? আজকের গবেষক রবীন্দ্রনাথের কোনও কোনও গানেও খুঁজে পান অষ্টাদশ শতকের গীতিকার রামনিধি গুপ্তকে (মৃত্যু ১৮৩৯)। নিধুবাবু আমাদের কে, তারপরও নিশ্চয় আমাদের সেটা বুঝিয়ে বলতে হবে না। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, ‘ভালবাসিবে বলে ভালবাসিনে, আমার স্বভাব এই তোমার বই আর জানিনে। শ্রীমুখে মধুর হাসি, দেখতে বড় ভালবাসি, তাই দেখিবারে আসি, দেখা দিতে আসিনে’র মতো ভালবাসার গান তিনি রচনা করেছিলেন ‘শ্রীমতী’ নামে একজন বারবিলাসিনীকে ভালবেসে। রামবসু ও যজ্ঞেশ্বরী, অ্যান্টনি এবং বিধবা ব্রাহ্মণী, দাশু এবং আকাবাইয়ের অসামাজিক প্রেমের মতো নিধুবাবু এবং শ্রীমতীকে ঘিরেও নানা উপাখ্যান। সত্যি বটে, যুগের অন্যদের গানের মতোই নিধুর ভালবাসাও দেহাতীত নয়। সেটা সম্ভব ছিল না। বহুবিবাহের যুগে, স্ত্রী যখন ‘ভদ্রা’ বা চর্মপাত্র মাত্র, তখন সত্যকারের ভালবাসার গান রচিত হওয়ার সম্ভাবনা কোথায়? পুরুষের কণ্ঠেও বিরহ তখন বহুলাংশে অন্তঃসারশূন্য। ভালবাসা যদি বা মেলে, সে ঘরে নয়, কড়ির বিনিময়ে অন্য কোনও খানে, অথবা অশাস্ত্রীয় অসামাজিকতায়। কিন্তু নিধুবাবুর সাফল্য এখানেই যে, তারই মধ্যে প্রেমের বহুবর্ণ অভিজ্ঞতাকে তিনি রূপান্তরিত করতে পেরেছেন গানে। আর, ‘হৃদয়বৃত্তিকে এইভাবে স্বীকার করে নেওয়ার নামই মানবিকতা।’ নিধুবাবু সেই মানবিকতারই গীতিকার।
অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকের কলকাতা অতএব নিছক হট্টমেলার দেশ নয়।
একদিন আচমকা
আজ থেকে আশি বছর আগের কথা। ১৯১১ সাল। ভূ-ভারতময় তুমুল উত্তেজনা আলোড়ন। দিল্লিতে রাজকীয় দরবার বসেছে। সাগরপার থেকে ভারত-সম্রাট স্বয়ং পঞ্চম জর্জ এসে দেওয়ান-ই-খাস বসিয়েছেন দিল্লিতে। সঙ্গে রানি মেরি। ভারতের যেখানে যত রাজা-মহারাজা ছিলেন, রংবেরঙের পোশাক পরে সবাই সেখানে হাজির। গোঁফদাড়ি, পাগড়ি, তলোয়ার আর জমকালো পোশাকের সে এক আশ্চর্য প্রদর্শনী। সমবেত চার হাজার মানুষের প্রত্যেকেই যেন এক স্বতন্ত্র পৃথিবীর আগন্তুক, প্রত্যেকেই দর্শনীয়। ফাঁকে ফাঁকে শোভাযাত্রা, ব্যান্ড-বাদ্য, তোপধ্বনি, আর ‘গড সেভ দ্য কিং’। ভারতের তামাম বড়মানুষের মন দিল্লিতে। ডিসেম্বরের শীতেও দিল্লি সেবার রীতিমত গরম।
সেদিন ১১ ডিসেম্বর, সোমবার। দরবারের শেষ দিন। অতিথিরা ক্লান্ত। দেখে দেখে আর শুনে শুনে চোখ-কান অবসন্ন তবুও শিষ্টাচারে ত্রুটি থাকা সংগত নয়। বিশেষ দান-খয়রাত, খেলাত ইত্যাদির ফর্দটি শেষ দিনই ঘোষিত হওয়ার কথা। উৎকর্ণ শ্রোতার দল তারই অপেক্ষায়। টুকিটাকি অনুষ্ঠান শেষে সেই ব্রাহ্ম-মুহূর্ত এল। মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন গভর্নর জেনারেল। মহামান্য সম্রাটের নামে তিনি দু’হাতে ফিতে মেডেল ‘সর্দার বাহাদুর’ আর ‘রায়বাহাদুর’ ‘খান বাহাদুর’ ইত্যাদি খেতাব ছাড়লেন। কারও দেনা মুকুব হল, কেউ নয়া তালুক উপরি পেলেন, কেউ বা অন্য কিছু। দীর্ঘ তালিকা। পাঠ শেষে লাটবাহাদুর আপন আসনে ফিরলেন। আবার তোপধ্বনি, বাদ্য। হেরাল্ড সম্রাটের নামে তিনবার জয়ধ্বনি তুললেন। অ্যাম্পিথিয়েটার ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত। এবার সহকারী হেরান্ডের পালা। তিনি ধ্বনি তুললেন রানির নামে। এবারও দরবারের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত অবধি তরঙ্গায়িত জয়ধ্বনি। রাজদম্পতি সিংহাসন থেকে উঠে শোভাযাত্রা সহকারে মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন। পরক্ষণেই আবার ফিরে এলেন। হেরাল্ড নিঃশব্দে বিদায় নিলেন। আবার গীতবাদ্য। রকম দেখে দর্শকদের মনে হল, সভাভঙ্গের সময় আগত। এবার সম্রাট উঠে দাঁড়ালেই তাঁদেরও ছুটি। ক’ মিনিট পরে সম্রাট সত্যিই উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে রানি মেরিও। কিন্তু আশ্চর্য, তিনি সামনের দিকে পা বাড়ালেন না। হাত বাড়িয়ে গভর্নর জেনারেলের কাছ থেকে একখানা কাগজ নিয়ে ধীরে স্বরে পড়তে লাগলেন:
‘We are pleased to announce to our people that on the advice of our Ministers, tendered after consultation with our Governor General in Council, we have decided upon the transfer of the seat of the Government of India from Calcutta to the ancient capital of Delhi…’
অর্থাৎ, আমরা স্থির করেছি, অতঃপর ভারতের রাজধানী হবে কলকাতা নয়, দিল্লি। সেই সঙ্গে মহামান্য ভারত-সম্রাট আরও ঘোষণা করলেন, অচিরেই বাংলা প্রেসিডেন্সির জন্য একজন গভর্নরের ব্যবস্থা করা হবে, নতুন শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিহার, ছোটনাগপুর এবং ওড়িশা একজন লেঃ গভর্নরের অধীন হবে এবং অসম শাসন করবেন একজন চিফ কমিশনার। অর্থাৎ ক’ বছর আগে কার্জন মানচিত্রে যেসব আঁকিবুকি করেছিলেন, তাও তামাদি হয়ে গেল। যুগপৎ যুগল চাঞ্চল্য। শ্রোতারা পুরো মর্ম বুঝতে না বুঝতেই মাস্টার অব দ্য সেরিমনিজ এগিয়ে এসে ঘোষণা করলেন, দরবার ভঙ্গ হল। রাজদম্পতি শোভাযাত্রা সহকারে সভাকক্ষ ত্যাগ করলেন। সেই সঙ্গেই হাতে হাতে মুদ্রিত রাজকীয় ঘোষণা বিতরিত হল। গেজেট এবং আনুষঙ্গিক কাগজপত্রও প্রকাশিত হয়ে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে সব শেষ। দরবার বিস্মিত, চমকিত। প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকের ভাষায় যেন ‘বম্ব-শেল’।
কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। রাজার ইচ্ছায় রাজধানী। রাজধানী বদল অতএব ইতিহাসের সব সময় উল্লেখযোগ্য খবর নয়। শহুরে ভাড়াটের ঠিকানা-বদলের মতো শৌখিন রাজারা হামেশাই তা করেছেন। রোম থেকে কনস্তান্তিনোপল, মস্কো থেকে পিটসবুর্গ, দিল্লি থেকে ফতেপুরসিক্রি বা আগ্রা, কিংবা প্যারিস থেকে ভার্সাই ইতিহাসের পাতায় নয়া নয়া রাজা রানি, আর নব নব রাজধানীর অনেক খবর। এমনকী, হঠাৎ রাতভোরে দিল্লি থেকে সুদূর দাক্ষিণাত্যে দেবগিরি-যাত্রার ফরমানও অজ্ঞাত নয়। বাদশা যখন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তাঁর সব হুকুমই শিরোধার্য। ‘কলকাতা থেকে দিল্লি’ তবুও ইতিহাসে একটি চাঞ্চল্যকর উপাখ্যান। কেননা, রাজধানী বদলের এই কাহিনী আর্থার বা ক্যানিউটের আমলের গল্প নয়, সেদিনের ঘটনা। তা ছাড়া, ঘোষণাটি যদিও ‘হিজ মোস্ট একসেলেন্ট ম্যাজেস্টি জর্জ দ্য ফিফথ বাই দ্য গ্রেস অব গড কিং অব দ্য ইউনাইটেড কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ার্ল্যান্ড অ্যান্ড অব দি ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন বিয়ন্ড দ্য সিজ, ডিফেন্ডার অব ফেথ এম্পায়ার অব ইন্ডিয়ার’ মুখ থেকে নির্গত, তাহলেও দেশময় সেদিন উত্তেজনা। কারণ, দেশে শুধু রাজা নয়, প্রজাও ছিল। মহম্মদ তুঘলকের আমলের নম্ৰ-বশ্য প্রজা নয়, বিশ শতকের দুর্বিনীত মানুষ। তারা কথা বলতে জানত।
বিশ শতকে রাজধানী বদল চলতি লোকাচার অনুযায়ী একেবারেই অসিদ্ধ কিংবা প্রজামুখে দুষ্কর্ম হিসেবে গণ্য—এমন নয়। নানকিং থেকে বেজিং কিংবা করাচি থেকে ইসলামাবাদ একালেও অবশ্যই সম্ভব। জনতার সম্মতি আদায় করতে জানলে কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু কলকাতা থেকে দিল্লির সিদ্ধান্তটি মোটেই সে সড়ক ধরে এগোয়নি। সে যেন লালদিঘি-পারে হঠাৎ ভূমিকম্প, কলকাতার মাথায় আচমকা বজ্রপাত।
‘একই চমক কলকাতায়। পরের দিন কাগজ খুলে রাজধানী কলকাতা যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। কী করে এমন ঘটনা সম্ভব। এত বড় শহর, হাজার হাজার রাজকর্মচারী, রীতিমত বড় কাউন্সিল। তা ছাড়া লাট ভবনে নিত্য আনাগোনা, অথচ কাকপক্ষীটিও জানতে পারল না—এমন মন্ত্রগুপ্তি এ যুগে কী করে সম্ভব হল? তবুও অবিশ্বাসের উপায় নেই। সামনেই মুদ্রিত রাজকীয় ঘোষণা। যেন বাচ্চা ছেলের হাতের বেলুনটি নিয়ে, ক্রীড়াচ্ছলে কেউ হঠাৎ আলপিনে ফুটো করে দিল। শহর কলকাতা বিমূঢ়, বিস্মিত, ক্রুদ্ধ। দুশো বছরের গৌরব, এই সাজানো ট্যাংক স্কোয়ার, এই ক্লাইভ স্ট্রিট, রাজভবন নিমেষে সব তছনছ হয়ে গেল। চোখ ঠেলে জল আসে, অথচ কান্নার উপায় নেই। সামনেই রাজকীয় অতিথিদের আগমনের ধার্য দিনক্ষণ, শহরে তার প্রস্তুতি চলছে। কলকাতা ভেবে পাচ্ছে না, এই অবিচারের প্রতিকার কী।
পরের দিন খবরের কাগজগুলোতে প্রকাশিত হল গভর্নর জেনারেল আর হোম সেক্রেটারির নোট। জানা গেল, এই ষড়যন্ত্রে আসল মন্ত্রী কে। তিনি আর কেউ নন, গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ। অগাস্টের ২৫ তারিখে বিলাতে হোম সেক্রেটারির কাছে এই সর্বনাশা প্রস্তাব নিবেদন করে একখানা চিঠি পাঠিয়েছিলেন তিনি। ষড়যন্ত্রের সেটিই সূত্রপাত।
দীর্ঘ নোট। তাতে নানা যুক্তি তর্ক। তার সার কথা: রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরালে সকলের মঙ্গল। কেননা, কলকাতা তথা ফোর্ট উইলিয়ম যে পরিস্থিতিতে ভারতে ইংরেজ রাজ্যের রাজধানী হয়েছিল, সে পরিস্থিতি আজ সম্পূর্ণ পরিবর্তিত। রাজ্য এখন বিশাল সাম্রাজ্য। রেলপথ স্থাপিত হয়েছে, এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত। তা ছাড়া, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাও অনেক পাল্টে গেছে। ইম্পিরিয়াল কাউন্সিলের আকার ক্রমেই বড় হচ্ছে। নানা প্রান্তের সদস্যদের পক্ষে কলকাতায় যাতায়াত রীতিমতো কঠিন সমস্যা। তাঁদের নিয়ে সভা করা আরও কঠিন। পুরোনো কাউন্সিল হাউসে জায়গা কম। এদিকে নতুন একটি গড়া হচ্ছে, সেটি সম্পূর্ণ হলে রাজধানী হিসেবে কলকাতার দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠবে। এর পরও আরও কয়েকটি যুক্তি আছে। বঙ্গভঙ্গের ফলে বাঙালিরা উত্তেজিত, এখানে প্রতিবাদ আন্দোলন ইত্যাদি লেগেই আছে। দেশ-শাসনের পক্ষে রাজধানীতে এত হট্টগোল অসুবিধাজনক। কলকাতার আর একটি অসুবিধা এখানকার আবহাওয়া। এখানে গ্রীষ্ম নিদারুণ। বছরে বেশ কয়েক মাসের জন্য রাজধানী সরিয়ে নিতে হয় সিমলায়। তাতে অনেক খরচ।
অতএব তার কাউন্সিলের সঙ্গে পরামর্শ করে গভর্নর জেনারেল প্রস্তাব করলেন, রাজধানী দিল্লিতে সরিয়ে নেওয়া হোক। দিল্লির পক্ষে বিস্তর সওয়াল করেছেন লর্ড হার্ডিঞ্জ তাঁর নোটে। দিল্লির আবহাওয়া বছরে সাত মাসই চমৎকার। ১ অক্টোবর থেকে ১ মে অনায়াসে সেখানে বসে শাসনকার্য পরিচালনা করা যায়। দিল্লি সিমলা থেকে কাছে। সিমলায় দফতরের মরসুমি অভিযান অপেক্ষাকৃত সহজে এবং কম খরচে সম্ভব হবে। দিল্লি মোটামুটি ভারতের কেন্দ্রস্থলে। সুতরাং রেল, ডাক, তার ইত্যাদি বিভাগগুলোর সমৃদ্ধি ঘটবে। বাণিজ্য দফতরেরও লোকসান হবে না। এতকাল কলকাতা তার কাছ থেকে যেসব সুযোগ সুবিধা পেয়েছে তখন বোম্বাই করাচিও তা পাবে। ফলে সমগ্র ভারতের শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে। তা ছাড়া দিল্লি একটি ঐতিহাসিক কেন্দ্র। রাজধানী সেখানে স্থানান্তরিত হলে হিন্দুরা খুশি হবে। মহাকাব্য মহাভারতে বর্ণিত কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ ওখানেই হয়েছিল। পুরনো কেল্লার জমিতেই ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ। দিল্লিকে রাজধানী হিসেবে পেলে মুসলমানেরাও যার-পর-নাই আনন্দিত হবে। দিল্লি মুসলিম গৌরবের নানা স্মৃতিবিজড়িত। সুতরাং হুকুম দিন ‘চলো দিল্লি’।
যুগপৎ পূর্ব ভারতে শাসনতান্ত্রিক নববিন্যাসেরও বিস্তারিত প্রস্তাব পেশ করলেন হার্ডিঞ্জ। তাঁর মতলব চতুর্বিধ। ১। শাসনকাজের সুবিধা, ২। বাঙালিদের ন্যায়সংগত দাবিদাওয়ার মীমাংসা, ৩। পূর্ববাংলায় মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা এবং মুসলিম জনসাধারণের পরিতোষসাধন, এবং ৪। যাবতীয় উত্তেজনা আন্দোলনের স্থায়ী উপসংহার। এর জন্য কার্জনকে বানচাল করে হার্ডিঞ্জ প্রস্তাব দিলেন—ক। প্রেসিডেন্সি, বর্ধমান, ঢাকা, রাজসাহী এবং চট্টগ্রাম এই পাঁচটি বঙ্গভাষী অঞ্চলকে আবার এক করে একজন সপারিষদ গভর্নরের অধীন করা হোক, খ। বিহার, ছোটনাগপুর এবং ওড়িশাকে একসঙ্গে একজন লেঃ গভর্নরের শাসনাধীনে আনা হোক, এবং গ। অসমে আবার চিফ কমিশনারের শাসন প্রবর্তিত হোক। প্রতিটি ব্যবস্থার সুবিধা-অসুবিধার কথাও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন হার্ডিঞ্জ। তাঁর এই নোটটি রাজনৈতিক এবং শাসনতান্ত্রিক দলিল হিসেবে একটি পড়বার মতো কাগজ। সেদিনের ইংরেজ শাসকের মন কত বাঁকাচোরা পথে ফিরত, প্রতি অধ্যায়ে ইঙ্গিত রয়েছে তার।
খুঁটিনাটি যাবতীয় আলোচনার মধ্যেই হার্ডিঞ্জ একসময় নিবেদন করলেন, সবচেয়ে ভাল হয়, যদি আগামী দরবারে সম্রাট স্বয়ং এই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি ভারতের কর্ণগোচর করেন।
হোম সেক্রেটারি তখন লর্ড ব্রুক। তিনি উত্তর দিলেন ১ নভেম্বর। প্রায় সমান মাপের দীর্ঘ উত্তর। তার সার কথা: ‘আমি তোমার সঙ্গে একমত। তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে। মহামান্য সম্রাট নিজেই যথাসময়ে সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন।’ আর কী? ফলত তার ক’ সপ্তাহ পরেই হঠাৎ ১১ ডিসেম্বর তারিখে সেই রাজকীয় ঘোষণা। রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগল রাজধানী কলকাতা।
‘হার্ডিঞ্জ মাস্ট গো।’ দাবি জানাল কলকাতার একটি কাগজ। ১৪ ডিসেম্বর ‘ইংলিশম্যান’ লিখল: ‘এই ঘোষণার ফলে দরবারের মহিমা এবং জনপ্রিয়তা দুই-ই কমে গেল। যদিও ঘোষণাটি রাজমুখে উচ্চারিত, তা হলেও আমরা এই অন্যায়ের সমালোচনা না করে পারছি না।’
‘…this cannot prevent us again questioning its wisdom and critcising with some severity the altogether inadequate excuses which have been put forward to justify it.’)
‘দ্য স্টেটসম্যান’ আরও কড়া সমালোচক। সে খোলাখুলি আক্রমণ করল গভর্নর জেনারেলকেই (১৪ ডিসেম্বর): ‘ভারত সরকার নিঃসন্দেহে আমাদের বিস্মিত করতে সমর্থ হয়েছেন। দু’ দিন আগেও গোটা ভারতে এক ডজন লোক ছিলেন কিনা সন্দেহ, যাঁরা জানতেন, কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী সত্যিই স্থানান্তরিত হতে চলেছে। লর্ড হার্ডিঞ্জ তাঁর উচ্চপদটিকে দুষ্কার্যে লাগিয়েছেন, রাজাকে তিনি ভুল বুঝিয়েছেন। এবং তার ফলে যে জনপ্রিয়তার হানি আসলে তারই প্রাপ্য, তা তিনি মহামান্য সম্রাটের মাথায় চাপিয়েছেন।…সুতরাং আমাদের দাবি, রাজধানী সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত যে সিদ্ধান্তই গৃহীত হোক না কেন, তার জন্য দায়ী ব্যক্তিটিকে অবিলম্বে বিতাড়িত করা হোক।
(‘…the man who is responsible thus abusing the authority of the sovereign should seek some other sphere of influence.’)
দিনের পর দিন কাগজে কাগজে ধ্বনিত হয়ে চলল প্রতিবাদ। কলমের পর কলমে বিস্তীর্ণ চিঠি ছাপা হতে লাগল। ফাঁকে ফাঁকে সম্পাদকীয়, কবিতা, বিশেষ প্রবন্ধ, ব্যঙ্গচিত্র। ‘ইংলিশম্যান’-এ পদ্য বের হল—
Why are the people shouting?
What is the news today?
Leaving the Ditch for Delhi!
Marching! Marching away!
ব্যঙ্গচিত্রে দেখা গেল, শূন্য গভর্নর হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিন্ন বসন কলকাতা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পাশে প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘খালি কুঠি যে কোনও ভাড়াটিয়া চাই’। কাগজে প্রকাশিত একটি বিশেষ প্রবন্ধের শিরোনাম ‘দিল্লি, ইটস ড্রব্যাক অ্যাজ ক্যাপিটাল অব ইন্ডিয়া’। কলকাতার হতাশা এবং ক্রোধ আর গোপন নেই।
একই উত্তেজনা সাগরের ওপারেও। ১২ ডিসেম্বর কমনস সভা খবর পেল। সেদিনই লর্ডদের সভাও। প্রধানমন্ত্রী তখন অ্যাসকুইথ। তাঁর মুখে খবর শুনে কমনস হতভম্ব। এমন গুরুতর খবরটিরও বিন্দুমাত্র আভাস পাননি তাঁরা? লর্ডস সভায় লর্ড ল্যান্সডাউন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি ঘোষণা করলেন, এমন গুরুতর সংবাদ বোধ হয় এই সভা আগে কখনও শোনেনি। কলকাতা থেকে রাজধানী স্থানান্তর অর্থ অনেক ঐতিহ্যের উৎসাদন। প্রস্তাবিত পরিবর্তন শুধু আকস্মিক নয়, জবরদস্তিমূলক। ঘটনাটা আরও গুরুতর কারণ স্বয়ং সম্রাটকে জড়িত করা হয়েছে এই অনভিপ্রেত সিদ্ধান্তের সঙ্গে। লর্ড কার্জনও উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। সম্রাটের ভারত ভ্রমণ এখনও শেষ হয়নি, সুতরাং তিনি সেদিনের মতো বিশেষ কিছু বললেন না।
কিন্তু বিলাতি কাগজগুলো মৌনব্রতে রাজি হল না। এদেশের কিছু কিছু কাগজের মতো (যথা লাহোরের ‘সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেট’, এলাহাবাদের ‘পাইওনিয়ার’ ইত্যাদি) বিলাতের ‘দ্য টাইমস’ এবং ‘ডেইলি মেল’ সিদ্ধান্তটিকে অভিনন্দন জানাল। কিন্তু অন্যান্য কাগজ সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠল। ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ লিখল এমন গাজোয়ারি ব্যাপার বোধ হয় রাশিয়াতেও সম্ভব নয়।’
কলকাতা এবং লন্ডনের অসংখ্য কাগজ তুমুল কোলাহল করেছিল। ল্যান্সডাউন, কার্জন, মিন্টো—তিন তিনজন ভূতপূর্ব গভর্নর জেনারেল কলকাতায় ইজ্জত রক্ষার্থে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। বাংলা দেশের ইঙ্গবঙ্গ ব্যবসায়ী সম্প্রদায় একযোগে আন্দোলন করেছিলেন। পরবর্তী দিনে গান্ধীজিসহ অনেক জাতীয় নেতাও। কিন্তু হার্ডিঞ্জকে তবুও ঠেকানো গেল না। দরবারের তেরাত্তির পার হতে না হতেই তিনি রাজদম্পতির হাতে নয়াদিল্লির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করিয়ে নিলেন।
দরবার মঞ্চের কাছেই তাড়াহুড়ো করে একটি জায়গা ঠিক করা হল। বেলা দশটায় রাজদম্পতি সেখানে এসে পৌঁছলেন। ত্বরিতে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। হার্ডিঞ্জ একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা করলেন: ‘দিল্লি এবং তার চারপাশের অঞ্চলে অনেক রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোনও কোনওটি এমন অতীতে যে, তার ইতিবৃত্ত আজ লোকেরা ভুলে গেছে। কিন্তু মহামান্য সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞী, আপনারা যে যে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে চলেছেন, দিল্লির ইতিহাসে তা অভূতপূর্ব। হার্ডিঞ্জ আরও জানালেন তিনি কথা দিতে পারেন, আজ যে রাজধানীর ভিত্তি স্থাপিত হবে, এমন দীর্ঘস্থায়ী রাজধানী দিল্লি আর কখনও দেখেনি। এমন গৌরবের রাজধানীও এতদ্দেশে এই প্রথম…ইত্যাদি।
সম্রাট উত্তরে বললেন, ‘আমি এবং রানি আমরা উভয়েই আজ প্রীত।’
‘May God’s blessings rest upon the work which is so happily inaugurated today.’
অভিভাষণ শেষে সম্রাট ধীর পায়ে ভিত্তিপ্রস্তরটির দিকে এগিয়ে গেলেন। সরকারি চিফ এনজিনিয়ার তাঁর হাতে কর্নিক তুলে দিলেন। যথোচিত গাম্ভীর্য সহকারে ভারতেশ্বর নয়াদিল্লির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। পুবের পাথরটি স্থাপন করলেন তিনি নিজে, পশ্চিমেরটি রানি। হেরাল্ড মঞ্চে উঠে ঘোষণা করলেন: মহামান্য রাজার আদেশে আমি জানাচ্ছি, রাজধানীর প্রস্তর উত্তমরূপে যথোপযুক্তভাবে স্থাপিত হয়েছে। তাঁর সহকারী উর্দুতে একই সংবাদ ঘোষণা করলেন। ধ্বনি উঠল পুরানো রাজধানী আবার নতুন হল। সম্রাটের জয়। সেদিন ১৫ ডিসেম্বর ১৯১১ সাল। হার্ডিঞ্জ বিজয়ীর হাসি হাসলেন।
চারদিকে রটে গেল, লাটবাহাদুর সমূহ অমঙ্গল ডেকে আনছেন। কাছেপিঠে পাথর না পেয়ে নতুন রাজধানীর ভিত্তির জন্য তিনি পাথর সংগ্রহ করেছেন পুরনো এক কবর থেকে। এমনিতেই দিল্লি বদনামি শহর। দিল্লি নাকি সাম্রাজ্যের কবর। একের পর এক প্রায় পনেরোটি সাম্রাজ্যের রাজধানী হয়েছিল এই নগর। কিন্তু কোনওটিই শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়নি, এমন অশুভ জমিতে কেন ইংরেজের রাজধানী বসালেন হার্ডিঞ্জ? কাগজে কাগজে আবার সমালোচনার ঢেউ। তার ওপর পাথর ঘিরে এই গুজব। কমনস সভায় মার্কিস অব জেটল্যান্ড-এর মুখেও শোনা গেল একই অভিযোগ। ‘শুভ অনুষ্ঠানে’ কবরের পাথর দেওয়া হল কেন? গায়ে পড়ে, সব জেনেশুনে কেন এ ভাবে অমঙ্গল ডেকে আনা? ১৮৫৭-র পরে ইংরেজরা যে কোনও গুজব বিষয়েই অতি সতর্ক।
কিন্তু এত কাণ্ড সত্ত্বেও কলকাতার রাজধানী গৌরবকে বাঁচাতে পারলেন না কেউ। কেননা, রাজকীয় সিদ্ধান্ত। রাজার কথা হাতির দাঁতের মতো, তার নড়ন-চড়ন নেই। হার্ডিঞ্জ সেটা জানতেন। আর তা তাঁর জানা ছিল বলেই তিনি এই অভাবিত পথেই পা বাড়িয়েছিলেন।
মতলবটি শুধু অভিনব নয়, অভিনব তা সিদ্ধ করার কৌশলটি। সূদুর ১৮৬৪ সাল থেকেই কলকাতা থেকে রাজধানী বদলের গুঞ্জন শোনা গেছে। লর্ড লরেন্স একবার সে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি। শোনা যায়, কার্জনও চেয়েছিলেন কলকাতার বদলে রাজধানী করেন আগ্রা। কিন্তু সে প্রস্তাব তিনি জনসমক্ষে পেশ করতে ভরসা পাননি। শুধু আগ্রা নয়, কলকাতার বদলে নানা সময়েও আরও নানা জায়গার নাম শোনা গেছে, কিন্তু কোনও শহরই কলকাতাকে জব্দ করতে সক্ষম হয়নি। কেননা, প্রতিবারই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে প্রকাশ্যে। কলকাতার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মহল প্রতিবারই লড়াই করেছেন প্রাণপণ। তাঁদের চেঁচামেচি, হই-হল্লায় সাধ্য কার, কলকাতা থেকে রাজধানী সরান। হার্ডিঞ্জ সে সব খবর জানতেন। তিনি জানতেন, খবরটা একবার ফাঁস হয়ে গেলে কিছুতেই এমন দুরূহ পরিকল্পনা সফল হবে না। সুতরাং তিনি বাঁকা পথ ধরলেন। এমন পথ, বা অপ্রত্যাশিত, কলকাতার স্বপ্নেরও অগোচর।
এক কথায় বলা চলে, সে এক অবিশ্বাস্য রাজকীয় কীর্তি। এবং তার সাফল্যের পুরো কৃতিত্ব একজন মানুষের। তিনি হার্ডিঞ্জ। মাত্র এক বছর আগে ( ডিসেম্বর ১৯১০) ভারতে অবতরণ করেছেন এই নতুন গভর্নর জেনারেল। কিন্তু কূটনীতিতে তিনি পুরনো রাজকর্মচারী, এর আগে সে কাজে হাত পাকিয়ে এসেছেন। সুতরাং প্রথম থেকেই অতি সংগোপনে শুরু হল তার কাজ। একটি গোপন নোটে লাটসাহেব একদিন কাউন্সিলকে তাঁর ইচ্ছার কথা জানালেন। বাইরে কেউ কিছু জানে না। সুতরাং কোনও মহল কোনও চাপ সৃষ্টির সুযোগ পেল না। কাউন্সিল গভর্নর জেনারেলের প্রস্তাবে সায় দিলেন। হার্ডিঞ্জ এবার বসলেন বিলাতে চিঠি লিখতে। পরবর্তী কালে নিজের স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন: ‘এ সম্পর্কে নিজের চিঠি আমি নিজেই লিখতাম। কাউন্সিল মেম্বারদের নোট ইত্যাদি টাইপ করানো হত অতি সংগোপনে। হোম সেক্রেটারিকেও আমি অনুরোধ জানিয়েছিলাম, কেউ যেন বিন্দুমাত্র টের না পায়। আমার প্রস্তাব গৃহীত হোক বা না হোক, কেউ যেন কিছুই জানতে না পারে।’
হোম সেক্রেটারি লর্ড ব্রু তাঁর সেই অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। একদা তিনি নিজেই কলকাতা থেকে রাজধানী সরিয়ে নেওয়ার জন্য দরবার করেছিলেন। কিন্তু কলকাতার প্রতিরোধের ফলে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন। এবার আর তিনি এ সুযোগ নষ্ট করতে রাজি হলেন না। গোপনীয়তায় তিনি হার্ডিঞ্জকেও পিছনে ফেললেন। দুঃসাহসীর মতো তিনি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কাছেও কলকাতার চিঠিটির কথা চেপে গেলেন। লর্ড অ্যাসকুইথ সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরেছিলেন রাজার কাছ থেকে সম্মতি পাওয়ার পরেই। আইনত সেটা অসিদ্ধ নয়, কিন্তু যে কোনও ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারির পক্ষে অবশ্যই এটা সাহসিকতার কাজ।
আরও গোপনীয়তা দেখালেন রাজা পঞ্চম জর্জ। লর্ড হার্ডিঞ্জ লিখছেন: রাজদম্পতির ভারত আগমনের দিন হঠাৎ আমি আবিষ্কার করলাম, রানি নিজেও রাজধানী বদলের খবরটি জানেন না। একটা গোপন সভায় রাজাকে কথাটা বলতে গিয়ে চমকে উঠলাম। তবে কি রানিও জানেন না। পঞ্চম জর্জ ইঙ্গিতে বলেছিলেন, হ্যাঁ, তাই। হার্ডিঞ্জের আনন্দ আর ধরে না। তবে বোধহয় এবার তাঁর স্বপ্ন সত্যিই সফল হল।
আনন্দ যত, উদ্বেগ তার চেয়েও বেশি। দরবারের আর ক’দিন মাত্র বাকি। এ যাবৎ গোপন আলোচনা যা হয়েছে, সবাই দায়িত্বশীল জনা কয়েক মানুষের মধ্যে। এবার সিদ্ধান্তটিকে কার্যকর করতে হলে আরও কিছু করণীয় আছে। ঘোষণাপত্র, গেজেট এবং আনুষঙ্গিক সরকারি কাগজপত্রের খসড়া করতে হবে, ছাপাতে হবে। যে কোনও মুহূর্তে পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যেতে পারে। আর তা হলেই বিপত্তি। রাজা অসন্তুষ্ট হবেন, মতলবটিও হাসিল হবে না। হার্ডিঞ্জ ভাবিত।
অনেক ভেবেচিন্তে শেষ পর্যন্ত একটা উপায় মাথায় এল। হার্ডিঞ্জ নিঃশব্দে আবার কাজ শুরু করলেন। দরবারের ক্যাম্পের ভিতরে তিনি আর একটি স্বতন্ত্র ছোট ক্যাম্প বসালেন। তার নির্দেশে সেখানে ছাপাখানা বসানো হল। সেই সঙ্গে হেঁসেল এবং তাঁবু। ৮ ডিসেম্বর দরবারের উদ্বোধন। তার তিন দিন আগে সেই গোপন ক্যাম্পে সেক্রেটারি এবং মুদ্রাকরদের ঢুকিয়ে দেওয়া হল। সকলের চোখের আড়ালে তাঁরা নির্দিষ্ট কাজ করে চললেন। ক্যাম্পের চারদিক ঘিরে সৈন্যবাহিনীর কড়া পাহারা। তারপর আবার একটি পুলিশ বেষ্টনী। কারও সাধ্য নেই অনুমতিহীন তার ভিতরে ঢোকেন, কিংবা বেরিয়ে আসেন। অনেকটা পরবর্তী কালের বাজেট ছাপানোর কৌশল।
বাজেট তবুও নানা সতর্কতা সত্ত্বেও কখনও কখনও ফাঁস হয়ে যায়। কিন্তু এ ষড়যন্ত্র নিচ্ছিদ্র। সম্রাটের ঘোষণা পাঠ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরবারে পৌঁছল সীলমোহর করা গেজেটের বাণ্ডিল। কাণ্ড দেখে বিরাট বিরাট রাজপুরুষেরাও স্তম্ভিত। একজন আর একজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। প্রত্যেকের মুখে জিজ্ঞাসা—তুমি কি জানতে? ভারত এবং ব্রিটেনে এক ডজন মানুষও মাথা নাড়িয়ে বলতে পারেননি—হ্যা, জানতাম।
মাত্র জনাকয় মানুষ, আর একটি নির্ভুল চাল, যার পথ ধরে নিমেষে দুশো বছরের পুরনো রাজধানী বাতিল হয়ে গেল। দিকে দিকে ধ্বনি উঠল, ‘চলো দিল্লি।’
নতুন শহর গড়ার ভার পড়েছিল বিখ্যাত স্থপতি এডুইন লিউটেনসের ওপর। পরের বছর গ্রীষ্মে এসে তিনি নামলেন নয়া রাজধানীর জন্য নির্দিষ্ট জায়গাটিতে। সব দেখেশুনে স্থপতি রায় দিলেন, ভুল জায়গা পছন্দ করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভার্সাই গড়তে হলে আরও কয়েক মাইল দক্ষিণে সরে না যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। সুতরাং আবার ছোটখাটো একটি ষড়যন্ত্র। গোপনে রাতের অন্ধকারে অনেক কৌশল করে আদি ভিত থেকে টেনে তোলা হল সেই পাথরযুগল। তারপর গরুর গাড়ি করে নিশুতি রাতেই সেগুলো বয়ে নিয়ে আসা হল সেই বিন্দুটি থেকে অন্তত দশ মাইল দক্ষিণে। নিঃশব্দে আবার মাটিতে বসানো হল রাজকীয় স্মৃতিচিহ্ন। তারপর শুরু হল নতুন শহর গড়ার কাজ।
কিন্তু এত করেও কি নয়াদিল্লি ইংরেজ-রাজধানী হিসেবে সফল হয়েছিল? অনেক ইংরেজই আপত্তি করবেন। অন্তত একজন অবশ্যই। তিনি সুখ্যাত পার্কিনসন। পার্কিনসন সাহেব বলেন, ইতিহাসে দেখা গেছে, ঝোঁক যখন বাড়ির দিকে, শাসনের মান তখন নীচের দিকে। নমুনা— নয়াদিল্লি। ‘নতুন রাজধানীর কাজের সঙ্গে সঙ্গে ধাপে ধাপে রাজনৈতিক বিপর্যয়।…১৯১২ সালে ভাইসরয়ের (হার্ডিঞ্জ) প্রাণনাশের চেষ্টা, ১৯১৭ সালের ঐতিহাসিক ঘোষণা, ১৮ সালে তা কার্যকর করা। লর্ড আরউইন প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁর নতুন প্রাসাদে গিয়ে উঠলেন ১৯২৯ সালে। সে বছরই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মুখে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি, সে বছরই গোলটেবিল বৈঠকের উদ্বোধন। আর তার পরের বছর আইন অমান্য আন্দোলন। পার্কিনসন বলেন—একটু পরিশ্রম করলেই দেখানো যায়, একদিকে নতুন রাজধানীতে এক-একটি বাড়ি হচ্ছে, অন্যদিকে ইংরেজের ভারত ত্যাগের সময় এগিয়ে আসছে।
‘What was finally achieved was no more and no less than a mausoleum.’
হার্ডিঞ্জ নিশ্চয়ই তার জন্য এত কানাকানি ফিসফিস, এমন উদ্যোগ-আয়োজন করেনি।
একজন সাহেব এসেছিলেন কলকাতা দেখতে
অনেক সাহেবই আসেন। আসেন, দেখেন, মন্তব্যের খাতায় দু’চার ছত্র লিখে সই করে দিয়ে চলে যান। কারও মতের সঙ্গে কারও মিল নেই।
১৮০৩ সালে লর্ড ভেলেনসিয়া লিখছেন, ‘চৌরঙ্গি প্রাসাদের গ্রাম। সব মিলিয়ে মনোহর দৃশ্য: জীবনে এমনটি আর কখনও দেখিনি।’
১৮৬৩ সালে জর্জ ট্রেভলিয়ান বলছেন ‘এমন বাজে জায়গা আর একটা খুঁজে বের করে দেখি। এই শহরের নৈসর্গিক চরিত্র এত খারাপ যে, তাকে আরও খারাপ করে তুলতে মানুষের বিশেষ খাটুনি নেই। সে সামান্যটুকুও অসামান্য যত্ন সহকারে করা হচ্ছে এখানে।’
তার একশো বছর আগেও ক্লাইভ লিখেছেন—বিশ্বের সবচেয়ে বদ জায়গা।
বেন্টিঙ্ক বলেন—আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্যাবলি, ম্যাগনিফিসেন্ট।
বিশপ হিবার মনে করেন, কলকাতা মস্কো। ‘আমার কাছে মস্কোর যে প্রিন্ট ক’খানা আছে, তার সঙ্গে হুবহু মিল চিনাবাজার আর কসাইটোলার।’
আর এক সাহেব লিখছেন, ‘গরমের কলকাতা যেন বাস্তিল, দম বন্ধ হয়ে আসে।’
অন্য আর এক সাহেবের অভিমত: লন্ডন যন্ত্রণাপুরী, স্বর্গের লাগোয়া শোধনাগারের মতো। কলকাতা সাক্ষাৎ স্বর্গ।
উইলিয়ম হান্টার লিখছেন তাঁর বান্ধবীকে, ‘কল্পনা করো, প্রকৃতির যা-কিছু গৌরবের, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রূপময় স্থাপত্য, তা হলেই কলকাতার সঠিক ছবিটি পেয়ে যাবে তুমি। (সন্দেহ নেই, হান্টার তখন সত্যিই প্রেমে পড়েছেন।)
উনিশ শতকের শেষে উইনস্টন চার্চিল তাঁর মাকে লিখছেন, ‘আমি খুশি কলকাতা দেখে। বাবা যে কারণে লিসবন দেখে খুশি হয়েছিলেন, সেই একই কারণে আমিও খুশি, ভবিষ্যতে দেখবার আর কোনও দরকার হবে না।…কলকাতা যত সব আনইন্টারেস্টিং লোকে বোঝাই।’
এডোয়ার্ড লিয়ার কলকাতার সাহেবনোগকে ভাগ করেছিলেন দুভাগে—‘কাম্বারবানডিয়ানস’ আর ‘নন-কাম্বারবানডিয়ানস’। তিনি ছিলেন লাটবাহাদুর লর্ড নর্থব্রুকের বন্ধু। তাঁরই পীড়াপীড়িতে সরকারি খরচায় চৌদ্দ মাসের জন্য ভারতে আসা। লিয়ারের বয়স তখন ষাট পেরিয়ে গেছে। শরীর খারাপ, মেজাজ আরও খারাপ। সুতরাং গভর্নর হাউসের জীবন তাঁর মোটে ভাল লাগেনি। ওই অট্টালিকার নাম দিয়েছিলেন তিনি ‘হাসল্ফাসাবাদ’। সুযোগ পেলেই রঙ-তুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন সাহেব। ছবি আঁকতেন। শহর কলকাতাকে নয়, তার ভাল লেগেছিল কালো মানুষ, সাদা কাপড়, আর সর্বব্যাপ্ত সবুজ রঙ।
মার্ক টোয়েন এসেছিলেন ১৮৯৬ সালে। থাকতেন হোটেল কন্টিনেন্টাল-এ। ছিলেন মাত্র দু-তিন দিন। বাবু ‘ওনোকুল চুন্দের মুখার্জি’ তথা বাঙালিদের বিষয়ে তাঁর কৌতূহলের কথা শোনা যায়, শোনা যায় মনুমেন্ট দর্শনের কথাও। কিন্তু তাঁর ভ্রমণ-বিবরণে কলকাতার চেয়ে অন্য শহরেরই খাতির বেশি। কলকাতায় তাঁর সঙ্গে নাকি বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া এক বান্ধবীর দেখা হয়েছিল। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার, প্রেম ভালবাসা নয়, দুজনের মধ্যে আলোচ্য বিষয় ছিল: শুকনো হেরিং মাছ। কিপলিংও কলকাতায় ক্ষণিকের অতিথি। তিনি বাস করতেন গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে। লাহোরের সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেট-এর জন্য লেখা পাঠাতেন হুগলি নদীর পাইলটদের সম্পর্কে। রাত্রে পুলিশের ভাইস স্কোয়াডের সঙ্গে শহরময় ঘুরে বেড়াতেন, রাতের কলকাতা দেখতেন। এ শহর তার কাছে মিহি অবিচার আর মোটা পাপাচারের শহর।
আমাদের এ সাহেবের মতামত, শত শত পৃষ্ঠা বিস্তীর্ণ। চট করে ক’ ছত্রে তা জানিয়ে দেওয়া শক্ত। তা ছাড়া তিনি আজকের দর্শক। অথচ আজকের অতিব্যস্ত দর্শকদের মতো তেরাত্তির বাস করেই তিনি তিন কাণ্ড কেতাব ফাঁদেননি। কলকাতায় এসেছেন তিনি দু’ দু’বার। একবার ৬৯ সালে, আর একবার ’৭০-এ। সাকুল্যে মাসাধিককালের সাক্ষাৎ-পরিচয়। শুধু তাই নয়, শহর দেখতে এসে সাহেব ঘেরাও হয়েছেনও। তিন-তিন বার। সুতরাং লেখক হিসাবে তিনি হকদার বটেই।
কেন এসেছিলেন? সাহেব বলছেন: একই কারণ, যে কারণে ম্যালোরি এভারেস্টের দিকে ছুটেছিলেন সেটা আছে বলেই। তিনি শুনেছেন, কলকাতা নামে একটা শহর আছে। তার পূর্বপুরুষদেরই হাতে গড়া শহর। বয়সে নিতান্তই অর্বাচীন সে শহর। রোম কিংবা বারাণসীর সঙ্গে তো তুলনাই চলে না, এমনকী, নিউ ইয়র্কের চেয়েও কলকাতা একাশি বছরের ছোট, আর মনট্রিলও তার চেয়ে পঞ্চাশ বছরের বড়। অথচ কলকাতা বিশাল শহর, তিরিশ লক্ষ মানুষের বাস সেখানে। বৃহত্তর কলকাতায় বাস করেন আশি লক্ষ। কলকাতা এক সময় যদি সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর এখনও তবে বিশ্বের চতুর্থ শহর। টোকিও লন্ডন নিউইয়র্ক এই ত্রয়ীর পরই কলকাতা। তিনি শুনেছেন, এই প্রকাণ্ড শহর আসলে সমস্যার মহাসাগর। কলকাতা প্রবলেম সিটি। কলকাতা তৃতীয়-দুনিয়ার জীবন্ত প্রতিবিম্ব। এখানে পরিমাপহীন দারিদ্র্য, এখানে যুক্তিহীন হিংসা, এখানে নৈরাজ্যের হাওয়া। কলকাতা মৃত্যুপথযাত্রী এক শহর। সুতরাং চলো কলকাতা।
ঘাড়ে ক্যামেরা হাতে নোট বই। সাহেব এলেন কলকাতায়। কী দেখলে? নামতে না নামতে প্রশ্ন। সে প্রশ্নের উত্তর ছড়িয়ে আছে পাতার পর পাতা জুড়ে। সংক্ষেপে বললে: ‘প্রথম নজরে দেখবার জিনিস সবুজ, আর মানুষ। দমদমে নামবার আগে সবুজ, নামবার পর মানুষ। মানুষ আর মানুষ। উড়োজাহাজ পশ্চিম থেকে ভারতের যে এলাকার উপর দিয়ে উড়ে আসে, তার মাটির রঙ ধূসর, কিন্তু দমদমের চারপাশ ঘিরে সবুজের সমারোহ। তার মধ্যে গেরুয়া জলের নদী, নদীতে চিমনি আর ধোঁয়াসহ চিত্রবৎ জাহাজ, নদীর দুই ধারে ছড়ানো অফুরন্ত শহর। আর তার পরেই অচিরে জনারণ্য।’
সাহেব বিস্ময়ে হতবাক। জীবনে এমন দৃশ্য আর কখনও দেখেননি তিনি। কত রকমের যানবাহনই না আছে কলকাতায়। কিন্তু সব বাহনেই সমান ভিড়, আঙুরের থোকার মতো ঝুলছে মানুষ। দোকানে মানুষ পথে মানুষ। মাথায় মোট নিয়ে চলেছে মানুষ। হাতে ব্রিফকেস নিয়ে চলেছে মানুষ। পথের ধারে মড়ার মতো পড়ে আছে মানুষ। বালতিতে জল ভরছে মানুষ। কেউ তর্ক করছে, কেউ হাসছে, কেউ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবছে, এবার কী করা যায়। সাহেব নোট বইতে লিখলেন, সকাল সাতটায় পৃথিবীর কোনও শহরে এত মানুষ কখনও দেখা যায়নি। দেখা সম্ভব নয়।
তারপর ক্রমে আরও মানুষ। ট্রেনের টাইমে হাওড়া স্টেশন। ছুটির পরে ডালহৌসি স্কোয়ারে। যেন রেফারি বাঁশি বাজিয়েছেন। খেলা ভাঙার বাঁশি। মাঠ উপচানো ভিড়। শিল্পী ব্রুগেলকে স্মরণ করলেন সাহেব। আহা, ব্রুগেল যদি ইজেল খাটিয়ে বসে যেতেন চৌরঙ্গিতে, একালের ‘বেবেল’ ধরা থাকত। চৌরঙ্গি দিয়ে হেলেদুলে বিপুল বেগে চলেছে মানুষ বোঝাই বাস। লন্ডনে তিনি শুনেছেন, প্রতি বাসে গড়ে যাত্রী সতেরো জন, কলকাতায় নাকি সাতাশি জন। কিন্তু এ বাসে বোধহয় তার চেয়েও বেশি। ঝড়ের গতি। চলার আনন্দ পেয়ে বসেছে যেন কণ্ডাক্টরকেও। সে ড্রাইভারের পাশে মাডগার্ডে বসে পড়েছে, দু’হাত সামনের দিকে ছুড়ে দিয়ে চিৎকার করছে, পয়সার থলি বাতাসে উড়ছে। সাহেব নোটবুকে লিখলেন, ব্রিটিশ লেল্যান্ডের পক্ষে যুগপৎ বেদনা এবং গৌরবের দৃশ্য।
বাসের শব্দ। ট্রামের শব্দ। গাড়ির শব্দ। কলকাতা এক বিচিত্র শব্দলোক। সুকুমার রায় আমাদের ফুল ফোটার, চাঁদ ডোবার, রাত কাটার শব্দ শুনিয়ে গেছেন। এ সাহেব বলছেন ট্যাক্সির হর্নের আওয়াজ ‘ফুসফুসে দোষ’ রুগ্ণ গরুর গভীর হাঁকের মতো। তারই পাশে পালিশওয়ালা বুরুশ দিয়ে কাঠের বাক্স পেটাচ্ছে, চাবিওয়ালা বাজাচ্ছে চাবির তোড়া, এবং প্রতি দশ গজ অন্তর কেউ না কেউ নাক ঝাড়ছে, কিংবা হাই তুলছে, অথবা গলা খাকারি দিচ্ছে। তারপরই খক থু। কলকাতার মানুষের স্নানের নেশা দেখে অবাক হয়েছেন তিনি, তাজ্জব হয়ে গেছেন রাস্তার ধারে স্নানের পর সকলের সামনে মেয়েদের কাপড় বদলাবার নৈপুণ্য দেখে। তাঁর অভিমত: ব্যক্তিগতভাবে এমন পরিচ্ছন্ন মানুষ অন্যত্র অল্পই আছে, কিন্তু অদ্ভুত উদাসীন এরা অন্যের স্বাস্থ্য সম্পর্কে। ভিখারির প্রার্থনাধ্বনি, মিছিলের স্লোগান, কিছুই কান এড়ায়নি তাঁর। (ময়দানে বামপন্থীদের সভা তাঁর কাছে নুরেমবার্গ র্যালির মতো)। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ঠেকেছে রিকশওয়ালার হাতের ছোট ঘণ্টিটির শব্দহীন বাদ্য। এ যেন তাড়িয়ে নিয়ে ফেরে। এ তাড়না মধ্যরাত্তিরেও শেষ হয় না। অনুসরণ করে রিকশর টুংটাং। অথবা, ‘মাগো’ ধ্বনি। সাহেব লিখছেন, সব সময়য়ই কেউ না কেউ, কিছু না কিছুর জন্য আর্তনাদ করছে। একমাত্র শান্তি মধ্য-ময়দানে। সাহেব বোধ হয় জানেন না, সন্ধ্যায় আবার সেখানে হাট বসে ট্রানজিস্টার, ফুচকা, ভেলপুরির, রাতে ছায়া-মানুষদের আনাগোনা। কে পুলিশ কে ডাকু–বোঝা ভার।
শব্দের মতোই তেজি কলকাতার গন্ধ। গাড়ির পোড়া তেল, কয়লার ধোঁয়া, হঠাৎ ধুপধুনো কিংবা বেলফুল, অথবা কড়ায় চাপানো ইলিশ মাছ, এসব গন্ধ আমাদের চেনা। সাহেব মনে করেন, কলকাতার গন্ধ শব্দের মতোই জটিল। ধুনো মশলা সবই আছে হয়তো, কিন্তু মনে হয় সব গন্ধের মূলে রয়েছে কোনও পচা বস্তু। পচা সবজি, পচা জন্তু, গ্যালন গ্যালন প্রস্রাব। অবশ্য তৎসহ উগ্র দারিদ্র্যের গন্ধও।
দর্শক যেহেতু সাহেব, অতএব নেমেই সাহেবি চিহ্নের খোঁজে ব্যস্তসমস্ত।
দমদম থেকে শহরের পথে আসতে আসতে একটা কারখানার লোহার গেট। অবিকল সেকেলে বিলাতি নকশা, এমনকী গ্যাস লণ্ঠনও রয়েছে। যেন উত্তর ইংল্যান্ড। শালিমারে একটা কারখানা এলাকার পথের বাঁকে পাথুরে ইটে ম্যানচেস্টারের পথ। ঠিক তেমনই লাল ইটের কারখানা-বাড়ি। সাইনবোর্ডের হরফগুলো পর্যন্ত উনিশ শতকের সাহেবদের পছন্দমতো। হাওড়ার বুকিং অফিসে ভিক্টোরীয় আমলে ধৃত। স্ট্র্যান্ড রোডের একটা বাড়িতে চার দেশের স্থাপত্য। বাগানে এবং বাড়ির চূড়ায় সাহেবি যুগের সিংহ, আফ্রোর্দিতি, মর্মর-সুন্দরী। আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে সুন্দরীর হাতের তালুতে প্রদীপ।
মিশরীয় ভিত, সিরিয়ান কলাম এবং তুর্কি গম্বুজ সত্ত্বেও যেমন চিনতে ভুল হয় না মনুমেন্ট সাহেবদের কীর্তি, ঠিক তেমনই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকেও তাজমহল বলে ভুল করার কোনও কারণ নেই। কবি অডেনকে কে নাকি কলকাতায় বলেছিলেন, যে স্থপতি তাজমহল ডিজাইন করেছেন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালও তাঁরই ডিজাইন। রোমান টোগা-পরা হেস্টিংস, প্রিয় ভৃত্য জন ব্রাউন সহ (সেই খ্যাপা তরুণটি যাকে রানির খাটের তলায় পাওয়া গিয়েছিল একবার) ভিক্টোরিয়া, তেষট্টি ভৃত্য এবং কুকুরসহ হিকি, ইত্যাদি হরেক দর্শনীয়ের ভিড়েও মুহূর্তের জন্যও ভোলা যায় না কার্জনের মূঢ়তার কথা। ব্যর্থ সাম্রাজ্যের ব্যর্থ স্মৃতিচিহ্ন। সাহেব শুনে যাননি অবশ্য যে, ক্লাইভের সেই বিশাল কেল্লা, যেখানে দশ হাজার সৈনিক সর্বক্ষণ শত্রুর মোকাবিলায় তৈরি থাকত, এবং অদ্যাবধি যেখান থেকে একটি অর্থপূর্ণ গোলাও নিক্ষিপ্ত হয়নি, সেখানে কিছুকাল আগে এক চিত্রতারকার বিবাহ আসর বসাবার উদ্যোগ হয়েছিল, আর উপস্থিত কেউ কেউ সওয়াল করছেন, য়ুনিভার্সিটি বসাবার জন্য। (অবশ্য কলেজ পালানো তরুণ-তরুণীরা ওদিকে যেতে যেতে বহুকাল ধরেই নাকি বলে—ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে যাচ্ছি!) আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হতে পারে নাকি আমাদের নাট্যশালা। কে একজন নাকি বলেছেন—খুশিতে সেদিন হেসেই মরে যাব। মারা যাবে সম্ভবত সেদিন ইতিহাস নিজেই। হাসতে হাসতে।
নিউমার্কেটের ঘড়িঘর যেন কোনও ভারতীয় পাগলা রাজা তুলে নিয়ে এসেছে হাভারফিল্ড থেকে, যেমন পয়সাওয়ালা আমেরিকানরা ইদানীং কিনে নিয়ে যাচ্ছেন নানা পুরনো বিলাতি দ্রষ্টব্য। নিউ মার্কেট নিউ ক্যাসলের একটি বাজারের আদলে গড়া, গঙ্গার ধারে পুরানো টাকশাল এথেন্সের মিনার্ভা মন্দিরের ছাঁদে, হাইকোর্টের সঙ্গে মিল বেলজিয়ামের এক টাউনহলের, বৈদ্যুতিক পাখাগুলি বাদ দিলে সেন্ট পলস অনায়াসে ব্রিটেনের যে-কোনও শহরে গঞ্জে থাকতে পারত।…উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকীর্তির মধ্যে হাতে রইল রাজভবন। সেটিও কার্যত ডার্বিশায়ারের কেডলস্টন হলের নকল। (হায় ওয়েলেসলি নাকি কলকাতার মেডিসি, কলকাতা তাঁর ফ্লোরেন্স)। তার এক ঘরে দ্বাদশ সিজারের মূর্তি। তাদের ভিড়ে বসে ওয়েলেসলি নাকি রাষ্ট্রচিন্তা করতেন গালে হাত দিয়ে। সিঁড়ির নীচে বুক-হারা স্ফিংক্স পাথুরে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকত সেদিকে। এ মূর্তি দুটির সুডৌল বুক ছিল নাকি এক সময় কিন্তু রাজভবনের এক কর্মচারীর নাকি মনে হয়, দৃশ্যটা রুচিসম্মত নয়, সুতরাং—
এ বাড়ির রাজকাহিনী কলকাতায় ইংরাজ ইতিহাসের অনেকখানি। কী করে ওঁরা সময় কাটাতেন, তার কিঞ্চিৎ আভাস মেলে গভর্নমেন্ট হাউসের উপাখ্যান থেকে। নুড়ি-বিছানো পথের ওই নুড়িগুলো পর্যন্ত বিলাতি। (ফরেন। মিসেস মাহিন্দ্র ফরেন)। বেজওয়াটার থেকে সেগুলো আনিয়েছিলেন লর্ড হেস্টিংস। বাগানে চিনাকামান বসিয়েছিলেন লর্ড এলিনবরা। লর্ড এলগিন আনলেন গ্যাস, ভগীরথতুল্য কাণ্ড করলেন লর্ড নর্থব্রুক। তিনি বসালেন গরম জলের পাইপ। কার্জন ছাদের ওপর বাহারি পাত্র স্থাপন করলেন, চালু করলেন বৈদ্যুতিক লিফট। রাজত্ব চলল এইভাবেই।
লাটবাহাদুরদের গিন্নিরাই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন? লেডি আমহার্স্ট বাগান শুরু করলেন। লেডি বেন্টিঙ্ক এসে বললেন, আহা, বাগানের কী ছিরি। তাঁর হুকুমে সাত দিনের মধ্যে সাজানো বাগান নিমূল। ইডেন বোনেরা আবার জলসেচ করলেন আলবালে। লেডি মেয়ো বড় জাতের গাছ লাগালেন। লেডি লিটন বসালেন সুইমিং পুল। আর লেডি ডাফরিন—টেনিস কোর্ট।
তবু লাটসাহেব আর লাটগিন্নিদের দুঃখ যেন ঘোচে না। থেকে থেকেই হাঁপিয়ে ওঠেন ওঁরা। মনে হয়, হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোনওখানে। বেন্টিঙ্ক সিমলা আবিষ্কার করলেন, কলকাতার রাজপুরুষদের কাছে তিনি কলম্বাসের মতো। গরম পড়তে না পড়তে হাজার হাজার আমলা যাত্রা করেন সিমলার দিকে। (কলকাতার গরম একবাক্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন আমাদের এই সাহেব। তিনি লিখেছেন, হাওড়া ব্রিজ দিনের বেলায় চার ফুট বেশি লম্বা হয়ে যায়।) তালিকার শীর্ষে ভাইসরয়, নীচে এক টেলিগ্রাফ ওয়ার্কশপের সুপার। মধ্যে নগরের বিশপ-বাহাদুরও আছেন। (বোধ হয়, ঈশ্বরও গ্রীষ্মে সিমলাবাসী।) ঝঞ্জাট নেই, ঝামেলা নেই। রাজভবনের মতো এখানে নিয়মিত ভোজের আসর বসে না। তার অর্থ উনিশ হাজার বার হ্যান্ডশেক করতে হয় না ভাইসরয়কে। উনিশ হাজার বার মাথা নোয়াতে বা কোমর বাঁকাতে হয় না তাঁর গিন্নিকে। নিঝঞ্ঝাটে কটি মাস নিরিবিলিতে কাটিয়ে শরতের মুখে আবার ফিরে চলো কলকাতা। কলকাতার পরবর্তী হাল, অতএব, ঐতিহ্যহীন নয়।
কিন্তু কেমন আছেন আজকাল সাহেবরা?
কলকাতায় আজকাল সাহেব নেই বললেই চলে। ১৯১০ সালে চোদ্দ হাজার পাক্কা সাহেব-মেম ছিলেন কলকাতায়। সেই সঙ্গে সোল হাজার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। কোনও কোনও নির্লজ্জ শ্বেতাঙ্গ যাঁদের বলতেন ‘এইট আনাস’। আর ১৯৬৮ সালে তাঁদের সংখ্যা মাত্র দু’ হাজার। ১৯৭০-এ আরও কম, এক হাজার তিনশো পঞ্চাশ। তথাকথিত ‘ব্ল্যাক-হোল’ এর কয়েক বছর আগেও এই সংখ্যাই ছিল নাকি।
আমাদের এ সাহেব দর্শক ঘুরে ঘুরে তাঁদের সম্পর্কে অনেক খবরাখবর সংগ্রহ করেছেন। স্বাধীনতার সময় এম্পায়ার সিনেমাতে যে ছবিটি চলছিল, তার নাম ‘দে ওন্ট বিলিভ মি’। স্বাধীনতার পর কলকাতায় সাহেব প্রীতিও অবিশ্বাস্য। রানি এসেছিলেন ’৬১ সালে। দমদমে পঁচিশ হাজার ভূতপূর্ব প্রজার ভিড়। রাজভবনে ন’ হাজার দুশো বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখ নিবদ্ধ তার ওপর। টেলিফোন গাইডে এখনও থেকে থেকে প্রতিষ্ঠানের নামের আগে ‘ইম্পিরিয়াল’ বা ‘এম্পায়ার’। প্রথমটি পাওয়া যাবে ৩৯ বার, দ্বিতীয়টি ২৩ বার। দরজির দোকানে প্রচারিত গৌরব-কথা ‘বাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট’। দমদম বিমান বন্দরের নোটিশ বোর্ডে ১৮টি ক্লাবের নাম। ক্লাব ভাঙছে। গড়েও উঠছে। জেনারেল ও ডায়ারের জন্য ২৬ হাজার পাউন্ড চাঁদা তুলেছিলেন মেমসাহেবরা একদিন যে বেঙ্গল ক্লাবের দরজায়, তা উঠে গেছে। আদি বাড়িটি না থাকলেও এখনও আছে বেঙ্গল ক্লাব। আছে ক্যালকাটা ক্লাব। বছরে নজরানা নাকি দেড় হাজার টাকা। কিন্তু তবু ভিড়। দু’ হাজার সদস্য। ওয়েটিং লিস্টে আছেন আরও চার হাজার। সাহেবদের ‘নিজস্ব’ ক্লাবও আছে বই কি।
কিন্তু এহো বাহ্য। আসল কথা বাণিজ্য। সেখানে হালচাল কী? ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতাকে বলেছেন, ‘কমলালয়’। সাহেবদের কাছেও কলকাতা তাই ছিল একদিন। এখানে পথের ধুলোয় টাকা আর টাকা।
১৮৫০-এ এল রেল। ’৬০-এ কয়লা উঠছে ৫০টি খনি থেকে। ’৮৫তে ডাণ্ডির মাকুতে সুতো কাটা হচ্ছে ২৪টি কলে। ১৯৬১-তে প্রথম চায়ের নিলাম। ১৮৯৮ সালে ক্লে সাহেবের আবিষ্কার ‘দমদম বুলেট’ অথচ ‘কলের জল’ ১৮৭০-এ, ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ১৯১১ সালে, বালি ব্রিজ ১৯৩১ সালে এবং ১৯১৪ সাল থেকে ভাবতে ভাবতে হাওড়া ব্রিজ ১৯৪৩ সালে। টেমস নদীর এপার ওপার জুড়ে কিন্তু স্রেফ লন্ডন এলাকায়ই সেতু আছে ১৬টি।
প্রথম মহাযুদ্ধে ৮০ লক্ষ করে চটের থলি সরবরাহ করতেন কলকাতার ৯৮ সাহেব কলওয়ালা। যুদ্ধ যখন থেমে গেল তখন তাঁরা এতই বিষণ্ণ যে, শান্তি চুক্তির দিনটিকে আখ্যা দিয়েছিলেন তাঁরা ‘ব্ল্যাক ডে’। ডিভিডেন্ড তখন শতকরা একশো থেকে দেড়শো ভাগ। চায়ের কারবারে টমাস লিপটন কিংবা ব্রুকবণ্ডের নাম তারও আগে থেকে। সাহেব বলছেন চেম্বার্সের খাতায় এখনও তাদের অনেকেই দিব্য বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। কেউ কেউ অবশ্য কিঞ্চিৎ অন্যভাবে। এখনও ভূত- পূর্ব ইম্পিরিয়াল টোব্যাকো আর সবার চেয়ে বেশি সিগারেট তৈরি করে, এখনও ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন মোটামুটি খাসা মুনাফা করে। ব্লুমসবারি থেকে এর হেড অফিস কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে, ডাইরেকটর বোর্ড-এ ঠাঁই পেয়েছেন ভারতীয়রাও, কিন্তু শেয়ারহোল্ডারদের তালিকা আমূল পালটে, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা নিজেদের হাতে নিয়ন্ত্রণ-পরিচালনের পূর্ণ লাগাম পেয়েছেন এই তো সেদিনই মাত্র। এর আগের ইতিহাসে একজন অবসরপ্রাপ্ত ডাইরেকটরকে দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার পাউন্ড। কলকাতার জনকল্যাণ খাতে ওঁদের দানের পরিমাণ কিন্তু মাত্র ৭৪৩ পাউন্ড। স্বভাবতই কাণ্ডকারখানা দেখে একালের এই সাহেব কিছুটা বিস্মিত। সত্য বটে, উনিশ শতকের শেষ অবধি লন্ডনেও ধনী সাহেবরা সম্পূর্ণ উদাসীন গরিবদের সম্পর্কে, কিন্তু কলকাতায় যেন তাঁরা চির উদাসীন।
বরাবরের মতো এখনও তাঁরা পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ। তৎকালের মতোই এখনও তাঁরা ভাল মহল্লায় ভাল বাড়িতে থাকেন। শেলফে এখনও মারি সাহেবের বিখ্যাত সেই হ্যান্ডবুক। যা প্রথম ছাপা হয়েছিল ১৮৫৯ সালে। একশো বছর পরে একুশতম সংস্করণ চলছে বইটির। ভাষা, কিংবা আগন্তুকদের প্রতি পরামর্শ বিশেষ কিছু পালটায়নি। তার ওপর নতুন খবর এয়ারকণ্ডিশনার এসেছে। আমেরিকান উইমেনস ক্লাব নবাগতদের সাবধান করে দেন ভৃত্যদের বেতন সম্পর্কে। কার কত প্রাপ্য, সে বিষয়ে ছাপানো কাগজও আছে। পাচক ৯০ থেকে ১০০ টাকা। সে বাজার ও রান্না দুইই করবে। ড্রাইভার ১৩০ থেকে ১৬৫ টাকা, আয়া ৬০ থেকে ৭৫ টাকা, মালী ৬০ থেকে ৮০ টাকা। সে অবশ্য দ্বারপাল এবং পাহারাওলার কাজও করে।
সস্তা ভৃত্য, প্রচুর অর্থ। অতএব ফিলিপ ফ্রান্সিসের স্টাইলেই বাস করেন আজকের বড়া সাহেব। মেয়েরা মাদার টেরিজার কাজে অবসর মতো সাহায্য করে বিবেক পরিচ্ছন্ন রাখেন। কোনও কোনও উৎসাহী ব্রিটিশ কাউন্সিলে বাংলা শেখেন। কোনও পাগলা বুড়ো সাহেব হয়তো নিজের পয়সায় বই ছাপিয়ে ভৃত্যকুলের সন্তানদের উপহার দেন, —কমিউনিজম ঠেকাতে হলে একটা কিছু করা চাই বইকি। অন্যরা সুন্দরবনে বাঘের পিছনে, কিংবা মিরাটে বুনো শুয়োর তাড়িয়ে ফেরেন। টালিগঞ্জে গলফ খেলেন, রেসকোর্সে রেস। তদুপরি ভিনটেজ কার র্যালি ইত্যাদিও আছে। এ ছাড়া আছে ‘ইউনাইটেড কিংডম সিটিজেনস অ্যাসোসিয়েশন’। তার কাজ: বিনা শুল্কে পানীয় আনার বন্দোবস্ত, কিংবা ট্যাকস কমানোর জন্য দরবার। রানি এদের ভোলেন না। সাহেব লিখছেন, এই সংঘের সভাপতিরা সাধারণত ‘ও-বি-ই’ হন।
তরুণতর ইংরাজের এসবেও নাকি মোটে মন নেই। তারা রোয়িং ক্লাবে যায়। সেখানেই নাচের আসর জমায়। কখনও কখনও স্টিমারে চড়ে নদীর বুকে হল্লা করে। তখন নদীতে যারা স্নান করে, সেই সব নেটিভদের দেখে সে কী হাসাহাসি। হাসতে হাসতে ‘ক্লিক’ ‘ক্লিক’ ছবি তোলে। মেয়েরা বিকিনি পরে হাসি হাসি মুখে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়ায়, লোকেরা জল থেকে ফ্যালফ্যাল করে তাদের দিকে তাকায়। মধ্য গঙ্গায় অন্য কাহিনী। সাহেব লিখছেন, সেখানে নিজের স্ত্রী ছাড়া আর সকলের সঙ্গে ফস্টিনস্টিতে কোনও বাধা নেই।
সাহেব-মেমদের কাণ্ড দেখে উত্তেজিত হয়ে কোনও লাভ নেই। আগেই বলেছি, সংখ্যায় ওঁরা আজ নামমাত্র। কলকাতার সব কিছু আজ আর তাদের হাতে নয়। অথচ আমরা সবাই জানি, কলকাতা শুধু মস্ত শহর নয়, কলকাতা রীতিমত ধনী শহর। দর্শক মনে করেন, রোম আর টোকিওর মাঝামাঝি এমন ধনাঢ্য শহর কোথায়ও নেই। কলকাতার বন্দর, কারখানা গুদাম, বাজার সবই জমজমাট। কলকাতা ভারতের সব সেরা বাণিজ্যকেন্দ্র, কলকাতা কুবেরের ভাণ্ডার। এ ভাণ্ডার থেকে সাহেবরা এখনও পুরোপুরি হাত উঠিয়ে নেননি বটে, কিন্তু চাবিগুলো অবশ্যই অন্য হাতে।
সাহেব বর্ণনের পরেই অতএব বাঙালির বদলে, সাহেবের নজরে পড়েছে আগে শহরের শ্ৰেষ্ঠীকুল। নাইপল যাদের বলেছেন—‘বক্সওয়ালা’, এ সাহেব আজ সরাসরি তাদের মারোয়াড়ি বলেই সনাক্ত করতে চান। একশো বছর ধরে মারোয়াড়িদের উত্থান কাহিনী শুনিয়েছেন তিনি। এমনকী, ১৯১৭ সালের বিখ্যাত ‘ঘি-স্ক্যান্ডেল’ উপাখ্যানও। সে বিবরণ বাংলার তৎকালীন গভর্নরের রচনা থেকে সংগৃহীত। হঠাৎ রটে গেল, ঘিয়ে নাকি ভেজাল। তদন্ত করে দেখা গেল, ৬৭টি নমুনা টিনের মধ্যে ঘি আছে মাত্র সাতটিতে। একটি টিনে ঘিয়ের পরিমাণ শতকরা মাত্র ৫ ভাগ। তার বদলে টিনে কী ছিল, সেসব কথা উচ্চারণ করাও নাকি পাপ। গোটা শহর পাতক হয়ে গেছে সেই ঘি ব্যবহার করে। সুতরাং হুলুস্থুল কাণ্ড। বেনারস থেকে পণ্ডিতেরা এলেন। পাতি দিলেন প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তিনশো ব্রাহ্মণের উপস্থিতিতে চার-পাঁচ হাজার লোক যোগ দিলেন সেই শুদ্ধি যজ্ঞে। ব্যবসায়ী সমিতি দোষীদের লাখ টাকা করে জরিমানা ধরলেন, ইত্যাদি।
সাহেব, স্পষ্টতই আজকের কলকাতার বাজার-হাট সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নন। প্রথম মহাযুদ্ধের কালের ভেজাল নিয়ে তিনি ভাবিত। হায় রে সেকাল। তখন প্রায়শ্চিত্তের বিধান ছিল অন্তত। একালের কলকাতা জাল ভেজালে ছয়লাপ।
আর একজন সাহেব লিখেছিলেন, কলকাতার সবাই যেন বিক্রেতা। এখানে লোক বিস্তর পরিশ্রম করে সামান্য রোজগারের জন্য, কিন্তু প্রকৃত অর্থে উপার্জন করে যৎসামান্য। এ সাহেব বলেন, এই শহরে সবই বিক্রি হয়। কলকাতার প্রধান কাজ কেনা আর বেচা। বেচা আর কেনা। কেনারাম আর বেচারামদের এই শহরে স্বভাবতই আর একটি বাড়বাড়ন্ত শ্রেণী ‘দালাল’। তিনি লিখেছেন ভারতের মতো আর কোথায়ও মিডলম্যানদের এমন স্ফূর্তি দেখা যায় না।
মারোয়াড়ি বিদ্যালয়, সরবতের মতো মিষ্টি চাকচিক্যময় স্ফটিক মন্দির, ‘বরফ নৃত্যের বন্দোবস্ত’ সবই উল্লেখ করেছেন তিনি। শুনিয়েছেন বিড়লাদের সাফল্য কাহিনীও। এসব নিত্যই আমাদের শুনতে হয়। সুতরাং পুনরাবৃত্তি অবান্তর। তবে বিড়লা পার্কের বাসিন্দাদের একজনের কথা বোধ হয় শোনার মতো। বড়িলা-বাড়ির এক ভদ্রমহিলাকে নাকি বিদেশি একটি বিমান কোম্পানির তরফ থেকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ‘আচ্ছা আপনি প্রধানমন্ত্রী হলে কী করবেন?’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, দেশের লোককে কাজ করতে বাধ্য করতাম।
করিৎকর্মা ব্যবসায়ী এবং তাঁদের কাজ-পাগল অনুচর বা সহচরদের ধনদৌলত, গরিমা মহিমা দেখতে হয় তো চলে এসো সন্ধ্যায় পার্ক স্ট্রিটে। সাহেব বলছেন, সেখানেই নাকি বিজয় পতাকা সহ তাদের শোভাযাত্রা। তিনি অবশ্য মারোয়াড়িদের সম্পর্কেই বেশি আগ্রহী। কিন্তু ‘বক্সওয়ালাদের’ মধ্যে আজ বোধ হয় গুজরাতি পাঞ্জাবি এবং সিন্ধিরাও অবহেলাযযাগ্য নয়। কলকাতা তো বলতে গেলে এই স্বদেশি বৈশ্যকুলেরই হাতে। এদের মধ্যে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে কিছু খালিপদ, বিস্তর নিরামিষাশী, কিন্তু টাকার বেলায় সবাই আস্ত মুদ্রারাক্ষস। আমরা বরং আধুনিকদের কথাই বলি।
বাড়িতে ওঁদের সাপ্তাহিক খরচের মধ্যে আছে প্রতি বোতল ১০ থেকে ১৪ পাউন্ড দরের বিদেশি পানীয়, প্রতি প্যাকেট ১০-১৫ টাকা দরের প্রচুর সিগারেট। অথচ মন খুঁতখুঁত করে রজকের বিল মেটাতে। তবু ক্লাবে অথবা পার্ক স্ট্রিটে সান্ধ্য অভিযান চলবেই। সে অভিযানে শুধু যে অবাঙালিরাই থাকেন তাই নয়, পেশাদার বাঙালিরাও যোগ দেন। একজন সরকারি ডাক্তারের মাইনে মাস বড় জোর পাঁচ হাজার টাকা, কিন্তু ভাল ডাক্তার কলকাতায় চল্লিশ হাজার টাকা নাকি হেসে খেলে রোজগার করেন। ভাল ব্যারিস্টার ছাড়িয়ে গেছেন স্যার ইলাইজা ইম্পেকেও। রোজগারে আসে লাখখানেক টাকা। সুতরাং আবছা মায়াবি আলোয় সুসজ্জিত টেবিল। টেবিল সাইজের মেনু। মাইকে পরদেশি নামওয়ালি স্বদেশি সুন্দরী। এ রূপসা নাকি রাডার-মনা।
ওহ্ কলকাত্তা।
এই কলকাতায় বাঙালি আজ ক্রমেই আরও পিছনে। বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের প্রতিষ্ঠা ১৮৮৫ সালে। সেন, বসু, মিত্র, দত্ত আদি প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে বিশিষ্ট। বিখ্যাত কার টেগোর কোং ছিল ক্যালকাটা চেম্বার্সের সদস্য। কোথায় সেই ঠাকুরেরা? টেলিফোনের বইয়ে অন্তত পঁচিশ জায়গায় টেগোর রয়েছে, তাঁদের মধ্যে স্বনামধন্য মাত্র জনাকয়। রিষড়ার প্রথম জুটমিল সাহেব আর বাঙালির মিলিত কীর্তি। জাহাজি বাঙালি রামদুলাল সরকার আমেরিকানদের টাকা ধার দিতেন তখন।
সেকাল আর নেই। কিন্তু বাঙালি এখনও আছে। এই সেদিন অবধিও শহরের তিন ভাগের দু ভাগ মানুষ কথা বলতেন বাংলায়। ইদানীং গলা যেন ক্রমেই অনুচ্চ। কিন্তু সন্দেহ নেই, বাঙালি এখনও বিশেষভাবে জীবিত। অন্তত আমাদের এই সাহেবের সেরকমই মনে হয়।
কর্নওয়ালিস বলতেন, প্রত্যেকটি নেটিভ দুর্নীতিগ্রস্ত। মার্কিস অব হেস্টিংস নাকি বলতেন, ওরা জান্তব জীবন যাপন করে মাত্র। কেসির অভিমত: অতি চালাক জাত বাঙালি কিন্তু লড়াইয়ে আদৌ মন নেই। সার চার্লস স্টুয়ার্ট বলেছিলেন, যদি সাহেবরা ভারতের আর সব এলাকা থেকে বিতাড়িতও হয়, বাংলা হবে তাদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। কারও সাধ্য নেই, সেখানে তাদের উৎখাত করে।
সাহেব ইতিহাসের কিছু কিছু খবর রাখেন। সুতরাং বলেন, ‘ভুল ভুল। কারও কথা ঠিক নয়।’ বাংলাদেশের লড়াই অবধি অপেক্ষা করেননি তিনি। স্বদেশি যুগের বাঙালি তরুণদের কথা পেড়ে বলেছেন, ফরাসি কাগজ সেদিন তাদের সাহসিকতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর, স্টুয়ার্ট সাহেব যাদের উপর নির্ভর করেছিলেন ইংরাজ বিদায়ে তারাই কিন্তু ছিল প্রথম সারিতে। সাহেব নানাক্ষেত্রে কীর্তিমান অনেক বাঙালির কাহিনীই শুনিয়েছেন। শিল্পে সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক চেতনায়, তাঁর মতে এখনও কলকাতার বাঙালি সকলের আগে। তাঁর মতে ভারত এ পর্যন্ত ‘তিনটি’ নোবেল প্রাইজ পেয়েছে। তিনটিই কলকাতার বাহাদুরি। রবীন্দ্রনাথ, রামন, প্রকারান্তরে ম্যালেরিয়া উৎখাতকারী সাহেব রোনাল্ড রস সবাই এক অর্থে কলকাতাওয়ালা। মাদার টেরিজা তখনও নোবেল প্রাইজ পাননি। তিনি মনে করেন, এখনও ডাবলিনে যত ঔপন্যাসিক আছেন, তার চেয়ে বেশি কবি কলকাতায়। পার্থক্য এই: কলকাতার কবিরা মনের ভাব কালিকলমে তথা কাগজেও ছাপেন। কলকাতার বইপড়া, কলকাতার পুরানো বইয়ের বিস্ময়কর ভাণ্ডার, কিছুই বাদ দেননি তিনি। এমনকী, ইনটেকলেকচুয়ালের সন্ধানে মনে হয়, আনাচে কানাচেও ঘুরেছেন। আজকাল সব বিদেশি দর্শকই চেনা নামের বাইরে নতুন জিনিয়স আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। এ সাহেবও সে চেষ্টা করেছেন। ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এর সেই বিখ্যাত অথচ নাতিদীর্ঘ ফর্দের মতো তিনিও রচনা করেছেন নিজস্ব ফর্দ। বলা নিষ্প্রয়োজন, ওদিকে যেমন মাদার টেরিজা, এদিকে তেমনই যামিনী রায়, সত্যজিৎ রায় আছেনই। তৎসহ আদৌ না-শোনা কিংবা ভাসাভাসা শোনা নানা নাম।
কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেননি তিনি। বোধ হয়, মনে করেছেন, পরচর্চা ঠিক নয়। ফলে এ সাহেব শূন্যে দোদুল্যমান। আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশের সাজানো বাগানগুলো এড়িয়ে গেছেন, কফি হাউসে রাজনীতি চর্চার কথা পেড়েও বলতে চাননি এ ব্যস্ততা কীসের জন্য? এ ব্যাপারে আমার মনে হয়, সত্যের অনেক বেশি কাছাকাছি এসেছিলেন নইপল, কিংবা আমেরিকান সংবাদপত্রের সেই রিপোর্টার। চিন-আক্রমণ প্রসঙ্গে নইপলকে একজন অতি সচ্ছল কোম্পানি সেবায়েত বলেছিলেন,—জানো, আমি ফ্রিডমকে খুবই মূল্যবান মনে করি। তারপর সেই ফ্রিডমের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ধরো, এই ছুটির দিনে গলফ খেলার স্বাধীনতা। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর রিপোর্টার প্রশ্ন তুলেছিলেন ফরাসি সংস্কৃতিমন্ত্রীর বিশেষ সিদ্ধান্তে কলকাতার বুদ্ধিজীবী এত ক্ষুব্ধ কেন? আর কেনই বা এমন উদাসীন আপন শহর সম্পর্কে?’
এসব প্রশ্নের উত্তরও আছে। কিন্তু এ সাহেব তা খুঁজতে চাননি। তিনি আমাদের বাঙালিদের দেখিয়েছেন প্রবাদের সেই বাঙালিকে হাইকোর্ট দেখাবার ভঙ্গিতে। বাঙালির কথা বলার স্টাইল, মুখভঙ্গি, তাদের নাটকীয়তা, রবীন্দ্রসংগীত-প্রীতি, এসবই মুখ্য উপজীব্য। বাঙালির সাহেব দেখিয়ে ফিরবার কায়দাটিও তিনি সানন্দে শুনিয়েছেন। সবই জানা কথা। তবু শোনা যায়। সাহেবও অবশ্য বলেছেন এসব তাঁরও শোনা কথা।
প্রতি দুশো গজ দূরে চেনা কোনও বাঙালিকে পেলেই বন্ধু সাহেবকে পরিচয় করিয়ে দেয়: ইনি ডকটর জন রোসেলি। ইনি হাফ ইতালিয়ান। মাসেকস য়ুনিভার্সিটিতে ইতিহাস পড়ান। বাংলা জানেন। মেঝেয় আসন করে বসতে পারেন। ডান হাতে খান। খিচুড়ি খেয়েছেন, ইলিশ মাছও। অবশ্য কাটা ছাড়াতে এখনও অসুবিধা হয়, ইত্যাদি।
সাহেবের ধারণা: বাঙালির মধ্যে এখনও দিব্যি বেঁচে আছে ইংরাজের স্মৃতি। তিনি দেখে অবাক, এখনও চক্রবর্তী লেখা হয় ৩১ ভাবে, মুখার্জি ১৪ ভাবে, আর চ্যাটার্জি ১১ রকম বানানে।
এত রকমের গহনা অঙ্গে ধারণ করলেও কলকাতার গরিবিয়ানা কিন্তু গোপন করা যায়নি। কিপলিং কথিত সেই কলকাতা এখনও বেঁচে আছে তো বটেই, বরং বৈপরীত্য আরও বেড়েছে। সাহেব অনেক পরিসংখ্যান ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন। সে অরণ্যে প্রবেশ করে লাভ নেই। কে যেন বলেছিলেন, পরিসংখ্যান বিকিনির মতো। যা দেখায় চমৎকার, যা দেখায় না তা তাৎপর্যপূর্ণ। শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে আজ সেসব অঙ্ক। কলকাতায় প্রতি বর্গমাইলে ১০২০১০ জন লোকের বাস। এ শহরের অন্তত তিন ভাগের এক ভাগ লোক বাস করেন বস্তিতে। খাস কলকাতায় ২০ হাজার ঠিকে প্রজা। এ শহরে শতকরা ৬৪ জন নাগরিকের অক্ষরজ্ঞান নেই। লাখ লোক নির্জলা বেকার। ৪২ হাজার খাটা পায়খানা। ফুটপাতে ঘুমোয় ৩০ থেকে ৭০ হাজার মানুষ। কুষ্ঠরোগী ৩০ হাজার, কিংবা ৪০ হাজার। ভিখারি ৬০ হাজার, না ১ লক্ষ? সাহেব লিখছেন: যেখানে ইউরোপিয়ানস সেখানেই ভিখারি। যেন আর এক হামেলিনে আর এক বাঁশিওয়ালা। মাতাল যেভাবে ল্যাম্পপোস্ট ব্যবহার করেন, ঠিক সেভাবে পরিসংখ্যান ধরে ধরে ‘চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা’র দিকে এগিয়ে গেছেন পরদেশি দর্শক। ভিখারিদের নিয়ে ভেবেছেন। ভেবেছেন ‘কাঙালি’ নামক এক একটি ফুটপাত-নিবাসী সম্প্রদায়ের কথা। মিনিটে এক হাতে দশটি সোডার বোতল ছুড়তে পারে কলকাতায় যে প্রসিদ্ধ গুণ্ডা, তার ইতিহাসকে তিনি ঠেলে দিয়েছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের থেকেও বহু পিছনে। কোম্পানির কর্মচারী এবং স্থানীয় জমিদার ও ব্যবসায়ী সকলেরই আশীর্বাদ ছিল এদের উপর। সাহেব মনে করেন তা আজও আছে। রাজনীতিতে তারা সব দলেই আদৃত। কিন্তু হায়, গুণ্ডার রোজগারও মাসে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকার বেশি নয়।
কলকাতার গুণ্ডা, ভিখারি, গৃহস্থ অনেকের পেটেই ক্ষুধা। কে কতখানি ক্যালোরি পাচ্ছে, তা মেপে নাকি বলা হয়, এদেশে শতকরা ৭০ ভাগই অতিশয় দরিদ্র। কলকাতা সেই গরিবদেরও শহর। সাহেব বলেন ‘স্টারভেনান’ শব্দটা তাঁরা নাকি খুবই হালকাভাবে ব্যবহার করেন। একবেলা পেট ভরে খাওয়ার পর দ্বিতীয়বার টেবিলে গিয়ে বসবার আগে অনেক ইংরাজ বলেন ‘আয়্যাম স্টারভিং’, শীতের রাত্তিরে অনেকে আগুন থেকে একটু দূরে পড়ে গেলেও নাকি ‘স্টার্ভিং’ শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু কলকাতায় এ শব্দের অর্থ: শরীর ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া দেহ এমন হাড্ডিসার হয়ে যাওয়া যে, গরমে যখন রাস্তার পিচ গলে তখনও ওদের শরীর আর ঘামে না। মাথার ওপরে আকাশে মাংসাশী পাখি তখন চক্রাকারে ঘোরে। সাহেব বলেন, দারিদ্র্য এখানে দেখা যায়, অনুভব করা যায়, দারিদ্রর গন্ধ নাকে টানা যায়। চিড়িয়াখানার হাতি শুঁড় দিয়ে এখানে মাহুতের জন্য পয়সা তোলে, নিজের জন্য খাদ্য নয়। অথচ মাহুত তবু যা হোক একটা মাইনে পায়।
বিদ্রোহ অতএব স্বাভাবিক। সাহেব মনে করেন: কলকাতা অশ্লীলতার সংজ্ঞা। শত গজ দূরে নর্দমার পাশে ইট সাজিয়ে মাটির হাঁড়িতে আবর্জনা সেদ্ধ হচ্ছে। অদূরে আলোকিত হরফে লেখা বিজ্ঞাপন ‘উপহার হিসাবে এই নরম বিছানার কথা ভেবেছেন কি?’ মানুষ যখন বাদুড়ের মতো বাসে ঝুলছে, বিজ্ঞাপন বলছে ‘ভিসি টেন্ডারনেস’ পরখ করে দেখো। সাহেব বলেন, ক্রোধ এই পরিস্থিতিতে একমাত্র স্বাভাবিক মানবিক প্রতিক্রিয়া। মানুষের এমন পতন আর কোথাও দেখা যায় না।
কলকাতার গরম-মেজাজের কারণ হিসাবে তিনি বলেন: প্রথম কারণ ধনবৈষম্য, দারিদ্র্য এবং প্রাচুর্যের পাশাপাশি অবস্থান এবং তার জের হিসাবে নাগরিকদের অবিশ্বাস্য সব আচরণ। দ্বিতীয়ত, নারী আর পুরুষের অনুপাতে অসাম্য। ১৯৬১ সালে এই শহরে প্রতি হাজার পুরুষের ভিড়ে ৬১২ জন মাত্র নারী। সাহেব ট্রাম বাসে ড্রাইভারের মাথা বাঁচানোর জন্য তারের জালের ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। পুলিশের ঢাল বারান্দায় কণ্টকশয্যা, অমসৃণ দেওয়াল ইত্যাদি আরও হরেক আয়োজন তাঁর চোখে পড়েনি। বর্ধমান ‘লাল-আলোর বৃত্ত’ তথা কলকাতার আমোদপুরীও তিনি এড়িয়ে গেছেন। এড়িয়ে গেছেন নামমাত্র মূল্যে লভ্য পথে পথে ভ্রাম্যমাণ প্রমোদ-কন্যাদের কথাও। একজন ফরাসি দর্শক ‘ভারতে জনৈক বর্বর’ নামে এক বইয়ে লিখেছিলেন: রাত্রে চৌরঙ্গির পথে ফিস ফিস ভাষায় মেয়ে ফিরি হয়। যার যা ইচ্ছে। দর যাচ্ছে যথেষ্ট সস্তা।
এও গরিবানারই বিবরণ বোধ হয়। এ সাহেব বলছেন অনিবার্য অতএব বিস্ফোরণ। শেষের সে ভয়ংকর দিনের বিবরণও শুনিয়েছেন তিনি। হঠাৎ একদিন কলকাতা মরে যাবে। প্লেগ কিংবা অন্য কোনও মহামারি। যারা বেঁচে থাকবে, তারা মশাল হাতে পথে নামবে। কলকাতা দেখতে দেখতে ছাই হয়ে যাবে। অনেকদিন কোনও খবর পাওয়া যাবে না এ শহরের।
অথবা হঠাৎ একদিন কলকাতার গরিবেরা খেপে যাবে। রিকশওয়ালা ঘণ্টির বাদ্যে তাদের ইশারা করবে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে। কারও নিস্তার নেই। মশাল, আগুন, লুঠ, খুন ইত্যাদি। এ রোমান্টিকতা হয়তো সাহেব আমাদেরই কোনও বাঙালি বিদ্রোহীর কাছে পেয়ে থাকবেন। কেননা, তাঁর নিজের বিবরণ কিন্তু অন্য চিত্রই উপস্থিত করে আমাদের সামনে।
বিপ্লবের পথ গেছে বেজিং-সাংহাই-কলকাতা হয়ে। সাহেব বলেন লেনিনের নামে চললেও এ উক্তি লেনিনের নয়। কলকাতায় ‘বিপ্লব’ তিনি নিজেও খুঁজেছেন কিন্তু দেখা পেয়েছেন কি? টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্টের পাঠক প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতার কথা আছে, তাঁর বিবরণে আছে ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাবান সাম্যবাদী নায়কের কথাও। সে প্রসঙ্গ এখানে মুলতুবি রাখাই ভাল, কিন্তু সেই ধনাঢ্য, অতিথিপরায়ণ সাম্যবাদী যিনি অতি র্যাডিক্যাল, সর্ব মহলে যাঁর অবাধ গতি বোধ হয় ব্যঙ্গই করতে চেয়েছেন তাঁকেও পরদেশি এই দর্শক। তবে?
সি এম ডি এ-র সাহসিকতাকে প্রশংসা করেছেন সাহেব। ওঁরা নাকি বড় গাড়ির বদলে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কাছে ছোট গাড়ি চেয়েছেন চলাফেরার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জানাচ্ছেন, পরদেশিরা যে হঠাৎ কলকাতা সম্পর্কে এমন উৎসাহী হয়ে উঠল, তার পিছনে নাকি একটা বিশেষ কারণ আছে। ইদানীং শহর বিশেষ মরছে না। সুতরাং কলকাতা মৃত্যুশয্যায়, এ সংবাদ শোনা মাত্র ভিড় জমালেন অন্য দেশের নগর পরিকল্পনাকারী। কীভাবে শহর অসুস্থ হয়, কেন শহর মরে, এসব স্বচক্ষে দেখা আসা দরকার। কেননা, পশ্চিমেও রয়েছে বিস্তর সমস্যাপীড়িত শহর। শিকাগোতে নিশ্চয়ই কলকাতার চেয়ে বেশি মানুষ খুন হয়, কলকাতার চেয়ে অনেক বেশি ছিনতাই রাহাজানি হয় দিল্লি কিংবা নিউইয়র্কে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী পুরুষময় এই মহানগরে কিন্তু যৌন অপরাধ অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় নামেমাত্র। সুতরাং অসুস্থ কলকাতাকে বাঁচাতে এসে আসলে নাকি নিজেদের ব্যাধিগুলোই বুঝবার চেষ্টা করছেন। চেষ্টা করছেন, শহর বাঁচাবার ওষুধগুলো পরখ করে দেখতে।
তা দেখুন ওঁরা। সেই সূত্রে ছিঁটেফোটা যদি কিছু কলকাতার মুখে পড়ে মন্দ কী? উপস্থিত অবশ্য পরিস্থিতি অন্যরকম। কাজকর্ম অবশ্যই কিছু হচ্ছে। ফুটপাত ছোট হচ্ছে, অর্থাৎ রাস্তা প্রশস্ততর, আলোকিত এলাকায় ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে, অর্থাৎ অন্ধকার এলাকা আরও অন্ধকারে। কলকাতায় এটাই চিরকালের রীতি। সাতান্নর মহাবিদ্রোহের পরে পরে কলকাতায় যখন গ্যাসের বাতি জ্বলল, ব্ল্যাক-টাউন তথা বাঙালিটোলা-নিবাসী গিরিশচন্দ্র ঘোষ তখন লিখেছিলেন এক একটা আলো সতেরোটি মোমবাতির সমান। তার অর্থ: আমরা আরও অন্ধকারে নিমজ্জিত হলাম। কলকাতা গরিবের পক্ষে ক্রমেই আরও ধনী হয়ে উঠছে, লিখেছিলেন তিনি। তবু এখন কিছু হচ্ছে। শহরের শারীরিক অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা বলা যায় আন্তরিক, কিন্তু মানসিক অবস্থা? সাহেব লিখেছেন গির্জায় কলকাতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ ধর্মতত্ত্ব আলোচনা হচ্ছিল। বেশ কয়েক মিনিট মন দিয়ে শুনেছেন তিনি। কিন্তু ‘কলকাতা’ শব্দটি একবারও কানে ঠেকল না। আর একদিন ব্রিটিশ কাউন্সিলের বিতর্ক সভায়। সেখানে আলোচ্য বিষয়: সমাজ থেকে ভদ্রলোকদের বিলুপ্তি। ‘হাউস অব লর্ডসে’ এখনও খই ফোটে মুখে মুখে সার্ত্র, মার্ক্স, ত্রুফো, গদার ইত্যাদি আরও কত কী। ‘হাউস অব লর্ডস’, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনুর কফি হাউসের উচ্চতর কক্ষ। ওই ঘরটিতে কফির দাম কিঞ্চিৎ বেশি।
সুতরাং, পার্ক স্ট্রিটের বিলাসী রেস্তোরাঁয় এখনও তেমনই ভিড়। সুন্দরী অভিনেত্রীর সঙ্গে এক ঘরে এক টেবিলেও নয়, ডিনার খেতে একশো টাকার নোট ফস ফস বেরিয়ে আসে পকেট থেকে, আসন পাওয়া নাকি সৌভাগ্যের ব্যাপার। থেকে থেকে খুশির উচ্ছ্বাস। ‘ওহ কলকাত্তা!’ মনে হয় ফরাসি বাক্যের বিকৃত উচ্চারণের ফল এই শব্দ দুটির মানেও আজ জেনে গেছেন আমুদেরা, ‘ওহ্ ক্যালকাটা’ মানে ‘আহা, কী সুন্দর নিতম্ব তোমার।’